২০. ইসলামী ব্যবস্থায় ‘আমীর’ এবং হাদীস অস্বীকারকারীদের “জাতির কেন্দ্রবিন্দু”-র মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
অভিযোগ:এই যে আমি বলেছি, “আল্লাহ এবং রসূল” বলতে “ইসলামী ব্যবস্থা” বুঝায়-তা আমার মনগড়া কথা নয়। এই অপরাধে আপনিও অপরাধী। আপনি আপনার তাফহীমুল কুরআন শীর্ষক তাফসীরে সূরা মাইদার ৩৩ নং আয়াত- এর ব্যাখ্যা প্রসংগে লিখেছেন, “আল্লাহ ও তার রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অর্থ সেই সুষ্ঠু ও কল্যাণকর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যা ইসলামের রাষ্ট্রীয় সংগঠন দেশের মধ্যে কায়েম করে রেখেছ। এরুপ ব্যবস্থা যখন পৃথিবীর বুকে কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তা ধ্বংস করার চেষ্টা মূলত আল্লাহ এবং তার রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”-(১ম খন্ড, পৃ. ৩৬৫)।
উত্তর:এখানে আবারো আমার সামনে আমারই বক্তব্য ছিন্নভিন্ন করে পেশ করার দুঃসাহস দেখানো হয়েছে। মূল বক্তব্য নিম্নরূপ:
এরূপ ব্যবস্থা যখন পৃথিবীর বুকে কায়েম হয়ে যায় তখন তা ধ্বংসের চেষ্টা করা, চাই তা ক্ষুদ্রাকারে নরহত্যা, লুটতরাজ, ছিনতাই ও চুরি-ডাকাতির সীমা পর্যন্তই হোক অথবা বৃহদাকারে এই সুষ্ঠ ব্যবস্থার পরিবর্তণ এবং তার পরিবর্তে বিপর্যয়কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই হোক, মূলত আল্লাহ ও তার রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শামিল। এর দৃষ্টান্ত এই যে, ভারতীয় দন্ডবিধিতে ভারতে বৃটিশ সরকারের উৎখাত প্রচেষ্টায় জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিকেই সম্রাটের বিরুদ্ধে লড়াই করার অপরাধে (Waging War agains the king) অপরাধী গন্য করা হত। চাই তার ততপরতা দেশের অভ্যন্তরভাগে দূর-দূরাঞ্চলে অবস্থিত একজন সাধারণ সৈনিকের হোক না কেন এবং সম্রাট তার হস্তক্ষেপ থেকে যত দূরেই হোকনা কেন।”
এখন একজন সাধারণ বুদ্ধিবিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিও স্বয়ং দেখতে পারে যে, সম্রাটের প্রতিনিধিত্বকারী সৈনিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ গন্য করা এবং স্বয়ং সিপাহীকে সম্রাট গণ্য করার মধ্যে কত বড় পার্থক্য বিদ্যমান! ঠিক অনুরূপ বিরাট পার্থক্য রয়েছে নিম্নোক্ত দুটি কথার মধ্যে: এক ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রসূলের উদ্দিষ্ট সমাজ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতাকে আল্লাহ ও তার রসুলের বিরুদ্ধে তৎপরতা সাব্যস্ত করে এবং অপর ব্যক্তি দাবী করে যে, এই সরকারই স্বয়ং আল্লাহ এবং রসুল।
আপনি এই দুটি কথার পরিণতি সম্পর্কে যতক্ষণ সামান্য চিন্তাভাবনা না করছেন ততক্ষণ এই পার্থক্যের সুক্ষ্মতা ও নাজুকতা পূর্ণরূপে হূদয়ংগম করতে পারবেন না। মনে করুন, ইসলামী সরকার কখনও একটি ভুল নির্দেশ দিয়ে বসল যা কুরআন ও সুন্নাতের পরিপন্থী। এ অবস্থায় আমার ব্যাখ্যা অনুযায়ী তো মুসলিম জনসাধারণ উঠে একথা বলার অধিকার রাখে যে, “আপনি আপনার নির্দেশ প্রত্যাহার করে নিন। কারণ আপনি আল্লাহ ও তার রসুলের নির্দেশের বিরুদ্ধোচরণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআন পাকে একথা বলেছেন। রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত থেকে একথা প্রমাণিত। আর আপনি তা থেকে বিচ্যুত হয়ে এ নির্দেশ দিচ্ছেন। অতএব আপনি এব্যাপারে আল্লাহ ও তার রসূলের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করেননি।”
হাদীস অস্বীকারকারীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী স্বযং ইসলামী সরকার আল্লাহ এবং রসুল। অতএব মুসলমানগণ তাদের কোন নির্দেশের বিরুদ্ধে উপরোক্ত যুক্তিপ্রমাণ পেশের অধিকার রাখে না। সে যখনই এরুপ যুক্তি পেশ করবে ততক্ষণাত সরকার একথা বলে তার মুখ বন্ধ করে দেবে যে, আমরাই তো স্বয়ং আল্লাহ এবং রসূল, আমরা যা কিছু বলব এবং করব তাই কুরআন এবং সুন্নাত।
হাদীস অস্বীকারকারীরা দাবী করে যে, কুরআনের যে যে স্থানে “আল্লাহ এবং রসুল” শব্দ এসেছে সেখানে তার অর্থ ইসলামী সরকার। আমি পাঠকদের নিকট আবেদন করব, তারা যেন কুরআন মজীদ একটু খুলে সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো বের করে দেখে নেন, যেখানে আল্লাহ এবং রসূল শব্দদ্বয় একসাথে এসেছে সেখানে উক্ত শব্দদ্বয়ের সরকার অর্থ গ্রহণের পরিণতি কি দাড়ায়। উদাহরণস্বরুপ নিম্নোক্ত আয়াত কয়টি দেখা যেতে পারে।
“হে নবী! তাদের বল, আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য কর। অতপর তারা যদি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আল্লাহ কাফেরদের পছন্দ করেন না”-(সূরা আল-ইমরান:৩২)।
“হে লোকসকল যারা ঈমান এনেছে-(সর্বান্তকরণে) ঈমান আন আল্লাহ ও রসুলের উপর” (সূরা নিসা: ১৩৬)।
“প্রকৃত মুমিন তো তারাই যারা আল্লাহ ও রসুলের উপর ঈমান এনেছে অতপর কখনো সন্দেহে পতিত হয়নি” (হুজরাত: ১৫)।
আর যারা আল্লাহ ও রসূলের উপর ঈমান আনেনি তবে এ ধরনের কাফেরদের জন্য আমরা জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত রেখেছি”-(ফাতহ:১৩)।
“নিশ্চিত আল্লাহ তাআলা কাফেরদের অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্য জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত রেখেছেন-যার মধ্যে তারা অনন্তকাল থাকবে। তারা সেদিন কোন অভিভাবক ও সাহায্যকরী পাবেনা যেদিন তাদের মুখমন্ডল আগুনে উলোট-পালট করা হবে। তখন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম এবং রসুলের আনুগত্য করতাম”-(আহযাব:৬৪-৬৬)।
“তাদের অর্থসাহায্য গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এজন্য যে, তারা আল্লাহ ও তার রসূলের সাথে কুফরী করেছে-(তওবা:৫৪)।
“হে নবী! তুমি যদি তাদের জন্য সত্তর বারও ক্ষমা প্রার্থনা কর তবুও আল্লাহ তাদের কখনও ক্ষমা করবেন না। কারণ তারা আল্লাহ ও তার রসুলের সাথে কুফরী করেছে”-(তওবা:৮০)।
“আর তাদের মধ্যে যে কেউ মারা যাক তুমি তার জানাযা কখনও পড়বে না, আর না তার কবরের নিকট দন্ডায়মান হবে। কারণ তারা আল্লাহ ও তার রসুলের সাথে নাফরমাণী করেছে এবং পাপাচারী অবস্থায় মারা গেছে”-(তওবা:৮৪)।
“হে লোকসকল যারা ঈমান এনেছে-আল্লাহর আনুগত্য কর, রসুলের আনুগত্য করা এবং তোমাদের কাজ বিনষ্ট কর না”- (মুহাম্মদ: ৩৩)।
“আর যে কেউ আল্লাহ ও তার রসূলের অবাধ্যাচরণ করে তার জন্য জাহান্নামের আগুন অপেক্ষমান। তারা তার মধ্যে অনন্তকাল থাকবে”-(জিন: ২৩)।
“তারা কি জানে না যে, যে কেউ আল্লাহ ও তার রসূলের বিরোধিতা করে তার জন্য জাহান্নামের আগুন অপেক্ষামান? তথায় তারা চিরস্থায়ী হবে”-(তওবা: ৬৩)।
“আল্লাহ এবং তার রসূল এর অধিক হকদার যে, তারা তাদেরকেই সন্তুষ্ট করবে-যদি তারা মুমিন হয়”-(তওবা: ৬২)।
উপরোক্ত আয়াতগুলো যে ব্যক্তিই মনোনিবেশ সহকারে পাঠ করবে সে-ই জানতে পারবে যে, আল্লাহ ও রসূলের অর্থ যদি কোথাও ‘সরকার’ হয়ে যায় তাহলে দীন ইসলামের কাঠামো বিকৃত হয়ে যাবে এবং এমন এক নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার কায়েম হবে যার সামনে ফেরাউন, চিংগীয, হিটলার মুসোলিনি ও স্টালিনের স্বৈরাচার নগণ্য মেন হবে। এর অর্থ তো এই যে, সরকারই মুসলমানদের দীন ও ঈমান। তা মান্যকারী মুসলমান থাকবে এবং অমান্যকারী কাফের হয়ে যাবে। এই সরকারের বিরুদ্ধচারণকারী পৃথিবীতে শুধু জেলে যাবে না, বরং আখেরাতেও চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। তার সাথে মতবিরোধ করলে চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। তার সাথে মতবিরোধ করলে চিরস্থায়ী শস্তি ভোগ করতে হবে। এই সরকারকে সন্তুষ্ট করা ঈমানের শর্ত সাব্যস্ত হবে এবং যে ব্যক্তি তার আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেবে তার নামায, রোযা, যাকাত এবং সমস্ত সৎ আমল নস্যাত হয়ে যাবে। তার জানাযা পড়াও মুসলমানদের জন্য জায়েয হবে না এবং তার ক্ষমার জন্য প্রার্থনাও করা যাবে না। বিশেষ কোনো স্বৈরাচারের এই ধরনের সরকারের সাথে কোনো তুলনা হয় কি?
অতপর এদিকটি সম্পর্কেও কিছুটা চিন্তা করুন যে. উমাইয়্যা রাজবংশের পর থেকে আজ পর্যন্ত গোটা ইসলামী দুনিয়া কখনও এক দিনের জন্যেও একই সরকারের আওতায় একত্র হয়নি এবং আজও মুসলিম দেশসমূহে অনেকগুলো সরকার প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এখন কি ইন্দোনিশিয়া,মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ইরাক, তুরস্ক, সৌদী আরব, মিসর লিবিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কো প্রভৃতির জন্য পৃথক পৃথক “আল্লাহ ও রসূল” হবে? অথবা কোন এক রাষ্টের “আল্লাহ ও রসূল” কি জোরপূর্বক নিজের একনায়কত্ব অন্যান্য রাষ্টের উপর চাপিয়ে দেবে? অথবা গোটা ইসলামী দুনিয়া এক্যবদ্ধভাবে এক “আল্লাহ ও রসূল” নির্বাচন না করা পর্যন্ত কি ইসলাম সম্পূর্ণরুপে অকেজো ও পরিত্যক্ত থাকবে?
২১. রিসালাতের যুগে পারষ্পরিক পরামর্শের কি সীমারেখা ছিল?
অভিযোগ:“রাষ্টপ্রধান হিসাবে রসূলুল্লাহ (স) এর প্রতিটি নির্দেশ যদি ওহীর ভিত্তিতে হয়ে থাকে তাহলে আবার কেন তাকে পরামর্শ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল? আপনি আলোচ্য পত্রালাপের অধীনে এ প্রসংগে লিখেছেন, মহানবী (স) শুধুমাত্র কার্যপ্রণালী নির্ধারনের ক্ষেত্রে পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। আপনি এর পূর্বে লিখেছিলেন যে, মহানবী (স) তার তেইশ বছরের নবূওয়াতী জীবনে যা কিছু বলেছেন ও করেছেন তা সবই ওহীর ভিত্তিতে ছিল এবং এখন আপনি “কার্যপ্রণালী” কে এর বাইরে রেখেছেন।”
উত্তর:যেসব ব্যাপারেই আল্লাহ তাআলা ওহী মাতলূ অথবা ওহী গায়র মতলূ দ্বারা মহানবী (স) কে পথনির্দেশ না দিতেন সেসব ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষার সাহায্য মহনবি (স) বুঝে নিতেন যে, এই বিষয়টি মানবীয় সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর এই জাতীয় ব্যাপারেই মহানবী (স) তার সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন। মহানবী (স) এর মাধ্যমে লোকদেরকে পরামর্শ গ্রহণের ইসলামী পন্থার প্রশিক্ষণদানই ছিল এর উদ্দেশ্য। মুসলমানদের এভাবে প্রশিক্ষণদানও ছিল স্বয়ং রিসালাতের দায়িত্বের একটি অংশ।
২২. আযানের পদ্ধতি কি পরামর্শের ভিত্তিতে না ইলহামের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছিল?
অভিযোগ:আপনি লিখেছেন, “আপনি কি এমন কোন উদাহরণ পেশ করতে পারেন যে, রিসালাতের যুগে কুরআন মজীদের কোন অংশের ব্যাখ্যা পরামর্শের ভিত্তিতে করা হয়েছিল? অথবা কোন আইন পরামর্শের ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল? অনেকগুলো নয়, মাত্র একটি উদাহরণ আপনি পেশ করুণ।” এর একটি উদাহরণ আমরা মিশকাত শরীফে পাই। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে নামাযের জন্য ডাকার নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু স্বয়ং এই ডাকার পন্থা নির্দিষ্ট করেননি। মহানবী (স) সাহাবাদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে এর পন্থা নির্ধারণ করেছেন এবং নিজের মতের বিপরীত করেছেন। করণ তিনি ইতিপূর্বে শিংগা ফুকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বলুন, আযান দীন ইসলামের বিধানের অন্তভুক্ত কিনা?
