৮
যুক্তিবাদের প্রতারণা
[প্রবন্ধটি ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরে মাসিক তরজমানুল কুরআনে প্রথম প্রকাশিত হয়]
এক
ইসলামী শিক্ষা দীক্ষায় অপরিণত কিংবা একেবারে আনাড়ী নওজোয়ানদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির ওপর পাশ্চাত্য শিক্ষা, কৃষ্টি ও সভ্যতা কিরূপ গভীর প্রভাব বিস্তার করে, তা এই শ্রেণীর লোকদের প্রকাশিত রচনা ও বক্তৃতা থেকেই অনুমান করা যেতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সম্প্রতি যুক্তপ্রদেশের জনৈক মুসলিম গ্রাজুয়েটের একটি প্রবন্ধ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। উক্ত প্রবন্ধে তিনে নিজের চীন ও জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
আমাদের চীনা সহগামীরা বেজায় পেটুক এবং মদখোর। শুকরের মাংস তো তাদের প্রাণতুল্য। এবার আমি খ্রীষ্টধর্মের উন্নতির রহস্যটি বুঝতে পেরেছি। চীনারা তাদের প্রাচীন ধর্মের আনুগত্যকে আধুনিক শিক্ষার পরিপন্থি মনে করে। তারা যদি বুঝতে পারতো তো তাদের ইসলাম গ্রহণে অসুবিধা হতোনা। কিন্তু ইসলাম তাদের সমস্ত প্রিয় খাদ্য থেকেই বঞ্চিত করে; তাই বাধ্য হয়ে তারা খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় ভবিষ্যতে খ্রীষ্টধর্ম চীনের সরকারি ধর্মে পরিণত হলে তাতে বিস্ময়ের কিছুই থাকবেনা। শুকরের মাংসের ব্যাপারে আমি ইউরোপ ও চীনের নওমুসলিমদের একটু সুবিধা দেবার পক্ষপাতী। কুরআন থেকেও এর স্পষ্ট হারাম হবার ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে। বড়জোর আরবদের জন্যে হয়তো কোনো বিশেষ কারণে এটি হারাম করা হয়েছে। কিন্তু যে দেশে এছাড়া ‘ফামানিদ তুর্বা গাইরা বাগিওঁ ওয়ালা আদিন’ (অর্থাৎ চলা অসম্ভব) হয়ে পড়ে সেখানে এর ব্যবহারে ক্ষতিটা কি। মোটকথা, কুরআনের এই একটিমাত্র বিধানের তাৎপর্য, অর্থাৎ এর সাধারণ নিষেধাজ্ঞার কারণটি আমার বোধগম্য হয়নি। নচেৎ নীতিগতভাবে পাকস্থলী ও নৈতিক চেতনার মধ্যে এতোখানি ব্যবধান থাকতেও ধর্ম যদি আমাদের জন্যে খাদ্যতালিকা তৈরি করতে পারে, তবে সে লৌহকর্ম, অলঙ্কার গড়ন, দর্জীগিরী ইত্যাদি কেন শিক্ষা দেবেনা? আমার মতে, দুনিয়ায় ইসলামের উন্নতি ও বিস্তৃতি না হবার গূঢ় কারণ এই যে, সে মানুষের তামাম মানবিক অধিকার হরণ করে তাকে একটি নির্জীব জড়পিন্ড এবং নিতান্ত অবোধ শিশুতে পরিণত করে। যার ফলে সে নিজের পার্থিব উন্নতির পথই হারিয়ে ফেলে। নচেৎ খ্রীষ্টানরা যেমন বুঝতে পেরেছে, আমাদেরও ধর্ম ঠিক তেমনি হওয়া উচিত।
এরপর তিনি সাংহাইয়ের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখছেনঃ
খোদার সৃষ্ট এই বেশুমার সুখী-সমৃদ্ধ সানুষগুলোকে দেখে আমার মন কিছুতেই সায় দেয়না যে, মাত্র কয়েক বছর পরই এরা দোযখের ইন্ধনে পরিণত হবে-যেনো এদের সৃষ্টির পেছনে খোদার এই একটিমাত্র উদ্দেশ্যই নিহিত রয়েছে। তাছাড়া এদের জনকয়েক ছাড়া বাদবাকি সবাই যদি কাফির ও মূর্তিপূজক হয়, তবে তাদের দোযখে নিক্ষেপের জন্য এটাই কি অপরাধ বলে গণ্য করা হবে যে, তারা খোদার দুনিয়াকে সমৃদ্ধ ও সুশোভিত করেছে? তারা তো হাজীদেরকে হত্যা বা রাহাজানি করেনা! লূত কওমের দৃষ্কৃতিু তাদের মধ্যে নেই। কারো ধন মাল তারা আত্মসাৎ করেনা এবং তা ‘হালাল’ করার জন্যে কোনো যুক্তি তর্কেরও অবতারণা করেনা। তারা নির্বিবাদে ও সুশৃংখলভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করছে। এতদ্বসত্ত্বেও তারা দোযখের উপযুক্ত বলে গণ্য হবে কেন? মুশরিকী ধারণা নিসন্দেহে একটি বাজে ও অন্তসারশূন্য জিনিস। কিন্তু আমায় বলুন, এক ব্যক্তি যদি কোনো সত্তাকে স্বভাবতই তার জীবন মৃত্যুর মালিক বলে মনে করে, কিন্তু তার নিগূঢ় রহস্য উপলব্ধি করতে সে আমাদের মতোই অক্ষম কিংবা সে আরবীকে খোদার ভাষা বলে বিশ্বাস করেনা- কেবল এইটুকু কারণেই আপনারা তার দুশমন এবং সে আপনাদের হয়ে যাবে? কিন্তু না, আপনাদের দৃষ্টিতে এতো কিছুরও প্রয়োজন নেই। আপনাদের শুধু প্রয়োজন হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের পায়জামা এবং বিশেষ কাটিং-এর জামা পরিধান করতে হবে। বিশেষ ধরনের খাদ্য খেতে হবে। মুখের ওপর চার আঙ্গুল পরিমাণ দাড়ি রাখতে হবে। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করা যাবেনা; কারণ সেখানে ধর্মীয় ভাষা ও শাস্ত্র শিক্ষা দেয়া হয়না।
জাপানের কোবে বন্দর সম্পর্কে তিনি লিখছেনঃ
দু’ঘন্টাকাল আমি কোবে বন্দর ঘুরে দেখছিলাম। কোথাও একটি ভিক্ষুক আমি দেখতে পাইনি- জীর্ণ-ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত কোনো দরিদ্রও আমার চোখে পড়েনি। যে জাতি ধর্ম বা খোদার নাম পর্যন্ত জানেনা, তারা এতোখানি উন্নত!
