চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় মুসলমানদের অন্যায়
সুতরাং ভারতীয় মুসলমানরা তাদের নিজস্ব আইন অনুসারেই আমাদের শাসনাধীনে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে বাধ্য। কিন্তু কেবল ততক্ষণই এই বাধ্যবাধকতা টিকে থাকতে পারে যখন আমরা চুক্তির ব্যাপারে আমাদের দায়িত্ব পালন করব এবং তাদের অধিকার ও ধর্মীয় সুযোগ সুবিধাগুলো মেনে চলব। যখনই আমরা ধর্মীয় বিধানসমূহ পালনে বিঘ্ন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তাদের নাগরিক ও ধর্মীয় মর্যাদার (আমান) উপর হস্তক্ষেপ করব তখনই আমাদের প্রতি তাদের কর্তব্যর অবসান ঘটবে। আমরা তাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারি কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমরা আর আনুগত্য দাবি করতে পারব না। অবশ্য, ভারতে এটাই ইংরেজদের সুখ্যাতির কারণ যে, পূর্ববর্তী অন্য সকল বিজেতাদের মত সামরিক দখল বজায় রাখার পরিবর্তে জনসাধারণের চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এমন একটা বেসামরিক সরকার তারা চালু করেছে যার প্রতি জনসাধারণের শুভেচ্ছা ও সমর্থন রয়েছে। মুসলমানদের প্রতি গুরুতর কোন অন্যায় করা হলে অনুরূপ সরকারের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এমনকি তাদের সাথে ছোটখাটো অবিচার করা হলেও সেটা গুরুতর রাজনৈতিক ভ্রান্তি হয়ে দেখা দিবে; ইসলামী অনুশাসন মোতাবেক যার চূড়ান্ত পরিণতি দাঁড়াবে শাসক শক্তির সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক পাল্টে দেয়া, যাতে করে প্রজা হিসেবে তারা তাদের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং রাজদ্রোহ ও জিহাদের পথ বেছে নিতে পারে।
আমার বিনীত অভিমত হচ্ছে এই যে, ভারত সরকার একাধিকবার অনুরূপ গুরুতর ভুল করেছেন। কিন্তু আমি যেগুলোকে আমাদের ত্রুটি বিচ্যুতি বলে মনে করি সেগুলোর ওপর আলোকপাত করার আগে এ পার্থক্যটা পরিষ্কার করে, বুঝাতে চাই যে, আমার মতামত শুধু সেই সব মুসলমানদের বেলা প্রযোজ্য, যারা শান্তিপূর্ণভাবে ব্রিটিশ শাসন মেনে নিয়েছে। পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর যে দুটি বিরাট ঘটনার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে তা হল সীমান্তে অবস্থিত বিদ্রোহীদের স্থায়ী শিবির এবং সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবহমান ষড়যন্ত্র। সশস্ত্র রাজদ্রোহীদের সাথে ব্রিটিশ সরকার কোনরূপ আলাপ আলোচনা চালাতে পারে না। যারা অস্ত্রের ভাষায় কথা বরে অস্ত্র দিয়েই তাদেরকে ধ্বংস করতে হবে। শক্তির মাঝেই শান্তি নিহিত অ্যালপাইনের পল্লীতে হেয় তুপেল সড্রখের এই উপমাটি ভারত সাম্রাজ্যের বেলায় চমৎকারভাবে প্রযোজ্য। এবং অর্থনৈতিক বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক ইংরেজরা যেদিন এদেশে কোন ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধে অগ্রসর হবার শক্তি হারিয়ে ফেলবে সেদিনই তাদেরকে নিকটস্থ বন্দর থেকে জাহাজে উঠতে হবে।
আমাদের এলাকার অভ্যন্তরে রাজদ্রোহীদের বেলায়ও ন্যায়বিচার অবাধে প্রয়োগ করতে হবে; কিন্তু ন্যায়বিচারের নামে ক্ষমা প্রদর্শিত হলে এবং ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে যারা চালিত হয়নি তাদেরকেও ক্ষমার পর্যায়ে টেনে আনা হলে সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত লোকেরাও নিজ নিজ বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী রাজদ্রোহের মনোভাব পোষণ করবে। আইনসভা গ্রেফতারের যে ক্ষমতা শাসন বিভাগের ওপর ন্যস্ত করেছে তা দিয়েই সরকার দোষী ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে পারেন। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেই দলনায়কদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংযত করা যায়। এবং তার ফলে স্বধর্মীয়দের প্রকাশ্যে জমায়েত তারা আর খ্যাতির মর্যাদা লাভের সুযোগ পাবে না। এমনকি আদালত যাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে তাদেরকেও সরকার ঘৃণাপূর্ণ অনুকম্পা দৃষ্টিতে দেখে থাকেন এবং এতে করে তারা সাধারণত কয়েক বছর পরেই ওয়াহাবী মতাদর্শের পুরোধা হিসেবে মুসলমান সম্প্রদায়ের মাঝে আবার ফিরে আসতে পারে। সার্বিক দমননীতি প্রয়োগের দ্বারা ষড়যন্ত্রের মূলোচ্ছেদের চেষ্টায় পরিণতি দাঁড়াবে ধর্মান্ধদের উৎসাহকে অগ্নিশিখায় পরিণত করে সকল ধর্মভীরু মুসলমানদের সহানুভূতি তাদের দিকে আকৃষ্ট করা। অসন্তোষের সামান্যতম মনোভাব সৃষ্টির আগেই অবাধ্য শ্রেণীকে অবশ্যই আলাদা করে ফেলতে হবে এবং এটা করতে হলে সম্পূর্ণ ভদ্র প্রক্রিয়ায় অথচ সামগ্রিক মুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে।
কিন্তু অবাধ্যতার বিরুদ্ধে কঠোরতা প্রদর্শনের সাথে সাথে আমাদের অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যেন অসন্তোষ সৃষ্টির মত ন্যায়সঙ্গত কোন কারণ বিদ্যমান না থাকে। বাইরে থেকে চাপ সৃষ্টির আগেই যদি অনুরূপ অনুসন্ধান সমাধা করা যায় তবে সেটাই হবে অধিকতর সম্মানজনক। প্রচণ্ড ষড়যন্ত্রের মুখে যে সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় তার মধ্যে উদারতা বা শুভেচ্ছার মনোভাব কদাচিৎ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা যদি ইতিপূর্বে মুসলমানদের ওপর কোন ব্যাপারে অবিচার করে থাকে তবে বর্তমানে ন্যায়বিচার প্রদর্শনে বিলম্ব করার অর্থই হবে ক্ষতিকর আত্মম্ভরিতার নীতি আঁকড়ে থাকা। ভারতে ব্রিটিশ সরকার এখন এত শক্তিশালী যে তাকে আর দুর্বল ভাবার কোন অবকাশ নেই। রাজদ্রোহীদের সকলেই সরকার কারান্তরালে আটকে রাখতে পারেন;কিন্তু সমগ্র বিদ্রোহী দলটাকে কোণঠাসা করার আরও একটা মহত্তর উপায় আছে; সেটা হল সাধারণ মুসলমান সমাজ থেকে তাদেরকে আলাদা করে ফেলা। মুসলমানদের মনে অন্যায়বোধের যে পুরনো রোগ ব্রিটিশ শাসনামলে সৃষ্টি হয়েছে তাকে অপসারণ করেই এটা করা যেতে পারে।
ভারতীয় মুসলমানরা আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের যে ফিরিস্তি খাড়া করেছে, যেকোনো সরকারের বিরুদ্ধেই তা আনা যথেষ্ট এবং এটা এমনই একটা বাস্তব ঘটনা যার সম্পর্কে আমরা কানে তুলো গুজে বসে থাকলেও কোন লাভ হবে না। তারা অভিযোগ করেছে যে, তাদের ধর্ম প্রচারকদের সম্মানজনক জীবনযাপনের প্রতিটি রাস্তা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। তারা অভিযোগ করেছে যে, আমরা এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেছি যা ফলে তাদের গোটা সম্প্রদায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে এবং তারা ভিক্ষাবৃত্তি ও অবমাননাকর জীবনযাপনের অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তারা অভিযোগ এনেছে যে, তাদের যেসকল আইন অফিসার বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে ধর্মীয় অনুমোদন দান করতেন এবং স্মরণাতীত কাল থেকে যারা ইসলামী পারিবারিক আইনের ব্যাখ্যা দান ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব পালন করে এসেছেন তাদের সবাইকে উচ্ছেদ করে আমরা হাজার হাজার পরিবারকে শোচনীয় দুরবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করেছি। তারা অভিযোগ করেছে যে, ধর্মীয় কর্তব্য পালনের উপায়গুলো থেকে বঞ্চিত করে আমরা তাদের আত্মার ওপর পীড়ন চালাচ্ছি। সর্বোপরি তারা এই অভিযোগও এনেছে যে, আমরা অসদুদ্দেশ্যে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অপব্যবহার করছি এবং তাদের শিক্ষা তহবিলের বিরাট অংক আমরা আত্মসাৎ করছি। এই সকল সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যা তারা প্রমাণ করতে পারবে বলে দাবি করে এ ছাড়াও তাদের আরো অনেক ভাবাবেগপূর্ণ অভিযোগ রয়েছে, যেগুলো নির্বিকার ব্রিটিশ মনের ওপর বড় একটা দাগ না কাটলেও আয়ারল্যান্ডবাসীদের মত ভারতীয়দের অন্তঃকরণকে ও শাসকদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলতে পারে। তারা প্রচার করে থাকে যে, আমরাও যারা মুসলিম সাম্রাজ্যের ভৃত্য হিসেবে বাংলার মাটিতে পা রাখবার জায়গা পেয়েছিলাম তারাই বিজয়ের সময় কোনরূপ পরদুঃখকাতরতা দেখায়নি এবং গর্বোদ্ধত রুঢ়তা প্রদর্শনের মাধ্যমে আমাদের সাবেক প্রভুদের কর্দমে প্রোথিত করেছি। এক কথায়, ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারকে সহানুভূতিহীন, অনুদান ও নিকৃষ্ট তহবিল তছরূপকারী এবং দীর্ঘ এক শতাব্দী ব্যাপী অন্যায়াচারী হিসেবে অভিযুক্ত করে থাকে।
