দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে অবিরাম ষড়যন্ত্র
সীমান্তের বিদ্রোহীদের এই অসাধারণ শক্তির উৎস দীর্ঘকাল যাবত আমাদের কাছে রহস্যাবৃত থেকেছে। পাঞ্জাবে আমাদের পূর্ববর্তী দেশীয় শাসক শক্তির কাছে তিনবার এরা পরাজিত হয়েছে। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর পদতলে এরা পর্যদুস্ত হয়েছে তিনবার। কিন্তু তথাপি এই বিদ্রোহী শিবির এখনো দাড়িয়ে আছে। এই অবিনশ্বরর এক অলৌকিক ঘটনারই শামিল। ভক্ত মুসলমানরা এর মধ্যেই তাদের চূড়ান্ত বিজয়ের আভাস দেখতে পায়। এর পশ্চাতে যে সত্য নিহিত রয়েছে, সেটা হচ্ছে এই যে, আমরা যখন সীমান্তের বিদ্রোহী উপনিবেশকে সামরিক শক্তিবলে পদানত করার চেষ্টা করেছি, তখন আমাদের মুসলমান প্রজাবৃন্দের ধর্মান্ধ অংশটি তাদের যুগিয়েছে অফুরন্ত অর্থ ও লোকবল। যে অঙ্গার নির্বাপিত মনে করে আমরা ফেলে দিয়েছি, তাকেই তৈল ঢেলে সযত্নে পরিচর্যায় ওরা আবার প্রজ্বলিত করে তুলেছে।
সৈয়দ আহমদ ১৮২০-২২ খ্রিষ্টাব্দে যে প্রচারকার্য চালিয়েছিল, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সেদিকে কর্ণপাত করেননি। ব্রিটিশ ভারতের সর্বত্র সে ছড়িয়ে দিয়েছি তার ভক্ত অনুচরবৃন্দকে। জনসাধারণের মধ্যে হাজার হাজার লোককে সে তার মুরিদে পরিণত করেছে। সে নিয়মিতভাবে ধর্মীয় শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরাধিকার প্রথা কায়েম করেছে। একই সময় আমাদের অফিসারবৃন্দ রাজস্ব আদায় করেছে, বিচারকার্য পরিচালনা করেছে, সৈন্য পরিচালনাও করেছে। কিন্তু তাদের চারপাশে যে বিরাট এক ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে উঠছিল। সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিল তারা। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এক প্রচন্ড আঘাত খেয়ে এই নির্বিকার অচৈতন্য থেকে জেগে ওঠে তারা। এই সময় কলকাতায় ধর্মগুরুর যেসব শিষ্য সাগরেদ ছিল, তাদের মধ্যে পেশাদার কুস্তিগির ও গুণ্ডা প্রকৃতির একটা লোক ছিল তিতু মিয়া (ওরফে নিছার আলী। জন্মস্থান চাঁদপুর, গ্রাম বাসস্থান বারাসাত) মিয়া নামে। এই ব্যক্তি এক সম্ভ্রান্ত কৃষকের পুত্র হিসেবে জীবন আরম্ভ করলেও জমিদারের ঘরে বিয়ে করে নিজের অবস্থার উন্নতি করেছিল। কিন্তু উগ্র ও দুর্দান্ত চরিত্রের দরুন তার সে অবস্থা বহার থাকেনি। কিছুদিন কলকাতায় মুষ্ঠিযোদ্ধার অসম্মানজনক জীবনযাপন করতে হয়েছিল তাকে। সে যুগে বাংলার গ্রামাঞ্চলের সম্ভ্রান্ত লোকেরা তাদের জমিজমা সংক্রান্ত এবং অন্যান্য পারিবারিক কলহ নিষ্পত্তি করার জন্য লাঠিয়ালদের সাহায্য গ্রহণ করত। এমনি এক লাঠিয়াল বাহিনীতেও সে যোগদান করেছিল। এই জীবিকার দরুন অবশেষে কারাগারে যেতে হয়েছিল। সেখান থেকে মুক্তিলাভের পর সে হজ্জ করতে মক্কায় গমন করেছিল। সেই পবিত্র নগরীতেই তার সাক্ষাৎ হয়েছিল সৈয়দ আহমদ এর সাথে। মক্কা থেকে সে ভারতে ফিরে এসেছিল শক্তিশালী একজন ধর্মপ্রচারক হয়ে। তারপর কলকাতার উত্তর ও পূর্ব দিকের জেলাগুলোতে সে ব্যাপকভাবে সফর করে এবং অসংখ্য লোককে তার শিষ্য করে নেয়। তারপর আল্লাহর তরফ থেকে কাফেরদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সে গোপন প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে সীমান্তের ধর্মান্ধ বাহিনী পেশোয়ার দখল করার ফরে তার সাহস বৃদ্ধি পায় এবং ছদ্মবেশ ফেলে দিয়ে সে আপন মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে। সে সময় তার সাগরেদদের উপর হিন্দু জমিদারগণের সামান্যতম জুলুমের (ইছামতি নদীর তীরবর্তী জমিদার কৃষ্ণ রায় তার প্রজাদের কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করলে তার উপর কর আরোপ করত উচ্চ হারে। আরেকজন জমিদারি মোহররমের সময় মন্দির ধ্বংস করার অপরাধে এক কৃষক প্রজাকে জেলে পাঠিয়েছিল) ফলেই তার নেতৃত্বে এক প্রচন্ড কৃষক বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়। এরপর একাদিক্রমে অনেকগুলো কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। সুরক্ষিত শিবির থেকে বিদ্রোহীরা ইংরেজ কর্তৃপক্ষকে অগ্রাহ্য করে এবং কিছু লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর ইংরেজদিগকে বিতাড়িত করে। কলকাতার উত্তর ও পূর্বে অবস্থিত তিনটি জেলা (২৪ পরগণা, নদীয়া, ফরিদপুর) সম্পূর্ণরূপে বিদ্রোহীদের পদানত হয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহী বাহিনীর লোকসংখ্যা ছিল তিন থেকে চার হাজার। একটি গ্রামের একজন অধিবাসী বিদ্রোহীদের দৈব অনুশাসন মেনে নিতে অস্বীকার করার ফলে সেই গ্রাম (ফরিদপুর জেলার) থেকেই তাদের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। আরেকটি জেলাতেও একটি গ্রামে (নদীয়া জেলার শরফরাজপুর) তারা লুঠতরাজ করে এবং একটি মসজিদ ভস্মীভূত করে। পক্ষান্তরে ঈমানদার লোকদের কাছ থেকে তারা নগদ অর্থ ও ধান চাউল আদায় করে। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে অক্টোবর তারিখে একটি সুরক্ষিত গ্রামে বিদ্রোহীরা তাদের সদর দফতর স্থাপন করে এবং সেখানে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে। ৬ই নভেম্বর তারিখে সেখান থেকে ৫০০ বিদ্রোহী যোদ্ধা একটি ক্ষুদ্র শহর আক্রমণ করে এবং সেখানকার পুরোহিতকে হত্যা করে। তারপর তারা সেখানে দুইটি গরু (হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবতুল্য প্রাণী) হত্যা করে তার রক্ত দিয়ে মন্দির অপবিত্র করে এবং নিহত গরুর দেহ খণ্ডসমূহ দেব প্রতিমার সম্মুখে ঝুলিয়ে রাখে। অতঃপর তারা ঘোষণা করে যে, সেখান থেকে ইংরেজ শাসন উৎখাত হয়েছে এবং মুসলমান রাজত্ব পুনঃ-প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপর তাদের অবিরাম উৎপাত চলতে থাকে। সাধারণত তারা যে কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করে সেটা হচ্ছে প্রথমে একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে গরু জবাই, গ্রামবাসীরা তাতে বাধা দিলে তাদের হত্যা অথবা বিতাড়িত করে তাদের ঘরবাড়ি লন্ঠন করা এবং অবশেষে জ্বালিয়ে দেয়া। মুসলমানদের মধ্যে যারা তাদের দলে যোগদান না করত তাদের প্রতিও বিদ্রোহীরা একই রকম বৈরী আচরণ করত। একজন বিত্তশালী মুসলমান তাদের আনুগত্য অস্বীকার কররে তারা তার বাড়ি লুট করে এবং তার কন্যাকে জোরপূর্বক তাদের দলের সর্দারের সঙ্গে বিবাহ দেয়।
