৪
তাকদীর (ভাগ্যলিপি)
তাকদীরে বিশ্বাস
ইসলামের যেসব আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান, কাযা ও কদর বা তাকদীরের ওপর ঈমান আনাও সেই আকীদা-বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহ পাকের মহান সত্তা, তাঁর সুন্দর নামগুলো এবং তাঁর মহান গুণাবলীর সঠিক পরিচয় লাভ করার ওপরই ঈমান বিল্লাহের ভিত্তি স্থাপিত।
ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহ তাআলা যেকোন দিক থেকেই পূর্ণাঙ্গ এবং পরিপূর্ণ, সম্মান ও মর্যাদা, সৌন্দর্য ও মহত্ব সব দিক থেকেই পরিপূর্ণ। তিনিই যাবতীয় প্রশংসা পাওয়ার একমাত্র অধিকারী। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
তিনিই সৃষ্টি করেছেন এবং ভারসাম্য স্থাপন করেছেন। তিনি তাকদীর নির্ধারণ করেছেন, অতঃপর পথ দেখিয়েছেন।–সূরা আলাঃ ২-৩
একজন মুমিন বান্দাকে যেখানে আরো অনেক বিষয়ের ওপর ঈমান আনতে হয় তার সাথে সাথে নিম্নোক্ত বিষয়ের ওপরও ঈমান আনতে হয় এবং মনকে নিশ্চিন্ত করতে হয় যে, আল্লাহ তাআলার জ্ঞান সব কিচুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে, তাঁর ইচ্ছা সব কিছুর ওপর কার্যকর রয়েছে, তাঁর শক্তি সব কিছুকে আয়ত্ত করে রেখেছে, তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন এবং তিনি ভাল করেই জানেন তাঁর কি করা উচিত।
এসব গুণ তাকদীর বিশ্বাসের ভিত্তি। সুতরাং তাকদীরের ওপর ঈমান আনা ছাড়া আল্লাহর ওপর ঈমান পরিপূর্ণ হতে পারে না। এটা হচ্ছে ঈমানের সেই মৌলিক উপাদান যা ছাড়া আল্লাহর ওপর ঈমানের আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হতে পারে না।
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা প্রতিটি জিনিসের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রাখেন। কোন জিনিসই তাঁর জ্ঞানের আওতা বহির্ভূত নয়। বালির মধ্যে সন্তরণকারী পিঁপড়াই হোক অথবা মহাশূন্যের বেগবান তারকাই হোক, সব কিছুই তাঁর দৃষ্টির মধ্যে অবস্থান করছে। এই বিরাট পৃথিবী, সীমাহীন বিশ্ব, এই যুগ-যুগান্তরের মধ্যে প্রসারিত কালের পরিক্রমা –এ সবই তঁর জ্হানের আওতায় অবস্থান করছে। যুগ-যুগান্তরের কোন একটি মুহুর্ত, পূর্ব ও পশ্চিমের কোন একটি স্থান তাঁর দৃষ্টির অন্তরালে নয়।
জীবনের ঘটনাপঞ্জী কখনো প্রাচুর্য, কখনো দুঃখ-দারিদ্র্য, কখনো আশার আলো, কখনো নিরাশার অন্ধকার, কখনো আনন্দের বন্যা, কখনো কান্নার রোল, কখনো বিলাপ, কখনো গানের সুর-মুর্ছনা প্রতিটি অবস্থা সম্পর্কেই আল্লাহ তাআলা অবগত রয়েছেন। মহান আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী**************************************************************************************)
আসমান ও যমীনের এক বিন্দু পরিমাণ জিনিস এমন নেই, না ছোট না বড়, যা তোমার প্রতিপালকের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে থাকতে পারে। এই সবই এক পরিচ্ছন্ন দফতরে লিপিবদ্ধ আছে। -সূরা ইউনুসঃ ৬১
এই দফতরে তাকদীরও লিপিবদ্ধ রয়েছে, সমস্ত জিনিসের পরিণতি এবং প্রতিটি কাজের ফলাফলও তাতে লিপিবদ্ধ রয়েছে, সমস্ত জিনিসের পরিণতি এবং প্রতিটি কাজের ফলাফলও তাতে লিপিবদ্ধ আছে। সফলতা, ব্যর্থতা, সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্য সবকিছুই তাতে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু আমাদের জ্ঞান কি ঐ পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম?
(আরবী***************************************************************************************)
“গায়েব একটি বই—
পাতাগুলো যার বন্ধ করা,
তাকে রেখেছেন রাব্বুল আলামীন
সৃষ্টির দৃষ্টির আড়ালে।
তার ভেতর থেকে শুধু
বর্তমানের পাতাগুলো তিনি
মেলে ধরেন নির্দিষ্ট সময় অন্তর”।
জীবনের ঘটনাবলী, মানবীয় কার্যক্রম, ব্যস্ততা ইত্যাদির ক্ষেত্রে তাকদীরের দুটি অবস্থা রয়েছে। এই দুটি অবস্থা পরিস্কার ও পরস্পর বিরোধী। ফলাফলের দিক থেকেও তা পরস্পর বিপরীত। তাকদীরের এই দুটি অবস্থার পৃথক পৃথক সীমা বা ক্ষেত্র রয়েছে। এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে দীন অস্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায এবং মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এখানে আমরা তাকদীরের প্রতিটি দিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করব।
আমাদের অক্ষমতার সীমা
এই পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস রয়েছে যা আল্লাহর কুদরতের অনন্য দৃষ্টান্ত বহন করে। আল্লাহর ইচ্ছায় তা অস্তিত্ব লাভ করে এবং মানুষের মাঝে কার্যকর হয়। মানুষ তা পছন্দ করুক বা না করুক, এ সম্পর্কে তাদের অনুভূতি থাক বা না থাক। জ্ঞানবুদ্ধি এবং এর প্রখরতা বা স্থূলতা, মেযাজ এবং এর নম্রতা বা রুক্ষতা, দেহ এবং দীর্ঘাকৃতি বা খর্বাকৃত চেহারার সৌন্দর্য বা অসৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব এবং এর পূর্ণতা বা অপূর্ণতা; যে যুগে তুমি জন্মেছ, যে স্থানে তুমি বসবাস করছ, যে পরিবেশে তুমি বেড়ে উঠছ, যে পিতা-মাতার কোলে লালিত-পালিত হয়েছ, উত্তরাধিকারসূত্রে তোমার মধ্যে যে আবেগ ও ঝোঁকপ্রবণতা পেয়েছ; জীবন-মৃত্যু, সুস্থতা-অসুস্থতা, প্রাচুর্য-দারিদ্র্য এবং এ জাতীয় যত জিনিস রয়েছে তাতে মানুষের কোন এখতিয়ার নেই। প্রকাশ্যে ও গোপনে কেবল তাকদীরের অদৃশ্য আগুলই গতিশীল রয়েছে এবং তা জীবনকে তার প্রভুর ইচ্ছা অনুযায়ী প্রাণচঞ্চল করে রাখছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী****************************************************************************************)
আকাশ ও পৃথিবীর কোন জিনিসই আল্লাহর কাছে গোপন নয়। তিনিই তো তোমাদের মায়েদের গর্ভে তোমাদের আকার-আকৃতি নিজের ইচ্ছামত বানিয়ে থাকেন। বাস্তবিকই এই মহান বুদ্ধিজ্ঞানের মালিক ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই।–সূরা আলে-ইমরানঃ ৫-৬
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এগুলো এমন জিনিস নয় যার ওপর আল্লাহর পাকড়াও হতে পারে অথবা এগুলোর হিসাব-নিকাশ হতে পারে। আমরা কেবল এজন্যই তোমাদের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট করছি যেন তোমাদের সামনে পরিস্কার হয়ে যায় যে, আমাদের ভাষা, জাতীয়তা ইত্যাদির উপর আমাদের কোন এখতিয়ার নেই। কুরআন পাকের নিম্নোক্ত আয়াত এই সত্যেরই ঘোষণ দিচ্ছেঃ
(আরবী***************************************************************************************)
তোমার রব যা চান তা-ই সৃষ্টি করেন এবং (তিনি নিজের কাজের জন্য যাকে ইচ্ছা) বাছাই করে নেন। বাছাই করে নেওয়াটা এই লোকদের কাজ নয়। এই লোকদের আরোপিত শিরক থেকে আল্লাহ পাক-পবিত্র এবং সুমহান। এই লোকেরা যা কিছু নিজেদের মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখে আর যা প্রকাশ করে –তোমার রব তা সবই জানেন। তিনিই আল্লাহ, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। দুনিয়া এবং আখিরাতে সর্বত্রই তাঁর জন্য প্রশংসা। শাসন-কর্তৃত্ব এবং সার্বভৌমত্ব কেবলমাত্র তাঁরই। তাঁর কাছেই তোমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে।–সূরা কাসাসঃ ৬৮-৭০
এ হচ্ছে তাকদীরের একটি শাখা –যার ওপর ঈমান আনা জরুরী এবং এর সমর্থনে কুরআন-সুন্নাহ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের কোন অভাব নেই। মুমিন ব্যক্তির বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এগুলো এমন বিষয় যার চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে গেছে। লোকদের তাকদীরে তা বণ্টিত হয়ে গেছে। তাকদীরের লেখনি শুকিয়ে গেছে, তা মুছে ফেলা আর সম্ভব নয়।
এসব বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন, তাঁর ইচ্ছায়ই এগুলোর প্রকাশ ঘটে এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী এগুলোর ব্যবস্থাপনা চলে। আমাদের এখানে কোন দখল নেই। আমাদের পূর্ববর্তীগণ এর ওপর পূর্ণ ঈমান রাখতেন। তাঁরা সত্যনিষ্ঠ এবং পরিপক্ক ঈমানের অধিকারী ছিলেন। এজন্য এগুলোর সুপ্রভাত জীবনকালের সীমা নির্দিষ্ট হয়ে আছে, ভয়ের কারণে তা বৃদ্ধিও পায় না এবং সাহসিকতার কারণে তার ঘাটতিও হয় না –তখন তারা নিজেদের দায়িত্ব পালনে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। তাদের কানে আল্লাহর এ বাণী বাজতে থাকতঃ
(আরবী***************************************************************************************)
তাদের বল! ভাল কিংবা মন্দ কিছুই আমাদের হয় না, হয় শুধু তাই যা আল্লাহ আমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন। তিনিই আমাদের মনিব। ঈমানদার লোকদের তাঁর উপরই ভরসা করা উচিত।–সূরা তাওবাঃ ৫১
তাকদীরের কাছে প্রত্যাবর্তন এবং আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের অনেক সুযোগ এসে থাকে। এটা মানুষের মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয়, উষ্ণ, আবেগও অসম সাহস সৃষ্টি করে। অতএব সে ধৈর্য, অবিচলতা, উদ্যম ও উৎসাহে সম্পূর্ণরূপে বিহ্বল হয়ে যায়।
এখানে আমরা স্বাধীন
তাকদীরের দ্বিতীয় অংশ আমাদের বাস্তব কর্মজীবনের সাথে সম্পৃক্ত। এ ক্ষেত্রে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমরা যখন কোন কাজ করি তখন পরিস্কারভাবে অনুভূত হয় যে, আমাদের বুদ্ধি-বিবেক জাগ্রত আছে, অন্তর সতর্ক আছে এবং আবেগ গতিশীল রয়েছে।
কর্মময় জীবনে আমরা কতটুকু স্বাধীন? আমাদের কর্মতৎপরতায় আমরা কতদূর স্বাধীনতা ভোগ করি? আমরা নিজেদের কাজকে তাকদীরের সাথে সংশ্লিষ্ট করে থাকি –এর অর্থইবা কি?