এসব অভিযোগ কতদূর সত্য এবং কতটা সুনিশ্চিত তা আমি খানিকটা খতিয়ে দেখতে চাই। কিন্তু পাঠকদের কাছে আমার অনুরোধ পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোতে যাদের অপকর্মের বিবরণ দেয়া হয়েছে, মুসলমানদের প্রতি আমাদের আচরণের পর্যালোচনা পাঠ করার সময় যেন তাদের বিরুদ্ধে কোন তুচ্ছ অসন্তোষ মনে না জাগে। রাজদ্রোহ এবং ধর্মমত বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে বৈদেশিক শাসনের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি এবং ইংরেজরা যতদিন ভারতকে নিজের তাঁবেদারিতে রাখতে সক্ষম হবে ততদিন তাদেরকে বুঝতে হবে যে কি করে ভেতরের রাজদ্রোহী ও সীমান্তবর্তী বিদ্রোহীদের সমভাবে মোকাবেলা করতে হয়। আমার নিজের অভিপ্রায় হচ্ছে এই যে, যেহেতু আমি মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষে যুক্তির অবতারণা করছি সেহেতু বিপথগামী ওয়াহাবীদের প্রসঙ্গটা আর উত্থাপন করব না। কিন্তু পরে যাতে তাদের সম্পর্কে আমি চুপ থাকতে পরি সে জন্য এখানে তেমন দুজন ইংরেজের কতিপয় বিবৃতি উদ্বৃত্ত করতে চাইছি যারা মুসলমানদের অভাব অভিযোগ এবং মুসলিম রাজদ্রোহের মধ্যকার সম্বন্ধ নির্ণয়ের ব্যাপারে সবচেয়ে পারদর্শী। ভারতে নিষ্ক্রিয় অসন্তোষ এবং সক্রিয় বিদ্বেষের মাঝে পার্থক্য খুবই ক্ষীণ। বাংলার শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের অভাব অভিযোগের প্রতি আমাদের উপেক্ষার কারণে এমন একটা দলের প্রতি তারা সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছে অন্য সময় হলে যাদেরকে তারা উগ্রপন্থী ও বিদ্রোহী বলে প্রত্যাখ্যাত করত।
ওয়াহাবীদের মামলায় সরকার পক্ষের ভারপ্রাপ্ত অফিসার (মিঃ জেমস ও কেনীলি, সি এস) সম্প্রতি লিখেছেন ঃ আমার মতে মুসলিম কৃষকদের ওপর ওয়াহাবী মতবাদের বিরাট প্রভাবের মূলে রয়েছে তাদের শিক্ষার প্রতি আমাদের অবহেলা।। আমাদের শাসনে পদমর্যাদা বিপর্যস্ত হওয়ার উচ্চতর শ্রেণীর লোকেরাও কিরূপে সমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাদের শিক্ষার যৎসামান্য ব্যবস্থা আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে সেসব বিষয়ের ওপরও তিনি আলোকপাত করেছেন। আম্বালা বিচারে ঠিক অনুরূপ একটি ঘটনা দৃষ্টি গোচর হবে। আমার সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ওসমান আলী বলেছে: তিন বছর হল আমি যশোর গিয়েছিলাম। সেখানে জজকোর্টের প্রধান পেয়াদার সাথে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আমি বললাম, আমার ভাগ্যবিপর্যয় ঘটেছে। জওয়াবে তিনি বললেন, তোমার মত একজন শিক্ষিত লোকের তো দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়া উচিত নয়। তুমি যদি আমার কথা মত কাজ কর তাহলে তোমার অবস্থার উন্নতি হবে। আমি জানতে চাইলাম সেটা কি? তিনি জওয়াব দিলেন তোমার ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলা গুলোয় সফর কর, স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় অনুশাসনসমূহ প্রচার কর এবং উৎসাহী লোকদের দেখতে পেলে তাদেরকে জিহাদের পথ অনুসরণের তাগিদ দাও। তার উপদেশ মোতাবেক পার্শ্ববর্তী জেলা গুলোয় আমি প্রচার চালালাম। অনেকে আমাকে অর্থ প্রদান করলেন। এই লোকটাকে আমি যতদূর জানি তাতে করে বলতে পারি যে, তিনি আংশিক নিজস্ব বিশ্বাসের দরুন এবং আংশিক অর্থের জন্য প্রচারকার্যে অংশগ্রহণ করেন। গোটা দেশ এই জাতীয় লোকে ছেয়ে গেছে। তারা কৃষকদের উত্তেজিত করেছে এবং আম্বালার ঘটনায় দেখা গেছে যে, তোদেরকে খাটো করে দেখা যায় না। এবং ভীরু বাঙ্গালীরাও উপযুক্ত পরিবেশে আফগানদের মত ভয়ঙ্কর লড়তে পারে।
আরো একজন উচ্চতর কর্তা ব্যক্তি (মিঃ ই সি বেইলী, সি. এস আই ভারত সরকারের স্বরাষ্ট দফতরের সেক্রেটারি যার পাণ্ডিত্য ও সহানুভূতির জন্য মুসলমানরাও ঋণী।) লিখেছেন: এটা বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এমন একটা ব্যবস্থা থেকে তারা নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে যা মূলত: উত্তম হলেও তাদের সংস্কারগুলোকে অনুমোদন দেয়নি এবং তারা যেসব বিষয়কে নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করে সেগুলোর কোন ব্যবস্থাও সেখানে রাখা হয়নি। আর এ ব্যবস্থাটা অনিবার্যভাবেই তাদের স্বার্থের পরিপন্থী এবং তাদের সকল সামাজিক ঐতিহ্যের বিরোধী।
পুরাতন রীতি নীতির প্রতি আস্থাবান শিক্ষিত মুসলমানরা দেখতে পাচ্ছে যে, সরকারী ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা এবং আর্থিক সুযোগ সুবিধা থেকে তারা কার্যত বঞ্চিত হয়ে পড়েছে, অথচ এসব ইতিপূর্বেই তাদের একচেটিয়া অধিকারে ছিল। তারা দেখতে পাচ্ছে যে, এগুলো সহ জীবনের অন্যান্য সকল সুযোগ সুবিধা এখন ঘৃণিত হিন্দুরা ভোগ দখল করছে। সত্যিকার ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত না হলেও ধর্মবিশ্বাসগত কারণে (পরোক্ষভাবে) তাদের প্রতি যে উপেক্ষা প্রদর্শিত হয়েছে তা থেকে উত্থিত অসন্তোষ উচ্চ শিক্ষিত মুসলমানদের মন অধিকার করে রেখেছে। তাদের এই ধর্মান্ধতা যার জন্য প্রচুর তাগিদ কোরআনে দেখতে পাওয়া যায়, ক্রমাগত ফেনিয়ে তোলা হচ্ছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত গোটা মুসলমান সম্প্রদায়কে ক্ষেপিয়ে অতি দ্রুত একদিকে একটা অজ্ঞ, ধর্মান্ধ, বিদ্রোহী জনসমাজের সৃষ্টি এবং অপর দিকে উচ্চ শিক্ষিত অথচ অত্যন্ত গোড়া একটি ক্ষুদ্র শ্রেণীর কর্তৃত্ব সাধারণ অজ্ঞ মুসলমানদের উপর প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততদিন ধর্মান্ধতায় উসকানী প্রদান অব্যাহত থাকবে।
এটা অবশ্য স্বীকার্য যে, উচ্চতম অফিসার থেকে নিম্নতর স্তরের সকল সরকারী কর্মচারীর (এবং বর্তমান ভাইসরয়ের মত আর কেউ মুসলমানদের অসন্তোষের কারণগুলোর এটাতো গভীরে প্রবেশ করেনি) এখন এই দৃঢ়-বিশ্বাস জন্মেছে ,যে মহামান্য রাণীর মুসলমান প্রজাদের প্রতি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। ভারতীয় জনসমষ্টির একটা বিরাট অংশ যাদের সংখ্যা তিন কোটির মত হবে, ব্রিটিশ শাসনে নিজেদের ধ্বংস দেখতে পাচ্ছে। তাদের অভিযোগ, মাত্র গতকালই যে দেশে তারা ছিল বিজেতা ও শাসক আজ সে দেশেই ভরণপোষণের যাবতীয় সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। তাদের অবস্থার অবনতি সংক্রান্ত এইসব অভিযোগের জওয়াব নীতিগত মনোভাবের ওপর নির্ভরশীল, কেননা তাদের প্রতি আমাদের উপেক্ষা এবং আমাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতাই এর অন্যতম কারণ। এদেশে শাসন কর্তৃত্ব হস্তান্তরিত হওয়ার আগে মুসলমানরা এখনকার মত একই ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করেছে, একই খাদ্যে খেয়েছে এবং মূলত: একইভাবে জীবনযাপন করেছে। আজ অবধি কিছুদিন পরপরই তারা পুরনো জাতীয় চেতনার অভিব্যক্তি ও যুদ্ধংহেদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে; কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে আর সব ব্যাপারেই তারা জাতি হিসেবে ধ্বংস হয়ে গেছে।
