হযরত আবু বকর ইবন কুহাফা (রা.)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওফাতের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সমগ্র এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এলো। সাহাবা মণ্ডলী হতবাক হয়ে গেলেন, তাঁরা ধারণাই করতে পারছিলেন না যে, রাসুলুল্লাহ (সা) আর এ দুনিয়ায় নেই। এমনকি হযরত ওমর (রা.) পর্যন্ত তরবারি কোষমুক্ত করে ঘোষণা দিলেন, ‘যে বলবে রাসূলুল্লাহ (সা.) –এর ওফাত হয়েছে তাকে হত্যা করবো’। সবারই যখন অবস্থা এই তখন একজন মানুষই ছিলেন ধীর স্থির এবং অবিচল। তিনি হলেন রাসূল (সা)-এর প্রিয় বন্ধু, নিত্যদিনের সহচর হযরত আবূ বকর (রা)। হযরত ওমর (রা)-এর ঘোষণা শুনে আবু বকর (রা) এগিয়ে এলন এবং ঘোষণা দিলেন, ‘যারা মুহাম্মদের ইবাদত করতো তারা জেনে রাখো, মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু যারা আল্লাহর ইবাদত করো তারা জেনে রাখো আল্লাহ চিরঞ্জীব –তাঁর মৃত্যু নেই’। এরপর তিনি পবিত্র কালামে পাকের এ আয়াত পাঠ করে শুনালেন, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল ছাড়া আর কিছু নন। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন তাহলে তোমরা কি পেছনে ফিরে যাবে? যারা পেছনে ফিরে যাবে তারা আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। যারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, শিগগির আল্লাহ তাদের প্রতিদান দেবেন’ (আলে ইমরান-১৪৪ আ.)। হযরত আবু বকর (রা)-এর মুখ থেকে এ আয়াতে করিমা শুনার সাথে সাথে সবাই থমকে গেলেন। হযরত ওমর (রা) সহ সকল সাহাবা সম্বিত ফিরে পেলেন। বুঝতেই পারছো হযরত আবু বকর কোন প্রকৃতির ও কোন পর্যায়ের মানুষ ছিলেন। এখন আমরা তাঁর বিষয়ে জানার চেষ্টা্ করবো। যিনি আশারায়ে মোবাশশারার বা বেহেশতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রধান।
তোমরা অনেকেই হয়ত হযরত আবু বকর (রা)-এর আসল নাম জানোনা। তাঁর আসল নাম ছিলো আবদুল্লাহ। আর আবূ বকর হলো ডাক নাম। পরবর্তীকালে তিনি দু’টি সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত হন –সিদ্দিক ও আতীক। তাঁর আব্বার নাম ছিল উসমান এবং ডাক নাম ছিল আবু কূহাফা। তাঁর মাতার নাম ছিলো সালমা এবং ডাক নাম ছিলো উম্মুল খায়ের। তোমরা শুনলে আশ্চর্য হবে যে, তাঁরা সবাই ডাক নামেই বহুল পরিচিত হয়ে আছেন। ধরো হযরত আবু বকরের কথা –তাঁর আসল নাম যে আবদুল্লাহ তা আমরা কয় জনই বা জানি? তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে দু’বছরের ছোট ছিলেন অর্থাৎ তাঁর জন্ম সাল ৫৭২ খৃষ্টাব্দ।
তোমরা সকলেই জানো যে হযরত আবু বকরই পুরুষদের মধ্যে প্রথম মুসলমান হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তিনিই খোলাফায়ে রাশেদার প্রথম খলিফা। তিনিই সাহাবাদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তি। অর্থাৎ তিনিই সব ক্ষেত্রে প্রথম এবং প্রধান।
হযরত আবু বকরের ইসলাম গ্রহণের সাথে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িয়ে আছে। তিনি মুহাম্মদ (সা) আবাল্য সংগী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) যতগুলো বাণিজ্য সফরে গেছেন তার বেশীর ভাগ সফরে আবু বকরও (রা) সাথী ছিলেন। রাসূল (সা)-এর বয়স যখন ২০ বচর আর আবু বকর (রা)-এর ১৮ বছর তখন তাঁরা সিরিয়ায় বাণিজ্য সফরে যান। এই সফরকালে সিরিয়া সীমান্তে উপনীত হলে রাসূল (সা) একটি গাছের নীচে বিশ্রামের জন্য বসেন। সে সময়ে আবু বকর (রা) এলাকাটা দেখার জন্য এদিক ওদিক হাটাহাটি করতে থাকেন। এরই এক পর্যায়ে এক খৃষ্টান পাদ্রীর সাথে সাক্ষাৎ হয় তাঁর এবং ধর্মীয় কিছু আলাপ আলোচনা হয়। আলোচনা কালে পাদ্রী জানতে চান তার সঙ্গী যুবকটি কে। আবু বকর (রা) যুবক মুহাম্মদের (সা) পরিচয় দিলে পাদ্রী স্বগত বলে ওঠেন, ‘এ ব্যক্তি আরবদের নবী হবেন’। সেই যে কথাটি আবু বকর তাঁর অন্তরে গেঁথে নিলেন আর ভুলেননি। ফলে রাসূল (সা)-এর নবুয়াত প্রাপ্তির সাথে সাথে বিনা বাক্য ব্যয়ে তিনি ইসলাম কবূল করলেন। অবশ্য হযরত আবু বকর (রা) রাসূল ৯সা)-এর সব কথা বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করেছেন। এ জন্যই রাসূল (সা) তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন, ‘আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি’।
ধরা যাক মি’রাজের ঘটনা –সেখানেও তো আবূ বকর (রা) এক অবিশ্বাস্য নজীর স্থাপন করেছেন। যখন অবিশ্বাসীরা তো বটেই এমন কি সাহাবীরা পর্যন্ত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দোল খাচ্ছিলেন, পরবর্তীতে অনেক দুর্বল ঈমানের মুসলমানরা ইসলাম ত্যাগ করেছিল –সেই অস্থায়ও আবু বকর দ্বিধাহীন চিত্তে রাসূল (সা)-এর মি’রাজ কে সত্য বলে বিশ্বাস করেন। তোমাদেরকে বলে এখন ঠিক বুঝানো যাবে না যে, তখন অবস্থাটা কেমন ছিলো। একটু খুলে বলি –মি’রাজের কথা যখন রাসূল (সা) সবাইকে বললেন তখন, একটা হৈ হৈ পড়ে গেলো। একদল লোক এসে আবু বকর (রা) কে বললেন, ‘আবু বকর তোমার বন্ধুকে তুমি বিশ্বাস করো? তিনি বলছেন, তিনি নাকি গত রাতে বাইতুল মাকদাসে গেছেন, সেখানে তিনি নামায পড়েছেন, অতঃপর মক্কায় ফিরে এসেছেন’। উত্তরে আবূ বকর বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তিনি যদি এ কথা বলে থাকেন তাহলে সত্য কথাই বলেছেন। এতে অবাক হওয়ার কি দেখলে? তিনি তো আমাকে বলে থাকেন, তাঁর কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী আসে। আকাশ থেকে ওহী আসে। আকাশ থেকে ওহী আসে মাত্র এক মুহুর্তের মধ্যে। তাঁর সে কথাও আমি বিশ্বাস করি। তোমরা যে ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করছো এটা তার চেয়েও বিস্ময়কর’। এরপর তিনি সবাইকে নিয়ে রাসূল (সা)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা) আপনি কি গতরাতে বাইতুল মাকদাসে ভ্রমণ করেছেন, এ কথা বলেছেন?’ তিনি বললেন, হ্যাঁ। একথা আমি বলছি’ সংগে সংগে আবূ বকর (রা) বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল’। নবী (সা) বললেন, ‘হে আবু বকর, তুমি সিদ্দীক’। সেই থেকেই তিনি আবূ বকর সিদ্দীক নামে পরিচিত হলেন।
