তিন
ইসলাম প্রচারে সুফী সাধকদর অবদান
পূর্ববর্তী পাতাগুলোতে ইসলাম প্রচারের দু’টো গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ আলোচিত হয়েছে। এবার বাস্তব দিক সম্পর্কে আলোচনা করে দেখা যাক, এ ঐশী সত্যের প্রতি যারা ঈমান এনেছেন তারা এ সত্যের আলো বিশ্বের সর্বত্র প্রচার করার ব্যাপারে কি পরিমাণ চেষ্টা-সাধনা করেছেন। একথা সত্য যে, ইসলামের নিজস্ব গুণাবলীই মানুষেল কাছে ইসলামকে হৃদয়গ্রাহী করে তোলার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু দুনিয়ার ব্যাপারে আমরা দিনরাত দেখতে পাই, অতি উত্তম পণ্যও ভালো প্রচার না হলে বিক্রি হয় না। আর বিক্রেতা যদি যোগ্য হয় তাহলে সে খারাপ পণ্যেরও অনেক ক্রেতা পেয়ে যায়। কোনো জিনিসের গুণাবলী মানুষকে না জানালে এবং মানুষের মনে তার প্রতি আগ্রহের সৃষ্টি না করলে সাধারণতঃ কেউই তার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। সে জন্য প্রত্যের পণ্যের সাফল্য তার বিক্রেতাদের তৎপরতা, যোগ্যতা ও প্রচারক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। ধর্মের প্রচার-প্রসারের ব্যাপারেও এ নীতি সমানভাবে প্রযোজ্য। ইসলাম যতই সত্য ও ভালো ধর্ম হোক না কেন, তার প্রচার-প্রসারের জন্য তার নিজের গুণাবলী যথেষ্ট নয় বরং তার অনুসারীদের প্রচারমুখী চরিত্রের অধিকারী হওয়াও প্রয়োজন। সত্য বলতে কি, এ প্রচারমুখী চরিত্রই ইসলামের প্রচার-প্রসারের তিন অপরিহার্য উপকরণের মধ্যে বাস্তব ও কার্যকরৃ উপকরণ।
মুসলমানদের প্রচার মুখী চরিত্রের বিশ্বজনীন প্রসার
আমরা এ যুগের নিষ্ক্রীয় মুসলমানেরা অতীতের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রচারমুখী চরিত্র ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে সঠিক কল্পনাও করতে পারি না। এমনকি এ যুগেও আফ্রিকা, চীন ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের মুসলমানদের মধ্যে যে তাবলিগী চরিত্র বিদ্যমান, সেটাও আমাদের ধারণা বহির্ভূত।–[এ পুস্তক লেখার সময় চীনে কমুনিষ্ট সরকার গঠিত হয়নি।–অনুবাদক]
তাঁদের দৈনন্দিন কর্মসূচীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ইসলামের মাহাত্ম মানবজাতির নিকট বেশী বেশী করে পৌঁছানো। ইসলামের আলোকে তাদের মন চিল উদভাসিত। পাথরে খোদাই হওয়ার মত তাদের মনে এ বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল ছিল যে, মুসলিম হিসাবে মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান জানানো এবং সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করাই তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। তারা যেখানেই যেতেন, এ উদ্দেশ্য সেখানে তাদের সাথে সাথেই যেত এবং তাদের জীবনের প্রতিটি কাজে তা অনিবার্যবাবেই শামিল হতো। তারা কুরাইশদের নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষা করে আবিসিনিয়া গেলেন; সেখানেও তারা শুধু এ কাজই করলেন। মক্কা থেকে বেরিয়ে মদীনায় তারা যখন শাস্তির জীবন রাভ করলেন তখনও তারা তাদের সমগ্র শক্তি এই ইসলামের প্রচারেই নিয়োজিত করলেন। তাোদেরকে সাসানী ও রোমক সভ্যতার ধ্বংসোন্মুখ প্রাসাদকে মিছমার করে দেয়ার দায়িত্ব যখন দেয়া হলো তখন সিরিয়া, ইরাক ও রোমেও তারা ঐ পবিত্র দায়িত্বই সমাধা করেছিলেন।
