পরিশিষ্ট
ওহাবী আন্দলনে’র রূপরেখা
বিশ্বনবীর ওফাতের পর মাত্র আশী বছরের মধ্যে [৬৩২- ৭১২ খৃঃ] পশ্চিমে হিসপানী শেষ, পূর্বে সিন্ধ হিন্দুদেশ’ পর্যন্ত সমকালীন জ্ঞাত পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশী অঞ্চলে আরব সম্রাজ্জের বিস্তৃতি বিশ্ব ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়। চীনদেশের সীমান্ত থেকে অতলান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত সমগ্র ভূ- ভাগ মরুচর যাযাবর আরবজাতির পদানত, পারশে্যর খসরু ও রোমান সীজারের জন- প্রবাদ মুখর সম্রাজ্জ্য শক্তি পর্যুদস্ত এবং বাগদাদে এমন একটি শক্তিধর ও উচ্চধর সংস্কৃতি ধন্য শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যার তুলনা তখনও পৃথিবীতে দেখা যায়নি।
এসব বিজয়- অভিযান ও সাম্রাজ্জ বিস্তৃতির অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ বেশুমার সম্পদসম্ভার ও অগণিত বিদেশী বিলাস সামগ্রী আরবে আমদানী হতে থাকে। কৃপণসভাবার প্রকৃতির মরুদুলালরা অতি শীঘ্রই তাদের সহজ সরল রুক্ষ স্বভাব ত্যাগ করে বিলাস- ব্যসনের শ্রোতে হাবুডুবু খেতে লাগল। ইরানী তন্বী রূপসী বাদী ও সিরাজীর আদর আরবের ঘরে ঘরে দেখা যায়। এসবের বিষময় ফলে মুসলমানের জাতীয় জীবনে যে ব্যাভিচারিতার আমদানি হয়, তার প্রতিচ্ছবি কুটির থেকে শুরু করে দামেস্কের ও বাগদাদের খলীফার রাজ প্রাসাদে অতি বীভৎস রূপে দেখা দেয়। শতাব্দী ধরে বিভিন্ন মুসলিম রাজপরিবারের এসব বিলাস- ব্যসন চলতে থাকায় মুসলমান সমাজের মধ্যে এগুলি যেন গা সওয়া হয়ে যায়। এজন্য দেখা যায়, আঠারো শতকে তুর্কীর সুলতানরা হজ্জের সময় মক্কা ও মদিনায় যেমন মুক্তহস্তে দান করতেন, তেমনি প্রকাশ্য রাজপথে সুরা ও আফিমের সঙ্গে বারবিলাসিনীদেরও শোভাযাত্রা করতেন- কারও শাসনবানীতে এসব সংযত হতো না।
এসব ছাড়াও আরও বহু শরীয়ত বিরুদ্ধ রীতিনীতি মুসলমানের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ঢুকে পরে। নানা দেশ বিজয়ের ফলে নানা জাতি ও নানান ধর্মের সংস্পর্শে মুসলমানরা আসতে বাধ্য হয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশে।
প্রভাব, আন্তর্জাতিক আদান- প্রদানের কারণ এবং বিভিন্ন জাতির নও- মুসলিমদের পূর্ব- পুরুষের আচার নীতি ইসলাম গ্রহনের পরও অনুসরণ করার কারনে মুসলমানের জীবনে এসব বেদাত বা শরীয়ত বিরুদ্ধ আচার নীতি সংক্রমিত হয়েছিল। আর কালক্রমে এসব নয়া রিতি নীতির কয়েকটি মুসলমান সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে একটা ধর্ম সম্মত অনুমোদনও লাভ করেছিল। এরূপ সচল ও সমাজ আচরণীয় হওয়া সম্ভব হয়েছিল ইজমার প্রয়োগে। ইজমার কাজ ছিল, যা প্রথমে বেদাত হিসেবে অধর্মীও হিসেবে বিবেচিত হতো, তাকে সচল ও সমাজ আচরণীয় করে শরীয়ত সম্মত করা। অতএব ইজমার সহজ অর্থ হচ্ছে যে, যা কিছু মুসলমানদের মধ্যে শাস্ত্রকারদের অনুমোদনে বা বিনা আপত্তিতে গৃহীত হয়েছে, সেগুলি কুরআন ও হাদিসের পরেই ইসলামী বিধি নিষেধ হিসেবে গৃহীত হয়। ইজমার দরকার হয়েছিল, অমুসলমানদের সাহচার্যে যেসব নয়া রীতিনীতি মুসলমানদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল, খাঁটি শরীয়ত পন্থী না হলেও সেগুলিকে মুসলমানদের মধ্যে খাপ খাইয়ে নেওয়ার দরুন শরীয়তি অনুমদন দেওয়া। উদাহরণ হিসেবে পীরপুজা ও পীর মতবাদের আনুষঙ্গিক সকল রকম রেওয়াজের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এখানে একথাও অবশ্যস্বীকার্য, ইজমার বেনামীতে কত বেদাত অনাচার ইসলামে প্রবেশাধিকার পেয়েছে হিসেব করাও একটা শক্ত ব্যাপার।
এসবের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সাবধান বাণী ঝংকৃত হয়েছিল তের- চৌদ্দ শতকে ইবনে তাইমিয়ার [৬৬১ হিজরি/ ১২৬৩ খ্রিঃ- ৭২৮ হিজরি/ ১৩২৮খ্রি] কণ্ঠে। ইসালামি অনুশাসনে ইজমার প্রয়োগ নিষেধ করে তিনি প্রচার করেন যে, কুরআনের বিধি ব্যাবস্থা আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং তার বাধ্য করতে হলে কুরআনেরই আশ্রয় নিতে হবে। হামবলী মজহাবের একনিষ্ঠ অনুসারী ইবনে তাইমিয়া যাবতীয় বেদাতের বিরুদ্ধে ফতওয়া দান করেন এবিং পীরবাদ ও তার আনুষঙ্গিক সব অনুষ্ঠানকে নিছক পৌত্তলিকতা বলে ঘোষণা দেন। ইসলামে ‘পিউরিটানিক’ বা অতিনৈতিক মতবাদের গোড়াপত্তন হয় ইবনে তাইমিয়ার শিক্ষা থেকেই।
অতঃপর আঠারো শতকে আরেক ধর্মসংস্কারকের আবির্ভাব হয়, তার নাম মুহম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব। উল্লেখ্য যে, এই চার শতাব্দীর ব্যাবধানে ইসলামে আয়ত্তে বহু বেদাতের এবং নানা অনাচারের প্রবেশালাভ হয়। হাজীদের মধ্যেও নানা গর্হিত আচরন এবং পবিত্র মক্কা ও মদিনা শহরে বহু নাটকীয় ধরনের পূজা পদ্ধতির প্রাদুর্ভাব ঘটে। তুর্কী ও ইরানীর বদৌলতে ইসলামে বহু সংস্কার ও আবর্জনা জমে উঠে। তারা বাদীড় বেনামিতে অসংখ্য রমণীয় সাহচর্যেই পরিতিপ্ত হতোনা, প্রকাশ্যে বারবিলাসিনী ও নৃত্যবাদ্যকুশলা রমণী নিয়ে মাতামাতি করতো, সুরা ও আফিমের প্রভাবে রাজপথেই মাতলামি করতো এবং আরও বহু নীতি ও রুচি বিগর্হিত পাপ কর্মে লিপ্ত থাকতো। এসব অনাচার, ব্যাভিচারের মূলোচ্ছেদ করাই ছিল আবদুল ওহহাবের জীবনব্যাপী সাধনা। এবং তার এই ভূমিকাকেই তার দুশমনরা, বিশেষত ইউরোপীয়রা ওহাবী আন্দোলন নামে চিহ্নিত করেছে। তবে তার আন্দোলনের শেষ পরিণতি অনুধাবন করলে দেখা যায় যে, মূলতঃ ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হলেও বিশ শতকে এর দ্বারাই আরবী ন্যাশনালিযম পুর্ণভাবে দানা বেঁধে উঠেছিল। ইসলামের প্রথম যুগের মতো আবদুল ওহহাবও চেয়েছিলেন, সবরকম পৌত্তলিক অনাচারের মূলোৎপাটন করে খাটি তাওহীদ বানীর মহমা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। এবং আরবের সবরকম রাষ্ট্রনৈতিক গোলযোগের অবসান ঘটিয়ে শুধু ইসলামী সাম্য ও মৈত্রী নীতির সূত্রে সমগ্র আরবভূমিকে এক রাষ্ট্রে বেঁধে দিতে।
আবদুল ওহাবের এই দ্বিবিধ ভূমিকার আলোচনা পৃথকভাবে করাই প্রশস্ত।
প্রথমে মুহম্মদ ইবনে আবদুল ওহহাবের চরিতালোচনা করা যাক। সম্ভবত ১১১৫ হিজরিতে [১৭০৩ খ্রিঃ] আরবের উয়াইনা অঞ্চলে তামিম গোত্রের একটি শাথা বানু- সিনান বংশে তার জন্ম হয়। মদিনায় সুলায়মান অল কুর্দি ও মুহম্মদ হায়াত অল সিন্ধির নিকট তিনি শিক্ষালাভ করেন। তার জীবনের অধিককাল দেশভ্রমণে কেটেছে। প্রথমে তিনি চার বছর বসরার কাযী হুসেনের বাড়ীতে গৃহশিক্ষক ছিলেন। পরে পাঁচ বছর তিনি বাগদাদে বসবাস করেন এবং সেখানকার জনৈকা ধনবতী বিধবাকে শাদী করেন। এ স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি পুনরায় পথে বের হন এবং এক বছর কুর্দিস্থানে ও দু বছর হামাদানে অবস্থান করার পর ইসপাহানে উপস্থিত হন। তখন নাদির শাহের শাসন শুরু হয়েছে [ ১১৪৮ হিঃ, ১৭৩৬ খ্রিঃ]। এখানে তিনি চার বছর অবস্থান করেন এবং এরিস্টটলের দর্শন ও সুফীতত্তে উচ্চজ্ঞান লাভ করেন। এক বছর তিনি সুফী- মতবাদে বহু ছাত্রকে শিক্ষা দান করেন। পরে তিনি কুম শহরে গমন করেন এবং হামমবলী মজহাবের একজন গোঁড়া সমর্থক হন। শেষে তিনি জন্মভূমিতে অত্যাগমন করেন এবং প্রকাশ্যে নিজের মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। ‘কিতাব- অল- তাওহীদে’ তার বিশেষ মতবাদগুলি বিধৃত আছে। তার অনুগামীর দল বর্ধিত হলেও তার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন আরম্ভ হয়। এমনকি তার সহোদর ভ্রাতা সুলায়মান তাকে আক্রমন করে একটি পুস্তিকা প্রচার করেন। তাকে কেন্দ্র করে বিবাদ ও রক্তপাত হওয়ায় স্থানীয় শাসক তাকে বহিষ্কার করেন। তখন তিনি সপরিবারে দারিয়াপল্লীতে উপস্থিত হন। দারিয়ার আমির মুহম্মদ ইবনে সউদ তাকে আদরের সঙ্গে গ্রহণ করেন ও তার নিকট দীক্ষা নিয়ে তার মতবাদ প্রচারে উৎসাহী হয়ে উঠেন।
শীঘ্রই আবদুল ওহহাবের প্রচারনা রাজনৈতিক রূপ গ্রহণ করে এবং রাষ্ট্রীয় অগ্রগতি ইসলামের প্রথম যুগের রাজ্য- বিস্তারের মতোই বিস্ময়কর হয়ে উঠে। ইবনে সউদের নেতৃত্বে একটা শক্তিশালী আরবলীগ গঠিত হয়, এবং দারিয়াকে কেন্দ্র করে সউদী অধিকার বর্ধিত হতে থাকে। ‘কিতাব- অল- তাওহীদের’ শিক্ষাদানের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রের শিক্ষাদানও চলতে থাকে। ফলে রিয়াদের শেখের সঙ্গে ১৭৪৭ সালে সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। এ সংঘর্ষ চলে প্রায় আটাশ বছর ধরে এবং ইবন সউদ ও তার মৃত্যুর পর [ ১৭৬৫ খ্রিঃ] তার সুযোগ্য পুত্র আবদুল আযীয ইঞ্চি ইঞ্চি করে সমগ্র রিয়াদ অধিকার করেন। ১৭৬৬ সালে আবদুল ওহহাব মক্কা শরীফের নিকট একজন প্রতিনিধি প্রেরন করে নিজের মতবাদ গ্রহণ করতে আহ্বান করেন। মক্কার শরীফ আবদুল ওহহাবের মতবাদ ইমাম হামবলের মজহাবের মতানুসারী বিবেচনা করে সেসব শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রচারের নির্দেশ দেন। কিন্তু ১৭৩৩ সালে রিয়াদের শাসক দাহহাম আবদুল ওহহাবের তীব্র প্রতিবাদ করে, কিন্তু আবদুল আযীযের নিকট পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। দলে দলে বেদুইনরা আবদুল ওহহাবের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে যুদ্ধের পর যুদ্ধে তার শিরেই বিজয়মাল্য শোভিত হয়। উত্তরে কাসিম থেকে দক্ষিণে খরজ পর্যন্ত সমগ্র নেজদ ভূমিতে আবদুল আজীজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে আবদুল ওহহাব ১৭৮৭ খৃষ্টাব্দে জান্নাতবাসী হন।
আবদুল আজীজ ও তার পুত্র সউদ অমিত বিক্রমে অভিযান চালাতে থাকেন। ১৭৯১ সালে মক্কায় হামলা চালানো হয়, ইরাকের নানাস্থানে বার বার অভিযান চলতে থাকে। তুর্কী সুলতান নতুন শক্তির অভ্যুদয়ে সংকিত হয়ে বাগদাদের পাশাকে নির্দেশ দেন, আর প্রশ্রয় না দিয়ে নবজাগ্রত সক্তিকে ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু ১৭৯৭ সালে বাগদাদের পাশা উদের হাতে বিশেষভাবে লাঞ্চিত হন এবং এশিয়াস্থ সমগ্র তুর্কী অধিকার সউদের হাতে চলে যায়। ১৮০৩ সালে গালিব মক্কা থেকে পলায়ন করেন এবং সউদ সদলবলে তথায় প্রবেশ করেন। সাময়িকভাবে সউদের বাহিনী মক্কা থেকে বহিষ্কৃত হয়; কিন্তু তিনি নতুন বিক্রমে পুনরায় হেজাজ আক্রমেন এবং ১৮০৪ সালে মদিনা, ১৮০৬ সালে মক্কা ও পরে জেদ্দা সম্পূর্ণভাবে দখল করেন। পরবর্তী কয়েক বছরে সমগ্র জাজিরাতুল আরব তার পদানত হল। ১৮১১ সালে ওহাবী সম্রাজ্জ উত্তরে আলেপ্প থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত এবং পারশ্য উপসাগর অ ইরাক সীমান্তের পরবর্তী পূর্বে লোহিত সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
