৯
যুক্তিবাদের প্রতারনা
[প্রবন্ধটি ১৯৩৬ সালের জুন মাসে প্রথম প্রকাশিত হয় মাসিক তরজমানুল কুরআন পত্রিকায়-সম্পাদক।]
দুই
যুক্তিবাদ (Rationalism) ও প্রকৃতিবাদ (Natuaralism) এই দুটি জিনিসের প্রচারনা গত দুই দশক ধরে পাশ্চাত্যবাসীরা খুব জোরেশোরে চালিয়ে আসছে। প্রচার শক্তির মহাত্ম কে অস্বীকার করতে পারে? কোন বস্তুকে ক্রমাগত উপর্যুপুরি ও বারংবার লোকদের চোখের সামনে তুলে ধরা হলে এবং তাদের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করিয়ে দিলে তার প্রভাব থেকে আপন মন মগজকে তারা কতক্ষন রক্ষা করবে? তাই শেষ পর্যন্ত প্রচারের মহিমায়ই দুনিয়া একথা স্বীকার করে নিয়েছে যে, পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান ও তার সভ্যতার ভিত্তি নিরেট যুক্তিবাদ ও প্রকৃতিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতার সমালোচনামূলক অধ্যয়নের ফলে একেবারে প্রতিভাত হয়ে উঠছে যে,তার ভিত্তি যুক্তিবাদ কি প্রাকৃতিক নিয়ম এর কোনোটার ওপরই নয়; বরং এর বিপরীত –পাশ্চাত্য সভ্যতার গোটা কাঠামোই নিছক অনুভূতি,কামনা ও প্রয়োজনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বস্তুত পাশ্চাত্যের নবজাগরণ ছিল বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড বিদ্রোহ মাত্র। সে জাগরণ বিচার বুদ্ধিকে পরিহার করে ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও বস্তুবাদের পথে এগিয়ে চলেছে। বিবেক বুদ্ধির পরিবর্তে অনুভূতির ওপর নির্ভর করেছে। বিবেকের নির্দেশ, যুক্তি সংগত প্রমাণাদি ও সহজ প্রবৃত্তিকে বাতিল করে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগত ফলাফলকেই আসল ও প্রকৃত মানদণ্ড বলে ঘোষণা করেছে। প্রকৃতির নির্দেশকে ভ্রান্ত ধারণা করে আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনকেই নিজের দিশারী হিসেবে গ্রহণ করেছে। মাপজোখের সীমা বহির্ভূত প্রতিটি জিনিসকেই অসাড় ও ভিত্তিহীন বলে মনে করেছে। কোনরূপ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগত স্বার্থ হাসিল হয়না,এমন প্রতিটি জিনিসকেই অকেজো ও অপ্রয়োজনীয় বলে আখ্যাদান করেছে। প্রথমদিকে খোদ পাশ্চাত্যবাসিদের কাছেই এ সত্যটি ছিল প্রচ্ছন্ন। এই কারণেই তারা যুক্তি ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে চলা সত্ত্বেও এই ধারণা পোষণ করেছিলো যে, তারা ‘মুক্ত বুদ্ধিবাদের’ যে নব্য যুগের উদ্ধোধন করেছে, তারা ভিত্তি ‘যুক্তিবাদ’ ও ‘প্রকৃতিবাদের’ ওপর প্রতিষ্ঠিত। পরে অবশ্য আসল রহস্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু তা স্বীকার করবার সৎসাহস তাদের হয়নি। তাই বস্তুপূজা প্রবৃত্তির গোলামী ও ইন্দ্রিয় পরবশতার চরম চাতুর্যের সঙ্গে তারা যুক্তি প্রমান ও প্রকৃতি বাদের আবরন টেনে দিচ্ছিল। কিন্তু ইংরেজি প্রবাদ অনুসারে আজ ‘থলের বিড়াল একেবারে বাইরে এসে পড়েছে’। আযৌক্তিকতা ও প্রকৃতি বিরোধিতা আজকে এত প্রকট হয়ে উঠেছে যে, তার উপর কোন আবরন টেনে দেয়াই আর সম্ভব নয়। এ কারণেই আজ যুক্তি ও প্রকৃতি উভয়ের বিরুদ্ধেই প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করা হচ্ছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের পবিত্র দিঙমন্ডল থেকে শুরু করে সমাজ,অর্থনীতি, রাজনীতি সর্বত্রই বিদ্রোহের ঝান্ডা সমুন্নত হয়েছে। ফলে ‘পশ্চাৎমুখী’ মুনাফিকদের একটি দল ছাড়া আধুনিক বিশ্বের সমস্ত নেতাই আপন সভ্যতার উপর শুধু কামনা ও প্রয়োজনের কর্তৃত্বই স্বীকার করে নিয়েছে।