সাহাবীদের মধ্যে দানশীলতার ক্ষেত্রে হযরত আবূ বকরই (রা) ছিলেন সবার আগে। তিনি যখন ইসলাম কবূল করেন তখণ তাঁর হাতে চল্লিশ হাজার দিরহাম মওজুদ ছিলো। একবার ভেবে দেখো আজ থেকৈ দেড় হাজার বছর আগে চল্লিশ হাজার দিরহাম মানে এখনকার কতো টাকা। হযরত আবূ বকর আরবের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন। তাঁর পিতা আবূ কুহাফাও ছিলেন প্রভূত সম্পদের অধিকারী ব্যক্তি। এই ধনী পিতার ধনী সন্তান ইসলাম কবূলের পর তার সমস্ত অর্থ সম্পদ, আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেন। তিনি তাঁর গচ্ছিত নগদ অর্থ সম্পদ, আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেন। তিনি তাঁর গচ্ছিত নগদ অর্থ দিয়ে কুরায়শদের হাতে নির্যাতিত লাঞ্চিত দাস-দাসীদের মুক্ত করেন। তার অর্থেই বিলাল, আম্মার, খাব্বাব, সুহাইব প্রমুখ মুক্ত জীবনে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
তিনি দানশীলতার ক্ষেত্রে এতো অধিক অগ্রসর ছিলেন যে, তাবুক যুদ্ধের সময় রাসূল (সা)-এর আহবানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধের খরচের জন্য তাঁর বাড়িতে যা কিছু ছিলো নিয়ে আসেন। রাসূল (সা) অবস্থা বুঝে জিজ্ঞেস করেন, ‘বাড়িতে ছেলে মেয়েদের জন্য কিছু রেখে এসেছো কি? জবাবে আবূ বকর (রা) বললেন, ‘আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই তাদের জন্য যথেষ্ঠ’। এ জন্যই পরবর্তীকালে রাসূল (সা) তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন, ‘আমি প্রতিটি মানুষের ইহসান পরিশোধ করেছি। কিন্তু আবূ বকরের ইহসান এমন যে, তা পরিশোধ করতে আমি অক্ষম। তার প্রতিদান আল্লাহর দেবেন। তার অর্থ আমার উপকারে যেমন এসেছে, অন্য কারো অর্থ তেমন আসেনি’।
অপরের কাজ নিজ হাতে করে দেবার ক্ষেত্রেও আবূ বকর (রা) ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। হযরত আবূ বকরের খেলাফতকালে হযরত ওমর (রা) এক বৃদ্ধার কাজ করে দিতেন। কিন্তু একদিন কাজ করতে গিয়ে শুনলেন এক নেক্কার ব্যক্তি আগেই কাজগুলো করে গেছেন। ওমর (রা) অনেক চিন্তা করেও বের করতে পারলেন না কে এই ব্যক্তি। এরপর কয়েকদিন তিনি অতি ভোরে এসে দেখলেন পূর্বেই কাজগুলো সেই ব্যক্তি করে গেছেন। পরে তিনি জানলেন সেই ব্যক্তি আর কেউ নন, মুসলিম দুনিয়ার খলিফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কিশোর বয়স থেকে শুরু করে ওফাতের আগে পর্যন্ত যিনি সার্বক্ষণিক সহচর ছিলেন সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটির নামও আবূ বকর ইবনে কুহাফা (রা)। আমি আগেই তোমাদের বলেছি রাসূলের নবুয়াত প্রাপ্তির পরে তো কথায় নেই। তোমরা সকলেই হয়তো জানো যে হিযরতের সময় রাসূল (সা)-এর সংগী ছিলেন হযরত আবূ বকর (রা)। আর এ জন্য তিনি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। ঘটনাটি এমন হযরত মুহাম্মদ (সা) আবূ বকর (রা)-এর বাড়িতে এসে বললেন, ‘আল্লাহ আমাকে হিযরত করার অনুমতি দিয়েছেন’। আবূ বকর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি আপনার সংগী হতে পারবো’। রাসূল (সা) বললেন, ‘হ্যাঁ, পারবে’। রাসূল (সা)-এর হা বোধন জবাবে আবূ বকর (রা) আনন্দে কেঁদে ফেললেন। এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই দেখুন, আমি এই উট দুটো এই কাজের জন্যই প্রস্তুত রেখেছি’।
মক্কা বিজয়ের পর প্রথম যে হজ্জ উদযাপন করা হয় তাতে আবূ বকর (রা) কে রাসূল (সা) ‘আমীরুল হজজ্’ নিযুক্ত করেন। হিজরাতের পর তিনি সকল অভিযানেই অংশগ্রহণ করেন এবং তাবুক অভিযানে তিনি মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী ছিলেন।
রাসূল (সা)-এর ওফাতের পর সর্ব সম্মতিক্রমে আবূ বকর (রা) খলীফা নির্বাচিত হন। অবশ্য এর আগে, রাসূল (সা) যখন রোগ শয্যায় ছিলেন তখন রাসূলেরই নির্দেশে মসজিদে নব্বীর নামাযের ইমমতির দায়িত্ব পালন করেন। খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সমবেত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন তা চিরকাল শাসকদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে খলীফঅ নির্বাচিত করা হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি চাচ্ছিলাম, আপনাদের মধ্য থেকে অন্য কেউ এ দায়িত্ব গ্রহণ করুক। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আপনারা যদি চান আমার আচরণ রাসূলুল্লাহর (সা) আচরণের মত হোক, তাহলে আমাকে সেই পর্যায়ে পৌঁছার ব্যাপারে অক্ষম মনে করবেন। তিনি ছিলেন নবী। ভুলত্রুটি থেকে তিনি পবিত্র। তাঁর মতো আমার কোন বিশেষ মর্যাদা নেই। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আপনাদের কোন একজন সাধারণ ব্যক্তি থেকেও উত্তম হওয়ার দাবী আমি করতে পারিনে।……..
