৯
আখেরাত
এই জীবন
এই দুনিয়ায় আমাদের আসার পূর্বে লক্ষ কোটি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে তা কে জানে? এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পর না জানি আবার এখানে কত জাতির আবির্ভাব ঘটবে? যে অজানা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং সামনে যে অনাগত সময় রয়েছে তার সাথে আমাদের এই সীমিত জীবনের কি তুলনা হতে পারে? এ জীবন বড়ই সীমিত, অসীমের সাথে এর কোন তুলনাই হয় না। এই সংকীর্ণ জীবনই হচ্ছে পার্থিব জীবন। পূর্বে এ জীবনের কোন অস্তিত্ব ছিল না এবং পরে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। এই জীবনই হচ্ছে এই জগতের চাকচিক্য, সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা।
জীবনের দীর্ঘ পথে মানবগোষ্ঠী অনন্তর সফররত। ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে তারা যখন থেমে যায়, তখন তাদের মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেয়া যায়। কিন্তু এই হাঁপিয়ে যাওয়া চেহারা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পূর্বে, এই অবসন্ন পাগুলো থেমে যাওয়ার পূর্বে দ্বিতীয় একটি জাতি দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়। তারা আবার নতুনভাবে সফর শুরু করে এবং নিজেদের কর্মতৎপরতার প্রদর্শনী করে। আর সেই শ্রান্তক্লান্ত জাতিকে দুনিয়ার চলমান সমাজ থেকে বের করে নিয়ে ধ্বংসের গহবরে নিক্ষেপ করা হয়, কাফনে পেঁচিয়ে মাটির নিচে গোপন করে দেয়া হয়।
এখন এই নতুন জাতি নতুন উদ্যমে জীবনের কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে থাকে। অতঃপর তারা যখন পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে তখ তাদেরকেও দুনিয়ার বুক থেকে বিদায় করে দেয়া হয় এবং তাদের স্থান দখন করে আরেকটি নতুন গোষ্ঠী। বিবর্তনের এই ধারা নিরন্তর চলতে থাকে। এই হচ্ছে জীবন পথের যাত্রীদল।
জীবনের তার ছিন্ন হচ্ছে, জীবন-পথের অভিযাত্রীদল থমকে যাচ্ছে, কিন্তু এই জগতের কর্মচাঞ্চল্য বরাবর তাকে গতিশীল করে রাখছে। তার গতিতে কোনরূপ পার্থক্য সূচিত হচ্ছে না। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে –কর্মরত মানুষগুলো তাদের কাজের মধ্যে ডুবে রয়েছে, কিন্তু তারা কখনো অনুভব করতে পারে না যে, তারাও উত্থান-পতনের ধারাবাহিকতায় একদিন হারিয়ে যাবে। ফুল যেমন অনেক সময় এই দুনিয়ার ছলনা তাকে এমনভাবে বিমোহিত করে রাখে যে, সে চিন্তাও করতে পারে না –সে কোথা থেকে এসেছে, যেভাবে একাকী এসেছে সেভাবেই নিঃসঙ্গ ফিরে যেতে হবে।
দুনিয়ার ভোগ-লালসা তাকে এতই বিভোর করে ফেলে যে, মনে হয় সে যেন অনন্তকাল ধরে এখানে আছে এবং অনন্তকাল এখানে থাকবে। সুতরাং যখন মৃত্যু এসে হানা দেয়, তখণ সে হতবাক হয়ে যায়। মনে হয় মৃত্যু যেন নতুন কোন জিনিস। কিন্তু হতভম্ব হলে কি হবে! মৃত্যুদূত আর খালি হাতে ফিরে যায় না। হাত কচলাতে কচলাতে তাকে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতে হয়। মানুষ যে দুনিয়ায় বসবাস করে তার মেজাজ-প্রকৃতি সম্পর্কে অমনোযোগী না হওয়ার মধ্যেই তার কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তারা যেন টলটলায়মান থামের উপর আকাশচুম্বী ইমারত নির্মাণ না করে।
কিন্তু এ কথার অর্থ কি? মানবজাতির এই জগতে আসার উদ্দেশ্য কি তাই? আমরা পূর্ণ বিশ্বস্ততার সঙ্গে বলব, না, মোটেই না। এই দুনিয়ার জীবনের অবস্থা যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আখেরাতের অনন্ত জীবনই আমাদের কাম্য। এই দুনিয়ার জীবনই যদি সবকিছু হত তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার মধ্যেই মানবজাতির কল্যাণ নিহিত থাকত। সত্য কথা এই যে, আসল জীবন এবং চিরস্থায়ী জীবন হচ্ছে আখেরাতের জীবন। যারা সেই অনন্ত জীবনের প্রস্তুতির জন্য এই সংকীর্ণ জীবনকে কাজে লাগায় –তারাই প্রকৃত বুদ্ধিমান। কবি বলেনঃ
মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে
চিরন্তন জীবনের জন্য
কিন্তু তারা মনে করেছে
সৃষ্টি তারা অস্থায়ী জীবনের জন্য,
তাদের কেবল পৌঁছিয়ে দেয়া হয়
আমলের জগত থেকে
দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যের জগতে।
যেসব লোক দুনিয়া ও আখেরাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তদনুযায়ী উভয়ের হক আদায় করেছে –প্রকৃতপক্ষে তারাই সৌভাগ্যবান। এখানে মানুষের জীবনকাল যত সংকীর্ণ তদনুযায়ী তার সময় ব্যয় করা উচিত। আর আখেলাতের জীবন যত দীর্ঘ হবে –তার জন্য তত প্রচেষ্টা চালাতে হবে!
এই জীবনের পর
প্রত্যেকেই জানে একদিন মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতেই হবে। এটা এমন এক ঘাঁটি যেখানে সবাইকে হাযির হতে হবে। মৃত্যুর হাত থেকে কেউ রেহাই পাবে না। কিন্তু মৃত্যু কি জিনিস? এর রহস্যই বা কি? এ সম্পর্কে অধিকাংশ লোকেরই ধারণা নেই। তারা মৃত্যু সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার শিকার। তারা মনে করে মৃত্যুর চেতনা বা অনুভূতির কোন সম্পর্ক নেই। তারা মনে করে –একটি মৃত জীব যেভাবে মাটিতে মিশে যায়, অথবা যবেহকৃত পশুর গোশত পাকস্থলীতে গিয়ে যেভাবে হজম হয়ে যায় এবং এরপর আর কিছুর অবশিষ্ট থাকে না –মানুষের অবস্থাও তাই।
এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। মৃত্যু নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার নাম নয়, নিঃশেষ হওয়ার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। মৃত্যুকে আমরা একটা দীর্ঘ নিদ্রা এবং একটি সংক্ষিপ্ত মৃত্যু বলতে পারি। কুরআনের দৃষ্টিতে মৃত্যু এবং ঘুম একই শ্রেণীভুক্ত জিনিস। এ হচ্ছে দুটি আপতিক অবস্থা, মানবাত্মার উপর এর প্রভাব খুব একটা বেশি নয়।
(আরবী**************************************************************************************)
তিনিই তো আল্লাহ, যিনি মৃত্যুর সময় রূহগুলোকে কবজ করেন এবং যারা এখনো মরেনি, ঘুমের মধ্যে তাদের রূহ কবজ করে নেন। অতঃপর যার উপর তিনি মৃত্যুর ফয়সালা কার্যকর করেন তার রূহ আটকে রাখেন এবং অন্যদের রূহকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফেরত পাঠিয়ে দেন।–সূরা যুমারঃ ৪২
কিছু সময়ের জন্য রূহ যদি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে মানুষের প্রকৃতি বদলে যায় না। দেহ যেন পোশাকের সাথে তুল্য। মানুষ তা কখনো পরিধান করে আবার কখনো খুলে রাখে। মানুষের প্রকৃতির সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। তাহলে মৃত্যু কি জিনিস? তা কেবল এক ধরনের স্থানান্তর মাত্র। মানুষ মরে গিয়ে নিজের স্থান পরিবর্তন করে মাত্র। সে এই বস্তুজগত থেকে এমন এক জগতে প্রবেশ করে যেখানে সে একইভাবে যাবতীয় বিষয় উপলব্ধি করতে পারে এবং তার চেতনা ও অনুভূতিও বর্তমান থাকে। বরং এখানে যেকোন বিষয়ের রহস্য আরো অধিক পরিস্কার হয়ে ধরা দেয় এবং চেতনা ও অনুভূতি আরো প্রখর হয়ে যায়। এই হচ্ছে মৃত্যুর ধারণা। এছাড়া অন্য কোন প্রকারের দৃষ্টিভংগী পোষন করা ঠিক হবে না।
আমরা যদি এই সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি তাহলে মৃত্যুর জন্য কোন পরোয়া নেই। তার কল্পনা করে ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। বরং সাহসী পদক্ষেপে তার সাথে বুক মেলানো উচিত।
আমরা যদি এই সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি তাহলে মৃত্যুর জন্য কোন পরোয়া নেই। তার কল্পনা করে ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। বরং সাহসী পদক্ষেপে তার সাথে বুক মেলানো উচিত।
আলমে বারযাখ (মধ্যবর্তী জগত)
মানুষ এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার সাথে সাথে তার যাবতীয় কাজের হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে যায় এবং তার প্রাপ্য সওয়াব অথবা শাস্তি সামনে এসে যায়। আখেরাতের জীবনের এই প্রথম ঘাঁটিতে মানুষ যেসব অবস্থার সম্মুখীন হয় কুরআন মজীদে তার কিছুটা উল্লেখ করা হয়েছে। ফিরাউন ও তার পরিষদবর্গের উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*********************************************************************************)
দোযখের আগুন। এর উপর তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় পেশ করা হয়। আর যখন কিয়ামতের মুহুর্ত এসে দাঁড়াবে, তখন হুকুম হবে, ফিরাউনী দলবলকে কঠিনতর আযাবে নিক্ষেপ কর।–সূরা মুমিনঃ ৪৬
কুরআন শহীদদের মর্যাদাও বর্ণনা করেছে। একথাও বলা হয়েছে যে, তারা তাদের সাথীদের জন্য অপেক্ষা করছে। তারাও এসে তাদের সাথে মিলিত হবে। যে সৌভাগ্য তারা লাভ করেছে তাতে এরা এসে শরীক হবে।
(আরবী*****************************************************************************************)
যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত করো না। প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত, তারা তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে রিযিক পাচ্ছে। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা কিছু দান করেছেন তা পেয়ে তারা খুশি ও পরিতৃপ্ত। যেসব ঈমানদার লোক তাদের পেছনে (দুনিয়ায়) রয়ে গেছে এবং এখনো তথায় পৌঁছেনি –তাদের জন্য কোন ভয় ও চিন্তা নেই জেনে তারা সন্তুষ্ট ও নিশ্চিন্ত। তারা আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহ লাভ করে আনন্দিত ও উৎফুল্ল। আল্লাহ তায়ালা ঈমানদার লোকদের কর্মফল বিনষ্ট করেন না।–সূরা আল ইমরানঃ ১৬৯-৭১
মানুষ যখন একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যখন তারা এক পা উপরে থাকে ও এক পা কবরে চলে যায় –তখন সফলতা বা ব্যর্থতা, সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের চিত্র প্রতীয়মান হয়ে উঠে। হাদীস থেকে জানা যায়, মুমিন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় সান্ত্বনা দেয়া হয় এবং তার শুভ পরিণতির কথা শুনান হয়। নিম্নোক্ত আয়াতও তার সত্যতা প্রমাণ করেঃ
(আরবী*******************************************************************************)
যেসব লোক বলে, আল্লাহ আমাদের রব এবং তারা এর উপর অটল হয়ে থাকল –নিঃসন্দেহে তাদের জন্য ফেরেশতা নাযিল হয় এবং তাদের বলতে থাকে –ভয় পেও না, চিন্তা করো না। তোমরা সেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে সন্তুষ্ট হও, যার ওয়াদা তোমাদের দেয়া হয়েছে।–সূরা হা-মীম সাজদাঃ ৩০
পক্ষান্তরে যেসব লোক জালিম এবং স্বৈরাচারী তাদের শাস্তির দুঃসংবাদ শুনান হয়।
(আরবী*******************************************************************************)