কিছুদিন যাবত জেলা কর্তৃপক্ষের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর অবশেষে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই নভেম্বর তারিখে কলকাতা থেকে একদল অনিয়মিত সৈন্য প্রেরিত হয় বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য। ধর্মান্ধরা কোন প্রকার আপোষ আলোচনায় বসতে অস্বীকার করে। যাতে অনর্থক রক্তপাত না ঘটে সেজন্য উক্ত সৈন্যদলের সেনাপতি তার সৈন্যদের আদেশ দেন বন্দুকে ফাকাগুলি করতে। দলে দলে বিদ্রোহীরা আমাদের সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকলে ফাকা গুলি করা হয় তাদের উপর। কিন্তু তারা আমাদের সৈন্যদের কেটে টুকরা টুকরা করতে থাকে। কলকাতা থেকে অশ্বারোহণে মাত্র কয়েক ঘন্টার পথের দূরত্বে এসব ঘটনা ঘটছিল। ১৭ই তারিখে তথাকার ম্যাজিস্ট্রেট আরো কিছু সৈন্য যোগাড় করে পাঠালেন। তন্মধ্যে ইউরোপীয় সৈন্যদের পাঠান হল হস্তীপৃষ্টে। এক হাজার বিদ্রোহীর একটি দল তাদের ধাওয়া করে নদীর তীর পর্যন্ত বিতাড়িত কর। যারা দ্রুত পশ্চাদপসরণ করতে পারল না, তারা বিদ্রোহীদের তরবারিতে কাটা পড়ল। অবশিষ্টরা নৌকাযোগে পশ্চাদপসরণ করল। এবার বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য নিয়মিত সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করা আবশ্যক হয়ে পড়ল। কলকাতা থেকে একদল দেশীয় পদাতিক কিছু অশ্বারোহী গোলন্দাজ এবং দেহরক্ষী বাহিনীর একটি দল দ্রুত রওনা হয়ে গেল। বিদ্রোহীরা তাদের কেল্লার নিরাপত্তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আমাদের সৈন্যবাহিনীর মোকাবেলা করতে অবতীর্ণ হল। আগের দিন নিহত একজন ইউরোপীয় সৈনিকের বিকৃত মৃতদেহ সম্মুখে ঝুলিয়ে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হল তারা। প্রচন্ড যুদ্ধে পর্যুদস্ত হল বিদ্রোহীরা। পরাজিত হয়ে পরিখায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হল তারা। ধূলিসাৎ হয়ে গেল তাদের বাঁশের কেল্লা, নিহত হল তাদের অধিনায়ক তিতু মিয়া। ৩৫০ জন বিদ্রোহীকে বন্দী করা হল। বিচারের তাদের ১৪০জনকে দেওয়া হল বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড। আর তিতু মিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর একজনকে দণ্ডিত করা হল মৃত্যুদন্ডে।
সংস্কারপন্থীদের দিন ফুরিয়ে এসেছে বলে মনে হল। পাঞ্জাব সীমান্তে তাদের অধিনায়ক নিহত ও সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হয়েছে। দক্ষিণ বঙ্গের বিদ্রোহীদের অবস্থাও একই রকম। ধর্মীয় নেতা পাটনায় তার যে কয়জন খলিফা বা ধর্মীয় উত্তরাধিকারী নিয়োগ করে গিয়েছিলে, তারা এবার এগিয়ে এল। এমন সব প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী তারা হাজরি করল, যারা ঘোষণা করল যে তাদের ধর্মীয় গুরুকে মানব চক্ষুর অন্তরালে ধূলিরাশির দ্বারা সৃষ্ট মেঘের মধ্যে লুকায়িত রাখা হয়েছে। তারা তাদের অনুসারীদের বুঝাতে লাগল যে, ধর্মীয় গুরু স্বয়ং তার এই অন্তর্ধান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। গুরু নিজেই প্রার্থনা করেছিল যেন প্রাচীন যুগের মূসা নবীর মত তার করবও তার শিষ্যদের চোখের আড়ালে লুকায়িত রাখা হয়, যাতে তার অস্থি উপাসনার মত ধর্ম বিরোধী ব্যাপার না ঘটাতে পারে। খলিফারা আরো প্রচার করতে লাগল যে, বর্তমান যুগের দুর্বলচেতা মানুষের কাছ থেকে সর্বশক্তিমান তাদের গুরুকে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু ভারতীয় মুসলমানরা যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ইংরেজ কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হতে পারবে, সেদিন আবার নেতা অবতীর্ণ হবে এবং তারই নেতৃত্বে জিহাদে জয়লাভ হবে অবশ্যম্ভাবী। মুসলমানের জন্য এতে অসম্মানের কিছু নেই। পূর্বেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। ইউনুছ নবী কিছুদিনের জন্য অন্তর্ধান হয়ে এক বিরাটকায় মাছের পেটে লুকিয়েছিলেন একথা সর্বজনবিদিত। মূসা পয়গম্বরও ওহি (ঐশীবাণী) গ্রহণের জন্য সিনাই পর্বতে আরোহণ করে অদৃশ্য হয়েছিলেন। বিধর্মী গগ ও ম্যাগগকে বন্দী করেছিলেন যে মহান নেতা জুলকারনাইন, তিনিও অনুরূপভাবেই অন্তর্ধান হয়েছিলেন। ঈসা পয়গম্বরকে মৃত্যু স্পর্শও করতে পারেনি। (ক্যালকাটা রিভিউ) সুতরাং ঈমানদারগণের জন্য নতুন উদ্যমে জিহাদে যোগদান করা অবশ্য কর্তব্য। পাটনার খলিফাগণ মুজাহিদ বাহিনীর একজন নতুন সেনাপতি (মৌলভী নসরুদ্দীন) নিযুক্ত করল। তলোয়ারধারী ধর্মান্ধরে ক্রমবর্ধমান এক বাহিনী সহকারে এই সেনাপতি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
ধর্মীয় নেতারা অপার্থিব শক্তির অলৌকিকত্ব সম্পর্কে এমন দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, কিছু কাল পর্যন্ত সে রহস্য মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এবং সবকিছু চলছিল নির্বিঘ্নেই। দক্ষিণ বাংলার ভক্ত প্রচারকদের মধ্যে একজন ঢাকা ও সিলেটসহ পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় প্রচারকার্য চালাবার পর এক হাজার অনুচর সঙ্গে নিয়ে উত্তর দিকে সীমান্ত পর্যন্ত ১৮০০ মাইল অগ্রসর হয়। কিন্তু দীর্ঘকাল যাবত গুরুর অনুপস্থিতির দরুন তার মনে তীব্র উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। এবং স্বল্পস্থায়ী এক অভিযান চালাবার পরই সে স্থির করে যে, আল্লাহ তার গুরুকে যে সুদূর পর্বত গুহায় লুকিয়ে রেখেছে, সেই গুহায় সে প্রবেশ করবে। তার এই সত্য-নিষ্ঠা তার দলের অন্যান্য আগ্রহী নেতাদের সন্দিহান দৃষ্টিকে অতিক্রম করে যায় এবং সে সেই পার্বত্য তীর্থ উপস্থিত হয়। কিন্তু সেখানে সে দেখতে পায় খড় দিয়ে তৈরী তিনটি মূর্তি। এতে তার মোহভঙ্গ হয়। অভিশপ্ত গুহা থেকে সে পালিয়ে আসে এবং তার অনুচরবৃন্দকে গৃহে প্রত্যাবর্তনের হুকুম দেয়। তারপর কলকাতার সেসব মুরিদ তার কাছে অর্থ ও লোকজন প্রেরণ করছিল, তাদের কাছে ঘৃনাপরবশ হয়ে সে এক দীর্ঘ পত্রে তার মনোভাব ব্যক্ত করে।
পত্রে সে লিখেছে সালাম আলায়কুম-আল্লাহর শান্তি ও আশীর্বাদ তোমাদের উপর বর্ষিত হোক। মোল্লা কাদির ধর্মীয় নেতার মূর্তি নির্মাণ করেছিল। কিন্তু সে মূর্তি কাউকে দেখাবার আগে সে সকলকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল যে, তারা কখনো নেতার সঙ্গে করমর্দনের বা কথা বলার চেষ্টা করবেনা। কারণ তা হলে চৌদ্দ বছরের জন্য নেতা অন্তর্ধান করবে। গভীর শ্রদ্ধাভরে জনতা দূর থেকে প্রাণহীন সেই মূর্তি অবলোকন করেছিল এবং তার প্রতি অভিবাদন জানিয়েছিল কিন্তু জনতা তাদের আকুল আবেদনের কোন জওয়াব না পেয়ে তাদের ধর্মীয় গুরুর সাথে করমর্দন করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। জনতার সন্দেহ উপশম করার চেষ্টা করেছিল মোল্লা কাদির এবং সে বলেছিল, যে পূর্বাহ্ণে না জানিয়ে যদি কেই গুরুর সঙ্গে করমর্দনের চেষ্টা করে তবে গুরুর খাদেম পিস্তল দিয়ে তাকে গুলী করবে। অতঃপর চিঠিতে ধূর্ত মোল্লা কাদির কিভাবে জনসাধারণকে তাদের বে-ঈমানীর জন্য ভর্ৎসনা করে, তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল সর্বশেষে চিঠিতে লেখা হয়েছিল, অনেক অনুনয় বিনয়ের পর জনতা সেই মূর্তি পরিদর্শনের অনুমতি পেয়েছিল মূর্তি পরীক্ষা করে তারা দেখতে পেয়েছিল যে, একটি ছাগলের চামড়ার মধ্য শুকনো ঘাস পাতা ঠেসে দিয়ে কয়েকটি কাঠের টুকরো এবং কিছু চুলের সাহায্যে সেটাকে মানবাকৃতি দেওয়া হয়েছিল। পীর সাহেবকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তদুত্তরে সে এর সত্যতা স্বীকার করে বলেছিল যে, অলৌকিক শক্তিবলে তার গুরু ঐ মূর্তি ধারণ করেছিল। এসব ভণ্ডদের ভ্রান্তি এবং মিথ্যাচার এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট। আমি এ পাপ থেকে আমার আত্মাকে রক্ষা করেছি।
ধর্মান্ধরা পর্যুদস্ত বলে আরেকবার অনুমতি হয়েছিল। কিন্তু পাটনার খলিফাগণ তাদের অদম্য উৎসাহ এবং অফুরন্ত অর্থবলে তাদের ভূলুণ্ঠিত পবিত্র পতাকা পুনরায় উত্তোলিত করল। সারা ভারতে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে ইতিহাসের এক বৃহত্তম ধর্মীয় পুনরুত্থান সাধিত করল তারা। দুই খলিফা (বিলায়েত আলী ও ইনায়েত আলী। প্রথমোক্ত জন বাংলার মিশনারি সফর শেষ করে বোম্বাই নিজাম রাজ্য ও মধ্য ভারতকে তার বিশেষ কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল। পক্ষান্তরে ইনায়েত নিম্নাঞ্চলের মালদা, বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা, নদীয়া ও ফরিদপুর জেলায় তার কর্মতৎপরতা নিবন্ধ রেখেছিল। জৌনপুর নিবাসী কেরামত আলী ফরিদপুর থেকে এই আন্দোলনকে পূর্ব দিকে ঢাকা ময়মনসিংহ, নোয়াখালী ও বরিশালে সম্প্রসারিত করে। বিলায়েত আলীর দক্ষিণ ভারতীয় মুরিদ জয়নুল আবেদীনের কর্মক্ষেত্র ছিল উত্তর পূর্ববঙ্গের ত্রিপুরা ও সিলেট জেলা) স্বয়ং বাংলা ও দক্ষিণ ভারত সফর করেছিল এছাড়া তাদের অসংখ্য ছোট ছোট মিশনারি দল ছিল। দক্ষ সংগঠনর মাধ্যমে তারা মুরিদগণের তাগিদে যেখানে প্রয়োজন সেখানেই আস্তানা স্থাপন করতে পারত। এইভাবে ধর্মান্ধ অধ্যুষিত প্রায় প্রত্যেক জেলাতেই একজন করে প্রচারক নিযুক্ত হয়। ভ্রাম্যমাণ মিশনারিরা মাঝে মাঝে এই সকর জেলা সফর করে সেখানকার স্থায়ী প্রচারকদের উদ্যমকে জাগ্রত রাখতে থাকে। আর পাটনায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় প্রচার সংস্থা এই সকল প্রচারকদের প্রভাবকে স্থায়ী ও সুসংহত করতে থাকে। বাংলায় এইসব প্রচারকদের অশুভ প্রভাব কিরূপ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, সে সম্পর্কে পরে আলোচনা করব। দক্ষিণ ভারতেও এরা এমন প্রচল উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল যে, স্ত্রীলোকেরা তাদের গহনাপত্র স্বেচ্ছায় ধর্মান্ধদের তহবিলে দান করেছিল। উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো থেকে দলের পর দল লোক সংগ্রহ করে ধর্মান্ধ শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। দেশের সর্বত্র মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে তারা গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, যদিও বাঙ্গালীদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ফলেই ধর্মান্ধদের আন্দোলন এরূপ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, তথাপি এক সময় ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও এই পুনর্জাগরণের আন্দোলন সমান উত্তাপেই ফেটে পড়েছিল। পাটনার ম্যাজিস্ট্রেট লিখেছিলেন, সরকারী কর্তৃপক্ষের আশ্রয় পুষ্ট হয়ে তাদেরেই নাকের ডগায় এরা আমাদের জনবহুল জেলাসমূহের জনসাধারণের মধ্যে রাজদ্রোহমূলক প্রচারকার্য চালিয়ে যাচ্ছিল। এবং মুসলমান জনসাধারণের মনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এক অসাধারণ অথচ নিশ্চিত কুপ্রভাব বিস্তার করছিল (সরকারী কার্যবিবরণী: ১৮৬৫)
এই বিস্ময়কর প্রভাবের উৎপত্তি কেবলমাত্র অশুভ ভিত্তির উপরেই ঘটেনি, সৈয়দ আহমদ ধর্মীয় নেতা হিসেবে তার জীবন আরম্ভ করেছিল দুইটি মহান নীতির প্রবক্তারূপে। নীতি দুইটি হচ্ছে ঈশ্বরের একত্ব এবং মানুষের সাম্য। সত্যিকার ধর্ম প্রচারকরা সকলেই এই দুই নীতি অনুসরণ করে থাকে। দেশবাসীর অন্তরে যে ধর্মভাব দীর্ঘকাল যাবত সুপ্ত অবস্থায় ছিল এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত হিন্দু ধর্মের সাহচর্যের দরুন সৃষ্ট কুসংস্কার অতিমাত্রায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে মুসলমানদের মনকে যেভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, এবং ইসলাম ধর্মকে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছিল, সৈয়দ আহমদ এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরনায় অনুপ্রাণিত হয়ে নাড়া দিয়েছিল মুসলমানদের সেই ধর্মনিষ্ঠা মনের দুয়ারে। সে দেখতে পরেছিল যে, মানুষের ধর্মবিশ্বাস প্রতিমা পূজার আনুষ্ঠানিকতায় সমাহিত হয়েছে। সৈয়দ আহমদ একজন দুর্বৃত্ত ছিল। সে এবং তার ঘনিষ্ঠ শিষ্যবর্গ ভণ্ডের দলে পরিণত হয়েছিল একথা সত্য হওয়া সত্ত্বেও আমি একথা বিশ্বাস না করে পারি না যে, সৈয়দ আহমদের জীবনে অন্তর্বর্তী এমন একটা সময় ছিল, যখন সর্বান্তকরণে বেদনাকুল হৃদয়ে সে তার দেশবাসীর মুক্তি কামনা করেছিল এবং তার অন্তর নিবদ্ধ হয়েছিল একমাত্র আল্লাহর প্রতি। উত্তেজিত স্বভাবের লোক হলেও সে তার এই চরিত্র লুকিয়ে রাখত বাহ্যিক শান্ত অবয়বের মধ্যে। ধর্মীয় ধ্যানে সে এমন মগ্ন থাকত যে, সেটাকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান অনুসারে মৃগীরোগ বলে অভিহিত করা যায়। কিন্তু এশিয়াবাসীর প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এটা হচ্ছে সর্বশক্তিমানের সাথে সরাসরি যোগাযোগের লক্ষণ। অপার্থিব ধ্যান মগ্নতায় সে প্রাচীনকালের পয়গম্বরগণকে তার অন্তর্দৃষ্টিতে অবলোকন করত এবং ভারতের দুটি প্রধান ধর্মীয় মতের যে দুজন প্রবক্তা দীর্ঘকাল পূর্বেই পরলোকগমন করেছিলেন, তাদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপন করত। ১৮২০ সালে যখন সে তার মিশন শুরু করে, তখন তার বয়স ছিল চৌত্রিশ বছর। মধ্যম অপেক্ষা কিঞ্চিত দীর্ঘকায় ছিল সে। আবক্ষলম্বিত শ্মশ্রুমণ্ডিত ছিল তার মুখমন্ডল। স্বল্পভাষী ও বিনম্র স্বভাবের এই লোকটি আইন কানুন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। সাধারণ মানুষের ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কেই মতামত প্রচার করতে সে, তত্ত্বগত কোন আলোচনা করত না। শত্রুরা বলত যে, তত্ত্বগত আলোচনা করার মত যোগ্যতা ছিল না তার। পক্ষান্তরে তার শিষ্যরা বলত যে, ধর্মীয় চিন্তার যে উচ্চমার্গে সে আরোহণ করেছিল, তাতে তত্ত্বগত আলোচনা ছিল তার পক্ষে অতি তুচ্ছ বিষয়। সর্বাগ্রে যারা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে এমন দুই বিরাট পণ্ডিত ব্যক্তি ছিল, যারা লালিত হয়েছিল দিল্লীর সেই প্রখ্যাত দরবেশ সম্পর্কিত আলোচনার পরিবেশে, যিনি ভারত সূর্য নামে অভিহিত ছিলেন এবং আলোচ্য ধর্মীয় নেতাও সে দরবেশের কাছে প্রাথমিক দীক্ষা গ্রহন করেছিল।
উপরোক্ত দুই ব্যক্তি (শাহ আবদুল আজিজের ভ্রাতুষ্পুত্র মৌলভী মোহাম্মাদ ইসমাইল এবং জামাতা মৌলভী আবদুল হাই) ছিল সে যুগের শ্রেষ্ঠতম মুসলমান পণ্ডিতের পরিবারভুক্ত। ইসলামী ভাষা এবং ইসলামী আইন সম্পর্কে তিনি সযত্নে এই দুইজনকে শিক্ষাদান করেছিলেন। তারা উভয়েই তাদের দেশবাসীর ধর্মবিশ্বাস ও আচার আচরণের সংস্কার সাধনের প্রয়োজনীয়তায় অনুপ্রাণিত হয়েছিল এবং তারা উভয়ই তাদের মূর্খ পীর ভাই ও প্রাক্তন দস্যুকে এই সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বলে গ্রহণ করেছিল। এই দুই বিজ্ঞ ও বিনয়ী আইন-শাস্ত্রবিদ প্রকাশ্যে যেভাবে সামান্য আরবী জ্ঞানসম্পন্ন অশিক্ষিত প্রাক্তন অশ্বারোহী সৈন্যকে সম্মান করে, তাতে ভবিষ্যৎ ধর্মীয় তেনার প্রতি জনগণের দৃষ্টি সর্বপ্রথমে আকৃষ্ট হয়েছিল। দেশাত্মবোধ মূলক ইসলামী সাহিত্যে তাদের গভীর জ্ঞানের দরুন সৈয়দ আহমদের ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রতি তারা প্রকাশ্যে সমর্থন দান করতে সমর্থ হয়েছিল। এবং তারা নিজেরাও তার নেতৃত্ব স্বীকার করেছিল। জনগণের মধ্যে সাধারণভাবে এরূপ ধারণা প্রচলিত থাকে যে, আল্লাহ তার বান্দাহগণকে ধর্মীয় বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত করার জন্য এবং পারলৌকিক মুক্তির পথে তাদের পরিচালিত করার জন্য মাঝে মাঝে ইমাম বা নেতা প্রেরণ করে থাকেন। এই ধারনা থেকেই সাধারণ মানুষের কাছে সৈয়দ আহমদ আল্লাহর প্রেরিত প্রতিনিধির যাবতীয় লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিরূপে প্রতীয়মান হয়েছিল। প্রথমত, গোড়া মতবাদী বংশ তালিকা অনুসারে সৈয়দ আহমদ ছিল স্বয়ং মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধর। আল্লাহর রাসূলের সাথে যোগসূত্র স্থাপনকালীন তার ধ্যান-আরাধনা, তার গম্ভীর মৌনতা ও বিনয়ী স্বভাব এবং তার দৈহিক আকৃতি সব কিছুতেই মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে তার সাদৃশ্যের কথা বলা হত। যে বারোজন খলিফা সমগ্র পৃথিবীতে সত্য ধর্ম কায়েম করবে, তম্মধ্যে ছয়জনের আবির্ভাব ও তিরোভাব ইতিমধ্যেই ঘটেছে বলে ভারতীয় মুসলমানদের কোন কোন মহল (সুন্নি সম্প্রদায়। শিয়া সম্প্রদায়ের মতে ১১জনে আবির্ভাব ও তিরোভাব ঘটে গিয়েছে এবং দ্বাদশজন উত্তর পশ্চিম সীমান্তের ওপারে কোন স্থানে লুকায়িত আছে। ভারতীয় মুসলমানদের শতকরা ৯৫জনই সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত। ) মনে করে। পক্ষান্তরে অন্যরা মনে করে যে চারজনের আবির্ভাব তিরোভাব ঘটেছে। তাদের মতে সৈয়দ আহমদেই হচ্ছে পরবর্তী খলিফা। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রয় কন্যা ও তার স্বামী (সৈয়দ আহমদের পূর্বপুরুষ) স্বপ্নে তার সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের পুত্র হিসেবে তাকে অভিবাদন জানিয়েছে, সুগন্ধি আতার সহযোগে তাকে গোসল করিয়েছে এবং রাজকীয় লেবাসে তাকে ভূষিত করেছে, এরপর জনসাধারণ এমনকি সৈয়দ আহমদ নিজেই বা আর কি প্রমাণ দাবি করতে পারে? তার দুইজন সুবিজ্ঞ শিষ্যের যুক্তিতর্কের কাজে নিজেই হার মেনেছিল সৈয়দ আহমদ এবং অবশেষে নিজের খেতাব সম্পর্কে তার এমন দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল যে, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সে সার্বভৌমত্বের যাবতীয় কর্তব্যভার গ্রহণ করেছিলেন, দশমিক কর আরোপ করেছিল, ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরাধিকার বজায় রাখার জন্য খলিফা নিয়োগ করেছিল এবং পেশোয়ারে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে বিশ্বাসীদের ইমাম বলে ঘোষণা করেছিল।
অবশ্য মক্কায় হজ্জ করতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সৈয়দ আহমদ তার মতবাদ সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করেছিল বলে মনে হয় না ধর্মীয় সংস্কার সাধন সম্পর্কিত তার চিন্তাধারা ছিল সম্পূর্ণ বাস্তবভিত্তিক। শ্রোতাদের সে বলত যে, আল্লাহর ক্রোধ থেকে রহাই পেতে হলে অবশ্যই সুন্দর জীবনযাপন করতে হবে। তার অন্যতম শিষ্য তার বক্তব্যসমূহ সংকলিত করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছে। (মুহাম্মদ ইসমাইল প্রণীত সিরাতুল মুস্তাকিম) তার সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা এই গ্রন্থটি কোরআনের মত অনুসরণ করে। লেখক এই গ্রন্থে তার গুরুর সংক্ষিপ্ত বাণীসমূহকে নিজের ভক্তি মিশ্রণে সম্প্রসারিত করে লিখেছে বলে মনে করা হয়। এই সম্প্রসারণ সত্ত্বেও সৈয়দ আহমদের অনুশাসনসমূহ প্রায় সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারিক নৈতিকতা ভিত্তিক বলে প্রতীয়মান হয়। যে সকল সনদ বলে সে পাটনায় তার খলিফাদিগকে নিয়োগ করেছিল, সেগুলোতেও দৈনন্দিন জীবন ধর্মের মূলভাব সুস্পষ্ট। তার মতবাদের একমাত্র বিষয় ছিল এক ঈশ্বরের উপাসনা, এবং মানুষের প্রবর্তিত আচার ও আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করে সরাসরি উপাসনা।
করুণাময় আল্লাহর নামে! যারা আল্লাহর পথ অনুসরণ করে, সাধারণভাবে তাদের অবগতির জন্য এবং উপস্থিত ও অনুপস্থিত যারা সৈয়দ আহমদদের বন্ধু বিশেষভাবে তাদের অবগতির জন্য জানান যাচ্ছে যে, হস্তধারণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পীরের মুরিদ হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার পথ নিশ্চিত করা, এবং সেটা নির্ভর করে রাসূলের বিধান পালন করার উপর।
রাসূলুল্লাহর বিধান দুইটি ভিত্তির উপর সংস্থাপিত; এক, আল্লাহর সৃষ্ট কোন জীবকে আল্লাহর মর্যাদা দান (শিরক) না করা, দ্বিতীয় রাসূলুল্লাহ ও তার উত্তরাধিকারী বা খলিফাগণের আমলে উদ্ভাবিত হয়নি, এমন কোন নীতি বা প্রথার উদ্ভব (বিদআত) না করা। প্রথমোক্ত বিধানের অর্থ হচ্ছে ফেরেশতা, আত্মা, আধ্যাত্মিক নেতা, শিষ্য, ওস্তাদ, ছাত্র ধর্মপ্রচারক বা দরবেশ মানুষের বিপদ অবসান করতে পারে একথা বিশ্বাস করা। সুতরাং কোন আশা আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য উপরোক্ত জীবদের উপর নির্ভর করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোন কল্যাণ সাধান করা বা অকল্যাণ নিবারণ করার ক্ষমতা তাদের আছে, একথা অস্বীকার করতে হবে এবং মনে করতে হবে যে, আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে যে কোন মানুষের মত ওরাও সমান অসহায় ও অজ্ঞ। কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কখনো কোন ধর্মপ্রচারক, দরবেশ, পীর বা ফেরেশতার কাছে প্রার্থনা করা হবেনা, তাদের কেবলমাত্র আল্লাহর প্রিয় বান্দা বলে বিবেচনা করতে হবে। জীবনের দুর্ঘটনাসমূহ তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং আল্লাহর পবিত্র জ্ঞান সম্পর্কে তারা অবহিত আছে, একথা বিশ্বাস করাই হচ্ছে আল্লাহর প্রতি চরম অবিশ্বাস (কুফর) ।
দ্বিতীয় বিধান সম্পর্কে বক্তব্য হচ্ছে এই যে, রাসূলের আমলে দৈনন্দিন জীবনের যেসব ভক্তিমূলক ও অন্যান্য প্রাত্যহিক আচর আচরণ প্রচলিত ছিল নিষ্ঠার সঙ্গে সেইগুলো পালন করাই হচ্ছে যথার্থ ও নির্ভেজাল ধর্মকর্ম। বিবাহ উৎসব, শোক অনুষ্ঠান, করব সজ্জিত করা, কবরের উপর বিশাল সৌধাদি নির্মাণ করা এবং মৃতব্যক্তির স্মৃতি বার্ষিকী পালন উপলক্ষে অপরিমিত অর্থ ব্যয় করা, রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করা ইত্যাদি বর্জন করতে হবে এবং এসব ধরনের কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে (ক্যালকাটা রিভিউ) ।
ধর্মীয় নেতার ১৮২২-২৩ খ্রিস্টাব্দে মক্কা সফরের পর অনাড়ম্বর নিষ্ঠাবান জীবনযাপনের নীতিমালা নিরূপিত ও প্রচারিত হয়। সফরকালে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, পবিত্র নগরীতে মরুভূমির জনৈক বেদুঈনের প্রচেষ্টায় ব্যাপক সংস্কার প্রবর্তিত হয়েছে। তার নিজের চিন্তাধারার সঙ্গে এ সংস্কার নীতির মিল ছিল। এ সংস্কারের প্রবর্তক পশ্চিম এশিয়ায় এক বিশাল ধর্মীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ভারতে সৈয়দ আহমদ ঠিক একই রকম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আশা পোষণ করত। সুতরাং তার ধর্মমত সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে হলে আরবে ওয়াহাবী সম্প্রদায়ের উত্থান ও অগ্রগতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন।
প্রায় দেড়শ বছর পূর্বেকার কথা। ক্ষুদ্র রাজ্য নেজদ অধিপতির পুত্র আবদুল ওয়াহাব (নামটির অর্থ মহান দাতার দাস) নামে এক আরব তরুণ গিয়েছিল হজ্জ করতে। সেখানে তার সমসাময়িক হজ্জ যাত্রীদের চরিত্রহীনতা এবং পবিত্র নগরীসমূহে প্রচলিত অসংখ্য অনাচার দর্শনে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিল আবদুল ওয়াহাব। দামেস্ক নগরের ইসলাম ধর্মের দুর্নীতি সম্পর্কে সে দীর্ঘ তিন বছর যাবত গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করে এবং তারপর সে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্যোগে গ্রহণ করে। তুরস্করে ধর্মীয় পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে সে অভিযোগ করে যে, তারা ঐতিহ্য বা সুন্নতের আতিশয্যের দ্বারা কোরআনের বাণীকে অকার্যকরী করেছে। তুর্কী জাতি তাদের পাপাচারের দরুন কাফের অপেক্ষাও অধর্ম হয়ে পড়েছে। এর ফলে সে কনস্টান্টিনোপলের রাজপুরুষদের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। নগর থেকে নগরে বিতাড়িত হতে হতে সে অবশেষে দেরাইয়াহ ইবনে সউদকে নিজ ধর্মমতে দীক্ষিত করে তার কৃতকাজসমূহ সম্পর্কে তার মনে পাপবোধ জাগ্রত করে আবদুল ওয়াহাব। যথাশীঘ্র এ সকল অন্যায়ের প্রতিকার করতে সে বদ্ধ পরিকর হয়। নব দীক্ষিত ইবনে সউদের সহায়তায় সে ক্ষুদ্র এক আরব লীগ গঠন করে, কনস্টান্টিনোপল সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা ও অনাচারদুষ্ট ধর্মমতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পতাকা উত্তোলন করে। একের পর এক বিজয় লাভ করতে থাকে সে। যে বেদুঈনরা মুহাম্মদ (সাঃ) কে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বলে কখনো স্বীকার করেনি অথবা কোরআনকে যারা আসমানী কেতাব বলে গ্রহণ করেনি, তারাও দলে দলে এসে এ সংস্কারক বাহিনীতে যোগদান করতে থাকে। নেজদের বৃহত্তর অংশ অধিকার করে আবদুল ওয়াহাব তথাকার আধ্যাত্মিক প্রদানরূপে অধিষ্ঠিত হয় এবং তার জামাতা মুহাম্মদ ইবনে সউদ তথাকার রাজা হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করে। অধিকৃত প্রদেশসমূহে তারা গভর্নর নিযুক্ত করে এবং তাদের পদানত করে রাখে। শান্তিপূর্ণ সময় আইন কানুন ও ধর্মবিষয়ক কার্যাদি সম্পাদনের জন্য উপজাতীয় পরিষদ কর্তৃক একটি মন্ত্রীসভা গঠিত হয় এবং যুদ্ধকালে সমর পরিষদ গঠিত হয়।
অনতিকাল পরেই এই নতুন রাজ্য সাহসের সঙ্গে তুর্কী শক্তিকে আক্রমণ করে। ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের পাশা (পূর্বে প্রধান উজির বলা হত) সংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে বাধ্য হয়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত এ আন্দোলনের নেতারাই তুরস্কের শাসনব্যবস্থা থেকে খলিফাগণের অকর্মণ্য বংশধরদিগকে বিতাড়িত করে নতুন এক মুসলিম সাম্রাজ্য স্থাপন করে। সংস্কার আন্দোলনকারীরা যুদ্ধে যেরূপ কৃতিত্বের মাধ্যমে জয়লাভ করেছিল, বেসামরিক শাসনব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রেও তার তুলনায় কোন অংশে কম কৃতিত্ব প্রদর্শন করেনি। তাদের শক্তির প্রধান উৎস ছিল যাযাবর আরব সম্প্রদায়। এই যাযাবরদিগকে একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল তারা। নিয়মিতভাবে তারা ধর্মীয় কর আদায়ের ব্যবস্থা করেছিল যুদ্ধের সময় লুণ্ঠিত সম্পদের এক পঞ্চমাংশ রাজকোষে জমা হত, আর বাকী চারপঞ্চামাংশ ভাগ করে দেয়া হত সৈন্যদের মধ্যে। কোরআনে যাকাত নামে অভিহিত ভূমি রাজস্ব কড়াকড়িভাবে আদায়য়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যেসব জমিতে বৃষ্টি বা নদীর দ্বারা প্রাকৃতিক উপায়ে পানি সিঞ্চন হত, তার বাৎসরিক উৎপাদনের দশভাগের এক ভাগ, আর যেসব জমিতে কৃত্রিম উপায়ে পানি সিঞ্চন হত, তার ক্ষেত্রে উৎপাদনের কুড়ি ভাগের এক ভাগ ভূমি রাজস্ব আদায় করা হত। সকল রকমের ব্যবসায়ীরা কাছ থেকে তাদের মূলধনের শতকরা দেড় ভাগ শুল্ক আদায় করা হত। বিদ্রোহী অথবা বিরুদ্ধচারী নগর ও প্রদেশ প্রথম বিরুদ্ধাচরণ করলে তার শাস্তি ছিল সাধারণ লুণ্ঠন। এই লুণ্ঠিত সম্পদের এক পঞ্চমাংশ রাজকোষে জমা হত। দ্বিতীয়বারের রাজদ্রোহ বা ধর্মদ্রোহের শাস্তি হিসেবে সংশ্লিষ্ট নগর ও তৎসংলগ্ন ভূখণ্ড ওয়াহাবী তেনার সম্পত্তিতে পরিণত হত। প্রকৃতপক্ষে সংস্কার আন্দোলনকারীরা ছিল একটা যোদ্ধা সম্প্রদায়। তরবারির সাহায্যে ধর্মান্তরিত করার নীতি তারা সাহসের সঙ্গেই ঘোষণা করত। প্রতি বছর দুতিনটি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে তারা এ নীতি বাস্তবায়িত করত এবং এটা ছিল তাদের আয়ের একটি মূল্যবান উৎস।
রক্তের অক্ষরে তারা যে নীতিমালা লিপিবদ্ধ করেছিল, সেগুলো ছিল মহান। সর্বপ্রথম তারা যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করত, সেটা হচ্ছে তুর্কীরা তাদের ইন্দ্রিয় সেবাপরায়ণতার দ্বারা পবিত্র নগরীকে কলুষিত করেছিল। বহুবিবাহেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তীর্থে আগমনকালে তারা জঘন্যতম চরিত্রের স্ত্রীলোক সাথে নিয়ে আসত এবং এমন ধরনের কুকার্যে তারা লিপ্ত হত হত যে, যেগুলো ছিল কোরআনে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। পবিত্র নগরীর রাজপথে প্রকাশ্যে তারা মদ ও গাজা সেবন করত। মক্কার পথে তুর্কী তীর্থযাত্রীদল ঘৃন্যতম অমিতাচারী দৃশ্যের অবতারণা করত। আবদুল ওয়াহাব সর্বপ্রথম এই সব জঘন্য কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। ক্রমান্বয়ে তার মতাবলম্বী একটি ধর্মীয় মতবাদের রূপ ধারণ করে ও ওয়াহাবী মতবাদ (মূল আরবীতে ওয়াহাবী শব্দটির বানান হচ্ছে ওয়াহাবী, তবে ওয়াহাবী একটি ইঙ্গ ভারতীয় শব্দ হিসেবে প্রচলিত হয়েছে। ) নামে বিস্তার লাভ করে। ভারতীয় মুসলমানদের অধিকাংশই এখন এ মতাবলম্বী। এ মতবাদ অনুসারে মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রবর্তিত ধর্মকে বিশুদ্ধ আস্তিকতায় পরিণত করা হয়েছিল এবং সাতটি প্রধান নীতির উপর তাকে স্থাপন করা হয়েছিল। প্রথম হচ্ছে, এক ঈশ্বরে অবিচল আস্থা; দ্বিতীয় মানুষ ও তার স্রষ্টার মাঝখানে কোন মধ্যস্থতাকারীর অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার, সাধু দরবেশগনের প্রার্থনা, এবং এমনকি, স্বয়ং মুহাম্মদ (সাঃ) এর মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান, তৃতীয় মুসলমানি ধর্মগ্রন্থের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার অধিকার এবং পবিত্র গ্রন্থের সকল প্রকার যাজকীয় ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান; চতুর্থ মধ্য ও আধুনিক যুগের মুসলমানগণ ইসলাম ধর্ম যেসব বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা ও উৎসবাদির প্রবর্তন করেছে তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান। পঞ্চম, যে ইমামের নেতৃত্বে প্রকৃত ঈমানদারগণ কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়লাভ করতে নিরন্তর সেই ইমামের প্রতীক্ষা; ষষ্ঠ, সকল কাফেরের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধ করা যে অবশ্য কর্তব্য তা তত্ত্বগত ও বাস্তব ক্ষেত্রে সর্বদা স্বীকার করা এবং সপ্তম হচ্ছে, আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য। কার্যত ওয়াহাবীরা হচ্ছে, সুন্নি সম্প্রদায়ের একটি অগ্রগামী অংশ এবং ইসলামের পন্থী অংশ। বাংলা এবং উত্তর পশ্চিম ভারতের প্রায় সকল মুসলমান সুন্নি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। (এদের অধিকাংশই হানাফী শাখাভূক্ত সুন্নি। তবে অল্প সংখ্যক শাফি শাখাভূক্ত। হানাফীরা তাদের মহান ইমাম আবু হানিফার মতবাদ অনুসরণ করে। ইমাম আবু হানিফার জন্ম ৮০ হিজরি (৬৯৯খ্রিঃ) এবং মৃত্যু ১১৫ হিজরি (৭৩৩ খ্রিঃ) হানাফীরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে এবং নামাযের সময় দুই হাত নাভির উপর আড়াআড়িভাবে আবদ্ধ রাখে। তারা নামাযে দাড়ায় সমানের দিকে সামান্য ঝুঁকে, কিন্তু মাথার উপর হাত উঠায় না। আমিন শব্দটি তারা নিঃশব্দে উচ্চারণ করে। ইমাম আবু আবদুল্লাহ শাফীর নামানুসারে তার অনুসারী জামাতের নাম হয়েছে শাফী। ইমাম শাফী জন্ম ১৫০হিঃ (৭৬৭ খ্রিঃ) এবং মৃত্যু ২০৪ হিঃ (৮১৯ খ্রিঃ) শাফীরা নামাযের সময় হাত বাধে বুকের উপর। সিজদার সময় মাথার উপর হাত উঠায় এবং উচ্চস্বরে আমিন উচ্চারণ করে।)
আবদুল ওয়াহাবের মৃত্যু হয় ১৭৮৭ সনে। তার বিজিত রাজ্য সে অর্পণ করে যায় একজন যোগ্য উত্তরাধিকারীর হাতে। ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে ওয়াহাবীরা মক্কার শেখের বিরুদ্ধে সাফল্যমন্তিত এক অভিযান পরিচালনা করে। ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তারা বাগদাদের পাশাকে যুদ্ধে পরাজিত ও বিতাড়িত করে। এ যুদ্ধে বহু লোক নিহত হয় এবং ওয়াহাবীরা এশিয় তুরস্কের সর্বাপেক্ষা উর্বর প্রদেশসমূহ পদানত কেলে। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে তারা লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে আরেকবার মক্কা আক্রমণ করে এবং অবশেষে ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে তারা এ পবিত্র নগরী দখল করে। পরের বছর তারা মদিনা দখল করে। ইসলামের এ দুটি প্রধান আস্তানায় সংস্কারকদের ধর্মমত মেনে নিতে যারা অস্বীকার করে, তাদের হত্যা করা হয়। মুসলমান সাধু দরবেশগণের মাজারে তারা লুঠতরাজ করে ও সেগুলোর অবমাননা করে। এমনকি পবিত্র মসজিদও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায় না। এগার শতাব্দী যাবত ধর্মপ্রাণ প্রত্যেক মুসলমান রাজা বাদশাহ তাদের সাধ্যমত সেব নজরানা পাঠিয়েছিল, বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দানের সম্পদ যা কিছু সেখানে সঞ্চিত হয়েছিল, সবিই মরুভূমির এই বিদ্রোহীদের হস্তগত হয়।
দস্যু বুর্বনের আক্রমণে ভ্যাটিকান বিধ্বস্ত হওয়ার এবং এঞ্জেলায় অবস্থিত স্যান্ট নামক স্থানে ডীশুর প্রতিনিধি বন্দী হওয়ার সংবাদে খ্রিষ্টান জগতে যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল, কেবলমাত্র তারই সঙ্গে তুলনা করা যায় মুসলিম জাহানের এই আতঙ্কময় অবস্থার। মুসলমানদের শ্রেষ্ঠতম উপাসনালয় যে কেবল লুণ্ঠিতই হয়েছিল তা নয়, উপরুন্ত সশস্ত্র ধর্মদ্রোহীরা সেটাকে চরমভাবে কলুষিত করেছিল স্বয়ং রাসূলুল্লাহর সমাধিও তারা বিকৃত করে ফেলেছিল। মুসলমানদের পারলৌকিক পরিত্রাণের অন্যতম পন্থা হজ্জ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কনস্টান্টিনোপল শহরের সেন্ট সোফিয়ায় অবস্থিত মর্মর নির্মিত মসজিদ থেকে শুরু করে চীনের সীমান্ত অবস্থিত পথিপার্শ্বের পলেস্তারা দেওয়া মসজিদ পর্যন্ত মুসলমানদের প্রতিটি উপাসনাগৃহ ক্রন্দন রোলে পরিপূর্ণ হয়েছিল। শিয়া সম্প্রদায়ের কতিপয় লোক ঘোষণা করেছিল যে, দ্বাদশ ইমামের আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু গোঁড়া ঈমানদার মুসলমানরা মনে করেছিল যে, হযরত মুহাম্মদ (সা:) যে, দজ্জালের কথা উল্লেখ করে গিয়েছেন দুনিয়ায় তারই আবির্ভাব ঘটেছে এবং দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার দিন সমাগত হয়েছে।
যথারীতি রোযা নামায সত্ত্বেও ১৮০৩ থেকে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বড় রকমের কোন হজ্জ যাত্রীদল মরুভূমি অতিক্রম করেনি; ওয়াহাবীরা এ সময় সিরিয়া দখল করে, পারস্য উপসাগরে ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং কনস্টান্টিনোপল আক্রমণের হুমকি দেয়। অবশেষে মিসরের মোহাম্মাদ আলী পাশা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে সমর্থ হয়েছিল। ১৮১২ সালে টমাস কিথ নামক একজন স্কটল্যান্ডদেশীয় সেনাপতি পাশার পুত্রের নেতৃত্বে অতর্কিতে মদিনার উপর প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালনা করে মদিনা দখল করে। মক্কার পতন হয় ১৮১৩ সালে। এই বিশাল শক্তির আবির্ভাব যেমন বিস্ময়করভাবে ঘটেছিল তেমনিভাবেই পাঁচ বছর পর মরুভূমির অপসৃয়মান বালুকা পর্বতের মত এই শক্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
এবার ওয়াহাবীরা একটি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত এবং গৃহহীন সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। তারা যে মতবাদ প্রচার করে, বিত্তশালী মুসলমানদের প্রতি তার ঘৃণা ব্যঞ্জক। আনুষ্ঠানিক ধর্মতত্ব অনুসারে ওয়াহাবীরা হচ্ছে যথার্থ একেশ্বরবাদী মুসলমান। তারা মুহাম্মদ (সা:) কেও আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বলে স্বীকার করেন না, এবং তার নামে নামায পড়তে নিষেধ করে। পরলোকগত সাধুপুরুষদের নামে দোয়া দরুদ পাঠ করতেও বারণ করে তারা। তবে ব্যবহারিক জীবনে তাদের ঐকান্তিক নৈতিকতাই তাদের শক্তির গোপন উৎস হিসেবে কাজ করে। সাহসের সঙ্গে তারা সনাতন মোহাম্মদীয় ধর্মপথে প্রত্যাবর্তন করার দাবী করে। মোহাম্মদীয় ধর্ম সহজ, সরল ও পবিত্র জীবনযাত্রা সত্য প্রচারের জন্য কাফেরদের রক্ত এবং নিজেদের সর্ব স্বার্থের বিনিময়েও সংগ্রামের আহবান জানায়। তাদের দুটি প্রধান নীতি হচ্ছে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন এবং আত্মস্বার্থ পরিহার করা। তার সেই সমঝোতার অনুসরণ করে যার দ্বারা মুহাম্মদ (সা:) এর চরম ধর্মান্ধতাকে দক্ষতার সাথে একটি বেসামরিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে কার্যকরী করা হয়েছে এবং একইভাবে সেটাকে মুসলমান রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক সম্পর্কের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। তারা প্রত্যেক নবদীক্ষিত মুসলমানের কাছে যা দাবী করে তা হচ্ছে, আল্লাহর ইচ্ছার উপর সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ (ইসলাম) এবং এটাই ছিল মুহাম্মদ (সা:) এর সাফল্যের চাবিকাঠি। কিন্তু অন্যান্য সংস্কারবাদী সম্প্রদায়ের মত তারাও এই মৌলিক নীতির উপর যত বেশী জোর দিতে থাকে ততই একক ধর্মতত্ত্ব মতবাদের দরুন শিক্ষিত সমাজের মধ্যে তাদের প্রভাব ক্ষুণ্ণ হয় এবং প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রাচীন আচারানুষ্ঠানের প্রতি চরম বৈরিতার দরুন সাধারণ জনসমাজের মধ্যে তাদের মতবাদ দুর্বল হয়ে পড়ে। এশিয়ার অধিকাংশ স্থানে ওয়াহাবী মতবাদে দীক্ষিত প্রত্যেককে বিশ্বের অন্যান্য সকল প্রচলিত ধর্মমত থেকে নিজেকে অবশ্যেই বিচ্ছিন্ন করতে হবে। তাকে তার সর্বাধিক প্রিয় রূপকথা, তার সবচেয়ে পবিত্র অনুষ্ঠানাদি এবং পবিত্রতম বিশ্বাসের সাথে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এমনকি পিতার মাজারে প্রার্থনা করার মত অত্যন্ত সান্ত্বনাদায়ক অভ্যাসও তাকে বর্জন করতে হবে। (এখান এবং অন্যত্র যে প্রবন্ধটি অবলম্বন করে আমি লিখেছি সেটা ১৮৬৪ সালে ইন্ডিয়ান ডেইলী নিউজ পত্রিকায় ছাপতে দেওয়া হয়।)
অবশ্য ভারতীয় ওয়াহাবীরা মুসলমানদের হৃদয়ে অবস্থিত এমন একটা নীতির কাছে আবেদন জানায় যার তীব্রতা অন্যান্য অসুবিধাগুলোকে হালকা করে ফেলে। মক্কায় অবস্থানকালে সৈয়দ আহমদ বেদুইনদের কাছে যেরূপ সরল ভাষায় প্রচার চালান অনুরূপ সারল্য প্রদর্শন করে সরকারী কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে এ পবিত্র নগরী বেদুইনদের হামলার শিকার হয়। মুফতি প্রকাশ্যভাবে সৈয়দ আহমদের পদাবনতি ঘটান এবং শেষ পর্যন্ত তাকে শহর তেকে বহিষ্কার করেন। এ নিগ্রহের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হেসেবে তিনি ভারতে প্রত্যার্বতন করেন। কিন্তু শুধুমাত্র মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে প্রচারক হিসেবে নয়। আবদুল ওয়াহাবের ধর্মান্ধ সাগরেদ হিসেবেই তিনি ভারতে ফিরে আসেন। তার হৃদয়কন্দরে যেসব স্বপ্ন জমাট ছিল তা এখন বহিঃপ্রকাশের বিপদজনক পথ খুঁজে পায়। সে পথটি হচ্ছে, ভারতের প্রতিটি জেলায় অর্ধচন্দ্রের উদয় ঘটানো এবং বিধর্মী ইংরেজদের মৃতদেহের নিচে ক্রসকে প্রোথিত করা। তার শিক্ষায় এতদিন যা কিছু অস্পষ্ট ছিল এখন তা আবদুল ওয়াহাবের মত ধর্মীয় উগ্রনীতিতে স্পষ্টরূপে পরিগ্রহ করে। এই ধর্মীয় উগ্রতা কাজে লগিয়ে আবদুল ওয়াহাব আরবের একটা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এবং সৈয়দ আহমদ আশা করেন যে, ঐ একই পদ্ধতি অনুসরণ করে ভারতে তিনি বৃহত্তম ও অধিকতর স্থায়ী একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। পয়গম্বরের মনের ভেতরে যে পরিবর্তন ঘটেছিল, তা শুধু তিনি এবং আল্লাহ জানেন। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তার সকল বাহ্যিক আচরণে পরিবর্তন ঘটে। কেবল ধর্মান্তরকরণকেই আর তিনি জীবনের একমাত্র কাজ হিসেবে গণ্য করতে পারছেন না, কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্যই তিনি ওটা করেছেন। বোম্বাইতে যখন তিনি প্রথম অবতরণ করেন তখন তার উপদেশ ও ধর্মীয় নির্দেশ শ্রবণের জন্য জমায়েত বিপুল সংখ্যক লোক তাকে বেশী সময় আটকে রাখতে পারেনি। তিনি যেখানে গমন করেছেন সেখানেই তিনি মক্কায় যাওয়ার আগের তুলনায় অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করেন। তবে মনে হয়, এবার তিনি নির্দিষ্ট জেলাসমুহে উদ্ধত অসহিষ্ণুতার সাথে প্রচারকার্যে আত্মনিয়োগ করেন এবং দূরবর্তী সীমান্তে প্রদেশের যোদ্ধা জাতির উপরই তার দৃষ্টি সারাক্ষণ নিবন্ধ ছিল তার পরবর্তী জীবনের ঘটনাবলী আগের পরিচ্ছেদে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। তবে তার মতবাদ ও শিক্ষা সম্পর্কে এখানে কিছু বলা প্রয়োজন, যার ভিত্তির উপর তার অনুসারীরা একটা আদর্শগত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, এবং সেটা এমনই একটা ব্যবস্থা যার দ্বারা তারা ভারতীয় ইতিহাসের এক অদৃষ্টপূর্ব ধর্মীয় পুনরভ্যূত্থোনের সূচনা করে গত পঞ্চাশ বছর যাবত জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মনোভাব জিয়েই রেখেছে।
ভারতীয় ওয়াহাবীরা প্রথম যে অসুবিধার সম্মুখীন হয় সেটা হচ্ছে তাদের নেতার অন্তর্ধান। তার ব্যক্তিগত নেতৃত্বে মুসলমানরা সকর বাধা বিপত্তি কাটিয়ে বিজয়ের রক্ষ্যে উপনীত হবে এই আশা তার মৃত্যুর পর বিলীন হয়ে যায়। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, যুদ্ধ ও বিদ্রোহ, বিরাট সামাজিক অভ্যুত্থান, নিম্নশ্রেণীর লোকদের উচ্চস্থান অধিকার, ভূমিকম্প, মহামারী এবং দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার বিলুপ্তি সাধিত হবে। শেষের দিকে মুহাম্মদ (সা:) এর বংশধর ইমাম মেহেদী মুহাম্মদ (স:) এর নামে আবির্ভূত হবেন। পাঞ্জাবের উত্তর পূব সীমান্তে জন্মগ্রহণ করে জীবনের কতক অংশ তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিন হবেন আরবের শাসনকর্তা এবং কনস্টান্টিনোপলের বিজেতা, যার আগে কনস্টান্টিনোপল পুনরায় একজন খ্রিস্টান রাজার করতলগত হবে। তারপর এ্যান্টিক্রাইষ্ট আবির্ভূত হয়ে ইমামের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সংগ্রামে লিপ্ত হবেন। সবশেষে দামেস্কের পূর্বদিকের একটি শ্বেতশৃংগের উপর ঈসা আবির্ভূত হয়ে অনিষ্টকারী জাতিগুলোকে ধ্বংস করবেন এবং সমগ্র বিশ্বকে মুহাম্মদ (সা:) এর সত্যধর্মে দীক্ষিত করবেন।
ভারতীয় ওয়াহাবীরা দাবি করেন যে, সৈয়দ আহমদই সেই মহান ইমাম এবং তিনিই ঈসার চূড়ান্ত আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। কিন্তু যে ঘটনার মধ্য দিয়ে তার জীবন সমাপ্ত হয় তাতে করে ভাল ও মন্দের মধ্যে শেষ সংঘর্ষের এই জনপ্রিয় কাহিনী সঙ্গতিহীন হয়ে পড়ে। সুতরাং তারা এই জনপ্রিয় কাহিনীর উপর জোরালো আঘাত হেনে বলতে থাকে যে, প্রকৃত ইমাম মেহেদী দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার সময় আসবেন না, বরং মুহাম্মদ (সা:) এর মৃত্যু ও কেয়ামতের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি আবির্ভূত হবেন। ইমামের পরিচয় সম্পর্কে খ্রিস্টান ইতিহাসে যেসব বিবরণ আছে তার সব নিদর্শনই তার মধ্যে দেখতে পাওয়া গেছে বলে তারা দাবি করে। বহু সংখ্যক পণ্ডিত ব্যক্তিকে হাজির করে তারা প্রমাণ করতে চায় যে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই (১৭৮৬-১৮৮৬ খ্রিঃ) ইমাম মেহেদীর আগমনের কথা। আহমদ ১৭৮৬ সালে জন্মগ্রহণ করে। এমনকি ধর্মীয় বিধির পরিবর্তনকারী হিসেবে ঘৃণিত শিয়াদের প্রামাণ্য গ্রন্থগুলোকেও এ কাজে ব্যবহার করা হয়। সুন্নিদের তুলনায় শিয়াদের হিসেবে অধিকতর নির্ভুল। শিয়াদের হিসেবে অনুযায়ী হিজরি ১২৬০ সালে অর্থাৎ ১৮৪৪ সালে ইমামের আবির্ভূত হওয়ার কথা। মুহাম্মদ (সা:) কি নিজেই বলেন যাননি যে, তোমরা যখন দেখবে খোরাসানের দিক থেকে কালো পতাকাধারীদের কাফেলা আসছে তখন এগিয়ে যাবে কারণ তাদের সাথে একজন খলিফা থাকবেন যিনি আল্লাহর দূত? ভারতের উপর খ্রিস্টান রাজশক্তির আধিপত্য এবং আরো শত শত ঘটনা ইমামের আবির্ভাবের সময়কালকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিচ্ছে। এই ধারণাকে আরো বদ্ধমূল করে তোলার জন্য নানা কল্পিত ভব্যিদ্বাণীর আশ্রয় দেয়া হয়। যেসব কল্পিত কাহিনীর উপর রচিত কবিতা আজও উত্তর ভারতে শুনতে পাওয়া যায় এবং তারই কিয়দংশ এখানে তুলে দিচ্ছি:
আমি দেখতে পাচ্ছি আল্লাহর শক্তি দেখতে পাচ্ছি দুনিয়ার দুঃখ
বড় বড় সেনাবাহিনী লড়ছে আর লুঠ করছে সম্পদ
নীচ বংশের লোক যত আজেবাজে শিখে ধর্মগুরুর নামাবলী গায় দিচ্ছে।
আমি দেখতে পাচ্ছি সৎস্বভাব আর গৌরব লুপ্ত হচ্ছে;
তুর্কী আর পার্সিদের মাঝে বিরোধ
আর যুদ্ধবিগ্রহ আমি দেখতে পাচ্ছি।
দেখতে পাচ্ছি পুণ্যবানদের অন্তর্ধানে ভাল ভাল দেশ
পাপীদের অবাধ বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হল।
এসব দেখেও আমি হইনি হতাশ কারণ এমন এক
ব্যক্তিকে আমি দেখছি যিনি দুঃখকে করবেন পরাভূত।
আমি দেখছি ১২০০ বছর (মূল কবিতায় ৭৫০ বছর লেখা হয়,কিন্তু আহমদের মৃত্যুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য পরে তা পরিবর্তন করা হয়, ক্যালকাটা রিভিউ গ খন্ড, পৃ ১০০ থেকে এই কবিতাগুলো আমি সংগ্রহ করেছি) অন্তে বিস্ময়কর ঘটনারাজি ঘটতে শুরু করবে;
আমি দেখতে পাচ্ছি দুনিয়ার রাজারা সব একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়ছে,
আমি দেখতে পাচ্ছি হিন্দুদের অধঃপতন; দেখতে পাচ্ছি তুর্কীদের উপর নির্যাতন;
তারপরেই আবির্ভূত হবেন ইমাম, বিশ্বকে করবেন তিনি শাসন;
আহমদ (মূল কবিতায় মহম্মদ শব্দ লিখিত ছিল) শব্দ আমি দেখেছি এবং পড়েছি;
আর তিনিই যে সেই বাঞ্ছিত শাসক তাও আমি বুঝতে পারছি।