তাদের এই অধঃপতনের জন্য শুধু যে আমরাই দায়ী তা নয়। হিন্দুদের অধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই বলা চলে যে, মুসলমানরা আর আগের মত সরকারী চাকরি একচেটিয়াভাবে ভোগ দখল করতে পারে না। সম্পদ আহরণের এই প্রাচীন উপায় এখন বিকল হয়ে পড়েছে এবং মুসলমানদের এখন এমন একটা সরকারের অধীনে চাকরি-বাকরি সন্ধান করতে হবে যে সরকার গাত্রবর্ণ কিংবা ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে কোনরূপ বৈষম্যের ধার ধারে না। ভারতের উদ্ধত ও বেপরোয়া বিজেতা জাতি হিসেবে তারা হিন্দুদের অধস্তন পদে নিয়োগ করেছে কিন্তু সকল উচ্চতর পদগুলো নিজেদের দখলে রেখেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, এমনকি আকবরের প্রগতিশীল শাসন সংস্কারের পরেও বড় বড় রাষ্ট্রীয় পদসমূহ নিন্মোক্ত রূপে বণ্টন করা হয়: পাঁচ সহস্রাধিক অশ্বারোহীর অধিনায়কের পদ (মনসব। মোঘল সরকারের অধীনে হিন্দু রাজন্যবৃন্দ কলকাতা ১৮৭১ শীর্ষক প্রফেসর ব্লকম্যান কৃত চিত্তাকর্ষক অথচ সংক্ষিপ্ত বইটি পড়ে দেখুন)সহ বারটি উচ্চতর পদে একনজ হিন্দুকেও (শাহজাহানের রাজত্বকালে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এসব সামরিক পদবি বেসামরিক সরকারী কর্মচারীরা ব্যবহার করতেন।) নিয়োগ করা হয়নি। পরবর্তী পদগুলোতে পাঁচ হাজার থেকে পাঁচ শত অশ্বারোহীর অধিনায়কের পদসহ মোট ২৫২ জন অফিসারের মধ্যে মাত্র ৩১ জন ছিল হিন্দু এবং এটা হচ্ছে আকবরের রাজত্বকালের ঘটনা। পরবর্তী উত্তরাধিকারীর রাজত্বকালে একই পদমর্যাদার ৬০৯ জন কমান্ডারের মধ্যে মাত্র ১১০ জন ছিল হিন্দু; এমনকি উচ্চতর পদের সর্বনিম্ন সারির পাঁচশ থেকে দুইশ অশ্বারোহীর ১৬৩ জন কমান্ডারের মধ্যে মাত্র ২৬ জন ছির হিন্দু।
ইংরেজ গভর্নমেন্টের অধীনে সরকারী চাকরিতে অনুরূপ একচেটিয়া অধিকার ভোগ করা যাবে এ রকম আশা করা মুসলমানদের পক্ষে অত্যন্ত অযৌক্তিক হবে। কিন্তু এটাই তাদের প্রতিবেদন বা অভিযোগ নয়। তাদের ওপর থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা যে সম্পূর্ণ প্রত্যাহৃত হয়েছে তা নয়, তবে ক্রমান্বয়ে তারা এই পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জীবন সংগ্রামে তাদেরকে যে হিন্দুদের সমান সুযোগ এখন পেতেই হবে এমন নয়, কিন্তু অন্তত: বাংলায় তারা কোন সুযোগ আর পাচ্ছে না। সংক্ষেপে বলা যায় যে, তারা এমন একটা জাতি যাদের বিরাট ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও কোন ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নেই। ভারতে এ রকম একটা জাতির লোকসংখ্যা যখন তিন কোটি, তখন তাদেরকে নিয়ে কি করা যায় এ প্রশ্নটা তাদের নিজেদের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, শাসকদের জন্যও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ।
সারা পূর্ব বাংলায় কৃষকদের অধিকাংশই হচ্ছে মুসলমান। নদী বহুল ও জলাভূমিতে পূর্ণ ঐসব জেলার আদিবাসীরা ভদ্র হিন্দু সমাজের কাছে কখনও গ্রহণযোগ্য হয়নি। আর্যদের দক্ষিণমুখী অভিযান সমুদ্রোপকূলবর্তী ব দ্বীপ এলাকার গভীরে তেমন প্রবেশ করেনি, ফলে এ এলাকার আদিবাসীদের উপর ব্রাক্ষণ্যবাদের প্রভাব খুব বড় হয়ে দেখা দেয়নি। কাজে কাজেই তার হিন্দু প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে নিম্নতর শ্রেণীর হিসেবে প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলের মাছ ধরা ও প্লাবিত জলাভূমিতে ধান চাষাবাদের মত কষ্টসাধ্য জীবিকায় নিয়োজিত থাকে। তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের কঠোরতা ছিল না (আমি এখানে ব দ্বীপের সর্বশেষ ব্রক্ষ্মণ অধ্যুষিত এলাকা ঢাকা ও বিক্রমপুরের দক্ষিণে অবস্থিত জিলা সমূহের কথা বলছি। তাদেরকে এতদূর অপবিত্র মনে করা হয় যে, উচ্চবর্ণের কোন ব্রক্ষ্মণ তাদের মাঝে বসবাস করলে তাকে সমাজচ্যুত হতে হয় (ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জ জিলায় এবং সুন্দরবন এলাকায় ব্যক্তিগত অনুসন্ধান চালিয়ে আমি এসব ঘটনার সত্যতা যাচাই করেছি।) এবং পরবর্তী কয়েক পুরুষের মধ্যে তার বংশধররা আর ব্রাক্ষ্মন বলে গণ্য হয় না। আবার জাতে উঠতে হলে তাদেরকে পুনরায় উত্তরাঞ্চলে গিয়ে বসবাস করতে হয়, যে দিক থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের আগমন ঘটেছিল। (তাদের এহেন দুর্গতির কারণ এই যে, তারা নিম্নশ্রেণীর চণ্ডাল জাতের সঙ্গে বসবাস করেছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের পুরোহিত হিসেবে কাজ করেছে।) কিন্তু মুসলমানরা অনুরূপ বর্ণবৈষম্যকে আদ্যে প্রশ্রয় দেয় না। কখনও সামরিক শক্তি হিসেবে আবার কখনও ব দ্বীপ এলাকার জিলাগুলোতে কৃষি খামার গড়ার প্রকল্প নিয়ে তারা এই এলাকায় আসে। এমনকি যশোরের মত একটা পুরনো আবাদি জেলায়ও তারা এসেছিল কৃষি খামার গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে। (মিঃ জেমস ওয়েস্ট ল্যান্ড সি. এস.যশোর জিলার বিবরণ দ্রষ্টব্য (কলিকাতা ১৮৭১) ভারতীয় ব দ্বীপ এলাকার জিলাসমূহ সম্পর্কে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বিবরণের মধ্যে এটিই সর্বোত্তম।) ভারতের অভ্যন্তরভাগের প্রাচীন বীর অভিযাত্রীদের যেমন বিরাটকায় পশু বধ করে, দানবাকৃতির উপ জাতীয়দের বশীভূত করে এবং ঘন বনাঞ্চল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করতে হয়েছে, তেমনি প্রাগৈতিহাসিক যুগের ব দ্বীপ এলাকায় প্রথম বসতি স্থাপকদেরও এমন একটা অঞ্চলে জীবনে সংগ্রামে জয়ী হতে হয়েছে যে এলাকাটা ছিল সামুদ্রিক আগ্রাসনের শিকার।
মুসলমানরা এই ভূখণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলে বিরাট এলাকা সংস্কার করে বসতি স্থাপন করে। তারাই পূর্ববঙ্গকে সর্বপ্রথম সমুদ্রের গ্রাস থেকে পৃথক করে বসবাসের উপযোগী করার সুখ্যাতি অর্জন করেছে। তাদের তৈরী বাধ ও পাকা রাস্তার ওপর দিয়েই পর্যটকরা এই এলাকায় আসা যাওয়া করে এবং জঙ্গল পরিবৃত নিভৃত পল্লীর যেখানেই যাওয়া যাক না কেন সেখানেই মুসলমানদের তৈরী মসজিদ, দীঘি এবং সমাধি দৃষ্টিগোচর হবে। তারা যেখানে গিয়েছে সেখানেই তাদের ধর্ম বিস্তার করেছে, কিছুটা অস্ত্রের ব্যবহারের দ্বারা কিন্তু প্রধানত: মানব হৃদয়ের দুটো সহজাত প্রবণতার ওপর বলিষ্ঠ আবেদন সৃষ্টির মাধ্যমে। হিন্দুরা কখনই ব-দ্বীপ অঞ্চলের কৃষক অধিবাসীগণকে নিজেদের সম্প্রদায়ের অংশীভূত বলে স্বীকার করেনি। কিন্তু মুসলমানরা ব্রাক্ষ্মন ও নিম্নবর্ণের হিন্দু সকলের সামনেই ইসলামের প্রাথমিক সুবিধাগুলো তুলে ধরে। তাদের অদম্য ধর্মপ্রচারকরা প্রচার করেন: সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে তোমরা সবাই একইভাবে হাঁটু গেড়ে বস, যে আল্লাহর চোখে সব মানুষ সমান, সকল সৃষ্ট জীবই ধূলিসম নগণ্য। এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সঃ) তার প্রেরিত রাসূল। যুদ্ধ জয়ের পর পরই সৈনিকের রণ হুঙ্কার ধর্মগুরুর উপদেশামৃতে পর্যবসিত হয়।
