দুই
ইসলাম কিভাবে প্রচারিত হয়েছিল
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের মূলে তিনটি জিনিস অত্যাবশ্যকীয় কার্যকারণ হিসেবে বর্তমান।
প্রথমতঃ ইসলামের সহজ ও সরল আকীদা-বিশ্বাস ও তার চিত্তাকর্ষক ইবাদাত।
দ্বিতীয়তঃ মুসলমানদের জীবনে ইসলামের শিক্ষা, উপদেশ ও অনুশাসনের বিস্ময়কর প্রভাব।
তৃতীয়তঃ মুসলমানদের জীবনে ইসলামের প্রচার মুখী চরিত্র। প্রথমটি বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আহবান জানায়। দ্বিতীয়টি আবেগ ও উদ্দীপনাকে জাগ্রত করে ও প্রেরণা জোগায়। আর তৃতীয়টি একজন স্নেহময় নেতা ও মুরুব্বীর মত ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট লোকদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। বাজারে যেমন কোনো পণ্যের নিজস্ব উৎকৃষ্টতাই তার ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি ও প্রসার লাভের জন্য যথেষ্ট নয় এবং সে জন্য এমন কিছু কর্মীরও প্রয়োজন যারা ঐ পন্যের শ্রেষ্ঠত্ব ও উপকারিতা লোকদের বুঝাবে। তাছাড়া এমন কিছু সংখ্যক লোকেরও প্রয়োজন যারা উক্ত পণ্য নিজেরা ব্যবহার করে ও তার উপকারিতার বাস্তব সাক্ষ্য প্রদান করবে। ঠিক তেমনিভাবে দুনিয়ায় ইসলামের প্রচার-প্রসারেও এ তিনটি জিনিসের সমানভাবে ও একত্রে সক্রিয় থাকার প্রয়োজন ছিল। যখনই এর মধ্য থেকে কোনো একটির অভাব পড়েছে তখন অনিবার্যভাবেই তার প্রভাব ইসলামের প্রচার-প্রসারের তীব্রতা ও ক্ষমতায় ভাটা পড়েছে। এ তিনটি জিনিস কিভাবে নিজের ভূমিকা পালন করে, এক য়টির একত্র সমাবেশে কি ফল দেখা দেয় তা জানার জন্য কিছুটা বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন।
ইসলামী আকায়েদের সহজবোধ্যতা ও মানব-প্রকৃতির সাথে তার সামঞ্জস্য
ইসলামী আকায়েদ এত সহজ ও হৃদয়গ্রাহী যে, একজন অতি সাধারণ মানুষও তা মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। এর ভেতরে না আছে কোনো দার্শনিক জটিলতা, না আছে কোনো কুসংস্কার ও অলীক কল্পনার অবকাশ, না আছে অবাস্তব কথাবার্তার কোনো স্থান।
ইসলাম এমন কতগুলো সরল-সহজ মূলনীতি পেশ করে যা সকল স্তরের বুদ্ধিবৃত্তির কাছে অনায়াসেই গ্রহণযোগ্য। শুধু তাই নয়, এ মূলনীতিগুলোর এমনই ধন্বন্তরী প্রভাব যে, এগুলো গ্রহণ করে নেবার পর মানুষের মধ্যে অপূর্ব ধরনের আমূল পরিবর্তন অনুভূত হতে থাকে। তাছাড়া এ আকীদাসমূহের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে, এর বক্তব্য স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন এবং তাতে কোনো রকমের দ্বিধা-দ্বন্দের অবকাশ মাত্র নেই। খোদা সম্পর্কে এতে সুস্পষ্টভাবে এরূপ আকীদা পেশ করা হয়েছেঃ
أَنَّما إِلٰهُكُم إِلٰهٌ وٰحِدٌ ۖ فَهَل أَنتُم مُسلِمونَ
“তোমাদের খোদা, একই খোদা”।–(সূরা আল আম্বিয়াঃ ১০৮)
এতে দ্বিত্বের কোনো অবকাশ নেই।
لا تَتَّخِذوا إِلٰهَينِ اثنَينِ ۖ
“তোমরা দুই খোদা গ্রহণ করো না”।–(সূরা আন নাহলঃ ৫১)
