কায়রোর দিনগুলো
কায়রোয় আমার দিনগুলো বেশ ভালোভাবেই কাটছিল। পরীক্ষায় আমি প্রথম বিভাগ উত্তীর্ণ হই। দারুল উলূমের পক্ষ থেকে আমি বৃত্তি লাভ করি। মাসে এক পাউন্ড বৃত্তির এ টাকা অ-পাঠ্য পুস্তক ক্রমের কাজে ব্যয় করি। আমার বর্তমান লাইব্রেরীর অনেক কিতাবই বৃত্তির টাকায় কেনা। ছাত্রজীবনে এসব কিতাব আমার সঙ্গে ছিল। আমি প্রতি সপ্তাহ শুক্রবার জুমার নামাজের পর শায়খ হোছাফীর বাসায় গমন করে যিকরের মাহফিলে যোগ দিতাম। এখানে আমি লাভ করতাম এক অনাবিল স্বাদ ও আনন্দ। সপ্তাহের অধিকাংশ রাত কাটতো শায়খ হোছাফীর প্রথম খলীফা আল আফেন্দী গালেব-এর বাসভবনে। আমি তাঁকে ডাকতাম সাইয়্যেদুনা আফেন্দী উপাধীতে। ওদিকে ভাই আহমদ আফেন্দী সাকারীর নিকট প্রায় প্রতিদিন পত্র লিখতাম আর সেও প্রায় প্রতিদিনই আমার কাছে চিঠি লিখতো। ছুটির দিনগুলোতে মাহমুদিয়া গমন, আহমদ সাকারী এবং হোছাফী ভাইদের সঙ্গে কাটাতাম। এভাবে সুন্দর রকমে কেটে যাচ্ছিল আমার শিক্ষা, আমল আর রূহানী জীবন। আলহামদু লিল্লাহ, কোন কিছুই তা কলুষিত করতে পারেনি।
ঘটনা না দুর্ঘটনা
বৎসরেরর শেষদিকে বার্ষিক পরীক্ষার সময় সম্ভবত: পরীক্ষার দুদিন যেতে না যেতেই এক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। যা এক বিরাট দুঃখের কারণ হয়ে দেখা দেয়। অবশ্য এ ঘটনা আমার জন্য একদিক থেকে কল্যাণকরও ছিল। এ দুর্ঘটনার ফলে আমাদের গোটা পারিবার মাহমুদিয়া থেকে কায়রোয় স্থানান্তরিত হয়।
আমার এক সহপাঠী আমার সঙ্গেই থাকতো। আমার মতো সে-ও ছিল বহিরাগত। পরীক্ষায় আমি তার চেয়ে উপরে থাকবো, এটা সে সহ্য করতে পারছিল না। কারণ, বয়সে সে ছিল আমার চেয়ে বড় এবং বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশকটা বৎসর সে অতিবাহিত করে এসেছে। সুতরাং তার বিবেচনায় প্রথম হওয়ার সে-ই বেশী হকদার। এটা তারই অধিকার। আমার মতো কম বয়সের ছাত্র প্রথম হবে- এটা সে কিভাবে মেনে নেবে। বিষয়টা তার মন-মানসে ভালোভাবে চেপে বসে। তাই পরীক্ষা থেকে আমাকে বিরত রাখার উপায় সম্পর্কে সে ভাবতে থাকে। সে একটা উপায় বের করে যে, আমরা যখন গভীর নিদ্রামগ্ন, তখন সে এক বোতল এসিড আমার মুখ আর ঘাড়ে ঢেলে দেয়্ আমি বিচলিত হয়ে জেড়ে উঠলে সে শুয়ে পড়ে ঘুমের ভান করে। অন্ধকারে আমি তাকে চিনতে পারিনি। আমি তৎক্ষণাৎ গোসলখানায় চলে যাই এবং ঝলসে দেয়ার উপকরণ ধুয়ে ফেরার চেষ্টা করি। ইতিমধ্যে মসজিদ থেকে ফজরের আযান ধ্বনিত হয়্ আমি তাড়াতাড়ি মসজিদে গমন করি। নামায পড়ে এসে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকি। কারণ, অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করারয় আমি ঘুমে অস্থির ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে এসিড় হামলার লক্ষণ দেখতে পাই। ভোর বেলাই সে পালিয়ে যায়। একজন সঙ্গি বলে যে, আমি তার হাতে একটা শিশি দেখেছি ফিরে এলে জিজ্ঝেস করায় সে অপরাধ স্বীকার করে এবং এর কারণ তাই উল্লেখ করে, যা আমি পূর্বে বলেছি। বাসায় সব সঙ্গী তার প্রতি লেলিয়ে গিয়ে তাকে বেশ মারধর করে, তার সমস্ত আসবাবপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তার উপর। এবং তাকেও কক্ষ থেকে বের করে দেয়। কোন কোন বন্ধ পুলিশ আর দারুল উলূমের প্রশাসনকে জানাতে বলে আমিও তাই করার চিন্তা করেছিলাম। পরে ভাবি যে, আমি রক্ষা পেয়েছি। এটা আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী। এর শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যাবে না। আর আল্লাহর শোকর আদায়ের উপায় হচ্ছে হামলাকারীকে ক্ষমা করা।
“যে ব্যক্তি ক্ষমা আর সংশোধন করে নেয়, তার প্রতিদান আল্লার যিম্মায়”। (সূরা শূরাঃ ৪০)
তাই আমি বিষয়টি আল্লার উপর ছেড়ে দেই এবং তার বিরুদ্ধে আদৌ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি।
খবরটা মাহমুদিয়ায় পৌঁছে। পরীক্ষা শেষে আমিও মাহমুদিয়া গমন করি। পরীক্ষার ফলও বের হয়েছে। আলহামদু লিল্লাহ আমি প্রথম হয়েছি। এ সময় আম্মাজান চাপ দেন যে, দু’টি কাজের যে কোন একটি অবলম্বন করতে হবে। হয় আমাকে পড়ালেখা ছেড়ে চাকুরী গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় বাসা বদল করে আমার সঙ্গে তাঁকেও কায়রো চলে আসতে হবে।
কায়রোর বাসা স্থানান্তর
এ সময় ভাই আব্দুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে। তাকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে হবে। ভাই মুহাম্মদও প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছে। আব্বাজানের ইচ্ছা, তাকে আল আযহারে ভর্তি করাবেন। অন্যান্য ভাইদের জন্যও শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরী। মাহমুদিয়ায় শিক্ষার তেমন সুযোগ ছিল না। পরিস্থিতির দাবী ছিল কায়রো গমন করা। যদিও দীর্ঘ সফর। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে।
ছুটি শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগে আব্বাজান কায়রো গমন করতঃ উপার্জনের সন্ধান করতে থাকেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর সন্ধান সফল করেন। তিনি মাহমুদিয়া ফিরে এলে গোটা পরিবার মাহমুদিয়া থেকে কায়রো বদলী হয়ে যায়। আব্দুর রহমান কমার্স স্কুলে ভর্তি হয়। মুহাম্মদ কায়রোয় আল-আযহারের মা’হাদুল কাহেরার সঙ্গে যুক্ত হয়। অন্যান্য ভাইয়েরাও উপযুক্ত বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
মনের অবস্থা
এভাবে গোটা পরিবার এক সঙ্গে বাস করার আনন্দকে কেবল একটা অনুভূতিই- যা ছিল কঠিন আর অস্বস্তিকর- ম্লান করে তুলছিল। আর সে অনুভূতি ছিল ভাই আহমদ আফেন্দী সাকারীর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্কচ্ছেদ। তার সঙ্গে আমার এ সম্পর্ক ছিল লিল্লাহ। প্রথমে তো আমরা এই বলে মনকে সান্ত্বনা দিতাম যে, ছুটির সময় এ বিচ্ছেদ পুষিয়ে নেবো। আর শেষ পর্যন্ত আমাদের ঠিকানা থাকবে একই শহরে। কিন্তু বর্তমানে আমরা সম্পূর্ণ একটা নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। এখন তো এমনও হতে পারে যে, আমি আর কখনো মাহমুদিয়ায় ফিরে যাবো না। মনে দারুণভাবে এ খটকা জাগছিল। এ বিষয়ে অনেক ভাবতে হবে এবং এর একটা উপায় বের করতে হবে।
এ ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য আহমদ আফেন্দীর সঙ্গে আমার কয়েক দফা বৈঠক হয়। এ চিন্তায় বেশ কিছু রজনী কাটে। কথাবার্তা হয়। বৈঠক বসে এবং ভাঙ্গে। আহমদ আফেন্দী ব্যবসায়ী। আর ব্যবসায়ীর নির্দিষ্ট কোন দেশ থাকে না। সে-ও তো আমাদের সঙ্গে কায়রো চলে আসতে পারে। কিন্তু তার পরিবারের লোকজন? তারা কি করবে? তারা আসতে চায় না, অবস্থা আর পরিবেশও তাদেরকে এ অনুমতি দেয় না। তাহলে এখন উপায় হবে? এ বিষয়ে আমরা অনেক চিন্তা করি। অবশেষে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, বর্তমান বৎসরটি হবে পরীক্ষামূলক। এরপর দেখবো, কি হতে পরে। আমরা কায়রোয় বদলী হয়ে যাই। নতুন বৎসর শুরু হয়। আহমদ আফেন্দী বৎসরের শুরুতে প্রায় এক বৎসর আমার সঙ্গে কায়রোয় কাটায়। এরপর সে মাহমুদিয়ায় ফিরে যায়। বৎসরের শেষ নাগাদ আমরা চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করি। এরপর শুর হয় গ্রীষ্মের ছুটি।
মাহমুদিয়ায় ঘড়ির দোকান
হ্যাঁ, এখন দ্বিতীয় গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। ছুটির এ সময়টা আমি আহমুদিয়ায় কাটাতে চাই। কিন্তু ছুটির পুরো সময়টা সেখানে কাটাবার জন্য কোন উপায় বের করতে হবে। আমি আব্বাজানকে বলি যে, আমি মাহমুদিয়া যাবো। সেখানে একটা দোকান খুলে আমি স্বাধীনভাবে ঘড়ি মেরামতের কাজ করবো। ফলে এ পেশায় আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা হবে। আমার মাহমুদিয়া যাওয়ার আসল কারণ আব্বাজান ভালোই জানতেন। কিন্তু অধিকন্তু তিনি আমার ইচ্ছা মেনে নিতেন। আর আমিও সব সময় মনে করতাম যে, আমার কাজকর্মের প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এ আস্থা অনুযায়ী তিনি আমাকে মাহমুদিয়া গমনের অনুমতি দেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমার কল্যাণ কামনাও করেন। আমি মাহমুয়িায় একটা দোকান নিয়ে কার্যত: ঘড়ি মেরামতের কাজ শুরু করি। এহেন জীবন ধারার আমার দু’ধরনের সৌভাগ্য লাভ হয়। একটা হচ্ছে আত্মনির্ভরশীলতা। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে নিজ হাতে জীবিকা উপার্জনের সৌভাগ্য। আহমদ আফেন্দী এবং হোছাফী ভাইদের সঙ্গে। আমরা আল্লাহর যিকর করতাম, ইলম আর ইরফান সম্পর্কে আলোচনা করতাম; কখনো মসজিদে, কখনো বাসাবাড়ীতে, আবার কখনো শহরের বাইরে খোলা ময়দানে। দিনে নীল নগে গোসল করারও সুযোগ হতো। আহমদ আফেন্দীর সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাতেরও সুযোগ হতো। এসব সম্পর্কে অধিকন্তু আমাদের গোটা রাত অতিবাহিত হয়ে যেতো। ছুটির গোটা সময়টা আমি কাটাতাম আহমদ আফেন্দীর বাসায়। ফলে রাতদিন আমরা একই সঙ্গে থাকতাম।
যিকর আর ইবাদাতে আমরা সম্পূর্ণ নিমগ্ন থাকতাম। তরীকতের দরূদ আর ওযীফায় ডুবে থাকলেও জ্ঞান চর্চা আর অধ্যয়নে নিমগ্নতায়ও কোন কমতি ছিল না। বাহ্যতঃ দ্বীনের বিধি-বিধানের বিরোধী যে কোন কাজের প্রতি আমাদের ঘৃণা ছিল। তাসাউউফের নানা সিলসিলার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে আমরা বলতাম, এরা ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা হোছাফী তরীকার মুরীদ ছিলাম। যিকর-ইবাদাত এবং আদাব ও সুলূকের মূল্যও আমরা পূর্ণ ইখলামের সঙ্গে মেনে নিতাম। কিন্তু আমাদের চিন্তা ছিল স্বাধীন। তাই বলে আমরা অন্ধ ভক্ত আর অনুসারী ছিলাম না।
একটা অনুকরণীয় আদর্শ
আমার মনে পড়ে যে, রবিউল আউয়াল মাস এলে পয়লা রবিউল আউয়াল থেকে ১২ই রবিউল আউয়াল পর্যন্ত প্রতি রাত্রে অভ্যাস অনুযায়ী আমরা হোছাফী ভাইদের মধ্যে কোন একজনের বাসায় যিকরের মহফিলের আয়োজন করতাম এবং মীলাদুন্নবীর মিছিল নিয়ে বের হতাম। এক রাত শায়খ শালবীর রিজালের বাসায় সমবেত হওয়ার পালা ছিল। অভ্যাস অনুযায়ী এশার পর আমরা তাঁর বাসায় হাজির হই। দেখি, বাসা আলোয় ঝলমল করছে। গোটা বাসা ভালোবাভে সাজানো হয়েছে। বেশ পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন। শায়খ শালবী রেওয়াজ অনুযায়ী উপস্থিত লোকজনকে শরবত, কফি এবং খোশবু পরিবেশন করেন। এরপর মিছিল আকারে আমরা বের হই। অতীব আনন্দের সঙ্গে প্রচলিত ভক্তিমূলক কবিতা আবৃত্তি করি। মিছিল শেষে আমরা শায়খ শালবির রিজালের বাসায় ফিরে আসি। কিছু সময় তাঁর সঙ্গে কাটাই। আমরা যখন ফিরে আসতে উদ্যত হই, তখন শায়খ শালবী হাসিমুখে ঘোষণা করেন: কাল ভোরে আপনারা আমার বাসায় আসবেন রুহিয়াকে দাফন করার জন্য।
রুহিয়া শায়খ শালবীল একমাত্র কন্যা। বিয়ের প্রায় ১১ বৎসর পর আল্লাহ তাঁকে এ কন্যা সন্তান দান করেন। এ কন্যা সন্তানকে তিনি এতই ভালোবাসতেন যে, কাজের সময়ও তাকে দূরে রাখতেন না। মেয়েটি বড় হয়ে যৌবনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। শায়খ তার নামকরণ করেন রুহিয়া। কারণ, সে ছিল দেহের জন্য প্রাণস্বরূপ। তাঁর ঘোষনায় আমরা মর্মাহত হই। জানতে চাই, কখন রুহিয়ার ইনতিকাল হয়েছে। বললেন, আজই মাগরিবের একটু আগে। বললাম, আপনি আগে কেন বললেন না? তাহলে মীলাদুন্নবীর শোভাযাত্রা অন্য কারো বাসা থেকে বের করতাম। বললেন: যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। এতে আমার শোক-দুঃখ কিছুটা হালকা হয়েছে। শোক আনন্দে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ামতের পরও কি আল্লাহ তা’আলার আর কোন নিয়ামতের দরকার আছে? আলোচনা তাসাউউফের শিক্ষার রূপ ধারণ করে। শায়খ শালবী নিজেই এ শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি তাঁর চক্ষের পুতুল আর কলিজার টুকরার মৃত্যুর এ ব্যাখ্যা করেন যে, মূলত: এ মৃত্যু দ্বারা আল্লাহ পরীক্ষা করেন। তিনি চান না যে, তাঁর বান্দাহদের অন্তর অন্য কিছুকে ভালোবাসুক, গায়রুল্লাহর সঙ্গে যুক্ত থাকুক। হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ঘটনা থেকে তিনি প্রমাণ উপস্থাপন করেন যে, হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর সঙ্গে যখন তাঁর অন্তর ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে যায়, তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁকে হুকুম দেন হযরত ইসমাঈল (আ:) কে কুরবানী করার। হযরত ইয়া’কুব (আ:)-এর উদাহরণ দিয়েও তিনি বলেন যে, তাঁর অন্তরে হযরত ইউসুফ (আ:)-এর প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা সৃষ্টি হলে আল্লাহ তা’আলা কয়েক বৎসরের জন্য তাকে দূরে সরিয়ে রাখেন। সুতরাং বান্দাহর অন্তর গায়রুল্লাহর সঙ্গে লেগে থাকা কিছুতেই উচিত নয়। অন্যথায় মহান আল্লাহর সঙ্গে ভালোবাসার দাবীতে সে মিথ্যা হবে।