অদ্যাবধি ব-দ্বীপ এলাকার কৃষকরা সবাই মুসলমান হয়ে গেছে। দক্ষিণ বাংলায় ইসলাম এত দৃঢ়বদ্ধ হয়ে বসেছে , সেখানে একটা ধর্মীয় সাহিত্য রীতির উৎপত্তি এবং নিজস্ব জনপ্রিয় কথ্য ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। বাঙ্গালী মুসলমানদের ভাষা আর উত্তর ভারতের উর্দুর মাঝে পার্থক্য, হেরাতের ফার্সি ভাষা ও ভারতীয় উর্দুর মধ্যেও অনুরূপ পার্থক্য বিদ্যমান। এসব পল্লীবাসীদের মধ্যে প্রাচীন প্রভাবশালী বংশীয় লোকদের উত্তরাধিকারীদের বিষয় সম্পত্তি ও ঘরবাড়ির ইতস্তত: ছড়িয়ে রয়েছে। একদা শক্তিমান নামযাদা মুসলমান অভিজাতদের ধ্বংসাবশেষ গোটা প্রদেশের সর্বত্র পরিদৃশ্যমান স্মৃতি স্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ দেখেই তাদের কীর্তির বিরাটত্ব আচ করা যায়। মুর্শিদাবাদে একটি মুসলিম আদালত এখনও পর্যন্ত তাদের অবলুপ্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থার নকল মহড়া দিয়ে চলেছে এবং প্রতিটি জেলায় সাবে নওয়াবদের কোন না কোন বংশধর ছাদবিহীন ভগ্ন প্রাসাদে অথবা শেওলা পড়া জীর্ণ দীঘির পাড়ে বসে অন্তরজ্বালায় দগ্ধ হচ্ছে। অনুরূপ পরিবারের অনেকের সাথেই আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে। এদের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদগুলো বয়ঃপ্রাপ্ত ছেলেমেয়ে নাতি নাতনী ও ভাইপো ভাইঝিতে পূর্ণ হয়ে গেছে এবং এই ক্ষুধার্ত বংশধরদের কারো সামনেই আত্মোন্নতির কোন সুযোগই আর নেই।তারা জীর্ণ ছাদযুক্ত ভগ্ন বারান্দায় বসে বসে ধুকছে, তারা ক্রমাগত ঋণের দরিয়ায় ডুবে যাচ্ছে, প্রতিবেশী হিন্দু মহাজনের সাথে ঝগড়া বিবাদে সর্বস্বান্ত হয়ে শেষ অবলম্বনটিও তার কাছে বাধা দিচ্ছে। এভাবেই এই প্রাচীন মুসলিম পরিবারগুলোর শেষ চিহ্ন মুছ যাচ্ছে।
কোন ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত কেউ জানতে চাইলে আমি নগর এর রাজাদের কথা উল্লেখ করব। ব্রিটিশরা যখন প্রথম তাদের সংস্পর্শে আসে তখন দুই শতাব্দীর ভ্রান্তি ও অপচয়ের পরেও তাদের বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড। রাজারা প্রাসাদের গম্বুজ শোভিত দরবারে বসে ইংল্যান্ডের দুটো জিলার সমান বিরাট এলাকার ওপর শাসন চালাতেন। কৃত্রিম হ্রদের এক পাশে মসজিদ এবং অন্য পাশে রাজাদের গ্রীষ্মকালীন প্রমোদ বাংলোগুলো শোভা পাচ্ছিল। এসব সৌধরাজির ছায়া হ্রদের জলরাশির ওপর অতি মনোরম দেখাচ্ছিল। হ্রদের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে ফুল বাগিচার শোভিত একখণ্ড দ্বীপ। একটা চমৎকার নৌকা হ্রদের বাধানো ঘাট থেকে ঐ দ্বীপটা পর্যন্ত যেন বুক ফুলিয়ে যাতায়াত করছে। দুর্গাপ্রাকারে সৈনিকরা পাহার দিচ্ছে; এবং অস্তগামী সূর্যের নরম আভা অপসৃত হওয়ার সময় বহুসংখ্যক ছেলেমেয়ের হাস্যধ্বনি ও রাজকীয় বাগানের মধ্যস্থিত ঝর্ণার পেছন থেকে মেয়েদের কলরব ভেসে আসে। বিরাটাকৃতির ফটক ছাড়া দুর্গের আর কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। ছাদবিহীন মসজিদে দেয়ালগাত্রে খোদিত অলঙ্কাররাজি অনেক আগেই ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। কৃত্রিম খাল শোভিত বিরাট বাগানগুলো এখন জঙ্গলে অথবা ধানক্ষেতে রূপান্তরিত হয়েছে। তাদের যে দীঘিগুলো একদিন মৎস্যরাজিতে পূর্ণ ছিল এখন তা এঁদো ডোবায় পরিণত হয়েছে। তাদের গ্রীষ্মকালীন বাংলো এখন ইটের স্তূপ ছাড়া আর কিছু নয়। ধ্বসে পড়া দেয়ালের খন্ড খন্ড ভগ্নাবশেষ এখানে সেখানে পরিদৃশ্যমান এবং মূল স্থাপত্যরীতি অনুসরণে নির্মিত বিরাটাকৃতির জানাগুলো নীরব হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে।
কিন্তু প্রাচীন রাজকীয় হ্রদের বর্তমান অবস্থাটাই হচ্ছে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক। হ্রদের অদূরবর্তী রাজপ্রাসাদ, যা এখন একটা পাতালপুরীর রূপ পরিগ্রহ করেছে, একদিন তার সুদৃশ্য প্রাচীরের মনোরম ছায়া ফেলতো হ্রদের পানির ওপর। (প্রাসাদ ও দীঘিটার অবস্থা আমি ১৮৬৪ সালে যেমন দেখেছি এখানে তার বিবরণ দিচ্ছি। এরপর আমি শুনেছি দীঘিটার সংস্কার করা হয়েছে এবং প্রাসাদটি প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে)। কারুকার্যশোভিত নাট্যশালা এখন ভগ্ন পরিত্যাগ বাড়িতে পরিণত হয়েছে। দুর্দশাকবলিত মহিলারা, যারা এখনও নিজেদেরকে প্রিন্সেস (রাণী) উপাধিতে ভূষিত করেন, এখন আর রাজকীয় হ্রদে সন্ধ্যাকালীন নৌবিহারে গমন করেন না। একালের রাণীরা এখন আর ছাদের নীচে বসবাস করেন না। একদিন যারা ছিল প্রাসাদের বাসিন্দা, তারা এখন আস্তাবল সদৃশ জীর্ণ কোঠায় বসবাস করছে। নগর রাজাদের বিলীয়মান ঐশ্বর্যের মধ্যে হ্রদের ছোট্ট জলস্রোতটি ছাড়া এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। পুরনো এই রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষের মাঝে দাড়িয়ে পথিকের মনে জেগে ওঠে প্রাচীন রোমের চোখ ধাঁধানো ঐশ্বর্যের অনুরূপ ধ্বংসাবশেষের স্মৃতি:
টাইবারের ঐশ্বর্য দ্রুত অপসৃয়মান,
নিয়তির লিখন কে পারে খণ্ডাতে?
বিশ্বকর্মার এ কি পরিবর্তনশীল লীলা!
যা কিছু কঠিন অবশেষে তাই পড়ে ধ্বসে;
যা কিছু উপযুক্ত তাই টিকে যায় শেষে। (বেলী রচিত স্পেন্সারের রোমের ধ্বংসাবশেষ)
ভগ্ন প্রাসাদরাজির এক কোণায় বসে রাজপরিবারের বংশধররা মজে যাওয়া হ্রদের দিকে স্বপ্নাতুর দৃষ্টি মেলে নিকৃষ্ট ধরনের মিষ্টান্ন চিবোচ্ছে আর নিজেদের দুঃখ দুর্গতির কাহিনী আলোচনা করছে। কোন রাজনীতিবিদ যদি ব্রিটিশ কমন্স সভায় আলোড়ন সৃষ্টি করতে চান, তাহলে বাংলার যেকোনো পুরনো মুসলিম পরিবারের সত্যিকার ইতিহাস বর্ণনা করাই তার পক্ষে যথেষ্ট হবে। তাকে প্রথমে বর্ণনা করতে হবে পুরনো সেই মহামান্য রাজার কাহিনী যিনি তার সেনাবাহিনীর প্রধান অধিনায়ক হেসেবে বিরাট জনপদের ওপর শাসন চালিয়েছেন, সারা জীবন যিনি বিভিন্ন মনোরম প্রাসাদে রাজ দরবারের যাবতীয় নিয়ম কানুনসহ জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং মৃত্যুর পর যার সমাধিসৌধ ঘিরে গড়ে উঠেছে জাঁকালো মসজিদ আর সে সবের দেখাশোনার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ওয়াকফ (ধর্মীয় ট্রাস্ট)। এরপর তাকে বর্ণনা করতে হবে বর্তমান সময়ের সেইসব নির্বোধ প্রায় রাজকীয় বংশধরদের কাহিনী, যারা তাদের বাগানে কোন ইংরেজ শিকারীদলের আগমনের কথা শোনামাত্র গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে থাকে এবং আগন্তুক মেহমানের প্রতি সম্মান দেখাবার কথা বলে বৃত্যরা তাদেরকে টেনে বের করে আনলে যারা একঘেয়ে নাকিসুরে বলে চলে যে, কদিন আগেই মাত্র কয়েকশ টাকার জন্য তাদেরই প্রসাদে একজন ব্যবসায়ীর প্রাণনাশ করা হয়েছে।
আমি বাংলার মুসলমান কৃষক ও মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর কথা মোটামুটি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করলাম। কারণ, যে বিশেষ একটা সম্প্রদায়ের অভাব অভিযোগ নিয়ে এই অধ্যায়ের আলোচনা করা হচ্ছে তাদের সম্পর্কে ইংরেজদের সৃষ্টির সামনে প্রকৃত ছবিটা তুলে ধরা প্রয়োজন। আমি আবার উল্লেখ করছি যে, আমার মতামতগুলো কেবলমাত্র দক্ষিণ বাংলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই প্রদেশের ঘটনাবলীর সাথেই আমি বিশেষভাবে পরিচিত এবং আমি যতদূর জানি তাতে করে বলা যায় যে, এখানকার মুসলমান অধিবাসীরাই ব্রিটিশ শাসনে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিম্নোক্ত মন্তব্যসমূহ ভারতের সকল মুসলমানদের বেলায় প্রযোজ্য এ কথা বিশ্বাস করতে হলে, কিংবা পাঠকদের বিশ্বাস করাতে বলা আমার জন্য খুবই দুঃখজনক।