এরপর তিনি নিজেই ‘সদুপদেশ’ ঝাড়তে শুরু করলেনঃ
স্মরণ রাখবেন, ‘ইহসান’ই হচ্ছে ধর্মের মূল জিনিস। কিন্তু এটি কোনো ভাষা বা শাস্ত্রের মুখাপেক্ষী নয়। এর স্বাভাবিক লক্ষ্য হচ্ছে, আমাদেরকে পরকালীন জীবনে কি ইহজীবনে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে দায়িত্বশীল করে তোলা। এটিই হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম ধর্ম। এর বেশি যে জিনিসটি নাম আপনারা ধর্ম রেখেছেন, তা শুধু আপনাদের আত্মপ্রবঞ্চনা কিংবা মস্তিস্কবিকৃতি মাত্র। যেদিন আপনারা দু’টি জিনিসের মধ্যে ধর্মকে সীমাবদ্ধ রাখবেন এবং শরীয়তের যাবতীয় বন্ধন ছিন্ন করে ফেলবেন, সেদিনআপনারাও অন্যান্য জাতির সাথে উন্নতির শীর্ষদেশে পৌছতে পারবেন; বরং একথা বলুন যে, সেদিন আপনারা জাতিসমূহের মধ্যে বিবেক বুদ্ধি জাগিয়ে তুলবেন। কারও হাত থেকে যদি দুনিয়ার কতৃর্ত্ব না যায় তো ‘আসমানী বাদশাহী’ ও যাবেনা। আপনারা নিজেরা কোনো জাতি নয়, বরং অন্যান্য জাতির সংস্কারক। কিন্তু আল্লাহর ওয়াস্তে এ কথা বলার সুযোগ দেবেননা যে, অমুক যাতি উন্নতির শীর্ষদেশে আরোহণ করেছে; কিন্তু তাদের মধ্যকার মুসলমানদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এটা নিঃসন্দেহ যে, তাদের এই শোচনীয় অবস্থার জন্য দায়ী হচ্ছে তাদের অদ্ভুত প্রকৃতির ধর্ম।
এই উদ্ধৃতিটুকু আমাদের নব্য শিক্ষিত তরুণ সমাজের সাধারণ মানসিক অবস্থার একটি স্পষ্ট নমুনা। তাঁরা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেছে, মুসলিম সমাজের অঙ্গ হিসেবেই লালিত পালিত হয়েছে, মুসলমানদের সাথে সমাজ ও সভ্যতার বন্ধনে তাঁরা আবদ্ধ। এই কারণেই ইসলামের প্রতি অনুরক্তি, মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতি এবং মুসলিম হিসেবে বেচে থাকার আকাঙ্খা তাদের সহজাত। এই আকাঙ্খা তাদের ইচ্ছাশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাশক্তির প্রভাব ছাড়াই তাদের মনমগজে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই অনিচ্ছাকৃত ও চেতনাহীন ইসলামকে শিক্ষাদীক্ষার সাহায্যে ইচ্ছাকৃত ও চেতনালব্ধ ইসলামে পরিণত করা, মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেওয়ার পূর্বে ইসলামী শিক্ষাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করা এবং বাস্তব জীবনে ইসলামী বিধি ব্যবস্থা ও আইন কানুন অনুশীলন করে দেখার মতো যোগ্যাতা সৃষ্টি করা একান্ত উচিত ছিল। কিন্তু তার পূর্বেই তাদেরকে ইংরেজী শিক্ষার জন্য স্কুল কলেজে প্রেরণ করা হল। সেখানে সম্পূর্ণ অনৈসলামিক শিক্ষা দীক্ষার মধ্যে তাদের মন মানস ও চিন্তা শক্তি বিকাশ লাভ করলো। তাদের মন মস্তিস্কের উপর পাশ্চাত্য সভ্যতা ও চিন্তাধারা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করলো। এর ফলে প্রত্যেকটি জিনিসকেই তারা পাশ্চাত্য দৃষ্টিতে দেখলো। প্রতিটি সমস্যাকেই তারা পাশ্চাত্য মানসিকতা দিয়েই বিচার করতে লাগলো। মোটকথা, পাশ্চাত্যবাদের এই সর্বাত্মক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কোনরূপ চিন্তা ভাবনা ও পর্যবেক্ষন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। তারা পাশ্চাত্য থেকে যুক্তিবাদের সবক গ্রহণ করলো বটে; কিন্তু তাদের নিজস্ব কোন যুক্তিজ্ঞান ছিলনা। তাদের যুক্তি ছিল ইউরোপ থেকে ধার করা। এই কারণেই তাদের যুক্তিবাদ মূলত ফিরিঙ্গী যুক্তিবাদে পরিনত হলতা আর মোটেই স্বাধীন যুক্তিবাদ রইলো না। তারা পাশ্চাত্য থেকে সমালোচনার শিক্ষাও গ্রহণ করলো; কিন্তু এটিও স্বাধীন সমালোচনার শিক্ষা ছিলোনা; বরং এ শিক্ষার সারকথা হলো এই যে, পাশ্চাত্য রীতিনীতিকে অভ্রান্ত জানবে, যার মানদণ্ডে প্রাচ্যের সবকিছুকেই যাচাই করবে কিন্তু খোদ পাশ্চাত্য রীতিনীতিকে সমালোচনার উর্ধ্বে মনে করবে।
এহেন শিক্ষা দীক্ষার পর তারা যখন কলেজের চৌহদ্দি পেরিয়ে জীবনের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলো, তখন তাদের মন ও মস্তিস্কের মধ্যে বিরাট ব্যবধান দেখা দিলো। তাদের মন ছিল মুসলমান, কিন্তু মস্তিস্ক ছিল অমুসলিম। তারা বাস করতো মুসলিম সমাজে। দিনরাত সমস্ত কাজ কারবার করতো মুসলিমদের সঙ্গে। সমাজ ও সভ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল মুসলমানদের সাথে। নিজেদের চারিদিকে লক্ষ্য করতো মুসলমানদেরই ধর্মীয় ও তামাদ্দুনিক ক্রিয়াকলাপ। ভালবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্ক মুসলমানদের সাথেই সম্পৃক্ত ছিলো; কিন্তু তাদের চিন্তা ভাবনা বিচার বিবেচনা ও মত গঠন করার সমস্ত শক্তিই ছিল পাশ্চাত্যের ছাঁচে গড়া। তার সাথে ইসলামের কোন রীতিনীতি বা মুসলমানদের কোন আচরণের আদৌ কোন সঙ্গতি ছিলোনা। এর ফলে পাশ্চাত্য মানদণ্ডেই ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতিটি জিনিস বিচার করতে শুরু করলো। এই মান্দন্ডের বিপরীত প্রতিটি জিনিসকে – তা ইসলামের কোনো মূলনীতি বা খুঁটিনাটি বিষয় হোক আর মুসলমানদের কোনো আচরণ হোক – তারা ভ্রান্ত ও সংশোধনীয় বলে মনে করলো। তাদের কেউ কেউ গবেষণা ও পর্যবেক্ষনের জন্য ইসলাম সম্পর্কে কিছুটা অধ্যায়নও করলো। কিন্তু তাদের সমালোচনা ও গবেষণার মানদন্ড ছিল তেমনি পাশ্চাত্য ধরণের। কাজেই তাদের মানসিকতার বাঁকা ছিদ্রপথে ইসলামের সোজা পেরেক আঁটবে কি করে?