পাশ্চাত্যবাদী ও ফিরিঙ্গীপন্থীরা তাদের গুরুদের চাইতে এখনও কয়েক কদম পেছনে রয়েছে। যে শিক্ষা ও মানবিক পরিবেশ এবং যে কৃষ্টি ও সভ্যতার মধ্যে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সাধিত হয়েছে, স্বভাবত এদের মধ্যেও তেমনি ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও বস্তুবাদের উপাসনা এবং কামনা ও প্রয়োজনের দাস্যবৃত্তি সৃষ্টি হতে বাধ্য। আর প্রকৃত পক্ষে তাই সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বার মত পর্যায়ে এখনো তারা উপনীত হয়নি। তারা এখনো আপন বক্তৃতা ও রচনাদির মাধ্যমে এই দাবিই করেছে যে, আমরা শুধু যুক্তিপ্রকৃতির নির্দেশই স্বীকার করি। আমাদের সামনে শুধু যুক্তি প্রমান পেশ করো। যুক্তি-প্রমান ও প্রাকৃতিক নিদর্শন দ্বারা সপ্রময়ান না করা গেলে কোন জিনিসই আমরা মানবোনা। কিন্তু এসব বড় বড় বুলির থলের মধ্যে এমন এক বিড়াল লুকিয়ে রয়েছে যা, যুক্তিযুক্ত কি প্রকৃতিগত কোনটাই নয়। তাদের রচনাবলী বিশ্লেষন করলে স্পষ্টতই বোঝা যাবে যে, যুক্তি প্রমান ও সহজ প্রবৃত্তির অনুসন্ধান ও উপলব্ধি করতে তাদের মন মগজ একেবারেই অক্ষম। তারা যে বস্তুটিকে ‘যুক্তি প্রসূত কল্যান’ বলে অভিহিত করে, তার তাৎপর্য অনুসন্ধান করলে জানা যাবে, আসলে তা হচ্ছে ‘অভিজ্ঞতাজাত কল্যান’। আর অভিজ্ঞতাজাত কল্যান হচ্ছে এমন জিনিস,যা কঠিন,ভারী, গণনা ও পরিমাপযোগ্য। যে জিনিসের কল্যান বা উপকারিতা তাদেরকে গাণিতিক নিয়মে হিসেব করে,কিংবা দাড়িপাল্লা দ্বারা ওজন করে অথবা মাপকাঠি দ্বারা পরিমাপ করে দেখানো যাবে না, তাকে তারা স্বীকার করতে মোটেই প্রস্তুত নয়। আর যতক্ষন পর্যন্ত এই বিশিষ্টার্থে তার উপকারিতে সপ্রমান না করা যাবে,তার প্রতি ঈমান পোষণ ও তার আনুগত্য করা তাদের দৃষ্টিতে নিতান্তই একটি ‘অযৌক্তিক’ কাজ। তারা প্রকৃতির নির্দেশ পালন সম্পর্কে যে দাবি করে,একটু তলিয়ে খোঁজ নিলে তার রহস্যটাও প্রকট হয়ে উঠে। তাদের মতে প্রকৃতি অর্থ মানবীয় প্রকৃতি নয়;বরং জৈবিক প্রকৃতি। আর জৈবিক প্রকৃতিতে বিবেক বুদ্ধি ও হৃদয় বৃত্তির কোন স্থান নেই,তা হচ্ছে শুধু অনুভূতি, আকাঙ্ক্ষা, ইন্দ্রিয় পরবশতায় পরিপূর্ণ। তাদের মনে যেসব জিনিস মানুষের ইন্দ্রিয়নিচয় কে প্রভাবিত করতে, তারা কামনা বাসনা চরিতার্থ করতে এবং তার দৈহিক মানসিক দাবি পূরণ করতে সক্ষম, কেবল তাই হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য; যেসব বস্তুর উপকারিতা সহজেই নিরীক্ষণ করা যায়,যার অপকারিতা দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়,কিংবা উপকারিতার তুলনায় কম দৃষ্টিগ্রাহ্য,শুধু তা-ই হচ্ছে নির্ভরযোগ্য। পক্ষান্তরে যেসব জিনিস মানুষের প্রকৃতিগত,যার গুরুত্ব মানুষ আপন বিবেক দ্বারা অনুভব করে,যার উপকার কি অপকার বস্তুগত বা অনুভূত নয়; বরং আত্মিক ও আন্তরিক- তা হচ্ছে কুসংস্কার, অর্থহীন,অকেজো ও অপ্রয়োজনীয়।
এরূপ জিনিসকে কোন গুরুত্ব দেয়া-এমনকি তার অস্তিত্ব পর্যন্ত স্বীকার করা অন্ধত্ব, কুসংস্কার ও সেকেলেপনার শামিল। একদিকে যুক্তি ও প্রকৃতির প্রতি এমনি বীতশ্রদ্ধা,অন্যদিকে আবার যুক্তিবাদ ও প্রগতিবাদের দাবি! তাদের বিবেক বুদ্ধি দেউলিয়াপনার এমন পর্যায়ে পৌছে গিয়েছে যে,পরস্পর বিরোধিতাকে তারা উপলব্ধি করতে পারছেনা।
