অভিযোগ ও জবাব
[পূর্বোক্ত পত্রালাপের পর ড: আবদুল ওয়াদূদ সাহেবের যে দীর্ঘ চিঠি হস্তগত হয়েছিল তা তরজমানুল কুরআন পত্রিকায় ‘মানসাবে রিসালাত’ সংখ্যায় ছাপানো হয়েছে। এই সুদীর্ঘ পত্রের এখানে পুনরুক্তি সম্পূর্ন নিষ্প্রোয়জন যা অনেক অনর্থক কথায় পরিপূর্ণ। তাই সর্বসাধারণের সুবিধার জন্য পত্রলেখকের অপ্রাসংগিক বক্তব্যগুলো পরিহার করে শুধুমাত্র তহার আপত্তিসমূহ এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাচ্ছে এবং সাথে সাথে প্রতিটি অভিযোগের জওয়াবও দেয়া হচ্ছে, যাতে পাঠকগণ হাদীস অস্বীকারকারীদের অস্ত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে সৎর্ক হয়ে যান এবং সাথে সাথে জানতে পারেন যে, তাদের অস্ত্র কতই না দুর্বল।]
১. বাযমে তুলূ-ই ইসলাম পত্রিকার সাথে সম্পর্ক
অভিযোগঃ“আপনি পত্রালাপের সূচনায় আমাকে ‘বাযমে তুলূ-ই ইসলাম পত্রিকার অন্যতম সদস্য বলেছেন। এ সম্পর্কে আমি তার প্রাথমিক অথবা সাধারণ সদস্যও নই এবং জোর দিয়ে বলেছিলাম যে, আপনি আমার একথা পত্রিকায় ছেপে দিন। কিন্তু আপনি তা ছাপেননি,বরং ছাপানো চিঠিতে এর প্রতি সামান্য ইংগিতও করেননি। অথচ সৎতা ও সুবিচারের দাবী অনুযায়ী আপনার ভুল স্বীকার কারা এবং অক্ষমতা প্রকাশ করা উচিত ছিল’’।
উত্তরঃডকটর সাহেবের এই আপত্তির জওয়াব স্বয়ং তুলূ-ই ইসলাম এর পাতায় অন্য কারো মুখে নয়, বরং পারভেয সাহেবের মুখ থেকে শুনাই অধিক উত্তম। ১৯৯০ সনের ৮, ৯ ও ১০ এপ্রিল লাহোরে তুলূ-ই ইসলাম কনোনেশনের চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনে ডকটর আবদুল ওয়াদূদ সাহেবের ভাষণের পূর্বে পারভেয সাহেব তার পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেন:
“ডকটর সাহেবের বন্ধুত্ব আমাদের জন্য গৌরবের বিষয় এবং আমাদের উপর তার সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ এই যে তিনি আমার কুরআনের দরস ও ইতিহাসের ক্লসের প্রতিটি ভাষণের এক একটি শব্দ লেখার আওতায় নিয়ে এসেছেন। একাজ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য যা তিনি এতটা আনন্দের সাথে সম্পাদন করে যাচ্ছেন”-(তুলূ-ই ইসলাম, মে-জুন সংখ্যা, ১৯৬০খৃ.পৃ.২৫)।
এখন যদি ডকটর সাহেব বলেন যে, তিনি বাযমে তুলু-ই ইসলামের প্রাথমিক সদস্যও নান তবে তা গান্ধীজির অনুরূপ কথাই হবে। কারণ তিনি বলতেন, আমি কংগ্রেসের চার আনার সদস্যও নই। তুলু-ই ইসলামের প্রচারণা সম্পর্কে অবহিত যে কোন ব্যক্তিই এই পত্রালাপ পাঠ করে দেখতে পারেন যে, ডকটর সাহেবের মুখ দিয়ে স্বয়ং তুলু-ই ইসলাম কথা বলছে না অন্য কেউ?
২. দুর্মুখ প্রশ্নমালার উদ্দেশ্য কি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান ছিল?
অভিযোগঃআপনি লিছেছেন, “আপনি এই পত্রালাপ বাস্তবিকই যদি কথা বুঝার উদ্দেশ্য করে থাকতেন তবে সোজা কথা সহজভাবে আপনার বুঝে এসে যেত। কিন্তু আপনার পরিকল্পনাই তো ছিল ভিন্ন কিছু। আপনি আপনার প্রাথমিক পর্যায়ের প্রশ্নবলী আমর নিকট পাঠানোর সাথে সাথে তা অপর কতিপয় আলেমের নিকটও এই আশায় পাঠিয়েছিলেন যে, তাদের নিকট থেকে ভিন্ন রকম উত্তর পাওয়া যাবে। অতপর এসব উত্তর পত্রস্থ করে অপপ্রচার করা যাবে যে, সুন্নাতের সম্পর্কে ঐক্যমত পাওয়া যায় না”-(তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৬০ খৃ.)।
আমি কি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি যে, আপনি আমার এই পরিকল্পনা সম্পর্কে কিভাবে জ্ঞাত হলেন? আপনি যে উদ্দেশ্য আমার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন তাই যে আমার উদ্দেশ্য এর সপক্ষে আপনার নিকট কোন প্রমাণ আছে কি?
উত্তর:মানুষের অন্তরের নিয়াত সম্পর্কে তো একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে অবহিত হওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য মানুষ যেসব জিনিসের মাধ্যমে কোন ব্যক্তির নিয়াত (উদ্দেশ্য) সম্পর্কে আন্দাজ-অনুমান করে থাকে তা হচ্ছে, তার কার্যকলাপ এবং যেসব লোকের সাথে একত্রিত হয়ে সে কাজ করে তাদের সামগ্রিক কার্যকলাপ। ডকটর সাহেব হাদীস-বিরোধী লোকদের যে দলের সাহায্য সহযোগিতা করছেন তারা আপাদমস্তক সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে, হাদীস একটি সংশয়পূর্ণ ও বিতর্কিত জিনিস। এই উদ্দেশ্য তাদের পক্ষ থেকে যে ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তার সাক্ষী প্রমাণ তুলূ-ই ইসলামের পৃষ্ঠাগুলো এবং এই সংস্থার পক্ষ থেকে প্রকাশিত পুস্তকাদি এসব কাজ দেখে খুব কষ্টেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে, সেই দলেরই একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ডকটর আবদুল ওয়াদূদ সাহেবের পক্ষ থেকে উলাময়ে কিরামগণের নামে যে প্রশ্নমালা পাঠানো হয়েছিল তা আকৃত্রিভাবই বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণের জন্যই ছিল।
৩. রসূলুল্লাহ (স) এর ব্যক্তিসত্তা ও নববী সত্তা
অভিযোগঃ“আপনার তাফহীমাত গন্থে আপনি বলেছিলেন যে, কুরআন মজীদের কোথাও সামান্যতম অস্পষ্ট ইংগিতও পাওয়া যায় না যার ভিত্তিতে মহানবী (স) এর ব্যক্তি সত্তা ও নববী সত্তার মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয়েছে। অথচ এখন আপনি বলেছেন, মহানবী (স) রসূল হিসাবে যা কিছু করেছেন তা সুন্নাত এবং অপরিহার্যরূপে অনুসরণীয়। আর যা কিছু তিনি ব্যক্তি হিসাবে করেছেন তা সুন্নাত নয় এবং অপরিহার্যরূপে অনুসরণীয় নয়। এভাবে আপনি দুইটি বিপরীতধর্মী কথা বলেছেন।”
উত্তর: উক্ত পত্রালাপ চলাকালে ডকটর সাহেব এই বিষয়টি প্রথম উত্থাপন করেন এবং তাকে এর জওয়াবও দেয়া হয়েছে? আমি তার নিকট আবেদন করেছিলাম যে, তিনি যদি বিষয়টি হৃদয়ংগম করতে চান তবে আমার “রসূলুল্লাহ (স) এর ব্যক্তিসত্তা ও নাববী সত্ত” শীর্ষক প্রবন্ধ তরজমানুল কুরআন পত্রিকার ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় পড়ে নিন। তাতে বিস্তারিতভাবে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে ডকটর সাহেব তা পাঠ করার কষ্ট স্বীকার করেননি। যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে হাদীস প্রত্যাখ্যনকারীরা বিভিন্ন পন্থায় লোকদের মনমগজে ভ্রান্ত ধারণার বীজ বপন করার চেষ্টায় রত আছে তার মধ্যে এই বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই এখানে বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরা হচ্ছে।
এতে কোন সন্দেহ নাই যে, আল্লাহ তাআলা রসূলুল্লাহ (স) এর আনুগত্য করার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা তার কোনো ব্যক্তিগত অধিকারের ভিত্তিতে নয়, বরং তার ভিত্তি এই যে, তিনি তাঁকে তার রসূল বানিয়েছেন। এই দিক থেকে একটি মতাদর্শ হিসাবে তার ব্যক্তি মর্যাদা ও নববী মর্যাদা ও মধ্যে নিশ্চিতই পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু যেহেতু একই সত্তার মধ্যে কার্যত ব্যক্তি মর্যাদা ও নববী মর্যাদার সম্মিলন ঘটেছে এবং আমাদেরকে তার আনুগত্যের সাধারণ নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তই আমরা স্বয়ং এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী নই যে, আমরা মহানবী (স) এর অমুক কথা মানব, কারণ তিনি রসূল হিসাবে তা করেছেন বা বলেছেন এবং অমুক কথা মানব না, কারণ এর সম্পর্ক রয়েছে তাঁর ব্যক্তিসত্তার সাথে। এটা রসূলুল্লাহ (স) এর কাজ ছিল। ব্যক্তিগত ধরনের বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি লোকদের কেবল স্বাদীনতাই প্রদান করেননি, বরং স্বাধীন মত প্রদানের প্রশিক্ষণও দিতেন এবং রিসালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি তাদের বিনা বাক্য ব্যয়ে আনুগত্য করাতেন। এক্ষেত্রে আমাদের যতটুকু স্বাধীনতা রয়েছে তা রসূলুল্লাহ (স) কর্তৃক পদত্ত, যার মূলনীতি ও সীমা রসূলুল্লাহ (স) নিজিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এটা আমাদের একচ্ছত্র স্বাধীনতা নয়। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আমি এ প্রসংঙ্গে বলেছিলাম:
যেগুলো স্পষ্টতই ব্যক্তিগত বিষয়,যেমন এক ব্যক্তির পানারহার,পোশাক পরিধান, বিাবহ, পুত্র-পরিজনের সাথে বসবাস, সাংসারিক কাজকর্ম সম্পাদন, গোসল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন, পায়খানা-পেশাব ইত্যাদি সব কাজও মহানবী (স) এর জীবনে একান্তই ব্যক্তিগত পর্যায়ভুক্ত নয়, বরং তার মধ্যেও শরীআতের সীমা ও পন্থা এবং নিয়ম-কানূনের শিক্ষাও শামিল রয়েছে।….. যেমন মহানবী (স) এর পোশাক পরিচ্ছদ ও পানারহারে র বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করুণ। এর একটি দিক তো এই ছিল যে, তিনি একটি বিশেষ মাপকাঠির পোশাক পরিধান করতেন, যা তৎকালীন আরবে প্রচলিত ছিল এবং যা নির্বাচনে তার ব্যক্তিগত রুচিও যুক্ত ছিল। অনুরূপভাবে সমসাময়িক আরব পরিবারগুলোতে যে ধরনের খাদ্য ও পরিধানের ক্ষেত্রে তিনি নিজের কাজ ও কথার মাধ্যমে শরীআতের সীমা এবং ইসলামী শিষ্টাচারের শিক্ষা দিতেন। এখন একথা স্বয়ং রসূলুল্লাহ (স) এর শিখানো শরীআতের মূলনীতি থেকে আমরা জানতে পারি যে, এর মধ্যে একটি জিনিস তার ব্যক্তিসত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং দ্বিতীয় দিকটি তার নববী সত্তার সাথে জড়িত ছিল। করণ যে শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট ছিলেন, লোকেরা কিভাবে নিজেদের পোশাক সেলাই করবে, নিজেদের খাদ্য কিভাবে রান্নাকরবে-শরীআত তা নিজ কার্যসীমার আওতাভুক্ত করেনি। অবশ্য পানাহার ও পরিধানের ক্ষেত্রে হারাম-হালাল ও জায়েয-নাজায়েযের সীমা নির্দিষ্ট করার বিষয়টি এবং ঈমানদার লোকদের নীতি- নৈতিকতা ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচার-ব্যবহার ও শিষ্টাচারের শিক্ষা শরীআত তার আওতাভুক্ত করেছে।”
এই বিষয়ের আলোচনা শেষ করতে গিয়ে আমি উপসংহারে যে কথা বলেছি তা হলো, “মহানবী (স) এর ব্যক্তিসত্তা ও নববী সত্তার মধ্যে বাস্তবিকপক্ষে যে পার্থক্যই থাক তা আল্লাহ তাআলার নিকটি এবং রসূলুল্লাহ (স) এর নিকট রয়েছে এবং আমাদেরকে এ সম্পর্কে শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্য অবহিত করা হয়েছে যে, আমরা যেন কোথাও আকীদা-বিশ্বাসের ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়ে আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ (স) ক্ষেত্রে যদি আমাদের কোন স্বাধীনতা থেকে ই থাকে তবে তাও মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স) কতৃক প্রদত্ত হওয়ার কারণেই? এবং মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (স) ই তার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, আর এই স্বাধীনতা প্রয়োগের প্রশিক্ষণও আমাদেরকে আল্লাহর রসূল মুহাম্মদ (স) ই দিয়েছেন।
যে ব্যক্তিই হঠকারিতা মুক্ত হয়ে উপরোক্ত বক্তব্য পাঠ করবে সে নিজেই সিদ্ধন্তে পৌছুতে সক্ষম হবে যে, হাদীস অস্বীকরকারীরা যে জটিলতায় ভুগছে তার আসল কারণ কি আমার বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে না তাদের মনমগজে?