হায়, তুমি যদি জালিমদের সেই অবস্থায় দেখতে পেতে যখন তারা মৃত্যুর যাতনায় হাবুডুবু খেতে থাকে! এ সময় ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বলতে থাকেঃ দাও, বের করে দাও তোমার জানপ্রাণ। আজ তোমাদের অপরাধের শাস্তি হিসেবে অপমানকর আযাব দেওয়া হবে। কেননা তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যা দোষারোপ করছিলে এবং তাঁর আয়াতের বিরুদ্ধে অহংকার প্রদর্শন করছিলে।–সূরা আনআমঃ ৯৩
(আরবী*****************************************************************************************)
তোমরা যদি সেই অবস্থা দেখতে পেতে যখন ফেরেশতারা নিহত কাফেরদের রূহ কবজ করছিল। তারা তাদের মুখমণ্ডল ও দেহের পশ্চাদভাগের উপর আঘাত করছিলে এবং বলছিলে, এখন আগুনে জ্বলবার শাস্তি ভোগ কর। এটা সেই শাস্তি যার আয়োজন তোমাদের হাতসমূহ পূর্বাহ্নেই করে রেখেছে। নতুবা আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের উপর জুলুমকারী নন।–সূরা আনফালঃ ৫০-৫১
ঈমানদার অপরাধীরা ফরয কর্তব্যসমূহ আদায়ের ব্যাপারে যতটা ত্রুটি করে থাকবে এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমা যতটা পদদলিত করে থাকবে –তদনুযায়ী তাদেরকেও শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। হাদীসে এসেছেঃ
(আরবী**************************************************************************************)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম একটি কবরের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার মধ্যে দুই ব্যক্তিকে দাফন করা হয়েছিল। তিনি বলেনঃ এদের উভয়কে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কোন মারাত্মক অপরাধের জন্য শাস্তি হচ্ছে না। তাদের একজন পেশাবের ব্যাপারে সতর্কথা অবলম্বন করত না। আর অপরজন লোকদের মধ্যে চোগলখোরি করে বেড়াত।
কবরের শাস্তি এবং শাস্তি সম্পর্কে অনেক প্রমাণ আছে। তা থেকে জানা যায়, বেহেশত অথবা দোযখে যাওয়ার পূর্বেও এমন কিছু জিনিস আছে যা মানুষকে আনন্দ ও সৌভাগ্যের খবর শুনায় অথবা বিপদ মুসীবদের সম্মুখীন করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী********************************************************************************)
তোমাদের কেউ যখন মারা যায়, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় তার ভবিষ্যতে বাসস্থান তার সামনে পেশ করা হয়। সে যদি বেহেশতীদেরঅন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে তাহলে বেহেশতীদের স্থান দেখানো হয়। আর যদি দোযখীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে তাহলে দোযখীদের স্থান দেখানো হয়।
সাথে সাথে বলা হয়, এটাই তোমার আসল স্থান। আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তোমাকে এখানে পাঠাবেন।–বুখারী, মুসলিম
মানুষের বয়সের বিভিন্ন স্তর হয়ে থাকে। তা তাকে অবশ্যই অতিক্রম করতে হয়। যেমন শিশুকাল, যৌবনকাল, বার্ধক্য ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মৃত্যুও মূলত জীবনের একটি স্তর। এই স্তরে মানুষের বোধশক্তি বেড়ে যায় এবং রূহ যা কিছু অনুভব করে তা সঠিকই অনুভব করে।
যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করে সে যদি জানত যে, সে কোন জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, অথবা কোন স্তরে পা রাখছে তাহলে সে নির্বোধের মত এই কাজ করত না। সে আত্মহত্যা করার পূর্বে শতবার চিন্তা করত। মানসিক যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার উদ্দেশ্যেই সে এরূপ ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। সে এমন এক জগতে পৌঁছে যেতে চায় যেখানে তার মতে চেতনা ও অনুভূতির কোন অস্তিত্ব নেই এবং তাকে যেন আর কখনো দুঃখজনক পরিণতির সম্মুখীন হতে না হয়। তার জানা নেই, সে যে জগতের দিকে পা বাড়াচ্ছে তা মূলত অনুভূতি ও পরিণতিরই জগত। এখানে অনুভূতিশক্তি কয়েক গুণ বেড়ে যায় এবং পদে পদে নিজের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে থাকে।
মৃত্যু সম্পর্কে সাধারণ লোকেরা যে দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে তা অজ্ঞতা ও কুসংস্কার পরিপূর্ণ। তাদের মতে কবর এমন একটি জায়গা যা নীরবতা ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন এবং কীটপতঙ্গের খেলার মাঠ। ব্যস এতটুকুই। আমরা এই ভয়ংকর দৃশ্য সম্পর্কে অজ্ঞ নই কিন্তু যে বক্ষ কল্যাণ ও অনুগ্রহের আবেগে উচ্ছ্বাসিত, যা ক্ষতিকর জিনিস সম্পর্কে সর্বদা সন্ত্রস্ত, অতঃপর এই দুই ভিত্তির উপর যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সভ্যতা-সংস্কৃতি অস্তিত্ব লাভ করে এবং যেসব যুদ্ধ ও সন্ধি হয়ে থাকে, এই পৃথিবীই এসব কিছুর সর্বশেষ মনযিল এবং এখান পর্যন্তই এর কার্যকারণ সীমাবদ্ধ –একথা আমরা স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত নই।
কবরের এই দৃশ্যের পেছনে রয়েছে প্রশস্ত ফুল বাগান, সেখানে নানা বর্ণের ফুল ও কলির সমাহার, সর্বত্র মন-মাতানো খোশবু ছড়িয়ে রয়েছে –এই সাজানো বাগান নেককার মুমিনদের জন্য তৈরি করে রাখা হয়েছে।
অপর দিকে কবর এমন একটি গর্ত, যেখানে নিকৃষ্ট আত্মাগুলোকে নিক্ষেপ করা হয়। এখানে তাদের উপর অবিরত হাতুড়ী মারা হচ্ছে, এখানে রয়েছে আগুনে উত্তপ্ত অসংখ্য হাতিয়ার এবং এর সাহায্যে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে দাগ দেওয়া হচ্ছে। আর এই অবস্থায় তারা তড়পাচ্ছে এবং হাঁকডাক ছাড়ছে। এ হচ্ছে সেসব লোক যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং তাঁর বান্দাদের উপর জুলুম-অত্যাচার করেছে। এটা এমন এক জগত যার রহস্য অনুধাবন করতে আমরা অক্ষম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এই অদৃশ্য জগতের (আলমে আরযাখ) তথ্য এত পরিস্কারভাবে তুলে ধরেছেন যে, তা একটি অবয়বের আকারে আমাদের সামনে ভেসে উঠছে। জীবন্ত হৃদয়ের অধিকারী মানুষ অনুভব করতে পারত, যেন সেই দৃশ্য তাদের দৃষ্টির সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে এবং তারা অন্তরচক্ষু দিয়ে তা দেখতে পাচ্ছে।
তিনি লোকদের মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দেন যে, মৃত্যু জীবনেরই একটি স্তর, যেমন শৈশব, বাধ্যর্ক জীবনের এক একটি স্তর। দেহের অভ্যন্তরে অবিরত যে হৃদকম্পন চলছে তা মুহুর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ বস্তুজগত ত্যাগ করে বারযাখ জগতে চলে আসতে বাধ্য হযে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এই বারযাখ (মধ্যবর্তী) জগতের যে বর্ণনা দিয়েছেন তার কিছুটা আমরা এখানে তুলে ধরব।
কোন মুমিন বান্দা যখন এই দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে আখেরাতের জগতে পা রাখতে যায়, তখন আসমান থেকে একদল ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়। তাদের চেহারা সূর্যের মত আলোক উদ্ভাসিত। তাদের সাথে থাকে বেহেশতের একটি কাফন এবং সুগন্ধি। তারা এসে তার এত কাছে বসে যে, সে স্বচক্ষে দেখতে পায়। অতঃপর মৃত্যুদূত এসে তার শিয়রে বসে বলেঃ
হে পাক রূহ! চল, আল্লাহর ক্ষমা এবং তাঁর সন্তুষ্টির দিকে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, অতঃপর রূহ বেরিয়ে আসে এবং তা কলসের পানির মত গড়িয়ে পড়ে। মৃত্যুদূত সাথে সাথে তা হাতে তুলে নেয়। এ সময় অপর এক ফেরেশতা সামনে এগিয়ে আসে। সে মুহুর্তের মধ্যে মৃত্যুদূতের হাত থেকে রূহটি নিজের হাতে নিয়ে নেয় এবং তা কাফনের মধ্যে রেখে তাতে সুগন্ধি মেখে দেয়। এই সুগন্ধি দুনিয়ার সর্বোত্তম সুগন্ধির চেয়েও উত্তম।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) আরো বলেন, অতঃপর এই ফেরেশতা রূহ নিয়ে আসমানের দিকে চলে যায়। সে ফেরেশতাদের যে দলের সামনে দিয়েই অতিক্রম করে। তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, এটা কোন পবিত্র ব্যক্তির রূহ? সে বলে, সে অমুক ব্যক্তির পুত্র অমুক। তাকে দুনিয়াতে যেমন সর্বোত্তম নামে ডাকা হত, এখানেও সেই নামে পরিচয় দেওয়া হয়। এভাবে সে তাকে নিয়ে প্রথম আসমানের কাছে পৌঁছে যায়। সে তার জন্য আসমানের দরজা খুলতে বলে। অতএব তা খুলে দেয়া হয়।
প্রত্যেক আসমানের বিশিষ্ট ফেরেশতা পরবর্তী আসমান পর্যন্ত তার সাথে যায়। এভাবে ঐ ফেরেশতা রূহটি নিয়ে সপ্তম আসমানে পৌঁছে যায়। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার এই বান্দার ঠিকানা ইল্লীনে লিখে দাও এবং তাকে তার পৃথিবীর দেহে পৌঁছিয়ে দাও! অতঃপর দুইজন ফেরেশতা এসে কবরের মধ্যে তাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করো, তোমার রব কে? সে বলে, আল্লাহ আমার রব। তারা উভয়ে বলে তোমার দ্বীন কি? সে বলে, ইসলাম আমার দীন। তারা উভয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, তোমাদের কাছে যে ব্যক্তিকে পাঠানো হয়েছে তিনি কে? সে বলে, তিনি আল্লাহর রাসূল। তারা বলে, তুমি তা কিভাবে জানতে পারলে? সে বলে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি, তার উপর ঈমান এনেছি এবং তার মধ্যে যা কিছু ছিল তা সত্য বলে মেনে নিয়েছি।
এ সময় আসমান থেকে শব্দ আসে, আমার বান্দা সত্য বলেছে। তার জন্য বেহেশতের বিছানা পেতে দাও এবং বেহেশতের একটি জানালা খুলে দাও। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, তার কাছে বেহেশতের বায়ু এবং সুগন্ধি আসতে থাকে। তার কবরকে দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। অতঃপর তার কাছে উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে এবং সুগন্ধি মেখে এক সুদর্শন ব্যক্তি উপস্থিত হয়। সে বলে, তোমাকে সাফল্যের সুসংবাদ। এই সেই দিন যার ওয়াদা তোমাদের কাছে নূরের তৈরী? এ ধরনের চেহারার অধিকারীদের কাছে কল্যাণই আশা করা যায়। সে বলে, আমি তোমার নেক কাজসমূহ। সে তখন বলে, হে প্রভু! কিয়ামত কায়েম কর, হে প্রভু! কিয়ামত এনে দাও। তাহলে আমি আমার পরিবার-পরিজন ও সম্পদের সাথে মিলিত হতে পারব।
অপরদিকে কাফের ব্যক্তির মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে কুৎসিৎ ও ভয়ংকর চেহারার অধিকারী দুই ফেরেশতা হাতে চট নিয়ে হাযির হয়। তারা উভয়ে তার এতটা দূরত্বে বসে যাতে সে তাদের দেখতে পায়। অতঃপর মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যায়। সে তার শিয়রে বসে বলে, হে কলুষিত আত্মা! চল আল্লাহর গযব এবং তাঁর শাস্তির দিকে। অতঃপর সে তার দেহের অভ্যন্তরে ঢুকে যায় এবং জোরপূর্বক তার রূহ বের করে নেয় –যেভাবে উল থেকে গরম লৌহ শলাকা টেনে বের করা হয়। সে তার রূহ নিজের হাতে নিয়ে নেয়।
