৬
গুনাহ ও তওবা
ঈমান ও অপরাধ
আমাদের আকীদা এই যে, ঈমান ও আমলের মধ্যে আন্ত-সম্পর্ক বিদ্যমান। এ কথার অর্থ এই নয় যে, ঈমানের অর্থ হচ্ছে নিষ্পাপ বা মাসুম থাকা। অর্থাৎ গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা ঈমানের তাৎপর্য নয়। কেননা মুমিন ব্যক্তিও ভুল করে বসতে পারে। কিন্তু মুমিন ব্যক্তির পদস্খলন তাকে দীনের গণ্ডি থেকে বহিস্কার করে দেয় না। এই বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার, যাতে এর সবগুলো দিক সামনে এসে যায়।
কোন ব্যক্তি যখন মজবুত ঈমানের অধিকারী হয়, যখন সে আল্লাহর আনুগত্যে সদা সক্রিয় থাকে এবং যখন সে আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণ করে তখন তার দ্বারা গুনাহের কাজ খুব কমই সংঘটিত হয়। কখনো যদি সে হোঁচট খেয়ে খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তাহলে এটা তার স্বাভাবিক জীবরে ব্যতিক্রমী ঘটনা। যেমন কোন মূলনীতির ব্যতিক্রম ঘটনাও কখনো কখনো ঘটে থাকে। এরূপ ব্যক্তির ভুলের যে মেজাজ-প্রকৃতি হয়ে থাকে, তা তার ভুলকে একটা ভিন্নতর স্বরূপ দান করে। সে ইচ্ছাপূর্বক এই খারাপ কাজ করে না, এ থেকে সে নিরাপদও থাকতে পারে না এবং এর উপর সে অনুক্ষণ স্থিরও থাকে না।
তার দৃষ্টান্ত এইরূপ যে, কোন পথিক তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যপথে এগিয়ে চলছে, সে তার প্রয়োজন না কাজের চিন্তায় ডুবে গেছে, হঠাৎ তার পা কোন খাদে পড়ে গেল। সে দ্রুত এই খাদ থেকে উঠে আসে। এভাবে পণ্ড যাওয়ার জন্য সে নীরবে লজ্জিত হয় এবং ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়।
তদ্রুপ একজন মুমিনের অবস্থা। সে দ্রুত পদক্ষেপে নিজের প্রতিপালকের দিকে ছুটে আসে। হঠাৎ তার পা ফসকে যায় এবং সে এমন এক কাজ করে বসে যা তার জন্য মোটেই শোভনীয় নয়। কিন্তু সে পংকিলতার এই গর্তে পতিত হওয়ার সাথে সাথেই বের হয়ে চলে আসে এবং এ সময় অনুশোচনায় তার চেহারা মলিন হয়ে যায়। তার অন্তরে দুঃখ-বেদনার তুফান সৃষ্টি হয়ে যায়।
এই ধরনের ভুলভ্রান্তি মুমিনের চরিত্রকে কলংকিত করতে পারে না। তার ব্যক্তিত্বকেও পর্যুদস্ত করতে পারে না। পর্যুদস্ত হওয়ার প্রশ্নই বা কেন? তাজী ঘোড়াও কখনো হোঁচট খেয়ে যায়, বীর সৈনিকের তরবারীও কখনো হাত থেকে সিটকে পড়ে যায়।
মানুষ দুই ধরনের উপাদানের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে। একটি উপাদানের সম্পর্ক রয়েছে উর্ধ্ব জগতের সাথে এবং অপরটির সম্পর্ক রয়েছে মাটির সাথে। অতএব মানুষের কর্মতৎপরতার আয়নায় এই উভয়বিধ উপাদানের প্রতিচ্ছবি দৃষ্টিগোচর হয়। তার স্বভাব-প্রকৃতির বিচারে এটা কোন তাজ্জবের ব্যাপার নয় যে, সে কখনো হীন কাজের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। এজন্য আল্লাহতাআলা এ ধরনের যাবতীয় অপরাধ নিজের ক্ষমার আঁচলে লুকিয়ে নেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ
(আরবী************************************************************************************)
যেসব লোক বড় বড় গুনাহ ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকে –তবে কিছু অপরাধ তাদের দ্বারা ঘটে যায়। তোমার প্রতিপালকের ক্ষমা যে ব্যাপক ও বিশাল তাতে কোন সন্দেহ নেই।–সূরা নাজমঃ ৩২
তাঁর এই উদারতাপূর্ণ ক্ষমতার কারণ এই যেঃ
(আরবী**************************************************************************************)
তিনি তোমাদের সেই সময় থেকে খুব ভালভাবেই জানেন যখন তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন আর যখন তোমরা তোমাদের মায়েদের গর্ভে ভ্রুণ অবস্থায় ছিলে।–সূরা নাজঃ ৩২
কবি বলেনঃ
মানুষের প্রকৃতিই তাকে ঝুঁকিয়ে দেয়
একবার
গলিত আঠালো মাটির দিকে।
আমরা পূর্বেও বলে এসেছি মুমিন লোকদের এ ধরনের পদস্খলন হতে পারে। তারা আল্লাহর রাস্তায় অবিচল থেকে যাবতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালতে তৎপর থাকে এবং নিজেদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য চিন্তামগ্ন থাকে। এরই ফাঁকে কোন এক অসতর্ক মুহুর্তে তাদের পা ফসকে যেতে পারে। এই পদস্খলন তাদের অজান্তে হয়ে যায়। এ ময় সে কিংকর্তভ্যবিমূঢ় হয়ে যায়, দুঃখ-বেদনায় হৃদয় ভরে যায়। তার এই অবস্থা পদস্খলনের দাগকে ধুয়েমুছে পরিস্কার করে দিতে থাকে এবং এর পরিণতিকে খুবই হাল্কা করে দেয়।
এটাও তার জন্য কম শাস্তি নয় যে, এই পদস্খলন সব সময় তার অন্তরে করাঘাত করতে থাকে এবং সে বিনীতভাবে নিজের প্রতিপালকের পদতলে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এ ধরনের লোকদের সম্পর্কেই আল্লাহতাআলা বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************************)
আর যে ব্যক্তি পরম সত্য নিয়ে এলো, এর যেসব লোক তা সত্য বলে মেনে নিল –তারাই মুত্তাকী। তাদের মনে যেসব ইচ্ছা জাগবে তা সবই তারা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে পাবে। নেক কাজ সম্পাদনকারীদের জন্য এটাই প্রতিদান। তারা যে নিকৃষ্টতম কাজ করেছিল তা যেন তাদের হিসাব থেকে আল্লাহতাআলা খারিজ করে দেন এবং যে উত্তম কাজ তারা করেছিল সেই অনুপাতে তিনি তাদের প্রতিফল দান করতে পারেন।–সূরা যুমারঃ ৩৩-৩৫
(আরবী**********************************************************************************)
আর যারা ঈমান আনবে ও সৎকা করবে তাদের দোষগুলি আমরা তাদের থেকে দূর করে দেব এবং তাদেরকে উত্তম কাজের প্রতিফল দান করব।–সূরা আনকাবুতঃ ৭
মনস্ততত্ত্ববিদগণ এই সাময়িক পদস্খলনের উপর অধিক সময় অবস্থান করা ঠিক মনে করেন না। তাদের দৃষ্টিতে পতনোন্মুখ ব্যক্তির হাত টেনে ধরতে হবে, যাতে সে তাড়াতাড়ি উঠে আবার লক্ষ্যপথে অগ্রসর হতে পারে। সে পূর্বের মতো অথবা তার চেয়েও অধিক আনন্দ সহকারে পুনর্বার নিজের কর্তব্যকর্মে লেগে যাবে। সংঘটিত এই ভুলভ্রান্তিকে যদি তারা গুরুত্ব না দিয়ে থাকে তাহলে এর কারণ এই নয় যে, তা তাদের কাছে পছন্দনীয়। বরং তারা ভুলের শিকার ব্যক্তিকে এর কু-প্রভাব থেকে বাঁচাতে চান, তাকে দ্রুত গর্ত থেকে তুলে নিতে চান। তারা তাকে পথ হারিয়ে সর্বস্বান্ত হতে দিতে চান না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের বাণীর স্বরূপও তাই। তিনি বলেনঃ
(আরবী************************************************************************************)
এক ব্যক্তি গুনাহের কাজ করে বসল। সে বলল, হে আল্লাহ! আমার গুনাহ মাফ করে দাও। তখন মহামহিম আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা একটি অপরাধ করেছে। সে জানতে পেরেছে যে, তার একজন প্রভু আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমাও করতে পারেন এবং এজন্য জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারেন। সে পুনরায় একটি গুনাহ করে বসল। অতঃপর বলল, হে প্রভু! আমার গুনাহ মাফ করে দাও। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার বান্দা একটি গুনাহ করে ফেলেছে এবং সে জানতে পেরেয়ে যে, তার একজন প্রভু আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমাও করতে পারেন এবং এ জন্য জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারেন। সে পুনরায় অপরাধ করে ফেলল। অতঃপর বলল, হে প্রভু! আমায় ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার বান্দা অপরাধ করে বসেছে এবং সে জানতে পেরেছে যে, তার একজন প্রভু আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমাও করতে পারেন এবং এজন্য জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারেন। অতপর তুমি যা চাও করতে পার, আমার ক্ষমতার দরজা তোমার জন্য খোলা রয়েছে।–বুখারী, মুসনাদে আহমাদ
এ হাদীস এবং এ ধরনের অন্যান্য হাদীস বলছে যে, যতই গুনাহ করা হোক –না কেন, তওবার দরজা সব সময়ই খোলা থাকে। তা সেই লোকদের জন্যই –যাদের উল্লেখ আমরা এইমাত্র করেছি। নেক কাজের প্রসার ঘটানো যায় তাহলে তাকে দ্রুত তা থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। শয়তান যখনই কারো দৃষ্টিকে নিচের দিকে নিবদ্ধ করাবে –তখনই সাথে সাথে তাকে উচ্চতার দিকে উঠিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
এসব হাদীসের উদ্দেশ্য কখনো তা নয় –যা নির্বোধ লোকেরা নির্ধারণ করেছে। তাদের মতে পদস্খলনকে কোন গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই। অপরাধীদের ইসলামের নির্দেশসমূহের পরিপন্থী কাজ করার অবাধ অধিকার থাকবে, যেন তারা হারাম কাজে নিজেদের জড়াতে পারে।
এই দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণরূপে ইসলামের পরিপন্থী। এই দৃষ্টিভঙ্গী নবুয়াতের ভিত্তিকেই ধ্বসিয়ে দেয় –যাঁরা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। যে অসংখ্য হাদীস খারাপ কাজের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করছে –উল্লেখিত দৃষ্টিভঙ্গী তার প্রকাশ্য বিরোধিতার পথ খুলে দেয় এবং এসব হাদীস সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতাকে তুলে ধরে। এসব হাদীসের ভ্রান্ত অর্থ গ্রহণ করা, অতঃপর ভাল কাজে শিথিলতা প্রদর্শন করা মানুষের একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপ। সব অপরাধের ধরন একরকম নয় এবং সব অপরাধীও একই মানসিকতা সম্পন্ন নয়।
অজ্ঞতা, অলসতা ও বোকামীর বিভিন্ন ধরন হতে পারে, যা মানুষকে অপরাধে অভ্যস্ত করে দেয়। অতঃপর সে খুব তাড়াতাড়ি তা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। তা সত্ত্বেও তার অন্তরে ঈমান কঠিন আকর্ষন-বিকর্ষণ সৃষ্টি করে। তা অবশিষ্ট থাকা বা না থাকা অপরাধীর অবস্থার উপর নির্ভরশীল। সে আল্লাহ থেকে কতটা দূরে সরে পড়েছে এবং গুনাহের কতটা নিকটবর্তী হয়ে পড়েছে –এটাই ফয়সালা করে দেয।
সে যাই হোক, কোন মুসলমান অপরাধ করে ফেললে সে দ্রুত তওবা করে পাকসাফ হয়ে যায়, অথবা তাকে তওবা ও অনুশোচনার অনুভূতি দংশন করতে থাকে এবং এর ভিত্তিতে সে ইসলামের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকে।
যেসব লোক পাপকাজে লিপ্ত থাকে এবং অনুশোচনার অনুভূতি ও শাস্তির আশংকা মনে থাকা সত্ত্বেও অবিলম্বে তওবা করে না –তাদের সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না যে, ভবিষ্যতে তাদের পরিণতি কি হবে। কেননা ভ্রান্ত কাজের অবিরত আক্রমণ ঈমানকে পরাভূত করে দেয়। তা একজন মুসলমানকে কুফরীর বাহুবন্ধনে নিয়ে যায়। যেমন কোন দূরারোগ্য ব্যাধি যদি কাউকে আক্রমণ করে বসে, তাহলে তা ঘুণে পোকার মত তার সমস্ত শরীর জর্জরিত করে ফেলে এবং একটি সজীব ও স্বাস্থ্যবান মানুষকে অন্তসারশূন্য করে দেয়।
সে যাই হোক, ঈমানের সাথে গুনাহের সম্পর্ক অত্যন্ত ক্ষীণ। আমরা একথা বলতে পারি যে, সত্ত্বেও ঈমান অবশিষ্ট থাকে। অবশ্য যদি কোন ব্যক্তি পাপ কাজ করে গর্ববোধ করে এবং ফরযসমূহকে উপহাস করে –তাহলে ইসলামের সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না এবং সে ধর্মত্যাগী মুরতাদ হিসাবে গণ্য হবে। এটা এমন এক জঘন্য মনোভাব যা কোন মুমিন ব্যক্তি সম্পর্কে কল্পনা করা যায় না।
এটা অসম্ভব নয় যে, কোন মুমিন ব্যক্তি কোন ভাল কাজে কিছুটা অলস হতে পারে, কিন্তু তার পক্ষে খারাপ কাজের অগ্রসর হওয়া এবং প্রকাশ্যে আল্লাহর নাফরমানী করার কল্পনাও করা যায় না। আল্লাহ তাআলা তাঁর কালামে পাকে পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে, মুমিন ব্যক্তি অজ্ঞতাবশতঃ পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ ইন্দ্রিয় আবেগ, দুর্বলতা, নিরুৎসাহ অথবা প্রবৃত্তির তাড়নায় সে পাপ কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে।
(আরবী*************************************************************************************)
যেসব লোক অজ্ঞতাবশতঃ কোন অন্যায় কাজ করে বসে, অতঃপর অবিলম্বে তওবা করে –কেবল তাদের তওবাই আল্লাহর নিকট কবুল হতে পারে। আল্লাহ তাআলা এদের তওবাই গ্রহণ করে থাকেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং মহাজ্ঞানী। কিন্তু যেসব লোক অব্যাহতবাবে পাপ কাজ করতে থাকে তাদের জন্য তওবার কোন অবকাশ নেই। এই অবস্থায় যখন তাদের কারো মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয় তখন বলে, এখন আমি তওবা করলাম। অনুরূপভাবে যেসব লোক মৃত্যু পর্যন্ত কাফির থাকে তাদের জন্যও তওবার কোন সুযোগ নেই।–সূরা নিসাঃ ১৭, ১৮
(আরবী*************************************************************************************)
তোমাদের প্রতিপালক দয়া-অনুগ্রহ করাটা নিজের উপর বাধ্যতামূলক করে নিয়েছেন। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অজ্ঞতাবশত কোন অন্যায় কাজ করে বসে, অতঃপর তওবা করে এবং সংশোধন হয় –তাহলে আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন এবং নরম ব্যবহার করেন। এভাবেই আমরা আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট করে পেশ করি, যেন অপরাধীদের পথ সুপ্রকট হয়ে উঠে।–সূরা আনআমঃ ৫৪,৫৫
ঈমানের সাথে আনুগত্য ও অন্যায় কাজের যে সম্পর্ক রয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। প্রথমটি হচ্ছে ঈমানের খাদ্য যার দ্বারা সে ফলে-ফুলে সুশোভিত হয় এবং পরিপুষ্ট থাকে। আর দ্বিতীয়টি যেন গরম বাতাস –লু হাওয়া যার ফলে ঈমানের দাবি করে তাকে বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। জিহাদের বিভিন্ন স্তরে তার পরীক্ষা চলে। সন্দেহ-সংশয়ের অন্ধকারের সাথে মোকাবেলা করতে হয়। জীবনের কর্মক্ষেত্রে অবিচলতার পরিচয় দিতে হয়। নীতির প্রশ্নে আপোসহীনতর প্রমাণ দিতে হয় ইত্যাদি। এই পরীক্ষা থেকে তার পলায়ন করার কোন উপায় নেই। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাকে অতিক্রম করতেই হবে। এরপর তার সফলতা বা ব্যর্থতার ফয়সালা হবে।
মানুষকে এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে –তা সম্ভব নয়। এটা হতেই পারে না যে, কোন ব্যক্তি ঈমানের মিথ্যা দাবি করবে আর তার কুফরী গোপন থেকে যাবে। কোন ব্যক্তি তার প্রতিপালককে ধোঁকা দিয়ে পার পেয়ে যাবে তা মোটেই সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা বান্দাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন তা মূলত এই পরীক্ষারই অব্রবাহিনী। এসব পরীক্ষা স্বভাব-প্রকৃতিকে নিংড়াতে থাকে এবং তার যাবতীয় ভাল ও মন্দ কাজ প্রকাশ করে দেয়। এই পরীক্ষা অনবরত ঈমানের গভীরতা ও মজবুতীকে পরখ করতে থাকে; ঈমানদার ব্যক্তি কি বেহেশতের অধিকারী না দোযখের উপযোগী, না উভয়টির –তা নির্ণয় করে দেয়। এভাবে মানুষ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হতে তার প্রতিপালকের দরবারে পৌঁছে যায়।
(আরবী*************************************************************************************)
আলিফ-লাম মীম। লোকেরা কি মনে করে নিয়েছে, “আমরা ঈমান এনেছি” এটুকু বললেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে এবং পরীক্ষা করা হবে না? অথচ আমরা এদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদের পরীক্ষা করেছি। আল্লাহকে তো অবশ্যই দেখে নিতে হবেকে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী। যেসব লোক খারাপ কাজ করছে তারা কি মনে করে নিয়েছে যে, তারা আমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে? তারা অত্যন্ত খারাপ ফয়সালাই করছে।–সূরা আনকাবুতঃ ১-৪
মানুষের পরিণতি কি হবে তার সিদ্ধান্ত একটি মাত্র অপরাধ অথবা একটি মাত্র আনুগত্যমূলক কাজের ভিত্তিতে নেওয়া যেতে পারে না। কেননা সময় দীর্ঘ, দায়িত্ব অনেক, কাজ বিভিন্নমুখী। অতএব এ সম্পর্কে সাধারণভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে না। হাদীসে এসেছেঃ
(আরবী**************************************************************************************)
মানুষের অন্তরের উপর ফিতনাসমূহ এমনভাবে জমে যায়, যেভাবে একটি চাটাইয়ের মধ্যে একটি একটি করে পাতা জমা নয়। যে অন্তরের মধ্যে ফিতনা ঢুকে পড়ে তার উপর একটি করে কালো দাগ পড়তে থাকে। আর যে অন্তর তা খারাপ জানে তার মধ্যে একটি করে সাদা দাগ পড়ে যায়। এভাবে অন্তরগুলো দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি হচ্ছে কালো দাগ ও ময়লাযুক্ত অন্তর। তা উপুড় করা পেয়ালার মত। তার কোন ভাল কাজের প্রতি কু-প্রবৃত্তির অনুসারী। আরেক অন্তর হচ্ছে উজ্জ্বল ধবধবে। আসান-যমীন যতদিন কায়েম থাকবে, এই ফিতনা এই অন্তরের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারবে না।
এ হাদীস থেকে জানা যায়, গুনাহসমূহের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। প্রতিটি পর্যায় তার পরবর্তী পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। অনন্তর অন্তরের মধ্যে যে বিভিন্ন অবস্থা ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে তাতে ঈমানও প্রভাবিত হয়। এমন কতগুলো অন্তর আছে যার উপর অনবরত পাপ কাজের আক্রমণ চলতে থাকে। ফলে ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার এমন কতগুলো অন্তর রয়েছে যা ধ্বংসের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তা যদিও এখনও ঈমানকে ধ্বংস করতে পারেনি কিন্তু গোমরাহীর গর্তের কিনারে পৌঁছে গেছে। আবার এমন কতগুলো অন্তর আছে যা ভাল ও মন্দের মাঝখানে নড়বড়ে অবস্থায় থাকে, একবার ডানদিকে ঝুঁকে যায় আর একবার বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়ে।
করবের উপর দুষ্কর্মের যে বিন্দু কালিমা জমতে থাকে –হাদীসে তাকে চাটাইয়ের পাতার সাথে তুলনা করা হয়েছে। যা একটি করে বুননের শৃঙ্খলে এসে যোগ হতে থাকে। হাদীসে একথাও বলা হয়েছে যে, দুষ্কর্মে আক্রান্ত কলবগুলো দুই ধরনের হয়ে থাকে।
এক. কলব তো তাকেই যা ফিতনার (দুষ্কর্ম) সম্মুখীন হতেই তার দ্বারা প্রভাবিত হয়। তা ফিতনাকে এমনভাবে শোষন করে নেয় যেমন তুলা পানিকে শুষে নেয় এবং এর উপর কালো তিলক চিহ্ন পড়ে যায়। সে আগত যেকোন দুষ্কর্মকে স্বাগত জানায়। শেষ পর্যন্ত তা কালো হয়ে পেয়ালার মত উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। অন্তর যখন কালো হয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় তখন তা দুটি ধ্বংসাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, যা থেকে তা আর কখনো আরোগ্য লাভ করতে পারে না। কোন ভাল কাজের প্রতি এর আকর্ষণ থাকে না এবং কোন খারাপ কাজের প্রতি ঘৃণা বোধও থাকে না। অনেক সময় এই রোগ এতটা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, ন্যায়কে অন্যায় এবং অন্যায়কে ন্যায়, ভালকে মন্দ এবং মন্দকে ভাল মনে করতে থাকে।
দুই. শরীআতের ব্যাপারে সে নিজের প্রবৃত্তিকে কর্তা বানিয়ে নেয়। প্রবৃত্তি তাকে যেখানে নিয়ে যায়, সে তার পিছে পিছে দৌঁড়াতে থাকে।
কিন্তু পরিস্কার এবং স্বচ্ছ অন্তরে ঈমানের নূর চমকাতে থাকে। যদি সে কখনো বা দুষ্কর্মে জড়িয়ে পড়ে তাহলে ঘৃণাভরে তার উপর পদাঘাত করে। এভাবে তার ঈমানের নূর আরও বেড়ে যায়। ফিতনা-বিপর্যয় এবং দুষ্কর্মের কোলাহলে ঈমানের অবস্থা কি হতে পারে সে প্রসঙ্গেও নিম্নোক্ত হাদীস উল্লেখযোগ্য। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী*****************************************************************************************)
বান্দাহ যখন কোন গুনাহ করে বসে তখন তার কলবের উপর একটি কাল দাগ পড়ে যায়। অতঃপর যখন সে তা পরিত্যাগ করে, ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তওবা করে তখন তার কলব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যদি সে অপরাধের পর অপরাধ করতেই থাকে তাহলে তার অন্তরের কালো দাগও বেড়ে যেতে থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত তার অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। আর এটাই হচ্ছে ‘মরিচা’ যা আল্লাহ পাক তাঁর কুরআন মজীদে উল্লেখ করছেনঃ
“কক্ষণও নয়, বরং এই লোকদের কলবের উপর তাদের পাপ কাজের মরিচা জমে গেছে। কক্ষণও নয় নিঃসন্দেহে এই লোকদের সেদিন তাদের প্রতিপালকের দর্শন লাভ থেকে বঞ্চিত রাখা হবে। অতঃপর তারা দোযখে নিপতিত হবে। -সূরা মুতাফফিফীনঃ ১৪-১৬
ইমাম তিরমিযী (রহ) এ হাদীসটিকে হাসান-সহীহ বলেছেন।
তওবা এবং নিষ্কলংকতা
বাস্তবিকপক্ষে মানুষ বড়ই অপরাধী। অপরাধ করাটা যেন তার মজ্জাগত ব্যাপার। অপরাধপ্রবণতা তার মধ্যে এমনভাবে সক্রিয় যেমন শিরা-উপশিরায় রক্তের প্রবাহ সদা-সক্রিয়। এজন্য কাউকে একেবারে নিষ্পাপ নিষ্কলুষ হতে হবে এমন দাবি করা যায় না। আল্লাহ তাআলা কাউকে একেবারে নিষ্পাপ থাকতে বাধ্য করেননি। তাঁর দাবি হচ্ছে, মানুষ যখনই কোন অপরাধ করে বসবে সাথে সাথে তওবা করে নেবে এবং পুনরায় সঠিক পথে ফিরে আসবে। কখনো তার পদস্খলন হলে সাথে সাথে সতর্ক হয়ে যাবে। কখনো হোঁচট খেয়ে মাটিতে উল্টে পড়ে গেলে সাথে সাথে উঠে দাঁড়াবে, শরীরে কোন ময়লা লেগে থাকলে তা ঝেড়ে ফেলবে এবং পুনরায় লক্ষ্যপথে এগিয়ে চলবে।
মানুষের আত্মাও বলতে গেলে তার দেহের মত। উভয়ই সব সময় পাক-পবিত্র থাকতে চায়। কেননা দেহ ও আত্মা থেকে সব সময় এমন জিনিস বের হয় এবং তার মধ্যে বাইরে থেকে প্রবেশ করে যা অনবরত গোসল এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখঅর দাবি জানায়। দেহে এমন সব গ্রন্থি এবং কলকব্জা রয়েছে যা সব সময় লালা নির্গত করে। সে যে যমীনের বুকে বাস করে তার পরিবেশ অনবরত তার দেহে ধুলোবালি জমা করে। অতএব স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এসব ময়লা দূর করে ফেলা একান্ত প্রয়োজন।
অনুরূপভাবে মানুষের অন্তরও খারাপ কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাছাড়া অন্যদের সাহচর্যে সে নানারূপ পরীক্ষার সম্মুখীন হতে পারে এবং নিত্য নতুন উত্তেজনার শিকার হতে পারে। এজন্য প্রয়োজন বারবার তওবা করার এবং ক্ষমা প্রার্থনা করার –যাতে অন্তরের ময়লা দূর হতে পারে এবং কালো দাগ বিলীন হয়ে যেতে পারে। যেমন গোসলের মাধ্যমে দেহ থেকে ময়লা দূর করে তা পরিস্কার রাখা হয়। কুরআন পাকের নিম্নোক্ত আয়াত সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেঃ
(আরবী**************************************************************************************)
নিশ্চিতই আল্লাহ তাআলা তওবাকারীদের ভালবাসেন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের পছন্দ করেন।–সূরা বাকারাঃ ২২২
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম সব সময় তওবা করতেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। অন্যদেরও তিনি এ কাজে উৎসাহিত করতেন এবং বলতেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর। আমি আল্লাহর কাছে দৈনিক একশো বার তওবা করে থাকি।
এই গুণের জন্য কুরআন মজীদ নবী-রাসূলদের প্রশংসা করেছে। হযরত সুলায়মান আলায়হিস সালাম সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************************)
অতি উত্তম বান্দাহ, বারবার খোদার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।
-সূরা সাদঃ ৩০
আল্লাহ তাআলা মুমিন লোকদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, তিনি তাদেরকে ব্যক্তি-স্বার্থের মালিন্য, প্রবৃত্তির তাড়না এবং জীবনযাত্রার পথের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। কেননা জীবনের প্রতিটি মুহুর্তেই তারা ঈমানের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। নিম্নোক্ত আয়াত এই বাস্তব সত্যকেই তুলে ধরেছেঃ
(আরবী**************************************************************************************)
ঈমানদার লোকদের সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন আল্লাহ। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন। আর যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করে তাদের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে আল্লাহদ্রোহী শক্তি ‘তাগুত’। এটা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যায়।–সূরা বাকারাঃ ২৫৭
এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের দ্বারা যে ভুলভ্রান্তি হয়ে যায় তার ধাপগুলোর মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে। একই জিনিস কারো জন্য সঠিক এবং বৈধ গণ্য হয়, কিন্তু অপরের জন্য ভ্রান্ত ও অবৈধ প্রমাণিত হয়। কবি বলেনঃ
একই কাজের ফল দ্বিবিধ হতে পারে
একজনের জন্য যা নেকী
অন্যের জন্য হতে পারে গুণাহের পর্যায়ভুক্ত।
তাসাওফপন্থীদের কথার অর্থও খুব সম্ভব তাইঃ
(আরবী**********************************************************************)
ধার্মিক লোকদের নেক কাজ নৈকট্যলাভকারী লোকদের অপরাধ বলে গণ্য হয়।
এই আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এ থেকে ফায়দা উঠানো এবং এর আলোকে অপরাধীদের অপরাধ এবং উদ্যত যুবকদের বেপরোয়া কার্যকলাপের চিকিৎসা করা। “ঈমান বর্তমান থাকলে গুনাহ কোন ক্ষতি করতে পারে না”।–এই ভ্রান্ত এবং নেতিবাচক দর্শনের কোন ভিত্তি নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গী মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় তাদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। এই ধ্যান-ধারণা একদিকে তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, শক্তি সামর্থ্য এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের পতন ঘটিয়েছে, অপরদিকে তা ঈমানকে একটি নৈতিক দুর্গ এবং জাতীয় সংহতি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি হিসেবে এর যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করেছে। তাছাড়া ঈমান যে জ্ঞানকে আলো দান করে এবং অন্তরকে প্রত্যয়ে পরিপূর্ণ করে দেয়, উল্লেখিত ধ্যানধারণা তার এই মর্যাদাকেও চরমভাবে আহত করেছে এবং সর্বপ্রথম তার অবয়বকে বিকৃত করে ছেড়েছে।
আমরা একথা বলছি না যে মানুষ অপরাধ করে বসলে চোখের পলকেই কাফির হয়ে যায়। ঈমানের প্রসঙ্গটি এর চেয়ে নাজুক। আমরা অবশ্যই এ কথা বলব যে, দুষ্কর্ম যখন ঈমানকে গ্রাস করে নেয় এবং তার উপর অবিরত আক্রমণ চালাতে থাকে, এভাবে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায় এবং ঈমান ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে থাকে –এই অবস্থায় তওবার অগ্নিস্ফুলিংগ উদ্ভাসিত হয়ে এই অন্ধকারের পর্দাকে ভেদ করতে পারে না। এ ধরনের অন্তর থেকে, শেষ পর্যন্ত ঈমান ধীরে ধীরে বিদায় নিতে থাকে, হৃদয়ের সৌন্দর্য বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং সে ভয়াবহ জাহিলিয়াতের দিকে ধাবিত হয়। আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী সম্পর্কে চিন্তা করে দেখা যাকঃ
(আরবী************************************************************************************)
হ্যাঁ, যে ব্যক্তি পাপ কামাই করেছে এবং পাপের জালে জড়িয়ে পড়েছে সে-ই হবে জাহান্নামী এবং চিরকাল জাহান্নামেই থাকবে। -সূরা বাকারাঃ ৮১
রাত-দিন অতিবাহিত হতে থাকে, দুষ্কর্ম নিজের জাল বিস্তার করতে থাকে, আর অমনোযোগী ব্যক্তি অপমান ও লজ্জার বিছানায় বেহুঁশ অবস্থায় পার্শ্ব বদল করতে থাকে। তার ঠিকানা দোযখ ছাড়া আর কি হতে পারে? আর তা কতই না নিকৃষ্ট ঠিকানা।
আয়াতে উল্লেখিত (সাইয়েআত) শব্দটি এখানে যদি শিরক এবং মূর্তিপূজা অর্থে ব্যবহৃত হত, তাহলে আয়াতের কোন অর্থই হয় না। এ আয়াত মূলত ইহুদী আলেমদের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে এবং তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। মূর্তিপূজার অর্থ করার সুযোগ কোথায়? আভিধানিক অর্থ এবং শরীআতের পরিভাষাগত দিকটিও এ ধরনের ব্যাখ্যা করার পথ বন্ধ করে দেয়। এজন্য কোন সুযোগই অবশিষ্ট থাকে না।
একটি বিতর্ক যুদ্ধ
কতিপয় লোক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যে, যে মুসলমান অনবরত গুনাহ করে এবং এর উপর অবিচল থাকে তার হুকুম কি? একদল বলেছেন, সে কাফির। অন্যরা বলেছেন, না না, সে মুসলমান। ঈমান অটুট থাকলে গুনাহ করলে আর কি হয়? অপর দল বলেছেন, ঈমান ও কুফরের মাঝখানে একটি স্তর আছে। সে এই পর্যায়ভুক্ত।
এ ছিল একটি শব্দগত বিতর্ক। এর ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহ দুটি পরস্পরবিরোধী দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং এর পরিণতিতে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বাস্তবিকপক্ষে এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করাটাই ভুল, বরং নাজায়েয। এটা মূলত ইসলামের মেজাজ-প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতারই ফল।
ইসরার (পুনঃ পুনঃ) শব্দটির মধ্যে ইচ্ছার একাগ্রতা এবং সংকল্পের দৃঢ়তার অর্থও নিহিত আছে। এ থেকে প্রকাশ পায় যে, কোন ব্যক্তি বাঞ্ছিত ফলাফল অনুমান করে নিয়েছে এবং উপায়-উপকরণ ও কার্যকারণ শক্তির উপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। অন্য কথায় বলা যায়, এটা আল্লাহর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ স্বরূপ, তাঁর সাথে নাফরমানী করার সংকল্প, তাঁর প্রতি বেপরোয়া মনোভাবের প্রকাশ এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা। একজন মুসলমানের বেলায় এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী কল্পনা করা যায় না।
নিঃসন্দেহে কোন নিষ্ঠাবান মুমিনের ইচ্ছা-শক্তির মধ্যে দুর্বলতা থাকতে পারে তার প্রবৃত্তির মধ্যে উত্তেজনা এবং তার আবেগের মধ্যে উচ্ছ্বাস থাকতে পারে, এভাবে সে খারাপ কাজের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। কিন্তু এটাকে ‘ইসারার’ বলা যায় না। যে ইতিবাচক শক্তি মানুষকে ভাল কাজের দিকে ধাবিত করে, তার দুর্বলতার কারণে সে যদি খারাপ কাজ করে বসে তাহলে এটাকে ‘দুষ্কর্মের উপর অবিচল থাকা বা তা বারবার করা’ বলাটা ঠিক হবে না। কেননা মুমিন ব্যক্তির কখনো পদস্খলন ঘটলে অবশ্যম্ভাবীরূপে তার মধ্যে এক ধরনের অপমান এবং লজ্জাকর অনুভূতি জাগ্রত হয় –চাই সে অনুভূতি দুর্বল হোক অথবা সবল।