ব্যাপারটি অত্যন্ত সহজ। ইনশাআল্লাহ এ সম্পর্কে আমরা এমন আলোচনা করব যাতে বিবেক-বুদ্ধি আলো পেতে পারে, অন্তর প্রশান্তি লাভ করতে পারে এবং এ সম্পর্কে যাবতীয় সংশয় ধূলির মত উড়ে যায়।
যেসব কাজ আমাদের ইচ্ছা ও এখতিয়ারাধীন তা করতে গিয়ে আমাদের পরিস্কার মনে হয় এগুলো আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে করে যাচ্ছি এবং এ ব্যাপারে আমরা পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী। আমরা ইচ্ছা এবং কর্মক্ষেত্রে স্বাধীন –এটা মেনে নেওয়ার জন্য আমাদের এই অনুভূতিই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু কোন ব্যক্তি বলতে পারে না, তা যথেষ্ট নয়। কারণ অনুভূতিও কোন কোন সময় ভুল করে বসে। সুতরাং কেবল অনুভূতির ওপর নির্ভর করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে না।
সর্বপ্রথম আমাদের দেখা উচিত এ সম্পর্কে কুরআন মজীদ আমাদের কি বলে? এই দৃষ্টিকোণ থেকে যখন কুরআন অধ্যয়ন করি তখন আমরা আশ্বস্ত হয়ে যাই যে, আমাদের এই অনুভূতি নির্ভুল। যারা অনুভূতির এই সাক্ষ্যকে গুরুত্ব দিতে চায় না তাদের অনুসৃত পন্থা সঠিক নয়। কুরআন এই অনুভূতির ওপর জোর দিচ্ছে এবং মানবীয় ইচ্ছার স্বাধীণতা ঘোষণা করছেঃ
(আরবী**************************************************************************************)
পরিস্কার বলে দাও, এই মহাসত্য তোমাদের রবের কাছ থেকে এসেছে। এখন যার ইচ্ছা মেনে নেবে, আর যার ইচ্ছা অমান্য বা অস্বীকার করবে।–সূরা কাহফঃ ২৯
কুরআন এ কথাও ঘোষণা করেছে যে, মানুষ নিজের ইচ্ছায় যা কিছু করে তার জন্য সে নিজেই দায়ী এবং একদিন তাকে এজন্য জবাবদিহি করতে হবে।
(আরবী*************************************************************************************)
বল, হে লোকেরা! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের কাছ থেকে প্রকৃত সত্য এসেছে। এখন যে লোক সোজা পথ অবলম্বন করবে, তার এই সোজা পথ অবলম্বন তার জন্যই কল্যাণকর হবে। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হবে, তার গোমরাহী তার জন্যই ক্ষতিকর হবে। আমি তোমাদের উপর কোন কর্তৃত্বধারী নই।–সূরা ইউনুসঃ ১০৮
এই দীনের প্রকৃতি হচ্ছে কষ্ট স্বীকার এবং পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া। মানুষের যদি স্বাধীনতাই না থাকে তাহলে পরীক্ষার প্রশ্ন আসে কি করে? আর পুরস্কার বা শাস্তির প্রশ্নই বা কি করে উঠতে পারে, যদি তার সামনে স্বাধীনভাবে কাজ করার বিস্তৃত ক্ষেত্র না থাকে? কুরআন মজীদে এ সম্পর্কে যেসব আয়াত এসেছে এখানে তার উল্লেখ করা প্রয়োজন নেই। কেননা গোটা কুরআনই এই সত্যের প্রমাণ বহন করছে।
আমাদের যাবতীয় কাজকর্মের সংবাদ কি পূর্ব থেকেই আল্লাহর জ্ঞানে রয়েছে? তিনি কি আগে থেকেই জানেন আমরা ভবিষ্যতে কি করব? হ্যাঁ, তিনি আমাদের সবকিছুই জানেন। আমাদের কোন কাজই তাঁর জ্ঞানসীমার বাইরে নয়।
(আরবী***********************************************************************************)
এ সম্পর্কিত জ্ঞান আমার প্রভুর কাছে একটি গ্রন্থে সুরক্ষিত রয়েছে। আমার প্রভু পথহারাও হন না এবং ভুলেও যান না। -সূরা ত্বাহাঃ ৫২
কিন্তু এ দুটি জিনিস একই সময় কি করে সম্ভব হতে পারে যে, আমাদের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতাও রয়েছে আবার আমাদের কোন কাজই আল্লহার জ্ঞানসীমার বাইরেও নয়? এর জবাব অত্যন্ত সহজ। তুমি নিজের চেহারাকে বিকৃত করে একটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যাও। তুমি নিজের হাতে নিজের চেহারাকে যেভাবে বিকৃত করেছ –আয়নার মাঝে ঠিক সেই দৃশ্যই দেখতে পাবে। এখানে আয়নার কি দোষ? সে তো তোমার সামনে তোমার অবিকল চেহারাই তুলে ধরছে। পক্ষান্তরে তুমি যদি তোমার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আয়নার সামনে তুলে ধরতে তাহলে সে তোমার চোখের সামনে অনুরূপ জিনিসই তুলে ধরত।
অনুরূপভাবে আল্লাহর জ্ঞান হচ্ছে একটি আয়না স্বরূপ। এর মধ্যে যাবতীয় কাজকর্মের অবিকল দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। কাজের ওপর এর কোন প্রভাব পড়ে না। এই আয়না যাবতীয় কাজের অধীন, কাজ তার অধীন নয়। অথবা বলা যায়, আয়না হচ্ছে কাজের প্রতিবিম্ব। কাজ আয়নার প্রতিবিম্ব নয়। আল্লাহর জ্ঞঅন নামক আয়তার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, এর মধ্যে কেবল বর্তমানের দৃশ্যই নয় বরং অতীত ও ভবিষ্যতের দৃশ্যও দেখা যায়।
কোন জিনিস পূর্বে কেমন ছিল, বর্তমানে কিরূপ আছে এবং ভবিষ্যতে কেমন হবে –সব দৃশ্যই এই আয়নায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে এবং তার অবিকল চেহারাই উদ্ভাসিত হয়।
হিদায়াত ও গোমরাহীর অর্থ
এখানে আরো প্রশ্ন থেকে যায়, আল্লাহর ইচ্ছার সর্ব-ব্যাপক হওয়ার অর্থ কি? গোটা সৃষ্টিকুল আল্লাহর ইচ্ছাধীন কি করে হতে পারে? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রশ্ন কেন? আল্লাহর ইচ্ছার সর্ব ব্যাপকতা এবং সৃষ্টির ইচ্ছা ও সংকল্পের স্বাধীনতা –এ দুটি জিনিস কি করে একত্রে সম্মিলিত হতে পারে?
এ প্রশ্নের জবাবও সহজ; আল্লাহর কিতাবেই এর সমাধান পাওয়া যাবে। যে বুঝাতে চায় সে সহজেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে।
(আরবী**************************************************************************)
আমরা এই কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের সহজ মাধ্যম বানিয়েছি। আছে কি কোন উপদেশ গ্রহণকারী? –সূরা কামারঃ ১৭
আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক আয়াতে যদি আল্লাহর ইচ্ছার সাধারণ প্রয়োগ উল্লেখ রয়েছে, তাহলে অন্য আয়াতে এর বিশেষ প্রয়োগ উল্লেখ আছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর একচ্ছত্র প্রয়োগ উল্লেখ থাকলে অন্য জায়গায় তার শর্তসাপেক্ষ প্রয়োগ উল্লেখ আছে এবং সেখানে মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতারও উল্লেখ আছে।
যদি কোথাও এরূপ বক্তব্য এসে থাকে যে, আল্লাহ তাআলা অমুক ব্যক্তিকে গোমরাহ করে দিয়েছেন, তাহলে সেখানকার বক্তব্য এই যে, এই ব্যক্তি হিদায়াতের পরিবর্তে গোমরাহীকে পছন্দ করেছে। এজন্য আল্লাহ তাআলা তাঁর পছন্দমাফিক তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। সে যে রাস্তায় চলা পছন্দ করেছে আল্লাহ তার সে রাস্তাকে সমতল করে দিয়েছেন। সে যে জিনিসের আকাঙ্ক্ষা করেছে আল্লাহ তার জন্য তা সহজলভ্য করে দিয়েছেন।
তিনি তাকে ইচ্ছা ও ক্ষমতা প্রয়োগের যে স্বাধীনতা দিয়েছেন তাতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেননি। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
তারা যখন বক্রতা অবলম্বন করল, তখন আল্লাহও তাদের অন্তরকে বাঁকা করে দিলেন। আল্লাহ ফাসিক লোকদের হিদায়াত করেন না।–সূরা সফঃ ৫
এখন দেখুন এ আয়াতে মানবীয় ইচ্ছা ও স্বাধীনতাভে ক্ষশতা প্রয়োগকে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
এবং যে ব্যক্তি রসূলের বিরোধিতা করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হবে এবং তার সামনে হিদায়াতের পথ সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও ঈমানদার লোকদের নিয়ম-নীতির বিপরীত চলবে –তাকে আমরা সেদিকেই চালাব যেদিকে সে নিজেই চলতে শুরু করেছে এবং আমরা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। -সূরা নিসাঃ ১১৫
অতএব ইচ্ছার প্রয়োগ সম্পর্কে এখন আর কি কোন অস্পষ্টতা বাকি আছে? না। “ইউদিল্ল বিহি মান ইয়াশা” (তিনি যাকে চান পথভ্রষ্ট করে দেন) –এর অর্থ সূরা বাকারার নিম্নোক্ত (২৬,২৭) আয়াতের অর্থের অনুরূপঃ
(আরবী***********************************************************************************)
তিনি শুধু ফাসিকদেরই বিভ্রান্ত করেন, যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সুদৃঢ় করে নেওয়ার পর তা ভঙ্গ করে।
“ইয়াহদী মান ইয়াশাউ” (তিনি যাকে চান হিদায়াত দান করেন)-এর অবস্থাও তদ্রুপ আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণীর মধ্যে দেখুন যে, মানবীয় ইচ্ছাকে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছেঃ
(আরবী****************************************************************************************)
বল, আল্লাহ যাকে চান পথভ্রষ্ট করেন এবং যে ব্যক্তি তাঁর পানে ছুটে আসে তিনি তাকে সৎপথ দেখান। এসব লোকই ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর প্রশান্তি লাভ করছে। শুনে রাখ! আল্লাহর স্মরনেই অন্তরের প্রশান্তি লাভ হয়।–সূরা রা’দঃ ২৭-২৮
এ থেকে জানা গেল, যারা তাঁর দিকে অগ্রসর হয় তিনি তাদের হিদদায়াত দান করেন। তিনি ফাসিক লোকদের হিদায়াত দান করেন না। এই মশাল হাতে নাও এবং প্রতিটি অবস্থা দেখে যাও। আল্লাহর দীনে কোথাও জটিলতা বা ভারসাম্যহীনতা খুঁজে পাবে না। জটিলতা ও ভারসাম্যহীনা কেবল নিবোধদের স্থূল জ্ঞানে এবং অলস ও সংজ্ঞঅহীনদের অন্তরেই পাওয়া যায়।
এখানে কেউ এ প্রশ্ন তুলতে পারে যে, কর্মক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছার সীমাই বা কতদূর এবং মানুষের ইচ্ছার স্বাধীন প্রয়োগের সীমাই বা কোথায় শেষ হয়ে যায়?