শিক্ষা, কৃষ্টি ও সভ্যতা থেকে মানুষের অন্তর এতটুকু উপকার অবশ্যই লাভ করা উচিত যে,তার চিন্তা চেতনা ও ধ্যান ধারনা বিক্ষিপ্ত,অসংলগ্ন ও অব্যবস্থিত হবেনা। সে পরিচ্ছন্ন ও সহজ সরল চিন্তা পদ্ধতি অবলম্বন করবে। ঘটনা প্রবাহ কে সঠিক ভাবে বিন্যস্ত করে সে নির্ভূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। স্ববিরোধীটা ও অর্থহীন প্রলাপের ন্যায় স্পষ্ট ভ্রান্তি থেকে সে বেঁচে থাকবে। কিন্তু কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের সাধারন শিক্ষিত ভদ্রলোকদের মানসিক উৎকর্ষের এই প্রাথমিক সুফলগুলো থেকেও বঞ্চিত দেখা যাচ্ছে। কোন বিষয়ে তর্ক করার আগে নিজেই সঠিক ভূমিকা নির্ণয় করা, সে ভূমিকার বুদ্ধিবৃত্তিক ফলাফল উপলব্ধি করা ও তার প্রতি লক্ষ্য রেখে আপন ভূমিকার সাথে সংগতিপূর্ণ যুক্তিধারা অবলিম্বন করার মতন কোনো বিচারবোধই তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। তাদের সঙ্গে আলাপ করলে কিংবা তাদের রচনাবলীর দিকে দৃকপাত করলে প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হবে যে, তাদের চিন্তাধারা নিদারুণ অসংলগ্ন। আলচনার সূত্রপাত এক হিসেবে করার পর কিছু দূর এগিয়েই তারা ভূমিকা বদলে ফেলে, আরো কিছুদূর এগিয়ে তো একেবারে স্বতন্ত্র ভূমিকা গ্রহণ করে। বক্তব্য বিষয়কে সপ্রমান করার জন্য সুচিন্তিতভাবে তথ্য নির্বাচন করা এবং যুক্তিবিজ্ঞানের ধারায় সেগুলকে বিন্যস্ত পর্যন্ত করা হয়নি। তাদের আসল বক্তব্যটা কি?, কোন বিষয়টির সত্যাসত্য তারা নির্ণয় করতে চেয়েছিলেন এবং শেষ অবধি কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, আদ্যোপান্ত খোঁজাখুঁজি করেও এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না। এই পরিস্থিতির অন্তর্নিহিত কারণ এই যে, বর্তমান সভ্যতা এবং এর প্রভাবাধীন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ইন্দ্রিয়পরাণয়তা ও বস্তুতান্রিকতার প্রতিই নিবদ্ধ। সে মানুষের লালসা, বাসনা জাগিয়ে দেয়; তার প্রয়োজনবোধ কে উদ্দীপিত করে এবং ইন্দ্রিয়গম্য বস্তুর গুরুত্ব তার হৃদয় মনে বদ্ধমূল করে দেয়, কিন্তু তার বুদ্ধিবৃত্তি ও মানসিকতার উৎকর্ষ সাধন করে না। তার মধ্যে বিচার বিবেচনা ও মননশীলতার অহমিকা সৃষ্টি করে বটে এবং সেই অহমিকা তাকে প্রতিটি জিনিসেরই ‘যুক্তিসম্মত’ সমালোচনা করতে এবং তার দৃষ্টিতে ‘যুক্তিগ্রাহ্য” নয় এমন প্রত্যেকটি জিনিসকে অস্বীকার করতে উদ্বুদ্ধও করে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যুক্তিবাদের প্রতি তার মনমানস একেবারেই বীতশ্রদ্ধ। নির্ভূল যুক্তি ধারায় কোন প্রশ্নের মীমাংসা করার অথবা কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মত যোগ্যতা তার মধ্যের আদৌ সৃষ্টি হতে পারেনা।
আধুনিক শিক্ষাভিমানিদের এই অযৌক্তিক ‘যুক্তিবাদের’ সবচাইতে বেশি প্রমান পাওয়া যায় ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে। কারণ এই বিষয়টির, আধ্যাত্মিক,নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তির সাথে পাশ্চাত্য মতবাদগুলো প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিবাদমান।