উত্তর:কুরআন মজীদের এমন কোন আয়াতের বরাত দেয়া যেতে পারে কি যার মধ্যে নামাযের জন্য আওয়াজ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে? কুরআন মজীদে তো নামাযের জন্য ডাকার উল্লেখ মাত্র দুটি আয়তে এসেছে। সূরা মাইদার ৫৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে: “তোমরা যখন নামাযের জন্য আহবান কর তখন তারা (আহলে কিতাব ও কাফেররা) এটাকে উপহাস ও কৌতুকের বস্তুরূপে গ্রহণ করে।” আর সূরা জুমুআর ৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে: “জুমুআর দিনে যখন নামাযের জন্য আহবান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও।” এই দুটি আয়াতেই নামাযের জন্য ডাকার উল্লেখ একটি প্রচলিত ব্যবস্থা হিসাবে উধৃত করা হয়েছে। আমরা তো কুরআনের কোথাও এমন কোন আয়াত পাচ্ছি না যেখানে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, নামাযের জন্য আযান দাও।
মিশকাত শরীফের যে বরাত দেয়া হয়েছে তা থেকে বুঝা যাচ্ছে, মিশকাত শরীফ পাঠ করে তা দেয়া হয়নি, বরং শুনা কথা এখানে তুলে দেয়া হয়েছে। মিশকাত শরীফে ‘নামায’ শীর্ষক অধ্যায়ের ‘আযান’ শীর্ষক অনুচ্ছেদ খুলে দেখুন। সেখানে যেসব হাদীস একত্রিত করা হয়েছে তা থেকে জানা যায়, মদীনা তাইয়্যেবায় রীতিমত জামাআতে নামায আদায়ের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে প্রথম প্রথম আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে কোন নির্দেশ আসেনি যে, নামাযের জন্য লোকদের কিভাবে একত্র করা যেতে পারে। মহানবী (স) সাহাবাদের সমবেত করে পরামর্শ করেন। কতেক লোক বলেক যে, আগুন জ্বালানো যেতে পারে। এর ধোয়া উর্ধগামী হতে দেখে লোকেরা জানতে পারবে যেম নামাযের জামাআত শুরু হতে যাচ্ছে। কতেক লোক শিংগা ফুঁকার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু অপর কতিপয় লোক বলেন যে, প্রথমোক্তটি ইহুদীদের এবং শেষোক্তটি খৃষ্টানদের পন্থা, এখন এ ব্যাপারে কোন শেষ সিদ্ধান্ত হয়নি এবং আরো চিন্তাভাবনা চলছিল। ইত্যবসরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ আল-আনসারী (রা) স্বপ্নে দেখেন যে, এক ব্যক্তি শিংগা নিয়ে যাচ্ছে। তিনি তাকে বলেন, হে আল্লাহর বান্দা! এই শিংগা বিক্রি করবে কি? সে জিজ্ঞিস করল, এদিয়ে তুমি কি করবে? তিনি বললেন, নামাযের জন্য লোকদের ডাকব। সে বলল, আমি এর চেয়েও উত্তম পন্থা তোমাদের বলে দিচ্ছি। অতএব স্বপ্নের মধ্যে আগন্তুক ব্যক্তি তাকে আযানের শব্দসমষ্টি শিখিয়ে দিল।
ভোর হলে হযরত আবদুল্লাহ (রা) উপস্থিত হয়ে রসূলুল্লাহ (স) এর নিকট তার স্বপ্নের কথা বলেন। মহানবী (স) বলেন, এটা সঠিক স্বপ্ন, উঠে দাড়াও এবং বিলালকে একটি একটি করে বাক্য বলে দাও, সে উচ্চস্বরে তা ঘোষণা করবে। আযানের উচ্চ আওয়াজ শুনতে পেয়ে হযরত উমার ফারূক (রা) দৌড়ে এসে বলেন, আল্লাহর শপথ! আপ আমিও এই স্বপ্ন দেখেছি। মহানবী (স) বলেন সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য নিবেদিত। এ হল মিশকাত শরীফের আযান শীর্ষক অনুচ্ছেদের সারসংক্ষেপ। এ থেকে যা কিছু প্রতিভাত হয় তা এই যে, নামাযের জন্য আযানের পদ্ধতি পরামর্শের ভিত্তিতে নয়, বরং ইলহামের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছিল। স্বপ্নের আকারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা) ও হযরত উমার (রা)-র উপর এই ইলহাম হয়েছিল।
কিন্তু মিশকাত শরীফ ব্যতীত হাদীসের অন্যান্য গ্রন্থে যেসব রিওয়ায়াত এসেছে সেগুলো একত্র করলে তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবীগণ যেদিন স্বপ্নের মাধ্যমে আযানের নির্দেশনা লাভ করেন ঠিক সেদিন মহানবী (স) এর নিকটও ওহীর সাহায্যে এই হুকুম এসে গিয়েছিল। ফাতহুল বরী গ্রন্থে আল্লামা ইবনে হাজার (রহ) এসব হাদীস একত্র করেছেন।
২৩. মহানবী (স) এর বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তসমূহ দলীল কি না?
অভিযোগ:“আপনার দাবী অনুযায়ী মহানবী (স) এর প্রতিটি সিদ্ধান্ত ওহী ভিত্তিক হওয়া উচিত। কিন্তু আপনি স্বয়ং স্বীকার করছেন যে, তার এই সিদ্ধান্ত ওহী ভিত্তিক হত না। অতএব আপনি তাফহীমূল কুরআনের প্রথম খন্ডের ১৪৭ নং পৃষ্ঠায় নিম্নোক্ত হাদীস উদ্ধৃত করেছে যে, নবী (স) বলেন:
“অবশ্যই আমি একজন মানুষ। তোমরাআমার নিকট কোন মোকদ্দমা নিয়ে আসবে এবং তোমাদের মেধ্যে এক পক্ষ অপর পক্ষের তুলনায় অধিক বাকচতুর এবং তাদের যুক্তিপ্রমাণ শুনে আমি তাদের অনুকূলে সিদ্ধান্ত দেব। কিন্তু জেনে রাখ! যদি এভাবে নিজের ভাইয়ের কোন স্বত্ব থেকে কোন জিনিস তোমরা আমার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে লাভ করে থাক তবে মূলত তোমরা দোযখের একটি টুকরা লাভ করলে।”
মহানবী (স) এর সিদ্ধান্তসমূহে এই সম্ভাব্য ভুল ছিল, যে সম্পর্কে কুরআন মজীদ মহানবী (স) এর জবানীতে বলিয়েছিল যে: “যদি আমি ভুল করে বসি তবে তা আমার নিজের কারণেই। আর যদি আমি সোজা পথে থাকি তবে তা ওহীর ভিত্তিতেই হয়ে থাকে” (সূরা সাবার ৫০ নং আয়াত দ্র.)।১
উত্তর: এটাও সুস্থ বুদ্ধির অভাবের আর একটি চিত্তাকর্ষক দৃষ্টান্ত। যে ব্যক্তির আইনগত বিষয় সম্পর্কে ভাসাভাসা জ্ঞান রয়েছে সেও জানে যে, প্রতিটি মোকাদ্দমার সিদ্ধান্তের মধ্যে দুটি ভিন্ন জিনিস থাকে। এক, মোকদ্দমার তথ্যাবলী (Fact of the case), যা সাক্ষ্য প্রমাণ ও আনুষংগিক বিষয়াদির ভিত্তিতে উদঘাটিত হয়। দুই, এই তথ্যাবলীর উপর আইনের প্রয়োগ। অর্থাৎ মোকদ্দমার বিবরণ থেকে যে তথ্যাবলী উদঘটিত হয় তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট মোকদ্দমার আইনগত নির্দেশ কি হওয়া উচিত তা স্থির করা। মহানবী (স) এ হাদীসে যা কিছু বলেছেন তার অর্থ এই নয় যে, মোকদ্দমার তথ্যাবলীর উপর আইনের প্রয়োগ করতে গিয়ে তিনি ভুল করতে পারেন, বরং তার বাণীর পরিষ্কার অর্থ এই যে, তোমরা ভুল বিবরণ প্রদান করে বাস্তবতার বিপরীত মোকদ্দমার তথ্যাবলী প্রমাণ করলে আমি তার উপর বর্তাবে। কারণ বিচারকের কাজ হচ্ছে,বাদী-বিবাদী বিবরণ ও সাক্ষ্য-প্রমাণে তার সামনে যে তথ্য উদঘাটিত হবে তার ভিত্তিতে রায় প্রদাণ। বাইরের কোন মাধ্যমে তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতে পারলেও তার ভিত্তিতে তিনি রায় দিতে পারেন না। বরং ইনসাফের নীতিমালার আলোকে তাকে মামলার বিবরণীর উপরই সিদ্ধান্ত দিতে হবে। অতএব ভুল বিবরণের ভিত্তিতে যে তথ্য উদঘটিত হবে তার ভিত্তিতে রায় প্রদাণ। বাইরের কোন মাধ্যমে তিনি প্রকৃত ঘটনা উদঘটিত হবে তার ভিত্তিতে তিনি রায় দিতে পারেন না। বরং ইনসাফের নীতিমালার আলোকে তাকে মামলার বিবরণীর উপরই সিদ্ধান্ত দিতে হবে। অতএব ভুল বিবরণের ভিত্তিতে যে ফয়সালা হবে তা বিচারকের ভুল নয়, বরং যে পক্ষ বাস্তব ঘটনার বিপরীত তথ্য প্রমাণ করে নিজের অনুকূলে সিদ্ধান্ত লাভ করেছে, এ ভুলের জন্য সেই দায়ী। এ থেকে সেই কথা কোথায় বের হয়ে এলো যা ডকটর সাহেব বের করতে চাচ্ছেন? শেষ পর্যন্ত এ দাবী কে করেছে যে, আল্লাহ তাআলা প্রতিটি মোকদ্দমার ক্ষেত্রে মহানবী (স) কে ওহীর মাধ্যমে মামলার প্রকৃত বিবরণ বলে দিতেন? আসল দাবী তো এই যে, মহানবী (স) আইনের ব্যাখ্যা এবং বাস্তব তথ্যের উপর তা প্রয়োগ করতে ভুলের শিকার হন না। কারণ তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োজিত বিচারক ছিলেন। আল্লাহ প্রদত্ত আলোকবকর্তিকা এই কাজে তার পথ প্রদর্শন করতে এবং এ কারণে তার সিদ্ধান্তসমূহ সনদ ও দলীল হিসাবে গণ্য। এই দাবীর পরিপন্থী কোন প্রমাণ কারো কাছে বর্তমান থাকলে সে তা পেশ করুক।
১. সূরা সবার এই আয়াত থেকে ড: সাহেব পুনরায় ভুল প্রমান গ্রহণ করেছেন। অথচ ইতিপূর্বে তাকে এই সম্পর্কে কতর্ক করা হয়েছে (“মহানবী (স) এর ইজতিহাদী পদঙ্খলন থেকে ভুল যক্তি গ্রহন” শীর্ষক অনুচ্ছে দ্র.)।
উপরে যে হাদীস থেকে ডকটর সাহেব দলীল গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে কোথাও বলা হয়নি যে, “আমি সিদ্ধান্ত প্রদানে ভুল করতে পারি।” আইন বিজ্ঞানেও একথা পূর্ণরূপে সর্বজন স্বীকৃত যে, আদালতের সামনে যদি কোন ব্যক্তি সাক্ষ্য-প্রমাণের জোরে বাস্তব ঘটনার বিপরীত বিবরণ সত্য প্রমাণিত করে এবং বিচারক তা মেনে নিয়ে ঠিক আইন অনুযায়ী রায় প্রদান করেন তবে সেই রায় স্বয়ং ভুল নয়। কিন্তু ডকটর সাহেব এটাকে রায়ের ভুল সাব্যস্ত করছেন।
২৪. বক্র বিতর্কের একটি বিস্ময়কর নমুনা
অভিযোগ:আপনি বললেন: নবী (স) এর মাত্র কয়েকটি পদঙ্খলন হয়েছিল। অর্থাৎ আপনার ধারণা এই যে, মহানবী (স) এর যদি অধিক পদঙ্খলন হত তবে তা আপত্তিকর ব্যাপার হত, কিন্তু কয়েকটি মাত্র পদঙ্খলন আপত্তিকর নয়।
উত্তর:কি মনোরম নির্যাস আমার লেখা থেকে নির্গত করে স্বয়ং আমার সামনে পেশ করা হচ্ছে। যে বক্তব্যের এই নির্যাস নির্গত করা হয়েছে তা হুবহু নিম্নেউল্লেখ করা হল:
“আপনি দ্বিতীয় যে আয়াত পেশ করেছেন তা থেকে আপনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, মহানবী (স) তার ফয়সালাসমূহে অনেক ভুলভ্রান্তি করেছেন যার মধ্য থেকে আল্লাহ তাআলা নমুনা হিসাবে এই দুই-চারটি ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলে দেন যাতে লোকেরা সাবধান হয়ে যায় যে, মহানবী (স) এর গোটা নবূওয়াতী জীবনে শুধুমাত্র ঐ কয়েকটি পদঙ্খলন হয়েছিল, যা আল্লাহ তাআলা সাথে সাতে সংশোধন করে দেন। এখন আমরা পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে তার থেকে প্রমাণিত সমস্ত সুন্নাতের উপর আমল করতে পারি। কারণ তার মধ্যে যদি আরো কোন পদঙ্খলন থাকত তবে আল্লাহ তাআলা তাও টিকে থাকতে দিতেন না, যে ভাবে এই পদঙ্খলনগুলোকে তিনি টিকে থাকতে দেননি।”
উপরোক্ত বক্তব্যের নির্যাস এরুপ নির্গত করা হয়েছে: “মহানবী (স) এর অধিক পরিমাণ পদঙ্খলন হলে তা আপত্তিকর ছিল, কিন্তু কয়েকটি মাত্র পদঙ্খলন আপত্তিকর নয়। ” যেসব লোকের বিতর্কের ঢং এরূপ তাদের সম্পর্কে লোকেরা কি করে সুধারণা পোষণ করতে পারে যে, তারা সৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে বক্তব্য হৃদয়ংগম করার জন্য বাক্যলাপ করছে।
অভিযোগ:নবী (স) এর প্রতিটি কথাই যদি ওহী ভিত্তিক হত তাহলে তার একটি বারের পদঙ্খলনও দীন ইসলামের গোটা ব্যবস্থা বিশৃংখল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। এজন্য যে, তা কোন মানুষের ভুল ছিল না, বরং (মাআযাল্লাহ) ওহীল ভ্রান্তি, স্বয়ং আল্লাহর ভ্রান্তি। আর আল্লাহ যদি (মাআযাল্লাহ) ভুল করতে পারেন তবে এই ধরনের খোদার উপর ঈমান আনার কি অর্থ হতে পারে?”