তাঁর কোন সাহায্যকারীও প্রয়োজন নেই। কারণ তিনি সর্বশক্তিমান।
إِنَّ اللَّهَ عَلىٰ كُلِّ شَيءٍ قَديرٌ
“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান”।–(বাকারাঃ ২০)
وَيَفعَلُ اللَّهُ ما يَشاءُ
“আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন”।–(সূরা ইবরাহীমঃ২৭)
يَحكُمُ ما يُريدُ
“নিজের ইচ্ছা মতই তিনি সিদ্ধান্ত করেন”।–(সূরা আল মায়েদাঃ১)
তাঁর সত্তা জনক ও জাতের বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত ও পবিত্র তার সাথে কারোর তুলনা চলে না।
لَم يَلِد وَلَم يولَد
وَلَم يَكُن لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ০
“তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনি জাতও নন। তাঁর সমতুল্য কেউ নেই”।–(সূরা ইখলাসঃ ৩-৪)
মানবসুলভ দুর্বলতা থেকে তিনি মুক্ত।
الحَىُّ القَيّومُ ۚ لا تَأخُذُهُ سِنَةٌ وَلا نَومٌ
“তিনি চিরঞ্জীব চিরস্থায়ী, ঘুম ও তন্দ্রা তাকে স্পর্শ করে না”।–(সূরা বাকারাঃ২৫৫)
আকাশ ও পৃথিবীতে তিনি ছাড়া আর এমন কেউ নেই যার কাছে মানুষ সাহায্য ও সহায়তা চাইতে পারে।
أَلَم تَعلَم أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلكُ السَّمٰوٰتِ وَالأَرضِ ۗ وَما لَكُم مِن دونِ اللَّهِ مِن وَلِىٍّ وَلا نَصيرٍ
“তুমি কি জান না যে, আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর? বস্তুত তোমাদের জন্য তিনি ছাড়া আর কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই”।–(সূরা আল বাকারাঃ ১০৭)
উপাসনার উপযুক্ত একমাত্র তিনিইঃ
أَعبُدَ اللَّهَ مُخلِصًا لَهُ الدّينَ
“পূর্ণ আনুগত্য আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে তাঁর উপাসনা করা”।
একনিভাবে রসূলের মর্যাদা সম্পর্কেও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য পেশ করা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে কোনো রকমের খোদায়ীর সংশয়ের অবকাশ রাখা হয়নি। সুস্পষ্টভাবে এ আকীদা পেশ করা হয়েছে যে, রসূল মানুষ ছাড়া আর কিছু নন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের নিকট স্বীয় বাণী পৌঁছানোর জন্য একজন মানুষকে রসূল হিসেবে বাঁছাই করেছেন মাত্র।
إِنَّما أَنا۠ بَشَرٌ مِثلُكُم يوحىٰ إِلَىَّ
“আমি তোমাদের মতই মানুষ। কেবল আমার নিকট ‘ওহি’ প্রেরণ করা হয়”। -(সূরা আল কাহাফঃ ১১০)
পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি নেই যার নিকট আল্লাহ একজন হেদায়েতকারী প্রেরণ করেননিঃ
وَلِكُلِّ قَومٍ هادٍ
“প্রত্যেক জাতির জন্য হেদায়েতকারী রয়েছে”।–(সূরা আর রা’দঃ ৭)
মানুষের ইহলৌকিক কার্যকলাপ, তার দায়িত্ব ও ফলাফল সম্পর্কে ইসলাম দ্ব্যর্থহীনভাবে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছে যে, এ ক্ষেত্রে কোনো প্রায়শ্চিত্ত বা আদল-বদলের অবকাশ নেই। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেই দায়ী এবং যে যেমন কাজ করবে, সে তেমনি কর্মফল ভোগ করবেঃ