সউদের বেদুইন বাহিনীর বিরুদ্ধে এই সময় সমগ্র ইসলাম জগতে তীব্র আন্দোলন চলতে থাকে এবং এ আন্দোলনের প্রায় সমস্ত টুকু তুর্কীরা অ তাদের ইউরোপীয়র বন্ধুরা চালতে থাকে। তুর্কী সম্রাজ্জের অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ লক্ষ্য করেই এই বিরুদ্ধ আন্দোলন এবং আলোড়ন, ক্ষোভ অ আতংক সৃষ্টি করা হয়েছিল। প্রচার করা হয়েছিল যে, ইসলামের কেন্দ্রস্থল পুন্যময় মক্কা অ মদিনা শহর দুটির অধিবাসী আবদুল ওহহাবের মতবাদ গ্রহন করতে অস্বীকার করলে নির্মম ভাবে নিহত হয়েছিল, সমস্ত মাজার ও মকবেরা উৎখাত করা হয়েছিল; এমনকি হযরত মুহম্মদের রওজা মোবারকও রেহাই পায়নি। ১৮০২ সালে কারবালা দখল করে সউদি বেদুইনরা সমস্ত মাজার ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং অধিবাসীদের হত্যা করেছিল। মসজিদে মসজিদে যেসব কারকার্য ছিল ও বহুমূল্যবান জিনিস শোভাবর্ধন করত, সেসবই বিলুপ্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছিল। দীর্ঘ এগারো শতাব্দী ধরে নানা দেশ থেকে মুসলিম সুলতান, বাদশাহ ও ভক্তবৃন্দ স্বদেশের জন্য যেসব বহুমূল্য ও দুষ্প্রাপ্য উপঢৌকন ভক্তির নিদর্শন হিসেবে পাঠিয়েছিলেন, সে সমস্তই মরুবাসী বেদুইনরা লুণ্ঠিত ও হস্তগত করেছিল।
আবদুল ওহহাবের অনুসারীদের এসব কাজ দারুণ মহাপাপ হিসেবে গণ্য হতে থাকে সারা মুসলিম জগতে; তাদের বিরুদ্ধে রোষ ও ক্ষোভ পূঞ্জীভূত হয়ে তারা মুসলিম জাহানের আতংক হয়ে উঠে। তুর্কীর সুলতান কাবাশরীফ ও মক্কা মদিনার রক্ষক হিসেবে ‘ওহাবীদলনে’ অগ্রসর হন- সারা মুসলিম জাহান তার স্বপক্ষে দন্ডায়মান হয়। মিসরের পাশা মুহম্মদ আলির উপর ‘ওহাবী’ ধ্বংসের ভার অর্পিত হয়। তিনি ইউরোপীয় প্রণালীতে সুশিক্ষিত সৈন্য পুত্র তুসুনকে প্রেরণ করেন হেজাজ অধিকার করতে। ১৮১২ সালে মদিনা ও ১৮১৩ সালে মক্কা মিসর বাহিনী দখল করে। মুহম্মদ আলি স্বয়ং ১৮১৩ সালে মিসরবাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহন করেন। ১৮১৪ সালের পহেলা মে সউদ ইন্তেকাল করেন। তার পুত্র আবদুল্লাহ তত সাহসী বীর ছিলেন না। তিনি তুসুনের সঙ্গে সন্ধি করেন এই শর্তে যে, তিনি অটোমান সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করবেন ও মিসরবাহিনী নেজদ ত্যাগ করে যাবে। কিন্তু মুহম্মদ আলি এ সন্ধি ভঙ্গ করে ১৮১৬ সালে পুনরায় নেজাদ আক্রমণ করতে প্রেরণ করেছিলেন ইবরাহিম পাশাকে। ইবরাহিম তীব্র যুদ্ধের পর ১৮১৮ সালের মে মাসে উপস্থিত হন দারিয়ায় এবং সেপ্টেম্বর মাসে রাজধানীটি ভূমিসাৎ করেন। আবদুলাহ বন্দী হয়ে কনস্টান্টিনোপলে প্রেরিত হন, সেখানে সাধারন অপরাধীর ন্যায় তার শিরচ্ছেদ করা হয়। আরবের মরীচিকার মতোই সহসা চক্ষু ঝলসিয়ে দিয়ে ‘ওহাবীদের’ বিশাল সম্রাজ্জ ক্ষাত্র শক্তি কোথায় যে মিলিয়ে গেল- তার কোনও অস্তিত্বই রইল না।
কিন্তু আরব জাতীয়তা- জ্ঞানের যে দীপশিখা আবদুল ওহহাব ও ইবনে সউদ প্রজ্বলিত করেছিলেন, তা ছিল অনির্বান এবং পরবর্তী এক শতাব্দী ধরে সঞ্জীবিত করে রেখেছিল সমগ্র আরব উপদ্বীপটিকে তুর্কী সাম্রাজ্জিক শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে। শেষে বিশ শতকের প্রথম পাদে ১৯০৪ সালে আবদুল আযীয ইবনে আব্দুর রহমান সম্পূর্ণভাবে নেজাদের তাবৎ অংশে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন, যা তার পিতামহ একদা নিরংকুশ ভাবে অধিকার করেছিলেন। পরবর্তী দুই দশক ব্যাপী ক্রমাগত যুদ্ধ- বিগ্রহে তিনি ও তার পুত্র ইবনে সউদ সমগ্র হেজাজ দখল করেন- ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে মক্কা, ১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মদিনা ও জেদ্দা অধিকৃত হয়। এভাবে প্রায় সমগ্র জাজিরাতুল আরব [ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমিরী অধিকার ব্যাতীত] ‘সউদী আরব’ নামাংকিত আরবী জাতীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, আবদুল ওহহাবের আরব জাতীয়তা জ্ঞান মধ্যপ্রাচ্যের আরবী ভাষাভাষী দেশগুলিকে এভাবে সন্দীপিত করে তুলেছিল যে, এক এক করে যুক্তমিসর গনরাস্ট্র, জর্দান, সিরিয়া, ইরাক প্রভৃতি স্বাধীন সার্বভউম রাষ্ট্রগুলি পৃথিবীর মানচিত্রে গৌরবময় স্থান অধিকার করে নিয়াছে।
আবদুল ওহহাবের ধর্মীয় শিক্ষা ও মতবাদের আলোচনায় প্রথমেই বলে রাখা ভাল, আরবদেশে ‘ওহাবী’ নামাংকিত কোনও মজহাব বা তরিকার অস্তিত্ব নেই। এ সংজ্ঞাটির প্রচলন আরব দেশের বাইরে এবং মতানুসারীদের দুশমন, বিশেষত তুর্কী ও ইউরোপীয়দের দ্বারা ‘ওহাবী’ কথাটির সৃষ্টি এবং তাদের মধ্যেই প্রচলিত। কোনও কোনও ইউরোপীয় লেখক, যেমন নীবর আবদুল ওহাবকে পয়গম্বর বলেছেন। এসব উদ্ভট চিন্তারও কোনও যুক্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে তিনি কোনও মজহাব সৃষ্টি করেন নি, চার ইমামের অন্যতম ইমাম হামমবলের মতানুসারী ছিলেন তিনি, এবং তার প্রযত্ন ছিল বিশ্বনবীর ও খুলাফায়ে রাসেদীনের আমলে ইসলামের যে রূপ ছিল, সেই আদিম সহজ সরল ইসলামের প্রত্যাবর্তন করা। তার আরও শিক্ষা ছিল যে, ধর্ম কোনও শ্রেণীবিশেষের একাধিকার নয়, কোনও যুগবিশেষের মধ্যেই সীমিত নয়- প্রত্যেক ‘আলিম’ বা শিক্ষিত ব্যাক্তির অধিকার আছে কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা দেওয়ার। তার শিক্ষা ও মতবাদ প্রধানত ইবনে তাইমিয়া ও তার শিষ্যদের বিভিন্ন পুঁথিতে বিধৃত মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত, যদিও আবদুল ওহহাব অনেক বিষয়ে তাদের সঙ্গে একমত নন।
বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদের শিক্ষানুসারী আবদুল ওহহাব মরণের পর প্রত্যেক জীবের পুরষ্কার না হয় শাস্তিলাভের দিকে বিশেষ জোর দেন এবং আল্লাহর বিচার দিনে তওবার উপর অকুন্ঠ নির্ভর করতে বলেন। তিনি নামায ও রোজার দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন এবং এ দুটির অমান্যকারীকে কখনও ক্ষমা করতেন না। যাবতীয় ধর্মীয় বিধিনিষেধ অনন্যমনে পালন করার প্রতিও তিনি খুবিই জোর দিতেন। সংক্ষেপে তার শিক্ষার মূলমন্ত্র ছিল আল্লাহর প্রতি এবং একমাত্র আল্লাহর প্রতিই অকুন্ঠ নির্ভর ও একান্ত বিশ্বাস এবং এজন্য চায় কঠোর সংযমের সঙ্গে জীবনযাপন। খাওয়া- পরায়, পোশাকে সাসারিক জীবনের সর্বস্তরে বিলাসিতা ও সৌখিনতা একেবারে নিষিদ্ধ হয় এবং সুরা অয়াফিম বিষবত পরিত্যাক্ত হয়। তার শিক্ষাসমূহ কালক্রমে একটা ধারাবাহিক রূপ গ্রহন করে এবং তার বিরুদ্ধবাদীরা সেটিকেই ‘ওহাবী’ অপভ্রংশে প্রচারিত করে।
আবদুল ওহহাবের শিক্ষাসমূহ ‘কিতাব আল তাওহীদে’ বিশদভাবে বিধৃত হয়েছে এবং সংক্ষেপে সেগুলি এইঃ
১: আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত বা আরাধনা পাপ এবং যারাই অন্য কারও উপাসনা করে, তারা বধার্হ।
২; অধিকাংশ মানুষই তাওহীদ বা একেশ্বরবাদী নয়, তারা অলি বা সন্তদের মাজারে গমন করে ও আশীস প্রার্থনা করে; তাদের এসব আচার কুরআনে বর্নিত ‘মক্কার মুসরেকিনদের’ মত।
৩: ইবাদাতকালে নবী, ওলী, ফেরেশতাদের নাম গ্রহন করে প্রার্থনা করা ‘শিরক’ বা বহু দেবার্চনার মতোই নিন্দনীয়।
৪: আল্লাহ ব্যাতীত অন্য কারও মদ্ধবর্তিতার আশ্রয় গ্রহন করা শিরক মাত্র।
৫: আল্লাহ ব্যাতীত অন্য কারও নিকট উৎসর্গ বা মানত করা শিরক মাত্র।
৬: কুরআন, হাদীস এবং যুক্তির সহজ ও অবশ্যম্ভাবী নির্দেশ ব্যাতীত অন্য জ্ঞানের আশ্রয় করা কুফর বা অবিশ্বাস মাত্র।
৭: কদর বা আল্লাহর অমোঘ বিধানে সন্দেহ প্রকাশ বা অবিশ্বাস করা ধর্মবিরুদ্ধতা [ ইলহাদ]।
৮: কুরআনের ‘তা’ বিল বা উপাদানগত ব্যাখ্যাদান ধর্মবিরুদ্ধতা।
ইবনে হামবল থেকে আবদুল ওহহাবের বিরুদ্ধ মতবাদ নিম্নলিখত বিষয়ে সুস্পষ্টঃ
১: জামাতে নামাজ আদায় করা অবশ্যকর্তব্য।
২: তামাক সেবন নিষিদ্ধ এবং এরূপ অপরাধে চল্লিশের অনধিক বেত্রদন্ড যথেষ্ট। দাড়ী কামানো প গালি দেওয়ার শাস্তি কাযীর ইচ্ছানুযায়ী।
৩: অপ্রকাশ্য মুনাফার, যেমন ব্যাবসায়িক মুনাফার উপর জাকাত দিতে হবে। ইমাম হামবল মাত্র প্রকাশ্য মুনাফার উপর যাকাত দিতে বলেছিলেন।
৪: কেবলমাত্র কালেমার উচ্চারণই মোমেন বা বিশ্বাসী হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়, যাতে তার জবেহ বা জীব হালাল হতে পারে। তার চরিত্র নিখুত কিনা, তারও অনুসন্ধান করা উচিত।
আবদুল ওহহাবের অনুসারীদের মদ্ধে এসব প্রথার প্রচলন দেখা যায়ঃ তসবিহ গননার নিষেধ, কারন এ আচরণটি বৌদ্ধদের নিকট থেকে নেওয়া। তার বদলে আঙ্গুলের গিঁঠে গিঁঠে আল্লাহর নাম গণনা করা উচিত। মসজিদে, মাজারে যেসব নকশার কাজ ছিল সেসব তুলে ফেলা হয়েছে। তুর্কীদের প্রবর্তিত মিনারও সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তার বদলে অতি সাধারন ও অলংকারশূণ্য মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। ‘রওয়াত- অল- আফফার’ গ্রন্থে আবদুল ওহহাবের সময়ে কতকগুলি রেওয়াজ মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত থাকার উল্লেখ আছে, সেগুলি পৌত্তলিক বা প্যাগান- রীতির অনুসরনমাত্র। যেমন কবরে ফুল দেওয়া, দীপ জ্বালানো, খাবার দেওয়া, বৃক্ষ পূজা করা। বলা বাহুল্য, এসব আচার- রেওয়াজ একেবারে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে সুন্নাহ পরিত্যাগ করার অপবাদ একেবারে ভিত্তিহীন। তবে তিনি আবু হোরায়রা বর্ণিত বহু হাদীসে সন্দেহ করতেন এবং মিলাদুন- নবীর জনসমাবেশ করে সীরাতুন নবীর প্রচলিত উৎসব বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে মুতাকাল্লামুনদের গ্রন্থাদির বহুতসব করার অপবাদও ভিত্তিহীন। কিন্তু মাজারে- মকবেরায় সমস্ত সমাধিসৌধ অ অলংকরণ নষ্ট করে দিতে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন। জুবাইলার জায়েদ- বিন- খাত্তাবের কবরের উপর নির্মিত সমাধিসৌধ তিনি নিজে ধ্বংস করেছিলেন এবং বর্তমানকালে তার অনুসারীরা, মদিনায় অলবাকী অঞ্চলে এ কাজ করেছে ব্যাপকভাবে।