৪. সুন্নাতের শিক্ষায় স্তর বিন্যাস
অভিযোগঃ “যেসব বিষয় সম্পর্কে আপনি স্বীকার করেন যে, মহানবী (স) সেগুলো রসূল হিসাবেই বলেছেন বা করেছেন, তার অনুসরণ করার ক্ষেত্রেও প্রথমে আপনি পাথ্যক্য করেছেন। অতএব আপনি তাফহীমাত গ্রন্থের ১ম খন্ড, ২৭৯ নং পৃষ্ঠয় লিখেছেনম যে, যেসব বিষয় সরাসরি দণি ও শরীআতের সাতে সম্পর্কিত সে ক্ষেত্রে মহানবী (স) এর কার্যক্রম ও বক্তব্য পদেপদে আনুগত্য করা অপরিহার্য। যেমন নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ এবং পবিত্রতা ইত্যাদি বিষয়সমূহ। এসব ক্ষেত্রে তিনি যে নির্দেশ দিয়েছেন এবং যেভাবে স্বয়ং কাজে পরিণত করে দেখিয়েছেন তার হুবহু অনুসরণ বাধ্যতামূলক। এরপর যেসব জিনিস সরাসরি দীনের সাথে সম্পর্কিত নয়, যেমন সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদি এবং সামাজের আনুষংগিক বিষয়াদি, এসব ক্ষেত্রে এমন কতগুলো জিনিস রয়েছে যা করার নির্দেশ মহানবী (স) দান করেছেন, অথবা যা থেকে দূরে থঅকার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন এমন কতগুলো জিনিসও রয়েছে যেখানে আমরা মহানবী (স) এর কর্মনীতির মধ্যে উন্নত নৈতিকতা, খোদাভীতি ও পবিত্রতার শিক্ষা পেয়ে থাকি এবং আমরা তার চলার পথ দেখে দেখে অবহিত হতে পারি যে, কাজের বিভিন্ন পন্থার মধ্যে কোন পন্থাটি ইসলামের প্রাণসত্তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ”। কিন্তু এখন আপনার বক্তব্য হলো, এধরনের পার্থক্য সঠিক নয়।
জওয়াব:এ আলোচনায় যা বলা হয়েছে তা শুধু এই যে, সন্নাত থেকে আমরা যা কিছু শিক্ষা পাই তার সবই একই পর্যায়ভুক্ত ও সমান মর্যাদা সম্পন্ন নয়, বরং তার মধ্যে স্তরগত পার্থক্য রয়েছে। হেদায়াতের এই দুটি উৎস থেকে আমরা যা কিছু পেয়েছি তার সবই সমভাবে ফরজ বা ওয়াজিব নয় এবং প্রতিটি নির্দেশের বক্তব্যকে যেনতেনভঅবে যে কোন পরিস্থিতিতে কার্যকর করাও উদ্দেশ্য নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ স্বয়ং কুরআন মজীদে দেখে নিন যে, একদিকে (তোমরা নামায কায়েম কর এবং যাকাত দাও) বলা হয়েছে যা নিশ্চিতই ফরজ এবং বাধ্যতামূলক। কিন্তু একইভাবে আমর-এর সীগা (Imperative Mood) কুরআনের বলা হয়েছে:
উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ে আমর-এর সীগা ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও এখানে শুধু বৈধতা প্রকাশ করে (বাধ্যতামূলক নির্দেশ প্রকাশ করে না)। ডকটর সাহেব যদি বিতর্কের উদ্দেশ্য এই কথোপকথন না করে থাকতেন তবে তার জন্য বক্তব্য হৃদয়ংগম করা এতটা কঠিন ব্যাপার ছিল না এই কথা উধৃত করেছেন তা বের করে পড়ে নিন। তাতে উপরোক্ত বক্তব্যের সংলগ্নেই নিম্নোক্ত বক্তব্য বর্তমান রয়েছে?
অতএব কোন ব্যক্তি যদি সৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে মহানবী (স) এর অনুসরণ করতে চায় এবং এই উদ্দেশ্য তার সুন্নাতের অধ্যয়ন করে তবে তার জন্য এটা জানা মোটেই কষ্টকর নয় যে, কোন সব বিষয়ে তাকে পদে পদে অনুসরণ করতে হবে, কোন সব বিষয়ে তার বক্তব্য ও কার্যাবলী থেকে মূলনীতি বের করে আইন প্রণয়ন করতে হবে আর কোন সব কাজে তার সুন্নাত থেকে নৈতিকতা ও কৌশল এবং কল্যাণ ও সংস্কার সংশোধনের সাধঅরণ মূলনীতি বের করতে হবে”।
আমি পাঠকদের নিকট আরজ করব, তারা যদি আমার এ গ্রন্থটি (তাফহীমাত ১ম খন্ড) সংগ্রহ করতে পারেন তবে যেন এই গোটা প্রবন্ধটি পড়ে নেন। তাহলে হাদীস প্রত্যাখ্যানকারীদের মন-মানসিকতার সেই আসল অবস্থা তাদের সামনে উম্মোচিত হয়ে যাবে যার কারণে তারা ঐ প্রবন্ধটির মধ্যে নিজেদের সংশয়-সন্দেহের উপকরণ অনুসন্ধান করেছে যা তাদের পূর্বেকার সংশয় দূর করতে পারত্ অবশ্য এই প্রবন্ধে পাঠের সময় মনে রাখতে হবে যে, তার মধ্যে যে পারভেয সাহেবের উল্লেখ আছে তিনি আজকের নয়, বরং ১৯৩৫ খৃষ্টাব্দের পারভেয সাহেব। ঐসময় তিনি পথভ্রষ্টতার সম্পূর্ণ প্রাথমিক স্তরে ছিলেন এবং আজকে তিনি সুস্পষ্ট গোমরাহির স্তর অতিক্রম করে পথভ্রষ্টতার নেতৃত্বের আসন পর্যন্ত পৌছে গেছেন।
৫. জ্ঞানানুসন্ধান না বিতর্কপ্রিয়তা?
অভিযোগ: “একদিকে আপনি তাফহীমাত গ্রন্থে বলেন, নাময, রোযা ইত্যাদি এমন বিষয় যার সম্পর্ক রয়েছে সরাসরি দীন ও শরীআতের সাথে, কিন্তু সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদির সম্পর্ক সরাসরি দীনের সাথে নয়। অপর দিকে আপনার দাবী হলো, “ইকামতে দীন অর্থাৎ দীনের প্রতিষ্ঠার অর্থই হচ্ছে-ইসলাম অনুযায়ী সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রানৈতিক ব্যবস্থা কায়েম কিভাবে হতে পারে! চিন্তা করে দেখুন, দেশের আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে যেসব বিষয়ের উপর আলোচনা হবে দেশের আইন সংক্রন্ত ব্যাপারে যেসব বিষয়ের উপর আলোচনা হবে, দেশের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিষয় ইত্যাদির সাথে তার সম্পর্ক রয়েছ্এসব বিষয়ের সম্পর্ক যদি সরাসরি দীনের সাথে না থাকে তবে দেশের আইন বিধান ধর্মীয় ভিত্তিতে অথবা ধর্ম বহির্ভূত হওয়ার প্রশ্ন উঠতো না। তাছাড়া এসব বিষয়ে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের অনুসরণ যদি এমন প্রকৃতির না হয়ে থাকে যে প্রকৃতিতে সুন্নাতের অনুসরণ অত্যাবশ্যক (যা আপনার বক্তব্য অনুযায়ী সরাসরি দীনের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যেমন নামায ইত্যাদি) তবে এসব ব্যাপারে এই প্রশ্ন উত্থাপনের কি গুরুত্ব আছে যে, তা সুন্নাত অনুযায়ী কি না?
উত্তর:আমার তাফহীমাত গ্রন্থের বক্তব্যে কোন কোন বিষয়ের দীনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত হওয়ার এবং কোন কোন বিষয়ের সরাসরি সম্পর্কিত না হওয়ার যে উল্লেখ রয়েছে তাকে গোটা প্রবন্ধ থেকে বিচ্ছিন্না করে ডকটর সাহেব এই ভুল অর্থ গ্রহণের চেষ্টা করেছেন যে, আমি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াদিকে দীন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বলেছি। অথচ সেখানে যেসব বিষয়কে আমি “সরাসরি” দীনের সাথে সম্পর্কিত বলেছি তার দ্বারা আমি সেই সব ইবাদত বুঝাচ্ছি ,যেগুলোকে আইন প্রণেতা (রসূলুল্লাহ) “ইসলামের রুকন” (ভিত্তি) এর মর্যাদা দিয়েছেন, অর্থাৎ নাময, রোযা, হজ্জ ও যাকাত। অপর দিকে যেসব বিষয় সম্পর্কে আমি বলেছি যে দীনের সাতে তা “সরাসরি” সম্পর্কিত নয়তার অর্থ: ইসলামের রুকনসমূহ ব্যতীত অন্যান্য বিষয়। এর অর্থ কখনও এই নয় যে, দীনের সাতে তা সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন। যদি বাস্তবিকই তা সম্পর্কহীন হত তবে এগুলো সম্পর্ক কুরআন ও সুন্নাতে শরীআতী বিধান কেন পাওয়া যাচ্ছে?
ডকটর সাহেব আমার যে বক্তব্যের এই অর্থ বের করেছেন তার শুধুমাত্র দুইটি বাক্যাংশ (“সরাসরি সম্পকিৃত” এবং “সরাসরি সম্পর্কিত নয়”) তিনি বেছে নিয়েছেন এবং তার উপর নিজের কল্পনার গোটা ইমারত নির্মাণ শুরু করে দিয়েছেন। অথচ স্বয়ং ঐ বাক্যেই তার এই অর্থের প্রতিবাদ বর্তমান রয়েছে। তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, দ্বিতীয় প্রকারের বিষয়াবলী সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা মহানবী (স) এর নিকট এরুপ যে…। ” এসব বাক্যাংশ থেকে কি এই অর্থ গ্রহণ করা যায় যে, মহানবী (স) যেসব কাজের হুকুম দিয়েছে অথবা যেসব কাজ করতে নিয়েধ করেছেন সেগুলো সম্পর্কে মহানবী (স) এর নির্দেশের বিরোধিতা করা জায়েয, অথবা তার অন্যান্য নির্দেশ উপেক্ষা করা যেতে পারে?
