প্রথম খণ্ড
——————–
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
এক
মুসলিম জাতির প্রচার ধর্মী চরিত্র
কিছু কিছু নও-মুসলিম জাতির মধ্যে যখন থেকে ইসলাম ত্যাগের প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তখন থেকে ভারত বর্ষের মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক অস্থিরতা ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। চারিদেক থেকে ইসলাম প্রচারের রব উঠতে শুরু করেছে। বিভিন্ন সংগঠন আপন আপন সামর্থ অনুযায়ী সত্য দ্বীনের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করেছেন। পত্র-পত্রিকায় এ কাজের গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য আমাদের কি কি উপায়-উপকরণ ও সুযোগ-সামর্থ আছে, তার পর্যালোচনার জন্য সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মোটকথা, অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যে সত্যিকারভাবে ইসলাম প্রচারের একটিা সাড়া পড়ে গেছে এবং একটা জাগরণ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে একটু তলিয়ে চিন্তা করলে আমরা অনুভব করি যে, আমরা যারা এ যুগে মুসলিম বলে পরিচিত, তারা অতীতের মুসলশানদের সেই তবলিগী প্রেরণা ও উদ্দীপনা সম্পর্কে একেবারই ওয়াকিফহাল নই, যা এক সময়ে ইসলামের সর্বব্যাপী বিজয়, তার বিশ্বজোড়া কর্তৃত্ব ও পরাক্রমের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার ছিল। আজ যদি আমাদের মধ্যে সেই প্রেরণা ও উদ্দীপনা বর্তমান থাকতো তাহলে হয়তো এ সভা-সমিতির প্রয়োজনই দেখা দিতো না। ইসলামের শত্রুদের শত্রুতামূলক আচরণের দরুণ আমাদের কপালে করাঘাত করার দরকার হতো না বরং আমাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি দেখেই শত্রুরা দিশেহারা হয়ে পড়তো। সময়ে সময়ে আমরা ভেবে বিস্মিত হই যে, এ অস্থিরতা ও চাঞ্চল্য এমন এক ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে, যে ধর্মের সাংগঠনিক উপাদানগুলোর মধ্যে একটা অপরিহার্য উপাদান ছিল সত্য ও ন্যায়ের দিকে আহবান জানানো এবং আল্লাহর সর্বশেষ বাণীকে তার বান্দাদের নিকট পৌঁছে দেয়ার কাজে ব্যয় করেছিলেন এবং যাঁর অনুসারীরা এক শতাব্দীর মধ্যেই আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল থেকে ভূ-মধ্যসাগরের উপকুল পর্যন্ত সত্য দ্বীনের প্রচারের কাজ সম্পন্ন করে ছিলেন। প্রশ্ন জাগে যে, আমরা কি তবে সেই সত্য দ্বীনেরই অনুসরণ করছি, না আমরা মুসলমানরাও বনী ইসরাঈলের মত আপন নবীর ইন্তেকালের পর নতুন কোনো ধর্ম বানিয়ে নিলাম?
আজ আমাদের মুখ ইসলাম প্রচারের সংকল্পে সোচ্চার। আমরা ইসলাম প্রচারের জন্য বিভিন্ন দল বা সংগঠন তৈরী করতে চাচ্ছি। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে এটাই সম্ভবত প্রথম ঘটনা যে, এর অনুসারীরা খৃষ্টানদের ন্যায় মিনারী সমিতি বানাতে সচেষ্ট হয়েছে কিংবা এতটা বেসামালভাবে ইসলাম প্রচারের রব তুলেছে। সমিতি বানানো বা হৈ-হুল্লা করাতেই যদি সাফল্যের প্রকৃত চাবিকাঠি নিহিত থাকতো তাহলে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে পূর্ববর্তীদের চেয়ে আমাদের বেশী উন্নতি করার কথা ছিল। কিন্তু এর বিপরীত অবশ্যই আমরা দেখতে পাচ্ছি। এত প্রস্তুতি সত্ত্বেও আমাদের পা পেছন দিকে ধাবিত হচ্ছে অথচ আমাদের পূর্ববর্তীরা উপায়-উপকরণ ও প্রস্তুতির চরম অভাব থাকা সত্ত্বেও এতখানি সাফল্য অর্জন করেছিলেন যে, সেই সাফল্যের দরুনই আজ পৃথিবীর প্রতিটি কোণে ইসলামের অনুসারী বর্তমান। খোদ ভারতবর্ষে আমাদের সংখ্যা ৭ কোটিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।–[এটা ১৯২৫ সালের কথা। বর্তমানে উপমহাদেশে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি।-অনুবাদক] এমতাবস্থায় আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের আসল অভাব কিসের? ইসলাম প্রচারের মূল রহস্যটি কি?