হযরত শালবী হযরত ফুযাইল ইবনে আয়াযের কাহিনীও উদাহরণ হিসাবে পেশ করেন। তিনি ছোট মেয়েটাকে হাত ধরে টনে কোলে তুলে চুমো খান। মেয়ে বলে: আব্বাজান! আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন? হযরত ফুযাইল বললেন: কন্যা, নিশ্চয়ই। কন্যা বললো: খোদার কসম, ইতিপূর্বে আমি তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করতাম না। ফুযাইল বললেন: কি ব্যাপার, আমি কখন মিথ্যা বলেছি? বন্যা বলে: আমার ধারণা ছিল, আল্লাহর সঙ্গে তোমার যে সম্পর্ক, তা থাকতে অন্য কিছু তোমার কাছে প্রিয় হতে পারে না। এ কথা শ্রবণ করে হযরত ফুযাইল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং চিৎকার করে উঠেন: তোমার বান্দাহ ফুযাইলের রিয়াকারীর বিষয়টা শিশুর কাছেও ধরা পড়েছে। এ ধরনের ঘটনা বর্ণনা করে শায়খ শালবীল রিজাল আমাদের দুঃখ হালকা করতে চান। তাঁর বিপদে আমরা যে দুঃখ পেয়েছি, তা দূর করার চেষ্টা করেন। তাঁর বাসায় মীলাদের কর্মসূচী পালন করে আমরা যে লজ্জা পেয়েছি, তিনি তা দূর করার চেষ্টা করেন। পরদিন ভোরে আমরা তাঁর বাসায় উপস্থিত হয়ে রুহিয়াকে দাফন-কাফনের আয়োজন করি। আমরা ঘর থেকে কোন কান্নার আওয়াজ শুনতে পাইনি। কোন মুখ থেকে অসমীচীন কোন কথা বের হয়নি। কেবল ছবর আর শোকরই আমরা দেখতে পেয়েছি। আমরা দেখতে পেয়েছি আল্লাহর ইচ্ছার সম্মুখে সকলকে আত্মসমর্পণ করতে। আমাদের ওস্তাদ শায়খ যাহরানের এক কন্যা সন্তানও ইনতিকাল করে; কিন্তু এ শোককে ওয়াজ-নছিহতের অনুষ্ঠানে পরিণত করা ছাড়া তিনি অন্য কিছুই করেননি। একাধারে তিন রাত তিনি এ কর্মসূচী পালন করেন। এভাবে শোক আর মৃত্যু উপলক্ষে বেদয়াত আর বদরসম মূলোৎপাটনের এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
কায়রো প্রত্যাবর্তন এবং ইসলামী সংগঠনে যোগদান
আমি কায়রো প্রত্যাবর্তন করি। সেকালে কায়রোয় আজকের মতো এতো ইসলামী সংগঠন ছিল না। তখন কায়রোয় কেবল একটা ইসলামী সংগঠন ছিল। এর নাম ছিল জমিয়তুল মাকারিমিল ইসলামিয়াহ। শায়খ মাহমুদ ছিলেন এ সংগঠনের নেতা। বরকতুল ফীল মহল্লায় দারুস সাদাতে ছিল এ সংগঠনের সদর দফতর। এখানে বিভিন্ন ইসলামী বিষয়ে তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ বক্তৃতা হতো। সংগঠনের কারী শায়খ আব্বাস তাঁর সূললীত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত দ্বারা সকলকে মুগ্ধ করতেন। সংগঠনের সমাবেশে আমি নিয়মিত যোগদান করি এবং যতদিন কায়রো ছিলাম এ সংগঠনের সদস্য হিসাবে অংশ গ্রহণ করেছি।
ইসলামের প্রচারক প্রস্তুত করার প্রস্তাব
কায়রোয় বহুস্থানে বিপথগামিতা আর ইসলামী নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের এমন অনেক দৃশ্য চোখে পড়ে, যা মিশরীয় গ্রামের শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কখনো চোখে পড়েনি। উপরন্তু কোন কোন পত্র-পত্রিকায় এমন কিছু ছাপা হচ্ছিল, যা ইসলামী শিক্ষার সরাসরি পরিপন্হী। আর সাধারণ লোকেরাও ছিল দ্বীনের বিধি-বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ। এসব কিছু দেখে আমি মনে মনে বলি, ইসলামের শিক্ষা জনগণের নিকট পৌঁছবার জন্য কেবল মসজিদই যথেষ্ট নয়। তখন বিজ্ঞ আলেমদের একটা দল স্বেচ্ছায় মসজিদে ওয়ায করতেন, দ্বীন প্রচার করতেন। এসব ওয়ায মানুষের মনে বিরাট ছাপ মুদ্রিত করতো। ওস্তাদ আব্দুল আযীয খাওলী, ওস্তাদ শায়খ আলী মাহফুয এবং ওয়াকফ বিভাগের ওয়ায ও তাবলীগ শাখার সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল শায়খ মুহাম্মদ আল আদবী ছিলেন ওয়ায়েযদের অন্তর্ভুক্ত। আমি ভাবলাম, আযহারী ছাত্র এবং দারুল উলূমের ছাত্রদের সমন্বয়ে একটা গ্রুপ গড়ে তোলার প্রস্তাব করবো। এরা মসজিদে ওয়ায ও তাবলীগের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে এবং কফি শপ আর সাধারণ মানুষের সমাবেশে ওয়ায আর তাবলীগ করবে। আর এদের সমন্বয়ে একটা দল গড়ে তোলা হবে, যারা গ্রামে- গঞ্জে এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরে-বন্দরে ছড়িয়ে পড়বে এবং মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেবে। আমি এ চিন্তাকে বাস্তব রূপ দেই এবং এ মহান পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করার জন্য একদল বন্ধু সংগ্রহ করি। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ওস্তাদ মুহাম্মদ মাদকুর। ইনি ছিলেন আল আযহারের শিক্ষাপ্রাপ্ত কিন্তু তখনো আযহারের ক্যাম্পাস তিনি ত্যাগ করেননি। দ্বিতীয়জন ছিলেন ওস্তাদ শায়খ হামেদ আসকারিয়া আর তৃতীয়জন ছিলেন ওস্তাদ শায়খ আহমদ আব্দুল হালীম (ইনি পরবর্তীকালে ইখওয়ানুল মুসলিমুন এ যোগদান করেন এবং কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য হন)। এছাড়া আরো কিছু বন্ধু বান্ধবও ছিলেন। আমরা ছালিবিয়ার শায়খুন মসজিদে ছাত্রাবাসে সমবেত হতাম এবং মিশনের গুরুত্ব এবং এজন্য প্রয়োজনীয় বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা করতাম। এ কাজের জন্য আমি কিছু কিতাবপত্র যেমন ইমাম গাযালীর এহইয়াউল উলূম, নাবহানীর আনওয়ারুল মুহাম্মদীয়্যাহ এবং শায়খ কুর্দীর তানবীরুল কুলূব ফী মুয়ামালাতি আল্লামিল গুয়ুবও দান করেছিলাম আমার ব্যক্তিগত পাঠাগার থেকে। এসব কিতাব দ্বারা মুবাল্লিাগদের জন্য একটা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরী গড়ে তোলা হয়। তারা এ লাইব্রেরী থেকে কিতাব ধার নেবে এবং বক্তৃতার জন্য প্রস্তুতি নেবে।
কফি শপে দাওয়াতের কাজ
জ্ঞানের প্রস্তুতির পর আসে কাজের পালা। বন্ধুদের নিকট আমি প্রস্তাব করি যে, আমার কফি শপে ওয়ায আর তাবলীগের জন্য গমন করবো। আমার এ প্রস্তাবে তারা ভীষণ বিস্ময় প্রকাশ করে বলে: কফি শপের মালিক কিছুতেই তাবলীগের অনুমতি দেবে না, বরং বিরোধিতাই করবে। কারণ, এতে তাদের কাজের ব্যাঘাত হবে। সব কিছুই তো অচল হয়ে যাবে। আর কফি শপে যারা যায়, তাদের অধিকাংশই এমন লোক, যারা নিজেকে নিয়েই নিমগ্ন থাকে। তাদের জন্য এর চেয়ে ভারী আর কিছু হতে পরে না। খেলাধুলা আর ক্রীড়া কৌতুক ছাড়া অন্য কিছুর যাদের কোন চিন্তাই নেই, আর এসব করার জন্যই যারা এখানে ছুটে এসেছে, এমন লোকদের কাছে আমরা কেমন করে দ্বীন আর নৈতিকতার কথা বলবো? আমি ছিলাম বন্ধুদের এ চিন্তাধারার বিরোধী। আমার বিশ্বাস ছিল, কফি শপে যারা বসে, তাদের অধিকাংশই অন্য সব লোকের চেয়ে এমনকি যারা মসজিদে গমন করে, তাদের চেয়েও উপদেশ আর নছিহত শুনতে বেশী ভালোবাসে। কারণ, এটা তাদের জন্য একটা সম্পূর্ণ অভিনব বিষয়। আসল হচ্ছে ভালো আলোচ্য বিষয় চয়ন করা। আমরা এমন কোন বিষয়ে আলোচনা করবো না, যা তাদের আবেগ- অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে। আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে কথা বলার সঠিক পদ্ধতি। আগ্রহ সহকারে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে আমাদের কথা উপস্থাপন করতে হবে। আর তৃতীয় বিষয় হচ্ছে সময়। দীর্ঘ ওয়ায থেকে আমাদেরকে বিরত থাকতে হবে।
বিষয়টা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা এমনকি বিতন্ডাও চলে। আমি বন্ধুদেরকে বলি, বাস্তব অভিজ্ঞতাকে এ বিরোধের চূড়ান্ত সীমা নির্ণয় করাই কি উত্তম হবে না? ফলে সকলেই আমার পরামর্শ মেনে নেয় এবং আমরা বেরিয়ে সালাহুদ্দীন পার্কের কফি শপ থেকে কাজ শুরু করি। সেখান থেকে বের হয়ে সাইয়্যেদা আয়েশা মহল্লার কফি শপে গমন করি। এরপর গমন করি তুলুন চকে ছড়িয়ে থাকা কফি শপ অভিমুখে। শেষ পর্যন্ত আমাদের দলটা তরীকুল জাবাল হয়ে সালামা সড়কে গিয়ে পৌঁছে। এবং সাইয়্যেদা যয়নবের অলি-গলিতে ছড়িয়ে থাকা কফি শপও চষে বেড়ায়। আমার মনে পড়ে, একই রাত্রে আমরা ২০টির বেশী বক্তৃতা করি। প্রতিটি বক্তৃতা ছিল পাঁচ থেকে দশ মিনিট সময়ের।
শ্রোতাদের বিস্ময়কর অনুভূতি প্রত্যক্ষ করা যায়। তারা অতি আগ্রহ নিয়ে নিতান্ত মনোযোগ সহকারে আমাদের বক্তৃতা শ্রবণ করে। কফি শপের মালিক বক্তৃতার শুরুতে হাতে আঙ্গুল কামড়িয়ে আমাদের দিকে তাকায়। কিন্তু পরে আরো বলার জন্য অনুরোধ করে। তারা আমাদেরকে কসম খাইয়ে বলেন, আমাদেরকে অবশ্যই কিছু খেতে হবে, বা পছন্দসই কিছু নিতে হবে। কিন্তু সময়ের সংকীর্ণতার ওযর পেশ করে আমরা বলতাম- আমরা এ সময়টা আল্লাহর কাজের জন্য উৎসর্গ করেছি। সুতরাং অন্য কোন কাজে তা ব্যয় করতে পারি না। আমাদের এ ব্যাখ্যা তাদের অন্তরে আরো বেশী ক্রিয়া করে। অসম্ভব নয় যে, এ কথায় এ রহস্যও লুক্কায়িত রয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা যতোসব নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, তাঁদের সকলের প্রথম ঘোষণা ছিল-
**********************************
লোকসকল! এ উপদেশের জন্য আমরা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাই না (সূরা হুদ: ১৫১)।
কারণ নিঃস্বার্থভাবে কথা বললে শ্রোতাদের অন্তরে ভালো ক্রিয়া করে।
আমাদের প্রথম পরীক্ষা শতকরা একশ ভাগ সফল হয়। আমরা শায়খুন কেন্দ্রে ফিরে আসি। এ সফলতায় আমরা যার পর নাই আনন্দিত হই। এ ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখার দৃঢ় সংকল্প করি আমরা। এটা অব্যাহত রাখা হবে বলে লোকজনের কাছেও আমরা ওয়াদা করি। মাহমূদিয়ার হোছাফী ভাইদের থেকে দূরে সরে যাওয়ার দুঃখও এতে কিছুটা হ্রাস পায়। এ সংস্থা এখন কার্যতঃ বিলূপ্ত হলেও সদস্যদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক এখনো অটুটস রয়েছে এবং এখনো তারা সকলে মিলে ইসলামের খেদমত করে যাচ্ছেন। যিকর- ইবাদাত এবং আমর বিন মারুফ আর নাহী আনিল মুনকার- এর কাজে হোছাফী তরীকা চেতনা চাঙ্গা করে তোলে। মাহমূদিয়ার মতো শান্ত শহরেও খৃষ্টান মিশনারীরা আখড়া গেড়ে বসেছে। ইতিপূর্বে এ শহরে এ মহামারী ছিল না। এদের জন্য উচিত হচ্ছে যেসব অঞ্চলে ধর্ম-কর্মের চর্চা নেই, সেখানে গমন করা এবং মুসলিম জনপদকে কলূষিত না করা। অন্য সমস্ত জাতির তুলনায় ঈমানের ব্যাপারে মুসলমানরা সত্যবাদী। তারা আল্লাহর সত্যিকার একত্ববাদের পতাকাবাহী। তাদের অন্তর পবিত্র আর বক্ষ নিষ্কুলষ।
শ্রেণী কক্ষে
তখন পর্যন্ত দারুল উলূমের শিক্ষা জড়তার শিকার হয়নি। বরং ছাত্র এবং শিক্ষকদের বয়স ও জ্ঞানের পর্যায়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হতো। অনেক সময় এমন হয়েছে যে, আমরা শ্রেণী কক্ষেই নানাবিধ সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি; এমনকি ছাত্র এবং শিক্ষকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সে কালে মিশরে রাজনৈতিক উদ্দীপনা চরমে পৌঁছে। ওয়াফদ পার্টি আর দস্তুর পার্টির মধ্যে ফাটল দেখা দেয়। আর এর পরিণতিতে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে একের পর এক। রাজনীতিকরা একতাবদ্ধ হতো, এরপর আবার বিচ্ছিন্ন হতো এবং এদের মধ্যে সালিশ পালা চলতো। আর এ সালিশী কখনো সফল হতো, আাবর কখনো হতো ব্যর্থ। এসব ঘটনা আর বাস্তবতা নিয়ে ছাত্র আর শিক্ষকরা আলোচনা সমালোচনা করতো। শিক্ষকরাও ছাত্রদের সম্মুখে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে কার্পণ্য করতেন না, রবং এমন অনেক ধর্মীয় বিষয়ও সামনে আসতো, যাতে ছাত্ররা শিক্ষকদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতো এবং তাদের মধ্যে বাক-বিতন্ডার দ্বার উন্মুক্ত হতো। কিন্তু এসব কথা যতটা আযাদীর সঙ্গে চলতো, ততটাই মেনে চলতো পরিপূর্ণ শিস্টাচারের সীমা। আামর মনে এ চিত্র এখনো অংকিত আছে যে, আমরা শিক্ষকদেরকে এতটা শ্রদ্ধা করতাম যে, তাঁদের কক্ষের সম্মুখ দিয়েও ছাত্ররা যেতো না। অথচ ছাত্রদের ক্লাশে যাওয়ার পথেই পড়তো তাদের কক্ষ। আমরা পরিপূর্ণ আযাদী ভোগ করতাম, তারপও তাঁরা আমাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতেন।শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের পরিপূর্ণ আত্মিক সম্পর্ক বজায় ছিল। আমরা শিক্ষকদের সম্মান এবং মর্যাদা কখনো বিসর্জন দেইনি। কখনো কখনো পাঠদান কালে কোন শিক্ষকের সঙ্গে দ্বিমতও হতো। আর শিক্ষক কৌতুক করতেন, বা দাতভাঙ্গা জবাবও দিতেন। আমার মনে আছে, আমাদের এক সহপাঠী ক্লাশ চলাকালে শিক্ষককে জিজ্ঞেস করে: আপনি কি বিবাহিত? শিক্ষক জবাব দেন, না। ছাত্র বলে: জনাব, কেন আপনি বিবাহ করেননি? আপনার তো বেশ বয়স হয়েছে। শিক্ষক বলেন: “অপেক্ষা করছি, বেতন যাতে এতটা বৃদ্ধি পায়, যা বিবাহের খরচ আর পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য যথেষ্ট হতে পারে এবং সন্তানদেরকে যেন ভালোভাবে লালন-পালন করতে পারি”। ছাত্র বলে: “কিন্তু আপনি যদি আরো বিলম্ব করেন, তবে আপনি তো নিশ্চয়তা দিতে পারেন না যে, আপনি বেঁচে থাকবেন এবং সন্তানদের লালন-পালন করবেন। জনাব, জীবিকা আর হায়াত তো কেবল আল্লাহরই হাতে। শিক্ষক নাজুক অবস্থায় পড়ে যান এবং বলেন, “তুমি কি বিবাহিত?” ছাত্রটি জবাব দেয়: “জি হ্যাঁ, আমার সন্তান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন আমার সঙ্গে গৃহ থেকে বের হয়। আমি আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গমন করি, আর সে গমন করে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে”। এ কথা শুনে ছাত্ররা খিলখিল করে হেসে পড়ে আর এখানেই আলোচনার সমাপ্তি ঘটে।
পোশাক পরিবর্তন
দারুল উলূমের চতুর্থ বর্ষে- যা ছিল দারুল উলূমের শেষ বর্ষ- ইউনিফর্ম পরিবর্তনের আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। সমস্ত ছাত্ররা এ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত। দারুল উলূম থেকে পাশ করা গুরুজনরা সমর্থন করায় এ আগ্রহ আরো তীব্র হয়ে উঠে। কিন্তু আমি এবং মুষ্টিমেয় ছাত্র এ পরিবর্তনের পক্ষে ছিলাম না। কয়েক মাসের মধ্যে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, দারুল উলূমে আগত ছাত্রদের এক বিরাট অংশ হয়ে উঠে স্যুটপরা বাবু আর কিছু অংশ মওলবী। প্রতিদিন ফেজ ক্যাপ পরিধানকারী ছাত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে আর পাগড়ি পরিধানকারীর সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তো পাগড়ি পরিধানকারী কেবল দু’জন দাঁড়ায়। একজন শায়খ ইবরাহীম, যিনি পরবর্তীকালে শিক্ষা বিভাগে যোগদান করেন শিক্ষকের পদে আর দ্বিতীয়জন ছিল এ অধম লেখক। আর এ সময় বাস্তব শিক্ষারও সুযোগ ঘটে। দারুল উলূমের প্রিন্সিপাল ছিলেন অতি বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ওস্তাদ মুহাম্মদ বেক সাইয়্যেদ। একদিন তিনি আমাদের দু’জনকে ডেকে বললেন: বাস্তব শিক্ষার জন্য আমরা এমন কোন প্রতিষ্ঠানে গমন করলে ভালো হয়, যেখানে নতুন ইউনিফর্মে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। এর ফলে ছাত্রদের সামনে নানা সুরতে আমাদেরকে উপস্থিত হতে হবে না। কিছু ছাত্র পাগড়ি পরিধান করবে আর বেশীরভাগ ছাত্র পরিধান করবে ফেজ ক্যাপ। শিক্ষকের এ উপদেশপূর্ণ কথার অর্থ বাধ্যতামূলক ছিল না। কিন্তু তাঁর জোরালো বক্তব্য আর তাঁর মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পুর্বক আমরা পোশাক পরিবর্তনের ব্যাপারে তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেই। আমরা আরয করি যে, আমরা অবশ্যই এ ওয়াদা বাস্তবায়িত করবো। জুব্বা আর পাগড়ি খুলে ফেলে স্যুট আর ফেজ ক্যাপ পরিধান করবো, তবে দারুল উলূম থেকে বের হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে।
মিশনে ধর্মহীনতা ও নাস্তিক্যবাদের ঢেউ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এবং ঠিক সে সময়টাতে, যে সময়টা আমি কায়রোয় অতিবাহিত করি, মিশরে নাস্তিক্যবাদের ঢেউ শুরু হয়। বুদ্ধির মুক্তির নামে মনমানস আর চিন্তাধারায় এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে আাচার-আচরণ আর নীতি-নৈতিকতায় নাস্তিক্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। নাস্তিক্য, যথেচ্ছচারিতা, লাম্পট্য আর ভ্রষ্টতার এমন ভয়ংকর সয়লাব দেখা দেয়, যার সামনে কোন কিছুই টিকতে পারছিল না। ঘটনাপ্রবাহ আর পরিস্থিতির দমকা হাওয়ার তার তীব্রতা আরো বাড়িয়ে তুলছিল।
তুরস্কে মোস্তফা কামাল বিপ্লব ঘটায়। খিলাফাত বিলু্প্তির ঘোষণা দেয়। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে। আর এমন দেশে এ পরিবর্তন ঘটায়, কয়েক বৎসর পূর্বেও সারা দুনিয়ার দৃষ্টিতে যে দেশটা ছিল আমীরুল মু’মিনীনের কেন্দ্রস্থল ও আস্তানা। তুর্কী সরকার বিপ্লবের তোড়ে এতটা বয়ে যায় যে, জীবনের সমস্ত বিকাশই সে বদল করে ফেলে।
জামেয়া মিছরিয়া গণশিক্ষা কেন্দ্রের পরিবর্তে এখন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এর শাসন-শৃংখলা এখন রাষ্ট্রের হাতে। এবং বেশ কিছু নিয়মিত কলেজকে এর অধীনে আনা হয়। এ সময় অনেক মন-মানসে উচ্চতর গবেশণা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের অভিনবত্ব সওয়ার হয়। আর এ ধারণার প্রাণসত্ত্বা ছিল এই যে, ধর্মের নাম-গন্ধ মুছে না ফেলে এবং ধর্ম থেকে গৃহীত সামাজিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করে বিশ্ববিদ্যালয় সেক্যুলার হতে পারে না। সুতরাং পাশ্চাত্য থেকে আমদানী করা বস্তুবাদী চিন্তাধারা পুরোপুরী গ্রহণ করতে বিশ্ববিদ্যালয় উদগ্রীব হয়ে উঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর ছাত্র উভয়ই লিপ্ত হয়ে পড়ে নাস্তিকতায় এবং বিসর্জন দেয় সকল নৈতিক বন্ধন।
এ সময় ডেমোক্রেটিক পার্টিরও ভিত্তি স্থাপন করা হয়, কিন্তু জন্মের পূর্বেই তার গর্ভপাত ঘটে। এ পার্টির কর্মসূচী এ ছঅড়া আর কিছুই ছিল না যে, তৎকালের প্রচলিত অর্থে স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের বাণী ছড়াতে হবে অর্থাৎ নাস্তিকতা আর লাগামহীনতা ছড়াতে হবে।
আল মানাখ সড়কে তথাকথিত গবেষণা একাডেমী স্থাপন করা হয় আর এক দল থিওসফিষ্টের উপর এর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। এতে এমনসব ভাষণ দেয়া হয়, যাতে সমস্ত প্রাচীন ধর্মের উপর আক্রমণ চালানো হয় এবং এক নতুন ধর্ম আর নতুন ওহীল সুসংবাদ শুনানো হয়। মুসলমান আর ইহুদী-খৃষ্টানদের সমন্বয়ে এক জগাখিঁচুড়ি ছিল এর বক্তা। সকল বক্তা এ নতুন দর্শন প্রচার করতো বিভিন্ন উপায়ে।
অনেক বই-পুস্তক আর পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এসবের এক একটি সূত্র থেকে এমন দর্শন প্রকাশ পায়, যার লক্ষ্য ছিল দ্বীনের যে কোন প্রভাবকে দুর্বল করা, বা মানুষের মন থেকে তা সম্পূর্ণ মুছে ফেলা, যাতে এসব নতুন লেখক-সাহিত্যিকদের চিন্তাধারা অনুযায়ী জাতি সত্যিকার আযাদী ভোগ করতে পারে।
কায়রোয় বেশ কিছু বড় বড় বাড়ীতে ‘সেলুন’ খোলা হয়। এখানে যারা গমন করতো, তারা এসব চিন্তাধারাই ছড়াতো। যুব সমাজ এবং অন্যান্য শ্রেণীর মধ্যে তা ছড়ানো হতো।
প্রতিক্রিয়া
আল-আযহার এবং অন্যান্য ইসলামী কেন্দ্র আর সংস্থায় এসব চিন্তাধারার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ দু’শ্রেণতে বিভক্ত ছিল। যুব সমাজ নতুন চিন্তাধারার প্রতি ছুটে আসে। আর অজ্ঞ-মূর্খরা এ ব্যাপারে চিন্তাও করতে পারেনা। কারণ, তাদেরকে পথ দেখাবার লোকের অভাব। এ দৃশ্য দেখে আমি ভীষণ বিচলিত বোধ করি। আমার চক্ষু দেখতে পাচ্ছিল যে, আমার প্রিয় মিশরীয় জাতির সামাজিক জীবন দু’টি বস্তুর মধ্যখানে টলটলায়মান। একদিকে ছিল সেই প্রিয় আর মহামূল্যবান ইসলাম, যা তারা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে। তারা ছিল যার হেফাযতকারী, যার ভালোবাসা তাদের রগ-রেশায় মিশে আছে, যার পরিবেশে তারা জীবন যাপন করেছে আর যার বদৌলতে চৌদ্দশ বৎসর থেকে তারা সম্মান লাভ করে আসছে। আর অন্যদিকে ছিল পাশ্চাত্যেল তীব্র হামলা, যা ছিল সব ধরনের কার্যকর আর ধ্বংসাত্মক অস্ত্রে সুসজ্জিত- অর্থ-সম্পদের অস্ত্র, বাহ্যিক চাকচিক্যের অস্ত্র, সুখ-সম্ভোগের অস্ত্র, শক্তি-সামর্থ্যের অস্ত্র এবং প্রোপাগান্ডার উপকরণের অস্ত্র।
দারুল উলূম, জামেয়ে আযহার এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে প্রকাশ করে আমার মনের এ তীব্র জ্বালা কিছুটা হালকা হতো। শায়খ হামেদ আসকারিয়্যাহ, শায়খ হাসান আব্দুল হামীদ, হাসান আফেন্দী ফযলিয়া, আহমদ আফেন্দী আমীন, শায়খ মুহাম্মদ বাশার, মুহাম্মদ সলীম আতিয়অ, কামাল আফেন্দী লুব্বান (এরা তখন ছিল ল কলেজের ছাত্র), ইউসুফ আফেন্দী লূব্বান, আব্দুল ফাত্তাহ কীরশাহ, ইবরাহীম আফেন্দী মাদকুর, সৈয়দ আফেন্দী নছর হেজাযী, ভাই মুহাম্মদ আফেন্দী শারনূব এবং কায়রোয় হোছাফী ভাইদের মধ্যে শিক্ষিত শ্রেণী। এরা ছিলেন সেসব পবিত্র আত্মার অধিকারী ব্যক্তি, যারা নিজ নিজ মজলিশে উপরোক্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে মত প্রকাশ করতেন। আর তা প্রতিরোধে এক তীব্র ইসলামী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। এসব আলাপ-আলোচনা মনের ব্যাথা কিছুটা হালকা হরতো এবং মানসিক ব্যাকুলতা দূর করার উপকরণ সরবরাহ করতো।
মাফতাবা সালাফিয়ায় যাতায়াতও মনের জন্য সান্ত্বনার কারণ ছিল। তখন এ মাসতাবা ছিল আপীল কোর্টের নিকটে। মর্দে মু’মিন, মহান বীর আলেম, অনলবর্ষী বক্তা এবং ইসলাম প্রেমিক সাংবাদিক সাইয়্যেদ মুহিউদ্দীন আল খতীবের সঙ্গে সেখানে সাক্ষাৎ হতো। (‘আলফাতাহ’ নামে ইনি প্রথম শ্রেণীর একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করতেন। মিশরে সংস্কার আন্দোলন আর ইসলামী জাগরণ সৃষ্টিতে তাঁর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আমি ১৯৬৪ সালে মিশরে মাকতাবা সালাফিয়ায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ১৯৬৬ সালে তিনি ইনতিকাল করেন- খলীল হামেদী)। সেখানে অন্যান্য বড় বড় আলেমদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হতো। যেমন মহান ওস্তাদ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আল-খিযির হুসাইন (তাঁকে মিশরের সবচেয়ে বিচক্ষণ আলেম মনে করা হতো। জেনারেল নজীবের শাসনামলে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরও ছিলেন। ফিকহ এবং দাওয়াত বিষয়ে তিনি অনেক গ্রন্হ রচনা করেছেন। কাদিয়ানীদের সম্পর্কে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছেন। মিশরীয় আলেমদের মধ্যে ইনিই প্রথম এ বিষয়ে লিখনী ধারণ করেন- খলীল হামেলী)। ওস্তাদ মুহাম্মদ আহমদ আলগামরাবী, আহমদ তাইমুর পাশা, আব্দুল আযীয পাশা প্রমুখ। শেষোক্ত দু’ব্যক্তি ছিলেন আপীল আদালতের আইন উপদেষ্টা। এদের কথাবার্তা থেকেও মনের ক্ষোভ কিছুটা উপশম হতো। দারুল উলূমেও যাতায়াত ছিল। ওস্তাদ সৈয়দ রশীদ রেজার মজলিশেও উপস্থিত হতাম। শায়খ আব্দুল আযীয খাওলী এবং শায়খ মুহাম্মদ আল- আদবীল মতো মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সেখানে সাক্ষাৎ হতো। দেশ আর মিল্লাতের অবস্থা সম্পর্কেও এখানে আলাপ-আলোচনা হতো। ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র বানচাল করায় সাইয়্যেদ রশীদ রেজার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। (তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম মুজাদ্দিদ মনে করা হয় (খলীল হামেদী)।
ইতিবাচক চেষ্টা