এই শ্রেণীর ভদ্রলোকেরা যখন ধর্মীয় ব্যাপারে মত প্রকাশ করেন, তখন এদের কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট মনে হয় যে, কোনোরূপ চিন্তা ভাবনা ছাড়াই যেন অনর্গল বক্তৃতা ঝেড়ে চলছেন। তার ভূমিকাটা যেমন সুসঙ্গত হয়না তেমনি তা যুক্তি বিজ্ঞানের নিয়মানুযায়ী সুবিন্যস্তও নয়। এমনকি, সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য কোনো চেষ্টা পর্যন্ত এরা করেননা। সবচাইতে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, কথা বলবার সময় নিজের ভূমিকাটা পর্যন্ত এরা নির্ধারণ করেনা। একই কথা প্রসঙ্গে এরা অবলীলাক্রমে বিভিন্ন ভূমিকা গ্রহণ করতে থাকেন – এক বিশেষ ভূমিকার কথা বলতে বলতে অকস্মাৎ অন্য এক ভূমিকা গ্রহণ করে বসেন এবং নিজেরাই পুর্ববর্তী ভূমিকার বিরুদ্ধে বলতে শুরু করেন। শিথিল চিন্তা হচ্ছে এদের ধর্মীয় আলোচনার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ধর্ম ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে এরা অত্যান্ত হুশিয়ারী ও সতর্কতার সাথে কথা বলবেন। কারণ সেখানে কোনো অসংবদ্ধ কথা বললে সূধীমন্ডলীর দৃষ্টিতে যে কোনো মর্যাদাই থাকবেনা – একথা তারা ভাল করেই জানেন। কিন্তু তাদের কাছে ধর্মের কোন মূল্য বা গুরুত্ব না থাকার কারণে সে সম্পর্কে কথা বলার সময় নিজের মস্তিস্কের উপর গুরত্ব আরোপ করার কোনো প্রয়োজনই তারা বোধ করেননা। এই কারণেই তারা এখানে সম্পূর্ণই নিশ্চিতভাবে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে পারেন। তাদের অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আহারের পর আরাম কেদারায় শুয়ে যেনো একটু রসালাপ করছেন মাত্র, তাই এ ব্যাপারে কথা বলার রীতির প্রতি লক্ষ্য রাখারও কোনো প্রয়োজন নেই।
এই জাতীয় লোকদের রচনাবলীতে দ্বিতীয় যে জিনিসটি স্পষ্টত পাওয়া যায়, তাহলো এদের চিন্তার স্থূল ও জ্ঞানের দৈন্যতা। ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে এতটা কম জ্ঞান এবং এত নগণ্য চিন্তা ভাবনা নিয়ে কথা বলার সাহস এদের নেই। কারণ প্রকৃত তথ্য না জেনে সেখানে কোন কথা বললে সম্ভ্রমহানি হবার ভয় থাকে। কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে অনুসন্ধান, অধ্যায়ন ও চিন্তা ভাবনা করার তারা প্রয়োজনই বোধ করেননা। হালকাভাবে যা কিছু জানতে পারেন, তার ভিত্তিতেই তারা সিধান্ত করে নেন এবং অসংকোচে তাই বিবৃত করে যান। কারণ, এখানে ধরপাকড়ের ভয় নেই। ধরপাকড় করলে হয়তো মৌলুভিরা করবেন; কিন্তু আগে থেকে এটা সুপরিকল্পিতভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে যে, মৌলুভিরা হচ্ছে অন্ধ, সেকেলে ও সঙ্কীর্ণমনা।
সুযোগ্য লেখকের আলোচ্য নিবন্ধটিতে এই উভয় বৈশিষ্ট্যই পুরোপুরি বজায় রয়েছে। তাঁর প্রবন্ধ থেকে প্রথমত এটা বোঝাই যায়না যে, তিনি মুসলিম হিসেবে কথা বলছেন কি অমুসলিম হিসেবে। অথচ ইসলাম সম্পর্কে যিনি কথা বলবেন, তাঁর মাত্র দুটি ভুমিকাই থাকতে পারেঃ হয় তিনি মুসলমানদের ভুমিকা গ্রহণ করবেন, নচেৎ অমুসলিম হিসেবে কথা বলবেন। যিনি মুসলমান হিসেবে কথা বলবেন, তিনি অন্ধবিশ্বাসী (Orthodox), স্বাধীনচেতা, সংস্কারবাদী যাই হোক না কেন, তাকে অবশ্যই ইসলামের সীমার মধ্যে থেকে কথা বলতে হবে। অর্থ্যাৎ কুরআন মজীদকে চূড়ান্ত বিধান (Final Authority) এবং কুরআন নির্ধারিত ধর্মীয় নীতি ও শরয়ী বিধানকে তাঁর নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিতে হবে। কারণ, কুরআনের প্রামাণিকতাকে তিনি বিশ্বাস না করলে এবং কুরআন থেকে প্রমাণিত কোনো বিষয়ের সমালোচনা করার অবকাশ আছে মনে করলে তাকে ইসলামের বাইরে চলে যেতে হবে। এভাবে সীমা অতিক্রমের পর তিনি আর মুসলমানের ভুমিকায় কথা বলতে পারেননা। পক্ষান্তরে তিনি দ্বিতীয় ভুমিকা গ্রহণ করলে, অর্থ্যাৎ ঘোষিত অমুসলিম হলে কুরআনের মূলনীতি ও বিধি ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বাধীনভাবে সমালোচনা করতে পারেন। কারণ তিনি কুরআনকে চূড়ান্ত দলিল বলে স্বীকার করেননা। কিন্তু এই ভূমিকা গ্রহণ করার পর মুসলিম হিসেবে কথা বলার, মুসলমান সেজে মুসলমানদের ইসলামের তাৎপর্য বোঝাবার এবং ইসলামের জন্য উন্নতির পথনির্দেশ করার কোনো অধিকারই তার থাকতে পারেনা। একজন বুদ্ধিমান ও চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি যখন বুঝে শুনে ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করবেন, তখন এই দুটি ভূমিকার মধ্যে কোনটি তাঁর পক্ষে গ্রহণযোগ্য তার যুক্তিসম্মত শর্তাবলীর প্রতিও তিনি লক্ষ্য রাখবেন। কারণ একই সময় নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়া আবার কুরআন নির্ধারিত মূলনীতি ও বিধিব্যাবস্থা সম্পর্কে সমালোচনা করা অথবা কুরআনের প্রামাণিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করা আবার মুসলমানদের সদুপদেশও খয়রাত করা – কোনো বুদ্ধিমান লোকেরই কাজ হতে পারেনা। এ হচ্ছে দুটি বিপরীতধর্মী জিনিসকে একত্রিত করার ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। এর মানে হচ্ছে এই যে, একই সময়ে এক ব্যক্তি নিজেকে মুসলমান এবং অমুসলমান উভয় নামেই পরিচয় দিচ্ছেন – একই সময়ে ইসলামের সীমার মধ্যে ও বাইরে উভয় জায়গায়ই তিনি অবস্থান করছেন।
লেখকের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং তাঁর বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আমরা এতখানি বিরূপ ধারণা পোষণ করিনা যে, ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলতে হলে একইভাবে দুটি পরস্পরবিরোধী ভূমিকা তিনি গ্রহণ করতেন। আমরা তাঁর কাছ থেকে এ প্রত্যাশাও করিনা যে, ভারত সম্রাটের [মনে রাখতে হবে যে, প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিল ১৯৩৪ সালে] আদালতে বসে তিনি ভারত সম্রাটেরই প্রবর্তিত বিধিব্যবস্থার সমালোচনা করবেন। আমরা তাঁর কাছ থেকে এ দুঃসাহসও আশা করিনা যে, তিনি কোনো ধর্ম বা মতাদর্শের (School of Thought) আনুগত্যের দাবি করার পর সেই ধর্মেই মৌলনীতির সমালোচনায় প্রবৃত্ত হবেন। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, ইসলাম সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী দুটি ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। এমনকি, তিনি যে বারংবার ভূমিকা বদলাচ্ছেন, এই অনুভূতিটি পর্যন্ত তাঁর নেই। একদিকে তিনি নিজেকে মুসলমান বলে জাহির করছেন, মুসলমানী নামে পরিচয় দিচ্ছেন, মুসলমানের দুর্দশার জন্য আক্ষেপ করছেন, ইসলামের উন্নতির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছেন, মুসলমানদের ‘ইহসান’ অর্থ্যাৎ ‘খাটি ধর্মের’ নসীহত শুনাচ্ছেন। অন্যদিকে যে কিতাবের উপর ইসলামের ভিত্তি অবস্থিত এবং যাকে চূড়ান্ত দলিল বলে স্বীকার করা মুসলমান হবার জন্যে অপরিহার্য শর্ত, তাঁর মুলনীতি ও বিধিব্যবস্থা সম্পর্কে বেপরোয়া সমালোচনাও করছেন। কুরআন শুধু এক আধটি ক্ষেত্রেই নয়, অন্তত, চার জায়গায় শূকরের মাংসকে [দেখুনঃ আল বাকারাঃ আয়াত ১৭৩, আল মায়েদাঃ আয়াত ৩, আল আনআমঃ আয়াত ১৪৫, আননাহলঃ আয়াত ১১৫] স্পষ্ট ভাষায় হারাম ঘোষণা করেছে। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে লোকদেরকে সুবিধা দেবার পক্ষপাতি। মজার ব্যাপার হলো, সুবিধা দেবার এই আগ্রহটাও নাকি ‘ইসলামের উন্নতির’ খাতিরে! মনে হয় যেনো কুরআনের চাইতেও ইসলামের উন্নতির চিন্তা তাকে বেশী পেয়ে বসেছে। অথবা তিনি কুরআন বহির্ভূত কোনো ইসলামের তরক্কির জন্য অধীর হয়ে পরেছেন! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কুরআন অন্যান্য জিনিসের ন্যায় মানুষের জন্য খাদ্য তালিকাও (Menu) প্রস্তুত করে এবং খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে হালাল হারাম ও পাক- নাপাকের পার্থক্য নির্ধারণ করে দেয়। এমনকি, স্পষ্টত বলে দেয় যে, ‘তোমরা নিজেদের খেয়াল খুশি অনুযায়ী কোনো জিনিসকে হালাল বা হারাম ঘোষণা করার অধিকারী নও’। [আননাহলঃ আয়াত ১১৬] কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে নিজের অধিকারের উপরই জোর দিচ্ছেন এবং কুরআনের অধিকার স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করছেন। অর্থ্যাৎ পানাহারের ব্যাপারে ধর্মের কোনো হস্তক্ষেপ মানতেই তিনি রাজি নন! বস্তুত সেন্ট পলের [ইনি যিশুখ্রিস্টের অন্যতম প্রধান শিষ্য। মৃত্যু, আনুমানিক ৬৭ খ্রিস্টাব্দ। বর্তমান খ্রিস্টান জগত এঁরই মতের অনুগামী।–সম্পাদক] (যীশুখ্রিষ্ট নন) অনুগামীদের ন্যায় কুরআন ধর্মকে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে আবদ্ধ করে রাখেনি। বরং পোশাক পরিচ্ছদ, খানাপিনা, বিবাহ তালাক, উত্তরাধিকার, লেনদেন, রাজনীতি, বিচারালয়, দন্ডবিধি ইত্যাদি প্রত্যেকটি ব্যাপারেই সে আইন প্রদান করে। অথচ তিনি একে ইসলামের উন্নতি ও তরক্কির পথে অন্তরায় মনে করেন। তিনি অভিজোগ করেছেন যে, এই আইন মানুষকে একটি নির্জীব লাশ এবং অবোধ শিশুতে পরিণত করে। আর তাই তিনি প্রস্তাব করেছেন, খ্রিষ্টানরা (প্রকৃতপক্ষে পল অনুগামীরা) যেমন বুঝছে, আমাদের ধর্মও ঠিক তেমনটিই হওয়া উচিত। কুরআন নিজেই শরয়ী বিধান তৈরী করেছে এবং তাকে আল্লাহ নির্ধারিত সীমা আখ্যা দিয়ে তার আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তিনি শরীয়তের এই সীমারেখাকে বেড়ি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সেন্ট পলের ন্যায় ধর্মের প্রচার ও উন্নতির জন্যে সে বেড়ি ছিন্ন করা আবশ্যক মনে করেছেন। কুরআনের দৃষ্টিতে ঈমান হচ্ছে মুক্তির জন্যে প্রথম ও আবশ্যিক শর্ত। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমানদার নয়, তার সম্পর্কে কুরআন সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছে যে, সে দোজখের ইন্ধনে পরিণত হবে। [আল আম্বিয়াঃ আয়াত ৯৮] তারা সংখ্যায় অগণিত হোক কি মুষ্টিমেয়, স্বচ্ছল হোক কি দরিদ্র তাতে কিছুই যায় আসেনা। কিন্তু তার অবস্থা হচ্ছে এইযে, কাফির ও মূর্তিপূজারীদের অগণিত জনসংখ্যাকে সুখী স্বচ্ছল ও সমৃদ্ধশালী দেখে তার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছেনা যে, কয়েক বছর পরেই তারা দোজখের ইন্ধনে পরিনত হবে! কারণ তারা খোদার দুনিয়াটাকে সমৃদ্ধ ও সুশোভিত করা ছাড়া আর কি অপরাধ করেছে, এটা তার বোধগম্যই হচ্ছেনা! প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, কুরআনের সঙ্গে এতটা খোলাখুলি মতবিরোধ পোষণ করে তিনি কিভাবে মুসলমান থাকতে পারেন? কিংবা মুসলমান হয়ে তিনি কিভাবে কুরআনের সাথে মতবিরোধ পোষণ করেন? তিনি যদি মুসলমান হন তো কুরআনের সাথে তার মতবিরোধ না করাই উচিত। আর যদি মতবিরোধ চান, তাহলে ইসলামের নির্ধারিত সীমার বাইরে গিয়েই করা উচিত। যে ব্যক্তি কোনো ধর্মের মূলনীতি ও বিধিব্যবস্থার প্রতি সন্তুষ্ট নয়, যার মন সে বিধিব্যবস্থার সত্যতায় সায় দেয়না, যিনি তার কার্যকারণ ও যৌক্তিকতা উপলব্ধি করতে অক্ষম, যার দৃষ্টিতে তার কতক বা অধিকাংশ বিষয়ই আপত্তিকর, তার সামনে দুটি পথই খোলা রয়েছেঃ হয় তিনি সে ধর্ম থেকে বেরিয়ে গিয়ে তার যেকোনো নিয়ম ও বিধান সম্পর্কে নির্বিবাদ সমালোচনা করার অধিকার লাভ করবেন, কিংবা অসন্তুষ্ট মনোভাব নিয়ে সে ধর্মের মধ্যে থাকতে চাইলে তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ থেকে বিরত থাকবেন এবং ‘মুজতাহিদ’ সেজে তার বিধিব্যবস্থার উপর করাত না চালিয়ে যথার্থ শিক্ষার্থীর ন্যায় নিজের সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করবেন। সুস্থ বিচার বুদ্ধি অনুসারে কেবল এই দুটি পন্থাই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। আর সত্যিকার বিবেকসম্পন্ন কোনো লোক এমনি পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে এর যেকোনো একটি পন্থাই অবলম্বন করবেন। কিন্তু লেখক প্রবর এবং তার ফিরিঙ্গী শিক্ষাপ্রাপ্ত অনেক লোকেরই অবস্থা হচ্ছে এই যে, প্রথম পথটি গ্রহণ করার মত নৈতিক সাহস তাদের মধ্যে নেই, আর দ্বিতীয় পথ অবলম্বন করতেও তাদের লজ্জাবোধ করেন। এই কারনেই তারা মাঝামাঝি একটা অযৌক্তিক পন্থা অবলম্বন করেছেন; তা হল এই যে, একদিকে তারা মুসলমানদের মধ্যে শামিল হয়ে ইসলামের উন্নতি ও তরক্কিওকামনা করেন, ইসলাম ও মুসলমানদের দুঃখ দরদে অস্থিরতাও প্রকাশ করেন, অন্যদিকে ইসলামের বিরুদ্ধে এমন সবকিছুই বলেন এবং করেন, যা একমাত্র অমুসলমানদের পক্ষেই সম্ভব। হাদিস ও ফিকাহ তো দুরের কথা, খোদ কুরআন মজীদের সমালোচনা করতেও এঁরা কুণ্ঠিত নন। ইসলামের প্রতিটি ভিত্তির ওপরই এঁরা অবলীলাক্রমে আঘাত হেনে চলছেন। এই শ্রেণীর ভদ্রজনেরা দাবি করেন যে, সমাজে এঁরাই একমাত্র যুক্তিবাদী লোক; সুতরাং যুক্তিবিরদ্ধ কোনো কথা এরা মানতে পারেননা। আর “মোল্লা”দের বিরুদ্ধে এদের সবচাইতে বড় অভিযোগ এই যে, তারা কোনো ব্যাপারেই বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করেনা। কিন্তু এদেরই অবস্থা হচ্ছে এই যে, ধর্মের ব্যাপারে এরা স্পষ্টত স্ববিরোধী কথা বলছেন, পরস্পর বিরোধী কর্মনীতি অবলম্বন করছেন এবং নিজেরই এক কথার দ্বারা অন্য কথার প্রতিবাদ করে চলছেন- এটা কোন ধরনের যুক্তিবাদ যা আবিস্কার করে প্রগতিবাদী গবেষকরা কৃতিত্ব অর্জন করছেন?
এবার তাদের জ্ঞানের বহর এবং চিন্তার গভীরতা একটু তলিয়ে দেখুন।
ইসলাম তরক্কির জন্যে লেখকপ্রবর খ্রিস্টধর্মের ন্যায় তাবৎ শরয়ী বিধি নিষেধ তুলে দেয়া এবং ইসলামকে নিছক একটি বিশ্বাসমূলক ধর্ম বানিয়ে রাখা আবশ্যক মনে করেন। কারণ খ্রিস্টধর্মের উন্নতির মূলে এই রহস্যটি তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, সেখানে হারাম হালালের কোনো সীমারেখা নেই। কোনো নৈতিক বিধি নিষেধের বালাই নেই। সেখানে মানুষের মানবিক অধিকার হরণ করে তাকে নিষ্প্রাণ লাশ ও অবোধ শিশুতে পরিণীত করা হয়নি; বরং খ্রিস্টের প্রতি বিশ্বাস রেখে যা খুশি তা করবার স্বাধীনতা তাকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি এটা তলিয়ে চিন্তাই করেননি যে, যে জিনিসটাকে ইসলাম বলা হয়, তা রয়েছে কুরআনে। আর কুরআন ঈমান ও সৎকাজ উভয়েরই সমাবেত নাম রেখেছে ইসলাম। পরন্তু সৎকাজের জন্যে সে স্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করেছে, বিধি ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছে এবং ব্যক্তিগত ও সামস্টিক জীবনের জন্যে একটি পরিপূর্ণ কর্মপদ্ধতি নির্দেশ করেছে। এমনি পদ্ধতি ছাড়া একটি দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) এবং একটি সভ্যতা হিসেবে ইসলাম কিছুতেই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনা। আর সে পদ্ধতি এবং সীমারেখাকে বিলোপ করার অধিকারও কোনো মুসলমানকে দেয়া হয়নি। কারণ তার বিলুপ্তি ইসলামের বিলুপ্তিরই নামান্তর মাত্র। আর ইসলামই যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় তো তার উন্নতির কি অর্থ থাকতে পারে? তিনি ইচ্ছা করলে নিজেই কোনো ধর্ম আবিস্কার করে তার প্রচার করতে পারেন, কিন্তু কুরআনের বিরুদ্ধ জিনিসকে ইসলামের নামে চালানো এবং তার উন্নতিকে “ইসলামের উন্নতি” আক্ষা দেয়ার তার কী অধিকার রয়েছে?
তিনি নিছক একটি বিশ্বাসকে ইসলাম বলতে চান; আর তাহলো এই যে, আমরা ইহজীবন ও পরজীবনে আমাদের কৃতকর্মের জন্যে দায়িত্বশীল। সম্ভবত একথাটি তিনি এই আশায় বলেছেন যে, আর দ্বারা ইসলাম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। তার প্রকৃতি সহজ ও মোলায়েম হয়ে যাবে এবং তা দ্রত প্রসার লাভ করতে থাকবে।
কিন্তু তিনি এই বিশ্বাসটির তাৎপর্য সম্পর্কে একটু তলিয়ে চিন্তা করলেই বুঝতে পারতেন যে, এভাবে সীমিত হবার পরও ইসলাম তাঁর মনোপুত হতে পারেনা। কারণ এই বিশ্বাসটিকে ধর্ম আখ্যা দিতে হলে সর্বপ্রথম পারলৌকিক জীবনের প্রতি ঈমান পোষণ আবশ্যক হয়ে পড়ে। পরন্তু জবাবদিহি বা দায়িত্ববোধ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। প্রথমত যার সামনে জবাবদিহি করতে হবে, তাঁর স্বরূপ নির্ণয় করা এবং তাঁর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়া। দ্বিতীয়ত, জবাবদিহির প্রকৃতি নির্ণয় করা এবং তদনুযায়ী বাস্তব জীবনে সফল ও ব্যর্থ কাজগুলোর মধ্যে পার্থক্য করে চলা। তৃতীয়ত, জবাবদিহির ব্যাপারে সাফল্য ও ব্যর্থতার পৃথক পৃথক ফলাফল নির্ণয় করা। কারণ ব্যর্থতা ও সাফল্য উভয়ের ফলাফল একরূপ হলে কিংবা আদৌ কোনো ফলাফল না থাকলে জবাবদিহিই সম্পূর্ণ নিরর্থক হয়ে পড়ে। লেখকপ্রবর যে বিশ্বাসটিকে “খাঁটি ধর্ম” আখ্যা দিতে চান, এ হচ্ছে তারই যুক্তিসঙ্গত দাবি। তাঁর প্রস্তাব আনুযায়ী এই বিশ্বাসটির উপর ইসলামকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়, তবু যে আপদ থেকে তিনি বাঁচতে চান তা এসে চেপে বসবেই। এর ফলে আবার সেই খোদাকে মানা আবশ্যক হয়ে পড়বে, যাকে বাদ দিয়েই জাপান উন্নতির শীর্ষদেশে আরোহণ করেছে বলে মনে হচ্ছে। আবার সেই শরয়ী বন্ধন ও নৈতিক শৃঙ্খল তৈরি হয়ে যাবে, যাকে তিনি ছিন্ন করতে চান এবং যার ভেতরে ইসলামের উন্নতি না করার গোপন রহস্যটি নিহিত রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। আবার সেই আযাব ও সওয়াব তথা শান্তি ও পুরস্কারের তর্ক আত্মপ্রকাশ করবে বং খোদার বেশুমার সৃষ্টিকে বিশ্বাস ছাড়াই সুখী সমৃদ্ধ দেখে তাঁর মন সায় দিতে অস্বীকার করবে যে, মাত্র কয়েক বছর পরই এরা আযাবের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে।
কাজেই তিনি একটু ভেবে চিন্তে বরং এমন একটা জিনিসের নাম ইসলাম রেখে দিন, যাতে কোনোরূপ বিধি নিষেদের বালাই থাকবেনা। যার প্রতি বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী উভয়েরই পরিনাম ফল একরূপ হবে। যাতে পারলৌকিক সাফল্যের জন্যে খোদার দুনিয়াটাকে সমৃদ্ধ সুবিন্যাস্ত করাই যথেষ্ট হবে এবং যার প্রতি অবিশ্বাসী বেশুমার সৃষ্টিকে সুখী সমৃদ্ধ দেখে তাঁর মন সায় দিতে পারবে যে, কয়েক বছর পরে এদের সবাইকে জান্নাতের বুলবুলে পরিণত করা হবে।
কুরআনের বিধানানুসারে শুকুরের মাংস চূড়ান্তভাবে হারাম হবার ব্যাপারটি লেখকের মনে সঠিক অ প্রামাণ্য নয়। তিনি সন্দেহ পোষণ করেছেন যে, হয়তো আরবদের জন্যে কোনো বিশেষ কারণে এটি হারাম করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই অভিমত প্রকাশ করার আগে কুরআন শরীফ খুলে একটু দেখে নিলেই তাঁর সন্দেহটা ঘুচে যেতো। কুরআনে স্পষ্টত বলা হয়েছেঃ
(আরবী)
অর্থঃ হে নবী! বলে দাওঃ আমার প্রতি যে ওহী নাযিল করা হয়েছে, তাতে কোনো ভোজনকারীর ভোজ্য জিনিসকে হারাম করা হয়নি, অবশ্য মৃতদেহ, প্রবাহিত রক্ত আর শুকুরের মাংস ছাড়া- কারণ এগুলো নিসন্দেহে অপবিত্র; কিংবা অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো নামে জবাই করা প্রানী ব্যতীত। অতপর যে ব্যক্তি নিরুপাই হয়ে পড়েছে (এবং এর কোনো জিনিস খেয়ে ফেলেছে) সে যদি আবাধ্যচারী অ সীমা লঙ্ঘনকারী না হয় তো তোমার প্রভু ক্ষমাশীল অ দয়াময়।“ ( সুরা আনয়ামঃ ১৪৫)
এই আয়াতে শুকুরের মাংস প্রত্যেক ‘ভজন’কারীর (আরবী) জন্যেই হারাম করে দেয়া হয়েছে। এর হারাম ঘোষণার জন্যেই এই কারণ দর্শানো হয়েছে যে, তা হচ্ছে ‘অপবিত্র’ (আরবী)। প্রশ্ন হলো, এখানে ভোজনকারী বলতে কি আরবের ভোজনকারীকে বুঝানো হয়েছে? তাছাড়া একই জিনিস কি আরবের জন্যে পবিত্র এবং অনারবের জন্যে অপবিত্র হতে পারে? এই সুত্র ধরেই কি লেখক মুর্দাখোরদের জন্যেও সুবিধা দেয়া পছন্দ করবেন। শুকুরের মাংসের বেলায় তিনি সুবিধা দিতে চাইলে নিজের পক্ষ থেকেই দিন। কিন্তু কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণার বিরুদ্ধে একথা বলার অধিকার তিনি কোথায় পেলেন যে, কুরআন দ্বারা এর চূড়ান্ত হারাম হবার ব্যাপারটা সন্দেহমুক্ত নয়।
আজকের নব্য মুজতাহিদরা ইজতিহাদের জন্যে এক অদ্ভুত নীতি আবিস্কার করেছেন। তাঁদের একটি বিশিষ্ট নীতি হচ্ছে এই যে, ইসলামের যে বিধানটির তারা বিরুদ্ধাচরন করতে চান, সে সম্পর্কে তারা নির্দ্বিধাই বলে দেন যে, এই বিশেষ ব্যবস্থাটি আরবদের জন্যে করা হয়েছিলো। এই বিশেষিতকরণ সম্পর্কে কুরআনে কোনো সামান্য ইঙ্গিত এবং এর স্বপক্ষে কোনো যুক্তি বা দৃষ্টান্ত না থাকলেও এ ধরনের উক্তি করতে তাঁরা মোটেই কুণ্ঠাবোধ করেননা। এমনিতর ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কুরানকেই একদিন তাঁরা আরবদের জন্যে নিদৃষ্ট করে দিতে চাইবেন।
পরন্তু (আরবী)( অবাধ্যচারী ও সীমা লঙ্ঘনকারী না হয়ে যে ব্যক্তি নিরুপাই হয়ে পড়ে)- এর সাহায্যে যুক্তি প্রদর্শন করাটা এমনি হাস্যকর যে, ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখকের জ্ঞান বুদ্ধির প্রশংসা করতে ইচ্ছে হয়। সম্ভবত আয়াতটির তিনি এই অর্থ গ্রহন করেছেন যে, ‘যখন শুকুরের মাংস খাবার স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছা জাগবে তখন খেয়ে নিও, কিন্তু বাগানে বসে খেয়োনা এবং তাঁর অভ্যাসও করোনা।‘
বস্তুত, এই আয়াত থেকে শুকুরের মাংসের ব্যাপারে ইউরোপীয় ও চীনাদেরকে সুবিধা দানের অবকাশ এমন ব্যক্তিই বের করতে পারে, যে নিরুপাই, অবাধ্য ও অভ্যস্ত- এর কোনো একটি শব্দেরই অর্থ বোঝেনা। নচেৎ যে ব্যক্তি এ শব্দগুলোরঅর্থ জানে, তার পক্ষে এতোখানি দুঃসাহস দেখানো সম্ভভপর নয়। প্রকৃতপক্ষে আয়াতটির অর্থ এ নয় যে, যারা মুর্দাভক্ষন বা রক্তপানে আসক্ত কিংবা যারা শুকুরের মাংসের জন্যে প্রাণপাত করে, অথবা যাদের মধ্যে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নামে জবাই করা প্রাণীর মাংস ভোজন সাধারণভাবে প্রচলিত, তারা সবাই উপায়হীনের অন্তর্ভুক্ত। এমনি হলে তো গোটা নিষেধাজ্ঞাটিই অর্থহীন হয়ে দাঁড়াতো। কারণ নিষেধাজ্ঞাটি যদি এই জিনিসগুলোর ভক্ষণকারীদের প্রতি প্রযোজ্য হতো তো তারা ব্যতিক্রম অবস্থার সুযোগ গ্রহন করে নিজেদের অভ্যাস অনুসারেই খেতে থাকতো কিংবা যারা নিজেরাই এই জিনিসগুলোর বর্জনকারী, নিষেধাজ্ঞাটি তাদের জন্যে হলেও এর কোনো প্রয়োজন ছিলোনা। প্রকৃতপক্ষে নিরুপাই (****) শব্দটির সঙ্গে ‘অবাধ্য ও সীমা লঙ্ঘনকারী ছাড়া’র শর্তারোপ করে এ ব্যতিক্রম সৃষ্টি করা হয়েছে, তার অর্থ এই যে, কোনো ব্যক্তি যদি ক্ষুধার জ্বালায় মারা যাবার উপক্রম এবং হারাম জিনিস ছাড়া অপর কোনো জিনিস সে সংগ্রহ করতে না পারে, তাহলে শুধু প্রাণ বাঁচানোর জন্যেই সে হারাম জিনিস খেতে পারে কিন্তু সে শর্ত এই যে, অনুমতির সীমা লংঘন করা যাবেনা। অর্থাৎ প্রাণ রক্ষার জন্যে যতোটুকু পরিমান অপরিহার্য, তার বেশি খাবেনা এবং আল্লাহ্র নির্ধারিত সীমা লংঘনের বাসনা মনে পোষণ করবেনা এ কথাটিই অন্যত্র শুকুরের মাংস, মৃতদেহ ইত্যাদির নিষিদ্ধকরণ প্রসঙ্গে আইভাবে বিবৃত হয়েছেঃ
(আরবী)
অর্থাৎ ক্ষুধার জ্বালায় কেউ নিরুপাই হয়ে পড়লে তার মনে যদি গুনাহর প্রতি আকর্ষণ না থাকে, তবে এমনি অবস্থায় সে হারাম জিনিস খেতে পারে।‘ কোথায় কুরআনের বিধান আর কোথায় ইউরোপ ও চীনাবাসীদের জন্যে লেখকের ওকালতি। ঐসকল দেশের অধিবাসীরা যেহেতু শুকুরের মাংসের জন্যে প্রাণপাত করে, এই কারণেই (আরবী) এর সুযোগে তাদের জন্যে শুকুরের মাংস জায়েয করতে হবে এবং তাও আবার তাদের ইসলামের দাখিল হবার জন্যে- কী উদ্ভট যুক্তি! এভাবে যদি প্রত্যেক জাতির আসক্তি ও আগ্রহের প্রতি লক্ষ্য রেখে ইসলামের বিধি ব্যবস্থায় সুবিধা দানের ধারা শুরু হয়ে যায়, তাহলে মদ, ব্যভিচার, সুদ এবং এ ধরনের তামাম নিষিদ্ধ বস্তুকেই একে একে হালাল করতে হবে। প্রশ্ন হলো এই যে, যারা আল্লাহর বিধানের অনুবর্তন করতে, তার নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চলতে এবং হারামকে হারাম ভাবতেই প্রস্তুত নয়, তাদেরকে ইসলামে দাখিল করাবার প্রয়োজনটা কী? ইসলাম কবে এ ধরনের লোকদের মুখাপেক্ষী ছিলো যে, এদেরকে সম্মত করাবার জন্যে দর কষাকষি করতে হবে?
প্রথমে শুধু শুকুরের মাংস হারাম হবার কারণটাই লেখকের বোধগম্য হয়নি। কিন্তু পরে কিছুটা চিন্তা ভাবনার পর তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, নীতিগতভাবে পাকস্থলী ও নৈতিক চেতনার মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। কাজেই তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, খাদ্যদ্রবের মধ্যে হালাল হারামের পার্থক্য নির্দেশ করার কোনো অধিকার ধর্মের নেই। তাঁর এই বক্তব্য থেকে এ রহস্যও উদঘাঁটিত হলো যে, কুরআন সম্পর্কে তিনি যা কিছু জানেন, জড় বিজ্ঞান (Physical Science) সম্পর্কে তার চাইতে বেশি মোটেই জানেননা। অবশ্য কুরআন সম্পর্কে না যানাটা একজন শিক্ষিত ও আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে তেমন কোনো লজ্জার ব্যাপার নয়, কিন্তু বিজ্ঞান সম্পর্কে এতোখানি অজ্ঞতা তো নিসন্দেহে এক বিরাট লজ্জাজনক ব্যাপার। এখন পর্যন্ত তিনি এই কথাটুকুই জানেননা যে, মানুষের আত্মার সঙ্গে তাঁর দৈহিক গঠনের এবং দৈহিক গঠনের সাথে খাদ্যের সম্পর্কটা কী? যে বস্তুটি দেহের ক্ষয়প্রাপ্ত উপাদান সরবরাহ করে, যাদ্বারা দেহের তামাম শিরা উপশিরা ও স্নায়ুমণ্ডলী গঠিত হয়, হৃদয় ও আত্মার ওপর তাঁর স্বভাবগত প্রভাব পড়াটা নয়; বরং না পড়াটাই বিস্ময়কর। এই সত্যের প্রতি বিজ্ঞান জগতও পূর্বে সাধারণভাবে উদাসীন ছিলো; কিন্তু খাদ্য বিজ্ঞান (Dietetics) সম্পর্কে ইদানিং যেসব গবেষণা হয়েছে, তার থেকে এই রহস্য প্রতিভাত হয়ে উঠেছে যে, মানুষের নৈতিক চরিত্র ও তার মানসিক শক্তির ওপর খাদ্য অবশ্যই প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তাই বিভিন্নরূপ খাদ্য আমাদের আত্মা ও চিন্তাশক্তির ওপর কি ধরনের প্রভাব বিস্তার করে, আধুনিক বিজ্ঞানীরা সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান চালাচ্ছেন। মনে হয় বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের গ্রাজুয়েট বন্ধুর জানাশোনা মোটেই অধুনাতম (Up-to- Date) নয়। নচেৎ এতোবড় ধৃষ্টতার সাথে তিনি এ দাবি করতে পারতেননা যে, নীতিগতভাবে পাকস্থলী ও নৈতিক চেতনার মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে।