প্রথম খণ্ড
প্রথম অধ্যায়
জ্ঞাতব্য বিষয়
ছুন্নাহ বা হাদীছঃ
রছুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম তাঁহার নবী জীবনে যাহা বলিয়াছেন, করিয়াছেন বা অন্যের কোন কথা বা কার্যের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করিয়াছেন তাহাকে ‘ছুন্নাহ’ [ফেকাহ শাস্ত্রে ছুন্নত বলিতে –ফরয ওয়াজেব ব্যতীত এবাদতরূপে যাহা করা হয় তাহাকে বুঝায়, যথা ছুন্নত নামাজ। অপর অর্থ হইলঃ দ্বীন বা শরীয়তের সুপ্রচলিত বা মনোনিত পন্থা।] বলে। ইহার অপর নাম ‘হাদীছ’। হাদীছ ব্যাপক অর্থে ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের কথা, কার্য ও সম্মতিকেও ‘আছার’ বলে।
ছুন্নাহ বা হাদীছের উৎসঃ
হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (ছঃ) আল্লাহর নবী ও রছূল ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মানুষও ছিলেন; সুতরাং তাঁহার নবী জীবনের কার্যাবলীকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়ঃ (ক) যাহা তিনি নবী ও রছুল পদের দায়িত্ব সম্পাদন উপলক্ষে করিয়াছেন এবং (খ) যাহা তিনি অপর মানুষের ন্যায় মানুষ হিসাবে করিয়াছেন যথা- খাওয়া, পরা ইত্যাদি। প্রথম শ্রেণীর কার্যবলী সমস্তই খোদায়ী নিয়ন্ত্রণাধীনে সম্পাদিত হইয়াছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর কার্যাবলী অবশ্য এইরূপ নহে।
শাহ ওলীউল্রাহ দেহলবী (রঃ) বলেনঃ রছুলুল্লাহর হাদীছ প্রধানতঃ দুই প্রকারের।
প্রথম প্রকার- যাহাতে তাঁহার নবুওত ও রেছালতের হাদীছ (নবী ও রছূল পদের) দায়িত্ব সম্পর্কীয় বিষয়সমূহ রহিয়াছে। নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ ইহার অন্তর্গতঃ
(১) যাহাতে –পরকাল বা ঊর্ধ্ব জগতের কোন বিষয় রহিয়াছে। ইহার উৎস ওহী।
(২) যাহাতে –এবাদত ও বিভিন্ন স্তরের সমাজ ব্যবস্থার নিয়ম-শৃঙখলার বিষয় রহিয়াছে। ইহার কোনটির উৎস ওহী আর কোনটির উৎস স্বয়ং রছুলুল্লাহর ইজতেহাদ। কিন্তু রছুলুল্রাহর ইজতেহাদও ওহীর সমপর্যায়। কেননা, আল্লাহ তা’আলা তাহাকে শরীয়ত সম্পর্কে কোন ভুল সিদ্ধান্তের উপর অবস্থান করা হইতে রক্ষা করিয়াছেন।
(৩) যাহাতে –এমন সকল জনকল্যাণকর বাণী ও নীতি-কথাসমূহ রহিয়াছে, যে সকলের জন্য কোন সীমা বা সময় নির্ধারিত করা হয় নাই। (অর্থাৎ, যাহা সার্বজনীন ও সর্বকালীন) যথা- আখলাক বা চরিত্র বিষয়ক কথা। ইহার উৎস সাধারণতঃ তাঁহার ইজতেহাদ।
(৪) যাহাতে –কোন আমল বা কার্য অথবা কার্যকারকের ফজীলত বা মর্যাদার কথা রহিয়াছে। ইহার কোনটির উৎস ওহী আর কোনটির উৎস তাঁহার ইজতেহাদ।
দ্বিতীয় প্রকার –যাহাতে –তাঁহার নবুওত ও রেছালাতের দায়িত্ব অন্তর্গত নহে, এরূপ বিষয়াবলী রহিয়াছে। নিম্নলিখিত বিষয়াবলী ইহার অন্তর্গতঃ
(১) যাহাতে –চাষাবাদ জাতীয় কোন কথা রহিয়াছে। যথা –তা’বীরে নখলের কথা। [মদীনার লোকেরা অধিক ফলনের জন্য নর খেজুর গাছের শীষ লইয়অ যাদা খেজুর গাছের সহিত লাগাইয়া দিন। একদা রছূলুল্লাহ (ছঃ) বলিলেনঃ ‘তোমরা ইহা না করিলেও পার’। ইহাতে ছাহাবীগণ এইরূপ করা বন্ধ করিয়া দিলেন। ফলে সে বৎসর ফলন কম হইল। ইহা দেখিয়া হুজুর বলিলেনঃ ‘আমি ধারণা করিয়াছিলাম যে, এইরূপ না করিলেও চলে। এইরূপ ধারণাপ্রসূত কথায় তোমরা আমায় দোষারোপ করিও না। ( কেননা, আমি আল্লাহর প্রতি কখনও অসত্য আরোপ করি না।]
(২) যাহাতে –চিকিৎসা বিষয়ক কোন কথা রহিয়াছে।
(৩) যাহাতে –কোন বস্তু বা জন্তুর গুণাগুণের কথা রহিয়াছে। (যথা –‘ঘোড়া কিনিতে গাড় করাল রং ও সাদা কপাল দেখিয়া কিনিবে’।_
(৪) যাহাতে –এমন সকল কাজের কথা রহিয়াছে, যে সকল কাজ তিনি এবাদতরূপে নহে, বরং অভ্যাসবশতঃ অথবা সংকল্প ব্যতিরেকে ঘটনাক্রমে করিয়াছেন।
(৫) যাহাতে –আরবদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনীসমূহের মধ্যে তাঁহার কোন কাহিনী বর্ণনার কথা রহিয়অছে। যথা –উম্মেজারা ও খোরাফার কাহিনী।
(৬) যাহাতে –সার্বজনীন, সর্বকালীন নহে বরং সমকালীন কোন বিশেষ মোছলেহাতের কথা রহিয়াছে। যথা –সৈন্য পরিচালন কৌশল।
(৭) যাহাতে –তাঁহার কোন বিশেষ ফয়ছালা বা বিচার-সিদ্ধান্তের কথা রহিয়াছে।