আল্লাহ যখন তাদেরকে পৃথিবীর খেলাফত দান করলেন তখন তা দিয়েও তারা আয়েশী জীবনের উপকরণ সংগ্রহ করার পরিবর্তে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের কাজ চালিয়েছেন। একদিকে আটলান্টিক মহাসাগরের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালা ও অন্যদিকে চীনের সুউচ্চ প্রাচীর তাদের পথের অন্তরায় না হওয়া পর্যন্ত এ কাজ তারা অব্যাহত রেখেছেন। তারা যখন বাণিজ্য পণ্য নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে বেরিয়েছেন তখনও এ আকাঙ্ক্ষাই তাদের মন-মগজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং তারা আফ্রিকার উত্তপ্ত মরুভূমিতে, ভারতবর্ষের শ্যামল উপত্যকায়, আটলান্টিক মহাসাগরের সুদূর দ্বীপসমূহে এবং ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ কুফরীজর্জ্জরিত ভূ-খণ্ডসমূহে ইসলামের আলোকরশ্মী ছড়িয়ে দিয়েছেন।
ইসলাম প্রচারের এ উদ্দীপনা এত তীব্রতা লাভ করেছিল যে, কারাগারের কঠোরমত যন্ত্রণা ভোগ করার সময়েও তাদের মন থেকে তার আকর্ষণ ম্লান হতো না। তারা কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠসমূহে তাদের কয়েদী সাথীদের কাছে ইসলাম প্রচার করতেন। এমনকি ফাঁসি কাষ্ঠে গিয়ে যদি কোনো অন্তিম আকাঙ্ক্ষা তাদের অস্থির করে তুলতো তবে সেটা আর কিছু নয় –শুধু এটুকু সাধ যে, জীবনের শেষ মুহুর্তগুরো যেন আল্লাহর দ্বীনের কথা তার বান্দাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার মধ্য দিয়ে কেটে যায়।
বেলজিয়ান কঙ্গোর একটা ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবী রাখে। বেলজিয়াম সরকার সেখানকার একজন মুসলিম নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু, তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার ঠিক পূর্ব মুহুর্তেই যে পাদ্র তাকে খৃষ্টীয় ধর্মে দীক্ষিত করতে গিয়েছিলেন, তাঁকে মুসলমান বানিয়ে গেলেন।
অনুরূপভাবে সাইয়েদ মুজাদ্দিদ সরহিন্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের কারাগারে তিনি যে দু’বছর কাটিয়েছেন তা শুধু ইসলাম প্রচার করেই কাটিয়েছেন। তার মুক্তির সময় পর্যন্ত কয়েক শো হিন্দু কয়েদী ইসলাম গ্রহণ করেছিল। সাম্প্রতিককালে হযরত মাওলানা জাফর থানেশ্বরী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সাম্প্রতিককালে হযরত মাওলানাজাফর থানেশ্বরী (র)-এর দৃষ্টান্তও উল্লেখ করার মত। সীমান্তের মুজাহেধীনের সাথে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে তাকে আন্দামানে নির্বাসিত করা হলে তিনি সেখানকার বহু সংখ্যক কয়েদীকে মুসলমান বানিয়ে দেন। ইতিহাসে এ দৃষ্টান্তও আছে যে, সমগ্র পূর্ব-ইউরোপে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়া মাত্র একজন মুসলিম আলেমের একক কৃতিত্ব। খৃষ্টানদের