আপনারা যদি দেখেন আমি সঠিক কাজ করছি, আমার সহায়তা করবেন। যদি দেখেন আমি বিপদগামী হচ্ছি, আমাকে সতর্ক করে দেবেন’।
সত্যি তিনি ছিলেন এক মহান খলীফা ‘কথা ও কাজের মধ্যে তাঁর কোন পার্থক্য ছিল না। তিনি নিজেকে খলীফা না মনে করে মনে করতেন জনগণের সেবক। আবার তিনি ইসলামী হুকুম আহকাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। আব্বাস ও জুবইয়ান গোত্রদ্বয় যাকাত দিতে অস্বীকার করলে, তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘আল্লাহর কসম, রাসূলের (সা) যুগে উটের যে বাচ্চাটি যাকাত পাঠানো হতো এখন যদি কেউ তা দিতে অস্বীকার করে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো’। এই খলীফাতুল মুসলেমীদের খলীফা হিসাবে উপাধি ছিল –খলীফাতু রাসূলুল্লাহ। আর অন্য তিনজনের উপাধি ছিল আমিরুল মু’মেনীন।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, হযরত আবূ বকর (রা)-এর চরিত্র ছিলো কঠিন ও কোমলের সমন্বয়ে গঠিত। তাঁর জীবনে এমন এমন ঘটনা আছে যা আমাদের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয়। তোমরা বড় হলে তাঁর সম্বন্ধে আরো অনেক কিছু জানতে পারবে।
আবূ বকর (রা) ৭ই জমাদিউল আওয়াল, ১৩ হিজরীতের জ্বরে পড়েন এবং ১৫ দিন রোগ ভোগের পর ২১শে জমাদিউল আউয়াল, বয়স হয়েছিলো ৬৩ বছর। তিন মাস দশ দিন খিলাফতের পদে আসীন ছিলেন। রাসূল (সা)-এর পূর্ব পাশের তাঁর আবাল্য সহচর প্রিয় বন্ধু আবূ বকর (রা) কে দাফন করা হয়।
আমিরুল মুমেনীন হযরত ওমর (রা)
মুক্ত তরবারি হাতে ছুটে চলেছেন এক যুবক। মরুভূমির রুক্ষ্মতা তার চোখে মুখে। দেখলেই বোঝা যায় তিনি কাউকে খতম করতেই ছুটছেন। যুবকরে নাম ওমর। হাদীসে আনাস ইবন মালিক থেকে ঘটনাটি এ ভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে ওমর চলেছেন। পথে বনি যুহরার এক ব্যক্তির (মতান্তরে নাঈম ইবনে আবদুল্লাহ) সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন দিকে ওমর?’
ওমর বললেন, ‘মুহাম্মদের একটা দফারফা করতে’।
লোকটি বললেন, ‘মুহাম্মদের (সা) দফাফা করে বনি হাশিম ও বনি যাহরার হাত থেকে বাঁচবে কিভাবে?’
একথা শুনে ওমর বলে উঠলেন, ‘মনে হচ্ছে তুমিও পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মী হয়েছো?’
লোকটি বললেন, ‘ওমর, একটি বিস্ময়কর খবর শোনো, তোমার বোন-ভগ্নিপতি বিধর্মী হয়ে গেছে। তারা তোমার ধর্ম ত্যাগ করেছে’।
একথা শুনে রাগে উন্মত্ত হয়ে ওমর ছুটলেন তাঁর বোন ভগ্নিপতির বাড়ির দিকে। বাড়ির দরজায় ওমরের করাঘাত পড়লো। তাঁরা দু’জন তখন খাব্বাব ইবন আল-আরাত-এর কাছে কোরআন শিখছিলেন। ওমর আসার আভাস পেয়ে খাব্বাব বাড়ির অন্য একটি ঘরে আত্মগোপন করলেন।
ওমর বোন-ভগ্নিপতিকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের এখানে গুনগুন আওয়াজ শুনছিলাম, তা কিসের?’
তাঁরা তখন কোরআনের সূরা ত্বাহা পাঠ করছিলেন।
তাঁরা উত্তর দিলেন, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম’।
ওমর বললেন, ‘তোমার ধর্ম ছাড়া অন্য কোথাও যদি সত্য থাকে তুমি কি করবে ওমর?’
একথা শুনে ওমর তাঁর ভগ্নিপতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং দু’পায়ে ভীষণ ভাবে তাঁকে মাড়াতে লাগলেন। বোন তাঁর স্বামীকে বাঁচাতে এলে ওমর তাঁকে এমন মারা মার দিলেন যে, তাঁর মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেলো।
বোন রাগে উত্তেজিত হলে বললেন, ‘সত্য যদি তোমর দ্বীনের বাইরে অন্য কোথাও তাকে তাহলে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল’।
আসল নাম ‘ওমর, ডাক নাম আবূ হাফস। পরবর্তীকালে উপাধি পান ফারুক। তাঁর আব্বার নাম খাত্তাব এবং মায়ের নাম হানতামা। আব্বা আম্মা উভয়েই কুরাইশ বংশের লোক। আরো একটু খোলোসা করে বলি-হযরত ওমরের আম্মা কুরাইশ বংশের সেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি হিশাম ইবনে মুগীরার কন্যা। মানে হিশাম ইবনে মুগীরা ওমর (রা)-এর নানা আর তিনি হলেন দৌহিত্র। তোমরা শুনলে আরো আশ্চর্য হবে যে, ইসলামের অন্যতম প্রধান সেনাপতি খালিত বিন ওয়ালিদ হিশাম ইবন মুগীরারই পৌত্র অর্থাৎ কিনা ওমরের আপন মামাতো ভাই। অপরদিকে ওমরের আপন চাচাতো ভাই হলেন যায়িদ বিন নুফাইল। যিনি সৌভাগ্য ক্রমে রাসূল (সা)-এর আবির্ভাবের পূর্বেই নিজের বিচার বুদ্ধি গুণে মুর্তিপূজা ত্যাগ করেন এবং তাওহীদবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হন।
হযরত ওমরের (রা) বাল্য ও কৈশর সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে এতটুকু জানা যায় যে, তিনি মক্কার নিকটবর্তী ‘দাজনান’ নামক স্থানে তাঁর পিতার উট চরাতেন। অর্থাৎ রাখালের কাজ করতেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘এমন এক সময় ছিল যখন আমি পশমী জামা পরে এই মাঠে প্রখর রোদে খাত্তাবের উট চরাতাম। খাত্তাব ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও নীরস ব্যক্তি। ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিলে পিতার হাতে নির্মম ভাবে মার খেতাম। কিন্তু আজ আমার এমন দিন এসেছে যে, এক আল্লাহ ছাড়া আমার ওপর কর্তৃত্ব করার আর কেউ নেই’।
ওমর আরবের একজন শ্রেষ্ঠ কুস্তিগীর হিসাবে সুনাম কুড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। আরবের প্রথা অনুযায়ী তিনি নসব নামা বা বংশ তালিকা বিদ্যাও আয়ত্ব করেন। আর যুদ্ধ বিদ্যায় ছিলেন সুপণ্ডিত ব্যক্তি। অপর দিকে জাহিলী আরবের তিনি ছিলেন, এক বিখ্যাত ঘোড় সওয়ার। এ ব্যাপারে আল্লামা জাহিয বলেছেন, ‘ওমর ঘোড়ায় চড়লে মনে হতো ঘোড়ার চামড়ার সাথে তাঁর শরীর মিশে গেছে’। হযরত ওমরের ছিল অসাধারণ মনে রাখার ক্ষমতা। তৎকালীন সময়ের খ্যাতনামা সব কবিদের সব কবিতায় তার কণ্ঠস্থ ছিলো বলে জানা যায়। এ থেকে প্রমাণ হয় তিনি কতবড় কাব্য প্রেমিক ছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি একজন শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। জানা যায়, রাসূলে করীমের (সা) নবুয়াত প্রাপ্তির সময় গোটা কুরাইশ বংশে মাত্র, সতেরো জন লেখা পড়া জানতেন। তাদের মধ্যে ওমর একজন।
হযরত ওমরের (রা) ইসলাম গ্রহণের ঘটনা ছিল আকস্মিক ও অত্যন্ত হৃদয় গ্রাহী। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে তোমাদেরকে জানানোর জন্যই প্রথমেই ইসলাম ও মুহাম্মদদের বিরুদ্ধে ওমরের যে অভিযান ছিলো তা পেশ করেছি।
আসলে ওমর প্রকৃতিগত দিক থেকেই ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ। এজন্য তিনি যখন জানতে পারলেন বোন ফাতিমা, ভগ্নিপতি এবং চাচাতো ভাই যায়িদ, দাসী লাবীনা এমন কি তার বংশের বিশিষ্ট ব্যক্তি নাঈম ইবন আবদুল্লাহ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তখন তিনি স্বাভাবিক ভাবেই মাথা ঠিক রাখতে পারেননি। বোন ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের সংবাদে তাই ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদেরকে মারাত্মকভাবে আহত করতেও তার বাঁধেনি। কিন্তু আপন সহোদরার সমস্ত শরীর এবং মুখ যখন রক্তাক্ত দেখেছেন তখন আর নিজেকে জাহেলিয়াতের ওপর মজবুত রাখতে পারেননি। মুহুর্তের মধ্যে মন থেকে শিরকের সমস্ত কালিমা উবে গেলে তিনি সত্যের বর্ণালী আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন। সংগে সংগে সহোদরা ফাতিমার নিকট থেকে সূরা ‘তাহা’র লিখিত অংশটুকু নিয়ে পড়লেন, আর স্বগত বলে উঠলেন, ‘তোমরা আমাকে মুহাম্মদের (সা)-এর কাছে নিয়ে চলো’। তোমাদেরকে পূর্বেই বলেছি ওমরের আগমনে খাব্বাব (রা) গোপন স্থান থেকে বের হয়ে এলেন। তিনি বললেন, সুসংবাদ ওমর! বৃহস্পতিবার রাতে রাসূল (সা) তোমার জন্য দু’আ করেছিলেন। আমি আশা করি তা কবুল হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ, ওমর ইবনুল খাত্তাব অথবা আমর ইবন হিশামের দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী করো’।
হযরত খাব্বাবের (রা) নিকট থেকে ওমর জানলেন রাসূল (সা) এখন সাফার পাদদেশে দারুল আরকামে অবস্থান করছেন। অতএব আর ক্ষণকাল দেরী নয়, ওমর ছুটলেন, দারুল আরকামের দিকে।
দারুল আরকামে পাহারারত সাহাবীরা ওমর কে উন্মুক্ত তরবারী হাত ছুটে আসতে দেখে ভয় পেলেন। হযরত হামযা (রা) সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি সবাইকে অভয় দিয়ে বললেন, ওমর কল্যাণ চাইলে সে ইসলাম গ্রহণ করবে। অন্যথায় তাকে হত্যা করার আমাদের জন্য কঠিন হবে না।
এসময় রাসূল (সা) ভেতরে ছিলেন। তিনি বের হয়ে ওমরের কাছে এসে বললেন, ‘ওমর তুমি কি বিরত হবে না? তারপর দু’আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! ওমর আমার সামনে, হে আল্লাহ, ওমরের দ্বারা দ্বীনকে শক্তিশালী করো’।
ওমর বলে উঠলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল’। এরপর তিনি বললেন ‘হে আল্লাহর রাসূল, ঘর থেকে বের হয়ে পড়ুন’।
হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণ এতো বড় ঘটনা ছিলো যে, তাঁর ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে হযরত জিবরাইল (আ) নাযিল হয়ে বললেন, ‘মুহাম্মদ (সা), ওমরের ইসলাম গ্রহণে আসমানের অধিবাসীরা উৎফুল্ল হয়েছেন’। আর ইতোপূর্বে ইসলাম গ্রহণকারীরা তো খুশীতে ফেলে পড়লেন। কারণ তারা জানতেন, ওমরের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে ইসলামের ইতিহাস ভিন্ন দিকে মোড় নিলো। সত্যিই তাই –ওমর ইসলাম গ্রহণের পর পরই অন্য মুসলমানদেরকে নিয়ে কাবায় গিয়ে সালাত আদায় করলেন –যা ছিলো মুসলমানদের জন্য অভাবনীয় এবং বিস্ময়কর। কারণ ইতোপূর্বে ৪০/৫০ জন ইসলাম কবুল করলেও প্রকাশ্যে তাঁরা কাবাতে গিয়ে সালাত আদায় করার সাহস করেননি। ওমর এখানেই ক্ষ্যান্ত হলেন না। তিনি আল্লাহ, রাসূল ও ইসলামের প্রধান শত্রু আবু জেহেলের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি তার দরজায় করাঘাত করলাম। আবূ জেহেল বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি মনে করে?’ আমি বললাম, ‘আপনাকে একথা জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর আনীত বিধান বাণীকে মেনে নিয়েছি’। একথা শোনা মাত্র সে আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো এবং বললো, ‘আল্লাহ তোকে কলংকিত করুক এবং যে খবর নিয়ে তুই এসেছিস তাকেও কলংকিত করুক’।
বুঝতেই পারছো অবস্থা কি। মূলত এখান থেকেই ইসলাম ও কুফরের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয়। তারপর! তারপর তো কতো ঘটনা, কতো সংঘর্ষ-সংগ্রাম, কতো বিজয়। আর এজন্যই আল্লাহ রাসূল (সা) ওমর সম্পর্কে বলেছেন, ‘ওমরের জিহবা ও অন্তঃকরণে আল্লাহ তা’আলা সত্যকে স্থায়ী করে দিয়েছেন। তাই সে ‘ফারুক’। আল্লাহ তাঁর দ্বারা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে দিয়েছেন’।
হযরত ওমর (রা) সকল ক্ষেত্রেই প্রচণ্ড সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। হিজরতকারী সকল সাহাবীই যেখানে নিরবে হিজরত করতে হয়েছে, সেখানে হযরত ওমর (রা) প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে হিজরত করেছেন। ঘটনাটি এমন –তিনি প্রথমে কাবা তওয়াফ করে কুরাইশদের নিকট গিয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘আমি মদীনায় যাচ্ছি। কেউ যদি তার মাকে পুত্রশোক দিতে চায়, সে যেন এ উপত্যকার অপর প্রান্তে আমার মুখোমুখি হয়।
এই হচ্ছেন হযরত ওমর (রা)। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি রাসূল (সা) জীবিত থাকা পর্যন্ত রাসূল-এর জীবনে সংঘটিত প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি বদর থেকে শুরু করে ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত সকল যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেন। রাসূল (সা) ওফাতের পরপরই খেলাফত সংক্রান্ত জটিলতার সময় তিনি সবার আগে হযরত আবূ বকরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে –এ জটিল সমস্যার সহজ সমাধান করেন।
তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, ইসলামের ইতিহাসে ইসলাম বিরোধী শক্তির সাথে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ হলো বদরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সৈন্য পরিচালনা থেকে প্রায় সকল বিষয়েই ওমর (রা) রাসূল (সা) কে একজন প্রাজ্ঞ প্রবীণ ব্যক্তির মতো পরামর্শ দান করেন। এমন কি বন্দী বিনিময়ের ব্যাপারে তার পরামর্শই আল্লাহ রাব্বুল ইযযাতের পছন্দনীয় ছিলো। শুধু তাই নয় –এই যুদ্ধে তিনিই প্রথম শত্রু বাহিনীতে থাকার কারণে আপন মামা আ’মীর ইবনে হিশামকে নিজ হাতে হত্যা করেন। এর মাধ্যমে তিনি এ কথায় প্রমাণ করেন যে, সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরম আত্মীয়ও শত্রুতে পরিণত হতে পারে।
ওহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন, সবাই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছেন, কিছু সংখ্যক আহত সাহাবীসহ রাসূল (সা) এক পাহাড়ী গুহায় নিরাপদ মনে করে আশ্রয় নিয়েছেন, তখন আবূ সুফিয়ান উচ্চস্বরে বলতে লাগলো, মুহাম্মদ তুমি ও তোমার সাথীরা কোথায়? কেউ কি বেঁচে আছো? রাসূলের (সা) ইংগিতে কেহই সাড়া দিলেন না। উত্তর না পেয়ে আবু সুফিয়ান স্বগোক্তি করলো, ‘নিশ্চয় তারা সকলেই নিহত হয়েছে’।
এই উক্তি শোনার সাথে সাথে ওমর বলে উঠলেন, ‘ওরে আল্লাহর দুশমন! আমরা সবাই জীবিত’।
আবূ সুফিয়ান বললো, ‘উলু হুবলু-হুবলের জয় হোক’।
ওমর জবাব দিলেন, ‘আল্লাহ আ’লা ও আজাল্লু আল্লাহ-আল্লাহ মহান ও সম্মানী’।
দান দাক্ষিণ্যের ক্ষেত্রেও ওমর সম্মানিত হয়ে আছেন। মুসলমানরা যখন খাইবার জয় করলো, তখণ খাইবারের বিজিত ভূমি মুহাজিরদের মধ্যে বণ্টন করা হলো। হযরত ওমর তাঁর প্রাপ্য সমস্ত ভূমিই আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দিলেন। তোমরা শুনে খুশী হবে যে, ইসলামের ইতিহাসে এটাই প্রথম ওয়াকফ।
ওমর (রা) মুহাম্মদ (সা) কে এতো বেশী ভালোবাসতেন যে, তার ওফাতের সংবাদ শোনার সাথে সাথে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন এবং তরবারী কোশমুক্ত করে বলে উঠলেন, ‘যে ব্যক্তি বলবে রাসূলুল্লাহ (সা) ইনতিকাল করেছেন, আমি তার মাথা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলবো’।
ইসলামের প্রথম খলিফা আবূ বকর ইবন কুহাফার (রা) ইন্তেকালের আগেই হযরত ওমর সর্বসম্মতিক্রমে খলীফা নির্বাচিত হন। তাঁর শাসনকাল এখনো পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হিসাবে স্বীকৃত। ‘দশ বছরের স্বল্প সময়ে গোটা বাইজান্টাইন, রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান। তাঁর যুগে বিভিন্ন অঞ্চলসহ মোট ১০৩৬ টি শহর বিজিত হয়। ইসলামী হুকুমাতের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা মূলত তাঁর যুগেই হয়। সরকার বা রাষ্ট্রের সকল শাখা তাঁর যুগেই আত্ম প্রকাশ করে। তাঁর শাসন ও ইনসাফের কথা সারা বিশ্বে মানুষের কাছে কিংবদন্তীর মত ছড়িয়ে আছে’।
এই সেই শাসক যিনি তাঁর প্রজা সাধারণের অবস্থা দেখার জন্য অন্ধকার রাতে মহল্লায় মহল্লায় ছুটে বেড়াতেন। নিজে পিঠে করে খাদ্যের বস্তা অভূক্তদের বাড়িতে পৌঁছে দিতেন। দুধ বিক্রেতা সত্য বাদিনী যুবতীকে নিজের পুত্রবধু হিসাবে বরণ করে নিয়েছেন। খৃষ্টান শাসকের আমন্ত্রণে জেরুযালেম যাওয়ার সময় উঠের রাখালকে পর্যায়ক্রমে উটের পিঠে উঠিয়ে নিজের রাখাল হিসাবে উটের রশি টেনে নিয়ে এগিয়ে গেছেন। অর্ধ দুনিয়ার বাদশাহ হয়েও নিজের রুটি রুজির জন্য ব্যবসাপাতি করেছেন।