কিন্তু এ পরিমাণ চেষ্টা যথেষ্ট ছিল না। বিশেষ করে নতুন ভাবধারা যখন তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। আমি গভীরভাবে উভয় শিবির নিরীক্ষণ করছিলাম। নাস্তিকতা আর আধুনিকতার শিবির শক্তি সঞ্চয় করছিল আর ইসলামী শিবির দিন দিন দুর্বল হচ্ছিল। আমার অস্থিরতা তীব্র হয়ে উঠছিল। মনে পড়ে, সে বৎসর রমযান মাসের অর্ধেক সময় অনিদ্রায় কাটে। তীব্র অস্থিরতা আর পরিস্থিতি নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা ভাবনার কারণে চোখের ঘুম উড়ে যায়। আমি কোন ইতিবাচক কাজ করার সংকল্প করি। মনে মনে বলি: মুসলিম নেতাদের উপর কেন এ দায়িত্ব অর্পন করবো না? কেন আমি তাদেরকে সজোরে ঝাঁকুনী দিয়ে বলবো না যে, এ সয়লাব রোধে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের এগিয়ে আসা উচিত। তাঁরা মেনে নিলে ভালো কথা, অন্যথায় আমি কোন ব্যবস্থা করবো।
শায়খ দাজবীর খেদমতে
আমি শায়খ ইউসুফ দাজবীর লেখা অধিকন্তু পড়তাম। ইনি ছিলেন সুন্দর চরিত্রের অধিকারী, মিষ্টভাষী এবং সরলমনা মানুষ। সূফী সুলভ মানসিকতার কারণে তাঁর সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক ছিল, যার ফলে আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বাধ্য হতাম। কখনো কাছরুশ শাওক-এ তাঁর বাসভবনে, আবার কখনো আল-আযহার চত্বরে ‘আতফা আদ দুয়াইদারী’তে। আমি জানতাম যে, ইসলামী শিবিরের অনেক আলেম আর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে শায়খের সম্পর্ক এবং শিবিরের অনেক আলেম আর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে শায়খের সম্পর্ক এবং যোগাযোগ রয়েছে এবং তারা শায়খকে বেশ ভালোবাসেন। আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, শায়খের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমার মনের কথা বলবো এবং ইসলামী ঐক্য গড়ে তোলার জন্য তাঁর সহায়তা কামনা করবো। একদিন সন্ধ্যঅয় ইফতার করার পর তাঁর খেদমতে হাজির হই। সেখানে একদল আলেম এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম এখনো আমার স্মরণ আছে। তাঁর নাম আহমদ বেক কামেল। এরপর আর কখনো তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি।আমি শায়খের সম্মুখে পরিস্থিতির পূর্ণ চিত্র তুলে ধরি। তিনিও অনেক দুঃখ ও ক্ষোভ ব্যক্ত করেন এবং এই নতুন ব্যাধির লক্ষণগুলো এক এক করে উল্লেখ করেন এবং মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে তা ছড়ানোর ফলে যেসব অশুভ ফল দেখা দেয়, তারও উল্লেখ করেন। এরপর ইসলামী শিবিরের কথাও বলেন, যারা ষড়যন্ত্রকারীদের সম্মুখে দুর্বল এবং অসহায় হয়ে পড়েছে। নয়া ভাবধারা রোধে আল আযহারের চেষ্টা-সাধনারও উল্লেখ করেন, কিন্তু তা রোধ করতে পারেনি।
‘নাহদাতুল ইসলাম’ তথা ইসলামের পুনর্জাগরণ সংগঠনের কথাও বলেন। অন্যান্য আলেমদেরকে নিয়ে শায়খ নিজেই এ সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু সে চেষ্টাও ফলবতী হয়নি। খৃষ্টান মিশনারী এবং নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আল-আযহারের চেষ্টা-সাধনার কথাও উল্লেখ করেন। জাপানে অনুষ্ঠিত ধর্ম সম্মেলন এবং এ সম্মেলনে প্রেরিত শায়খের পুস্তিকা সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়। এসব কথার সারবস্তু এই যে, সব রকম চেষ্টা করে দেখা হয়েছে, কোন ফল হয়নি। মানুষ নিজেকে নিয়ে চিন্তা করবে এবং এ সয়লাব থেকে নিজেকে রক্ষা করবে এটাই এখন মানুষের জন্য যথেষ্ট। আমার মনে পড়ে, তিনি দৃষ্টন্তস্বরূপ একটা কবিতা পাঠ করেন। অনেক দৃষ্টান্তের ক্ষেত্রেই তিনি এ কবিতাটি উল্লেখ করেন। একবার একটা কার্ডে তিনি আমাকে কবিতাটি লিখেও দেন। কবিতাটি এইঃ
**********************************
কে মরলো আর কে ধ্বংস হলো। আামার কোন পরওয়া নেই, যদি আমার নাফস আমায় অনুসরণ করে, নিজের শক্তির জন্য।
সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য শায়খ আমাকেও দীক্ষা দেন। তিনি বলেন, কাজ করে যাও এবং ফলাফল আল্লাহর হাতে ছেড়ে দাও। আল্লাহ প্রত্যেককে কেবল ততটুকু দায়িত্ব দেন, যতটুকুর সাধ্য আর সামর্থ্য তার রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই শায়খের কথা আমার ভালো লাগেনি। আমার মানসিক উত্তাপ বেড়ে যায়। আমার চোখের সম্মুখেই নেচে উঠে আমার মিশনের ব্যর্থতার ভয়ংকর চিত্র। এটা স্পষ্ট যে, এসব নেতাদের মধ্যে যার সঙ্গেই আমি সাক্ষাৎ করি, তার কাছ থেকে যদি এমন জবাবই শুনতে হয়, তবে ব্যর্থতা আর হতাশা ছাড়া অন্য কোন ফল পাওয়া যাবে না। আমি গর্জনের স্বরে শায়খকে বলি: জনাব, আপনি যা কিছু বলছেন, আমি তার তীব্র বিরোধিতা করি। আমার ধারণা, ব্যাপার ইচ্ছার দুর্বলতা, চেষ্টা না করা এবং দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনারা কোন বস্তুটাকে ভয় পান? সরকারকে? নাকি আল-আযহারকে? সরকারী পেনশন ভোগ করতে চাইলে ঘরে বসে আরামে তা ভোগ করুন। আর ইসলামের জন্য কাজ করতে চাইলে মাঠে নেমে দেখুন, জাতি আপনাদের সঙ্গে রয়েছে। এরা মুসলিম জাতি। আমি তাদেরকে দেখেছি মসজিদে, কফি শপে, সড়কে আর ফুটপাথে। সর্বত্র আমি তাদেরকে দেখতে পেয়েছি ঈমানে পরিপূর্ণ। কিন্তু এ বিরাট শক্তিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এসব নাস্তিক আর আধুনিকতাবাদীদের এমনকি মূল্য রয়েছে? তাদের পত্র-পত্রিকা বের হচ্ছে এ জন্য যে, আপনারা অবচেতন হয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আপনারা জেগে উঠলে তারা গর্তে প্রবেশ করবে। শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ, আপনারা আল্লাহর জন্য কিছু করতে না চইলে অন্তত: দুনিয়ার জন্য কিছু করুন। যে রুটি আপনারা ভক্ষণ করছেন, তার জন্য কিছু করুন। কারণ, এ জাতির মধ্য থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আযহারও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আলেম সমাজও। আপনারা ইসলামের বাগান রক্ষা করতে না পারলে অন্তত: নিজেদের স্বত্ত্বাতো রক্ষা করবেন। আখেরাত বানাতে না চাইলে অন্তত: দুনিয়াতো বানাবেন। অন্যথায় আপনাদের দুনিয়াও বরবাদ হবে, আর আখেরাতও হবে হাতছাড়া।
ভীষণ জোশ, উত্তেজনা আর তীব্র ভাষায় আমি কথা বলছিলাম। আমার কথাগুলো ছিল জ্বলেপুড়ে যাওয়া আর আহত হৃদয়ের প্রতিধ্বনী। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে জনৈক মওলবী সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়ান এবং তীব্রভাবে আমার বিরোধিতা শুরু করেন। তিনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, আমি শায়খের সঙ্গে বেয়াদবী করেছি এবং তাঁর শানের পরিপন্হী বাকধারা অবলম্বন করেছি। বরং আমি আল-আযহারের আলেমদের শানেও বেয়াদবী করেছি। আর এভাবে আমি নিজেই ইসলামেরও অবমাননা করেছি। ইসলাম এক বড় শক্তিশালী এবং বিজয়ী দ্বীন। ইসলাম কখনো দুর্বল হবে না। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ নিজেই ইসলামকে হেফাযত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
আমি মওলবী সাহেবের কথার জবাব দেয়ার আগেই আহমদ বেক কামেল- যার কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে- উঠে দাঁড়ান এবং বলেন:
“মওলানা! না, তা হতে পারে না কিছুতেই। এই নওজোয়ান ঠিক কথা বলছে। আপনাদের কর্তব্য হচ্ছে জেগে উঠা এবং বেরিয়ে পড়া। আর কতকাল হাতের উপর হাত রেখে বসে থাকবেন? এ নওজোয়ান আপনাদের কাছে কেবল এটাই চাচ্ছে যে, ইসলামের খাতীরে আপনারা ঐক্যবদ্ধ হবেন। সমাবেশের জন্য আপনাদের কোন জায়গার প্রয়োজন হলে আমার ঘর হাজির আছে। তা আপনাদের দখলে দেবো। সেখানে আপনারা যা ইচ্ছা করতে পারেন। অর্থের প্রয়োজন হলে মুসলমানদের মধ্যে বিত্তবান লোকের অভাব নেই। কিন্তু আপনারা মিল্লাতের নেতা। আমরা আপনাদের পেছনে থাকবো। এসব অন্তসারশূন্য কথাবার্তায় এখন আর কোন কাঝ হবে না”।
আমি পাশে বসা একজনকে জিজ্ঞেস করি: এ কোন মর্দে মু’মিন? লোকটি আমাকে কেবল তাঁর নাম বলেছিলেন, যা আজও অন্তরে গেঁথে আছে। কিন্তু এরপর আর তাঁর দেখা পাইনি। আমাদের এ মজলিশ দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল ছিল হযরত মওলানার সমর্থক। আর অপর দল ছিল আহমদ বেক কামেল- এর সমর্থক। শায়খ দাজবী খামুশ হয়ে বসে থাকেন। এরপর তিনি এ ঝগড়া থামাবার চিন্তা করে বলেন: যাই হোক, আল্লাহর নিকট দোয়া করি, তিনি এমন কাজের তাওফীক দান করুন, যাতে তাঁর সন্তুষ্টি রয়েছে। সন্দেহ নেই যে, সকলের ইচ্ছা এটাই যে, কাজ করা হোক, সকল কাজের চাবিকাঠি তো আল্লাহর হাতে। আমার মনে হয় এখন শায়খ মুহাম্মদ সায়াদের সঙ্গে দেখা করার সময় হয়েছে। চলুন, তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসি।
আমরা সকলে শায়খ মুহাম্মদ সায়াদের বাসায় গমন করি। তাঁর বাসা ছিল শায়খ দাজবীর বাসার নিকটেই। আমার চেষ্টা ছিল শায়খ দাজবীর কাছাকাছি বসার, যাতে প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়। শায়খ মুহাম্মদ সায়াদ রমযানুল মুবারকের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি সকলের মধ্যে বিতরণ করেন। শায়খ মিষ্টি নেয়ার জন্য এগিয়ে যান। আমিও তাঁর কাছে আসি। তিনি যখন দেখলেন যে, আমিও তাঁর কাছে বসেছি, তখন বললেন, কে তুমি? বললাম, আমি অমুক। তিনি বললেন: তুমিও এসেছ আমাদের সঙ্গে? বললাম: জ্বি, জনাব। কোন সিদ্ধান্তে না পৌঁছা পর্যন্ত আমি আপনাদের থেকে পৃথক হবো না। শায়খ এক মুষ্টি মিষ্টি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “নাও। ইনশাআল্লাহ আমরা কিছু ভেবে দেখবো”। আমি বললাম, “সুবহানাল্লাহ। জনাব, এখন আর বেশী চিন্তা করার সময় নেই। কাজ করার দরকার। এটাই হচ্ছে সময়ের দাবী। এসব ফল আর মিষ্টির লোভ আমার থাকলে এক দুই ক্রোশ দিয়ে দোকান থেকেই তা কিনে নিতে পারতাম আর ঘরে বসেই আরামে তা খেতাম। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য এত কষ্ট করতে হতো না। জনাব! ইসলামের বিরুদ্ধে এক ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু ইসলামের সমর্থক আর নাম উচ্চারণকারী আর মুসলমানদের ইমাম ও নেতারা মিষ্টি নিয়ে ব্যস্ত। আপনারা কি মনে করছেন, যে কান্ড কারখানা আপনারা শুরু করেছেন, আল্লাহ সে জন্য হিসাব নেবেন না? আপনারা ছাড়া ইসলাম আর মুসলমানদের অন্য কোন নেতা থাকলে আমাকে তাদের নাম বলূন। তাদের ঠিকানা দিন। আমি তাদের কাছে যাবো। হতে পারে, আপনাদের কাছে পাইনি, এমন কিছু আমি তাদের কাছে পাবো”।
গোটা মহফিল নীরব। ভয়ংকর নীরবতা ছেয়ে গেছে। শায়খ দাজবীর চক্ষু অশ্রুবিগলিত। চক্ষের পানিতে তাঁর দাঁড়ি সিক্ত হয়ে গেছে। উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে আরো কেউ কেউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। শায়খ নীরবতা ভেদ করে দৃপ্তকণ্ঠে বললেন: ভাই আমি কি করবো? আমি বললাম, ব্যাপারটা সহজ। আল্লাহ তা’আলা কাউকে সাধ্যের অতীত কষ্ঠ দেন না। আমি কেবল এটুকু চাই যে, আলেম, প্রভাবশালী এবং সম্ভান্ত ব্যক্তিবর্গ, যাদের অন্তরে দ্বীনের দরদ আছে, এমন লোকদের একটা তালিকা আপনি প্রস্তুত করুন। তারা একত্রে বসে চিন্তা করবেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁদের কি করা উচিত। নাস্তিকতা আর ধর্মহীনতার ধ্বজাধারী পত্র-পত্রিকার বিরুদ্ধে কোন সাপ্তাহিক পত্রিকা হলেও প্রকাশ করুন। তাদের বিষাক্ত বইয়ের জবাবে কোন বই প্রকাশ করুন। এমন সংগঠন গড়ে তুলুন, যাতে যুব সমাজ যোগ দিতে পারে। ওয়ায আর প্রচারের অভিযান তীব্র করতে পারেন। এমন অনেক কাজ করা যায়”। শায়খ বললেন: বেশ ভালো কথা। এই বলে খাবার পাত্র সরিয়ে কাগজ-কলম তলব করে বললেন: লেখ। অনেক নাম নিয়ে আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত বড় বড় আলেমদের এক দীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করি। এরমধ্যে কয়েকটা নাম এখনো আমার মনে আছে। স্বয়ং শায়খ দাজবী (১৯১৯ সালে মিশরে ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহে শায়খ দাজবীও অংশগ্রহণ করেন এবং আযহারী আলেদের মধ্যে এ বিদ্রোহ তাঁর নাম ছিল তালিকার শীর্ষে), শায়খ মুহাম্মদ খিযির হোসাইন, শায়খ আব্দুল আযীয জাবেশ (জামালূদ্দীন আফগানী এবং শায়খ মুহাম্মদ আব্দুহুর উত্তরসূরী মনে করা হয় তাঁকে। সাংবাদিকতা এবং শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে ইসলামী পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সারা জীবন তিনি মিশরের স্বাধীনতা এবং ওসমানী খেলাফতের অধীনে মুসলিম জাহানের ঐক্যের জন্য চেষ্টা করে গেছেন। আল ইসলাম দ্বীনুল ফিতরাহ (ইসলাম স্বভাবধর্ম) নামে তাঁর একটা চমৎকার গ্রন্হ রয়েছে- খলীল হামেদী)। শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব নাজ্জার, শায়খ মুহাম্মদ আল খিযরী (ইনি বহু গ্রন্হের প্রণেতা। রাসূলের জীবনী বিষয়ে ‘নূরুল ইয়াকীন ফী সিরাতির রাসূলিল আমীন’ এবং ‘মুহাদারাতুন ফী তারীখিল উমামিল ইসলামিয়া’ নামে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে তাঁর একটা বিরাট বক্তৃতার সংকলন রয়েছে। এ ছাড়া ‘তারীখুত তাশরীইল ইসলামী’ নামে ইসলামী ফিকহের একটা নির্ভরযোগ্য গ্রন্হও তিনি প্রণয়ন করেছেন- খলীল হামেদী) শায়ক মুহাম্মদ আহমদ ইবরাহীম এবং শায়খ আব্দুল আযীয খাওলী প্রমুখ। আল্লাহ তা’আলা এদের সকলের প্রতি রহমত নাযিল করুন।