এ সকলের মধ্যে কোনটির উৎস তাঁহার অভিজ্ঞতা, কোনটির উৎস ধারণা, কোনটির উৎস আদত-অভ্যাস, কোনাটির উৎস দেশ-প্রথা আর কোনটির উৎস সাক্ষ্য প্রমাণ। (যথা –বিচার-সিদ্ধান্ত।)
প্রথম প্রকার ছুন্নাহর অনুসরণ করিতে আমরা বাধ্য (ইহার বিস্তারিত বিবরণ দ্বিথীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য।) এবং দ্বিতীয় প্রকার ছুন্নার মধ্যে যাহা তাঁহার ইচ্ছাকৃত অভ্যাসপ্রসূত বা যাহাকে তিনি পছন্দ করিতেন তাহাও আমাদের অনুকরণীয়।
ওহীর শ্রেণী ও হাদীছঃ
আল্লাহ তা’ আলা তাঁহার রছূলের প্রতি যে সকল ওহী নাজিল করিয়াছেন তাহা দুই শ্রেণীর প্রথম শ্রেণীর ওহীঃ যাহা – যে যে শব্দ বা বাক্যের সহিত নাজিল করা হইয়াছে তাহা হুবহু বহাল রাখাতে রছূলুল্লাহু আলাইহ ওয়াছাল্লাম বাধ্য ছিলেন। কোনআন পাক এই শ্রেণীর ওহী। ইহাকে ‘ওহীয়ে মাতলূ বলে। নামাজে কেবল ইহারই তেলাওত (আবৃত্তি) করা যায়। দ্বিতীয় শ্রেণীর ওহীর শব্দ বা বাক্য অবিকল বজায় রাখাতে রছূলুল্লাহ (ছ) বাধ্য ছিলেন না। ওহী দ্বারা প্রাপ্ত মূল ভাবটিকে তাঁহার নিজস্ব ভাষায় প্রকাশ করার অধিকার তাঁহাকে দেওয় হইয়ছিল। ইহাকে ‘ওহীয়ে গায়র মাতল বলে। ইহা নামাজে পড়া যায় না। যে যে হাদীছ ওহী- প্রসূত তাহা এই দ্বিতীয় শ্রেণীরই ওহী-প্রসূত। হাদীছকে যে ‘ওহীয়েয গায়ের মাতলূ’ বলা হয়, ইহই তাহার অর্থ।
হাদীছ শাস্ত্রের কতিপয় পরিভাষা
ছাহবী-যে ব্যাক্তি ঈমানের সহিত-
(ক) রছূলল্লাহ (ছঃ)-এর সাহচর্য লাভ করিয়াছেন বা
(খ) তাঁহাকে দেখিয়াছেন ও তাঁহার একটি হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন অথবা
(গ) একবার তাঁহাকে দেখিয়াছে- এবং ঈমানের সহিত মৃত্যুবরণ করিয়াছেন, তাঁহাকে ‘ছাহাবী’ বলে।
তাবেয়ী- যিনি কোন ছাহাবীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন অথবা অন্ততঃপক্ষে তাঁহাকে দেখিয়াছেন, তাঁহাকে ‘তাবেয়ী’ বলে।
তাবে’ তাবেয়ী- যিনি কোন তাবেয়ীর নিকট হাদীছ শিক্ষা করিয়াছেন অথবা তাঁহাকে দেখিয়াছেন, তাঁহাকে ‘তাবে’-তাবেয়ী’ বলে।
রেওয়ায়ত- হাদীছ বা আছার বর্ণনা করাকে ‘রেওয়ায়ত’ বলে এবং যিনি বর্ণনা করেন তাঁহাকে ‘রাবী’ বলে।
কোন কোন সময় ‘হাদীছ’ বা ‘আছার’কেও রেওয়ায়ত বলে। যেমন বলা হয়ঃ এ সম্পর্কে একটি রেওয়ায়ত আছে।
ছনদ – হাদীছের রাবী পরম্পরাকে ‘ছনদ’ বলে। কোন হাদীছের ছনদ বর্ণনা করাকে ‘ইছনাদ’ বলে। কখনো কখনো ‘ইছনাদ’ ‘ছনদের’ অর্থও ব্যবহৃত হইয়া থাকে।
রেজাল- হাদীছের ‘রাবী; সমষ্টকে ‘রেজাল বলে। আর যে শাস্ত্রে রাবীদের জীবনী বর্ণনা করা হইয়াছে তাহাকে ‘এলমে আছমাউর রেজাল’ বলে।
মতন- ছনদ বর্ণনা করার পর যে মূল হাদীছটি বর্ণনা করা হয় তাহাকে ‘মতন’ বলে।
আদালত- যে সুদৃঢ় শক্তি মানুষকে ‘তাকওয়া’ ও ‘মরুওত’ অবলম্বন করিতে (এবং মিথ্যা আচরণ হইতে বিরত থাকেতে) উদ্বুদ্ধ করে, তাহাকে ‘আদালত’ বলে। ‘তাকওয়া’ অর্থে এখানে শিরক, বেদআত ও ফেছক প্রভৃতি কবীরাহ গুনাহ এবং পুনঃ পুনঃ ছগীরা গোনাহ করা হইতে বাঁচিয়া থাকাকে বুঝায়। ‘মরুওত’ অর্থে অশোভন বা অভদ্রোচিত কার্য হইতে দূরে থাকাকে বুঝায়,
যদিও ‘মোবাহ’ হয়। যথা-হাটে- বাজারে প্রকাশ্যে পানাহার করা বা রাস্তা-ঘাটে প্রসাব করা ইত্যাদি। এরূপ কার্য করেন এমন ব্যক্তির বর্ণিত হাদীছ ছহীহ নহে।
আদল বা আদেল- যে ব্যক্তি ‘আদালত’ গুণসম্পন্ন তাঁহাকে ‘আদল’ বা ‘আদেল’ বলে। [অর্থাৎ, যিনি (১) রছুলুল্লাহর হাদীছ সম্পর্কে কখনো মিথ্যা কথা বলেন নাই, (২) বা সাধারণ কাজ-কারবারে কখনো মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হন নাই, (৩) অজাতনামা অপরিচিত অর্থাৎ, দোষ-গুণ বিচারের জন্য যাহার জীবনী জানা যায় নাই এরূপ লোকও নহেন, (৪) বে-আমল ফাছেকও নহেন, (৫) অথবা বদ-এ’তেকাদ বেদআতীও নহেন, তাঁহাকে ‘আদল’ বলে।]
জবত- যে শক্তি দ্বারা মানুষ শ্রুত বা লিখিত বিষয়কে বিস্মৃতি বা বিনাশ হইতে রক্ষা করিতে পারে এবং যখন ইচ্ছা তখন উহাকে সঠিকভাবে স্মরণ করিতে পারে তাহাকে ‘জবত’ বলে।
জাবেত- ‘জাবেত’ গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে ‘জাবেত’ বলে।
ছেকাহ- যে ব্যক্তির মধ্যে ‘আদালত’ ও ‘জবত’ উভয় গুণ পূর্ণভাবে বিদ্যমান, তাঁহাকে ‘ছেকাহ’ ‘ছাবেত’ বা ‘ছাবাত’ বলে।
শায়খ- হাদীছ শিক্ষাদাতা রাবীকে তাঁহার শাগরেদের তুলনায় ‘শায়খ’ বলা হইয়া থাকে।
মোহাদ্দেছ- যে ব্যক্তি হাদীছ চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যাক হাদীছের ছনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাঁহাকে ‘মোহাদ্দেছ’ বলে।
হাফেজ, হুজ্জাত ও হাকেম- (ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের যুগের পর) যিনি ছনদ ও মতনের সমস্ত বৃত্তান্তসহ এক লক্ষ হাদীছ আয়ত্ত করিয়াছেন তাঁহাকে ‘হাফেজ’ (হাফেজে হাদীছ) বলে। এইরূপে যিনি তিন লক্ষ হাদীছ আয়ত্ত করিয়াছেন তাঁহাকে ‘হুজ্জাত’ আর যিনি সমস্ত হাদীছ আয়ত্ত করিয়াছেন তাঁহাকে ‘হাকেম’ বলে।
এযাবৎ দুনিয়ায় কত ‘হাফেজে হাদীছ’ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন তাহার সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন। হাফেজ জাহবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ) তাঁহার ‘তাজকেরাতুল হোফফাজ’ নামক কিতাবে ১১ শতকেরও অধিক হফেজের জীবনী লিখিয়াছেন। ‘হুজ্জাত’গণের সংখ্যাও অনেক। তাঁহার বহু হুজ্জাতের জীবনী রহিয়াছেন। ‘হাকেম’দের সংখ্যাও কম নহে। হাদীছের হেফাজতের জন্য এসকল লোকের সৃষ্টি মুসলিম জাতির প্রতি সত্যই আল্লাহর এক বিরাট দান বলিতে হইবে।
শায়খাইন_ইমাম বোখারী ও মোছলেমকে এক সঙ্গে ‘শায়খাইন’ বলে। কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে ‘শায়খাইন’ বলিতে ইমাম আবু হানীফা এ ইমাম আবু ইউছুফকে বুঝায়।
ছেহাহ ছেত্তা¬¬¬_বোখারী শরীফ, আবু দাউদ শরীফ,তিরমিজী শরীফ, নাছায়ী শরীফ ও ইবনে মাজাহ-হাদীছের এই ছয়খানি কিতাবকে এক সঙ্গে ‘ছেহাহ ছেত্ত’ বলে, ইহাই প্রসিদ্ধ। কিন্তু বিশিষ্ট আলেমগণ ‘ইবনে মাজাহ’-এর স্থলে ‘মোআত্ত ইমাম মালেক আবার কেহ কেন ‘ছনানে দারেমী’কেই ‘ছেহাহ ‘ছেত্তার’ অপর চারি কিতাব (আবু দাউদ, তিরমিজী, নাছায়ী ও ইবনে মাজাহ)- কে এক সঙ্গে ‘ছুনানে আরবাআ বলে।
মোত্তফাক আলাইহে_ যে হাদীছকে একই ছাহাবী হইতে ইমাম বোখারী ও মোছলেম ইভয়ে গ্রহণ করিয়ছেন তাহাকে হাদীছে ‘মোত্তফাক আলাইহে’ (বা ঐক্যসম্মত হাদীছ) বলে।
হাদীছ শ্রেণীবিভাগ
হাদীছসমূহকে বাছাই করিতে যাইয়া আমাদের মোহদ্দেছগণ উহাদিগকে নিম্নলিলিত শ্রণী- সমূহে ভাগ করিয়াছেনঃ
হাদীছ প্রথমতঃ তিন প্রকারেরঃ কাওলী, ফে‘লী ও তাকরিরী। কথা জাতীয় হাদীছকে কাওলী কার্য বিবরণ সম্বলিত হাদীছকে ফে’লী এবং সম্মতিসূচক হাদীছকে তাকরিরী হাদীছ বলে। তিন প্রকারের হাদীছেরই নিম্নরূপ শ্রেণীবিভাগ রহিয়াছেঃ
(ক)
মারফু- যে হাদীছের ছনাদ রছূলুল্লাহ (ছঃ) পযর্ন্ত পৌছিয়াছে অর্থাৎ, যাহয স্বয়ং রছূলুল্লাহর হাদীছ বলিয়াই সাব্যস্ত হইয়াছে তাহাকে ‘হাদীছে মারফু বলে।
মাওকূফ_ যে হাদীছের ছনদ কোন ছাহাবী পযর্ন্ত পৌছিয়াছে অর্থাৎ, যাহা স্বয়ং ছাহাবীর হাদীছ বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে তাহাকে ‘হাদীছে মাওকুফ’ বলে। ইহার অপর নাম ‘আছার’।
মাকতু- যে হাদীছের ছনদ কোন তাবেয়ী পযর্ন্ত পৌছিয়াছে অর্থাৎ, যাহা স্বয়ং তাবেয়ীর হাদীছ বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে তাহাকে ‘হাদীছে মাকতু’ বলে।
[ অনেকে ‘মাওকূফ’ ও মাকতূ ‘কে ‘হাদীছ’ না বলিয়া ‘আছার’ই বলিয়া থাকেন। আবার কখনো কখনো ‘আছার’ অর্থে রছূলুল্লাহ (ছঃ)-এর হাদীছকেও বুঝায়।– মোকাদ্দমায়ে ইবনুছছালাহ।]
(খ)
মোত্তছিল- যে হাদীছের ছনদের মধ্যে কোন স্তরে কোন রাবী বাদ পড়েন নাই অর্থৎ, সকল স্তরের সকল রাবীর নামই যথাস্থানে উল্লেখ রহিয়াছে তাহাকে ‘হাদীছে মোত্তছিল’ বলে। আর এ বাদ না পড়াকে বলা হয় ইত্তেছাল।
মোনকাতে- যে হাদীছের ছনদের মধ্যে কোন স্তরে কোন রাবীর নাম বাদ পড়িয়াছে তাহাকে ‘হাদীছে মোনকাতে’ বলে। আর এ বাদ পড়লে বলা হয় ‘এনকেতা’। এ হাদীছ প্রধানতঃ দুই প্রকারঃ ‘মোরছাল’ ও মোআল্লাক’।