আবদুল ওহহাবের শিক্ষাসমূহ নিরাসক্তভাবে অনুধাবন করলে মনে হয়, যেসব বেদাত শিরক অ কুফরের প্রশ্রয় দেয় এবং ইলহাদ বা ধর্মবিরুদ্ধ , সেসবের উতখাতকরনে তিনি বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। আল্লাহর তাওহীদ জ্ঞানে এতোটুকু অন্যভাবে অ অনুভূতির প্রশ্রয় দেওয়া তার স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল। তার মৌল শিক্ষায় ছিল লা- শরীফ আল্লাহয় একান্ত অ অকুণ্ঠ নির্ভর এবং স্রষ্টা অ মানুষের মধ্যে যাবতীয় মধ্যস্থতার অস্তিত্ব বা চিন্তার বিলোপ সাধন- ওলী ও পীরদের প্রতি মুসলমানের পূজা, এমনকি হযরত মুহম্মদেরও আধা ঐশ্বরিক রূপকল্পনার বিলোপসাধন। কবরে সৌধ নির্মাণ তার মতে পৌত্তলিকদের শেষ চিহ্ন মাত্র, এজন্য সেসব ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, যাতে মুসলমানরা সেগুলিকে ভক্তিস্রদ্ধা দেখাতে বা সেখানে গিয়ে নিজের মঙ্গলকামনা করতে না পারে। কারন এরূপ মনোবৃত্তিই হল শিরক ও কুফরীর নামান্তর মাত্র। এই বিশ্বাসে চালিত হয়েই উনিশ শতকের প্রথম দশকে কারবালা, মদিনা ও মক্কার মাজার- মকবেরা উৎখাত করা হয়েছিল এবং সৌধ ও মিনারগুলি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। যেমন হয়েছিল ১৯২৫- ২৬ সালে বর্তমান সউদী সাসন কর্তৃপক্ষের আমলে।
আবদুল ওহহাব ছিলেন ইজতেহাদের প্রধান সমর্থক। কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা বা নির্দেশের প্রত্যক্ষ বিপরীত বা পরিপন্থী না হলে যুগ ও পরিবেশের কারনোদ্ভুত সমস্যার সমাধান ইজতেহাদের বলে হওয়া উচিত। এ প্রত্যয়ে তিনি সুদৃঢ় ছিলেন। এবং তার মতানুসারী বর্তমান সউদী আরবের শাসন কর্তৃপক্ষও এ প্রত্যয়ে আস্থাবান। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, বর্তমান কালের ব্যাবসা- বাণিজ্যিক প্রসার ও মালামাল চলাচলের বিভিন্ন উপায় উদ্ভূত হওয়ায় মালামাল ইনসিউর করার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যস্বীকার্য। আবদুল ওহহাবের একান্ত পাওবন্দ রাজা আব্দুল আজীজ কাণ্ডজ্ঞানের অনুসারী হয়ে ইনসিউর করার প্রয়োজনীয়তা সম্যক অনুধাবন করেন এবং মক্কার বর্তমান মুফতী বিপক্ষতা করলেও ইনসিউর নীতি গ্রহণ করেছেন।
বর্তমান যুগে ধর্ম ও বিজ্ঞানের ঘাত- প্রতিঘাত শিক্ষিত মনকে অহরহ আলোড়িত করছে, এবং এ দুটির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানে জ্ঞানদীপ্ত মনে চিন্তার উদয়ে অন্ত নেই। নেজাদী উলেমা সম্প্রদায় দর্শন ও তর্কশাস্ত্রের শিক্ষা নিষেধ করেন, আরও করেন জ্যেতিস সাস্ত্রের বিবিধ শিক্ষা- তার মধ্যে পৃথিবীর ঘূর্ণন নীতিও একটি। তারা সঙ্গীত ও চিত্রকলায় শিক্ষা দানও নিষেধ করেন, এবং এ সম্বন্ধে হাদীসের বাণীকে চূড়ান্ত হিসেবে মত পোষণ করেন। তবে অনেকে বর্তমানকালের ফটোগ্রাফির সম্বন্ধে উদার মত পোষণ করেন। নেজাদী উলেমা বৈজ্ঞানিক বিষয়কে- তা সে যতই নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠিত হোক না- কুরআন ও হাদিসের শিখার অনুগামী হিসেবে গ্রহণ করেন। এক কথায়, নেজাদীরা শিক্ষাকে গোঁড়া ভাবেই গ্রহণ করে থাকেন, এবং এ সম্বন্ধে কোন যুক্তিতর্ক ও শিথিল মনোভাব সহ্য করতে প্রস্তুত নন। মনে রাখা উচিত, আবদুল ওহহাব ধর্মীয় বিষয়ে কঠিন অনমনীয় নীতি অনুসরণ করতেন।
উনিশ শতকে আবদুল ওহহাবের মতানুসারীদের রাষ্ট্রিক প্রচেষ্টা অকৃতকার্য এবং রাজশক্তি নষ্ট হয়ে গেলেও তার পিউরিটানিক সংস্কারধর্মী আন্দোলন বেচে থাকলো। ইসলাম প্রচারের পূর্ব জাহেলী জামানায় যেমন যুগ যুগ সঞ্চিত অনাচার, কুসংস্কার ও অধর্মের আবর্তে পরে মানুষ দিগভ্রস্ট হয়ে পড়েছিল, সেই রকম আবদুল ওহহাবের দৃষ্টিতে মুসলমানরা গোমরাহীর পথে এত বেশী অগ্রসর হয়েছিলেন যে, তারা আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে ব্যাবধান সৃষ্টি করে ফেলেছিল- তার ফলে তাদের ঈমান ও আমান দুইই বরবাদ হতে বসেছিল। নয়ারুপে ইসলামী প্রাণধারায় তার আন্দোলন মুসলমানদের অন্তরমন ভরিয়ে দিয়েছিল, সেজন্য তার আন্দোলনের রাজশক্তি নষ্ট হয়েও তার শিক্ষার মহিমা দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল- মিসর, তুরান, ইরান, পাকভারত, এমনকি জাভা- মালয়াতেও তার শিক্ষার বাণী আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিল।
পাকভারত উপমহাদেশে আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্থে মুসলমানদের ভাগ্যবিপর্যয় শুরু হয়েছিল। সাড়ে পাঁচশো বছর ধরে এদেশটার শাসন দন্ড একচ্ছত্রভাবে পরিচালনা করলেও তাদের রাষ্ট্রিক নিরাপত্তা নিরংকুশ হয়নি। প্রতিবেশী হিন্দুজাতি বিদেশী বণিকজাতি ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করে এদেশটার শাসন কার্য থেকেই মুসলমানদের বঞ্চিত করেনি, তাদের আর্থিক, ধর্মীয়, সামাজিক, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিপর্যয়েরও সূচনা করেছিল। এক কথায়, মুসলমানদের ঈমান ও আমান নিরংকুশ করে শত শত বছর ধরে বহির্বিশ্বে যে পাকভারত ছিল দারুল ইসলাম নামে পরিচিত, সেখানে বিধাতার অভিশাপ হিসেবে তার শিরে উদ্যত হয়েছিল বিদেশী শাসকের অত্যাচার ও ক্ষয়ক্ষতির দুঃখের বোঝা। সংক্ষেপে বলতে হয়, ১৭৫৭ এর পর পাক- ভারতীয় মুসলমানের ভাগ্যে সূচিত হয়েছিল ঘনতমসাবৃত পতন যুগ।
কিন্তু এ উপমহাদেশের মুসলমানরা অসহায় ক্লীবের মত ভাগ্যের এই বিপর্যয় মেনে নেয়নি নির্বিকারভাবে। তারা পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করেছিল যে, দিল্লীর মুঘল বাদশাহীর নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে। মারাঠারা ‘হিন্দু- পাদ- পাদশাহী’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমগ্র ভারতে ‘এক ধর্ম পাশে’ বেধে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশে পলাশীর প্রান্তরে জয়লাভ করে বিদেশী বেনিয়ার জাত ইংরেজরা সারা উপমহাদেশের রাজদন্ড অধিকার করার জন্য লোলুপ্ত হাত প্রসারিত করছে এবং পাঞ্জাবে শিখ সম্প্রদায় ও নতুন রাজ্জস্থাপনের আশায় মেতেছে। ১৮০৩ সালে দিল্লী অধিকার করে ইংরেজরা বিশা পাকভারতের বিভিন্ন অংশ নিজেদের নিরঙ্কুশ দখলে আনয়ন করায় ব্যাস্ত হয়ে উঠেছে, বিশাল জমিদারীর ছিটমহলগুলোকে শায়েস্তা করে করায়ত্ত করার মতোই উদ্যম উৎসাহ নিয়ে। মুসলমানের তখন মোহ ভেঙে গেছে যে, তার আর শাহী বাদশাহী তো নেই-ই, তার ঈমান- আমানও সংশয়িত হয়ে উঠেছে।
মুসলমানের এই আত্মসচেতনতা জাগ্রত হওয়ার ফলে তার পরবর্তী জীবনও আবর্তিত হয়েছে দ্বিমুখী সংগ্রামে সংস্কার আন্দোলনে। তার ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে সংস্কার সাধন কর তাকে যেমন খাঁটি মুসলমানে রূপান্তর করে সংহতি আনয়নের সাধনা করা হয়েছে, তেমনি ক্ষাত্র শক্তির আশ্রয় নিয়ে এ উপমহাদেশে পুনরায় ইসলামী শাসন প্রবর্তিত ও প্রতিষ্ঠিত করে এটিকে দারুল ইসলামে কায়েম করে তার ঈমান- আমানও নিঃসংশয় করবার রক্তক্ষয়ী মরণপণ সাধনা চলছে।
প্রথমেই সশস্ত্র জেহাদী আন্দোলনের কথা আলোচনা করা প্রশস্ত। কারন এটাই ছিল বাহ্যত সবচেয়ে তীব্র ও পরিচালন ও পরিণাম ছিল পাক- ভারতীয় মুসলমানদের ভাগ্যাকাশ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি অর্থপুর্ন।
নিঃসন্দেহে মুসলমানের এ বোধ, এ উপলব্ধি প্রথম থেকেই জন্মেছিল, ইংরেজ ক্রমশ সমগ্র পাক- ভারত দখল করে ফেলবে এবং নিরংকুশ সম্রাজ্জের প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র হিন্দুস্থানবাসিকেই স্বদেশে পরাধীন গোলামের জাতিতে পরিণত করবে। কিন্তু সমকালীন সমস্ত আলেম ও ধর্মনেতার মধ্যে দিল্লীর শাহ আব্দুল আজিজই উনিশ শতকের প্রথম ভাগে প্রকাশ্যে ফতোয়া জারি করেনঃ বিদেশীর শাসনাধীন হিন্দুস্থান হচ্ছে দারুল হরব, যেখানে জেহাদ করা বা বিধর্মী অত্যাচারের হাত থেকে যেখান থেকে হিজরত করাই খাঁটি মুসলমানের পক্ষে ফরজ। এই উপলব্ধির দরুনই মুসলমানরা বারে বারে বিক্ষোভ, বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে ইংরেজ শক্তির উপর। ১৭৫৭ এর পর পুরো একশতকেরও বেশি এই বিদ্রোহের অনলে দেশটিকে রাঙিয়ে রেখেছিল মুসলমানরা। এবং তারিই চরম বিস্ফোরণরূপে দেখা দিয়েছিল ১৮৫৭ সালের সারা দেশব্যাপী বিপ্লবের বহ্নিবন্যা। কিন্তু তার পরও ছিল ১৮৬৪ সালের সীমান্ত অভিযান। পাবনা ও রংপুরের ১৭৬৫ সালের ফকির বিদ্রোহ দিয়ে এ সংগ্রাম অধ্যায়ের ভূমিকা; মাঝখানে তিতুমীরের বিদ্রোহ, হাজী শরীয়তুল্লাহ ও তার পুত্র দুদু মিয়ার আন্দোলন; সৈয়দ আহমদের শহীদের অভ্যুদয় ও বালাকোটের যুদ্ধ; পাটনায় শাহ্ ইনায়েত আলী ও শাহ্ বেলায়েত আলীর সংগঠন ও কার্যকলাপ;সিত্তানা, মূলকা, পঞ্জতরের ঘটনাসমূহে প্রভৃতি দিয়ে এর বিস্তৃতি। এবং ১৮৬৪ সালের সীমান্তের অভিযান ও সর্বসেস পাটনা, আম্বালার ষড়যন্ত্র মামলায় সে সশস্ত্র সংগ্রাম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি।
উনিশ শতকের তৃতীয় পাদ পর্যন্ত মুসলমানদের উদ্যম উৎসাহের মূলকথা হচ্ছে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ বা সশস্ত্র বিদ্রোহ। সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে যে জেহাদি সংগঠন হয়, তার প্রথম আক্রমন উদ্যত হয় উদ্ধত ও অত্যাচারী শিখদের বিরুদ্ধে। শিখেরা রণজিৎ সিংহ এর নেতৃত্বে পাঞ্জাবে একটা শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে মুসলমানদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করেছিল; এমনকি আযান দেওয়া পর্যন্ত বান্ধ করে দিয়েছিল। শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদে প্রথমে বিজয়ী হলেও সৈয়দ আহমদ শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও শহীদ হ বিশিষ্ট আলেম ও সহকর্মী শাহ্ মুহম্মদ ইসমাইলের সঙ্গে [মে ১৮৩১]। কিন্তু পাটনার ইনায়েত আলী ও বিলায়েত আলী মুমূর্স জেহাদী আন্দোলনকে সংগঠন শক্তি বলে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন, ধূলা থেকে জেহাদী ঝাণ্ডা আকাশে তুলে ধরেন। এই সহোদর ভ্রাতৃদ্বয়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে সারা পাকভারতে আবার জেহাদীরা জেগে উঠে। তারা বাংলাদেশে ও দক্ষিণ ভারতে সফর করে মুজাহিদ ও রসদ সংগ্রহ করেন। তাদের উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতায় মহিলারাও শরীরের গয়না খুলে জেহাদ ভাণ্ডারে দান করত। বাঙালি মুসলমানরা কূটবুদ্ধির সঙ্গে উত্তর ভারতের মুসলমানের ক্ষাত্রশক্তি মিলিত হয়ে অভাবনীয় তেজের স্ফুরণ হয়। সম্মুখ লড়ায়ে বাঙালিরা দুর্দান্তভাবে লড়ত। আম্বালা অভিযানে প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা উপেক্ষণীয় নয় এবং ক্ষেত্র উপস্থিত হলে ভীরু বাঙ্গালিও আফগানের ন্যায় হিংস্র ভাবে লড়তে পারে। সিলেট মালদহ, রংপুর থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশের কৃষকসম্প্রদায় নিষ্ঠার সঙ্গে এই শতাব্দীর সংগ্রামে সৈন্য ও রসদ যুগিয়েছেন। তখন বাঙালি মুসলমানের পরিবারের প্রত্যেক সমর্থ যুবাটি হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যেত হাজার হাজার মাইল দূরে সীমান্তাস্থ জিহাদী শিবিরে। প্রতিটি মুসলমান পরিবার থেকে মুষ্টিভিক্ষা নিষ্ঠার সঙ্গে আদায় করা হত জেহাদ্ভান্ডারে। আর জেহাদ শিবিরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জমায়েত হয়েছে মুসলমান সমাজের সর্বশ্রেণীর লোক- সর্বোচ্চ অভিজাত বংশের মওলানা, জঙ্গী কনট্রাক্টর, সিপাহী, সাধারণ চাষি, কসাই নির্বিশেষে। যুদ্ধের ময়দানে ও জেহাদের শিবিরে প্রত্যেক ক্ষেত্রে পথে- প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে বাঙালি মুসলমানের পূত অস্থি। মালদহ, পাটনা, আম্বালার বিচারালয়ে আসামীর কাঠগড়ায় বাঙালি, বিহারী, পাঞ্জাবী, সরহদ্দী মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে একই লক্ষের অনুসারী হয়ে।