এ কথার সত্যতা প্রমান করতে হলে কোন ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তির সঙ্গে আপনি কোন ধর্মীয় ব্যাপারে আলাপ করুন এবং তার মানসিক অবস্থা যাচাই করার জন্য তার কাছ থেকে মুসলমান হবার স্বীকৃতি আদায় করুন। অতপর তার সামনে শরীয়তের কোন নির্দেশ উপস্থাপিত করে তার সপক্ষে প্রমান পেশ করে দেখুন। অমনি ভদ্রলোক গা ঝাড়া দিয়ে উঠবেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার ভঙ্গিতে বলবেনঃ ‘ এ তো হচ্ছে নেহায়েত ‘মোল্লাপনা’ আমার কাছে যুক্তি প্রমান নিয়ে এসো। নিছক বর্ননা বা উদ্ধৃতি ছাড়া তোমার কাছে যদি যুক্তি-প্রমান না থাকে তো তোমার কোন কথাই আমি স্বীকার করবো না’। ব্যস, এই ক’টি কথা থেকেই এই রহস্য প্রকাশ হয়ে পড়বে যে, ভদ্রলোককে যুক্তিবাদের হাওয়া পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। কোন ব্যাপারে যুক্তি –প্রমান দাবি করার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিণাম কি দাড়ায় এবং দাবিদার ব্যক্তির সঠিক মর্যাদা কি হয়,দীর্ঘদিনের শিক্ষা দিক্ষা ও জ্ঞানানুশীলনের পরও বেচারা এটুকু উপলব্ধি করতে পারেনি।
ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়ত মানুষের দু’টি মর্যাদাই হতে পারেঃ হয় সে মুসলমান হবে, নচেত অমুসলমান বা কাফের হবে। মুসলমান হলে তার অর্থ হবে এই যে, আল্লাহ ও তার রসুল(সাঃ) কে সে মনে প্রানে স্বীকার করে নিয়েছে। সে এই স্বীকৃতিও দিয়েছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রাসূল যে নির্দেশই পৌছাবেন,বিনা বাক্য ব্যয়ে সে তাঁর আনুগত্য করবে। এমতাবস্থায় পৃথক পৃথক ভাবে প্রতিটি বিধানের সমর্থনে যুক্তি প্রমান দাবি করার তার আর অধিকার থাকে না। মুসলিম হিসেবে তার কাজ হচ্ছে- রসূলে খোদা কোন বিশেষ নির্দেশ দান করেছেন কিনা,শুধু তা-ই অন্বেষণ করা। অতঃপর প্রথাগত যৌক্তিকতা দ্বারা কোন নির্দেশ সপ্রমানিত না হলেও সঙ্গে সঙ্গে তার আনুগত্য করা উচিৎ। অবশ্য মানসিক প্রশান্তি ও দূরদৃষ্টি লাভের জন্যে সে যুক্তি-প্রমান দাবি করতে পারে। কিন্তু এ দাবি কেবল তখনই করা যেতে পারে,যখন সে নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত হবে। কিন্তু আনুগত্যর পূর্ব শর্ত হিসেবে যুক্তি–প্রমান দাবি করা এবং যুক্তি-প্রমান না পেলে বা মানসিক প্রশান্তি লাভ না করলে আনুগত্য প্রকাশে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের অর্থ হচ্ছে এই যে,মূলত সে রসূলে খোদার কর্তৃত্বই অস্বীকার করছে আর এই অস্বীকৃতি হচ্ছে কুফরীর নামান্তর। অথচ প্রথমে সে নিজেকে মুসলমান হিসেবে দাবি করেছিলো। এখন যদি সে কাফিরের ভূমিকা গ্রহণ করে তো তার যথার্থ স্থান ইসলামের সীমার মধ্যে নয়; বরং তার বাইরে। প্রথমত যে ধর্মের প্রতি তার আদপেই বিশ্বাস নেই,তা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মত সৎ সাহস তার মধ্যে থাকা উচিত। এর পরই সে যুক্তি প্রমান দাবি করার মতো যোগ্যতা অর্জন করবে এবং সে দাবির জবাবও দেয়া যাবে।
এই হচ্ছে সুস্থ বিচার-বুদ্ধিসম্মত নিয়ম। এছাড়া দুনিয়ার কোন বিধি ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনা। কোন রাষ্ট্রের নাগরিকগণ যদি প্রতিটি সরকারি আদেশেরই যৌক্তিকতা দাবি করে এবং যুক্তি ছাড়া আদেশ পালন করতে অস্বীকৃতি জানায়,তবে সে রাষ্ট্র এক মুহূর্তের জন্যও টিকে থাকতে পারেনা। কোনো সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিকই যদি সেনাধ্যক্ষের প্রতিটি আদেশের হেতু জিজ্ঞেস করে এবং প্রতিটি ব্যাপারেই নিজের মানসিক স্বস্তিকে আনুগত্যর জন্য পূর্বশর্ত হিসেবে পেশ করে, তাহলে মূলত কোন সেনাবাহিনীই গড়ে উঠতে পারেনা। ফলকথা প্রতিটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতে হবে এবং প্রতিটি ব্যক্তি স্বস্তি লাভ না করা পর্যন্ত কোন নির্দেশ পালন করবেনা- এই নীতির