বস্তুত আজ মুসলমানদের মধ্যে যতগুলো দুর্বলতা দেখা দিয়েছে সেসবই শুধুমাত্র এজন্য দেখা দিয়েছে যে, তাদের মধ্য থেকে ইসলামের প্রাণশক্তি বেরিয়ে গেছে। মুসলমান হিসাবে তাঁরা কি মর্যাদার অধিকারী সে কথা তাঁরা ভুলে গেছে। তাঁরা যদি ইসলামকে ভাল করে উপলব্ধি করে এবং একজন মুসলমানের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি তা যদি তাঁরা জেনে নিতে পারে তাহলে ইসলাম প্রচারের সমস্যা আপনা আপনিই সমাধান হয়ে যাবে।
মুসলমানদের জীবনের উদ্দেশ্য
অধ্যাপক মাক্স মুলার (Max Muller)-এর অভিমত এই যে, ইসলমা মূলতঃ একটি প্রচারমূলক ধর্ম। তাবলীগ বা প্রচারের উপরতই এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। প্রচারের বলেই তার অগ্রগতি ও বিকাশ সাধিত হয়েছে এবং প্রচারের উপরই তার অস্তিত্ব নির্ভরশীল। বস্তুত ইসলামের শিক্ষা ও উপদেশাবলী অনুশীলন করলে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ইসলাম মানেই সত্যের প্রতি আহবান জানানো এবং মুসলমানের জীবনের উদ্দেশ্য সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা ছাড়া আর কিছু নয়। পবিত্র কুরআনে মুসলমানের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এরূপ বর্ণনা করা হয়েছে।
كُنتُمخَيرَأُمَّةٍأُخرِجَتلِلنّاسِتَأمُرونَبِالمَعروفِوَتَنهَونَعَنِالمُنكَرِوَتُؤمِنونَبِاللَّهِۗوَلَوءامَنَأَهلُالكِتٰبِلَكانَخَيرًالَهُمۚمِنهُمُالمُؤمِنونَوَأَكثَرُهُمُالفٰسِقونَ
“তোমাদের দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম জাতি করে সৃষ্টি করা হয়েছে যেন তোমরা মানুষকে সৎকাজের নির্দেশ দান কর ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখ এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখ”-(সূরা আলে ইমরানঃ ১১০)
পৃথিবীর জন্য মুসলমানের অস্তিত্বের প্রয়োজন শুধু এটুকু যেঃ
وَلتَكُن مِنكُم أُمَّةٌ يَدعونَ إِلَى الخَيرِ وَيَأمُرونَ بِالمَعروفِ وَيَنهَونَ عَنِ المُنكَرِ ۚ وَأُولٰئِكَ هُمُ المُفلِحونَ
“তোমাদের মধ্য হতে এমন একটি গোষ্ঠী তৈরী হওয়া চাই যারা কেবল কল্যাণের দিকে আহবান জানাবে, সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে”।–(সূরা আলে ইমরানঃ ১০৪)
মুসলমানদেরকে বারংবার নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ
ادعُ إِلىٰ سَبيلِ رَبِّكَ بِالحِكمَةِ وَالمَوعِظَةِ الحَسَنَةِ ۖ وَجٰدِلهُم بِالَّتى هِىَ أَحسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبيلِهِ ۖ وَهُوَ أَعلَمُ بِالمُهتَدينَ
“তোমার প্রতিপালকের পথের দিকে মানুষকে আহবান জানাও কুশলতা ও সদুপদেশ সহকারে”। -(সূরা আন নাহলঃ ১২৫)
فَذَكِّر بِالقُرءانِ مَن يَخافُ وَعيدِ
“কুরআনের সাহায্যে সেই ব্যি্তিকে উদ্দীপিত কর যে আমার হুশিয়ারীতে ভীত হয়”। -(সূরা ক্বাফঃ ৪৫)
فَذَكِّر إِنَّما أَنتَ مُذَكِّرٌ
“আপনি উদ্দীপিত করুন। উদ্দীপিত করা ছাড়া আপনার আর কোনো দায়িত্ব নেই”। -(সূরা আল গাশিয়াঃ ২১)
এসব শিক্ষার প্রভাব রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে সবচেয়ে প্রবল ছিল এবং এ শিক্ষাই সাহাবায়ে কেরামের জীবনে সবাত্মক বিপ্লব এনেছিল। তাঁদের পবিত্র জীবন ছিল কেবল দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে সদা নিয়োজিত। তাদের উঠাবসা, চলাফেরা –প্রতিটি কাজেরই মূল লক্ষ্য ছিল আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান জানানো এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকীমের দিকে চালিত করা।
মুসলমানদের জীবনে যতদিন পবিত্র কুরআন ও রসূলের আদর্শের এ শিক্ষাগুলোর প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল ততদিন প্রতিটি মুসলমান ছিল একজন প্রচারক ও মুবাল্লিগ।
তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, কৃষি, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং দুনিয়ার যাবতীয় কাজই করেছেন। কিন্তু তাঁদের মনে সবসময় এ প্রেরণা ও চেতনা সক্রিয় তাকে যে, ইসলামের আকারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে মহান নেয়ামত ও অমূল্য সম্পদ তাদেরকে দিয়েছেন তা সমগ্র মানবজাতির নিকট পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। তাঁরা সত্যিকারভাবে ইষলামকে বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে উপাদেয় ও উত্তম নেয়ামত মনে করতেন। আর এ নেয়ামত মনে করতেন। আর এ নেয়ামত প্রত্যেক মানুষের নিকট পৌঁছানোকে তাঁরা তাঁদের ঈমানী দায়িত্বের অঙ্গ বলে বিশ্বাস করতেন। তাই যে ব্যক্তি যখন যে অবস্থায় থাকতো সে সেই অবস্থাতেই এ দায়িত্ব পালন করতো। সওদাগর ও ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়ী কাজকর্ম ও লেনদেনের সময়, পর্যটকরা তাদের পর্যটনের ভেতর দিয়ে, কয়েদীরা জেলখানার অভ্যন্তরে, চাকুরেরা অফিসে এবং কৃষকরা খেত-খামারে বসেই এ পবিত্র দায়িত্ব পালন করতো। প্রচার ও তাবলীগের এ প্রেরণা এতটা চরমে পৌঁছেছিল যে, মহিলারা পর্যন্ত অত্যন্ত আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে ইসলাম প্রচার করেছেন।
ইসলামের শক্তির আসল উৎস
প্রকৃতপক্ষে এ প্রচারোদ্দীপনাই ছিল ইসলামের শক্তির মূল উৎস। আজ যে পৃথিবীতে ৪০ কোটি (এটাটও ১৯২৫ সালের অনুমান। বর্তমানে এর দ্বিগুণ ধরে নেয়া যেতে পারে-অনুবাদক) মুসলমান আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন বর্ণ, বংশ ও দেশে যে ইসলামের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বিদ্যমান, সেটা মুসলিম জাতির এ প্রচার ধর্মী চরিত্রেরই ফল।
ইসলামের শত্রুরা বলে থাকে যে, ইসলাম শুধু তরবারীর সাহায্যে ছড়িয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে, ইসলাম কেবল তাবলীগ বা প্রচারের সাহায্যে বিস্তার লাভ করেছে। ইসলামের আবির্ভাব যদি কেবল তরবারীর সাহায্যে হতো তাহলে তরবারীর আঘাতেই তা এতদিন শেষ হয়ে যেত। এ যাবত তরবারীর যত আক্রমণ তার ওপর পরিচালিত হয়েছে, তা ইসলামকে ধ্বংস করতে সক্ষম হতো। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সে তরবারীর বলপ্রয়োগ করে পরাজিত হয়ে পুনরায় প্রচারের অস্ত্র প্রয়োগ করে বিজয়ী হয়েছে। বাগদাদে যখন মুসলমানদের পাইকারী হত্যা চলছিল, তখন সুমাত্রায় ইসলামী হুকুমত কায়েক হচ্ছিল। একদিকে কর্ডোভা থেকে ইসলামকে নির্বাসিত করা হচ্ছিল। অন্যদিকে জাভায় তার পতাকা উড্ডীন হচ্ছিল। সিসিলিতে যখন ইসলামকে খতম করার অভিযান চলছিল, জাভায় তখন সে নতুন জীবনী শক্তি লাভ করছিল। একদিকে তাতারীরা ইসলামের গলায় ছুরি চালাচ্ছিল, অন্যদিকে মুসলমান মুবাল্লিগরা সেই তাতারীদেরই হৃদয় জয় করে নিচ্ছিলেন। একদিকে তুর্কীরা ইসলামকে দাসত্বের জিঞ্জির পরাচ্ছিল, অন্যদিকে তারা নিজেদের মন ইসলামের দাসত্বের জন্য পেশ করছিল।
এসব বিজয় তাবলীগ ও প্রচারের বিজয় নয়, তো কি? আজ পৃথিবীর চারদিকে তাকিয়ে দেখুন। ইসলামের যে বিজয়গুলোকে সামরিক বিজয় বলে অভিহিত করা চলে, তা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। স্পেন ধ্বংস হয়েছে। সিসিলি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। গ্রীস বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু মধ্য আফ্রিকা, জাভা, সুমাত্রা, চীন, মালয় –যাকে ইসলাম প্রচারের অস্ত্র দ্বারা জয় করেছিল –তা যথাযথভাবে বর্তমান এবং তা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ইসলামের অস্তিত্ব একমাত্র তাবলীগ তথা প্রচারের উপরই পরিপূর্ণ ও চূড়ান্তভাবে নির্ভরশীল। এখন প্রশ্ন হলো, এ প্রচার কি গুটিকয় মিশনারী সমিতির দ্বারা সাধিত হয়েছিল? এ বিরাট বিজয় কি আজ আমরা যে কর্ম বিমুখ হৈ-হল্লা করছি সেই ধরণের হৈ-হল্লার ফল? আজকের মত কাগুজে লড়াই ও পত্র-পত্রিকার সাময়িক আলোচনা-পর্যালোচনার ফলে কি এসব হতে পেরেছে –যে লড়াই আমরা খৃষ্টান মিশনার্রীদের অনুকরণে করে যাচ্ছি? ইতিহাস এর জবাবে বলে, ‘না’। বক্ষমান নিবন্ধে আমরা এ বিষয় নিয়েই আলোচনা করতে প্রবৃত্ত হচ্ছি।