সাথে জিহাদ করার সময় তিনি গ্রেফতার হন। অন্তরীণ অবস্থায় তাঁকে হাত-পা বেঁধে ডানিয়ুব নদের মধ্যবর্তী উপত্যকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে তাঁর ঈমানী আলোকচ্ছটা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, অল্পদিনের মধ্যেই ১২ হাজার লোক মুসলমান হয়। ক্রমে ক্রমে হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় গোটা এলাকায় ইসলামের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।
ইসলাম প্রচারে নারী
এই সর্বাত্মক প্রচার উদ্দীপনা থেকে মুসলিম নারীরাও বঞ্চিত ছিলেন না। তাতারী মোগল হানাদারদের হাত হতে মুসলিম নিধনের তরবারী ছিনিয়ে তাদের গলে ইসলামের আনুগত্যের শৃঙ্খল পরানোর কৃতিত্ব যদি কারো থেকে থাকে তবে সে ছিল এই দুর্বল অথচ ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান মহীয়সী নারীদেরই কৃতিত্ব। এরা ছিলেন সেসব নারী যাদেরকে উক্ত হানাদারেরা মুসলিম দেশসমূহ থেকে দাসী বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। গাজান শাহের ভাই ওল জাতিভ খানকে তার স্ত্রীই মুসলমান বানিয়েছিল এবং তার বদৌলতেই ইলখানের সরকার ইসলামী সরকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। চুগতাই বংশ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল। কিন্তু হালাকু খানের মুসলিম স্ত্রী কোররাই সর্বপ্রথম ঐ বংশের লোকদের মধ্যে ইসলামের জ্ঞান বিস্তার করেন এবং তারই প্রভাবে মুবারক শাহ ও বাররাক খান মুসলমান হন। হাজার হাজার তাতারী সৈন্য তাদের সাথে মুসলিম নারীদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেসব মহীয়সী নারীগণ নিজ ধর্ম ত্যাগ করে তাদের স্বামীদের ধর্ম গ্রহণ করেননি। বরং তারা তাদের স্বামীদেরকই, বিশেষতঃ তাদের সন্তানদেরকে বেশী করে ইসলামে দীক্ষিত করে। আর তাদের প্রভাবেই সমগ্র তাতার ভূখণ্ডে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। একনিভাবে আবিসিনিয়াতেও মহিলারাই ইসলাম প্রচার করেন। ইতিহাস গ্রন্থাবলীতে এমন বুহ নিগ্রো নেতার উল্লেখ পাওয়া যায় যাদেরকে তাদের স্ত্রীরা ইসলামে দীক্ষিত করেছিলেন। সন্নৌসী প্রচারকগণ তো মধ্য আফ্রিকায় নিয়মিতভাবে মহিলাদের প্রতিষ্ঠান দ্বারা ইসলাম প্রচারের কাজ নিতেন। সেখানে আজও মহিলা পরিচালিত বহু ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ভারত বর্ষে ইসলাম প্রচারে সুফী সাধকগণের অবদান
কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে যে দলটি আল্লাহর দ্বীনের প্রচার-প্রসারে সবচেয়ে বেশী আগ্রহ উদ্দীপনার সাথে সক্রিয় ছিলেন সে হলো এসব সুফী সাধকেরই দল –যারা আজকের ভারতবর্ষে –[এখানে অবিভক্ত ভারতের কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ বর্তমান পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত।] এ ব্যাপারে প্রায় পুরোপুরিই নিষ্ক্রিয়। ভারতবর্ষে আউলিয়া ও সুফীগণ যে অতুলনীয় দৃঢ়তা ও ধর্মীয় নিষ্ঠা নিয়ে ইসলামের আলো বিস্তার করেছেন তাতে আজকের তাসাওউফ প্রচারকদের জন্য গভীর শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। এখানে সবচেয়ে বড় ইসলাম প্রচারক ছিলেন হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র) যাঁর কল্যাণে রজপুতনায় ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল। তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মুরিদগণ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন এবং ইসলামের বাণী প্রচার করেছিলেন। হযরত খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (র) দিল্লীর চতুর্দিকে, হযরত ফরিদউদ্দীন গঞ্জে শাকার (র) পাঞ্জাব অঞ্চলে, হযরত নিজাম উদ্দীন মাহবুবে ইলাহী (র) দিল্লী ও তার আশেপাশে, হযরত সাইয়েদ মুহাম্মদ গেসুদারাজ (র), হযরত শেখ বুরহানউদ্দীন (র), হযরত শেখ জয়নুদ্দীন (র) এবং শেষের দিকে (আওরঙ্গবাদের) হযরত নিজামউদ্দীন (রা) দাক্ষিণাত্যে এবং আরো পরবর্তীকালে হযরত শাহ কলিমুল্লাহ জাহান আবাদী (র) দিল্লীতে এ একই কাজ তথা সত্যের দিকে আহবান ও ইসলাম প্রচারের মহান কাজ সম্পাদন করেন। এছাড়া অন্যান্য ছেলছেলার আউলিয়া কেরামও এ কাজে অত্যন্ত যোগ্যতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পরিচয় দেন। পাঞ্জাবে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচার করেন হযরত সাইয়েদ ইসমাঈল বুখারী (র) যিতি হিজরী ৫ম শতকে লাহোরে আগমন করন। কথিত আছে, হাজার হাজার লোক তাঁর কাছে আসতো এবং তাঁর মূল্যবান ওয়াজ শুনতো। একবার যে তাঁর ওয়াজ শুনতো সে ইসলাম গ্রহণ না করে পারতো না। পশ্চিম পাঞ্জাবে ইসলাম প্রচারের কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশী হযরত বাহাউল হক জাকারিয়া মুলতানীর (র) প্রাপ্য। বাহাওয়ালপুর ও পূর্ব সিন্ধুতে ইসলাম প্রচারিত হয় হযরত সাইয়েদ জালাল বুখারীর (র) কল্যাণে। তাঁর উত্তর পুরুষ হযরম মাখছুম জাহনিয়াঁ (র) পাঞ্জাবের অনেকগুলো গোত্রকে ইসলামে দীক্ষিত করেন। অপর দুই বুজর্গ হযরত সাইয়েদ সদরুদ্দীন (র) এবং তাঁর পুত্র হযরত হাসান কবীরুদ্দীন (র)-ও পাঞ্জাবের খুব উঁচুদরের ইসলাম প্রচারক ছিলেন। হযরত হাসান কবীরুদ্দীন (র) সম্পর্কে ইতিহাসে লেখা আছে যে, তাঁর ব্যক্তিত্বে এক আশ্চর্য মোহিনী শক্তি ছিল। শুধু তাঁকে দেখলেই মানুষের মনে ইসলামের সত্যতা ও মহত্বের ছাপ পড়ে যেত এবং লোকেরা আপনা থেকৈই তাঁর চার পাশে ভীড় জমাতো।
সিন্ধুতে ইসলাম প্রচারের প্রকৃত যুগ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে ইসলামের পতনের পরের যুগ। এখন থেকে প্রায় ৬’শ বছর আগে হযরত সাইয়েধ ইউসুফুদ্দীন (র) সেখানে আগমন করেন এবং তাঁর কল্যাণে লোহানা সম্প্রদায়ের সাত’শ পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেন। কচ্ছ ও গুজরাটে হযরত ইমাম শাহ পিরানভী (র) ও মালিক আবদুল লতিফ (র)-এর চেষ্টায় ইসলাম প্রচারিত হয়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচার করেন হযরত শেখ শিহাবুদ্দীন সোহারাওয়ার্দী (র) মুরিদ শেখ জালালুদ্দীন ফারছী (র) যিনি শাহ জালাল (র) নামক একজন দরবেশ ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেন। তাঁর প্রভাবে স্বয়ং রাজা ইসলাম গ্রহণ করেন। ইতিহাসে এ রাজা সদরুদ্দীন নামে পরিচিত। এরপর হিজরী ৭ম শতকে সাইয়েদ আলী হামদানী (র) সাতশো শিষ্যসহ সেখানে আগমন করেন এবং সমগ্র কাশ্মীর ভূ-খণ্ডে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে সাইয়েদ শাহ ফরিদ উদ্দীন কায়িাবের রাজাকে ইসলামে দীক্ষিত করেন এবং তার সাহায্যে সমগ্র এলাকায় ইসলাম প্রচারিত হয়। দাক্ষিণাত্যে ইসলামের সূচনা হয় মহাবীর খামদায়েত থেকে –যিনি আজ থেকে সাতশ’ বছর আগে বিজাপুরে আগমন করেছিলেন। হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানীর (র) বংশধর অপর এক বুজর্গ কংকন এলাকায় ইসলামের বাণী প্রচার করেন। ধারওয়াড়ের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে ইবরাহীম আদিল শাহের পীর হযরত হাশেম গুজরাতী (র)-এর কাছ থেকে। নাছেক এলাকায় হযরত মোহাম্মদ ছাদেক ছারমাস্ত (র) ও খাজা আখ্ন্দে মীর হোসাইনীর (র) অবদান এখনো স্বীকার করা হয়ে থাকে। মাদ্রাজে যেসব বোজর্গ ইসলাম প্রচার করেন তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন হযরত সাইয়েধ নেছার শাহ (র), সাইয়েদ ইবরাহীম শহীদ (র) ও শাহ আল হামেদ (র)। নিউগাণ্ডায় ইসলাম প্রচার করেন হযরত বাবা ফখরুদ্দীন (র)। ইনি সেখানকার রাজাকে ইসলামে দীক্ষিত করেন।
হযরত সুফী সাহেবাদনের এসব প্রচার কার্যের ফল এই হয়েছে যে, হিন্দুদের একট বিরাট অংশ মুসলমান না হলেও মুসলিম পীর দরবেশদের ভক্ত। ১৮৯১ সালের আদম শুমারীতে বর্তমান ইউ পি রাজ্যের ২৩২৬৪৩ জন হিন্দু নিজেদেরকে কোনো দেবতার পূজারী নয় বরং কোনো না কোনো মুসলিম পীরের ভ্ক্ত বলে জাহির করে। পরিতাপের বিষয় যে, ঐসব পীর বুজর্গগণ হিন্দুদের একটি বিরাট অংশের ওপর ইসলামের প্রভাব রেখে গেলেও আমরা সেই প্রভাবকে কোনো কাজে লাগাতে পারিনি।
ভারতের বাইরে
ভারতের বাইরে কয়েকটি ভিন্ন দেশেও এ নেক বান্দাদের প্রচারমূলক তৎপরতা অপূর্ব ফল দর্শিয়েছে। বিশেষতঃ মধ্যযুগীয় ইতিসাহের এ ঘটনা অনস্বীকার্য যে, তাতারীদের আক্রমণে যখন ইসলামী সাম্রাজ্যের পতন হলো তখন সমগ্র মধ্য এশিয়ায় শুধুমাত্র সুফী সাধকগণের আধ্যাত্মিক শক্তিই তার মুকাবেলা করার জন্য অবশিষ্ট ছিল। শেষ পর্যন্ত এ শক্তিই ইসলামের এ বৃহত্তর দুশমনদের উপর জয় লাভ করে। তাতারীদের প্রবল প্রতাপ ইসলামের অগ্রগতি রোধ করতে ব্যর্থ হয়। এমনকি এ শক্তির হাতে তাতারীদের শক্তি সমগ্র মধ্য-এশিয়ার প্রায় চূড়ান্তভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার উপক্রম হয়। মুসলমানদের দুর্ভাগ্য যে, এ প্রচণ্ড শক্তি আজ একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। সত্যিব লতে কি, এটা অনৈসলামী সভ্যতার সামনে অনেকখানি পর্যুদস্তও হয়ে পড়েছে।
আফ্রিকায়
বর্তমান সময়ে এ শক্তি শুধুমাত্র আফ্রিকায় জীবন্ত রয়েছে। ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে এ দলের অপূর্ব সাফল্য আমাদের দেশের সুফীগণের জন্য পরম শিক্ষার বিষয়।
