“পাঞ্জাব সরকারের প্রদর্শনে পাটনার ম্যাজিস্ট্রেট মওলবী আহমদউল্লাহর খানসামা হোসেন আলী খানের বাড়ি তল্লাশি করেনঃ কারণ এরকম সন্দেহ হয় যে, চিঠিপত্র সেখান দিয়েই আদান- প্রদান হতো। এ খবর পাওয়া যায় একজন দেশীয় ডাক্তার বা হেকিমের মারফত। তখন পাটনার ষড়যন্ত্রকারীরা সাবধান হয়ে যায় এবং বাড়ীর সব চিঠিপত্র নষ্ট করে দেয়। যাহোক, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব রিপোর্ট পাঠান, ওহাবী সম্প্রদায় তখন বেড়েই চলেছে এবং জেহাদ প্রচার করা হয় মওলবী বেলায়েত আলী, মলিবি আহমদউল্লাহ ও তার পিতা ইলাহী বংশের বাড়ীতে। তিনি আরও রিপোর্ট পাঠান যে, স্থানীয় অহাবীদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে পুলিশের, আর তার দরুন ওহাবীদের গতিবিধি সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য সংবাদ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি মওলবী আহমদউল্লাহ ছয়- সাতশো সশস্ত্র লোক তার বাড়ীতে জমায়েত রেখেছিলেন। এবং দরকার হলে এ সম্বন্ধে ম্যাজিস্ট্রেটের আরও তদন্ত প্রচেষ্টায় বাহুবলে বাধা দিতে ও বিদ্রোহের নিশান তুলতে প্রস্তুত ছিলেন।
“বিষয়টি তদানীন্তন বড়লাট বাহাদুর লর্ড ডালহৌসির নিকট পেশ করা হল ১৮৫২ সালের ২০শে আগস্ট। তিনি তখন বিষয়টিতে এই মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন যে, পাটনা ও সীমান্তের মধ্যে বিদ্রোহাত্মক চিঠিপত্র আদান- প্রদান সম্বন্ধে সরকার ওইয়াকিফহাল এবং তিনি এ নির্দেশ দেন যে, পাটনার বিদ্রোহীদের উপর যেন কড়া নজর রাখা হয়।
“১৮৫২ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর কাউন্সিলর বৈঠকে আরেকটি মন্তব্য লিপিবদ্ধ হয় এই চিঠিপত্র সম্বন্ধে পাঞ্জাব সরকারের চিঠির উল্লেখ করে, এবং সীমান্তের আদি জাতিদের সঙ্গে যুদ্ধাভিযানের প্রজোনীয়তা বিষয়ে; কারণ বাঙালি হিন্দুস্থানি ধর্মান্ধরা তখন তাদের ক্ষেপীয়ে তুলেছিল। একটা ফৌজদারি মামলা হয় চতুর্থ দেশীয় পদাতিক বাহিনীর মুনশী মুহম্মদ ওয়ালীর বিরুদ্ধে রাওয়ালপিন্ডীতে এবং বিচারে তিনি ১৮৫৩ সালের ১২ই মে দন্ডিত হন। তখন মওলবী আহমদউল্লাহ ও পাটনার বহু আদিবাসীদের নাম সাক্ষে উঠে যে, তার সীমান্তের ধর্মান্ধদের নিকট রসদ সরবরাহ করেন।
“বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, সরকার তখন কঠিন নীতি অবলম্বন করেননি এবং পাটনার ষড়যন্ত্র ভেঙ্গে ফেলেনি। তাহলে রাজদ্রোহের দমন হয়ে যেতো। আম্বালা অভিযানে কোনও সৈন্যক্ষয় হতোনা এবং সরকারী কর্মচারীরাও বহু পরিশ্রম ও অহেতুক ভর্তসনা থেকে বেঁচে যেত। কারণ ১৮৬২ সালের রাজদ্রোহী আহমদউল্লাহ হচ্ছেন ১৮৫৭ সালের সামান্য পুস্তক বিক্রেতা ‘ওহাবী ভদ্রলোক’।
এদিকে ইনায়েত আলী উত্তর- পশ্চিমে নিশ্চেষ্ট থাকেননি। পাঠান অধিবাসীদের সাহায্য লাভের জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন এবং সোয়াতের আখুন্দ ও সিত্তানায় সৈয়দ সাহেবের সহানুভূতি লাভেও সক্ষম হয়েছিলেন। এমন সময় অবস্থাগতিকে তাকে অসময়ে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হতে হয়। সিত্তানার অদূরে সিন্ধুনদির দক্ষিণ তীরে আম্বের করদরাজ্য অবস্থিত। সমতল ভূমি ও সিত্তানা থেকে সেখানে সহজেই যাওয়া যাই এবং বিলায়েত আলীর জীবদ্দশায় নও- মুজাহিদদের কাফেলা আম্বের ভিতর দিয়ে সিত্তানায় যাতায়াত করতো। কিন্তু ইনায়েত আলী যখন আদিবাসীদের জেহাদের পক্ষে একত্রিত করেন, তখন আম্বের শাসক জাহাদাদ খান এই উদ্যমে যোগ দিতে অস্বীকার করলেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মিলিত হয়ে মুজাহিদদের তার এলাকার ভিতর দিয়ে পথ দিতে অস্বীকার করলেন। ১৮৫২ সালের প্রথম ভাগে জেহাদিদের একটা কাফেলা জোর করে আম্বের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করতে চেষ্টা করলে তাদের লুট কড়া হয়। ছিন্নবেশে ও অনাহারে তারা সিত্তানায় তারা উপস্থিত হল। ইনায়েত আলী এতে অপমান বোধ করেন এবং সোয়াতের আখুন্দের ও সিত্তানায় সৈয়দদের সাহায্য দাবী করলেন। ওহাবীরা ছোট বড় যে কাজই করুক, ধর্মের নামে করে থাকে। মওলবীদের একটা মজলিস ডাকা হয়। জাহাদাদ খান কাফের বিবেচিত হন ও তাকে জেহাদ করে উৎখাত করা পুন্যের কাজ হিসেবে ফতওয়া জারী করা হল। আখুন্দ সাহেব সাহায্য নিয়ে অগ্রসর হওয়ার উৎসাহ দেওয়ায় ইনায়েত আলী পার্বত্য অঞ্চল থেকে নীচে আম্বের দিকে অগ্রসর হলেন এবং বিনা বাধায় আসুরা নামক গ্রামটি দখল করে নিলেন। তারপর তিনি আসুরা ও আম্বের মধ্যবর্তী নিম্ন গিরিমালা অতিক্রম করলেন। জাহাদাদের সৈন্যদের কিল্লাহর মধ্যে বিতাড়িত করলেন এবং উপত্যকাটি দখল করে অবরুদ্ধ লোকদের সব যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দিলেন। তারা আর প্রতিরোধ করা অনর্থক দেখে একখানা কুরআন নিশান হিসেবে উর্ধে করে সন্ধি প্রার্থনা করলো। কিছু দেরি করে জাহাদাদ খান ইনায়েত আলীর মুরিদ হতে ও তার অধীনে রাজ্য শাসন করতে রাজি হলেন এই শর্তে যে, আক্রমক- বাহিনী উপত্যকা থেকে সরে যাবে এবং সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত না হওয়া পর্যন্ত আসুরার অপেক্ষা করবে। কূটনীতিতে বাঙালি পাঠানের মতো ধুরন্দর ছিলেননা। জাহাদাদ খান কালক্ষেপণের দুরভিসন্ধিতে বশ্যতা স্বীকারের ভান করেছিলেন মাত্র। তিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার সংবাদ পাওয়া মাত্র একজন দূত পাঠিয়েছিলেন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করে। এখন সাহায্য না আসা পর্যন্ত সন্ধির শর্তবিষয়ে টালবাহানায় সময় কাটাতে লাগলেন। তিনি দুদিন ধরে ওহাবীদের এটা সেটা কুচকাওয়াজে ব্যাস্ত রাখলেন, কিন্তু তৃতীয় দিন সকাল বেলায় দেখা গেলো যে, আসুরার উল্টা দিকে পূর্ব তীরে ব্রিটিশ বাহিনী শ্রেণীবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে আছে। তারা দ্রুত গতিতে নদি পার হল এবং আসুরা ও সিত্তানার মধ্যবর্তী গিরিপর্বতটি দখল করে ওহাবীদের কিল্লাহ থেকে বিছিন্ন করার চেষ্টা করলো। এদিকে জাহাদাদ মুখোশ খুলে ফেলে উত্তর দিকে নিম্নে অগ্রসর হয়ে আম্বের পথপার্সের পাহাড়ে ছাউনি ফেলে সেদিকে ওহাবীদের গতিবিধি একেবারে বন্ধ করে দিলেন। ধর্মান্ধরা সমূহ বিপদ দেখে সিত্তানার দিকে পলায়ন করলেন, আর তখন তাদের বাহিনী ও ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে এক উত্তেজনাময় দৌড় শুরু হলে, কে আগে গিরিপর্বতটি দখল করবে। ওহাবোরাই সেখানে প্রথমে পৌছাতে সমর্থ হল এবং ইনায়েত আলীর অধীনে ওহাবীদের প্রধান বাহিনী পলায়ন করতে সক্ষম হল। কিন্তু দিনাজপুরের করম আলীর চালনায় পশ্চাদরক্ষী দল একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলো।
ওহাবীদের এই পরাজয়ে ইনায়েত আলী সাবধান হয়ে গেলেন এবং পরবর্তী কয়েক বছর সীমান্তে আর গোলযোগ হয়নি। তিনি ভ্রাতার মতো বুদ্ধিমানের নীতিই অবলম্বন করলেন এবং অনুচরদের সংঘবদ্ধ করতে এবং কাফের ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘৃণার জ্বলে উঠে দারুণ পরিশ্রম করতে লাগলেন। জেহাদিদের দৈনিক দুবেলা করে ড্রিল করান হতো এবং প্যারাডের মতো তাদের জেহাদের মহিমা কীর্তন করে গান করান হতো। আর শুক্রবার নামাজের পর তাদের শ্রবন করান হতো বেহেশতে তাদের জন্য কত সুখ মজুদ আছে। আরও বলা হতো ব্রিটিশ ভারত সরকারের নির্দিষ্ট সময় সমাগত হওয়া পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করতে বলল।
নীচে উদ্ধৃত সঙ্গীতটাই বোধ হয় ওহাবীদের সবচেয়ে প্রিয় ও অতিপুরাতন ছিল। এটাকে বলা হতো ‘রিসালা- ই- জিহাদ’ বা যুদ্ধ সঙ্গীতঃ
প্রথমে আল্লাহ্র মহিমা গায়, তিনি সব প্রশংসার উর্ধে,
আমি রসূলের প্রশংসা করি ও জেহাদের গান গায়।
জেহাদ ধর্মের যুদ্ধ, তাতে ক্ষমতার লালসা নাই,
হাদিস ও কুরআনে তার মহিমা ঘোষিত। আমি কিছু বলছি শুন,
পায়ে যার জেহাদের ধুলি আছে, দোজখে তার শাস্তি নাই,
যে এক মুহূর্তও আল্লাহ্ থেকে সরে যায়, বেহেশতে তার স্থান নাই।
রসূলের বাণী এই হাদিসটি শুন-
‘তরবারির ছায়ায় বেহেশত রয়েছে।
যে প্রসান্ত চিত্তে জেহাদে এক পয়সাও খরচ করে,
অতঃপর সে তার সাতশো গুন বদলা পাবে।
আর যে জেহাদে দান করে ও নিজেও শরীক হয়
আল্লাহ্ তাকে সাত হাজার গুন বদলা দিবেন।
আল্লাহ্র রাহে যে একজন মুজাহিদকে সজ্জিত করে,
সে নিশ্চয়ই শহীদের পুরষ্কার লাভ করে।
যে জেহাদে সাহায্য করেনা, কিংবা শরীক হয়না,
এই দুনিয়াতেই তার কঠিন শাস্তি অবধারিত।
জেহাদে যে নিহত হয়, সে মরণ তো মরণ নয়,
সে হাসতে হাসতে বেহেশতে চলে যাবে।
কেন তুমি আল্লাহ্র পথে জীবন বিলিয়ে দিচ্ছনা?
আল্লাহ্র হুকুম, শহীদের সব ছেলেই মাফ পেয়ে যাবে।
তাদের গর- আযাব মাফ হয়ে যায়, রোজ- কেয়ামত বা রোজ হাশরে তাদের ভয় নেই।
আল্লাহ্ ভালোবাসেন শুধু তাদের, যারা
জেহাদের ময়দানে অচঞ্চল হয়ে দাড়িয়ে থাকে।
হে মোমেনগণ! জেহাদের মহিমা শুনলে, যাও যুদ্ধে যাও,
তোমার পরিবার, তোমার সম্পত্তি এসব কিছু ভেবো না।
ধন- জন- পরিবার- ঘর, সব কিছুরই বাসনা ত্যাগ করো,
যাও যুদ্ধের ময়দানে, আল্লাহ্র রাহে চল।
মরণের পরে ধন- পরিবার নিয়ে কবরে যাবে না,
সাবধান, দোযখের শাস্তি থেকে রেহাই নাই তোমার।
যদি তোমার বরাতে থাকে, নিশ্চয়ই ঘরে ফিরবে,
আর যদি শহীদ হও, তাহলে বেহেশতে চলে যাবে।
আজ দুনিয়াতে ইসলামে বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়েছে,
আর কাফেরদের ধর্ম সে স্থলে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আগের দ্বীনের মুসলমানরা যদি জেহাদ না চালাতেন,
তাহলে হিন্দুস্থানের বাসিন্দা কীভাবে মুসলমান হতো?
ইসলামের শক্তি সবকালেই ছিল তরবারির মুখে;
তারা যদি নিষ্ক্রিয় থাকতেন, ইসলাম অজ্ঞাত রয়ে যেত।
আর কতকাল ঘরে নিষ্ক্রিয় বাসে থাকবে,
এতে কোন লাভ নায়, শেষে তোমায় অনুতাপ করতে হবে।
অতএব ভীরু হয়ো না, ইমামের সঙ্গে যোগ দাও।
আর কাফেরদের দলনে তৎপর হও।
আল্লাহ্র মহিমা গাও, তিনি এক মহান ব্যাক্তি পাঠিয়েছেন
আমাদের মধ্যে তেরশ হিজরির মধ্যে।
মুসলমানরা ইমামবিহিন হয়ে অশেষ দুর্দশা পাচ্ছিলো,
শেষে রসূলের বংশেই এক ইমাম উদয় হলেন।
বন্ধুরা শোনো, আমি নিগম কথা বলছি,
তলোয়ার চালানোর সময় এসে গেছে।
মওলবী সা’ ব! গ্রন্থ ছাড় আর তলোয়ার ধর,
আর যাও ছুটে যাও জেহাদের ময়দানে।
সময় এসেছে এখন প্রাণ কুরবানী দেয়ার;
তর্ক ছাড়, সব ছাড়, শুধু তলোয়ার মুঠি ধর।
তুমি তো নেতা, তুমি সৎ আদর্শ দেখাও
তুমি আগুয়ান হলে বহু পরিজন তোমার সঙ্গী হবে।
তোমার ‘চিলা’ ছাড় এখন জেহাদের ডাক পড়েছে!
হে তরুন! বাঘের মতো সাহসী ও রুস্তমের মতো বীর তুমি,
এখন আগুয়ান না হও যদি, বীরত্বে কী লাভ?
তুমি নিহত করো বা নিহত হও, সমান লাভ;
একজন কাফের হত্যা করলে তুমি জয়ী হলে;
আর যদি তুমি নিহত হও, শাহাদাত লাভ করলে।
একদিন তুমি সব আনন্দ ছেড়ে যাবে,
মরণ সেদিন তোমায় এখান থেকে মুছে ফেলবে।
শোন বন্ধু শোন! মরণ যখন হবেই হবে,
তখন তুমি কেন নিজেকে আল্লাহ্র রাহে বিলিয়ে দিচ্ছনা?
হাজার মানুষ যুদ্ধে যায়, আর অক্ষত হয়ে ফিরে আসে,
হাজারো মানুষ তো ঘরে বসেই মৃত্যুবরণ করে।
হে জ্ঞানী ভাই! মৃত্যুর ভয় অবধারিত, তবে কিসের ভয়?
মরণ না এলে মানুষ মরেনা, অবধারিত ক্ষনের আগেও মরেনা।
মরণ যখন আসে তখন ঘরে থাকলেও রেহাই নাই।
তুমি পথের শ্রমে বিমুখ? এসব ভয় ছাড়;
তুমি পুরুষ, তুমি নিজের আরাম আয়েশ ভুলে যাও।
পুরুষ সব কিছুর অভ্যাস সহজে করতে পারে,
সে আরাম- আয়েশের অভ্যাসও ছেড়ে দিতে পারে।
চেয়ে দেখ হাজারো মুজাহিদ ঘর ছেড়ে বাইরে এসেছে।
আর এতটুকু দ্বিধা না করে যুদ্ধে প্রাণ দিতে তৈরি হয়েছে।
আশ্চর্য যে তোমরা নিজেদের মুসলমান বলছ।
তবু আল্লাহ্র ডাক পড়লে প্রতারণা করছ।
তোমরা দুনিয়াই মশগুল হয়ে পড়েছ,
স্ত্রী- পুত্র- কন্যার চিন্তায় নিজের স্রষ্টাকে ভুলে গেছ।
কতদিন স্ত্রী- পুত্র নিয়ে ঘরে থাকতে পারবে?
আজ যদি আল্লাহ্র রাহে প্রাণ কুরবানি দাও
কাল তুমি বেহেশতে অনন্ত সুখ লাভ করবে।
ঘরে বসে মৃত্যু- যন্ত্রণা ভোগ করা আর
আল্লাহ্র রাহে জীবন দেয়া, কোনটা ভাল?
আল্লাহ্র রাহে যদি জীবন বিলিয়ে না দাও,
তোমার অনুতাপ হবে, রসূলকে কীভাবে মুখ দেখাবে?
এক কাজ করো, মন প্রাণ দিয়ে ইমামের আজ্ঞানুবর্তী হও,
তা না হলে তোমার তরবারি ধরাই বৃথা হবে।
যদি কোনও স্বেচ্ছাচারী লোক জেহাদে যায়,
সে যত নিহত করবে, সবার জন্য দায়ী হবে, তার শ্রম বৃথা যাবে।
যারা আল্লাহ্কে জানে আর রসূলকে জানে,
তারা বিনা দ্বিধায় ইমামের আজ্ঞানুবর্তী হবে।
এসব উপদেশ মুসলমানদের পক্ষে যথেষ্ট,
এখন আল্লাহ্র নিকট মুনাজাত করে শেষ করি।
হে আসমান- জমীনের স্রষ্টা! হে আমাদের প্রভু!
মুসলমানকে জেহাদ করতে শক্তি দান করো!
তাদের বাহুকে শক্তিশালী করো,
আর তাদের জয়ী করে তোমার ওয়াদা পূরণ করো!
ভারতের প্রান্তে প্রান্তে ইসলামের মহিমা গাও,
আর সব ধ্বনি ছাপিয়ে শুধু শোনাও ‘আল্লাহ্’ আল্লাহ্!
পঞ্চপঞ্চাশত্তম দেশীয় পদাতিক বাহিনী হোটিমর্দানে বিদ্রোহ করলে বিদ্রোহীরা পার্বত্য অঞ্চলে পলায়ন করে ও সোয়াতের উপত্তকায় আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের বৃহদংশ আখুন্দের নিকট উপস্থিত হলে তাদের তিনি পর্বতমালা অতিক্রম করে কাশ্মীরে উপস্থিত হতে সাহায্য করেন, যাতে তারা হিন্দুস্থানে নিজের দলের সাথে যোগ দিতে পারে। তাদের কেউ কেউ ইনায়েত আলীর সঙ্গে যোগ দিল মুঙ্গল- আন্নায়। এটি সিত্তানা থেকে একদিনের পথের দূরবর্তী মহাবনের মাথার উপর একটা সুরক্ষিত কিল্লাহ। তিনিও তাদের সাদরে গ্রহণ করলেন, কিন্তু দাবী করলেন যে, তাদের ওহাবী মতাবলম্বের হতে হবে। অতঃপর তিনি সোয়াত থেকে সৈয়দদের সর্দার মুবারক শাহ কে তলব করলেন এবং নিজের সমগ্র বাহিনী নিয়ে নিম্নে অবতরণ করে সীমান্তের একটা গ্রাম চিনঘাউতে ছাউনি ফেললেন। তারপর দ্রুত প্রস্তুতি চলতে লাগল ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত ইউসুফজাই অঞ্চল আক্রমন করার।
ইউসুফজাই অঞ্চলের পূর্বদিকে এবং চিনঘাইএর অনতিদূরে, নওয়াখিল্লা গ্রাম অবস্থিত। তার বাশিন্দাদের সুনাম নিকটবর্তি অঞ্চলে মোটেই ঈর্ষাজনক ছিলনা। অশিক্ষিত, ধর্মান্ধ ও সীমান্তের বাশিন্দাদের স্বভাবজাত চঞ্চলমতির জন্য তারা শাসক পরিবর্তন করতে মোটেই অনিচ্ছুক ছিলনা। আর ইনায়েত আলীও তার প্রতি তাদের সদিচ্ছার বিষয় সম্যক অবগত ছিলেন। এজন্য তিনি দুশো মুজাহিদ এবং মুবারক শাহের ১২০ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে আফ্রিদি মির্জা মুহম্মদ রিসালদারের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিলেন গ্রামখানি দখল করে নিতে। আফ্রিদি মির্জা নওয়াখিল্লায় উপস্থিত হয়ে তার ও নিকটবর্তী গ্রাম শেখজানার মধ্যস্থলে ছাউনি ফেললেন। কিন্তু জেহাদিদের সাফল্য খুব ক্ষণস্থায়ী হয়। কারণ হোটিমর্দান থেকে একটি ব্রিটিশ বাহিনী তাদের আক্রমন করে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দেই এবং তাদের নায়ককে বন্দী করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। তার একমাস পর ইনায়েত আলী সমগ্র বাহিনী নিয়ে ব্রিটিশ এলাকার সিমান্তস্থিত গ্রাম নারিঞ্জি দখল করে নেন। এই আক্রমণের সংবাদ শীঘ্রই পেশাওরে পৌঁছালে তথাকার ডেপুটি কমিশনার কিছু সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হন জেহাদিদের সীমান্তের বাহিরে বিতাড়িত করতে। তখন একটা যুদ্ধ বাধে। কিন্তু ওহাবীরা বনায়ের ও সোয়াতের আদিজাতিদের বলিষ্ঠ সাহায্যে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠে। দ্বিতীয় আক্রমণটা সফল হয় এবং ওহাবীরা বিপুল ক্ষতি স্বীকার করে পলায়ন করে এবং চিনঘাই ও বাগে আশ্রয় নেয়। পরপর দুবার বিতাড়িত হয়ে ইনায়েত আলী বুঝলেন যে, একা তার দ্বারা বিজয়ের কোনও সম্ভাবনাই নায়। তখন তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন সীমান্তের আদিজাতিদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে একজোট করতে। তিনি আপোষের নীতি অবলম্বন করলেন এবং পার্বত্য আদিজাতির সর্দারগণকে প্রচুর ইনাম পাঠালেন। আর একজন অবিবেচক কিন্তু সাহসী কমিশনার নাওইয়াখিল্লায় ছাউনি ফেললে তাকে সহসা পরাজিত করে বিজয়টাকে ইনায়েত আলী কাফেরদের উপর অবধারিত বিজয় হিসেবে অহেতুক সর্দারদের চোখে বাড়িয়ে তুলেন এবং যুদ্ধে লুণ্ঠিত সমস্ত দ্রব্য তাদের মধ্যে বিতরণ করে দেন। সংক্ষেপে তিনি পাঠানদের ধর্মান্ধতা ও লোলুপতা বৃদ্ধি করতে সব পন্থা অবলম্বন করেন ও তাদের জেহাদ করতে প্ররোচিত করেন। কিন্তু পাটনার কমিশনার সাবধানতা ও প্রচেষ্টায় ইনায়েত আলীর সব অভিসন্ধিই পন্ড হয়ে যায় এবং তার ফলে সম্ভবত একটা সীমান্ত- যুদ্ধ এড়ানো গেলো। সিন্ধু নদের পারাপারের সব ক্ষেত্রেই কড়া পাহারা রক্ষিত হল এবং তার দরুন নিম্নঅঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা কড়া শক্ত হয়ে দাঁড়ালো। পাটনায় তার সব আত্মীয় স্বজনকে বন্দী করা হয় এবং তার ফলে বার বার সাহায্য প্রত্যাশা করেও কোন সাহায্য পাওয়া যায়নি। তার অর্থও ফুরিয়ে গেলো এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী করতে তিনি ব্যাক্তিগত সম্পত্তিও নামমাত্র মূল্যে দিতে বাধ্য হলেন। চিনঘায়ে আর অবস্থান করা সমীচীন নয় দেখে তিনি রুগ্ন দেহে ও হতোদ্যম হয়ে অভুক্ত অনুচরদের নিয়ে সিত্তানায় বন্ধুভাবাপন্ন সৈয়দদের সঙ্গে যোগ দিতে অগ্রসর হলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি সেখানে পৌছাতে পারেননি। পথেই পর্বতমালার মধ্যে তিনি মৃত্যু আলিঙ্গন করেন। আর ১২ দিন পর ব্রিটিশ বাহিনী সিত্তানা ও মুংগলয়ান্না পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়।