সৈয়দ মুহাম্মদ রশীদ বেজার নাম উল্লেখ করলে শায়খ দাজবী বলেন: লিখ লিখ। তাঁর নাম অবশ্যই লিখবে। এটা কোন খুঁটিনাটি বিষয় নয় যে, আমরা তাতে বিরোধ করবো। বরং এটা হচ্ছে ইসলাম আর কুফরের সমস্যা। শায়খ রশীদ রেজা তাঁর লিখনী, জ্ঞান আর পত্রিকার মাধ্যমে ইসলামকে রক্ষা করতে পারেন। শায়খ রশীদ এবং শায়খ দাজবীর মধ্যে কোন কোন বিষয়ে বিরোধ আর দ্বিমত রয়েছে। এরপরও শায়খ দাজবীর পক্ষ থেকে শায়খ রশীদের ইসলামী খেদমতের পক্ষে এটা একটা ভালো সার্টিফিকেট। সম্মানিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যাদের নাম লিখা হয়; আহমদ তাইমুর পাশা, নাসীম পাশা, আবু বকর ইয়াহইয়া পাশা, মুতাওয়াল্লী বেক গানীম, আব্দুল আযীয বেক মুহাম্মদ- এখন যাকে আব্দুল আযীয পাশা মুহাম্মদ বলা হয় এবং আব্দুল হামীদ বেক সাঈদ। এরা ছাড়া আরো অনেকের নাম লিখা হয়। এরপর শায়খ বললেন: এখন এটা তোমার দায়িত্ব, এদের মধ্যে যাদেরকে তুমি জান, তাদের কাছে যাও। আর যাদেরকে আমি জানি, তাদের কাছে আমি যাবো। এক সপ্তাহ পরে আমরা পুনরায় মিলিত হবো ইনশাআল্লাহ।
আমরা বেশ কয়েক দফা মিলিত হই এবং এসব জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ইসলামী আন্দোলনের একটা ভিত রচিত হয়। ঈদুল ফিতরের পর এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পরস্পর বৈঠকে বসেন এবং ‘আল-ফাতাহ’ নামে একটা শক্তিশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন শায়খ আব্দুল বাকী সারওয়ার নাঈম আর ম্যানেজার ছিলেন সাইয়্যেদ মুহিবুদ্দীন আল খতীব। পরবর্তীকালে এর সম্পাদনা এবং ব্যবস্থাপনা উভয় দায়িত্বই ন্যস্ত হয় সাইয়্যেদ মুহিব্বুদ্দীন আল খতীবের উপর। এবং তিনি পত্রিকাটিকে বেশ উন্নত করেন। মূলত: এ পত্রিকাটি ছিল শিক্ষিত যুব সমাজের জন্য আলোর মশাল।
আমার দারুল উলুম ত্যঅগ করার পরও এরা সক্রিয় ছিলেন। একদল নিষ্ঠাবান তরুণ ছিল এদের মূল শক্তি। এই প্রচেষ্টা আর তৎপরতাই পরবর্তীকালে ‘জমিয়তে শুব্বান আল মুসলিমীন’ বা ‘মুসলিম যুব সংগঠন’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
রচনার বিষয়বস্তু
আমাদের শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ শায়খ আহমদ ইউসূফ নাজাতী- আল্লাহ তা’আলা তাঁকে নেক প্রতিদান দান করুন- রচনা লিখার জন্য মজাদার বিষয়বস্তু নির্বাচনে তিনি ছিলেন বেশ আগ্রহী। এ বিষয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে বেশ কৌতুক করতেন এবং নানা মজার মজার কথা বলতেন। আমাদের দীর্ঘ রচনা সংশেঅধন করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে গেলে রচনার খাতাগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়াতেন, যেন খাতার বোঝায় তিনি নুয়ে পড়ছেন। এ সময় তিনি বলতেন: মওলবীরা! এই নাও তোমাদের রচনার খাতা আর তা সকলের মধ্যে বন্টন করে দাও। বৎস্যগণ! মধ্যপন্হা অবলম্বন করবে। সংক্ষেপে লেখার মধ্যেই লেখার পান্ডিত্য। খোদার কসম করে বলছি, তোমাদের রচনার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আমি কখনো পরিমাপ করে দেখি না।
আমরা হাসিতে গড়িয়ে পড়তাম এবং কপিগুলো ছাত্রদের মধ্যে বন্টন করে দিতাম। ১৯২৭ সাল ছিল আমার শেষ শিক্ষাবর্ষ। এ উপলক্ষে শায়খ নাজাতী রচনা লিখার যে বিষয়গুলো আমাদের জন্য ঠিক করে দেন, তার একটা ছিল: শিক্ষা জীবন শেষ করার পর তোমার সবচেয়ে বড় আকাংখা কি? বিস্তারিত লিখ এবং সে আকাংখা বাস্তবায়িত করার জন্য তুমি কি উপায় অবলম্বন করবে, তা-ও আলোচনা কর।
এ বিষয়ে আমি লিখি:
যেসব সৎ স্বভাবের লোক মানুষের কল্যাণ আর পথ প্রদর্শনের মধ্যেই নিজের সৌভাগ্য সন্ধান, আমার বিশ্বাস, তারাই সর্বোত্তম মানুষ। মানুষের কষ্ট দুর করে তাদেরকে আনন্দ দান করার মধ্যেই তারা নিজের আনন্দ খুঁজে পায়। মানুষের সংস্কার- সংশোধনের পথে কোরবানীকেই তারা গনীমত মনে করে। আর সত্য ও হিদায়াতের পথে- এ কথা জেনেও যে, এ পথ কন্টকাকীর্ণ এবং কঠিন- পরীক্ষার মধ্য দিয়েই এ পথ পাড়ি দিতে হয়- জেহাদেই তারা আনন্দ পায়। এটাকেই তারা মনে করে সুখের। মানুষের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করতঃ তাদের ব্যাধি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। আর যেসব বিষয় মানব জীবনের স্বচ্ছ, ফোয়ারাকে কলূষিত করে এবং মানুষের আনন্দকে দুঃখে পর্যবসিত করে তোলে, সমাজের বাহ্যিক অবস্থায় উঁকি মেরে সেসব বিষয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। এরপর এমন ব্যবস্থাপত্র প্রণয়ন করে, যা মানুষের পবিত্রতায় সংযোজন করে এবং তার আনন্দ বৃদ্ধি করে। মানুষের প্রতি ভালোবাসার অনুভূতিই তার মধ্যে এসব কাজের আকর্ষণ সৃষ্টি করে। তাই সে চেষ্টা চালায় অসুস্থ ব্যক্তিদেরকে সুস্থ করে তোলার জন্য, সংকুচিত বক্ষকে প্রশস্ত করা আর মুষড়ে পড়া আত্মাকে সজীব করে তুলতে। যে মুহূর্তে সে মানুষকে স্থায়ী অস্থিরতার হাত থেকে উদ্ধার করতঃ সুখের পথে এনে দাঁড় করায়, তার চেয়ে সৌভার্গের মুহূর্ত তার জন্য আর কিছুই হতে পারে না।
আমি বিশ্বাস করি, যে কাজের ক্রিয়অ কর্তার স্বত্ত্বা অতিক্রম করে না, যে কাজের ফল অন্যদের নিকট পৌঁছে না, সে কাজ অসম্পূর্ণ, অকিঞ্চিৎকর এবং তুচ্ছ। সর্বোত্তম আর সবচেয়ে মহৎ কাজ হচ্ছে তা, যার ফলাফল কর্তা নিজেও ভোগ করতে পারে এবং তার আত্মীয়-স্বজন আর স্বজাতির লোকরাও তার দ্বারা উপকৃত হতে পারে। কাজের ফলাফল যত ব্যাপক আর সুদূরপ্রসারী হবে, কাজটা হবে ততই মহৎ এবং মূল্যবান। এ বিশ্বাস আর দর্শনের ভিত্তিতেই আমি শিক্ষকতার পথ বাছাই করে নিয়েছি। আমার মতে, শিক্ষক শ্রেণী হচ্ছেন সে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, যা থেকে বিপুল জনগোষ্ঠী আলো লাভ করে এবং মানুষের ভিড়ের মধ্যেও তারা পথের সন্ধান খুঁজে পায়। যদিও শিক্ষকরা হচ্ছেন সে বাতির মতো, যা নিজে জ্বলে যায়, কিন্তু অন্যদের জন্য আলেঅর ব্যবস্থা করে যায়।
আমি বিশ্বাস করি, যে মহৎ উদ্দেশ্যকে মানুষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা উচিত এবং যে মহত্তর লাভের জন্য তার সর্বাত্মক চেষ্টা-সাধনা করা উচিত, তা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা মানুষকে তার পবিত্র পরিমন্ডলে অন্তর্ভুক্ত করে নেবেন, যিনি মানুষকে তাঁর ভালোবাসার বিশেষ পোশাক পরাবেন এবং তাকে জাহান্নামের আযাব আর নিজের গযব থেকে দুরে রাখবেন। এ উচ্চতর লক্ষ্যপানে যে ব্যক্তি মুখ করে, তাকে সংঘাতের পথ অতিক্রম করতে হয়। এ সংঘাত দু’টি পথের। এ দু’টি পথের প্রতিটির রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা। এ দু’টি পথের মধ্যে যেটি ইচ্ছা সে বাছাই করে নিতে পারে।
প্রথম পথটা হচ্ছে সঠিক তাসাউউফের পথ। এর সারকথা হচ্ছে: ইখলাস তথা নিষ্ঠা আর আমল তথা কর্ম। ভালো-মন্দ সব রকম মানুষের সঙ্গে অন্তরকে জড়িত করা থেকে বিরত রাখা। এ পথটি সংক্ষিপ্ততর এবং অধিক নিরাপদ।
দ্বিতীয় পথটা হচ্ছে শিক্ষা দান আর পথ প্রদর্শনের। ইখলাস আর আমলে প্রথম পথটার সঙ্গে এ পথের মিল রয়েছে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, তাদের অবস্থা যাচাই করা, তাদের সমাজে অংশগ্রহণ এবং তাদের ব্যাধিকর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা-গ্রহণ- এসব হচ্ছে এমন বিষয়, যা এ পথকে প্রথমোক্ত পথ থেকে পৃথক করে। কিন্তু এ দ্বিতীয় পথটা আল্লাহর নিকট বেশী উত্তম ও মহত্বপূর্ণ। কুরআন মজীদ এ পথকেই উত্তম বলে অভিহিত করে। আর রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পথের ফযীলত ও গুরুত্ব স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন। তাসাউউফের পথ মাড়াবার পর অধিকতর কল্যাণ আর বেশী ফযীলতের কারণে এখন আমি এ দ্বিতীয় পথটাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। আর এ জন্য যে, যে ব্যক্তি জ্ঞানে ধন্য হয়েছে আর কিছুটা প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতা যার মধ্যে আছে, তার জন্য দ্বিতীয় পথটা অবলম্বন করাই অধিক সমীচীন এবং অতি উত্তমঃ
**********************************
“যাতে তারা স্বজাতিকে সতর্ক করতে পারে, যখন তাদের কাছে ফিরে যায়, যেন তারা রক্ষা পেতে পারে”। (তাওবা: ১২২)।
আমি দেখতে পাচ্ছি যে, আমার জাতি-সামাজিক এবং রাজণৈতিক কারণে পাশ্চাত্য সভ্যতা, ইউরোপের অনুকরণ, ব্স্তুগত দর্শন আর ফিরিঙ্গীদের অনুকরণের প্রভাবের ফলে- নিজেদের দ্বীনের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য এবং নিজেদের কিতাবের দাবী সম্পর্কে অজ্ঞতায় ডুবে যাচ্ছে। নিজেদের পুর্ব পুরুষের শান- শওকত আর কীর্তি ভূলে বসছে। অজ্ঞতা- মুর্খতার কারণে সত্য দ্বীনে অনেক অসত্য আকীদা-বিশ্বাস আর চিন্তা-ধারার সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। মুসলিম জাতি আজ গোলক ধাঁধায় নিমজ্জিত। দ্বীনের প্রোজ্জ্বল আলোক আর তার আসল এবং সাদাসিদা শিল্প আজ তাদের চোখের সম্মুখে প্রচ্ছন্ন। মধ্যখানে নানা আজেবাজে চিন্তার আবরণ অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দৃষ্টি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে আর চিন্তা হয়ে পড়ে স্থবির। সুতরাং সাধারণ মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে। যুব সমাজ আর শিক্ষিত শ্রেণী বিস্ময় আর সংশয় তাদের আকীদা-বিশ্বাসকে বিকৃত করেছে এবং তাদের ঈমানকে করেছে অবিশ্বাসে পর্যবসিত।
আমার দর্শন এই যে, মানব মন স্বভাবতই ভালোবাসা প্রিয়। তার জন্য এমন সত্ত্বা অপরিহার্য, যার কাছে সে মনের আবেগ আর ভালোবাসা ব্যক্ত করতে পারে। আমি সে বন্ধুর চেয়ে অধিক ভালোবাসার কেন্দ্র অন্য কাউকে মনে করি না, যার হৃদয়ের সঙ্গে আমার হৃদয় একাকার হয়েছে। আমি তার জন্য ভালোবাসার ডালি পেতে দিয়েছি এবং তাকেই ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছি।
এসব বিষয়ে আমার বিশ্বাস এমনই গভীর এবং সুদৃঢ় যে, আমার অন্তরের গভীরে তার শিকড় প্রোথিত। তার শাখা-পল্লব প্রসারিত আর তার পাতা সবুজ-সতেজ। এখন বাকী আছে কেবল তার ফলবান হওয়া। শিক্ষা জীবন শেষে সবচেয়ে বড় যে আকাংখাটা আমি কার্যকর করতে চাই, তা দু’ভাগে বিভক্ত।
বিশেষ আকাংখাঃ আমার পরিবার- পরিজন আর আত্মীয়-স্বজনের কল্যাণ সাধন এবং প্রিয় বন্ধর সঙ্গে সমান সমান সদ্ভাব বজায় রাখা, যতটা আমার সাধ্যে কুলায়, যতটা আমার অবস্থা অনুমতি দেয় এবং যে পরিমাণ আল্লাহ আমাকে শক্তি দেন। (এখানে, পূর্ববর্তী প্যারায় এবং অতীত পৃষ্ঠাগুলোর স্থানে স্থানে বন্ধু বলতে তিনি মাহমুদিয়অর আহমদ সাকারীকে বুঝিয়েছেন। আহমদ সাকারী ছিলের ছাত্রজীবনে ইমাম হাসানুল বান্নার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরবর্তীকালে ইখওয়ানুল মুসলিমুন প্রতিষ্ঠা লাভ করলে আমহদ সাকারীকে এর প্রথম সেক্রেটারী জেনারেল মনোনীত করা হয়। ৪/৫ বৎসরে মধ্যে একটা শক্তি হিসাবে ইখওয়ান আত্মপ্রকাশ করে এবং দেশের রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করে। এ সময় আহমদ সাকারী তলে তলে ওয়াফাদ পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ইঙ্গিতে ইখওয়ানের মারাত্মক ক্ষতি সাধনের পরিকল্পনা গ্রহণ করলে তাকে ইখওয়ান থেকে বহিষ্কার করা হয়- অনুবাদক)।
সাধারণ আকাংখা: আমি হবো একজন শিক্ষক এবং পথপ্রদর্শক। দিনের সময়টা এবং বৎসরের বেশীরভাগ অংশ আমি শিশুদের শিক্ষা দানের কাজে ব্যয় করবো আর রাত্রিবেলা ছাত্রদের পিতামাতাকে শিক্ষঅ দেবা যে, দ্বীনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি? তাদের সৌভাগ্যের উৎস কোথায় এবং তাদের আনন্দের রহস্য কোথায় নিহিত। বক্তৃতা আর কথাবার্তার মাধ্যমে হোক বা গ্রন্হ রচনা এবং লিখনী চালনার মাধ্যমে, অথবা নানা স্তানে পরিভ্রমণের মাধ্যমে।
প্রথমোক্ত আকাংখাটি পূরণ করার জন্য আমি নিজের মধ্যে উপকার চেনার স্পৃহা এবং নেকীর কদর করার অনুভূতি প্রস্তুত করেছিঃ
**********************************
“অনুগ্রহের বিনিময় অনুগ্রহ ছাড়া কিছুই নেই”। (সূরা আর রাহমানঃ ৬০)।
আর দ্বিতীয় আকাংখাটি চরিতার্থ করার জন্য আমি দু’টি নৈতিক অস্ত্র প্রস্তুত করেছি: দৃঢ়তা এবং ত্যাগ ও কোরবানীর স্পৃহা। একজন সংস্কারকের জন্য এ দু’টি অস্ত্র সজ্জিত, সে কখনো এমনভাবে পরাভূত হতে পারে না, যা মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করতে পারে, বা করতে পারে তার চেহারাকে ধূলায় ধূসরিত। এছাড়া আমি কিছু বাস্তব উপকরণেরও ব্যবস্থা করেছি। যেমন উচ্চশিক্ষা। আমি চেষ্টা করবো, যাতে সরকারী কাগজপত্রের মাধ্যমে এ শিক্ষার সনদপত্র লাভ করা যায়। যারা এ দর্শন গ্রহণ করে এবং এ দর্শনের পতাকাবাহীদেরকে ভালোবাসে, তাদের সঙ্গে পরিচয় করা। মৃত্তিকার দেহ, যা জীর্ণ-শীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত এবং সামর্থ না থাকা সত্ত্বেও কষ্ট করতে ভালবাসে। জীবন, যা আমি আল্লাহর হাতে বিক্রয় করে দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ এটা একটা সফল-স্বার্থক সওদা। আল্লাহর নিকট দরখাস্ত, তিনি এ সওদা কবুল করুন এবং তা পরিপূর্ণ করার হিম্মত দান করুন। উপরন্তু দেহ-প্রাণ উভয়কেই কর্তব্য অনুধাবন করার তাওফীক দান করুন এবং সে সাহায্য আর মদদ দ্বারা ধন্য করুন, যা আমি পাঠ করে থাকি তাঁর বাণীতে:
**********************************
তোমরা আল্লাহর সাহায্য করলে তিনিও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদযুগল দৃঢ় রাখবেন। (সূরা মুহাম্মদঃ ৭)।
এ রচনা আমার এবং আমার পালনকর্তার মধ্যে এক চুক্তিপত্র। নিজের উপর বাধ্যতামূলক করে আমি স্বহস্তে এ চুক্তিপত্র লিখছি। আর আমার ওস্তাদকে করছি এ চুক্তিপত্রের সাক্ষী। সেখানে বিবেক ছাড়া আর কিছুই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না; আর রাতের অন্ধকারে থাকলেও যেখানে সূক্ষ্মদর্শী আর সর্বজ্ঞ স্বত্ত্বা ছাড়া আর কারোই জানার উপায় নেইঃ
**********************************
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করবে, অবিলম্বে আল্লাহ তাকে দান করবেন মহা প্রতিদান”। (সূরা ফাতহ: ১০)। ওস্তাদ হাসান ইউসূফ নাজাতী আমার এ রচনা স্থানে স্থঅনে সংশোধন করেন। মনে পড়ে, এ রচনার জন্য তিনি আমাকে ভালো নাম্বার দিয়েছিলেন- দশের মধ্যে সাড়ে সাত।
রচনায় যে বন্ধর প্রতি ইঙ্গত করা হয়েছে তিনি হচ্ছেন ওস্তাদ আহমদ সাকারী। আমার আবেগ- অনুভূতিতে তিনি সর্বদা শরীক ছিলেন। এমনকি দোকান আর কাজ-কারবার দ্বারাও সহায়তা করেন। বাহীরার জেলা শিক্ষা বোর্ডে তিনি সরকারী চাকুরী গ্রহণ করেন এ চিন্তা করে যে, ছাত্রজবীন শেষে আমিও শিক্ষা বিভাগে চাকুরী নিয়ে সেখানে গমন করবো আর এভাবে আমরা একসঙ্গে বাস করবো। কিছুদিন পরে আল্লাহ তা’আলা এ কামনা পূরণ করেন। আমি শিক্ষা বিভাগে চাকুরী গ্রহণ করি। আহমদ সাকারীও বদলী হয়ে সেখানে গমন করেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে আমরা উভয়ে কায়রোয় একত্র হই।
দারুল উলূমের স্মৃতি
এটা আমার শেষ বর্ষ। দারুল উলূম থেকে ডিপ্লোমা পরীক্ষার প্রস্তুতিতে আমি পুরোদমে ব্যস্ত। কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে এ বিদ্যাপীঠ ছাড়তে হবে- এ চিন্তা মনে জাগলে আমার মনে জাগতো এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভয়ানক আকর্ষণ আর সহপাঠীদের ভালোবাসা খেলতো মনে। আমি কখনো এ কথা ভুলতে পারবো না যে, আমি কখনো কখনো দারুল উলূমের মসজিদে আল মুনীরা এবং দারুল উলূমের মধ্যখানে বা পাঠকক্ষের এক কোণে চিন্তিত মনে দাঁড়িয়ে থাকতাম এবং দারুল উলূম ও দারুল উলূমের বাসিন্দাদের প্রতি এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতাম ভীষণ আগ্রহ নিয়ে। আল্লাহর নবী যথার্থই বলেছেনঃ
**********************************
“তুমি যাকে ইচ্ছা ভালোবাসো। শেষ পর্যন্ত তোমাকে তা ছেড়ে যেতে হবে”।
শ্রেণীকক্ষে ওস্তাদ বুদাইর বেক-এর সঙ্গে যেসব মনোমুগ্ধকর কথাবার্তা চলতো, তাও ভুলবার মতো নয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ আরবী সাহিত্য আর রচনা শিক্ষার ভার তাঁর উপর অর্পণ করলে তিনি অতীব বিষণ্ন হয়ে আমাদের কক্ষে আসেন। আমি তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি বললেন, জান, আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে এমন দুঃখজনক ঘটনায় জড়িত করেছেন, যার কোন তুলনা নেই। বললাম, তা কেমন? বললেন: তৃতীয় বর্ষের আরবী সাহিত্য পড়ানোর দায়িত্ব বুদাইর-এর গলায় লটকানো হয়েছে। বিশেষ করে আব্বাসী যুগের সাহিত্য। এটা আরবী সাহিত্যেরই একটা অংশ। এ সম্পর্কে আমার তেমন কিছুই জানা নেই। আমি কি তোমাদেরকে এমন ওস্তাদের কথা বলবো, যিনি এ বিষয়ে দক্ষ। তিনি হচ্ছেন ওস্তাদ নাজাতী। তোমরা তাঁর কাছে যাও এবং কর্তৃপক্ষের নিকট দাবী জানাও এ কাজ থেকে আমাকে অব্যাহতি দিতে। বিশ্বাস কর, আমি তোমাদেরকে ভালো পরামর্শ দিচ্ছি। আমরা ওস্তাদ বুদাইর-এর চাপলূসী শুরু করি, ঠিক সেভাবে, যেভাবে করতে পারে ছাত্র শিক্ষকের জন্য। কিন্তু তাঁর জবাব ছিল: আমার নাফসের ব্যাপারে আমাকে ধোঁকা দেবে না। আমি আমার নিজেকে তোমাদের চেয়ে বেশী জানি এবং তোমাদের স্বার্থও আমি ভালো করে জানি। তোমাদের জন্য মঙ্গল ছাড়া আর কিছুই আমি কামনা করি না। শেষ পর্যন্ত আমরা ওস্তাদ বুদাইর-এর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করি। প্রিন্সিপালের নিকট গমন করে উপরের প্রস্তাব তাঁর নিকট পেশ করলে তিনি মেনে নেন। বাস্তবে হয়েছেও তাই। আমরা ওস্তাদ নাজাতী দ্বারা অনেক উপকৃত হতে পেরেছি এবং ওস্তাদ বুদাইর-এর এহেন ভদ্র ভূমিকার জন্য তাঁর অনেক শুকরিয়া আদায় করি। আল্লাহ তা’আলা তাঁর উপর রহমতের পুষ্প বর্ষণ করুন।
কায়রোয় ওস্তাদ ফরীদ বেক বেজদীল বাসভবনও একটা অবিস্মরণীয় স্মৃতি। আমি ছিলাম আল-হায়াত পত্রিকার পাঠক। ইসলাম এবং ইসলামী তমদ্দুন বিষয়ে তাঁর লেখা অনেক গ্রন্হ আমি পাঠ করেছি। বিশেষ করে আমি ছিলাম তাঁর দায়েরাতুল মা’আরফিল ইসলামিয়া (ইসলামী বিশ্বকোষ) গ্রন্হের একজন ভক্ত। কায়রোয় অবস্থানের পর থেকেই আমি তাঁর বাসায় গনম করা শুরু করি। তখন তাঁর বাসা ছিল খালীজ মিছরী এলাকায়। আব্বাজানের সঙ্গে ফরীদ বেজদীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাঁর বাসায় জ্ঞানী-গুণীজনদের সমাবেশ ঘটতো। আসরের পর অনেকেই সেখানে একত্র হতো। আগে নানা পান্ডিত্যপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হতো। পরে সকলে মিলে বেড়াতে বের হতেন। অধিকন্তু এসব গুণীজনদের সমাবেশে আমিও উপস্থিত হতাম জ্ঞান লাভের আগ্রহ নিয়ে। এ মজলিশে একদিন একটা বিষয়ে ওস্তাদ ফরীদ বেক-এর সঙ্গে আমার মতবিরোধ হয়। ওস্তাদ ফরীদ বেক-এর বন্ধু ওস্তাদ আহমদ বেক আবু সাতীতও এ মতবিরোধে তাঁকে সমর্থন করে। বিষয়টা ছিল রূহ হাজির হওয়া সম্পর্কিত। ফরীদ বেক-এর মতে যেসব রূহ হাযির হয়, তা স্বয়ং মৃত ব্যক্তিদেরই রূহ। কিন্তু আমার মত ছিল এর বিপরীত। এ বিষয়ে আমাদের বিতর্কের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু জানার সুযেগ হয়। অবশেষে উভয়ে স্ব-স্ব মতে অটল থেকে বিতর্কের অবসান ঘটাই। এসব মূল্যবান আসর থেকে আমি অনেক উপকৃত হয়েছি।
কায়রোয় এমনই ছিল আমার জীবনধারা। শায়খ হোছাফীর বাসা বা আলী আফেন্দী গালিব-এর বাসায় যিকর-এর মহফিলে অংশ গ্রহণ, মাকতাবা-ই সালফিয়া গমন এবং সাইয়্যেদ মুহিবুদ্দীন আল-খতীবের সঙ্গে সাক্ষাৎ, দারুল মানার এবং সৈয়দ রশীদ রেজার নিকট যাতায়াত, শায়খ দাজবীর বাসায় উপস্থিত এবং ফরীদ বেজদীর জ্ঞানের মজলিশে অংশগ্রহণ, আবার কখনো দারুল কুতুব- এর বিশাল চত্বরে আবার কখনো শায়কুন মসজিদের চাটাই-এ।
ডিপ্লোমা লাভ
পরীক্ষার দিন আসে এবং অতিক্রান্ত হয়ে যায়। ফলও প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে আমি দারুল উলূম থেকে ডিপ্লোমা লাভ করি। মৌখিখ পরীক্ষার ঘটনা ভুলবার মতো নয়। পরীক্ষা দেয়ার জন্য আমি কমিটির সম্মুখে উপস্থিত হই। ওস্তাদ আবুল ফাতহ উলফতী আর ওস্তাদ নাজাতীর সমন্বয়ে এ কমিটি। পদ্য-গদ্যের বিশাল ভান্ডার আমি মুখন্ড করে নিয়েছিলাম। ১৮ হাজার কবিতা, গদ্যের কলেবরও ছিল প্রায় অনুরূপ। তোরফা ইবনে লবীদ-এর গোটা মোয়াল্লাকা আমার মুখস্ত ছিল। কিন্তু মুয়াল্লাকার একটা মাত্র কবিতা এবং নেপোলিয়ান সম্পর্কে শাওকীর ৪টা কবিতা সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করা হয়। ওমর খাইয়্যম সম্পর্কেও কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়। কেবল এটুকুই। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আমি যে কঠোর পরিশ্রম করেছি, সে জন্য আমার মনে কোন দুঃখ নেই। কারণ, পরীক্ষার জন্য নয়, জ্ঞান লাভের জন্য আমি এ পরিশ্রম করেছি।
স্কলারশীপ না চাকুরী
আমি দেখতে পাই, কিছু বন্ধু বৈদেশিক স্কলারশীপের জন্য দরখাস্ত করছে। এ স্কলারশীপ ছিল ডিপ্লোমা পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারীর হক। কিন্তু দু’টি কারণে এ ব্যাপারে ইতস্তত ছিল। প্রথম কারণ: আরো জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ। এ জন্য যদি ইউরোপ বা চীন দেশেও গমন করতে হয়। জ্ঞান মু’মিনের হারানো ধন। যেখানেই পাওয়া যায়, অন্যদের তুলনায় সে জ্ঞানের বেশী হকদার। দ্বিতীয় কারণ; বাহ্যিক জাঁকজমক থেকে দূরে থাকা। আর এ চিন্তা তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নের জন্য যে আগ্রহ আমার মন-মগজে বিস্তার লাভ করেছিল, অর্থাৎ ইসলামের শিক্ষার দিকে ফিরে আসার আহ্বান এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বার্হ প্রকরণের সৃষ্ট বিকৃতি রোধে সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলা। এ ইতস্তত: আর দোদুল্যপনা থেকে স্বয়ং দারুল উলূমই আমাকে মুক্তি দিয়েছে। কারণ এ বৎসর বৈদেশিক স্কলারশীপের জন্য দারুল উলুম কারো না প্রস্তাব করেনি। এখন কেবল চাকুরীর পথই অবশিষ্ট রয়েছে। আমার ধারণা ছিল সরকারী চাকুরী কায়রোর স্কুলের বাইরে যাবে না। কিন্তু এ বৎসর পাশ করা ছাত্রের সংখ্যা ছিল বেশী, আর শিক্ষা বিভাগ যে শিক্ষক চেয়েছে, তাদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। শিক্ষা বিভাগ কেবল আটজন লোক চেয়েছে। আর বাকীদেরকে ছেড়ে দিয়েছে প্রাদেশিক বোর্ডের দয়ার উপর। এ অবস্থায় কায়রো কিসমতে জুটেনি। কেবল দুজনের ক্ষেত্রে- প্রথম এবং দ্বিতীয়- বিশেষ নির্দেশ জারী করা হয়েছে। এ হিসাবে ইসমাঈলিয়া আমার ভাগ্যে জুটেছে আর আলেকজান্দ্রিয়া ভাগ্যে জুটেছে ওস্তাদ ইবরাহীম মাদকূরের। ইনি পরে ড. ইবরাহীম মাদকূর বলে পরিচিত হন (পরবর্তীকালে তিনি কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিকহে ইসলামীর শিক্ষক হন। ফিকহ শাস্ত্রের মূলনীতি বিষয়ে রচিত তাঁর গ্রন্হাবলী বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে- খলীল হামেদী)। রাজনৈতিক ক্যরিশমার ফলে তিনি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ওদফুজা গমন করতে বাধ্য হন। কিন্তু তিনি ইস্তফা দিয়ে নিজের খরচে উচ্চতর ডিগ্রী লাভের জন্য ইউরোপ গমন করেন। অবশ্য পরবর্তীকালে তাঁকে সরকারী স্কলারশীফ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। ভাগ্য আমাদের অপর ৬ জন বন্ধুকে দক্ষিণ মিশরের আবহাওয়ার হাতে ছেড়ে দিয়েছে।