অবশিষ্ট থাকল সেই সব শব্দ যা থেকে ডকটর সাহেব আজ অবৈধ ফায়দা লুটার চেষ্টা করছেন। এ সম্পর্কে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমি অনেক পূর্বেই অনুভব করেছিলাম, কোন ফেতনাবাজ লোক এগুলো ভুল অর্থে প্রয়োগ করতে পারে। অতএব তাফহীমাত গ্রন্থের ১ম খন্ডের পঞ্চম সংস্করণ (সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ খৃ.) দেখে নিন তাতে পূর্বোক্ত বাক্যের স্থানে নিম্নোক্ত বাক্য লিখে দেয়া হয়েছে; “যেসব কাজ ফরজ, ওয়াজিব এবং ইসলামী জিন্দেগীর সাধারণ নির্দেশসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট।”এই সংশোধন আমি এজন্য করেছিলাম যাতে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিষয়সমূহ দীনের সাথে সম্পর্কহীন মনে করার ধারণা-যা আমার পূর্বোক্ত বক্তব্য থেকে বের করা যেত, দূর হয়ে যায়। উপরোক্ত একটি প্রবন্ধের পূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শুধুমাত্র তার দুটি বাক্যাংশ থেকে তো গ্রহণ করা যায় না। গোটা প্রবন্ধটি কোন ব্যক্তি পাঠ করলে তার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এর লক্ষ্য ডকটর সাহেবের দুটি বাক্যাংশ থেকেত গৃহীত অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। পর্যালোচনা ও তথ্যানুসন্দানের উদ্দেশ্য যে ব্যক্তি বিতর্ক করে সে কারো গোটা বক্তব্য শুনার পর তার সমাগ্রিক অর্থের উপর বক্তব্য রাখে। কোথাও থেকে একটি বা দুইটি শব্দ নিয়ে তাকে মন্থন করা বিতর্কপ্রিয়তা ছাড়া আর কিছুই নয়।
৬. রসূলুল্লাহ (স) এর দ্বিবিধ সত্তার মধ্যে পার্থক্র করার মূলনীতি ও পন্থা
অভিযোগ:“মহানবী (স) এর নববী সত্তা ও ব্যক্তি সত্তার মধ্যে যদি পার্থক্য করা হয় তবে তা থেকে আপরিহার্যরূপে এই প্রশ্নের সৃষ্টি হয় যে, তার মধ্যে কে পার্থক্য করবে? এজন্য ভবিষ্যত উম্মাতকে যদি বিশেষজ্ঞ আলেমগণের দ্বারস্ত হতে হয় তবে তাদের মধ্যে রয়েছে চরম মতোবিরোধ। তাদের মধ্যে কার বক্তব্য সঠিক মনে করা যাবে আর কার বক্তব্য ভ্রন্ত? এই অবস্থান কতই না দুর্বল। এটা আপনি নিজেও স্বীকার করবেন। অতএব আপনি লিখেছেন:?
“হাদীসসমূহ কতিপয় লোকের মাধ্যমে অপর কতিপয় লোকের নিকট হস্তান্তর হতে হতে এসেছে। তার দ্বারা সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত যদি কিছু লাভ করা যায় তবে তা সঠিক ধারণা, নিশ্চিত জ্ঞান তার দ্বারা লাভ হয় না। আর একথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের এই আশংকার মধ্য নিক্ষেপ করা কখনও পছন্দ করতে পারেন না যে, যেসব বিষয়ের ভিত্তিতে দীন ইসলামে ঈমান ও কুফরে পার্থক্য সৃষ্টি হয় এরুপ গুরুত্বপূর্ন জিনিস মাত্র কতিপয় লোকের রিওয়ায়াতের উপর সীমাবদ্ধ করে দেয়া হবে। এই প্রকৃতির বিষয়সমূহের দাবীই এই যে, আল্লাহ তার কিতাবে এগুলো পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে দিবেন। আল্লাহর রসূল এগুলোকে তার নবুওয়াতী মিশনের মূল কাজ মনে করে তার ব্যাপক প্রচার করবেন এবং তা সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত পন্থায় প্রত্যেক মুসলমানের নিকট পৌছে দেয়া হবে- (রাসায়েল ওয়া মাসায়েল পৃ.৬৭)।
উত্তর:আপনার এই অভিযোগটি মূলত অজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত যে, মহানবী (স) এর ব্যক্তি সত্তা ও নববী সত্তার মধ্যে পার্থক্য কে নির্ণয় করবে? মহানবী (স) আমাদের কে শরীআতের যে নীতিমালা দান করেছেন তার ভিত্তিতে এটা জ্ঞাত হওয়া কোন কষ্টকর ব্যাপারই নয় যে, তার পবিত্র জীবনাচারের মধ্যে কোন জিনিসটি তার ব্যক্তি সত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট আর কোন জিনিসটি তার নববী সত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট। যে ব্যক্তি এ সম্পর্কে নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চায় তার জন্য শর্ত এই যে, তাকে কুরআন ও সুন্নাতের এবং ইসলামী ফিকাহের মূলনীতি ও আনুষংগিক বিষয়াদি অধ্যয়নে জীবনের একটি উল্লেখযোগ্র অংশ ব্যয় করতে হবে। এটা অন্তত সাধারণ লোকদের করার মত কাজ নয়। এখন বিশেষজ্ঞ আলেমগণের মতপার্থক্যের ব্যাপার বলা যায় যে, এ সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা উচিত যে, বিশেষজ্ঞ আলেমগণ যখনই কোন জিনিসকে সুন্নাত সাব্যস্ত করা বা না করার ক্ষেত্রে মতবিরোধ করেন তখন তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতের সপক্ষে অবশ্যই দলীল পেশ করেন। তারা গায়ের জোরে কোন দাবী করে বসেন না। তাদেরকে অবশ্যই বলে দিতে হয় যে, শরীআতের মূলনীতিসমূহের মধ্যে কোন নীতি-পদ্ধতির ভিত্তিতে তারা কোন জিনিসকে সুন্নাত প্রমাণ করছেন, অথবা তার সুন্নাত হওয়র বিষয়টি অস্কীকার করছেন। এই অবস্থায় যেটি গুরুত্ব পূর্ণ কথা হবে তাই টিকে থাকতে পারবে এবং যে কথাই টিকে যাবে সে সম্পর্কে সকল বিশেষজ্ঞ আলেম জ্ঞাত হবেন যে, তা কোন দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে টিকে গেছে। এই প্রকৃতির মতবিরোধ যদি অবশিষ্টও থাকে তবেক তা আতংকিত হওয়ার মত কোন জিনিস নয়। তাকে অযথা হাওয়া দিয়ে ফাপিয়ে তোলার চেষ্টা কেন করা হচ্ছে?
এখন আমার রাসাইল ওয়া মাসাইল গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত বক্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এর কর্থ স্বয়ং উধৃত বাক্যেই স্পষ্টভাবে বিধৃত রয়েছে। বিতর্কের উদ্দেশ্য তা বুঝাবার বিন্দু মাত্র চেষ্টা করা হয়নি এবং স্বভাবজাত বিতর্কের উদ্দেশ্যে তা বুঝবার বিন্দু মাত্র চেষ্ট করা হয়নি এবং স্বভাবজাত বিতর্কের উদ্দেশ্যে তা এখানে তুলে দেয়া হয়েছে। উল্লেখিত বক্তব্যে তো আলোচনা এই বিষয়ের উপর করা হয়েছে যে, যেসব আকীদা-বিশ্বাসের উপর কোন ব্যক্তির মুসলমান হওয়া বা না হওয়া নির্ভরশীল সেগুলোর প্রমাণের জন্য শুধুমাত্র খবরে ওয়াহেদ যথেষ্ট নয়। তার জন্য হয় কুরআনের প্রমাণ থাকতে হবে, অথবা মুতাওয়াতির বিল-মানীর পর্যায়ভুক্ত। অর্থাৎ অসংখ্য রাবীদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মহানবী (স) অমুক আকীদা-বিশ্বাসের শিক্ষা দিতেন। আনুষংগিক বিধানের প্রমাণের জন্য খবরে ওয়াদেও যথেষ্ট হতে পারে যদি তা সহীহ (বিশুদ্ধ) সনদসূত্রে বর্ণিত হয়। কিন্তু ঈমান ও কুফরের ফয়সালা প্রদানকারী বিষয়ের জন্য খুব শক্তিশালী সাক্ষ্যের প্রয়োজন রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ হত্যা মামলায় কোন ব্যক্তিকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার জন্য খুবই শক্তিশালী সমর্থন ও সাক্ষ্যের প্রয়োজন হয়। পক্ষান্তরে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা আপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী সাক্ষ্যের ভিত্তিতে করা যেতে পারে।
৭. কুরআনের মত হাদীস লিপিবদ্ধ করানোর ব্যবস্থা করা হল না কেন?
অভিযোগ: “আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ওহী মাতলূ অর্থাৎ প্রকাশ্য ওহী এবং অপরটি ওহী গায়র মাতলূ অর্থাৎ অপ্রকাশ্য ওহী, এই দুই ধরনের ওহী এসে থাকলে তবে এটা কি মহানবী (স) এর রিসালাতের অন্তভূক্ত ছিল না যে, তিনি ওহীর এই দ্বিতীয় অংশও স্বয়ং সংকলন করিয়ে সংরক্ষিত আকারে উম্মাতকে দিয়ে যেতেন, যেভাবে তিনি ওহীর প্রথম অংশ (কুরআন) উম্মাতকে দান করেছেন?”