কোন জাতিকে যদি আত্মোন্নতির প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি করতে হয় তবে তারা হচ্ছে দক্ষিণ বাংলার মুসলমান অভিজাত শ্রেণী। তাদের সম্পদ আহরণের পুরনো উপায়গুলো বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিবেশী হিন্দু উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর প্রভাব প্রতিপত্তি বিনষ্ট কেরা; কৃষকদের উপর লুণ্ঠন চালাবার জন্য সৈন্য পাঠানো; আগন্তুক ব্যবসায়ীদের উপর কর ধার্য করা; ভূমি রাজস্ব ব্যয় করে বন্ধুর সাহায্য আদালত থেকে মুক্তি বা অব্যাহতি ক্রয় করা, বিবাহ জন্ম ফসল কাটা ও গ্রামীণ জীবনের অনুরূপ বহুবিধ ছোট খাটো বিষয়ের উপর কর ধার্য করে অর্থ আদায় করা ইচ্ছামত আবগারি শুল্ক উসুল করা এবং পবিত্র রমজান মাসে নিষিদ্ধ মাদক দ্রব্য বিক্রি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা ইত্যাকারের যাবতীয় সুযোগ ও অধিকারের কাজ তাদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। রাজকীয় কর আদায় ব্যবস্থাটা ছিল বাংলায় অর্থ উপার্জনের প্রথম বিরাট সুযোগ এবং মুসলমান অভিজাত ব্যক্তিরা এই ব্যবস্থাটা একচেটিয়াভাবে অধিকার করেছে। (এটা অধিকতর বিশ্লেষণ সাপেক্ষ ব্যাপার এবং পরে এ প্রসঙ্গে আরো আলোচনা করা হচ্ছে) পুলিশের সকল অফিসার ছিল মুসলমান এবং পুলিশবাহীনি তাদের অর্থোপার্জনের তৃতীয় বৃহত্তম সূত্র এবং এখানেও মুসলমানদের একচেটিয়া অধিকার কায়েম ছিল। সর্বোপরি তাদের সেনাবাহিনী ছিল, যার অফিসাররা মোটেও প্রাপ্ত কমিশনের অর্থ ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখে তার সূদের উপর নির্ভরশীল থাকার মত ভদ্রলোক ছিল না বরং এই অফিসাররা ছিল বিজেতা সামরিক ব্যক্তিদের এমন একটা সংঘবদ্ধ দল যারা কৃষকদেরকে সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্ত করে তাদের নামে বেতন বাবদ বিরাট অংকের টাকা রাষ্ট্রীয় খাজাঞ্চি খোনা থেকে সংগ্রহ করত। একশ সত্তর বছর আগে বাংলার কোন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তানদের দরিদ্র হয়ে পড়া ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, কিন্তু বর্তমানে তার পক্ষে ধনী হওয়াটাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে মুসলমান অভিজাত ব্যক্তিরা ছিলেন বিজেতা এবং সেইহেতু সরকারী প্রশাসনের ওপর স্বভাবতই তারা একচেটিয়া অধিকার দাব করেছেন। হয়ত কখনও কোন বিত্তবান হিন্দু এবং কদাচিৎ কোন হিন্দু সেনাধ্যক্ষ প্রশাসনযন্ত্রের উপরিস্থরে ঠাই পেয়েছে। (এরকম ঘটনা যখনই ঘটেছে তখনই তা মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষের কারণ সৃষ্ট করেছে। অর্থ লগ্নীকারী রাজা টোডরমল এবং সেনাপতি রাজা মানসিংহের ঘটনা হচ্ছে এ সম্পর্কে সর্বাধিক পরিচিত দুটো ঘটনা। তাদের পদোন্নতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য সাধারণ মুসলমানরা দিল্লী বাদশাহী দরবারে আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল। কিন্তু সংখ্যক মুসলমান সেনাধ্যক্ষ রাজা মানসিংহের অধীনে রাণা প্রতাপের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিল। অপেক্ষাকৃত কম সংকীর্ণমনা মুসলমান বাদশাহদের আমলে কতজন হিন্দু উচ্চপদে নিযুক্তির সুযোগ লাভ করে সে হিসেব ইতিপূর্বে আমি উল্লেখ করেছি।)
কিন্তু এরকম ব্যাপার এত কম ঘটেছে যে, এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, এগুলো ছিল একান্তই বিরল ঘটনা। তিনটি পৃথক সূত্র ধরে অভিজাত মুসলিম পরিবারে অর্থাগম হত সামরিক অধিনায়কত্ব ,রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা এবং বিচার বিভাগীয় অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতা। এগুলোই ছিল তাদের বিরাট অবস্থার আইনানুগ সূত্র, এছাড়াও ছিল দরবারের চাকরি এবং ভাগ্যোন্নতির আরো শত রকমের অজানা সূত্র। শেষোক্ত সূত্রগুলো সম্পর্কে আমি শেষ প্যারার প্রারম্ভে আভাস দিয়েছি এবং এ বিষয়ে অধিক আর কিছু বলব না কিন্তু সরকারী ক্ষমতার যে তিনটি আইনানুগ ও প্রকাশ্য সূত্রের ওপর তারা একচেটিয়া অধিকার ভোগ করেছে তার মাঝে আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেই আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই যে, ব্রিটিশ শাসনাধীনে দক্ষিণ বাংলার মুসলমান পরিবারগুলোর সামনে ঐ সূত্রগুলোর কিছু আর অবশিষ্ট আছে কিনা।
সূত্রগুলোর প্রথমটি হচ্ছে সেনাবাহিনী এবং সেখানে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কোন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান আমদের কোন রেজিমেন্ট আর প্রবেশ করতে পারে না; এবং যদিওবা আমাদের সামরিক ব্যবস্থায় তার জন্য কদাচিৎ কোন জায়গা করে দেওয়া যায় তবু সেটা তার জন্য অর্থোপার্জনের কোন সুযোগই আর সৃষ্টি করতে পারে না (নগণ্য সংখ্যক অভিজাত মুসলমান গভর্নর জেনারেলের কাছ থেকে কমিশন লাভ করেছে। কিন্তু আমার জনা মতে, রাণীর কাছ থেকে কমিশন একজনও পায়নি। ভারতীয়রা কেবলমাত্র সাধারণ সৈনিক হিসেবে আমাদের সামরিক বাহিনীতে প্রবেশ করতে পারে এবং কদাচিৎ কারো কোন পদোন্নতি হয়ে থাকলে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। কারণ স্থানীয়ভাবে কমিশন পেয়েই ও রকম পদোন্নতি ঘটেছে। এমনকি যে একটিমাত্র ক্ষেত্রে কোন মুসলমান সম্মানজনক ক্যাপ্টেন উপাধি লাভ করেছেন তিনি হলেন ক্যাপ্টেন হেদায়েত আলী। সিপাহী বিদ্রোহের সময় কর্নেল র্যাটারী তাকে সামনে টেনে আনেন তার সম্পর্কে আমি যা জানি তা হল, শুধুমাত্র নিজের কর্মগুণে কোন মুসলমান মহামান্য রাণীর কমিশন লাভ করতে পারেন।))। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস আজ হোক কাল হোক, অভিজাত ভারতীয়রা কতিপয় বিধিনিষেধের আওতায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে প্রবেশাধিকার লাভ করবে। যেকোনো রেজিমেন্টের সৈনাপত্যের দায়িত্ব সব সময় একজন ইংরেজর উপর ন্যস্ত থাকবে। অবশ্য, এই নতুন ব্যবস্থা কার্যকরী করার আগে এর বিভিন্ন দিক পরীক্ষা করে দেখা দরকার। কেননা উত্তর ভারতের সামরিক জাতিগুলো তাদের বর্তমান উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্ব যেকোনো সময় ঘুরে দাড়াতে পারে অশ্বারোহী সৈনিক হিসেবে তারা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। সামরিক বাহিনীতে এদের অন্তর্ভুক্তি সাগ্রহে অনুমোদিত হওয়া উচিত। বর্তমানকালে, রাণী অধীনস্থ সামরিক বাহিনীর কোন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারের পক্ষে বিরাট সৌভাগ্য গড়ে তোলা সম্ভবপর নয় এবং এ সম্পর্কে মুসলমানরা যথেষ্ট সচেতন রয়েছে। কিন্তু সামরিক বাহিনীতে চাকরির সম্মান ও ভদ্রোচিত জীবনযাপনকে খাটো করে দেখে তারা তীব্রভাবে অনুভব করে যে, উত্তরাধিকার সূত্রে যে সুযোগ সুবিধা তাদের পাওয়া উচিত ছিল তা থেকে তারা বঞ্চিত রয়েছে। (এ মতের প্রবক্তাদের মধ্যে আমি বেঙ্গল ক্যাভালরীর ক্যাপ্টেন অসবর্ণের নাম উল্লেখ করব। অতি সম্প্রতি তিনি ক্যালকাটা অবজারভারে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন)
অভিজাত মুসলমানদের সৌভাগ্য গড়ার দ্বিতীয় সূত্র ছিল রাজস্ব আদায়। এ ব্যাপারে তারা যে একচেটিয়া কর্তৃত্ব ভোগ করেছে তার মূলে ছিল ইসলামের রাষ্ট্রীয় আইন কানুন। কর আদায় ছিল জয়ের অনিবার্য চিহ্ন এবং বিজেতারা শুধু যে কর পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন তাই নয়, বরং এটা আদায়ের দায়িত্বও ছিল অত্যন্ত লাভজনক কাজ। আর এ ব্যাপারে তো বিতর্কের তেমন অবকাশ নেই যে, ভারতে স্থানীয় জনসাধারণের সাথে বিজেতাদের সম্পর্ক রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তার পরিবর্তে বরং মুসলিম আচরণবিধির দ্বারাই নির্ধারিত হত। গর্বিত বিদেশীরা খুঁটিনাটি কর সংগ্রহ কার্যকে ঘৃনার চোখে দেখত এবং সেজন্য কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কর আদায়ের দায়িত্ব হিন্দু পেয়াদাদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এ ব্যবস্থাটা এতদূর সর্বব্যাপী হয়ে দাড়ায় যে, আকবর ঠিক এই কারণটির দৃষ্টান্ত টেনে একজন হিন্দুকে অর্থমন্ত্রীর পদে নিয়োগ করেন। সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী পদে টোডরমলের নিয়োগের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশের জন্য মুসলমান রাজন্যবৃন্দ বাদশাহর কাছে প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। বাদশাহ প্রশ্ন করেন, আপনাদের সম্পত্তির এবং উপঢৌকন হিসেবে প্রাপ্ত জমিজমার দেখাশুনা কারা করে থাকে?
আমাদের হিন্দু কর্মচারীরা রাজন্যবৃন্দ জওয়াব দিলেন। আকবর বললেন: ভাল কথা। তাহলে আমাকেও আমার সম্পত্তি তদারকের জন্য একজন হিন্দু কে নিয়োগ করতে দিন।
অর্থ সংক্রান্ত ঊর্ধ্বতন পদগুলো মুসলমানদের হাতে থাকলেও কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায়ের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব তাদের হিন্দু পেয়াদাদের উপর ন্যস্ত করা হয়। এতে করে হিন্দুরা কাযতঃ একটি অধস্তন রেভেনিউ সার্ভিস গড়ে তোলে এবং আদায়কৃত রাজস্ব উপরওয়ালা মুসলমান কর্তাদের কাছে সমর্পণের আগে তারা তাদের নিজস্ব মুনাফাটা পকেটস্থ করে ফেলতো। শেষোক্ত ব্যক্তিরা বাদশাহর কাছে দায়ী ছিল এবং তারা মুসলিম অর্থ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সংযোগসূত্রে পরিণত হয়। সিভিল কোটের মাধ্যমে নয়, বরং সৈনিকের ধারালো তলোয়ারের বলেই তারা ভূমিরাজস্ব উসুল করত বিভিন্ন জেলায় বকেয়া খাজনা উসুল করার জন্য লুণ্ঠনকারী দস্যুদের নিয়োগ করা হত এবং তারা শেষ পয়সাটা আদায় না হওয়া পর্যন্ত গ্রামবাসীদের উপর উৎপীড়ন চালিয়ে যেত। কৃষকরা এবং হিন্দু পেয়াদারা সব সময় নির্ধারিত খাজনার চেয়ে কিছু কম আদায় হলে তাতেই সন্তুষ্ট থাকত: কিন্তু ঊর্ধ্বতন মুসলমান অফিসাররা নির্দিষ্ট অংক অপেক্ষা যতটা সম্ভব বেশী আদায়ের জন্য নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা চালাতেন।(রাজস্ব আদায়ে এই দ্বৈত সংঘাতের চমৎকার বিবরণ যশোর জেলা সম্পর্কিত মিঃ ওয়েষ্টল্যান্ডার সাম্প্রতিক রিপোর্টে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বাংলার প্রায় প্রতিটি জিলার মহাফেজ খানায় এই রিপোর্ট পাওয়া যাবে)
বাংলায় ইংরেজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় দিল্লীর বাদশাহের প্রধান রাজস্ব অফিসারদের দায়িত্ব লাভের ঘটনার মাধ্যমে। মোটা অংকের উৎকোচ দেয়ার পরিবর্তে তলোয়ারের জোরেই এই নিয়োগ আমরা ক্রয় করেছি। কিন্তু আমাদের পদের নাম ছিল বাদশাহর দেওয়ান বা প্রধান রাজস্ব অফিসার (মিঃ আইচিসনের চুক্তিনামায় ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট তারিখের ফরমান অথবা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক প্রণীত ১৮১২ সালের কোয়াটো তথ্যমালা থেকে (১৬ নং ও ২০ নং) দেখুন) এ কারণে মুসলমানরা মনে করে যে, মুসলামানদের প্রবর্তিত বিধিব্যবস্থাগুলো যথাযথভাবে মেনে চলতে আমরা বাধ্য; কারণ ঐ বিধিব্যবস্থার প্রশাসনের দায়িত্ব আমাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। আমার মতে, এ সম্পর্কে সংশয়ের খুব কমই অবকাশ আছে যে, চুক্তি রচনার সময় উভয় পক্ষ এটাই বুঝেছিল (ওয়াহাবী মামলায় সরকার পক্ষের ভারপ্রাপ্ত অফিসার লিখেছেন: কতকটা প্রতিশ্রুতি আকারে তৎকালে প্রচলিত মুসলমানী বিধান মেনে চলার অঙ্গীকার আমরা করেছিলাম এবং তা আমরা আজো পরিণত করি) যদিও অনুদান ও চুক্তির দ্বারা আমরা একেবারে অধস্তন কর্মচারীর পর্যায়ে নেমে যাইনি বলেই আমার ধারণা। ইংরেজরা বেশ কয়েক বছর মুসলমান অফিসারদের স্বপদে বহাল রাখে। এবং তারা যখন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ার কথা চিন্তা করে তখন যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে ধীরে সুস্থেই তা করা হয়। পুরানো ব্যবস্থার ওপর যে প্রচন্ড আঘাতটা আমরা হেনেছি সেটা বোধকরি শঠতার পর্যায়েই পড়ে এবং ইংরেজরা বা মুসলমানরা কেউই এর পরিণতি তখন উপলব্ধি করতে পারেনি। এটা হচ্ছে লর্ড কর্নওয়ালিস এবং জনশোর প্রবর্তিত এক গাদা সংস্কার কার্যক্রম, ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যে যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে। এই নয়া ব্যবস্থা প্রবর্তনের দ্বারা আমরা সেই সব উচ্চপদস্থ মুসলমান অফিসারের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছি যারা ইতিপূর্বে প্রকৃত কর আদায়কারী কর্তৃপক্ষ ও সরকারের মাঝে যোগসূত্র ছিল এবং যাদের অশ্বারোহী পেয়াদারা ছিল ভূমিরাজস্ব নীতি কার্যকরীকরণের স্বীকৃত বাহিনী। মুসলমান রাজস্ব অফিসার এবং তার সশস্ত্র পেয়াদা বাহিনীর জায়গায় আমরা প্রতি জেলায় একজন করে ইংরেজ কালেক্টর নিয়োগ করি। তাদের সাহায্যকারী হিসেবে ছিল গুটিকতক নিরস্ত্র রাজস্ব পুলিশ এবং এরা তার আদালতের সাধারণ চাপরাশির মতই কাজ করত। ফলে মুসলমান অভিজাতরা ভূমিরাজস্ব ব্যস্ততার সাথে তাদের সাবেক সম্বন্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, অথবা জমির আয়ের একটা নির্ধারিত অংশের ভোক্তা হিসেবে নিছক জমির মালিকে পরিণত হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা এই পরিবর্তন সূচিত না হয়ে এবং এর পরিসমাপ্তিকেই চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে এই ব্যবস্থা অভিজাত মুসলমান পরিবারগুলোর মর্যাদায় মারাত্মক আঘাত হানে। কেননা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মৌল উদ্দেশ্যই ছিল কৃষকদের ওপর তদারকির কার্যে নিয়োজিত অধস্তন হিন্দু অফিসারদের জমির মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ১৭৮৮-১৭৯০ সালের এম.এস সেটেলমেন্ট রিপোর্টটি আমি সযত্নে পড়ে দেখেছি; এবং ১৭৯৩ সালের আইনে মধ্যস্বত্ব ভোগীদের সম্পর্কে যে ব্যবস্থাই থেকে থাক না কেন, আমার কাছে এটা খুবই স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে যে, আমাদের তদানীন্তন রাজস্ব অফিসারদের দৃষ্টি পূর্ববর্তী ব্যবস্থার মাত্র তিনটি যোগসূত্রের উপর নিবন্ধ ছিল, রাষ্ট্র, স্থানীয় এজেন্ট বা জমিদার যারা সরাসরি কৃষকদের কাছে থেকে খাজনা আদায় করত এবং কৃষক যারা জমি চাষ করত। পুরনো ব্যবস্থার এই তিনটি বিষয়ই শুধু আমাদের নয়া পরিকল্পনায় বহার থাকে এবং মুসলমান আমলে রাজস্ব ব্যবস্থার বাদবাকি সব যোগসূত্রগুলোকে হয় বাতিল করা হয় অথবা বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেয়া হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ স্বতন্ত্র তালুকদার বা অধস্তন ভূস্বামীদের পৃথকীকরণ সংক্রান্ত ব্যবস্থাটির কথা উল্লেখ করা যায়। এই তালুকদাররা ঊর্ধ্বতন মুসলিম জমিদারদের কাছ থেকে জমির স্থায়ী দখলিস্বত্ব লাভ করে ভূমি রাজস্ব সরাসরি রাষ্ট্রকে প্রদান করত এবং তারা অনেক মুসলমান অভিজাত পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তির শিকারে পর্যবসিত হয়। এই পরিবারগুলো তাদের জমিদারী কোন বিশেষ এলাকা স্থায়ী ভিত্তিতে খামার হিসেবে পত্তনী দিলেও তারা অধস্তন ভূস্বামীদের উপর সর্বদাই খবরদারী চালাত এবং প্রয়োজনমত তাদেরে কাছ থেকে অতিরিক্ত কর কিংবা যেকোনো ছুতানাতায় অর্থ আদায় করত। সে অফিসারটি মুসলমানদের অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনটি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিশ্লেষন করেছেন তিনি লিখেছেন: যেসব হিন্দু কর আদায়কারী ঐ সময় পর্যন্ত নিম্নপদের চাকরিতে নিযুক্ত ছিল, নয়া ব্যবস্থার বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয়। নয়া ব্যবস্থা তাদেরকে জমির উপর মালিকানার অধিকার এবং সম্পদ আহরণের সুযোগ সুবিধা প্রদান করে, অথচ মুসলমানরা নিজেদের শাসনামলে এবং সুযোগ সুবিধাগুলোই একচেটিয়াভাবে ভোগ করেছে। (মিঃ জেমস ও কিনীলি)