উত্তর:এটা একটা ভ্রান্তি ছাড়া আর কি? একথা কে বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা প্রথমে ওহীর মাধ্যমে ভুল পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন, সে কারণে মহানবী (স) এর পদঙ্খলন হয়েছিল? মূল কথা যা হঠকারিতা ছাড়াই সহজে হৃদয়ংগম করা যায় তা হলো, মহানবী (স) এর একটি বারের পদঙ্খলন যেহেতু দীন ইসলামের গোটা ব্যবস্থা উলটপালট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, তাই আল্লাহ তাআলা এই কাজ নিজের দায়িত্বে নিয়েছিলেন যে, নবূওয়াতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি নিজে মহানবী (স) এর পথনির্দেশনা ও পূষ্ঠপোষকতা করবেন এবং কখনও মানবিক দাবীতে তার পদঙ্খলন হয়ে গেলে সাথে সাথে তা সংশোধন করে দেবেন, যাতে দীন ইসলামের ধ্যে কোন ক্রটি অবশিষ্ট থাকতে না পারে।
২৫. মহানবী (স) এর ব্যক্তিগত মত এবং ওহীর ভিত্তিতে প্রদত্ত বক্তব্যের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল
অভিযোগ:আপনি বলেছেন যে, নবী (স) তার পুরা নবূওয়াতী জীবনে যা কিছু করেছেন অথবা বলেছেন তা ওহীর ভিত্তিতেই ছিল। কিন্তু দাজ্জাল সম্পর্কিত হাদিস সম্পর্কে আপনার বক্তব্য এই যে:
“এসব বিষয় সম্পর্কে যে বিভিন্ন কথা মহানবী (স) এর হাদীসসমূহে উল্লেখ আছে তা মূলত তার অনুমান ভিত্তিক কথা, যে সম্পর্কে তিনি নিজেই সন্দেহের মধ্যে ছিলেন”-(রাসায়েল ওয়া মাসায়েল, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫)।
আর এর পরপরই আপনি নিজই স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, “মহানবী (স) এর এই উতকন্ঠাই এ কথা প্রকাশ করছে যে, এসব কথা তিনি ওহীলদ্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে বলেন নি, বরং নিজর ধারণা অনুমানের ভিত্তিতে বলেছিলেন”-(ঐ,পৃ.৫৬)।
উত্তর:আমার যে বাক্যসমূহের এখানে আশ্রয় লওয়া হচ্ছে তা নকল করার ব্যাপারে পুনরায় একই ভেল্কিবাজির নৈপুণ্যতা প্রদর্শন করা হয়েছে। পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে এক স্থান থেকে একটি বাক্য আবার অন্য অংশ থেকে একটি বাক্য নকল করে নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা হয়েছে। আমি এখানে মূলত যে কথা বলেছি তা হলো, দাজ্জাল সম্পর্কে মহানবী (স) কে ওহীর মাধ্যমে যে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল তা কেবলমাত্র এতটুকু ছিল যে, দাজ্জালের আবির্ভাব হবে এবং তার এই এই বৈশিষ্ট্য থাকবে। এসব কথা মহানবী (স) সংবাদ হিসেবে বলেছিলেন। কিন্তু সে কখন এবং কোথায় আত্বপ্রকাশ করবে এ সম্পর্কে মহানবী (স) কে ওহীর সাহায্যে কোন জ্ঞান দান করা হয়নি। তাই এসব বিষয়ে তিনি যা কিছু বলেছেন তা খবরের ভংগিতে নয়, বরং কিয়াস ও অনুমানের ভিত্তিতে বলেছেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি ইবনে সাইয়্যাদ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে, সম্ভবত সে-ই কথিত দাজ্জাল হয়ে থাকবে।
কিন্তু হযরত উমার (রা) তাকে হত্যা করতে চাইলে মহানবী (স) বলেন: যদি সে দাজ্জাল হয়ে থাকবে তবে তার হত্যাকরী তুমি নও। আর সে যদি দাজ্জাল না হয়ে থাকে তবে একজন যিম্মী(মুসলিম রাষ্টের অমুসলিম নাগরিক) কে হত্যা করা অধিকার তোমার নেই। অপর হাদীসে আছে: “আমার জীবদ্দশায়ই যদি দাজ্জালের আগমন ঘটে তবে আমি যুক্তিপ্রমাণের সাহায্যে তার মোকাবিলা করব, অন্যথায় আমার পরে আমার প্রতিপালক তো প্রত্যেক মুমিনের পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারী আছেনই।”
এই ছিলো আমার বক্তব্য। এ থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান মহানবী (স) এক ভংগীতে প্রকাশ করতেন এবং যেসব বিষয়ের জ্ঞান তাকে ওহরি মাধ্যমে দেয়া হত না তা সম্পূর্ণ ভিন্নতর ভংগীতে বর্ণনা করতেন। তার প্রকাশভংগীই এই পার্থক্য সুস্পষ্ট করে তুলতো।কিন্তু যেখানে সাহাবীগণ সহজে এই পার্থক্য হৃদয়ংগম করতে পারতেন না সেখানে তারা স্বয়ং তার নিকট থেকে জেনে নিতেন যে, একথা তিনি নিজের ব্যক্তিগত মতানুযায়ী বলেছেন, না আল্লাহ তাআলার নির্দেশে বলেছেন? এর অনেকগুলো দৃষ্টান্ত আমি তাফহীমাত গ্রন্থের ১ম খন্ডের “স্বাধীনতার ইসলামী ধারণা” শীর্ষক প্রবন্ধে পেশ করেছি।
২৬. সাহাবীগণ কি একথার প্রবক্তা ছিলেন যে, মহানবী (স) এর সিদ্ধান্তসমূহ পরিবর্তন করা যেতে পারে?
অভিযোগ:“আমি লিখেছিলাম,এমন কিছু সিদ্ধান্ত ছিল যা রসূলুল্লাহ (স) এর যুগে গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু নবী (স) এর পর অবস্থার পরিবর্তনের দাবী অনুযায়ী খুলাফায়ে রাশেদীন এসব সিদ্ধান্তের পরিবর্তন সাধন করেন। আপনি বলেছেন যে, এটা সেই মহান ব্যক্তিত্বগণের প্রতি চরম অপবাদ। এর প্রমাণস্বরূপ আপনি তাদের কোন কাথা বা কার্যক্রমও পেশ করতে পারেননি। আপনি এখন জেনে আশ্চর্য হবেন, এ সম্পর্কে স্বয়ং আপনি এক পৃষ্ঠা সামনে অগ্রসর হয়ে এ বিষয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করেছেন যে, সাহাবায়ে কেরাম (রা) অবস্থা ও পরিস্থিতির পরিবর্তন অনুযায়ী মহানবী (স) এর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনযোগ্য মনে করতেন। দেখুন, আপনি কি লিখেছেন:
“কার জানা নাই যে, হযরত আবু বাকর সিদ্দীক (রা) মহানবী (স) এর ইন্তেকালের পর উসামা (রা) এর নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী অভিযানে প্রেরণের জন্য কেবলমাত্র এজন্য দৃঢ়তা প্রকাশ করেছেন যে, মহানবী (স) স্বয়ং তার জীবদ্দশায় যে কাজের ফয়সালা করেছেন তিনি নিজেকে তার পরিবর্তনের অধিকারী মনে করেন না। সাহাবাযে কেরাম (রা) যখন আরবের সর্বত্র একটি ভয়াবহ তুফান উত্থিত হওয়ার আশংকার প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এবং এই অবস্থায় সিরিয়ার দিকে সৈন্যবাহিণী প্রেরণ অনুপযোগী সাবস্ত করলেন তখন হযরত আবু বাকর (রা) উত্তর দেন, যদি কুকুর অথবা নেকড়ে বাঘ এসে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তবুও আমি রসূলুল্লাহ (স) এর কৃত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারব না”-(তরজমানুল কুরআন, নভেম্বর ১৯৬০ খৃ. পৃ.)।
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আবু বাকর (রা) ব্যতীত অবশিষ্ট সকল সাহাবী অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে নবী (স) এর সিদ্ধান্তের পরিবর্তন সাধন বৈধ মনে করতেন্ আপনি আরও লিখেছেনঃ
“হযরত উমার (রা) তার ইচ্ছা ব্যক্ত করে বলেন, অন্তত উসামাকে এই সৈন্যবাহিনীর অধিনায়কত্ব থেকে বরখাস্ত করা হোক। কারণ অনেক প্রবীণ সাহাবী এই যুবক ছেলের অধীনে থাকতে আগ্রহী নন। তখন হযরত আবু বাকর (রা) তার দাড়ি ধরে বলেন, খাত্তাবের পুত্র! তোমার মা তোমার জন্য কাঁদুক এবং তোমাকে হারিয়ে ফিলুক। রসূলুল্লাহ (স) তাকে নিয়োগ করেছেন, আর তুমি বলছ যে, আমি তাকে বরখাস্ত করি”-(ঐ)।
এ থকেও প্রমাণিত হয় যে, হযরত উমার (রা) অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে নবী (স) এর সিদ্ধান্তসমূহের পরিবর্তন সাধন বৈধ মনে করতেন। বরং এ ঘটনায় তো অবস্থার পরিবর্তনেরও প্রশ্ন ছিল না। হযরত উমার (রা) তা এজন্য পরিবর্তন করতে চাচ্ছিলেন যে, তার প্রতি সাহাবীগণ সন্তুষ্ট ছিলেন না। আপনার কি মত যে, [এক হযরত আবু বাকর (রা) ব্যতীত] সাহাবীদের মধ্যে কেউই একথা বুঝতেন না যে, রসূলুল্লাহ (স) এ সিদ্ধান্ত কোন অবস্থায়ই পরিবর্তন করা যেতে পারে না?
উত্তর:এটাই একথার একটি উদাহরণ যে, হাদীস অস্বীকারকারীগণ প্রতিটি বাক্যের মধ্যে শুধু নিজেদের মতলব অনুসন্ধান করে বেড়ায়। উপরে হযরত আবু বাকর (রা) এর যে দুটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে তা পুনরায় পাঠ করে দেখুন। তার মধ্যে একথার কি কোথাও উল্লেখ আছে যে, হযরত আবযু বাকর (রা) যখন মহাবী (স) এর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন তখন হযরত উমার (রা) অথবা সহাবীদের মধ্যে কেউ একথা বলেছিলেন যে, “হে হুযুর, জাতির কেন্দ্রবিন্দু! আপনি শরীআত আনুযায়ী নবী (স) এর সিদ্ধান্তসমূহ মানতে বাধ্য নন, বরং তা পরিবর্তন করে দেয়ার পূর্ণ কর্তৃত্ব আপনার রয়েছে। যদি আপনার নিজস্ব রায় এই হয়ে থাকে যে, এসময় উসামার বাহিনীর চলে যাওয়া উচিত এবং উসামা (রা) ই এর অীধনায়ক থাকবেন, তবে ভিন্ন কথা। আপনি তদনুযায়ী কাজ করুন। কারণ আপনি হচ্ছেন “আল্লাহ ও রসূল”। কিন্তু এই প্রমাণ পেশ করবেন না যে, এটা রসূলুল্লাহ (স) এর সিদ্ধান্ত, তাই তা পরিবর্তন করা যাবে না। মহানবী (স) তার যুগের জাতির কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন, আর আপনি আপনার যুগের জাতির কেন্দ্রবিন্দু। আজ আপনার কর্তৃত্ব তাই যা গতকাল মহানবী (স) এর ছিল।”
এ কথা যদি হযরত উমার (রা) অথবা অপরাপর সাহাবীগণ বলে থাকতেন তবে নিসন্দেহে হাদীস অস্বীকারকারীরা নিজেদের পক্ষে একটা যুক্তি পেয়ে যেতো। কিন্তু পক্ষন্তরে সেখানে ঘটনা এই হয়েছিল যে, হযরত আবু বাকর (রা) যখন মহানবী (স) এর সিদ্ধন্তের কথা উল্লেখ করলেন তখন হযরত উমার (রা) সহ সকল সাহাবী সাহাবী আনুগত্যের মাথা অবনত করে দিলেন। উসামা বাহিণী রওনা হল, উসামা (রা) ই এর অধিনায়ক থাকলেন এবং অনেক প্রবীণ সাহাবী তার নেতৃত্বে সন্তুষ্ট চিত্তে ও আনন্দিত মনে রওনা হলেন। অধিকন্তু এ থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, মহানবী (স) এর পরে কতিপয় লোকের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল যে, তার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত সিদ্ধান্তসমূহে প্রয়োজন বোধে পরিবর্তন আনয়ন করা যেতে পারে। কিন্তু ঐ সময় দীনের জ্ঞানে যিনি সবচেয়ে পরিপক্ক ছিলেন তার সতর্ক করার সাথে সাথে সকলে নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন এবং আনুগত্যের মস্তক অবনত করে দেন।