فَمَن يَعمَل مِثقالَ ذَرَّةٍ خَيرًا يَرَهُ
وَمَن يَعمَل مِثقالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
“যে ব্যক্তি কণা পরিমাণও ভালো কাজ করবে সে তাঁর প্রতিদান পাবে আর যে ব্যক্তি কণা পরিমাণও খারাপ কাজ করবে সে তাঁর প্রতিফল পাবে”। -(সূরা যিলযালঃ ৭-৮)
পরকাল সম্পর্কে ইসলাম এই যে সুস্পষ্ট আকীদা-বিশ্বাস পেশ করেছে, পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম একনটি করেনি। বৌদ্ধ ধর্মের দুর্বোধ্য মুক্তি মতবাদের স্থান যেমন এতে নেই, তেমিন নেই হিন্দু মতবাদের জটিল ও পেঁচালো পুনর্জন্মবাদ এবং জড়বাদের পূর্ণ বিনাশবাদের অবকাশ। এতে বরঞ্চ অত্যন্ত সহজ ও সরলভাবে বলা আছে যে, মানুষ তাঁর বর্তমান জীবনের কার্যকলাপের ফল তাঁর পরবর্তী জীবনে ভোগ করবে এবং সেটাই হবে প্রকৃত জীবন।
এ আকীদাগুলো এত সহজ ও সরল যে, মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি তা অনায়াসেই গ্রহণ করে। ইসলাম প্রচারকদের প্রচারকার্যে ব্যাপক সাফল্যের কারণ এই যে তাঁরা এমন কোনো বক্তব্য পেশ করে না যা গ্রহণ করতে সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি অক্ষম বা বিমুখ। জনৈক প্রখ্যাত ফরাসী দার্শনিক অধ্যাপক মন্টেইট ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে লিখেছেনঃ
“এত সহজ ও স্পষ্ট যে আকীদা, যে আকীদা দার্শনিক জটিলতা থেকে এতটা মুক্ত এবং সাধারণ বিবেক-বুদ্ধির পক্ষে এতটা অনায়াসে অনুধাবনযোগ্য, তাতে মানব জাতির মন-মগজে বশীভূত করার এক অভাবনীয় ও বিস্ময়কর শক্তি থাকার কথা এবং বাস্তবিকপক্ষে তার সে শক্তি আছে”।
মানুষের মন-মগজের উপর এ আকীদাসমূহের যে কী গভীর প্রভাব তা একটি ঘটনা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। একবার আফ্রিকার গারা উপজাতির একটি ক্রিতদাসকে ঝানজ উপকূল থেকে নিয়ে জেদ্দায় বিক্রি করে দেয়া হয়। ক্রিতদাসটিকে অতপর স্বাধীন করে দেয়া হয় এবং সে ইসলাম গ্রহণ করে। এ সময়ে জনৈক ইউরোপীয় পর্যটক তাঁর সাথে সাক্ষাত করে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন যে, যারা তোমাকে এভাবে বিনা অধিকারে ধরে এনে জানোয়ারের মত বিক্রি করে দিলো তাদের প্রতি তোমার কি রাগ হয় না? জবাবে নিগ্রো দাসটি বললোঃ
“হ্যাঁ, স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রতি আমার রাগ হয়। তবে একটি জিনিস আমার ক্ষতিপূরণ করে দিয়েছে। সেটা হলো, আমি তাদের কারণেই কুফরীর অন্ধত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি। আমি যে এই দেশে আসতে পেরেছি এবং আমি যে ইসলামের মত অপূর্ব নেয়ামত অর্জন করতে পেরেছি, একে আমি আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করি। বিশ্বাস করুন, ঈমানে যে স্বাদ, যে মধুরতা, তার চেয়ে বড় স্বাদ ও মধুরতা আর কোনো বস্তুতেই নেই। এ মধুরতাকে কেবল হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। ভাষা দিয়ে তা ব্যক্ত করা যায় না”।