আমিরুল মুমেনীন উপাধিতে ভূষিত প্রথম খলীফা হলেন হযরত ওমর (রা)। আমরা এখন যে জামায়াতের সাথে তারাবীর নামায আদায় করি এটা তিনি প্রচলন করেন। হিজরী সন তাঁর আমল থেকেই গণনা শুরু হয়। তিনিই সেনাবাহিনীর ভেতর বিভিন্ন স্তরভেদ ও ব্যাটালিয়ন নির্দিষ্ট করেন। দেশের নাগরিক তালিকা তৈরী ও কারী নিয়োগ করেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলকে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য নানা প্রদেশে তিনিই বিভক্ত করেন।
হযরত ওমর (রা) ছিলেন অসম্ভব মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি। রাসূল (সা) নিজেই বলেছেন, ‘লাও কানা বা’দী নাবিয়্যুন লা কানা ওমর’, ‘আমার পরে কোন নবী হলে ওমরই হতো’। কি বলো এর পর কি আর কোন কথা থাকে? আসলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে ওমরের মর্যাদা ছিলো অতি উচ্চে। তোমরা শুনলে আনন্দিত হবে যে, ‘ওমরের সব মতের সমর্থনেই সর্বদা কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে।
তার ব্যাপারে হযরত আলী (রা) বলেছেন, ‘নবীর (সা) পর উম্মতের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যক্তি আবূ বকর তারপর ওমর (রা)’। আর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেছেন, ‘ওমরের ইসলাম গ্রহণ ইসলামের বিজয়। তাঁর হিজরত আল্লাহর সাহায্য এবং তাঁর খিলাফত আল্লাহর রহমত’।
ইন্তেকালের পূর্বে ওমর (রা) ছয়জন প্রখ্যাত সাহাবীর –হযরত আলী, ওসমান, আবদুর রহমা, সা’দ, যুবাইর ও তালহার (রা) ওপর পরবর্তী খলীফা খলীফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে যান। তাঁকে ৬৩ বছর বয়সে হিজরী ২৩ সনের ২৫ শে জিলহজ সোমবার আবূ লুলু ফিরোজ নামে মুগীরা ইবন শুবার (রা) অগ্নি উপাসক দাস ফজরের নামাযরত অবস্থায় ছুরিকাঘাত করে। দশ বছর ছয় মাস চার দিন খিলাফতের দায়িত্ব পালনের পর মুসলিম দুনিয়ার আমিরুল মুমেনীন আহতাবস্তায় ৩ দিনের দিন বুধবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নামাযে জানাজার পর হযরত আবূ বকরের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁল জানাযায় ইমামতি করেন হযরত সুহায়িব (রা)।
হযরত ওসমান ইবন আফফান (রা)
ওসমান ইবন আফফান (রা) পরবর্তীকালে ইসলামের তৃতীয় খলীফা। মূল নাম ওসমান। ডাক নাম বেশ কয়েকটি –আবূ আবদুল্লাহ, আবূ লায়লা, আবূ আমর ইত্যাদি। আব্বার নাম আফফান, মায়েল নাম আরওয়া বিনতু কুরাইশ। বংশের দিক থেকে কুরাইশ বংশের উমাইয়া শাখার লোক ছিলেন তিনি। তাঁর মা আরওয়া মহানবী (সা)-এর ফুফাতো বোন ছিলেন অর্থাৎ ওসমান ছিলেন মহানবী (সা)-এর ভাগিনা।
তিনি ৫৭৬ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ছ’বছর পরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর উপাধি ছিল, গণী, যুননূরাইন, আস সাবেকুনাল আওয়ালুন ও যুল হিজরাতাইন। তাঁর শিক্ষা জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে তিনি যে একজন শিক্ষিত মানুষ ছিলেন তা দিবালোকের মত পরিস্কার। ‘কাতিবে অহী’ অর্থাৎ অহী লেখক হযরত ওসমান তাঁর যুগের অন্যতম কুষ্ঠিবিদ্যা বিশারদ ছিলেন। তিনি কুরাইশদের প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে আদ্যপান্থ জ্ঞান রাখতেন। তিনি পণ্ডিত অথচ বিনয়ী ছিলেন। তাঁর সৌজন্য ও লৌকিকতা বোধের কথা কিংবদন্তী হয়ে আছে। তিনি অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের মানুষ ছিলেন। সাথে সাথে ছিলো তাঁর প্রখর আত্মমর্যাদা বোদ। যৌবনে হযরত ওসমান (রা) অন্যান্য কুরাইশদের মত ব্যবসা শুরু করেন। সততা, নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার গুণে তিনি ব্যবসায় অসম্ভব সাফল্য অর্জন করেন। এমনকি অতি অল্প কালের মধ্যেই প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হওয়ার কারণে তিনি গণী উপাধিতে ভূষিত হন। রাসূলের (সা) নবুয়াত প্রাপ্তির প্রাথমিক পর্যায়ে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন হযরত ওসমান (রা) তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি ইসলাম গ্রহণকারী চারজনের মধ্যে চতুর্থ’।
খোঁজ খবর দিয়ে যতদূর জানা যায় হযরত আবূ বকর, আলী ও যায়িদ ইবনে হারিসের পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এজন্য হযরত ওসমানকে আস সাবেকুনাল আওয়ালুন বা প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী বলা হয়। আর রাসূল (সা) যে ছ’জন প্রধানত সাহাবীর প্রতি আমৃত্যু খুশী ছিলেন, তিনি তাঁদের মধ্যে একজন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন ‘আশরায়ে মুবাশশারা’র অন্তর্গত। হযরত ওসমান (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে নানা কথা শোনা যায়। কেউ কেউ বলেন, তাঁর খালা সু’দা ঐ যুগের একজন বিশিষ্ট ‘মাহিন’ বা ভবিষ্যদ্বক্তা ছিলেন। তিনি ওসমানকে মহানবী সম্বন্ধে আগাম কিছু কতা বলেন এবং তাঁর অনুরক্ত হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। এই খালার উৎসাহতেই তিনি ইসলাম কবুল করেন। অন্য মতে ওসমান যখন সিরিয়া সফরে যান সে সময়ে তিনি ‘মুয়ান ও যারকার’ মধ্যবর্তী জায়গায় বিশ্রাম করছিলেন, এক পর্যায়ে তাঁর তন্দ্রা আসলে তিনি শুনতে পান, ‘ওহে ঘুমন্ত ব্যক্তিরা, তাড়াতাড়ি কর। আহমদ নামের রাসূল মক্কায় আত্মপ্রকাশ করেছেন’। মক্কায় ফিরে তিনি খোঁজ নিয়ে জানলেন ঘটনা সত্য। এরপর তিনি প্রিয় বন্ধু আবূ বকর সিদ্দিকের আহবানে ইসলাম কবুল করেন। ইসলাম কবূলের পর ওসমানে স্বাগত জানিয়ে তার খালা সু’দা একটি কাসীদা লিখেন।
ওসমানের ভাই-বোনসহ পরিবারের সবাই ইসলাম কবুল করেছিলেন। তাঁর বোন উম্মে কুলসুম সেই সৌভাগ্যবত কুরাইশ বধু যিনি প্রথম রাসূল (সা) এর হাতে বাইয়াত হন। ওসমান ইবনে আফফান ছিলেন একজন ধনকুবের ও অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর ওপরও নেমে আস অকথ্য নির্যাতন। তাঁরই চাচা হাকাম ইব নআবিল ‘আস’ ইসলাম গ্রহণের কারণে তাকে বেঁধে পিটাতো আর বলতো, ‘এ নতুন ধর্মগ্রহণ করে তুমি আমাদের বাপ-দাদার মুখে কালি দিয়েছো। এ ধর্ম ত্যাগ না করা পর্যন্ত তোমাকে ছাড়া হবে না’। কিন্তু সত্যের সাধক, মর্দে মূমীন ওসমান (রা) এ সময় অবিচল থেকেছেন এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের যা ইচ্ছে করতে পার, আমি এ দ্বীন কখনো ছাড়বো না’। ইসলাম গ্রহণের পর নবী নন্দিনী রুকাইয়াকে বিয়ে করেন। হিজরী দ্বিতীয় সনে রুকাইয়া ইন্তেকাল করেন। রাসূল (সা) ওসমানের ওপর এতো বেশী খুশী ছিলেন যে রুকাইয়ার ইন্তেকালের পর তিনি অপর কন্যা উম্মে কুলসুমকে ওসমানের সাথে বিবাহ দেন। এ জন্যই তাঁর উপাধি ‘যুননুরাইন’ অর্থাৎ দুই জ্যোতির অধিকারী। উম্মে কুলসুম হিজরী ৯ সনে নিঃসন্তান অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। কুলসুমের মৃত্যুর পর রাসূল (সা) বলেন, ‘আমার যদি তৃতীয় কোন মেয়ে থাকতো তাকেও আমি ওসমানের সাথে বিয়ে দিতাম’। রুকাইয়ার সাথে ওসমানের দাম্পত্য জীবন ছিল খুব মধুর। ওসমান যখন অন্যান্য মুসলমানদের সাথে হাবসায় হিজরত করেন তখন রুকাইয়া তাঁর সাথে ছিলেন। হযরত ওসমান (রা) সেই ব্যক্তি যিনি মদীনায়ও হিজরত করেন। এ জন্যই তাঁকে ‘যুল হিজরাতাইন’ অর্থাৎ দুই হিজরতের অধিকারী বলা হয়। হযরত ওসমান নরম দিলের মানুষ ছিলেন কিন্তু অপর দিকে ছিলেন সাহসী যোদ্ধা। তিনি একমাত্র বদর ছাড়া অপর সকল যুদ্ধেই অংশ গ্রহণ করেছিলেন। বদর যুদ্ধে না যাওয়ার কারণ ছিল বদরের যুদ্ধে যাওয়ার সময়ে ওসমানের স্ত্রী নবী দুহিতা হযরত রুকাইয়া ছিলেন দারুণভাবে অসুস্থ। যে জন্যে রাসূল (সা) তাঁকে যুদ্ধে যেতে নিষেধ করেন। ঘটনাক্রমে যেদিন বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের সংবাদ মদীনায় পৌঁছায় ঐ দিনই রুকাইয়া ইন্তেকাল করেন। রুতাইয়ার একজন পুত্র সন্তান ছিল নাম আবদুল্লাহ। এ কারণেই ওসমানের ডাক নাম হয় আবূ আবদুল্লাহ। কিন্তু আবদুল্লাহ হিজরী ৪ সালে মারা যান। দান দক্ষিণার ক্ষেত্রে ওসমানের ভূমিকা কিংবদন্তির মত সারা বিশ্বে মশহুর হয়ে আছে। আল্লাহ যেমন তাঁকে প্রভূত সম্পদ দান করেছিলেন তেমনি তাঁর দিলও করেছিলেন বড়। যতদূর জানা যায় ঐ সময়ে আরবে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ ধনী। কিন্তু তিনি তাঁর ধন সম্পদকে কুক্ষিগত করে রাখেননি। ইসলাম গ্রহণের পরে তাঁর সম্পদ মুসলমানদের কল্যাণে বিলিয়ে দেন। তাবুক যুদ্ধের খরচের জন্য সাহাবীরা অত্যন্ত খোলা মনে যুদ্ধফাণ্ডে অকাতরে সাহায্য করলেন। এ সময়ে হযরত ওমর তাঁর সম্পদের অর্ধেক এনে রাসূল (সা)-এর হাতে তুলে দিলেন। হযরত আবূ বকর দিলেন তার সমস্ত অর্থ। আর হযরত ওসমান পুরা যুদ্ধের এক তৃতীয়াংশের ব্যয়ভার বহন করণের। এ যুদ্ধে তিনি সাড়ে নয় শো উট, পঞ্চাশটি ঘোড়া ও এক হাজার দিনার দান করেন। সেদিন ওসমানের দানে রাসূল (সা) এতো খুশী হয়েছিলেন যে দিনার গুলো নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি বলেন ‘আজ থেকে ওসমান যা কিছুই করবে, কোন কিছুই তার জন্য ক্ষতিকর হবে না’। একটি বর্ণনায় আছে, ‘তাবুকের যুদ্ধে তাঁর দানে সন্তুষ্ট হয়ে রাসূল (সা) তাঁর আগে পিছের সকল গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করেন এবং তাঁকে জান্নাতের ওয়াদা করেন’।
মুধু তাবুক যুদ্ধেই নয় অন্যান্য যুদ্ধের প্রস্তুতি লগ্নেও তিনি মন খুলে দান করতেন।
তোমরা নিশ্চয় হুদাইবিয়ার সন্ধির কথা শুনেছো। এই সন্ধি হবার আগে হযরত ওসমানকে নিয়ে দারুণ আবেগময় একটা ঘটনা ঘটেছিলো। রাসূল (সা) সাহাবা কেরামসহ হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মক্কার অদূরে হুদাইবিয়া নামক স্থানে তাবু গাড়েন। পরে মক্কার নেতৃবৃন্দকে অবহিত করার জন্য হযরত ওসমানকে এ খবর দিয়ে পাঠালেন যে, আমরা যুদ্ধ নয়, বরং বাইতুল্লাহর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে এসেছি’।
ওসমান (রা) রাসূল (সা) এর বার্তা নিয়ে মক্কায় পৌঁছলে আরব নেতৃবৃন্দ তাঁকে তওয়াফ করার অনুমতি দেন। কিন্তু তিনি তা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল (সা) যতক্ষণ তওয়াফ না করেন ততক্ষণ আমি তওয়াফ করতে পারিনা’। তাঁর স্পষ্ট কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে বেঈমান কাফেররা তাঁকে তিনদিন আটকে রাখে। কিন্তু ঘটনাক্রমে হুদাইবিয়ার মুসলিম শিবিরে এ গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, মক্কার কাফেররা ওসমান (রা) কে শহীদ করেছে। এ সংবাদ শোনার সাথে সাথে রাসূল (সা) ঘোসনা করলেন, ‘ওসমানের রক্তের বদলা না নিয়ে আমরা প্রত্যাবর্তন করবো না। রাসূল (সা) তাঁর ডান হাত বাম হাতের ওপর রেখে বলেন, ‘হে আল্লাহ। এ বাইয়াত ওসমানের পক্ষ থেকে। সে তোমার ও তোমার রাসূলের কাজে মক্কায় গেছে’। মক্কা থেকে ফিরে এসে বাইয়াতে রিদওয়ান ইত্যাদি নামে পরিচিত। তোমার শুনলে খুশী হবে যে, পবিত্র কোরআনে এ বাইয়াতের প্রশংসা করে আয়াত নাযিল হয়’।
ওসমান (রা) অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ ছিলেন। তিনি সব কিছুকেই স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করতে পারতেন। রাসূল (সা) ওয়াতের পর পরই খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে যখণ তিনি শুনলেন আবূ বকরের হাতে বাইয়াত নেয়া হচ্ছে তখন তিনি দ্রুত সেখানে যান ও বিনা বাক্য ব্যয়ে আবূ বকরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। হযরত ওমরের (রা) হাতে তিনিই প্রথম বাইয়াত হন। পরে তাঁর দেখাদেখি অন্যান্যরাও বাইয়াত গ্রহণ করেন। আনন্দের ব্যাপার হলো ওমর (রা) কে খলীফা মনোনীত করে হযরত আবূ বকর (রা) যে অঙ্গীকার পত্রটি লিখে যান তার লেখক ছিলেন স্বয়ং ওসমান (রা)।
হযরত ওমর (রা) কাউকে খলীফা হিসাবে মনোনয়ন দিয়ে যাননি। তিনি আলী, ওসমান, আবদুর রহমান, সা’দ, যুবাইর ও তালহা এই ছয়জনের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচন করার পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করেন তাঁর মৃত্যুর তিন দিন তিন রাত্রি পর। হযরত ওমর (রা) যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন তালহা মদীনায় ছিলেন না। তাই ওপরের বাকী পাঁচজন হরযত আয়েশা (রা)-এর হুজরায় একত্রিত হলেন, এ সময় তাঁদের সাথে ছিলেন হযরত ওমরের (রা) পুত্র আবদুল্লাহ (রা)। খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে যাঁকে ওমর (রা) সহযোগিতা করতে বলেছিলেন। অনেক আলাপ আলোচনার পর উক্ত ছয়জন হযরত আবদুর রহমানকে শালিশ নির্বাচন করেন, অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব দেন।
হযরত আবদুর রহমান বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম, সেনা কর্মকর্তা, বিশিষ্ট নাগরিকসহ সর্বস্তরের প্রতিনিধি স্থানীয় মানুষ জনের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। এরপর ১লা মুহাররম ২৪ হিজরীতে মসজিদে নববীতে প্রচুর লোকের সামনে খলীফা হিসাবে ওসমান ইবনে আফফান (রা)-এর নাম ঘোষণা করেন। সংগে সংগে উপস্থিত জনতা ওসমান (রা)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।
খিলাফতের দায়িত্ব ওসমান (রা) যথাযথ দায়িত্বশীলতার সাথে পালন করেন। তিনি সর্বমোট প্রায় বার বছর এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তাঁর দায়িত্ব প্রাপ্তির প্রথম ছয় বছর দেশে শান্তি শৃংখলা বিরাজিত ছিল কিন্তু দ্বিতীয় ছয় বছরে তাঁর বিরুদ্ধে নানা রকম কথা ওঠে। এখানে তোমাদের একটা কথা জেনে রাখা দরকার যে, এ সময়ে খলীফা শাসিত অঞ্চলে যথেষ্ঠ ইয়াহুদি খৃষ্টান বাস করতো। মুসলমানদের শাসনে থাকার কারণে তারা প্রথম দিকে চুপচাপ ছিল ঠিকই কিন্তু যতই দিন যেতে লাগলো ততই এসব পরাজিত শক্তি মাথা চাড়া দিতে লাগলো। মূলত এরাই হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে নানা রকম মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলো। দুর্বল ঈমানের মুসলমানরাও এ সমস্ত চক্রান্ত কারীদের ফাঁদে সহজেই পা দিলো। ফলে খুব দ্রুত অবস্থার অবনতি হলো। বিদ্রোহীরা খলীফার বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে রোজাদার খলীফাকে কোরআন তেলাওয়াত রত অবস্থায় হত্যা করলো। ঘটনাটি ঘটে হিজরী ৩৫ সনের ১৮ই জিলহজ্জ শুক্রবার বাদ আসর। মাগরিব ও এশার মাঝামাঝি সময়ে যুবাইর ইবন মুতঈম (রা)-এর ইমামতিতে জান্নাতুল বাকরীর হাশশে কাওয়ার নামক অংশে ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রা) কে দাফন করা হয়। তাঁর শাহাদাতের সময় মুসলিম বিশ্বের বিস্তৃতি ছিলো কাবুল থেকে মরক্কো পর্যন্ত।
তোমরা হয়ত ভাবছো এতো বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক অথচ গুটিকতক বিভ্রান্ত লোকের হাতে শহীদ হলেন? ইচ্ছে করলে তিনি বিদ্রোহীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারতেন কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং নরম মনের মানুষ। তিনি নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য রক্তপাতকে পছন্দ করেন নি। তাছাড়া এ বিদ্রোহীদের মধ্যে মুসলমানরাও রয়েছে। তাই নিজের জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন, খলীফার জীবনের চেয়ে সম্প্রীতি রক্ষা করা বড়।
তোমরা শুনলে অত্যন্ত আনন্দিত হবে যে, ওসমান (রা) মহানবী (সা)-এর একান্ত প্রিয় ভাজন ছিলেন। রাসূল (সা) নিজেই বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীরই বন্ধু থাকে; জান্নাতে আমার বন্ধু হবে ওসমান’।