উত্তর:হাদীস অস্বীকারকারীগণ সাধারণত এই প্রশ্নটি খুবই জোরেশোরে উত্থাপন করে থাকে এবং তাদের ধারণায় তারা এটাকে নিরুত্তর করে দেয়ার মত প্রশ্ন মনে করে। তদের ধারণা হলো, কুরআন যেহেতু লিখিতভঅবে গ্রন্থবদ্ধ করা হয়েছিল তাই তা সুরকক্ষিত। কিন্তু আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি, মহানবী (স) যদি কুরআন মজীদ শুধুমাত্র লিখিত আকারেই রেখে দিতেন এবং হাজার হাজার লোক তা মুখস্ত করার পর পরবর্তী বংশধরদের নিকট মৌখিকভাবে পৌছিয়ে না দিতেন তবে এই লিখিত দস্তাবেয কি পরবর্তী কালের লোকদের জন্য এই কথার চূড়ান্ত প্রমাণ হতে পারত যে, এটা সেই কুরআন যা মহানবী (স) লিখিয়েছিলেন? তাও তো স্বয়ং সাক্ষ্য প্রমাণের মুখাপেক্ষী হত। কারণ যতক্ষণ না কতিপয় লোক এই সাক্ষ্য দিত যে, মহানবী (স) তাদের সামনে এই কিতাব লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন ততক্ষণ ঐ লিপিবদ্ধ গ্রন্থখানির নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যেত। এ আলোচনা থেকে জানা গেল, কোন জিনিসের নির্ভরযোগ্য হওয়াটা শুধুমাত্র তার লিখিত হওয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। বরং জীবিত লোকেরা যতক্ষণ অনুকুলে সাক্ষ্য না দেয় ততক্ষণ তা নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হয় না। মনে করুণ কোন বিষয় সম্পর্কে লিখিত কিছিু বর্তমান নাই, কিন্তু জীবিত লোকদের সাক্ষ্য বর্তমান আছে। এখন এ সম্পর্কে একজন আইনজ্ঞ ব্যক্তির নিকট জিজ্ঞাসা করুন যে, এর সপক্ষে লিখিত কিছু না পাওয়া পর্যন্ত এসব জীবিত লোদের সাক্ষ্য কি প্রত্যাখ্যান হবে? খুব সম্ভব আপনি আইনকানূন সম্পর্কে অভিজ্ঞ এমন একজন লোকও পাবেন না যিনি এই প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব দিতে পারেন। আজ পৃথিবীর কোথাও মহানবী (স) এর উদ্যোগে লিখিত কুরআন মজীদের কপি বর্তমান নাই, কিন্তু তার ফলে কুরআন পাকের নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্যতার উপর কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে না। ধারাবাহিক ও অবিচ্ছিন্ন বাচনিক বর্ণনার মাধ্যমে তার র্ভিরযোগ্যতা প্রমানতিত। রসূলুল্লাহ (স) যে কুরআন মজীদ লিখিয়েছিলেন তাও স্বয়ং বাচনিক বর্ণনার ভিত্তিতেই গ্রহণযোগ্য হয়েছে। অন্যথায় মূল দস্তাবেজ এই দাবীল সর্মথনে পেশ করা যেত না। আর তা যদি কোথাও পাওয়া যায় তবে এটা প্রমাণ করা যেত না যে, এটাই সেই সহীফা যা মহানবী (স) লিখিয়েছিলেন। অতএব এসব লোক লেখার উপর যত জোর দেয় তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। মহানবী (স) নিজের সুন্নাতের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি পূর্ণাংঙ্গ সমাজ রেখে যান যার জীবনের প্রতিটি দিকের উপর তার সুন্নাতের সীলমোহর লাগানো ছিল। এ সমাজে তার বক্তব্য শুনেছেন, তার কাজকর্ম দেখেছেন এবং তার তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন এমন হাজার হাজার লোক বর্তমান ছিলেন। এই সমাজ পরবর্তী বংশধরদের নিকট এই সব চিহ্নপৌছে দিয়েছেন এবং এভাবে বংশ পরস্পরায় তা আমাদের পর্যন্ত পৌছেছে। দুনিয়ার কোন সর্বজন স্বীকৃত সাক্ষ্যের মূলনীতি অনুযায়ী তা প্রত্যাখ্যান করা যায় না। অতপর একথা বলাও ঠিক নয় যে, এসব নিদর্শন কাগজে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। বরং এসব নিদর্শন সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়া মহানবী (স) এর যুগেই শুরু হয়েছিল। প্রথম হিজরী শতকে এদেকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং দ্বিতীয় হিজরী শতকের মুহাদ্দিসগণ জীবন্ত সাক্ষ্য ও লিপিবদ্ধ সাক্ষ্য-উভয়ের সাহায্যে এই গোটা স্মৃতি সংকলনের আওতায় নিয়ে আসেন।
৮. ধোকা ও প্রতারণার একটি নমুনা
অভীযোগ: “ওহীর দ্বিতীয় অংশ-যার সংরক্ষণ সম্পর্কে আপনি এখন বলেছেন যে, এর পশ্চাতেও আল্লাহ তাআলার সেই ব্যবস্থাপনা কার্যকর রয়েছে যা কুরআন মজীদের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কার্যকর রয়েছে। এই ব্যবস্থাকে যে ব্যক্তি চ্যালেঞ্জ করে যেস মূলত কুরআনের যথার্থতা চ্যালেঞ্জ করার পথ ইসলামের শত্রুদের দিখিয়ে দিচ্ছে।” এর ধরনটা কি? এ সম্পর্কে আমার থেকে নয়, স্বয়ং আপনার বক্তব্য থেকে জেনে নিন। আপনি রাসায়েল ওয়া মাসায়েল গ্রন্থের ১৭০ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন:
“রসূলুল্লাহ (স) এর কথা এবং যেসব রিওয়ায়াত হাদীসের গ্রন্থাবলীতে পাওয়া যায় তা অপরিহার্যরূপে একই জিনিস নয়। আর এসব রিওয়ায়াতকে সনদসূত্রের ভিত্তিতে কুরআনের আয়াতের সমকক্ষ সাব্যস্ত করা যায় না। কুরআনের আয়াতসমূহ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নাযিল হওয়ার ব্যাপারে কারো কোনরুপ সন্দেহ করার অবকাশ নেই। পক্ষন্তরে রিওয়ায়াত সম্পর্কে এই সন্দেহের অবকাশ আছে যে, যে কথা বা কাজকে মহানবী (স) এর কথা বা কাজ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা বাস্তবিকই মহানবী (স) এর সাথে সম্পর্কিত কি না?
উত্তর: সততা ও ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত সমান্য দেখে নিন যে, উল্লেখিত বক্তব্যের পরপরই যে বক্তব্য রয়েছে তা জ্ঞাতসারেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যাদের নিকট রাসায়েল ওয়া মাসায়েল প্রথম খন্ড রয়েছে তারা তার পৃষ্ঠার খুলে নিন, উল্লেখিত বক্তব্যের সাথে সাথে নিম্নোক্ত বক্তব্যের বর্তমান রয়েছে:
যেসব সুন্নাত (হাদীস) মুতাওয়াতির (ধারাবাহিক) সূত্রে মহানবী (স) এর নিকট থেকে আমাদের কাছে পৌছেছে, অথাব যেসব রিওয়ায়াত মুহাদ্দিসগণের নিকট স্বীকৃত মুতাওয়াতির সনদের শর্তবলীর মানদন্ড টিকে গেছে তা নিশ্চিতই প্রত্যাখ্যানের অযোগ্য দলীল হিসাবে গৃহীত। কিন্তু যেসব রিওয়ায়াত মুতাওয়াতির সনদে বর্ণিত হয়নি তার সাহায্যে নিশ্চিত জ্ঞান লাভ হয় না, বরং নিশ্চয়তার প্রবল ধারণা জন্মে। এ কারণে উসূলবিদ আলেমগণের নিকট একথা সর্ববাদী স্বীকৃত যে, যেসব হাদীস মুতাওয়াতির সনদে বর্ণিত নয়, সেগুলৈা আইন-কানূণের উৎস হতে পারে বটে, কিন্তু ঈমানের (অর্থাৎ যার সাহায্যে ঈমান ও কুফরের পার্থক্য সৃষ্টি হয় ) উৎস হতে পারে না।”
এই নৈতিক দু:সাহস বাস্তবিকই আর্শীবাদযোগ্য যে, আমাকে স্বয়ং আমার বক্তব্যের সাহায্যে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
৯. হাদীসের ভান্ডারে কি জিনিস সন্দেহজনক এবং কি জিনিস সন্দেহমুক্ত
অভিযোগ: কুরআন মজীদ সম্পর্কে তো আল্লাহ তাআলা প্রথমেই বলে দিয়েছেন যে: অর্থাৎ“এই গ্রন্থে সন্দেহ-সংশয়ের কোন অবকাশ নাই।” আর দ্বিতীয় প্রকারের ওহীল অবস্থঅ এই যে, তাতে এরুপ সন্দেহের অবকাশ রয়েছে যে, যে কথা বা কাজকে রসূলুল্লাহ (স) এর সাথে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে তা বাস্তবিকই মহানবী (স) এর কথা বা কাজ কি না? এরই নাম কি আল্লাহর হেফাজত?”
উত্তর:সত্য কথা হলো, হাদীস অস্বীকারকারীগণ হাদীস শাস্ত্রের সমান্যতম অধ্যয়নও করেনি। এজন্য তারা বারবার এই বিষয়টি নিয়ে সংশয়ে পতিত হয়েছে যে বিষয়টি সাধারণ পর্যায়ের জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিও সহজেই বুঝতে পারে। আসলে এসব লোককে বুঝানো আমার সাধ্যের বাইরে। কারণ তাদের মধ্যে হৃদয়ংগম করার আগ্রহের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ দর্শকদের বুঝাবার জন্য আমার আরজ এই যে, লোকেরা দুটি জিনিস যদি উত্তমরূপে জেনে নেয় তবে তাদের মনে কোন সংশয় সৃষ্টি হতে পারে না।
এক. ওহির দুটি বৃহৎ বিভাগ রয়েছে। এর একটি হচ্ছে যা আল্লাহ তাআলার নিজের বাক্য মহানবী (স) এর নিকট প্রেরণ করা হয়েছে, যেন তিনি র্সষ্টিকুলের নিকট তা হুবহু সেই বাক্যই পৌছিয়ে দেন। এর নাম ওহী মাতলূ (যা তিলাওয়াত করা হয়) এবং এই ধরনের সমস্ত ওহী সেই গ্রন্থে একত্রে সন্নিবেশ করা হয়েছে যাকে সমগ্র বিশ্ব কুরআন নামে জানে। দ্বিতীয় প্রকারের ওহী ছিলো তা যা রসূলুল্লাহ (স) কে দিকনির্দেশনা দানের জন্য নাযিল করা হত। যেন তার আলোকে তিনি সৃষ্টিকুলের পথপ্রদর্শন করতে পারেন, ইসলামী জীবন ব্যবস্থার নির্মাণ করতে পারেন এবং ইসলামী আন্দোলনে নেতৃত্বের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারেন। এই ওহী জনগণের নিকট অক্ষরে অক্ষরে পৌছানোর জন্য ছিল না, বরং তার প্রভাবসমূহ মহানবী (স) এর কথা ও কজোর মধ্যে বিভিন্ন আকারে ও অবয়বে প্রকাশ পেত। মহানবী (স) এর গোটা জীবনাচার এই নূরের প্রকাশক ছিল। এই জিনিসকেই সুন্নাত ও ওহী গায়রে মাতলূ বলা হয়-অর্থাৎ যে ওহী তিলাওয়াতের জন্য নয়।
দুই.যেসব উপায়-উপকরণের মাধ্যমে আমরা দীনের জ্ঞান লাভ করেছি তার ক্রমিক বর্ণনা এই যে, সর্বপ্রথমে আল-কুরআন, অতপর যেসব সুন্নাত অব্যাহত আমলের মাধ্যমে অর্থাৎ বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে মহানবী (স) এর নিকট থেকে পৌছেছে। অর্থাৎ যেসব কাজের উপর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত উম্মাতের মধ্যে অব্যাহত অনুশীলন হয়ে আসছে।
অতপর যেসব নির্দেশ এবং তার শিক্ষা ও হেদায়াত মুতাওয়াতির ও মশহুর রিওয়ায়াতের মাধ্যমে আমাদের নিকট পর্যন্ত পৌছেছে।
অতপর যেসব খবরে ওযাহিদ-সনদের দিক থেকেও সহীহ এবং কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনার সাথেও সাংঘর্ষিক নয়।
এসব উপায়ে আমরা মহানবী (স) এর নিকট থেকে যা কিছুই লাভ করেছি তা সংশয় সন্দেহের উর্ধে। অতপর পরবর্তী স্তরে গিয়ে এই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কোন কথা বা কাজ যা মহানবী (স) এর সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে তা বাস্তবিকই তার কথা বা কাজ কি না? এই প্রশ্ন মূলত নিম্নোক্ত প্রকারের রিওয়ায়াতসমূহের বেলায় উঠতে পারে?:
১. যেসব হাদীসের সনদ শক্তিশালী কিন্তু তার বিষয়বস্তু অধিকতর নির্ভরযোগ্য কোন জিনিসের বিপারীত দেখা যায়।
২. যেসব হাদীসের সনদ শক্তিশালী, কিন্তু সেগুলো পরস্পার বিপরীত এবং এই বৈপরিত্য দূর করা কষ্টকর মনে হয়।
৩. যেসব হাদীসের সনদ শক্তি কিন্তু সেগুলো একক (মুনফারিদ) বর্ণনা এবং অর্থগত দিক থেকে তার মধ্যে কিছুটা অস্পষ্টতা অনুভূত হয়।
৪. যেসব হাদীসের সনদের মধ্যে কোন প্রকারের দুর্বলতা রয়েছে, কিন্তু বিষয়বস্তুর মধ্যে কোন দোষ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এবং
৫. যেসব হাদীসের সনদ ও বিষয়বস্তু উভয়ের ব্যাপারে আপত্তি তোলার সুযোগ রয়েছে।
এখন যদি এই দ্বিতীয় প্রকারের রিওয়ায়াতসমূহের ব্যাপারে কোনো আপত্তি উত্থপনের সুযোগ সৃষ্টি হয় তবে তাকে এরুপ দাবী করার অনুক’লে প্রমাণ হিসাবে পেশ করা যায় না যে, প্রথমোক্ত উপায়-উপকরণেল মাধ্যমে মহানবী (স) এর নিকট থেকে যা কিছু লাভ করেছি তাও সন্দেহপূর্ণ।
উপরন্ত একথাও জেনে রাখা দরকার যে, দীন ইসলামের যেসব বিষয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ তার সবই প্রথমোক্ত মাধ্যমে আমাদের নিকট পৌছেছে এবং দ্বিতীয় স্তরের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিষয়সমূহ অীধকাংশই শুধু প্রাসংগিক আনুষংগিক ও অপ্রধান (যদিও প্রয়োজনীয়), যে ক্ষেত্রে একাধিক মতের মধ্যে যে কোন একটি মত গ্রহণ করলে মূলত কোন পার্থক্য সৃষ্টি হয় না। অধ্যয়ন, অনুসন্ধান ও গবেষণার ভিত্তিতে কোন ব্যক্তি এর মধ্যে কোন একটি রিওয়ায়াত সুন্নাত হিসাবে গ্রহণ করলে এবং অপরজন তা গ্রহণ না করলেও উভয়ই মহানবী (স) এর অনুসারী গণ্য হবে। অবশ্য যেসব লোক বলে, মহানবী (স) এর কথা ও কাজ প্রকৃতই তার কথা ও কাজ প্রমাণিত হলেও তা আমাদের জন্য আইনের মর্যাদা রাখে না-এরা মহানবী (স) এর অণুসারী নয়।
১০. আরও একটি প্রতারণা
“হাদিস সমূহের হেফাজত ও সংরক্ষণ ব্যবস্থায়” যে দুর্বলতা রয়েছে তা আপনি নিজেও স্বীকার করেন। আপনি লিখেছেন: “প্রথম দৃষ্টিতেই একথা সম্পূর্ণ সঠিক মনে হয় যে, যেসব কাওলী (বাচনিক) ও ফেলী (কর্মমূলক) হাদীস শ্রবণকারী ও দর্শণকারীর সংখ্যা অনেক, সেগুলোকে মুতাওয়াতির হাদীসের মর্যাদা দেয়া উচিত। তার মধ্যে মতহবিরোধ থাকা উচিত নয়। কিন্তু প্রত্যেক ব্যীক্ত সাধারণ বিবেচনায় একথা বুঝতে সক্ষম যে, যে ঘটনা বহু সংখ্যক লোক দেখেছে অথবা আলোচনা বহু সংখ্যক লোক শুনেছে, সেগুলো বর্ণনা করার বেলায় অথবা তদনুযায়ী আমল করার ক্ষেত্রে সব লোকের মধ্যে এতোটা মতৈক্য পাওয়া সম্ভব নয় যে, তাদের মধ্যে সমান্য পার্থক্যও নেই। যেমন ধরুন আজ আমি একটি বক্তৃতা করলাম এবং কয়েক হাজার লোক তা শুনলো। সভা শেষ হওয়ার কয়েক ঘন্টা পরই (মাস অথবা বছর নয়, মাত্র কয়েক ঘন্টা পর) লোখদের জিজ্ঞাসা করুন যে, বক্তা কি বলেছে? আপনি দেখবেন যে, বক্তৃতার বিষয়বস্তু উল্লেখ কারার ক্ষেত্রে সকলের বর্ণনা হুবহু এক রকম হবে না। কেউ বক্তৃতার কোন অংশ বর্ণনা করবে, কেউ অন্য অংশ, কেউ কোন বাক্য বর্ণনা করবে। ধীশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ বক্তৃতা সঠিকভাবে হৃদয়ংগম করে তার যথার্থ সারসংক্ষেপ বর্ণনা করবে। কারো বোধশক্তি খুব ভালো না হওয়অর সে বক্তৃতার বিষয়বস্তু নিজের কথায় সঠিক ভাবে বর্ণনা করতে পারবে না। কারো মুখস্ত শক্তি প্রখর হওয়ার কারণে আলোচনাটির বেশীরভাগ হুবহু বর্ণনা করতে সক্ষম হবে। কারো স্মরণশক্তি দুর্বল হওয়ার কারণে বিষয়বস্তু বর্ণনা করতে গিয়ে ভুল করবে” (তাফহীমাত. ১ম খন্ড.পৃ. ৩৩০)।
উত্তর:প্রথম কথা হলো, উপরোক্ত উধৃতির ঠিক মাঝখানের রেখা টানা একটি অংশ বাদ দেয়া হয়েছে এবং যে কোন ব্যক্তি স্বয়ং পড়ে দেখতে পারে যে, কতটা সৎ উদ্দেশ্যে তা বাদ দেয়া হয়েছে। পরিত্যক্ত অংশটুকু নিম্নেউল্লেখ করা হলঃ
“এই ঘটনা এই বক্তৃতার গুরুত্বপূর্ণ অংশের উপর তো অবশ্যি সকলের মতৈক্য পাওয়া যাবে, কিন্তু আনুষংগিক ও অপ্রধান অংশের ক্ষেত্রে শে কিছু মতপার্থক্যও পওয়া যাবে এবং এই মতপার্থক্যের দ্বারা কখনও প্রমাণিত হয় না যে, বর্ণিত ঘটনা মূলতই সংঘটিত হয়নি।”
তারপর এই উধৃতির পরবর্তী গোটা আলোচনাই ছিল যেহেতু ড: সাহেবের সন্দেহ-সংশয়ের জওয়াব এবং তার মাধ্যমে সন্দেহ দূর হতে পারত, এজন্য ড: সাহেব তার উল্লেখ বর্জন করেছেন, কারণ তিনি তা সন্দেহ-সংশয়ের অনুসন্ধানেই আছেন। একটি আলোচনার যতখানি অংশ সন্দেহপ্রবণ হতে এবং সন্দেহপ্রবণ করতে প্রয়োজন তিনি ততটুকু গ্রহণ করেন এবং যে অংশের সাহায্যে জট খুলে যাওয়ার আশংকা রয়েছে তা তিনি কেটেছেটে ফেলে দেন। আরো মজার ব্যাপার হলো, একজন লেখককে তারই গ্রন্থের সাহায্যে এই ধোকা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি পাঠকদের নিকট আরজ করব,তারা যদি ‘তাফহীমাত’ গ্রন্থের পথম খন্ড পেয়ে যান তাহলে সেখানে “হাদীস কে মুতাআল্লাক চানদ সোয়ালাত” (হাদীস সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন) শীর্ষক প্রবন্ধটি বের করে পাঠম করুন,. যেখান থেকে উধৃত অংশ পেশ করা হয়েছে। তথাপি উল্লেখিত উধৃতাংশের পরপরই আমার যে বক্তব্য রয়েছে তা এখনে উল্লেখ করাই ভালো মনে হয়, তাহলে গ্রন্থখানি যারা সংগ্রহ করতে সক্ষম হবেন না, তারাও ডকটর সাহেবের ভেল্কীবাজির সমুচিত জবাব দিতে পারবেন। বাদ দেয়া বাক্যাংশ নিম্নেপ্রদত্ত হল:
এখন যদি কোন ব্যক্তি এই মতবিরোধ দেখে বলে যে, আমি মূলত কোন বক্তৃতাই করিনি, অথবা বক্তৃতার আদ্যপান্ত ভুল নকল করা হয়েছে, তাহলে তা সঠিক নয়। পক্ষন্তরে বক্তৃতা সম্পর্কে যদি সমস্ত তথ্যাবলী সংগ্রহ করা হয় তবে জানা যাবে যে, বর্ণনাকারীদের মধ্যে একটি বিষয়ে ঐক্যমত রয়েছে যে, আমি বক্তৃতা করেছি, অমুক স্থানে করেছি এবং অমুক সময়ে করেছ্ সেখানে অসংখ্য লোক উপস্থিত ছিল এবং বক্তৃতার বিষয়বস্তু এই ছিল। অতপর বক্তৃতার যে যে অংশ সম্পর্কে আক্ষরিক ও অর্থগত দিক থেকে অধিক মতৈক্য পরিলক্ষিত হবে তা অধিক নির্ভরযোগ্য সংকলন প্রণয়ন করা যায়। আর বক্তৃতার যেসব অংশের বর্ণনা একক বর্ণনাকারীর মাধমে পাওয়া যাবে তা তুলনামূলকভাবে কম নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হবে, কিন্তু তাকে মনগড়া অথবা ভ্রান্তবলা ঠিক হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা বক্তৃতার পূর্ণ ভাবধারার পরিপন্থী না হয়, অথবা তার মধ্যে এমন কোন কথা না থাকে যার কারণে তার যথার্থতা সন্দেহপূর্ণ হয়ে পড়ে, যেমন বক্তৃতার নির্ভরযোগ্য অংশের বিপরীতে হওয়া, অথবা বক্তার চিন্তাধার, প্রকাশ ভংগী ও মেজাজ-প্রকৃতি সম্পর্কে লোকদের মধ্যে পূর্ব থেকে যে সঠিক পরিচয় বর্তমান রয়েছে তার পরিপন্থী হওয়া।”
১১. উম্মাতের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এরূপ কোন জিনিস কি নেই?
অভিযোগ:“আপনি বলছেন: সুন্নাত সুরক্ষিত হওয়ার প্রমাণ এই যে, উযু পাঁচ ওয়াক্তের নামায, আযান, দুই ঈদের নাময, বিবাহ, তালাক উত্তরধিকারের বিধান ইত্যাধি মুসলিম সমাজে ঠিক সেইভাবে প্রচলিত আছে যেভাবে কুরআন মজীদের আয়াতসমূহ মুখে উচ্চারিত হয়ে আসছে।” আপনি কি বলতে পারবেন যে, নামায, আযান বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে গোটা উম্মাত একই পন্থায় আমল করছে?”
উত্তর:নামায, আযান, বিবাহশাদি, তালাক, উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে যতখানি অংশের উপর উম্মাতের ঐক্যমত রয়েছে তা একদিকে জমা করুন, এবং অপরদিকে যেসব বিষয়ে মতভেদ দেখা যায় তা একত্র করুন। আপনি স্বয়ং জানতে পারবেন যে, কত বেশী পরিমাণ মতৈক্য রয়েছে এবং খুব কমই মতানৈক্য আছে। মৌলিক বিষয়ের প্রায় সবগুলোতেই মতৈক্য রয়েছে এবং মতানৈক্য বিষয়গুলো নিয়ে কখনো বিতর্ক হয় না, বরং মতভেদের বিষয়গুলো নিয়েই সব সময় বিতর্কের সূচনা হয় ফলে বিতর্ক বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোকে চোখে পড়ার মতো করে রেখেছে। এই কারণে স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী লোকেরা ভ্রান্তির শিকার হয়ে মনে করে যে, উম্মাতের মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এরুপ কিছুই নেই। উদাহরণ স্বরুপ নামাযের কথাই মনে করুন। গোটা বিশ্বের মুসলমান একমত যে, পাঁচ ওয়াক্তের নামায কথাই মনে করুন। গোটা বিশ্বের মুসলমান একমত যে, পাচ ওয়াক্তের নামায ফরজ, এর ওয়াক্তসমূহ নির্দিষ্ট, নামায পড়তে হলে দেহ এবং পরিচ্ছদ পাক হতে হবে এবং উযু করতে হবে, কিবলামূখী হয়ে নামায পড়তে হবে, প্রতি ওয়াক্তে এত এত রাকআত নামায ফরজ, তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে নামায শুরু করতে হবে। নামাযের মধ্য দাড়ানো অবস্থায় অমুক জিনিস, রুকূ অবস্থায় অমুক জিনিস, সিজদা অবস্থায় অমুক জিনিস এবং সবা অবস্থায় অমুক জিনিস পড়তে হবে। মোটকথা নামযের গোটা কাঠামোতেই সামগ্রিকভাবে মতৈক্য রয়েছে। মতানৈক্য কেবল এমন সব বিষয়ে যে, হাত বেধে রাখবে না ছেড়ে দিতে হবে, বাধলে তা বুকের উপর বধবে না নাভির উপর, ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পড়বে কি না, সূরা ফাতিহা পাঠ শেষে ‘আমীন” সশব্দে বলতে হবে না নিঃশব্দে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মতভেদগুলোকে ভিত্তি করে এই দাবী করা ঠিক হবে কি যে, নামাযের বিষয়ে উম্মাত মূলতই কোন ঐক্যবদ্ধ পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়? আযানের মধ্যে এতটুকু মতভেদ আছে যে, শীআ সম্প্রদায় “হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল” বলে থাকে, এবং সুন্নীগণ তা বলে না। আযানের অবশিষ্ট সকল বাক্য ও সংশ্লিষ্ট মাসলা-মাসায়েলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মতৈক্য রয়েছে। এই সামান্য মতবিরোধকে কি এই কথার প্রমান হিসাবে পেশ করা যেতে পারে যে, আযান স্বয়ং একটি বিতর্কিত বিষয়?
১২. সুন্নাহ মতবিরোধ কমিয়েছে না বৃদ্ধি করেছে?
অভিযোগ: “আপনি যদি বলেন , হাদীসের ভিত্তিতে সৃষ্ট মতভেদসমূহ আনুষংগিক ও অপ্রধান বিষয়াবলীর সাধারণ প্রকৃতির মতবিরোধ, এর দ্বারা দীনের উপর কোন প্রভাব পড়ে না, তাহলে একথা জিজ্ঞেসা করতে চাই যে, আনুসংগিক ও অপ্রধান যেসব বিষয় (আপনার বক্তব্য অনুযায়ীআল্লাহর ওহীর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে তার মধ্যে সামান্যতম মতবিরোধও কি পাপের কারণ হয়ে দাড়ায় না? উদাহরণস্বরুপ আল্লাহ তাআলা কুরআনে উধৃত ওহীর মাধ্যমে হুকুম দিয়েছেন যে, উযুর মধ্যে দুই হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করে তবে তাও কি আপনার মতানুযায়ী কনুই পর্যন্ত হাত ধৌতকারী ব্যক্তি অথবা সম্প্রদায়ের আমলের অনুরুপ আল্লাহর হুকুম পালন হিসাবে গন্য হবে?”
উত্তর:এতো কেবল একটি মোটা ভুল। কুরআনের নির্দেশের খোলাখুলি বিরোধিতার নাম মতানৈক্য নয়। বরং মতানৈক্য এই জিনিসের নাম যে, দুই ব্যক্তির মধ্যে এই কথা বিতর্কিত যে, শরীআতের হুকুম কি? এর সঠিক উদাহরণ, স্বয়ং কুরআন মজীদে বিদ্যমান। কুরআনের তাইয়াম্মুম স্মর্কিত আয়াতে বলা হয়েছে যে:
তা (মাটি) দিয়ে তোমাদের মুখন্ডল ও উভয় হাত মাসেহ কর”-(সুরা মাইদা:৭)।
এখন দেখুন, এক ব্যক্তি ‘হাত’ অর্থ কব্জি পর্যন্ত’ মনে করে ততটুকু মাসেহ করে। অপর ব্যক্তির কনুই পর্যন্ত মনে করে ততখানি মাসেহ করে। তৃতীয় ব্যক্তি মনে করে যে, হাত বলতে তো গোটা বাহুই বুঝায়, তাই সে গোটা হাতই মাসেহ করে। বলুন কুরআনের বাক্য এই মতভেদের সুযোগ আছে কি না। পরন্তু এই মতবিরোধ কি পাপের কারণে পরিণত হয়?
হাদীস অস্বীকারকারীগণ যদি কিছুটা মাথা খাটাত তবে তারা স্বয়ং দেখতে পেত যে, সুন্নাত মতবিরোধের ক্ষেত্রে অনেকটা সীমিত করে দেয়েছে। অন্যথায় সুন্নাতের অস্তিত্ব না থাকলে কুরআন মজীদ থাকলে কুরআন মজীদ থেকে হুকুম-আহকাম বের করতে গিয়ে এতটা মতবিরোধ হয়ে যেত যে, দুইজন মুসলমানও একত্রিত হয়ে কোন সামগ্রিক আমল করতে পারত না। যেমন কুরআন মজীদ বারবার নামাযের নির্দেশ দিচ্ছে। সুন্নাত যদি তার কাঠামো ও পন্থা নির্দিষ্ট করে না দিত তবে লোকেরা কখনও সিদ্ধন্তে পৌছতে পারত না যে, এই হুকুম কিভাবে পালন করা যায়। কুরআন মজীদ যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। সুন্নাত যদি এই নির্দেশের ব্যাখ্যা করে না দিত তবে কখনো এ বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না যে, এই ফরজ কিভাবে সমাধা করা যেতে পারে। কুরআন মজীদের অন্যান্য হুকুম-আহকামের বেলায়ও এই একই অবস্থা যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন কর্তৃত্ব সম্পন্ন শিক্ষক(সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এসব নির্দেশ পালনের কাঠামো বলে দিয়ে এবং কার্যত দেখিয়ে দিয়ে মতবিরোধের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। যদি এই জিনিস না হত এবং উম্মাত শুধুমাত্র কুরআন মজীদ তুলে নিয়ে অভিধানের সাহায্যে কোন জীবন ব্যবস্থা গঠন করতে চাইত তবে মৌলিক বিষয়েও এতটা মতৈক্য পাওয়া যেত না যার ভিত্তিতে কোন অভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হত। সুন্নাতের মাধ্যমেই সমস্ত সম্ভাব্য মতবিরোধ কুঞ্চিত হয়ে ইসলামী দুনিয়ার আজ মাত্র আটটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়, এবং তার মধ্যে বৃহৎ ফেরকা মাত্র পাঁচটি যার মধ্যে কোটি কোটি মুসলমান এক এক ফিকহের উপর সমবেত হয়েছে।১ এবং অব্যাহত রয়েছে? কিন্তু হাদীস অস্বীকারকারীরা সুন্নাতের বিরুদ্ধে যে খেলা খেলছেতাতে যদি তারা কৃতকার্য হয়ে যায় তবে তার ফল এই হবে না যে, কুরআনের তাফসীর ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সব একমত হয়ে যাবে। বরং তার ফল এই হবে যে, আজ পর্যন্ত যেসব বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে সেগুলোতেও মতভেদ সৃষ্টি হয়ে যাবে।
১৩. হাদীস অস্বীকারকারী ও খতমে নবুওয়াত অস্বীকারকারীদের মধ্যে সাদৃশ্য
আপত্তি:আপনি বলছেন, “সুন্নতের মূল পাঠে এতটা মতভেদ থেকে থাকে তবে কুরআন মজীদের ব্যাখ্যায়ও অসংখ্য মতভেদ হতে পারে এবং হয়েছেও। কুরআনের ব্যাখ্যায় মতবিরোধ যদি আইনের ভিত্তি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক না হয় তাহলে সুন্নাতের মূল পাঠের বিভিন্নতা এই ব্যাপারে কিভাবে প্রতিবন্ধক হতে পারে।” আপনার এই যক্তি হুবহু কাদিয়ানীর চরিত্র ও কার্যলাপে অমুক দোষক্রটি লক্ষ করা যায় তাহলে তারা অবলিলায় বলে দেয় যে, (নাউযুবিল্লাহ) রসূলুল্লাহ (স) এর অমুক কথা কি এরুপ ছিল না?
১. (৭৫ পৃ)বর্তমান দুনিয়ার কেবলমাত্র নিম্নলিখিত ফেরকাগুলো দেখা যায়: হানাফী, শাফিঈ,মালিকী হাম্বলী, আহলে হাদীস, ইসনা আশারী (শীআ) ,যায়দী (শীআ) এবং খারিজীদের ইবাদিয়া ফিরকা। এদের মধ্যে যায়দী আহলে হাদিস ইবাদীদের সংখ্যা খুবই কম। কতিপয় লোক অযথা ৭৩ ফেরকার মনগড়া কাহীনী বহুল পরিচিত করে রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্য্ কেবল কিতাবেই পাওয়া যায়, জমীনের বুকে এর কোন অস্তিত্ব নেই।
উত্তর:এই উপমা মৌলিকভাবেই ভ্রান্ত। কারণ মিথ্যুক দাজ্জাল নবী ও সত্যবাদী নবীর মধ্যে মূলতই কোন তুলনা হতে পারে না। সত্য নবীর মধ্যে হতে পারে, আর না তার ও আল্লাহর কিতাবের মধ্যে হতে পারে।
ডকটর সাহেবের এই উদাহরণ স্বয়ং তার উপর এবং তার সম্প্রদায়ের উপর প্রযোজ্য হয়। কাদিয়ানীরা যেভাবে একজন জাল ও ভুয়া নবীর নবুওয়াত প্রমাণের জন্য রসূলুল্লাহ (স) কে মাঝখানে টেনে আনে, অনুরূপভাবে হাদীস অস্বীকারকারীরাও রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাত ও আল্লাহর কিতাবের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য আল্লাহর কিতাব ব্যবহার করছে। কাদিয়ানীরা যেভাবে গোটা উম্মাতের সম্মিলিত আকীদা “খতমে নবুওয়াত” এর বিরুদ্ধে এক নতুন নবুওয়াতের ফেতনা দাড় করিয়েছে অনুরুপভাবেই হাদীস অস্বীকারকারীরাও সুন্নাতের আইনগত মর্যাদা চ্যালেঞ্জ করে দ্বিতীয় আরেকটি ভয়ংকর ফেতনা দাড় করিয়েছে। অথচ খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত গোটা দুনিয়ার মুসলমান প্রতিটি যুগে ঐক্যমত পোষণ করে আসছে যে, কুরআনের পরেই সুন্নাত হচ্ছে আইনের দ্বিতীয় উৎস এমনকি অমুসলিম আইনজ্ঞগণও ঐক্যবদ্ধভাবে একথা স্বীকার করেন। কাদিয়ানীরা যেভাবে খতেমে নবুওয়াতের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করে এক নতুন নবী দাড় করিয়েছে অনুরূপভাভে হাদীস অস্বীকারকারীরা সুন্নাতের অনুসরণের ভুল ব্যখ্যা করে এই রাস্তা বের করেছে যে, রসূলুল্লাহ (স) এ রগোটা হেদায়াত ও শিক্ষার দফতর গুটিয়ে রেখে দিতে হবে এবং “মিল্লাতের কোন কেন্দ্র” কে প্রতি যুগে উম্মাতের মধ্যে রসূলুল্লাহ (স) এর অনুরূপ কর্তৃত্বের অধিারী বানাতে হবে। কাদিয়ানীরা তাদের মিথ্যা নবীর পথ পরিষ্কার করার জন্য রসূলুল্লাহ (স) এর সত্তার মধ্যে ক্রটি নির্দেশ করে এবং হাদীস অস্বীকারকারীরা তাদের “মিল্লাতের কেন্দ্রের’’ জন্য পথ তৈরীর উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের সমালোচনা ও ক্রটি নির্দেশ করে।
আমরা যুক্তির উপর ডকটর সাহেব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তার জবাবে বলা যায় যে, তা বাস্তবিকই ভিত্তিহীন। আমার যুক্তি এই নয় যে, আপনি সুন্নারেত মধ্যে যে ক্রটি নির্দেশ করেছেন তা কুরআন মজীদেও বর্তমান রয়েছে। পক্ষন্তরে আমার যুক্তি হলো, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মতভেদ হওয়ার সুযোগ থাকাটা মূলতই কোন আইন-কানূনের জন্য ক্রটি বা অপূর্ণতা নয়। অতএব এই সুযোগের ভিত্তিতে না কুরআনকে আইনের ভিত্তি বানানো অস্বীকার করা যেতে পারে, আর না সুন্নাতকে।
১৪. যে জিনিসের মধ্যে মতভেদের সম্ভাবনা নেই তা কি আইনের উৎস হতে পারে?