ভিত্তিতে কোন স্কুল,কলেজ,সমিতি এক কথায় কোন সামাজিক ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। মানুষ সাধারনত এই প্রাথমিক ও মৌলিক ধারণা নিয়েই কোন প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হয় যে, সেই প্রতিষ্ঠানের উচ্চতর ক্ষমতার প্রতি তার সর্বোতভাবে বিশ্বাস আছে এবং তার কর্তৃত্বকে সে স্বীকার করে। অতঃপর যতক্ষন সে এই প্রতিষ্ঠানের অংশ থাকবে ততক্ষন উচ্চতর ক্ষমতার আদেশ পালন তার জন্য কর্তব্য- কোন ছোটখাট ব্যাপারে সে সন্তুষ্ট হতে না পারলেও আদেশ পালন করা তার অবশ্য কর্তব্য। অবশ্য অপরাধী হিসেবে কোন নির্দেশের বিরুদ্ধচারণ করা ভিন্নকথা। ছোটখাট ব্যাপারে অবাধ্যতা করেও কোন ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভূক্ত থাকতে পারে; কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারেও কেউ ব্যক্তিগত সন্তুষ্টিকে আনুগত্যর পূর্বশর্ত হিসেবে ঘোষণা করলে বুঝতে হবে, সে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব মানতেই অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। এ হচ্ছে সুস্পষ্ট বিদ্রোহেরই শামিল। কোন রাষ্ট্রের মধ্যে এমনই কর্মনীতি অবলম্বিত হলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র দ্রোহের মামলা দায়ের করা হবে। কোন সেনাবাহিনীতে এরূপ করলে তার বিরুদ্ধে কোর্টমার্শাল করা হবে। কোন স্কুল কলেজে এরূপ ঘটলে তৎক্ষণাৎ তাকে বহিষ্কার করা হবে। এর ধর্মের মধ্যে এমন হলে কুফরির ফতোয়া জারি করা হবে। কোনো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে এ ধরনের যুক্তি-প্রমান দাবির অধিকার কাউকে দেয়া যেতে পারেনা। এমন দাবিদারের প্রকৃত স্থান ভেতরে নয়; বরং তার বাইরে। কজেই প্রথমত তার বাইরে চলে যাওয়াই উচিৎ। তারপর সে যতখুশী আপত্তি ও প্রতিবাদ জানাতে পারে।
ইসলামের সাংগঠনিক ব্যাপারে এটা মূলনীতি বা ভিত্তিতুল্য। ইসলাম প্রথমেই মানুষকে নির্দেশ দেয়নি; বরং প্রথম সে আল্লাহ ও রসূল এর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানিয়েছে। এই একটি জিনিসের সমর্থনেই সমস্ত যুক্তি প্রমান পেশ করা হয়েছে। প্রতিটি যুক্তিসহ প্রমাণ ও প্রাকৃতিক নিদর্শনের সাহায্যে মানুষকে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ই তার প্রভু এবং মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রসূল। এই মৌলিক প্রশ্নটি আপনি যতখুশী যুক্তি তর্ক দ্বারা যাচাই পরখ করে দেখতে পারেন। কোন যুক্তি বা প্রমান দ্বারা আপনি সন্তুষ্ট হতে না পারলে ইসলাম গ্রহনে কখনোই আপনাকে বাধ্য করা হবেনা। আপনার প্রতি ইসলামের কোন বিধি ব্যবস্থাও প্রয়োগ করা হবেনা। কিন্তু যেই মাত্র আপনি স্বেচ্ছায় ইসলাম কবুল করলেন,অমনি আপনি একজন ‘মুসলমান’ হয়ে গেলেন। আর মুসলমান শব্দের অর্থই হচ্ছে অনুগত। অতঃপর ইসলামের প্রতিটি নির্দেশ সম্পর্কে আপনাকে যুক্তি প্রমান দেখানো এবং নির্দেশ পালনের ব্যাপারটি আপনার মানসিক প্রশান্তির উপর ছেড়ে দেয়ার কোনোই প্রয়োজন নেই; বরং আল্লাহ্ ও রসূলের পক্ষ থেকে যে নির্দেশই আপনার কাছে পৌছানো হবে, বিনা বাক্য ব্যয়ে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করাই হচ্ছে মুসলিম হিসেবে আপনার সর্বপ্রথম কর্তব্যঃ
(আরবী)
অর্থঃ ঈমানদার লোকের কর্তব্য হচ্ছে এই যে, তাদের কে যখন আল্লাহ ও রসূলের দিকে ডাকা হবে- যাতে করে রসূল তাদের মধ্যে ফয়সালা করতে পারেন – তখন তারা বলবে, “ আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম”।(সূরা আন নূর-৫১)