এ সুফি দলসমূহের মধ্যে একটি দল হলো “আমিরগনীল দল”। এর প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ওসমান আমিরগনী ১৮৩৫ থেকে ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব সুদানে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধির সহায়তা করেন এবং বহু মুশরিক গোত্রকে ইসলামে দীক্ষিত করেন।
অপর দলটি হলে কাদেরীয়া দল। পশ্চিম-আফ্রিকায় এ ছেলছেলার লোকেরা হিজরী নবম শতক থেকেই বিদ্যমান। ১৯শ শতকে তাদের মধ্যে এক নব জীবনের সঞ্চার হয় এবং তারা পশ্চিম সুদান থেকে শুরু করে টাম্বাকটো ও সেনেগাল পর্যন্ত সংগঠন গড়ে তোলেন ও অনেকগুলো মূর্তি পূজারী গোত্রকে ইসলামে দীক্ষিত করে। তাদের নিয়ম হলো, যখন কোনো জনপদে কিছু লোককে ইসলামে দীক্ষিত করে নেন তখন সেখানকার প্রতিভাবান ছেলেদেরকে নিজেদের কেন্দ্রীয় সংগঠনে ট্রেনিং-এর জন্য পাঠিয়ে দেন। আর তাদের মধ্যে অধিকতর যোগ্যতা অনুভূতি হলে তাদেরকে কিরোওয়ান, ফাস, ত্রিপোলী অথবা আল আজহারে পাঠিয়ে দেন এবং সেখান থেকে ফিরে আসার পর তাদেরই এলাকায় তাদেরকে প্রচার ও ট্রেনিং এর কাজে নিযুক্ত করেন। এছাড়া এ দলীট আফ্রিকার অভ্যন্তরে বহু সংখ্যক মাদ্রাসা কায়েম করে দেন এবং সেখানে সভ্যতার আলো থেকে বঞ্চিত গোত্রসমূহের বালকদের ইসলামী ট্রেনিং ও শিক্ষা দেয়া হয়।
“তিজানিয়া” নামে আর একটি ইসলাম প্রচাক গোষ্ঠী আফ্রিকায় সক্রিয় রয়েছে। এটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় আলজিরিয়ায়। কাদেরিয়া ছেলছলার মতই এদের প্রচার পদ্ধীত। পার্থক্য শুধু এই যে, এ দল প্রচার বা তাবলীগের সাথে জিহাদও করে থাকে। এ কারণে খৃষ্টান মিশনারীরা এর বিরুদ্ধে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণের অজুহাত পেয়ে যায়। এদের সাংগঠনিক এলাকা প্রধানতঃ উত্তর-আফ্রিকা এবং এর সবচেয়ে সক্রিয় আহবায়ক হচ্ছেন আলহাজ্জ ওমর। আলহাজ্জ ওমরের সততা ও ন্যায়পরায়ণতার খ্যাতি আফ্রিকা থেকে সউদী আরব পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইনি ১৯৩৩ সালে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন এবং নাইজেরিয়া ও সেনেগালের মোশরেক গোত্রসমূহকে ইসলামে দীক্ষিত করে এক বিশাল ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন। অবশেষে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ এ ইসলামী রাষ্ট্রটির পতন ঘটায়।
আফ্রিকার এসব ইসলাম প্রচারক সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিমান সংগঠন হচ্ছে সন্নৌসী দল। ১৮৩৩ সালে আলজিরিয়ার প্রখ্যাত আলেম জনাব মুহাম্মদ ইবনে আলী সন্নৌসী সন্নীসী সংগঠনের পত্তন করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের সংশোধন, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিরোধ ও ইসলামের প্রচার। মাত্র ২২ বছরে তিনি এমন শক্তিমান সংগঠন করলেন যার শৃঙ্খলা রাষ্ট্রীয় শৃংখার চেয়েও পূর্ণতর ছিল। এর প্রতিটি লোক সংগঠনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার স্বপ্নে বিভোর থাকতো, এর প্রতিটি সদস্যকে খালেছ ইসলামী প্রশিক্ষণ দিয়ে সাচ্চা মুসলমান বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। এতে পবিত্র কুরআনের শব্দে শব্দে অনুসরণ করা একটি অত্যাবশ্যকীয় পূর্ব শর্ত। এ সংগঠনে আউলিয়া পূজা, মাজার পূজা, কফি ও তামাক সেবন এবং ইহুদী ও খৃষ্টানদের সাথে সম্পর্ক রাখা নিষেধ। প্রতিটি ব্যক্তি একজন খাঁটি মুজাহিদের মত জীবন যাপন করে। মিশর থেকে নিয়ে মরক্কো পর্যন্ত এবং ত্রিপোলীর সমুদ্রতট থেকে শুরু করেন সাহারা মরুভূমির শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এর খানকাসমূহ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। আফ্রিকা ছাড়াও আরব, ইরাক ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত এর প্রভাব ছড়িয়ে রয়েছে।
আফ্রিকার যেসব গোত্রের লোকেরা নামমাত্র মুসলমান ছিল, সন্নৌসী দলেন কল্যাণে তারা খাঁটি মুসলমানে পরিণত হয়। এছাড়া আফ্রিকার কোণে কোণে তারা ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন। কাদেরিয়া ছেলছেলার লোকেরা যেমন শুধু ওয়াজ নছিহত করেই ক্ষান্ত হন না বরং মুসলমান বানানোর পর নও-মুসলিমদেরকে তাদের স্বগোত্রীয়দের মধ্যে ইসলাম প্রচারের প্রশিক্ষণও দেন তেমনি সন্নৌসী প্রচারকগণও প্রচার কার্যের সাথে সাথে প্রত্যেক নও-মুসলিমকে এক একজন মুবাল্লিগ রূপে গড়ে তোলেন।
আফ্রিকার এই ইসলাম প্রচারক দলসমূহ সেখানকার নিরক্ষর ও সব্যতা বিবর্জিত গোত্রসমূহের মধ্যে যে নবজীবনের সঞ্চার করেন সে সম্পর্কে জনৈক ইউরোপীয় পর্যটক লিখেছেনঃ
“নাইজেরিয়া নদীর কিনার দিয়ে যখন আমি মধ্য-আফ্রিকার দিকে রওনা হলাম, তখন প্রথম দু’শো মাইল পর্যন্ত আফ্রিকার উপজাতিগুলোর অসভ্যপনা, বর্বরতা ও নরখাদকতা সম্পর্কে আমার যে ধারণা ছিল তা বদলানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু আমি যখন মধ্য সুদানের নিকট পৌঁছুলাম তখন উপজাতীয় গোত্রগুলোর জীবনে আমি প্রগতির নিদর্শনাবলী দেখতে পেলাম, যা দেখে আমার ধারণা পাল্টে যেতে লাগলো। আমি দেখলাম, সেখানে মানুষ খাওয়ার প্রবণতা নেই, মুর্তিপূজারও অস্তিত্ব নেই, মদখোরী নেশাখোরীও বিলুপ্ত প্রায়। সকল গোত্রের লোকেরা কাপড় পরে। কাপড়-চোপড় পরিস্কার ও পবিত্র রাখে এবং আচার-আচরণে ভদ্রতা রক্ষা করে। দেখে স্পষ্টতই মনে হয়, তাদের নৈতিক মান তাদের সমপর্যায়ের অন্যান্য গোত্রসমূহের চেয়ে অনেক বেশী উন্নত। তাদের সবকিছুই প্রগতিশীল। নিগ্রো প্রকৃতি যেন কোনো উন্নততর প্রকৃতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে আর এসবই হচ্ছে ইসলামের কল্যাণে। ‘লোকোজা’ নামক জায়গাটা অতিক্রম করার পর আমি মূল ইসলামী প্রচার কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছুলাম এবং সেখানে এক অতি উচ্চাংগের শৃংখলাবদ্ধ প্রশাসন সক্রিয় দেখলাম। চারদিকের লোক বসতিতে সর্বত্র সভ্যতার নিদর্শন পরিস্ফুট। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও কারিগরির ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে এবং আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন একটি সুসভ্য দেশে এসে উপস্থিত হয়েছি”।