অভিযোগ:“মূল পাঠ ও তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দুটি স্বতন্ত্র জিনিস। কুরআন মজীদের মূল পাঠ কোন একটি অক্ষর সম্পর্কেও সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই। এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে বলা যায় যে, তা মানুষের কাজ যা অপর কারো জন্য দীনের সনদ ও প্রমাণ হতে পারে না। পক্ষন্তরে হাদীসের ব্যাখ্যা সেরূপ নয়, তার মূল পাঠেই মতভেদ আছে। এই মতহভেদের উপস্থিতিতে সুন্নাতকে ইসলামী আইনের উৎস কিভাবে বানানো যেতে পারে?”
উত্তর: আসল বিবেচনাযোগ্য প্রশ্ন তো এই যে, কিতাবের মূল পাঠে যদি মতৈক্য থাকে কিন্তু ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মতভেদ হয় তবে তা আইনের ভিত্তি কিভাবে হতে পারে? স্বয়ং ডকটর সাহেব বলেন যে,, “ব্যাখ্যা একটি মানবীয় কাজ যা অন্য কারো জন্য হুজ্জাত ও সনদ হতে পারে না”। এই অবস্থায় তো অপরিহার্যরূপে মূল পাঠ সনদ হুজ্জাত (দলীল-প্রমান) হতে পারে এবং অর্থের মধ্যে মতভেদ হয়ে যাওয়ার পর তার হুজ্জাত ও সনদ হিসাবে পরিগণিত হওয়াটা অর্থহীন হয়ে যায়। কেননা বাস্তবে যে জিনিস কার্যকর হয় তা কিতাবের মূল পাঠ নয়, বরং তার সেই অর্থ যা কোন ব্যক্তি মূল পাঠ অধ্যয়নপূর্বক অনুধাবন করেন। তাই আমি আমার দ্বিতীয় পত্রে তার নিকট আরজ করেছিলাম, আপনি প্রথমে আপনার এই দৃষ্টিভংগীর পরিবর্তন করুন যে, “আইনের ভিত্তি কেবল সেই জিনিসই হতে পারে যার মধ্যে মতভেদ হওয়া সম্ভব নয়।” অতপর এই কথা এভাবে মীমাংসা হতে পারে যে, কুরআন মজীদ স্বয়ং আইনের উৎস এবং তার বিভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে যে ব্যাখ্যাটি বিবেক-বুদ্ধির নিরপেক্ষ বিচারে অধিকতর বিশুদ্ধ তাই কার্যকর হবে। অনুরূপভাবে এরুপ সিদ্ধান্তেও পৌছে যেতে পারে যে, স্বয়ং সুন্নাতকে আইনের উৎস হিসাবে স্বীকার করে নিতে হবে এবং যে কোন বিষয়ের মীমাংসার ক্ষেত্রে সেই সুন্নাত কার্যকর হবে যা নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত সাব্যস্ত হবে। কুরআনের মূল পাঠকে আইনের ভিত্তি মেনে নেয়ার উপকারিতা এই হবে যে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যে মতভেদ দেখা দিবে তা কুরআনের মূল পাঠের সীমার মধ্যে আবর্তিত হবে। এসীমা অতিক্রম করতে পারবে না। অনুরপভাবে “সুন্নাত” কে আইনের ভিত্তি হিসাবে মেনে নেয়ার উপকারিতা এই হবে যে, আমরা নিজেদের কার্যক্রমের জন্য সেই সব হেদায়াত ও শিক্ষার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে পারব, যা রসূলুল্লাহ (স) এর নিকট থেকে প্রাপ্ত এবং আমরা যতক্ষণ না অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জানতে পারব যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন সুন্নাত প্রমানিত নাই। এই সোজা কথাটা বুঝতে শেষপর্যন্ত কি সুবিধা আছে?
১৫. কুরআন ও সুন্নাত উভয়ের বেলায় মতভেদ দূর করার পন্থা একই
অভিযোগ:“কুরআনের মূল পাঠ থেকে বিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে তখনই মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে যখন দীন ইসলাম একটি সমাজিক সামগ্রিক জীবন বিধানের পরিবর্তে ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। যতক্ষণ দীনের সামগ্রীক ব্যবস্থা কায়েম ছিল ততক্ষণ পর্যন্ত এ ব্যাপারে উম্মাতের মধ্যে কোন বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। আপনি কি বলতে পারেন যে হযরত আবু বাকর সিদ্দিক (রা) অথবা হযরত উমার ফারূক (রা) ইরে যুগে উম্মাতের সদস্যগণ কুরআনের কোন নির্দেশের উপর বিবিধ পন্থায আমল করতেন? আবার সেই ব্যবস্থা কায়েম হলে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এই মতভেদ অবশিষ্ট থাকবে না। তা এই অবস্থায়ই সম্ভব ছিল যখন কুরআনের মূল পাঠ সুরক্ষিত অবস্থায় বহাল থাকে। কুরআনের মূল পাঠ যদি সুরক্ষিত না থাকত এবং বিভিন্ন ফিরকার নিকট হাদীসের অনুরূপ কুরআনেরও পৃথক সংকলন থাকত, তাহলে উম্মাতের মধ্যে বাস্তব অখন্ডতার সম্ভাবনাই অবশিষ্ট থাকত না, যতক্ষণ না আরেকজন রসূল আবির্ভূত হয়ে ওহরি মূল পাঠসমূহ সুরক্ষিতভাবে মানুষের নিকট পৌছে দিতেন।”
উত্তর:কোন বিষয় হৃদয়ংগম করেই সে সম্পর্কে বক্তব্য পেশের এটা একটিা চিত্তাকর্ষক দৃষ্টান্ত। হযরত আবু বাকর (রা) ও হযরত উমার ফারূক (রা) যুগেও লোকেরা কুরআন মজীদের আয়াত সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করতেন এবং তাদের মধ্যে তাৎপর্য অনুধাবন ও ব্যখ্যার ক্ষেত্রে মতভেদ হত। কিন্তু সে সময় সৎপথপ্রাপ্ত খলীফা ও মজলিসে শুরার স্বাধীন সংস্থাও বর্তমান ছিল যার কর্তৃত্বও ছিল এবং তার জ্ঞান ও তাকওয়া সম্পর্কে উম্মাত আশ্বস্ত ছিল। এই প্রতিষ্ঠানে সার্বিক আলোচনা ও পর্যালোচনার পর কুরআনিক বিধানের যেই ব্যখ্যার অনুকুলে গণতান্ত্রিক পন্থায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হত তা-ই আইন হিসাবে কার্যকর হয়ে যেত। অনুরূপভাবে রসূলুল্লাহ (স) এর সুন্নাতের ক্ষেত্রেও সে সময় যথারীতি অনুসন্ধান চালানো হত এবং যখন আশ্বস্ত হওয়া যেত যে, কোন বিষয়ে রসূলুল্লাহ (স) এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হত। আজও যদি এরূপ কোন সংস্থা বর্তমান থাকে তবে তাও কুরআনের ব্যখ্যাসমূহের মধ্যে সর্বাধিক ঠিক ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করবে, একইভাবে তা হাদীসের ভান্ডারের মধ্যে থেকে সর্বাধিক সহীহ হাদীস অনুসন্ধান করবে।
১৬. একটি চিত্তাকর্ষক ভ্রান্তি
অভিযোগ: “আপনি বলছেন, বৃটেনের আইন লিখিত আকারে বিদ্যমান নেই। তারপরও তাদের কাজকর্ম কিভাবে চলছেআপনার কি জানা আছে যে, বৃটেনের আইনে নিত্য নতুন কত পরিবর্তন হচ্ছে? তাদের এখানকার সংসদের অধিকাংশ সদস্য যে কোন পরিবর্তন ইচ্ছা করে নিতে পারে। আপনার দৃষ্টিতে দীন ইসলামের অবস্থাও কি তাই? দীন ইসলামের আইন লিখিত আকারে না থাকায় যদি কোন পার্থক্য সূচীত না হত তবে কুরআন মজীদকে কেন লিখিত রূপ দেয়া হল এবং এই লিখিত সংকলনের হেফাজতের দায়িত্বই বা আল্লাহ কেন গ্রহণ করলেন?”
উত্তর:এটা আরেকটি চিত্তাকর্ষক ভ্রান্তি। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তার লিখিত সংকলনের হেফাজতের দায়িত্ব নেননি, যা রসূলুল্লাহ (স) স্বীয় যুগে ওহী লেখক সাহাবী গণের সাহায্য লিখিয়ে নিয়েছিলেন। কুরআন মজীদ তো আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিশ্চিত সুরক্ষিত আছে। কিন্তু মহানবী (স) এর নির্দেশে লিখিত মূল পান্ডুলিীপও কি বর্তমান আছে? হাদীস অস্বীকারকারীদের জানামতে তা যদি কোথাও বর্তমান থেকে থাকে তবে অবশ্যই যেন তারা তার খোজ বলে দেয়। মজার ব্যাপার হলো, হদীস অস্বীকারকারী সকলেই বারবার তাদের যুক্তিপ্রমাণের ভিত্তি কুরআন মজীদ লিপিবদ্ধ হওয়া এবং হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ না হওয়ার উপর স্থাপন করে থাকে। কিন্তু মহানবী (স) যে তাঁর যুগে ওহী লেখক সাহাবীগণের সাহায্যে প্রতিটি ওহী লিপিবদ্ধ করে নিতেন, এবং এই লিখিত দস্তাবেজ থেকে নকল করে হযরত আবু বাকর (রা)- র যুগেকুরআনকে একটি পুস্তকের রূপ দেয়া হয়, এবং পরবর্তী কালে হযরত উসমান (রা) তারই নকলকৃত কপিসমূহ ছড়িয়ে দেন, এসব কিছু কেবল হাদীসের রিওয়ায়াতসমূহের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারে। কুরআনে এর কোন উল্লেখ নাই। হাদীসের বর্ণনা ব্যতীত এর দ্বিতীয় কোন সাক্ষী দুনিয়ায় বর্তমান নেই। এখন হাদীসের বর্ণনাসমূহ যদি একেবারেই গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে এরপর কোন জিনিসের মাধ্যমে আপনি দুনিয়বাসিকে নিশ্চিত করবেন যে, কুরআন বাস্তবিকই মহানবী (স) এর জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ হয়েছিল?
১৭. ব্যক্তিগত আইন ও জাতীয় আইনের মধ্যে বিভক্তি কেন?
অভিযোগ:আপনি বলছেন, প্রমাণিত সুন্নাতসমূহের মধ্যেকার পার্থক্য বহাল রেখে (পাকিস্তানে সঠিক ইসলামী আইন অনুযায়ী) আইন প্রণয়নের সমস্যাটির সমাধান এভাবে করা যায়:
“ব্যক্তিগত আইনের (Personal Law) সীমা পর্যন্ত প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরআনিক বিধানের তাদের অনুসৃত ব্যাখ্যা ও প্রমাণিত সুন্নাতের সংকলন নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হবে। আর জাতিয় আইনে (Public Law) ক্ষেত্রে তা কুরআনের সেই ব্যাখ্যা এবং প্রমাণিত সুন্নাত মোতাবেক হবে যার উপর অধিকাংশের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হবে।”
আমি কি একথা জিজ্ঞেস করার দুসাহস দেখাতে পারি যে, ব্যক্তিাগত ও জাতীয় আইনের এই পার্থক্য মহানবী (স) অথবা তার সৎপথ প্রাপ্ত খলীফাদের আমলেও ছিল? আর এই পার্থক্যের সমর্থনে কুরআন মজীদ থেকে কোন যুক্তিপ্রমাণ পাওয়া যাবে কি?
উত্তর:এসব প্রশ্ন কেবলমাত্র এই কারণে সৃষ্টি হয়েছে যে, ডকটর সাহেব না ব্যক্তিগত আইন ও জাতীয় আইনের তাৎপর্য ও সীমারেখা অনুধাবন করতে পেরেছেন, আর না পাকিস্তানে আমরা যে বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেছেন। ব্যক্তিগত আইন বলতে জনগণের পরিবারিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত আইন বুঝানো হয়েছে। যেমন বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকার। আর জাতীয় আইন বলতে রাষ্টীয় সাধারণ সংগঠন, প্রশাসন ও শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় আইন বুঝানো হয়েছে। যেমন ফৌজদারী ও দেওয়াণী আইন। প্রথমোক্ত প্রকারের আইন সম্পর্কে বলা যায় যে, একই দেশে যদি বিভিন্ন সম্প্রদায় বর্তমান থাকে তবে সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের অনুসৃত আইন স্বস্ব ক্ষেত্রে কার্যকর করা হবে। তাহলে তাদের পারিবারিক জীবন নিরাপদ হওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্তহতে পারবে। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারের আইনের বেলায় পৃথক সম্প্রদায়ের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে না। তা অবশ্যম্ভাবীরূপে সকলের জন্য একরূপ হওয়া উচিত।
কুরআন মজীদ নাযিলের যুগে মুসলমানরা তো একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে ইহুদী খৃষ্টান এবং অগ্নি উপাসকরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদের ব্রক্তিগহত আইন মুসলমানদের থেকে স্বতন্ত্র ছিল। কুরআন মজীদ তাদের জন্য জিযয়া (যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য অমুসলিমদের দেয় কর) প্রদান করে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসের সযোগ করে দিয়েছিল। তার অর্থ এই ছিল যে, তাদের ধর্ম এবং তাদের ব্যক্তিগত আইনে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। অবশ্য ইসলামের জাতীয় আইন তাদের উপর মুসলমানদের মত সমভাবে প্রযোজ্য হবে। অতএব মহানবী (স) এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের সরকার এই নীতির অনুসরণ করে।
এখন পাকিস্তানে আমরা যে যুগে বেছে আছি তা কুরআন নাযিল হওয়ার যুগ নয়, বরং তা থেকে চৌদ্দশত বছর পরের যুগ। গত শতাব্দীগুলোতে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন ফেরকার উদ্ভব হয়েছে এবং কয়েক শত বছরে তার ভিত মজবুত হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কুরআনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও মতভেদ আছে এবং সুন্নাতের অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও। আমরা যদি সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়গুলোকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, তাদের মাযহাব সংক্রান্ত এবং পারিবারিক ব্যাপারসমূহে তাদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একটি অভিন্ন রাষ্টীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রস্তুত হবে। কিন্তু যদি “জাতির কেন্দ্রবিন্দু”তে সমাসীন কোন ব্যক্তি কুরআনের নাম নিয়ে তাদের নিজস্ব আকীদা-বিশ্বাস ও ইবাদাত এবং পারিবারিক বিষয়সমূহে জোরপূর্বক হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে আর এই সমস্ত ফেরকার বিলুপ্তি ঘটাতে চায় তাবে তা একটি মারাত্বক হত্যাকান্ড ছাড়া সম্ভব হবে না।
নিসন্দেহে এটা একটা দৃষ্টান্তমূলক পরিবেশ হবে যে, মুসলমানগণ পুনরায় একই জামাআতের রুপ ধারণ করবে যেখানে মুসলিম উম্মাহর জন্য যাবতীয় আইন-কানূন খোলাখুলি ও স্বাধীন আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে গৃহীত হতে পারে। কিন্তু এই দৃষ্টান্তমূলক পরিবেশ না আগে ডান্ডার জোরে সৃষ্টি হয়েছিল, আরনা বর্তমানে তা ডান্ডার জোরে সৃষ্টি করা যেতে পারে।
১৮. রসূলের মর্যাদা সম্পর্কিত সিদ্ধান্তকরী বক্তব্য থেকে পশ্চাদপসরণ
অভিযোগ: “আপনি তরজমানুল কুরআন পত্রিকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পৃষ্ঠা এই আলোচনায় নষ্ট করেছেন যে, মহানবী (স) কে ইসলামী রাষ্টের প্রধান অথবা মুসলামানদের নেতা বা বিচারক কে বানিয়েছিল? আল্লাহ তাআলা না মুসলমানগণ নির্বাচনের মাধ্যম? বুঝে আসে না যে, শেষ পর্যন্ত আপনার এই আলোচনার উদ্দেশ্য কি ছিল? রসূলুল্লাহ (স) কুরআন মজীদের নির্দেশ অনুযায়ী একটি ইসলামী রাষ্ট কায়েম করেন। একটি শিশুও একথা বুঝতে সক্ষম হবে যে, এই রাষ্টের সর্বপ্রথম সরকার প্রধান এবং মুসলমানদের পথপ্রদর্শক এবং যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চুড়ান্ত কর্তৃত্ব, যার ফয়সালার বিরুদ্দে কোথাও আপিল চলে না, তিনি রসূলুল্লাহ (স) ব্যতিত আর কে হতে পারে?”
উত্তর:যে প্রশ্নটিকে একটি অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন সাব্যস্ত করে তার মোকাবিলা করার পরিবর্তে পশ্চাদপসরণ করা হচ্ছে তা মূলত এই আলোচনার একটি সিদ্ধান্তকরী প্রশ্ন ছিল। মহানবী (স) যদি আল্লাহ তাআলার নিযুক্ত রাষ্টনায়ক, বিচারক ও পথপ্রদর্শক হয়ে থাকেন তবে একথা স্বীকার না করে উপায় নাই যে, মহানবী (স) এর সিদ্ধান্ত এবং তার শিক্ষা ও পথনির্দেশ এবং তার দেয়া বিধানসমূহ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ছিল এবং এ কারণে তা অপরিহার্যরূপে ইসলামে সনদ ও হুজ্জাত (Authority) হিসাবে গন্য। পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তি যদি মহানবী (স) এর এসব জিনিসকে সনদ ও হুজ্জাত না মানে তবে তাকে দুটি কথার মধ্যে অবশ্যম্ভাবীরূপে একটি কথা বলতে হবে। হয় সে বলবে যে, মহানবী (স) স্বয়ং রাষ্টপ্রধান, বিচারক ও পথপ্রদর্শক বনে গিয়েছিলেন। অথবা সে বলবে যে, মুসলমানরা নিজেদের মর্জি অনুযায়ী তাকে এসব পদের জন্য নির্বাচন করেছিল এবং তারা মহানবী (স) এর দ্যিমান থাকা অবস্থায় তার পরিবর্তে অপর কাউকে নির্বাচন করার অধীকারী ছিল এবং তাকে অপসারণের অধিকারও তাদের ছিল।
হাদীস অস্বীকারকারীগণ প্রথমোক্ত কথা মানতে চায় না। কারণ মেনে নিলে তাদের মতবাদের শিকড় কেটে যায়। কিন্তু শেষোক্ত দুটি কথার কোন একটি কথা পরিষ্কার বলে দেয়ার মত সৎসাহস তাদের নেই। কারণ তারা মুসলমানদের যে ধোকার জালে জড়াতে চায়, একথা বলার পর তাদের সেই জালের প্রতিটি সূতা ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই এসব লোক উক্ত প্রশ্নের জবাব দেয়ার পরিবর্তে পলায়নে ততপর হয়। পাঠকগণ এই গ্রন্থে ইতিপূর্বে “জাতির কেন্দ্রবিন্দু” শীর্ষক আলোচনাটি পুনরায় দেখে নিন এবং তারপর দেখুন যে, আমার উত্থাপিত প্রশ্নাবলী পাশ কাটিয়ে গিয়ে কিভাবে পশ্চাদপসরণনের পথ অবলম্বন হচ্ছে।
১৯. কোন অ-নবী কি নবীর যাবতীয় কর্তৃত্বের অধিকারী হতে পারে?
অভিযোগ:কুরআন নাযিল হওয়াকালে পৃথিবীতে ধর্ম ও রাজনীতি দুটি প্রথক বিভাগে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের অনুসরণ করা হত এবং রাজনৈতিক অথবা পার্থিব বিষয়ে সরকারের অনুসরণ করা হত।কুরআন মজীদ এই দ্বৈততার মূলোতপাটন করেছে এবং মুসলমানদের বলেছে যে, রসূলুল্লাহ (স) তোমাদের ধর্মীয় পথপ্রদর্শকই নন, রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাপারেও তোমাদের পথপ্রদর্শক। এজন্য উল্লেখিত সব ব্যাপারেই তার আনুগত্য করতে হবে। রসূলুল্লাহ (স) এর পর এই সকল পদে (অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে ওহী প্রাপ্ত হওয়া ছাড়া অন্যান্য পদ্য) মহানবী (স) এর স্থলাভিষিক্ত (খলীফাতুর রসূল) ব্যক্তির নিকট স্থানান্তরিত হয়েছে। এখন আল্লাহ ও তার রসূলের আনুগত্য করার অর্থ এমন একটি ব্যবস্থার আনুগত্য করা যা “খিলাফাত আলা মিনহাজিন- নুবূওয়াহ” (নবুওয়াতের পন্থায় খিলাফত পরিচালন ব্যবস্থা) পরিভাষার মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়। তাকেই আমি “জাতির কেন্দ্রবিন্দু” পরিভাষার ব্যক্ত করেছিলাম-যা নিয়ে আপনি বিদ্রুপ করছেন।
উত্তর: এই দাবীর অনুকুলে কি প্রমাণ আছে যে, ওহীর বাহক হওয়া ব্যতীত ইসলামী ব্যবস্থায় মহানবী (স) এর যতগুলো পদমর্যাদা ছিল তার সবগুলোই তার পরে খলীফা অথবা “জাতির কেন্দ্রবিন্দুর” নিকট স্থানান্তরিত হয়েছে? কুরআন মজীদের কোথাও কি একথা বলা হয়েছে? অথবা রসূলুল্লাহ (স) কি এরুপ কোন ব্যাখ্যা দিয়েছেন? অথবা খুলাফায়ে রাশেদীন কি কখনও এই দাবী করেছেন যে, তারা এই পদমর্যাদার অধিকারী? অথবা রিসালাতের যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত উম্মাতের আলেমগণের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি কি এ মত পোষণ করেছেন? কুরআন মজীদ যা কিছু বলে তা আমি এই গ্রন্থের “রসূলুল্লাহ (স) শিক্ষক ও মুরব্বি হিসাবে” শীর্ষক অনুচ্ছেদ থেকে “রসূল (স) বিচারক ও রাষ্ট্রপ্রধান” শীর্ষক অনুচ্ছেদের আওতায় উল্লেখ করে এসেছি। এরা মহানবী (স) এর কোন হাদীসই মানে না, অন্যথায় আমি সহীহ ও নির্ভরযোগ্য সনদসূত্রে বর্ণিত মহানবী (স) এর প্রচুর হাদিস পেশ করতাম যার সাহায্যে এই দাবী চূড়ান্তভাবে দাবী হচ্ছে, তারা নিজেদের উক্ত পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত মনে করতেন। কিন্তু আমি এই গ্রন্থের “খুলাফায়ে রাশেদীনের প্রতি অপবাদ” শীর্ষক অনুচ্ছেদে হযরত আবু বাকর সিদ্দিক (রা) উমার ফারুক (রা) উসমান (রা) ও আলী (রা) প্রমুখ খলীফাগনের নিজস্ব বক্তব্য হুবহু পেশ করেছি যার ফলে তাদের বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অপবাদ প্রমানিত হয় না। এখন তারা অন্তত বলে দিক, গত চৌদ্দশত বছরের মধ্যে কখনও কোন আলেমে দীন কি একথা বলেছেন?