বাংলাদেশের বুকেও সশস্ত্র বিদ্রোহানল জ্বলে উঠেছিল মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীরের নেতৃত্বে, এবং ইংরেজ রাজশক্তির কেন্দ্রস্থল কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে একটা বৃহৎ অঞ্চলে কিছুকাল ইংরেজের শাসন খতম করে দিয়ে তিতুমীর আপন হুকুম কায়েম করেছিলেন। তার নির্মিত বাহাদুরপুরের নিকটবর্তী নাড়িকেল বেরিয়ার বাঁশের কিল্লা আজ ইতিহাসে স্থন লাভ করেছে। এখানে প্রকাশ্য ময়দানে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি শহীদ হন [ ১৮ই নভেম্বর ১৮৩১]। তার অনুচরদের বিচার হলে সিপাহসালার মাসুম খার ফাঁসির হুকুম হয় এবং ১৪০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড হয়। আজাদীর সংগ্রামে প্রথম বাঙালি শহীদের গৌরব তার, অন্য কারও নয়।
সশস্ত্র না হলেও সামাজিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক আন্দোলন তুলেছিলেন আজী শরীয়তুল্লাহ ও তার উপযুক্ত পুত্র দুদু মিয়া ওরফে মহসীন। যে মেনোবৃত্তিতে চালিত হয়ে শরীয়তুল্লাহ জুম্মার ও দুই ঈদের নামাজ অসিদ্ধ হিসেবে প্রচার করেছিলেন, তা ছিল ব্যাহত ও বাস্তবত ইংরেজের হুকুমতকে অস্বীকার করারই নামান্তর মাত্র। যেসব বেদাত আচার ও প্রথা তিনি তার ‘ফারাজী’ অনুগামীদের বর্জন করতে বলেছিলেন, সেসবের মধ্য দিয়েই বর্ণহিন্দু জমিদার শ্রেণী ও ইংরেজ সরকার মুসলমান কৃষক সমাজের দেহমনের উপর কর্তৃত্ব করে আসছিল। এবং একই উদ্দেশ্যে তিতুমীরও তার ‘হিদায়েতী’ দলকে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করলে পূর্ণিয়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় এই বিপ্লবী দলকে শাস্তি দিতে অগ্রসর হন। তখন অন্য সব জমিদার, ইংরেজ নীলকর ও কোম্পানী সরকার একযোগে তার সহযোগিতা করেছিল। কৃষক শ্রেণীর আন্দোলনে স্বাভাবিক উগ্রতা ও আক্রোশ ছিল, সেজন্য আইন ও শৃঙ্খলার রক্ষক সরকার দুদু মিয়াকে ডাকাত ও কৃতঘ্ন দেশদ্রোহী অপরাধে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত বার বার কারান্তরালে নিক্ষেপ করেছিল।
কালক্রমে বাঙালি জ্বিহাদীরা আহলে- হাদীস, লা- মজহবী, মওয়াহেদ, মুহম্মদী, গায়ের মুকাল্লিদ প্রভৃতি নামে চিহ্নিত হয়েছিল। কিন্তু তাদের আকিদা ও শিক্ষার সঙ্গে মুজাহিদের বিশেষ পার্থক্য না থাকায় ইয়াহইয়া আলী তাদের সকলকে জেহাদ আন্দোলনে সংযুক্ত করেন। তারপর দেখা যায়, সীমান্ত প্রদেশের ইনকেলাবী সমর ঘাটিতে অথবা ইংরেজ সরকারের ফৌজদারি আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় ফারাজী ও অন্যান্য নামে চিহ্নিত বাঙালি মুজাহিদরা উত্তর ভারতের মুজাহিদ বাহিনীর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে পরস্পরের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। শিখ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ লড়তে বাঙালি মুসল্মানেরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেছিল এবং অগণিত সৈন্য ও অর্থ পাঠিয়ে নিজিদের কর্তব্য পালনে তৎপর হয়েছে। সেকালীন বাংলাদেশের প্রত্যেক শহরে তাদের অর্থ ও সৈন্য সংগ্রহের ঘাটি ছিল, এবং কর্তৃপক্ষের নজড় এড়িয়ে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে তারা যুদ্ধের এ দুটি অতি প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করত। সরবরাহকারীদের মধ্যে মালদহের রফিক মিয়া ও তার পুত্র আমীরউদ্দিনের নাম ইতিহাসের অন্তর্গত আছে। বাংলাদেশ থেকে কত মুজহিদ পাঠানো হয়েছিল, তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয়ের কোনও প্রামাণ্য দলিল বা তথ্য মেলে না; তবে মাত্র একটি ইনকেলাবী ঘাটির ৪৩০ জনের মধ্যে শতকরা ১০ জন মালদহ কেন্দ্র থেকেই পাঠানো হয়েছিল। বাংলাদেশের মুসলমানরা জেহাদি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে কতখানি অংসগ্রহন করেছিল তার বিস্তৃত ও যথাযথ ইতিহাস প্রণয়ন আজও হয়নি।
সৈয়দ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে পাক- ভারতের যে জেহাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার প্রথম আক্রমন উদ্যত হয়েছিল রণজিৎ সিংহ এর শিখরাজ্যের উপরে। পরে ব্রিটিশ সকার এই আন্দোলনকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে ইংরেজদের সঙ্গে মুজাহিদদের সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষে আধুনিক অস্ত্রসজ্জে সজ্জিত ও সুশিক্ষিত ব্রিটিশ বাহিনি কঠোর হস্তে জেহাদিদের দমন করে ও তাদের ঘাটি গুলো নির্মূল করে দেয়। কিন্তু তাতে জেহাদী আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়নি। সারা হিন্দুস্থান কে দারুল হরব ঘোষণা করে জেহাদ করবার অথবা এদেশ থেকে হিজরত করার বাণী সৈয়দ আহমদের খলিফারা প্রচার করে বেড়াতে লাগলো, সীমান্ত প্রদেশে একটা ইনকেলাবী সমর ঘাটি স্থাপন করে সারা উপমহাদেশ থেকে অর্থ ও সৈন্য আমদানী করতে লাগলো। তাদের শায়েস্তা করতে ইংরেজ সরকারকে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যায় করতে হয়েছে, তিনটি ভীষণ যুদ্ধ করতে হয়েছিল এবং বহু বৎসর ধরে তাদের অত্যাচারে উৎপীড়িত ও সশংকিত থাকতে হয়েছে। সমুদ্যত অস্ত্র ও আইনের শৃঙ্খল পর্যাপ্ত না হওয়ায় দেশপ্রসিদ্ধ আলেমদের, এমনকি মক্কা শরীফের চার প্রসিদ্ধ মজহাবের প্রধান মুফতীদের ফতোয়া প্রচারেরও দরকার হয়েছিল ভারতীয় বিশেষত বাঙালি মুসলমানদের ধর্মবুদ্ধিকে প্রভাবিত করবার জন্য। বিদেশী ও বিধর্মীদের শাসনাধিকারে চলে গেলেও এ দেশটাকে দারুল ইসলাম হিসেবে মেনে নিয়ে এখানে শান্তিতে ও নিরুপদ্রবে বসবাস করতে ধর্মীয় অনুমোদনও এসব ফতওয়ার দ্বারা লাভ করা হয়েছিল।
যাহোক, একথা অবশ্য স্বীকার্য যে, পাক- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে উনিশ শতকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘ওহাবী’ নামাংকিত জেহাদী আন্দোলন এক বিশিষ্ট অধ্যায়। পলাশীর পর থেকে পাক- ভারতের বিভিন্ন স্থানে যে প্রতিরোধ দেখা দিয়েছিল, তার প্রকাশ হত মুসলমানদের দ্বারা। কোন রাজা, বাদশাহ বা রাজপুরুষের স্বার্থে এ আন্দোলন প্রচারিত হয়নি। বিধর্মী ও বিদেশী শাসনব্যাবস্থার বিরুদ্ধে পাক- ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া থেকে এর জন্ম। এ জিহাদি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এদেশের বিভিন্ন অংশের উচ্চ- নীচু, ধিনী- দরিদ্র সব শ্রেণীর মুসলমান; এবং একে সংগঠন করেছিল ও পরিচালনা করে নেতৃত্ব দিয়েছিল এ যুগের ধিকৃত ও ধর্মধাস্ত্রবিদ মুসলিম আলেম সমাজ। ব্যাক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য রাজবংশের কয়েকজন এসে যোগ দিলেও এ আন্দোলনের কোন সময় এর শক্তি কোন নওয়াব রাজার স্বার্থে কেন্দ্রীভূত হয়নি। দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত না করলে ধর্মীয় সংস্কার করা যায়না। এবং দারুল ইসলামের প্রতিষ্ঠা করতে হলে সর্বাগ্রে বিধর্মী রাজশক্তির উচ্ছেদ প্রয়োজন, মুসলমানদের এ বোধ ও এ উপলব্ধি সম্যক জন্মেছিল। এবং এ বোধ জন্মানোর সঙ্গে আন্দোলনের রূপও বদলে তীব্রতর হয়েছিল। অবশ্য আন্দোলনের নেতাদের মনে দারুল ইসলামের কোনও পরিকল্পনা সুস্পষ্ট ভাবে দানা বেধেছিল কিনা, বলা শক্ত কিন্তু একথা অনস্বীকার্য, এই মনস্বী নেতাদের মনে কোন দুর্বলতা ছিলনা। কোনও স্বার্থবুদ্ধির নীচতা তাদের বিবেককে, তাদের শুভবুদ্ধিকে মোটেও আচ্ছন্ন করেনি।
মুসলমানদের এ অনমনীয় মনোভাবকে লক্ষ করেই হান্টার সাহেব বলেছেনঃ
‘আমাদের অধিকার একটি চিরস্থায়ী ষড়যন্ত্র এবং আমাদের সীমান্তে একটা স্থায়ী বিদ্রোহী শিবির’। তার ‘ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ নামাংকিত গ্রন্থটির রচনা সূচিত হয় তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল লর্ড মিয়ো কর্তৃক [১৭৬৯- ৭২ খৃঃ] উপস্থাপিত একটি প্রশ্নের জওয়াব হিসেবেঃ ভারতীয় মুসলমানরা কি ধর্মীয় অনুজ্ঞা হেতু মহারাণীর [ ভিক্টোরিয়া] বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য? যদিও গ্রন্থটি রচনা করার উদ্দেশ্য ছিল পাক- ভারতীয়, বিশেষত বাঙালি মুসলমানের উপর ইংরেজদের অন্যায় অত্যাচার সমূহের একটা সাফাই প্রস্তুত করা, তবু তার প্রথম দুটি অধ্যায়ের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে সদ্য রাজ্য হারা একটা বিরাট জাতির অপরিসীম ক্ষোভ ও বিদ্বেষ বহ্নি। হান্টার বলেছেনঃ ভারতীয় মুসলমানরা ভু বছর ধরেই রয়ে গেছে ভারত ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে একটা মহাবিপদের উৎস। নানা কারণেই তারা আমাদের শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা কর আসছে; এবং যেসব পরিবর্তনকে নমনীয় ভাবাপন্ন হিন্দুরা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছে, সেগুলিকে মুসলমানরা তাদের উপর তীক্ষ্ণ অবিচার হিসেবেই বিবেচনা করে।
১৮৫৭ সালের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে জেহাদি আন্দোলনের যোগাযোগ ছিল, একথা অনেক ঐতিহাসিকই স্বীকার করেন, কিন্তু তার বিস্তারিত তথ্য এখনও গবেষণার অপেক্ষায় আছে। বিলায়েত আলী বাদশাহ বাহাদুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, এ প্রমাণ পাওয়া যায়। দীর্ঘ এক শতক ধরে জেহাদী মুসলমানরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে যে বারে বারে ছোটখাটো বহু বিস্ফোরণ ও প্রতিরোধের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করছিল, তার সঙ্গেই বহু দিনের ধূমায়িত অসন্তোষ সর্বভারতীয় বিরাট ও ব্যাপক আকারে ফেটে পড়েছিল, এ কথাটি অস্বীকার করা যায় না। বাইরের অবস্থা শান্ত বিবেচিত হলেও আসলে সারা দেশটা বাবুদের স্তূপ হয়েছিল এবং জনগণের পুঞ্জিভূত অসন্তোষই বিস্ফোরণে মূর্ত হয়েছিল। মাওলানা আহমদ উল্লাহ, মওলবী ফজলে হক খয়রাবাদী প্রমুখ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্যাক্তিগত স্বার্থবেশে নয়, ইংরেজ শাসন উচ্ছেদের দুর্বার বাসনা নিয়ে। আর এ আন্দোলনে মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলমানরাই; এজন্য সংগ্রাম শেষে ইংরেজ রাজশক্তি নির্মমভাবে চন্ডনিতি ও সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল মুসলমানদের শির লক্ষ্য করে। সীমাহীন নির্মমতা দেখিয়ে কুখ্যাত হডসন শাহাজাদাদের হত্যা করেছে; নীল গর্ব করে বলেছে, বিনাবিচারে শত শত মুসলমানকে ঈদ- উল- আযহার দিনে ফাঁসি দিয়েছে, হত্যা করেছে। মুসলমানদের অভিজাতদের শুয়োরের চানড়ায় জীবন্ত সেলাই করে হত্যা করা হয়েছে। জোর করে তাদের শুকরের গোশত খাওয়ানো হয়েছে।
আফসোস এই যে, সে জেহাদ আন্দোলনের, সে মুক্তি সংগ্রামের পুর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও রচিত হয়নি। সে অগণিত জনসমষ্টি ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত বিদ্রোহে, সমরে, ফাঁসির মঞ্চে জীবন পাত করে গেছে। আজ তার অলক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের পশ্চাতে এ দাবী নিয়ে- তাদেরও মহৎ আত্মত্যাগের মর্যাদা দিতে হবে।
সরকারী মামলাসমূহে কঠোর শাস্তি দান করা হলেও জেহাদী আন্দোলন একেবারে স্তব্ধ করে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সীমান্তের জেহাদী ঘাটির অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হয়নি, এবং পাক- ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গুপ্ত সংগঠন মারফত অর্থ ও মুজাহিদ প্রেরণও বন্ধ হয়ে যায়নি। প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ বন্ধ হয়ে গেলেও কোনও কালেই জেহাদি আন্দোলনের বিভীষিকা দূরীভূত হয়নি। ১৮৯০ সালেও অলিভার সাহেব সীমান্তে জেহাদী ঘাঁটির অস্তিত্ব দেখেছিলেন, এবং তখনও তার আতংক স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সশংকিত করে রেখেছিল।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বময় আরম্ভ হলে তুরস্ক ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তখন সরহদী জেহাদী ঘাঁটিতে তৎপরতা লক্ষিত হয়। ১৯১৫ সালে সীমান্তে কয়েকবার সংঘর্ষ বাধে; তার মধ্যে রুস্তম ও শবকদর এলাকার যুদ্ধ তীব্র ছিল। যুদ্ধশেষে কালো পোশাক পরিহিত ১২ জন জেহাদীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। উক্ত সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে ১৫ জন যুবছাত্র এবং পেশোয়ার ও কোহাটের অনেক ছাত্র মুজাহিদের সঙ্গে যোগ দেয়; পরে তারা কাবুল যাত্রা করে। ১৯১৭ সালের জানুয়ারী মাসে দেখা যায়, রংপুর ও ঢাকা জেলার ৮ জন মুসলমান মুজাহেদিন দলে যোগ দিয়েছে। উক্ত সালের মার্চ মাসে দুজন বাঙালি মুসলমান মুজাহিদ শিবিরে ৮০০০ টাকা গোপনে বহন করার সময় উত্তর- পশ্চিম সীমান্তের এক ঘাঁটিতে ধরা পরে। তারা বহু পূর্ব থেকে জেহাদী আন্দোলনে যুক্ত ছিল।
এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, মুসলমান জাতির এক অংশ তখনও ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে লিপ্ত ছিল। তাছারা আরও একদল মুসলমান বিদেশী রাষ্ট্র কাবুল ও তুর্কীর সাহায্যে ইংরেজ বিতারনের ষড়যন্ত্র করত। তাদের নেতা ছেলেন দেওবন্দ মাদ্রাসার মাওলানা ওবায়দুল্লাহ এবং তার সহকর্মী ছিলেন মওলানা মাহমুদ হাসান। তারা হেজাজে ও কাবুলে পাক- ভারতীয় মুসলিম প্রবাসীদের নেতৃত্ব দিয়ে সংঘবদ্ধ করতেন এবং কাবুলের আমঈরের সাহায্যে বিদ্রোহ চালাবার ষড়যন্ত্র করতেন। কাবুলে একটা সামরিক সরকারও তারা প্রতিষ্ঠা করেন, এবং মওলানা ওবায়দুল্লাহ ছিলেন তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। এই ষড়যন্ত্রের কয়েকখানি চিঠি সিন্ধের একজন মুজাহিদ নেতার নিকত প্রেরিত হয়েছিল। চিঠিগুলি পরিচ্ছন্ন ফারসীতে হলদে রঙের রেশমী কাপড়ে লেখা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিঠিগুলি ধরা পরে ও বিখ্যাত ‘রেশমী চিঠির ষড়যন্ত্র’ ফাঁস হয়ে যায়। এসব বিবরণ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে একদল পাক- ভারতীয় মুসলমান তুরস্ক, হেজাজ ও কাবুলের সাহায্যে এদেশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালাবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
এখানে জেহাদী আন্দোলন সাহিত্য সম্বন্ধে কিছুটা আভাস দেয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না। হেজাজে আবদুল ওহহাব যখন নিজের মতবাদ প্রচার করেন, তখন সেখানে কোনও ছাপাখানা ছিলনা। এজন্য তার রচিত ‘কিতাব অল- তাওহীদ’ ও অন্যান্য প্রচার পুস্তিকা হাতে লেখা অবস্থায় জনসমাজে প্রচার করা হত। পাক- ভারতের জেহাদী আন্দোলন সংক্রান্ত পুথি পত্রিকা ছাপা হয়ে বা লিথোকপি প্রস্তুত করে প্রচারিত হত। এজন্য প্রচার কার্য আরও ব্যাপক হওয়ার সুযোগ ছিল। হান্টার সাহেব তার ‘ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে তেরখানি ও ‘ওহাবী’ গ্রন্থের নামোল্লেখ করেছেন, তাদের কোনটি আরবী, কোনটি ফারসী ও কোনটি উর্দু ভাষায় রচিত। পুঁথিগুলির সম্বন্ধে তার মন্তব্য হল, ‘পদ্যে ও গদ্যে লেখা ওহাবী পুঁথিগুলির- যার প্রত্যেকটিতে ইংরেজের বিরুদ্ধে জেহাদের জ্বলন্ত প্ররোচনা আছে- ক্ষুদ্রতম খানিও একখানি বৃহৎ গ্রন্থের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার যোগ্য’। জেহাদি আন্দোলনের নেতা সৈয়দ আহমদের শিক্ষা ও বাণী সংকলন ও ব্যাখ্যা করে শাহ ইসমাইল শহীদ প্রথমে ‘সিরাতুল মুসতাকিম’ নামক ফরাসী ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন। এখানিতে জেহাদ আন্দোলনের মূলতত্বগুলি শক্তিশালী লেখকের হাতে প্রাঞ্জল্ভাবে ফুটে উঠেছে। মুসলমান সমাজের সংস্কার মানস নিয়েও গ্রন্থখানিতে বিভিন্ন বিষয়ে বিসদ আলোচনা আছে। এখানিকে কেউ বলেছেন ‘ওহাবীদের ম্যানিফেস্টো’ কেউ বলেছেন বাইবেল। বলা বাহুল্য, এখানি সৈয়দ আহমদের পন্থীদের মধ্যে প্রচারিত ও সবচেয়ে প্রিয় পাঠ্য ধর্মগ্রন্থ।
একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, জেহাদ সম্পর্কিত সাহিত্য পূর্ণভাবে বিকশিত হয়। গদ্যে, কবিতায়, লোককথায়, সবদিকেই তার অপূর্ব উন্নতি হয়। এ সম্বন্ধে যত পুস্তিকা লেখা হয়েছে তার পূর্ণ পরিচয় দিতে চেষ্টা করলে একখানা প্রকাণ্ড গ্রন্থ রচনারই দরকার পরে। এসব পুস্তকের শিরোনাম থেকে তার বিষয়বস্তুর পরিচয় মেলে। রিসালা- ই- জেহাদ, কাসিদা, শিররওকায়া, আসার- মাশহার, তাকিয়াতুল ইমাম, নাসিহাতুল মুসলেমীন, হিদায়াতুল- মুমেনীন, তানবীর- উল- আইনাইন,তামবিহ- উল- গাফেলীন, চিলিহ হাদিস প্রভৃতি নামাংকিত অসংখ্য পুস্তক রচিত হয় এবং ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এসব কিতাবের ভাষা আরবী, ফারসী ও উর্দু হলেও তাদের কয়েকটি মুসলমানী বাঙলাতেও তর্জমা করা হয়েছিল। তাম্বিহোল- মোমেনীন নামক গ্রন্থটি মুসলমানি বাংলায় [ অর্থাৎ মিস্ররীতির বাংলায়] পদ্যে রচিত হয়েছিল জনৈক ওমর শাহ্ কর্তৃক ও ১৮৮০ সালে ঢাকায় মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। বলা বাহুল্য, এসব ওহাবী পুস্তিকা ইংরেজ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। তবুও সেগুলি হাতে লেখা অবস্থাতেই প্রচারিত হত এবং তাদের পাঠক সংখ্যা অত্যন্ত বেশি ছিল।
এখানে প্রশ্ন জাগে, কোন ভাষায় বাংলাদেশের জেহাদ আন্দোলনের প্রচারকার্য চালান হত? এ সম্বন্ধে কোন প্রামাণ্য দলিল হাতের কাছে না থাকলেও এ কথা অসংকোচ বলা চলে যে, জনগণের সম্মুখে প্রচার চলত মুসলমানি বাংলা ভাষাতেই; কিন্তু লেখা পড়ার সমস্ত কাজ ফারসী ও উর্দু ভাষাতেই করা হত। বাংলার বাইরে থেকে যেসব প্রচারক বাংলায় আসতেন, তারা বহুদিন এদেশে বাস করে এদেশের ভাষা ও আদব- কায়দা রিতিমতভাবে আয়ত্ত করে প্রচারকার্য হাতে নিতেন। লক্ষ্মৌবাসী আবদুর রহমান সাহেব বাংলাদেশে প্রচারের জন্য আদিষ্ট হয়ে মালদহ জেলায় হিজরত করেন এবং সেখানেই শাদি করে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। এভাবে তিনি বাঙালী মুসলমানদেরই একজন হয়ে জেহাদ প্রচার করেছিলেন। সে আমলে শিক্ষিত মুসলমান সমাজের সংযোগসূত্র উত্তর ভারতের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ থাকায় বাঙালী মুসলমান মাত্রই উর্দু ও ফরাসী প্রাথমিক অবস্থা থেকেই স্বভাবতই শিক্ষা করত। এ থেকে আমাদের দৃঢ় ধারনা জন্মেছে যে, বাংলাদেশে জেহাদ আন্দোলনের লেখাপড়ার কাজটা এ দুটি ভাষার সাহায্যেই হত। উদাহরণস্বরূপ, সাধারন সংগঠন কার্যে ‘দীন- কি- সরদার’ ‘দুনিয়া- কি- সরদার’, ‘ডাক- কি- সরদার’ প্রভৃতি উপাধি থেকেই আমাদের যুক্তির পোষকতা মেলে।