এই কর্মপন্থা অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে,শুধুমাত্র নিজদের বক্তব্য সাব্যস্ত করার জন্য সাহাবায়ে কেরামের এই প্রতিক্রিয়ার আশ্রয় তো নেয়া হচ্ছে যার প্রকাশ কেবল আলোচনাকালে ঘটেছিল, কিন্তু আলোচনাশেষে সকলের ঐক্যমত অনুযায়ী যে ইজমা ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, তা থেকে চোখ বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত নীতি তো এই যে, আলোচনা শেষে সম্মিলিতভাবে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে সেই সিদ্ধান্তই দলীল হিসাবে গ্রহনযোগ্য হবে, আলোচনা চলাকালে যেসব মত ব্যক্ত হয়ে থাকে তা নয়।
২৭. তিন তালাকের ব্যাপারে হযরত উমার (রা) এর ফয়সালার স্বরূপ
অভিযোগ:“আপনি বলেছেন, আমি যেন কোন দৃষ্টান্ত পেশ করি যে, রসূলুল্লাহ (স) এর যুগের কোন সিদ্ধান্ত খুলাফায়ে রাশেদীন পরিবর্তন করেছেন, এটা তো আপনি ও অস্বীকার করতে পারবেন না যে, নবী (স) এর যুগে এক বৈঠকে প্রদত্ত তিন তালাককে এক তালাক করে তাকে রিজঈ (প্রত্যাহারযোগ্য) তালাক সাব্যস্ত করা হত। হযরত উমার (রা) তার শাসনামলে এটাকে তিন তালাক গণ্য করে মুগাল্লাযা তালাক সাব্যস্ত করেন এবং ফিকহ শাস্ত্রের আলোকে উম্মাত আজ পর্যন্ত এর উপরই আমল করে আসছে।
উত্তর:এ প্রসংগে সঠিক অবস্থা হলো, মহানবী (স)-এর যুগেও (একত্রে পদত্ত) তিন তালাককে তিন তালাকই মনে করা হত এবং বিভিন্ন স্থানে মহানবী (স) তাকে তিন তালাকই গণ্য করে ফয়সালা দিয়েছেন। কিন্তু যে ব্যক্তি তিনবার তালাক শব্দটি পৃথক পৃথকভাবে উচ্চারণ করত তার পক্ষ থেকে যদি এই ওজর পেশ করা হত যে, তার এক তালাকেরই নিয়াত ছিল এবং অবশিষ্ট দুইবার সে কেবল নিশ্চিত করার জন্য এই শব্দ ব্যবহার করেছে তাতে তার ওজর মহানবী (স) অনুমোদন করতেন।
হযরত উমার ফারূক (রা) তার যুগে যা কিছু করেছেন তা শুধু এই যে, লোকেরা যখন ব্যাপকভাবে তিন তালাক দিয়ে এক তালাকের ব্যাপারটি খেলায় পরিণত হতে যাচ্ছে, তাই আমি এই ওজর কবুল করব না এবং তিন তালাককে তিন তালাক হিসাবেই কার্যকর করব। এটাকে সাহাবীগণ ঐক্যবদ্ধভাবে মেনে নেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাবিঈগণ ও মুজতাহিদ ইমামগণও এই সিদ্ধান্তের উপর একমত থাকেন। তাদের মধ্যে কেউই একথা বলেননি যে, হযরত উমার (রা) রিসালাত যুগের আইনের কোন পরিবর্তন করেছেন। কারণ নিয়াতের ওজর কবুল করাটা আইন নয়, বরং যে ব্যক্তি নিজের নিয়াতের কথা বলছে সে বিচারকের রায় অনুযায়ী সত্যবাদী কিনা তার উপর ওজর কবুল করার ব্যাপারটি নির্ভরশীল। মহানবী (স) এর যুগে মদীনার খুব স্বল্প সংখ্যক সাধারণ লোক এ ধরনের ওজর পেশ করেছিল। তাই মহানবী (স) তাদের সত্যবাদী মনে করে তাদের বক্তব্য গ্রহণ করেন। হযরত উমার (রা) -র যুগে ইরান থেকে মিসরপর্যন্ত এবং ইয়ামেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তারিত রাজ্যের প্রতিটি ব্যক্তির এই ওজর আদালতে অপরিহার্যরূপে সমর্থনযোগ্য হতে পারত না। বিশেষত যখন বহু লোক একত্রে তিন তালক দিয়ে এক তালাকের নিয়াতের দাবী করা শুরু করে দিয়ে থাকবে।
২৮. “মুআল্লাফাতুল কুলূব” সম্পর্কে হযরত উমার (রা) এর যুক্তির ধরন-প্রকৃতি
অভিযোগ: “রসূলুল্লাহ (স) এর যুগে মুআল্লাফাতুল-কুলূব (নও-মুসলিম, অথবা যে অমুসলিমের দৃষ্টি ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা উদ্দেশ্য)-এর জন্য যাকাতের খাত থেকে সাহায্য দেয়া হত। হযরত উমার (রা) তার শাসনামলে এই সাহায্য বন্ধ করে দেন।”
উত্তর:এটাকে যদি কোন ব্যক্তি সিদ্ধান্তের মধ্যে রদবদলের দৃষ্টান্ত মনে করে তবে তার এই দাবী করা উচিত যে, শুধু মহানবী (স) এর সিদ্ধান্তই নয়, বরং আল্লাহর নিজের ফয়সালাসমূহের মধ্যেও ‘জাতির কেন্দ্রবিন্দু’ সাহেব রদবদল করতে পারে। কারণ যাকাতে মুআল্লাফাতুল-কুলূবের অংশ মহানবী (স) কোন হাদীসের মাধ্যমে নির্ধারণ করেননি, বরং আল্লাহ তাআলা স্বয়ং কুরআন মজীদে তা নির্ধারন করেছেন (দ্র.সূরা তওবা , ৬০ নং আয়াত)। নিমজ্জিত হওয়ার সময় খড়কুটার উপর ভর করার মত অবস্থা যদি হাদীছ অস্বীকারকারীদের না হয়ে থাকে এবং তারা যদি বিষয়টিতাৎপর্য অনুধাবন করতে চায়, তকে স্বয়ং “মুআল্লাফাতুল কুলূব” শব্দের উপর সামান্য চিন্তা করে তা বুঝতে পারে। পরিভাষাটি নিজেই নিজের অর্থ প্রকাশ করছে যে, যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য তাদেরকে খাত থেকে টাকাপয়সা দেয়া যেতে পারে। হযরত উমার (রা) এর যুক্তি এই ছিল যে, রসূলূল্লাহ (স) এর যুগে মুআল্লাফাতুল কুলুবের জন্য সম্পদ ব্যয় করা ইসলামী সরকারের প্রয়োজন ছিল। এজন্য মহানবী (স) এই খাত থেকে লোকদের দান করতেন। এখন আমাদের রাষ্ট এতটা শক্তিশালী হয়ে গিয়েছে যে, উল্লেখিত উদ্দেশ্য কারো পেছনে অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন আমাদের নেই। অতএব আমরা এই খাতে কোন অর্থ ব্যয় করব না।
উপরোক্ত বিবরণ থেকে কি এই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে, হযরত উমার (রা) মহানবী (স) এর যুগের কোন ফয়সালার পরিবর্তন করেছেন? বাস্তবিকই কি মহানবী (স) এর এমন কোন সিদ্ধান্ত ছিল যে, মন জয়ের প্রয়োজন হোক বা না হোক মোটকথা কিছু লোককে অবশ্যই মুআল্লাফাতুল-কুলূব সাব্যস্ত করা হবে এবং যাকাত থেকে তাদের জন্য সব সময় তাদের অংশ বের করতে হবে? স্বয়ং কুরআন মজীদে কি আল্লাহ তাআলাও এটা বাধ্যতামূলক করেছেন যে, যাকাতের সম্পদের একটি অংশ মুআল্লাফতুল-কুলূব খাতে সর্বাবস্থায় অবশ্যই খরচ করতে হবে?
২৯. বিজিত এলাকা সম্পর্কে হযরত উমার (রা)-র সিদ্ধান্ত কি মহানবী (স) এর সিদ্ধান্তের পরিপন্থী ছিল?
অভিযোগ: “নবী (স) এর যুগে বিজিত এলাকা মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করে দেয় হত। কিন্তু হযরত উমার (রা) তার যুগে এই ব্যবস্থার মূলোচ্ছেদ করেন।”
উত্তর: মহানবী (স) কখনও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি যে, বিজিত এলাকা সবসময় সৈনিকদের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে। তিনি যদি এরূপ কোন ফয়সালা দিয়ে থাকতেন এবং হযরত উমার (রা) তার বিপারীত কাজ করে থাকতেন তবে আপনি বলতে পারতেন যে, তিনি মহানবী (স) এর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। অথবা মহানবী (স) তার সময়ে মুজাহিদদের মধ্যে যেসব জমি বন্টন করে দিয়েছিলেন হযরত উমার (রা) যদি তা তাদের নিকট থেকে ফেরত নিয়ে থাকতেন তবে এই অবস্থায় উপরোক্ত দাবী করা যেত। কিন্তু এই দুই অবস্থার কোনটিই ঘটেনি। আসল ব্যাপার এই যে, বিজিত এলাকা মুজাহিদগণের মধ্যে অপরিহার্যরূপে বন্টন করে দেয়াটা মূলতই কোন ইসলামী আইন ছিল না। বিজিত ভূখন্ড সম্পর্কে মহানবী (স) প্রয়োজন মোতাবেক বিভিন্ন স্থানে বিবিন্নরূপ ফয়সালা দান করেছিলেন। বানূ নাদীর ,বানূ কুরায়যা, খায়বার, ফাদক, ওয়াদিল-কুরা, মক্কাও তায়েফের বিজিত ভুখন্ডসমূহের প্রতিটির বন্দবস্ত নববী যুগে পৃথক পৃথক পন্থায় দেয়া হয়েছিল এবং এমন কোন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি যে, ভবিষ্যতে এসব জমির বন্দবস্ত অপরিহার্যরূপে অমুক পন্থায় দেয়া হবে। তাই হযরত উমার (রা) নিজের যুগে সাহাবীদের সাথে পরামর্শক্রমে বিজিত জমির যেরূপ বন্দবস্তের ব্যবস্থা করেন তাকে মহানবী (স) এর সিদ্ধান্তের মধ্যে রদবদলের দৃষ্টান্ত সাব্যস্ত যেতে পারে না।
৩০. বেতন-ভাতা বন্টনের ব্যাপারে হযরত উমার (রা) এর সিদ্ধান্ত
অভিযোগ:রসূলুল্লাহ (স) লোকদের একই সমান বেতন-ভাতা নির্ধারণ করতেন। কিন্তু হযরত উমার (রা) তা সেবার পরিমাণ অনুযায়ী নির্ধারণ করে মহানবী (স)-এর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। এটি এবং এরূপ আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত পরিবর্তন করেন। এটি এবং এরূপ আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যা থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, খুলাফায়ে রাশেদীনের আমালে অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে মহানবী (স)-এর সিদ্ধান্তসমূহে সংশোধনী আনয়ন করা হয়েছিল।
উত্তর:মহানবী (স) যে সকল কর্মচারীকে একই সমান বেতন-ভাতা দিতেন, একথার কি প্রমাণ আছে?ইতিহাসের আলোকে তো দেখা যায়, এটা হযরত আবু বাকর (রা) এর কাজ ছিল। তাই এটাকে যদি কোন জিনিসের উদাহরণ সাব্যস্ত করা যায় তবে তা এই যে, একজন খলীফা তার পূর্ববর্তী খলীফার সিদ্ধান্তসমূহে সংশোধনী আনয়নের অধিকার রাখেন।
আমার আরজ এই যে, হাদীস অস্বীকারকারীগণ সম্মিলিতভাবে এই ধরনের দৃষ্টান্তসমূহ একটি পূর্ণাংগ তালিকা প্রণয়ন করে পেশ করুন। আমি ইনশাআল্লাহ প্রমাণ করব যে, তার মধ্যে একটি উদাহরণও খিলাফাতে রাশেদার যুগে মহানবী (স) এর সিদ্ধান্তসমূহ রদবদল করার দৃষ্টান্ত নয়।
৩১. কুরআন মজীদের অর্থনৈতিক বিধানসমূহ কি ততকালীন যুগের জন্য ছিল?