ইসলাম ইবাদাতের চিত্তাকর্ষতা
ইসলামী ইবাদাতগুলো এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এতে এমন এক চিত্তবিমোহনী শক্তি রয়েছে যে মন্টেঙ্কুর মতানুসারে কারো মন তা দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারে না। আলেকজান্দ্রিয়ার জনৈক ইহুদী ধর্মত্যাগী নও মুসলিম লিখেছেনঃ
“আমি শুধু মুসলমানদের ইবাদাত দেখে মুসলমান হয়েছি। একবার আমি জামে মসজিদে নামাযের দৃশ্য দেখতে গিয়েছিলাম। সর্বপ্রথম যে জিনিসটি আমার মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাহরো খুতবা। খুতবার প্রতিটি শ্ব আমার মনকে প্রভাবিত করছিল। বিশেষত খতবি যখন বললেনঃ
إِنَّ اللَّهَ يَأمُرُ بِالعَدلِ وَالإِحسٰنِ وَإيتائِ ذِى القُربىٰ وَيَنهىٰ عَنِ الفَحشاءِ وَالمُنكَرِ وَالبَغىِ
“নিশ্চয়ই আল্রাহ ন্যায় বিচার, সদাচার ও আত্মীয় স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন আর অশ্লীলতা, অন্যায় ও ব্যভিচার থেকে বিরত থাকতে বলেন”।–(সূরা আন নাহলঃ ৯০)
খতীবের মুখে একথা শুনে আমার মন এ ধর্মের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্দায় ভরে উঠরো যার খোদা এমন উচ্চাংগের নীতি শিক্ষা দেন। এরপর যখন নামাজ শুরু হলো এবং মুসলমানরা কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল তখন আমার মনে হলো যেন, এরা সব ফেরেশতা দাঁড়িয়েছে আর আল্লাহ যেন খোলাখুলি-ভাবে তাদের সামনে দেখা দিয়েছেন। আমার মন বলে উঠরো, বনী ইসরাঈলের সাথে তো আল্লাদ দু’বার কথা বলেছেন, আর এ জাতির সাথে তিনি প্রতিদিন পাঁচবার করে কথা বলেন।
নামায এমন এক ইবাদাত যে, এর জন্য না কোনো পাদ্রী-পুরোহিতের প্রয়োজন থাকে, না থাকে কোনো মন্দির-গীর্জার বাধ্যবাধকতা। প্রত্যেক মুসলমান এর ইমাম হতে পারে। সব জায়গায় এর মসজিদ রয়েছে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি পদমর্যাদা ও জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে। নামাযের এমন বিস্ময়কর প্রভাব যে, কট্টর থেকে কট্টর ইসলাম বিরোধীরাও এর প্রশংসা করতে বাধ্য হয়ে যায়। এক অদৃশ্য খোদার এমনভাবে আনুগত্যের ভাব জন্মে এবং প্রত্যেক উঠা-বসার থেকে চরম শ্রদ্ধা ও ভীতির ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠে, এতে পাষাণ হৃদয়ও গলে যায়।
পাদ্রী লেফরদের সাথে ভারতবর্ষের আলেমদের চাঞ্চল্যকর বাহাছসমূহের কথা সম্ভবতঃ এখনো অনেকের মনে আছে। তিনি তাঁর গ্রন্থ Mankind and Church-এ লিখেছেনঃ
“মুসলমানদের এ ইবাদাত দেখে কেউই প্রভাবিত না হয়ে পারে না। মুসলমান যেখানে যে অবস্থায় থাক না কেন –রাস্তায় হাটুক, রেলষ্টেশনে দাঁড়িয়ে থাক, দোকানে বসে থাক, কিংবা মাঠে বিচরণ করুক, আযান হওয়া মাত্রই সব কাজ ছেড়ে দিয়ে এক খোদার সামনে আনত মস্তকে দাঁড়িয়ে যায়। এ দৃশ্য মানুষের মনে ছাপ না রেখে যায় না। বিশেষতঃ দিল্লীর জামে মসজিদে জুমায়াতুল বিদার নামাযে পনেরো বিশ হাজার মুসলশানকে পরম বিনয়, নিষ্ঠা ও পূর্ণ নীরবতার সাথে নামায পড়তে যে ব্যক্তি দেখেছে সে ঐ দৃশ্য দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারে না। ইসলামের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে যে শক্তি নিহিত রয়েছে, এ দৃশ্য দেখে তা বেশ অনুভব করা যায়। এছাড়া মুসলমানদের প্রত্যহ পাঁচবার নিয়মিত নামায পড়া এবং চরম শোরগোলের মধ্যেও ধীরস্থিরভাবে নিজ দায়িথ্ব পালন করার এ ধারাবাহিকতার মধ্যে এক বিশেষ আবেদন রয়েছে”।
মুসলমানদের জীবনে ইসলামের অনুশাসনের প্রভাব
আকায়েধ ও ইবাদাতের পর যে জিনিসটি নিজের কার্যকর প্রভাবের বলে ইসলামের প্রচার-প্রসারে সবচেয়ে বেশী ক্রিয়াশীল, তা হচ্ছে মুসলমানদের ইসলাবী জীবন। ইসলাম যদি শুধু নীতি পেশ করেই ক্ষান্ত থাকতো এবং তার শিক্ষা ও অনুশাসনে যদি সেই বিপ্লবী প্রভাব না থাকতো যা চরম সভ্যতা বিবর্জিত জাতিগুলোকে মানবতার উচ্চতর স্তরে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল তাহলে বোধহয় বিশ্বের মানুষ এর দিকে তেমন আকৃষ্ট হতো না। কিন্তু ইসলাম নীতি পেশ করার সাথে সাথে তার বাস্তব দৃষ্টান্তও পেশ করেছে। বাস্তবিক পক্ষে এ বাস্তব দৃষ্টান্তের চুম্বক শক্তিই মানুষের মনকে এর দিকে আকৃষ্ট করে থাকে।
আল্লাহর একত্ব তাঁর শক্তিমানত্ব এবং একমাত্র তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার ইসলামী শিক্ষা মুসলমানদেরকে এতটা আত্মসম্ভ্রমী, এতটা ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ এবং এতখানি সহনশীল, স্বাতন্ত্রবোধ সম্পন্ন ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন করে দিয়েছে যে, তারা দুনিয়ার কাউকে ভয় করে না, কারও কাছে প্রার্থনার হাত প্রসারিত করে না এবং কোনো বিপদে হতাশ হয় না –তা যত বড়ই হোক না কেন। প্রতিফল, প্রতিদান ও আখেরাতের বিচার সংক্রান্ত ইসলাম শিক্ষা তাদের মদ্যে এত বীরত্ব ও শৌর্য-বির্যের জন্ম দিয়েছে যে, তারা তাদের বর্তমান জীবনকে নশ্বর মনে করে প্রতি মুহুর্তে তা আল্লাহর পতে কুরবানী করার জন্য প্রস্তুত থাকে। তাদের রক্তের উত্তাপ পৃথিবীতে অতুলনীয়। পরহেজগারী ও আল্লাহভীরুতার শিক্ষা তাদের মধ্যে অস্বাভাবিক ধরনের ন্যায়পরায়ণতা ও নিঃস্বার্থতার গুণাবলী সৃষ্টি করেছে এবং নেশা, চুরি ও নৈতিক অপরাধ এড়িয়ে চলার ব্যাপারে তারা পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীর তুলনায় শ্রেষ্ঠতর। ইসলামী সাম্য ও ইসলামী সৌভ্রাতৃত্বের শিক্ষা তাদের মধ্যে এমন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্ম দিয়েছে যে, তাদের সমাজে না আছে বর্ণ ও বংশের ভেদাভেদ, না আছে ধনী-নির্ধনের মর্যাদার পার্থক্য, না আছে ভৌগলিক জাতীয়তার বৈষম্যের গোঁড়ামী। ইসলাম গ্রহণ করার পর যে কোনো ব্যক্তি ইসলামী সমাজের সদস্য হয়ে যায়-চাই সে কৃষ্ণাঙ্গ হোক কিংবা শ্বেতাঙ্গ, ধনী হোক কিংবা দরিদ্র, মনিব হোক কিংবা দাস। সব অবস্থাতেই মুসলমানরা তাকে ভাই বলে গ্রহণ করবে এবং নামাযের জামায়াতে সে যে কোনো অভিজাত মুসরমানের পাশে দাঁড়াতে পারবে।