আমার নিযুক্তিতে আমি হতভম্ব হই। কারণ, আমি ভালোভাবে এটাও জানতাম না যে, ইসমাঈলিয়অ কোনদিকে অবস্থিত। আমি শিক্ষা দফতরে গমন করতঃ এ নিযুক্তির জন্য আপত্তি জানাই। শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ আব্দুল হামীদ বেক হাসানীর সঙ্গে মুখোমুখী বিতর্কও করি। তিনি হাসি-কৌতুক দ্বারা আমার ক্রোধ উপশম করেন। তিনি শায়খ আব্দুল হামিদ আল-খাওলীরও আশ্রয় নেন। এ সময় ইসমাঈলিয়ার কৃতি সন্তান ওস্তাদ আলী হাসবুল্লাহও উপস্থিত ছিলেন। ওস্তাদ আব্দুল হামীদ বেক এ দু’জন দ্বারা সাক্ষ্য দান করান যে, ইসমাঈলিয়া আল্লাহর ভালো শহরগুলোর অন্যতম। সেখানে অনেক সুখ-শান্তি আমার ভাগ্যে জুটবে। আমার বেশ ভালো লাগবে। শান্ত শহর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। অধিক খাদ্যশস্য উৎপাদনে ইসমাঈলিয়া নামকরা এলাকা। আমি দফতর থেকে ফিরে এসে আব্বাজানের সঙ্গে পরামর্শ করলে তিনি বললেন, আলা বারাকাতিল্লাহ- আল্লাহর নাম নিয়ে চলে যাও। আল্লাহ যা পছন্দ করেন, তা-ই উত্তম। তাঁর কথায় আমান মন ভরে যায় এবং আমি সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এ সফরে আল্লাহর হেকমতের যে রহস্য লুক্কায়িত ছিল, পরে তা ভালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে:
**********************************
“আল্লাহ তাঁর পয়গাম কোথায় রাখবেন, তা তিনিই ভালো জানেন”। (সূরা আনআমঃ ১২৪)
আমি আল্লাহর নাম নিয়ে রওয়ানা হই। সেখানে গিয়ে দাওয়াতের জন্য কোন রীতি অবলম্বন করবো- এ চিন্তায় আমার মন বিভোর ছিল। কারণ, আমার মনে এখন পাকা- পোক্ত ইচ্ছা যে, আমি ইসমাঈলিয়ায় দাওয়াত আর সংস্কারের কাজ শুরু করবো আর ভাই আহমদ আফেন্দী সাকারী মাহমুদিয়ায় এ মিশনের দায়িত্ব নেবেন। দু’জন বিজ্ঞ বন্ধু শায়খ হামেদ আসকারিয়া এবং শায়খ আব্দুল হামিদকে আমরা কায়রোর জন্য রেখে এসেছি। প্রথমোক্ত জন আল-আযহারের উচ্চ ডিগ্রী গ্রহণের পর যাকাযীক-এ ওয়ায়েয নিযুক্ত হন এবং সেখানে তিনি দাওয়াতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর শেষোক্ত জন আরো উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার পর কাফার আদ দাওয়ার-এ স্বাধীনভাবে চাষাবাদ কার্য শুরু করেন। এর সঙ্গে তিনি দাওয়াতের দায়িত্বও পালন করেন। আর এভাবে আমরা হয়ে যাই কবির কথার দৃষ্টান্তঃ
**********************************
আমার পরিবার-পরিজন শাম দেশে, অন্তর আমার বাগদাদে আর আমি,
রাকমাতাইন-এ পড়ে রয়েছি আর আমার প্রতিবেশী রয়েছে ফুসতাত-এ।
আমাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মপন্হা অনুযায়ী, যার জ্ঞান আল্লাহ তাকে দান করেছেন- দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করি। ইসমাঈলিয়া গমনের প্রায় এক বৎসর পর ইসমাঈলিয়ার মনমাতানো শান্ত-সমাহিত পরিবেশে এবং সেখানকার পূণ্যবান আর পুণ্যাত্ম্য ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় ইখওয়ানুল মুসলিমূনের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং শাশাও খোলা হয়।
ইসমাঈলিয়ার উদ্দেশ্যে
১৯২৭ সালের ১৯ শে সেপ্টেম্বর সোমবার- আমি দুঃখিত যে, এ দিন হিজরী কোন তারিখ ছিল, তা এখন আর আমার মনে পড়ছে না- বন্ধুরা তাদের সঙ্গীকে বিদায় জানাবার জন্য সমবেত হয়। এ দিন তাদের সঙ্গী ইসমাঈলিয়া গমন করছিল। সেখানে গিয়ে অর্পিত দায়িত্বের (ইসমাঈলিয়ার সরকারী স্কুলের শিক্ষকতা) চার্জ বুঝে নেবে। তাদের এ সঙ্গী ইসমাঈলিয়া সম্পর্কে তেমন কিছু জানতো না। সে কেবল এতটুকু জানতো, এ শহরটা বদ্বীপের পূর্বে প্রান্তে অবস্থিত। তার আর কায়রোর মধ্যখানে রয়েছে পূর্ব সাহারার বিশাল বালূকাময় অঞ্চল। সুয়েজ খালের সঙ্গে লাগোয়া তিমসাহ ঝিলের নিকট অবস্থঅন এ ইসমাঈলিয়া অঞ্চলের। এ অধম বন্ধুদেরকি বিদায় জানায়। আর বন্ধুরা বিদায় জানায় এ অধমকে। বন্ধুদের মধ্যে কিছু কথাবার্তাও হয়। এদের মধ্যে মুহাম্মদ আফেন্দী শারনূবীও ছিল। বড়ই নেককার আর সৎ স্বভাবের মানুষ। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন: ‘ভালো মানুষ যেখানেই অবস্থান করে, ভালো প্রভাব ফেলে। আমরা আশা করি, আমাদের বন্ধু ইসমাঈলিয়া শহরেও ভালো প্রভাব ফেলবে”। মুহাম্মদ আফেন্দী শারনূবীর এ কথাগুলো তার বন্ধুর মনে গেঁথে আছে।
সমস্ত বন্ধু বিদায় নিলে মুসাফির ভোরের ট্রেন ধরে। যোহরের সময় ইসমাঈলিয়া পৌঁছার কথা। লক্ষ্যাপানে ছুটে চলে গাড়ি। গাড়ীর মধ্যেই সাক্ষাৎ হয় একই পেশার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। অতি সম্প্রতিং তারাও নিযুক্তি লাভ করেছেন একই স্কুলে। আমার স্মৃতিশক্তি ভুল না করলে তাদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ বাহিউদ্দীন সনদ আফেন্দী, আহমদ হাফেয আফেন্দী, আব্দুল মজিদ ইজ্জত আফেন্দী এবং মাহমূদ আব্দুন নবী আফেন্দী। এরা সকলেই ছিলেন একই স্কুলের শিক্ষক। সুয়েজ প্রাইমারী স্কুলের জনৈক শিক্ষক বন্ধুর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়। হামেদিয়অ শাযেলিয়া সিলসিলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। পথিক (বান্না নিজে) ইসলঅমের পুনর্জাগরণ এবং ইসলামী দাওয়াত সম্পর্কে তার নিজের চিন্তা আর আকাংখা সঙ্গীর কানে পৌঁছায়। আর এখন ডাইরীতে এ প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করছেঃ
তার মনস্তাত্ত্বিক এবং আত্মিক অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্য এ কয়েকটা মুহূর্ত যথেষ্ট নয়। অবশ্য যেটুকু ধারণা হয়েছে, তাতে বুঝা যায় যে, তাঁর বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হচ্ছে কাজকর্ম দ্বারা নিজের জীবনকে রক্ষঅ করা। পালনকর্তা, দ্বীন এবং আপন শায়খের সঙ্গে ভক্তি-আকীদাতকে তিনি জ্ঞান করেন সৌভাগ্যের প্রতীক বলে। তার আশপাশে ভক্তবৃন্দের ভক্তির লক্ষণ দেখে খুশী হন। অবশ্য এ অধম আদৌ এটা চায় না যে কাজকে বাঁচার উপায় করেই কেবল বেঁচে থাকতে হবে। পথচারী (বান্না নিজে) এটাও পছন্দ করে না যে, তার চিন্তাধারা কেবল নিজের স্বত্বা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। ভাই-বন্ধুদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে সে জড়িয়ে যেতে চায় না। অন্য কিছু তাকে ব্যাকুল করে রেখেছে।
গাড়ী ইসমাঈলিয়া ষ্টেশনে পৌঁছে। মুসাফিররা চলে যায় নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে। এ অধম সুন্দর শহর পানে উঁকি মারে। রেলওয়ে ষ্টেশনের পুল থেকে পথচারী যখন শহরের দিকে তাকায়, তখন বেশ মনোরম দেখতে পায় শহরটাকে। এ মনোরম দৃশ্য নবাগতের অন্তরকে করে তোলে বিমুগ্ধ-বিমোহিত। নবাগত মন ভরে তাকায়। এরপর ক্ষণেকের তরে চিন্তার জগতে ডুবে যায়। এ পবিত্র শহরের ললাটে তার জন্য ভালো কি লেখা রয়েছে, সে পড়ার চেষ্টা করে। সে কায়মনো বাক্যে বিনীত কণ্ঠে দোয়া করে:
“পরওয়ারদেগার! তার ভাগ্যে তাই জুটাও, যাতে কল্যাণ নিহিত রয়েছে, পাপ আর অকল্যাণ থেকে তাকে দূরে রাখ। সে মনের গভীরে অনুভব করছে। এ শহরে তার চলাফেরা সেসব লোকের চলাফেরা থেকে ভিন্ন হবে, যারা এখানে বসবাস করে বা বাইরে থেকে এখানে যাতায়াত করে”।
হোটেলে অবস্থান
পথচারী একটা হোটেলে গমন করে এবং ব্যাগটা হোটেল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়। এ ব্যাগটা ছাড়া তার কাছে আর কোন মাল-সামান নেই। এখন তাকে যে স্কুলে কাজ করতে হবে, সে স্কুলে গমন করে। প্রধান শিক্ষক এবং অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করে। তাদের সঙ্গে নানা রকম কথাবার্তা হয়। এরপর পুরাতন বন্ধু ওস্তাদ ইবরাহীম বানহাবীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি এ স্কুলের পুরাতন শিক্ষক। নবাগতের আগ্রহ, পুরাতন বন্ধুর সঙ্গেই সে অবস্থান করবে। তার বন্ধু নিজের পক্ষ থেকেই প্রস্তাব করেন যে, কোন সাধারণ হোটেলে অবস্থান করা-ই ঠিক হবে। অতিথি শিক্ষক তার মতের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে। দু’বন্ধু একই কক্ষে অবস্থান করা শুরু করে। প্রথমে এক ইংরেজ মহিলা মিসেস এম গেমীর বিল্ডিং- এ একটা কক্ষ ভাড়া নেয়। এরপর সেখান থেকে জনৈকা ইটালীর মহিলা ম্যাডাম ববিনার বিল্ডিং-এ স্থানান্তরিত হয়।
বিদ্যালয় আর মসজিদে
নবাগত শিক্ষক বিদ্যালয়, মসজিদ আর কক্ষে সময় কাটায়। সে অন্য কারো সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টা করে না। বিশেষ পরিমন্ডলের সহকর্মীদের ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টাও করে না সে। অবসর সময়ে সে রিয়াযাত- মুজাহাদা করে। নতুন দেশকে বুঝবার চেষ্টা করে। এখানকার অধিবাসী, এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং এখানকার বৈশিষ্ট্য বুঝবার চেষ্টা করে। অথবা কুরআন মজীদ তিলাওয়াত এবং বই-পুস্তক পাঠে সময় কাটায়। পুরো চল্লিশ দিন এ ব্যস্ততায় সে অন্য কিছু যোগ করেনি। তার অন্তর থেকে বিদায়দাতা বন্ধর এ কথাটা ক্ষণেকের তরেও মুছে যায়নি: “ভালো মানুষ যেখানেই অবস্থান করে, ভালো প্রভাব বিস্তার করে। আমরা আশা করি, আমাদের বন্ধু ইসমাঈলিয়া শহরেও ভালো প্রভাব ফেলবে”।
ধর্মীয় বিরোধ
শহরে নবাগত এ ব্যক্তিটি মসজিদে অবস্থান করেই অনেকাংশে ইসমাঈলিয়া ধর্মীয় খবরাখবর সংগ্রহ করে। এখানকার সমাজ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। সে এটাও জানতে পারে যে, এ শহরে ফিরিঙ্গীপনার প্রভাব রয়েছে। কারণ, এর পশ্চিম দিকে রয়েছে বৃটিশ শিবির আর পূর্বদিকে রয়েছে সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীর কর্মচারীদের কলোনী। আর শহর এ দু’য়ের মধ্যখানে আবদ্ধ। এখানকার অধিকাংশ লোক এ দু’টি স্থানে কাজ কারবার করে। ইউরোপীয় জীবনধারার সঙ্গে এদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সংযোগ। আর ইউরোপীয় জীবনধারার নমুনাই চতুর্দিক থেকে তাদেরকে আহ্বান জানায়।
কিন্তু এতসব কিছুর পরও এখানকার লোকজনের মনে রয়েছে মযবুত ইসলামী জযবা। এরা আলেমদের পেছনে জড়ো হয়, তাদের কথা শোনে-মানে। লেখক এটাও জানতে পেরেছে যে, ইতিপূর্বে জনৈক ইসলামপ্রিয় শিক্ষক এখানে ছিলেন। ইসলামের দর্শন সম্পর্কে শহরবাদীদের সামনে এমন কিছু কথাবার্তা ব্যক্ত করেছেন, যার সঙ্গে এদের অধিকাংশই ছিল অপরিচিত। সুতরাং শহরের কিছু আলেম এসব চিন্তাধারার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাঁড়ায়। ফলে মানুষের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। এমনসব কথাবার্তার পক্ষপাতিত্ব শুরু হয়ে যায়, যার ফলে গড়ে উঠতে পারে না ঐক্য ও সংহতি। আর ঐক্য ও সংহতি ছাড়া কোন কাজ করা সম্ভব নয়।
পুনরায় কফি শপ অভিমুখে
লেখক ভাবতে থাকে, এখন কি করা যায়? বিভেদ কিভাবে দূর করা যায়। লেখক দেখতে পায়, কেউ ইসলামের কথা বলতে দাঁড়ালে এখানকার সমস্ত দল নিজ নিজ বিশ্বাসের কথা তার সামনে উপস্থাপন করে এবং সকল দলই চায় তাকে নিজেদের বোতলে ভরতে। অথবা কমপক্ষে তারা জানতে চায় যে, এ নতুন প্রচারক তাদের সমর্থক, না বিরোধী। অথচ সে চায়, সকলকে লক্ষ্য করে কথা বলতে, সকলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে এবং সকলকে ঐক্যবদ্ধ করতে। কিন্তু পরিস্থিতি তার অনুকূল নয়।
এ অধম বিষয়টা নিয়ে অনেক চিন্তা করে। অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, এসব দল আর ফের্কা থেকে দূরে থাকবে এবং যতদূর সম্ভব, মসজিদের ভেতরে লোকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলা থেকেও বিরত থাকবে। মসজিদের লোকজনই বিরোধপূর্ণ কথাবার্তা ছড়ায়। সুযোগ পেলেই তারা এ বিরোধ চাঙ্গা করে তোলে। সুতরাং এ অধম মসজিদবাসীদেরকে দাওয়াতের কেন্দ্রবিন্দু করবেনা; বরং জনসংযোগের ভিন্ন উপায় সন্ধান করবে। যারা কফি শপে গনম করে, তাদেরকে কেন সম্বোধন করা হবে না?