চলতি শতকে প্রথমেই বঙ্গভঙ্গ রদ নিয়ে আন্দোলনকালে বাংলাদেশে হিন্দু যুবকদের দ্বারা যে সন্ত্রাসবাদের উদ্ভব হয়, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ, সংগঠন শক্তি, প্রাচরনা গুপ্তসমিতি, গুপ্তচরবৃত্তি, গুপ্ত শব্দ সংকেত এবং গুপ্ত ভাবে অর্থ ও অস্ত্রাদি চলাচলের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি বিশেষ ভাবে আলোচনা করলে ওহাবী চিহ্নিত উনিশ শতকের মুসলিম জিহাদিদের কথায় স্মরণে আসে। কারন এসব ক্রিয়া কর্মে দুটি দলের অনেক মিল আছে, যা থেকে নিরাসক্ত মনে স্বতই প্রশ্ন জাগে- জেহাদিদের আদর্শের অনুকরণ করে বিশ শতকের বাঙালী হিন্দু সন্ত্রাসবাদ সংগঠিত হয়েছিল কিনা। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, জেহাদিদের কর্মধারা ছিল সাধারন মানুষের অপরাধ ও পাপাচার বোধের সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গতি রেখে, এবং তাদের সব প্রচেষ্টাই ছিল প্রকাশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে। ডাকাতি, অর্থ লুণ্ঠন, গুপ্ত খুন জখম প্রভৃতি কর্ম ছিল জেহাদিদের স্বপ্নেরও অগোচর। কিন্তু দুটি আন্দোলনের কর্মীদের চারিত্রিক ঋজুতা প দৃঢ়টা, কর্তব্য কর্মে নিষ্ঠা ও দলগত অকুণ্ঠ বশ্যতা ছিল। বিস্ময়কর। জেহাদি আন্দোলন সম্বন্ধে আরও বলা যায় যে, এটি কোন বিদেশী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়নি কোনও সময়ে কোনও বিদেশী সাহায্য নির্ভর ছিলনা। আরা এ আন্দোলনের ব্যাপকতা ও তীব্রতা সম্বন্ধে ডক্টর চৌধুরী স্বীকার করেন যে, ‘ব্রিটিশ শাসন আমলে যেসব আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছে, সেসবের মধ্যে ওহাবী আন্দোলন ছিল তীব্রভাবেই ব্রিটিশ বিরুদ্ধ, তার সর্বস্তরেই এই তীব্র বিরোধিতা পরিলক্ষিত হত’।
পাক- ভারতীয় জেহাদি আন্দোলনের পরিক্রমা শেষে একথা বলা যায় যে, এ আন্দোলনের দুটি বিশেষ লক্ষ ও কর্মসূচী ছিলঃ [১] ধর্মীয়- সামাজিক সংস্কার ও [২] রাজনৈতিক, অর্থাৎ বিদেশী শাসন উচ্ছেদ পূর্বক ইসলামী শাসন কায়েম করা। ধর্মীয়- সামাজিক সংস্কার প্রধানতঃ শুরু হয়েছিল শাহ্ ওয়ালী উল্লাহর সময় থেকে, এবং তার পুত্র আবদুল আজীজের সময় ‘তরিকা- ই- মুহম্মদীয়া’ সংস্কার আন্দোলনের মারফত। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর এদিকে কর্মসূচী ছিল মুসলমানের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে যেসব বেদাত অনুপ্রবেশ করেছিল, সেগুলির মূলোৎপাটন করা। বলাবাহুল্য, এই সমাজ ও ধর্মীয় সংস্কার কর্মে কোন বাধা উপস্থিত হয়নি। যদিও সৈয়দ আহমদকে একবার আদিবাসী মোল্লা ও স্বার্থভোজীদের তীব্র প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
জেহাদিদের সশস্ত্র আন্দোলন ছিল নিঃসন্দেহে শিখ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে এবং এদেশটাকে দারুল হরব থেকে দারুল ইসলামে পরিণত করার মহান ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। প্রসঙ্গত এখানে পরিচ্ছন্ন হওয়া উচিত যে, কোনও রাজা- বাদশাহ বা আমীর- ওমরাহের স্বার্থে বা নেতৃত্বে এ আন্দোলন পরিচালিত হয়নি এবং ব্যাক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য পরে রাজবংশের কয়েকজন যোগ দিলেও এ আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসের কোন সময়ই এর শক্তি কোন রাজা- বাদশাহ বা আমীরের স্বপক্ষে কেন্দ্রীভূত হয়নি। এ আন্দোলনকে পরিচালনা ও সংগঠন করেছিলেন ধর্ম শাস্ত্রবিদ মুসলিম আলেম সমাজ এবং এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে পাক- ভারতের বিভিন্ন অংশের মুসলমান। আলেম সমাজ এ প্রত্যয়ে দৃঢ় ছিলেন যে, দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত না হলে খাঁটি ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়না কিংবা ইসলামেরও সংস্কার করা যায়না এবং দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সর্বাগ্রে বিধর্মী বিদেশী রাজশক্তির উচ্ছেদ প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয় দিক নির্ণ্যে সৈয়দ আহমদ বা তার অনুসারীদের বিন্দুমাত্র সংশয় ছিলনা। এ সম্বন্ধে নজীর হিসেবে উপস্থিত করা যায় তার কর্তৃক গোয়ালিয়রের মহারাজা দৌলতরাও সিন্ধীয়ার শ্যালক রাজা হিন্দুরাওকে লিখিত এক পত্র থেকেঃ
মহাশয় পরিস্কার ভাবে জ্ঞাত আছেন যে, দূর দেশের বিদেশী লোকেরা এখন আমাদের দেশের ও যমানার শাসক পদে বরিত হয়েছে এবং ব্যাবসায়ীরা ও পণ্যবিক্রেতারা এখন আমাদের প্রভুপদে উন্নীত হয়েছে- কিন্তু একদল জেহাদি দুর্বল হলেও পার্থিব লোকসানের কথা চিন্তা না করে এই বিদেশীদের উৎখাত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে— যতো শীঘ্রই হিন্দুস্থান এসব বিদেশী দুশমনের হাত থেকে মুক্ত হয়ে ও জেহাদিদের মনস্কামনা পূর্ণ হবে, তত শীঘ্রই এ দেশের শাসনভার পূর্বতন মালিকদের হস্তেই ফিরে যাবে এবং তাদের শক্তি ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করা হবে।
তার আরও একটি পত্রের অংশ বিশেষ হতে পাওয়া জায়ঃ
আমার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, জেহাদ কায়েম করা ও হিন্দুস্থানে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করা—– যেসব বিধর্মী খ্রিস্টান ভারত অধিকার করেছে তারা অত্যন্ত ধূর্ত ও প্রবঞ্চক—— দুষ্ট প্রকৃতির ইংরেজরা ও হতভাগ্য মুশরেকরা ভারতের বিভিন্ন অংশে কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে। তারা সিন্ধু নদের তীর হতে সমুদ্রোপকূল পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে।
সৈয়দ আহমদের চিঠিপত্রের এসব উধৃতাংশ হতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকেনা যে, তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ বিতারন। তিনি অবশ্য প্রথমেই শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেই তিনি নিহত হন। তার কারণ এই ছিল যে, পাঞ্জাব অধিপতি রণজিৎ সিংহ বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল এবং প্রত্যক্ষ ভাবে মুসলমানদের ধর্মেকর্মে বাধা দিতে অগ্রসর হয়েছিলেন। এমনকি তার হুকুমে পাঞ্জাবে আযান দেয়াও নিষিদ্ধ হয়েছিল।
একজন আধুনিক হিন্দু লেখক পাক- ভারতে ব্রিটিশ বিদ্বেষী যেসব আন্দোলন আঠারো ও উনিশ শতকে উদ্ভব হয়েছিল, সেসবের মূল্যায়নকালে ওহাবী আন্দোলন সম্পর্কে এ মতামত প্রকাশ করেছেনঃ
ওহাবী আন্দোলনের প্রতি গণশক্তির সহানুভূতির নিদর্শন মেলে ঢাকা থেকে পেশোয়ারা পর্যন্ত সমগ্র দেশের অর্থ ও জেহাদী সংগ্রহ পূর্বক এ আন্দোলনকে পুষ্টিদান করায়। এখানে এ কথাও স্বীকার করতেই হয় যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনে যে সমস্ত আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছে, তাদের মধ্যে ওহাবী আন্দোলন ছিল সর্বাপেক্ষা নির্দয়ভাবে ব্রিটিশ বিদ্বেষী এবং তাদের এ ভূমিকা শেষ দিন পর্যন্ত প্রচেষ্টায় অব্যাহত ছিল।
জেহাদীদের আত্মত্যাগ অতুলনীয়। জগত ও জীবন সম্পর্কে অন্যসব চিন্তা ও বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী এসব আত্মভোলা জেহাদীরা একমন ও একপ্রাণ হয়ে একমাত্র ব্রিটিশের উৎখাত মানুষে জীবন ও যৌবন কোরবাণীর যে অনন্য ও অপূর্ব নিদর্শন রেখে গেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা নেই। তবুও আক্ষেপের সঙ্গে স্বীকার করতেই হয়, এ আন্দোলন নিষ্ফল হয়েছিল- বারে বারে ইংরেজ শক্তিকে উদ্ধত খজোর মত আঘাত করেও ইংরেজকে এদেশ থেকে উৎখাত করার সাধনা জেহাদীদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এবং তার কারণ গুলি ছিল নিম্নরূপঃ
[১] জেহাদিদের মধ্যে সংগঠন ও পরিচালনা শক্তি বিজ্ঞানসম্মত ছিলনা। জেহাদিদের প্রতিজ্ঞায় ও সংকল্পে কোন খাদ না থাকলেও ধর্মীয় খুঁটিনাটি মতবিভেদ ও তজ্জনিত মনকষাকষি নেতৃত্বদানে অনেক সময়ে দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। ‘রাফেয়াদান’, ‘লা- মযহবী’, ‘গায়ের মাকাল্লিদ’, ‘আহলে হাদীস’ প্রভৃতি ধর্মীয় প্রশ্নে নেতৃবৃন্দের উৎকট রেষারেষি ও মনকষাকষিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আলেম নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভেদ দেখা দেওয়ায় প্রকৃত জেহাদের ক্ষেত্রে বাধা- অসুবিধাই সৃষ্টি করেছে। এই প্রসঙ্গে খোদ বিলায়েত আলী ও ইনায়েত আলী সহোদর ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্ব নিয়ে মতবিরোধ স্মরণীয়।
ঘাতকতা প্রতারণার দ্বারা জেহাদী আন্দোলনের উপর কুঠারাঘাত করেছে। লক্ষ করে দেখা গেছে যে, পাহাড়ি অধিবাসীরা কখনও দলীয় স্বার্থের উর্ধে উঠে নিঃস্বার্থ ভাবে জেহাদের জন্য দন্ডায়মান হয়নি; সুবিধাবাদী ও অর্থগৃধুর ভূমিকা নিয়ে জেহাদীদেরই সর্বনাশ সাধনে উৎসাহী হয়েছে, পাহাড়ি অধিবাসীদের নিয়ে জেহাদ করার এটাই সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্বল দিক ছিল।
[৩] জেহাদী আন্দোলনের লোক ও রসদ সরবরাহ হত সারা পাক- ভারতের দূরদূরান্তে প্রত্যেক অঞ্চল হতে- হাজার হাজার মাইল দূরবর্তী রংপুর, মালদেহ, সিলেট, চট্টগ্রাম প্রভৃতি বাংলাদেশের অঞ্চল থেকে এবং সূদুর হায়দারাবাদ থেকেও। এসব লোক ও রসদ সরবরাহ হত সুপ্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ শাসনাধিকারের অভ্যন্তর দিয়ে; এবং তার দরুন রসদ ও লোক সরবরাহ টা বরাবরই বিপদসংকুল ছিল এবং যেকোনো সময়ে যুদ্ধের অতি প্রয়োজনীয় দুটি উপকরণ বন্ধ হয়ে যেত, কিংবা যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
[৪] সর্বশেষে বলা যায়, জেহাদীদের অস্ত্র ছিল পুরানো প্রণালীর। এজন্য আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত ও কারিগরি বিদ্যায় অনেক উন্নত ইংরেজদের অস্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদিদের অস্ত্র তুলনামূলক একেবারেই নিম্ন মানের ছিল। মালকায় জেহাদিদের যে পুরানো আমলের বাবুদের কারখানা ছিল এবং হস্ত নির্মিত বংশদন্ডের বন্দুকসমূহ প্রস্তুত করা হত, সেগুলির আধুনিক বিজ্ঞান কারিগরি বিদ্যার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনরূপে নির্মিত এনফিল্ড রাইফেলের সঙ্গে মোটেই তুলনা করা চলেনা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংঘাতে প্রাচ্যের এই অস্ত্রশস্ত্র শোচনীয় দুর্বলতা ও অক্ষমতাই যে পাশ্চাত্যকে প্রাচ্যের উপর সাফল্লের সৌভাগ্য দান করেছে তার পরিণতি দেখা গেছে চীনের সঙ্গে সংগ্রামে, ১৮৫৭ এর বিপ্লবে এবং জেহাদীরাও এই অক্ষমতার স্বীকারে পরিণত হয়েছে। আশ্চর্য এই যে, এই বিসদৃশ ও অসম অবস্থাটা মুসলমান ধর্মীয় নেতারা কোনও সময়ে অনুধাবন করতে পারেনি, এবং নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র আধুনিক ধরনের উন্নয়ন করতে কিংবা যুদ্ধকালে আধুনিক কলা- কৌশল অনুসরণ করতে চেষ্টা করেননি।
এবার ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের আলোচনা করা যাক।