তোমরা জান যে, একজন কৃষক তার জমিতে বীজ বপন করে, এর পরিচর্যা করে, আল্লাহ এর অংকুরোদগম করিয়ে তাতে আবার শস্যদানা সৃষ্টি করেন। এখন তোমরা ইচ্ছা করলে এই চাষীকেও কৃষক বলতে পার এবং তোমাদের এ বলাটা ভুল হবে না। কেননা সে শস্য উৎপদানের উপাদান সরবরাহ করেছে। আবার ইচ্ছা করলে আল্লাহ তাআলাকেও কৃষক বলতে পার। কেননা তিনি চারাগাছের পরিবর্ধন করেছেন এবং তাতে ফসল ধরিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী*****************************************************************************)
তোমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছ –তোমরা এই যে বীজ বপন কর, তা থেকে তোমরা ফসল উৎপাদন কর না আমরা উৎপাদন করি? আমরা ইচ্ছা করলে এই ফসলকে ভুষি বানিয়ে দিতে পারি।–সূরা ওয়াকিয়াঃ ৬৩-৫
ফসল উৎপাদনে একজন কৃষকের যে ভূমিকা –নিজের ভাগ্য গড়ায় একজন মানুষেরও অনুরূপ ভুমিকা রয়েছে। অতএব তুমি ইচ্ছা করলে তোমার জীবনের কৃষিক্ষেত্রে নেকীর বীজ বপন করতে পার এবং আল্লাহর অসীম শক্তি তাকে একটি সুদৃশ্য বাগানে পরিণত করে দেবে। আর ইচ্ছা করলে তুমি তোমার জীবন ক্ষেত্রে দুষ্কৃতির বীজও বপন করতে পার এবং অদৃশ্য শক্তির হাত তাকে একটি কণ্টকাকীর্ণ জঙ্গলে পরিণত করে দেবে।
(আরবী**************************************************************************)
এই লোকদের বল, তোমরা কাজ কর, আল্লাহ তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ সকলেই লক্ষ্য করবেন যে, তারপর তোমাদের কর্মনীতি কি হয।–সূরা তাওবাঃ ১০৫
আল্লাহর দীন সম্পর্কে একটি মিথ্যাচার
লোকেরা সাধারণত বাধ্যবাধকতা এবং স্বাধীনতার মধ্যে পার্থক্য করে না। তারা এই দুটি জিনিসের সীমাকে একত্র করে ফেলে। আমরা এখানে কেবল এতটুকুই বুঝাবার চেষ্টা করব যে, আখেরাতে যাবতীয় কাজের হিসাব-নিকাশ অনেকটা অংক ও হিসাব শাস্ত্রের অনুরূপই হবে। বান্দার যাবতীয় কাজকর্মে আল্লাহর যতটা দখল থাকবে –সে সম্পর্কে তার কাছে হিসাব-চাওয়া হবে না। কিন্তু সরাসরি তার হাত যা করেছে সে সম্পর্কে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। মহান আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী*************************************************************************************)
আল্লাহ কারো ওপর একবিন্দু পরিমাণও জুলুম করেন না। কেউ যদি একটি নেকী করে তবে তিনি এটাকে দ্বিগুণ করে দেন। -সূরা নিসাঃ ৪০
কিন্তু একদল লোকের বক্তব্য হচ্ছে –আল্লাহ তাআলা প্রতিটি জিনিস লিখে দিয়েছেন। অতঃপর তা কার্যকর করার জন্য তিনি লোকদের বাধ্য করেছেন। সে যা কিছু করেছে তা করতে সে বাধ্য এবং যা করছে না তাতেও সে বাধ্য। অতএব সে এক্ষেত্রে নিরুপায়, তার স্বাধীন ইচ্ছা বলতে কিছুই নেই।
এই ধরনের বাতিল আকীদার শিকার হয়ে একদল ভণ্ড সূফী স্বচক্ষে গর্হিত কাজ হতে দেখে বাহু দোলাতে দোলাতে বলে, “তিনি যা চান বান্দা তো তাই করছে”। এভাবে আমরা কত বিদ্রোহীর সাক্ষাত পাই যে, তাদেরকে বুঝালে, উপদেশ দিলে বলে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তো আমাদের হিদায়াতের পথে নিয়ে আসতে পারতেন। প্রাচীনকালের মুশরিকদের অমার্জনীয় কথার সাথে এদের কথার মিল রয়েছে। এরাও নিজেদের ভ্রান্তির দিকে লক্ষ্য করে বলে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমাদের দিয়ে এটা করাতেন না। কুরআন এ ধরনের উদ্ভট বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেঃ
(আরবী*****************************************************************************************)
এই মুশরিকরা (তোমার কথার জবাবে) অবশ্যই বলবে, আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে আমরাও শিরক করতাম না, আমাদের বাপ-দাদারাও করত না এবং কোন জিনিসকে হারাম করেও নিতাম না। এ ধরনের কথা বলেই এদের পূর্বের লোকেরাও সত্যকে মিথ্যা মনে করেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করেছে। এদের বল, তোমাদের কাছে কোন প্রকৃত জ্ঞান আছে কি, যা আমাদের সামনে তোমরা পেশ করতে পার? তোমরা তো শুধু ধারণা-অনুমানের ওপর (নির্ভর করে) চলছ এবং শুধু ভিত্তিহীন ধারণা রচনা করেই যাচ্ছ।–সূরা আনআমঃ ১৪৮
আবার দেখ, কুরআন মজীদ এই কূটতর্কের ভিত্কিমূলকে কিভাবে উড়িয়ে দিয়েছে। সে এদিকে মোটেই মনোযোগ দেয়নি। যেন তারা এটাকে এক ধরনের স্বীকৃতি বলে ধরে না নিতে পারে।
(আরবী**************************************************************************)
এই মুশরিকরা বলে, আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে আমরা এবং আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা তিনি ছাড়া আর কোন কিছুর ইবাদত করতাম না এবং তাঁর হুকুম ছাড়া কোন জিনিস হারাম গণ্য করতাম না। তাদের পূর্ববর্তী লোকেরাও এ ধরনের বাহানাই তৈরি করেছিল। তাহলে পরিস্কার বক্তব্য পৌঁছে দেওয়া ছাড়াও কি এই রসূলদের আরো কোন দায়িত্ব আছে? –সূরা নাহলঃ ৩৫
আল্লাহর কাছে এবং মানুষের কাছে এই সুস্পষ্ট বক্তব্যের ফলাফল কি হতে পারে? এই বক্তব্য বিরুদ্ধবাদীদের কূটতর্কের শিকড় কেটে দেয়।
(আরবী***********************************************************************************)
এই রসূলগণই সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারীরূপে প্রেরিত হয়েছিলেন, যেন তাদের পাঠাবার পর লোকদের কাছে আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি না থাকে। আল্লাহ পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।–সূরা নিসাঃ ১৬৫
ঘুমে অচেতন এসব লোকের এখনো হুশ হওয়া উচিত। আপনভোলা এই প্রাচ্যবাসীদের সতর্ক হওয়া উচিত যারা নিজেদের দার্শনিক কর্মের অহমিকায় আত্মহারা হয়ে আছে। যে লোকদের আল্লাহ তাআলা শক্তি, ক্ষমতা ও প্রত্যয় দান করেছেন তাদেরও ভুল ভাঙ্গা উচিত। কিন্তু তাদের শীতল হয়ে গেছে এবং তাদের শক্তি অবচেতনভাবে পড়ে আছে। তারা অপমান ও পরাজয়ের ছায়ায় ঘুমিয়ে রয়েছে। অথচ উন্নত যোগ্যতাসম্পন্ন লোকেরা এই কর্মময় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সদা তৎপর রয়েছে। যেসব লোক ‘তাকদীরে বিশ্বাসকে ইসলামের একটি প্রবেশদ্বার মনে করে নিয়েছে এবং এই দরজা দিয়ে ইসলামের সুরক্ষিত দূর্গে প্রবেশ করতে চায় তাদের সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিতঃ
(আরবী*************************************************************************************)
প্রত্যেক মিথ্যবাদী ও অসদাচারীর জন্য ধ্বংস।–সূরা জাসিয়াঃ ৭
তাকদীরের অজুহাত
মানুষ অপরাধ করে তার ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করে। সে কোন আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা তালাশ করে যে, সে কোন অপরাধ করেনি, অথবা যদি করে থাকে তাও খুব হালকা অপরাধ। এভাবে অপরাধের ব্যাখ্যা করে তারা বড় অপরাধের শিকার হয়ে পড়ে। যেমন সে মিথ্যা অথবা প্রতারণার আশ্রয় নেয়।
কখনো মানুষকে একটি কাজ করতে বলা হয়, কিন্তু সে অলসতা ও অযোগ্যতার পরিচয় দেয়। দুর্বলতার কারণে সে এ কাজ করে না। আবার কখনো তাকে কোন কাজ করতে নিষেধ করা হয়, কিন্তু সে নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সেই নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এখন যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তুমি একাজ কেন করলে না অথবা এ কাজে কেমন করে তুমি লিপ্ত হতে পারলে –তবে সে আসল কারণ বলবো না, সে নিজের অযোগ্যতা অথবা নিচ স্বভাবের কথা স্বীকার করবে না, বরং অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে বলবে, আমি কি করতে পারি, আমি তো নিরুপায় ছিলাম, আমি নিরপরাধ।
প্রাচীনকালে মুশরিকরা যা বলত –সে ঠিক তাই বলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম যখন তাদেরকে মূর্তিপূজা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতেন, তখন তারা ঘাড় বাঁকা করে বলতঃ
(আরবী***************************************************************)
এরা বলে, রহমান যদি চাইতেন (যে, আমরা এগুলোর পূজা করব না) তাহলে আমরা কখনোই এদের পূজা করতাম না। এ সম্পর্কে প্রকৃত কথা এরা আদৌ জানে না, শুধু আন্দাজ-অনুমান করে বেড়ায়। আমরা কি তাদেরকে কুরআনের পূর্বে কোন কিতাব দান করেছি যা তারা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছে? –সূরা যুখরুফঃ ২০-২১
আল্লাহ তাআলা মানুষকে যে শক্তি দান করেছেন, কোন জিনিস অনুধাবন করার যে যোগ্যতা তাদের দান করেছেন, তাদের স্বভাব-প্রকৃতির মধ্যে উন্নত বা অবনত হওয়া যে মানসিক শক্তি লুকিয়ে রেখেছেন এবং সৎপথ অথবা অসৎ পথের যেকোন একটি বেছে নেওয়া যে স্বাধীনতা দান করেছেন –এর ওপর কোনরূপ চাপ প্রয়োগ করা হয় না, এতে কোন বাধার সৃষ্টি করাও হয় না। মানুষ যদি এসব ব্যাপারে অনবহিত থাকে এবং বুঝে-শুনে নিজের চোখ বন্ধ করে রাখে তাহলে তার দায়িত্বের এতটুকুও পার্থক্য হবে না। সে প্রতারণা অথবা একগুঁয়েমীর যতই আশ্রয় নিক না কেন।
একাবর এমন একদল লোকের সাথে বসার আমার সুযোগ হয়েছিল যারা নিজেদের দায়দায়িত্বের সব বোঝা তাকদীরের ওপর চাপাতে চায়। আমি মনোযোগ সহকারে তাদের যুক্তি প্রমাণ শুনলাম। এই দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থনে তারা যেসব জিনিসের আশ্রয় নেয় তা সবই আমার সামনে ফুটে উঠে। আমি অনুভব করলাম, তারা কুরআন ও হাদীসকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। এজন্যই তারা এই অপরিপক্ক ধারণার শিকার হয়েছে। দুঃখের বিষয়, এই ভ্রান্ত চিন্তাধারা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত হয়ে পড়েছে। অথচ যেসব লোকের জীবন জিহাদ ও ইবাদতের মধ্য দিয়েই কেটেছে তাদের জন্যও রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুহুর্তকাল তাকদীরের নামে বসে বসে আরাক করা পছন্দ করেননি। আমাদের মত অযোগ্য ও ত্রুটিপূর্ণ আমলের অধিকারী লোকদের অবস্থা তাহলে কি হতে পারে!
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম রাতের বেলা তাদের কাছে আসছেন। ঘরে তিনি এবং ফাতিমা (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা রাতে উঠে কি নামায পড় না? আলী (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের প্রাণগুলো তো আল্লাহর হাতে থাকে। তিনি যখন আমাদের জাগিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখনই ফিরে চললেন। কথাটা তাঁর খুবই অপছন্দ হল এবং তিনি এর কোন প্রতিউত্তর করলেন না। অতঃপর আমি দেখলাম তিনি উরুর উপর হাতের আঘাত করছেন আর বলছেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
“মানুষ বড়ই ঝগড়াটে”। -সূরা কাহফঃ ৫৪
হযরত আলী (রাঃ)-এর মুখ দিয়ে একথা বের হওয়ার সাথে সাথেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) ফিরে চললেন। তিনি আশ্চর্য হলেন, এরূপ কথা কি করে বলা গেল। অন্য কেউ কথা বলতে পারে, কিন্তু হযরত আলী (রাঃ)-এর মুখে তা কেমন করে আসতে পারল? তিনি যে পর্যায়ের মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি তাঁর পক্ষে এরূপ কথাতো শোভা পায় না। আসলে জিহাদ এবং কঠোর শ্রমের পর মানুষ যখন শ্রান্তক্লান্ত হয়ে বিছানায় যায তখন অলক্ষ্যে এ ধরনের কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে।
কতিপয় লোক তাকদীরকে অজুহাত বানানোর জন্য হযতর মূসা ও আদম আলাইহিমাস সালামের মধ্যে অনুষ্ঠিত বিতর্কের আশ্রয় নিয়ে থাকে। আলোচনাটি নিম্নরূপঃ
(আরবী*********************************************************************************)
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আদম (আ) বিতর্কে মূসা (আঃ)-এর ওপর বিজয়ী হলেন। মূসা (আঃ) বললেন, হে আদম! আপনি আমাদের পিতা, আপনিই জান্নাত থেকে আমাদের বহিস্কার করে নিয়ে এসেছেন। আদম (আঃ) তাঁকে বললেন, হে মূসা! আল্লাহ তোমার সাথে কথা বলে তোমাকে বিরল সম্মান দান করেছেন। নিজের হাতে লিখে তোমাকে তাওরাত কিতাব দান করেছেন। তুমি আমকে এমন একটি ব্যাপারে অভিযুক্ত করছ যা আমার সৃষ্টির চল্লিশ বছর পূর্বে তিনি আমার তাকদীরে লিখে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আদম মূসার ওপর বিজয়ী হলেন।–মুসলিম
তাকদীরের অজুহাত হিসেবে পেশকারী লোকেরা যে ধরনের চিন্তা করে এ হাদীস থেকে তাদের জন্য কোন সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে না। কেননা এ হাদীস এবং অন্যান্য হাদীস থেকে জানা যায়, হযরত মূসা (আঃ) নিষিদ্ধ গাছে হাত দিয়েছেন –এটাকেই তিনি মানব জাতির দুর্ভাগ্যের কারণ সাব্যস্ত করেন। আদম (আঃ) নিজের নির্দোষিতার পক্ষে যে কথা বলেছিলেন –সঠিক কথাই বলেছিলেন। মানব জাতির অস্তিত্ব তাঁর অপরাধের ফল নয় –এতে কোন সন্দেহ নেই। এই অপরাধের সাথে মানব বংশের ধারবাহিকতার কোন সম্পর্ক নেই। এই ধরনের দাবি কোন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি করতে পারে না।
যদি তাই হত তাহলে এ অপরাধের কি অন্যরূপ শাস্তি হতে পারত না? শুধু একটুকুই কি যথেষ্ট ছিল না যে, তাঁকে সতর্ক করে দেওয়া হত অথবা বেহেশত থেকে বহিস্কার করে দেওয়া হত অথবা অন্য কোন দুশ্চিন্তায় নিক্ষেপ করা যেত? এই অপরাধের কারণেই সুখ-দুঃখ ও বিপদ-মুসিবতের পরিপূর্ণ এই পৃথিবী অস্তিত্ব লাভ করেছে –এ কথার সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই। আদম (আঃ)-এর পক্ষেও এরূপ ধারণা করা সম্ভব ছিল না। অতএব এজন্য তিরস্কার করা যেতে পারে না। মূসা আলাইহিস সালামকেও শেষ পর্যন্ত একথা স্বীকার করতে হয়।
এই বিরাট পৃথিবী, দেশ-মহাদেশ, বিস্তৃত জনবসতি, তাদের কর্মমুখর জীবনযাত্রা –এ সবই কি আদম আলাইহহিস সালামের অপরাধের ফল? তা কি করে হতে পারে? ইসলাম কখনো একথা বলে না এবং বুদ্ধিবিবেকও সমর্থন করে না। অতএব এ ব্যাপারে মূসা (আঃ) যখন ভুল বুঝলেন, আদম (আঃ) তাকে সতর্ক করে দিলেন যে, এটা তো আল্লাহর লিখন ছিল। সুতরাং মানব জাতির যাবতীয় অপরাধ আদম (আঃ)-এর ঘাড়ে চাপানো যেতে পারে না। ব্যক্তিগতভাবে আদম (আঃ)-এর অপরাধ এবং তার জন্য তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে –হাদীসে এর পক্ষে কোন সমর্থন বর্তমান নেই। কেননা আল্লাহ তাআলা তাঁর অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুনান গ্রন্থসমূহের অপর বর্ণনায় আছেঃ
(আরবী*************************************************************************************)
মূসা (আঃ) বললেন, হে প্রভু! আমাকে একটু আদমকে দেখান যিনি নিজেকে এবং আমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে এনেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে তাঁর আদি পিতা আদমকে দেখালেন। মূসা (আঃ) বললেন, আপনি কি আমাদের পিতা আদম? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আপনি কি সেই ব্যক্তি যার মধ্যে আল্লাহ তাআলা নিজের রূহ থেকে ফুঁকে দিয়েছেন, সমস্ত কিছুর নাম শিখিয়েছেন এবং ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন আপনাকে সিজদা করার জন্য? তিনি বললেন, হাঁ। মূসা (আঃ) বললেন, তাহলে কোন জিনিস আপনাকে বাধ্য করল আপনার নিজেকে এবং আমাদেরকে বেহেশত থেকে বের করে আনতে? আদম (আঃ) বললেন, তুমি কে? তিনি বললেন, আমি মূসা। তিনি বললেন, তুমি কি সেই ব্যক্তি যাকে তোমার প্রভু তাঁর রিসালাতের জন্য বাছাই করেছেন, তুমি কি বনী ইসরাঈলদের নবী, আল্লাহ যার সাথে পর্দার অন্তরাল থেকে সরাসরি কথা বলেছেন এবং এজন্য তোমার ও তাঁর মাঝে কাউকে মাধ্যম বানান নি? তিনি বললেন, হাঁ আমি সেই ব্যক্তি। আদম (আঃ) বললেন, তোমার কি একথা স্মরণ নেই যে, এটা আমার জন্মের পূর্বে আল্লাহ তাআলা লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন? মূসা (আঃ) বললেন, হাঁ। আদম (আঃ) বললেন, তাহলে তুমি আমাকে এমন একটি ব্যাপারে দোষারোপ করলে যা আল্লাহ তাআলা আমার জন্মের পূর্বেই সিদ্ধান্ত করে রেখেছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
আদম মূসার ওপর বিজয়ী হলেন, আদম মূসার ওপর বিজয়ী হলেন, আদম মূসার ওপর বিজয়ী হলেন।
আদম (আঃ) ভাল করেই জানতেন যে, তিনি নিষিদ্ধ গাছের কাছে গিয়ে বড়ই ভুল করেছেন। তিনি সরল মনেই তা স্বীকার করেছেন। অতএব তিনি এই অপরাধের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং আল্লাহ তাঁকে মাফ করে দিলেন। এখন কথা হচ্ছে গোটা মানব জাতির দুঃখ-দুর্দশার জন্য কি তাঁকে দায়ী করা চলে? আদম (আঃ) এই দায়িত্ব স্বীকার করলেন না এবং এ ব্যাপারে তিনি সত্যপন্থীই ছিলেন। তিনি এটাকে আল্লাহর নিষিদ্ধ এবং তাঁর নির্ধারিত তাকদীরের ফল বলে সাব্যস্ত করেছেন। মূসা (আঃ)-ও এই বক্তব্যের সমর্থক হয়ে যান। বাস্তব অবস্থা সামনে এসে গেলে তিনিও সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হয়ে যান। এখন আমরা যদি আদমের ভুলকে বাহানা বানিয়ে নিজেদের অপরাধ ধামাচাপা দিতে চাই, তাহলে আমরা ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হব।
জবরিয়া মতবাদে বিশ্বাসীরা এই জগতের যে নকশা অংকন করে –যদি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় তাহলে গোটা বিশ্বকে একটি অন্ধকার নগরী এবং একটি বিধ্বস্ত রাজ্য বলতে হয়। অনন্তর তাদের মতে যেহেতু মানব জাতি স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্তৃত্ব বঞ্চিত –অতএব সে যা কিছু করে তা করতে বাধ্য। এজন্য পাপ-পুণ্য সবই তাদের দৃষ্টিতে সমান।
এই বাতিল মতবাদের অনুসারী একদল সুফীও দেখতে পাওয়া যায়। তারা এই পর্যন্ত বলে ফেলেছে যে, আদম ও শয়তান এবং মূসা ও ফিরাউনের মধ্যে মূলত কোন তফাত নেই। কারণ তাদের মতে, এদের প্রত্যেকেই তাই করেছে যা অনাদি কাল থেকে এদের নসিবে লিখে দেওয়া হয়েছে। এ থেকে পলায়ন করা তাদের কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এই জীবন হচ্ছে একটি নাটক। প্রতিটি মানুষ তাই করে যা তার জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যে কথা তাদের অন্তরে ঢেলে দেওয়া হযেছে তাই তারা বলে। কবি বলেনঃ
এ জীবন তো অভিনয়
একজন অভিনেতার
দিবস রঙ্গমঞ্চ এখানে
আর রাত্রি তার পরদা।
যদি তুমি অনুসন্ধান চালাও, তাহলে অনেকের মন-মগজেই জীবনের এই নকশাই অঙ্কিত পাবে। কতেকে তো প্রাকশ্যে এরূপ বলে বেড়ায় এবং কতেকে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই চিন্তা-ভাবনা করে, কিন্তু তা প্রকাশ করতে লজ্জা পায়। মুসলিম রাজ্যের পতন অনেকাংশে এই বাতিল মতবাদেরই ফল। জনগনের মাঝে এই মতবাদ এমনভাবে বিস্তার লাভ করে যে, খারাপ কাজের জন্য ধরপাকড় করার আর কেউ থাকল না। ফরয ও ওয়াজিব (অত্যাবশ্যকীয়) দায়িত্ব পালনে শিথিলতা দেখা দিল, কিন্তু সতর্ক করার কেউ থাকল না।
এখন সংশোধনের প্রথম পদক্ষেপ এই যে, তাকদীর সম্পর্কিত আকীদার ক্ষেত্রে মন-মস্তিষ্ক ও চিন্তাধারার সংশোধন করতে হবে। আগেকার দিনে তাকদীরে বিশ্বাস যেভাবে ত্যাগ-তিতিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধকারী হাতিয়ার ছিল, যেভাবে তা নেক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং বড় কাজ থেকে দূরে থাকার জযবা সৃষ্টি করত –পুনরায় এর মধ্যে সেই প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হবে। এভাবেই মানুষকে দায়িত্ব সচেতন করা যেতে পারে এবং এভাবেই আল্লাহর বিধান কার্যকর হতে পারে।
এখন থাকল কুরআনের সেই সব আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাদীস –যার প্রকাশ্য অর্থ থেকে সন্দেহেরে সৃষ্টি হয়ে যে, মানুষ তার ইচ্ছা ও কাজের ক্ষেত্রে তাকদীরের হাতে বন্দী। এটা মূলত মানুষের উপলব্ধির ত্রুটি। অন্যথায় বাস্তবতার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এই অদ্ভূত দৃষ্টিভঙ্গী মূলত অপরিপক্ক ও ত্রুটিপূর্ণ জ্ঞানেরই ফল। অন্যথায় কুরআ-হাদীসে এ ধরনের কোন কথা নেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ যদি বলা হয় আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************************)
যেসব লোক কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তুমি তাদের সতর্ক কর আর নাই কর তাদের পক্ষে উভয়ই সমান, তারা কখনও ঈমান আনবে না।–সূরা বাকারাঃ ৬
এ কথার অর্থ এই নয় যে, তাদের অন্তরগুলোকে এমনভাবে বানানো হয়েছে যে, তারা সত্যকে গ্রহণ করার যোগ্যতাই রাখে না, তারা ইচ্ছা করলেও কুফী থেকে মুক্ত হতে পারবে না। এজন্য তাদের সতর্ক কা হোক বা না কোন –তাদের জন্যই উভয়ই সমান। আয়াতের অর্থ মোটেই তা নয়। এখানে তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে কেবল এতটুকু কথা বলা হয়েছে যে, তুমি এই লোকদের মাঝে একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে আসছ, তাদের হিদায়াতের জন্য মন-মগজের শক্তি ব্যয় করছ, তাদেরকে গোমরাহী থেকে বের করে আনার জন্য তুমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছ এবং রাতদিন এই চিন্তায় নিজের জীবনটাকে তিলে তিলে ক্ষয় করে দিচ্ছ –কিন্তু তারা স্বেচ্ছায় সত্যপথ থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে এবং সত্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করছে। অতএব তাদের পেছনে সময় ও শ্রম ব্যয় করার কোন প্রয়োজন নেই।
অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলা যে বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
তুমি যাকে চাও হিদায়াত করতে পার না, বরং আল্লাহ যাকে চান হিদায়ত দান করেন।–সূরা কাসাসঃ ৫৬
এ আয়াতের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে। তাঁর প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর চাচা আবু তালিব ইসলাম গ্রহণ করুক। তিনি কাতর কণ্ঠে আরাধনা করছিলেন, মৃত্যুর সময় তাঁর চাচা আল্লাহর উপর ঈমান আনুক এবং পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করুক। কিন্তু শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আবূ তালিব তাতে সম্মত হয়নি এবং তৌহীদের বাণী গ্রহণ করেনি। এ অবস্থায় তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল। এই ঘটনায় রাসুলূল্লাহ (সঃ) খুবই মর্মাহত হলেন। এই সময় আল্লাহ তাআলা উল্লিখিত আয়াত নাযিল করে তাঁর নবীকে সান্ত্বনা দেন।
এভাবে আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেনঃ
(আরবী******************************************************************)
আমি দোযখে নিক্ষেপ করার জন্য অসংখ্য জিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছি। এদের অন্তর আছে কিন্তু এরা বুঝতে চেষ্টা করে না।–সূরা আরাফঃ ১৭৯
অর্থাৎ এই ধনিক শ্রেণী ইসলাম করা থেকে বিরত থেকে নিজেরাই নিজেদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করছে। এখানে একথাই বলা হয়েছে। কিন্তু কথাটা এমন ভঙ্গীতে বলা হয়েছে যে, মনে হয় তাদেরকে জাহান্নামের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন অন্যমনস্ক বা অলস ছাত্রকে তার শিক্ষক সতর্ক করে বলে থাকে, যে নির্বোধ লেখাপড়াকে একটা খেলো বিষয় বানিয়ে নিয়েছে এবং পরীক্ষার প্রস্তুতি থেকে দূরে রয়েছে তার ভাগ্যেই অকৃতকার্যতা রয়েছে। একানে বাক্যের প্রকাশ্য অর্থ উদ্দেশ্য হয় না।
যখন কোন কাজকে বান্দার সাথে অথবা শুধু আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করা হয় তখন সেখানে এ কথা মনে রাখা উচিত যে, কোন এক পক্ষের উল্লেখ অপর পক্ষের নেতিবাচক হওয়ার প্রমাণ বহন করে না। যদি এই নীতি সামনে রাখা হয় তাহলে কুরআনের বহু আয়াতের অর্থ বোঝা সহজ হয়ে যাবে এবং কোনরূপ জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে না। এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, অনেক কাজের ব্যবস্থাপনা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে কিন্তু সৌজন্যের দাবি অনুযায়ী তা আল্লাহর সাথে সংযুক্ত করা উচিত নয়। যেমন নিম্নোক্ত আয়াতে নিকৃষ্টতার কথা উল্লেখ আছে, কিন্তু এর কর্তার উল্লেখ নেইঃ
(আরবী************************************************************************)
আরও এই যে, আমরা বুঝতে পারতাম না, পৃথিবীবাসীর প্রতি কোন খারাপ আচরণ করার সংকল্প করা হয়েছে কিংবা তাদের রব তাদেরকে সরল-সঠিক পথ প্রদর্শন করতে চান? –সূরা জিনঃ ১০
অনুরূপভাবে নিম্নোক্ত আয়াতে দেখুন, ইবরাহীম (আঃ) অসুস্থতাকে তো নিজের সাথে সম্পৃক্ত আরোগ্য দানকে নিজের রবের সাথে সম্পৃক্ত করেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
যিনি আমাকে খাওয়ান ও পান করান, আর যখন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ি তখন আমাকে আরোগ্য দান করেন।–সূরা শুআরাঃ ৭৯-৮০
অনুরূপভাবে হযরত খিদর (আঃ) নৌকা ছিদ্র করে দেওয়ার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেনঃ
(আরবী***********************************************************************************)
আমি একে দোষমুক্ত করে দিতে চাইলাম। -সূরা কাহফঃ ৭৯
গুপ্ত সম্পদের নিরাপত্তার উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছেনঃ
(আরবী*******************************************************************************)
অতএব তোমার রব চাইলেন যে, এই বালক দুটি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে তাদের জন্য গচ্ছিত এই সম্পদ তারা বের করে নেবে।–সূরা কাহফঃ ৮২
অনুরূপভাবে আখিরাতে ঈমানদার সম্প্রদায় বিনয় প্রকাশার্থে নিজেদেরকে কোন ধরনের সম্মান ও মর্যাদার অযোগ্য সাব্যস্ত করবে। তারা স্বীকার করবে, তারা যে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছে তা একান্তভাবেই আল্লাহ তাআলার দান।
(আরবী***********************************************************************************)
সমস্ত প্রশংসা কেবল আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের হিদায়াত দান করেছেন। আমরা নিজেরা কিছুতেই পথ পেতে পারতাম না –যদি আল্লাহ আমাদের পথ না দেখাতেন। আমাদের রবের প্রেরিত রাসূলগণ সত্য বিধান নিয়ে এসেছিলেন। -সূরা আরাফঃ ৪৩
একইভাবে আল্লাহ তাআলা তাদের চেষ্টা-সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা উল্লেখ করেছেনঃ
(আরবী********************************************************************************)
তখন আওয়াজ আসবে, তোমরা যে জান্নাতের উত্তরাঝিদারী হয়েছ তা তোমরা নিজেদের কাজের প্রতিদান হিসেবেই পেয়েছ, যা তোমরা (দুনিয়ার জীবনে) করেছিলে।–সূরা আরাফঃ ৪৩
তাকদীর সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের প্রচুর সংখ্যক হাদীসও রয়েছে। তা পাঠ করে পাঠকদের মনে যে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে আমরা তা দূর করে দিতে চাচ্ছি। তাহলে এটাকে আর বাহানা বানানোর সুযোগ থাকবে না। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ
(আরবী***************************************************************************************)
আমরা একটি লাশের সাথ বকী আল-গারকাদে ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের কাছে আসলেন। তিনি বসে পড়লেন এবং আমরাও তাঁর চারপাশে বসে পড়লাম। তাঁর হাতে ছিল এক ছড়ি। তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে ছড়ি দিয়ে মাটি খুড়তে লাগলেন, অতঃপর বললেনঃ তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির ঠিকানা বেহেশত অথবা দোযখ নির্ধারিত হয়ে আছে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাহরে আমরা কেন সেই লেখার ভরসা করব না এবং কাজকর্ম ছেড়ে দেব না? তিনি বললেঃ তোমরা কাজ করতে থাক। যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেটা তার জন্য সহজ করে দেওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি সৌভাগ্যবান সে সৌবাগ্যবানদের কাজই করে। আর যে ব্যক্তি হতভাগ্য সে হতভাগ্যদের কাজই করে থাকে। অতঃপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেনঃ
“পরন্তু যে লোক (আল্লাহর পথে) ধনমাল ব্যয় করল, (তাঁর নাফরমানী থেকে) আত্মরক্ষা করল এবং কল্যাণ ও মঙ্গলকে সত্য বলে মেনে নিল –তাকে আমি সহজ পথে চলার সহজতা দেব। আর যে ব্যক্তি কার্পণ্য করল, (আল্লাহর প্রতি) বিমুখ হল এবং কল্যাণ ও মঙ্গলকে অমান্য করল, তার জন্য আমি দুষ্কর পথের সহজতা দান করব।–সূরা লাইলঃ ৫-১০
একজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের জন্য এ হাদীসের মধ্যে কোন সংশয় থাকতে পারে না। একথা সত্য যে, কোন ব্যক্তি দুনিয়াতে কি করবে এবং আখিরাতে তার পরিণতি কি হবে এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সম্পূর্ণ অবহিত। এটা একটা বাস্তব সত্য যার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। তবে একথা সত্য নয় যে, অনাদি কাল থেকে আল্লাহ তাআলার জানা থাকার কারণে মানুষ সংশ্লিষ্ট কাজ করতে বাধ্য হয়ে গেছে। কেননা জ্ঞান হচ্ছে একটি আলো যা বিভিন্ন জিনিসকে সমুজ্জর করে তোলে। তা কোন শক্তি নয় যে, কাউকে কোন কাজ করতে বাধ্য করবে।
মানুষ নিজেই উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে কাজ করে, চেষ্টা-সাধনায় লিপ্ত হয়। আল্লাহ তাআলা কেবল তার উদ্দেশ্যের পথকে সমতল করে দেন এবং তার উদ্দেশ্যকে পূর্ণতায় পৌঁছে দেন। যে ব্যক্তি আপেলের চাষাবাদ করে আল্লাহ তাকে আপেল খেতে দেন। আর যে ব্যক্তি কাঁটা বপন করে আল্লাহ তাকে কাঁটা খেতে দেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম যে আয়াত কটি প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন –সেগুলো পরিস্কারভাবে এই সত্যেরই ঘোষণা দেয়।
এই আয়াতগুরো বলছে, যে ব্যক্তি কল্যাণের পথ অবলম্বন করে এবং তাকওয়া, অর্থব্যয় ও সত্যকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে –আল্লাহ তাআলা তার জন্য শুভ পরিণামের ব্যবস্থা করেন এবং জান্নাতের পথ তার জন্য সহজ করে দেন। আর যে ব্যক্তি পাপের পথ অবলম্বন করে এবং কৃপণতা, নির্লজ্জতা এবং মিথ্যার আশ্রয় নেয় –আল্লাহ তাআলা তাকে এগুলোর চর্চা করার সুযোগ দেন। তিনি তার রশি ঢিলা করে দেন এবং শেষ পর্যন্ত তাকে জাহান্নামে পৌছিয়ে দেন।
আরো একটি হাদীস দেখুন, যাকে কেন্দ্রস্থল জ্ঞানসম্পন্ন লোকেরা দীর্ঘকাল ধরে হৈ চৈ করে আসছে। তারা মনে করেছে যে, এই হাদীসের মাধ্যমে তারা দীনের ভিত্তিমূল নড়বড়ে করে দিতে পারবে। অথচ আল্লাহর দীনকে তারা যতটা দুর্বল মনে করে নিয়েছে, তা এর চেয়ে অনেক শক্তিশালী। আল্লাহর দীনকে তারা যতটা নিঃসঙ্গ দেখতে পাচ্ছে –বাস্তব অবস্থা মোটেই তদ্রুপ নয়। হাদীসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
সেই সত্তার শপথ, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই! তোমাদের কোন ব্যক্তি জান্নাতবাসীদের কাজ করতে থাকে, এমনকি তার মাঝে ও জান্নাতের মাঝে মাত্র এক বাহু পরিমাণ দূরত্বের ব্যবধান থাকে। এমন সময় তার সামনে তার তাকদীরের লিখন এসে উপস্থিত হয় এবং সে দোযখবাসীদের কাজ করে বসে। ফলে সে দোযখে প্রবেশ করে। আবার তোমাদের কোন ব্যক্তি দোযখবাসীদের কাজ করতে থাকে, এমনি তার মাঝে এবং দোযখের মাঝে এক বাহু পরিমাণ দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে। এমন সময় তার সামনে তার তাকদীরের লিখন উপস্থিত হয় এবং সে জান্নাতবাসীদের কাজ করতে থাকে। ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করে।
এই হাদিসে দুই ধরনের লোকের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। একদল লোকের পরবর্তী জীবন পূর্ববর্তী জীবনের সম্পূর্ণ বিপরীত দেখা যায়। তাদের প্রথম জীবন এক ধরনের হয়ে থাকে এবং পরবর্তী জীবন ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। আমরা স্বচক্ষে জীবনের যে উত্থান-পতন দেখতে পাই তার পরিপ্রেক্ষিতে এটা আশ্চর্যজনক কিছু নয়।
এমন কত লোক রয়েছে যাদের জীবনটা দুষ্কর্মের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে, এমন সময় তারা চিন্তার বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিল; হঠাৎ তাদের মনে গোমরাহীর অনুভূতি জাগ্রত হল এবং দ্রুত হিদায়াতের পথে চলে আসল। অনুরূপভাবে কোন কোন লোককে দেখা যায় তার জীবনে বিরাট একটা অংশ সৎপথে কেটেছে। হঠাৎ করে একদিন সে গোমরাহীর শিকার হয়ে জীবনের নিচ স্তরে নেমে যায়।
হাদীসে তাকদীরের লিখন সামনে এসে যাওয়ার যে কথা এসেছে তা ব্যাখ্যার একটি ধরন মাত্র। এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার সঠিক এবং সূক্ষ্ম জ্ঞানের দিকে ইঙ্গিত করাই উদ্দেশ্য। এটা অতিশয়েক্তির একটা রীতি যা আরবী ভাষায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
কোন ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি অনুমান করলে যে, তার পরিণতি এই হবে। সে যখন এই পরিণতির কাছে পৌঁছে যায়, তখন তুমি তা দুইভাবে উল্লেখ করতে পার এবং এই দুই পন্থাই সঠিক। তুমি বলতে পার, তার সম্পর্কে তোমার যে ধারণা ছিল তা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। অথবা তুমি এও বলতে পার যে, তার সম্পর্কে তোমার যে সিদ্ধান্ত ছিল তা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। তুমি ইচ্ছা করলে তোমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, অন্তর্দৃষ্টি ও বিচক্ষণতাকে আরও প্রতীয়মান করার জন্য এও বলতে পার যে, সে আমার অনুমানের বাইরে কি করে যেতে পারে, অথবা আমার সিদ্ধান্ত কি করে ভুল হতে পারে! আরবী ভাষায় এ ধরনের বাকরীতির বহুল প্রচলন আছে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী************************************************************************)
হে আদম সন্তান! শতান যেন তোমাদের বিপথগামী করতে না পারে।–সূরা আরাফঃ ২৭
অর্থাৎ শয়তানের কারণে তোমরা বিপথগামী হয়ে পড় না। বাক্যবিন্যাস এবং বাকরীতি যতই বিভিন্ন হোক না কেন, একজন বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে তা অনুধাবন করা মোটেই কষ্টকর নয়। অতএব আমাদের যে কর্মের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তার সুযোগ গ্রহণ না করে আমরা যদি সমস্ত বোঝা তাকদীরের উপর চাপাতে চাই তাহলে এটা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।
একটি রসাত্মক জবাব
এক ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞেস করল, মানুষ কি স্বাধীন না নিয়ন্ত্রিত? আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, তাকে বাঁকাভাবে জবাব দেব –যেভাবে সে তার স্বভাবের সাথে বক্রতা মিশিয়ে রেখেছে। আমি বললাম, মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত; যেমন- (১) একদল প্রাচ্যে বসবাস করে এবং (২) অপর দল পাশ্চাত্যে বসবাস করে।
সে বলল, এ কেমন কথা? আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, মানুষ কি স্বাধীন ইচ্ছা এবং স্বাধীন কর্মের অধিকারী? সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে কি? অথবা সে কোন অদৃশ্য শক্তির হাতে বন্দী? আমি বললাম, আমি তো আপনাকে জবাব দিয়ে দিয়েছি। পাশ্চাত্যের লোকেরা স্বাধীন ইচ্ছা ও ক্ষমতার অধিকারী এবং প্রাচ্যের মানুষ পরাধীন ও নিয়ন্ত্রিত। ওখানকার মানুষেরা স্বাধীন ইচ্ছা ও ক্ষমতার মালিক, আর এখানকার মানুষের তা নেই।
এক ব্যক্তি হেসে বলল, এটা তো কূটনৈতিক জবাব হল। আমি বললাম, কেবল রাজনৈতিকই নয়, বরং ধর্মীয় জবাবও এই। তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে, পাশ্চাত্যের লোকদের জ্ঞান দান করা হয়েছে এবং তারা তা কাজে লাগিয়েছে। তারা বিশ্বের অনেক রহস্য আবিস্কার করছে এবং প্রকৃতির মধ্যে লুক্কায়িত বিস্ময়কর শক্তির সন্ধান লাভ করেছে। তারা নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যকে অনুভন করেছে, পাশ্চাত্য-প্রাচ্যকে তন্ন তন্ন করে দেখেছে এবং বিস্ময়কর আবিস্কার পৃথিবীবাসীকে উপহার দিয়েছে।
পক্ষান্তরে আমাদের অবস্থা এই যে, আমাদের লোকেরা এখনো জানে না তারা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও জ্ঞানের অধিকারী কি না? তারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার অধিকার রাখে কি না? তারা কি স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী? তারা কি স্বাধীনভাবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে? তারা স্বাধীনভাবে কোন কিছু করার অধিকার রাখে কি না? এখন সর্বপ্রথম এগুলো প্রমাণ করতে হবে। অতঃপর তারা কাজ শুরু করবে। কিছু চিন্তা-ভাবনা করবে, অতঃপর কোন সিদ্ধান্ত নেবে, অতঃপর কোন পদক্ষেপ নেবে।
এ সময় অবশ্যই সে পরাধীন, হুকুমের দাস। পাশ্চাত্যের স্বাধীন ব্যক্তি তাকে যেভাবে নাচাতে চায় সেভাবেই নাচায় এবং যেভাবে চায় ঘুরপাক খাওয়ায়। কি বিরাট ব্যবধান এই দুই দলের মাঝে। পাশ্চাত্যের লোকের অবস্থা এই যে, তাকে যখন জীবন নদীর উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয় তখন সে চিন্তা করে, আমার যখন হাত-পা রয়েছে আমি কেন সাঁতার কাটব না? অতএব সে সাঁতার কাটতে থাকে। কখনো সে তুফানের অনুকূলে সাঁতার কাটে, আবার কখনো তুফানের প্রতিকূলে অগ্রসর হয়। এভাবে সে তীরভাগে পৌঁছে যায়।
আমাদের প্রাচ্যের অবস্থা এর থেকে ভিন্নতর। এখানে কোন ব্যক্তিকে উত্তাল তরঙ্গের মাঝে নিক্ষেপ করা হলে সে চিন্তা করে –আমি কি সত্যিই জীবিত আছি, না মরে গেছি? আমি কি স্বাধীন না আমার পায়ে জিঞ্জির পরানো আছে? কিন্তু তুফান তো আর নিষ্ফল চিন্তায় নিমজ্জিত ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করে না। তুফানের পর তুফান এসে তাকে খড়কুটার ন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং ধ্বংসের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায়। তখন আমাদের নির্বোধ কবির স্মরণ তার কোন উপকারে আসে নাঃ
সাগর বুকে নিক্ষেপ করলো
হাত-পা বেঁধে
আর বললোঃ
খবরদার! বস্ত্র সিক্ত করো না।
হে মানুষ! আল্লাহ তোমাকে যে শক্তি, ক্ষমতা ও যোগ্যতা দান করেছেন তা নিয়ে কঠোর শ্রমে নিয়োজিত হও! এ কথা জিজ্ঞেস কর না যে, তুমি কি স্বাধীন না পরাধীন? আল্লাহ তোমাকে যে যোগ্যতা দান করেছেন তা কাজে লাগাও। এ কথা স্মরণে রেখ –জীবনে যেখানে তোমার কিছু অধিকার রয়েছে সেখানে তোমার কিছু দায়িত্ব এবং কর্তব্য রয়েছে।
তাকদীর সম্পর্কে আরো কিছু কথা
যে প্রাকৃতিক বিধানের উপর জীবন ও জীবন্ত সত্তাগুলো নির্ভরশীল এবং আসমান ও যমীনের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা যে বিধানের উপর ভিত্তি করে অটল রয়েছে তাও তাকদীরের আওতাভুক্ত। কেননা আল্লাহ তাআলা সব জিনিস অণু এবং শূন্যতা থেকে সৃষ্টি করেছেন যা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণের দিক থেকে কতগুলো স্থায়ী বিধানের অধীন ও অনুগত। এগুলো একটি সুনিশ্চিত ব্যবস্থাপনার অধীনে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে, সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পাদন করে যাচ্ছে। এরা কখনো ভুল করে না, কখনো সীমা লংঘন করে না। মহান আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী**************************************************************************************)
আমাদের রব প্রতিটি জিনিসের মূল সৃষ্টি-কাঠামো দান করেছেন, অতঃপর একে পথ দেখিয়েছেন।–সূরা ত্বাহাঃ ৫০
যেসব উপাদানে পানি সৃষ্টি হয়, এই উপাদানগুলোর পরিমাণ নির্ণয় করার বিধান অথবা যে বিধানের মাধ্যমে পানির ঘনত্ব নিরূপণ করা যায়, অনুরূপভাবে পানি কখনো বাষ্পের আকার ধারণ করে, কখনো জমাট আকার ধারণ করে, আবার কখনো বন্যার আকার করে, কখনো স্থির অবস্থায় থাকে, কখনো স্রোতের আকারে প্রবাহিত হয় –এই সব অবস্থায় পানির মধ্যে কতটা ওজন, কতটা চাপ এবং কি পরিমাণ শক্তি সৃষ্টি হয় তা পরিমাপ করার জন্য যে বিধান রয়েছে তা সবই আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে রেখেছেন। স্রষ্টার নির্ধারিত বিধান অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বজগতের ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে।
(আরবী********************************************************************************)
আমরা প্রতিটি জিনিস একটি পরিমাণ সহকারে সৃষ্টি করেছি।–সূরা কামারঃ ৪৯
তোমার মহান প্রভুর নামে তসবীহ কর –যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং ভারসাম্য স্থাপন করেছেন; যিনি তাকদীর নির্দিষ্ট করেছেন, অতঃপর পথ দেখিয়েছেন।–সূরা আলাঃ ১-৩
বিভিন্ন রকমের ফল উৎপন্ন হওয়া এবং তা পরিপক্ক হওয়া, মাতৃগর্ভে সন্তান পয়দা হওয়া এবং এই বস্তুজগতে তার আগমন, রাত-দিনের আবর্তন –এসবই স্রষ্টার নির্ধারিত ব্যবস্থাপনা এবং তাঁর হিকমতপূর্ণ পরিচালনার অধীন।
(আরবী********************************************************************************)
দানা ও বীজ দীর্ণকারী হচ্ছেন আল্লাহ। তিনিই জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন এবং মৃতকে বের করেন জীবিত থেকে। এসব কাজের আসল কর্তা হচ্ছেন আল্লাহ। তাহলে ভ্রান্ত পথে কোথায় যাচ্ছ? তিনিই রঙ্গীন প্রভাতের উন্মেষ করেন। তিনিই রাতকে শান্তির বাহন বানিয়েছেন এবং চন্দ্র ও সূর্যের উদয়-অস্তের হিসাব নির্দিষ্ট করেছেন। বস্তুত এ সবই সেই মহা পরাক্রমশালী ও মহা জ্ঞানীর নির্ধারিত পরিমাণ। -সূরা আনআমঃ% ৯৫-৯৬
দুই. আদালত বা ন্যায়নিষ্ঠার ওপর তাকদীরের ভিত্তি হওয়াতে তা মর্যাদার মধ্যে ব্যবধান হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক নয়। যেমন –কখনো দুই ব্যক্তি একই কাজ করে সমান পরিমাণ প্রতিদান পাওয়ার অধিকারী হয়। কিন্তু এক ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা কেবল তার প্রাপ্য মজুরীই দেন এবং অপর ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য মজুরী ছাড়াও বিশেষ পুরস্কার দান করতে পারেন। এরূপভাবে দুই ব্যক্তি একই রূপ খারাপ কাজ করে বসে এবং সমান পরিমাণ শাস্তির যোগ্য হয়ে পড়ে। অতঃপর একজন হয়ত ক্ষমা পেয়ে যায় এবং অপর জনকে প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করতে হয়।
আমাদের দাবি এই যে, লোকেরা ভালভাবে বুঝে নিক যে, আল্লাহর ওপর কারো জোর খাটে না, তাঁর ইচ্ছা কারো অধীন নয়। অতএব তাঁর বান্দাগণ আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভয়-ভীতি ও প্রেম-ভালবাসার পরিপূর্ণ অন্তর নিয়ে সরাসরি তাঁর দরবারে হাযির হবে। মহান আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী**********************************************************************************)
হে নবী! তাদের বলে দাও, অনুগ্রহ এবং মর্যাদা সবই আল্লহার হাতে, তিনি যাকে চান তা দান করেন। আল্লাহ বিশাল-ব্যাপক এবং সর্বজ্ঞ। তিনি নিজের অনুগ্রহ দানের জন্য যাকে চান নির্দিষ্ট করে নেন। তাঁর অনুগ্রহও অনেক বেশি এবং বিরাট। -সূরা আলে-ইমরানঃ ৭৩-৭৪
এ থেকেই আমরা জানতে পারি সবকিছুর উৎসকে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে কেন সম্পৃক্ত করা হয়েছে এবং গুনাহ মাফ পাওয়ার প্রসঙ্গইবা কেন তাঁর ইচ্ছার সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী****************************************************************************************)
নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু করার ক্ষমতা রাখেন। তিনি যাকে চাইবেন শাস্তি দেবেন এবং যাকে চাইবেন দয়া করবেন। তোমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। তোমরা না পৃথিবীতে কাতর ও অক্ষম করে দিতে পর আর না আসমানে। আর আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা করার মত কোন পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারী তোমাদের নেই।–সূরা আনকাবুতঃ ২০-২২
আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী***************************************************************************************)
তোমাদের পূর্বে যেসব জাতি অতীত হয়েছে তাদের তুলনায় তোমাদের স্থায়িত্বকাল আসরের নামাযের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের সমান। ইহুদীদের তাওরাত কিতাব দেয়া হল। তারা তদনুযায়ী আমল করতে থাকল। দুপুর বেলায় পৌঁছেই তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। অতএব তাদেরকে এক এক কীরাত পরিমাণ সওয়াব দেওয়া হল। অতঃপর খৃষ্টানদেরকে ইনজীল কিতাব দেওয়া হল। তারা আসরের নামায পর্যন্ত তদনুযায়ী কাজ করতে থাকল। অতঃপর তারাও ক্লান্ত হয়ে পড়ল। অতএব তাদেরকেও এক কীরাত এক কীরাত সওয়াব দেওয়া হল। অতঃপর আমাদেরকে কুরআন মজীদ দেওয়া হল। আমরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত তার উপর আমল করলাম। অতএব আমাদেরকে দুই কীরাত দুই কীরাত সওয়াব দান করা হল। তাওরাত এবং ইনজীল কিতাবের অধিকারীগণ বলল, হে প্রভু! তুমি এদেরকে দুই কীরাত করে সওয়াব দান করেছ আর আমাদেরকে এক কীরাত করে সওয়াব দিলে? অথচ আমরা তাদের তুলনায় অধিক কাজ করেছি। মহামহিম আল্লাহ বললেনঃ আমি কি তোমাদের মজুরী কম দিয়েছি? তারা বলল, না। তিনি বললেনঃ এটাই আমার অনুগ্রহ –যাকে ইচ্ছা আমি দান করি।
এই জীবনে মানুষের মধ্যে কত ব্যবধান ও পার্থক্য রয়েছে। এই ব্যবধানও তাকদীরেরই ফল। মানুষের মাঝে বিরাজমান এই পার্থক্য, সম্মান ও মর্যাদার এই ব্যবধান সভ্যতা-সংস্কৃতির স্তম্ভ এবং বিশ্ব-ব্যবস্থাপনার ভিত্তি। সমস্ত মানুষের একই সমান যোগ্যতা নিয়ে পয়দা হওয়া অসম্ভব। বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক যোগ্যতা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা, পার্থিব ও পারলৌকিক ফলাফল একই রূপ হওয়া কখনো সম্ভব নয়।
জীবনের এই চাকচিক্য এবং পৃথিবীর এই আনন্দ-উৎসব যেসব কাজের ওপর নির্ভরশীল তা আঞ্জাম দেওয়ার জন্য কিছু সংখ্যক হাত-পা ও মাথার প্রয়োজন রয়েছে। মানুষের মাঝে যে যোগ্যতা লুকিয়ে রাখা হয়েছে তার মধ্যে এগুলোর দিকেও পূর্ণ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। যাতে মানব সমাজ সুচারুরূপে ও পূর্ণাঙ্গভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হতে পারে। মানুষের কার্যকলাপে তখনই দোষত্রুটি সৃষ্টি হয় যখন পায়ের স্থানে মাথা এবং মাথার স্থানে পা ব্যবহার করা হয়। যে জাতির অবস্থা এইরূপ হয় তাকে সেই আহাম্মকের সাথেই তুলনা করা যায়, যে পায়ে হ্যাট পরিধান করে এবং মাথায় জুতা বাঁধে। প্রাচ্যে এ ধরনের নির্বোধ জাতির অভাব নেই।
এখন আমরা এর অধিক বলতে চাই না যে, এ সময় আমাদের আলোচ্য বিষয় সামাজিক সংস্কার নয়। বরং এখন আমরা যে জিনিসটি হৃদয়ঙ্গম করতে চাই তা হচ্ছে –একজন অধিনায়ক যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের বাহিনীকে যেভাবে সজ্জিত করে, তাকদীরেও অনুরূপ দায়িত্ব ও কর্তব্য বণ্টন করে দিয়েছে। একদল সৈনিকের দায়িত্ব হচ্ছে, মূল বাহিনীর পশ্চাতে, ডানে, বায়ে, সম্মুখভাবে তাদের অবস্থান নেওয়া। তাদের কেউ অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করে, কেউ রসদপত্র সরবরাহ করে, প্রয়োজনবোধে অতিরিক্ত জনশক্তি সরবরাহ করে এবং অপর দল অফিসের ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগ রক্ষা করে। যুদ্ধক্ষেত্রে এসব কাজই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু এই বণ্টন ব্যবস্থা ন্যায়নিষ্ঠা ও আদল-ইনসাফের উপর কোন প্রভাব ফেলে না। এই পার্থক্যের অর্থ কখনো এই নয় যে, তাকদীর কারো অধিকার খর্ব করেছে, অথবা কারো প্রচেষ্টার মোটেই গুরুত্ব দেয়নি, অথবা পুরস্কার বণ্টনে কোনরূপ বেইনসাফী করেছে। কেননা আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রত্যেককেই ব্যক্তিগতভাবে জবাবদিহি করতে হবে। মানুষকে যে শক্তি ও যোগ্যতা দান করা হয়েছে, তার জন্য যে সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাকে যে উপায়-উপকরণ দান করা হয়েছে –এসবকে সামনে রেখেই তাকে পুরস্কার অথবা শাস্তি দেওয়া হবে।
আমার মনে পড়ে, কোথাও বিমান উড্ডয়ন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এটা ছির ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী বৈমানিক পুরস্কার পাবার অধিকারী হয়না, বরং রীতিমত উড়োজাহাজগুলোর উড্ডয়ন ক্ষমতার গড় নির্ণয় করা হয়। বাতাস দ্রুতগতিতে বয়েলি না স্বাভাবিক গতিতে বয়েছিল, আকাশ পরিস্কার ছিল না মেঘাচ্ছন্ন ছিল, ঋতু অনুকূল ছিল না প্রতিকূল ছিল –এসব বিষয় বিবেচনা করে রীতিমত হিসাব করা হয়। অতঃপর একটি উড়োজাহাজ নিজের উড্ডয়ন ক্ষমতা অনুযায়ী কত সময়ে কি পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে –তা এভাবে নির্ণয় করা হয়। এর অর্থ এই যে, একটি বিমান চারটি বিমানের পর লক্ষ্যস্থানে পৌঁছার পরও পঞ্চম পুরস্কার পাবার পরিবর্তে প্রথম পুরস্কার পেয়ে যেতে পারে।
এটা আমাদের সামনে একটি উদাহরণ। এ থেকে অনেকটা অনুমান করা যায় যে, কিয়ামতের দিন লোকদের যাবতীয় কাজকর্ম কিভাবে ওজন করা হবে। তাদের শ্রমসাধনা ও কর্মতৎপরতা এমনভাবে পরিমাণ করা হবে যে, তাদের অধিকারও খর্ব করা হবে না। বরং প্রত্যেকের যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মক্ষমতা বিবেচনা করেই তাদের যাবতীয় বিষয়ের ফয়সালা করা হবে। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী*********************************************************************************)
কিয়ামতের দিন আমরা নির্ভুল ওজন করার দাঁড়িপাল্লা সংস্থাপন করব। তার ফলে কোন ব্যক্তির ওপর সামান্য পরিমাণও জুলুম হবে না। যার এক বিন্দু পরিমাণও কাজ থাকবে তাও আমরা সামনে নিয়ে আসব। আর হিসাব সম্পন্ন করার জন্য আমরাই যথেষ্ট। -সূরা আম্বিয়াঃ ৪৭
মানুষকে বিজলী বাতির সাথে তুলনা করা যায়। বিজলী বাতির কোনটি ষাট ওয়াট, কোনটি একশ ওয়াট আবার কোনটি দুইশ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। এখন যদি দুই ভোল্টেজ ক্ষমতাসম্পন্ন বাল্ব মাত্র সত্তর ভোল্টেজ আলো দান করে এবং ষাট ভোল্টেজ ক্ষমতাসম্পন্ন বাল্ব পঞ্চাশ ভোল্টেজ আলো দান করে তাহলে দুইশ ভোল্টেজের বাল্বটি ষাট ভোল্টেজ বাতিটির তুলনায় কম আলো দেয়। কিন্তু প্রকাশ্যত ষাট ভোল্টেজ বাল্বটির তুলনায় দুইশ ভোল্টেজ বাল্বটি অধিক উজ্জ্বল দেখায়।
মানুষের অবস্থাও তদ্রূপ। এমন অনেক লোক আছে যাদেরকে আল্লাহ তাআলা অসম শক্তি এবং যোগ্যতা দান করে থাকবেন, তাদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ও উপায়-উকরণের ব্যবস্থা থাকবে, অনুকূল পরিবেশ দান করা হবে। কিন্তু এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তাদের দ্বারা যে পরিমাণ কাজ সম্পাদিত হওয়া উচিত ছিল তা করতে পারবে না। তাদের কার্যক্রমের দ্বারা লোকেরা প্রভাবিত হবে, তাদের ব্যক্তিত্বের দ্বারা দীনের যে আলো ছড়াবে তা হয়ত অবাক দৃষ্টিতে দেখা হবে –কিন্তু আল্লাহর দরবারে তাদের অবস্থা ভিন্নতর হবে, তাদের চেহারায় কোন সৌন্দর্য থাকবে না।
পক্ষান্তরে এমন অনেক লোক দেখা যাবে যাদেরকে সীমাবদ্ধ যোগ্যতা দান করা হবে। কিন্তু এই সীমাবদ্ধ যোগ্যতার দ্বারা তারা আল্লাহর দীনের যে খেদমত আঞ্জাম দেবে লোকদের দৃষ্টিতে হয়ত তা গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে না, কিন্তু আল্লাহর দরবারে তাদেরকে উচ্চ মর্যাদার স্থান দান করা হবে। কেননা তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ যোগ্যতাকে পূর্ণরূপে কাজে লাগিয়ে থাকবে। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী***************************************************************************************)
হে ঈমানদার লোকেরা! পুরুষ লোকদের একদল অপর দলকে উপহাস এবং বিদ্রূপ করবে না। এমনও হতে পারে যে, বিদ্রূপকৃত দল বিদ্রূপকারী দলের তুলনায় উত্তম। অনুরূপভাবে মহিলাদের এক দলও অপর দলকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে না। এমনও হতে পারে যে, এদের তুলনায় তারা উত্তম।–সূরা হুজুরাতঃ ১১
আমরা পূর্বেও বলে এসেছি, ব্যক্তিত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে তাকদীরের গভীর প্রভাব রয়েছে। মানুষ যে শক্তিমত্তার অধিকারী হয় এবং যেসব যোগ্যতা তার মধ্যে পাওয়া যায় –সবই তাকদীরের খেলা। অনুরূপভাবে তার যে কর্মক্ষেত্র এবং কর্মসীমা রয়েছে –যেখানে সে জীবনভর নিজের শক্তি ব্যয় করে, তা নির্দিষ্টকরণেও তাদকীরের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
মানুষের মধ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে যেসব প্রকাশ্য এবং গোপন বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হয় তা নির্ধারণ করার জন্য বংশ বিজ্ঞানীগণ উদারভাবে কাজ করে থাকেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে মানুষের অধিকাংশ কার্যকলাপ এবং যাবতীয় আকর্ষণ তাদের জন্মগত ঝোঁক-প্রবণতারই ফল। এ কথা তো প্রমাণিত যে, দেহের গ্রন্থিসমূহ থেকে যে লালা নির্গত হয় তার মধ্যে এবং স্বভাব-প্রকৃতির ভারসাম্য ও শক্তির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। জৈবিক গ্রন্থিগুলো রক্তের মধ্যে যে হরমোন সরবরাহ করে, মানুষের জৈবিক শক্তির উপর এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। মানুষ কখনো দৈহিক উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আবার কখনো পারে না; এখানেও হরমোনের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
অনুরূপভাবে মূত্রাশয়ের চারদিকে যে বৃক্কের (Adrenal gland) সমাবেশ রয়েছে, ভয় ও রাগের সময় মানুষের মনে দুর্ভাবনা ও উত্তেজনা সৃষ্টিতে এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। কেননা এই বৃক্কগুলো মানুষের রক্তে এমন লোলা সরবরাহ করে যার ফলে অন্তর ও স্নায়ুতে প্রফুল্লতা অথবা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ কারণেই লোকদের ঝোঁক-প্রবণতার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদের সময় তাঁদের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নতর হয়ে থাকে।
কিন্তু উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এসব জিনিস সাধারণ প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের তুলনায় অধিক শক্তিশালী নয়। মনোবিজ্ঞানের বক্তব্য হচ্ছে, এই দুটি জিনিসের এতটা সংশোধন সম্ভব যে, তা শরীআতের বিধি-বিধানের অনুগত হয়ে যেতে পারে। অতএব মানুষের উত্তেজনা ও ঝোঁক-প্রবণতার গতি পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। প্রথমে বাতিলের দিকে ধাবিত হলে পরে সত্যের দিকেও ফিরে আসা সম্ভব।
মনোবিজ্ঞানের বক্তব্য এই যে, এমন কিছু লোকও আছে যাদের অদ্ভুত রকমের কাজকর্ম করার বদ-অভ্যাস রয়েছে। যেমন কিছু লোকের সিঁড়ির থাক গণনা করার অভ্যাস আছে, কিছু লোক দালানের তলা গণতা করতে মজা পায়। ইংরেজ সাহিত্যিক জনসন সম্পর্কে জানা যায়, রাস্তায় চলার সময় যদি কোথাও তাঁর নজরে কাঠের খুঁটি পড়ে যেত তাহলে তিনি প্রতিটি খুঁটি হাতে স্পর্শ করতেন। যদি কোন একটি বাদ পড়ে যেত তাহরে তিনি ফিরে এসে খুঁটিগুলো পুনরায় স্পর্শ করতেন।
এমন লোকও আছে যে একটি ইঁদুর দেখেও ভয় পায়। অথচ সে বীরত্ব, সাহসিকতার জন্য খ্যাতিমান। এমনও কিছু লোক আছে যাদের ছোটখাট জিনিস চুরি করার অভ্যাস রয়েছে। অথচ তার বিরাট সম্মান ও উচ্চ পদের অধিকারী।
এসব জিনিস বলে দিচ্ছে যে, মানুষ কখনো কখনো এমন কাজ করে বসে যে সম্পর্কে তার কোন অনুভূতি থাকে না। এমন কিছু অদৃশ্য শক্তি আছে যা গোপনে তার মধ্যে কার্যকর রয়েছে এবং তাকে দিয়ে অজান্তে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। প্রাচীনপন্থী মনস্তত্ত্ববিদগণ এটাকে মানসিক অবসন্নতা অথবা মস্তিষ্ক বিকৃতির ফল বলে থাকেন অথবা এটাকে পদস্খলন মনে করেন। কিন্তু বর্তমানকালের বিশেষজ্ঞগণ এটাকে সুপ্ত জ্ঞানের ফল মনে করেন। সাহসিকতার পতন ও যোগ্যতার পরাজয় সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানের বক্তব্য হচ্ছে, এই পরাজয় আমাদের উপর সাধারণভাবেই ক্রিয়াশীল হয় এবং আমাদের ইচ্ছা, সংকল্প ও অনুভূতির উপর বিজয়ী হয়; আমাদেরকে নিজের পছন্দ-অপছন্দের অনুগত অথবা নিজের প্রবৃত্তির গোলাম বানিয়ে দেয়।
নিঃসন্দেহে এমন কিছু আভ্যন্তরীণ অবস্থা রয়েছে যা অজান্তে মানুষের উপর ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে এবং তার ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাকে দুর্বল করে দেয়। খুব সম্ভব এই ধরনের অবস্থা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর উপর ক্রিয়াশীল হয়েছিল, যার ফলে তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে পূর্বোল্লিখিত কথা বলেছিলেন।
কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তাঁর এ কথা প্রত্যাখ্যান করেন। কেননা জীবনের সাধারণ নীতিমালা বা দৈনন্দিন রীতিনীতির ক্ষেত্রে এই ধরনের দুর্বল মুহুর্তগুলোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা যেতে পারে না বা তা বিবেচনা করাও ঠিক নয়। তা অস্থিরতা বা আনন্দের মুহুর্তই হোক না কেন।