কিছুকাল এ চিন্তা মনে জাগে। ধীরে ধীরে তা পাকাপোক্ত হয়। অতপর তাই কার্যকর করা হয়। এ উদ্দেশ্যে তিনটি বড় বড় কফি শপ বাছাই করা হয়। এসব কফি শপে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়। প্রতিটি কফি শপে সপ্তাহে দু’টি দারস দেওয়ার প্রোগ্রাম করা হয়। এ তিনটি স্থানে নিয়মিত দারস দান শুরু হয়। শুরুতে ওয়াজ আর দারসের এহেন নুতন ধারা সকলের নিকট ছিল এক অবাক কান্ড। কিন্তু ধীরে ধীরে সকলে অভ্যস্ত হয়ে উঠে এবং বেশ আগ্রহ দেখাতে শুরু করে।
শিক্ষক তার এ নতুন ধারায় কথা বলায় বেশ মনোযোগ দেয়। সে সব সময় এমন শিরোনামকে প্রাধান্য দেয়, যাতে সে ভালোভাবে কথা বলতে পারে। উপরন্তু মৌলিক কথা থেকেও সে দূরে যায় না। আল্লাহ আর পরকাল স্মরণ করানো, নেকীর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং পাপ কাজে ভয় দেখানোর মধ্যেই সে সীমাবদ্ধ থাকে। কারো মনে কষ্ট দেয়া, কাউকে গাল-মন্দ দেয়া থেকে সে বিরত থাকে। উপস্থিত লোকজন যেসব অন্যায় আর খারাপ কাজে আসক্ত, সেসবকে সরাসরি সে মন্দ বলে না। সে চেষ্টা করে উপস্থিত লোকজনের মনে কোন না কোন উপায়ে প্রভাব বিস্তার করার। বলার ভঙ্গিও সে বেশ ছাটকাট করে এবং সহজ-সরল আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলে সে আগ্রহ সৃষ্টি করতে চায়। প্রয়োজনে সে সহজবোধ্য ভাষারও সংমিশ্রণ ঘটায়। প্রত্যক্য অভিজ্ঞতা আর উদাহরণ দ্বারাও সে বক্তব্যকে হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। কিচ্ছা-কাহিনীরও আশ্রয় নেয় এবং অধিকন্তু ওয়াযের ভঙ্গি অবলম্বন করে বক্তব্য বিষয়কে আকর্ষনীয় করে তোলে। এভাবে মানুষের মনকে আকৃষ্ট করার জন্য সে নানা উপায় অবলম্বন করে। তার কথার দিকে মানুষের আগ্রহ জাগ্রহত করে। মানুষকে বিরক্ত করে তোলার মতো দীর্ষ ভাষণ সে দেয় না। তার দারস দশ মিনিটের বেশী হতো না। প্রয়োজনে দীর্ষ করলে বড় জোর পনর মিনিট। এর বেশী নয়। অবশ্য সে চেষ্টা করতো এ সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে বক্তব্য বিষয়ের সব দিক তুলে ধরতে এবং শ্রোতাদের মনে তা ভালোভাবে বদ্ধমূল করতে। কুরআনের কোন আয়াত বা নবীজীর কোন হাদীস উল্লেখ করতে হলে পরিবেশ আর পরিস্থিতি অনুযায়ী তা বাছাই করতো। দরদ আর আবেগ নিয়ে তা পাঠ করতো। পারিভাষিক কথাবার্তা আর পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনার অবতারণা থেকে সে দূরে থাকতো। অতি সংক্ষেপে বক্তব্য স্পষ্ট করতো এবং প্রয়োজনীয় যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপন করই সে শেষ করতো।
ইসমাঈলিয়ার সাধারণ মানুষের মনে দাওয়াতের এ ধারা শুভ প্রভাব ফেলে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। লোকজন সেসব কপিশপে ছুটে যায় এবং দারসের অপেক্ষায় থাকে। এ ধরনের কথাবার্তা শ্রোতাদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। যারা নিয়মিত শুনতো, তারা জেগে উঠে এবং চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য হয়। ধীরে ধীরে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, তারা নিজেরাই এখন জানতে চায় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং দ্বীন মিল্লাতের ব্যাপারে কর্তব্য পালনের জন্য এখন তাদেরকে কি করতে হবে? যার ফলে আল্লাহর আযাব থেকে তারা নাজাত পেতে পারে এবং জান্নাত লাভ নিশ্চিত হয়। শিক্ষক তাদের এসব কথার জবাব দিতে শুরু করে। কিন্তু এসব জবাব শেষ কথা ছিল না। তাদের মনের ব্যাকুলতা আরো বৃদ্ধি করার জন্য এ ধারা অবলম্বন করা হয়। সে চায় মনকে আরো প্রস্তুত করতে এবং স্পষ্ট কথা বলার জন্য উপযুক্ত সংযোগেরই অপেক্ষায় থাকতে।
বাস্তব শিক্ষা
কিন্তু সেসব পূত-পবিত্র এবং ঈমানে পরিপূর্ণ মানুষের পক্ষ থেকে শিক্ষকের উপর একের পর এক প্রশ্নের বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে। এবং ভাসা ভাসা জবাব দ্বারা তাদের তৃষ্ণা দূর হয় না। বন্ধদের একটা দল পীড়াপীড়ি করতে থাকে যে, এমন কর্মপন্হা অবলম্বন করতে হবে, যা মেনে চলে তারা সত্যিকার মুসলমান হতে পারে এবং ইসলামের গুণাবলীতে নিজেদেরকে বিভূষিত করে তুলতে পারে। ইসলামের অনুভূতি তাদের অন্তরকে জাগ্রত করেছে। এখন তারা ইসলামের বিধান জানতে চায়। শিক্ষক তাদেরকে পরামর্শ দেয়- এমন কোন বিশেষ স্থান বাছাই করে নেয়ার, কফি শপের দারসের আগে বা পরে যেখানে বসে ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে সামষ্টিক পাঠ গ্রহণ করা যায়। এ উদ্দেশ্যের জন্য তাদের দৃষ্টি পড়ে এমন একটা দূরবর্তী স্থানের উপর, যে স্থানটা ব্যবহার করতে হলে কিছু মেরামত করা দরকার।
হে আল্লাহ! এ জাতির অন্তর কতইনা পূত-পবিত্র, মঙ্গল আর কল্যাণ পানে কতো দ্রুত তারা ছুটে আসতে প্রস্তুত। অবশ্য এ জন্য শর্ত হচ্ছে একজন নিষ্ঠাবান এবং পূত পবিত্র নেতা। সাথী আর বন্ধূদের মধ্যে নির্মাণ কাজের বিভিন্ন বিভাগের লোকজনও ছিল। তারা সে ঘরটির প্রয়োজনীয় মেরামতের কাজে গেলে যায় এবং তা ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে। মাত্র দু’দিনের মধ্যে তারা এ কাজ সম্পন্ন করতঃ তাতে প্রথম সমাবেশের আয়োজন করে।
সমাবেশে যারা উপস্থিত হয়েছে, নামায আর ইবাদাত কক্ষে তাদের এই প্রথম প্রবেশ। অন্য কথায় তাদের অধিকাংশই ছিল নতুন। তারা শিখতে চায়। এ শিক্ষক তাদের সঙ্গে বাস্তব কর্মপন্হা অবলম্বন করে। তাদেরকে এবারত তথা মূল পাঠ পড়ে শুনাবার চেষ্টা করেনি, বা তাত্ত্বিক বিধঅন আর মাসআলা সারাক্ষণ তাদের সম্মুখে বলার চেষ্টাও সে করেনি; বরং সে সোজা তাদেরকে নিয়ে যায় পানির নলের দিকে। তাদের সকলকে এক সারিতে বসায় আর নিজে শিক্ষক হিসাবে তাদের সামনে দাঁড়ায়। ওযুর এক একটা বিষয় তাদেরকে শিক্ষা দেয়। তারা ভালোভাবে ওযু করা শিখে নিলে দ্বিতীয় দলকেও এভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। এ বাস্তব শিক্ষার ফলে ওযুর কাজ আর আদব সম্পর্কে সকলে ভালো রকমে অবগত হতে পরে। এরপর তাদের সম্মুখে ওযুর শারীরিক-মানসিক এবং পার্থিব ফযীলত বয়ান করা শুরু করে। আর হাদীস শরীফে ওযুর যেসব পূর্ণ আর সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে, সকলের মনে তা অর্জন করার আগ্রহ জাগ্রত করে।
যেমন নবীজীর এ বাণীঃ
**********************************
“যে ব্যক্তি ভালভাবে ওযু করে, তার দেহ থেকে সমুদয়, পাপ-তাপ দুর হয়ে যায়; এমনকি তার নখের নীচ থেকেও পাপ দূর হয়ে যায়”।
অথবা নবীজীর এ হাদীসঃ
**********************************
“যে ব্যক্তি ওযু করে এবং তা ভালোভাবে সম্পন্ন করে অতঃপর দু’রাকাত নামায আদায় করে এবং নিজের অন্তর আর চেহারা তাতে নিয়োজিত রাখে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজেব হয়ে যায়”।
এ ধরনের হাদীস দ্বারা শিক্ষক তার তরবিয়তের অধীন ভাইদের মনে মুস্তাহাব আর মুস্তাহসান কাজ করার আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং তাদেরকে এ জন্য উদ্বুদ্ধ করে। অতঃপর শিক্ষক তাদেরকে নামাযের দিকে নিয়ে যায়। নামাযের এক একটা রোকন তাদের সামনে ব্যাখ্যা করে। এবং তাদের প্রতি আবেদন জানায় কার্যতঃ তার সামনে নামায আদায় করে দেখাবার জন্য। অতঃপর তাদেরকে নামাযের দিকে নিয়ে যায়। নামাযের এক একটা রোকন তাদের সামনে ব্যাখ্যা করে। এবং তাদের প্রতি আবেদন জানায় কার্যতঃ তার সামনে নামায আদায় করে দেখাবার জন্য। অতঃপর তাদেরকে নামাযের ফযীলত আর বরকত সম্পর্কে অবহিত করে। নামায তরক করার ভয় দেখায়। এসব কাজ করার সময় এক এক করে তাদের সঙ্গে সূরা ফাতেহা পাঠ করে মুখে মুখে এবং আগে থেকে তাদের যেসব ছোট ছোট সূরা মুখস্ত আছে, তাদের মুখ থেকে এক এক করে সূরাগুলো শুনে এবং সংশোধন করে। এসব নবাগতের সঙ্গে তার আলোচনা কেবল সেসব অবস্থা বর্ণনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে, যা পরিপূর্ণ থাকে আশা-নিরাশা আর ভয়-ভীতিতে। খুঁটিনাটি বিষয়ের তত্ত্ব নিয়ে সে আলোচনা করে না এবং দুর্বোধ্য পরিভাষার আশ্রয়ও সে নেয় না। ফল এ দাঁড়ায় যে, উপস্থিত লোকজনের অন্তর ইসলামের বিধান জানার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যায় এবং প্রতিটি বিষয় তাদের মনে ভালোভাবে বদ্ধমূল হয়। এভাবে বিধি-বিধানের একান্ত ফিকহী দিকটাও তাদের জন্য শুষ্ক আর রসহীন থাকে না।
বিশ্বাসের প্রতি গুরুত্বারোপ
শিক্ষক তার প্রতিটি কথাবার্তা আর প্রতিটি বৈঠকেই ইসলামের সঠিক আকীদার প্রসঙ্গ তোলে, তা নিয়মিত পালন করে এবং মজবুত করে তোলার চেষ্টা চালায়। কুরআন মজীদের আয়াত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলঅইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস, সালফে সালিহীনের জীবনধারা আর ঈমানদারদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতঃ তাদের মন-মানসে তা বদ্ধমূলক করে তোলার উপায় অবলম্বন করে। এ ক্ষেত্রেও সে দার্শনিক তত্ত্ব আর যুক্তিবাদী দর্শনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে না, বরং সে সৃষ্টি লোকের মধ্যে আল্লাহ তা’আলার স্বত্ত্বার শ্রেষ্ঠত্ব- প্রাধান্য এবং মখলূকাতের মধ্যে আল্লাহর গুণাবলীর দীপ্তির প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট করতঃ আখেরাতের কথা স্মরণ করায়ে দেয়। ওয়াজ-নছীহতের ধারায় এসব তত্ত্বকে সে এ পরিমাণে তুলে ধরে, যাতে এসব তত্ত্ব সম্পর্কে কুরআন মজিদের মহত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিভাত হয়ে উঠে। উপরন্তু কোন তুল আকীদা সে তখন পর্যন্ত খন্ডন করে না, যতক্ষণ না সে মন-মানসে সঠিক ও নির্ভুল আকীদা বদ্ধমূল করে তোলে। গড়ার পর ভাঙ্গা যতটা সহজ হয়, গড়ার পূর্বে তা ততটাই কঠিন হয়। এ এক নিতান্ত সূক্ষ্মতত্ত্ব। অধিকাংশ সংস্কারক আর প্রচারকের বোধের অগম্য এ তত্ত্ব।
আলহাজ্ব মুস্তফার আঙ্গিনায়
অপর একটা আঙ্গিনাও ছিল আমাদের আশ্রয় স্থল। হাজী মুস্তফা আল্লাহর ওয়াস্তে এ আঙ্গিনা স্থাপন করেন। একদল জ্ঞানের অন্বেষক সেখানেও সমবেত হতো এবং ভ্রাতৃত্বসূলভ আর নাফসের পরিচ্ছন্নতার পরিমন্ডলে আল্লাহর আয়াত আর তাঁর সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা চলতো।
খুব বেশীদিন যেতে না যেতেই আমাদের এসব দারস আর সমাবেশের খবর দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এ দারস চলতো মাগরিব আর এশার মধ্যবর্তী সময়ে। এ দারসের পর লেখক বেরিয়ে পড়তো কফি শপের অভ্যন্তরে জারী করা দারসের উদ্দেশ্যে। এখন এসব দারসে সকল স্তরের লোক বিপুল সংখ্যায় অংশ্রগহণ করতে থাকে। এদের মধ্যে বিরোধের ক্রীড়নক, তার্কিক এবং অতীত ফেৎনার চর্চাকারীরাও থাকে।
এক রাত্রে আমি উপস্থিত লোকজনের মধ্যে এক বিরল প্রাণ চাঞ্চল্য লক্ষ্য করি। ফের্কাবাযীল প্রাণচাঞ্চল্য আর লম্ফ ঝম্ফের অব্স্থা। আমি দেখতে পাই, শ্রোতারা নানা দলে বিভক্ত। এমনকি বসার আসনের ক্ষেত্রেও তারতম্য। আমি দারস শুরুই করেছি মাত্র। হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করা হয়ঃ