৮
রিসালাত
নবুয়াত ও দর্শন
মহান ও উন্নত পর্যায়ের জ্ঞানের কিছু নির্দিষ্ট উৎস রয়েছে যা ছাড়া অন্য কোন উৎসের উপর আস্থা আনা যায় না। যদি মানবীয় জ্ঞান হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা অংকশাস্ত্র অথবা বিজ্ঞানের নির্ধারিত মূলনীতি থেকে গৃহীত হতে হবে। যেমন বর্তমান যুগে আমরা জীবন ও জগতের সাথে সম্পৃক্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে দেখতে পাই, অথবা যে জ্ঞান জড় পদার্থের ধরন ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পৃক্ত অথবা মানবীয় জ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট –তার বেলায় দেখতে পাই।
কিন্তু যদি এই জ্ঞান আধিভৌতিক উপাদানের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকে যা বিজ্ঞান ও অংকশাস্ত্রের আওতা বহির্ভূত, তা হলেও এ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার একটি উপায় আছে। আর তা হচ্ছে আল্লাহর ওহী। এক্ষেত্রে আল্লাহর ওহী ছাড়া আর কিছু কে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে না। এজন্যই আল্লাহর গুণাবলী এবং তাঁর অধিকার সম্পর্কে যত কথাই বলা হোক না কেন –এর মধ্যে কেবল নবী-রসূলদের সূত্র থেকে পাওয়া কথাই আমাদের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে। যদি কোন নবীর সপক্ষে পরিস্কার দলীল-প্রমাণ পাওয়া যায় যা তাঁর সততা প্রমাণ করে –তাহলে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা বিশ্বাসযোগ্য জিনিসের মর্যাদা লাভ করবে এবং এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কোন সুযোগ বাকি থাকবে না।
হাজার হাজার দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক জড় পদার্থ ও আধিভৌতিক পদার্থ সম্পর্কে দীর্ঘকাল ধরে অভিমত ব্যক্ত করে আসছেন। তারা আমাদের জন্য যে মূলধন রেখে গেছেন তা সঠিক ও রুগ্ন এবং শুষ্ক ও আর্দ্রতার সংমিশ্রণ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশেষজ্ঞগণ এ নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পান যে, এর কিছু জিনিস নির্ভুল কিন্তু অবশিষ্ট সবই ভ্রান্ত। নির্বিবাদে বলা যায়, আধিভৌতিক বিষয় বা অতি প্রাকৃতিক ব্যাপার সম্পর্কে যত অভিমত রয়েছে –চাই তা প্রাচীনপন্থীদের হোক অথবা আধুনিকপন্থীনের –তার মধ্যে সত্যতার উপাদান খুবই নগণ্য। কেননা আল্লাহর ওহীর সাথে তার কোন মিল নেই। এর অবস্থা এই যে, তা সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী এবং হাস্যকর বক্তব্যে পরিপূর্ণ।
ইখওয়ানুস সাফা বলেন, “যত নবী-রসূল অতীত হয়ে গেছেন, তাদের পরস্পরের মধ্যে সময়ের যত বড় ব্যবধানই থাক, যুগের ব্যবধানে, ভাষার পার্থক্য, শরীয়াতের পার্থক্য যতই থাক না কেন –তাঁরা মানবজাতির সামনে যে দাওয়াত পেশে করেছিলেন –তা ছিল এক ও অভিন্ন। তাদের প্রাণসত্তা, মন-মানসিকতা ও উদ্দেশ্য –লক্ষ্য ছিল সম্পূর্ণ এক।
“দার্শনিকদের অবস্থা এর চেয়ে ভিন্নতর। তাদের এখানে কোন বিষয়েই ঐকমত্য নেই, তাদের কর্মপন্থা ধর্ম, অভিমত, বক্তব্য সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে বিরোধ। তারা নিজেদের অনুসারীদের এমন অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করে যে, তা থেকে মুক্তি লাভ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার।
“অতএব কোন প্রতিভাবান ব্যক্তি দার্শনিকদের কথাবার্তাকে কি করে অগ্রাধিকার দিতে পার? অথচ তাদের মধ্যেকার মতবিরোধ এত চরমে পৌঁছেছে, যেন মনে হয় একে অপরকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করছে। নবীদের আনীত আসমানী কিতাবসমূহ উপেক্ষা করা এবং এর উপর গভীরভাবে চিন্তাভাবনা না করা তাদের জন্য কি করে সম্ভব হতে পারে? অথচ তার শিক্ষা একই এবং পরস্পরের সাথে এক সূত্রে গ্রথিত।
“অধিকাংশ দার্শনিকের বাস্তব সত্য পর্যন্ত না পৌঁছতে সক্ষম হয়নি”।
আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই হচ্ছে তাদের অবস্থা। জড়বাদী দর্শনের ক্ষেত্রেও তাদের অবস্থা কম শোচনীয় নয়। পরবর্তী কালে বিজ্ঞান যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দেয় এবং অতি সূক্ষভাবে প্রতিটি জিনিস পরখ হতে থাকে, তখন প্রাচীন দর্শন নিজের সমস্ত মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। তার অধিকাংশ দাবি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়।
সত্য কথা এই যে, চিন্তাবিদদের অধিকাশ চিন্তা, দার্শনিকদের অধিকাংশ রায় এবং সাহিত্যিকদের অধিকাংশ বক্তব্যের পেছনে বিশ্বাসের কোন ভিত্তি নেই। এ সবের দৃষ্টান্ত হচ্ছে –যেমন কোন কবি তার কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়ায়। অথচ বলা যায়, এগুলো কতিপয় লোকের আত্মিক অনুভূতি অথবা জীবনের বিভিন্ন বিধান –যা কেবল এভাবেই সমর্থন করা যেতে পারে যে, তা কতিপয় লোকের ব্যক্তিগত ঝোঁক-প্রবণতার সমষ্টি মাত্র। কিন্ত তাকে সাধারণ আকীদা-বিশ্বাস হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে না। মানব মস্তিষ্কপ্রসূত জ্ঞানের এই শাখার ফলাফলের মধ্যে এত মারাত্মক সংঘর্ষ বিদ্যমান রয়েছে যে, এটাকে আমরা এর চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে পারি না।
আমরা যদি ব্রাহ্মণ্যবাদী, খৃষ্টবাদী ও গ্রীক দর্শন অধ্যয়ন করি এবং প্রতিটি যুগে এর মধ্যে যে পরিবর্তন হতে থাকে তার মূল্যায়ন করি, তাহলে এটাকে কোন যুগেই একটি গোপন সত্যের ব্যর্থ অনুসন্ধানের অধিক কিছু মনে করা যায় না। অনেক কাল্পনিক কথা ধরে নেওয়া হয়েছে –বাস্তবতার সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। এ এক অজ্ঞাত ভ্রমণ। তা কোন একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় টিকে থাকতে পারে না। একদিকে দর্শনের এই গোলক ধাঁধা, অন্যদিকে ওহীর সাহায্যে পেশকৃত সুনিদিষ্ট মূলনীতি, পরিস্কার ধ্যান-ধারণা ও উজ্জ্বল আকীদা-বিশ্বাস। তা এত সহজ পন্থায় ও বোধগম্য পেশ করা হয়েছে, যেন ফলিত বিজ্ঞানের বুনিয়াদি মূলনীতি।
আমরা পূর্বে বলে এসেছি, কেবল সেই পার্থিব জ্ঞানই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য –যা হবে বিজ্ঞানসম্মত। অনুরূপভাবে কেবল সেই আধ্যাত্মিক জ্ঞানই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ও মূল্যবান বিবেচিত হবে না যা কোন নবীর মাধ্যমে আমরা লাভ করেছি, যার সত্যতা সম্পর্কে আমরা যেকোন দিক থেকে সুনিশ্চিত। এ সময় তা আমাদের অন্তর ও চিন্তাচেতনায় যে আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বীজ বপন করবে এবং ব্যক্তি ও সমাজকে যে নকশার উপর নির্মাণ করবে –সে ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারব। কেননা আমরা ঈমান এনেছি যে, এই রূহানী জ্ঞান আল্লাহও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে এসেছে এবং আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে যা কিছু আসে তা সবই সত্য। এছাড়া যা কিছু তা সবই অলিক ধারণা-কল্পনা। তা গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে ভিত্তিহীন কল্পনার অনুসারী হওয়া। নিশ্চিত জিনিসকে পরিত্যাগ করে কোন ধারণা-কল্পনার পেছনে ছুটে বেড়ানোর অনুমতি ইসলামে নেই।
(আরবী************************************************************************)
এমন কোন জিনিসের পেছনে লেগে যেও না যে বিষয়ের জ্ঞান তোমার নেই। নিশ্চিত যেন চোখ, কান ও অন্তর সবকিছুর জন্যই জবাবদিহি করতে হবে।–সূরা ইসরাঃ ৩৬
(আরবী***************************************************************************************)
এ ব্যাপারে তাদের কিছুই জানা নেই। তারা নিছক ধারণা-অনুমানের অনুসরণ করছে। আর সত্যের সাথে ধারণা-অনুমানের কোন সম্পর্ক নেই। অতএব যে লোক আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বৈষয়িক জীবন ছাড়া যার আর লক্ষ্য নেই তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দাও। তাদের জ্ঞানের দৌড় শুধু এই পর্যন্তই।–সূরা নাজমঃ ২৮-৩০
ওহী
নবীদের জ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে ওহী। আদম সন্তানদের মধ্যে তাঁরা সবচেয়ে সম্মানিত এবং পূত-পবিত্র মানুষ। ঐশী শক্তি প্রথম থেকেই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাদেরকে মানবীয় স্বভাবের কদর্যতা থেকে সুরক্ষিত রাখে, তাদেরকে উন্নতি ও পূর্ণতার স্তরসমূহ অতিক্রম করার এবং তাদের অন্তরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয় যে, আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতাগণ তাঁর দরবার থেকে যে যে পয়গাম নিয়ে আসেন তা ধারণ করতে তাঁরা সক্ষম হন।
অতএব তাদের মুখ দিয়ে হিকমতে পরিপূর্ণ বাক্য নির্গত হয় এবং তাদের কাজকর্মের মধ্য দিয়ে উত্তম আদর্শের নমুনা ফুটে উঠে। কথা হোক, চিন্তা-চেতনা হোক সবকিছুর মধ্য দিয়ে পবিত্রতার আবে কাওসার প্রবাহিত হয়।
যে ওহীর বদৌলতে আম্বিয়ায়ে কিরামের অন্তর জ্ঞান ও মারিফাতের আলোকচ্ছটায় চকচক করে থাকে তার বিভিন্ন শ্রেণী এবং বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে তাদেরকে সত্য স্বপ্ন দেখানো হয়। সাধারণ মানুষের স্বপ্নের মত নবীদের স্বপ্নের মধ্যে অস্থিরতার কোন চিহ্ন দেখানো থাকে না। সাধারণ মানুষ অর্থহীন ও অপবিত্র স্বপ্নও দেখে থাকে। মানবীয় পূর্ণতার দিক থেকে নবীগণ এত উন্নত পর্যায়ে অবস্থান করেন যে, তাদের দেহ ঘুমিয়ে পড়লেও হৃদয় সদা জাগ্রত থাকে। তাদের অন্তর খবর গ্রহণ করার জন্য টেলিপ্রিন্টারের মত সব সময় সজাগ ও সতর্ক থাকে। ফেরেশতা যা কিছু ঢেলে দেয় তাদের অন্তরে তা তাঁরা ধারণ করে নেন এবং সাথে সাথে মানুষের মধ্যে প্রচার করে দেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামও প্রাথমিক পর্যায়ে সত্য স্বপ্ন দেখতেনঃ
(আরবী*****************************************************************************************)
প্রথম দিকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের উপর যে ওহী আসত তা ছিল স্বপ্নের আকারে। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের শুভ্র রেখার মত প্রতীয়মান হয়ে সামনে আসত।–বুখারী
জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত হৃদয় আল্লাহর সাথে সংযুক্ত ছিল, শোয়া এবং জাগ্রত অবস্থায় এর মধ্যে কোন বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হত না, আল্লাহর অনুগ্রহ ও শান্তি তাঁকে সর্বদা ঢেকে রেখেছিল। হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে যবেহ করার জন্য হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম যে নির্দেশ লাভ করেন তা ওহীর মাধ্যমে এবং স্বপ্নবিষ্ট অবস্থায় লাভ করেন।
(আরবী**************************************************************************************)
সেই ছেলেটি যখন তার সাথে দৌড়াদৌড়ি করার বয়স পর্যন্ত পৌঁছল তখন (একদিন) ইবরাহীম তাকে বলল, হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তুমি বল, তোমার কি মত? সে বলল, আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা পালন করুন। ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।–সূরা সাফফাতঃ ১০২
অবশ্য বেশীর ভাগ ওহীই ইলহামের আকারে এসে থাকে। জাগ্রত অবস্থায় ফেরেশতা ওহী নিয়ে আসে, নবীর কলবে ইলহাম করে, অন্তর তা সংরক্ষণ করে এবং মুখে তার প্রকাশ ঘটে। হাদীসসমূহে এ ধরনের ইলহামের বহু উদাহরণ রয়েছে। কখনো তাতে মাধ্যমেরও উল্লেখ থাকে। যেমন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী*****************************************************************************************)
রব্বুল আলামীনের বার্তাবাহক জিবরাঈল আমার হৃদয়ে এই ইলহাম করেছেন যে, কোন ব্যক্তি তার বরাদ্দের রিযিক পেতে কখনো বিলম্ব হতে থাকলে আল্লাহর নাফরমানী লিপ্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাক এবং তা অর্জনের জন্য উত্তম ও পছন্দনীয় পন্থা অবলম্বন কর।–[ইবনে মাজার কিতাবুল বুয়ুতে অনুরূপ বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি হাদীস রয়েছে।]
আবার কখনো কখনো ফেরেশতার নাম উল্লেখ থাকে না, শুধু হাদীস বর্ণনা করে দেওয়া হয়। যেমন আমরা অন্যান্য রিওয়ায়াতে দেখতে পাই। কুরআনও নিজের শব্দ ভাণ্ডারসহ ওহীর আকারে নাযিল হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি এমন জ্ঞান লাভ করলেন যা তিনি জানতেন না। এতে জিবরাঈলের কোন দখল নেই। শুধু এতটুকু যে, তিনি আল্লাহর দরবার থেকে তা নিয়ে এসে রসুলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে পৌঁছে দিতেন।
(আরবী*********************************************************************************)
এটা নিয়ে তোমার কলবে আমানতদার রূহ নাযিল হয়েছে, যেন তুমি সেই লোকদের মধ্যে শামিল হতে পার, যার (আল্লাহর পক্ষ থেকে সব মানুষের জন্য) সাবধানকারী, স্পষ্ট ও পরিস্কার আরবী ভাষার।–সূরা শুআরাঃ ১৯৩
আবার কখনো ওহীর ধরন এরূপ হয় যে, আল্লাহ তায়ালা সরাসরি কথা বলে, মাঝখানে কোন মাধ্যম থাকে না। যেমন হযরত মুসা আলায়হিস সালামের সাথে কথা হয়েছিলঃ
(আরবী**********************************************************************************)
সে যখন সেখানে পৌঁছল, প্রান্তরের ডান কিনারে অবস্থিত পবিত্র ভূখণ্ডে একটি গাছের আড়াল থেকে আওয়াজ উঠলঃ হে মুসা! আমি আল্লাহ সমগ্র বিশ্বের মালিক। তুমি নিজের লাঠি নিক্ষেপ কর।–সূরা কাসাসঃ ৩০-৩১
মিরাজ রজনীতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামও এই বিরল সম্মান লাভ করেন। একদল আলেমেরও এই মত। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীদের সাথে যে কথাবার্তা বলেন তার ধরন ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
এর ধরণ আমাদের পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তা বলার ধরনের মত মোটেই নয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা এদিকে ইঙ্গিত করেছেন।
(আরবী***************************************************************************************)
কোন মানুষের মর্যাদা এই নয় যে, আল্লাহ তার সাথে সামনাসামনি কথা বলবেন। হয় তাঁর কথা ওহী (ইশারা)-রূপে হয়ে থাকে, অথবা তিনি কোন পয়গাম বাহক পাঠান এবং সে তাঁর নির্দেশে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী ওহী করে। তিনি মাহন ও সুবিজ্ঞানী। আর এভাবে আমরা আমাদের প্রাণ সঞ্চাকারী নির্দেশের ওহী তোমার কাছে পাঠিয়েছি। তুমি কিছুই জানতে না কিতাব কাকে বলে এবং ঈমান কি জিনিস।–সূরা শূরাঃ ৫১-৫২
ওহী এমন কোন জিনিস নয় যা জ্ঞানের পক্ষে অবোধগম্য এবং যা অনুধাবন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে জড়বাদীদের যে সংশয় সন্দেহ রয়েছে তা স্বয়ং ধূলোবালির মত উড়ে যায় –যদি আমরা বিম্বাস করি যে, আল্লাহ তায়ালা বর্তমান রয়েছেন, তাঁর অস্তিত্ব সংশয়-সন্দেহের ঊর্ধ্বে এবং তাঁর পূর্ণ অধিকার রয়েছে যে, তিনি নিজের কতিপয় বান্দাকে মানবজাতির কাছে তাঁর ওহী পৌঁছে দেওয়ার জন্য বেছে নিতে পারেন, যারা তাঁর প্রতি বিদ্রোহী তাদের সঠিক পথ দেখাবেন এবং অন্ধকার থেকে বের করে আলোর মধ্যে নিয়ে আসবেন।
এই পৃথিবী একান্তভাবেই নবী-রাসূলদের মুখাপেক্ষী। মানবীয় চিন্তার সংকটকে যদি মানবীয় গবেষণা ও অনুসন্ধানের উপর ছেড়ে দেওয়া হত তাহলে মানুষ হেদায়েতের পথ থেকে বঞ্চিত থেকে যেত। তারা কখনো এমন একটি সত্যের উপর একত্র হতে পারত না, যা তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনকে পরিপাটি করতে পারে। আমরা যখন দুনিয়ার প্রাচীন ও বর্তমান ইতিহাস অধ্যয়ন করি তখন নবীদের আনীত শিক্ষা ছাড়া এমন কোন জিনিস আমাদের নজরে পড়ে না, যার আঁচলে মানুষ আশ্রয় নিতে পারে অথবা যার ছত্রছায়ায় কল্যাণ ও বরকত তালাশ করতে পারে।
নবীদের শিক্ষার এমন কিছু অংশ রয়েছে যার আবিস্কার মানববুদ্ধির কক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব। কেবল জ্ঞানবুদ্ধি তার দ্বারোদঘাটন করতে পারে না। তাদের শিক্ষার আর কিছু অংশ আছে –যে পর্যন্ত মানবজ্ঞান পৌঁছতে পারে বটে, কিন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতার এক সুদীর্ঘ সময় অতিক্রম করার পর। অতঃপর মানবমস্তিষ্ক প্রসূত জ্ঞান যতটুকু আবিস্কার করতে পারে তা অস্পষ্টতার পর্যায়েই থেকে যায়। আমরা যা কিছু চিন্তা করি তার মধ্যে যথেষ্ট ত্রুটি থেকে যায়। সর্বত্রই এর মধ্যে অপূর্ণতা ও দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়।
আমি মনে করি যদি আমাদের কাছে রসুল না আসতেন, তাঁরা যদি আমাদেরকে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত না করতেন তাহলে আমরা নিজেরাই এই মহান সত্তার অনুসন্ধান করতাম এবং এই বিশ্বের সম্পর্কের উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করতাম। সুষ্ঠু চিন্তা ও সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী লোকেরা নিশ্চিতই এই সত্যে উপনীত হয়ে যেত যে, এই বিশ্ব ধারণা-কল্পনা এবং অনুমান ও খেয়ালের সৃষ্টি নয়, এই বিশ্বব্যবস্থা আপনাআপনিই এভাবে চলছে না। নিশ্চিতই এ মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা রয়েছেন যিনি গোটা সৃষ্টিলোকের উৎস। এক মহান শক্তি এই বিশ্বব্যবস্থা পরিচালনা করছেন।
কিন্তু এই নির্ভুল চিন্তার মর্যাদা নড়বড়ে ও অনুমিতির পর্যায়েই থেকে যেত। ভিন্নমত ও নাস্তিক্যবাদী দর্শন খুব সহজেই তাকে নিজের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারত। যদিও বা এই চিন্তাধারা স্বস্থানে অবিচল থাকত তাহলে ওহী না আসা অবস্থায় তার মর্যাদা ধারণ-অনুমানের অধিক কিছু হত না। এর মধ্যে হক ও বাতিলের সংমিশ্রণ থাকত।
এ কারণে নবী-রাসূলদের আগমন অবশ্যম্ভাবী ছিল। যেন মানুষ আলোকোজ্জ্বল পথ খুঁজে পেতে পারে এবং তাকে যেন হতবুদ্ধি হয়ে ভয়ংকর পথে ঘুরে বেড়াতে না হয়। অতএব নবী-রসুলগণ ও অন্তর ও চিন্তার পরিশুদ্ধি ঘটানোর ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ব পূর্ণরূপে আদায় করেছেন এবং অনাগত মানব সভ্যতার জন্য তাঁরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার নিগূঢ় সত্যকে অত্যন্ত সহজ ও সজীব অবস্থায় রেখে গেছেন। তাদের পবিত্র হাতে এই সত্যকে লাভ করার পর আর মানসিক অবসন্নতা কখনো অনুভূত হবে না –যা দার্শনিকদের চিন্তার অবশ্যম্ভাবীরূপে অনুভূত হয়ে থাকে যখন তারা আল্লহার অস্তিত্বের রহস্য সম্পর্কে আলোচনায় লিপ্ত হন।
নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আমরা যেভাবে আল্লাহর উপর ঈমান আনার ব্যাপারটি বিশদভাবে জানতে পেরেছি, অনুরূপভাবে আখেরাতের উপর ঈমান আনার শিক্ষাও তাদের কাছ থেকে লাভ করেছি। আখেরাতে মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের যে হিসাব-নিকাশ এবং শাস্তি অথবা পুরস্কার দেওয়া হবে –সে সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করতে পেরেছি। যদি ওহী না আসত তাহলে আমাদের জ্ঞানের পক্ষে এই কোলাহলপূর্ণ পৃথিবীর সর্বশেষ মনযিল খুঁজে বের করা কখনো সম্ভব হত না।
হাঁ, মানুষ এটা মেনে নিতে অস্বীকার করতে পারে যে, এই পার্থিব জীবনই সবকিছু। বিশেষ করে যখন তারা দেখতে পায় যে, এখঅনে কেউই পূর্ণ প্রতিদান লাভ করতে পারছে না অথবা অপরাধের শাস্তি ভোগ করছে না। কত নেককার ও বদকার লোক মরে যাচ্ছে। নেককার লোকেরা তাদের পুরস্কার পাচ্ছে না এবং বদকার লোকেরাও তাদের শাস্তি ভোগ করছে না। কত যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হচ্ছে যাতে হয়ত বাতিলপন্থীরা বিজয়ী হচ্ছে এবং হকপন্থীরা মার খেয়ে যাচ্ছে।
দুনিয়াতে প্রতিদান শাস্তির দাঁড়িপাল্লা সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। ফলে মনের মধ্যে আশার সৃষ্টি হয় যে, অবশ্যই কখনো এমন একটি দিন আসবে যখন পূর্ণ ইনসাফ পাওয়া যাবে এবং আদলের সমস্ত দাবি পূরা করা হবে। স্বয়ং বিশ্বপ্রকৃতি যে সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করে তাও মানুষের মধ্যে আখেরাতের অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং মানুষ তার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে বিভিন্নভাবে আখেরাতের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
এটা কেবল আসমানী নবুয়াতেরই অবদান যে, আখেরাত ও মৃত্যুর পর পুনর্জীবন সম্পর্কে যত সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করা যায় এবং যেতে পারে, নবুয়াত তার সবকিছুরই মূলোচ্ছেদ করে দিয়েছে এবং এই জীবনের পর মানুষকে যেসব পর্যায় ও স্তর অতিক্রম করতে হবে সে সম্পর্কেও নবুয়াত তাদেরকে পূর্ণরূপে অবহিত করেছে।
নবী-রসূলদের দায়িত্ব কেবল এতটুকুই ছিল না যে, তাঁরা মানবজাতিকে জীবনের মূলনীতি অনুযায়ী তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়াও তাঁদের অন্যতম দায়িত্ব। প্রশিক্ষণ এমন কোন জিনিস নয় যা বই-পুস্তকে পাওয়া যেতে পারে। মন-মগজে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সারবস্তু পুঞ্জীভূত হওয়ার নাম প্রশিক্ষণ নয়। অথবা সামরিক বিধানের জিঞ্জিরে জীবনকে শক্ত করে বেঁধে দেওয়ার নামও প্রশিক্ষণ নয়, বরং নবী রসুলগণ মানবজাতিকে জীবনযাপনের সে পদ্ধতি হাতে কলমে শিখিয়েছেন, যার মাধ্যমে তাঁরা মানবেতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করেছেন –এখানে প্রশিক্ষণ বলতে তাই বোঝানো হচ্ছে। মানুষের মনে যখন অত্যন্ত গভীর পরিবর্তন সূচিত হয় তখনই এই প্রশিক্ষণ কার্যকর হয়। এটা এমনই পরিবর্তন যেন মাটির মধ্যে রূহ ফুঁকে দেওয়া হল।
জাহিলী যুগের সেই লম্পট ও উদ্ধত রূহগুলো –যাদের জীবনটা নরহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে পরিব্যপ্ত ছিল, দেখতে তা আল্লহার দাসত্বের জীবন্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়াল। তারা নিজেদের জানমাল এবং সন্তানদের আল্লাহর সাথে কোরবানী করে দেওয়ার মধ্যে গৌরব বোধ করতে লাগল। এমনটা কি করে সম্ভব হল? এটা নবুয়াতের জীবন্ত প্রশ্বাসেরই অবদান। এটা রিসালাতের প্রাণ সঞ্চারকে জীবন কাঠিরই স্পর্শ। এই কাঠি তাদের নীতি নৈতিকতার মৃত কাঠামোর মধ্যে রূহ ফুঁকে দিল এবং তা জীবন ও জনগণের বিহবল হয়ে গেল।
ব্যক্তি ও সমাজকে পথ প্রদর্শন করা এবং যেকোন দিক থেকে নসীহত করা ও কল্যাণের দিকে পরিচালিত করা রাসূলদের দায়িত্ব। সুতরাং তাঁরা মলিন ও অপবিত্র অন্তরসমূহকে নবুয়াতের ঝর্ণাধারার ধৌত করে তাকে পরিচ্ছন্ন করেন এবং নিজেদের নূরের আলোকে নির্বাপিত চিন্তায় চেতনার বিজলী ছড়িয়ে দেন। এভাবে আলোকিত হয়ে তা অন্যদের জন্যও আলো হিদায়াতের সুউচ্চ মিনারে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে নবী রাসূলদের এতটা পূর্ণতা দান করা হয় যে, কেউ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার সাহস পায় না। দর্শন যতটা পূর্ণতা ও উন্নতি লাভ করুক না কেন তা এই পথে কয়েক বিঘতও সামনে অগ্রসর হতে পারে না, পথিমধ্যেই হোঁচট খেয়ে যায়।
নবী-রাসুলগণ মাসুম (নিষ্পাপ)
নবী-রাসূলদের জীবনযাত্রা সব সময়ই উচ্চতার চরম শিখরে উন্নীত থাকে। সেখান থেকে তা কখনো নিম্নগামী হয় না।
একজন সাধারণ মুমিনের ঈমানের উষ্ণতা অনবরত হ্রাস-বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার উন্নতির সর্বশেষ পর্যায় হচ্ছে ‘ইহসান’। এখান পর্যন্ত পৌঁছে তার উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ইহসানের অর্থ এই যে, “তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। যদিও তুমি তাঁকে না দেখছ, তাহলে তিনি তোমাকে দেখছেন”।–বুখারী, মুসলিম
(আরবী************************************************************************************)
কিন্তু এই ইহসান যা মানুষের উন্নতির সর্বশেষ মনযিল, যেখানে অনেক প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও কঠিন শ্রম-সাধনার পর পৌঁছতে পারে –এখান থেকেই নবীদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। অর্থাৎ ইহসান হচ্ছে নবীদের উচ্চতার শিখরে আরোহণ করার সূচনা বিন্দু। অতঃপর তাঁরা নিজেদের সেই বিশিষ্ট ও স্থায়ী আসনে পৌঁছে যান, যার নিম্ন পর্যায়ে তাঁরা কখনো নেমে আসেন না। অতঃপর আল্লাহর সাথে তাদের যে উচ্চতম-উন্নততম সম্পর্ক স্থাপিত হয় তার জ্ঞান আল্লাহর কাছেই রয়েছে। এ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। এর রহস্য উদঘাটন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
আল্লাহ তায়ালা যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই চূড়ান্তভাবে মাসুম, নিষ্পাপ। এ ব্যাপারে গোটা মুসলিম উম্মাতের ঐকমত্য রয়েছে। তাদের দ্বারা কখনো কোন কবীরা গুনাহ সংঘটিত হয়নি। কেননা এটা তাদের পদমর্যাদার পরিপন্থী। নবুয়াত প্রাপ্তির পূর্বেও কোন কবীরা গুনাহ প্রকাশ পায়নি এবং পরেও সংঘটিত হয়নি। তাদের দ্বারা এমন কোন সগীরা গুনাহও সংঘটিত হয়নি যার কারণে তাদের ব্যক্তিত্বে কোনরূপ আঁচড় লাগতে পারে অথবা তাদের বিশ্বস্ততা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তবে এটা নিঃসন্দেহ যে, কখনো কখনো তাদের ভুলভ্রান্তি হয়েছে। কিন্তু সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে এবং তাঁরা সঠিক পথে এসেছেন। অনন্তর এই ভুলভ্রান্তি আকীদাগত এবং নৈতিক বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না। এজন্য তাদের ইসমাতের বৈশিষ্ট্যের উপর তা কোন দাগ ফেলতে পারে না। বরং এসব ভুলভ্রান্তি পার্থিব ব্যাপার ও জাতীয় সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। এসব ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য হওয়াটা কোন আশ্চর্যের ব্যাপার নয়।
কখনো কখনো নবীদের উপর আল্লাহ-ভীতির তীব্রতা প্রকট হয়ে উঠে। তাঁরা আল্লাহর অধিকার যথাযথভাবে আদায় করার ব্যাপারে নিজেদের অপারগ মনে করেন। কেননা সাধারণ লোকদের তুলনায় তাঁরা আল্লাহ সম্পর্কে অধিক বেশী অবহিত। আল্লহার মহত্ব, তাঁর মহিমা, তাঁর মর্যাদা এবং তাঁর অধিকার সম্পর্কে তাঁরা অধিক জ্ঞাত। তাঁরা সব সময়ই অনুভব করেন, কোন ব্যক্তি আল্লহার রাস্তায় যত শ্রম-সাধনা করুক না কেন, তাঁর অধিকার পূর্ণরূপে আদায় করতে সক্ষম নয়।
অতএব নবী-রসূলগণ যদি এই অনুভূতির প্রভাবে ব্যাকুল হয়ে পড়েন এবং অধিক পরিমাণে তওবা ও ইসতিগফার করতে থাকেন তাহলে তার অর্থ এই নয় যে, তাঁরা আমাদের মত ভুলভ্রান্তি করে থাকেন এবং আমাদের মতই গুনাহে লিপ্ত হন। যদি কোন আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে এরূপ ধারণা হয়ে থাকে তাহলে মনে করতে হবে, এটা বোধশক্তিরই ত্রুটি এবং ভিত্তিহীন ধারণা মাত্র। এর সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই।
মুজিযা
যদি কোন ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর নবী বলে দাবি করে, তাহলে তাকে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, তার দাবির সপক্ষে তার কাছে কি প্রমাণ আছে? কিভাবে তার দাবি আমরা সত্য বলে মেনে নিতে পারি? সে যদি তার দাবির সপক্ষে কোন সন্তোষজনক প্রমাণ পেশ করতে পারে তাহলে লোকদের দায়িত্ব হচ্ছে তাঁকে রসূল বলে মেনে নেওয়া এবং তার কথা মনোযোগ সহকারে শোনা। সামূদ জাতির কাছে হযরত সালেহ আলায়হিস সালাম এসে দাবি করলেন যে, তিনি আল্লাহর নবী; অতঃপর তিনি তাদের ভালভাবে বোঝালেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। যেসব লোক যমীনের বুকে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং সংশোধন করা হয় না –এই ধরনের সীমালংঘনকারীদের অনুসরণ করো না।–সূরা শুআরাঃ ১৫০-১৫২
কিন্তু সামুদ জাতির লোকেরা এই উপদেশে কর্ণপাত করল না। তারা হযরত সালেহ আলায়হিস সালামের কাছে তাঁর নবুয়াতের সপক্ষে প্রমাণ দাবি করল। কুরআন মজীদের ভাষায়ঃ
(আরবী****************************************************************************)
তারা জববা দিল, তুমি নিছক একজন যাদুগ্রস্ত ব্যক্তি। তুমি আমাদেরই মত একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নও। তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক তাহলে কোন নিদর্শন পেশ কর। সালেহ বলল, এই উষ্ট্রী –পালাক্রমে একদিন এর পানি পান করার জন্য নির্দিষ্ট এবং একদিন তোমাদের সকলের পানি নেবার জন্য নির্দিষ্ট। একে তোমরা কখনো উত্যক্ত করো না। অন্যথায় এক ভয়ংকর দিনের শাস্তি তোমাদের পাকড়াও করবে।–সূরা শুআরাঃ ১৫৩-১৫৬
সামুদ জাতির এই দাবি অসঙ্গত ছিল না। তাদের দাবি মেনে নেয়া হয়েছিল এবং একটি উষ্ট্রী নিদর্শন হিসাবে উপস্থিত হয়ে গেল। এই উষ্ট্রী যেভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছিল এবং এটা যেভাবে চলাফেরা করত তা তাদের জন্য ছিল এক অলৌকিক ব্যাপার। তার অবয়ব ও দৈহিক গঠনই বলে দিত যে, এটা একান্তই আল্লাহর কুদরতের এক অতুলনীয় নিদর্শন। তা কোন মানবীয় প্রতারণা অথবা মানবীয় শক্তির নিদর্শন নয়।
এ ধরনের প্রমাণ থেকে এ কথা পরিস্কার হয়ে যায় –যে ব্যক্তি কথা বলছে সে ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলছে। সে নিজের ব্যক্তিগত কথা বলছে না, বরং বিশ্বপ্রভুর প্রতিনিধিত্ব করছে। অতএব সে সীমিত মানবীয় শক্তির ব্যবহার করছে না, বরং মহান আল্লাহর অসীম কুদরতের নিদর্শন পেশ করছে। ফিরাউন যখন মুসা আলায়হিস সালামের রিসালাতের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তাঁকে শাস্তির হুমকি দিচ্ছিল, তখন তিনিও এ ধরনের দলীল পেশ করেছিলেনঃ
(আরবী***************************************************************************)
ফিরাউন বলল, তুমি যদি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে মাবুদ মেনে নাও তবে তোমাকেও সেই লোকদের মধ্যে গণ্য করব, যারা জেলখানায় বন্দী অবস্থায় আছে। মূসা বলল, আমি যদি তোমার সামনে এক সুস্পষ্ট জিনিস নিয়ে এসে থাকি তাহলেও? ফিরাউন বলল, আচ্ছা তাহলে তুমি তা নিয়ে এসে উপস্থিত কর, যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাক। মূসা নিজের লাঠি নিক্ষেপ করল এবং সহসাই একটা সুস্পষ্ট অজগর সাপে পরিণত হল। পরে সে নিজের হাত (বগলের মাঝখান থেকে) টেনে বের করল, তা সব দর্শকের সামনে ঝকমক করছিল।–সূরা শুআরাঃ ২৯-৩৩
হযরত ঈসা আলায়হিস সালামও যখন বনী ইসরাঈলদের কাছে আসেন এবং নবুয়াতের দাবি পেশ করেন তখন তার সপক্ষে প্রমাণও পেশ করেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
আমি তোমাদের সামনেই মাটি দিয়ে একটি পাখিবৎ জিনিস তৈরি করি এবং তাঁতে ফুঁক দেই, তা আল্লহার নির্দেশে পাখি হয়ে যায়। আমি আল্লাহর হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে ভাল করে দেই এবং মৃতকে জীবন্ত করি। তোমরা নিজেদের ঘরে কি খাও এবং সঞ্চয় কর –আমি তাও তোমাদের বলে দিতে পারি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য যথেষ্ট নিদর্শন রয়েছে –যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক।–সূরা আল ইমরানঃ ৪৯
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, অনেক জাতি সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখার পরও হককে কবুল করেনি। তারা নবীদের রিসালাতকে মেনে নেয়নি। তার কারণ এই নয় যে, উপস্থাপিত নিদর্শনসমূহের মধ্যে কোন ত্রুটি ছিল, বরং শুধু জেদ এবং হঠকারিতাই ছিল এর প্রতিবন্ধক। মহান আল্লাহর বাণীঃ
(আরভী**************************************************************)
যারা বলে, আল্লাহ আমাদের এই নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা কোন ব্যক্তিকে রাসূল বলে মেনে নেব না –যতক্ষণ না সে আমাদের সামনে একটি কোরবানী পেশ না করবে –যা (অদৃশ্য হতে) আগুন এসে খেয়ে ফেলবে। তাদের বল, তোমাদের কাছে পূর্বে আমার অনেক রাসূলই এসেছে, তারা বহু উজ্জ্বল নিদর্শনও এনেছিল এবং তোমরা যে নিদর্শনের কথা বলছ তাও তাঁরা এনেছিল। এতদসত্ত্বেও (ঈমান আনার জন্য এই শর্ত আরোপ করার ব্যাপারে) তোমরা যদি সত্যবাদী ও নিষ্ঠাবান হতে তাহলে সেই রসুলদের তোমরা কেন হত্যা করলে? –সূরা আল ইমরানঃ ১৮৩
কোন দাবি সত্য হওয়ার জন্য কখনো তার সপক্ষে বাইরের প্রমাণ বর্তমান থাকে, আবার কখনো সেই দাবিই তার তাৎপর্যেরদিক থেকে নিজের সপক্ষে দলীল হয়ে থাকে। এক ব্যক্তি দাবি করছে যে, সে একজন প্রকৌশলী। সে তার দাবির সপক্ষে এই প্রমাণ পেশ করছে যে, সে পানির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারে বা শূন্যলোকে উড়তে পারে। সে যদি তা করে দেখাতে পারে তাহলে আমরা তাকে প্রকৌশলী বলে মেনে নেই। আবার কখনো সে বলে, আমি খুব মজবুত দালান নির্মাণ করতে পারি অথবা নদীর উপর একটা সুন্দর সেতু নির্মাণ করে দিতে পারি। যদি সে তা করে দেখাতে পারে, তাহলে আমরা তাকে একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী হিসাবে মেনে নিই।
বলতে গেলে পূর্বোল্লেখিত অলৌকিক দলিলসমূহের তুলনায় এই প্রমাণগুলোকে অধিক সফল ও সন্তোষজনক বলতে হয়।
আল্লামা ইবনে রুশদ (রহ) বলেন, “নিঃসন্দেহে কুরআন তার বাহকের নবুয়াতের সপক্ষে এক শক্তিশালী দলিল। কিন্তু তার রয়েছে একটা ভিন্নতর ধরন। লাঠি অজগর সাপে পরিণত হওয়া, মৃতের জীবিত হওয়া অথবা রুগ্নদের সুস্থ করে তোলার মধ্যে যে বিশিষ্টতা রয়েছে তা কুরআনের মধ্যে নেই। কেননা এসব অলৌকিক ব্যাপারে যদিও নবীদের মাধ্যমেই প্রকাশ পেতে পারে এবং সাধারণ লোকদের কুপোকাত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু নবুয়াতের কার্যাবলী শরী’আতের প্রাণসত্তা এবং ওহীর উদ্দেশ্যের সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকে না।
কুরআনের ব্যাপারটি এই যে, তা নবুয়াতের বৈশিষ্ট্য এবং দীনের বাস্তব সত্যের ইঙ্গিতবহ, যেমন রোগীর সুস্থতা ডাক্তারের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার দিকে ইঙ্গিত করে। এর দৃষ্টান্ত এই যে, দুই ব্যক্তি নিজেদের ডাক্তার বলে দাবি করল। একজন বলল, আমার দাবির সপক্ষে দলীল এই যে, আমি বাতাসে ভর করে উড়তে পারি। অপরজন বলল, আমি রোগের চিকিৎসা জানি এবং রোগীকে সুস্থ করে তুলতে পারি। অতএব এদের মধ্যে যে ক্যক্তি রোগীকে সুস্থ করে তুলতে পারবে তার ডাক্তার হওয়ার ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারব। আর অপর ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা এতটুকুই বলতে পারি যে, আমরা তার দাবি মেনে নিলাম।
অনুরূপভাবে মুজিযা কখনো মূল নবুয়াতের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, আবার কখনো মূল নবুয়াতের সাথে এর কোন সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। অনন্তর যুগ ও পরিবেশের দিক থেকে এসব মুজিযার মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধানও থাকতে পারে। পূর্বকালের মুজিযাসমূহ ছিল জড় প্রকৃতির বা বস্তুভিত্তিক। দীনের মদ্যে যে নিগূঢ় সত্য লুক্কায়িত ছিল তা দ্বিতীয় স্তরের মর্যাদা পেত। কিন্তু ইসলাম আসার পর সে জড় প্রকৃতির মুজিযাসমূহের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। সে বুদ্ধিবৃত্তিক মুজিযা ও নবুয়াতের তাৎপর্যগত মূল্যবোধকে উদ্ভাসিত করে তোলে।
ইসলাম পরিস্কার করে তুলে ধরেছে যে, পূর্ববর্তী যুগে দীনে হকের সমর্থনে যেসব মুজিযা পেশ করা হয়েছিল তা স্বচক্ষে দেখার পরও লোকেরা আল্লাহর দীন এবং তাঁর রসুলদের মিথ্যা সাব্যস্ত করা থেকে বিরত থাকেনি। আজো যদি সেই ধরনের মুজিযা পেশ করা হয়, তাহলে এর প্রভাবের মধ্যে কি কোন পার্থক্য সূচিত হবে? অতীতে যদি এই মুজিযা কাফেরদের মধ্যে ঈমানের আকাংখা সৃষ্টি করতে না পেরে থাকে তাহলে আজ তার মাধ্যমে এই আকাংখা কি করে সৃষ্টি হতে পারে?
(আরবী***************************************************************************************)
আর নিদর্শন পাঠাতে আমাকে কেউই নিষেধ করেনি। তবে শুধু এ কারণেই পাঠাইনি যে, এদের পূর্বেকার লোকেরা তা মিথ্যা মনে করে অমান্য করেছে। সামুদকে আমরা প্রকাশ্য উষ্ট্রী এনে দিলাম, আর তারা এর প্রতি অত্যাচার করল। আমরা নিদর্শন তো এজন্যই পাঠাই যে, লোকেরা তা দেখে ভয় পাবে।–সূরা ইসরাঃ ৫৯
এজন্যই নবুয়াত ও রিসালাতের সাহায্য-সমর্থনের জন্য ভিন্নতর পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে।
পূর্ববর্তী নবুয়াত এবং সর্বশেষ নবুয়াতের মুজিযা
আল্লাহতাআলার এই নিয়ম চলে আসছিল যে, তিনি প্রকাশ্য মুজিযার মাধ্যমে তাঁর নবীদের সাহায্য করেছেন। তিনি তাঁদের হাতে এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছেন যা দৃষ্টিশক্তিকে আকর্ষন করতে পারে, হৃদয়কে ঝুঁকিয়ে দিতে পারে এবং স্বভাব প্রকৃতির মধ্যে প্রত্যয়, শান্তি ও দৃঢ়তা সৃষ্টি করতে পারে। পূর্ববর্তী যুগের নবীগণ যে নবুয়াতের সুসংবাদ শোনাতেন এবং যে সত্যের দিকে দাওয়াত দিতেন, তাদের মুজিযাসমূহ এর চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির ছিল।
যেমন, ঈসা আলায়হিস সালামের নিরাময় ব্যবস্থা এমন একটি জিনিস, যার সাথে ইনজীলের কোন সম্পর্ক ছিল না। আবার মূসা আলায়হিস সালামের লাঠি এমন এক মুজিযা, যার সাথে তাওরাতের কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা হল সর্বশেষ নবুয়াতের মুজিযা এমন এক জিনিস হবে যা নবুয়াতের সৌন্দর্য থেকে ভিন্নতর হবে না।
সুতরাং একই কিতাব যার মধ্যে নবুয়াতের সত্যতাও রয়েছে এবং এই সভ্যতার সমর্থনে প্রমাণও রয়েছে। এই দীনের মূলনীতি এবং এই দাওয়াতের ধরনকেই আল্লাহ তায়ালা রিসালাতের দাবির সবচেয়ে বড় প্রমাণ এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সত্যবাদিতার সর্বশ্রেষ্ঠ সনদ আখ্যা দিয়েছেন। কুরআন মজীদের আয়াতগুলোই –যা নৈতিক, সামাজিক রাজনৈতিক যাবতীয় প্রকারের আইনের সমষ্টি এবং যা স্বভাব প্রকৃতিকে উন্নত প্রশিক্ষণ দান করে, তাকে উত্তম চরিত্র ও ভাল কাজের ছাঁচে ঢালাই করে –একাধারে ইসলামের শিক্ষা, পয়গাম ও মুজিযা।
এসব আয়াতের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, তার মধ্যে মানব প্রকৃতি জীবনের প্রশস্ততা ও ব্যাপকতা লাভ করে, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এর পরিচ্ছন্ন ও খোলামেলা পরিবেশ মানব প্রকৃতি শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে। তা একথাই প্রমাণ করে যে, কুরআন মজীদ একটি স্বভাবসুলভ কিতাব, তার বাহক নবী একজনই পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ মানুষ এবং ইসলামের শিক্ষা তাঁর বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে মানব প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল।
কুরআন মজীদ সব সময়ই সরাসরি মানবজ্ঞান ও তার বিবেককে সম্বোধন করে। সে তাকে জিঞ্জিরমুক্ত করে এবং তার হারানো আস্থা তাকে ফেরত দেয়। সে বারবার একথার উপর জোর দিয়েছে যে, যারা বুদ্ধি-বিবেকের অধিকারী তারাই এটা বুঝতে পারে এবং এর দাবি ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে। মহান আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী********************************************************************************)
যে ব্যক্তি জানে যে, তোমার উপর যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তা সত্য, সে কি অন্ধ ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে? উপদেশ তো বুদ্ধিমান লোকেরাই কবুল করতে থাকে।–সূরা রাদঃ ১৯
কেবল এই বুদ্ধিমান লোকেরা জীবন ও জগতের ইঙ্গিত এবং বিশ্ব প্রকৃতির রহস্য অনুধাবন করতে সক্ষম।
(আরবী**************************************************************************)
আসমান ও জমীনের সৃষ্টি এবং রাত-দিনের আবর্তনের মধ্যে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে।–সূরা আল ইমরানঃ ১৯০
যত দিন জ্ঞান-বুদ্ধির মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকবে, এসব মুজিযার মর্যাদা ও মূল্য ততদিন অবশিষ্ট থাকবে। যতদিন জ্ঞানবুদ্ধি জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও মূল্যবান সম্পদ বিবেচিত হতে থাকবে ততদিন এই মুজিযার মূল্য ও মর্যাদা বাকি থাকবে, জ্ঞানবুদ্ধির আলোকেই যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং উন্নতি ও পূর্ণতার ধাপগুলো অতিক্রম করতে থাকবে।
কাফের সুলভ দাবি
কিন্তু আরব উপদ্বীপের বেদুইন, বিগত জাতিসমূহেরক কাহিনীকার ও ধারণা-কল্পনার পূজারীদের দৃষ্টিতে এই মুজিযাসমূহ যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি। তাদের বুদ্ধির দৌড় তাদেরকে দিয়ে মরুভূতিকে সমুদ্রে অথবা সবুজ-শ্যামল বাগানে পরিণত করে দেখানোর মুজিযা দাবি করাল। এছাড়া এরা ইসলামের সামনে মাথা নত করতে প্রস্তুত ছিল না। তাদের দাবি এমন কোন দুরুহ ব্যাপার ছিল না যে, তা পুরা করা কঠিন। আল্লাহর অসীম কুদরতের জন্য তা অতি সহজ কাজ। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনার দাবি ছিল ভিন্নরূপ। তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল এই যে, লোকেরা যে জ্ঞান-বুদ্ধির মর্যাদা খাটো করে দিয়েছে তাকে আবার মর্যাদাপূর্ণ করে তুলতে হবে।
আল্লাহর কুদরত মানুষকে এমন বুদ্ধিজ্ঞান দান করতে অস্বীকৃতি জানাল, যার সাহায্যে সে যখনই ইচ্ছা অলৌকিক মুজিযা প্রদর্শন করতে পারে। কারণ এতে সে একটা বিরাট দানকে অযথা ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ত। যেসব নির্বোধ নিজেদেরও চিনতে পারেনি, নিজেদের অসম যোগ্যতার মূল্যায়ন করতেও পারেনি, বিবেকের সিদ্ধান্তের পদাঘাত করে আসছিল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের নবুয়াতের সত্যতার জন্য জড় প্রকৃতির মুজিযা দাবি করছিল –তারা এদের প্রবৃত্তির দাবি অনুযায়ী প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শন করে বেড়াত। এজন্য এমন একটি পন্থা অবলম্বন করা জরুরী ছিল, যাতে তারা বুদ্ধি-বিবেকের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনে বাধ্য হয় এবং অনুধাবন করতে সক্ষম হয় যে, এর মধ্যেই তাদের জন্য এবং ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
তাই আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে সবচেয়ে বড় মুজিযা এই কুরআন মজীদ দান করা হয়েছে। সুতরাং কুরআনকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে পেশ করা হয়েছে। এটাই ছিল তাঁর আজীবনের কর্মপন্থা। তাঁর ইন্তিকালের পর এই কুরআনকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে পেশ করা হয়েছে। এটাই ছিল তাঁর আজীবন কর্মপন্থা। তাঁর ইন্তিকালের পর এই কুরআনই ইসলামের কিতাব হিসাবে পরিগণিত হয়। তা তাঁর প্রদর্শিত পথের দিকে আহবানও জানায় এবং তাঁর নবুয়াতের সাক্ষ্যও বহন করে।
কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসুলকে এমন কিছু মুজিযা দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিলেন, যার মাধ্যমে পূর্ববর্তী নবীদের সাহায্য হতে পারে। এসব অলৌকিক মুজিযার একটি বিশেষ মেজাজ-প্রকৃতি রয়েছে। এ সম্পর্কে অবহিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন, যাতে এর সঠিক মর্যাদা দৃষ্টির আড়াল থেকে না যায়। এসব মুজিযা নিঃসন্দেহে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের রিসালাত প্রমাণ করে এবং তাঁর সত্যতার সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু এর মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে দ্বিতীয় পর্যায়ের।
যে ভঙ্গীতে এসব মুজিযা প্রকাশ পেয়েছে তা থেকে পরিস্কার জানা যায়, আল্লাহতায়ালার কর্মকৌশল একে অধিক গুরুত্ব দেয়নি। এগুলোর প্রভাবে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক মুজিযার মূল্যমানে কোনরূপ পার্থক্য সূচিত হওয়ার সুযোগ দেননি। বুদ্ধিবৃত্তিক মুজিযা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে অনেক মুজিযা মুমিনদের সামনে প্রকাশ পেয়েছে –যাদের হৃদয়ে ঈমান বসে গিয়েছিল। তাঁরা নিজেদের বুদ্ধির সাহায্যে কাজ করেছেন এবং নিজেদের মনুষ্যত্বের মর্যাদা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন।
কিছু সংখ্যক মুজিযা কাফেরদের সামনে প্রকাশ পেয়েছে। তার ধরনটা এরূপ ছিল যে, কায়েররা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। তারা দাবি করত এ ধরনের মুজিযার, কিন্তু প্রকাশ পেত অন্য ধরনের মুজিযা। অথবা তারা যে মুজিযা দাবি করত তা হয়ত কয়েক বছর পর প্রকাশ পেত। তা এমনভাবে প্রকাশ পেত যে, তাতে মনে হত তাদের দাবির সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। আবার কখনো এমনও হত যে, তাদের সকল দাবি প্রত্যাখ্যান করা হত এবং এর প্রতি ভ্রুক্ষেপই করা হত না। এর তাৎপর্য কি? এর মধ্যে কি রহস্য নিহিত আছে? তা অবশ্যই চিন্তার বিষয়।
বস্তুভিত্তিক মুজিযার তাৎপর্য
আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাবে ঈমানের যাবতীয় দলীল এবং নবুয়্যতের সমস্ত সাক্ষ্য বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু লোকেরা এ ধলনের বুদ্ধিবৃত্তিক মুজিযার মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়নি। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী************************************************************************)
আমরা এই কুরআনে লোকদের জন্য বিভিন্নভাবে নানা রকম দলীল পেশ করেছি। কিন্তু তারা কুফরের উপরই অবিচল থাকল।–সূরা ইসরাঃ ৮৯
আবার কুফরী করার পর তারা কি করল? তারা নানা রকম দাবি উত্থাপন করল। তারা বলল, আমাদের দাবি পূরণ হলেই কেবল আমরা ঈমান আনতে পারি।
(আরবী************************************************************************)
তারা বলল, আমরা তোমাদের উপর ঈমান আনব না, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আমাদের জন্য যমীনের দীর্ণ করে একটি ঝর্ণা প্রবাহিত না করবে; অথবা তোমাদের জন্য খেজুর ও আংগুরের একটি বাগান রচিত না হবে, আর তুমি তাতে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত না করে দেবে; অথবা তুমি আকাশমণ্ডলকে টুকরা টুকরা করে আমাদের উপর আপতিত না করবে –যেমন তুমি দাবি করছ।–সূরা ইসরাঃ ৯০-৯২
রেখে দাও তাদের এই লম্বা-চওড়া দাবি যা তাদের বিদ্রোহের ফলেই উত্থাপিত হয়েছে। যমীনের বুকে একটি ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করা কি এমন কোন কঠিন কাজ –যার জন্য আসমানী শক্তির প্রয়োজন হতে পারে? যদি তাই হয় তাহলে মানবীয় শক্তি কি কাজে লাগবে?
ছোট বেলায় কোন জিনিস সংগ্রহ করার জন্য যেকোন ব্যক্তি পিতার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। কোন কিছুর প্রয়োজন হলেই তার দৃষ্টি পিতার উপর পতিত হয়। কিন্তু সে যখন বাল্যকালের সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে, তখন তার শক্তি-সামর্থ কাজে লাগানোর জন্য তাকে স্বাধীনতা দেওয়া কি পিতার কর্তব্য নয়? সে নিজেই চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করবে, নিজের পথ নিজেই তৈরি করবে, নিজের পথ নিজেই অতিক্রম করবে এবং তার বয়স যতই বাড়তে থাকবে, নিজের বোঝা নিজেই বহন করার যোগ্য হয়ে যাবে।
আল্লাহ তায়ালাও তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে এই নীতিই রেখেছেন। মানবজাতি যতদিন শৈশবে ছিল, তিনি তাদের সামনে একাধিকক্রমে মুজিযা প্রকাশ করতে থাকেন যাতে তাদের হৃদয়ের হক বসে যেতে পারে এবং তারা নবীর সত্যতার প্রবক্তা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মানবজাতি যখন যৌবনে পদার্পন করল এবং তাদের চিন্তার পরিপক্কতা আসল, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতাকে কাজে লাগানোর জন্য তাদেরকে ছেড়ে দিলেন। তারা নিজেরাই যেন সঠিক ও ভুল পথের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। মানুষ নিজেই এখন চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেবে যে, তার ধ্বংসের পথে অগ্রসর হওয়া উচিত না মুক্তির পথে।
আল্লাহর ইচ্ছার সামনে এ কথা মোটেই গোপন ছিল না যে, যেদিন মানবজাতি তার বুদ্ধিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন হয়ে যাবে এবং যেদিন সে কোন দীনকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে পথ খুঁজতে থাকবে সেদিন সে নিজেই বুঝতে পারবে যে, কিভাবে সে নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগাবে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের নবুয়াতকে স্বীকার করে নেয়ার ক্ষেত্রে আরব উপদ্বীপের বেদুঈনরা যেসব দাবি উত্থাপন করেছিল তার কয়েকটি নিম্নরূপঃ
তাদের একটি দাবি এই ছিল যে, তিনি আসমানে আরোহণ করে সেখান থেকে কোন নিদর্শন নিয়ে আসবেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছিল, তাদের এই মানসিকতা পরিশুদ্ধ করা, তাদের চেতনা শক্তিকে জাগ্রত করা এবং নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধির মূল্য ও মর্যাদা অনুধাবনে সক্ষম করে তোলা। তারা যেন মানবতার মর্যাদা অনুধাবন করতে পারে, তারা মানুষ রসূলের উপর ঈমান এনে নিজেদের মানব পরিচয়কে উন্নত করে তুলতে পারে এবং এই রসুল (সঃ)-এর বিরোধিতা থেকে নিজেদের বিরত রাখে। কারণ তিনি মানবীয় জ্ঞানকে উন্নত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্যই এসেছেন। এজন্য কুরআন মজীদ যেখানেই এই দাবির উল্লেখ করেছে, সেখানে জোরেশোরে বলেছেঃ
(আরবী***********************************************************************************)
বল! আমার প্রতিপালক অতীব পবিত্র। আমি একজন পয়গাম বাহক মানুষ ঝাড়া আরো কি কিছু? –সূরা ইসরাঃ ৯৩
এই দাবি উত্থাপন করার এক যুগ পর ঠিকই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম মিরাজের রাতে আসমানে উঠেছিল। এভঅবে আসমানে আরোহণ করার তাৎপর্য কি? আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের দাবির প্রতি মোটেই ভ্রূক্ষেপ করেননি –সেদিকেই এ ঘটনার মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাদের দাবির কোন গুরুত্বই দেননি। বরং মিরাজের রাতে মহানবী (সঃ)-এর আসমানে আরোহণের ব্যাপারটিই ছিল মূলতঃ একটি মুজিযা। আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী (সঃ)-কে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়। আল্লাহ তায়ালা এখানে কারো ইচ্ছার পরোয়া করেননি। এজন্য তখন কারো ঈমান আনা অথবা কুফরীর উপর অবিচল থাকার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। বরং সত্যকে মেনে নেয়া বা না নেয়ার প্রসঙ্গটি কুরআনের অতুলনীয় মুজিযার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
(আরবী****************************************************************************************)
এখন যার ইচ্ছা মেনে নেবে, আর যার ইচ্ছা অমান্য করবে।–সূরা কাহফঃ ২৯
মুশরিকরা একবার শপথ করে বলল, যদি কোন বস্তুভিত্তিক মুজিযা প্রকাশ পায়, তাহলে তারা ঈমান আনবে। ব্যাপারটা যেন এরূপ যে, কোন যুবক তার পিতার সাথে জেদ ধরে বসল যে, সে প্রথমে তার বালসুলভ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করবে, অতঃপর তাকে যুবক ভাববে।
এবারও আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তাদের বিবেক-বুদ্ধি ও তাদের হৃদয়ের কাছে ছেড়ে দিলেন। তারা এর সাহায্যে সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করুক, সত্যের সন্ধাকে ব্যাপৃত হোক। কেননা বিবেক-বুদ্ধি ও হৃদয়ের মাঝে আল্লাহ তায়ালা যে মশাল জ্বালিয়ে রেখেছেন, তা যদি নিভে গিয়ে না থাকে তাহলে তারা এই গোটা বিশ্বকে মারেফাতের এক বিশাল দফতর রূপেই দেখতে পাবে। এর প্রতিটি অণু-পরমাণুই এক একটি মুজিযা। এসব মুজিযার সাহায্যে সত্যের সন্ধান করা বা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারাটা কোন কঠিন ব্যাপার নয়।
(আরবী************************************************************************************)
এরা আল্লাহর নামে কঠিন শপথ করে বলে, আমাদের সামনে যদি কোন নিদর্শন সুস্পষ্ট হয়ে উঠে তাহলে আমরা এর উপর অবশ্যই ঈমান আনব। তুমি বল, আল্লাহর কাছে অনেক নিদর্শন রয়েছে। তোমরা কি জান! নিদর্শনসমূহ প্রকাশ পেলেও এরা ঈমান আনবে না। তারা যেমন প্রথমবারে ঈমান আনেনি, তেমনিভাবে আমরা তাদের দিল ও দৃষ্টিশক্তিকে ফিরিয়ে দেব। আমরা তাদেরকে তাদের বিদ্রোহের মধ্যেই বিভ্রান্ত হয়ে থাকার জন্য ছেড়ে দেব।–সূরা আনআমঃ ১০৯-১০
কুরআন মজীদের এই তিরস্কার বাণী আমাদের সামনে থাকলে এই সত্য আরো প্রতিভাত হয়ে উঠে। কাফেরদের হৃদয় ও দৃষ্টিশক্তির উপর হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার যে পর্দা ঝুলে আছে তা উন্মোচন করতে গিয়ে কুরআন মজীদ বলছেঃ
(আরবী***************************************************************************************)
আমরা যদি তাদের জন্য আসমানের কোন দরজা খুলে দিতাম, আর তারা দিনমানে তাতে আরোহণ করতে থাকত, তখনও তারা এটাই বলত, আমাদের চোখকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। বরং আমাদের উপর যাদু করা হয়েছে।–সূরা হিজরঃ ১৪, ১৫
বস্তুভিত্তিক মুজিযাই বা এ ধরনের লোকদের কি উপকারে আসতে পারে? তাদের পথভ্রষ্টতার কারণ এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, তাদের হৃদয় ও জ্ঞানের দরজার তালা ঝুলে আছে। যদি তাদের হৃদযের দরজা খুলে যায় তাহলে কুরআনের উপস্থিতিতে আর কোন মুজিযার প্রয়োজন হবে না। কুরআনের চেয়ে বড় মুজিয়া ও নিদর্শন আর কি হতে পারে?
(আরবী***************************************************************************************)
তারা কি কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে না? না তাদের হৃদয়ে তালা পড়ে গেছে? আসল কথা এই যে, হেদায়াত সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হওয়ার পর যারা তা থেকে ফিরে গেছে তাদের জন্য শয়তান এই আচরণকে সহজ বানিয়ে দিয়েছে এবং মিথ্যা আশা-আকাঙ্ক্ষার মোহকে তাদের জন্য দীর্ঘ করে রেখেছে।–সূরা মুহাম্মদধঃ ২৪, ২৫
নবী একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ
কুরআন মজীদ যদি সেই কিতাব হয়ে থাকে যা মানবজাতির সামনে পূর্ণতার দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দিয়েছে –তাহলে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম সেই মানুষ, যাঁর ব্যক্তিত্ব মানবতার কাঙ্ক্ষিত এই উন্নততম মূল্যমানের ধারক ও বাহক। তাঁর জীবনের কার্যাবলীই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি সেদিনই অন্তর ও বিবেকের মর্যাদা অনেক উন্নত করে দিয়েছেন যখন ঘোষণা করলেন –তাকওয়া হচ্ছে সেই আলোকবর্তিকা –পরিচ্ছন্ন হৃদয়ে যার অবস্থান। যদি তাকওয়াই না থাকে তাহলে বাহ্যিক ইবাদত অর্থহীন হয়ে পড়ে। তিনি জ্ঞান-বুদ্ধির মর্যাদা দান করলেন এবং একে দ্বীনের মূল ঘোষণা করলেন।
এর উপর মুসলমানরা এমন এক সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করল যা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সমষ্টি। এর বদৌলতে মানবীয় চিন্তা-গবেষণার স্তব্ধ স্রোতধারা আবার বইতে শুরু করল। এরই বোনা বীজ থেকে নতুন সভ্যতার সূচনা হল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামই হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সঠিক অর্থে মানুষকে স্বাধীনতা দান করেছেন এবং তাদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি গোটা বিশ্বকে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও দৈহিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অধীন-নিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই নেতৃত্বের অধিকারী। তাকে এই জগতের যাবতীয় জিনিসের উপর কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। সে কেবল আল্লাহর বান্দা। সে কোন রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার নয় বা কোন ফের্কার ক্রীড়নকও নয়।
ইসলামের বার্তাবাহক নবী আরবীভাষী কিন্তু তাঁর আনীত দীন শুধু আরবদের জন্য নয়। তাঁর কোন নির্দিষ্ট জাতি-পরিচয় নেই। আর যে দীন মানুষের বুদ্ধি-বিবেকের কাছে আবেদন জানায়, যে দীনের দলীল-প্রমাণের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বজগতের অধ্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ –তার আবার কিসের জাতি পরিচয়!
নবুয়াত ও প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব
মানবেতিহাসে এমন অসংখ্য ব্যক্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়, যারা অসম শক্তি ও যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। মানবজাতি তাদের অবদানকে নিজেদের স্মৃতিপটে এবং ইতিহাসের পাতায় বন্দী করে রেখেছে –যাতে অনাগত মানব সভ্যতা তাদের প্রতিভার নিদর্শনসমূহ অবলোকন করতে পারে এবং এসব ঘটনা থেকে নিজেদের মধ্যে বলবীর্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনা লাভ করতে পারে। বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ যশ ও খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছে। কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে রয়েছে বিরাট ব্যবধান।
শূন্যলোকের নক্ষত্রপুঞ্জ সম্পর্কে গবেষণা করে দেখা গেছে যে, তার একটি অপরটি থেকে আয়তনে হাজারো গুণ বড়। কিন্তু মণি-মুক্তা আয়তনে যদই ক্ষুদ্র হোক না কেন তা নুড়ি পাথর তো আর নয়। অতএব আমরা যখন এই মহামানবদের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তখন দেখতে পাই তাদের মধ্যে নবী-রসুলগণও রয়েছেন, যাঁদেরকে রিসালাতের পদে সমাসীন করা হয়েছে, দার্শনিকগণও রয়েছেন যারা চিন্তার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বৈজ্ঞানিকগণও রয়েছেন যারা নিত্য নতুন আবিস্কারে পৃথিবীকে চমকিত করেছেন, রাষ্ট্রনায়কগণও রয়েছেন যারা নিজ নিজ দেশের জনগণকে শাসন করেছেন, সাহিত্যিকগণও রয়েছেন যারা সাহিত্যের জ্ঞানকে অলংকার পরিয়েছেন। এরকম আরো কত অসংখ্য লোক রয়েছেন।
আমরা যদি তাদের ইতিহাসের মূল্যায়ন করি, তাদের মধ্যে তুলনা করি, একজনকে অপরজনের উপর অগ্রাধিকার দেই তাহলে এর অর্থ এই নয় যে, আমরা তাদের কারো প্রতিভাকে গোপন করতে চাই, অথবা তাদরেকে মহত্বের আসন থেকে নামিয়ে এনে সাধারণের পর্যায়ে দাঁড় করাতে চাই।
প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব
মানবীয় গৌরব ও মহত্বের তাৎপর্য এই যে, তার যাবতীয় যোগতার মধ্যে যেকোন একটি দিকের যোগ্যতা অধিক প্রতীয়মান হয়ে থাকে। বরং বলতে গেলে কোন একটি বিশেষ দিকের যোগ্যথার বিকাশ অন্য সব দিকের যোগ্যতার মৃত্যুধ্বনি হয়ে থাকে। তার অন্য সব যোগ্যতা হয়ত বা সাধারণ মানুষের যোগ্যতার পর্যায়ে থেকে যায়। বরং কখনো কখনো তা সাধারণ স্তরের চেয়েও নিচে থেকে যায়।
অতএব এসব মনীষী গৌরব ও মহত্ব এবং তাদের জীবন-চরিত পাট করলে দেখা যায়, তাদের জীবনের কোন কোন দিক একেবারেই অন্ধকার রয়ে গেছে। নেপোলিয়ান একজন শক্তিমান নেতা ও বীর যোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু তাঁর চরিত্র ও ব্যবহার সম্পর্কে অনেক বদনাম রয়েছে।
জ্যাক রুশো একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ছিলেন। দুনিয়ার যেসব লোক স্বাধীনতার আইন রচনা করেন, তিনি তাদের প্রথম সারির একজন। কিন্তু তাঁর স্বভাব ছিল অত্যন্ত নিকৃষ্ট।
বিসমার্ক রাজনৈতিক ময়দানের একন অবিসম্বাদিত নেতা ছিলেন। কিন্ত তিনি ছিলেন ডাতা মিথ্যুক।
এরকম কত দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, কবি-সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ রয়েছেন যাদের জীবনাচার অনুসন্ধান করলে অনেক কুৎসিৎ তথ্য বেরিয়ে আসে। এ ধরনের জঘন্য কাজ কেমন করে সংঘটিত হল তা চিন্তা করলে স্তম্ভিত হতে হয়। এসব সত্ত্বেও তাঁরা মহামনীষী, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। কেননা তাদের চিন্তা-সাহিত্যকর্ম ও উজ্জ্বল অবদান তাদেরকে সাধারণ স্তর থেকে অনেক ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে।
অপরদিকে যেসব লোকের জীবন-চরিত উল্লিখিত দোষত্রুটি থেকে মুক্ত তারাও একদিক থেকে প্রখ্যাত হলেও অন্য দিক থেকে সাধারণের পর্যায়ে রয়ে গেছেন। অথবা তারা এমন রোগে আক্রান্ত যার দ্বারা তাদের যাবতীয় চিন্তা প্রভাবিত হয়েছে। শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে এমন লোকও পাওয়া যাবে যিনি মানসিক জটিলতা অথবা জৈবিক লালসার শিকার, অথবা চরম আত্মকেন্দ্রিক। এমন লোকও পাওয়া যাবে যারা যশ ও খ্যাতির পাগল। এমন লোকও দেখা যায় যিনি কোন বিশেষ জিনিসের প্রতি ঘৃণা পোষন অথবা ভালবাসার ব্যাপারে অন্ধ।
এজন্যই তাদের জীবন ভণ্ডামি ও কপটতার শিকার। তাদের ব্যক্তিগত জীবন অত্যন্ত কলুষিত। কিন্তু বাহ্যিক চাল-চলন, আচার-ব্যবহার অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। পাশ্চাত্য সভ্যতা এই দ্বেততার শিকারে পরিণত হয়েছে। এজন্যে সে এতে কোন আশ্চর্য বোধ করে না। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের ভণ্ডামিকে সে কোন অপরাধ মনে করে না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী এই যে, জাতি তাদের যোগ্যতার দ্বারা উপকৃত হবে এবং তাদের ত্রুটিসমূহ উপেক্ষা করবে।
ইংরেজদের জানা আছে যে, নেলসন অপরের মান-সম্ভ্রমে হস্তক্ষেপরত অবস্থায় মারা যান। কিন্তু তারা তার এ অন্যায় হস্তক্ষেপকে উপেক্ষা করে থাকে। চার্চিল অনেক ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত চুক্তি লংঘন করেছেন। কিন্তু তারা সেটাকে পাশ কাটিয়ে যায়।
এসব বিশেষ ব্যক্তিত্বের আলোচনা এখানে শেষ করে আমরা আরো উপরের স্তরের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব, যাঁদের জীবন, চরিত্র ও কর্মকাণ্ড নিখুঁত, নিষ্কলুষ, পবিত্র ও মনোমুগ্ধকর। তাঁরা হচ্ছেন আল্লহার প্রেরিত নবী-রসূল।
নবী-রসূল
প্রতিভাধরগণ যেখানে একটি বা কয়েকটি বিষয়ে বিশেস যোগ্যতার অধিকারী হয়ে থাকেন, সেখানে নবী-রসূলগণ প্রতিটি বিষয়ে যোগ্যতার শীর্ষদেশে অবস্থান করেন। পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারী, পরিচ্ছন্ন চিন্তায় সঞ্জীবিত, দেহ প্রস্ফুটিত, হীনতা-নীচতা থেকে পবিত্র, যাবতীয় গুণে সু-সজ্জিত, নেকী, সৌজন্য ও আভিজাত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতার প্রতীক, দেখতে একজন ফেরেশতা সদৃশ। কবি বলেনঃ
এরা যেন প্রদীপের মত
মনে হয় জীবন্ত উজ্জ্বল নক্ষত্র থেকে
ঢেলে সাজানো এদের অবয়ব,
এদের চরিত্র যেন আলোর তরঙ্গমালা
যেদিকেই দেখ ঔজ্জ্বল্য ছিটিয়ে চলে।
যাঁদেরকে নবুয়াতের জন্য বাছাই করা হয় তাঁরা মানবজাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, ঊর্ধ্ব জগতের সাথে সংযুক্ত, উন্নত রুচির অধিকারী, দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, নির্ভুল জ্ঞানের অধিকারী, নিগুঢ় তাৎপর্য সম্পর্কে অবহিত, ভ্রান্তি থেকে দূরে বহু দূরে, পথভ্রষ্টতা থেকে সুরক্ষিত। দার্শনিকগণ যেখানে হোঁচট খেয়ে গেছেন তাঁরা সেখানে অবিচল রয়েছেন। চলার পথে তাঁদের পা কখনো পিছলে যায়নি। শক্তিশালী ও সুঠাম দেহের অধিকারী, যেসব রোগকে মানুষ ঘৃণা করে অথবা যেসব রোগ দৈহিক বিকৃতি ঘটায় তা থেকে তাঁরা নিরাপদ ছিলেন। মানব দরদী, জনগণের কল্যাণকামী, সৎকাজের প্রতীক, তাকওয়ার আধার, লেনদেনে সত্যবাদী এবং আচার-ব্যবহারে আন্তরিক।
কোন নবী সম্পর্কেই এরূপ ধারণা করা যায় না যে, তিনি ভদ্রতা, সৌজন্য ও মনুষ্যত্বের দাবিসমূহ উপেক্ষা করেছেন। তাঁর দ্বারা এমন কোন কাজও সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয় যা সম্মান ও মর্যাদাকে কলংকিত করতে পারে। নবীগণ তো আসমানী ওহী ও আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধানের ধারক ও বাহক। তাঁদের কথাবার্তা হিকমতও জ্ঞানে পরিপূর্ণ এবং তাদের জীবন অনুসরণীয় আদর্শ। তাঁদের ভেতর ও বাহির এবং গোপন ও প্রকাশ্য জীবন সবই উজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত। তাদের গোটা জীবন যেন একটা উন্মুক্ত কিতাব। এর কিছু পৃষ্ঠা বন্ধ এবং কিছু পৃষ্ঠা খোলা তা নয়।
তাদের ব্যক্তিগত জীবন তাদের আনীত পয়গামের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। তাদের জীবন-চরিত তাদের দাওয়াতেরই সত্যিকার প্রতিচ্ছবি এবং তাদের কার্যাবলীর ব্যাখ্যা। তাঁরা যখন জনগণের মধ্য অবস্থান করেন তখন রহমত ও অনুগ্রহের বারিধারা বর্ষিত হতে থাকে। আর তাঁরা যখন বিদায় নেন নিজেদের পেছনে বরকত ও প্রাচুর্যের কাফেলা রেখে যান। আমাদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, তাঁরা আল্লাহর মনোনীত বান্দা।
(আরবী**************************************************************************)
আল্লাহ তাঁর রিসালাত কাকে দান করবেন তা তিনিই সবচেয়ে ভাল জানেন।–সূরা আনআমঃ ১২৪
(আরবী*************************************************************************)
আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের মধ্য থেকেও পয়গামবাহক নির্বাচন করেন এবং মানুষের মধ্য থেকেও। তিনিই সব শুনেন এবং সব দেখেন। যা কিছু তাদের সামনে রয়েছে এবং যা কিছু তাদের থেকে লুকায়িত রয়েছে তার সবই তিনি জানেন। সমস্ত ব্যাপার তাঁর দিকেই পত্যাবর্তিত হয়।–সূরা হজ্জঃ ৭৫-৭৬
শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের দিক থেকে নবীদের মর্যাদার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কেউ ছোট্ট একটি সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত হয়েছেন, কেউ হাজারো বা লাখো মানুষের একটি বসতির কাছে প্রেরিত হয়েছেন, আবার কেউ গোটা জাতির কাছে প্রেরিত হয়েছেন। তাদের কেউ স্বতন্ত্র কিতাব ও শরীআত নিয়ে এসেছেন, আবার কেউ পূববর্তী শরীআতের অধীনে প্রেরিত হয়েছেন। এজন্য তাদের সবার মর্যাদা সমান নয়।
এভাবে আমরা যতই উপরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি, যতই উচ্চতার শিখরে আরোহণ করতে থাকি, মানবীয় পূর্ণতার স্তরসমূহ অতিক্রম করতে থাকি, এভাবে এমন এক জায়গায় পৌঁছে যাই যেখানে মহৎ প্রতিভাধরদের খুবই ক্ষুদ্র মনে হয় এবং যেখানে সব নবীদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব হালকা মনে হয় –সেখানেই আমরা নবীকুল শিরোমণি মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে দীপ্তিমান দেখতে পাই। সারা জাহানের নবী, যাবতীয় গুণবৈশিষ্ট্যের সঙ্গমস্থল, সৌন্দর্যের প্রতীক। কল্পনা-শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানত্বের একটি প্রতিকৃতি আঁকলো, আর কুদরতের হাত তার মধ্যে রূহ ফুকে দিল। সাথে সাথে তা এক জীবন্ত-জাগ্রত মানুষে পরিণত হয়ে গেল। এমন এক মানুষ যাঁর দৃষ্টান্ত তিনি নিজেই।
ইনিই হচ্ছেন মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম। তাঁর উপর আল্লাহর রহম ও করুণা বর্ষিত হোক। সব নবীদের ইমাম এবং সব প্রতিভাধরদের নেতা। সম্মান ও মর্যাদার এক সুউচ্চ মিনার। প্রেম-প্রীতি, আন্তরিকতা, বুদ্ধিমত্তা, উদারতা, কল্যাণকামিতা, প্রজ্ঞা সবকিছুর আধার। তাঁর বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। মহান ব্যক্তিই মহান ব্যক্তির মূল্যায়ন করতে পারে। কিন্তু মুহাম্মদ (সঃ)-এর মত মহান ব্যক্তিত্ব দ্বিতীয়টি আর কোথা!!
কস্তুরীর মোহর
পূর্ববর্তী নবীগণ হেদায়াতের আলোকবর্তিকা ছিলেন। সমগ্র বিশ্বে কুফর ও শিরকের যে ঘণীভূত অন্ধকার বিরাজিত ছিল, তার মধ্যে তাঁরা আলোর মশাল হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অতঃপর যখন ইসলামের সূর্য উদিত হল, ঘণীভূত অন্ধকার দূর হতে শুরু করল। বিশ্বনবীর আলোকবর্তিকা যখন প্রজ্জলিত হল, বিশ্বের চেহারায় বিবর্তন শুরু হয়ে গেল। কবি বলেনঃ
প্রসঙ্গ উত্থাপন কর না এর
আগের কিতাবগুলোর
প্রভাতের আলো প্রস্ফুটিত হল যেই নিবিয়ে দিল সবগুলো হারিকেন।
যে মহান সত্তা নবুয়াতের এই ভারবোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন তাঁর মহত্বের বর্ণনা শেষ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তায়লা আমাদের নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের মধ্যে সমস্ত নবীদের গুণবৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা আঠার জন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে অবিচল হৃদয়ের অধিকারী এবং নতুন শরীআতের প্রবর্তক নবীদের নামও শামিল রয়েছে। তাদের সবার নাম উল্লেখ করার পর আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
এরাই ছিল সেই লোক, যাদেরকে আমরা কিতাব, হিকমত এবং নবুয়াত দান করেছি। এখন যদি তারা এটা মেনে নিতে অস্বীকার করে তাহলে কোন পরোয়া নেই, আমরা অন্য কিছু লোককে এই নিয়ামত সোপর্দ করেছি, যারা এর অস্বীকারকারী নয়। এদেরকেই আল্লাহ তায়ালা হেদায়াত দান করেছেন। তোমরাও তাদের পথেই চল। হে মুহাম্মাদ! তুমি বলে দাও, আমি (তাবলীগ ও হেদায়াতের) কাজের জন্য তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাচ্ছি না। এতো সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য এক সাধারণ নসীহত বিশেষ।–সূরা আনআমঃ ৮৯, ৯০
আনুগত্য ও অনুসরণের এই যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের মনে সব সময়ই জাগ্রত থাকত। একবারকার ঘটনা। তিনি গনীমাতের মাল বণ্টন করছিলেন। এক মুনাফিক ব্যক্তি অপবাদ দিয়ে বলল, “এই বণ্টনের ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য রাখা হয়নি”। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম নিজের রাগ সংবরণ করে বললেনঃ
মূসা (আঃ)-এর উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হোক। তাঁকে এর চেয়েও বেশি কষ্ট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ধৈর্যধারণ করেছেন।–বুখারী-কিতাবুল আদাব
অতএব এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরকারগণ বলেছেন, এই আয়াতে পূর্ববর্তী সব নবীদের তুলনায় রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা পূর্ববর্তী নবীদের যেসব গুণবৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে, রসূলুল্লাহ (সঃ) এর মাঝে তার সবগুলোরই সমাবেশ ঘটেছে।
হযরত নূহ আলায়হিস সালাম ছিলেন ধৈর্য-সহ্য, অবিচলতা ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞার মূর্ত প্রতীক।
হযরত ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন দানশীল, দয়ালু এবং আল্লাহর পথে নিরন্তর চেষ্টা-সাধনা কারী।
হযরত দাউদ (আঃ) ছিলেন আল্লাহর দানের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং যথাযথ হক আদায়কারী।
হযরত যাকারিয়া (আঃ), হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) এবং হযরত ঈসা (আঃ) ছিলেন সংসার-বিরাগী এবং পার্থিব ভোগ বিলাসের প্রতি বিমুখ।
হযরত ইউসুফ (আঃ) ছিলেন সুখে-সম্পদে কৃতজ্ঞশীল এবং দুঃখে-বিপদে ধৈর্য্যশীল।
হযরত ইউনুস (আঃ) ছিলেন অনুতপ্ত, বিনয়ী ও বিগলিত হৃদয়ের অধিকারী।
হযরত মুসা (আঃ) ছিলেন বীরত্ব, শৌর্যবীর্য ও শক্তিমত্তার প্রতীক।
হযরত হারুণ (আঃ) ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী।
অতঃপর আমরা যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের জীবনচরিতের দিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে তাঁকে এক বিরাট মহাসাগর হিসাবে দেখতে পাই, যার মধ্যে সাগর-উপসাগরগুলো একাকার হয়ে গেছে।
সব ময়দানের বীর সৈনিক
একদল প্রতিভাবান লোক রয়েছে যারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পছন্দ করেন। সাধারণ লোকদের সাথে অবাধে মেলামেশা করলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ন হবে এই আশংকায় তারা তাদের এড়িয়ে চলেন।
আবার এমন কিছু লোক রয়েছে যারা জীবন-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং সাফল্যের সব চাবিকাঠি হাতের কাছে পেয়ে যায়। তাদের এখঅনে চিন্তার গভীরতা আছে, জ্ঞানের প্রাচুর্য আছে এবং তারা দূরদৃষ্টিরও অধিকারী। তারা জরিত প্রকৃত রোগ নির্ণয়ে সিদ্ধহস্তও। কিন্তু এই ধরনের যোগ্যতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের মন অত্যন্ত সংকীর্ণ। তাদের প্রেম-প্রীতি ও মনুষ্যত্ববোধের সীমা অত্যন্ত সীমিত। যেসব লোক তাদের রুচি ও উদ্দেশ্যের সাথে ঐকমত্য পোষন করে কেবল তারাই তাদের প্রিয়পাত্র।
আবার এমনও কিছু প্রতিভাবান ব্যক্তি আছেন, যারা অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব ও বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী। তাঁদের আচার-ব্যবহার মানুষকে সহজেই আপন করে নেয়। তবে আমাদের উদ্দেশ্য এই নয় যে, তাঁরা জনগণকে বশীভূত করার মত শক্তির অধিকারী হয়ে গেছেন এবং তারা তাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে; এখন তারা যেভাবে চায়, যেদিকে চায় তাদের ঘুরপাক খাওয়াতে পারে।
আমরা এখানে উন্নত মন-মানসিকতা সম্পন্ন প্রতিভাধর ব্যক্তিদের দিকে ইঙ্গি করছি, যাদের চারপাশে প্রতিভাবান ব্যক্তিরাই সমবেত হয়ে থাকে। তারা তাদেরকে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখে এবং সন্তুষ্টচিত্তে তাঁদের বড়ত্ব ও মহত্বকে মেনে নেয়। দুনিয়ার মঞ্চে এ ধরনের ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব খুব কমই হয়েছে। তবে তাঁরা ইতিহাসের পাতায় নিজেদের অক্ষয় ছাপ রেখে গেছেন।
কিন্তু দুনিয়ার মানুষ তাঁদের সুদীর্ঘ অতীতে এমন কোন ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না –যার সামনে কোন জাতির বীর পুরুষ ও প্রতিভাবান ব্যক্তিগণ মাথা নত করে দিয়েছে, আকীদা-বিশ্বাসে তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে গেছে এবং তাঁর জন্য অন্তরের ভালবাসা উজাড় করে দিয়েছে। একমাত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রেই এই ব্যতিক্রম। ঘোরতর যুদ্ধের সময় নামকরা বীর-যোদ্ধাগণ তাঁর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করে দিত। কারণ যুদ্ধ চলাকালে তারা তাঁর সাহস ও বীরত্ব দেখে বিমোহিত হয়ে যেত। বড় বড় চিন্তাশীল ব্যক্তি ও রাজনীতিজ্ঞ তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। কারণ তিনি তাদের সামনে এমন তথ্য তুলে ধরতেন যেখানে তাদের চিন্তা কখনো পৌঁছতে সক্ষম হত না।
দানবীরগণ তাঁর দানের মহিমা দেখ হতভম্ব হয়ে যেত। সকাল বেলা তাঁর কাছে হাজারো উট-বকরী, অঢেল অর্থ-সম্পদ এসে জমা হত, কিন্তু সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বেই তা বিলি-বণ্টন হয়ে যেত। তা বেকার, অক্ষম, বিধবা ও দরিদ্রের দরজায় পৌঁছে যেত।
ইবাদত-বন্দেগীতে রত ব্যক্তি তাঁকে ইবাদত অনুশীলনে বহুদূর অগ্রসর দেখতে পেত। দুনিয়ার আকর্ষণ-বিমুখ ব্যক্তি তাঁকে এ ব্যাপারে তার সামনে দেখতে পেত। ভাষা, প্রকাশভঙ্গী এবং অলংকরণের দিক থেকৈ কেউই তাঁর নাগালে পৌঁছতে পারত না। তার বক্তব্যে যেন যাদু ছড়িয়ে রয়েছে। এমনকি সুঠাম দেহ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লোকেরা দেখতে পেত, তিনি অনায়াসে নামকরা মল্লযোদ্ধাকে ধরাশায়ী করে দিয়েছেন। অনুরূপভাবে প্রতিভাধর ব্যক্তিরা তাঁর মধ্যে যাবতীয় প্রতিভার সমাবেশ দেখতে পেত এবং নিজেদের প্রতিভাকে এর সামনে মূল্যহীন মনে করত। সাধারণ মানুষ যেভাবে পাহাড়ের আকাশচুম্বী চূড়ার দিকে মাথা উঁচু করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে থাকে –প্রতিভাধর ব্যক্তিগণও তাঁকে সেভাবেই দেখেছেন।
অপরদিকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নম্র স্বভাবের অধিকারী। তিনি ছিলেন প্রত্যেকের অতি নিকটের মানুষ। বিধবাই হোক অথবা মিসকীন, তাঁর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য তাদের কোনরূপ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হত না। বরং তাঁর প্রশস্ত হৃদয়, প্রশস্ত প্রতিভা ও আন্তরিকতার কারণে তারা তাঁকে নিজেদের একান্ত আপনজন মনে করত। সমাজের এই অসহায় মানুষগুলোকেই তিনি অধিক ভালবাসতেন।
তিনি যেন একটি সূর্য, যার আলোক থেকে সবাই সমভাবে উপকৃত হয়, প্রত্যেকেই এর মাধ্যমে নিজ নিজ প্রয়োজন পূরণ করে নেয় এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে আলো ও উত্তাপ সংগ্রহ করে। কেউই মনে করে না যে, অপর কেউ তার শরীক আছে, অথবা তাঁর সাথে ঝগড়া করার কেউ আছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের অবস্থাও তদ্রূপ ছিল। তাঁর মহান ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর সাথীদের জন্য স্নেহ-ভালবাসার একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
প্রতিভার প্রশংসা
নবুয়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সুমহান দান, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অর্জিত কোন জিনিস নয়। এটা কারো নির্দিষ্ট অংশ নয় যে, দাবি করে আদায় করা যাবে অথবা চেষ্টা তদবীর করে অর্জন করা যাবে। এটাই সঠিক আকীদা এবং কুরআনের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল।
(আরবী********************************************)
তোমার রবের রহমত কি এই লোকেরা বণ্টন করবে? –সূরা যুখরুফঃ ৩২
(আরবী***************************************************************************************)
তোমার প্রতিপালরে ধনভাণ্ডার কি এদের মুঠোর মধ্যে কিংবা এর উপর তাদের শাসন চলে? এদের নিকট কোন সিঁড়ি আছে না কি, যার উপর চড়ে এরা ঊর্ধ্ব জগতের কথা গোপনে শুনে নেয়? এদের মধ্যে যে ব্যক্তিই গোপনে কিছু শুনে নিয়েছে, সে নিয়ে আসুক না কোন অকাট্য দলীল।–সূরা তুরঃ ৩৭, ৩৮
এ কথা মনে রাখা দরকার যে, ঘটনাচক্রে হাতে এসে যাওয়ার মত নিয়ামত এটা নয়। এটা কোন অন্ধ বণ্টন নয় যে, ভাগ্যক্রমে কারো ভাগে পড়ে যাবে।
জাহিলী যুগের এক কবি আল্লাহ সম্পর্কিত আলোচনাকে নিজের বিষয়বস্তু বানিয়ে নিয়েছিল। তার আশা ছিল হয়ত এভাবে সে একদিন নবুয়াতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হবে। কিন্তু তার সে আশা কোন দিন পূরণ হয়নি। রাহেব ও পাদ্রীদের একটি দলও এই মর্যাদা লাভ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা এই মাহন পদের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিকেই নির্বাচন করেন। যারা মনে করে নবুয়াতের এই পদ নির্বিচারে অর্পণ করা হয়, এজন্য কোনরূপ যাচাই বাছাই করা হয় না, অথবা নবীদের মর্যাদা শুধু এটুকুই যে, তাঁরা ওহীর ধারক ও বাহক, তাঁদের দায়িত্ব শুধু তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া, তাঁরা যেন একটি লাউড স্পীকার, ফেরেশতা এসে এর মধ্যে কথা বলে যায়, ব্যক্তিগতভাবে তাদের কোন যোগ্যতা নেই, তারা পূর্ণতা ও উন্নত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নন –এরা নবীদের সম্পর্কে চরম ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। নবীগণ যে গুণ-বৈশিষ্ট্য ও পূর্ণতার অধিকারী হয়ে থাকেন সে সম্পর্কে এদের কোন ধারণাই নেই। তাঁরা যে মহত্ব ও বিশেষত্বের কাণে এত উপরে অবস্থান করেন যে, দুনিয়ার বড় বড় দার্শনিকও তার কুলকিনারা করতে পারেননি –এ সম্পর্কে তারা অনবহিত।
অনুরূপভাবে অসংখ্য বিশিষ্ট লেখক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের জীবন-চরিত লিখেছেন। কিন্তু তারা তাঁকে একটি প্রতভা হিসাবে স্বীকৃত দিয়েছেন। তাঁকে প্রতিভা বলতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু কতগুলো সীমা-শর্ত অবশ্যই মানতে হবে। আমরা তাঁকে এই শর্তে প্রতিভা বলতে পারি যে, আমাদের উদ্দেশ্য হবে তাঁর মহান ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরা, তাঁর পরিপূর্ণতাকে আলোক উদ্ভাসিত করে তোলা।
তাঁকে প্রতিভা বলতে কোন দোষ নেই, যদি আমরা ওহীকে স্বীকার করে নেই যা বস্তুজগত এবং অবস্তু জগতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে। এটাই নবুয়াতের প্রথম ভিত্তি। কিন্তু প্রতিভা বলতে যদি তাঁকে দুনিয়ার অন্যান্য প্রতিভাধর ব্যক্তিদের একজন মনে করা হয়, তাহলে আমরা তাঁর জন্য ‘প্রতিভা’ শব্দ ব্যবহার করার কখনো অনুমতি দিতে পারি না। তাঁর প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব হওয়ার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর আসল মর্যাদা হচ্ছে, তিনি আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ওহীর জ্ঞান দান করেছেন। যেসব লেখক ও ঐতিহাসিক তাঁর জীবন-চরিতের উপর গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাদের এবং মুসলিম লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে এখানেই পার্থক্য।
সব নবীদের উপর ঈমান আনা ফরয
আল্লাহ তায়ালা সব নবীদের উপর ঈমান আনাকে দীনের অন্যতম রুকন (স্তম্ভ) হিসাবে নির্ধারণ করেছেন এবং নিজের নামের সাথে তাদের নামও উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর উপর ঈমান তখনই পূর্ণতা লাভ করবে যখন সমস্ত নবীর উপর ঈমান আনা হবে। কুরআন মজীদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এবং নিষ্ঠাবান ঈমানদার সম্প্রদায়ের এই আদর্শই বর্ণনা করেছেঃ
(আরবী*****************************************************************************)
রসূল সেই জিনিসের উপর ঈমান এনেছে যা তার উপর তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে এবং মুমিনরাও এর উপর ঈমান এনেছে। তারা সকলেই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমূহ এবং তার রসূলগণের উপর ঈমান এনেছে। তাদের কথা হচ্ছেঃ আমরা আল্লাহর রসূলদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না। আমরা নির্দেশ শুনেছি এবং তা মেনে নিয়েছি। হে প্রভু! আমরা তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, আমাদের তোমার কাছেই ফিরে যেতে হবে।–সূরা বাকারাঃ ২৮৫
অনুরূপভাবে মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান আনা ইসলামের কলেমা শাহাদাতের দ্বিতীয় অংশ। এছাড়া কারো ঈমান গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয় না।
নবীদের উপর ঈমান আনা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? এর কারণ এই যে, আল্লাহর সঠিক পরিচয় জানার জন্য তাঁরাই হচ্ছেন একমাত্র মাধ্যম। তাঁদের মাধ্যমৈই আমরা জানতে পারি, আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের কাছে কি চান? তিনি তাদের কি অবস্থায় দেখতে চান?
নবী-রসূলদের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক তা নির্ভেজাল মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। এই সম্পর্ক তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং বাহ্যিক দেহের সাথে নয়। এ সম্পর্ক মূলত তাঁদের কাছে আসা ওহীর সাথেই হয়ে থাকে, তারা যে হেদায়াত নিয়ে আসেন তার সাথেই হয়ে থাকে। অতএব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
তোমাদের কেউই ঈমানদার হতে পারো না, যতক্ষণ তার কামনা-বাসনা আমার আনীত আদর্শের অনুগত না হবে।–শারহুস সুন্নাহ
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
যাদের কাছে রাসূল পাঠানো হয়েছে আমরা অবশ্যই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করব এবং নবী-রসূলদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করব। আমরা পূর্ণবিজ্ঞতাসহকারে সমস্ত কাহিনী তাদের কাছে পেশ করব। আমরা তো কোথাও লুকিয়ে ছিলাম না।–সূরা আরাফঃ ৬,৭
ইসলাম ছাড়া আরো দুটি ধর্ম রয়েছে –ইহুদী ধর্ম ও খৃষ্ট ধর্ম। এ দুটিই ইসলামের পূর্ববর্তী যুগের ধর্ম। কিন্তু আজ এ দু’টি ধর্মের কোন নির্ভরযোগ্যতা নেই। এই দুই ধর্মের অনুসারীরা নিজ নিজ ধর্মকে নিকৃষ্টভাবে কদাকার করে রেখে দিয়েছে। তাদের আসমানী কিতাবসমূহ যথেচ্ছাবাবে তাহরীফ (পরিবর্তন) করা হয়েছে। অতএব আজ সঠিক ঈমানের জন্য যদি কোথাও কোন পথনির্দেশ থেকে থাকে, তাহলে কেবল ইসলামেই তা বর্তমান আছে।
আজ কেবল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের উপর নাযিলকৃত কিতাবেই হেদায়েতের আলো পাওয়া যেতে পারে এবং তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যেতে পারে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চাবিকাঠি আজ আর ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদের হাতে নেই। আজ কেবলমাত্র ইসলামই মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিতে পারে।
আজ কেবল ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েই আল্লাহ তায়ালার সঠিক পরিচয় লাভ করা সম্ভব। এর প্রবর্তক হচ্ছেন আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (সঃ) তাঁর পাঠানো সর্বশেষ ঐশীগ্রন্থ আল-কুরআন এবং চিরস্থায়ী শরীআত যা সম্পূর্ণ সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। ইসলামের প্রদর্শিত পথ সহজ, সরল ও পরিস্কার। এখান থেকেই স্পষ্টভাবে জানা যায়, আল্লাহ তাঁর বান্দার কাছে কি চান এবং তিনি তাদের উপর কি দায়িত্ব অর্পন করেছেন। এখানে কোনরূপ পরিবর্তন পরিবর্ধন নেই।
এজন্যই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান আনলেই আল্লাহর উপর ঈমান নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হবে। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এই সত্যের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমনঃ
(আরবী****************************************************************************************)
যেসব লোক কুফরী করেছে এবং (জনগণকে) আল্লাহর পথে আসতে বাধা দিচ্ছে, আল্লাহ তাদের যাবতীয় আমল নিস্ফল করে দিয়েছেন। আর যারা ঈমান এনেছে, ভাল কাজ করেছে এবং মুহাম্মাদের উপর যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তার উপরও ঈমান এনেছে –তা সত্য এবং তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে এসেছে –আল্লাহ তাদের দোষত্রুটি দূর করে দিয়েছেন এবং তাদের অবস্থা সুষ্ঠু ও সঠিক করে দিয়েছেন। তা এই কারণে যে, অবাধ্যচারণকারীরা বাতিলের অনুসরণ করেছে এবং ঈমান গ্রহণকারীরা তাদের প্রভুর কাছ থেকে আগত হকের অনুসরণ করেছে। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা লোকদেরকে তাদের আসল অবস্থা বলে দিয়ে থাকেন।–সূরা মুহাম্মাদঃ ১-৩
কারো এরূপ ভুল ধারণা শিকার হওয়া উচিৎ নয় যে, এটা নিজেদের নবী (সঃ) প্রশংসায় অযথা বাড়াবাড়ি, অথবা এতে স্রষ্টার কোন অধিকার খর্ব হচ্ছে অথবা পূর্ববর্তী মুসা ও ঈসা আলায়হিস সালামের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে কিতাব এসেছে এবং তাঁরা লোকদের যে পথে পরিচালিত করেছিলেন তা সত্য ন্যায়েরই পথ ছিল। কিন্তু তাদের পরে তাদের অনুসারীরা এই দীনে হকের উপর কি জুলুম করেছে –সে সম্পর্কে তাদের কি কোন খবর আছে? যদি তাঁরা আজ দুনিয়ায় ফিরে আসতেন, তাহলে নিজেদের কিতাবের এই করুণ অবস্থা দেখে চরমভাবে ব্যথিত হতেন, সামনে অগ্রসর হয়ে ইসলামের কিতাবকেই সাদরে গ্রহণ করতেন এবং কুরআনের শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অস্থির হয়ে পড়তেন।
অতএব যেভাবে আল্লাহ এবং তাঁর সব নবীদের উপর ঈমান আনা ফরয, তেমনিভাবে যদি তাদের কোন একজনকে প্রত্যাখ্যান করা হয় তাহলে এটা আল্লাহ এবং তাঁর সব নবীদের প্রত্যাখ্যান করারই শামিল। পবিত্র কুরআনের বাণীঃ
(আরবী************************************************************************************)
যেসব লোক আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের অমান্য করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করতে চায় আর বলে, ‘আমরা কতককে মানব আর কতককে মানব না’ তারা কুফর ও ইসলামের মাঝে একটি পথ বের করার ইচ্ছা পোষন করে। এরাই হচ্ছে পাক্কা কাফের। এই কাফেরদের জন্যই আমরা লাঞ্ছনাকর শাস্তি নির্দিষ্ট করে রেখেছি। অপর দিকে যেসব লোক আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের মানে এবং তাদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করে না –তাদেরকে আমরা অবশ্যই তাদের পুরস্কার দেব। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল এবং অনুগ্রহকারী।–সূরা নিসাঃ ১৫০-১৫২
মুহাম্মদ (সঃ) নবীদের মধ্যে সর্বশেষ নবী। তাঁর মাধ্যমেই নবুয়াত নামক প্রাসাদের নির্মাণ কাজ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে এবং রিসালাতের ধারাবাহিকতার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী****************************************************************************************)
আমার ও আমার পূর্ববর্তী নবীগণের দৃষ্টান্ত এইরূপঃ যেমন কোন ব্যক্তি একটি প্রাসাদ নির্মাণ করল এবং খুব সুন্দর করে নির্মাণ করল, কিন্তু এক কোণায় একটি ইটের জায়গা খালি রেখে দিল। লোকেরা এই প্রসাদের চারদিকে প্রদক্ষিণ করত এবং এর সৌন্দর্য দেখে বিস্ময় প্রকাশ করত। কিন্তু তারা বলত, এখানের এই ইটখানি লাগানো হয়নি কেন? জেনে রাখ, আমিই সেই ইট এবং আমিই সমস্ত নবীদের শেষ নবী।–বুখারী, মানাকিব অধ্যায়
অতএব রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের পর কোন ব্যক্তি আমাদের কাছে এসে নবুয়াতের দাবি করলে সে মিথ্যাবাদী এবং যে ব্যক্তি তাকে নবী বলে মানবে সে কাফের। বাহাউল্লাহ এবং গোলাম আহমাদ নামে দুই ব্যক্তি নিজ নিজকে নবী বলে দাবি করেছে এবং নির্বোধদের একটি দল এদের পেছনে সারিবদ্ধ হয়েছে। এরা ইসলামের সাথেও নিজেদের সম্পর্ক প্রমাণ করে এবং অন্যান্য সব ধর্মকেও সঠিক বলে সাব্যস্ত করে। ইসলামের ছদ্মবরণে তারা দুরভিসদ্ধিমূলকভাবে নিজেদের বাতিল মতবাদ প্রচার করছে। আল্লাহর দীনের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।
তারা যে বাহাউল্লাহ ও গোলাম আহমাদের উপর ঈমান এনেছে এদের উভয়ই দাজ্জাল এবং কাজ্জাব (ডাহা মিথ্যাবাদী)। তাদের সমস্ত শিক্ষাই মিথ্যা এবং প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। কুরআন মজীদের বর্তমানে কোন প্রকারের ওহী নাযিল হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
(আরবী**************************************************************************************)
মহাসত্যের পর গোমরাহী ছাড়া আর কি-ই বা অবশিষ্ট থাকে।–সূরা ইউনুসঃ ৩২
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তাঁর ইন্তেকালের পূর্বেই এই ধরনের প্রতারকদের সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে গিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ
(আরবী*************************************************************************)
শেষ যুগে আমার উম্মতের মধ্যে অনেক দাজ্জাল ও কাযযাবের আবির্ভাব হবে। তারা তোমাদের এমন সব কথা শুনাবে যা তোমরা কখনো শুননি এবং তোমাদের পূর্বপুরুষেরা শুনেনি। অতএব তাদের ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থাকবে যেন তারা তোমাদের পথভ্রষ্ট করতে না পারে। সাবধান! তারা যেন তোমাদের বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করতে না পারে।
অপর এক হাদীসে তিনি বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************************)
অচিরেই আমার উম্মতের মধ্যে তিরিশজন কাযযাবের আবির্ভাব হবে। তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবি করবে। অথচ আমিই নবীদের মধ্যে সর্বশেষ নবী। আমার পরে আর কোন নবী আসবে না। আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সব সময় হকের উপর কায়েম থাকবে। তাদের বিরুদ্ধবাদীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ফয়সালা এসে যাবে এবং তখনো তারা হকের উপরই অবিচল থাকবে।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম আদাদের আরো কতিপয় জিনিসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, যা আমাদের আকীদা-বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত। আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের সাহায্যে তা জেনে নেয়া বা এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছু জানা সম্ভব ছিল না।কেননা এর সম্পর্ক রয়েছে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের সাথে যা আমাদের দৃষ্টিসীমার অন্তরালে রয়ে গেছে। মানবীয় জ্ঞান-গবেষণা ও অনুসন্ধান করে কিছু তথ্য আবিস্কার করতে পারবে হয়ত, কিন্তু এই গবেষণার পর যে চিত্র আমাদের সামনে আসবে তা হবে খুবই অস্পষ্ট ও অপূর্ণাঙ্গ।
কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে আমাদের পরিপূর্ণ সুস্পষ্ট হেদায়াত দান করেছেন। তার আলোকেই আমরা এ আলোচনা করি এবং তাঁর আনুগত্য করার ক্ষেত্রে আমরা এসব কথার উপর ঈমান রাখি!