অভিযোগ:“আপনি আমার একথা নিয়েও বিদ্রুপ করছেন যে, কুরআনের যেসব বিধান কোন শর্তের অধীনে কার্যকর হয় তা শর্তের অনুপস্থিতিতে মূলতবী থাকবে, যতক্ষণ না পুনশ্চ অনুরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এগুলোকে সমসাময়িক যুগের বিধান হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যাকাতের খাত থেকে “মুআল্লাফাতুল-কুলূব”দের সাহায্য প্রদানের নির্দেশ কুরআন মজীদে বিদ্যমান রয়েছে। হযরত উমার (রা) এই খাতকে এই বলে বন্ধ করে দেন যে, রাষ্টের যতক্ষণ পর্যন্ত এই খাতে ব্যয়ের প্রয়োজন ছিল ততক্ষণ পর্যন্ত এই হুকুম কার্যকর ছিল। এখন সেই প্রয়োজন আর অবশিষ্ট নেই। যেসব লোক কুরআনের এজাতীয় বিধানকে “সমসাময়িক কালের বিধান বলে তাদের উদ্দেশ্যও তাই”।
উত্তর:এই নৈপুণ্যতায় মূলত উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। হাদীস অস্বীকারকারীগণ ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে কমিউনিষ্টদের দৃষ্টিভংগী গ্রহণ করেছে। তারা এর নামকরণ করেছে “কুরআনের প্রতিপালন ব্যবস্থা”। এ সম্পর্কে যখন যখন তাদের বলা হয় যে, কুরআন মজীদে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে যত বিধিবিধান এসেছে, সরাসরি অথবা আকারে ইংগীতে তা উচ্ছেদ করার লক্ষ্য ব্যক্ত করে। তখন তারা উত্তর দেয় যে, এসব বিধান ছিল সমসাময়িক কালের জন্য। অন্য কাথায় যখনই এই কালটি অতিক্রান্ত হয়ে যাবে এবং এসব লোকের মনগড়া “খোদায়ী প্রতিপালন ব্যবস্থা” কায়েম হবে তখন উক্ত বিধানসমূহ রহিত হয়ে যাবে। জনাব পাভেজ সাহেব পরিষ্কার বাক্য বলেছেনঃ
“(প্রশ্ন করা হয়ে থাকে), কুরআনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যদি এই প্রকৃতির হয়ে থাকে, তবে এরপরও তা যাকাত, দান-খয়রাত, উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত বিধিবিধান কেন দিল? এর কারণ এই যে, কুরআন এই ব্যবস্থাকে একই সাথে নিয়ে আসতে চায় না, ক্রমান্বয়ে কায়েম করতে চায়। অতএব যাকাত, দান-খয়রাত, উত্তরাধিকার ইত্যাদি সম্পর্কিত বিধানসমূহ সেই সমসাময়িক কালের সাতে সংশ্লিষ্ট ছিল যেখানে তখনও এই ব্যবস্থা তার সর্বশেষ কাঠামোতে কায়েম হয়নি (দ্র. আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রদত্ত প্রবন্ধ ‘ইসলামী ব্যবস্থায় অর্থনীতি’)।
কিন্তু এসব লোক কুরআনের কোথাও দেখাতে সক্ষম হয়নি যে, আল্লাহ তাআলা তাদের এই মনগড়া “খোদায়ী ব্যবস্থা”-র বিধান দিয়েছেন এবং একথা বলেছেন যে, আমাদের আসল উদ্দেশ্য তো এই “খোদায়ী ব্যবস্থা”-র প্রতিষ্ঠা, অবশ্য এই ব্যবস্থা যতক্ষণ প্রতিষ্ঠিত না হবে ততক্ষণের জন্য আমরা যাকাত, দান-খয়রাত, উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিধিবিধান পালনের নির্দেশ দান করেছি। এই সব কিছুই তাদের স্বকপোলকল্পিত এবং এর পরিবর্তে তারা কুরআনের সুস্পষ্ট ও চুড়ান্ত বিধিবিধানসমূহকে সাময়িক কালের বিধান মনে করে তা উড়িয়ে দিতে চায়। হযরত উমার (রা) মুআলাফাতুল-কুলূব সম্পর্কেযে কথা বলেছিলেন তার সাথে শেষ পর্যন্ত এদের উপরোক্ত বিষয়ের কি সম্পর্কআছে? এর উদ্দেশ্য তো এই ছিল যে, মন জয়ের জন্য যতদিন যাচ্ছিলাম, এখন এখাতে অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন নাই, তাই এখন আমরা তাদেরকে অর্থ সাহায্য দেব না। এটা সম্পূর্ণতকুরআন মজীদে ফকীর-মিসকীনদের যাকাত দেয়ার যে হুকুম দেয়া হয়েছে তদ্রপ্ এই হুকুম অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যতক্ষণ ফকীর বা মিসকীন থাকবে ততক্ষণ আমরা তাকে যাকাত দেব তার এই অবস্থার পরিবর্তন হলে আমরা তাকে যাকাত দেয়া বন্ধ করে দেব। এ কথার সাথে পারভেয সাহেবের “সমসাময়িক কল”-এর মতবাদের দূরতম সম্পর্কও নেই।
৩২. “সমসাময়িক কালের” ভুল ব্যাখ্যা
অভিযোগ: “পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়া পর্যন্ত যে শরীআতের কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্তও মূলতবী রাখা যায়, আপনি নিজেও একথা স্বীকার করেন। যেমন পাকিস্তানের আইন সম্পর্কে আপনি বলেছিলেন, “একটি ইসলামী রাষ্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালনায় অমুসলিদের অংশগ্রহণ শরীআত ও বুদ্ধিবৃত্তি উভয় দিক থেকেই সঠিক নয়। কিন্তু একটি সাময়িক বন্দবস্ত হিসাবে আমরা জায়েয ও যুক্তিসংগত মনে করি যে, দেশের গণপরিষদে তাদের প্রতিনিধিত্ব দেয়া যেতে পারে” (তরজমানুল কুরআন, সেপ্টেম্বর ১৯৫২ খৃ.পৃদ ৪৩০-১)।
উত্তর:এ বিষয়টিও হাদিস অস্বীকারকারীদের দৃষ্টিভংগী ও মতবাদ থেকে সম্পূর্ন ভিন্নতর। অমুসলিমদের সম্পর্কে তো আমাদের নিশ্চিতভাবে জানা আছে যে, ইসলাম তার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালনার দায়িত্বে তাদের শরীক করে না। তাই এই পলিসি কার্যকর করা আমাদের দায়িত্ব এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তা কার্যকর করতে সক্ষম হব না ততক্ষণ আমরা বাধ্য হয়ে যা কিছুই করব তা একটি সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবে করব। পক্ষান্তরে হাদীস অস্বীকারকারীগণ স্বয়ং একটি “খোদায়ী ব্যবস্থা” রচনা করে, যে সম্পর্কে কুরআনের একটি প্রামাণ্য হুকুমও তারা দেখাতে পারবে না এবং ব্যক্তিগত মালিকানা প্রমাণের পক্ষে যে পরিষ্কার ও চুড়ান্ত বিধান কুরআন মজীদে রয়েছে তাকে তারা সাময়িক কালের বিধান মনে করে। এ দুটি কথার মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে।
আমাদের মতে “সাময়িক কালের” সংজ্ঞা এই যে, কুরআন মজীদের কোন বিধান অথবা কুরআন প্রদত্ত কোন পন্থা বা মূলনীতি অনুযায়ী আমল করার ক্ষেত্রে যদি কিছু প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান থাকে তবে তা দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত সাময়িকভাবে আমরা যা কিছুই করব, তা হবে সাময়িক কালের ব্যবস্থা। পক্ষান্তরে হাদীস অস্বীকারকারীদের মতে তাদের নিজস্ব মনগড়া নীতিমালার উপর আমল করার জন্য যতক্ষণ পর্যন্ত পরিবেশ অনুকুল না হবে ততক্ষণ তারা কুরআন প্রদত্ত বিধিবিধানও নীতিমালার উপর কেবলমাত্র একটি সাময়িক ব্যবস্থা হিসাবে আমল করবে।
৩৩. মহানবী (স) কি শুধুমাত্র কুরআনের ভাষ্যকার না আইন প্রণেতাও?
অভিযোগ:“এই প্রশ্নটিও সামনে এসেছিল যে, সুন্নাত কি শুধুমাত্র কুরআনিক বিধান ও নীতিমালার ভাষ্য না কি তা কুরআনিক বিধানের তালিকা বর্ধিতও করে? সঠিক কথা এই যে, কুরআন যেসব বিষয়ে মৌল নির্দেশ দিয়েছে, সুন্নাত তার আনুষংগিক বিষয় নির্ধারণ করে। এটা নয় যে, কুরআন কিছু বিধান প্রবর্তন করল এবং সেই তালিকায় সুন্নাত আরো কিছু বিধান যোগ করল। অবস্থা যদি তাই হত তবে কুরআনিক বিধান যে তালিকা দিয়েছে তা অসম্পূর্ণ ছিল এবং সুন্নাত অতিরিক্ত কিছু যোগ করে তালিকার পূর্ণতা সাধন করে দিয়েছে। কিন্তু আপনি যেখানে এক স্থানে প্রথম অবস্থা বর্ণনা করেছেন, সেখানে অন্যত্র দ্বিতীয় অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। অথচ এই দুটি কথা পরস্পর বিরোধী।
আপনি সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন লোকদের নিকটও জিজ্ঞেস করে দেখুন (আপনার বক্তব্য অনুযায়ী) রসূলুল্লাহ (স) এর বণী: “ফুফু-ভাইঝি এবং খালা-ভাগ্নীকে একত্রে বিবাহ করাও হারাম” তা কি কুরআনিক বিধান (অর্থাৎ দুই বোন একত্রে বিবাহ করা হারাম) এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না মুহরিমাতের কুরআন প্রদত্ত তালিকায় সংযোজন? প্রত্যেক বিবেকবান ব্যক্তি (তবে শর্ত হচ্ছে সে যদি আপনার মত একগুয়ে না হয় অথবা নির্বোধের মত আচরণ না করে) বলবে যে, তা কুরআনিক তালিকায় সংযোজন। এই আলোচনা থেকে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসে তা এই যে, আল্লাহ তাআলা যেখানে কুরআনিক তালিকায় ফুফু, খালা, বোনঝি, দুধমাতা দুধবোন, স্ত্রীর মা (শাশুড়ি), পুত্রদের স্ত্রীগণ এমনকি পালিত কন্যাদের পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন এবং এও বলে দিয়েছেন যে, দুই বোন একত্রে বিবাহ করা যাবে না, সেখানে কি আল্লাহ তাআলা একথাটুকু বলতে পারলেন না (মাআযাল্লাহ) যে, ফুফু-ভাইঝি ও খালা বোনঝিকে একত্রে বিবাহ করা যাবে না?”
উত্তর:উপরোক্ত গোটা আলোচনার জবাব এই যে, রসূলুল্লাহ (স) কুরআনের ভাষ্যকারও ছিলেন এবং আল্লাহ তাআলার নিয়োগকৃত আইনপ্রণেতাও। তার এই দায়িত্বও ছিল যে, (মানব জাতির জন্য নাযিলকৃত আল্লাহর বিধানের তিনি ব্যাখ্যা করে দেবেন) এবং এই দায়িত্ব ছিল যে- (তিনি লোকদের জন্য পাক জিনিসসমূহ হালাল করেন এবং নাপাক জিনিসসমূহ তাদের জন্য হারাম করেন)। অতএব মহানবী (স) যেরুপ কুরআনিক বিধানের ব্যাখ্যা প্রদানের অধিকারী ছিলেন এবং তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দলীল হিসাবে গন্য, তেমনিভাবে তিনি আইন প্রণয়নের কর্তৃত্ব প্রাপ্ত ছিলেন এবং তার প্রদত্ত বিধান দলীল হিসাবে গন্য। এই দুটি কথার মধ্যে চূড়ান্ত ভাবেই কোন বিরোধ নেই। এখন থাকল ফুফু ও খালার প্রসংগ। হাদীস প্রত্যাখ্যানকারীরা যদি বক্র বিতর্কের রোগে আক্রান্ত না হত তবে সহজেই তাদের বুঝে একথা আসতে পারত যে, কুরআন মজীদ যখন কোন মহিলাকে তার বোনের সাথে একত্রে বিবাহ করতে নিষেধ করেছে তখন তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, দুই বোনের মধ্যে যে সহজাত ভালবাসার সম্পর্ক রয়েছে এবং থাকা উচিত তার হেফাজত করা। মহানবী (স) বলেছেন যে, এই একই কারণ পিতার বোন এবং মায়ের বোনের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। অতএব ফুফু ও ভাইঝি এবং খালা ও বোনঝিকে একত্রে বিবাহ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এটা চাই কুরআনের ব্যাখ্যাই হোক, অথবা কুরআন থেকে নির্গত বিধান (ইসতিম্বাত) হোক অথবা রসূল প্রদত্ত বিধানই হোক মোটকথা আল্লাহর রসূলের হুকুম এবং ইসলামের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত গোটা উম্মাত ঐক্যবদ্ধভাবে তাকে বিধান হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। খারিজীদের একটি উপদল ব্যতীত কেউই এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেনি। আর ঐ উপদলটির যুক্তি ও ঠিক তাই ছিল যা আজ হাদীস প্রত্যাখ্যানকারীরা পেশ করে থাকে যে, এই হুকুম যেহেতু কুরআন মজীদে নাই, অতএব আমরা তা মানব না।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি ডকটর সাহেব এই প্রসংগে উত্থাপন করেছেন তা সবই স্বল্প জ্ঞান ও স্বল্প ধীশক্তির ফল। শরীআতের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি সমূহরে মধ্যে এও একটি যে, কোন একটি বিষয়ে যে জিনিসটি মূল নির্দেশের উদ্দেশ্য (ইল্লাত) ইে একই উদ্দেশ্য যদি অন্য বিষয়েও পাওয়া যায় তবে তার উপরও একইি হুকুম বলবত হবে। উদাহরনস্বরুপ কুরআন মজীদের শুধুমাত্র শরাবপান হারাম করা হয়েছিল। মহানবী (স) বলেন যে, এ প্রসংগে নিষিদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দানের উদ্দেশ্য নেশাগ্রস্ত হওয়া তাই যে কোন নেশাউদ্রেককারী জিনিস হারাম। এখন কেবলমাত্র স্বল্প জ্ঞান সম্পন্ন নির্বোধ ব্যক্তিই এই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে যে, আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য যদি তাই ছিল তবে তিনি কি কুরআন মজীদে ভাং,চরস, তাড়ি ইত্যাদি সকল প্রকার মাদক দ্রব্যের একটি তালিকা দিতে পারতেন না?
৩৪. রসূলুল্লাহ (স) এর অন্তরদৃষ্টি আল্লাহ প্রদত্তত হওয়ার তাৎপর্য
অভিযোগ:“গোটা আরৈাচনার কেন্দ্রবিন্দু এই প্রশ্ন যে, রসূলুল্লাহ (স) এর উপর যি ওহী নাযিল হত তার সবটাই কি কুরআন মজীদে সংকলিত হয়েছে, নাকি কুরআনে ওহীর একটি অংশ প্রবেশ করেছে এবং অপর অংশ সন্নিবেশিত হয়নি? এক্ষেত্রে আপনার উত্তর হলো, ওহীর দুইটি (বরং কয়েকটি) বিভাগ ছিল। তার মধ্যে কেবলমাত্র এক প্রকারের ওহী কুরআনে সন্নিবেশিত হয়েছে, অবশিষ্ট প্রকারের ওহীগুলো কুরআনে সন্নিবেশিত হয়নি। আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আপনি তাফহীমাত গ্রন্থের ১ম খন্ডে লিখেছেন:
“এত সন্দেহ নেই যে, কুরআনই হচ্ছে মৌলিক বিধান। কিন্তু এই বিধান আমদের নিকট কোন মাধ্যম ব্যতীত পাঠানো হয়নি, বরং রসূলে খোদা (স) এর মধ্যস্থতায় প্রেরণ করা হয়েছে। আর রসূলূল্লাহ (স) এজন্য মাধ্যম বানানো হয়েছে যে তিনি মৌলিক বিধানগুলো নিজের ও নিজের উম্মাতের জীবনে বাস্তবায়ন করে একটি নমুনা পেশ করবেন এবং নিজের খোদা প্রদত্ত অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে আমাদের জন্য সেই পন্থা নির্ধারণ করে দেবেন যেভাবে এই মৌলিক বিধানগুলো আমাদের সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত জীবনের আচার-ব্যবহার কার্যকর করা উচিত”(পৃ.২৩৭)।১
ওহীর বৈশিষ্ট্য এবং যেই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বলা হয় তা এই যে, যার নিকট এই ওহী প্রেরণ করা হয় তার অন্তরদৃষ্টি কোন দখল এর মধ্যে থাকে না। যে ‘ওহীর’ আলোকে রসূলুল্লাহ (স) কুরআনের মৌল বিধান কার্যকর করার পন্থা নির্ধারণ করেছিলেন তাও যদি বাস্তবিকই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত হত তার মধ্যে রসূলুল্লা (স) এর অন্তরদৃষ্টির কোন হস্তক্ষেপ হতে পারত না। আর নবী (স) যদি নিজের অন্তরদৃষ্টি সাহায্যে তা নির্ধারণ করতেন তবে তা ওহী হত না। রসূলের অন্তরদৃষ্টি যতই উচ্চ ও উন্নত হোক না কেন তা আল্লাহর ওহী হতে পারে না।
সম্ভবত আপনি বলবেন যে, আমি “খোদা প্রদত্ত অন্তরদৃষ্টি” বলেছি। আর মানবীয় অন্তরদৃষ্টি ও খোদা প্রদত্ত অন্তরদৃষ্টির মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। আপনার জবাব যদি তাই হয় তবে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই যে, আপনি যে দূরদৃষ্টি ও অন্তরদৃষ্টি লাভ করেছেন তা কি আল্লাহ প্রদত্ত নাকি অপর কেউ দান করেছে? প্রত্যেক মানবীয় অন্তরদৃষ্টি আল্লাহ প্রদত্তই হয়ে থাকে”।
উত্তর:এখানে ডকটর সাহেব ‘ওহী’ শব্দের অর্থ অনুধাবনে পুনরায় একই ভুল করেছেন, যে সম্পর্কে আমি আমার সর্বশেষ চিঠিতে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম (দ্র. “ওহী বলতে কি বুঝায়” শীর্ষক অনুচ্ছেদ)। হাদীস প্রত্যাখ্যানকারীদের অতুলনীয় গুণাবলীর মধ্যে এও একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য যে, আপনি যদি তাদের একটি ভ্রান্তি যুক্তির মাধ্যমে দশবারও ভ্রান্ত প্রমাণ করে দেন তারপরও তারা নিজেদের কথার পুনরাবৃত্তি করতে থাকবে এবং আপনার কথার প্রতি মোটেও ভ্রক্ষেপ করবে না।
“আল্লাহ প্রদত্ত দূরদৃষ্টি বা অন্তদৃষ্টি” দ্বারা আমি কোন জন্মগত গুন বুঝাতে চাইনি, যেমন প্রত্যেক ব্যক্তিই জন্মগত ভাবে কোন না কোন গুণের অধিকরী হয়ে থাকে। বরং নবুওয়াতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা রসূলুল্লাহ (স) কে নবূওয়াতের সাথে সাথে যে অন্তরদৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি দান করেছেলেন, এখানে তাই বুঝানো হয়েছে, যার ভিত্তিতে তিনি কুরআনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের গভীর পর্যন্ত পৌছে যেতেন যে পর্যন্ত কোন অ-নবীর পক্ষে পৌছা সম্ভব ছিল না এবং যার আলোকে তিনি নিজে ইসলামের সঠিক পথে চলতেন আর অন্যদের জন্যও পথের দিশা বলে দিতেন। এই অন্তরদৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি নবুওয়াতের অপরিহার্য উপাদান ছিল যা কিতাবের সাথে সাথে মহানবী (স) কে দান করা হয়েছিল যাতে তিনি কিতাবের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বলে দিতে পারেন এবং জীবনের আচার-আচরণে লোকদের পথ প্রদর্শনও করতে পারেন। এই অন্তরদৃষ্টি ও দূরদৃষ্টির সাথে শেষ পর্যন্ত অ-নবীদের দূরদৃষ্টি ও অন্তরদৃষ্টির কি তুলনা হতে পারে?
অ-নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে যে দূরদৃষ্টিই প্রাপ্ত হোক-চাই তা আইনগত দূরদৃষ্টি হোক, অথবা চিকিৎসা বিষয়ক দূরদৃষ্টি হোক, অথবা কারিগরি ও প্রকৌশলগত অথবা অন্য কোন বিষয়ের উপর দূরদৃষ্টি হোক-তা স্বীয় বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে সেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলো থেকে, সেটই পরিপূর্ণ তীক্ষ্নবুদ্ধি ও বোধশক্তি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক-যা নবীকে নবুওয়াতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য দান করা হয়ে থাকে। প্রথম প্রকারের জিনিসটি যতই উচ্চ ও উন্নত পার্যায়েরই হোক, তা অবশ্যই কোন নিশ্চিত জ্ঞানমাধ্যম (Source) নয়। কারণ এই দূরদৃষ্টির সাহায্যে একজন অ-নবী যে সিদ্ধান্তে পৌছে ততসম্পর্কে সে চুড়ান্তভাবে জানে না যে, এই সিদ্ধন্তে পৌছে ততসম্পর্কে সে চূড়ান্তভাবে জানে না যে, এই সিদ্ধান্ত কি আল্লাহর পথনির্দেশে প্রাপ্ত হচ্ছে না নিজের ব্যক্তিগত চিন্তা-গবেষণার সাহায্যে। পক্ষান্তরে নবীর উপর অবতীর্ণ কিতাব যেরূপ নিশ্চিত জ্ঞানের উৎস, এই দ্বিতীয় জিনিসটি ঠিক তদ্রুপ নিশ্চিত জ্ঞানের উৎস। কারণ একজন নবী পূর্ণ সচেতনতার সাথে জানতে পারেন যে, এই পথপ্রদর্শন আল্লার পক্ষ থেকে হচ্ছে।
কিন্তু হাদীস প্রত্যাখ্যানকারীদের নবীর সত্তার সাথে যে চরম শত্রুতা রয়েছে তার কারণে নবীর প্রতিটি মহত্ত ও মর্যাদাকে তারা পদদলিত করছে। তারা প্রাণান্তকর চেষ্টারমাধ্যমে প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে, নবী ও সাধারণ জ্ঞানবান ব্যক্তিদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যদি তার কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থেকেও থাকে তবে তা এতটুকু যে, আল্লাহ তাআলা নিজের ডাক বান্দাদের পর্যন্ত পৌছে দেয়ার জন্য তাকে রানার ডাক হরকরা নিযুক্ত করেছিলেন।
ক্সএর পরের বাক্যাংশ যা ডকটর সাহেব বর্জন করেছেন তা এই যে, “অতএব কুরআনের আলোকে সঠিক পদ্ধতি হলো: প্রথমে আল্লাহ প্রদত্ত মৌলিক বিধানসমূহ অতপর আল্লাহর রসূল প্রদত্ত পন্থা, অতপর উভয়টির আলোকে আমাদের কর্তৃত্ব সুম্পন্ন ব্যক্তিগণের ইজতিহাদ:
“আল্লাহর আনুগত্য কর, রসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বসম্পন্ন লোকদেরও” (সূরা নিসা: ৫৯)।
৩৫. কুরআনের আলোকে ওহীর শ্রেণীবিভাগ
অভিযোগ: “আপনি আল্লাহ প্রদত্ত ওহীর বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ প্রমাণের জন্য সূরা আশ-শরারা ৫১ নং আয়াত পেশ করেছেন। তার অনুবাদ আপনি এভাবে করেছেন:
“কোন মানুষের মর্যাদা এই নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যমে ব্যতিরেকে, অথবা পর্দার অন্তরাল থেকে অথবা এভাবে যে, একজন দূত প্রেরণ করবেন এবং সে আল্লাহর অনুমতিক্রমে ওহী করবে যা কিছু আল্লাহ চান। তিনি মহান ও প্রজ্ঞাময়।”
প্রথমত, আপনি (কুরআনের উপর আমার দূরদৃষ্টি অনুযায়ী) এই আয়াতের শেষাংশের অর্থই বুঝেননি। আমি এ আয়াত থেকে এই বুঝেছি যে, এখানে আল্লাহ তাআলা শুধুমাত্র নবী-রসূলগণের সাথে বাক্যলাপের পন্তাগুলো সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছেন না, বরং এখানে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে তার বাক্যলাপের পন্থা কি। প্রকাশ থাকে যে, মানুষ দুই প্রকারের। এক, নবী-রসূলগণ এবং দুই, অ-নবী মানুষ। অত্র আয়াতের প্রথম দুই অংশে আম্বিয়ায়ে কিরামের সাথে বাক্যলাপ করার দুটি পন্থার উল্লেখ রয়েছে। একটি পন্থাকে ওহী শব্দের দ্বারা বুঝানো হয়েছে-যার অর্থ হচ্ছে নবীর অন্তরে ওহীর অবতরণ যা হযরত জিবরীল (আ) এর মধ্যস্থতায় হত। আর দ্বিতীয় পন্থা ছিল সরাসরি আল্লাহর বাক্যধ্বনি-যা পর্দার অন্তরাল থেকে শুনিয়ে দেয়া হত এবং এর বিশেষ উল্লখ পাওয়া যায় হযরত মূসা (আ) এর আলোচন্য়া। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে পরিষ্কার উল্লেখ আছে:وكلم الله موسى تكليما .। অন্যত্র আছে যে, হযরত মূসা (আ) আকাংখা ব্যক্ত করেন, যে মহান সত্তা আমার সাথে পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলেন আমি তাকে উন্মুক্ত অবস্থায় দেখতে চাই। এই অংশের “আম্বিয়ায় কেরাম স্বপ্নের মাধ্যমে ওহী প্রাপ্ত হতেন” এরূপ অর্থ করা কোন ক্রমেই সঠিক হতে পারে না। আয়াতের তৃতীয় অংশে বলা হয়েছে, সাধারণ মানুষের সাথে আল্লাহ পাকের বাক্যলাপ করার পন্থা এই যে, তিনি তাদের নিকট রসূল প্রেরণ করেন। এই রসূলের নিকট আল্লাহ ওহী পাঠান এবং রসূল এই ওহী সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেন। অন্য কথায়, আমরা যখন কুরআন মজীদ পাঠ করি তখন আল্লাহ যেন আমাদের সাথে বাক্যালাপ করছেন।”
উত্তর:কুরআন সম্পর্কে এখানে দূরদৃষ্টির যে নমুনাপেশ করা হয়েছে তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ জানার জন্য খুব দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কুরআন মজীদের সূরা শূরার ৫ম রুকূ বের করে দেখে নিন। ডকটর সাহেব যে আয়াতের উপরোক্ত অর্থ বর্ণনা করেছেন ঠিক তার পরের আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“এবং এভাবে (হে নবী) আমরা আমাদের নির্দেশের একটি রূহ তোমার দিকে ওহী পাঠিয়েছি। তুমি কিছুই জানতে না কিতাব কাকে বলে, ঈমান কি জিনিস। কিন্তু আমরা সেই রূহকে একটি আলো বানিয়ে দিয়েছি, যার সাহায্যে আমরা বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ দেখাই। আর নিশ্চিত তুমি সঠিক-সোজা দিকে পথ দেখাচ্ছ”-(আয়াত: ৫২)।
এ থেকে পরিষ্কার জানা যাচ্ছে যে, পূর্বোক্ত আয়াতের কোন অংশই সাধারণ মানুষ পর্যন্ত আল্লাহর বাণী পৌছানোর পন্থা বর্ণনা করছে না, বরং তাতে শুধুমাত্র আল্লাহ তার নবীর নিকট যে পন্থায় তার বাণী পৌছান তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে।আল্লাহর বিধানসমূহ পৌছার যে তিনটি পন্থাল কথা তাতে উল্লেখিত হয়েছে সেদিকেই এ আয়াতে (আর এভাবে) শব্দটি ইংগীত করেছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা রসূলুল্লাহ (স) কে বলছেন, উপরোক্ত তিনটি পন্থায় আমরা আমাদের নির্দেশের একটি রূহ তোমার প্রতি ওহী করেছি। অর্থ ‘জিবরীল আমীন’ গ্রহণ করা যায় না, কারণ যদি তাই বুঝানো হত হবে বলার পরিবর্তে …..বলা হত। এজন্য “নির্দেশের রূহ” অর্থ সেই সকল হেদায়াত যা উল্লেখিত তিনটি পন্থায় মহানবী (স) এর উপর ওহী করা হয়েছে। অতপর শেষের দুটি বাক্যাংশে ঘটনাবলীর পারস্পর্য এই বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের মধ্যে থেকে এক বান্দার পথ প্রদর্শন সেই আলোর দ্বারা করেছেন যা “নির্দেশের রূহ” এর আকারে তার নিকট পাঠানো হয়েছে এবং এখনও সেই বান্দা সিরাতে মুস্তাকীমের দিকে লোকদের পথপ্রদর্শন করছেন।
তথাপি যদি পূর্বাপর সম্পর্ক অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র ঐ একটি আয়াতের উপর দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করে নেয়া হয় যার ব্যাখ্যা ডকটর সাহেব প্রদান করেছেন তবুও তার সেই তাৎপর্য হতে পারে না, যা তিনি তা থেকে বের করার চেষ্টা করেছেন। ঐ আয়াতের তৃতীয় অংশের তিনি এই ব্যাখ্যা করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা সাধারন মানুষের নিকট রসূল প্রেরণ করেন, রসূলের নিকট আল্লাহ ওহী পাঠান এবং রসূল এই ওহী সাধারণ লোকদের নিকট পৌছে দেন। অথচ আয়াতের মূল পাঠ এই যে:
“অথবা তিনি একজন বার্তাবাহক পাঠান, অতপর সে তার নির্দেশ অনুযায়ী ওহী করে যা তিনি চান।”
উক্ত বাক্যাংশে “রসূল” শব্দের অর্থ যদি ফেরেশতা পরিবর্তে “মানুষ রসূল” করা হয় তবে তার অর্থ এই দাড়ায় যে, রসূল সাধারণত মানুষের উপর ওহী করেন। বাস্তবিকই কি সাধারণ মানুষের উপর আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম ওহী করতেন? ওহী শব্দের অর্থই তো সূক্ষ্ম ইংগীত এবং গোপন বাক্যালাপ। আম্বিয়া আলাইহিমুস-সালাম আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে প্রকাশ্যে যে প্রচারকার্য করতেন তা বুঝানোর জন্যও আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে না, আর কুরআনের কোথাও তা এই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। এখানে তো ‘রসূল’ শব্দটি পরিষ্কারভাবে সেই ফেরেশতার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে যিনি আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের নিকট ওহী নিয়ে আসতেন। তার বার্তা পৌছিয়ে দেয়ার কাজটিকে “ওহী করা” শব্দের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং করা যেতে পারে।
৩৬. ওহী গায়র মাতলূর উপর ঈমান আনয়ন রসূলের উপর ঈমানের অংশ
অভিযোগ:“আম্বিয়ায় কিরামের নিকট যে ওহী আসত তার শ্রেণীবিভাগ উল্লেখ কুরআনের কোথাও নেই। অথবা এ ধরনের কোন উল্লেখও কুরআনের কোথাও আসেনি যে, কুরআন শুধুমাত্র এক ধরনের ওহীর সমষ্টি এবং অবশিষ্ট শ্রেণীর ওহীসমূহ-যা রসূলুল্লাহ (স) কে দান করা হয়েছিল তা অন্য কোথাও সংকলিত আছে। পক্ষান্তরে রসূলুল্লাহ (স) এর জবানীতে স্বয়ং কুরআন মজীদে একথা বলানো হয়েছে যে …. আমার নিকট এই কুরআন ওহী করা হয়েছে।”-(সূরা আল-আনআম:১৯)।
কুরআনের কোন এক স্থানেও কি উল্লোখ আছে যে, আমার নিকট কুরআন ওহী করা হয়েছে এবং তা ছাড়া আরও ওহী পাওয়া গেছে যা কুরআনে উল্লেখ নাই? আসল কথা হচ্ছে আপনি ওহীর গুরুত্বই বুঝতে পারেননি। ওহীর উপর ঈমান আনয়ন করায় কোন ব্যক্তি মুমিন হতে পারে এবং ঈমান পূণাংগ ও পরিপূর্ণ ওহরি উপর ঈমান আনায়নের নাম। এই নয় যে, ওহীর এক অংশের উপর ঈমান আনা হবে এবং অপরাংশের উপর ঈমান আনা হবে না।”
উত্তর:“কুরআন ব্যতীতও মহানবী (স) এর উপর ওহীর মাধ্যমে বিধি বিধান নাযিল হত’’ শীর্ষক আলোচনা সম্পর্কিত পত্রালাপে এই বিষয়ের প্রমাণ ইতিপূর্বে পেশ করা হয়েছে [“কুরআন ছাড়াও কি মহানবী (স) এর উপর আরও কোন ওহী আসত?” শীর্ষক অনুচ্ছেদ দ্র.]। এখন থাকল এই প্রশ্ন যে দ্বিতীয় প্রকারের ওহীর উপর ঈমান আনায়নের নির্দেশ কোথায় দেয়া হয়েছে? এর জওয়াব এই যে, এর উপর ঈমান আনা মূলত রিসালাতের উপর ঈমান আনার এক অপরিহার্য অংশ। আল্লাহ তাআলা তার কিতাব ছাড়াও তার রসূলের উপর ঈমান আনার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা স্বয়ং দাবী করে যে, রসূল যে পথর্নিদেশ ও শিক্ষাই দান করেন তার উপর ও ঈমান আনতে হবে। কারণ তা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত “যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করল সে মূলত আল্লাহর আনুগত্য করল”-সূরা নিসা: ৮০)। “তোমরা যদি তার আনুগত্য কর তেব সৎপথপ্রাপ্ত হবে”। (সূরা নূর: ৫৪)। এই নবীগণ সেইসব লোক যাদের আল্লাহ হেদায়াত দান করেছেন। অতএব তোমরা তাদের হেদায়াতের অনুসরণ কর”-(আল-আনআম:৯১)।
ডকটর সাহেবের হয়ত জানা নাই যে, এমন অসংখ্য নবী অতিক্রান্ত হয়েছে যাদের উপর আদৌ কোন কিতাব নাযিল হয়নি। কিতাব তো কখনও নবী ছাড়া আসেনি, কিন্তু কিতাব ছাড়াও নবী এসেছেন। লোকেরা তাদের শিক্ষা ও পথনির্দেশের উপর ঈমান আনতে এবং তাদের অনুশীলন করতে ঠিক তদ্রুপ আদিষ্ট ছিল যেভাবে আল্লাহর কিতাবের উপর ঈমান আনতে এবং তা অনুসরণ করতে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। স্বয়ং কিতাব আনয়নকারী নবীগণের উপর প্রথম দিন থেকেই ওহী মাতলূ (প্রত্যক্ষ ওহী) নাযিল হওয়া একান্ত জরূরী নয়। হযরত মূসা (আ) এর উপর তাওরাত কিতাব ঠিক তখন নাযিল শুরু হয় যখন তিনি ফিরাউনের ডুবে মরার পর বণী ইসরাঈলদের নিয়ে তুর পর্বতের পাদদেশে পৌছেন (সূরা আল-আরাফ: ১৩০-১৪৭নং আয়াত এবং আল-কাসাস: ৪০-৪৩ নং আয়াত দ্র.)। মিসরে অবস্থানকালে তার উপর কোন কিতাব নাযিল হয়নি। কিন্তু তা সত্তেও ফিরাউন এবং মিসরের প্রাতিটি অধিবাসী আল্লাহর পক্ষ থেকে তার পেশকৃত প্রতিটি কথার উপর ঈমান আনতে আদিষ্ট ছিল। এমনকি এসব কথার উপর ঈমান না আনার কারণে ফিরাউন স্বীয় সৈন্যবাহিনী সমেত শাস্তির শিকার হল।
হাদিস প্রত্যাখ্যানকারীরা যদি এই জিনিসটি মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তবে আমি তাদের জিজ্ঞেস করতে চাই যে, কুরআনের বর্তমান ক্রমবিন্যাস আল্লাহর পক্ষ থেকে হওয়ার উপর আপনারা ঈমান রাখেন কি না? কুরআনে স্বয়ং একথা পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, এই পবিত্র গ্রন্থ একই সময় একটি সুসংবদ্ধ গ্রন্থকারে নাযিল হয়নি, বরং তা বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে অল্প অল্প করে নাযিল করা হয়েছে (দ. সূরা বনী ইসরাঈল: ১০৬ নং আয়াত এবং আল- ফুরকান: ৩২ নং আয়াত)। অপর দিকে একথাও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে যে, তা সুসংবদ্ব করে পড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তাআলা গ্রহণ করেছিল।
এ থেকে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন মজীদের বর্তমান ক্রমবিণ্যাস সরাসরি আল্লাহ তাআলার নির্দেশনার অধীনে হয়েছে মহানবী (স) নিজ মর্জি মাফিক তার বিন্যাস করেননি। এখন কেউ কি কুরআন মজীদে থেকে এমন কোন নির্দেশ বের করে দেখাতে পারবে যে, এর সূরাসমূহ বর্তমান বিন্যাস অনুযায়ী পড়তে হবে এবং এর বিভিন্ন আয়াতসমূহকে কোথায় কোন প্রেক্ষাপটে রাখতে হবে? যদি কুরআন মজীদে এ ধরনের কোন হেদায়াত না থেকে থাকে এবং এটা সুস্পষ্ট যে, এধরনের কোন হুকুম তাতে নাই, তখন অবশ্যম্ভাবীরূপে কুরআন বহির্ভূত কিছু নির্দেশ আল্লাহর পক্ষা থেকে মহানবী (স) লাভ করে থাকবেন যার অধীনে তিনি এই পবিত্র গ্রন্থ বর্তমান বিন্যাস পাঠ করেছেন এবং সাহাবীদের পড়িয়েছেন। উপরন্ত সূরা আল-কিয়ামায় আল-কিয়ামায় আল্লাহ এও বলেছেন যে-“অতপর এর তাৎপর্য বুঝিয়ে দেয়া আমারদের দায়িত্ব”-(আয়াত নং ১৯)।
উপরোক্ত আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরআনের বিধিবিধান ও শিক্ষার যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মহানবী (স) নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে দান করতেন তা তার নিজস্ব মস্তিষ্ক প্রসূত ছিল না, বরং যেই মহান পবিত্র সত্তা তার উপর কুরআন নাযিল করতেন তিনিই তাকে এর তাৎপর্য বুঝিয়ে দিতেন এবং এর যেসব বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ দানের প্রয়োজন ছিল তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতেন। কুরআনের উপর ঈমানের দাবীদার কোন ব্যক্তিই তা মানতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে না।
৩৭. পরোক্ষ ওহী (ওহী গায়র মাতলূ)-ও কি জিবরীল (আ) নিয়ে আসতেন?
অভিযোগ: “আপনি লিখেছেন, কুরআন করীমে শুধুমাত্র জিবরীল (আ) এর মাধ্যমে নবী (স) এর উপর নাযিলকৃত ওহী লিপিবদ্ধ আছে। প্রথমতো বলুন যে, আপনি কোথা থেকে জানতে পারলেন যে, জিবরীল (আ) এর মধ্যস্থতা ছাড়াও মহানবী (স) এর উপর ওহী নাযিল হত? দ্বিতীয়তো খুব সম্ভব আপনার জানা নাই যে, আপনি যে, ওহীকে জিবরীল (আ) এর মধ্যস্থতা ব্যতিরেকে ওহী বলেন (অর্থাৎ হাদীস) সে সম্পর্কে হাদীসকে ওহীবলে স্বীকৃতিদানকারীগণের আকীদা-বিশ্বাস এই যে, জিবরীল (আ) কুরআন নিয়ে যেভাবে অবতীর্ণ হতেন ঠিক সেভাবে এই হাদীস নিয়েও অবতীর্ণ হতেন (জামে বায়নিল ইলম গ্রন্থ দ্র.)। অতএব আপনার এই বর্ণনা স্বয়ং আপনার সম্প্রদায়ের নিকটও গ্রহণযোগ্য নয়।”
উত্তর: এক আশ্চর্য ধরনের রোগ যে, যে কথার উৎস বারবার বলে দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় এর উৎস কি? সূরা শূরার ৫১ নং আয়াত যে সম্পর্কে এইমাত্র ডকটর সাহেব স্বয়ং আলোচনা করে এসেছেন তা থেকে একথা পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয় যে, জিবরীল (আ) এর মধ্যস্থতা ছাড়াও আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের উপর ওহী নাযিল হত। মনে হয় ডকটর সাহেব ‘জামে বায়ানিল ইলম’ গ্রন্থের আকৃতিও দেখেননি এবং উড়ন্তভাবে কোথাও থেকে তার বরাত দিয়েছেন। এই গ্রন্থে তো হাসসান ইবন আতিয়্যার নিম্নোক্ত বক্তব্য নকল করা হয়েছে:
“রসূলুল্লাহ (স) এর উপর ওহী নাযিল হত এবং জিবরীল (আ) এসে তার ব্যাখ্যা করতেন এবং তার উপর আমল করার পন্থা বলে দিতেন।”
উপরোক্ত বাক্য থেকে এই অর্থ কোথায় পাওয়া গেল যে, প্রতিটি ওহী জিবরীল নিয়ে আসতেন? তা থেকে তো শুধু একথাই জানা যায় যে, জিবরীল (আ) কুরআন ছাড়াও অন্যান্য ওহী নিয়ে আসতেন। “জিবরীলও আনতেন” এবং “জিবরীলই আনতেন” এ দুটি কথার পার্থক্য অনুধাবন করা তো খুব কষ্টকর কাজ নয়।
৩৮. কিতাব ও হিকমাত (বিচক্ষণতা) কি একই জিনিস না স্বতন্ত্র জিনিস?
“আপনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলা “কিতাব ও হিকমাত” উভয়কে আল্লাহর তরফ থেকে নাযিলকৃত বলেছেন। কিতাব অর্থ কুরআন এবং হিকামত অর্থ সুন্নাত অর্থাৎ হাদীস। কুরআনের উপর আপনার এরুপ অভিজ্ঞতার জন্য যতই বিলাপ করা হোক তা কমই হবে। বান্দা নাওয়াজ! কিতাব ও হিকমাত এর মাঝখানে ওয়াও অক্ষরটি সংযোগ অব্যয় নয় (যার অর্থ “এবং” হয়ে থাকে) এটা ব্যাখ্যামূলক ‘ওয়াও’। এর প্রমাণ কুরআন মজীদেই বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ তাআলা কুরআনকেই স্বয়ং হাকীম (হিকমাতময়) বলেছেন। …………….. অন্যত্র আল-কিতাব কে আল-হাকীম বলেছেন।…………..
উত্তর:হাদীস অস্বীকারকারীরা এই ভ্রান্তিতে লিপ্ত আছে যে, ‘ওয়াও’ অক্ষরের অর্থ গ্রহণের ব্যাপারে মানুষ পূর্ণ স্বাধীন, যেখানে ইচ্ছা এটাকে সংযোগ অব্যয় বলবে এবং যেখানে ইচ্ছা তাকে ‘ব্যাখ্যামূলক ‘ওয়াও’ সাবস্ত করবে। কিন্তু তাদের জানা উচিত, শুধু আরবী ভাষায়ই নয়, যে কোন ভাষার সাহিত্যেই শব্দের অর্থ নির্ধারনের বিষয়টি এভাবে খেয়ালী নয়। ওয়াও-কে ব্যাখ্যামূলক কেবলমাত্র তখনই সাব্যস্ত করা যেতে পারে যখন এই অক্ষরটি যে দুটি শব্দের মাঝখানে এসেছে তা পরস্পর সমার্থবোক, অথবা সম্বন্ধ থেকে মনে হয় যে, বক্তা তাকে সমার্থবোধক সাব্যস্ত করতে চায়। কিন্তু যেখানে এ অবস্থা নাই সেখানে ‘ওয়াও’ অক্ষর হয় দুটি ভিন্ন জিনিস একত্র করার জন্য ব্যবহৃত হয়, না হয় সাধারণকে বিশেষের সাথে অথবা বিশেষকে সাধারনের সাথে সম্পৃক্ত সম্পূর্ণ অস্পষ্ট।
এখন দেখুন, আরবী ভাষার আলোকে একথা পরিষ্কার যে, কিতাব ও হিকমাত শব্দদ্বয় সমার্থবোধক নয়, বরং উভয়টি দুটি স্বতন্ত্র অর্থ প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়। এখন কুরআনের আলোকেও বলা যায় যে, কুরআনে শব্দদুটির ব্যবহার দ্বারা প্রমানিত হয় না যে, তা হিকমাতকে কিতাবের সমার্থবোধক সাব্যস্ত করে। সূরা নাহল-এ আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমার প্রতিপালকের রাস্তার দিকে হিকমাতের সাথে ডাক।” এর অর্থ কি এই যে, কুরআনের সাথে ডাক?
হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে সূরা যুখরুফ এ আছে “ সে বলল, আমি তোমাদের নিকট হিকমাতসহ এসেছি।” এর অর্থ কি এই যে, আমি কিতাবসহ এসেছি? সূরা বাকারায় আছে “যাকে হিকমাত দেয়া হয়েছে তাকে প্রচুর কল্যাণ দান করা হয়েছে।” এর অর্থ কি এই যে, তাকে কিতাব দেয়া হয়েছে? সূরা লুকমান-এ লুকমান হাকীম সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“আমরা লুকমানকে হেকমাত দান করেছি।” এর কি এই যে, তাকে কিতাব দেয়া হয়েছে?
মূলত কুরআনের কোথাও ‘কিতাব’ বলে ‘হিকমাত’ বুঝানো হয়নি এবং ‘হিকমাত‘ বলেও ‘কিতাব’ বুঝানো হয়নি। যেখানেই ‘কিতাব’ শব্দটি এসেছে- তার দ্বারা আল্লাহ তাআলার অবতীর্ণ আয়াতসমূহের সমষ্টিকে বুঝানো হয়েছে। আর যেখানেই ‘হিকমাত’ শব্দটি এসেছে সেখানে এমন বুদ্ধিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যার সাহায্যে মানুষ প্রকৃত সত্য অনুধাবনে এবং চিন্তায় ও কাজে সঠিক দৃষ্টিভংগি গ্রহণে সক্ষম হয়। এ জিনিস কিতাবের ক্ষেত্রেও হতে পারে, আবার কিতাবের বাইরেও হতে পারে। কিতাবের জন্য যেখানে ‘হাকীম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, সেখানে অবশ্যই তার অর্থ এই যে, কিতাবের মধ্যে হিকমাত আছে, কিন্তু এই অর্থ নয় যে, স্বয়ং কিতাবই হিকমাত, অথবা হিকমাত শুধুমাত্র কিতাবেই আছে এবং তার বাইরে কোন হিকমাত নেই।
অতএব রসূলুল্লাহ (স) এর উপর কিতাব ও হিকমাত নাযিল হওয়ার এরূপ অর্থ গ্রহণ ঠিক হবে না যে, মহানবী (স) এর উপর কেবলমাত্র কিতাব নাযিল করা হয়েছে। বরং এর সঠিক অর্থ এই হবে যে, তার উপর কিতাবরে সাথে সাথে কর্মকৌশল, বুদ্ধিজ্ঞান ও প্রজ্ঞাও নাযিল করা হয়েছে যার সাহায্যে তিনি এই কিতাবের উদ্দেশ্য সঠিকবাবে অনুধাবন করেছেন এবং মানবজীবনে তাকে সর্বাধিক সঠিক পন্থায় কার্যকর করে দেখিয়েছে। অনুরূপভাবে ……….. বাক্যের অর্থ কখনও এই নয় যে, রসূলুল্লাহ (স) শুধুমাত্র কিতাবের বাক্যগুলো পড়ে শুনিয়ে দেবেন। বরং তার অর্থ এই যে, তিনি লোকদের কিতাবরে অর্থ ও তাৎপর্য বুঝিয়ে দেবেন এবং তাদেরকে সেই বুদ্ধিজ্ঞান ও কর্মকৌশলের প্রশিক্ষণ দেবেন যার সাহায্যে তারা পৃথিবীর জীবনব্যবস্থাকে আল্লাহর কিতাবের লক্ষ ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
৩৯. ‘তিলওয়াত’ শব্দের অর্থ
অভিযোগ:“কুরআনই যে হিকমাত তা প্রমাণের জন্যে সর্বাধিক শক্তিশালী দলীল হচ্ছে আপনার উধৃত সূরা আহযাবের আয়াত যে সম্পর্কে আপনি এতটুকুও চিন্তা করেননি যে, আপনি কি বলছেন। আয়াতটি এখানে উল্লেখ করা হল:
আপনি উত্তমরুপেই অবগত আছেন যে, আপনি কুরআনে সন্নিবেশিত ওহীকে ওহী মাতলু এবং কুরআনের বহির্ভুত ওহীকে ওহী গায়র মাতলু বলে থাকেন।
অত্র আয়াতে হিকমাতকেও ‘মা ইউতলা’ বলা হয়েছে। অতএব হিকমাত বলে ওহী মাতলূ-কেই বুঝানো হয়েছে, ওহী গায়র মাতলূ নয়। অন্যত্র কুরআনকে ওহী মাতলূ বলা হয়েছে। যেমন সূলা কাহফে আছে …………………….. অন্যত্র …………………উপরন্তু কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ………… বাক্য এসেছে, হাদীসসমূহের তিলাওয়াতের কথা আসেনি। তাই সূরা আহযাবে যে হিকমাত এর তিলওয়াতের কথা এসেছে সেই হিকমাত অর্থ কুরআন।
উত্তর: এই প্রকারের দলীল পেশও অজ্ঞাতা এবং জ্ঞানের স্বল্পতার উপর ভিত্তিশীল। “তিলাওয়াত” শব্দটিকে একটি পরিভাষা হিসাবে কেবলমাত্র কুরআন পাকের তিলাওয়াত অর্থে পরবর্তী কালের বিশেষজ্ঞ আলেমগণ ব্যবহার করেছেন যার ভিত্তিতে ‘ওহী মতলূ’ ও ওহী গায়র মাতলূ’ পরিভাসাদ্বয় প্রচলিত হয়েছে। কুরআন মজীদে ‘তিলাওয়াত’ শব্দটি শুধুমাত্র ‘পড়া’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, পরিভাষা হিসাবে কেবলমাত্র কুরআনের আয়াত তিলাওয়াতের জন্য বিশেষিত করা হয়নি। যদি এতে সমান্যও সন্দেহ থেকে থাকে তবে সূরা বাকারার ১০২ নং আয়াত দেখা যেতে পারে ‘আর তারা অনুসরণ করল সেই জিনিস যা সূলায়মানের রাজত্বকালে শয়তান তিলাওয়াত করত।”
৪০. কিতাবের সাথে মীযান অবতীর্ণ হওয়ার অর্থ
অভিযোগ: “আপনি বলেছে, অতপর কুরআন মজীদ আরও একটি জিনিসের কথাও উল্লেখ করেছে যা আল্লাহ তাআলা কিতাবের সাথে নাযিল করেছেন। তা হচ্ছে আল-মীযান, অর্থাৎ পথপ্রর্শনের যোগ্যতা। প্রকাশ থাকে যে, এই তৃতীয় জিনিসটি না রসূলুল্লাহ (স) এর কথার মধ্যে শামিল আছে আর না কাজের মধ্যে। অন্যভাবে বলা যায়, রসূলুল্লাহ (স) এর কথা ও কাজ যেভাবে কুরআন থেকে পৃথক ছিল, ঠিক তেমনিভাবে নবী (স) এর কথা ও কাজ সেই আসমানী পথনির্দেশ থেকেও পৃথক ছিল যাকে আল-মীযান বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। আশ্চর্য হতে হয় যে, আপনি সূরা হাদীদ এর ২৫নং আয়াতের এতটুকু কেন নকল করলেন যাতে কিতাব ও মীযান এর উল্লেখ আছে। আর উক্ত আয়াতের (‘আর আমরা লোহা নাযিল করেছি”) অংশটুকু কেন বাদ দিলেন? এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, কিতাব ও মীযনের সাথে চতুর্থ জিনিস আল-হাদীদ ( লোহা) ও অনুরূপভঅবে আল্লাহ পক্ষ থেকে নাযিলকৃত।”
উত্তর: এই আলোচনা যদি কেবল বিতর্কের উদ্দেশ্য না হত তবে এটা হৃদয়ংগম করা মোটেই কষ্টসাধ্য ছিল না যে, রসূলুল্লাহ (স) এর পবিত্র সীরাত (জীবনচরিতা) এবং তার কথ ও কাজের মধ্যে প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তি আল্লাহ প্রদত্ত হিকমাত (প্রজ্ঞা) ও ন্যায়ের মীযান তার কথা ও কাজের মধ্যে শামিল ছিল তখন এই মীযান তার কাত ও কাজের বহির্ভূত হওয়া উচিত এখানে এরূপ বিতর্কের সৃষ্টি করা মূলত বক্র বিতর্কের একটি নিকৃষ্ট নমুনা। কোন ব্যক্তির কথা ও কাজের মধ্যে যুগপতভাবে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যেতে পারে এবং ভারসাম্যও। এই দুটি জিনিসের মধ্যে কি এমন কোন বৈপরিত্য আছে যে, একটির উপস্থিতিতে তার সাথে অপরটি বর্তমান থাকতে পারবে না? এসব কথা থেকে অনুমান করা যায় যে, হাদীস অস্বীকারকারীরা কতটা বক্রবুদ্ধি ও বক্র বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। এখানে আরও একটি কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার যে, আমি মীযান শব্দটি শুধুমাত্র পথপ্রদর্শনের সাধারণ যোগ্যতা অর্থে ব্যবহার করিনি, বরং সেই যোগ্যতা যার সাহায্যে মহানবী (স) আল্লাহর কিতাবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করেছেন।
আল-হাদীদ ( লোহা) সম্পর্কিত অভিযোগের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, পাঠকগণ অনুগ্রহপূর্বক স্বয়ং সূরা হাদীদ-এর ২৫ নং আয়াত পাঠ করে দেখুন। তাতে কিতাব ও মীযান সম্পর্কে তো বলা হয়েছে- (আমরা এই দুটি জিনিস নবীদের সাথে নাযিল করেছি)। কিন্তু লোহা সম্পর্কে শুধু লা হয়েছে-. (এবং আমরা লোহা নাযিল করেছি)। তাই এই জিনিসটিকে বিশেষভাবে নবীদেরকে প্রদত্ত কিতাব ও মীযানের অধীনে রেখে ব্যবহার করেন। এখন লোহা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত হওয়ার বিষয়টি হাদীস অস্বীকারকারীদের জন্য অদ্ভুত কান্ড। কিন্তু কুরআন মজীদের পরিষ্কার বাক্য ‘আমরা লোহা নাযিল করেছি।”
৪১. আরেকটি বক্র বিতর্ক
অভিযোগ: “সামনে অগ্রসর হয়ে আপনি বলেছেন যে, কুরআন তৃতীয় একটি জিনিসেরও খবর দেয় যা কিতাব ব্যতীত নাযিল করা হয়েছিল।” এর সমর্থনে আপনি নিম্নোক্ত তিনটি আয়াত উল্লেখ করেছেন:
“অতএব ঈমান আন আল্লাহ ও তার রসূলের উপর এবং সেই নূরের উপর যা আমরা নাযিল করেছি”-(সূরা তাগাবুন:৮)।
“অতএব যেসব লোক ঈমান আনে এই রসূলের উপর এবং তাকে সম্মান করে, তার সাহায্য করে এবং সেই নূরের পেছনে চলে যা তার সাথে নাযিল করা হয়েছে-এরাই সফলকাম”-(সূরা আরাফ:১৫৭)।
“তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। এর সাহায্য আল্লাহ তাআলা এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে শান্তির পথ দেখান-যে তার ইচ্ছার অনুসরণকারী”-(সূরা মাইদা: ১৫-১৬)।
প্রথম আয়াতে আল্লাহ, রসূল ও নূরের উপর ঈমান আনয়নের নির্দেশ রয়েছে। আপনার ধারণা অনুযায়ী কি আল্লাহ ও রসূল ব্যতীত আর কোন জিনিসের উপর ঈমান আনার নিদর্শে দেয়া হয়নি, না কিতাবের উপর না হিকমাতরে উপর, না মীযানের উপর; বরং শুধু চতুর্থ জিনিসের উপর ঈমান আনার নির্দেশ রয়েছে যাকে আপনি কিতাব, হিকমাত ও মীযান থেকে স্বতন্ত্র জিনিস সাব্যস্ত করেছেন? দ্বিতীয় আয়াতে রসূলের উপর ঈমান আনার উল্লেখ আছে এবং নূরের অনুসরণ করার নির্দেশ। অর্থাৎ আয়াতে কিতাব ও হিকমাতের অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়নি। আপনার যুক্তি অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি কুরআনের উপর ঈমান না আনে,শুধু নূরের উপর ঈমান আনে, এবং সে কুরআনের অনুসরণ না করে শুধু নূরের অনুসরণ করে তবে সে মুমিনদের ও নাজাত প্রাপ্তদের দলভুক্ত হবে। এই নূর কি জিনিস? এর ব্যাখ্যায় আপনি বলেছেন, “এর অর্থ সেই বুদ্ধিজ্ঞান, দূরদৃষ্টি ও অন্তরদৃষ্টি হতে পারে যা মহানবী (স) কে আল্লাহ তাআলা দান করেছেন।” কুরাআনের উপর ঈমান আনয়ন এবং তার অনুসরণ থেকে তো মুক্তিপাওয়া গেল, বরং মহানবী (স) এর কথা ও কাজের আনুগত্য থেকেও। কেননা এসব আয়াতে কেবল নুরের উল্লেখ আছে।”
উত্তর: এটাও বক্র বিতর্কের আরেকটি চিত্রাকর্ষক দৃষ্টান্ত। হাদীস অস্বীকারকারীরা যদি কখানও বুঝেশুনে কুরআন পাঠ করে থাকত তবে তারা কুরআন পাকের বাচনভংগীর সাথে পরিচিত হতে পারত। কুরআন মজীদ বিভিন্ন পার্যায়ে স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী নিজস্ব শিক্ষার বিভিন্ন অংশের উপর জোর দেয়। যেমন, তা কোথাও শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ঈমান আনার ফলশ্রুতিতে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়। কোথাও শুধুমাত্র আখেরাতে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসকে কৃতকার্যতা ও অকৃতকার্যতার মূল করণ হিসাবে বর্ণনা করে। কোথাও আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ইমান আনার ফল এই বলে যে কোথাও শুধু রসূলের উপর ঈমান আনাকে মুক্তির উপায় নির্দেশ করে। অনুরূপভাবে আমলসমূহের মধ্য থেকেও কোন একটি আমলকে মুক্তির উপায় হিাসবে উল্লেখ করে এবং কখনও অন্য কোন জিনিসকে। এখন কি এই সমস্ত আয়াতকে উপরোক্তভাবে পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক রূপে তুলে ধরা হবে এবং তা থেকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে যে, তা পরস্পর বিরোধী?
অথচ সামান্য জ্ঞানই একথা হৃদয়ংম করার জন্য যথেষ্ট যে, উল্লেখিত সব স্থানে কুরআন মজীদ একটি বিরাট সত্যের বিভিন্ন দিক পরিবেশ অনুযায়ী পৃথক পৃথকভাবে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে এবং এসব দিকের কোন একটি অপরটিকে নাকচ করে দেয়না। যে ব্যক্তিই রসূলুল্লাহ (স) এর উর ঈমান আনবে এবং তার আনীত আলোর পেছনে চলতে প্রস্তুত হবে সে স্বতস্ফুর্তভাবেই কুরআনকেও মান্য করবে এবং রসূলুল্লাহ (স) এর শিখানো হিকমাত ও জ্ঞানবুদ্ধির দ্বারা উপকৃত হতেও চেষ্টা করবে। কুরআন অস্বীকারকারী সম্পর্কে এই ধারণা কিভাবে করা যেতে পারে যে, সে রিসালাতের নূরের অনুসরী?