অতএব এটাই হচ্ছে প্রথম সাধারণ অন্যায়, যার জন্য অভিজাত মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারকে প্রকাশ্যে দোষারোপ করে থাকে। তাদের অভিযোগ হল, আমরা এই শর্তে মুসলমান বাদশাহর কাছ থেকে বাংলার প্রশাসনিক কর্তৃত্ব লাভ করি যে, মুসলমানদের প্রবর্তিত ব্যবস্থাগুলো আমরা বহাল রাখব; কিন্তু নিজেদেরকে যথেষ্ট শক্তিশালী মনে করা মাত্রই আমরা সে শর্তগুলো লঙ্ঘন করেছি। এ অভিযোগের জওয়াবে আমাদের বক্তব্য হল বাংলায় মুসলমানদের প্রশাসনিক কার্যকলাপ তদারকের দায়িত্ব লাভ করার পর আমরা দেখতে পেলাম যে, তাদের অনুসৃত বিধি ব্যবস্থাগুলো এতদূর পক্ষপাতিত্বমূলক, এত দুর্নীতিদুষ্ট এবং মানবিকতার প্রতিটি দৃষ্টিকোণ থেকে এতটা দুঃখজনক যে, সেগুলো বহাল রাখলে আমরা সভ্যতার কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হব। প্রতিটি জেলার রেকর্ডপত্র থেকে আমরা এটা প্রমাণ করতে পারি যে, মুসলমান সরকারের লোলুপদৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুই ছিল রাজস্ব। প্রশাসনের প্রায় সমুদয় কাজের চাপ একত্রিত হত ভূমি রাজস্ব আদায়কারীদের উপর এবং এরা প্রয়োজনমত রাজস্ব আদায় করে দিতে পারলে নিজেরাও যথেষ্ট সম্পদ আহরণ করতে পারতো। ভূস্বামীরা ইচ্ছামত খাজনা আদায় করতো এটা যেমন ছিল জনসাধারণের দুর্দশার কারণ, তেমনি ভূস্বামীদের কর্মচারীরাও তাদেরকে সর্বস্বান্ত করে উপরি পাওয়া উসুল করে দিত। অন্যান্য অবিচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা ছিল নিরর্থক। অভিযোগের প্রতি কর্ণপাত করা বা না করা ছিল ভূস্বামী এবং তার কর্মচারীদের খেয়াল খুশীর ব্যাপার। অভিযোগকারী কদাচিৎ প্রতিকার আশা করতে পারত, কেননা অত্যাচারীদের প্রায় সকলেই ছিল ভূস্বামীদের কর্মচারী এবং কোন সময় তোকে খুঁজে বের করা সম্ভব হলেও লুণ্ঠনকারী ছিল ভূস্বামীর প্রকৃত বন্ধু। (মিঃ ওয়েষ্টল্যান্ডের যশোর জিলার বিবরণ ৬৭ পৃষ্ঠা। অসুবিধা হওয়া সত্বেও আমার নিজের পল্লী বাংলার ঘটনাবলী থেকে বারংবার উদ্ধৃতি দেয়া থেকে আমি বিরত থাকছি এবং এখানে শুধু এটুকুই বলে রাখছি যে, বাংলার ঘটনাবলী ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের গোচেরে না আনা পর্যন্ত ভারত সরকার ব্রিটিশ জাতির অবমাননার দায়ে হতে থাকেন। কিন্তু রোম সাম্রাজ্যের পতনের মত এদেশেও এক বিরাট রাজশক্তিকে অধিকতর তীব্রতার সাথে বিধ্বস্ত করতে পেরেছে এমন একটি সরকার নির্যাতিত ও বিধ্বস্ত ভারতীয় জাতির মাঝে একটি সমৃদ্ধিশালী সাম্রাজ্যে গড়ে তুলতে সমর্থ হওয়ায় তার উক্ত অপরাধ থেকে অব্যাহতি পেতে পারে, কারণ ব্রিটিশ জাতির লিখিত গৌরব ইতিহাস থেকে এটা কিছুটা স্বতন্ত্র কৃতিত্বের দাবি রাখে।)
আসল সত্য এইযে, মুসলমানদের সরকারী প্রশাসন চিল মুষ্টিমেয় লোকের বিত্তশালী হওয়ার যন্ত্রমাত্র, অধিকাংশের স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার নয়। বিপুল সংখ্যক কৃষক খালি গায়ে গ্রীষ্মের খরতাপে দগ্ধ হয়ে এবং শরতের বৃষ্টিতে ভিজে কী কষ্টের মধ্যে যে জমি চাষ করে সেটা কখনও শাসকদের হৃদয় স্পর্শ করতে বা বিবেকে দংশন সৃষ্টি করতে পেরেছে বলে মনে হয় না, কেননা এদেরই দুঃখ কষ্টের বিনিময়ে প্রতি জিলায় মুষ্টিমেয় পরিবার বিলাসবহুল জীবনযাপনের সুযোগ পেয়েছে। আমরা যখন শর্ত লঙ্ঘন করে পুরনো ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের কাজ শুরু করলাম কেবল তখনই জনসাধারণের অস্তিত্ব রক্ষার পথ তৈরী হয়। অভিজাত মুসলমানদের প্রতি যে বিরাট অন্যায় কাজটা আমরা করেছি সেটা হচ্ছে তাদের অধিকারের সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দেয়া। এটা না করা পর্যন্ত তাদের অধিকারের কোন স্থায়ী ভিত্তি যেমন ছিল না, তেমনি তার কোন সীমারেখাও টানা ছিল না। শাসকশক্তির স্বীকৃত দাবি বরবাদ করার বিনিময়ে আমরা তাদেরকে জোতজমি ভোগদখলের স্থায়ী সুযোগ দান করেছি; কিন্তু সেই সাথে দখলী অধিকারের সীমারেখাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যে জাতি কয়েক শতাব্দী ধরে লুণ্ঠনের অবারিত অধিকার ভোগ করে এসেছে তারা গভর্নর জেনারেলের সামান্য একটা কলমের খোঁচায় সম্পাদিত ব্যবস্থা অনুসারে নিজ নিজ জোত জমি পরিচালনার শান্তিপূর্ণ কলাকৌশলের শিক্ষা রপ্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। পল্লীবাসীদের উপর উৎপীড়ন চালাবার মুসলমানী একচেটিয়া অধিকার বিলুপ্ত হয়েছে, এবং তার ত্রিশ বছর পরে পুনগ্রহন আইন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের সৌভাগ্য রবিও চির অস্তমিত হয়েছে। এই আইনগুলো সম্পর্কে আমি পরে যৎকিঞ্চিত আলোচনা করব; তবে এখানে শুধু এটুকু বলে রাখছি যে, সম্পত্তির দলিল প্রণয়নের ব্যাখ্যার কঠোর বিধিবিধান আরোপ করার এই সব আইনের দ্বারা রাষ্ট্র লাভবান হয়েছে কিন্তু মুসলমানরা তাদের বাদশাহদের শাসনামলে এসব বিধিবিধানের সাথে আদৌ পরিচিত ছিল না। বিগত পঁচাত্তর বছরে বাংলার অভিজাত মুসলমান পরিবারগুলো হয় ধ্বংস হয়ে গেছে অথবা আমাদের শাসনের ফলে সৃষ্ট নতুন সমাজ বিন্যাসের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে এরা হল উদ্ধত, প্রগলভ ও অলস, কিন্তু সর্বশেষ রাজপুরুষদের বংশধররূপে তারা এখনও পরিচিত।
সুতরাং সেনাবাহিনী এবং রাজস্ব বিভাগরে উচ্চতর পদ মুসলমানদের অর্থ সঞ্চয়ের এই দুটি প্রাথমিক বিরাট সূত্র সম্পর্কে আমরা যে ব্যবস্থা গ্রহন করেছি তার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে, কিন্তু আমাদের এ ব্যবস্থার ফলে বাংলার মুসলমান পরিবারগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অভিজাত মুসলমানদের জন্য সেনাবাহিনীতে প্রবেশের দরজা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি কারণ আমাদের নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে বাইরে রাখা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করছি। প্রশাসনের সবচেয়ে লাভজনক পদ থেকে আমরা তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব বিনষ্ট করেছি কারণ জনকল্যাণ ও ন্যায়বিচারের স্বার্থেই এটা করা প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু এই সকল কারণ যতই যুক্তিযুক্ত হোক না কেন, ব্রিটিশ শাসনে বিপন্ন প্রাচীন অভিজাতরা তা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। সেনাবাহিনীতে ঢুকতে না দেওয়াটা মুসলমানদের দৃষ্টিতে একটা বিরাট অন্যায় কাজ বলে বিবেচিত হচ্ছে এবং তাদের পুরনো রাজস্ব ব্যবস্থা আমরা পরিত্যাগ করায় তারা এটাকে মারাত্মক বিশ্বাসঘাতকতা বলেই গণ্য করছে।
