ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (র)
১
মুসলমানদের মানসিক গোলামি ও তার কারণ
রাষ্ট্রশাসন, বাদশাহী এবং বিজয় ও আধিপত্য দু’প্রকারঃ প্রথমটি মানসিক ও নৈতিক আধিপত্য, আর দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক ও বস্তুগত। প্রথম শ্রেণীর আধিপত্য হলো, কোনো জাতি যখন চিন্তা, গবেষণা, আবিষ্কার ও মানসিক শক্তিতে বিপুলভাবে উন্নতি লাভ করে, তখন অন্যান্য জাতি স্বভাবতই তার চিন্তাদর্শের প্রতি ঈমান পোষণ করে। তার ধ্যান-ধারণা, ধর্মবিশ্বাস ও মতাদর্শ তাদের মন-মস্তিস্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলে; তারই ছাঁচে তাদের মানসিকতা গড়ে উঠে। তার সভ্যতাই তাদের আপন সভ্যতায় পরিণত হয়। তার জ্ঞান-বিজ্ঞানকেই তারা নিজস্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান বলে গ্রহণ করে নেয়। এমনকি, তার ভালোমন্দ ও সত্যাসত্যই তাদের কাছে ভালোমন্দ ও সত্যাসত্যের মানদণ্ড বলে বিবেচিত হয়। দ্বিতীয় প্রকার আধিপত্য হলো, কোনো জাতি যখন বস্তুগত সমৃদ্ধির দিক থেকে অতীব শক্তিশালী হয়, তখন তার মোকাবিলায় অন্যন্য জাতি নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে অক্ষম হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সামগ্রিকভাবে কিংবা আংশিকভাবে অন্যান্য জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর জেঁকে বসে।
পক্ষান্তরে গোলামি বা পরাধীনতাও দু’প্রকারঃ প্রথমটি মানসিক আর দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক। উপরে আধিপত্য প্রসঙ্গে দু’টো শ্রেণীর যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, গোলামির এ দু’টো শ্রেণী ঠিক তার বিপরীত।
এক হিসেবে আধিপত্যের এই দু’টো শ্রেণী সম্পূর্ণ আলাদা। কোথাও মানসিক প্রাধান্য বিস্তৃত হলে রাজনৈতিক আধিপত্যও প্রতিষ্ঠিত হবে, এমনটি অনিবার্য নয়। কিংবা রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে মানসিক প্রাধান্যও কায়েম হয়ে যাবে, এরও কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। তবে প্রকৃতির নিয়ম এই যে, কোনো জাতি চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা এবং জ্ঞান সাধনা ও তথ্যানুসন্ধানের পথে অগ্রসর হলে, মানসিক উন্নতির সাথে সাথে বৈষয়িক অগ্রগতিও সে অর্জন করে। পক্ষান্তরে কোনো জাতি চিন্তা ও জ্ঞান-গবেষণার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লে মানসিক অবনতির সাথে সাথে তার বৈষয়িক অধঃপতনও শুরু হয়ে যায়। পরন্তু আধিপত্য, শক্তিমত্তা আর পরাধীনতা দুর্বলতার পরিণতি বিধায় মানসিক ও বৈষয়িক দিক থেকে দুর্বল ও নির্বীর্য জাতিগুলো তাদের দুর্বলতা ও নির্বীর্যতার পথে যতো এগিয়ে চলে, সেই অনুপাতেই তারা গোলামি ও পরাধীনতার শিকার হতে থাকে; আর এই উভয় দিক থেকে শক্তিমান জাতিগুলো তাদের মন-মগজ ও দেহ-সত্তার ওপর কর্তৃত্বশীল হয়ে বসে।
আজকের দিনে মুসলমান এই দ্বিবিধ গোলামিরই শিকার। কোথাও উভয়বিধ গোলামি পুরোপরি বর্তমান, আবার কোথাও রাজনৈতিক গোলামি কিছুটা কম হলেও মানসিক গোলামি সমধিক। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমানে কোনো মুসলিম জনপদই সত্যিকারভাবে রাজনৈতিক ও মানসিক দিক দিয়ে পুরোপুরি স্বাধীন নয়। কোথাও তারা রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ভোগ করলেও নৈতিক ও মানসিক গোলামি থেকে আদৌ মুক্ত নয়। তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, হাট-বাজার, সভা-সমিতি, ঘরবাড়ি, এমনকি তাদের আপন দেহ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতি, চিন্তাধারা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান তাদের ওপর পুরোমাত্রায় কর্তৃত্বশীল। তারা পাশ্চাত্যের মগজ দিয়ে চিন্তা করে, পাশ্চাত্যের চোখ দিয়ে দেখে, পাশ্চাত্যের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে চলে। তারা উপলব্ধি করুক আর নাই করুক তাদের মগজের ওপর এই ধারনাই চেপে রয়েছে যে, পাশ্চাত্য যাকে সত্য মনে করে, তা-ই সত্য, আর সে যাকে মিথ্যা ঘোষণা করছে, তা-ই মিথ্যা। তাদের মতে সত্যতা, যথার্থতা, সভ্যতা, নৈতিকতা, ভদ্রতা, শালীনতা ইত্যাদি ব্যাপারে পাশ্চাত্যের নির্ধারিত মানদণ্ডই হচ্ছে একমাত্র নির্ভুল মানদণ্ড। এমনকি, নিজেদের দীন ও ঈমান, চিন্তাধারা ও ধ্যান-ধারণা, সভ্যতা ও শালীনতা, চরিত্র ও রীতিনীতি, সব কিছুই তারা ঐ মানদণ্ডে যাচাই করে। যে জিনিস এই মানদণ্ডে পুরোপুরি উত্তীর্ণ, তাকেই তারা যথার্থ বলে মনে করে; তার সম্পর্কে তারা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে যায় এবং জিনিসটি পাশ্চাত্য মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে বলে গর্ববোধ করে। আর যা কিছু এই মানদণ্ডের বিচারে উত্তীর্ণ নয়, তাকে তারা সচেতনভাবে হোক কি অচেতনভাবে ভ্রান্ত বলে মনে করে। কেউ তাকে প্রকাশ্যে বর্জন করে, কেউ মনে মনে বিরক্তি বোধ করে এবং কোনো রকম টেনে হিচড়ে তাকে পাশ্চাত্য মানদণ্ডে উতরিয়ে নেবার চেষ্টা করে।[গ্রন্থকার এ মন্তব্য করেছেন আজ থেকে ৪১ বছর আগে। এ দীর্ঘ সময়ে মুসলিম জাহানের রাজনৈতিক গোলামি কিছুটা শিথিল হয়েছে বটে, কিন্তু তাদের মানসিক গোলামি হ্রাস পায়নি এতোটুকুও।– সম্পাদক]আমাদের স্বাধীন জাতিগুলোর অবস্থাই যখন এই, তখন পাশ্চাত্য জাতিগুলোর অধীনস্থ মুসলমানদের মানসিক গোলামির কথা আলোচনা করে আর কি লাভ?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই গোলামির কারণ কি? এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে হলে একটি আলাদা গ্রন্থই রচনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তবে সংক্ষেপে বললে তা নিন্মরূপ দাঁড়ায়ঃ
মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাধান্যের ভিত্তি স্থাপিত হয় চিন্তা-গবেষণা ও জ্ঞান সাধনার ওপর। যে জাতি এ পথে অগ্রগামী, সে-ই দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসন অলঙ্কৃত করে; তার চিন্তাধারাই গোটা দুনিয়াকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। পক্ষান্তরে যে জাতি এক্ষেত্রে পেছনে পড়ে থাকে, তাকে স্বভাবতই অন্যের অনুবর্তী ও অনুসারী হয়ে থাকতে হয়। তার চিন্তাধারা ও মতাদর্শে লোকদের মস্তিষ্কেরওপর আধিপত্য বিস্তার করার মতো কোনো শক্তিই বাকী থাকেনা। জ্ঞানসাধক ও সত্যানুসন্ধিৎসু জাতির শক্তিশালী চিন্তা ও মতবিশ্বাসের বন্যা-প্রবাহ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবার মতো শক্তি-সামর্থ্য পর্যন্ত তার মধ্যে বর্তমান থাকেনা। মুসলমানরা যতোদিন সত্যানুসন্ধিৎসা ও জ্ঞান সাধনার পথে অগ্রসর ছিল, ততোদিন দুনিয়ার সকল জাতি তাদের অনুসরণ ও অনুবর্তন করে চলছে। ইসলামী চিন্তাধারা সমগ্র মানব জাতির চিন্তা-দর্শনকে আচ্ছন্ন করেছিল। ভালো-মন্দ, সুকৃতি-দুষ্কৃতি, ভ্রান্তি-অভ্রান্তি সম্পর্কে ইসলামের নির্ধারিত মানদণ্ড-সজ্ঞানে হোক আর অজ্ঞানে- সমগ্র দুনিয়ার কাছে একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। আর দুনিয়ার লোকেরা কি ইচ্ছায়, কি অনিচ্ছায়- তাদের চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ডকে সেই মানদণ্ডের আদলেই গড়ে তুলেছিল। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে চিন্তানায়ক ও গবেষকের আবির্ভাব যখন বন্ধ হয়ে গেলো, তারা ত্যাগ করলো চিন্তা-ভাবনা ও সত্যানুসন্ধিৎসা এবং জ্ঞান-সাধনা ও চিন্তা-গবেষণার ক্ষেত্রে ক্লান্ত হয়ে পড়লো, তখন তারা দুনিয়ার নেতৃত্ব থেকেই যেনো অবসর গ্রহণ করলো। অন্যদিকে পাশ্চাত্য জাতিগুলো এই সকল ক্ষেত্রেই দ্রুতবেগে এগিয়ে চললো। তারা চিন্তা-গবেষণার শক্তিকে কাজে লাগালো; বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য উদঘাটনে আত্মনিয়োগ করলো; প্রকৃতির অন্তর্নিহিত শক্তিগুলোর উৎস সন্ধান করলো। এর অনিবার্য পরিণতি যা হবার তা-ই হলো। পাশ্চাত্য জাতিগুলো দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসন দখল করে বসলো। এক সময় যেভাবে দুনিয়ার লোকেরা মুসলমানদের কর্তৃত্বের সামনে নতি স্বীকার করেছিলো, তেমনি তাদেরকেও পাশ্চাত্য জাতিগুলোর কর্তৃত্ব মেনে নিতে হলো। চার-পাঁচ শতক পর্যন্ত মুসলমানরা তাদের পূর্ব পুরুষদের বিছানো সুখশয্যায় অঘোরে ঘুমাচ্ছিল, আর পাশ্চাত্য জাতিগুলো ছিলো নিজেদের উন্নয়নের কাজে লিপ্ত। এরপর সহসা পাশ্চাত্য শক্তিগুলোর অভ্যুত্থান ঘটলো এবং মাত্র এক শতকের মধ্যেই তারা গোটা পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়লো। ঘুমের ঘোরে চোখ মেলে তাকিয়েই মুসলমানরা দেখতে পেলো, খ্রীস্টান ইউরোপ লেখনী ও তরবারি উভয় দিক থেকেই সুসজ্জিত; আর এই দ্বিবিধ শক্তির সাহায্যেই তারা গোটা দুনিয়ার ওপর কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। একটি ক্ষুদ্রাকৃতির দল এর মোকাবিলায় প্রতিরক্ষার চেষ্টা করলো; কিন্তু তার না ছিলো লেখনীর শক্তি, আর না ছিলো তরবারির তেজ। ফলে তারা শুধু পরাজয়ই বরণ করতে লাগল। জাতির বাকী অংশ অর্থাৎ সংখ্যাগুরু দলটি যে কর্মনীতি অবলম্বন করলো, দুর্বল ও কাপুরুষরা চিরকাল তা-ই করে থাকে। তরবারির তেজ, যুক্তির বল, বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য-প্রমাণের সমর্থন এবং চোখ ধাঁধানো রূপ-সৌন্দর্যসহ যে ধ্যান-ধারণা, মতাদর্শ ও রীতিনীতি পাশ্চাত্য থেকে এলো, আরামপ্রিয় মস্তিষ্ক ও পরাভূত মানসিকতা তাকে একেবারে ঈমানের মর্যাদা দিয়ে বসলো। যেসব পুরনো ধর্মবিশ্বাস, নৈতিক মূল্যবোধ ও সামাজিক আইন-কানুন নিছক গতানুগতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো, এই নতুন ও শক্তিশালী বন্যার স্রোতে তা খড়কূটোর মতো ভেসে গেলো। আর চেতনাহীনতার এ পথে লোকদের মন-মগজে এইধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, পাশ্চাত্য থেকে যা কিছু আসে তা-ই সত্য এবং তা-ই হছে সভ্যতা ও বিশুদ্ধতার একমাত্র মানদণ্ড।
পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে অন্য যেসব জাতির সংঘর্ষ হয়েছে, তাদের কারো কারো তো স্থায়ী ও স্বতন্ত্র কোনো সভ্যতাই বর্তমান ছিলোনা। কারো কারো কাছে একটা স্বতন্ত্র সভ্যতা ছিলো বটে, কিন্তু তা অন্য সভ্যতার মোকাবিলায় আপন স্বাতন্ত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখার মতো শক্তিশালী ছিলোনা। আবার কারো কারো সভ্যতার সাথে এই নবাগত সভ্যতার তেমন কোন মৌলিক পার্থক্যই ছিলোনা। ফলে এই সকল জাতি অতি সহজেই পাশ্চাত্য সভ্যতার রঙে রঙিন হয়ে গেলো এবং কোনো বড় রকম সংঘর্ষেরই প্রয়োজন দেখা দিলনা। কিন্তু মুসলমানদের ব্যাপারটা ছিলো তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এরা একটি স্থায়ী, স্বতন্ত্র ও পূর্নাঙ্গ সভ্যতার অধিকারী। এদের সভ্যতার একটি নিজস্ব ও পূর্নাঙ্গ নিয়ম-নীতি ও বিধি-ব্যবস্থা চিন্তা ও কর্ম উভয় দিক থেকেই জীবনের তামাম বিভাগের ওপর পরিব্যাপ্ত। পাশ্চাত্য সভ্যতার মূলনীতি ও ভিত্তি সম্পূর্ণ এই সভ্যতার পরিপন্থী। এ কারণেই প্রতি পদক্ষেপে এই দু’ সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দানা বেঁধে উঠেছে। আর এই সংঘাতের ফলে মুসলমানদের চিন্তা-বিশ্বাস ও বাস্তব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে।
যে দর্শন ও বিজ্ঞানের কোলে পাশ্চাত্য সভ্যতা লালিত হয়েছে, পাঁচ-ছয় শতক ধরে তা শুধু নাস্তিকতা, ধর্মদ্রোহিতা ও বস্তুবাদের পথেই এগিয়ে চলেছে। এই সভ্যতা যেদিন জন্মলাভ করেছে, ঠিক সেদিন থেকেই ধর্মের সাথে এর সংঘাত শুরু হয়েছে; বরং বলা যায়, ধর্মের বিরুদ্ধে যুক্তি ও বুদ্ধির সংঘাতই এই সভ্যতার জন্মদান করেছে। যদিও বিশ্বপ্রকৃতির নিদর্শনাদির পর্যবেক্ষণ, তার বিচিত্র রহস্যের উদ্ঘাটন, তার অন্তর্নিহিত নিয়ম-শৃঙ্খলার অন্বেষণ, তার বাহ্যিক দৃশ্যাবলী সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা এবং এগুলোর সমন্বয়ে অনুমান ও সাক্ষ্য-প্রমাণের সাহায্যে ফলাফল নির্ণয় ইত্যাদির কোনটাই ধর্মবিরুদ্ধ কাজ নয়, তবু ঘটনাচক্রে রেনেসাঁ আমলে ইউরোপে নয়া বৈজ্ঞানিক আন্দোলনের সূত্রপাত হতেই খ্রীস্টান পাদ্রীদের সঙ্গে তার তীব্র বিরোধ ও সংঘর্ষ দেখা দেয়। কারণ এই পাদ্রী সম্প্রদায় তাদের ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিকে প্রাচীন গ্রীক দর্শন ও বিজ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিলো। তারা এই আশা পোষণ করে রেখেছিল যে, আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধিৎসার ফলে এই ভিত্তিতে যদি সামান্যতম ফাটলও ধরে, তাহলে ধর্মের গোটা ইমারতই ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে। এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই তারা এই নয়া বৈজ্ঞানিক আন্দোলনের বিরোধিতায় লিপ্ত হলো এবং একে প্রতিরোধ করার জন্যে শক্তি পর্যন্ত প্রয়োগ করলো। প্রতিষ্ঠা করলো ধর্মীয় আদালত এবং এর মাধ্যমে এই আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও নিশানবাহীদের কঠোর, নির্মম ও ভয়ঙ্কর শাস্তি প্রদান করতে লাগলো। কিন্তু এ আন্দোলন ছিলো এক অপ্রতিরোধ্য মানস-চেতনার ফল; তাই নিপীড়ন ও নির্যাতনে নিস্তেজ হবার পরিবর্তে এটি আরো জোরদার হয়ে উঠল।
এমনকি, শেষ পর্যন্ত মুক্ত চিন্তার বন্যা-প্রবাহ ধর্মীয় কর্তৃত্বকে একেবারে খতম করে দিলো।
শুরুতেই এই লড়াইটা ছিলো মুক্ত চিন্তার অগ্রনায়ক ও পাদ্রীদের মধ্যে সীমিত। কিন্তু পাদ্রীরা যেহেতু ধর্মের নামে স্বাধীন চিন্তানায়কের সঙ্গে লড়াই করছিল, তাই খুব শীগ্গীরই এটি খ্রীস্টান ধর্ম ও মুক্ত চিন্তার ধারকদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে পরিণত হলো। অতপর ধর্ম বস্তুটাকেই (তা যে কোনো ধর্মই হোক না কেন) এই আন্দোলনের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে আখ্যা দেয়া হলো। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চিন্তা-ভাবনাকে ধর্মীয় চিন্তাপদ্ধতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হলো। যে ব্যক্তি বিশ্বপ্রকৃতির বিষয়াদি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পন্থায় চিন্তা-ভাবনা করবে, তার পক্ষে ধর্মীয় মতবাদ বর্জন করে নিজস্ব পথে চলা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হলো। বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে ধর্মীয় মতবাদের মূল ভিত্তি এই যে, এই বিশ্বজাহান থেকে ঊর্ধ্বতন এক শক্তিকে প্রাকৃতিক জগতের তামাম নিদর্শন ও দৃশ্যাবলীর কার্যকারণ বলে ঘোষণা করতে হবে। যেহেতু এটি ছিলো আধুনিক বৈজ্ঞানিক আন্দোলনের শত্রুদের মতবাদ, এজন্যই খোদা অথবা কোনো অতি-প্রাকৃতিক সত্তার ধারণা ছাড়াই বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য উদঘাটন করা এবং খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে প্রাকৃতিক বিষয়াদির ওপর দৃষ্টিক্ষেপণকারী প্রত্যেকটি পন্থাকেই অবৈজ্ঞানিক আখ্যা দেয়াকে এই নয়া আন্দোলনের নায়কগণ অনিবার্য মনে করলো। এইভাবে নব্যযুগের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকদের মধ্যে খোদা, আত্মা কিংবা আধ্যাত্ববাদ ও অতিপ্রকৃতিবাদের বিরুদ্ধে এক তীব্র বিদ্বেষের সঞ্চার হলো। অথচ এটা আদৌ বুদ্ধি ও যুক্তিবাদের স্বাভাবিক পরিণতি ছিলোনা; বরং এ ছিলো নিতান্তই ভাবাবেগের আতিশয্যের ফলমাত্র। তারা খোদার প্রতি এই জন্যে বিদ্বেষী ছিলোনা যে, তাঁর অনস্তিত্ব বা অনুপস্থিতি সাক্ষ্য-প্রমাণের দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছিলো; বরং তার প্রতি এই জন্যে বিরক্ত ছিলো যে, তিনি ছিলেন তাদের এবং তাদের মুক্ত চিন্তার শত্রুদের প্রভু (মা’বুদ)। পরবর্তী পাঁচ শতকে তাদের যুক্তি, বুদ্ধি ও চিন্তা এবং তাদের বৈজ্ঞানিক আন্দোলন যেটুকু কাজ করেছে, তার মূলে এই অযৌক্তিক ভাবাবেগই সক্রিয় ছিল।
পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞান যখন আসল যাত্রাপথে পদক্ষেপ করে, তখন তার লক্ষ্য ছিলো খোদাপরস্তির সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে নিবন্ধ। তবু ধর্মীয় পরিবেশে বেষ্টিত থাকার ফলে শুরুতে প্রকৃতিবাদকে খোদাপরস্তির সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে চলছিলো। কিন্তু যতোই সে নিজের লক্ষ্যপথে এগিয়ে চললো, খোদাপরস্তির ওপর ততোই প্রকৃতিবাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতে লাগলো। এমনকি, খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কিত ধারণা এবং তাঁর সঙ্গে প্রত্যেকটি অতি প্রাকৃতিক জিনিসের ধারণাই দার্শনিক-বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলো। তারা এমন চরম প্রান্তে গিয়ে পৌঁছলো যে, বস্তু ও গতি ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো জিনিসেরই অস্তিত্ব রইলোনা। তারা বিজ্ঞানকে প্রকৃতবাদেরই সমর্থক বলে ঘোষণা করলো। যে জিনিস মাপা বা ওজন করা যায়না, তার কোনো অস্তিত্বনেই, এই মতবাদের ওপর গোটা বিজ্ঞানী ও দার্শনিক সম্প্রদায় বিশ্বাস স্থাপন করে বসলো।
পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানের ইতিহাস একথারই সাক্ষ্য বহন করে। পাশ্চাত্য দর্শনের জনকরূপে পরিচিত ডেকার্টে (মৃত্যু ১৬৫০) একদিকে যেমনি খোদার অস্তিত্বে প্রগাঢ় বিশ্বাসী ছিলেন, অপরদিকে তেমনি বস্তুর সাথে আত্মার স্বতন্ত্র অস্তিত্বও স্বীকার করতেন। অন্যদিকে তিনিই আবার বিশ্ব-প্রকৃতির নিদর্শনাদির যান্ত্রিক বিশ্লেষণ পদ্ধতির সূচনা করেন। শুধু তাই নয়, তাঁর প্রবর্তিত চিন্তাপদ্ধতিই পরবর্তীকালে নিরেট বস্তুবাদে পরিণত হয়। হব্স (মৃত্যু ১৬৭৯) আর এক ধাপ সামনে এগিয়ে অতি-প্রকৃতিবাদের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন। তিনি বিশ্বপ্রকৃতি এবং এর প্রতিটি বস্তুকেই যান্ত্রিক বিশ্লেষণের উপযোগী বলে ঘোষণা করেন এবং এই জড়জগতের প্রভাবশীল যে কোনো আত্মিক বা অশরীরী শক্তির সম্ভাবনাকে অস্বীকার করেন; কিন্তু একই সাথে তিনি খোদার অস্তিত্বেও বিশ্বাস করেন। কারণ, বুদ্ধিবৃত্তির দৃষ্টিতে এমনি এক কার্যকারণ শক্তিকে স্বীকার করা আবশ্যক ছিলো। এ সময়েই সতের শতকের যুক্তিবাদের সবচেয়ে বড় অগ্রনায়ক স্পিনোজার (মৃত্যু ১৬৭৭) আবির্ভাব হয়। তিনি বস্তু, আত্মা এবং খোদার মধ্যে কোনো পার্থক্যই বাকী রাখলেন না। তিনি খোদা এবং বিশ্বপ্রকৃতিকে মিলিয়ে একটি অচ্ছেদ্য সত্ত্বা বানিয়ে দিলেন এবং খোদার সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে অস্বীকার করলেন। এদের উত্তরসূরী লিব্নিজ (মৃত্যু ১৭১৬) এবং লক্ (মৃত্যু ১৭০৪) খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু উভয়েরই মানসিক প্রবণতা ছিলো প্রকৃতিবাদের দিকে।
এইভাবে দেখা যায় যে, সতের শতকের দর্শনশাস্রে খোদাপরস্তি ও প্রকৃতিবাদ উভয়েই পাশাপাশি চলছিলো। অনুরূপভাবে বিজ্ঞানও সতের শতক পর্যন্ত পুরোপুরি জড়বাদে পরিণত হয়নি। কোপার্নিকাস, কেপলার, গ্যালিলও, নিউটন এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য অগ্রনায়কেদের কেউই খোদার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু এরা বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটনে খোদায়ী মতবাদ পরিহার করে যেসব শক্তি ওবিধি-বিধান এই ব্যবস্থাপনাটি পরিচালনা করছে, সেগুলো অন্বেষণ করার ইচ্ছুক ছিলেন। এই খোদায়ী মতবাদ পরিহার করাটাই ছিলো প্রকৃতপক্ষে নাস্তিকতা ও প্রকৃতিবাদের বীজ তুল্য। এই বীজই পরবর্তীকালে মুক্ত চিন্তার বৃক্ষহিসেবে বিকশিত হয়। কিন্তু সতের শতকের বিজ্ঞানীদের এ সম্পর্কে কোনো চেতনাই ছিলোনা। তাঁরা প্রকৃতিবাদ ও খোদাপরস্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য রেখা আঁক্তে পারেননি; বরং এই দু’টো মতবাদ পাশা-পাশি চলতে পারে বলে তাঁরা মনে করতেন।
অবশ্য আঠার শতকে এসে এ সত্য প্রতিভাত হলো যে, খোদার সত্তাকে অগ্রাহ্য করে যে চিন্তাপদ্ধতি বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য ও তার বিধি-বিধানের অনুসন্ধান করবে, তা কিছুতেই বস্তুবাদ, ধর্মহীনতা ও জড়বাদ পর্যন্ত না পৌঁছে পারেনা। এই শতকে জন টোলেন্ড, ডেভিড হার্টলে, জোসেফ প্রিস্টলি, ভলটেয়ার, লা-মেট্র, হোলবাক, কেবানিস, ডেনিস ডয়েড্রো, মন্টেস্কু, রুশো এবং এই ধরনের আরও কতিপয় স্বাধীন চিন্তাশীল দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর আবির্ভাব হয়। এরা হয় প্রকাশ্যে খোদার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন, নতুবা তার স্বীকৃতি দিলেও মর্যাদার দিক দিয়ে তাকে একজন নিয়মতান্ত্রিক সম্রাটের চেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করেননি। অর্থাৎ এদের স্বীকৃত খোদা বিশ্বপ্রকৃতিকে একবার গতিবান করে তার থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। এখন আর এই ব্যবস্থাপনার পরিচালনায় তার কোনো ভূমিকা নেই। এই শ্রেণীর দার্শনিক ও বিজ্ঞানী বিশ্বপ্রকৃতি, জড়জগত এবং গতি ছাড়া আর কোনো জিনিসেরই অস্তিত্ব স্বীকার করতেন না। এঁদের মতে যেসব জিনিস পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার আয়ত্বাধীন, কেবল তা-ই সত্য। হিউম তার অভিজ্ঞতাবাদ ও সংশয়বাদের সাহায্যে এই চিন্তা পদ্ধতি জোরালোভাবে সমর্থন করেন। এমনকি যুক্তিসিদ্ধ বিষয়াদির সভ্যতার জন্যেও তিনি অভিজ্ঞতাকেই চূড়ান্ত মানদণ্ড বলে ঘোষণা করেন। অবশ্য বার্কলি বস্তুবাদের এই ক্রমবর্ধমান বন্যা প্রবাহের গতিরোধ করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ অবধি তিনিও একে রোধ করতে সমর্থ হননি। অতপর হেগেল বস্তুবাদের স্থলে আদর্শবাদ প্রবর্তন করার প্রয়াস পান। কিন্তু নিরেট বস্তুর মোকাবিলায় সূক্ষ্ম আদর্শকে কেউ গ্রহণ করলোনা। কান্ট একটি মধ্যম পন্থা উদ্ভাবন করলেন। তিনি বললেন, ‘খোদার অস্তিত্ব, আত্মার স্থায়িত্ব, ইচ্ছার স্বাধীনতা ইত্যাদি আমাদের বোধগম্য জিনিস নয়, সুতরাং এগুলো মেনে চলা সম্ভব নয়; তবে এগুলোর প্রতি ঈমান পোষণ করা যেতে পারে। কারণ আমাদের বাস্তব বিচারবোধ এগুলোর প্রতি ঈমান পোষণেরই দাবী জানায়।’ এই ছিলো খোদাপরস্তি ও প্রকৃতিবাদের মধ্যে আপোষ সৃষ্টির সর্বশেষ প্রচেষ্টা। কিন্তু এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কেননা বুদ্ধি ও চিন্তার ভ্রান্তি খোদার অস্তিত্বকে নিছক কল্পনাপ্রসূত কিংবা বড়জোর একজন নিষ্ক্রিয় ও ক্ষমতাহীন সত্তা বলে ঘোষণা করার পর শুধু নৈতিকতার হেফাজতের জন্যে তাকে মানা, ভয় করা এবং তার সন্তুষ্টি কামনা করাটা ছিলো নিতান্তই এক অযৌক্তিক ব্যাপার।
ঊনিশ শতকে বস্তুবাদ তার উৎকর্ষের চরম শীর্ষে পৌঁছে। ভোগট, রুখ্নার, জোলবে, কোমে, মোল্শট এবং অন্যান্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিকগণ বস্তু এবং তার গুনাগুণ ছাড়া আর সব জিনিসের অস্তিত্বকেই বাতিল করে দেন। মিল দর্শনশাস্রে অভিজ্ঞতাবাদ এবং নীতিশাস্রে উপযোগবাদের প্রবর্তন করেন। অতপর স্পেনসার দার্শনিক বিবর্তনবাদ, বিশ্বপ্রকৃতির স্বাভাবিক সৃষ্টি এবং জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত উন্মেষের ধারণাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে প্রচার করেন। পরন্তু জীবতত্ত্ব, শরীরতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব এবং প্রাণীতত্ত্বের আবিষ্কার উদ্ভাবনী, ফলিত বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ এবং বৈষয়িক উপকরণের প্রাচুর্য লোকদের মনে এই ধারণা গভীরভাবে বদ্ধমূল করে দিলো যে, বিশ্বপ্রকৃতি আপনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে; কেউ একে সৃষ্টি করেনি; তা নিজে নিজেই এক বাঁধাধরা নিয়মে চালিত হচ্ছে, এর কোনো সুনির্দিষ্ট চালক নেই; আপনা আপনিই এ বিবর্তন ও উৎকর্ষের পর্যায়গুলো অতিক্রম করে চলছে, এই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ওপর অপর কোনো অতি-প্রাকৃতিক সত্তার প্রভাব নেই। নিষ্প্রাণ বস্তুর ভেতরে কারো নির্দেশে প্রাণের সঞ্চার হয়না; বরং বস্তু তার নিজস্ব ধারায় বিবর্তিত হতে থাকলেই প্রাণের সঞ্চার হয়। বিবর্তন, ইচ্ছাশক্তি, অনুভূতি, চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তি ইত্যাদি হচ্ছে এই বিবর্তিত বস্তুরই গুনগত বিশেষত্ব। মানুষ, পশু সবাই হচ্ছে যন্ত্র মাত্র; স্বাভাবিক নিয়মেই এরা চালিত হচ্ছে। এদের কলকব্জাগুলো যেভাবে বিন্যাস্ত হয়, তেমনি ধরনের কাজই এরা সম্পাদন করে থাকে। এদের ভেতরে কোন ইখতিয়ার বা ‘স্বাধীন ইচ্ছার’ অস্তিত্ব নেই। এদের নিয়ম-শৃঙ্খলার বিচ্যুতি ঘটলে এবং প্রাণশক্তি ফুরিয়ে গেলেই মৃত্যু হয়। এ মৃত্যু হচ্ছে স্বাভাবিক বিলুপ্তিরই নামান্তর মাত্র। অন্যকথায় যন্ত্র যখন ভেঙ্গেচুরে গিয়েছে, তখন তার গুন-বৈশিষ্ট্যও বিলীন হয়ে গিয়েছে। এখন আর তার হাশর বা পুনর্জীবন লাভের কোনোই সম্ভাবনা নেই।
এই প্রকৃতিবাদ ও বস্তুবাদকে স্থিতিশীল করে তোলা এবং একটা প্রামাণ্য ও সুসংবদ্ধ মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে ডারউইনের বিবর্তনবাদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর লিখিত ‘প্রজাতির উৎস’ (Origin of Species) নামক গ্রন্থটি ঈসায়ী ১৫৮৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি বিজ্ঞান জগতে একটি প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থরূপে বিবেচিত হয়। এই গ্রন্থে যে যুক্তিধারা সন্নিবেশিত হয়, ঊনিশ শতকের বিজ্ঞানীদের কাছে তা ছিলো যুক্তির সর্বোত্তম পদ্ধতি। সে যুক্তিধারা থেকে এই মতবাদ আরো বলিষ্ঠরূপে সমর্থিত হয় যে, বিশ্বপ্রকৃতির তামাম ক্রিয়াকলাপ খোদার অস্তিত্ব ছাড়াই চলতে পারে। প্রকৃতির নিদর্শন ও দৃশ্যাবলীর জন্যে তার নিজস্ব নিয়ম-কানুন ছাড়া আর কোনো কার্যকারণের প্রয়োজন নেই। জীবনের নগণ্য স্তর থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত সকল বস্তুরই বিকাশ ও বিবর্তন হচ্ছে এ যুক্তি ও বিচার বুদ্ধিহীন প্রকৃতির অনুক্রমিক ক্রিয়ার নিছক পরিণতি। মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুকে কোনো বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ সত্তা সৃষ্টি করেননি; বরং যে প্রানবস্তু যন্ত্রটি একদিন কীটরূপে বিচরণ করতো, তা-ই শেষে বাঁচার লড়াই, যোগ্যতমের ঊদ্বর্তন এবং প্রকৃতির নির্বাচনে ইচ্ছা, অনুভূতি বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষরূপে আত্ম-প্রকাশ করে।
এই দর্শন থেকেই পাশ্চাত্য কৃষ্টি ও সভ্যতা জন্মলাভ করে। এতে না আছে কোনো বিচক্ষণ ও ক্ষমতাবান খোদার ভয়ের স্থান; আর না আছে নবুয়্যত, প্রাত্যাদেশ (ওহী) ও ইল্হামের কোনো গুরুত্ব। এর ভেতরে মৃত্যুর পর অপর কোনো জীবনের ধারণা, ইহজীবনের কৃতকর্ম সম্পর্কে জবাবদিহির চিন্তা, মানুষের ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের প্রশ্ন, জীবনের জৈবিক উদ্দেশ্যের চেয়ে উচ্চতর কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সম্ভবনা ইত্যাদির কোনোই অবকাশ নেই। এ হচ্ছে নিরেট বস্তুবাদী সভ্যতা। এর গোটা অবয়বই খোদাভীতি, সরলতা, সত্যবাদিতা, সত্যানুসন্ধিৎসা, সচ্চরিত্র, দায়িত্বজ্ঞান, বিশ্বস্ততা, সৎকর্মশীলতা, লজ্জাশীলতা, পরহেযগারী ও পবিত্রতার ধারণা থেকে মুক্ত। পক্ষান্তরে এই সকল ধারণার ওপরই ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত। ফলকথা, পাশ্চাত্যের গোটা মতাদর্শ ইসলামী মতাদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তার পথ ইসলামের অনুসৃত পথের সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলাম যে জিনিসগুলোর ওপর মানবীয় আচরণ ও তমদ্দুনের ভিত্তি স্থাপন করে, এ সভ্যতা চায় সেগুলোর মূলোৎপাটন করতে। পক্ষান্তরে এই সভ্যতা যে ভিত্তিগুলোর ওপর মানুষের ব্যক্তি চরিত্র ও সমাজ পদ্ধতির ইমারত গড়ে তুলতে চায়, তার উপর ইসলামের ইমারত এক মুহূর্তের জন্যেও টিকে থাকতে পারেনা। মোটকথা, ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতা হছে দুই বিপরীত লক্ষ্যগামী তরুণীর মতো। যে ব্যক্তি এর কোন একটিতে আরোহণ করবে, তাকে অন্যটি ত্যাগ করতেই হবে। আর যে একই সাথে উভয়টিতে আরোহণ করবে, সে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে।
দুর্ভাগ্যবশত যে শতকে এই নয়া সভ্যতা তার বস্তুতান্ত্রিকতা, ধর্মদ্রোহিতা ও নাস্তিকতার চরম প্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়, ঠিক সেই শতকেই মরক্কো থেকে দূরপ্রাচ্য পর্যন্ত গোটা মুসলিম জাহান পাশ্চাত্য জাতিগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতা ও শাসনতান্ত্রিক প্রাধান্যের অক্টোপাসে বন্দী হয়ে পড়ে। ফলে মুসলমানদের ওপর পাশ্চাত্যের তরবারি ও লেখনীর হামলা এক সাথেই চালিত হয়। যাদের মন-মগজ পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের রাজনৈতিক প্রাধান্যে বশীভূত ও ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো, তাদের পক্ষে পাশ্চাত্যের দর্শন, বিজ্ঞান ও তার উদ্ভাবিত কৃষ্টি-সভ্যতার জাঁকজমক থেকে আত্মরক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়লো। বিশেষ করে, যেসব মুসলিম জনপদ সরাসরি কোনো পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যের শাসনাধীন হয়ে পড়েছিলো, তাদের অবস্থা ছিলো আরো বেশি নাজুক। তাদেরকে পার্থিব আত্মস্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে বাধ্য হয়ে পাশ্চাত্য জ্ঞান অর্জন করতে হলো আর এই জ্ঞান অর্জন যেহেতু নিছক জ্ঞান অর্জনই ছিলোনা বরং ছিলো ‘এক পরাভূত মানসিকতা নিয়ে পাশ্চাত্য গুরুদের সামনে নতজানু হয়ে বসা’, এই জন্যে মুসলমানদের নতূন প্রজন্ম গভীরভাবে পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও বৈজ্ঞানিক মতবাদের প্রভাবে প্রভাবিত হলো; তাদের দৃষ্টিভঙ্গী ও মানসিকতা পাশ্চাত্য ছাঁচে গড়ে উঠতে লাগলো; তাদের হৃদয়-মন পাশ্চাত্য সভ্যতার বশ্যতা স্বীকার করে নিলো। তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ পরখ করা এবং নিরেট ভালটিকে গ্রহণ করার মতো বিচারবোধ ও অনুসন্ধিৎসারই সৃষ্টি হলোনা! তাদের মধ্যে স্বাধীনভাবে চিন্তা-ভাবনা করার এবং ব্যক্তিগত বিচার-বুদ্ধির সাহায্যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মত যোগ্যতাই সৃষ্টি হতে পারলোনা। এরই ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইসলামী সভ্যতা ও কৃষ্টির গোটা ভিত্তিমূলই আজ নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। ইসলামী পদ্ধতিতে চিন্তা-ভাবনা করার মতো মানসিক কাঠামোই বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে। বস্তুত যারা পাশ্চাত্য পন্থায় চিন্তা-ভাবনা করে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার মূলনীতির প্রতি আস্থা পোষণ করে, তাদের মানসিক গড়নটাই হচ্ছে অদ্ভুত প্রকৃতির। সে মানসিকতার সাথে ইসলামের নীতি কিছুতেই খাপ খেতে পারেনা। আর মূলনীতিই যখন খাপ খায়না, তখন খুঁটিনাটি ও ছোটখাটো ব্যাপারে নানারূপ সন্দেহ ও নিত্য নতুন সংশয়ের উদ্রেক হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
এটা নিঃসন্দেহ যে, মুসলমানদের অধিকাংশ এখনো ইসলামের সভ্যতার প্রতি ঈমান পোষণ করে এবং মুসলমান হিসেবেই তারা বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু পাশ্চাত্য চিন্তা ও সভ্যতার প্রভাবে তাদের মন-মগজ ইসলামের প্রতি ক্রমশ বিমুখ হতে চলেছে এবং এই বিমুখতা দিনদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রাধান্য ও প্রভুত্বের কথা বাদ দিলেও পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রভাব প্রতিপত্তি দুনিয়াব্যাপী সবার মন মানসকে আচ্ছন্ন করে নিয়েছে। এর ফলে লোকদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে গেছে, কারো পক্ষে মুসলমানী দৃষ্টিতে দেখা এবং ইসলামী ধারায় চিন্তা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই যতোক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তানায়কের আবির্ভাব না ঘটবে, ততোক্ষণ এই নতজানু অবস্থার অবসান হবেনা। বস্তুত আজ ইসলামের এক নবজাগরণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। প্রাচীন ইসলামী চিন্তানায়ক ও তথ্যানুসন্ধানীদের রক্ষিত জ্ঞানসম্পদ আজকের দিনে ফলপ্রসূ হতে পারেনা; কেননা দুনিয়া আজ অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। ছয়’শ বছর আগে দুনিয়া যেসব পর্যায় অতিক্রম করে এসেছে, আজ তাকে আবার পেছনদিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আজকে যে দুনিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে, জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে সে-ই নেতৃত্বদানে সক্ষম হবে।
কাজেই আজকে আবার ইসলামকে দুনিয়ার নেতৃত্বের আসন অলংকৃত করতে হলে তার একমাত্র উপায় হচ্ছে মুসলিম সমাজে এমন চিন্তাবিদ ও তথ্যানুসন্ধানীর আবির্ভাব হতে হবে, যাঁরা চিন্তা-গবেষণা ও অনুসন্ধান অনুশীলনের সাহায্যে পাশ্চাত্য সভ্যতার গোটা ভিত্তিমূলকেই ধসিয়ে দিতে পারবেন। কুরআনের নির্দেশিত চিন্তা-গবেষণার পদ্ধতিতে যারা প্রাকৃতিক নিদর্শনাদির পর্যবেক্ষণ এবং তার রহস্যাবলীর অনুসন্ধান করে খালেস ইসলামী চিন্তাধারার ভিত্তিতে নতুন দর্শন শাস্রের ভিত্তি রচনা করবেন। যাঁরা কুরআনের অঙ্কিত রূপরেখার ভিত্তিতে এক নয়া প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ইমারত গড়ে তুলবেন। খোদাবিমুখ মতবাদকে বাতিল করে যাঁরা খোদায়ী মতবাদের ওপর চিন্তা ও গবেষণার ভিত্তি স্থাপন করবেন। সর্বোপরি এই আধুনিক চিন্তা ও গবেষণার ইমারতকে তারা এমনি সুদৃঢ়ভাবে গড়ে তুলবেন যে, তা গোটা দুনিয়াকেই আছন্ন করে ফেলবে এবং দুনিয়ার সর্বত্র পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতার বদলে ইসলামের সত্য ও সুবিচার ভিত্তিক সভ্যতা উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
উপরে যা কিছু আলোচিত হলো, তার সারমর্মকে একটি উপমার সাহায্যে এভাবে পেশ করা যেতে পারেঃ দুনিয়াটা যেনো একটি রেলগাড়ী। একে চালিত করছে চিন্তা-গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধানের ইঞ্জিন। আর চিন্তাবিদ ও তথ্যানুসন্ধানীরা হচ্ছে এই ইঞ্জিনের ড্রাইভার। তাঁরা এই গাড়ীকে যেদিকে চালিত করেন, সেদিকেই সে ধাবিত হয়। যারা গাড়ীর আরোহী, তারা ইচ্ছায় হোক কি অনিচ্ছায়- তার গতিপানেই যেতে বাধ্য। যদি গাড়ীর কোনো যাত্রী তার গতিপানে যেতে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে সে চলন্ত গাড়ীর মধ্যে বসে নিজের আসনটিকে এদিক-ওদিক ঘুরানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনা। কিন্তু আসনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেই তাতে নিজের গতিমুখ বদলে যায়না; তা করতে হলে গাড়ীয়ে ইঞ্জিন দখল করে তার গতিকে নিজের ঈস্পিত পথে ঘুরিয়ে দিতে হবে। একমাত্র এভাবেই নিজের গতিমুখ বদলানো যেতে পারে।
বর্তমানে এই ইঞ্জিনটি যাদের করায়ত্ত, তারা সবাই আল্লাহবিমুখ এবং ইসলামী চিন্তাধারা সম্পর্কে নিদারুণ অজ্ঞও। এ জন্যেই গাড়ীটি তার যাত্রীদের নিয়ে ধর্মদ্রোহীতা ও বস্তুতান্ত্রিকতার পথে দ্রুত ছুটে চলছে। ফলে সমস্ত যাত্রীই ইসলামের লক্ষ্যস্থল থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। তাই গাড়ীর এই গতিধারাকে বদলাতে হলে আজ থেকে ইঞ্জিন করায়ত্বের চেষ্টা করতে হবে। এই কাজটি যে পর্যন্ত না হবে, সে পর্যন্ত গাড়ীর গতি কিছুতেই বদলানো যাবেনা; বরং আমাদের শত আপত্তি-বিরক্তি ও চিৎকার সত্ত্বেও গাড়ী আল্লাহদ্রোহী ড্রাইভারদের নির্দেশিত পথেই চলতে থাকবে। (তরজামানুল কুরআনঃ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ ইং)