প্রতিরক্ষার উপায়
মুসলমান সমাজের যেসব আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও অন্যান্য যেসব অসুবিধার দরুন ভবিষ্যতে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম একেবারে খতম না হয়ে গেলেও তার অত্যণ্ত অসহায় অবস্থায় পতিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমি ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। আমি ঐ সাথে পাঠকগণের সামনে ইসলামের শত্রুরা ইসলামের শক্তি চূর্ণ করার জন্য যেসব গভীর ও অত্যন্ত কার্যকর চক্রান্ত চালাচ্ছে, তাও তুলে ধরেছি। সেই আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আমরাও যতক্ষণ এমনি ধরনের সুদূর প্রসারী ও কার্যকর কৌশল গ্রহণ না করি ততক্ষণ আমাদের ইসলামের রক্ষায় ও প্রসারে সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব। এখন সেই রক্ষা ব্যবস্থা কি রকম হওয়া উচিত, কি কি কৌশল আমাদের গ্রহণ করা উচিত তাই নিয়ে আলোচনা করবো।
১-ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও ধর্মীয় প্রেরণার উজ্জীবন
আমি আগেই বলেছি, অজ্ঞতাই আমাদের প্রধানতম দুর্বলতা। মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ নিজেদের ধর্মের শিক্ষা এবং তার আকীদা ও আইনগত অনুশীলনাদি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। এটাই তাদেরকে ধর্মচ্যুত করার ব্যাপারে শত্রুদের সবচেয়ে বেশী সহায়ক। এদিক থেকে আমাদের প্রথম প্রয়োজন হলো ভারতবর্ষের-[এখানে ১৯২৫ সালের অবিভক্ত ভারতের কথা বলা হয়েছে।-অনুবাদক] সমস্ত অজ্ঞ মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষার প্রসার ঘটানো –ইসলামের সহজবোধ্য আকীদাসমূহ তাদের মনে বদ্ধমূল করে দেয়া দরকার এবং তাদের মধ্যে এতটা ধর্মীয় প্রেরণার সৃষ্টি করা দরকার যেন তারা নামায-রোযার পাবন্দ হয়ে যায়। এজন্য আমাদেরকে সাধারণভাবে গ্রামাঞ্চলে ও ছোট ছোট শহরমোকামগুলোতে একজন করে এমন লোক নিয়োগ করতে হবে যিতি জনগণকে তাদের অবসর সময়ে অত্যন্ত ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে পারেন এবং তাদের বোধগম্য ভাষাতে তাদেরকে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো ও তার উপকারিতা বুঝিয়ে দিতে পারেন। যদিও এই সাথে অমুসলিমদেরকেও দাওয়াত দেয়া যেতে পারে। তবে আপাততঃ আমাদের পূর্ণ মনোযোগ দিতে হেব কাফেরদের মুসলমান বানানোর পরিবর্তে মুসলমানদেরকে খাঁটি মুসলমান বানানোর দিকে। মুসলমানদের ঘুমন্ত ধর্মীয় প্রেরণাকে জাগিয়ে তুলতে পারলে আমরা আমাদের আভ্যন্তরীণ সমাজ কাঠামোকে বহিরাগতদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত করে দিতে পারবো। তারপর অন্যদের দিকে মনোযোগ দেয়ার জন্য আমরা অধিকতর সুযোগ পাব।
২-প্রাথমিক ধর্মীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
এই সাথেই দ্বিতীয় যে জিনিসটি প্রয়োজন তাহলো, মুসলমান বালক বালিকাদেরকে প্রাথবিম ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার জন্য গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এজন্য কোনো লম্বা-চওড়া বিধি-ব্যবস্থা বা কোনো বিশেষ শিক্ষা কারিকুলামের প্রয়োজন হয় না। তাদেরকে মুসলমান বানানোর জন্য শুধু এটুকু যথেষ্ট যে, খুব সহজ ভাষায় ইসলামী আকীদাসমূহ তাদের মনে বদ্ধমূল করিয়ে দিতে হবে। ওযু, মলমূত্র থেকে পবিত্রতা অর্জন, নামায, রোযা প্রভৃতি সম্পর্কে সাধারণ মাসলাসমূহ মুখস্ত করিয়ে দিতে হবে এবং কুরআন মজিদ পড়াতে হবে। কুরআন শরীফ শুধু তোতা পাখীল মত পড়াতেই মানুষের ওপর এমন প্রভাব পড়ে যে, মনের ওপর ইসলামের মহত্বের ছাপ পড়ে যায় এবং তারপর সেই প্রভাব দূর করা সহজসাধ্য হয় না। সুতরাং আমাদের শিশুদেরকে কার্যকর শিক্ষা দেয়ার ক্ষমতা যদি আমাদের না হয়, তাহলে তাদের কোমল মনে অন্ততঃ কুরআনের ছাপ বসিয়ে দেয়াই উচিত যাতে তাদের ওপর কুফরীর যাদুর প্রভাব না হয়।
এটা হলো সর্বনিম্ন অত্যাবশ্যকীয় কাজ। এটুকু কাজ করতে আমাদের বিন্দুমাত্রও বিলম্ব না করা উচিত। এ কাজের জন্য আলাদা মুবাল্লিগ বাহিনী সফরে পাঠানো কোনো স্বার্থকতা নেই। বরং এমন রোকের দরকার যারা স্থায়ীভাবে এক জায়গায় থাকবে এবং আর্য মিশনারীদের মত গ্রামীণ জীবনের কষ্ট সহ্য করে পূর্ণ নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার সাথে ইসলামের খেদমত করতে পারবে। তাদের মধ্যে এতটা মহনশীলতা থাকা প্রয়োজন যেন সাফল্যের সাথে লোকদের মূর্খজনোচিত আচরণের মোকাবিলা করতে পারে। প্রাথবিম ব্যর্থতায় যেন তারা হিম্মতহারা না হয়। শেরেকী ও বেদাতী রসম-রেওয়াজ দূর করতে যদি কয়েক বছরও লেগে যায় তবুও যেন মনোবল না হারায় এবং তাড়াহুড়া করতে গিয়ে মূর্খদের সাথে যুদ্ধ না করে দেয়। বরং ধীরে উপদেশ দান, শিক্ষাদান ও প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মনকে চরিত্র সংশোধনের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। এই সাথে তাদের মধ্যে এতটা ত্যাগের মনোভাবও থাকা উচিত যেন তারা এই দরিদ্র জাতির কাছ থেকে ইসলামের খেদমতের জন্য যথাসাধ্য কম পারিশ্রকিম নেয়। জানা কথা যে, খৃষ্টানদের মত কোটি কোটি টাকা পানির মত গড়িয়ে দেবে, সে সামর্থ এ জাতির নেই। তাদের নৈতিক চরিত্র এতটা পূতপবিত্র হওয়া চাই যেন সরলমতি গ্রামবাসী তাদের কাজ দেখে বিরূপ না হয়। বরং তাদের মহৎ চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তারা যেন নিজেদের মধ্যে এমন ইসলামী চরিত্রের নমুনা পেশ করতে পারে যেন লোকেরা তাদের কাছ থেকে ইসলামী আখলাকের বাস্তব শিক্ষা পায়।
৩-প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপদ্রুতদের পুনর্বাসনের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা
এতক্ষণ যা আলোচিত হলো, তা ছিল প্রথম স্তরের কাজ। এরপর দ্বিতীয় স্তর হলো, মুসলমানদের প্রাকৃতিক দুর্যোগাদির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য আঞ্চলিক পুনর্বাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। এ ব্যবস্থা না থাকার কারণেই উপদ্রুত মুসলমানেরা খৃষ্টান ও আর্য প্রচারকদের করুণার উপর র্নিভরশীল হয়ে পড়ে। উদাহরণ স্বরূপ, দুর্ভিক্ষ ও বন্যার সময় হাজার হাজার পুরুষ, স্ত্রী ও ভিশু গৃহহারা হয়ে পড়ে। সেই বিপদের সময় তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার কেউ থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের ধর্ম ও ঈমান বেচে দিয়ে বিত্তশালী খৃষ্টান মিশনারীদের কাছ থেকে পেট বাঁচানোর জন্য ভাত ও লজ্জা ঢাকার জন্য কাপড় সংগ্রহ করতে হয়। এভাবে যেসব শিমুর অভিভাবক নেই তারা কেবল আশ্রয়ের অভাবে দিন-রাত ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ায় এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তারা খৃষ্টান অথবা আর্য প্রচারকদের এতিমখানায় আশ্রয় পায়। ইসলামের শত্রুদের পক্ষ থেকে পরিচালিত মুসলমানদেরকে ধর্মচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের এর চিরন্তর শিকার। কেবলমাত্র মুসলমানদের উদাসীনতাই এ কোমলমতি বালকদেরকে ইসলামের কোল থেকে ছিনিয়ে কুফরীর আবর্তে নিক্ষেপ করে। এদেরকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করতে হলে স্থায়ী অনাথাশ্রমের প্রয়োজন। অবশ্য খুব ব্যাপক ভিত্তিক একটা ব্যবস্থা যে নিতেই হবে –এমন কথা বলা হচ্ছে না। তাদেরকে মিশনারীদের খপ্পরে পড়া থেকে বাঁচানো যায়, আপাততঃ এতটুকু ব্যবস্থাই যথেষ্ট। অবশ্য তাদেরকে কিছু কাজ দেয়ার এবং কাজ করার যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য কি ব্যবস্থা করা যায়, সেটা আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। আপাততঃ আমাদের লক্ষ্য শুধু এটুকু হওয়া উচিত যে, তাদের ইসলামকে রক্ষা করতে হবে। সেটা এভাবে সম্ভব হতে পারে যে, তাদেরকে মুসলিম পরিবারসমূহের আশ্রয়ে দিয়ে দিতে হবে। আর এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, সেসব পরিবারে তারা যেন দাসসুলভ ব্যবহার না পায় বরং খেদমতগারের মত সদয় ব্যবহার পায়। আরযদি কেউ কারিগরি কাজ জানে তবে তাকে কোনো কাজে লাঘিয়ে দেয়া যেতে পারে। একথা নিসন্দেহে বলা যায় যে, ইয়াতীম ও অনাথদের এ অবস্থা কিছুতেই সহনীয় নয়। কিন্তু যদি আমাদের জাতির মধ্যে এতটুকু অনুভূতি না থেকে থাকে যাতে করে তারা তাদের শিশু কিশোরদের লালন-পালনের উত্তম ব্যভস্থা করতে পারে তাহলেও এটা সুনিশ্চিত সত্য যে, একজন মুসলমান কিশোরের মুসলমান অবস্থায় খেদমতগার হওয়া, কুফরী বরণ করে নিয়ে ব্যাপিষ্টার হওয়ার চেয়ে বহুগুণ শ্রেয়।
৪-মিশনারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কট করা
একটা জরুরী কাজ হলো, মুসলমান ছেলেদের মিশনারী স্কুল ও কলেজ থেকে তুলে আনার একটা জোরদার আন্দোলন চালাতে হবে। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো বিস্তার করা নয়। এদের উদ্দেশ্য হলো, বালক-বালিকাদেরকে তাদের ধর্ম থেকে বিচ্যত করে সেন্টপলের মনগড়া ধর্ম খৃষ্টবাদে দীক্ষিত করা। সাধারণভাবে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করার অনিবার্য ফল এই দাঁড়ায় যে, ছাত্ররা যদি প্রকাশ্যতঃ ইসলাম ত্যাগ নাও করে তথাপি অন্ততঃ পক্ষে নিজ ধর্মের প্রতি বিমুখ হয়ই। তাদের মনে ইসলামের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাই আর অবশিষ্ট থাকে না। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস থেকে তারা স্পষ্টতই দূরে সরে যায়। ইবাদাতকে তারা খেলা মনে করতে আরম্ভ করে। ইসলামী বিধানকে খোলাখুলিভাবে লংঘন করে। শুধুমাত্র বংশগত সম্পক ও সামাজিক প্রতিরোধের মুখে তাদের ইসলামের সাথে নামমাত্র সম্পর্ক থাকে। একথা সত্য যে, মিঃ আরনল্ডের অভিজ্ঞতা অনুসারে মিশনারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা অর্জন কোনো কোনো সময় সম্পূর্ণ বিপরীত ফলও দর্শিয়েছে। কোনো কোনো ছাত্র খৃষ্ট ধর্মের দোষ-ত্রুটি জানতে পেরে তারা আরো প্রবল বিরোধী হয়ে গেছে। কিন্তু এমন ভাগ্যবান পুণ্যাত্মার সংখ্যা খুবই কম। সাধারণভাবে মিশনারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুরোর ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা, আমরা যা উপরে আলোচনা করেছি তাই। তাদেরকে এ ধর্মহীনতার বিপদ থেকে নিষ্কৃতি দেয়া নিশ্চয়ই ইসলামের এক অতি বড় সেবার কাজ।
এ ধরনের আন্দোলনের বিপক্ষে একটি যুক্তি দর্শানো হয়ে থাকে। বলা হয়, মুসলমানরা এমনিই শিক্ষা-দীক্ষায় পেছনে পড়ে আছে এবং তাদের মধ্যে এর কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। এরপর যদি মিশনারী স্কুল-কলেজও বয়কট করা হয় তাহলে আমাদের ছেলেরা পড়বে কোথায়? কিন্তু আমার কথা হলো, মিশনারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘাটতি বর্তমান ইসলামী ও সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পূরণ করতে পারে। বস্তুতঃ এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা তাদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেকগুণ উত্তম। কিন্তু সেখানে যদি ঐ ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নাও হয় তথাপি একজন খাঁটি মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিছক উচ্চ শিক্ষার খাতিরে ধর্মকে বিসর্জন দেয়া যেতে পারে না। মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষা অর্জন করার জন্য যদি মিশনারী প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া আর কোনো উপায় না থাকে, তবে তেমন উচ্চ শিক্ষা অর্জন করার চেয়ে বর্জন করাই উত্তম। কেননা আমাদের শিশুদের অজ্ঞ থেকে যাওয়ার চেয়ে তাদের ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া অনেক বড় আপদ। সুতরাং মিশনারী মিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালানো প্রয়োজন। শুধু প্রচারাভিযানই যথেষ্ট নয়, প্রত্যেক মুসলমান যাতে নিজ নিজ ছেলেমেয়েদের ঐসব প্রতিষ্ঠান থেকে তুলে আনে সে জন্যও তাদেরকে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে।
৫-অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তি
সর্বশেষ কাজ এবং বর্তমান অবস্থার সবচেয়ে জরুরী কাজ এই যে, মুসলশানদেরকে তাদের বর্তমান অর্থনৈতকি দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে হবে। আগে সরকারই ছিল ভারতীয় মুসলমানদের অর্থনৈতিক কল্যাণের প্রধান সহায়। তাদের অবশ্য বাণিজ্য ও পুঁজি সংগঠনের প্রবণতা কোনোদিনই ছিল না। তাদের ছিল শুধু বিভিন্ন কারিগরি পেশার সহজাত ঝোঁক। আর এসব পেশার আর্থিক সুফল নির্ভর করতো পুরোপুরিভাবে সরকার ও সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকদের উপর। তারা এসবের কদর ও মূল্য দিতো। যখন সরকার গেল, তখন সেই সাথে তাদের সচ্ছলতা ও ধনাঢ্যতার উৎসও শুকিয়ে গেল। ফলে আজ এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, মুসলমানদের মধ্যে যারা বিভিন্ন পেশার দ্ক্ষ কারিগর ও কৃষক আছে সকলেই পুঁজিপতি হিন্দুদের গোলাম। আর যাদেরকে আল্লাহ পৈতৃক সম্পদে সম্পদশারী করেছেন তারা তাদের বিকৃত কৃষ্টি ও রুচি এবং ভ্রান্ত অপব্যয়মূলক আদত-অভ্যাসের দরুন প্রতিনিয়ত তা দেনার খাতে উড়িয়ে দিচ্ছে। এই অর্থনৈতিক দাসত্বের ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, কায়-কারবারের ক্ষেত্রে হিন্দুদের শক্তি এত বেড়ে গেছে যে, তারা মুসলমানদের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এ দিকটায় এতখানি অগ্রসর হয়েছে যে, যখন খুশী অবরোধ চালিয়ে মুসলমানেদর বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে। শহর-বন্দরে এ ব্যাপারটা কেবল অর্থনৈতিক দাসত্বের মধ্যে সীমিত আছে বটে। তবে দূর-দূরান্তের গ্রামাঞ্চলে এ জিনিসই মুসলমানদের ধর্মচ্যুত করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অমুসলিম ধর্ম প্রচারকরা পূর্ণ শক্তি নিয়ে অজ্ঞ গ্রাম্য মুসলমানদেরকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অতএব ইসলামকে নিরাপদ করার জন্য এ রোগের চিকিৎসা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। এমনকি বর্তমান অবস্থার আলোকে একথা বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে, অর্থনৈতিক বিপদই ভারবর্সে ইসলামের অস্তিত্বের জন্য হুমটি স্বরূপ।
জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব
মুসলমানদের অর্থনৈতিক বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য কি কর্মপন্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, সেটা একটা স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়। তা নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোকনা করার অবকাশ নেই। তবে এটা সত্য যে, এতবড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করার জন্য আমাদের এ অনৈক্য ও জাতীয় দলসমূহের বিভিন্নতা মোটেই সমীচীন নয়। আমরা এখনো আলাদা আলাদা দল গড়ার তালে আছি। অথচ এ ক্ষেত্রে সমগ্র জাতির ঐক্যবদ্ধ শক্তি প্রয়োজন। আমরা অল্প সময়েল মধ্যে বিরাট ফল আশা করছি। অথচ এ কাজে বছরের পর বছর ধরে অবিশ্রান্ত পরিশ্রম প্রয়োজন। আমরা এখনো হৈ-হল্লা করাতেই পূর্ণ স্বাদ অনুভব করি। অথচ এক্ষেত্রে উদ্দেশ্যের প্রতি গভীরতর নিষ্ঠা ও সত্যিকার ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন। আমরা এখনো কেবলা আগুনের মত সহসা জ্বালিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রপ্ত করেছি। অথচ এ ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন নেই। আমাদের এখনো অতি সামান্য উত্তাপের প্রয়োজন –যে উত্তাপ বছরের পর বছর ধরে ভেতরে ভেতরেই পাকিয়ে মণি-মুক্তা তৈরী করে দিতে পারে। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কাজ করার সঠিক পদ্ধতি আয়ত্ব করতে না পারবো ততক্ষণ সমস্ত প্রস্তাবাদি নিস্ফল। বিভিন্ন আন্দোলন যদি এখনো এ ভাবাবেগই সক্রিয় থাকে এবং আমরা যদি অন্যদের মোকাবিলা করার বদলে নিজেদের মধ্যে ঠুকাঠুকিতেই যথারিত মশগুল থাকি, আমাদের সব কাজ যদি একতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবর্তে অনৈক্যের পথ অনুসরণ করে চলতে থাকে তাহলে আমাদের সংস্কার ও সংশোধনের সব চেষ্টা বাদ দিয়ে সকলে মিলে ইসলামের ফাতেহা পাঠ করে যার যার পসন্দসই সাকে নিয়োজিত হওয়াই উত্তম। একটি দালান তৈরী করতে যেমন ভারো মাল মশলার চেয়ে মিস্ত্রির দক্ষতার প্রয়োজন বেশী, তেমনি আমাদের ভালো ভালো প্রস্তাব ও কর্মপন্থার চেয়ে কাজ করার উত্তম যোগ্যতার প্রয়োজন বেশী। ওষুধ যত ভালোই হোক না কেন, চিকিৎসক যোগ্য না হলে সে ওষুধে রোগীর কোনো উপকার সাধিত হয় না। অতএব আমাদের জাতির (অর্থাৎ মুসলিম উম্মতের) সুধীবৃন্দ যদি সময়ের গুরুত্ব ও নাজুকতা সঠিকভাবে অনুভব করেন তাহলে তাদের অন্য সব চিন্তা বাদ দিয়ে সর্বপ্রথম মুসলিম জাতির ঐক্য কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সেই চ্নিতা করতে হবে। আজ সমস্ত জাতীয় আন্দোলনগুলোতে যে অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা বিরাজমান তা যত শীঘ্র সম্ভব দূর করে দিতে হবে।
—০০০—
মুসলমান ও দাওয়াত
“ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রণাঙ্গণেও দাওয়াত ও প্রচারের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর বন্দেগীর দিকে দাওয়াত দেয়ার কাজ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, কোনো অবস্থাতেই কোনো মুসলমানের পক্ষে সে কাজ বাদ দেয়া সম্ভব নয়। দাওয়াতের এ কাজ মুসলমানের জীবন ও তার ব্যক্তি সত্ত্বার অবিচ্ছেদ্য অংগ। বাস্তব জীবনের কঠোর সংগ্রামের ভেতর দিয়েও যখন আমরা এ দাওয়াত অব্যাহত রাখতে পারবো তখনই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সফল হবে এবং লক্ষ্য অর্জিত হবে। আমাদের ও খৃষ্টান মিশনারীদের মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে, তারা একদল পেশাধার ধর্ম প্রচারক। কিন্তু মুসলমানের প্রচার চলে কর্মব্যস্ত জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে। এ প্রচার কোথাও আলাদাভাবে বসে শুধুমাত্র ওয়ায়েজ হিসেবে করা হয় না। বরং মুসলমান যদি কোনো বাজারে কার্যরত থাকে তাহলে একদিকে সে নিজের কায়কারবার চালায়, অপরদিকে আল্লাহর দ্বীনের দিকেও মানুষকে আহবান জানায়। সে যেখানেই থাক এবং যে কাজই করুক –সব অবস্থাতেই সে প্রথমে আল্লাহর দ্বীনের আহবায়ক, অতপর অন্য কিছু”।
মাওলানা মওদূদী
ঝিলাম
১৪ নভেম্বর, ১৯৬৭ইং