তাদের বিরাট অবস্থায় তৃতীয় সূত্র ছিল বিচার বিভাগে ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, এক কথায় বেসামরিক চাকরিতে তাদের একচেটিয়া অধিকার ভোগ। পরিবর্তিত পরিবেশের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা অন্যায় হবে, কিন্তু এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় ,যে ভারতীয়দের মধ্যে যে, কয়জন উচ্চতর সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের কিংবা হাইকোর্টের বিচারকের আসনে বসার সুযোগ পেয়েছে তাদের একজনও মুসলমান নয়। কিন্তু এদেশের শাসন কর্তৃত্ব আমাদের। করায়ত্ত হওয়ার পরে কিছুদিনের জন্য প্রশাসনের সর্বত্র মুসলমানরা স্বপদে টিকে ছিল। মুসলমান কালেক্টররাই ভূমি রাজস্ব আদায় করেছে; মুসলমান ফৌজদার ও ঘাটওয়ালারা পুলিশ বাহিনীর অফিসার হিসেবে কাজ করেছে। একটা বিরাট মুসলিম ডিপার্টমেন্ট যার সদর দফতর ছিল মুর্শিদাবাদের নিজাম প্রসাদে, এবং প্রদেশের প্রত্যেক জেলায় বিস্তৃত একটা প্রশাসনিক কাঠামো ফৌজদারি আইনের শাসনকার্য নির্বাহ করেছে। বাংলার সকল জেলা কয়েদীর কাছ থেকে মুসলমান জেলাররা ঘুষ আদায় করেছে। কাজী অথবা মুসলমান আইন-শাস্ত্রবিদরা সিভিল কোট এবং পারিবারিক আইন আদালতে বিচারকের আসনে উপবেশন করেছে। এমনকি ন্যায়বিচারের স্বার্থে আমরা যখন সুশিক্ষিত ইংরেজ অফিসারদের আদালতে নিয়োগ করি তখনও মুসলমান আইনজ্ঞরা আইনের ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে কাজ করার জন্য তাদের পাশে আসন গ্রহন করেছে। ইসলামী আইন সারা দেশের আইন হিসেবে বহাল থাকে এবং সরকারী প্রশাসনের অধস্তন পদগুলোতে মুসলমানদের একচেটিয়া অধিকার তখনও টিকে ছিল। কেবল তারাই সরকারী ভাষায় কথা বলতে পারত এবং ফার্সিতে হাতে লেখা সরকারী রেকর্ড পত্রের পাঠোদ্ধার কেবল তাদের দ্বারাই সম্ভব ছিল। (শিকান্ত নামীয় এক ধরনের সাংকেতিক ভাষা) কর্ণ ওয়ালিশ বিধি এই একচেটিয়া অধিকার ভেঙ্গে দেয় এবং এতে বিচার বিভাগের ওপর শ্লথ গতিতে হলেও রাজস্ব ব্যবস্থার ওপর তীব্রতর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কিন্তু কোম্পানির শাসনের প্রথম পঞ্চাশ বছর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার সিংহভাগটি মুসলমানরাই পেয়েছে। কোম্পানির ক্ষমতা লাভের একশ বছরের শেষ অর্ধাংশে স্রোতের গতি উল্টে যায়, প্রথমে আস্তে আস্তে কিন্তু পরে অপেক্ষাকৃত তীব্রতর গতিতে, কারণ সাবেক মুসলমান বিজেতাশক্তির উত্তরপুরুষদের বিদেশী ভাষার পরিবর্তে স্থানীয় জনসাধারণের মাতৃভাষায় সরকারী কাজকর্ম পরিচালনার অনিবার্য দায়িত্ব তখন সরকার উপলব্ধি করেন। এই সময় হিন্দুরা মঞ্চে প্রবেশ করে এবং ক্রমান্বয়ে সকল স্তরের সরকারী চাকরি সম্পূর্ণভাবে তাদের দখলে এসে যায়। এমনকি দক্ষিণ বাংলায় যেখানে পুরনো রাতিতে সরকারী কাজকর্ম চালানো এখনও কিছুটা সম্ভব, সেখানেও জেলা কালেক্টরেটগুলোতে অতি নগণ্য সংখ্যক তরুণ মুসলমান অফিসার দেখতে পাওয়া যাবে। (আমলা) যে কয়জন পুরনো মুসলমান কর্মচারী এখনও টিকে আছে তাদের দাড়ি সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের কোন উত্তরাধিকারী নেই। এমনকি দশ বছর আগেও মুসলমান নাজিররা অবসর গ্রহণের সময় তাদের পরিত্যক্ত পদে স্বধর্মীয়দের বসিয়ে যেতে পেরেছে; কিন্তু এখন কেবল জেলখানায় দু একটা অধস্তন চাকরি ছাড়া আর কোথায়ও ভারতের এই সাবেক প্রভুরা ঠাই পাচ্ছেনা।বিভিন্ন অফিসে কেরানীর চাকরি আদালতের দায়িত্বশীল পদে, এমনকি পুলিশ সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে সরকারী স্কুলে উৎসাহী হিন্দু যুবকদের নিয়োগ করা হচ্ছ। (এই মন্তব্য বঙ্গ প্রদেশের সব জায়গাতেই প্রযোজ্য; তবে সকল জেলার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য হলেও ভাগলপুর ও পাটনা বিভাগের জেলাগুলোতে এর ব্যতিক্রম রয়েছে।)
নন গেজেটেড পদের মত সাধারণ চাকরি থেকে শুরু করে উচ্চতর পদগুলো পর্যন্ত এই প্রশ্নটা ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের দ্বারা যেমন ধরা পড়েছে, তেমনি পরিসংখ্যানের হিসেবেও সন্দেহাতীতভাবে ধরা পড়বে। বছর দুয়েক আগে অনেকগুলো প্রবন্ধ (উত্তর পশ্চিম প্রদেশের নেতৃস্থানীয় পত্রিকা পাইওনিয়ার এ প্রকাশিত এই প্রবন্ধগুলো আমি আলোচ্য পরিচ্ছেদে অবাধে কাজে লাগিয়েছি) আমি দেখিয়েছি যে, বাংলার বিচার ও রাজস্ব বিভাগের চাকরি থেকে মুসলমানদের কিভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। এই দুইটি বিভাগের চাকরি যেমন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন তেমনি এতে নিয়োগের সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার প্রশ্ন যথেষ্ট সতর্কতার সাথে বিচার বিবেচনা করা হয়। আলোচ্য প্রবন্ধগুলো পত্রিকায় প্রকাশের পরপরই ফার্সি ভাষায় অনূদিত হয়, এবং এ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্র পত্রিকায় এ সম্বন্ধে প্রচুর আলোচনাও হয়। কলকাতার মুসলমানদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষার হার তদন্তের জন্য বাংলা সরকার একটা কমিশন নিয়োগ করেন। কিন্তু এসবের শেষ ফলাফল এই দাড়ায় যে, সরকারী চাকরিতে মুসলমানদের সংখ্যা বরাবরের মত বর্তমানেও প্রতি বছর হ্রাস পাচ্ছে।
নিম্নোক্ত পরিসংখ্যান থেকে আমার এ মন্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হবে। সরকারী চাকরির উচ্চতম স্তরের বেলায় মুসলমানদের অভিযোগের বড় একটা কারণ নেই, কেননা (১৮৬৯ সালের এপ্রিলে যেখানে আনুপাতিক হার ছিল মুসলমান একজন আর হিন্দু দুইজন; আর বর্তমান হার হচ্ছে মুসলমান একজন, হিন্দু তিনজন। দ্বিতীয় স্তরে ঐ সময়ের হার ছিল মুসলমান দুইজন আর হিন্দু নয় জন; এখনকার হার হচ্ছে মুসলমান একজন আর হিন্দু দশজন। তৃতীয় স্তরের চাকরিতে ঐ সময়ের হার ছিল মুসলমান চারজন এবং হিন্দু ও ইংরেজ মিলে সাতাশ জন; আর বর্তমানে তিনজন মুসলমান এবং হিন্দু ও ইংরেজ মিলে চব্বিশজন। অধস্তন স্তরে ১৮৬৯ সালে মুসলমান চারজন আর অন্যান্য সম্প্রদায়ের মিলিত সংখ্যা ছিল ত্রিশ জন। আর বর্তমানে এই হার দাঁড়িয়েছে মুসলমান চারজন অন্যান্য সম্প্রদায় উনচল্লিশ জন। শিক্ষানবিশি পর্যায়ে ঐ সময়ের হার ছিল মেটা আটশটির মধ্যে মাত্র দুইজন মুসলমান; আর বর্তামানে সেখানে একটিও মুসলমান নেই।
অপেক্ষাকৃত মর্যদাসম্পন্ন ডিপার্টমেন্টগুলোতে মুসলমানদের অবস্থাটা এতই করুণ যে, বাংলার রাজনৈতিক দলসমূহ এদিকে তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ করেনি।এই বিভাগগুলোতে চাকরির আনুপাতিক হার ১৮৬৯ সালে নিম্নরূপ ছিল: এ্যাসিস্ট্যান্ট গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারের তিনটি গ্রেডে হিন্দুরা সংখ্যা ছিল ১৪, মুসলমান একজনও নয়; শিক্ষানবিশি পর্যায়ে হিন্দু চারজন ও ইংরেজ দুইজন, কিন্তু মুসলমান একজনও নয়। সাব ইঞ্জিনিয়ার গণ-পূর্ত বিভাগের সুপারভাইজার পদে হিন্দু চব্বিশ জন আর মুসলমান একজন, ওবারসিয়ার পদে মুসলমান দুইজন আর হিন্দু তেষট্টি জন। এ্যাকাউন্টস অফিসার পদে হিন্দু পঞ্চাশজন কিন্তু মুসলমান একজনও নয়; এবং আপার সাবর্ডিনেট ডিপার্টমেন্টে হিন্দু বাইশজন, কিন্তু মুসলমানের সংখ্যা শূন্যের কোঠায়।
কিন্তু বেসামরিক চাকরির তালিকায় যে বাস্তব অবস্থা বিরাজমান তা বাড়িয়ে দেখাবার কোন প্রয়োজন করে না। এমন একটা গেজেটেড চাকরির তালিকাটি আমি প্রণয়ন করেছি যেখানে ইংরেজ, মুসলমান ও হিন্দুরা নিয়োগের সমান সুযোগ পাবার অধিকারী। তালিকাটি নিম্নরূপ: