তৃতীয় প্রবন্ধ
রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর পর পাঞ্জাব রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। পরবর্তী প্রত্যেক সরকার ছিল নামে মাত্র শক্তিধর, রাষ্ট্রের সমস্ত কর্তৃত্ব ছিল খালসা সৈন্যদের হাতে। শেষ পর্যন্ত লাহোরের দরবার স্থির করলো, তার রাজনৈতিক সত্তা রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বিদ্রোহপরায়ন খালসা বাহিনীকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা। এই বিবেচনায় শিখরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। কিন্তু যুদ্ধে শিখরা দারুণভাবে পরাজিত হয়, খালসা বাহিনী আংশিক ভাবে ধংস হয় লাহরে একজ রেসিডেন্টের অধীনে দেশীয় সরকারের পতন হয়। শেষের কয় বছরের ভীষণ গোলযোগের সময়টা ছিল জেহাদের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল এবং ওহাবীরাও খুব বিজয়ের আশা করতো। তারা বালাকোট দখল করে নেয় এবং মুজাফফরবাদ দ্বিতীয় বার আক্রমনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এমন সময় জয়নুল আবেদীনের দলত্যগে আন্দোলনটা সাময়িক ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সমকালীন জেহাদীদের প্রধান নেতা ছিলেন রিন জনঃ বিলায়েত আলী, ইনায়েত আলী ও মকসুদ আলী; আর তারা সকলেই ছিলেন বিহারের অধিবাসী। ইনায়েত আলীর ইচ্ছা ছিল মওলবী কাদিরকে সমর্থন করার। কিন্তু মকসুদ আলী সোজা জানিয়ে দিলেন যে, সৈয়দ আহমদের পুনরাবির্ভাবের কাহিনী যদি অস্বীকার করা না হয়, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই জেহাদ ত্যাগ করে বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। তখন বিলায়েত আলীকে নেতা নির্বাচন করা হল ও জেহাদ পুনরায় শুরু করা হল। মুজাফফরবাদের দ্বিতীয় অভিযানও সাফল্যমণ্ডিত হল। শিখদের দক্ষিন্মুখে বিতাড়িত করে জ্বিহাদীরা তাদের পশ্চাৎধাবন করলেন। তখন একদল পাঠান এই বিজয়বার্তা শুনে জেহাদিদের পক্ষাবলম্বন করে। শিখরা নওশেরায় একবার বাধা দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু পুনরায় পরাজিত হয়। সিন্ধু নদীর পূর্ব থেকে হরিপুর থেকে কাগান এবং সিত্তানা থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ওহাবীরা অত্যল্পকালেই নিজেদের অধিকার স্থাপন করে। কিন্তু খালসা বাহিনীর ধ্বংস এবং তার দরুন ব্রিটিশ সরকারের আশ্রয়ে একটা নয়া শিখ শক্তির প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ওহাবীদের পক্ষে নিজের অধিকার সুদৃঢ় রাখা অসম্ভব হয়ে পরে এবং ১৮৪৭ সালে হরিপুরের নিকট মিঃ এগনিট এর নিকট সমগ্র মুজাহিদবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। কেবলমাত্র মীর আওলাদ আলী ও তার কিছু অনুগামীসহ সিত্তানায় পলায়ন করে। মওলবী ইনায়েত আলী ও মওলবী বেলায়েত আলী রাজবন্দী হিসেবে জন্মস্থানে প্রেরিত হয়। সেখানে উপস্থিত হলে তারা প্রত্যেকে দশ হাজার টাকা মুচলেকা দিয়ে খালাস পান এই শর্তে যে, চার বছর তারা পাটনা শহর ত্যাগ করতে পারবেননা। কিন্তু মুচলেকা শর্ত পালনের দিকে লক্ষ রাখা হয়নি, মাত্র কয়েক মাস তারা নিষ্ক্রিয় থেকে পুনরায় সিত্তানায় আশ্রয়প্রাপ্ত মীর আওলাদ আলীর সঙ্গে চিঠি পত্র যোগাযোগ শুরু করেন এবং উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলে হৃত অধিকার পুনরুদ্ধার করতে চেষ্টিত হন।
১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খবর পান যে, ইনায়েত আলী পুনরায় সেখানে উপস্থিত হয়েছেন ও মুজাহিদ সংগ্রহ করছেন, অথচ পূর্বে তাকে একবার এই জেলা থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়েছিল রাজদ্রোহ অপরাধে ও বিদ্রোহ প্রচার করার কাজে। তদন্ত আরম্ভ হলেই তিনি আত্মগোপন করেন ও পাটনায় পলায়ন করেন। তখন তাকে গ্রেফতার করার জন্য পাটনার ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট পরঅয়ানা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি রাজশাহী থেকে উধাও হয়ে গেলেও তার প্রভাব অক্ষুণ্ণ থাকে। কয়েকদিনের মধ্যেই রাজশাহীর ম্যাজিস্ট্রেট তার সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখিত হন এবং ১৮৫০ সালের মার্চ মাসে তিনি এতদসংক্রান্ত মামলায় এই হুকুম দেনঃ পুলিশ রিপোর্টে দেখা যায় যে, ইনায়েত আলী নিরীহ ব্যাক্তি, তাকে গ্রেফতার করার দরকার নেই, তার বিরুদ্ধ ফরিয়াদ কে পুলিশের নিকট সোপর্দ করা হোক মিথ্যা অভিযোগ আনয়নের কারণ দর্শাতে। এই হুকুমের নকল পাটনার ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট পাঠানো হয়। তিনি কিন্তু পাটনায় মওলবীদের কার্যকলাপের বিষয় রাজশাহীর ম্যাজিস্ট্রেটের চেয়ে সম্যক অবগত ছিলেন। এজন্য তিনি বিশ্বাস করতে চাইলেননা যে, ইনায়েত আলী নিরীহ লোক। তিনি পুনরায় ইনায়েত আলীর নিকট এক হাজার টাকা মুচলেকা নেন এই শর্তে যে, তিনি পাটনা পরিত্যাগ করতে পারবেননা। তার কার্যকলাপ সম্বন্ধে বাংলার কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয়েছেন লক্ষ করে ইনায়েত আলী গোপনে উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলে পলায়ন করে সিত্তানায় জেহাদিদের সঙ্গে মিলিত হলেন এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতিনিধি হিসেবে এই ওহাবী বসতির মুজাহিদ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহন করেন। ১৮৫০ সালের শেষ ভাগে বিলায়েত আলী সীমান্ত প্রদেশের দিকে সফর আরম্ভ করেন নিজের পরিবারবর্গ ও আশিজন অনুগামী নিয়ে। পথে তিনি বড় শহরে প্রচারকার্য চালান। দিল্লীতে প্রচারকার্য অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং কথিত আছে যে, এই সময় তিনি বাদশাহের নিকটও জেহাদ প্রচার করেন ও সমর্থন লাভ করেন।
দিল্লী থেকে পূর্বের মতো ধীর মন্থর গতিতে অগ্রসর হয়ে তিনি সিত্তানায় পৌঁছালেন জেলা প্রশাসকের নিকট হতে কোনও বাধা না পেয়ে। কেবল মাত্র এক জায়গায় কুববলের নিকট পুলিশ তাদের মালবাহী উট গুলকে ধরে পেশোয়ারের ডেপুটি কমিশনারের নিকট চালান দেয়, কিন্তু নির্দেশ দেন উটগুলোকে অবিলম্বে মালিকদের নিকট ফিরিয়ে দিতে।
বিলায়েত আলী ও ইনায়েত আলী চার বছর পূর্বে গ্রেফতার হয়ে পুলিশ প্রহরায় পাটনা প্রেরিত হয়েছিলেন, অথচ তারাই নির্ভয়ে ও নিরাপদে সাড়া ভারত পরিভ্রমণ করে ফিরলেন, এটা নিশ্চয়ই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের এক আশ্চর্য বিষয় বটে। এ থেকেই শাসক ও শাসিতের মধ্যে পার্থক্যটা সহজে নজর পরে- তখন শাসকরা বিপজ্জনক সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে কতটুকুই বা খবর রাখতেন। সৈয়দ আহমদের যুদ্ধবিগ্রহ, বারাসতের বিদ্রোহ, হরিপুর ধর্মান্ধদের প্রতিরোধ ও শেষে আত্মসমর্পণ সমস্তই শেষ হয়ে গেলে ভুলে যাওয়া হল। আর তারপর সহসা রূঢ়ভাবে সরকার জাগ্রত হল শেষ সময়ে, যখন মওলবীরা সিত্তানায় ফিরে গেছেন এবং পার্বত্য আদিবাসীদের উত্তেজিত করে তুলছেন।
বিলায়েত আলীর উপস্থিতিতে শক্তি বৃদ্ধি না হয়ে অনৈক্য সৃষ্টি হল। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভাইয়ের মতো তার জাতক্রোধ ছিলনা। তার ধর্মীয় উৎসাহ ততোখানি বন্য অন্ধ প্রকৃতির মতো ছিলনা, যার দরুন ধর্মীয় দুর্বলতাবশত মানুষ আত্মসংযম হারিয়ে ফেলে এবং পার্থিব পরিনামদর্শিতাও বর্জন করে। তিনি সফর করে ফিরেছেন মধ্যভারতে, দক্ষিনাত্যে, সিন্ধুতে ও বোম্বাইতে এবং তার দরুন ভায়ের চেয়ে আরও সঠিকভাবে তিনি ব্রিটিশ শক্তির গুরুত্ব পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই শক্তিই মারাঠা বর্গীয়দের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, মুসলমান পীন্ডারীরদের শায়েস্তা করেছে, সিন্ধুর আমীরদের দমন করেছে, শিখদের ধংস করে দিয়েছে। এজন্য তিনি কাফেরের দেশ থেকে পলায়ন করে নিজের বিবেককে প্রবোধ দিয়েছেন ও শান্তিতে থাকতে চেয়েছেন যতদিন না সৈয়দ আহমদ পুনরায় উদিত হন কিংবা নিশ্চিত জয়ের সম্ভাবনাময় অনুগামীদের সংখ্যা বর্ধিত হয়। তিনি বোঝালেন যে, উপস্থিত অল্প সংখ্যক জেহাদিদের নিয়ে ভারত জয় করা একেবারেই অসম্ভব এবং আরও দেখালেন যে, কোনও রকম নিষ্ফল প্রচেষ্টায় মাত্র ব্রিটিশ সকারের চোখ খুলে দেওয়ায় হবে। আর যদি সে সরকার একবার তাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে বিশেষভাবে ওইয়াকিফহাল হয়ে উঠে তাহলে সরকার তাদের সব রকম রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে এবং প্রজাদেরও জিহাদ সমর্থন করতে নিষেধ করবে। কিন্তু ইনায়েত আলী সংকর্ণমনা গোঁড়া এবং ভাইয়ের চেয়ে কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। এজন্য তার নিকট এরূপ পন্থা ভ্রমাত্মক বিবেচিত হল- এ যেন ইসলামে ও সৈয়দ আহমদের কাজে আস্থাহীনতা মাত্র। খোদ পয়গম্বর সাহেব ইমাম মেহদীর চেয়ে উচ্চস্তরের না হয়েও মাত্র কয়েকজন অনুসারী নিয়ে সারা আরবদেশ জয় করেছিলেন। যা একবার ঘটেছে তা পুনরায় ঘটতে পারে। এখন শুধু দরকার বিশ্বাসের, তাহলে সুফল নিশ্চিত। এভাবে তিনি ভায়ের বিরুদ্ধে জেহাদের পক্ষে ওকালতি করলেন এবং অনিচ্ছুক ভাইকে সরদারী ছেড়ে দিতে গররাজী হলেন। ফলে বসতিতে একটা গোলযোগের সৃষ্টি হয়। বাঙালীরা সমর্থন করলো তাদের পীর সাহেব ইনায়েত আলীর দাবী, আর সংখ্যাবহুল হিন্দুস্থানিরা পক্ষ নিল তার ভায়ের। ঝগড়া তীব্রতর হয়ে উঠলো এবং পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ালো যে, জেহাদিরা ভারত অধিকারের কথা ত্যাগ করে আত্মকলহেই শক্তি অপচয় করতে প্রস্তুত হল। এমন সময় বিলায়েত আলীর শুভবুদ্ধিতে বিরোধটা মীমাংসা হয়ে গেলো। তিনি বিবেদমান দুই দলের সামনে উপস্থিত হয়ে আল্লাহ্র নিকট এই মোনাজাত করলেন, তিনি যেন দুর্দিনে মুসলমানদের করুণা করেন ও ভায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করে দেন। শত্রু- মিত্র তার আচরণে অভিভূত হয়ে পরেন এবং অস্ত্র ত্যাগ করেন। তখন ইনায়েত আলী নিজের অবস্থা সম্বন্ধে নিরাশ হয়ে ভায়ের পক্ষে খেলাফতের দাবী ত্যাগ করেন এবং নিজের অল্প সংখ্যক অনুচর নিয়ে সোয়াতের আখুন্দের নিকট আশ্রয় লাভের আশায় প্রস্থান করেন। আখুন্দ তার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। আখুন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইনায়েত আলী বনায়ের নদীর উপর তীরবর্তী গ্রাম মুদদখলে বসবাস করতে থাকেন। আর নিজের অভিলাষ পূরণের সুযোগের অপেক্ষায়ও করতে লাগলেন। ভাগ্য তার উপর সুপ্রসন্ন ছিল। কয়েক মাসের মধ্যেই বিলায়েত আলী রোগভোগের পর জান্নাতবাসী হন। তখন জেহাদি বাহিনীর নেতৃত্বের একমাত্র বাধাও অপসারিত হয়ে গেলো। এখন ওহাবীদের অর্থাৎ ব্রিটিশ প্রজাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিল, তারা শাসকদের অধীনে শান্তিতে বাস করবে কিংবা শাসকদের ধর্মের শত্রু বিবেচনায় তাদের নির্মূল করাই অবশ্য কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করবে। এ পর্যন্ত একথা বলা উচিত হবেনা যে, তারা বিনা উত্তেজনায় সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অস্ত্রধারণ করেছে। কয়েকবছর ধরে তারা সিন্ধুতে নিস্ক্রিওভাবে বসে ছিল এবং যদিও তারা কাবুল যুদ্ধে দোস্ত মুহম্মদ খানের সঙ্গে যোগদান করেছিল এবং আমাদের বিরুদ্ধে গজনীতে যুদ্ধও করেছিল, তারা স্থানীয় চাপে পরেই তা করতে বাধ্য হয়েছিল। আর তখন পরিস্থিতিও ছিল অন্য রকম। কাবুলে যুদ্ধের আসল উদ্দেশ্য ছিল একটা মুসলিম রাজ্যকে উৎখাত করা, এজন্য ওহাবীরা আক্রমকদের বাধা দিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের ভাইদের সাহায্য করেছিল একটা বিধর্মী শক্তির বিনা কারনে আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা কালে।
ইসলামের শিক্ষার ধারনানুযায়ী স্রষ্টা এমন কোনও সত্তা নন, যিনি মানুষের ছোটখাটো অভিযোগের উর্ধে থেকে কেবলমাত্র অপরিবর্তনীয় বিধান দান করেন। বরং তিনি হচ্ছেন তাদের মহান শিক্ষক, করুণাময় পিতা, যিনি মানুষের সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষাকে উপযোগি করেন এবং প্রত্যেক মুশকিলে ও সমস্যায় সাহায্যদান করেন। তার বিধিবিধান একেবারেই চরমভাবে দেওয়া হয়নি, বরং ভিন্ন ভিন্ন যুগে মানবীয় বিভিন্ন স্তরে ধারনা শক্তির উপযোগী করেই দেওয়া হয়েছে এবং যখনই এসবের উপযোগিতা শেষ হয়ে গেছে, তখনই সেগুলিকে রদ করে দেয়া হয়েছে। সর্বকালের জন্য অপরিবর্তনীয় বিধিসমূহের ভিত্তিমূলে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত নয়; ধর্ম যুগে যুগে ক্রমোন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে। হযরত ইব্রাহিম, হযরত মুসা ও হযরত ঈসার দ্বারা এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মদের সময় পূর্ণ লাভ করেছে। হযরত মুহম্মদের সময় পর্যন্ত এই ধারা ধর্মীয় অনুদাতার অনুকূলে ছিলনা। শক্তিকে শক্তি দ্বারা প্রতিরোধ করা ধর্মের অজানা! ধর্মবিশ্বাসীর কর্তব্য ছিল, অহিংস বাধ্যতা দেখিয়ে প্রতিরোধ করে যতদিন সম্ভব ধর্মের অনুশীলন করা। আর যখনই ধর্ম আর পৃথিবীর মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিলনা তখনই তার কর্তব্য ছিল ঘর ত্যাগ করা এবং এমন এক দেশে হিজরত করা, যে দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করা যায়। হযরত মুসা এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে ইসলামের প্রথম যুগেও এই নিতি অনুসৃত হয়েছিল। মক্কার প্রথম দীক্ষিত মুসলমানদের উপর উৎপীড়ন শুরু হলে তারা মিসরের দক্ষিণে পলায়ন করে আশ্রয় লাভ করেছিল এবং তারপর স্বয়ং হযরত মুহম্মদ মদিনায় হিজরত করেন এই নীতিকে মুসলমানদের আদর্শ হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যে, যখন দেশে মুসলমানদের ধর্মচারন প্রাণসংশয়ের কারণ হবে, তখনই সে দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে যাবে। তরবারির মুখে ধর্ম প্রচারের বোধ তখন হযরত মুহম্মদের হয়নি। আর এ জন্য তিনি কোরায়েশদের এই প্রস্তাব অস্বীকার করেছিলেন যে, তারা তার আল্লাহ্কে এক বছর পূজা করবে, যদি রিনি তাদের দেবতাদের এক বছর পূজা করেন, তাহলেও তার অস্বীকৃতি চরম উদারবাণীতে প্রকাশিত হয়েছিলঃ ‘বলো, হে অবিশ্বাসীগণ! আমি তার পূজা করবনা, যার পূজা তোমরা কর, আএ তোমরা তা পূজা করবেনা, যার পূজা আমি করি। তোমাদের ধর্ম তোমাদেরই থাক, আর আমার ধর্ম থাক আমারই’। কিন্তু যতোই তিনি মক্কাবাসীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরতে লাগলেন, ততোই তার ধর্মমতে দীক্ষিত মুসলমানরা বিপজ্জনক রাষ্ট্রীয় অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হতে লাগলো, আর এজন্য নও মুসলিমরা উৎপীড়ন এড়াবার উদ্দেশ্যে জন্মস্থান ত্যাগ করে মদিনায় পয়গম্বরের সাথে মিলিত হতে লাগলো। ক্রমে ক্রমে মুহম্মদের অনুসারী বিভিন্ন জাতের লোক ইসলামের একসূত্রে আবদ্ধ হয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায়ে গ্রথিত হতে লাগলো, এবং তার শাসনও বিস্তৃত হতে লাগলো তাদের বাসভূমির সমগ্র এলাকা জুড়ে। তাদের সংখ্যা যতোই বাড়তে লাগলো হযরত মুহম্মদও সেই অনুপাতে কম উদার হতে লাগলেন। শেষে এক ঐশী বিধানের বলে পূর্বের উদারনৈতিক বিধানকে মাত্র চার মাসে সীমাবদ্ধ করে এই আদেশ দেয়া হল যে, তারপর মুসলমানরা বিধর্মীদের সঙ্গে সামাজিক সম্মন্ধ বান্ধ করে দিবে এবং তাদের ধর্মও প্রচার করতে পারবে তরবারির মুখে। এই নীতির বলে মুসলমানরা যে কোন দেশে বাস করুক না কেন, ধর্মের সুত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল, আর বিধর্মীরা ধর্মীয় ও জাতীয় যতোই পার্থক্য থাক না কেন তাদের মধ্যে, সমানভাবে মুসলমানদের দুশমন হয়ে গেলো। আর তার দরুন মুসলমানদের চোখে সাড়া দুনিয়াটা ভাগ হয়ে গেলো ‘দারুল ইসলাম’ অর্থাৎ শান্তির আবাস, যার বিস্তৃতি হচ্ছে সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্রের আর ‘দারুল হরব’ অর্থাৎ দুশমনের দেশ, যার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সব অমুসলমান রাজ্য। প্রত্যেক ‘দার’ অর্থাৎ দেশের অধিবাসীরা অন্যটিতে বাস করতে পারে তার জাতীয়তা ত্যাগ না করেও। কিন্তু মুসলমান দারুল হরবের অধিবাসী হয়ে গেলে তাকে দারুল ইসলামে প্রত্যাবর্তন করার স্বদিচ্ছা প্রকাশ করতেই হবে। অন্যথায় সে হবে ধর্মত্যাগী। কারণ মুসলমান আইন কোন অমুসলমানকে স্থায়ীভাবে একজন ‘হরবী’ অর্থাৎ দুশমনের প্রজা হিসেবে স্বীকার করেনা।
মুসলমান আইনের বিধানদাতারা এ বিষয়ে একমত যে, মুসলমান কর্তৃক শাসিত প্রত্যেক দেশই দারুল ইসলামের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তাদের মধ্যে দ্বিমত থেকে গেছে যে, এককালীন দারুল ইসলামের অন্তর্ভুক্ত বর্তমান ব্রিটিশ ভারত বিধর্মী শক্তি কর্তৃক বিজিত হওয়ার দরুন দারুল হরব হয়ে গেছে কিনা। এই প্রশ্নের জবাব যদি ব্রিটিশ সরকারের অনুকূলে যায়, তাহলে মুসলমানরা জেহাদ করার অধিকার হারিয়ে ফেলে। আর যদি জওয়াবটা প্রতিকূল হয়, তাহলে মুসলমানরা গোলমেলে অবস্থায় পরে যায়। কারণ সরকার বিরোধ না করলে তাদের সক্রিয় বাধ্যবাধকতা হয় না। কিন্তু এ দেশ থেকে হিজরত বা পলায়ন করা অবশ্য কর্তব্য হয়ে পরে। স্থায়ীভাবে এদেশবাসী মুসলমান তার সর্ববিধ ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে, সে পাপে জীবনযাপন করবে, তার বিবাহ সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন অর্থাৎ বিবি তালাক হয়ে যাবে এবং তার সন্তানরা হবে জারজ। এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে গোঁড়া মানুষদের উপর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা যদি ইউরোপীয় পাঠকরা সম্যক অনুধাবন করতে চান তাহলে তারা ক্ষণকাল চিন্তা করে দেখুন, ইউরোপবাসীদের- দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা যাক আইরীশদের উপর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যদি তাদের বিশ্বাস করতে বলা হয় যে, তাদের রাজনৈতিক ক্ষোভ ছাড়া তাদের বিবাহ অসিদ্ধ হবে, সন্তানরা হবে জারজ ও প্রার্থনা হবে মূল্যহীন। যতদিন তারা ইংল্যান্ড শাসিত দেশে বাস করবে।
হানাফী সম্প্রদায়ের বিধানমতে দারুল ইসলাম সারুল হরবে পরিণত হয়ে যায় তিনটি শরতেঃ
প্রথম- বিধর্মী কর্তৃত্বের সাধারন প্রকাশ এবং তার মধ্যে মুসলিম কর্তৃত্বের প্রকাশ না থাকা।
দ্বিতীয়- দারুল হরবে এমন ভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া যে, কোনও মধ্যবর্তী মুসলিম শহর বা কওমের অস্তিত্ব না থাকা।
তৃতীয়- তার মধ্যে কোন ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান উপস্থিত না থাকা।
প্রথম শর্তটি ব্রিটিশ ভারতে উপস্থিত, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় টি নাই। ব্রিটিশ ভার উত্তর- পশ্চিমে মুসলমান রাজ্যর সঙ্গে মিলিত হয়ে আছে। আর তার মধ্যে এমন সব মওলবী উপস্থিত, যারা জ্ঞান- গরিমায় ও ধর্মনিষ্ঠাই দূর- দূরান্তে খ্যাতিমান। হানাফীরা এখনও এদেশকে দারুল ইসলাম বিবেচনা করে থাকে। কিন্তু ওহাবী আন্দলন শুরু হওয়ার পর থেকে মওলবী মুহম্মদ ইসমাইলের অনুগামীরা মনে করতেন যে, মাত্র প্রথম শর্তটি উপস্থিত প্রয়োজন। আর এজন্য প্রচার করতেন যে, ভারত দারুল হরব হয়ে গেছে। তারা কল্পনা করতেন যে, ইংরেজদের অধীনে ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা হচ্ছে ঠিক মিশরে ইসরাইলীদের মতো অবস্থা। আর এজন্য তারা দ্বিতীয় মুসার আবির্ভাব আশা করতেন। ইংরেজরা হচ্ছে বর্তমান যুগের ফেরাউন, অতএব তাদের অধিকার থেকে পলায়ন মিশর থেকে পলায়নের মতই প্রয়োজনীয়। তবে উৎপীড়িত মুসলমানদের জন্য সান্ত্বনা এই যে, ব্রিটিশ সরকারের ধ্বংস অবধারিত। তার স্থায়িত্ব মাত্র এক বছর- ঠিক যতদিন ইসরাইলীরা মিসরে দাসত্ত ভোগ করেছিল। এই দাবী সপ্রমাণ করতে ওহাবীরা পিছপা হয়নি। তারা এই সম্বন্ধে ভবিষ্যৎবাণী জাল করে, ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারপত্র ছাপিয়ে অজ্ঞ অসন্ধিগ্ধ মুসলমান ভাইদের মধ্যে বিতরণ করতঃ
সত্য কাহিনী শোনঃ একজন বাদশাহ হবেন, তার নাম তাইমুর, ত্রিশ বছর তিনি শাহী করবেন। মর্দান শাহ হবেন তার উত্তরাধিকারি, তিনিও দুনিয়াই ত্রিসগ বছর শাসন করবেন। যখন তিনি এ দুনিয়া ছেড়ে যাবেন, তখন আবু সাঈদ হবেন জিন ও মানুষের বাদশাহ। তারপর বাদশাহ হবেন ওমর শাহ, হিন্দুস্তানের তখত তার অধীনে আসবে। কাবুলে শাহ মহামতি বাবুর হবেন হিন্দুস্তানের বাদশাহ, আর দিল্লী হবে রাজধানী। তার উত্তরাধিকারি হবেন সিকান্দার, তার পরে তখত পাবেন ইব্রাহীম। তখন দুনিয়াই নামবে বিপর্যয়। তারপর হুমায়ন তখতে উন্নীত হবেন। তার আমলে হবে আফগানদের অভ্যুদয়- এই বংশের শাহ হিন্দুস্তান দখল করবেন, তার নাম মহামতি শের শাহ।
হুমায়ন ইরানে পালিয়ে আশ্রয় নিবেন মুহম্মদের বংশধরদের, সেখানে তার সম্মান হবে। ইরানের শাহ হবেন তার প্রতি সদয়, তার মর্যাদা ও সম্মান বাড়িয়ে দিবেন। যখন তিনি হিন্দুস্তানে অভিযান করবেন হুমায়ুন কে তখতে বসাতে, তখন শের শাহ গত হবেন, তার ছেলে হবেন্সাহ। হুমায়ুন সহজেই ফিরে পাবেন হিন্দুস্থানের তখত। তারপর আকবর হবেন হিন্দুস্থানের বাদশাহ। তার পুত্র জাহাঙ্গীর হবেন উত্তরাধিকারি, তিনি সাড়া দুনিয়ার রক্ষক। যখন তিনি এ দুনিয়া ছেড়ে যাবেন, শাহজাহান শাহী করবেন ত্রিশ বছর বা আরও বেশী। তার কনিষ্ঠতর পুত্র হবেন উত্তরাধিকারি, তিনিও শাহী করবেন ত্রিশ- চল্লিশ বছর। তারপর ইমাম একেবারে লুপ্ত হবে, সত্য নষ্ট হবে, মিথ্যা মাথা তুলে দাঁড়াবে, বন্ধুরা হবে পরস্পরের দুশমন। তিনি শাসন করবেন কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর। তার কনিষ্ঠতর পুত্র হবেন উত্তরাধিকারি। তার আমলে ঈমান আবার তাজা হবে, তার নাম হবে বাদশাহ মুজান শাহ। তার শাহীতে মানুষ থাকবে আরাম- আয়েসে। আর ন্যায়বিচার তার রাজ্যে বিরাজ করবে। আবার শান্তি নেমে আসবে তার সময়ে। দুঃখ দূর হবে, সুখ দেখা দিবে সর্বত্র। তার শাহী থাকবে এগারো বছর। তারপর হবেন আর একজন বাদশাহ, তখন নাদির শাহ করবেন হিন্দুস্থানে অভিযান, তার তরবারি দিল্লীতে রক্তস্রোত বইয়ে দিবে। তারপরে অভিযান করবেন আহমদ শাহ, তার হাতে শাহী বংশ উৎখাত হয়ে যাবে। এই বাদশাহ ফৌত হলে পরে আগের বংশ আবার তখত পাবে। তখন শিখেরা হবে শক্তিশালী, আর করবে অত্যাচার- উৎপীড়ন প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। তারপর নাসারারা সাড়া হিন্দুস্থান জয় করবে, তাদের শাহী হবে মাত্র একশো বছর। তাদের আমলে দুনিয়াই নেমে আসবে ভীষণ উৎপীড়ন। তাদের ধ্বংস করতে পশ্চিমে এক শাহ উদয় হবেন, তিনি যুদ্ধ করবেন নাসারাদের সঙ্গে। এই যুধে অগণিত শহীদ হয়ে যাবে। পশ্চিমের শাহ জয়ী হবেন জেহাদের তরবারিতে, আর ঈসার অনুসারীরা হবে পরাজিত। আবার ইসলাম আবাদ হবে চল্লিশ বছর। তারপর এক বেঈমান জাতি আসবে ইস্পাহান থেকে।এই স্বেচ্ছাচারীদের ধ্বংস করতে ঈসা আসবেন আসমান থেকে নেমে, আর আসবেন মেহদী। এসব ঘটবে যখন রোজ- কেয়ামত শুরু হবে দুনিয়াই। এই কাসিদা লেখা হল পাঁচশো হিজরিতে। পশ্চিমের শাহ আসবে বারশ সত্তর হিজরিতে। নেয়ামতউল্লাহ জানতেন আল্লাহ্র অনন্ত রহস্য, তার ভবিষ্যৎ বাণী একদিন সফল হবেই।
হিজরত করার অনুকূলে যেসব প্রচারনা করা হতো, নীচের উদ্ধৃতিই তার উপযুক্ত প্রমানঃ
‘পরম দয়ালু ও করুণাময় আল্লাহ্র নামে, আল্লাহ্ পরম মঙ্গলময়। তিনি রাব্বুল- আলামিন- সাড়া বিশ্বের মালিক। আল্লাহ্র করুণা ও নিরাপত্তা হযরত মুহম্মদ, তার রাসুল, তার বংশধরদের ও সাহাবীদের উপর বর্ষিত হোক। এখন সকল মুসলমান অবহিত হোক যে, তাদের কর্তব্য হচ্ছে, কাফের শাসিত দেশ ত্যাগ করা, কারণ সেখানে মুসলমান আইন নির্দিষ্ট বিধিবিধান শাসনশক্তি প্রতিপালিত হতে বাধা দেয়। তারা যদি দেশ ত্যাগ না করে, তাহলে মৃত্যুকালে আজরাইল যখন তাদের দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন করবেন, তখন তিনি তাদের এই প্রশ্ন করবেন, আল্লাহ্র রাজ্য কি এত প্রশস্ত ছিলনা যে, তোমরা গৃহত্যাগ করে অন্যত্র বাস করতে পারনি? আর এই কথা বলে তিনি তাদের অসেস যন্ত্রণা দিয়ে দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন করবেন। তারপর তারা কবরের ভিতর ভোগ করবে অশেষ যন্ত্রণা ও তাদের রেহাই নাই। শেষে রোজ- কিয়ামতের সময় তাদের দোজখে ফেলে দেয়া হবে এবং সেখানে তারা শাস্তি ভোগ করবে অনন্ত কাল ধরে। আল্লাহ্ করুন! কোন মুসলমান যেন কাফেরদের রাজ্যে মৃত্যু আলিঙ্গন না করে। যদি তার কফেরের রাজ্যে মৃত্যু ঘটে, তাহলে মৃত্যুকালে তার অশেষ যন্ত্রণা ভোগ হয়। তারপর তার ভাগ্যে আসে কবরের ভিতরে অশেষ শাস্তি, আর রোজ- কিয়ামতে তার যে শাস্তি হয়, তা মানুষের অচিন্তনীয়। ভাইগন! এখনও মরণ আসেনি। এখনও তোমরা পলায়ন করতে পার। সেই দেশে যাও যেখানের শাসক মুসলমান এবং মোমেন মুসলমানদের সঙ্গে বাস কর। তুমি যদি জীবিতকালে স্বদেশে উপস্থিত হউ, তাহলে তুমি সাড়া জীবন যত পাপ করেছ, সব মাফ হয়ে যাবে। তোমরা রুযীর কথা মোটেই ভেবনা। আল্লাহ্ সকলেরই আহার যোগান। তুমি যেখানেই যাবে, সেখানেই তোমার আহার যোগাবেন। আল্লাহ্ কখনও কাউকে অনাহারে বা বিবসনে রাখেননা। বা তুমি তো আল্লাহ্র হুকুমে গৃহত্যাগ করে যাচ্ছ, আল্লাহ্ তোমাকে কুরআনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিরাট সম্ভাবনাময় উন্নতির ও তার অনন্ত করুণার। তবু তোমার ভয় কিসের? আসমান ও জমিনের মালিক তো সর্বদাই আছেন তোমার সাথে। তুমি যে দেশে যাচ্ছ, সেখানেই তোমার রুজির হিল্লে হয়ে যাবে। এ চিন্তা মনেই এননা। সে দেশে চলে যাও আর এখানে যে পেশা চালাচ্ছ, তাই সেখানে শুরু করে দাও। আল্লাহ্ সবারই আহার যোগান। তোমার মনে শান্তি আন। যেখানেই তুমি যাবে, সেইখানেই সম্মানের সঙ্গে তিনি আহার যুগিয়ে দিবেন, আর তোমার সব গুনাহ মাফ করে দিবেন। তুমি এ জীবন আরাম- আয়েশে কাটিয়ে যাবে আর মরণকাল আজরাইল তোমায় এতটুকু যন্ত্রণা না দিয়ে তোমার দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন করে দিবেন। আর তোমার কোনও গোর আজাব হবেনা। রোজ- কিয়ামতে তোমার কোনও ভয়ের কারণ নাই। তুমি দোযখের যন্ত্রণা থেকেও মুক্তি পাবে।
“পুরাকাহিনীতে আছে যে, একজন ইসরাইলী অন্যায়ভাবে নিরানব্বইটা খুন করে। তারপর এক সাধুর নিকট যেয়ে অপরাধ স্বীকার করে ও জিজ্ঞাসা করে কিভাবে ের মুক্তিলাভ হবে। সাধু পুরুষ বললেন, কেউ যদি যদি অন্যায়ভাবে একজন লোককেও খুন করে, তাহলে তার পরিত্রাণ নাই। তোমার পাপের ক্ষমা নাই, তোমাকে দোজখে যেতেই হবে। একথা শুনে ইসরাইলী বলল, ‘আমাকে দেখছি দোজখে যেতেই হবে, এটা ধ্রুবসত্য। তাহলে তোমাকেও খুন করে খুনের সংখ্যাটা শত পূর্তি করি’। একথা বলে সে সাধু পুরুষকে খুন করলো। তারপর সে আরেক সাধুর নিকট গিয়ে স্বীকার করলো, সে একশোটি খুন করেছে, এখন কিভাবে তার মুক্তিলাভ হবে। সাধুর জওয়াব হল, অকপট মনে তওবাহ বা অনুশোচনা করে ও হিজরত করে মুক্তিলাভ করে যাবে। একথা শুনেই সে তওবাহ করলো ও নিজের দেশ ত্যাগ করে বিদেশে যাত্রা করলো। পথেই কিন্তু তার মৃত্যু এল ঘনিয়ে এবং করুণার দূত ও শাস্তির দূত তার দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন করতে উপস্থিত হলেন। করুণার দূত [রহমতের ফেরেশতা] বললেন, দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন করার অধিকার তারই আছে, কারণ লোকটি তওবাহ করেছে ও হিজরত করেছে। শাস্তির দূত [গজবের ফেরেশতা] স্বীকার করলেন, লোকটি যদি অন্য রাজ্যে পৌছাতে পারত, তাহলে শাস্তির দূতেরই অধিকার হতো একাজ করার। কিন্তু তিনি নিজেরই অধিকার দাবী করলেন, এই যুক্তি দিয়ে যে, লোকটি এখনও তার দেশেই থেকে গেছে এবং তার মৃত্যু ঘটাতে চাইলেন। কারণ লোকটি হিজরত সমাধা করতে সমর্থ হয়নি। তখন দূত দুটি লোকটি যেখানে শুয়েছিল, সে জায়গাটি মেপে দেখলেন এবং ফলে জানা গেলো যে, লোকটির একখানা পা সীমানা অতিক্রম করে অন্য দেশে পড়েছে। তখন শান্তির দূত নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে ঘোষণা করে সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু ঘটিয়ে দিল, আর লোকটিও আল্লাহ্র অনুগৃহীত মানুষের দলভুক্ত হয়ে গেলো। তোমরা শুনলে কিভাবে হিজরত মৃত্যুর পরও পুরস্কৃত হয়। অতএব তোমার আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা কর তিনি যেন তোমাদের হিজরত করার সামর্থ্য দেন। আর তোমরা অতি শীঘ্রই হিজরত কর, নাহলে কাফেরদের দেশেই তোমাদের মৃত্যু হতে পারে। এদেশে মৃত্যু হলে তোমাদের অশেষ দুর্গতি হবে। মরণ যখন এসে যায় তখন তওবাহ করার সময় থাকেনা। যা করবার এখনি করে ফেল”।
হিজরতের মতবাদ শুধু ইসলাম ধর্মেরই বিশেষত্ব নয়, খ্রিস্টান ধর্মেও রয়েছে সমান মতবাদ। যে ক্রুসেডার তীর্থযাত্রী জেরুজালেমে অস্থিরক্ষা করার আশা পোষণ করে, আর যে রোমান ক্যাথলিক জীবনের শেষ দিনগুলো রোমে কাটিয়ে দিতে চাই, তারা একই প্রর্বত্তিতে উদ্বুদ্ধ হয় জীবনের শেষ দিনগুলো এমন কোন পবিত্র স্থানে অতবাহিত করতে, যেখানে পাপের প্রলোভনে পরার কম সম্ভাবনা। গোঁড়া মুসলমানও হিজরত করাকে এরকম একটা প্রবৃত্তিতে দেখে থাকে। তারা আশা করে থাকে মক্কা বা মদীনাশরীফে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার। কিন্তু তারা এটাকে মুক্তিলাভের জন্য প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করতে দিধা করে। আর এজন্য তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল, যখন তারা দেখল যে, একটা বিরুদ্ধবাদী সম্প্রদায় অজ্ঞ জনসাধারণকে বিশ্বাস করাতে চায়ছে যে, তাদের এই মতবাদের সমর্থন করে মক্কাবাসীরাও। ১৮৩৩ সালে মওলবী কেরামত নামে একজন ও সৈয়দ আহমদের জনৈক খলীফার ‘কাতুল-ইমাম’ থেকে নীচের উদ্ধৃতিটা এই বিষয়ের উপর সমকালীন সবচেয়ে উন্নত মত হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারেঃ
“আরও একটি বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করে দরকার, কারণ তাতে বহু উপকার পাওয়া যেতে পারে; যদি পয়গম্বরদের কোন উম্মত মুশ্রিকদের দ্বারা কিংবা নাস্তিকদের দ্বারা উৎপীড়িত হয় এবং অবিশ্বাসীদের দেশে শরীয়াতের আইন পালন করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠে তাহলে সে আশ্রয় নেয় কোন এক মুসলিম রাজ্যে, বিশেষত মক্কা ও মদীনা শরিফে। কিন্তু ওহাবী যদি সেসব জায়গায় প্রবেশ করে, তাহলে তাদের স্থানীয় বাশিন্দারা শাস্তি দিয়ে থাকে। সেসব দেশে হিন্দুস্থানের মতো নয় যে, একজন কারও এততুকু বিনা আপত্তিতে যা ইচ্ছা সেখানে করতে পারে। এজন্য ওহাবী যখন দেখে যে, সেসব দেশের লোক তাদের বিপক্ষে ও তাদের শাস্তি দিতে প্রস্তুত, তখন তারা কোন বিধর্মীর দেশেও আশ্রয় খুঁজবে। বহু ওহাবী এমনতর করেছে। আল্লাহ্ আমাদের হেফাজত করুন! এটা কেমন খারাপ মজহাব যে, তার অনুসারীরা দারুল- ইসলামে বাস করতে পারেনা, তাদের কাফেরের দেশেও ছুটাছুটি করতে হয়। অতএব তাদের মজহাবের কেউ যদি তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, কেন তুমি কাফেরের দেশে বাস করছ, তাহলে তাকে জওয়াব দাওঃ কাফেরের রীতিনীতি দেখে মন হতবুদ্ধি হয়ে যায়। আর তোমাদের মজহাবই তো এমন মনোবৃত্তি জাগিয়ে তুলেছে। শুধু পারেনি মক্কা, মদীনা ও দারুল ইসলামের অন্যান্য শহরে। কারও দৃষ্টি ঠিকভাবে সংযত রাখা যায়না। তোমরা যারা ওহাবী এবং ঐ সব স্থানে সফর করেছ, তোমরাই বুকে হাত দিয়ে এই প্রশ্নটা করে দেখ। এদেশে বসবাসের সওয়ালে তোমাদের ও আমার মধ্যে নিশ্চয়ই পার্থক্য আছে। আমি এখানে আছি বটে, কিন্তু আমার মন পরে আছে ওখানে। এবং আমার একান্ত কামনা যে, আল্লাহ্ আমায় একদিন দারুল ইসলামে নিয়ে যাবেন কিংবা এদেশটাকে দারুল ইসলামে পরিণত করে দিবেন। আর আমি বিশ্বাস করি ওখানকার মানুষগুলো সৎ, উত্তম, ধর্মে নিষ্ঠাবান ও ঈমানে বলিষ্ঠ। কিন্তু তোমরা রাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে, তাদের আচার- নীতিতে ও ফতোয়ায় সন্তুষ্ট নও। এখন কি তাদের আখ্যা দাও স্বেচ্ছাচারী বলে। আর তোমাদের আরও অনেকে বলে থাকে যে, মক্কা ও মদীনার লোকদের উপর বিশ্বাস করা চলেনা, তারা দশ টাকার বিনিময়ে মিথ্যা ফতওয়া দিয়ে বসে থাকে” ।
ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা যখন বেনারসে বা গয়ায় তীর্থ করতে যায়, তখন তারা বিদায়ের পূর্বে তাদের সম্পত্তির শেষ ব্যাবস্থা করে যায়। বহু লোক মনে করতো হিজরত করা কঠিন কাজ। এখন রেলপথ বসান হয়েছে, ভারত ও আরবের বন্দরগুলোতে জাহাজের যাতায়াতও সহজ হয়েছে। তার দরুন মক্কা শরীফে হিজরত করতে যাওয়ার লোকদের উৎসাহ বেড়েছে। কিন্তু তার ফলেই মুসলমানদের চিরতরে ভারত ছাড়ার ইচ্ছা জেগেছে কিনা, তা বলা শক্ত। শাহ আবদুল আজীজ ছিলেন ভারতে বহু শতাব্দীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মোমেন মুসলমান। কিন্তু তিনি দিল্লীতেই বাস করেছেন এবং সেখানেই মৃত্যু বরণ করেছেন। তার উত্তরাধিকারী মওলবী ইসহাক হিজরত করেছেন। আর সমকালীন হানাফীদের নেতা মওলবী কুতবউদ্দিনের রচনাসমূহ বিবেচনা করে ধারনা হয় যে, আজকাল গোঁড়া মুসলমানরা হিজরত সম্বন্ধে এরকম ধারনা করে, যা ওহাবীদের প্রচারিত মতবাদ থেকে খুব কমই পৃথক। আর তার তুলনায় মওলবী কেরামত আলীর মতামত অনেক উদার। দিল্লীতে ১৮৬৭ সালে মুদ্রিত তার ‘ইমাম তাফাসীর’ গ্রন্থের ২৫৩ পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেনঃ
“আল্লাহ্র রাসুল বল্লেনঃ ‘আমি সেসব মুসলমানদের উপর নারাজ যারা মুশ্রিকদের মধ্যে বাস করে’। সাহাবারা একথা শুনে রসূলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহ্র রসূল! আপনি কেন নারাজ হলেন? রসূল বললেন, ঈমানের একটা বড় চিহ্ন এই যে, মুশরিকরা ও মুসলমানরা একে অপরের থেকে দূরে থেকেও দেখতে পাবেনা এবং কাফেরদের থেকে মুসলমানরা এত দূরে থাকবে যে, তারা কেউ কারও ঘরের আগুনও দেখতে পাবেনা। কাফেরদের মধ্যে বাস করার প্রশ্নই উঠেনা। কারণ তার ফলে ইসলাম দুর্বল হয়ে পরে। এই দুর্বলতা আসে কাফেরদের রীতিনীতি লক্ষ করে।
সংক্ষেপে বলতে চাই, ভাইসব! আমাদের উচিত বর্তমান অবস্থার জন্য ক্রন্দন করা। কারণ আল্লাহ্র রসূল আমাদের উপর বিরূপ রয়েছেন আমরা কাফেরদের দেশে বাস করছি বলে। যখন খোদ রসূল আমাদের বিরূপ রয়েছেন তখন আমরা কার শরণাপন্ন হব? আল্লাহ্ যাদের সামর্থ্য দিয়েছেন, তাদের উচিত হিজরত করা, কারণ এদেশে আগুন জলে উঠেছে। আমরা যদি সত্য কথা বলি, তাহলে আমাদের ফাঁসি যেতে হয়; আর যদি চুপ করে থাকি, তাহলে ধর্মচ্যুতি হয়”।
কুরআন থেকে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত বাণীগুলি থেকে বিধানের অব্যার্থতা সৎ ও ধর্মীয় কাজের ও ধইর্যের শ্রেষ্ঠত্ব সুপরিস্ফুট; কুরআনের বিভিন্ন বাণীতেও এসব পালনের বিধান দেওয়া আছে। তার উপকারিতার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছেঃ
“হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহ্কে ভয় কর, তোমাদের প্রত্যেকের উচিত আগামীদিনের পূর্বে যেসব দেখেছ সেগুলি পুনরায় দেখা।
তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর, নিশ্চয়ই তিনি অবগত আছেন তোমরা যা করছ।
যে আল্লাহ্কে ভয় করে, তাকে নিশ্চয়ই তিনি সকল বিপদ থেকে বাচান; আর তাকে যোগান, যখন তা পাওয়ার মোটেই সম্ভাবনা থাকেনা।
যারা ধর্মচারন করে তাদের অতি নিকটে তিনি সঞ্চয় করে রেখেছেন বেহেশত, যার নীচে দিয়ে অনন্তকাল স্থায়ী নহর বয়ে যায়, আর যেখানে আছে পবিত্র ও ধর্মশীলা তরুণীগণ যাদের উপর আল্লাহ্ দয়ালু।
আল্লাহ্ তার সৃষ্ট প্রাণীগণের অবস্থার প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
মওলবী কুতুবউদ্দিন, যার ফতওয়া তার মুরিদরা অভ্রান্ত হিসেবে বিশ্বাস করে বলেছেন যে, তাদের তিনটির যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে; শাহাদত, হিজরত কিংবা পরলোকে অনন্ত শাস্তি। আর সরকারী কর্মচারীরা যেমন তাচ্ছিল্লভাবে দেশীয় ভাষায় সাহিত্যের বিচার করে থাকেন, তার প্রতি বিদ্রূপ করেই তিনি তার পুস্তকের শেষে বলেছেন যে, তার কিতাবখানি আইনানুসারে রেজিস্ট্রি করাও হয়েছে।
হানাফী সম্প্রদায়ের মুখ্য ব্যাক্তি যদি এ ভাষা ব্যাবহার করে থাকেন, তাহলে ব্রিটিশ সরকার সম্ভবতঃ আর ধারনা করতে পারে না যে, হানাফী ও ওহাবীদের মধ্যে কোনও রকম মতভেদ আছে, অথচ আমরা এতকাল তাই ভেবে আসছি। বর্তমানে এমন অনেক চিহ্ন বিদ্যমান, যা থেকে লক্ষ করা যায় যে, এককালে এই দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যা কিছু পার্থক্য ছিল, তা আংশিক ভাবে ক্ষয়িত হয়েছে। আর আমাদের সামনে যে পুস্তকটি আছে, তাও লেখক এমন প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, বাস্তবিক পক্ষে উভয় সম্প্রদায় একই মতামত পোষণ করে। আর আমরা একথাও জোর করে বলতে পারিনা যে, অসন্তুষ্ট হওয়ার কোনও কারণও নায়। বহু বছর ধরে মুসলমানরা অবহেলিত হয়ে আসছে, কিংবা আমাদের সন্দেহদগ্ধ প্রজা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তাদের শিক্ষা- সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা দেখানো হয়, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত মুসলমানদের ব্যাক্তিগত দাতব্য সম্পত্তিগুলোও কোন কোন ক্ষেত্রে অন্য কাজে লাগানো হয়। আমাদের বিশ্বাস, বিবেচনা ও উদারনীতি অবলম্বন করে নিশ্চয়ই এই অবহেলা দূর করা হবে। যা হোক, আমরা এই বিষয়টার আর অধিক আলোচনা করতে পারিনে; কারণ এমনিতেই আমরা এই নিবন্ধে অনেক দূরে গেছি, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ওহাবীদের অনুসরণ করা। অতএব আমরা প্রসঙ্গটা এখানেই ত্যাগ করছি এই আশা নিয়ে যে, আমাদের কোনও পাঠক হয়তো সাধারণের উপকার্থে অগ্রসর হবেন, ব্রিটিশ অধিকারে পর হতে ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় মতামতের যে বিভিন্ন স্তরে যে বিকাশ দেখা গেছে সে সম্বন্ধে আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে।। কারণ এ সম্বন্ধে কেবলমাত্র মুসলমান পাঠকদের জন্য যেসব পুঁথি- পুস্তক মুদ্রিত আছে সেসব যদি বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে বলতে হয় যে, এটি ক্রমেই সরকারের বিরুদ্ধে অসহনীয় ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
ইনায়েত আলী মুজাহিদ বাহিনীর সরদার হয়েই ইংরেজদের বিরুদ্ধে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত জেহাদ শোসনার সক্রিয় পন্থা অবলম্বন করতে চেষ্টিত হলেন। তিনি বাংলাদেশের খলীফাদের তাগিদ দিলেন এই উদ্দেশ্যর জন্য সর্বসক্তি ব্যায় করতে এবং প্রচার করতে যে সৈয়দ আহমদের আবির্ভাব আসন্ন। আর ওহাবী প্রচারকরা সাড়া দেশটায় পুনরায় অসন্তোষের আগুন জ্বেলে তুলল ও এভাবে বিদ্রোহ প্রচার করতে লাগলোঃ
“যারা অন্যকে হিজরত বা জেহাদ থেকে বিরত করতে চেষ্টা করবে, তারা মুনাফেক ও কপট বিশ্বাসী। সকলেরই এ বিষয়ে অবহিত হওয়া দরকারঃ যে দেশে ইসলাম ব্যাতীত অন্য কোনও ধর্মের প্রাধান্য সে দেশে হযরত মুহম্মদের ধর্মীয় বিধিবিধান চালু হওয়া সম্ভব নয়। তখন মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে একতাবদ্ধ হওয়া এবং জেহাদ করা। বর্তমান সময়ে এদেশ থেকে হিজরত করা একান্ত কর্তব্য হয়ে পড়েছে। আলেমরা এ বিষয়ে সঠিক ফতোয়ায় দিয়েছেন। এখন যারা এ কাজ করতে নিষেধ করে, মোমেন মুসলমানরা শোনো, তাদের উচিত ভোগাসক্তির দাস হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করা। যারা একবার ইসলামের দেশে চলে যেয়ে আবার ফিরে আসে বিবেক বিসর্জন দিয়ে এবং আর হিজরত করতে অনিচ্ছুক, তাদের জানা উচিত যে, তাদের বিগত সমস্ত পুণ্যফল বিফল হয়ে গেছে। যদি সে এদেশ থেকে হিজরত না করে মারা যায়, তাহলে সে নাজাত ও মুহতিলাভ থেকে বঞ্চিত হবে। এ জামানার মওলবী, পীর ও হাজীদের ইতিহাস পর ও জান; এবং ভেবে দেখ, তাদের মধ্যে কে এদেশ থেকে হিজরত করেছেন এবং বিবেক বিসর্জন দিয়ে ফিরে এসেছেন। কে বাস করছেন কাফেরদের সঙ্গে এবং কেই বা হিজরত বা জেহাদ করতে নিষেধ করছেন”।
যেসব লোক হিজরত করতে কিংবা জেহাদে যোগদান করতে অক্ষম তাদের উপদেশ দেওয়া হতো নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ করতে এবং কাফের শাসকদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না রাখতে। আর এভাবেই সরকারের মধ্যেই অন্য শক্তি সঞ্চয় করে সম্পূর্ণভাবে বিরুদ্ধাচরণ করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। বিধর্মীদের সাহায্য গ্রহণ করা অনুচিত। তাদের আদালত সুদের
ডিক্রি দেয়, অতএব সেগুলো বর্জন করা উচিত। আর মুসলমান ভাইয়ে ভাইয়ে যেসব ঝগড়া- বিবাদ হয়, সেগুলি নেতাদের দ্বারা মীমাংসা করে নেয়া উচিত। হযরত মুহম্মদের আইন হিসেবে এসব অজ্ঞ লোক যা ভাবে, টি প্রয়োগ করে। কারণ আল্লাহ্ কি নির্দেশ করেননি, “আর আল্লাহ্র নামে বলছি, তারা তখন পুনঃবিশ্বাসী হবেনা, যতক্ষণ তোমাকে তাদের বিরোধের বিচারক না করছে, এবং তুমি যা বিচার করে দিবে, তাই গ্রহণ করতে তারা অন্তরে কষ্ট অনুভব না করছে এবং সর্বোতভাবে নির্ভর করে তা মেনে না নিচ্ছে”?
ইনায়েত আলীর সমর্থনে ব্রিটিশ ভারতে ওহাবীদের যে কার্যকলাপ চলেছিল, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া আছে মিঃ র্যাভেন্স কর্তৃক বাংলা সরকারকে প্রদত্ত রিপোর্টের ১৫২ পৃষ্ঠায়। নীচে তার কিছুটা উদ্ধৃতি দেয়া হলঃ
“পাঞ্জাব সরকার ১৮৫২ সালে বিদ্রোহাত্মক চিঠিপত্রের একখানি চিঠি আটক করে ফেলে। তাতে প্রকাশ হয়ে পরে, পার্বত্য অঞ্চলে যেসব হিন্দুস্থানি ধর্মান্ধ থাকতো, তারা কীভাবে রাওইয়ালপিন্ডীতে অবস্থিত ভারতীয় রাজকীয় বাহিনীর চতুর্থ রেজিমেন্ট কে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে প্ররোচিত করেছিল। এই ষড়যন্ত্রের উৎপত্তি হয় পাটনায়। আর যেসব চিঠিপত্র আটক করা হয়, তাতে উল্লেখ ছিল যে, সাদিকপুরের মওলবীরা ও বহু কাফেলা লোক অস্ত্র সজ্জে সজ্জিত হয়ে তখন সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই রকম একখানা স্বাক্ষরহীন ও তারিখবিহীন চিঠি লেখা হয় পেশোয়ার থেকে। তাতে বলা হয়েছিল, মওলবী বিলায়েত আলী এবং আজীমাবাদের মওলবী ইলাহী বখশ সাহেবের পুত্রগন মওলবী ইনায়েত আলী, মওলবী ফয়েজ আলী, মওলবী ইয়াহইয়া আলী এবং দিনাজপুরের মওলবী করম আলী [ তিনি একজন দরজী ছিলেন ] তখন সিত্তানায় অবস্থান করতেন সোয়াতের আকবর বাদশাহের সঙ্গে, এবং তাদের উদ্দেশ্য ছিল সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। এই সৈয়দ আকবর শাহের সম্বন্ধে আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, তিনি ছিলেন সোয়াত উপত্তকার নির্বাচিত শাসক। চিঠিটা লেখা ছিল এই মর্মেঃ আজীমাবাদের মওলবী বিলায়েত আলীর ভাই মওলবী ফরহাত আলী এবং মওলবী ফয়েজ আলী এবং মওলবী ইয়াহয়া আলী ও মওলবী আহমদউল্লাহ তাদের বাড়ীতে ও গ্রামে অন্যান্য লোকের নিকট থেকে চাদা আদায় করতেন এবং অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করতেন। অন্যান্য চিঠিতে জানা যাই, মানুষ ও অস্ত্রাদি পাটনা থেকে মিরাট ও রাওইয়ালপিন্ডির মধ্য দিয়ে চালান দেয়া হতো এসব জায়গায় লোক নিযুক্ত থাকতো সীমান্তে জেহাদের জন্য সেগুলি পৌঁছে দিতে।