পাক- ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কারের সম্বন্ধে আলচনার প্রথমেই স্মরণ করতে হয় শাহ্ ওয়ালী উল্লাহর নাম। কারণ আঠারোশ শতকের মাঝামাঝি তিনিই প্রথমে এ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। মনে রাখা ভাল যে, ঠিক এই সময়ে আবদুল ওহহাব হেজাজে তার ধর্মীয় সংস্কার প্রচেষ্টায় ব্যাস্ত ছিলেন। শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মক্কায় হজ্ব পালন করতে গিয়েছিলেন এবং শাহ্ আবু তাহির নামে এক মশহুর আলেমের নিকট কিছুকাল শিক্ষালাভ করেন। মক্কা থেকে ১৭৩০ সালে প্রত্যাবর্তনের পর তার কর্মজীবনের শুরু হয়। এমন কোন প্রমাণ মেলে না যে, আবদুল ওহহাব এর সঙ্গে শাহ্ ওয়ালী উল্লাহর কোন সাক্ষাৎ হয়েছিল। শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ লক্ষ্য করেছিলেন, শরীয়তী ইসলামের প্রতি সুফীদের উদাসীনতা ও অবজ্ঞা ইসলাম ও মুসলিম সমাজ জীবনের শৃঙ্খলার পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছিল। তাদের আচরিত ও বহু প্রচারিত ইসলামবিরুদ্ধ মতবাদের অনুপ্রবেশ মুসলিম ধর্মজীবনকে কলুষিত করেছিল। পেশাদার সুফীর প্রাদুর্ভাব ও কবরপূজার প্রথাও ক্রমাগত বেড়েই চলেছিল। শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ অবশ্য তাসাউফের উচ্ছেদ চাননি, তার লক্ষ্য ছিল সুফীদের সংস্কার। তিনি সূফীবাদকে সংস্কার করে তা সমাজের কল্যাণে লাগাতে চেয়েছিলেন। পেশাদার পীর- ফকির ও কবরপুজা, কেরামতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে তার ‘ওসিয়তনামায়’ বহু যুক্তি ও নির্দেশ আছে, কিন্তু এ সম্বন্ধে জোর জবরদস্তি করা তিনি অন্যায় মনে করতেন।
শাহ্ ওয়ালী উল্লাহর সুযোগ্য পুত্র শাহ্ আবদুল আজীজ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি, মুক্তবুদ্ধি ও ধর্মীয় উদারনীতির শিক্ষা দিয়ে সমাজ সংস্কারের দিকে জোর দেন। তার শিক্ষায় অনুপ্রাণিত সৈয়দ আহমদ যে ‘তারগীব- ই- মুহম্মদীয়া’ নামক সংস্কার আন্দোলন আরম্ভ করেন, তার বিস্তারিত কর্মসূচী মেলে ‘সিরাতুল মুসতাকিম’ নামক পুস্তকে; সৈয়দ আহমদ প্রথমে মুরিদদের বহুল প্রচলিত চারটি প্রধান সূফী তরিকায়- চিশতিয়া, কাদেরীয়া, নকশবন্দিয়া ও সোহরাওইয়ার্দীয়া- দীক্ষা দিয়ে পরে মুহম্মদি তরিকায় দিক্ষা দিতেন। তার তরিকার অনুসারী লোক এখনও আছে। তিনি ঈমানের দৃঢ়টা সাধনের ও ধর্মাচরনের উপরেই বেশি জোর দিতেন; তার আদর্শিক সংস্কারযোগ্য বিষয়গুলি মোটামুটি এইঃ ঈমানকে দুর্বল করে এমন সব অভ্যাস, যেমন শরীয়তের বিধানকে অবজ্ঞা করা বা উপেক্ষা করা, পৌত্তলিক ও নাস্তিকসুলভ কথাবার্তা বা আচরণের প্রশ্রয়, আল্লাহ ও নবী সম্বন্ধে অসম্মানজনক কথা বার্তা, কর্মফলের জন্য মানুষ ও আল্লাহর দায়িত্ব নিয়ে অর্থহিন চুলচেরা বিতর্ক, কদাচারী শিথিলবিশ্বাসী সুফীদের প্রভাবে পীরপুজা, কবরপূজা, শিরণী দেওয়া প্রভৃতি আচরন যা থেকে ঈমানের ক্ষতি ও অপব্যায় হয় প্রচুর। সামাজিক কুসংস্কারেরও উল্লেখ আছে। বিয়েশাদী, নামকরন, খাতনা প্রভৃতি পারিবারিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে উৎসব আরম্বর করা অনাবশ্যক- কারণ সেসবেও অর্থের অপব্যায় হয়। দাফন উপলক্ষে নানারকম ব্যায়বহুল ও নিরর্থক অনুষ্ঠান। বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধাচরণ- এ কুপ্রথা রদ করতে সৈয়দ আহমদ নিজেই জ্যেষ্ঠভ্রাতার বিধবাকে বিবাহ করেছিলেন।
উত্তর ভারতে শরীয়ত বিরুদ্ধ রীতিনীতি মুসলমান সমাজে কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল, আল্লামা ইকবালের একটি উক্তি থেকেই তা বোঝা যায়ঃ ‘নিশ্চয়ই আমরা হিন্দুয়ানীতে হিন্দুদের ছাড়িয়ে গেছি। আমরা দুরকম জাতিভেদের কবলে পড়েছি- মজহাবী বিভেদ ও সামাজিক জাতিবিভেদ। আমরা এসব হিন্দুদের থেকে শিক্ষা করেছি, না হয় উত্তরাধিকার হিসেবে গ্রহণ করেছি। এটিই হচ্ছে একটি নীরব উপায়, যার দ্বারা বিজিত জাতি বিজেতার উপর চরম প্রতিশোধ নেয়’। মনে রাখা ভাল, ইকবাল এ খেদোক্তি করেছিলেন সৈয়দ আহমহের ওফাতের প্রায় ১০০ বছর পরে এবং তার দ্বারা মুসলমান সমাজের সংস্কার সাধনেরও পর। শাহ্ আবদুল আজীজ ও তার উপযুক্ত শিষ্য ‘তাগরীব- ই- মুহম্মদীয়া’ আন্দোলনের মারফত ইচ্ছা করেছিলেন, যেসব বেদাত, চালচলন ও আচারনিতি সাধারন মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ লাভ করেছে, সেগুলির মূলোৎপাটন করা ও খাঁটি ইসলামী শিক্ষাদর্শে তাদের উদ্বুদ্ধ করে তোলা। এই আন্দোলনের ফলে বহু লোক ইসলামের সত্যিকার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শরীয়ত বিরুদ্ধ ও কুসংস্কারমূলক অভ্যাস পরিত্যাগ করে। এক সুপরিকল্পিতও উপায়ে সারা পাক- ভারতে এই আন্দোলন বিস্তৃত করা হয় এবং একাজে একদল নিঃস্বার্থ ও অক্লান্তকর্মী নিয়োগ করা হয়।
সৈয়দ আহমদ পাটনায় তার আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল করেন। এখন থেকেই তার খলিফারা পাক- ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে প্রচারকার্য চালাতেন। তার হুকুমে খলিফা মুহম্মদ আলী সর্বপ্রথমে পূর্ব বাংলায় জেহাদী আন্দোলন শুরু করেন। তখন বাংলাদেশের অনেকে নামেমাত্র মুসলমান থাকায় তাদের খাওয়া- পরায়, সামাজিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে তাদেরকে মুসলমান হিসেবে সনাক্ত করাই কঠিন ছিল। মুহম্মদ আলী তাদের ইসলামী বিধি ব্যাবস্থা শেখাতে লাগলেন এবং তাদের হিন্দুয়ানী আচার ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম চালাতে লাগলেন। ১৮২০ সালে সৈয়দ আহমদের চারজন খাস খলিফার অন্যতম মওলবী বিলায়েত আলী এদেশ হিজরত করেন এবং জেহাদী আন্দোলনের বিশেষ অনুশাসন ও শিক্ষাগুলি এদেশে প্রয়োগ করতে জোর দেন। নামাজে সুরা ফাতেহা পাঠ শেষে প্রত্যেকবার উপর দিকে হাত তোলার ও উচ্চকণ্ঠে ‘আমীন’ বলবার বিধি তিনিই এদেশে প্রবর্তন করেন। তার শিক্ষার সারমর্ম ছিল, কোরআনের পরেই হাদিস মুসলমানের একমাত্র অনুসরনীয় ব্যাবস্থাপত্র। এদেশে জেহাদী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় প্রচারক ছিলেন মওলবী ইনায়েত আলী, মওলানা কেরামত আলী, মওলানা জয়নুল আবেদীন ও মওলানা সৈয়দ মুহম্মদ জামাল- উল- লায়ল আরাবী। ইনায়েত আলীর কর্মক্ষেত্র ছিল মালদহ, রাজশাহী, বগুরা,নদীয়া ও ফরিদপুর জিলাগুলিতে। জয়নুল আবেদীনের কর্মক্ষেত্র ছিল ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা ও সিলেট জিলায়। তাদের শিক্ষার মহিমায় পূর্ব ও উত্তর বাংলার অনেক অনেক মুসলমান জেহাদ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে এবং পাক্কা শরীয়ত অনুসারী ইসলাম আমল করতে শেখে। চাষি ও মধ্যবিত্ত লোকদের মধ্যে তাদের প্রচারকার্য বেশ ব্যাপকভাবেই হয়েছিল। তাদের প্রচারণায় বাংলার মুসলমান যেন হারানো সম্বিৎ ফিরে পেল এবং কত বড় তাহজীব ও তমদ্দুনের তারা অধিকারী তাই সম্যক উপলব্ধি করে তাদের ধর্মীয় জোশ শতগুণে বর্ধিত হয়েছিল।
উনিশ শতকে যে তিনজন মহাপ্রাণ বাংলাদেশের মুসলমানের জীবনের সামগ্রিকভাবে সংস্কারসাধন করতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তাদের নাম হাজী শরীয়ত উল্লাহ্, শহীদ তিতুমীর ও মওলানা কেরামত আলী। তাদের প্রত্যেকেরই কর্মভূমি ছিল নিরক্ষর পল্লীবাসী কৃষক ও কারিগর মুসলমান সমাজে- তিতুমীরের চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, যশোর ও ফরিদপুরে এবং দুজনের সমগ্র বাংলায়। তাদের প্রচেষ্টায় ইসলামের পুনরুজ্জীবনের কাহিনী বিস্ময়কর ও শিক্ষাপ্রদ। একদিকে ধর্মীয় সংস্কার করে তারা ইসলামের আদি সূচিতা পুননির্ণয় করেন; অন্যদিকে রাজনৈতিক ভূমিকায় তিতুমীর ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জেহাদ করেন। তাদের অর্থনৈতিক আন্দোলনও মুসলমানদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়।
এই ধর্মীয় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে হলে আমাদের ইতিহাসের আরও পশ্চাতে তাকাতে হবে। বাংলা যখন মুঘল বাদশাহীর সুবাহ হিসেবে ঢাকার নওয়াব নাজিমের শাসনাধীনে ছিল [১৬১২—১৭০৪ খৃঃ] তখন তাদের নিয়োজিত কাজী মুফতী ও মুহতাসিব নামাংকিত বিশেষ কর্মচারীরা থাকতেন। তাদের বিশেষ কর্তব্য ছিল, মুসলমানের ধর্মীয় জীবন শরীয়ত মোতাবেক নিয়ন্ত্রন করা এবং তাদের শিক্ষা ও কালচার উন্নয়ন করা। তাদের অধীনে পল্লী অঞ্চলে নায়েব থাকতেন; তারা মুসলমানের ধর্মসম্পর্কিত সমস্যার সমাধান করতেন, বিয়ে- শাদী পড়াতেন, জানাযা, জুম্মার নামাজের ইমামতি করতেন। পলাশির যুদ্ধর পর এসব পদ বিলুপ্ত হয়ে যায় ইংরেজ শাসনামলে। ম্যারেজ- রেজিস্টার নামে কাযীদের অস্তিত্ব রাখা হল, কিন্তু সমাজের উপর আর তাদের পূর্বের মত কর্তৃত্ব রইল না। পীর, ফকীর, খন্দকার নামে মুসলমান নেতাদের প্রাদুর্ভাব ঘটলো, কিন্তু তাদের প্রভাব রইল নিজ নিজ শিষ্যদের মধ্যেই সীমিত। আরও দুঃখের কথা, তারা আপন আপন ডালরুটি রোজগারেই ব্যাস্ত থাকলেন, মুসলমান জনগণের ধর্মীয় জীবনের খবরদারী করার মহৎ কর্তব্যটা বিস্মৃত হলেন। তার ফল এই হল যে, মুসলমান ধর্মীয় জীবনে বহু বেদআতের অনুপ্রবেশ ঘটলো, এবং আরও আক্ষেপের কথা হল যে, এসব লোক স্বার্থান্ধ হয়ে এসব বেদআত প্রশ্রয় দিতে থাকেন।
এরূপ বেদনাদায়ক পরিস্থিতি ছিল পলাশীর যুদ্ধের পর ষাট বছরেরও উপর। বাংলার মুসলমানরা বিপথগামী হল, প্রতিবেশী হিন্দুর প্রভাবে ও অনুকরণে বহু কুসংস্কার ও বেদআত এর তারা অনুসারী হয়ে পড়ল। বহু হিন্দুধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সামাজিক- অসামাজিক আচার প্রচ্ছন্নভাবে মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে এবং কালক্রমে তাদের ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে উঠে। অনেক নওমুসলমান দুর্বলতা ও অশিক্ষার কারণে পুর্বের দেবদেবীর পূজায় ও কুসংস্কার পালনে অভ্যস্ত থাকে। আবার অনেকে সুবিধা মতো সেগুলিকে ইসলামী পোশাক পড়িয়ে ধর্মীয় মর্যাদাশক্তি করে ফেলে। মা বরকত, ওলা বিবি, শীতলাবিবির পূজা দেয়া, সিন্নি দেওয়া [হরিলুটের মত], তবররুক বিতরন করা মুসলমান সমাজে প্রচলিত হয়ে যাই। কোরআনের আয়াত লিখিত কিংবা হিন্দুধর্মের মন্ত্রলিখিত তাবিজ পরার প্রথা, কলেরা বসন্ত মহামারীর সময় কিন্দুর অনুকরণে মাটির পাত্রে এসব আয়াত বা মন্ত্র লিখে বাড়ির দরজায় টাঙানো, তেলপরা, নুনপরা, কালিজিরাপরা প্রভৃতি খাওয়ার রেওয়াজ মুসলমানদের মধ্যে বেশ চলিত হয়ে উঠে।
এসব ইসলাম বিরুদ্ধ প্রথা ও আচারের বিরুদ্ধে প্রথমে প্রবল আপত্তি হয়ে উঠে হাজী শরীয়তুল্লাহর কণ্ঠে। ফরিদপুর জিলার এক দরিদ্র অখ্যাত কুলে জন্মগ্রহণ করেও তিনি বাল্যকালেই তিনি সুদূর মক্কায় গমন করেন এবং ২০ বছর সেখানে বসবাস করে আরবী ভাষা, তফসীর, কাদিস প ফিকাহ পাঠ করে একজন মশহুর মুহাদ্দিস হিসেবে পরিচিত হন। ১৮১৮ সালে নিজের গ্রামে ফিরে এসে তিনি সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথমে স্বযিলা তার প্রচারক্ষেত্র ছিল, পরে ঢাকা জিলায় নয়াবাড়িতে তার কর্মকেন্দ্র স্থাপিত হয়। ক্রমে ক্রমে পাবনা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালি, বরিশাল প্রভৃতি জিলার কৃষক এবং হস্ত ও কুটির শিল্প সমাজে তার শিক্ষা প্রচারিত হতে থাকে। হিন্দু জমিদারেরা তার অর্থনৈতিক আন্দোলনে ভীত হয়ে তাকে বাধা দিতে থাকে কিন্তু আপন কর্তব্যে নিষ্ঠা ও সংকল্পে দৃঢ়টার জোরে তিনি এসব বাধা তুচ্ছ করে সংস্কার কর্মে জীবনপাত করেন। তার প্রধান শিক্ষা ছিল, ‘ফরয’ অর্থাৎ অবশ্যপালনীয় ধর্মানুস্থানের অনুগামী করা। এজন্য তার শিষ্যদের বলা হয় ‘ফারায়েযী’। তিনি পীর মুরীদদের বদলে অস্থাদ- সাগরেদ সম্মন্ধ প্রবর্তন করেন ও ‘বয়েত’ গ্রহণ নিষিদ্ধ করেন। তার আর একটি শিক্ষা, এদেশ দারুল হরব হয়ে যাওয়ায় এখানে জুম্মার ও দুই ঈদের নামাজ অসিদ্ধ। মুহররম মাসে তাজিয়া উৎসব করা, গীতবাদ্য করা, বিবাহাদি উৎসবে অনর্থক অর্থব্যায় করারও তিনি বিরুদ্ধ ছিলেন। তার প্রধান শিক্ষা ছিল, ‘তওবাহ’ অর্থাৎ সর্বপ্রকার পাপাচার ও বেদআত থেকে নিবৃত্তিই প্রধান কাম্য।
তার পুত্র দুদু মিয়া ওরফে মুহম্মদ মুহসীন পিতার আরদ্ধ কার্য আরও বলিষ্ঠ ও সংঘবদ্ধভাবে আরম্ভ করেন। তিনিও বাল্যকালে কিছুকাল মক্কায় বাস করে আরবী ভাষা, তফসীর, হাদিস, ফিকাহ প্রভৃতি ভাল করে শিক্ষা করেন। তার সংগঠন শক্তি এরূপ ছিল যে, তার আদেশ পালনে ৬০ হাজার কর্মী সর্বদা প্রস্তুত থাকতো। তার আন্দোলন প্রধানত ছিল অর্থনৈতিক- অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের বিরুদ্ধে। হিন্দু জমিদার ও নীলকররা তার অনুগামী মুসলমানদের উপর যে অকথ্য নির্যাতন চালাত, তার তুলনা নেই। দরিদ্র কৃষকদের দাড়িতে দাড়িতে বেধে নাকে মরিচের গুড়া দেয়া হত; শ্যামচাদের প্রহারে জর্জরিত করত। দাড়ি রাখার জন্য, শাদী, খাতনার উতসবকালে পৃথক কর আদায় করতে হত। কিন্তু মুসলমান রায়তকে দুর্গা, কালী, সরস্বতী পূজা উপলক্ষে চাদা দিতে বাধ্য করা ও জমিদারীর মধ্যে গো- কোরবানি নিষিদ্ধ করার মত অত্যাচার ছিল দুদু মিয়ার চোখে একেবারে অসহ্য। তিনি সব অন্যায় ও ইস্লামবিরুদ্ধ কর আদায় দেওয়া একেবারে নিষিদ্ধ করেন।
তিতুমীরের ভূমিকা প্রধানত সশস্ত্র বিদ্রোহ হলেও তার পটভূমিকা ছিল সামাজসংস্কার। তিনিও মক্কায় যান এবং সেখানে সৈয়দ আহমদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। দেশে প্রত্যাগমন করে তিনি সংস্কারকর্মে তিনি প্রথম আত্মনিয়োগ করেন এবং তার শিষ্যদের দাড়ি রাখতে ও শরীয়ত পাওবন্দ হতে শিক্ষা দেন। রায়তদের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টে ব্যাথিত হয়ে তিনি জমিদারদের বিরুদ্ধে দাড়ান। পুর্নার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় দাড়ি রাখার জন্য আড়াই টাকা ধার্য করেন, তখন জমিদারদের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে। সে বিরোধ পরে নীলকরদের ও সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে রূপ নেয়। তার শিষ্যদের বলা হত মওলবী বা হেদায়াতী।
মওলানা কেরামত আলীর জন্ম জৌনপুরে এবং তিনি ছিলেন শাহ্ আবদুল আজীজের প্রত্যক্ষ ছাত্র। সৈয়দ আহমদের একনিষ্ঠ অনুগামী হিসেবে তিনি শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদে যোগ দেন। বালাকোটের যুদ্ধের পর কেরামত আলী বাংলাদেশে হিজরত করেন ১৮৩৫ সালে এবং সেখানেই বাকি জীবন সংস্কারকর্মে অতিবাহিত করেন। রংপুরে তার কর্মকেন্দ্র স্থাপিত হয়, পূর্ববাংলা হয় তার কর্মক্কখেত্র। উল্লেখযোগ্য যে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তার বিরোধ ছিলনা এবং দ্ব্যার্থহীনভাবে তিনি ফতোয়া দিতেন, পাক- ভারত মুসলমানের পক্ষে দারুল ইসলাম। কেরামত আলী ছিলেন শুদ্ধচিত্ত সাধু মানুষ, ইসলামী শাস্ত্রে অগাধ পন্ডিত। তার সংস্কার কর্ম ছিল শান্ত ও নির্বিরোধি। ধর্মীয় সংস্কারই ছিল তার একমাত্র ভূমিকা এ সাধনায় তার কর্মপন্থা ছিল দ্বিমুখীঃ প্রথম, পূর্ববাংলার মুসলমান সমাজে যেসব বেদআত ঢুকে পড়েছে, সেগুলি নিঃশেষে নির্মূল করা, এজন্য তিনি ‘রদ্দেবিদা’ নামে পুস্তিকা রচনা করেন। দ্বিতীয়, বাউল প্রভৃতি যেসব সম্প্রদায় ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছে, সেগুলিকে সুশিক্ষা দিয়ে সংশোধন করে পুনরায় ইসলামের গণ্ডিতে আনায়ন করা; এজন্য তিনি ‘হিদায়াত- অল- রাফিদীন’ নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। মওলানা সাহেব দিবারাত্র পূর্ববাংলার গ্রামে গ্রামে ফিরেছেন প্রতিটি মুসলমানকে হিদায়েত করার দুর্বার বাসনা নিয়ে। চল্লিশ বছর তিনি নিরলসভাবে এ মহান ব্রতে অবিচলিত ছিলেন। তিনি ‘ওহাবী’ ছিলেননা, যদিও তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সৈয়দ আহমদ একজন মুজাদ্দিদ ছিলেন। এই অজাতশত্রু নিরভিমানী ন্যায়দর্শী উদার মহৎপ্রাণ উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের মুসলমানের ভাগ্যে ছিলেন আল্লাহর নিয়ামত স্বরূপ।
উনবিংশ শতাব্দীতে পাক- ভারতের মুসলমানদের মধ্যে আন্দোলনের যে জোয়ার এসেছিলো উপরে তার যথাযথ রূপ বর্ণনার প্রয়াস করা হয়েছে। লক্ষণীয় যে, সশস্ত্র আন্দোলনটাকে ‘জেহাদী- আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে; কারণ এ আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, শিখ ও ব্রিটিশ রাজশক্তির উচ্ছেদ সাধন করে পাক- ভারতকে দারুল ইসলাম রূপে কায়েম করা। ধর্মরাস্ট্র হিসেবে স্থাপিত না হলে ইসলামী ঈমান ও আমান প্রতিষ্ঠিত করা যায় না এবং ধর্মীয় সংস্কার সাধনও সম্ভব নয়- এটাই ছিলে সেকালীন মুসলমান নেতাদের বিশ্বাস আর ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার কর্মে তারা কায়েমী স্বার্থভোজীদেরও সঙ্গে সংঘাতে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন অর্থনৈতিক কারণে। এজন্য এ আন্দোলন রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক রূপের সংমিশ্রণ ঘটেছিলো। যদিও সামগ্রিক ভাবে এ আন্দোলনকে ‘জেহাদী আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করাই প্রশস্ত।
কিন্তু নেহাত মতলববাজিতে সুবিধার জন্য এ আন্দোলনকে ‘ওহাবী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এবং বিদেশী শাসক ইংরেজরা মুসলমানদের সশস্ত্র আন্দোলনকে লোকচক্ষে হেয় করবার হীন মনোবৃত্তিতে ‘ওহাবী’ নামাংকৃত করেছেন। আসলে হেজাজে আঠারো শতকে মুহম্মদ বিন আবদুল ওহহাব যে পিউরাটানিকা বা অতিনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত করেন, তার সঙ্গে পাক- ভারতীয় মুসলমানদের আন্দোলনের অনেক পার্থক্য রয়েছে। পাক- ভারতীয় আন্দোলনকারীরা কখনও নিজেদের ‘ওহাবীদের’ সঙ্গে তুলনা করেননি। এ দেশী আন্দোলনের জনক হাজী শাহ্ ওইয়ালীউল্লাহ, শাহ্ আবদুল আজোজ, সৈয়দ আহমদ শহীদ, হাজী শরীউতুল্লাহ বা তিতুমীর কেউই আবদুল ওহহাবের বা তার অনুগামীদের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসেনি।
ইসলামের চারটি মজহাবের যেকোনো একটির অনুসারী হওয়া সুন্নী মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু আবদুল ওহহা্ব ইমাম হামবলের অনুসারী হলেও তার অনুগামীরা বরং কুরআন- হাদিসেরই একান্ত অনুসারী। পাক- ভারতীয় জেহাদিরা নিষ্ঠার সঙ্গে মজহাব পন্থী ছিলেন। পীর- ফকিরী, কবর- মাজার জিয়ারতের বিরুদ্ধাচরণ করা আরবী ওহাব- পন্থীদের প্রধান নীতি। এগুলিকে তারা পুত্তলিকা জ্ঞান করে এবং বিশ্বাসে তারা ১৮০৪ সালে মদিনায় বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদের মাজার পর্যন্ত ভেঙে ফেলেছিল। এ দেশীয় জেহাদীরা কখনও কবর মাজার জিয়ারতের বিরুদ্ধতা করেনি। তাছারা বাংলাদেশে যে সংস্কারধর্মী আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল, তার সঙ্গে হেজাযী আন্দোলনের কোনও সামঞ্জস্য ছিলনা। হয়তো আরবী আন্দোলনের সঙ্গে পাক- ভারতীয় জেহাদীদের ধর্মীয় সংস্কার প্রচেষ্টায় কিছুটা মিল ছিল, কিন্তু সেহেতু জেহাদী আন্দোলনকে ‘ওহাবী’ হিসেবে চিহ্নিত করা সমীচীন নয়। জেহাদী আন্দোলনকে ইংরেজরা ‘ওহাবী’ বলে আখ্যায়িত করেছে পাক- ভারতীয় মুসলমানদের সহানিভূতি নষ্ট করে তাদের প্রতি বিতৃষ্ণা ও বিদ্বেষ জাগাবার দুরভিসন্ধিমূলে। এবং ইংরেজরা এ প্রয়াসে এক শ্রেণীর মোল্লা- মওলবীকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করেছিল প্রচারণা কার্যে। কিন্তু দুটি আন্দোলনকে একধর্মি বলে চিহ্নিত করা কখনও যুক্তিনির্ভর বা সমীচীন নয়।
উপরোক্ত মতামতের পোষকতায় প্রখ্যাত, ঐতিহাসিক রমেশ্চন্দ্র মজুমদারের এ উক্তিটি উদ্ধৃতির যোগ্যঃ
“আরব দেশে ওহাবী আন্দোলনের উদ্ভব হয়। কিন্তু ভারতবর্ষের যে অনুরূপ আন্দোলন হয়, তাহার সহিত ওহাবীদের কোন সম্মন্ধ ছিল এমন কোন প্রমাণ নাই। মনে রাখতে হবে যে, রায়বেরেলীর সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী যখন ভারতে এ আন্দোলনের প্রবর্তন করেন তখনও তিনি আরব দেশে যাননি। তাহার দল অনেকটা দৃঢ়প্রতিস্থ হইবার পর তিনি মক্কা গমন করেন। ভারতে তিনি এক বিরাট সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তাহা প্রথমে শিখ ও পরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে তুমুল সংগ্রাম করে, তাহাই এ আন্দোলনের প্রধান কীর্তি। ইহার সহিত ওহাবী মতের কোনও সম্মন্ধ নাই। ধর্মমূলক হইলেও ইহার সহিত বিনষ্ট মুসলমান রাজশক্তি উদ্ধারের আশা- আকাঙ্ক্ষা ছিল না- তাহা বলা যায়না। সুতরাং এই আন্দোলনকে এক হিসেবে ব্রিটিশ রাজত্বে মুসলমানদের প্রথম মুক্তিসংগ্রাম বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে”।