মোরছাল- যে হাদীছের ছনদেরে ‘এনকেতা’ শেষের দিকে হইয়াছে অর্থাৎ ছাহাবীর নামই বাদ পড়িয়াছে এবং স্বয়ং তাবেয়ী রছূলুল্লাহ (ছঃ)- এর নাম করিয়া হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন তাহাকে ‘হাদীছে মোরছাল’ বলে। ইমামগণের মধ্যে কেবল ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালেকই (রঃ) ইহাকে বিনা শর্তে গ্রহণ করিয়াছেন তাহাদের মতে তাবেয়ী শুধু তখনই ছাহাবার নাম বাদ দিয়া সরাসরি রছূলুল্লাহর নামে হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন যখন ইহা তাহার নিকট নিঃসন্দেহে রছূলুল্লাহর হাদীছ বলিয়য় সাব্যস্ত হইয়াছে।
মোআল্লাক- যে হাদীছের ছনদ ‘এনকেতা’ প্রথম দিকে হইয়াছে অর্থাৎ, ছাহাবীর পর এক বা একাধিক নাম বাদ পড়িয়াছে তাহাকে ‘মোআল্লাকে’ বলে। ইহা গ্রহণযোগ্য নহে।
[‘মোরছাল’ ও ‘মোআল্লাক’ মোনকাতে ‘রই যে দুইটি রকম বিশেষ তাহা পূর্বই বলা হইয়াছে। ইহা ছাড়াও ‘মোনকতে ‘র বহু রকম রহিয়াছে। সগুলির বর্ণনা এখনে সম্ভবপর নহেঅ}
কোন কোন গ্রন্হকার কোন কোন হাদীছের পূর্ণ ছনদকে বাদ দিয়া কেবল মূল হাদীছকেই বর্ণনা করিয়াছেন। এরূপ করাকে ‘তা লীক’ বলে। কখনো কখনো তা’ লীকরূপে বর্ণিত হাদীছকেও ‘তা’লীক বলে। ইমাম বোখারীর (রঃ) কিতাবে এরূপ বহু ‘তা’লীক রহিয়াছে। কিন্তু অসুন্ধানে দেখা গিয়াছে যে, বোখারীর সমস্ত তা’ লীকেরই মোত্তাছিল ছনদ রহিয়াছে। অপর সংকলনকারীগণ এই সমস্ত তা’ লীক মোত্তাছিল ছনদ সহকারে বর্ণনা করিয়াছেন।
মোদাল্লাছ- যে হাদীছের রাবী নিজের প্রকৃত শায়খের (উস্তাদের) নাম না করিয়া তাঁহার উপরস্থ শায়খর নাম এভাবে হাদীছ বর্ণনা করিয়াছেন যাহাতে মনে হয় যে, তিনি নিজেই উহা উপরস্ত শায়খের নিকট শুনিয়াছেন অথচ তিনি নিজে উহা তাঁহার নিকট শুনেন নাই (বরং তাঁহার প্রকৃত ওস্তাদই উহা তাঁহার নিকট শুনিয়াছেন)- সে হাদীছকে ‘হাদীছ মোদাল্লাছ’ বলে। মোদাল্লেছের হাদীছ গ্রহণযোগ্য নহে- যে পযর্ন্ত না একথা নিশ্চতরূপে জানা যায় যে, তিনি একমাত্র ছেকাহ রাবী হইতে তাদলীছ করেন অথবা তিনি উহা আপন শায়েখের নিকট শনিয়াছেন বলিয়া পরিস্কারভাবে বলিয়া দেন।
মোজতারাব-যে হাদীছের রাবী হাদীছের মতন বা ছনদকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকারে গোলমাল করিয়া বর্ণনা করিয়াছেন – সে হাদীছকে ‘হাদীছ মোজতারাব’ বলে।
যে পযর্ন্ত না ইহার কোনরূপ সমম্বয় সাধান সম্ভবপর হয়, সে পযর্ন্ত ইহা সম্পর্কে তাওয়াককুফ (অপেক্ষা) করিতে হইবে। (অর্থাৎ, ইহাকে প্রমাণে ব্যবহার করা চলিবে না।)
মোদরাজ- যে হাদীছের মধ্যে রাবী তাঁহার নিজের অথবা অপর কাহারো উক্তি প্রক্ষেপ করিয়াছেন-সে হাদীছকে ‘হাদীছে মোদরাজ’ (প্রক্ষিপ্ত) বলে এবং এইরূপে করাকে ‘ইদরাজ বলে। ইদরাজ হারাম- অবশ্য যদি উহা কোন শব্দ বা বাক্যের অর্থ প্রকাশার্থে হয় এবং মোদরাজ বলিয়া সহজে বঝা যায়, তাব দূষণীয় নহে।
(গ)
মোছনাদ_ যে মারফূ’ হাদীছের, কাহারো মতে- যে কোন রকমের হাদীছের ছনদ সম্পূর্ণ মোত্তাছিল- সে হাদীছকে ‘হাদীছে মোছনাদ বলে। (ইহার অপর অর্থ অপর স্থানে বলা হইবে।)
(ঘ)
মাহফুজ ও শাজ- কোন ছেকাহ রাবীর হাদীছ অপর কোন ছেকাহ রাবী বা রাবীগণের হাদীছ এর বিরোধী হইলে, যে হাদীছের রাবীর ‘জবত’ গুণ অধিক বা অপর কোন সূত্র দ্বারা যাহার হাদীছের সমর্থন পাওয়া যায় অথবা যাহার হাদীছের শ্রেষ্ঠত্ব অপর কোন কারণে প্রতিপাদিত হয় তাঁহার হাদীছটিকে ‘হাদীছে মাহফুজ’ এবং অপর রাবীর হাদীছটিকে ‘হাদীছ শাজ’ বলে এবং এইরূপ হওয়াকে ‘শজুজ” বলে। হাদীছের পক্ষে শজুজ একটি মারাত্মক দোষ। শাজ হাদীছ ‘ছহীহ রূপে গণ্য নহে।
মা ‘রূফ ও মোনকার- কোন জঈফ রাবীর হাদীছ অপর কোন জঈফ রাবীর হাদীছের বিরোধী হইলে অপেক্ষাকৃত কম জঈফ রাবীর হাদীসটিকে ‘হাদীছে মা ‘রূফ’ এবং অপর রাবীর হাদীছটিকে ‘হাদীছে মোনকার’ বলে এবং এইরূপ হওয়াকে ‘নাকারাৎ’ বলে। নারাকাৎ হাদীছের পক্ষে একটা বড় দোষ।
মোআল্লাল-যে হাদীছের ছনদ এমন কোন সূক্ষ্ম ক্রটি রহিয়াছে যাহাকে কোন বড় হাদীছ বিশেষজ্ঞ ব্যতীত ধরিতে পারেন না, সে হাদীছকে ‘হাদীছে মোআল্লাল হাদীছ ‘ছহীহ’ হইতে পারে না।
(ঙ)
মোতাবে’ও শাহেদ- এক রাবীর হাদীছের অনুরূপ যদি অপর রাবীর কোন হাদীছ পাওয়া যায়, তাহা হইলে এই দ্বিতীয় রাবীর হাদীছটিকে প্রথম রাবীর হাদীছটির মোতাবে’ বলে- যদি উভয় হাদীছের মূল রাবী (অর্থাৎ, ছাহাবী) একই ব্যক্তি হন। আর এইরূপ হওয়াকে ‘মোতাবা’ আত’ বলে। যদি মূল রাবী একই ব্যক্তি না হয়, তবে দ্বিতীয় ব্যক্তির হাদীছটিকে প্রথম ব্যক্তির হাদীছের ‘শাহেদ’ বলে। আর এইরূ হওয়াকে ‘শাহাদাত’ বলে। মোতাবা’আত ও শাহাদত দ্বারা প্রথম হাদীছটির শক্তি বা প্রামণ্যতা বৃদ্ধি পায়।
(চ)
ছহীহ- যে মোত্তছিল হাদীছের ছনদের প্রত্যেক রাবীই পূর্ণ ‘আদালত’ ও ‘জবত’ গুণসম্পন্ন এবং হাদীছটি ‘শজুজ’ ও ‘ইল্লত’ দোষমুক্ত- সে হাদীছকে ‘হাদীছে ছহীহ বলে।
[অর্থাৎ, যে হাদীছটি ‘মোনকাতে’ নহে; ‘মো’দাল’ নহে, ‘মোআল্লাক’ নহে, মোদাল্লাছ’ নহে, কাহারো কাহারো মতে ‘মোরছাল’ও নহে; ‘মোবহাম’ অথবা প্রসিদ্ধ জঈফ রাবীর হাদীছ নহে; স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার দবুন অনেক ভুল করেন এমন ‘মোগাফফাল’ রাবীর হাদীছ নহে এবং হাদীছটি ‘শাজ’ ও ‘মোআল্লাল’ও নহে- একমাত্র সে হাদীছকেই ‘হাদীছে ছহীহ’ বলে।]
হাছান-যে হাদীছের রাবীর ‘জবত’ গুণে পরিপুর্ণতার অভাব রহিয়াছে- সে হাদীছকে ‘হাদীছে হাছান বলে।
[ফকীহগণ সাধারণতঃ এই দুই প্রকার হাদীছ হইতেই আইন প্রণয়নে সাহয্য গ্রহণ করেন।]
জঈফ-যে হাদীছের কোন রাবী হাছান হাদীছের রাবীর গুণ সম্পন্নও নহেন- সে হাদীছকে ‘হাদীছে জঈফ’ বলে। [রাবীর জো’ফ বা দুর্বলতার কারণেই হাদীছটিকে জঈফ বলা হয়, অন্যথায় (নাউজুবিল্লাহ) রছুলের কোন কথাই জঈফ নহে। জঈফ হাদীছের জো’ফ কম ও বেশী হইতে পারে। খব কম হইলে উহা হাছানের নিকটবর্তী থাকে। আর বেশি হইতে হইতে উহা একেবারে ‘মাওজুতেও পরিণত হইতে পারে। প্রথম পর্যায়ের জঈফ হাদীছ আমলের ফজীলত বা আইনের উপকারিতা বর্ণনায় করা যাইতে পারে, আইন প্রণয়ন নহে।]
(ছ)
মাওজু’- যে হাদীছের রাবী জীবনে কখনো রছূলুল্লাহর নামে ইচ্ছা করিয় কোন মিথ্যা কথা রচনা করিয়াছে বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছে –তাহার হাদীছকে ‘হাদীছে মাওজু’ বলে।
এইরূপ ব্যক্তির কোন হাদীছই কখনো গ্রহণযোগ্য নহে, যদিও সে অতঃপর খালেছ তওবা করে।
মাতরূক –যে হাদীছের রাবী হাদীছের ব্যাপারে নহে; বরং সাধারণ কাজ-কারবারে কখনও মিথ্যা কথা বলিয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে –তাঁহার হাদীছকে ‘হাদীছে মাতরূক’ বা পরিত্যক্ত হাদীছ বলে।
এইরূপ ব্যক্তিরও সমস্ত হাদীছ পরিত্যাজা। অবশ্য সে যদি পরে খালেছ তওবা করে এবং মিথ্যা পরিত্যাগ ও সত্য অবলম্বন লক্ষণ তাহার কাজ-কারবারে প্রকাশ পায় তা হইলে তাহার পরবর্তীকালের হাদীছ গ্রহণ করা যাইতে পারে।
মোবহাম –যে হাদীছের রাবীর উত্তমরূপে পরিচয় পাওয়া যায় নাই –যাহাতে তাহার দোষ গুণ বিচার করা যাইতে পারে –তাহার হাদীছকে ‘হাদীছে মোবহাম’ বলে। এইরূপ ব্যক্তি ছাহাবী না হইলে তাহার হাদীছ গ্রহণ করা যায় না।
(জ)
গরীব –যে ছহীহ হাদীছকে কোন যুগে মাত্র একজন রাবী রেওয়ায়ত করিয়াছেন –সে হাদীছকে ‘হাদীছে গরীব’ বলে।
আজীজ –যে ছহীহ হাদীছকে প্রত্যেক যুগেই অন্ততঃ দুই জন রাবী রেওয়ায়ত করিয়াছেন –সে হাদীছকে ‘হাদীছে আজীজ’ বলে।
মাশহুর –যে ছহীহ হাদীছকে প্রত্যেক যুগে তিন জন রাবী রেওয়ায়ত করিয়াছেন –সে হাদীছকে ‘হাদীছে মাশহুর’ বলে। ফকীহগণ ইহাকে ‘মোস্তাফীজ’ বলেন।
গরীব, আজীজ ও মাশহুর –তিনো রকমের হাদীছকে এক সঙ্গে ‘খবরে আহাদ’ এবং প্রত্যেকটিকে পৃথকভাবে ‘খবরে ওয়াহেদ’ বলে।
খবরে ওয়াহেদ দ্বারা বিশ্বাস (একীন) লাভ হয় কি না তাহার বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী পরিচ্ছেদে করা হইয়াছে।
মোতাওয়াতের –যে ছহীহ হাদীছকে প্রত্যেক যুগে এত অধিক লোক রেওয়ায়ত করিয়াছেন যত লোকের পক্ষে একত্রে মিথ্যা বলা সাধারণতঃ অসম্ভব বিবেচিত হয়, সে হাদীছকে ‘হাদীছে মোতাওয়াতের’ বলে, এরূপ হওয়াকে ‘তাওয়াতোর’ বলে। মোতাওয়াতের হাদীছ দ্বারা এলমে একীন অর্থাৎ, এমন নিশ্চিত জ্ঞান ও বিশ্বাস লাভ হয়, যাহা সমস্ত শোবাহ-সন্দেহের ঊর্ধ্বে।
হাদীছ প্রধানতঃ দুই প্রকারে মোতাওয়অতের হইতে পারেঃ (ক) ‘মোতাওয়াতেরে লফজী’ বা শব্দগত মোতাওয়াতের –যাহার লফজ বা শব্দ একই রূপে সকল যুগে বহু লোক বর্ণনা করিয়াছেন। উপরে দেওয়া সংজ্ঞাটি ইহারই। (খ) ‘মোতাওয়াতেরে মা’নভী’ বা ভাবগত মোতাওয়াতের –যাহার শব্দ ও আনুষঙ্গিক ব্যাপার বিভিন্ন হইলেও মূল ‘মানে’ বা অর্থটি সকল যুগেই বহু লোক বর্ণনা করিয়াছেন। যথা –‘দোআ করিতে হাত উঠান। রছূলে করীম (ছঃ) কোন কোন দোআ’য় কি কি রূপে হাত উঠাইয়াছেন উহার বর্ণনা একরূপ না হইলেও তিনি যে, দোআ করিতে হাত উঠাইয়াছেন এই মূল অর্থটি সকলেই বর্ণনা করিয়াছেন।
এই ছাড়া আমল বা কার্য দ্বারাও একটি হাদীছ ‘মোতাওয়াতের’ হইতে পারে। যে হাদীছকে প্রত্যেক যুগেই বহু লোক কার্যকরী করিয়া আসিয়াছে –সে হাদীছকে ‘হাদীছে মোতাওয়াতেরে আমলী’ বলা যাইতে পারে। এই দৃষ্টিতে বিচার করিলে আহকামের সমস্ত হাদীছই মোতাওয়াতের।
কেননা, এ সকল হাদীছকে ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের যুগ হইতে এ যুগ পর্যন্ত সমস্ত মুসলমানই কার্যকরী করিয়া আসিতেছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, হাদীছের রাবীর এ সংখ্যাগত প্রশ্নটি শুধু ছাহাবা ও তাবেয়ীনদের যুগেরই বিচার্য বিষয়। অতঃপর হাদীছসমূহ কিতাবে লিপিবদ্ধ হওয়ার দরুন সমস্ত হাদীছই মোতাওয়াতের হইয়া গিয়াছে।
এলমে উছুলে হাদীছের বিষয়াবলী হইল অত্যস্ত জটিল, অথচ বাংলা ভাষায় ইহার আলোচনা ইতঃপূর্বে তেমন একটা হয় নাই। অতএব, এখানে সরল ভাষায় অত্যাবশ্যক বিষয়াবলীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা গেল। বিস্তারিত বিবরণ জানার জন্য বিজ্ঞ আলেমদের নিকট দরয়াপ্ত করা আবশ্যক।
খবরে ওয়াহেদ দ্বারা জ্ঞান ও বিশ্বাস লাভ হয় কি না?
‘মোতাওয়াতের’ হাদীছ দ্বারা যে একীন বা সন্দেহাতীত বিশ্বাস লাভ হইয়া থাকে তাহা বলার প্রয়োজন নাই। এখন দেকা যাক যে, ‘খবরে ওয়াহেদ’ দ্বারা নিশ্চিত বিশ্বাস লাভ হয় কি না?
কোনো ঘনটা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ বা উহাতে বিশ্বাস স্থাপন করার সাধারণ সূত্র হইল মাত্র দুইট, স্বয়ং ঘটনা প্রত্যক্ষ করা অথবা অন্যের নিকট উহার বিবরণ শুনা। হাদীছে রছূল সম্পর্কে ছাহাবীগণের জ্ঞান হইল প্রথম পর্যায়ের এবং আমাদের জ্ঞান দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থাৎ শুনা। আর শুনা কথায় বিশ্বাস স্থাপনের একমাত্র উপায় হইল যাহার মারফত কথাটি শুনা গিয়াছে তাহার বিশ্বস্ততা প্রমাণিত হওয়া। সে বিশ্বস্ত হইলে কথায়ও বিশ্বাস জন্মে আর সে বিশ্বস্ত না হইলে কথায়ও বিশ্বাস জন্মে না। আমাদের দৈনন্দিন কাজ কারকারে আমরা ইহাই লক্ষ্য করিয়া থাকি। বিশ্বস্ত একজন ভৃত্যের কথায়ও সাধারণতঃ আমাদের বিশ্বাস জন্মে এবং সংশয় থাকে না। গুরুত্বপূর্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কথায় আমরা সন্দেহ করি না। অন্যথায় আমাদের বহু কাজ-কারবার অচল হইয়া পড়িবে। ইতিহাসে আস্থা স্থাপন চলিবে না, সরকারি বার্তায় বিশ্বাস করা যাইবে না, অথচ এগুলি আমরা বিশ্বাস করিয়া থাকি।
এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিাচর করিলে ‘খবরে ওয়াহেদ’ (অর্থাৎ এক, দুই বা তিন জন প্রমুখাৎ বর্ণিত হাদীছ) দ্বারা যে সংবিদিত বিষয়ে পূর্ণ বিশ্বাস লাভ হয় ইহা বিনা দ্বিধায় বলা যায়। কারণ, হাদীছের বর্ণনাকারীগণের বিশ্বস্ততা এমন অগ্নি-পরীক্ষার ভিতর দিয়অ প্রমাণিত হইয়াছে, যাহার নজীর দুনিয়ায় কোন ব্যাপারেই মিলে না। তবে যে, সাধারণভাবে বলা হইয়া থাকে ‘খবরে ওয়াহিদ’ জ্বন্নী, (উহা দ্বারা জ্বন লাভ হ্য়,) ইহার অর্থ অবহিত হওয়ার পূর্বে ইহা অবহিত হওয়া আবশ্যক যে, কোনো সংবাদ সম্পর্কে সাধারণতঃ মানুষের মনে পাঁচটি অবস্থার সৃষ্টি হয়ঃ ১। শুনিবামাত্র উহাতে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে –ইহাকে আরবীতে এলম বা একীন বলে। ২। দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে না তবে বিশ্বাসের পাল্লা ভারী হইয়া থাকে। ইহাকে আরবীতে ‘জ্বন’ বা গালেবুররায় বলে। ৩। বিশ্বাস ও অবিশ্বাস উভয়ের পাল্লা সমান থাকে। ইহাকে আরবীতে ‘শক’ বলে। ৪। বিশ্বাসের পাল্লা হালকা এবং অবিশ্বাসের পাল্লা ভারী হয়। ইহাকে আরবীতে ওহম, বলে এবং ৫। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস। ইহাকে আরবীতে ‘কিজব’ বলে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আরবী ‘জ্বন’ শব্দটি যেমন দ্বিতীয় অবস্থার জন্য বলা হইয়া থাকে তেমন উহা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস ব্যতীত অপর সকল অবস্থার জন্যও বলা হইয়া থাকে। কোরআনে ইহার উদাহরণ রহিয়াছে। কোরআনের বিখ্যাত আভিধানিক ইমাম রাগেব ইস্পাহানী বলেনঃ ‘জ্বন’ সংবাদ সম্পর্কীয় সেই অবস্থারই নাম যাহা (বিশ্বাসের পক্ষে) ইঙ্গিত দ্বারা লাভ হইয়া থাকে। ইঙ্গিত যখন শক্তিশালি হয়, তখন উহা একীন বা দৃঢ় বিশআসে পরিণত হয়। আর ইঙ্গিত যখন দুর্বল হয়, তখন উহা ‘ওহমে’ পরিণত হয়। কোরআনের নিম্নলিখিত দুইট আয়াতে ইহা এলম বা পূর্ণ বিশ্বাসের অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছেঃ
(ক) (আরবী******************************) –যাহার ‘জ্বন’ (বিশ্বাস) করিয়া থাকে যে, তাহারা তাহাদের পরওয়ারদেগারের সহিত সাক্ষাৎ করিবে। ছূরা বাকারা-৪৬
(খ) (আরবী******************************) –তাহার ‘জ্বন’ (বিশ্বাস) করে যে, তাহারা আল্লাহ পাকের সহিত মিলিত হইবে। এখানে ‘জ্বন’ এর অর্থ বিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে না। অপরপক্ষে নিম্নোদ্ধৃত আয়াতসমূহে ‘জ্বন’ শব্দ শক বা ওহমের অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছেঃ
(ক) (আরবী******************************) –‘জ্বন’-এর অনুসরণ ব্যতীত এ ব্যাপারে তাহাদের কোনো এলমই নাই। -ছূরা নেছা-১৫৭
(খ) (আরবী******************************) –‘তোমরা আল্লা সম্পর্কে নানা রকমের ‘জ্বন’ (শোবাহ-সন্দেহ) করিতেছ’। -ছূরা আহজাব-১০
(গ) (আরবী******************************) –নিশ্চয় ‘জ্বন’ দ্বারা কোন সত্য লাব হয় না। -ছূরা নজম -২৮ (রাগিব)
মাওলানা শিব্বির আহমদ ওছমানী তাঁহার শরহে মোছলেমের ভূমিকায় বলেনঃ ‘খবরে ওয়াদেহ দ্বারা যে ‘জ্বন’ লাভ হইয়া থাকে তাহা একীন বা দৃঢ় বিশ্বাসের খুব কাছাকাছি সবল অবস্থারই নাম। মানুষের দ্বীন ও দুনিয়ার অধিকাংশ কার্য ইহার দ্বারাই সম্পাদিত হইয়া থাকে। কিন্তু ‘জ্বন’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে –বিশেষ করিয়া শক ও ওহমের অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার দরুন ইহাতে মহা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হইয়াছে। সুতরাং এরূপ স্থলে ‘জ্বন’ শব্দ ব্যবহার করাই সঙ্গত নহে’। -শরহে মোছলেম, ৮
এ আলোচনার সার এ হইল যে, ‘খবরে ওয়াহেদ’ দ্বারা ‘জ্বন’ লাভ হয়। ইহার অর্থ হইল একীনই লাভ হয়, ওহম বা শক নহে। তবে ‘মুতাওয়াতেরের’ ন্যায় একীন নহে –শুধু একথা বুঝাইবার জন্যই বলা হইয়া থাকেঃ ‘খবরে ওয়াহেদ’ দ্বারা ‘জ্বন’ লাভ হইয়া থাকে।
বিশ্বস্ত হইলে একজনের কথাওয়ই যে একীন হাছিল হইতে পারে বা উহা গ্রহণ করা যাইতে পারে তাহার প্রমাণ কোরআন ও হাদীছেও রহিয়াছে। কোরআনে রহিয়াছে-
(আরবী******************************)
‘প্রত্যেক দল (ফিরকাহ) হইতে এক ‘তায়েফাহ’ (আরবী*******) যেন দ্বীনের জ্ঞান লাভ করার জন্য বাহির হইয়া যায়, অতঃপর দলে ফিরিয়া তাহাদেরকে দ্বীন সম্পর্কে সতর্ক করে’। -ছূরা বারাআত-১২২। অথচ আরবীতে ‘তায়েফাহ’ একজনকেও বলে। একজনের কথা গ্রহণযোহ্য না হইলে এরূপ আদেশের কোন অর্থই হয় না।
কোরআনে আরো রহিয়াছে –
(আরবী******************************)
‘আল্লাহ তা’আলা আহলে কিতাব (ইহুদী-খৃষ্টান) আলেমগণের নিকট হইতে (তাহাদের নবীর মারফত) এ অঙ্গিকার গ্রহণ করিয়াছিলেন যে, তোমরা লোকদের নিকট উহা (কিতাব) খুলিয়া বলিবে এবং উহা গোপন করিবে না’। -ছূরা আলে ইমরান-১৮৭
এখানে আল্লাহর কিতাব বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করার আদেশ প্রত্যেক আলেমের প্রতি স্বতস্ত্রভাবেই প্রবর্তিত হইয়াছিল। কেননা, প্রত্যেক লোকের নিকট কিতাব বর্ণনার জন্য সকল আলেমের একত্র সমাবেশ সম্ভবপর নহে।
এইরূপে রছূলুল্লাহ (ছ)-ও শরীয়াতের আহকাম প্রচার এবং দেশের শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে অনেক সময় অনেক স্থলে মাত্র একজন বা দুই জন ছাহাবীকেই পাঠাইয়াছেন। একা হজরত মোআজ ইবনে জাবালকেই প্রচারক ও শাসকরূপে ইয়ামানে পাঠাইয়াছিলেন। বাদশাহদের নিকট দাওয়াতে ইসলামের চিঠি দিয়াও এক এক জন বাহককেই পাঠাইয়াছিলেন। বহু ব্যক্তি ব্যতীত এক, দুই বা তিন ব্যক্তির কথা ‘মো’তাবার’ বা বিশ্বাসযেগ্য না হইলে এরূপ একা পাঠানো কোন অর্থই থাকে না।
মশহুর হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে যে, হজরত আনাছ (রাঃ) একদা হজরত আবু তালহা, হজরত আবু উবাইদা ও হজরত ইবনে কা’বকে শরাব পান করাইতে ছিলেন, এমন সময় রছূলূল্লাহর পক্ষ হইতে এক ঘোষনাকারী আসিয়া ঘোষণা করিলেনঃ ‘শরাব হারাম হইয়া গিয়াছে, শরাব হারাম হইয়া গিয়াছে’। ইহা শুনিবা মাত্রই হজরত আবু তালহা বলিলেনঃ উঠ আনাছ, শরাবের মটকা ভাঙ্গ।
এইরূপে একদিন কুবাবাসীরা কুবার মসজিদে বায়তুল মাকদেছের দিকে ফিরিয়া নামাজ পড়িতেছিলেন, এ সময় এক ব্যক্তি আসিয়া বলিলঃ ‘কেবলা পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে, মক্কার কা’বাই আমাদের কেবলা নির্ধারিত হইয়াছে’। ইহা শুনিয়অ মুছল্লীগণ নামাজের মধ্যেই কা’বার দিকে ফিরিয়া গেলেন। এই সকল ঘটনা রছুলুল্লাহর জীবনেই সংঘটিত হইয়াছে; আর তিনি একথা বলেন নাই যে, তোমরা একজনের কথায় বিশ্বাস করিয়া কেন এইরূপ কাজ করিলে? অথচ ইহা শরীয়তের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
এতদ্ব্যতীত খোলাফায়ে রাশেদীন এক বা দুই জন ছাহাবী প্রমুখাৎ রছূলুল্লাহর হাধীছ অবগত হইয়া যে নিজদের বহু মত পরিবর্তন করিয়াছিলেন তাহার বহু উদাহরণ পাঠকগণ দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখিতে পাইবেন। এই আলোচনা হইতে ইহাই প্রমাণিত হইল যে, একজন বা দুই জন বিশ্বস্ত লোকের সংবাদেও জ্ঞান ও বিশ্বাস লাভ হইয়া থাকে। সুতরাং তিন জনের সংবাদে অর্থাৎ, মাশহুর হাদীছ দ্বারা যে, নিশ্চিত বিশ্বাস বা একীন লাভ হয় তাহাতে কোন সন্দেহ থাকিতেছে না।
হাদীছের কিতাবের রকমবিভাগ
মোহাদ্দেছগণ হাদীছের কিতাব লিখিতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করিয়াছেন এবং বিভিন্ন কিতাবকে বিভিন্নরূপে সাজাইয়াছেন। নীচে ইহার কতিপয় প্রসিদ্ধ রকমের নাম দেওয়া গেলঃ
জামে –[জামে শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। যে কিতাবে বিভিন্ন মূল কিতাব হইতে ব্যাপকভাবে হাদীছ সংকলিত হইয়াছে তাহাকেও জামে বলা হইয়া থাকে।– : যে কিতাবে হাদীছসমূহকে বিষয় অনুসারে সাজানো হইয়াছে এবং যাহাতে ‘আকায়েদ, ছিয়ার, তফছীর, ফেতান, আদাব, আহকাম, রেকাক ও মানাকেব –এ আটটি প্রধান অধ্যায় রহিয়াছে তাহাকে ‘জামে’ বলে। যথা –‘জামেয়ে’ ছহীহ’ –ইমাম বোখারী, ‘জামেয়ে’ তিরমিজী’। তিরমিজীর কিতাবটি আসলে ‘জামে’ হইলেও উহা ‘ছুনান’ নামেই প্রসিদ্ধ। এ জাতীয় কিতাবে ইসলামের যাবতীয় বিষয়ের হাদীছ রহিয়াছে।
হাদীছ রহিয়াছে।
ছুনান বা মোছান্নাফ –যে কিতাবে হাদীছসমূহকে বিষয় অনুসারে সাজানো হইয়াছে এবং যাহাতে তাহারাৎ, নামাজ, রোজা প্রভৃতি আহকামের হাদীছসমূহ সংগ্রহের প্রতিই বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হইয়াছে, তাহাকে ‘ছুনান’ বা ‘মোছান্নাফ’ বলে। যথা –‘ছুনানে আবু দাঊদ’, ‘ছুনানে ইবনে মাজা’, ছুনানে দারেমী, ‘মোছান্নাফে ইবনে আমি শাইবা, ‘মোছান্নাফে আবদুর রাজ্জাক’ প্রভৃতি।
মোছনাদ –যে কিতাববে হাদীছসমূহকে ছাহাবীগণের নাম অনুসারে সাজানো হইয়াছে এবং এক এক ছাহাবী হইতে বর্ণিত হাদীছসমূহকে এক এক অধ্যায়ে স্থান দেওয়া হইয়াছে, তাহাকে ‘মোছনাদ’ বলে। যথা –‘মোছনাদে ইমাম আহমদ, ‘মোছনাদে তায়ালছী’, ‘মোছনাদে আবদ ইবনে হোমাইদ’ প্রভৃতি।
মো’জাম –যে কিতাবে হাদীছসমূহকে শায়খ অর্থাৎ, উস্তাদগণের নাম অনুসারে (তাঁতাদের মর্যাদা বা বর্ণনানুক্রমে) সাজানো হইয়াছে তাহাকে ‘মো’জাম’ বলে। যথা –‘মো’জামে ইবনে কানে’, ‘মো’জামে তবরানী’ (মো’জামে কবীর’, ‘মো’জামে ছগীর, মোজামে আওছাত) প্রভৃতি।
শেষোক্ত ‘মো’জাম’ তিনটি তবরানী কর্তৃক রচিত। ইহাতে তিনি হাদীছসমূহকে বর্ণনাক্রমে সাজাইয়াছেন। এ ‘মো’জাম’ নিয়মের প্রতিষ্ঠাতা হইতেছেন ইবনে কানে’ (রঃ) (মৃঃ ৩৫১ হিঃ)।
রেছালা –যে ক্ষুদ্র কিতাবে মাত্র এক বিষয়ের হাদীছসমূহকে একত্র করা হইয়াছে তাহাকে ‘রেছালা’ বা ‘জুজ’ বলে। যথা –‘কিতাবুত তাওহীদ’ –ইবনে খোজাইমা; ইহাতে শুধু তাওহীদ সম্পর্কীয় হাদীছসমূহ একত্র করা হইয়াছে। ‘কিতাবুত তফছীর’ –ছাঈদ ইবনে জোবায়র; ইহাতে কেবল তফছীর সংক্রান্ত হাদীছসমূহ জমা করা হইয়াছে।