অতঃপর আর এক ফেরেশতা তার হাত থেকে এই রূহ নিজের হাতে নিয়ে সেই চটে পেচিয়ে নেয়। এই রূহ থেকে দুনিয়ার নিকৃষ্টতম দুগন্ধের চেয়েও তীব্র দুর্গন্ধ নির্গত হতে থাকে। সে তা নিয়ে ঊর্ধ্ব জগতে আরোহণ করে। ফেরেশতাদের যে দলের কাছ দিয়েই সে এই রূহ নিয়ে অতিক্রম করে, তারা তাকে জিজ্ঞেস করে –এটা কার নিকৃষ্ট আত্মা? সে বলে, অমুকের পুত্র অমুকের। দুনিয়াতে তাকে সে নিকৃষ্ট নামে ডাকা হত সেই নামেই তার পরিচয় দেওয়া হয়। সে এটা নিয়ে আসমানের কাছে পৌঁছে যায়। সে তা নিয়ে প্রবেশ করার জন্য আসমানের দরজা খুলতে বলে। কিন্তু তা খোলা হয় না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) এই আয়াত পাঠ করলেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ মোটেই খোলা হবে না। তাদরে জান্নাতে প্রবেশ ততখানি অসম্ভব, যতখানি অসম্ভব সূচের ছিদ্রপথে উটের গমন।–সূরা আরাফঃ ৪০
এ সময় আল্লাহ তাআলা বলেন, এর ঠিকানা সিজজীনে লিখে দাও, যমীনের সর্বনিম্ন স্তরে। অতঃপর তার রূহ নিকৃষ্টতভাবে ছুঁড়ে মারা হয়। এ স্থানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
যে ব্যক্তিই আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে যেন আসমান থেকে পড়ে গেল। অতঃপর হয় তাকে পাখি ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে অথবা বাতাস তাকে এমন জায়গায় নিক্ষেপ করবে যেখানে তার বিন্দু বিন্দু উড়ে যাবে।–সূরা হজ্জঃ ৩১
অতঃপর তার রূহ তার দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এ সময় দুই ফেরেশতা এসে তাকে উঠিয়ে বসার এবং জিজ্ঞেস করে, তোমার রব কে? সে বলে, হায়! হায়! আমি কিছুই জানি না। তারা জিজ্ঞেস করে, তোমার দীন কি? সে বলে, হায়! হায়! আমি কিছুই জানি না। তারা আবার জিজ্ঞেস করে, তোমাদের কাছে যে ব্যক্তিকে পাঠানো হয়েছিল সে কে? সে বলে হায়! হায়! আমি কিছুই জানি না। এ সময় আসমান থেকে আওয়াজ আসে, এ মিথ্যাবাদী, এর জন্য দোযখের আগুনের বিছানা পেতে দাও এবং দোযখের একটি দরজা খুলে দাও।
অতএব তার কাছে গরম বায়ু ও অগ্নিশিখা আসতে থাকে এবং তার কবর এত সংকীর্ণ করে দেওয়া হয় যে, তার দেহের এক পাঁজর অপর পাঁজরের সাথে মিশে যায়। অতঃপর তার সামনে একটি নিকৃষ্ট চেহারার লোক এসে হাযির হয়। তার পরণে থাকে দুর্গন্ধময় বিশ্রী পোশাক। সে বলে, তুমি যে দুষ্কর্ম করেছ তার সুসংবাদ গ্রহণ কর! এই সেই দিন যার ওয়াদা তোমাকে দেওয়া হয়েছিল। তখন সে জিজ্ঞেস করে, তুমি কে? তোমার চেহারা কত ভয়ানক! তোমার কাছে অকল্যাণ ছাড়া আর কি আশা করা যায়! সে বলে, আমি তোমার সেই দুষ্কর্ম। তখন সে বলে, হে আল্লাহ! কিয়ামত কায়েম কর না।
অপর একটি হাদীসের বর্ণনাও ঠিক এরূপ। কিন্তু তাতে আরো আছেঃ তার কাছে একটি লোক আসে! তার চেহারা অত্যন্ত কুৎসিৎ ও দুর্গন্ধময়। তার পোশাক অত্যন্ত ভয়ংকর ধরনের। সে বলে, দুর্ভাগা! চিরন্তন শাস্তি, চিরকাল ধরে অপমান, এখন নিজের চোখ জুড়াও। সে বলে, আল্লাহ তোমার ধ্বংস করুন, তুমি কে? সে বলে, হে বদনসীব! আমি তোমার সেই দুষ্কর্ম, পাপ কাজের ব্যস্ততা এবং আল্লাহর আনুগত্য থেকে ঘাড় ফিরিয়ে নেয়া। আল্লাহ তোমায় ধ্বংস করুন, এ তো তোমার সেই কৃতকর্ম।
অতঃপর তার উপর একটি অন্ধ, বধির ও বোবা ফেরেশতাকে নিযুক্ত করে দেওয়া হয়। তার হাতে দেওয়া হয় লোহার একটি ডাণ্ডা। তা দিয়ে কোন পাহাড়ের উপর আঘাত করা হলে তা গুড়া হয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেত। এটা দিয়ে যখন সে তাকে আঘাত করে তখন সে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা তাকে পূর্বের ন্যায় দেহবিশিষ্ট করে দেন এবং ফেরেশতা তাকে আঘাত করতে থাকে। ফলে সে এমন জোরে চিৎকার দেয় যে, মানুষ ও জিন ছাড়া আর সব সৃষ্টিই তা শুনতে পায়। অতঃপর তার জন্য দোযখের একটি দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং দোযখের বিছানা পেতে দেওয়া হয়।
কবরের আযাব ও সওয়াবের রহস্য সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। দেহ ও আত্মার উপর কি কি অবস্থা ছেয়ে যায় সে সম্পর্কেও আমাদের কোন জ্ঞান নেই। তবে আমরা এই আযাব ও সওয়াব সম্পর্কে ঈমান রাখি। অবশ্য এর ধরন, দেহ থেকে গোশত আলাদা হয়ে যাওয়া, হাড়গুলো গুড়া হয়ে যাওয়া এবং এরপর যে অবস্থা হয়ে থা –এ সম্পর্কে আমরা কিছুই বলতে পারি না। কেননা আত্মার ন্যায় জড় পদার্থের ব্যাপারটিও উদ্ভুত ধরনের। জীবনের যে বৈশিষ্ট্য এবং জগতের যে রহস্য দিনের পর দিন সামনে আসছে –যাচ্ছে, তার দাবি এই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে আমরা যা জানতে পেরেছি তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করব এবং তার সূক্ষ্ম দিকগুলো ভবিষ্যতের হাতে তুলে দেব। আমরা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার উপযুক্ত নই।
ব্যক্তির জীবনকাল ও পৃথিবীর জীবনকাল
কোন ব্যক্তির জীবনকাল শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আখেরাতের পানে ধাবিত হয় এবং আশা-নিরাশা ও সুখ-দুঃখের এই যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যদের রেখে যায়। এই জীবনের জাগরণ কতদিন ধরে চলবে, কতকাল মানুষ বেঁচে থাকবে, কতদিন জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে, কত কাল এখানে তার শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে থাকবে এবং বেহেশত অথবা দোযখের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে? হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার এই জগতকে ধ্বংস করার জন্য আল্লাহ তাআলা কখন সিদ্ধান্ত নেবেন?
কুরআন ও হাদীস থেকে জানা যায়, এই জগতের একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। এই সীমার বাইরে সে যেতে পারে না। যখন সেই নির্দিষ্ট সময় এসে যাবে –আসমান ফেটে চৌচির হয়ে যাবে, যমীন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, সাগর-মহাসাগর শুকিয়ে যাবে, সমগ্র-সৃষ্টিকুল ধ্বংস হয়ে যাবে এবং বিশ্ব-ইতিহাসের এই বিরাট দফতর উলট—পালট করে দেওয়া হবে।
মৃত্যুর পূর্বে কতগুলো নিদর্শন প্রকাশ পায়, যা মৃত্যুর আগাম সংবাদ বহন করে, যেমন রোগ, বার্ধক্য বা অন্য আলামত। অনুরূপভাবে গোটা মানবজাতির জীবনকাল শেষ হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে কতগুলো নিদর্শন প্রকাশ পায়। এই নিদর্শনগুলো প্রকাশ পাওয়ার অর্থ হচ্ছে, দুনিয়ার বয়সসীমা শেষ হয়ে যাচ্ছে, এখন তা ধ্বংস হওয়ার অপেক্ষায় আছে।
আমাদের মতে জগতের অস্তিত্ব অটুট থাকার জন্য প্রথম শর্ত এই যে, যমীনের বুকে এমন একদল লোক অবশ্যই থাকতে হবে যারা নিজেদের প্রতিপালককে চিনবে এবং তাঁর অধিকারসমূহ পূর্ণরূপে আদায় করবে। তাদের সংখ্যা বেশি অথবা কম যাই হোক না কেন। দুনিয়াতে যখন এ ধরনের লোকের অস্তিত্ব থাকবে না এবং একথা প্রমাণিত হয়ে যাবে যে, দুনিয়ার মানুষ এ ধরনের পবিত্র স্বভাবের লোক সৃষ্টি করতে অক্ষম তখণ মনে করতে হবে দুনিয়া এখন কাঙ্গাল হয়ে পড়েছে। যেসব মূল্যবোধ তার অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য তা সে হারিয়ে ফেলেছে। যেসব মূল্যবোধ তার অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য তা সে হারিয়ে ফেলেছে। এখন তার ধ্বংস হওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। কুরআন-হাদীসে কিয়ামতের যেসব আলামত উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে পরিস্কারভাবে একথাই জানা যায়।
নবী-রাসূলগণ উদ্যত জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করেছেন। নিজেদের দেহের রক্ত দিয়ে সত্যের মশাল প্রজ্বলিত করেছেন। লোকদের হিদায়াতের পথে আনার জন্য জীবনের সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন। অবশেষে মানবগোষ্ঠীর একটি অংশ তাঁদের দাওয়াত কবুল করেছে। তারা যুগ যুগ ধরে তাঁদের পতাকাতলে চলতে থাকে এবং আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে। অতঃপর তাঁদের অনুসারীদের সংখ্যা যখন কমে যাবে, তাঁদের পতাকা নিম্নগামী হয়ে যাবে, তাঁদের শরীআত লুপ্ত হয়ে যাবে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শেষ হয়ে যাবে এবং তাঁদের প্রজ্বলিত আলোকশিখা নির্বাপিত করার জন্য বাতিল সভ্যতার উন্মেষ ঘটবে, মানুষ তাদের দেখানো পথ হারিয়ে ফেলবে, চারদিকে বিবাদ-বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়বে, সম্মান ও মর্যাদাবোধ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, মসজিদসমূহ অনাবাদী পড়ে থাকবে, অন্তরে আল্লাহর স্মরণ অবশিষ্ট থাকবে না, লোকেরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াবে –এই সময় গোটা মানবজাতি প্রলয়ের সম্মুখীন হবে এবং হাশরের মাঠের দিকে দ্রুত ধাবিত হবে।
একথা সত্য যে, মানবজাতি আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গেছে। আজ সে প্রতিটি জিনিসের উপর হুকুম খাটাচ্ছে এবং তাকে মানুসের সুখ-শান্তির জন্য বশীভূত করেছে এবং করছে। কিন্তু একথাও সত্য যে, মানবজাতি বস্তুগত দিক থেকে যতই উন্নতি করছে নৈতিক মূল্যবোধ থেকে ততই দূরে সরে যাচ্ছে। সে বস্তুগত উন্নতির যতগুলো সিঁড়ি অতিক্রম করছে, নৈতিক মূল্যবোধের ঠিক তত ধাপ নিচে নেমে গেছে। সে খুনখারাবিতে লিপ্ত হয়ে পড়বে, বিদ্রোহের মস্তক উত্তোলন করবে, ‘আমি সর্বেসর্বা’, ‘আমি সবচেয়ে বড় খোদা’ বলে শ্লোগান দেবে। এ সময়েই বিশ্বের ধ্বংস হওয়া চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যাবে। কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াত সম্পর্কে চিন্তা করলে এ সত্যই সামনে এসে যায়।
(আরবী************************************************************************)
এমনকি যমীনের উৎপাদন –যা মানুষ ও জন্তু সকলেই খায় –খুব পুঞ্জীভূত হয়ে সুশোভিত হয়ে উঠল –তখন এর মালিকগণ মনে করছিল যে, তারা এখন তা ভোগ করতে সক্ষম। তখণ সহসা রাতের বেলা কিংবা দিনের বেলা আমাদের নির্দেশ এসে পৌঁছল এবং আমরা তা এমনভাবে ধ্বংস করে ফেললাম, যেন গতকাল সেখানে কিছুই ছিল না। আমরা চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এভাবে নিদর্শনসমূহ বিস্তারিতভাবে পেশ করি।–সূরা ইউনুসঃ ২৪
এখানে আমরা কিছু সংখ্যক হাদীস নকল করব। তা থেকে জানা যায়, যমীনের বুকে যখন কুফর ও শিরকের জয়জয়কার চলবে তখন কিয়ামত এসে যাবে। সর্বত্র দুষ্কৃতি, ফিতনা-ফাসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিশৃঙ্খলার অন্ধকার এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে, এরপর নেকী ও তাকওয়া এবং কল্যাণ ও মঙ্গলের সুবহে সাদেক উদিত হওয়ার আর আশাই করা যাবে না। দুনিয়াটা লালসা-বাসনা, বিলাসিতা ও অহংকারের পাকে এমনভাবে নিমজ্জিত হবে যে, এরপর এই আবর্জনার মধ্য থেকে বের হওয়ার আর কোন উপায় থাকবে না। হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
এমন কোন ব্যক্তির উপর কিয়ামত আসবে না, যে বলে আল্লাহ, আল্লাহ।–মুসলিম, কিতাবুল ঈমান
হযরত হুযাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
দুনিয়ায় এমন ব্যক্তি যখন সৌভাগ্যশালী হবে যে নিজেও অসভ্য, জঘন্য ও নিচ, আর তার পিতাও নিচ, অসভ্য ও জঘন্য –কেবল তখনই কিয়ামত কায়েম হবে।
ধর্মের প্রভাব এমনভাবে বিলীন হয়ে যাবে যে, আরব উপদ্বীপে আবার মূর্তি পূজার প্রচলন হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী***************************************************************************************)
দাওস গোত্রের নারীরা যতক্ষণ যুল-খালাসার চারদিকে প্রদক্ষিণ না করবে ততক্ষণ কিয়ামত হবে না।
যুল-খালাসা নামে আরবে একটি মূর্তি ছিল। জাহিলী যুগের লোকেরা এর পূজা করত।
মানুষ দুনিয়ায় সুখ-শান্তি, ভোগ-বিলাস ও অর্থসম্পদের প্রতি এমনভাবে ঝুঁকে পড়বে যে, বৈধ-অবৈধ যেকোন উপায়ে তা হস্তগত করার চেষ্টা করবে। নিজেদের মর্যাদা, মনুষ্যত্ব ও সম্ভ্রমকেও এর জন্য বিকিয়ে দেবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী***********************************************************************************)
কিয়ামতের পূর্বে অন্ধকার রাতের টুকরার মত বিপর্যয় দেখা দেবে। সকাল বেলা যে ব্যক্তি মুমিন ছিল সন্ধ্যেবেলা সে কাফের হয়ে যাবে। আবার সন্ধ্যে বেলা যে ব্যক্তি মুমিন ছিল সকাল বেলা সে কাফের হয়ে যাবে। দলে দলে লোকেরা দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে নিজেদের দীনকে বিক্রি করে দেবে।
মানুষের স্বভাব-চরিত্র চরম নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। ওয়াদা চুক্তি প্রকাশ্যভাবে পদদলিত হবে। ফলে গোটা পৃথিবী বিশৃঙ্খলা, অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতায় ছেয়ে যাবে। সর্বত্র যুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী*********************************************************************************)
কিয়ামত কায়েম হবে না যতক্ষণ সূত্র ‘হারাজ’ ছড়িয়ে না পড়বে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হারাজ’ বলতে কি বোঝায়? নবী করীম (সঃ) বললেনঃ খুনখারাবি, যুদ্ধবিগ্রহ।
মানুষের বয়সের সীমার মধ্যে কোন বরকত থাকবে না, বয়স যত দীর্ঘই হোক না কেন কিভাবে যে তা শেষ হয়ে যাবে টেরও পাওয়া যাবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী***********************************************************************************)
কিয়ামত কায়েম হবে না –যতক্ষণ না যুগের দৈর্ঘ্য সংকুচিত হবে, বৎসর মাসের সমান হয়ে যাবে, মাস সপ্তাহের সমান, সপ্তাহ এক দিনের সামন, দিন ঘণ্টার সমান এবং ঘণ্টার পরিমান অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সামন হয়ে যাবে।
এভাবে অসংখ্য হাদীস থেকে জানা যায়, কিয়ামত তখনই আসবে যখন যমীনের বুকে ভাল মানুষের অস্তিত্ব থাকবে না এবং সর্বত্র পাপাচার ছড়িয়ে পড়বে। অবশ্য কখনো কোন দুষ্কৃতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দেখেই কিয়ামত এসে গেছে, কিয়ামত এসে গেছে বলে চিৎকার করাও উচিত নয়। নিশ্চিতই কিয়ামত আসবে। এতে কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু এভাবে অপেক্ষা করা কোন ক্রমেই জায়েয নেই। সৃষ্টির সূচনা থেকেই যমীনের বুকে ঝগড়াঝাটি, ফিতনা-ফাসাদ, হত্যাকাণ্ড, যুদ্ধ-সংঘাত চলে আসছে। ভাল-মন্দের মধ্যে অহরহ সংঘাত চলছে। কখনো কল্যাণের জয় হচ্ছে, আবার কখনো অকল্যাণের জয় হচ্ছে। যদি কখনো কল্যাণের পরাজয় হয় তবে তার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ তায়ালা গোটা মানবজাতিকে ধ্বংস করে দেবেন।
আমাদের এতটুকুই বলা উচিত যে, এই পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী মানবতাকে অবকাশ দেওয়া হচ্ছে। যতদিন তার মধ্য থেকে এমন কোন সভ্যতা অথবা উম্মাত, অথবা জামাআতের আবির্ভাব হতে থাকবে –যারা হকের পথে অবিচল থাকবে এবং আল্লাহর প্রশংসা, আনুগত্য ও ইবাদতে মশগুল থাকবে, আবার কখনো কখনো এমনও হয়ে থাকে যে, কোন সামগ্রিক কল্যাণের খাতিরে সাময়িকভাবে অকল্যাণকে সহ্য করা হয়। অবশ্য যখন তাকওয়ার প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে, কোথাও হেদায়েতের সন্ধান পাওয়া যাবে না, গোটা মানবজাতি দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়বে, বংশ পরম্পরায এই রোগজীবাণু ছড়াতে থাকবে তখন মানবতার এই বিছানা উল্টিয়ে দেওয়া হবে এবং তাদেরকে আল্লাহর আদালতে হাযির করা হবে। সেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নেয়া হবে, প্রত্যেককেই ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী****************************************************************************************)
যমীনের বুকে এই যা কিছু রয়েছে তাকে আমরা যমীনের অলংকার বানিয়ে দিয়েছি, যেন এই লোকদের পরীক্ষা করতে পারি –তাদের মধ্যে উত্তম আমলকারী কারা। অবশেষে আমরা এই সবকিছু একটি প্রস্তরময় মরুভূমিতে পরিণত করে দেব।–সূরা কাহফঃ ৭, ৮
কিয়ামতের কতিপয় নিদর্শন
এই বিশ্বব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার পূর্বে কিয়ামতের কতিপয় বিশেষ নিদর্শন প্রকাশ পাবে। তার কয়েকটি আমরা সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করব। একটি নিদর্শন এই যে, হযরত ঈসা আলায়হিস-সালাম পুনর্বার পৃথিবীতে আগমন করবেন। এই বিশেষত্ব কেবল তাঁকেই দান করা হয়েছে, অন্য কোন নবীকে নয়। তাঁর পুনরাগমনের কারণ খুব সম্ভব এই যে, তাঁর সম্পর্কে যেসব ভিত্তিহীন কথা রচনা করা হয়েছে তা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, তাঁকে আল্লহার আসনে বসানো হয়েছে এবং তাঁর নামে অত্যন্ত শক্তিশালী কয়েকটি রাষ্ট্রও রয়েছে –খোদায়ীর এই বাতিল ধারণাকে প্রতিহত করার জন্য তিনি নিজেই পুনর্বার আগমন করবেন। খৃষ্টানদের এই কল্পকাহিনীর মূলোৎপাটন তিনি নিজেই করবেন। তাঁর আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত না জানি কত শতাব্দী অতিক্রান্ত হবে।
অপর একটি নিদর্শন হচ্ছে দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ। হবে তো সে কানা, কিন্তু বিপর্যয়ের অগ্রসেনা। তার বৈশিষ্ট্য থেকে জানা যায়, সে প্রকৃতিবিজ্ঞানে হবে অত্যন্ত দক্ষ। লোকদের অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে দেখাবে। সে হবে নিজের যুগের সামেরী এবং লোকদের উপর যাদুকরি প্রভাব বিস্তার করা তার জন্য হবে খুবই সহজ। তার আয়ত্তে এমন কিছু উপায়-উপকরণ থাকবে যা অপর কারো কাছে থাকবে না। এভাবে সে লোকদের নিজের দলে ভিড়াবে। সে হবে ইহুদী সম্প্রদায়ভুক্ত। সে নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম পূর্বে আমাদের তার ধোঁকায় না পড়ার জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন। সে জনপদের পর জনপদ চষে বেড়াবে এবং নিজের ইবাদত করার জন্য লোকদের আহবান করবে। অবশেষে হযরত ঈসা মসীহ আলায়হিস সালামের হাতে সে নিহত হবে।
অপর একটি নিদর্শন হচ্ছে –সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবে। সৌর ব্যবস্থাপনায় এই পরিবর্তন ভয়ংকর দুর্যোগেরই প্রতিধ্বনি। যে সূক্ষ্ম ও সুদৃঢ় ব্যবস্থাপনার অধীনে গ্রহ-নক্ষত্র সুশৃঙ্খলভাবে মহাবিশ্বে সাঁতার কাটছে –তা এখন আল্লাহর হুকুমে এলোমেলো হতে যাচ্ছে। এরপর গ্রহ-নক্ষত্র কক্ষচ্যুত হতে থাকবে, পাহাড় নিজ স্থান থেকে সরে যেতে থাকবে, এবং বনজঙ্গলের পশুপাখি এক জায়গায় সমবেত হতে থাকবে।
চতুর্থ একটি নিদর্শন হচ্ছে ‘দাব্বাতুল আরদ’ নামক প্রাণীর আবির্ভাব। আমার মতে, যেসব লোককে আল্লাহ তাআলা বুদ্ধি-বিবেক দান করেছেন, কিন্তু তারা নিজেদের প্রতিপালককে চিনেনি এবং জীবনভর তাঁর অধিকারসমূহ থেকে নির্লিপ্ত রয়েছে –দাব্বাতুল আরদ তাদের জন্য হবে হুঁশিয়ারী সংকেত। এই প্রাণীটি গাধা অথবা খচ্চরের বংশধরও হতে পারে। তা আবির্ভূত হয়ে তথাকথিত নেতাদের কপালে আঘাত করবে আর বলবে –আল্লাহকে চেনার মত জ্ঞানও কি তোদের দেওয়া হয়নি? তোদের সব জ্ঞান-বুদ্ধি কোথায় চলে গেছে? কুফর ও নাস্তিকতার এই শ্লোগান তারা কোথা থেকে নিয়ে এসেছিল? মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
আর যখন আমাদের কথা পূর্ণ হওয়ার সময় তাদের উপর এসে পৌঁছবে, তখন আমরা তাদের জন্য যমীন থেকে একটি পশু বের করব। তা তাদের সাথে কথা বলব। সে সাক্ষ্য দেবে, এই লোকেরা আমাদের আয়াতগুলোকে বিশ্বাস করত না।–সূরা নামলঃ ৮২
হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশ
অচিরেই আমরা এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে যাব এবং এই দুনিয়াও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। -তারপর? আমরা প্রথমেই বলতে চাই, আল্লাহ তাআলা মহান এবং মহিমামণ্ডিত। তাঁর মহিমার কোন সীমা নেই। তিনি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর রহস্য অনুধাবন করা জ্ঞানবুদ্ধির পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে আমাদের অস্তিত্বে এনেছেন এবং মূল্যবান জীবন দান করেছেন। আমরা যদি এ জীবনের মূল্য অনুধাবন করি এবং তাকে কাজে লাগাই তাহলে তা কতই না মঙ্গলজনক। যেসব লোক জীবনের এই সুযোগকে দুর্লভ সম্পদ মনে করেছে এবং নিজেদের চরিত্র ও আমল পরিশুদ্ধ করেছে –কেবল তারাই আল্লাহর মহিমামণ্ডিত ছায়াতলে আশ্রয় পাবে।
আল্লাহ তাআলা মহাপবিত্র। তিনি নিকৃষ্ট লোকদের নিজের ছায়ায় স্থান দেবেন না। তিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান। তিনি নির্বোধকে গ্রহণ করতে পারেন না। তিনি পবিত্র, তাঁর কাছে পবিত্রতাই গ্রহণযোগ্য। অপবিত্রতাকে তিনি চরম ঘৃণা করেন। নিচ স্বভাবের যেসব লোক কাদামাটির সাথে মিশে থাকে এবং এর জন্য জান দেয়, তারা কি করে আল্লাহর দরবারে উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পারে? মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী************************************************************************************)
যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা মনে করে অস্বীকার করেছে এবং এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে –তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ কখনো খোলা হবে না।–সূরা আরাফঃ ৪০
মানুষের একথা ভাল করে বুঝে নেয়া দরকার যে, তাকে এই দুনিয়ায় যে সংক্ষিপ্ত জীবন দান করা হয়েছে, একে যদি সে উন্নতি ও পূর্ণতা লাভের উপায় না বানায় –তাহলে তার ভবিষ্যত কখনো উজ্জ্বল হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা মুত্তাকী লোকদের জন্য যে বেহেশতের ওয়াদা করেছেন তাতে কোন দুষ্কৃতিকারীর প্রবেশাধিকার থাকতে পারে না। মানুষ যদি নিজেদের মধ্যে সৌন্দর্য ও পূর্ণতা সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে সেখানে তার কোন স্থান হতে পারে না। ইবলীস শয়তান তো প্রথমে বেহেশতেই বসবাস করত। কিন্তু সে অহংকার ও বিদ্রোহে লিপ্ত হল তখন তাকে সেখান থেকে বহিস্কার করে দেওয়া হল এবং আল্লাহ তাআলা তাকে বললেনঃ
(আরবী*****************************************************************************)
তুই এখান থেকে নিচে নেমে যা। এখঅনে অবস্থান করে অহংকার প্রদর্শনের কোন অধিকার তোর নেই। তুই বের হয়ে যা, তুই লাঞ্ছনা-অপমান ভোগকারীদেরই একজন।–সূরা আরাফঃ ১৩
হযরত আদ আলায়হিস সালাম যখন নিজের প্রতিপালকের অধিকার সম্পর্কে অমনোযোগী হলেন এবং তার মধ্যে তাকওয়া ও কল্যাণের অনুভূতি দুর্বল হয়ে পড়ল, তখন তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে বেহেশত থেকেবের করে দেওয়া হল। সাথে সাথে তাদের এবং তাদের বংশধরদের সতর্ক করে দেওয়া হল যে, বেহেশতে বসবাসের একটি পূর্ণাঙ্গ মানদণ্ড রয়েছে। যে ব্যক্তি এই মানদণ্ডে উৎরাত পারবে না সে এখানে বসবাস করার যোগ্য নয়।
অতএব যার মধ্যে শিরকের কদর্যতা রয়েছে এবং এই অবস্থায় তার মৃত্যু এসে গেলে তাকে বেহেশতের বাইরেই বাধা দেওয়া হবে। কদর্যতা নিয়ে কখনো প্রতিপালকের জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী**********************************************************)
মুমিন ব্যক্তিরা দোযখ থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে আসবে। বেহেশত ও দোযখের মাঝখানে অবস্থিত পুলের কাছে তাদের বাধা দেওয়া হবে।
দুনিয়াতে তারা একে অপরের উপর যে বাড়াবাড়ি ও জুলুম করেছে এখানে তার হিসাব নেয়া হবে। যখন তারা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে তখন তাদের জান্নাতে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে।–বুখারী-কিতাবুল রিকাক, মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খণ্ড
চিন্তার বিষয়, মুমিন লোকদেরও পরিশুদ্ধ করা হবে। সে দুনিয়াতে যে ত্রুটিবিচ্যুতি করেছে, জাহান্নামের আগুন তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পরিস্কার করে দেবে।
(আরবী************************************************************************************)
তাদের প্রত্যেকেই কি এই লোভ পোষন করে যে, তাকে নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে? কখনই নয়। আমরা যে জিনিস দিয়ে তাদের সৃষ্টি করেছি তা তারা নিজেরাই জানে।–সূরা মাআরিজঃ ৩৮, ৩৯
মানুষকে অপবিত্র পদার্থ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের আঁঠালো মাটি এবং মিশ্রিত বীর্য থেকে পয়দা করা হয়েছে। এই দুনিয়ায় তাদের একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা উন্নতির ধাপগুলো অতিক্রম করে রফীকে আলা হয়ে যেতে পারে। নিজেদের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যেই রয়েছে তাদের কল্যাণ। তারা নিজেদের মধ্য থেকে মলিনতা দূর করবে, নিজেদের স্বভাব উন্নত করবে এবং নিজেদের আত্মার পরিশুদ্ধি করবে। এভাবে তারা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে। যখন তাঁর প্রতিপালকের দূত তাকে নিয়ে যাবার জন্য আসবে তখন সে হবে নিম্নোক্ত আয়াতের দৃষ্টান্তঃ
(আরভী*****************************************************************************)
ফেরেশতাগণ যাদের রূহ এই অবস্থায় কবজ করে যে, তারা সম্পূর্ণ পবিত্র –তখন তারা বল, শান্তি বর্ষিত হোক তোমাদের উপর, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর তোমাদের আমলের বিনিময়ে।–সূরা নাহলঃ ৩২
আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক পাওয়া যাবে যাদের কার্যকলাপ থেকে সেই পচা মাটির দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে এবং তাদের চরিত্রে তার মলিনতা ও অন্ধকার লক্ষ্য করা যায়। তারা কখনো জান্নাতের অধিকারী হতে পারে না তারা যতই কল্পনার ডানা ব্সিতার করুক না কেন।
ইসলামের পরিস্কার বক্তব্য হচ্ছে –এই পৃথিবীতে যারা ভাল কাজ করবে তারাই আখেরাতে সফলকাম হবে এবং যারা খারাপ কাজ করবে তারা পীড়াদায়ক শাস্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে। কতিপয় লোক তাদের ভিত্তিহীন বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চায়, ‘আমলের সাথে পরিণতির কোন সম্পর্ক নেই’। অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে, তারা যেরূপ কাজ করছে সেরূপ প্রতিফল ভোগ করবে।
(আরবী************************************************************************************)
ফাসাদকারী লোকদের কাজকে আল্লাহ শুদ্ধ করে দেন না। আল্লাহ তাঁর ফরমান দ্বারা সত্যকে সত্য করে দেখিয়ে থাকেন, অপরাধীরা তা যতই অপন্দ করুক না কেন।–সূরা ইউনুসঃ ৮১-৮২
কিয়ামতের দিন যখন নাফরমান লোকেরা পরস্পরকে তিরস্কার করতে থাকবে, একদল অপর দলের কাঁধে সমস্ত দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিস্কৃতি লাভ করার চেষ্টা করবে, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের নিম্নোক্ত ঘোষণা শুনিয়ে দেবেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
আমার সামনে ঝগড়া করো না। আমি তোমাদের পূর্বাহ্নেই খারাপ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। আমার সামনে কথা পাল্টানো হয় না। আর আমি আমার বান্দাদের উপর জুলুমকারী নই।–সূরা কাফঃ ২৮-২৯
নেককার বান্দাদের সাথে আল্লাহ তাআলা যে ওয়াদা করেছেন তা অবশ্যই পূর্ণ হবে। তারা যেসব ভাল কাজ করে থাকবে তার পারিশ্রমিক প্রদানে সামান্যতম হেরফের করা হবে না।
(আরবী***********************************************************************************)
যেসব লোক ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের জন্য নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাত রয়েছে। তারা অনন্তকাল সেখানে থাকবে। এটা আল্লাহর পাক্কা ওয়াদা, তিনি মহাশক্তিশালী ও সুবিজ্ঞ।–সূরা লোকমানঃ ৮,৯
তথাকথিত একদল বুদ্ধিজীবী এ সম্পর্কিত আয়াতগুলো নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। তারা ভাল কাজের স্বাভাবিক পরিণতিকে খাটো করে দেখানোর অপপ্রয়াস চালায়। তারা ভাল কাজের শুভ দিক এবং খারাপ কাজের অশুভ দিকের গুরুত্বকে খাটো করে দিতে চায়। তারা নিজেদের এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য লোকদের বলে বেড়ায়, ‘পুরস্কার ও শাস্তির ব্যাপারটি আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল’ আমলের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। যদি তাই হয় তাহলে এটা অসম্ভব নয় যে, দুষ্কৃতিকারীরা ক্ষমা পেয়ে যাবে আর ভাল লোকেরা জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা যা ইচ্চা তাই করতে পারেন। কারণ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার মত কেহ নেই। এই ধরনের বক্তব্যের সাথে আল্লাহর দীনের কোন সম্পর্ক নেই।
এই নাপাক দর্শন উম্মাতের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতে, ইসলামী সমাজকে কলুষিত করতে এবং দীনের শিক্ষার মূল্য ও মর্যাদা খাটো করার ব্যাপারে বড়ই নিকৃষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। আল্লাহ তাআলা এই নাপাক দর্শনকে চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
(আরবী***********************************************************************************)
যেসব লোক পাপ কাজ করেছে তারা কি মনে করে নিয়েছে যে, আমরা তাদের ও ঈমানদার লোকদের একই সমান করে দেব এবং তাদের জীবন ও মৃত্যু একই রকম হয়ে যাবে? তারা যে ফয়সালা করেছে তা অত্যন্ত খারাপ।–সূরা জাসিয়াঃ ২১
(আরবী***************************************************************************************)
যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে, আর যারা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে তাদের সবাইকে আমরা কি সমান করে দেব? মুত্তাকী লোকদের কি আমরা নাফরমান লোকদের মত করে দেব? এ এক বরকতময় কিতাব যা আমরা তোমার উপর নাযিল করেছি –যেন এই লোকেরা তার আয়াতগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে এবং বুদ্ধিবিবেক সম্পন্ন লোকেরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।–সূরা সাদঃ ২৮, ২৯
বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা সহজেই অনুধাবন করতে পারে যে, আল্লাহর মর্জির অর্থ কি? তার অর্থ মোটেই এটা নয় যে, ঈমানদার ও খেয়ানতকারীদের এক সমান করে দেওয়া হবে। ক্ষমা ও উদারতার অর্থ এই নয় যে, গোটা শরীআত বাতিল হয়ে যাবে এবং আইন-কানুন অকেজো হয়ে থাকবে।
ইমামুল আম্বিয়ার শাফাআত
গুনাহগারদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের শাফাআত সম্পর্কিত কতিপয় হাদীস সর্বসাধারণের মধ্যে বহুল পরিচিত। এসব হাদীসের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে সৃষ্ট ধারণা এই যে, প্রতিদানের যাবতীয় বিধি-বিধান বাতিল হয়ে গেছে। আখেরাতে দোযখের আগুন গুনাহগার মুসলমানদের জন্য ফুল বাগানে পরিণত হবে। এই জাহিলরা বেপরোয়াভাবে ফরযসমূহ উপেক্ষা করে এবং দুঃসাহসের সাথে মারাত্মক অপরাধে লিপ্ত হয় আর বলে, উম্মাতে মুহাম্মদিয়ার জন্য চিন্তার কোন কারণ নেই। এটা সম্পূর্ণ অবৈধ ও নিকৃষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম আজ যদি জীবিত থাকতেন তাহলে তিনিই সর্বপ্রথম এর বিরুদ্ধে ঘৃণা ও অসন্তোষ প্রকাশ করতেন, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতেন এবং তাদের জাহান্নামী ঘোষণা করতেন।
প্রতিদানের ব্যাপারটিও অবশ্যম্ভাবী। অণু পরিমাণ ভাল অথবা খারাপ কাজ থাকলেও তার হিসাব নেওয়া হবে এবং প্রতিফল দান করা হবে। সমস্ত লোককে এই স্তর অতিক্রম করতে হবে। পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণাঃ
(আরবী***************************************************************************************)
যে ব্যক্তি বিন্দু পরিমাণও নেক আমল করে থাকবে সে তা দেখতে পাবে। আর যে ব্যক্তি বিন্দু পরিমাণও খারাপ কাজ করে থাকবে, সেও তা দেখতে পাবে।–সূরা যিলযালঃ ৭, ৮
কোন এক নবীর অনুসারীদের ক্ষেত্রে শাস্তি ও পুরস্কারের বিধান পরিত্যক্ত হবে এরূপ ধারণা করাটা চরম আহাম্মকি ছাড়া আর কিছুই নয়। পূর্ববর্তী কোন কোন জাতিও এ ধরনের ভিত্তিহীন আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল। কুরআন মজীদ একাধিক স্থানে তার প্রতিবাদ করেছে। শাফাআত সম্পর্কে যেসব সহীহ হাদীস রয়েছে তা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু সেগুলোর ভ্রান্ত প্রয়োগের আমরা চরম বিরোধী। আমরা সেগুলোকে তার সঠিক স্থানে রাখতে চাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
প্রত্যেক নবীর জন্য একটি বিশেষ দোয়া রয়েছে যা অবশ্যই কবুল হয়। আমি আমার দোয়াকে উম্মাতের শাফাআতের জন্য সংরক্ষিত রেখেছি। ইনশাআল্লাহ তোমাদের মধ্যে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই তার সুফল পাবে, যে আল্লাহর সাথে কোন কিচু শরীক না করা অবস্থায় মারা গেছে।–বুখারী, মুসলিম
এ হাদীসের তাৎপর্য কি? যেকোন ব্যক্তি অশ্লীল কাজে লিপ্ত রয়েছে, কিন্তু আল্লাহর সাথে শরীক না করা অবস্থায় মারা গেছে –সে-ই কি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-র এই শাফাআত লাভের অধিকারী হয়ে যাবে? সে যে অপরাধ করেছে তা থেকে এমনি ছাড়া পেয়ে যাবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম পরিস্কার ভাষায় এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী প্রত্যাখ্যান করেছেন। সহীহ বুখারীর এক হাদীসে হাশরের মাঠের ভয়ংকর অবস্থা এবং দোযখবাসীদের মর্মান্তির পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
দোযখের উপরে একটি পুল স্থাপন করা হবে। আমিই হব প্রথম ব্যক্তি যে তাঁর উম্মাতদের নিয়ে তা অতিক্রম করবে। এই দিন নবীদের ছাড়া আর কারো কথা বলার দুঃসাহস হবে না। সেদিন নবীদের কথা হবে, “হে আল্লাহ শান্তি দাও, শান্তি দাও”। জাহান্নামে সাদান বৃক্ষের কাঁটার অনুরূপ আংটা বিছানো থাকবে। তোমরা কি সাদানের কাঁটা দেখেছ? সাহাবীগণ বলেন, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ সেগুলো সাদানের কাঁটার মতই হবে। আল্লাহ তাআলাই জানেন তা কত লম্বা হবে। মানুষের আমল অনুযায়ী তা তাদের শরীরে বিদ্ধ হতে থাকবে। কিছু লোক নিজেদের আমলের কারণে ধ্বংস হবে, আর কিছু লোকের দেহ নিষ্পেষিত হবে, কিন্তু মুক্তি পেয়ে যাবে। অতঃপর জাহান্নামের কিছু সংখ্যক লোকের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করার ইচ্ছা করবেন। তিনি ফেরেশতাদের নির্দেশ দেবেন, যেসব লোক আল্লাহর ইবাদত করত তাদের বের করে নিয়ে এস। তারা তাদের বের করে নিয়ে আসবে। কপালে সিজদার চিহ্ন দেখেই তারা তাদের বের করে নিয়ে আসবে। কপালে সিজদার চিহ্ন দেখেই তারা তাদের চিনতে পারবে। আল্লাহ তাআলা সিজদার অংগকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেবেন। অতএব তাদেরকে দোযখ থেকে কের করে আনা হবে। আগুন প্রতিটি আদম সন্তানকে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেবে, কিন্তু সিজদার স্থান অক্ষত থাকবে। তারা দগ্ধীভূত অবস্থায় দোযখ থেকে বেরিয়ে আসবে। তাদের উপর আবেহায়াত ঢেলে দেওয়া হবে। তখন তারা নতুনভাবে গজিয়ে উঠবে, যেভাবে বন্যার পানি চলে যাবার পর চারা গাছ জন্মায়।
এ হাদীস থেকে জানা যায়, এমন অনেক মুসলমান হবে যারা প্রকাশ্যত আল্লাহর ইবাদত করেছে এবং শিরক থেকে বেঁচে থেকেছে, কিন্তু অন্য কোন পাপের কারণে জাহান্নামী হয়ে গেছে। আগুনের লেলিহান শিখা তাদের এমনভাবে ঝলসিয়ে দেবে যে, কেবল সিজদার চিহ্ন দেখেই তাদের চেনা যাবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে তারা এই কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। অতঃপর তাদের পূর্বেখার মলিনতা জীবন সঞ্জীবনী পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হবে। তখন তারা একটি নবতর সৃষ্টিতে পরিণত হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ও বেহেশতের নিয়ামত ভোগ করার উপযোগী হয়ে যাবে।
এ আলোচনা থেকে জানা গেল, শাফাআতের ক্ষেত্র এতটা বিস্তৃত নয়, যতটা আমরা ধারণা করে নিয়েছি। আর এই ভিত্তিহীন ধারণার বশবর্তী হয়ে আমরা নির্দ্বিধায় পাপ কাজ করে যাচ্ছি। নিছক আশা-আকাঙ্ক্ষায় কিছুই হয় না। আল্লাহ তাআলা পরিস্কার বলে দিয়েছেন, কোন কাফের অথবা ফাসেক ব্যক্তি শাফাআতের দ্বারা লাভবান হতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
তোমরাসেই দিনটির ভয় কর, যখন কেউ কারো এক বিন্দু উপকারে আসবে না, কারো কাছ থেকে কোনরূপ বিনিময় গ্রহণ করা হবে না, কারো সুপারিশও উপকারে আসবে না এবং কোন দিক থেকেও পাপীদের কিছুমাত্র সাহায্য করা হবে না।–সূরা বাকারাঃ ১২৩
কোন বোঝা বহনকারী অপর কারো বোঝা বহন করবে না। কোন বোঝা বহনকারী যদি নিজের বোঝা বহনের জন্য অপর কাউকে ডাকে, তবে তার বোঝার সামান্য অংশও বহন করতে সে এগিয়ে আসবে না –সে নিকটাত্মীয় হলেও।–সূরা ফাতিরঃ ১৮
অপরাধীর নিজের অপরাধের বোঝা তাকেই বহন করতে হবে। কোন ব্যক্তি যতই নামায-রোযা করুক না কেন, নিজের গুনাহের প্রতিশোধ থেকে বাঁচতে পারবে না। পুলসিরাত সম্পর্কিত হাদীস এই সত্যকেই তুলে ধরেছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে যে শাফাআত লাভের আশা করা যায় তা এই যে, তা কেবল এমন ব্যক্তিরা লাভ করবে যাদের পাপ-পুণ্যের দাঁড়ি-পাল্লায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে। কখনো হকের পাল্লা সামান্য ভারী দেখা যাবে আবার কখনো বাতিলের পাল্লা ভারী দেখা যাবে। তারা সফলতা ও ব্যর্থতার প্রান্তদেশে অবস্থান করবে।
আমাদের পার্থিব জীবনেও এরূপ হয়ে থাকে। যেমন কোন ছাত্র সামান্য দুই-এক নম্বরের জন্য অকৃতকার্য হতে যাচ্ছে। তখন তার সাথে সহানুভূতিসুলভ আচরণ করা হয়। তাকে এক-দুই নম্বর দিয়ে পাস করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যাদের নম্বর অনেক কম থাকে, আমরা তাদের ফেল করিয়ে দেই। তাদের ব্যাপারে কোন সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হয় না। হাদীসসমূহে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের শাফাআত সম্পর্কে যে উল্লেখ রয়েছে –আমরা মনে করি তা কেবল এমন লোকেরাই লাভ করবে, যারা মুক্তির প্রান্তসীমায় অবস্থা করবে। যদি শাফাআতের ব্যাপারে পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে শাফাআত সম্পর্কিত কুরআনের সমস্ত আয়াত এবং হাদীসসমূহের মধ্যে কোন বিরোধ অবশিষ্ট থাকে না।
এই শাফাআতের একটি উদ্দেশ্য এত্ত হতে পারে যে, আল্লাহ তাআলার দরবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের যে উচ্চ মর্যাদা ও নৈকট্য রয়েছে –শাফাআতের মাধ্যমে তার অধিক চর্চা হবে। এই পার্থিব জগতে যেমন স্বাধীণতা দিবস, জাতীয় দিবস, রাসূলের জন্মদিবস প্রভৃতি বিশেষ দিনগুলোতে দীর্ঘ কারাদণ্ড ভোগকারী কয়েদীদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে কিছুকাল পূর্বে রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়ে থাকে –শাফাআতের দৃষ্টান্তও তদ্রূপ।
সাধারণ ক্ষমার আওতায়ও রেহাই দেওয়া হয়। এতে নির্ধারিত শাস্তির উপর কোন প্রভাব পড়ে না। তার অর্থ কেউ এটা মনে করে না যে, এখন আইন প্রণয়ন করা, বিচার ব্যবস্থা কায়েম করা এবং বিচারক নিয়োগ করার কোন প্রয়োজন নেই। সাধারণ মুসলমানরা শাফাআত সম্পর্কিত হাদীসের অনেকটা এরূপ অর্থ বের করতেই ব্যস্ত।
এসব হাদীস থেকে আরও জানা যায় আগে-পিছের সব উম্মাতের অনেক লোক হাশরের ময়দানের প্রচণ্ড উত্তাপে অস্থির হয়ে পড়বে। গুনাহগার লোকেরা দোযখের আগুনে দগ্ধীভূত হতে থাকবে। তারা আল্লাহর কাছে আহাজারি করতে থাকবে তার অসন্তোষ থেকে রেহাই পাবার জন্য। তারা নবীদের কাছে গিয়ে তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার অনুরেধ করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রতিপালকের দরবারে গিয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়বেন এবং তাদের ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে সবিনয় নিবেদন জানাবেন। এ সময় আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীর দোয়া কবুল করবেন।
একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাআলার দরবারে কোন ব্যক্তির মর্যাদা যত উচ্চই হোক না কেন, সে তাঁর কাছে কেবল বিনয়ের সাথে দোয়া করতে পারে। অন্যথায় কোন নবীর পক্ষেও স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া অথবা কোন কথা জোরপূর্বক মানিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
আর আল্লাহর দরবারে কোন সুপারিশও কারো জন্য কল্যাণকর হতে পারে না, সেই ব্যক্তি ছাড়া যার জন্য আল্লাহ সুপারিশ করার অনুমতি দিয়েছেন। এমনকি যখন লোকদের মন থেকে ভয়ভীতি দূর হয়ে যাবে তখন তারা (সুপারিশকারীদের) জিজ্ঞেস করবে, তোমাদের প্রতিপালক কি জবাব দিয়েছেন? তারা বলবে, সঠিক জবাবই পাওয়া গেছে। তিনি তো অতীব মহান ও শ্রেষ্ঠ।–সূরা সাবাঃ ২৩
(আরবী*********************************************************************************)
সেদিন রূহ (জিবরাঈল) এবং ফেরেশতারা কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়াবে কেউই সাড়াশব্দ করবে না। অবশ্য দয়াময় রহমান যাকে অনুমতি দেবেন কেবল সে-ই যথাযথ কথা বলবে।–সূরা নাবাঃ ৩৮
এ আয়াত থেকে জানা গেল, সেখানে বিনা অনুমতিতে কেউ কথা বলতে পারবে না এবং যাকে অনুমতি দেওয়া হবে তাকে সঠিক ও যথার্থ কথাই বলতে হবে। সেদিন সমস্ত কর্তৃত্ব এককভাবে আল্লাহর হাতেই থাকবে। অতএব যেসব লোক শাফাআতের কাল্পনিক আশার উপর ভরসা করে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে, তারা যেন দোযখীদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী শুনে রাখেঃ
(আরবী***************************************************************************)*******)
কোন জিনিসটি তোমাদের জাহান্নামে নিয়ে গেছে? তারা বলবে, আমরা নামাযী লোকদের মধ্যে শামিল ছিলাম না। মিসকীনদের খাবার দিতাম না। উদ্ভট কথা রচনাকারীদের সাথে মিলিত হয়ে ভিত্তিহীন কথা রচনা করতাম। প্রতিফল লাভের দিনকে মিথ্যা মনে করতাম। শেষ পর্যন্ত সেই প্রত্যয়মূলক জিনিসটি আমাদের সামনে এসে গেছে। এ সময় সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন উপকারে আসবে না।–সূরা মুদ্দাসসিরঃ ৪২-৪৮
এই জরুরী অবতণিকার পর আমরা মহান শাফাআত সম্পর্কিত হাদীস উল্লেখ করব। আমরা আশা করি পাঠকগণ বাড়াবাড়ির নীতি অবলম্বন করা থেকে বিরত থাকবেন এবং এ হাদীসকে সঠিক স্থানে রাখার চেষ্টা করবেন। হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা সব লোককে একত্র করবেন। এ সময় তারা একেবারেই নির্জীব এবং অস্থির থাকবে। তারা বলবে, আমরা যদি এক ব্যক্তিকে আমাদের জন্য শাফাআতকারী বানিয়ে আল্লাহর দরবারে পেশ করতাম যেন তিনি আমাদের এ স্থান থেকে মুক্তি দেন। অতএব তারা হযরত আদম আলায়হিস সালামের কাছে এসে বলবে, আপনি আদম (আঃ), গোটা মানবজাতির পিতা। আল্লাহ তাআলা নিজ হাতে আপনাকে সৃষ্টি করেছেন এবং বেহেশতের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। তিনি ফেরেশতাদের দ্বারা আপনাকে সিজদা করিয়েছেন এবং প্রতিটি জিনিসের নাম আপনাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। আপনি আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে সুপারিশ করুন –যাতে তিনি আমাদের এ বিপদ থেকে মুক্তি দেন। আদম (আঃ) বলবেন, আমি এ কাজের যোগ্য নই। এ সময় তাঁর নিজের অপরাধের কথা মনে পড়ে যাবে এবং তিনি তাঁর রবের কাছে যেতে লজ্জাবোধ করবেন। তিনি বলবেন, বরং তোমরা নূহের কাছে যাও। আল্লাহ তাআলা তাঁকে প্রথম রাসূল করে দুনিয়ার মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন।
অতএব তারা নূহ আলায়হিস সালামের কাছে চলে আসবে। তিনি বলবেন, আমি এ কাজের উপযুক্ত নই। তাঁরও নিজের কৃত অপরাধের কথা মনে পড়ে যাবে এবং তিনি আল্লাহর কাছে যেতে লজ্জাবোধ করবেন। তিনি বলবেন, বরং তোমরা ইবরাহীমের কাছে যাও। আল্লাহ তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
অতঃপর তারা ইবরাহীম আলায়হিস সালামের কাছে চলে আসবে। এ সময় তিনিও নিজের অপরাধের কথা স্মরণ করে আল্লাহর কাছে লজ্জাবোধ করবেন। তিনি বলবেন, আমি এ কাজের যোগ্য নই, বরং তোমরা মূসার কাছে যাও। আল্লাহ তাআলা তাঁর সাথে সরাসরি কথা বলেছেন এবং তাঁকে তাওরাত কিতাব দান করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, অতএব তারা মূসা আলায়হিস সালামের কাছে চলে আসবে। তিনিও নিজের একটি অপরাধের কথা স্মরণ করে আল্লাহর কাছে যেতে লজ্জাবোধ করবেণ। তিনি বলবেন, আমি তোমাদের এ কাজের যোগ্য নই, বরং তোমরা আল্লাহর রূহ ও তাঁর কলেমা ঈসার কাছে যাও।
অতঃপর তারা ঈসা রূহুল্লাহর কাছে চলে আসবে। তিনি বলবেন, আমি তোমাদের এ কাজের যোগ্য নই, বরং তোমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের কাছে চলে যাও। আল্লাহ তাআলা তাঁর পূর্বাপর সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন।
রাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ অতএব তারা আমার কাছে চলে আসবে। আমি আমার প্রতিপালকের কাছে যাওয়ার অনুমতি চাব। আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে। আমি যখন তাঁকে দেখতে পাব, অমনিই সিজদায় পড়ে যাব। আল্লাহ যতক্ষণ চাইবেন আমি এই অবস্থায় পড়ে থাকব। অতঃপর বলা হবে, হে মুহাম্মদ! তোমার মাথা তোল। তুমি যা বলবে শুনা হবে, যা চাবে দেওয়া হবে এবং সুপারিশ করলে গ্রহণ করা হবে। অতঃপর আমি আমার মাথা তুলব এবং আমার প্রভুর প্রশংসা করব এমন বাক্যে যা তিনি আমাকে তখন শিখিয়ে দেবেন। অতঃপর আমি শাফাআত করব। এ ব্যাপারে আমার জন্য একটা সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। আমি তাদের দোযখ থেকে বের করে এনে বেহেশতে প্রবেশ করিয়ে দেব।
আমি পুনরায় ফিরে এসে সিজদায় পড়ে যাব এবং আল্লাহ যতক্ষণ চাইবেন এই অবস্থায় পড়ে থাকব। অতঃর আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মদ! তোমার মাথা উঠাও। যা বলবে তা শুনা হবে, যা চাইবে তা দেওয়া হবে, সুপারিশ করলে তা গ্রহণ করা হবে। অতঃপর আমি মাথা তুলব এবং আমার প্রভুর প্রশংসা করব এমন বাক্যে যা তিনি তখন আমাকে শিখিয়ে দেবেন। অতঃপর আমি শাফাআত করব। এ ব্যাপারে আমাকে একটি সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। আমি তাদের দোযখ থেকে বের করে এনে বেহেশতে প্রবেশ করাব।
রাবীবলেন, আমার সঠিক মনে নেই, তিনি তৃতীয় বারে অথবা চতুর্থ বারে বলেছেনঃ আমি বলব, হে প্রভু! দোযখে কেবল সেই লোকেরাই রয়ে গেছে যাদেরকে কুরআন প্রতিরোধ করে রেখেছে (অর্থাৎ চিরকালের জন্য জাহান্নামী সাব্যস্ত হয়েছে)।
আল্লাহর দীনের অনুসারীদের এ কথা ভালভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন যে, আল্লাহ হিসাব-নিকাশ থেকে অণু পরিমাণ ভাল অথবা মন্দ বাদ থেকে যাবে না! এখানে কোন বিশৃঙ্খলা নেই। এখানে অনুমানের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। প্রতিটি আমলের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব হবে এবং তদনুযায়ী প্রতিদান দেওয়া হবে।
ইতিপূর্বে ইহুদী জাতির মধ্যে এই অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গী সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের সাধারণ আকীদা ছিল, তাদের গোটা জাতির জন্য বেহেশত রেজিষ্ট্রিকৃত হয়ে গেছে। অতএব তারা দুনিয়ার ভোগ-লালসায় নিমজ্জিত হয়ে থাকত এবং তৃপ্তির সাথে বলত, আমাদের আবার চিন্তা কিসের? এই মনগড়া মতবাদের কঠোর প্রতিবাদ করেছে।
(আরবী**************************************************************************************)
কিন্তু তাদের পরে এমন সব অযোগ্য লোক তাদের স্থলাভিষিক্ত হয় যারা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়ে এই দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলে ব্যাপৃত থাকে আর বলেঃ অচিরেই আমাদের মাফ করে দেওয়া হবে। সেই বৈষয়িক স্বার্থই আবার যদি তাদের সামনে এসে পড়ে, তাহলে অমনি টপ করে তা হস্তগত করে। তাদের কাছ থেকে কিতাবের প্রতিশ্রুতি কি পূর্বে গ্রহণ করা হয়নি যে, আল্লাহর নামে তারা কেবল সেই কথাই বলবে যে সত্য? আর কিতাবে যা কিছু লেখা রয়েছে –তা তারা নিজেরাই পড়েছে। আখেলাতের বাসস্থান কেবল আল্লাহভীরু লোকদের জন্যই কল্যাণকর হবে। এতটুকু কথাও কি তোমরা বুঝতে পার না? –সূরা আরাফঃ ১৬৯
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজ মুসলমানদেকেও এই ইহুদী মানসিকতা গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে তারা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং নিজেদের দীনেরও ক্ষতি সাধন করেছে। শুধু তাই নয়, মুসলমানদের পথভ্রষ্টতা, অজ্ঞতা ও পতাকাবাহীদের প্রতি আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। মুসলমানদের জন্য আফসোস! তারা সর্বথা আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করে এবং তারপরও এ ধরনের গোমরাহীর শিকারে পরিণত হয়।
(আরবী***********************************************************************************)
শেষ পরিণতি তোমাদের আকাঙ্ক্ষার উপরও নির্ভরশীল নয় এবং আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের আকাঙ্ক্ষার উপরও নির্ভরশীল নয়। যে ব্যক্তি পাপ করবে, তার প্রতিফল সে-ই ভোগ করবে এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে নিজের জন্য কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী পাবে না।–সূরা নিসাঃ১২৩
প্রতিদান সত্য ও নিশ্চিত। কুরআন মজীদ বারবার একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে এবং বিভিন্ন ভঙ্গীতে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। কেননা অধিকাংশ লোক সামনের জিনিসের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং পেছনের জিনিস থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। দুনিয়ার নগদ প্রাপ্তির জন্য সে জান দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু আখেরাতের ওয়াদা সম্পর্কে অমনোযোগী বরং কখনো কখনো তা অস্বীকারই করে বসে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এ ব্যাপারে সে মোটেই পরোয়া করে না যে, সেই দিনটি হবে কত ভয়ংকর।
তারা যদি নিজেদের বুদ্ধি-বিবেক কাজে লাগাত তাহলে এটা অনুধাবন করাতাদের পক্ষে মোটেই কঠিন ছিল না যে, আখেরাতের জীবনই আসল জীবন। এই জীবনে সফলতা লাভ করার জন্যই প্রতিটি বিবেকবান মানুসের চেষ্টা করা উচিত। এই জীবনে আমাদের এমন ফলের বাগান করা উচিত যার ফল এখানে ভোগ করতে না পারলেও আখেরাতে অবশ্যই ভোগ করা যাবে। আমরা যেসব কাজ করি ফলাফলের দিক থেকে তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জীবনকাল শেষ হয়ে গেলে আমরা এই দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যাব। আমরা এখানে যেভাবে খালি হাতে এসেছি ঠিক সেভাবেই খালি হাতে ফিরে যাব। দুনিয়ার সহায়-সম্পদ আমাদের পেছনেই পড়ে থাকবে। আমরা যদি কোন ভাল কাজ করতে পারি তাহলে সেটাই হবে আমাদের পরকালের পাথেয়।
আখেরাতের জীবন সম্পর্কে মানুষের মনে যদি বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যায় তাহলে সে নিজের এ জীবনকে অযথা নষ্ট করবে না। যে অবকাশ সে পেয়েছে তা থেকে পূর্ণ ফায়দা হাসিল করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
দুনিয়া পেছনে সরে যাচ্ছে এবং আখেরাত সামনে এগিয়ে আসছে। এদের উভয়েরই কিছু সন্তান (পূজারী) আছে। অতএব তুমি আগত দুনিয়ার সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং বিগত দুনিয়ার সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত হও না। কেননা আজ কাজের সুযোগ আছে, আজ তার হিসাব হচ্ছেনা। কিন্তু কাল হিসাব হবে, কাজের সুযোগ আছে, আজ তার হিসাব হচ্ছে না। কিন্তু কাল হিসাব হবে, কাজের সুযোগ থাকবে না।–বুখারী, কিতাবুর-রিকাক
আখেরাত অস্বীকারকারীদের নির্বোধসুলভ দাবি
প্রাচীনকাল থেকে একদল লোকের ধারণা হচ্ছে –তারা এই জীবনের ঘানির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থাকে। চাবুক তাকে যেদিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় সে সেদিকেই ধাবিত হয়। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়ে চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলে। অতঃপর সে মরে যায় অথবা বন্দুকের গুলীর আঘাতে উড়িয়ে দেওয়া হয় …….এরপর আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তারা বলে, মায়ের জরায়ু আমাদের বাইরে নিক্ষেপ করেছে, আমার মাটি তার অভ্যন্তরে আমাদের লুকিয়ে ফেলবে। কালের প্রবাহের সাথেই আমাদের জীবন-মৃত্যুর সংযোগ। এই তো শেষ।
এসব লোক ঈমানদার লোকদের উত্যক্ত করে এবং তাদের নিস্ফল বিতর্কে জড়াতে চেষ্টা করে। তারা শপথ করে নিজেদের মতবাদকে শক্তিশালী করতে চায়। আবার তারা এমন জিনিসের শপথ করে যার উপর তাদের ঈমান নেই।
(আরবী***************************************************************************************)
এই লোকেরা আল্লাহর নামে কঠিন শপথ করে বলে, আল্লাহ কোন মৃতকে পুনরায় জীবিত করে উঠাবেন না। কেন উঠাবেন না? এতো একটি ওয়াদা যা পূরণ করা তিনি নিজের উপর আবশ্যকীয় করে নিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানে না। আর এরূপ হওয়া এজন্য জরুরী যে, আল্লাহ এদের সামনে সেই মহাসত্যকে প্রকাশ করে দেবেন –যে সম্পর্কে তারা মতভেদ করছে। আর কাফিররা জানতে পারবে যে, তারা মিথ্যাবাদী ছিল। কোন জিনিসকে অস্তিত্ব দান করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, আমরা তাকে হুকুম দেব, হয়ে যাও, আর অমনি তা হয়ে যাবে।–সূরা নাহলঃ ৩৮-৪
যে ব্যক্তি আখেরাতের উপর ঈমান রাখে তার জীবনে কি সৌন্দর্য ফুটে উঠে এবং একজন নাস্তিকের জীবনে কি কি ধ্বংসকারিতা দেখা দেয়? এ সম্পর্কে আল-মাআররীর নিম্নোক্ত কবিতা উল্লেখযোগ্যঃ
বলল দুজনে তারা চিকিৎসক আর জ্যোতির্বিদঃ
মৃতদেহ জীবিত হবে না পুনর্বার,
আমি বললামঃ থামো থামো,
তোমাদের দুজনের কথা সত্য হয় যদি
আমার ক্ষতি নেই তাতে
আর যদি আমি হই সত্যবাদী
তাহলে তোমরাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
আমি নামাযের জন্য কাপড় পবিত্র রেখেছি
আর এমনিও থেকেছে পবিত্র কিন্তু তোমাদের শরীর পবিত্র রাখার বালাই নেই,
আমি প্রভুকে স্মরণ করেছি।
এভাবে আমার হৃদয়ে ভরে রাখ বিভ্রান্তি অশান্তি
আর আমি থাকি সকাল সাঁঝে
আমার প্রভুর রহমাতের অভিলাষী
কিন্তু তোমাদের সকাল-সন্ধ্যায় গড্ডালিকা
প্রবাহ চলে।
আমি যা কিছু করি
তাতে যদি কিছুই না পেয়ে থাকি
তোমরাও কি পেয়েছ কিছু?
তাকওয়ার চাদর
যদিও তার দুর্বল বুনন
আল্লাহ জানেন তোমাদের দু’জনের চাদরের চেয়ে ভাল।
আল-মাআররীর এই কবিতায় বিষয়বস্তুর একটি দিকই সামনে এসেছে। নিঃসন্দেহে আল্লাহর দীন হৃদয়কে রোগমুক্ত রাখে, মান-সম্ভ্রমে কোনরূপ আঘাত লাগতে দেয় না। সে দেহকেও নানাবিধ রোগ থেকে নিরাপদ রাখে –যা কুপ্রবৃত্তি ও আবেগ উত্তেজনার ফলে সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই উত্তম ফলাফলই তার চূড়ান্ত দলিল হতে পারে না। মনে হচ্ছে আল-মাআররী নির্বোধকে বক্র বিতর্কের মূলোচ্ছেদ করার জন্য শুধু ঐ জিনিসগুলোর উল্লেখ করেছেন।
হাদীসের বর্ণনা থেকে জানা যায় আখেরাত অবিশ্বাসকারীদেরই একন একটি বিগলিত হাড় নিয়ে রাসূলুল্লাহ আলাইহে ওয়াসাল্লামের কাছে হাযির হল এবং তা তাঁর সামনে রাখল। সে মনে করছিল, সে এই হাড় তাঁকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবে –এই হাড় কেমন করে একটি মানুষে পরিণত হতে পারে?
(আরবী********************************************************************)
সে আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত পেশ করে এবং নিজের সৃষ্টির ব্যাপারে ভুলে যায়।–সূরা ইয়াসীনঃ ৭৮
সে নিজের ব্যাপারটি ভুলে গেছে –এটা একটি প্রাসঙ্গিক বাক্য। এ যেন সেই প্রশ্নকারীর গালে এক কঠিন চপেটাঘাত –যে আখেরাতকে অসম্ভব এবং আল্লাহর কুদরতের সীমা বহির্ভূত মনে করে। এই বাক্য তাকে এমন স্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে, যেখান থেকে সে জোরপূর্বক সামনে অগ্রসর হতে চেষ্টা করে।
(আরবী*********************************************************************************)
সে বলে, কে এই অস্থিগুলোকে জীবন্ত করবে, অথচ তা জরাজীর্ণ হয়ে গেছে? বল, এগুলো তিনিই জীবিত করবেন, যিনি প্রথমবার তা সৃষ্টি করেছেন। তিনি তো সৃষ্টির সব কাজই জানেন…….। যিনি আকাশসমূহ এবং যমীন সৃষ্টি করেছেন, তিনি সুদক্ষ সৃষ্টিকর্তা।–সূরা ইয়াসীনঃ ৭৮, ৭৯, ৮১
নিঃসন্দেহে যিনি সৃষ্টি করতে পারেন, সুন্দর কাঠামো দান করতে পারেন, তিনি পুনর্বার তাকে জীবনও দান করতে পারেন। মৃত্যুর পর পুনর্জীবন সম্পর্কে যেসব প্রমাণ পেশ করা হয়েছে তার মধ্যে বাস্তব ও স্বীকৃত সত্যকেই তুলে ধরা হয়েছ। উদাহরণস্বরূপ, যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন, তিনি পুনর্বার সৃষ্টি করতে সক্ষম।
(আরবী***************************************************************************************)
মানুষ বলে, আমি যখন সত্যিই মরে যাব, তখন কি আমাকে পুনরুজ্জীবিত করে উঠানো হবে? মানুষের একথা কি মনে পড়ে না যে, আমরা প্রথমবার তাদের এমন অবস্থা থেকে সৃষ্টি করেছি যখন তারা কিছুই ছিল না? –সূরা মরিয়মঃ ৬৬-৬৭
সৃষ্টির ধারা তো আমাদের সামনেই অহরহ চলছে –বিভিন্ন আকারে এবং প্রকারে। কিন্তু মানুষ খেয়াল করছে না। তার দৈহিক গ্রন্থি হাজার হাজার শূক্রকীট উৎপাদন করছে। প্রতিটি শূক্রকীটের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হওয়ার যোগ্যতাও বর্তমান রয়েছে। সৃষ্টির এই অসংখ্য উপাদান পুনর্বার সৃষ্টি করাও তাঁর জন্য কোন কঠিন ব্যাপার নয়।
(আরবী********************************************************************************)
তোমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছ, তোমরা এই যে, শূক্রকীট নিক্ষেপ কর, তা থেকে তোমরা সন্তান সৃষ্টি কর, না এর সৃষ্টিকর্তা আমরা? আমরাই তোমাদের মধ্যে মৃত্যুকে নির্ধারণ করেছি, আর আমরা কিছুমাত্র অক্ষম নই এ কাজ থেকে যে, তোমাদের আকৃতি পরিবর্তন করে দেব এবং এমন একটা আকৃতিতে তোমাদের সৃষ্টি করব, যা তোমরা জান না। নিজেদের প্রথম সৃষ্টি লাভকে তো তোমরা জান, তাহলে কেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? –সূরা ওয়াকিয়াঃ ৫৮-৬২
(আরবী**************************************************************************************)
আবু রযীন উকায়লী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকুলকে পুনর্বার কেমন করে জীবিত করবেন? এর কোন দৃষ্টান্ত আছে কি? তিনি বললেনঃ তুমি কি কখনো তোমার সম্প্রদায়ের মাঠসমূহ অতিক্রম করেছ …….যখন তা সম্পূর্ণ শুষ্ক ও ফসলশূণ্য ছিল এবং যখন তাতে উর্বরতা ও সবুজের সমারোহ ছিল? রাবী বললেন, হাঁ। নবী করীম (সঃ) বললেনঃ এই তো আল্লাহর সৃষ্টির একটি নমুনা। এভাবেই আল্লাহ তাআলা মৃতদের জীবিত করবেন।
এই যে সবুজ ফসলের মাঠ যমীনের বুককে ঢেকে নেয় এবং তার সজীবতায় যে প্রাণচাঞ্চল্য বিরাজ করে –তাও আল্লাহর অপার ক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করে। এই দৃশ্যমান সাক্ষ্য থেকে চোখ বন্ধ করে রাখা ঠিক নয়। কোন কৃষক মাটির নিচে কয়েকটি বীজ লুকিয়ে রাখে, অথবা কয়েকটি ডালপালা রোপণ করে। দেখতে দেখতে তা একটি সবুজ বাগানে পরিণত হয়ে যায়। আল্লাহর নামে বাগান ফলে পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং মাঠ শস্য দানায় ভরে যায়। এই মাটি, এই আবর্জনা, এই ময়লা পানি –অবশেষে সুমিষ্ট ফল, সুন্দর ফুল এবং পত্রপল্লবে সুশোভিত বৃক্ষরাজি –আল্লাহর অপার মহিমা!
(আরবী*********************************************************************************)
তোমরা দেখছ যমীনে শুষ্ক অবস্থায় পড়ে আছে। অতঃরপ যখনই আমরা তার উপর পানি বর্ষণ করলাম, সহসাই তা সতেজ হয়ে উঠল, ফুলে উঠল এবং যাবতীয় রকমের সুদৃশ্য উদ্ভিদ উৎপাদন করতে শুরু করল। এসব কিছু এজন্য যে, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই মহাসত্য এবং তিনিই মৃতদেহ জীবিত করেন। তিনি সবকিছুর উপর শক্তিমান। কিয়ামতের মুহুর্তটি অবশ্যই আসবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর আল্লাহ তাআলা কবরে অন্তর্হিত ব্যক্তিদের অবশ্যই উঠাবেন।–সূরা হজ্জঃ ৫-৭
আমরা যে খাবার গ্রহণ করে থাকি তার নিষ্প্রাণ পদার্থগুলো আমাদের দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জীবন্ত কোষে (Cell) পরিণত হয়। এর মধ্যে চেতনা, অনুভূতি এবং জীবরেন স্পন্দন সবই আছে। এসব ঘটনা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে যেসব ঘটনা অনবরত আমাদের মাঝে ঘটে যাচ্ছে –সে ধরনর কোন ঘটনাকে অস্বীকার করার কি অর্থ হতে পারে? হাশর-পুনরুত্থান তো এ ধরনেরই ব্যাপার! অতএব মানুষ নিজের সম্পর্কে কি ভাবছে?
এই যমীন এবং যমীনের বুকের গোটা মানবজাতি এই সীমাহীন বিশ্বের তুলনায় কি গুরুত্ব রাখে? অসীম শুন্যলোকে যে শত-সহস্র লক্ষ কোটি দুনিয়া ছড়িয়ে আছে তার সাথে ক্ষুদ্র মানুষের কি তুলনা হতে পারে?
(আরবী***************************************************************************)
আকাশরাজি ও যমীন সৃষ্টি করা মানুষ সৃষ্টি করা অপেক্ষা নিশ্চয়ই অনেক বড় কাজ। কিন্তু অধিকাংশ লোকই অনুধাবন করে না।–সূরা মুমিনঃ ৫৭
যে হাত একিট আলিশান ইমারত নির্মাণ করতে সক্ষম, তার জন্য এটা কি অসম্ভব হতে পারে যে, তা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় সে তা নির্মাণ করে দেবে? মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের আকীদা সন্দেহাতীত। অতএব এজন্য আমাদের প্রস্তুতি নেয়া একান্ত প্রয়োজন। নেকী, আল্লাহ ভীতি ও পবিত্রতার পাথেয় এখনই সংগ্রহ করার সময়। এগুলোই সেদিন আমাদের উপকারে আসবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তাঁর নবুয়াত প্রাপ্তির প্রথম পর্যায়ে একটি ভাষন দিয়েছিরেন। তাতে তিনি বলেছেনঃ
পরিচালক কখনো তার লোকদের মিথ্যা বলতে পারে না। আল্লাহর শপথ! যদি আমি লোকদের মিথ্যে কথা বলেও ফেলি –তাহলেও তোমাদের সাথে মিথ্যে কথা বলতে পারি না। ধরে নাও যদি সকল লোককে আমি ধোঁকাও দিই, তবুও তোমাদের ধোঁকা দিতে পারি না। আল্লাহর শপথ! যেভাবে তোমাদের ঘুম এসে যায়, ঠিক সেভাবে একদিন মৃত্যুও এসে যাবে। তোমরা ঘুম থেকে যেভাবে জেগে উঠ, ঠিক সেভাবে মৃত্যুর পর একদিন জেগে উঠবে। যদি ভাল কাজ করে থাক তাহলে অবশ্যই ভাল ফল পাবে। আর যদি খারাপ কাজ করে থাক তাহলে খারাপ ফলই পাবে। অতঃপর হয় চিরকালের জন্য জান্নাত লাভ করবে, অন্যথায় চিরকালের জন্য দোযখ লাভ করবে।
অতএব সকাল বেলা আমরা গভীর ঘুম থেকে যেভাবে জেগে উঠি ঠিক সেভাবে একদিন কবরের ঘুম থেকেও জেগে উঠতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকার পর কবর থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অতঃপর যে ব্যক্তি পাপিষ্ঠ বলে সাব্যস্ত হবে তাকে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিযে যাওয়া হবে। আর যারা নেককার, অনুগত ও মুত্তাকী প্রমাণিত হবে, তাদের পৌঁছে দেওয়া হবেঃ
(আরবী******************************************************)
প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদার স্থানে, মহাশক্তিমান সম্রাটের কাছে।–সূরা কামারঃ ৫৫
####সমাপ্ত####
৩১৭ পৃষ্ঠা থেকে শুরু হবে*************************************************************************