বস্তুত ঈমান ও আনুগত্যের শর্ত স্বরূপ যুক্তি প্রমানের দাবি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী জিনিস। এই দুটি জিনিসের সমন্বয় একেবারে সুস্থ বিচার বুদ্ধির পরিপন্থী। কোনো মুমিন এভাবে যুক্তি প্রমানের দাবিদার হতে পারেনা। পক্ষান্তরে এই ধরনের কোন যুক্তিবাদির পক্ষেও মুমিন হওয়া সম্ভব নয়ঃ
(আরবী)
অর্থঃ যখন আল্লাহ্ ও রসূল কোন ব্যপারে ফয়সালা করে দেন,তখন মুমিন নরনারীর ব্যাপারে নিজেদের কোন স্বতন্ত্র ফয়সালা করার কোনই অধিকার নেই। (সূরা আহযাব-৩৬)
সংস্কার ও সংগঠনের ক্ষেত্রে ইসলাম যে বিরাট সাফল্য লাভ করেছিলো তার মূলে ছিল এই নীতিটির প্রত্যক্ষ প্রভাব। লোকদের মধ্যে ঈমানী ভাবধারা বদ্ধমুল করে দেবার পর যে বিষয়ে বারণ করা হয়েছে, গোটা ঈমানদার সমাজই তার থেকে বিরত রয়েছেন। পক্ষান্তরে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে, একটি মাত্র ইঙ্গিতেই তা লক্ষ্য কোটি মানুষের মধ্যে চালু হয়ে গিয়েছে। প্রতিটি ব্যপারেই যদি যুক্তি প্রমান পেশ করা জরুরী হতো এবং প্রতি বিধি নিষেধেরই যৌক্তিকতা ও তাৎপর্য বুঝানোর উপর আইনানুবর্তিতা নির্ভরশীল হতো। তাহলে মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে রসূল সাঃ মানব চরিত্র ও আচরণের যে সংশোধন ও সংগঠন করেছিলেন, তা কিয়ামত পর্যন্ত ও সম্ভব হতোনা।
এর মানে এই নয় যে ইসলামের বিধি ব্যবস্থা গুলো যুক্তি বিরোধী কিংবা তার কোন খুটিনাটি বিধানও তাৎপর্যহীন। এর অর্থ এ- ও নয় যে,ইসলাম তার অনুগামীদের কাছে অন্ধ তকলিদ দাবি করে এবং তার বিধি ব্যবস্থার যুক্তিযুক্ত ও স্বাভাবিক ভিত্তি অনুসন্ধান করতে ও সেগুলোর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে বারণ করে। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে এর বিপরীত। ইসলামকে যথার্থ ভাবে অনুসরন করতে হলে প্রখর মণীষার ও বিচক্ষণতার একান্ত আবশ্যক। যে ব্যক্তি ইসলামী বিধি-ব্যবস্থার তাৎপর্য ও যৌক্তিকতা যত গভীরভাবে উপলব্ধি করবে, সে ততখানি নিখুঁতভাবে তা অনুসরণ করতে পারবে। এমনি ধরনের বুৎপত্তি ও দূরদৃষ্টিতে ইসলাম বারণ করেনা; বরং এজন্য উৎসাহ প্রদান করে। কিন্তু আনুগত্য প্রকাশের পরবর্তি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধিৎসা আর আনুগত্য পূর্ববর্তী শর্ত স্বরূপ বিচার বিবেচনার মধ্যে আসমান জমিনের পার্থক্য রয়েছে। মুসলমান সর্বপ্রথম শর্তহীন আনুগত্য প্রকাশ করে। অতঃপর সে ইসলামী বিধি ব্যবস্থার তাৎপর্য ও যৌক্তিকতা উপলব্ধি করার প্রয়াস পায়। কিন্তু তাই বলে প্রতিটি বিধানের যৌক্তিকতাই তার বোধগম্য হবে, এমন কোন কথা নেই। প্রকৃত পক্ষে তার তো আল্লাহর প্রভুত্ব ও রসূলের নবুয়াতের প্রতিই সম্পূর্ণ আস্থা ও সন্তুষ্টি রয়েছে। এরপর পূর্ণ দূর দৃষ্টি লাভ করার জন্য সে খুঁটিনাটি বিষয়েও অধিকতর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়। এমনই সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে; কিন্তু অর্জন করতে না পারলে আল্লাহ্ ও রসূলের প্রতি পূর্ণ সন্তুষ্টির ভিত্তিতে সে নির্দ্বিধায় সে ইসলামী বিধি ব্যবস্থার আনুগত্য করে যায়। যে ব্যক্তি প্রতি পদক্ষেপেই যুক্তি প্রমানের দাবি করে বলে যে, ‘ আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তবেই আমি এগোবো, নচেত পিছু হটবো’ তার সঙ্গে এই ধরনের যুক্তি প্রমান দাবির তুলনা কোথায়!