এছাড়া মুসলমানদের জীবনে ইসলামের অন্যান্য শিক্ষার প্রভাবও উল্লেখের দাবী রাখে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথেই মুসলমানদের মধ্যে জ্ঞানার্জন এবং সভ্যতা ও কৃষ্টির উন্নয়নের সাড়া পড়ে যায়। ইউরোপের খৃষ্টান ধর্মপ্রচারকগণ দেখে অবাক হয়ে গেছেন যে, আফ্রিকার সভ্যতা বিবর্জিত জাতিগুরোতেও ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথেই সভ্য জীবনের নিদর্শন ফুটে উঠেছে। মসজিদ নির্মাণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, সামাজিক জীবন, সংগঠণ এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য ও আর্থিক সচ্ছলতার উৎকর্ষতা সাধন ইত্যাকার গুণ-বৈশিষ্ট্য আফ্রিকায় সভ্যতা বিবর্জিত সমাজ জীবনকে সুসভ্য ও কৃষ্টিবান জীবনে রূপান্তরিত করেছে। এসব দেখে শুনে অন্যান্য অসভ্য জাতিগুলোও ঐ ধর্ম গ্রহণের দিকে আকৃষ্ট হয়। কেননা ধর্ম তাদেরই স্বগোত্রীয়দেরকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে অতি উচ্চমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইতিহাসে এ ঘটনা ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, হিজরী ৬ষ্ঠ শতকে ‘বারবার’ জাতীয় রোকেরা যখন নাইজেরিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য জিন্নীতে ইসলাম প্রচার শুরু করেন তখন সেখানে প্রচুর সংখ্যক আলেম সৃষ্টি হয়। অবশেষে রাজা যখন ইসলাম গ্রহনের জন্য একটি পরিষদ গঠন করলেন, তখন সেই পরিষদে দু’হাজার চারশো আলেম যোগদান করেন। ইসলামের এ সভ্যতা মুখী ভূমিকা আরব ও ভারত বর্ষ মিশর ও স্পেনে যে বিস্ময়কর প্রভাব রেখেছে তা এখানে বর্ণনা করা নিষ্প্রয়োজন। ইতিহাসে এর উজ্জ্বল নিদর্শন রয়েছে।
ইসলামী সাম্যের প্রভাব
ইসলামী জীবন-যাপনের সবচেয়ে প্রভাবশালী বস্তু ছিল সাম্য। স্থানীয় রসম-রেওয়াজ ও শক্তিধরদের স্বার্থপরতার দরুন যে জাত্গিুলো সাধারণ মানুষের চেয়ে নীচে নেমে যেতে বাধ্য হয়েছিল, ইসলাম তাদের জন্য করুণা হয়ে এসেছিল। ইসলাম তাদের জন্য মুক্তিদাতা হয়ে এসেছিল। ইতিহাস সাক্ষী যে, ইসলাম এ ধরনের হাজার হাজার জাতিকে মানবেতর পর্যায় থেকে উঠিয়ে ইজ্জত ও সম্মানের উচ্চমত শিখরে আরোহণ করিছিলেন। সাম্যের এ অপূর্ব দৃষ্টান্ত ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সবচেয়ে বেশী কার্যকর হয়েছিল। বিশেষতঃ যেসব এলাকায় এরূপ নির্যাতিত জাতিদের বাস ছিল, সেখানে ইসলামের জনপ্রিয়তার একমাত্র কারণ ছিল এটাই। স্যার উইলিয়াম হান্টার তৎকালীন বাংলাদেশের অবহেরিত শ্রেণীর লোকদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