কিন্তু যদি এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, কোন মুসলমান হাসতে হাসতে মারাত্মক অপরাধে লিপ্ত হয় এবং ইসলামী শরীআতকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে থাকে তাহলে বলতে হবে তার অন্তর থেকে আল্লাহর দীন বিদায় নিয়েছে এবং ইসলামের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।
অপমানবোধ এবং অনুভূতিই যেকোন মুমিন ব্যক্তিকে তওবার দিকে ধাবিত করে –চাই সে অবিলম্বে তওবা করুক বা বিলম্বে। এই অনুভূতিই তাকে ঈমানের সাথে সংযুক্ত করে রাখে। কিন্তু যদি এই বোধশক্তি বিদায় হয়ে যায় তখন ঈমানের আর কি বাকি থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী*************************************************************************************)
মুমিন এবং ঈমানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে যেন খুঁটিতে বাঁধা একটি ঘোড়া। তা চারদিকে চক্কর দেয় আবার নিজের খুঁটির কাছে কাছে ফিরে আসে। মুমিন ব্যক্তি ভুল করে বসে কিন্তু সাথে সাথে নিজের প্রতিপালকের কাছে ফিরে আসে।–মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৮-৫৫
তিনি আরো বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
মুমিন ব্যক্তি অপরাধী এবং তওবাকারী ও ক্ষমা প্রার্থনাকারী। যে ব্যক্তি তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে মারা যায় সে-ই হচ্ছে সৌভাগ্যবান।
ইসরার বা বাড়াবাড়ি এমন একটি জিনিস যা সহসা সৃষ্টি হয় না। মানুষ একবার, দু’বার, তিনবার, এভঅবে বারবার গুনাহ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তার অনুভূতির মৃত্যু ঘটে। এখন সে কেবল অপরাধই করে না, বরং অপরাধের প্রতি তার আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে যায়। এই অবস্থায় নামই হচ্ছে ইসরার। অপরাধের গলিপথে পা রাখার পর ঈমানের শিকড়গুলো কাটা শুরু হয়ে যায় এবং মানুষ যদি তওবার দিকে অগ্রসর না হয় তাহলে ঈমানের শিকড়গুলো কাটতেই থাকে।
এটা এমন একটা বিষয় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যাপারগুলোর সঠিক অধ্যয়ন এবং ঘটনাবলীর সঠিক মূল্যায়ন ছাড়া নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়। অন্যথায় বিতর্ক ও শব্দের মারপ্যাচ একটি খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমি এখানে নীতিশাস্ত্রের কিছু স্বীকৃত তত্ত্ব তুলে ধরতে চাই। এর আলোকে দুষ্কর্মের শ্রেণীবিভাগ, তার ধরন, দুষ্কৃতিকারীদের স্তর এবং এর ফলে কুফর অথবা ঈমানের সাথে তাদের কতটা কাছে অথবা দূর সম্পর্ক সৃষ্টি হয় –তা অনুধাবন করা যেতে পারে। উস্তাদ মুহাম্মদ ইউসুফ মূসা তার ‘মাবাহিসুন ফালসাফিয়াতুন ফিল আখলাক” নামক গ্রন্থে বোধশক্তির কয়েকটি স্তর বর্ণনা করেছেন। তা সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করা হলঃ
উদ্ভিদেরও খাদ্য এবং আলো-বাতাসের প্রয়োজন হয়। খাদ্য সংগ্রহের জন্য শাখা-প্রশাখা শূন্যের দিকে উঠে যায়। এটাকে তিনি ‘প্রয়োজন’ নাম দিয়েছেন।
যেসব জিনিস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে পশু জীবন ধারণ করে সে সেদিকেই ধাবিত হয়। সে জিনিস তার প্রয়োজন সে সম্পর্কে তার সীমিত জ্ঞানও আছে। কিন্তু এসব জিনিস লাভ করে যে ফল পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে পশুর কোন বোধশক্তি বা চেতনা নেই। তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘ক্ষুধা’।
তিনি পুনরায় বলেন, এরপর আমরা মানুষের দিকে অগ্রসর হব। আমরা দেখছি মানুষ তার প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের জন্য চেষ্টা সাধনা করে এবং এ সম্পর্কে তার পরিপূর্ণ বোধশক্তিও রয়েছে। তা অর্জন করতে পারলে যে আনন্দ পাওয়া যায় এবং হারিয়ে গেলে যে কষ্ট পাওয়া যায় –এ সম্পর্কে তার পূর্ণ অনুভূতি রয়েছে। এই জিনিসই তাকে জন্তু-জানোয়ারের থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করে। তার এই বৈশিষ্ট্যকে ‘ইচ্ছা বা মনোযোগ’ নাম দেওয়া যায়। মানুষ যে জিনিসের সঠিক ধারণা রাখে এবং এর ফলাফল সম্পর্কেও জ্ঞান রাখে –তার দিকে মনোনিবেশের নাম হচ্ছে ‘ইচ্ছা বা মনোযোগ’। মানুষের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য বিভিন্নরূপে হয়ে থাকে এবং তদনুযায়ী ইচ্ছাও বিভিন্নমুখী হয়ে যায়। কারো লক্ষ্য হচ্ছে বিখ্যাত ব্যক্তি হওয়া, কারো উদ্দেশ্য হচ্ছে নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব হস্তগত করা, কারো উদ্দেশ্য হচ্ছে ধন-সম্পদ অর্জন করা ইত্যাদি।
একই শ্রেণীভুক্ত ঝোঁকপ্রবণতা যা একই উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে তাকে ‘আলাম’ বলা হয়। আর এখান থেকেই আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। যখন কোন ঝোঁক-প্রবণতা সমশ্রেণীর অন্যসব ঝোঁকপ্রবণতার উপর বিজয়ী হয় এবং এগুলোকে পূর্ণরূপে পরিবেষ্টন করে নেয় তখন এটাকে বলা হয় ‘আকর্ষণ’।
অতঃপর যে জিনিসের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় –সে সম্পর্কে মানুষ যখন চিন্তা-ভাবনা করে, তার পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা থাকে তা দূরীভূত করে, যেসব গিরিপথ থাকে তা সমতল করে নেয়, অতঃপর তা অর্জনের জন্য একাগ্র হয়ে উঠে –এটা হচ্ছে আকর্ষণের পরবর্তী পর্যায়, আর এর নাম হচ্ছে ‘সংকল্প’। আকর্ষণ এবং সংকল্পের মধ্যে পার্থক্য এই যে, আকর্ষণ অনেক সময় পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না। তা বাঞ্ছিত ফলাফল থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। মানুষের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি হয় কিন্তু তা অর্জন করা সম্ভব হয় না।
ইচ্ছা বা সংকল্প সম্পর্কে বলা যায়, মানুষ প্রথমে কোন জিনিস সম্পর্কে চিন্তা করে, যাবতীয় উপায়-উপাদানের পরিমাপ করে, অবস্থা ও পরিবেশ যাচাই করে, বাঞ্ছিত জিনিস লাভ করা সম্ভবপর মনে হলে তা অর্জনের সংকল্প করে। অতঃপর বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের পালা আসে। যদি তা স্বভাবের মধ্যে ঢুকে যায় তখন তার নাম দেওয়া হয় স্বভাব। অতএব জানা গেল আভ্যন্তরীণ শক্তির এক আলামের উপর অপর আলামের বিজয়ী হওয়ার নাম হচ্ছে সংকল্প।
মনোবিজ্ঞানের এই ব্যাখ্যা থেকে পরিস্কার হয়ে যায় যে কবীরা গুণাহ বারবার করাটা এমনিভাবেই হয় না। এর পূর্বে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করতে হয়, যার পরিণতি হচ্ছে কবীরা গুনাহ। যেখানে এক স্তর শেষ হয় সেখানে পরবর্তী স্তরের সূচনা হয়। এভাবে সর্বশেষ স্তরে পৌঁছে যায়।
অতএব যখন আমরা জানতে পারলাম যে, কোন সাময়িক ঝোঁক-প্রবণতা অথবা কোন দুর্বার ইচ্ছার পরিণতিতে যে অপরাধ সংঘটিত হয় তা ঈমানকে অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। তা তার দেহে এত গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তার উপর তওবার কাঁটা ফুটানো না হয় এবং অনুশোচনার ব্যাণ্ডেজ না লাগানো হয়, ততক্ষণ তা নিরাময় হয় না।–নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী***************************************************************************************)
ব্যভিচারী যখন যেনায় লিপ্ত হয় তখন সে মুমিন থাকে না। (অর্থাৎ তার ঈমানী প্রত্যয়ে দুর্বলতা এসে যায়, অন্যথায় সে পাপে লিপ্ত হতে পারে না)। চোর যখন চুরি করে তখন সে মুমিন থাকে না। মদখোর যখন শরাব পান করে তখন সে মুমিন থাকে না।–ইবনে মাজাহঃ ফিতান অধ্যায়।
অতএব যে ব্যক্তি মারাত্মক অপরাধের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে তার ঈমানের অবস্থা কি হতে পারে? আর অপরাধ করাটা যার মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে তার ঈমান সম্পর্কেই বা কি বলা যায়? এরূপ অবস্থায় ঈমান বাকি থাকাটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। যদি তা অবশিষ্ট থাকতে পারে তাহলে বিতর্ক-প্রিয়দের খুপরির মধ্যেই অবশিষ্ট থাকতে পারে।
বারবার কবীরা গুনাহে লিপ্ত হওয়ার একটি মেজাজ-প্রকৃতিও আছে। তা জেনে নেয়া দরকার। বারবার অপরাধে লিপ্ত হওয়ার ক্ষতি শুধু এতটুকুই নয় যে, তা দুষ্কর্মের অন্তরালে ঈমানের সৌন্দর্যকে ঢেকে ফেলে, বরং তা মানুষকে দুষ্কর্মের মধ্যে এমনভাবে বিভোর করে দেয় যে, অতঃপর সে আর কোন ভাল কাজ করা বা কল্যাণের দিকে অগ্রসর হওয়ার যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলে। গুনাহের কাজে অবিরত লিপ্ত ব্যক্তিদের অবস্থা ঠিক সে ধরনের নয় –যা কুরআন মজীদ উল্লেখ করেছেঃ
(আরবী***************************************************************************************)
আরো কিছু লোক আছে যারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। তাদের আমল মিশ্রিত ধরনের –কিছু ভাল আর কিছু মন্দ। আশা করা যায় আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন। তিনি ক্ষমাকারী ও করুণাময়।–সূরা তওবাঃ ১০২
কখনও নয়, খারাপ কাজের উপর অবিচল থাকার অর্থ হচ্ছে, অন্তরের কল্যাণকর কাজ করার যে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত ছিল তা শুকিয়ে যাওয়া এবং এখন আর তার মধ্যে ভাল কাজ করার তৃষ্ণা থাকতে পারে না। এজন্যই নীতিশাস্ত্রের স্বীকৃত সত্য এই যে, যে চরিত্র বিভিন্ন রূপ ধারণ করে, কোন একটি অবস্থার উর যার স্থায়িত্ব নেই তাকে চরিত্র বলা যায় না। উস্তাদ মুহাম্মদ ইউসুফ মূসা বলেনঃ
যে দর্শন নৈতিকতাকে আপেক্ষিক জিনিস বলে তার উপর কোন গুরুত্ব দেওয়া আমাদের মোটেই উচিত নয়। অর্থাৎ মানুষের উপর যখন যে ধরনের ঝোঁক-প্রবণতা প্রভাব বিস্তার করবে তার পরিপ্রেক্ষিতে তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হবে। যেমন কোন ব্যক্তির উপর দানশীলতার আবেগ প্রভাবশীল এবং তার মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে খরচ করার প্রবণতা রয়েছে, কচিৎ সে কৃপণতা করে –তাহলে তাকে দানশীলই বলা হবে।
সত্য-মিথ্যা, ভাল ও খারাপ সব কাজের ক্ষেত্রেই এই অবস্থাই বিরাজমান। কিন্তু উল্লেখিত দৃষ্টিভঙ্গীর উর গুরুত্ব দেওয়া আমাদের জন্য সঠিক নয়। এজন্য যে, চরিত্র-নৈতিকতার মধ্যে দৃঢ়তা ও অবিচলতার বৈশিষ্ট্য থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। এর ফলে আমলের আকারে তার ফলাফল সর্বদা প্রকাশ পেতে থাকবে।
ঈমানের আওতায় যখন আমরা এই নৈতিক মূলনীতিকে সংযুক্ত করব তখন আমাদের মানতেই হবে যে, যেখানে পরিপূর্ণ ঈমান আছে সেখানে অবশ্যম্ভাবীরূপে নেক আমলও রয়েছে। যখনই আমলে ঘাটতি দেখা দেবে, ঈমানেও ঘাটতি দেখা দেবে। অতএব যেখানে অপকর্ম ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না সেক্ষেত্রে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতেই হবে যে, এখান থেকে ঈমান বিদায় নিয়েছে। এজন্যই আমরা বলেছি, দুষ্কর্মে অনবরত লিপ্ত থাকাটা ব্যাপক অর্থে কখনো কোন মুমিন চরিত্রে পাওয়া যেতে পারে না।
কুরআন-হাদীস এবং এর সঠিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে জানা যায় যে, শরীআত কাজের অনুপ্রেরণা ও চালিকাশক্তির উপর অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করে থাকে, যে আভ্যন্তরীণ অবস্থার প্রভাব থেকে কোন কাজই মুক্ত নয় এবং যার কারণে কোন কাজ অবিরত চলতে থাকে অথবা বন্ধ হয়ে যায় –যখন সে সম্পর্কে আশ্বস্ত হওয়া যায় তখন শরীআত ঈমান ও তার শুভ পরিণাম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত করে থাকে। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
আদম তার প্রতিপালকের অবাধ্যাচরণ করেছে, অতএব সে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।–সূরা ত্বাহাঃ ১২১
ইবনে কুতায়বা এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, একথা বলা যেতে পারে যে, আদম (আঃ) নাফরমানী করেছেন, কিন্তু একথা বলা মোটেই ঠিক নয় যে, তিনি নাফরমান ছিলেন। কেননা নাফরমান কেবল সেই ব্যক্তিকেই বলা যায়, যে নাফরমানীর মধ্যে ডুবে থাকে এবং নাফরমানীকেই নিজের অভ্যাসে পরিণত করে নেয়। যেমন কোন ব্যক্তি কাপড় সেলাই করছে, তখন বলা হয়, সে নিজের কাপড় সেলাই করছে, কিন্তু একথা বলা হয় না যে, সে একজন দর্জি –যতক্ষণ সে এটাকে পেশা বানিয়ে না নেয়।
অনুরূপভাবে হযরত আদম (আঃ)-এর দ্বারা নাফরমানী হয়েছিল বটে, কিন্তু মাত্র একবার, তাও ভুলবশত। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এখনো অপরাধ করেনি ঠিকই, কিন্তু সে তা করার সংকল্প রাখে, সে নিশ্চতরূপেই অপরাধী। তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হবে এবং এজন্য শাস্তির যোগ্য বিবেচিত হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
(আরবী****************************************************************************************)
যখন দুই মুসলমানরা উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তখন হত্যাকারী এবং নিহত ব্যক্তি উভয়ই দোযখের উপযোগী হয়ে যায়। বলা হল, ঠিক আছে। সে তো হত্যাকারী, কিন্তু নিহত ব্যক্তির কি অপরাধ? তিনি বললেনঃ সেও তার প্রতিপক্ষকে হত্যা করার প্রস্তুতি নিয়ে থাকবে।–নাসাঈ, ইবনে মাজাহ
নিঃসন্দেহে অপরাধ এবং পদস্খলনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গিয়ে নিয়াতকে উপেক্ষা করা যায় না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়াতের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
ঈমানের উপর গুনাহের যে কু-প্রভাব পড়ে তা নিরূপণ করতে গিয়ে আমাদেরকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নজর রাখতে হবে।
এক. যাবতীয় গুনাহ একই প্রকৃতির নয়, সব গুনাহের প্রতি সমান আকর্ষণ থাকে না এবং এসব লোক একই ধরনের অপরাধে লিপ্ত হয় হয় না। যেমন, আমাদের দেশের কোন মুসলমান শুকরের গোশত খায় না। এর পরিবর্তে তারা আনন্দ সহকারে গরু-ছাগলের গোশত খেয়ে থাকে। অনুরূপভাবে গরীব ও নিঃস্ব লোকেরা রেশমের কাপড় পরিধান করে না এবং সোনার ব্যবহারও করে না। শূকরের গোশত খাওয়া এবং রেশমী বস্ত্র পরিধান করা গর্হিত কাজ –যা ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। কিন্তু একদিকে শূকরের গোশত খাওয়া একটি খারাপ কাজ, অন্যদিকে রেশমী বস্ত্র পরিধান করাটাও একটি খারাপ কাজ। শেষোক্তটির সম্পর্কে জৈবিক লালসার সাথে। এমন অনেক লোক রয়েছে, যারা জৈবিক ভারাসাম্যহীনতার শিকার হয়। তারা হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও কামাবেগকে বশ করতে পারে না। এই দৃষ্টিতে দেখা হলে এই দুই ধরনের অপরাধী এক সমান হতে পারে না।
দুই. এখানে এমন পরিবেশও আছে যা খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং এমনও পরিবেশ আছে যা খারাপ কাজে লিপ্ত করে। অনেক লোক আছে –যারা খারাপ কাজকে চরমভাবে ঘৃণা করে। কিন্তু খারাপ পরিবেশের কারণে তাদের পা ফসকে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিবেশ তাদের দীন ও আখলাকের জন্য আশংকাজনক। আবার এমন অনেক লোক রয়েছে যারা দুষ্কর্মের প্রতি প্রলুব্ধ। কিন্তু তারা নিজেদের সামনের সমস্ত দরজা বন্ধ দেখতে পায়। তা খোলার কোন পথ নেই। তারা এমন এক উন্নত ও পবিত্র পরিবেশে বাস করে যেখানে খারাপ কাজ করার কোন সুযোগ নেই।
তিন. পতনেরও বিভিন্ন পর্যায় আছে। কেউ পাহাড়ের সুউচ্চ শৃঙ্গ থেকে পতিত হয়, আবার কেউ পথ চলতে চলতে পা ফসকে গিয়ে পতিত হয়, কেউ গভীর গর্তে গিয়ে পতিত হয়। এদের সবার পতন এক রকমের নয়। গুনাহের গর্ভে পতিত হওয়ার ব্যাপারটিও তদ্রূপ। এক ব্যক্তি অনুকূল পরিবেশ পেয়ে যায়, মনের মধ্যে রম উত্তেজনা বিরাজ করে এবং সে অপরাধ করে বসে। অপর ব্যক্তি আনন্দ-উৎসাহের সাথে অপরাধে লিপ্ত হয়। অপর ব্যক্তি সংকল্প ও চেতনা সহকারে অপরাধে লিপ্ত হয়। চতুর্থ এক ব্যক্তি খারাপ কাজ করার সংকল্প করে, অনবরত খারাপ কাজ করতে থাকে, ধীরে ধীরে এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। সে বার বার গুনাহ করে এবং তাতেই আনন্দ পায়। এই কয়েক ধরনের লোক এই সমতলে অবস্থান করছে না। তাদের মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে।
চার. স্বয়ং গুনাহের বৈশিষ্ট্য এই যে, এটা যেন পরস্পর সংযুক্ত একটি বৃত্ত। মিথ্যাবাদী খেয়ানতকারী হয়ে থাকে এবং খেয়ানতকারী ঘুষখোর হয়ে থাকে। ঘুষখোর জাতির কল্যাণ ও নিরাপত্তার দুশমন। সে তার দীন, ঈমান, মর্যাদা, দেশ সবকিছু পূর্ব থেকে ক্রেতার হাতে তুলে দেয়। অনুরূপভাবে মদখোর ব্যভিচারী হয়ে থাকে এবং ব্যভিচারী নরঘাতক হয়ে থাকে। নরঘাতক এমন এক হিংস্র পশু যে দীন ও আখলাকের ভাণ্ডার তছনছ করে দেয়।
সত্যকথা এই যে, ব্যক্তি ও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে মাসিয়াত (অপরাধ) শব্দের অর্থের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে। যেমন ‘সফর’ (ভ্রমণ) শব্দটি কাছের জন্যও ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং সারা পৃথিবী পরিভ্রমণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অথবা ‘রোগ’ শব্দটি যেমন সাধারণ মাথা ব্যথার জন্যও ব্যবহৃত হয়। ‘মাসিয়াত’ শব্দটিও তদ্রূপ। এর অর্থের মধ্যেও দুটি দিক রয়েছে –যার মধ্যে অনেক ব্যবধান আছে। এর কারণ এই নয় যে, কতগুলো হচ্ছে খোছখাট অপরাধ আর কতগুলো হচ্ছে মারাত্মক অপরাধ। বরং মারাত্মক অপরাধের সবগুলো সমান নয়। অন্তরের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই এই পার্থক্য সূচিত হয়ে থাকে। কত বড় ভুল হবে যদি আমরা বলে বেড়াই যে, ঈমান থাকলে কবীরা গুনাহের দ্বারা কোন ক্ষতি হতে পারে না অথবা যদি খারিজীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, কবীরা গুনাহে লিপ্ত হলে ঈমান চলে যায়! এই নাজুক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বকালের একজন কবি বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
যে ব্যক্তি মারা গেল।
কিন্তু তওবা করল না তার গুনাহের জন্য।
তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাতে ন্যস্ত।
কবি নিম্নোক্ত আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
আল্লাহ কখনো শিরকের অপরাধ ক্ষমা করবেন না, এ ছাড়া যত গুনাহ আছে তা যার জন্য ইচ্ছা মাফ করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করল, সে অতি বড় মিথ্যা রচনা করল এবং কঠিন গুনাহের কাজ করল।–সূরা নিসাঃ ৪৮
এই আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ‘শিরকের অপরাধ ক্ষমার যোগ্য নয়’। শিরকের সমপর্যায়ের আরো অনেক কথা আছে। যেমন আল্লাহকে অস্বীকার করা অথবা আল্লাহকে স্বীকার করা হয় কিন্তু তাঁর বিধান প্রত্যাখ্যান করা এবং তা অনুসরণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা ইত্যাদি।
শিরক ছাড়া আর যত গুনাহ আছে তার মধ্যে কতক গুনাহ তিরস্কারের পর্যায়ভুক্ত। এগুলো মাফ হয়ে যাবে। কিন্তু এমন অনেক মারাত্মক গুনাহ আছে যা ঈমানের জন্য জীবন সংহারক। যেমন আমরা পেছনে উল্লেখ করে এসেছি। এই ধরনের গুনাহ শিরকের চেয়ে কম নয়। এসব মারাত্মক অপরাধের দিকেই নিম্নোক্ত আয়াত ইঙ্গিত করছেঃ
(আরবী**************************************************************************************)
আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমাসমূহ লংঘন করে –আল্লাহ তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন, সেখানেই সে চিরকাল থাকবে। এটা হবে তার জন্য অপমানকর শাস্তি।–সূরা নিসাঃ ১৪
(আরবী**************************************************************************)
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা অমান্য করবে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। এই ধরনের লোকেরা তাতে চিরকাল থাকবে।–সূরা জিনঃ ২৩
সাধারণ গুনাহ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
আর যাদের অবস্থা এই যে, তারা যদি কোন অশ্লীল কাজ করে বসে অথবা নিজেদের উপর জুলুম করে বসে, তাহলে সাথে সাথেই আল্লাহর কথা স্মরণ করে এবং তাঁর কাছে নিজেদের পাপের ক্ষমা চায়। কেননা আল্লাহ ছাড়া গুনাহ মাফ করতে পারে এমন আর কে আছে? এই লোকেরা জেনে-বুঝে নিজেদের অন্যায় কাজ নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না।–সূরা আলে-ইমরানঃ ১৩৫
অপরাধ প্রবণতা কি একটি রোগ?
আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক মহল থেকে বরাবর আওয়াজ উঠছে –পাপ এবং পথভ্রষ্টতাকে অন্তরের রোগের ফল মনে করা উচিত। অনুরূপভাবে অপরাধের ব্যাখ্যায় বলা হয় যে, তা রোগের লক্ষণ। অতএব শক্তির ভয় দেখানো এবং উপদেশ দেওয়ার পরিবর্তে স্নায়বিক দুর্বলতা ও মানসিক রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা হওয়া উচিত –যার পরিণতিতে এই অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে।
‘অপরাধ-প্রবণা’ একটি রোগ। তাকে অপরাধ মেনে নিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করার আগে এর চিকিৎসার চিন্তাভাবনা করা উচিত। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। এ সম্পর্কে গুরত্বপূর্ণ সহকারে চিন্তা-ভাবনা করা এবং ইসলামের শিক্ষার আলোকে তার মূল্যায়ন করা আমাদের কর্তব্য।
হয়ত জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, অপরাধ-প্রবণতা সত্যিই কি একটি রোগ? কুরআন মজীদ বিভিন্ন জায়গায় যে ব্যাখ্যা অবলম্বন করেছে তার আলোকে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। হাঁ, অপরাধ-প্রবণতা একটি রোগ বিশেষ। সূরা বাকারায় নিফাকের (কপটতা) জন্য ‘রোগ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
(আরবী**************************************************************************************)
তাদের মনে একটি রোগ রয়েছে। এ রোগকে আল্লাহ আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছেন।–সূরা বাকারাঃ ১০
এখানে ‘মনের রোগ’ বলতে কলবের গতি দ্রুত অথবা ধীর হয়ে যাওয়া বোঝানো হয়নি। আরো অনেক সূরা আছে যাতে এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়েছে।
সূরা আহযাবে এই শব্দটি তিনবার এসেছে এবং কথার ধরণ থেকেই বোঝা যায়, কোন স্থানে তা কি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। উম্মুল মুমিনদের (নবী-পত্নীগণ) উপদে দিতে গিয়ে বলা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************************************************)
তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় কর, তবে বাক্যালাপে কোমলতা অবলম্বন করো না। তাতে রোগগ্রস্ত মনে কোন ব্যক্তি লালসা করতে পারে।–সূরা আহযাবঃ ৩২
এখানে রোগ অর্থ মনের সেই অবস্থা যা রচম জৈবিক উত্তেজনার পরিণতিতে সৃষ্টি হয়। এর ফলে মানুষের মন এমন চারণভূমিতে বেড়াতে চায় যা তার চারণভূমি নয় এবং যেখানে তার সভ্য, ভদ্র ও বিনয়ী হওয়া উচিত সেখানেও সে লাগামহীন ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীর স্ত্রীদের এমন স্থানে দেখতে চান, যেখানে মানসিক ওয়াসওয়াসা অনুপ্রবেশ করতে না পারে। তিনি এর সমস্ত ছিদ্রপথ বন্ধ করে দিতে চান। আর এ কথা প্রমাণিত যে, জৈবিক ভারসাম্যহীনতা অসংখ্য চৈন্তিক, নৈতিক ও স্নায়বিক রোগের উৎস। ইসলামের দুশমনরা আহযাব যুদ্ধের সময় যখন মদীনাকে চতুর্দিক থেকে অবরোধ করে রেখেছিল, তখন দুর্বল ঈমানের অধিকারী এবং সংশয়বাদী লোকদের যে ভূমিকা ছিল –সে সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************************************)
যখন মুনাফিক এবং রোগগ্রস্ত অন্তরের লোকেরা পরিস্কারভাবে বলছিল যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল আমাদের কাছে যে ওয়াদা করেছিলেন তা ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়।–সূরা আহযাবঃ ১২
ব্যক্তিত্ব যতই দুর্বল এবং বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে –এই রোগের পংকিলতা ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কোন ব্যক্তি এই সভায় এক কথা বলে এবং অন্য সভায় আরেক কথা বলে। এখানে তার কথার ধরন হয় একরূপ, আবার অন্যখানে হয় আরেক রূপ। শেষ পর্যন্ত এটাই তার স্বভাবে পরিণত হয় এবং সে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ধরনের অসংখ্য মুনাফিক ছিল যারা ইষলামী সমাজের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা কট্টর কাফিরদের চেয়েও মারাত্মক বিপদ ছিল।
এখানে আয়াতের অর্থ এও হতে পারে যে, “সেই সময়ের কথা স্মরণ কর যখন সেই মুনাফিকরা –যাদের অন্তরে রোগ ছিল –বলেছিল”। এও হতে পারে যে, (আরভী****************************) –দ্বারা অন্য কোন দলকে বোঝানো হয়েছে, যারা শত্রুদের ভয় করার ব্যাপারে, যুদ্ধে কাপুরুষতা প্রদর্শনে এবং রাসূলের পয়গাম ও তার শুভ পরিণতি সম্পর্কে সংশয় পোষণ করার দিক থেকে মুনাফিকদের সাথে তুলনীয় ছিল। এভাবে তারা মুনাফিকদের সাথেই থেকে থাকবে এবং তাদের মধ্যেই গণ্য হয়ে থাকবে।
যাদের চেহারায় যুদ্ধে না যাওয়ার ভাব ফুটে উঠেছিল তাদেরকেও রুগ্নদের সাথে রেখে দেওয়া হয়েছিল, যেন তাদের মুখোশ উন্মোচিত হতে পারে। সূরা আহযাবের নিম্নোক্ত আয়াতে এই ধরনের সব লোকদের একত্র করা হয়েছেঃ
(আরবী***************************************************************************************)
মুনাফিক লোকেরা এবং যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, আর যারা মদীনায় উত্তেজনাকর গুজব ছড়াচ্ছে –তারা যদি নিজেদের একাজ থেকে বিরত না থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য আমরা তোমাকে দায়িত্বশীল করে তুলব। পরে এই শহরে তোমার সাথে তাদের বসবাস কঠিনই হবে।–সূরা আহযাবঃ ৬০
এই তিরস্কার এবং হুমকির পূর্বে মুসলিম নারী সমাজকে হিদায়াত দান করা হয়েছে, পবিত্রতা ও মানসম্ভ্রমের যাবতীয় নীতিমালার অনুসরণ করে। এ থেকে জানা যায় যে, এখানে (আরবী*****************) বলতে সেই যুবকদের বোঝানো হয়েছে, যারা ভবঘুরের মত রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াত এবং লাম্পট্যের সুযোগ খুঁজে বেড়াত। এসব যুবকের সংশোধন ও সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ তাআলা নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
হে নবী! তোমার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ এবং ঈমানদার লোকদের পরিবারের মহিলাদের বলে দাও –তারা যেন নিজেদের উপর চাদরের আঁচল ঝুলিয়ে দেয়। এটা অতি উত্তম নিয়ম –যেন তাদের চেনা যায় ও তাদের উত্যক্ত করা না হয়। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান।–সূরা আহযাবঃ ৫৯
কিন্তু মনের রোগের মধ্যে লঘুত্ব ও প্রচণ্ডতার মাত্রা অনুযায়ী পার্থক্য হয়ে থাকে। সাথে সাথে এর প্রভাবে শরীআত ও ইসলামী আইনের যে বিরোধিতা হয়ে থাকে এবং মূল্যবোধ ও রীতিনীতির যে লংঘন হয়ে থাকে, তার মধ্যেও মাত্রার পার্থক্য রয়েছে। অনন্তর অপরাধী যদি মনের রোগী হয়ে থাকে তাহলে তাকে অপরাধ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ঘোষণা করা ও কোনরূপ জিজ্ঞাসাবাদ করা ছাড়াই ছেড়ে দেওয়াও ঠিক হবে না। ইসলাম রোগের এই বিভিন্ন অবস্থাকে দুই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকে।
এক. ইসলাম শাস্তির ব্যবস্থাও করে থাকে। যেসব জিনিসের উপর সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থায়িত্ব নির্ভরশীল এবং যেগুলোর সাহায্য ছাড়া সমাজের সৌন্দর্যের পরিবৃদ্ধি ঘটানো, তার উন্নত মূল্যবোধের সংরক্ষণ এবং তার অসম্মানকারীদের পরাভূত করা সম্ভব নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম বেত্রাঘাতও করায়, রজমেরও (পাথর নিক্ষেপে হত্যা) ব্যবস্থা করায়, হাতও কাটায় এবং মৃত্যুদণ্ডেরও ব্যবস্থা করে।
দুই. ইসলাম এই কঠোর দণ্ডের ব্যবস্থা করার সাথে সাথে অপরাধকারীকে রোগী মনে করে তার প্রতি সহানুভূতি ও দয়ার দৃষ্টিও নিক্ষেপ করে। সে তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সতর্কতার সাথে অগ্রসর হয্ সে বিচারককে শিক্ষা দেয় যে, ভুলক্রমে অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়া হলে ঠিক আছে, কিন্তু অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয় যে, ভুলক্রমে অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়া হলে ঠিক আছে, কিন্তু অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া যাবে না। ইসলাম অপরাধীর জন্য কল্যাণের দোয়া করার শিক্ষা দেয়, কিন্তু বদদোয়া করতে নিষেধ করে।
একবারকার ঘটনা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের কাছে এই মদখোরকে উপস্থিত করা হল। সেখানে উপস্থিত এক ব্যক্তি বলল, তোমার উপর আল্লাহর অভিশাপ! তোমাকে কতবারই না গ্রেফতার করা হয়েছে। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বললেনঃ
(আরবী***************************************************************************************)
তাকে অভিশম্পাত করো না। আল্লাহর শপথ! আমি যতদূর জানি যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে ভালবাসে।–বুখারী –কিতাবুল হুদূদ
অপর বর্ণনায় আছেঃ
(আরবী***************************************************************************************)
এরূপ বলো না। বরং তোমরা বল, হে আল্লাহ! তার প্রতি অনুগ্রহ কর, হে আল্লাহ! তার তওবা কবুল কর।
এই অনুগ্রহপূর্ণ দৃষ্টি অপরাধীকে নিজের আঁচলের মধ্যে টেনে নেয়, তাকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দেয় এবং ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য সুপারিশও করা যেতে পারে। এর ফলে হয়ত সে গোমরাহী থেকে ফিরে আসতে পারে অথবা মনের রোগ থেকে মুক্তি পেয়ে যেতে পারে।
অন্তরের যেসব রোগ বিবেচনাযোগ্য এবং ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার যোগ্য তা এই যে, মানুষ যখন পূর্ণতা অর্জন ও উন্নত পর্যায়ে পৌঁছার জন্য অবিরত চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু তার সংকল্প রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ার কারণে বারবার অকৃতকার্য হয়ে যায় –এই ধরনের রোগের সহানুভূতির সাথে চিকিৎসা করতে হবে।
মানুষ যখন ক্ষতিকর জিনিস থেকে বাঁচতে চায়, নিকৃষ্টতা থেকে বের হয়ে আসতে চায় এবং উন্নত স্তরের দিকে অগ্রসর হতে চায়, তখন মাটিজাত প্রকৃতির অসংখ্য অনুভূতি তাকে সামনে অগ্রসর হতে বাধা দেয়া তা তাকে কল্যাণের পথে পা বাড়াতে দেয় না। শেষ পর্যন্ত তা তাকে নৈরাশ্যের পর্যায়ে নিয়ে যায়। ফলে তার আকাঙ্ক্ষা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং তার সংকল্প দুর্বল হয়ে যায়। এ সময় আল্লাহর দীন তার শিক্ষা নিয়ে এই হাশাগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে হাযির হয় এবং তার আকাঙ্ক্ষাকে রোগমুক্ত করে দেয় ও তার সংকল্পকে শক্তিশালী করে তোলে। অতঃপর সে মৃত্যু পর্যন্ত উন্নতির পথে অগ্রসর হতে থাকে।
মানসিক রোগের এই নাজুক স্থানের চিকিৎসা করার জন্যই উৎসাহমূলক আয়াত এবং হাদীসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো অন্তরকে আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের আশায় পরিপূর্ণ করে দেয় এবং তাকে কখনো নিরাশার শিকার হতে দেয় না। যেমন পাপীদের জন্য আল্লাহ তাআলা নিম্নোক্ত বাণী প্রণিধানযোগ্যঃ
(আরবী*************************************************************************************)
বল, হে আমার বান্দাগণ –যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ –তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যেও না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি তো ক্ষমাশীল এবং দয়াময়।–সূরা যুমারঃ ৫৩
এ ধরনের আশার বাণী সম্বলিত ও সুসংবাদ প্রদানকারী আয়াতগুলোকে সংকীর্ণমনা ও অপরিণামদর্শী লোকেরা ত্রুটিপূর্ণ কাজ করার এবং পাপে লিপ্ত থাকার হাতিয়ারে পরিণত করে নিয়েছে। এই ধরনের অলীক ধারণা তাদেরকে ভ্রান্ত পথেই নিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের যত আয়াত এসেছে তার উদ্দেশ্য এই যে, যেসব লোক নিজেদের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে অবিরত জিহাদ করছে –তাদের যোগতা ও সাহসকে বাড়িয়ে তোলা। তারা যেন সামনেই অগ্রসর হতে থাকে এবং কোন প্রতিবন্ধকতা যেন তাদের প্রতিরোধ করতে না পারে। কোন গিরিসংকট সামনে পড়লে তাদের গতিপথ যেন ঘুরে না যায়। তাদের দ্বারা কখনো অসংখ্য অপরাধ সংঘটিত হলেও যেন ভাল কাজ করার আগ্রহ-উদ্দীপনা স্তিমিত হয়ে না যায়। তখন থেকে যদি সে পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতে চায়, তাহলে এ পর্যন্ত সে যত অপরাধই করে থাকুক –আল্লাহর রহমত থেকে যেন নিরাশ না হয়ে যায়।
অসংখ্য আয়াত এবং হাদীস বলে দিচ্ছে যে, এই দুনিয়ায় আমলই হচ্ছে সবকিছু। যার আমল (সৎকর্ম) নেই তার কিছুই নেই। আবার এমন অনেক আয়াত এবং হাদীস রয়েছে যা সামান্য নেক কাজের বিনিময়ে রহমত ও মাগফিরাত লাভের সুসংবাদ দেয়।
লোকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে যে উত্তম জিনিসটি সাধারণত আমাদের সামনে থাকে তা হযরত ঈসা আলায়হিস সালামের নিম্নোক্ত বাণীঃ
(আরবী**************************************************************************************)
তোমার প্রভু হয়ে মানুষের যাবতীয় কাজ দেখো না। বরং তোমরা আল্লাহর বান্দাহ, অতএব নিজেদের কাজের উপর দৃষ্টি দাও। মানুষ দুই ধরনের হয়ে থাকে। কিছু লোক পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হয়ে পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এদেরকে অপারগ মনে কর। কিছু লোক নিরাপদে থাকতে পারে। এদের ব্যাপারে আল্লাহর প্রশংসা কর।
ইসলামের মধ্যে এ ধরনের বহু ইতিবাচক শিক্ষা রয়েছে যার মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি অন্তরের সুস্বাস্থ্য এবং রূহানী শক্তি অর্জন করতে পারে।
যেসব লোক মনে করে যে, ইসলামের ইবাদতসমূহ এক ধরনের প্রাণহীন রসম-রেওয়াজ ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এগুলো অবচেতনভাবে ও না বুঝে-শুনে আদায় করা হয়ে থাকে –তাদের একথা মোটেই ঠিক নয়। কেননা ইসলামের প্রাথমিক কর্তব্যসমূহের ভিত্তিই হচ্ছে, জ্ঞান ও চেতনাকে জাগ্রত করা। এসব করণীয় কর্তব্য যখন অন্তর ও মন-মগজের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, তখনই বলা যায় তা গৃহীত হয়েছে। অনুরূপভাবে ঈমানদারদের উপর ইবাদত-বন্দেগীর যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তা তাদের আত্মিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি স্থায়ী বুনিয়াদের গুরুত্ব রাখে। এসব ইবাদত বাধ্যতামূলক করার পেছনে যে হিকমত নিহিত রয়েছে তা এই যে, এগুলো ময়লা দূর করে দেয়, গুনাহের কাজ থেকে বাঁচায় এবং মানুষ ভুল করে বসলে তা সংশোধনের উপায় হয়ে থাকে। তা দুষ্কর্মের দাগগুলো ধুয়ে-মুছে আত্মাকে পরিচ্ছন্ন করে তোলে।
এই ইবাদতসমূহ মানুষকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে, এর মলিনতাকে পরিস্কার করে এবং এই দুইটি জিনিসই নিরাপত্তার উপায় এবং কলব ও আত্মার রোগ থেকে মুক্তি পাবার পথ। যেমন কুরআন পাঠের উদ্দেশ্য কেবল এই নয় যে, মুখে পুত-পবিত্র বাক্যগুলো সুমধুর স্বরে পাঠ করা হবে। এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর ওহীর সাথে আত্মার সাথে সাধন করা, যাতে পাঠকারী পবিত্র জীবনযাপন করতে সক্ষম হয় এবং সে যখন নিজের প্রতিপালকের কাছে মুনাজাত করবে তখন যেন দুনিয়ার আকর্ষণ ও প্রবৃত্তির গোলামী থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
(আরবী***************************************************************************************)
আমরা কুরআন নাযিলের ধারাবাহিকতায় এমন কিছু জিনিস নাযিল করছি যা ঈমানদারদের জন্য নিরাময় ও রহমত।–সূরা ইসরাঃ ৮২
অনুরূপভাবে নামায গুনাহের কাজ থেকে প্রতিরোধ করে, ওয়াসওয়াসা দূর করে এবং অপরাধের দাগ লেগে গেলে তার চিকিৎসা করে। বড়ই তত্ত্বপূর্ণ কথা বলেছেন কেউঃ “যদি তুমি নিজের আত্মাকে ভাল কাজে ব্যাপৃত না রাখ তাহলে তা তোমাকে খারাপ কাজে নিয়োজিত করবে”।
ইসলামেরও এই মূলনীতি। এই মূলনীতির সাহায্যে সে ব্যক্তি এবং সমাজকে বিপদসংকুল বাতেনী রোগ থেকে নিরাপদ রাখে। যে ব্যক্তি অলস এবং যে জাতির কোন দিকদর্শন নেই তাদের অন্তর ও বুদ্ধিবিবেক সহজেই নিকৃষ্টতম রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। মুসলিম সমাজের কাছে যে কঠোর শ্রম আশা করা হয় এবং তার উপর ইবাদতের যে দায়িত্ব চাপানো হয়েছে –যদি সে তাতে ব্যস্ত থাকে, তাহলে অলসতা ও বেকারত্বের ফলে যে অপরাধ সংঘটিত হয় –তাতে লিপ্ত হওয়ার সুযোগই তার হবে না এবং ইসলামী সমাজ বাস্তব কর্মক্ষেত্রে যে জটিলতার সম্মুখীন হয় তাও দূর হয়ে যাবে।
আমার ধারণামতে লোকদের থেকে যে অপরাধ প্রকাশ পায় তার জন্য জাতীয় সরকারই অনেকাংশে দায়ী। কেননা সরকার এমন কোন পরিবেশ ও জীবনবিধি সহজলভ্য করেনি যা তাদেরকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে দূরে রাখতে পারে। যে আভ্যন্তরীণ রোগে মানবজীবন বিপথগামী এবং ভারসাম্যহীন হয় তার সংখ্যা অনেক। যদি আমরা মনস্তত্ত্ববিদদের বক্তব্যের উপর গুরুত্ব দেই তাহলে তাদের মনে আভ্যন্তরীণ জটিলতা অন্তসারশূন্যতা এবং মানসিক রোগ থেকে মুক্ত কোন মানুষ নেই। পার্থক্য কেবল এতটুকু যে, কাউকে পাগলামীর রোগে আক্রান্ত বলা হয় আর কারো সম্পর্কে বলা হয যে, তার থেকে পাগলসুলভ কাজ সংঘটিত হয়েছে। কোন ব্যক্তি যদি এরূপ কাজ করে বসে তাহলে বলা হয়, তোমার কোন জ্ঞানবুদ্ধি নেই। মহান আল্লাহ তাআলাও ইহুদী আলেমদের সম্পর্কে বলছেনঃ
(আরবী****************************************************************************************)
তোমরা অন্য লোকদের ন্যায়ের পথ অবলম্বন করতে বল, কিন্তু নিজেদের তোমরা ভুলে যাও। অথচ তোমর কিতাব অধ্যয়ন করছ, তোমাদের বুদ্ধি কি কোন কাজেই লাগও না? –সুরা বাকারাঃ ৪৪
অনন্তর বাতেনী রোগের তীব্রতা ও দুর্বলতার দিক থেকেও যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ যে পর্যায়ে থাকে শেষ পর্যায়ে তা সেই অবস্থায় থাকে না। অধিকন্তু কতগুলো রোগ তো মহামারীর আকার ধারণ করে এবং তা গোটা মানবসত্তাকে প্রভাবিত করে ফেলে। আর কতিপয় রোগ নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে।
কুরআন মজীদ বিভিন্ন স্থানে পরিস্কার বলেছে যে, আত্মিক রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রামক রোগ হচ্ছে –যা জৈবিক শক্তিকে উত্তেজিত করার কারণ হয়ে থাকে। অথবা মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যে ব্যাধি অহংবোধ অথবা হীনমন্যতার কারণ হয়ে থাক। জৈবিক শক্তি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে তা যেনা ব্যভিচার, পায়ুকাম, বিপথগামিতা, উন্মাদনা, অবৈধ প্রেম ইত্যাদির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অহংবোধের রোগ হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, আত্মকেন্দ্রিকতা, আত্মপ্রশংসা এবং একগুঁয়েমির উন্মাদনা, অবৈধ প্রেম ইত্যাদির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অহংবোধের রোগ হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, আত্মকেন্দ্রিকতা, আত্মপ্রশংসা এবং একগুঁয়েমির উন্মাদনা সৃষ্টি করে। হীনমন্যতাবোধ গর্ব-অহংকার ও হিংসা-বিদ্বেষমূলক প্রবণতার প্রতিপালন করে থাকে।
আমরা পূর্বেই বলেছি যে, ইসলাম আত্মাকে ইবাদতে মশগুল রাখে এবং এভাবে তাকে যাবতীয় রোগ থেকে নিরাপদ রাখে, আর যদি এই রোগ আক্রমণ করে থাকে তাহলে এর প্রভাবকে দূর করে দেয়। তা অবিরতভাবে আত্মার চিকিৎসা করতে থাকে এবং একে রোগমুক্ত করে ছাড়ে অথবা এর কাছাকাছি নিয়ে আসে। অর্থাৎ মানুষ যতটা চেষ্টা সাধনা করে এবং নিজেকে প্রশিক্ষণে ব্যস্ত রাখে সে ততই রোগমুক্ত হতে থাকে।
আমরা অপরাধের অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানি না। এর কতগুলো বাহ্যিক রূপই আমাদের সামনে প্রকাশ পেয়ে থাকে। এজন্য আমরা এ সম্পর্কে কোন সাধারণ নির্দেশ দান করতে পারি না। আমরা এ পার্থিব জগতে বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন পন্থা সম্পর্কে বলতে পারি যে এটা ঈমান অথবা ফিসক অথবা কুফর। কিন্তু আখেরাতে কার কি অবস্থা হবে এ সম্পর্কেই কেবল আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন। অপরাধীদের চিরকাল দোযখে অবস্থান অথবা তাদের অপরাধের আংশিক মাফ হয়ে যাওয়া, অথবা কারো একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শাস্তি ভোগ করার ব্যাপারটি যে বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট –আমরা ইতিপূর্বে তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। আমরা এ ব্যাপারে বিতর্ক যুদ্ধ, কূটতর্ক বা পূর্বকালের তর্কশাস্ত্রের কোন গুরুত্ব দেই না। এ বিষয়ের উপর উস্তাদ ইসমাঈল হামদী ব্যাপক আলোচনা করেছেন। আমরা এখানে তার সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরছিঃ
আদল হচ্ছে একটি মৌল জিনিস। শাস্তি হচ্ছে তার একটি অংশ। অতএব এ দুটি জিনিসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কিন্তু কোন অপরাধীর সাথে পূর্ণ আদল ও ইনসাফ ভিত্তিক ব্যবহার করা হবে? কোন অপরাধীর সাথে আদল এবং অনুগ্রহপূর্ণ ব্যবহার করা হবে? কোন অপরাধীকে রুগ্ন বিবেচনা করে একান্ত দয়ার্দ্র ব্যবহার করা হবে? এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কেননা আত্মার অবস্থা বাহ্যিক অবস্থার তুলনায় অসংখ্য ভাগে বিভক্ত। চেতনা ও সংকল্পই এই পার্থক্যের ভিত্তি।
এক ব্যক্তি পূর্ণ চেতনা ও সংকল্পের সাথে অপরাধে লিপ্ত হয়। সে এর ফলাফল সম্পর্কে অবহিত। সে ইচ্ছা করলে তা থেকে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু সে অপরাধে লিপ্ত হওয়ার জন্য উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করে, পরিবেশকে অনুকূল বানায় এবং এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতির জন্য তৈরি থাকে।
আরেক ব্যক্তির উপর ক্রোধ অথবা ভালবাসা অথবা স্বজনপ্রীতির ভুত সওয়ার হয়ে বসে, অথবা অন্য কোন ধরনের আবেগ-উত্তেজনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। অতঃপর সে একটি উন্মাদের মত অথবা বুদ্ধিজ্ঞানশূন্য ব্যক্তির মত অপরাধের গর্তের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। এই দুই ধরনের অপরাধীর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
তৃতীয় এক ব্যক্তির সামনে রিযিকের সব দরজা বন্ধ। সে দু’মুঠো খাবারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়। এক সময় তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় এবং সে চুরিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
অথবা কোন ব্যক্তি উত্তম প্রতিপালন এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের উপায় উপকরণ থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। এ কারণে সে বিপথগামী হয়ে পড়ে। এ কথা পরিস্কার যে, এই ধরনের অপরাধী এবং প্রথমোক্ত দুই ধরনের অপরাধীর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আমাদের একথা বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই যে, এদের প্রত্যেকে কিরূপ ব্যবহার পাবার অধিকারী হবে। কারণ ব্যাপারটি পরিস্কার।
মানবীয় সিদ্ধান্তও কখনো এটা অস্বীকার করতে পারে না যে, যে ব্যক্তি পূর্ণ অনুগ্রহ পাবার অধিকারী, তাকে পূর্ন অনুগ্রহ প্রদর্শন করাই উচিত। আর যে ব্যক্তি কেবল ইনসাফ পাবার অধিকারী তার সাথে ইনসাফপূর্ণ ব্যবাহর করাই উচিত। আর যে ব্যক্তি ইনসাফ এবং অনুগ্রহ উভয়টিই পাবার হকদার তাকে তা-ই দেওয়া উচিত। কেননা আইন প্রণয়নকারীই হোক অথবা বিচারকই হোক –আইন প্রণয়ন অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময় তারা মূক-অন্ধ-বধির মেশিন মাত্র নয়। তারাও মানুষ, মানবীয় গুণ-বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে বর্তমান রয়েছে এবং সেই গুণের মাধ্যমে তারা পথ নির্দেশ পেতে পারে। যারা আইন প্রণয়ন করে অথবা যারা রায় প্রদান করে তাদের মধ্যে অবশ্যই সেই গুণাবলী বর্তমান রয়েছে। বরং তারা সাধারণ মানবীয় স্তর থেকৈ অনেক উন্নত হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে আদল, ইনসাফ, পবিত্র মনোবৃত্তি, দয়া-অনুগ্রহ, ব্যক্তির মন-মানসিকতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় অনুধাবন ক্ষমতা ইত্যাকার যেসব গুণ রয়েছে তা অত্যন্ত উন্নতমানের বৈশিষ্ট্য।
কুরআন মজীদ আল্লাহ তাআলার যে গুণাবলী বর্ণনা করে তা সর্বোত্তম গুণ বৈশিষ্ট্য। যেমন তিনি গোটা সৃষ্টিকুল সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, পূর্ণরূপে ইনসাফ করেন, বান্দাকেও অনুরূপ ইনসাফ করার নির্দেশ দেন, তাঁর অনুগ্রহ সীমাহীন, তিনি ক্ষমা ও উদারতার ভাণ্ডার এবং দয়া ও অনুগ্রহের সাগর। এগুলো কোন নিষ্প্রাণ, শীতল অথবা নেতিবাচক গুণ নয়। তা কেবল দুনিয়ার জীবনের জন্যই সীমাবদ্ধ নয়।
আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে এটাই আমাদের ধারণা। আল্লাহর গুণাবলীর মধ্যে কখনো স্তবিরতা বা শূন্যতা থাকতে পারে না। এর ঝর্ণাধারা কখনো শুকিয়ে যেতে পারে না, তার ধারাবাকিতা কখনো বিচ্ছিন্ন হতে পারে না, তা দুনিয়া এবং আখেরাতকে পরিব্যপ্ত করে রেখেছে। আল্লাহ তাআলা যে আইন-বিধান রচনা করেছেন এবং লোকদের মাঝে ফয়সালা দান করেন তার মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে।
যে অবস্থা ও পরিবেশ নম্রতা প্রদর্শনের মাধ্যমে কাজ আদায়ের দাবি রাখে এবং যেসব কারণ ও অনুপ্রেরণা বিচারকের মধ্যে সহানুভূতিশীল ডাক্তারের মনোবৃত্তি সৃষ্টি করে এবং তা মানবসমাজে যেরূপ বিবেচনাযোগ্য হয়ে থাকে –আল্লাহর দরবারেও তা বিবেচনাযোগ্য হবে। আল্লাহ তাআলা হচ্ছেন সবচেয়ে বড় দয়ালু। তিনি তো সহানুভূতি ও রহমতের উৎস এবং দয়া ও অনুগ্রহের সাগর। আসমান-যমীনের সমস্ত সৌন্দর্যের উৎস তিনিই।
যাই হোক, ঈমান থেকে আমল বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। যেমন সূর্য থেকে আলো বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। কখনো অর্ধ দিবস অতিবাহিত হয়ে যায়, ঘন মেঘ এসে আকাশকে আচ্ছন্ন করে ফেরে এবং পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসে। কিন্তু তারপরও দিন দিনই থেকে যায়। তা রাত হয়ে যায় না। কেননা এটা একটা সাময়িক ব্যাপার, স্থায়ী ব্যাপার নয়। ভোরবেলা রাতের অন্ধকার দূর হয়ে যায়, সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়ে এবং আলো ও গরমে সারা দুনিয়া পরিপূর্ণ করে দেয়।
ঈমানের নূরেরও এই একই অবস্থা। কিছু সময়ের জন্য সাময়িক লালসমার মেঘ ছেয়ে যায়, অন্তরে কোণগুলো অন্ধকার হয়ে যায়, একজন মুমিনের সঠিক রাস্তা নজরে পড়ে না, তারপরও ঈমান তার নিজের কাজ করে যায় এবং তার অবস্থান হয় যা কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতের উল্লেখ করা হয়েছেঃ
(আরবী**************************************************************************************)
প্রকৃতপক্ষে যারা মুত্তাকী তাদের অবস্থা এই যে, শয়তানের প্ররোচনায় কোন খারাপ খেয়াল তাদের স্পর্শ করলেও তারা সাথে সাথে সতর্ক ও সজাগ হয়ে যায় এবং তাদের জন্য কল্যাণকর পথ পন্থা কি তা তারা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পায়।–সূরা আরাফঃ ২০১
অনবরত অপরাধ এবং অপরাধের ঘন অন্ধকার তখনই হয় যখন কুফরের রাত তাঁবু গেড়ে বসে, ঈমানের সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়, অপরাধী দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে এবং এখন তারা সৎপথ পাবার আর কোন সম্ভাবনাই অবশিষ্ট থাকে না। মহান আল্লাহর বাণীঃ
(আরবী***************************************************************************************)
আর যারা এই দুনিয়ায় অন্ধ হয়েছিল তারা আখেরাতেও অন্ধ হয়ে থাকবে। বরং পথ লাভ করার ব্যাপারে এরা অন্ধের চেয়েও অধিক ব্যর্থকাম।–সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৭২
যেসব লোক নাজাত পেতে চায় তাদের ভূমিকা আমাদের আদি পিতা আদম আলায়হিস সালামের মতই হয়ে থাকে –“অপরাধ এবং সাথে সাথে তওবা”।
আর যারা ধ্বংস হতে চায় তাদের ভূমিকা অভিশপ্ত শয়তানের অনুরূপ হয়ে থাকে –“অপরাধ এবং এজন্য অনুতপ্ত হতে অস্বীকৃতি”।
এখন তোমার যে পথ পছন্দ হয় তা বেছে নাও। একথাও মনে রেখ, আখেরাতে মানতিক বা যুক্তিশাস্ত্রের মারপ্যাচে কোন কাজে আসবে না। সেখানে আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাতের সাথে আ হাসিঠাট্টা চলবে না। সেখানে কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব নেওয়া হবে এবং হিসাব গ্রহণকারী হবেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা।
(আরবী***********************************************************************************)
হিসাব গ্রহণের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।–সূরা নিসাঃ ৬