ইদানিং কোন মুসলিম দলের পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি প্রচারপত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ দলটি উচ্চ শিক্ষিত মুসলমানদের সমন্বয়ে গঠিত। দলের লোকেরা ধর্ম বিরোধীও নয়; বরং নিজেদের ধারনায় তারা ধর্মের বিরাট খেদমত করে চলেছে। এরা ধর্মীও ‘সংস্কারের’ নামে যেসব বিষয় বস্তু প্রচার করে থাকে তার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, প্রতি বছর বকরা ঈদের সময় মুসলমানদের কুরবানি করতে বারণ করা। সে সঙ্গে এরা মুসলমানদেরকে এই মর্মেও পরামর্শ দেয় যে, পশু জবাই করার লক্ষ্যে তারা যে অর্থ ব্যয় করে, তা জাতীয় প্রতিষ্ঠানাদির সাহায্য, ইয়াতিম ও বিধবাদের প্রতিপালন এবং বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যয় করা উচিৎ। এই প্রচারনা সম্পর্কে জনৈক মুসলমান যে আপত্তি জানিয়েছিলেন তার পূর্ণ বিবরণ আমাদের হস্তগত হয়নি। কিন্তু তাঁর সেই আপত্তির জবাবে বলা হয়েছে ঃ
কেবল আচার পালন ও অন্ধ অনুকরণ ছাড়া আজ পর্যন্ত কুরবানির যুক্তিযুক্ত ও ব্যবহারিক উপকারিতার প্রতি কেউ আলোকপাত করেনি।……কেউ যদি কুরবানির যৌক্তিকতা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেন, তাহলে তিনি আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হবেন।
যারা নিজেদের ‘শিক্ষিত’ এবং ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বলে দাবি করেন,এই হচ্ছে তাদের লেখার নমুনা। একদিকে ‘যুক্তিবাদে’র উচুকন্ঠ দাবি অন্যদিকে ‘অযৌক্তিকতা’র এমনি পরাকাষ্ঠা! ব্যক্তি বিশেষের ‘পবিত্র লেখনী’ নিসৃত এই দুটি বাক্যই প্রমান করছে যে, নিজের সঠিক ভূমিকাটাই তিনি নির্ধারন করেননি। তিনি যদি মুসলিম হিসেবে কথা বলতে চান তো ‘আচারে’র সামনেই তার মাথা নত করা উচিত। এরপরই তিনি যুক্তি প্রমান দাবির অধিকারী হতে পারেন। কিন্তু তাও আনুগত্যের শর্ত হিসেবে নয়; বরং শুধু মানসিক তুষ্টির জন্য। কিন্তু তিনি যদি আনুগত্য প্রকাশের আগেই যুক্তি প্রমানের দাবিদার হন এবং এটা তার আনুগত্যের শর্ত হয়, তবে তিনি ‘মুসলিম’ হিসেবে কথা বলারই অধিকারী নন। এই ধরনের যুক্তির দাবিদারের প্রথমেই কোন অমুসলিমের ভুমিকা গ্রহণ করা উচিত। তার পরেই তিনি যে কোন বিষয়ে স্বাধীনভাবে আপত্তি তুলবার অধিকারী হবেন। কিন্তু তাই বলে মুসলমানদের কোন ধর্মীও ব্যাপারে কোন ‘মুফতি’ সেজে ফতোয়া জারি করার কোন অধিকার তার থাকবেনা। তিনি একই সময়ে দুটি পরস্পর বিরোধী ভূমিকা পালন করছেন অথচ একটি ভূমিকার বুদ্ধিবৃত্তিক দায়িত্ব পালন করছেননা। একদিকে তিনি কেবন ‘মুসলমান’ ই নন; বরং ‘ইসলামের মুফতি’ পর্যন্ত সেজেছেন অন্যদিকে তিনিই আবার প্রামান্য আচার’কে অনর্থক মনে করছেন। কোন নির্দেশকে প্রামান্য ‘আচারের’ সাহায্যে নির্দেশ প্রমান করে দিলে তার আনুগত্য করতে তিনি অস্বীকৃতি জানান; এবং প্রথমেই সেই নির্দেশের যৌক্তিকতা ও ব্যবহারিক উপকারিতার প্রতি আলোকপাত করার শর্ত পেশ করেন। অন্য কথায়, কোন আদেশ তিনি শুধু আল্লাহ্ ও রাসূলের আদেশ বলেই তিনি মানতে প্রস্তুত নন; বরং যৌক্তিকতা ও ব্যবহারিক উপকারিতার ভিত্তিতেই তিনি তা মানবেন। এ ধরনের উপকারিতা যদি তিনি উপলব্ধি করতে না পারেন, কিংবা তার মাপকাঠিতে তা উপকারি প্রতিপন্ন না হয়, তাহলে তিনি খোদায়ী বিধানকে বাতিল করে দিবেন –তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাবেন। তাকে ‘অবান্তর’, ‘নিরর্থক’,‘বাহুল্য’ বরং ক্ষতিকর ও অপচয়মূলক প্রথা বলে অভিহিত করবেন। শুধু তাই নয় এর অনুসৃতি থেকে মুসলমানদের বিরত রাখার জন্য নিজের সর্বশক্তি পর্যন্ত নিয়োগ করবেন। এহেন স্ববিরোধী আচরন ও পরস্পর বিরোধী ভূমিকাকে কি কেউ বিবেক বুদ্ধিসম্মত মনে করতে পারে? লেখক প্রবরের যুক্তি প্রমানের দাবি ন্যায়সঙ্গত, সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি নিজেই যে বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন লোক, পয়লা এটা প্রমান করুন।
যুক্তিগত ও অভিজ্ঞতাজাত উপকারিতা কোন একটা বিশেষ ও নির্দিষ্ট জিনিসের নাম নয়; বরং এ হচ্ছে একটি আপেক্ষিক ও গুনবাচক জিনিস। এক ব্যক্তির বিচার বুদ্ধি একটা জিনিসকে উপকারি মনে করে, আবার অন্য ব্যক্তির বিচার বুদ্ধি তার বিরোধী মত পোষণ করে। তৃতীয় ব্যক্তি তার কিছুটা উপকারিতা স্বীকার করে বটে, কিন্তু তার প্রতি মোটেই গুরুত্ব প্রদান করেনা; বরং একটা ভিন্ন জিনিসকে তার চাইতেও বেশি উপকারি মনে করে। অভিজ্ঞতাজাত উপকারিতার প্রশ্নে এর চাইতেও বেশি মতবিরোধ রয়েছে। কারণ উপকারিতা সম্পর্কে প্রত্যেকের ধারণাই আলাদা। সেই ধারণা অনুসারেই প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের কিংবা অন্যের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কোন জিনিসকে উপকারি বা অপকারী বলে সাব্যস্ত করে। এক ব্যক্তির কাছে আপাত লাভই শুধু কাম্য এবং আপাত ক্ষতিই পরিহারযোগ্য। তার পছন্দ একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন লোকের থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য। আবার বহুতর জিনিসের মধ্যেই এক রকমের উপকার এবং অন্য রকমের অপকার আছে। এক ব্যক্তি উপকারের তুলনায় অপকারকে তুচ্ছ মনে করেই ঐ জিনিসগুলোকে গ্রহণ করে, আবার অন্য ব্যক্তি উপকারের চেয়ে অপকার বেশি মনে করে ঐগুলোকে পরিহার করে চলে।
পরন্তু যুক্তিযুক্ত ও অভিজ্ঞতা জাত উপকারের ক্ষেত্রে কখনো কখনো বিরোধ লক্ষ্য করা যায়। অভিজ্ঞতার দিক থেকে একটা জিনিস হয়তো ক্ষতিকর; কিন্তু বিচার বুদ্ধির ফয়সালার অনুযায়ী কোন বড় রকমের যুক্তিসহ উপকারিতার খাতিরে এই অনিষ্টকে বরদাশত করা উচিত। অন্য একটা জিনিস অভিজ্ঞতার দিক থেকে উপকারি বটে কিন্তু বিবেকের নির্দেশ অনুসারে কোন যুক্তিযুক্ত অপকার থেকে বাঁচবার জন্য তাকে পরিহার করাই কর্তব্য। এই ধরনের বিরোধ বা সংঘাত বর্তমান থাকতে কোন জিনিসের ‘যুক্তিযুক্ত’ ও ‘অভিজ্ঞতাজাত’ উপকারিতা সম্পর্কে কোন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই সম্ভব নয়। আর কোন জিনিসের উপকারিতা সম্পর্কে সবাই ঐক্যমত পোষণ করবে এবং কারো ভিন্ন মত পোষণ কিংবা অস্বীকার জ্ঞাপনের কোন সুযোগই থাকবেনা, এ- ও এক অসম্ভব ব্যাপার। কেবল এক কুরবানী প্রসঙ্গ কেন- নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত ও অন্যান্য শরীয় আদেশ নিষেধের মধ্যে কোন জিনিসের যৌক্তিকতা ও অভিজ্ঞতাজাত উপকারিতা দিবালোকের ন্যায় প্রতিভাত হয়ে উঠেছে এবং সমস্ত মানুষই কি তা বুঝে শুনে আনুগত্য স্বীকার করেছে? তাই যদি হতো তবে নামায, রোজা বর্জনকারী এবং হজ্জ ও যাকাতে অবিশ্বাসী একটি লোকও দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যেতোনা। এই কারণেই বিধি ব্যবস্থা প্রতিটি লোকের বিচার বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল নয়; বরং তার ভিত্তি হচ্ছে ঈমান ও আনুগত্য। মুসলমান কখনো যৌক্তিকতা ও অভিজ্ঞতাজাত উপকারিতার প্রতি ঈমান পোষণ করেনা; বরং তার ঈমান হচ্ছে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রতি। তার ধর্ম এই নয় যে কোন জিনিসের প্রতি যৌক্তিকতা ও উপযোগীতা প্রতিপন্ন হলে তবেই তাকে গ্রহণ করা যাবে এবং কোন জিনিসের অযৌক্তিকতা ও অনুপযোগীতা প্রতিভাত হলেই তা পরিহার করতে হবে। বরং তার ধর্ম হচ্ছে আল্লাহ্ ও রসূলের নির্দেশ বলে যা প্রমানিত তা অবশ্য পালনীয় আর যা প্রামান্য নয় তা পালনেরও যোগ্য নয়।
কাজেই লেখকের ঈমান কি যৌক্তিকতা ও উপকারিতার উপর না আল্লাহ্ ও রসূলের প্রতি এটাই হচ্ছে এখনকার প্রশ্ন। প্রথমটি যদি সত্যি হয় তবে ইসলামের সাথে তার কিছু মাত্র সম্পর্ক নেই। কাজেই তার মুসলমান সেজে কথা বলবার ও জনসাধারণকে ‘মরুভূমির তথাকথিত সুন্নত পরিহার’ করবার পরামর্শ দানের কি অধিকার রয়েছে? আর যদি দ্বিতীয়টি সত্য হয় তবে যৌক্তিকতা ও উপযোগীতাকে আলোচনার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ না করাই উচিত। বরং তার এই প্রশ্ন করা উচিত যে কুরবানী কি শুধু মুসলমানদের মনগড়া প্রথা মাত্র? নাকি আল্লাহ্ ও রসূলের মনোনীত একটি ইবাদাত- যা খোদ আল্লাহর রসূলই তাঁর উম্মতের মধ্যে প্রবর্তন করেছেন?