“এসব দরিদ্র জেলে, শিকারী ও নিম্নশ্রেণীর কৃষকদের জন্য ইসলাম একটি আসমানী করুণাধারা হয়ে বর্ষিত হয়েছিল। এটা শুধু শাসক জাতির ধর্মই ছিল না বরং এতে এতটা সাম্য্ও ছিল যে, তারা এটা মেনে নিয়ে যে অভিজাত হিন্দুরা তাদের ঘৃণা করতো তাদের চেয়েও লাভ করতে পারতো। এ কারণে ভারতবর্ষের সবচেয়ে সচ্ছল প্রদেশটিতে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়েছিল। যদিও কোথাও কোথাও বলপ্রয়োগে ইসলাম প্রচারের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও প্রকৃতপক্ষে শক্তি প্রয়োগ মুখ্য ভূমিকা পারন করেনি বরং মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল তার নিজের গুণাবলী। ইসলাম এদেশের মানুষের বিবেকের কাছে আবেদন জানিয়েছিল এবং তাদের সামনে মানবতার একটি উচ্চ ধারণা পেশ করেছিল। ইসলাম মানবিক ভ্রাতৃত্বের এমন এক অপূর্ব নীতি প্রতিষ্ঠা করেছিল যা তারা কখনো দেখেনি এবং মানুষে মানুষে ভেদাভেদের সমস্ত শৃঙ্খল সে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছিল”।
দক্ষিণ ভারতে প্রধানতঃ এ সাম্যের কারণেই ইসলাম হিন্দুধর্মের উপর জয় লাভ করেছিল। আজ থেকে বিশ পঁচিশ বছর আগে টিনাভেলী অঞ্চলে একটি শিক্ষাপ্রদ ঘটনা ঘটে। ঐ অঞ্চলে সানার নামক একটি সম্প্রদায় বাস করে। তৎকালে এ সম্প্রদায়কে নীচ শ্রেণীর সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য করা হতো। এরা নিজেদের প্রতিভা ও যোগ্যতার বলে যথেষ্ট বিত্তশালী হয়ে উঠে এবং শিক্ষা ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে সাধারণ হিন্দুদের চেয়ে অনেক উচ্চমর্যাদার অধিকারী হয়। ক্নিতু তা সত্ত্বেও হিন্দুরা তাদের সাথে সেই অবমাননাকর আচরণ অব্যাহত রাখে যে আচরণ তারা করতো অচ্ছুতদের সাথে। এতে সানার সম্প্রদায়ের লোকদের মনে মারাত্মক আঘাত লাগে এবং হিন্দু ধর্মের প্রত তাদের মন বিরূপ হতে আরম্ভ করে। অবশেষে একবার তাদের সাথে হ্নিদুদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। কতিপয় সানারের মন্দিরে ঢোকার কারণে হিন্দুরা তাদরকে ভীষণ মারধোর করে। এতে গোটা সানার সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় ৬’শ সানার সেদিনই ইসলাম গ্রহণ করে। আশেপাশের সানাররা যখন এ খবর শুনতে পেল তখন তারাও একে একে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো।
আফ্রিকার নিগ্রোদের মধ্যেও এ মানবিক সাম্য ও ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ইসলামের প্রচার-প্রসারে সর্বাধিক কার্যকর হয়েছিল। মিঃ ব্লাইডেন তার গ্রন্থ খৃষ্টবাদ, ইসলাম ও নিগ্রো জাতি “(Christanity Islam and Negro Race)”-তে লিখেছেনঃ
“মুহাম্মদের অনুগামীরা যখনই শুনতে পায় যে, একজন পৌত্তলিক নিগ্রো ইসলাম গ্রহণে ইচ্ছুক, তখন সেই নিগ্রো যতই ইতর শ্রেণীর মানুষ হোক না কেন, তাকে তৎক্ষণাৎ মুসলিম সমাজের একজন সমান মর্যাদাবান সদস্য হিসাবে গ্রহণ করা হয় এবং শুধু তার মন জয় করার মানসেই নয় বরং সত্যি সত্যি ভাই মনে করেই তাকে সমাদর করা হয়। ফলে সে অনুভব করতে পারে যে, ইসলাম বাস্তবিকই তার জন্য এক অপূর্ব নেয়ামত। বস্তুতঃ আফ্রিকায় ইসলাম যে খৃষ্টবাদের উপর প্রাধান্য লাভ করেছে, তার প্রধান কারণ এটাই।