হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা)
নাম আবদু আমর বা আবদু কা’বা। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল (সা) তাঁর নতুন নামকরণ করেন আবদুর রহমান। ডাক নাম আবূ মুহাম্মদ। আব্বার নাম আওফ এবং মার নাম শেফা। আব্বা মা উভয়েই যোহরী গোত্রের লোক ছিলেন। তাঁর দাদা ও নানা উভয়েরই নাম ছিল আওফ। তাঁর বংশ তালিকা নিম্নরূপ –আবদুর রহমান ইবন আওফ, ইবন আবদু আওফ, ইবন আবদ, ইবনুল হারেস, ইবন যোহারা, ইবন কেলাব, ইবন মুরারা আল কারশী আযযোহরী।
জানা যায় তিনি আমূল ফীল বা হস্তী বছরের দশ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। এ হিসাবে আবদুর রহমান রাসূল (সা)-এর দশ বছরের ছোট ছিলেন। কারণ রাসূল (সা) আমূল ফীলের ঘটনার পঞ্চাশ দিন পর জন্মগ্রহণ করেন। আর রাসূল (সা) যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন তখন তাঁর বয়স ত্রিশ বছরের কিছু বেশী ছিলো।
মক্কার বিশিষ্ট কিছু লোক নিয়মিত হযরত আবূ বকর (রা)-এর বাড়িতে মিলিত হয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। হযরত আবদুর রহমান ছিলেন তাদেরই একজন। এখান থেকেই হযরত আবূ বকরের দাওয়াতে তিনি রাসূল (সা)-এর খেদমতে হাজির হন এবং ইসলাম কবূল করেন। এ সময় রাসূল (সা) আরকাম ইবন আবূ আরকামের ঘরে অবস্থান করছিলেন। আবদুর রহমান সেই সৌভাগ্যবানদেরই একন যাঁরা প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হযরত আবূ বকরের বাড়িতে যাঁরা নিয়মিত মিলিত হতেন ইতিহাসে তাদের পাঁচ জনের নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন, হযরত ওসমান (রা), হযরত সা’দ (রা), হযরত তালহা (রা), হযরত যুবাইর (রা) ও হযরত আবদুর রহমান (রা)। আনন্দের খবর হলো এ পাঁচ জনই আবূ বকর (রা)-এর প্রথম দাওয়াতে প্রথম পর্যায়ে ইসলাম কবূল করেন এবং দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত হন।
নবুওয়াতের প্রথম পর্বে যাঁরা ইসলাম কবূল করেছিলেন তাঁদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন নেমে আসলে নবুওয়াতের পঞ্চম বছরে এগারোজন পুরুষ ও চারজন মহিলা মক্কা থেকে হাবশায় হিজরত করেন। ইসলামের ইতিহাসে হিজরত কারী এ প্রথম কাফিলাটিতে হযরত আবদুর রহমান (রা) ছিলেন। পরে রাসূল (সা) যখন মদীনায় হিজরত করেন তখন আবদুর রহমানও মদীনায় হিজরত করেন। এজন্য তাঁকে সাহিবুল হিজরাতাইন’ বা দু’হিজরতের অধিকারী বলা হয়। মদীনায় হিজরতের পর রাসূল (সা) হযরত আবদুর রহমানের সাথে হযরত সা’দ ইবনুর রাবী (রা)-এর ভাই সম্পর্ক পাতিয়ে দেন। এরপর একটি শিক্ষণীয় ঘটনা ঘটে –সা’দ (রা) আবদুর রহমান (রা) কে বললেন, আনসারদের সকলে জানে আমি একজন ধণ্যাঢ্য ব্যক্তি। আমি আমার সকল সম্পদ সমান দু’ভাগে ভাগ করে দিতে চাই। আমার দু’জন স্ত্রীও আছেন। আমি চাই আপনি তাদের দু’জনকে দেখে একজনকে পছন্দ করুন। আমি তাকে তালাক দেবো। তারপর আপনি তাকে বিয়ে করে নেবেন। উত্তরে আবদুর রহমান বললেন, ‘আল্লাহ আপনার পরিজনের মধ্যে বরকত ও কল্যাণ দান করুন। ভাই, এসব কোনো কিছুর প্রয়োজন আমার নেই। আমাকে শুধু বাজারের পথটি দেখিয়ে দিন’। হযরত আবদুর রহমানকে নিকটস্থ কাইনুকা বাজারে পৌছে দিলে ঐ দিনই তিনি ঘি ও পণীরের ব্যবসা শুরু করেন এবং কিছুটা লাভবান হন। পরদিন থেকে তিনি রীতিমত ব্যবসা শুরু করেন।
তোমরা নিশ্চয়ই হযরত সাদ (রা) ইসলামী ভ্রাতৃত্বের যে মর্যাদা দিয়েছে তাতে মুগ্ধ হয়েছো। অপরদিকে হযরত আবদুর রহমানও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা অনুসরণ যোগ্য। আসলে ইসলামের শিক্ষায় এমন।
ব্যবসা শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই হযরত আবদুর রহমানের হাতে বেশ পয়সা জমা হয়। তখন তিনি এক আনসারী মহিলাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরপরই তিনি একদিন রাসূল (সা)-এর দরবারে হাজির হন তখন তাঁর কাপড়ে হলুদের দাগ ছিলো। তা দেখে রাসূল (সা) বললেন, ‘মোহর কত নির্ধারণ করেছো?’ তিনি বললেন, ‘খেজুরের একটি দানা পরিমাণ সোনা’। এরপর রাসূল (সা) বললেন, ‘তা হলে ওলীমার ব্যবস্থা করো। বেশী না হয় অন্তত একটা ছাগল দিয়ে হোক’।
পরবর্তীতে তাঁর হাতে যখন ব্যবসা থেকে আরো কিছু নগদ টাকা আসে তখন তিনি ওলীমার ব্যবস্থা করেন। তিনি ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে দ্রুত সাফল্য লাভ করতে থাকেন। এসময়ে উমাইয়া ইবন খালফ নামক মক্কার এক ব্যক্তির সাথে তিনি একটি ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদন করেন।
হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হযরত আবদুর রহমান বদর সহ প্রায় সকল যুদ্ধেই অংশ গ্রহণ করেন এবং সকল যুদ্ধেই তিনি একজন দুঃসাহসিক যোদ্ধা হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হন। বদরের যুদ্ধ চলাকালে হযরত আবদুর রহমান হঠাৎ করে নিজেকে দু’জন কিশোরের ভেতরে দেখতে পান। তিনি এসময় নিজেকে কিছুটা অসহায় মনে করছিলেন, এমন সময় তাদের একজন এসে তাকে আবূ জেহেল কোন দিকে? জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাতিজা, তাকে খুঁজছো কেনো?’ ছেলেটি বললো, ‘আমি আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছি, হয় তাকে কতল করবো, না হয় এজন্য জীবন দেবো’। অন্যজনও একই কথা জানালো। এরপর আবদুর রহমান (রা) বলেন, ‘তাদের কথা শোনার পর আমি খুশি হলাম। ভাবলাম কতো মহৎ দু’জন কিশোরের মাঝখানেই না দাঁড়িয়ে আছি। ইশারা করে আমি আবূ জেহেলকে দেখানো মাত্র দু’জন কিশোর তরবারি উন্মুক্ত করে বাজপাখির মতো আবূ জেহেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তাঁকে ধরাশায়ী করে হত্যা করেন’। এ দু’জন কিশোর কারা ছিলেন জানো? এরা ছিলেন আফরার দু’পুত্র হযরত মুয়ায (রা) ও হযরত মায়ায (রা)। ইসলাম ও মুসলমানদের সব থেকে বড় শত্রু আবূ জেহেলকে হত্যা করে এঁরা ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। ওহুদের যুদ্ধে হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফের ভূমিকা ছিলো চোখে পড়ার মতো। উবাই ইবন খালফ নামক এক নরাধম রাসূল (সা) কে হত্যা করার জন্য এগিয়ে এলে আবদুর রহমান তাকে কতল করার জন্য এগিয়ে যান কিন্তু রসূল (সা) আবদুর রহমানকে থামিয়ে দেন। পরে রাসূল (সা) নিজেই হারিসের বর্শাটি নিয়ে উবাই ইবন খালফ কে লক্ষ্য করে সেটি ছুড়ে দেন। এতে উবাই আহত হয়ে চেচাতে পালিয়ে যায় এবং সারফ নামক স্থানে মারা যায়। এ যুদ্ধে আবদুর রহমান মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁর সারা দেহে একত্রিশটি আঘাত পান। সবচেয়ে পায়ের আঘাত ছিল মারাত্মক। যার জন্য সুস্থ হওয়ার পর তিনি খোঁড়া হয়ে যান। মানে পরবর্তী জীবন থেকে তিনি খোঁড়ায়ে হেটেছেন।
মদীনা থেকে প্রায় তিনশো মাইল দূরে দুমাতুল জান্দালে ‘ষাট হিজরী সনে রাসূল (সা) হযরত আবদুর রহমানের নেতৃত্বে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। অভিযানে রওয়ানা হওয়ার আগে আবদুর রহমান রাসূল (সা)-এর নিকট এলে তিনি আবদুর রহমানের মাথায় পাগড়িটি নিজ হাতে খুলে রেখে দিলেন। এরপর ইসলামী পতাকা তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘বিসমিল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় রওয়ানা হও। যারা আল্লাহর নাফরমানী করে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করো। কিন্তু কাউকে ধোকা দিও না, ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে মেরো না। এমন কি দুমাতুল জান্দাল পৌঁছে কলব গোত্রের লোকজনকেই প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করে, তা’হলে তাদের রাজ কন্যাকে বিয়ে করবে। অন্যথায় যুদ্ধ করবে’।
জানা যায় হযরত আবদুর রহমান সেখানে পৌঁছানোর পর একাধারে তিন দিন তাবলীগের কাজ করারপর কলবগোত্রের সরদার আসবাগ ইবন আমর আল কলবী তার বিপুল সংখ্যক সংগী সাথীসহ ইসলাম কবূল করেন। পরে তিনি ঐ সর্দারের কন্যা তামজুরকে বিয়ে করেন। এই তামজুরের গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন হযরত আবূ সালমা ইবন আবদুর রহমান (রা)।
মক্কা অভিযান কালে রাসূল (সা) যে ছোট্ট কাফেলাটির সাথে ছিলেন, হযরত আবদুর রহমানও (রা) সে দলে ছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর বানূ খুজাইম গোত্রের লোকজনের কাছে দাওয়াতী কাজের জন্য হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদকে পাঠালে বানূ খুজাইমা ও খালিদের সাথে ভুলবুঝাবুঝি হয় এবং এক পর্যায়ে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে বানূ খুজাইমার বেশ কিছু লোক নিহত হয়।
বানূ খুজাইমার এ দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে খালিদ ও আবদুরর রহমানের মধ্যে বচসা হয়। এ সংবাদে রাসূল (সা) খালিদ ইবন ওয়ালিদকে ডেকে বলেন, ‘তুমি সাবোনে আওয়ারীন (প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী) একজন সাহাবীর সাথে ঝগড়া ও তর্ক করেছো। এমনটি করা তোমার শোভন হয়নি। আল্লাহর কসম, যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনার মালিকও তুমি হও এবং সার সবই আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দাও তবুও তুমি আমার সে সব প্রবীণ সাহাবীর একজনেরও সমকক্ষ হতে পারবে না’। বুঝতেই পারছো হযরত আবদুর রহমান কোন পর্যায়ে মানুষ ছিলেন।
তাবূক অভিযানকালে মুসলমানরা ঈমানী পরীক্ষার সম্মুখীন হন। আবদুর রহমান এ পরীক্ষায় অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে উত্তীর্ণ হন। এ যুদ্ধের খরচ বহনের জন্য রাসূল (সা) সাহায্য চাইলে আবূ বকর, ওসমান ও আবদুর রহমান প্রচুর অর্থ সাহায্য করেন। হযরত আবদুর রহমান তো আটহাজার দিনার নবী (সা)-এর হাতে তুলে দেন। এ দৃশ্য দেখে মুনাফিকরা রীতিমতো কানাকানি করতে থাকে যে, ‘সে মানুষ দেখানোর জন্য এ অর্থ দান করেছে। তাদের এহেন মিথ্যা অভিযোগের জবাব স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা তওবার ৭১ নং আয়াতে এভাবে দিয়েছেন- ‘এ তো সেই ব্যক্তি যার ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হতে থাকবে’।
হযরত আবূ বকর (রা) মৃত্যু শয্যায় থাকা কালে পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে অনেকের সাথে পরামর্শ করেন। এক পর্যায় হযরত আবদুর রহমানের সাথে পরামর্শ করেন এবং হযরত ওমরের (রা) নাম পেশ করেন। আবদুর রহমান (রা) সব কথা শোনার পর বলেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে কোনই সন্দেহ নেই। তবে স্বভাবগত ভাবেই তিনি একটু কঠোর’। যে আট জন সাহাবী হযরত আবূ বকরের খেলাফত কালে ফতোয়া ও বিচারের দায়িত্ব পালন করতেন তাঁর মধ্যে আবদুর রহমানও ছিলেন শীর্ষে। তিনি ফীকাহ বিষয়ক একজন মহান পণ্ডিত ছিলেন। এ সম্বন্ধে হযরত ওমর (রা) বলেছেন, ‘যারা কুরআন বুঝতে চায়, তাা উবাই বিন কাব, যারা ফারায়েজ সম্পর্কে জানতে চায়, তারা যায়িদ বিন সাবিত এবং যারা ফিকাহ সংক্রান্ত বিষয় জানতে চায়, তারা মুয়ায বিন জাবাল ও আবদুর রহমান বিন আওফের সাথে যেনো সম্পর্ক গড়ে তোলে’। বলা যায় আবদুর রহমান (রা) হযরত ওমর (রা)-এর সার্বক্ষণিক উপদেষ্টা ছিলেন। প্রায়ই ওমর (রা) যখন জনগণের খোঁজ খবর নেবার জন্য বের হতেন আবদুর রহমান থাকতেন তাঁর সংগী।
হযরত ওমর (রা) নামাযে ইমামতি করা অবস্থায় যেদিন ফিরোজ নামক জনৈক অগ্নিপূজাকে কর্তৃক আহত হন, সেদিন তিনি বাকী নামায পড়ানোর জন্য হযরত আবদুর রহমানকে দায়িত্ব দেন। অবশ্য রাসূল (সা) জীবিত থাকা অবস্থায় একদিন তিনি প্রাকৃতিক কাজে বাইরে গেলে হযরত আবদুর রহমানের ইমামতিতে নামায শুরু হয়। রাসূল (সা) ফিরে এসে আবদুর রহমানের পেছনে এক্তেদা করেন।
আবদুর রহমানের বিচক্ষণতার জন্য তার সিদ্ধান্তের কারণে অনেক বড় বড় দুর্ঘটনা থেকেও মুসলিম সমাজ রক্ষা পেয়েছে, যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। এমন কি হযরত ওমর (রা)-এর ইন্তেকালের পর খলীফা নির্বাচন নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে হযরত আবদুর রহমান এ মামলার মীমাংসা করেন। জীবিতাবস্থায় ওমর (রা) পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের জন্য ছয়জনের একটি প্যানেল ঘোষণা করেন। এর মধ্যে জনগণ তিনজনের ব্যাপারে কোন সমর্থন না দিলে হযরত আবদুর রহমান বলেন, প্রশ্নটা ছয়জনের মধ্যেই সীমিত। যেই তিনজন সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত কারও সমর্থন পাওয়া যায় নি, তাদেরকে আমরা বাদ দিয়ে অপর তিনজন সম্পর্কে আলোচনা করি এতে বিতর্ক অনেক কমে যাবে। এরপর যুবাইর (রা), হযরত আলী (রা), তালহা (রা), ওসমান (রা), সা’দ (রা) এবং আবদুর রহমান (রা)-এর নাম প্রস্তাব করেন।
এ প্রস্তাব শোনারপর হযরত আবদুর রহমান বললেন, ‘এখন দেখছি যে, আমাদের এ তিন জনের মধ্যেই যে কোন একজন খলীফা নির্বাচিত হবে। আমি এ কাজটি আরো সহজ করে দিচ্ছি। আমি নিজে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করছি। এবার শুধু আপনাদের দু’জনের মধ্যে বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকলো’। এরপর তিনি উভয়ের সাথে আলাপ আলোচনা করে হযরত ওসমান (রা)-এর হাতে নিজেই সর্ব প্রথম বাইয়াত হন।
হযরত ওমর (রা) এর খিলাফতের প্রথম বছরে আবদুর রহমানকে আমীরুল হজ্ব নিযুক্ত করেন। হযরত ওসমান (রা)-এর খেলাফতকালে হযরত আবদুর রহমান নিজেকে গুটিয়ে নেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার কোন কাজে আর উৎসাহবোধ করেননি, একান্ত নীরব জীবন যাপন করেন। এ অবস্থায় হিজরী ৩২ সনে ৭৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁরলাশ মদীনায় জান্নাতুল বাকী নামক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার জানাযার সময় প্রখ্যাত সাহাবীরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময়ে হযরত আলী বলেন, ‘হে আবদুর রহমান ইবন আওফ। তুমি আল্লাহর কাছে যাচ্ছো। তুমি দুনিয়ার পরিস্কার পানি পেয়েছো এবং ঘোলা আর দূষিত পানি ছেড়ে গেছো’। হযরত সা’দ (রা) বলেন, ‘ওয়া জাবালাহ!’ অর্থাৎ এই পর্বতটিও আজ আমাদেরকে ছেড়ে চললো। তাঁর জানাযার নামায পড়ান আমীরুল মোমেনীন হযরত ওসমান (রা)। হযরত আবদুর রহমানের দিলে ছিলো প্রচণ্ড খোদাভীতি। তিনি সব সময়েই খোদার ভয়ে ভীত থাকতেন। এবং কান্নাকাটি করতেন। আর রাসূল (সা)-এর প্রতি ছিলো তার অগাধ প্রেম ও ভালবাসা। এ প্রেম এতটা ছিলো যে একবার তিনি নওফেল ইবনে আয়াস (রা) কে নিয়ে খেতে বসে খাবারের মধ্যে আটার রুটি ও গোশত দেখে কানতে শুরু করলেন। কান্নার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘রাসূল (সা) আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু সারাটা জীবন তিনি ও তাঁর পরিবার পেট ভরে যবের রুটিও খেতে পারিনি। এখন দেখছি যে, আমার বহু কিছু খাচ্ছি। তাই আমার মনে হচ্ছে, রাসূল (সা)-এরপর এতদিন ধনের জীবিত থাকা আমাদের জন্য ঠিক হয়নি’।
হযরত আবদুর রহমান (রা) সততার ক্ষেত্রে ছিলেন এক মাইল ফলক। এ সম্পর্কে হযরত ওসমান গণী (রা) বলেন, ‘আবদুর রহমান নিজের স্বপক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষী দেওয়ার অধিকারী। অর্থাৎ তিনি যা বলেন তা তাঁর নিজের স্বার্থের পক্ষেই হোক আর বিপক্ষেই হোক, তার জন্য কোন সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। বরং তিনি যাই বলেন তাই ঠিক’।
আবদুর রহমান উম্মাহাতুল মোমেনীনের খেদমত করার গৌরব অর্জন করেন। তিনি সব সময় তাঁদের সফর সঙ্গী হতেন। তিনি তাদের পর্দা, যান বাহন এবং অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থাও করতেন। এ ব্যাপারে রাসূল (সা) এরশাদ করেছিলেন, ‘আমার পর যে ব্যক্তি আমার পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ করবে সে ব্যক্তি অত্যন্ত সত্যবাদী এবং নেককার হবে’।
দান দক্ষিণার ক্ষেত্রে হযরত আবদুর রহমানের ভূমিকা কিংবদন্তী হয়ে আছে। যে আবদুর রহমান শূন্য হাতে মদীনায় ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি পরবর্তীকালে নিজগুণে ও আল্লাহর মেহেরবানীতে প্রভূত অর্থের মালিক হন। তিনি সর্বদা এই ভয়ে ভীত থাকতেন যে তার মাল সম্পদ অর্থ কড়িই বুঝি তাকে বিপদে ফেলবে। এ জন্য তিনি সব সময় দুহাতে দান খয়রাত করতেন। একবার তো মদীনায় ঢি ঢি পড়ে গেলো, সিরিয়া থেকে একটি কাফেলা প্রচুর খাদ্য সামগ্রীসহ উপস্থিত হয়েছে। শুধু উট আর উট। এ কাফেলাটি ছিলো আবদুর রহমানের। এ কাফেলায় ছিলো পাঁচশো মতান্তরে সাতশো উট। জানা যায় উটসহ হযরত আবদুর রহমান পুরা বাণিজ্য কাফেলাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করে দেন।
এতকিছু দান করার পরও তিনি ছিলেন অঢেল অর্থের মালিক। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আল্লাহ পাক আমার ব্যবসায় এতই রহমত দান করেছেন যে, আমি যদি কোন স্থান থেকে একটি পাথর উঠিয়ে নেই, তবুও তার নীচে স্বর্ণ পাওয়া যায়’।
হযরত আবদুর রহমান (রা) সবার কাছে এত গ্রহণীয় ব্যক্তি ছিলেন যে, হযরত আলী (রা) হযরত মুহাম্মদ (সা) থেকে বর্ণনা করেন, ‘আবদুর রহমান আসমান ও যমীনের বিশ্বাস ভাজন ব্যক্তি’। সবথেকে বড় কথা হলো হযরত আবদুর রহমান (রা) ছিলেন সেই দশজন সাহাবীর একজন, যাঁরা কিনা দুনিয়াতেই বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন।
হযরত তালহা ইবন ওবায়দুল্লাহ (রা)
ওহুদ যুদ্ধে হযরত তালহার ভূমিকার কারণে রাসূল (সা) বলেছিলেন, ‘কেউ যদি কোন মৃত ব্যক্তিকে দুনিয়ায় হেঁটে বেড়াতে আনন্দ পেতে চায়, সে যেনো তালহা ইবন ওবায়দুল্লাহকে দেখে’।
তাঁর নাম তালহা। ডাক নাম আবূ মুহাম্মদ তালহা ও আবূ মুহাম্মদ ফাইয়াজ। আব্বার নাম ওবায়দুল্লাহ এবং মা’র নাম সোবাহ বা সা’বা। তালহার বংশগত সম্পর্ক সপ্তম পুরুষ গিয়ে রাসূল (সা)-এর বংশ লতিকার সাথে মিলিত হয়েছে। অপর দিকে তাঁর মা সোবাহ (রা) প্রখ্যাত সাহাবী আলী ইবনুল হাদরামীর (রা) বোন ছিলেন।
রাসূল (সা)-এর নবুয়াত প্রাপ্তির প্রথম দিকেই তালহা (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র পনেরো বছর। হযরত তালহা (রা)-এর ইসলাম গ্রহণ ছিলো একটি চমকপ্রদ ঘটনা। ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে ঐ কিশোর বয়সেই অন্যান্য আরব ব্যবসায়ীর সাথে তালহা (রা) ব্যবসায়িক কাজে বসরা যান। তাদের বাণিজ্য কাফেলা বসরা শহরে পৌঁছানোর পর সবাই কেনা-বেচার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এরই এক পর্যায়ে তালহা (রা) অন্যান্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তিনি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাজারে ঘোরাফেরার সময়ে এমন একটি ঘোষণা শুনলেন যা তাঁর জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিলো। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি তখন বসরভার বাজারে। একজন খৃষ্টান পাদ্রীকে ঘোষণা করতে শুনলাম –‘ওহে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। আপনারা এ বাজারে আগত লোকদের জিজ্ঞেস করুন, তাদের মধ্যে মক্কাবাসী কোন লোক আছে কিনা’। আমি নিকটেই ছিলাম। দ্রুত তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি মক্কার লোক’। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে আহমদ কি আত্মপ্রকাশ করেছেন?’ বললাম, ‘কোন আহমদ?’ বললেন, ‘আবদুল্লাহ ইবন আবদিল মুত্তালিবের পুত্র। যে মাসে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন, এটা সেই মাস। তিনি হবেন শেষ নবী। মক্কায় আত্মপ্রকাশ করে কালো পাথর ও খেজুর উদ্যান বিশিষ্ট ভূমির দিকে হিজরত করবেন। যুবক, খুব তাড়াতাড়ি তোমার ‘তাঁর কাছে যাওয়া উচিত’। এরপর তালহা (রা) বলেন, তাঁর এ কথা আমার অন্তরে দারুণ প্রভাব ব্সিতার করলো। আমি আমার কাফেলা ফেলে রেখে বাহনে সওয়ার হলাম। বাড়িতে পৌঁছেই পরিবারের লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আমার যাওয়ার পর মক্কায় নতুন কিছু কি ঘটেছে? তারা বললো, ‘হ্যাঁ, মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ (সা) নিজেকে নবী বলে দাবী করছে এবং আবূ কুহাফার ছেলে আবূ বকর তাঁর অনুসারী হয়েছে’।
তিনি আরো বলেন, ‘আমি আবূ বকরের (রা) কাছে গেলাম এবং তাকে জিজ্ঞেস করলাম –এ কথা কি সত্যি যে, মুহাম্মদ নবুয়াত দাবী করেছেন এবং আপনি তাঁর অনুসারী হয়েছেন?’ তিনি বললেন হ্যাঁ, তারপর আমাকেও ইসলামের দাওয়াত দিলেন। আমি তখন তাঁর কাছে খৃষ্টান পাদরীর সব কথা খুলে বললাম। অতপর তিনি আমাকে রাসূল (সা)-এর কাছে নিয়ে গেলেন। আমি সেখানে কলেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলাম এবং নবী (সা)-এর কাছে পাদরীর সব কথা বললাম। তিনি শুনে খুব খুশি হলেন। এভামে আমি হলাম হযরত আবূ বকর (রা)-এর হাতে চতুর্থ ইসলাম গ্রহণকারী।
হযরত তালহা (রা)-এর আব্বা ওবাইদুল্লাহ রাসূল (সা)-এর নবুওয়াত লাভের পূর্বেই ইন্তেকাল করেন। তবে তাঁর মা সোবাহ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘজীবী হন। একটা ঘটনা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত ওসমান (রা) যখন বিদ্রোহীদের দআবরা অবরুদ্ধ ছিলেন তখন সোবাহ (রা) হযরত তালহা (রা) কে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ‘বাবা! তুমি স্বীয় ব্যক্তিত্বের প্রভাবে বিদ্রোহীদেরকে সরিয়ে দাও’। এ সময় তালহার (রা) বয়স ষাট বছর। এ হিসাব মতে সোবাহ (রা) কমপক্ষে আশি বছর যাবত ছিলেন।
তালহা’র (রা) শৈশব-কৈশোর সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানা যায় না। এটুকু জানা যায় যে, তিনি রাসূল (সা)-এর মদীনায় হিজরতের চব্বিশ কি পঁচিশ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন। আর একটা ব্যাপারে সবাই একমত –তা হলো তিনি খুব শৈশবকাল থেকেই ব্যবসার সাথে জড়িত হন এবং একটু বড় হলেই ব্যবসায়িক কাজে দেশে-বিদেশে গমন করেন। অন্যান্যের মতো হযরত তালহা (রা) ইসলাম গ্রহণ করার পর নানাভাবে অত্যাচারিত হন। বিশেষ করে তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে তাঁর ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয় বেশী। এ ব্যাপারে তাঁর মা সোবাহও কম ছিলেন না। মাসউদ ইবন খারাশ বলেন, ‘একদিন আমি সাফা মারওয়ার মাঝখানে দৌড়াচ্ছি, এমন সময় দেখলাম, একদল লোক হাত পা বাঁধা একটি যুবককে ধরে টেনে নিয়ে আসছে। তারপর তাকে উপুড় করে শুইয়ে তাঁর পিঠে ও মাতার বেদম মার শুরু করলো। তাদের পেছনে একজন বৃদ্ধা মহিলা চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে তাকে গাল দিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম –ছেলেটির এ অবস্থা কেন? তারা বললো, এ হচ্ছে তালহা ইবন ওবাইদুল্লাহ। পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে বানূ হাশিমের সেই লোকটির অনুসারী হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, এই মহিলাটি কে? তারা বললো, সোবাহ বিনতু আল হাদরামী, যুবকটির মা।
তালহার আপন ভাই ওসমান ইবন ওবাইদুল্লাহ এবং কুরাইশদের সিংহ বলে পরিচিত নাওফিল ইবন খুয়াইলিদও তাঁর সাথে নির্দয় ব্যবসার করে। তারা একই রশিতে তালহা (রা) ও হযরত আবূ বকরকে এক রশিতে বাঁধা হয়েছিলো এ জন্য তাদেরকে বলা হয় ‘কারীনান’।
হিজরতের পূর্বে মক্কাতেই গোপনে তালহা (রা) ইসলাম প্রচারে কাজ চালিয় যাচ্ছিলেন। ৬২২ সনের অক্টোবর মাসে রাসূল (সা) হযরত আবূ বকরকে সঙ্গে নিয়ে হিযরত করেন। তাদের পথ প্রদর্শক আবদুল্লাহকে সব ঘটনা বলেন। এরপর আবদুল্লাহ ইবনে আবূ বকর পরিবার-পরিজনসহ মদীনায় হিজরতের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমন সময় তালহা (রা) ও শুয়াইব ইবন সিনান তাদের সাথে যোগ দেন। হযরত তালহা (রা) এই কাফেলার আমীর নির্বাচিত হন।
মদীনায় পৌঁছে হযরত আসয়াদ-এর বাড়িতে তালহা (রা) ও সুহায়েব ইবন সিনান অতিথি হন। মক্কায় অবস্থান কালে রাসূল (সা) মদীনায় হিজরত করেন তখণ তালহার সাথে প্রখ্যাত সাহাবী আবূ আইউব আনসারীর সাথে ভাই সম্পর্ক করে দেন। আর একটি বর্ণনায় জানা যায়, রাসূল (সা) কাব বিন মালিকের (রা) সাথে তাঁর ভাই সম্পর্ক পাতিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁরা আপন ভাইয়ের মত আমৃত্যু সম্পর্ক টিকিয় রেখেছিলেন।
ইসলামের ইতিহাসে হিজরী দ্বিথীয় সন থেকে যুদ্ধাভিযান শুরু হয়। সর্বপ্রথম যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তার নাম বদরের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হযরত তালহা (রা) অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এ যুদ্ধের সওয়াব থেকে তিনি বঞ্চিত হননি। বদর যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত মালে গণিমতের অংশও তিনি পেয়েছিলেন। মালে গণীমতের অংশ তালহা (রা) কে প্রদানকালে রাসূল (সা) বলেন, ‘তুমি জেহাদের সওয়াব থেকৈ মাহরুম হবে না’।
আসল ব্যাপার হলো, বদর যুদ্ধের সময় একদল কাফির মদীনার জনপদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলো। রাসূল (সা) এ ষড়যন্ত্রের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য হযরত তালহাকে সেখানে পাঠান। যার কারণে তিনি বদর যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। তাই আমরা বলতে পারি তিনি বদর যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ না নিলেও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
হিজরী তৃতীয় সনে সংঘটিত ওহুদ যুদ্ধে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। এবং এ যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। ওহুদ যুদ্ধের সেই সময়টি যখন মুসলমানরা শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, রাসূল (সা) কে ঘিরে মুষ্টিমেয় কয়েকজন জানবাজ মুজাহিদ সাহাবী ছাড়া আর কেউই ছিলো না, হযরত তালহা (রা) ছিলেন তাদের অন্যতম। এ সময় শত্রুদের হাতে আম্মার বিন ইয়াযিদ শহীদ হন। অন্যান্য সাহাবীরাও দারুণবাবে আহত হন। আবূ দুজানা তো রাসূল (সা)-এর দেহকে আড়াল করে নিজের পুরো দেহটিকে ঢাল বানিয়ে নেন। আর হযরত তালহা (রা) অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ঢাল তলোয়ার নিয়ে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং ঘুরে ঘুরে রাসূল (সা) কে হেফাজত করার চেষ্টা করেন। তাঁর একক আক্রমণের প্রচণ্ডতায় সেদিন ওহুদ যুদ্ধের মোড় পুনরায় ভিন্ন রূপ নেয়। এরই এক পর্যায়ে যখন কাফেরদের আক্রমণ হ্রাস পায় তখন তালহা (রা) রাসূল (সা) কে পিঠে তুলে পাহাড়ের ওপর নিরাপদ স্থানে পৌঁছান।
ওহুদ যুদ্ধে তালহা (রা) মারাত্মক আহত হন। এ সম্পর্কে হযরত আবূ বকর (রা) বলেন, ‘এ সময় আমি ও আবূ উবাইদা রাসূল (সা)-এর নিকট ফিরে এসে তাঁর সেবার জন্য এগিয়ে গেলে তিনি বললেন, ‘আমাকে ছাড়ো, তোমাদের বন্ধু তালহাকে দেখো’। আমরা তাকিয়ে দেখি তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় একটি গর্তে অজ্ঞঅন হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর একটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায় এবং সারা দেহে তরবারী, তীর ও বর্শার সত্তরটিরও বেশী আঘাত’। এ কারণেই রাসূল (সা) তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন, ‘যদি কেউ কোন মৃত ব্যক্তিকে পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াতে দেখে আনন্দ পেতে চায়, সে যেনো তালহা ইবনে ওবাইদুল্লাহকে দেখে’। তাঁকে জীবিত শহীদ বলার করণও এটাই।
রাসূল (সা) ওহুদ যুদ্ধে বীরত্বের কারণে তাঁকে খাইর (অতি উত্তম) উপাধিতে ভূমিত করেন। হযরত আবূ বকর (রা) ওহুদ যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন, ‘সে দিনটির সবটুকুই তালহার’। হযরত ওমর (রা) তাঁকে ‘সাহেবে ওহুদ অর্থাৎ ওহুদওয়ালা’ বলে সম্বোধন করতেন।
মূলত এ যুদ্ধে হযরত তালহার ভূমিকায় রাসূল (সা) মুগ্ধ হয়েই তাকে বেহেশতের সুসংবাদ দেন।
এক বদর যুদ্ধ ছাড়া তাঁর জীবদ্দশায় যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তিনি তার সব ক’টিতেই সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। মক্কা বিজয়ের দিন হযরত তালহা (রা) রাসূল (সা)-এর সাথেই ছিলেন এবং তাঁর সাথেই কাবা ঘরে প্রবেশ করেন।
মক্কা বিজয়ের পর হুনাইনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধেও মুসলমানদের অবস্থা অনেকটা ওহুদের মত হয় কিন্তু হযরত তালহাসহ কয়েকজন জানবাজ মুজাহিদের কারণে নিশ্চিত পরাজয় থেকে মুসলমানরা রক্ষা পান।
বিদায় হজ্বে রাসূল (সা)-এর যারা সফর সঙ্গী ছিলেন হযরত তালহা (রা) সেইসব সৌভাগ্যবানদের একজন ছিলেন। জানা যায় এ সফরে রাসূল (সা) ও তালহা (রা) ছাড়া আর কারো কাছে কোরবানীর পশু ছিলো না।
রাসূল (সা)-এর ইন্তেকালে তালহা (লা) এতই বেদনা বিধুর হয়ে পড়েন যে, তিনি জনগণ থেকে দূরে একাকী অবস্থান গ্রহণ করেন। এমনকি খলীফা নির্বাচনের সময়ও তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি নিজে বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা সকল মুসীবতে ধৈর্য ধারনের হুকুম দিয়েছেন, তাই তাঁর বিচ্ছেদে ‘সবরে জামীল’ অবলম্বনের চেষ্টা করি এবং সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে তাওফিক কামনা করি’।
হযরত আবূ বকর (রা) খলীফা নির্বাচিত হওয়ার বেশ কয়েকদিন পরে তালহা (রা) বাইয়াত গ্রহণ করলেও খলীফাকে পরামর্শ দানের ব্যাপারে তিনি অগ্রণী ছিলেন। যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে খলীফার জিহাদ ঘোষণার পক্ষে রায় দিয়ে তালহা বলেন, ‘যে দ্বীনে যাকাত থাকবে না তা সত্য ও সঠিক হতে পারে না’।
হযরত ওমর (রা)-এর কঠোর ব্যবহারের কারণে হযরত তালহা (রা) খলীফা মনোনয়নের সময় তাঁর বিপক্ষে মত দেন। কিন্তু হযরত ওমর (রা) খলীফা হলে সেই তালহা হন তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা।
হযরত ওসমান (রা) বিদ্রোহীনের দ্বারা আক্রান্ত হলে তাঁর হেফাজতের জন্য তালহা (রা) পুত্র মুহাম্মদ ইবন তালহা (রঅ) কে নিয়োগ করেন। হযরত ওসমান (রা) বিদ্রোহীদের হাতে শহীদ হলে অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। হযরত ওসমানের হত্যার বিচারের দাবীতে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে ইহুদী ইবন সাবা মুসলমান সেজে সুযোগ গ্রহণ করে। তারই চক্রান্ত মুসলমানদেরকে দ্বিধা বিভক্ত করে ফেলে। এক পর্যায়ে হযরত আয়েশার (রা) সাথে পরামর্শ করে বসরার দিকে রওনা হন। হযরত আলী (রা) এ সংবাদ পেয়ে বসরার উপকণ্ঠেই তাদের বাঁধা প্রদান করেন। ফলে উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করে। পরে হযরত কাকা ইবন আমরের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষ যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু ঐ ইবন সাবার তাবেদার লোকেরা রাতের অন্ধকারে উভয় পক্ষের ঘুমন্ত সৈনিকদের মনে করলো প্রতিপক্ষ অন্যায়ভাবে আক্রমণ করেছে। ফলে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিহাসে এ যুদ্ধটে উটের যুদ্ধ বলে। এ যুদ্ধে প্রতিপক্ষের একটি তীর এসে হযরত তালহার (রা) পায়ে বিধে। ক্ষতস্থান থেকে বিরামহীনভাবে রক্ত পড়তে থাকে। কোনভাবেই যখন রক্তপড়া বন্ধ করা যাচ্ছিলো না, তখন কাকা ইবন আমরের অনুরোধে তিনি দারুণ ইলাজে (হাসপাতাল) যান। অবশ্য সে সময় অনেক দেরি হয়ে গেছে। শরীর রক্তশূন্য হওয়ার কারণে দারুল ইলাজে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরেই তিনি শাহাদাতবরণ করেন। বসরাতেই তাঁকে দাফন করা হয়। দিনটি ছিল হিজরী ৩৬ সনের জমাদিউল আওয়াল, অন্যমতে ১০ই জমাদিউস সানী। এ সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।
হযরত তালহা (রা) ছিলেন সেই যুগের একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী। অর্জিত অর্থ দুহাতে দান করতেও তিনি ছিলেন খুবই উদার। যার কারণে ঐতিহাসিকরা তাকে দানশীল তালহা বলে উল্লেখ করেছেন।
তাঁর দানশীলতার ব্যাপারে তোমাদেরকে একটা গল্প শোনাই। হাদরামাউত থেকে একবার তাঁর হাতে নগদ সত্তর হাজার দিরহাম এলো। কিন্তু এতো টাকা তিনি কি করবেন তা ভেবে পেরেশান হয়ে পড়লেন। রাতে ঘুম হলো না। এ অবস্থা দেখে স্ত্রী হযরত আবূ বকরের কন্যা উম্মে কুলসুম স্বামীকে বললেন, ‘আপনার কি কিছু হয়েছে? আমার কোন আচরণে কি কষ্ট পেয়েছেন?
‘না! একজন মুসলমানের স্ত্রী হিসেবে তুমি খুবই চমৎকার।কিন্তু আমি সেই সন্ধ্যা থেকে ভাবছি এতো নগদ টাকা ঘরে রেখে ঘুমালে আল্লাহ তাঁর বান্দাহ সম্বন্ধে কি ভাববেন?’
‘এতে ঘাবড়াবার কি আছে। এতো রাতে গরীব দুঃখী ও আপনার আত্মীয়স্বজনদের কোথায় পাবেন? সকাল হলেই তাদের মাঝে ভাগ করে দেবেন’।
‘আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন। একেই বলে বাপ কে বেটি’। পরদিন ভোর হতে না হতেই আলাদা আলাদা প্যাকেটে সকল টাকা মুহাজির ও আনসার গরীব মিসকিনদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। অন্য একটি ঘটনাতেও দানশীল তালহাকে প্রত্যক্ষ করা যায়। একবার এক ব্যক্তি এসে আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা বলে তাঁর কাছে কিছু সাহায্যের জন্য আবেদন করলো। তালহা (রা) লোকটিকে বললেন, ‘অমুক স্থানে আমার একটুকরো জমি আছে। জমিটুকু তুমি নিতে পারো অথবা ঐ জমিটুকুর মূল্য হিসাবে হযরত ওসমান আমাকে তিনলাখ দিরহাম দিতে চেয়েছেন, তুমি ইচ্ছে করলে দিরহামও নিতে পারো’। লোকটি নগদ তিন লাখ দিরহামই নিলো।
জানা যায়, বানূ তামীম গোত্রের দুঃস্থ গরীবদের তিনি একাই লালন পালন করতেন। মোট কথা তিনি নিজেকে দুঃস্থ মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি অত্যন্ত উঁচুস্তরের মানুষ ছিলেন। একটি ঘটনা বললে ব্যাপারটি সবার কাছে পরিস্কার হবে। বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি উতবা ইবনে রাবীয়ার কন্যা উম্মে আবানকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন কিন্তু উম্মে আবান সমস্ত প্রস্তাব বাতিল করে হযরত তালহাকে পছন্দ করেন। এর কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি তার স্বভাব চরিত্র অবগত আছি। তিনি ঘরে ঢোকার সময় হাসতে হাসতে ঢোকেন এবং যাওয়ার সময় হাসতে হাসতে যান। কেউ কিছু চাইলে কার্পণ্য করেন না এবং না চাইলেও অপেক্ষা করেন না। কেউ তাঁর কাজ করে দিলে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন এবং অপরাধ করলে ক্ষমা করেন।
তাবুকের যুদ্ধে হযরত কা’ব ইবনে মালেক (রা) অংশগ্রহণ না করায় তাঁর ওপর রাসূল (সা) নাখেঅশ হন। পরে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে মাফ করে আয়াত নাযিল হলে তালহা (রা) ছুটে যান এবং কা’ব (রা)-এর সাথে করমর্দন করেন। এ ব্যাপারে কা’ব (রা) বলেন, ‘আমি তালহার (রা) এই ব্যবহার কখনও ভুলবো না। কারণ, মুহাজিরগণের মধ্যে কেউই তাঁর মতো এমন বাবে এগিয়ে এসে আমার সাথে সাক্ষাত করেনি।
হযরত আবূ ওবাইদাহ ইবনুল জাররাহ (রা)
নাম আমের। ডাক নাম আবূ ওবাইদাহ। উপাধি আমনুল উম্মত। তিনি তাঁর আব্বা আবদুল্লাহ’র নামে পরিচিত না হয়ে দাদার নামে অর্থাৎ ইবনুল জাররাহ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তার বংশ তালিকা নিম্নরূপ –আমের ইবন আবদুল্লাহ, ইবন জাররাহ, ইবন হেলাল, ইবন উহাউব, ইবন জাররাহ, ইবন হারেস, ইবন ফেহর আল কারশী আল যোহরী। তার উর্ধতন পঞ্চম পুরুষ ফেহর-এর সাথে গিয়ে রাসূল (সা)-এর বংশের সাথে মিলিত হয়। তাঁর মা এ ফেহর বংশের মেয়ে ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি ডাক নাম আবূ ওবাইদাহ নামেই খ্যাত হন।
যতদূর জানা যায় হযরত আবূ বকর (রা)-এর ইসলাম গ্রহেণের পরের দিনই তিনি মুসলমান হন। তিনি আবূ বকরের (রা) হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। এরপর আবদুর রহমান ইবন আউফ, আল আরকাম ইবন আবিল আরাকাম, উসমান ইবন মাজউনকে সংগে নিয়ে রাসূল (সা)-এর খেদমতে হাজির হন এবং একসাথে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন।
মক্কায় মুসলমানদের বসবাস করা বিপদজনক হতে থাকলে রাসূল (সা)-এর নির্দেশে অনেকেই হাবশায় হিজরত করেন। হযরত আবূ ওবাইদাহ কোরাইশ জালিমদের অত্যাচারে দু’দুবার হাবশায় হিজরত করেন। পরবর্তীতে রাসূল (সা) মদীনায় হিজরত করলে তিনিও মদীনায় হিজরত করেন। অর্থাৎ তিনি মোট তিন তিনবার হিজরত করেন। মদীনায় হিজরতের পর রাসূল (সা) তাঁকে সা’দ ইবন মু’আযেরসাথে ভাই পাতিয়ে দেন।
হযরত আবূ ওবাইদাহ সেই ব্যক্তি যিনি ইসলামের জন্য আপন মুশরিক পিতাকে হত্যা করেন। ঘটনা এরকম, বদরের প্রান্তরে মুসলিম ও কোরাইশ মুশরিকদের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। হযরত আবূ ওবাইদাহ বীর বিক্রমে মুশরিক কাফিরদের ওপর আগাত হেনে চলেছেন, তাঁর আঘাতের প্রচণ্ডতায় কাফিররা দিগ্বিদিক জ্ঞান হারা হয়ে পালাতে শুরু করেছে। ঠিক এ সময়ে অথবা তার পূর্ব থেকে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ তাঁর দিকে তীর ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে এলো এবং পুত্র ওবাইদাকে হত্যা করার জন্য নানান কোশেষ করতে লাগলো। ওবাইদাহ পিতাকে এড়িয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু পারলেন না। এক পর্যায়ে পিতা আবদুল্লাহ যখন শত্রু ও তার মধ্যে চরম বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো তখন বাধ্য হয়েই তিনি তরবারির এক কোপে পিতার দেহ থেকে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।
এরপর পরই সূরা আল মুজাদিলার এ আয়াতটি নাজিল হয়-
‘তোমরা কখনো এমনটি দেখতে পাবে না যে, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার লোকেরা কখনো তাদের প্রতি ভালবাসা পোষণ করে যারা আল্লাহ এবং তার রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করেছে। তারা তাদের পিতা-ই হোক কিংবা তাদের পুত্র-ই হোক বা ভাই হোক অথবা তাদের গোত্রের লোক। তারা সেই লোক যাদের দিলে আল্লাহ তা’আলা ঈমান দৃঢ়মূল করে দিয়েছেন এবং নিজের তরফ হতে একটা রূহ দান করে তাদেরকে এমন সব জান্নাতে দাখিল করবেন যার নিম্নদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান হবে। তাতে তাঁরা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও সন্তুষ্ট হয়েছে তাঁর প্রতি। এঁরা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রাখো, আল্লাহর দলের লোকেরাই কল্যাণ প্রাপ্ত হবে’।
একবার খৃষ্টানদের এক প্রতিনিধিদল রাসূল (সা)-এর কাছে এসে তাঁর মনোনীত একজন প্রতিনিধি তাদের সাথে দিতে বললেন। এজন্য যে, তিনি গিয়ে তাদের বিতর্কিত কিছু সম্পদের ফয়সালা করে দেবেন। একথা শুনে রাসূল (সা) তাদেরকে সন্ধ্যায় আসতে বলে বললেন, ‘আমি তোমাদের সাথে একজন দৃঢ়চেতা ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠাবো’। ওমর (রা) বলেন, ‘আমি সেদিন সকাল সকাল জোহরের নামায আদায়ের জন্য মসজিদে উপস্থিত হলাম। আর আমি এদিনের মতো আর কোন দিন নেতৃত্বের জন্য লালায়িত হইনি। এর একমাত্র কারণ আমিই যেনো হতে পারি রাসূল (সা)-এর এ প্রশংসার পাত্রটি। রাসূল (সা) আমাদের সাথে জোহরের সালাত শেষ করে ডানে বায়ে দেখতে লাগলেন। আর আমিও তাঁর দৃষ্টিতে পড়ার জন্য আমার গর্দানটি একটু উঁচু করতে লাগলাম। কিন্তু তিনি তাঁর দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে এক সময় আবূ ওবায়দা ইবনুল জাররাহকে দেখতে পেলেন। তাঁকে ডেকে তিনি বললেন, তুমি তাদের সাথে যাও এবং সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে তাদের বিতর্কিত বিষয়টির ফয়সালা করে দাও’।
ওহুদের যুদ্ধে যে দশজন সাহাবী হযরত মুহাম্মদ (সা) কে ঘিরে ব্যূহ রচনা করেছিলেন, যাঁরা তাঁদের জান বাজি রেখে আল্লাহর নবী হেফাজতের চেষ্টা করেছিলেন, ওবায়দাহ (রা) তাদেরই একজন। যুদ্ধ শেষে যখন দেখা গেলো রাসূল (সা-এর চেহারা মোবারক যখম হয়েছে, দু’টি দাঁত শহীদ হয়েছে এবং লৌহবর্মের দু’টি বেড়ি গণ্ডদেশে ঢুকে গেছে। হযরত আবূ বকর (রা) এ দৃশ্য দেখে ছুটে এসে বেড়ি দু’টি দ্রুত খোলার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু ওবায়দাহ তাকে বাঁধা দিয়ে নিজেই রাসূল (সা) কষ্ট পান তাই তিনি দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে সাবদানে বেড়ি বের করে আনলেন। কিন্তু বেড়ি দুটো মারাত্মকভাবে ঢুকে যাওয়ার কারণে ওবায়দাহ (রা) দুটো দাঁত ভেঙ্গে যায়। রাসূল (সা)-এর প্রতি এ প্রেম দেখে হযরত আবূ বকর (রা) বললেন, ‘আবূ ওবায়দাহ সর্বোত্তম দাঁত ভাঙ্গা ব্যক্তি’।
হযরত ওবায়দা (রা) ওহুদ, খন্দক ছাড়াও বানূ কুরাইজা অভিযানেও অংশ গ্রহণ করেন। বাইয়াতে রেদওয়ানেও তিনি শরীক হন, হুদাইবিয়ার সন্ধিতে তিনি একজন স্বামী হিসাবে স্বাক্ষর করেন। সপ্তম হিজরী সনে রাসূল (সা)-এর সাথে খাইবার অভিযানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং অসম্ভব বীরত্বের পরিচয় দেন। যাতুস সালাসিলে পৌঁছে হযরত আমর ইবনুল আস যখন বুঝলেন আরো সৈন্য প্রয়োজন তখন তিনি রাসূলের (সা) খেদমতে সাহায্য চেয়ে পাঠান। তখন রাসূল (সা) আবূ ওবায়দাহর নেতৃত্বে দু’শো সৈন্য আমর ইবনুল আসের সাহায্যে প্রেরণ করেন। তোমরা শুনলে বিস্মিত হবে যে, এ যোদ্ধাদের মধ্যে প্রথম খলিফা হযরত আবূ বকর ও দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রা) ছিলেন। মক্কা বিজয়, হুনাইনের যুদ্ধ, তায়েফের যুদ্ধসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক যুদ্ধেই তিনি অংশ গ্রহণ করেন। মক্কা বিজয়ের সনে আবূ ওবায়দাহর নেতৃত্বে সামুদ্রিক এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এ অভিযানে তাদেরকে খাবার হিসাবে কিচু খেজুর দেয়া হয়েছিলো এবং তা এতো কম ছিলো যে, জন প্রতি দৈনিক মাত্র একটি খেজুর নির্ধারিত ছিলো। পরবর্তীতে অবশ্য তারা প্রকাণ্ড একটি মাছ পাওয়ায় খাদ্যাভাব দূর হয়।
রাসূল (সা)-এর ওফাতের পর খলীফা নির্বাচন নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে হযরত আবূ বকর (রা) ওবায়দাহ (রা) কে বললেন, ‘আপনি হাত বাড়িয়ে দিন, আমি আপনার হাতে বাইয়াত করি। আমি রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি, ‘প্রত্যেক জাতিরই একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি আছে, তুমি এ জাতির সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তি’। উত্তরে ওবায়দাহ বললেন, ‘আমি এমন ব্যক্তির সামনে হাত বাড়াতে পারিনা যাঁকে রাসূল (সা) আমাদের নামাযের ইমামতির আদেশ করেছেন এবং তিনি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ইমামতি করেছেন’। হরযত আবূ ওবায়দাহর (রা) এমন দিকনির্দেশ মূলক কথার পর পরই সবাই হযরত আবূ বকরের হাতে বাইয়াত হন। পরে খলীফা নির্বাচনের জটিলতাও দূরিভূত হয়। হযরত ওমর (রা) খলীফা হলে আবূ ওবায়দা বিনা বাক্য ব্যয়ে তাঁর হাতে বাইয়াত হন।
হযরত আবূ বকর (রা) খেলাফতের তৃতীয় সনে চতুর্দিক থেকৈ শাম দেশ আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। সময়ের হিসেবে হিজরী ১৩ সন ছিল পরিকল্পনা অনুযায়ী হযরত আবূ বকর (রা) হেমসের দিকে, আবূ ওবায়দাহকে দামেস্কের দিকে, ইয়াজিদ ইবন আবূ সুফিয়ানকে জর্দানের দিকে শোরাহবিলকে এবং ফিলিস্তিনের দিকে আমর ইবনুল আসকে প্রেরণ করেন। তবে তিনি তাদেরকে বলেন, ‘আপনারা সকলে একত্র হলে আবূ ওবায়দাহ সেনাপতি হবেন’।
হিজরী ১৭ সনে হযরত ওমর (রা) দামেস্কের আমীর ও ওয়ালীর পদ থেকে হযরত খালিদ ইবন ওয়ালিদকে অপসারণ করে সেখানে আবূ ওবায়দাহকে নিয়োগ দেন। এ সিদ্ধান্ত শোনার পর খালিদ সাইফুল্লাহ দামেস্কের লোকদেরকে বলেন, তোমাদের খুশি হওয়া উচিত যে, আমীরুল উম্মত তোমাদের ওয়ালী’।
হযরত আবূ ওবায়দার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী দামেস্ক, হিমস প্রভৃতি শহর একের পর এক জয় করেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধ তিনিই পরিচালনা করেন। সমগ্র সিরিয়া তাঁর করায়াত্বে নিয়ে আসেন। এ সময় সিরিয়ায় মারাত্মক আকারে প্লেগ রোগ দেখা দেয়। ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছিলো। হযরত ওমর (রা) এ সংবাদে বিচলিত হয়ে পড়লেন। এমনকি তিনি মদিনা থেকে স্বয়ং সুরাগ নামক স্থানে উপস্থিত হলেন। হযরত ওবায়দাহ (রা) গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ খলীফাকে অভ্যর্থনা জানালেন। প্লেগের ব্যাপারে অনেক কথা বার্তার পর খলীফা হযরত ওবায়দাহকে তাঁর সাথে মদীনায় যেতে বললেন। কিন্তু ওবায়দাহ (রা) অন্যান্যদেরকে এ অবস্থায় ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, ‘কপালের লেখা কখনও বদলায় না। সুতরাং মুসলমানদিগকে ত্যাগ করে আমি এখান থেকে কোথাও যাওয়া ভাল মনে করছি না’।
পরবর্তীতে হযরত ওবায়দাহ (রা) প্লেগে আক্রান্ত হন। রোগের অবস্থা ক্রমাবনতির দিকে গেলে তিনি হযরত মুয়াজ ইবন জাবাল (রা) কে নামাযের ইমামতির হুকুম দেন। অতপর লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বন্ধুগণ! এ রোগ আল্লাহর রহমত এবং রাসূল (সা)-এর দো’আ। ইতোপূর্বে অসংখ্য মুমীন মুসলমান এ রোগে বিদায় নিয়েছেন। এখন আবূ ওবায়দাও সেই পথে তাঁর প্রভুর মিলন প্রার্থী।
এরপর হযরত মুয়ায (রা) নামায শুরু করলে হযরত ওবায়দাহ (রা) ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মুয়াজ ইবন জাবাল (রা) তাঁর কাফন দাফনের ব্যবস্থা করলেন এবং সমবেত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বন্ধুগণ! আজই এ ব্যক্তি আমাদেরকে নিঃসঙ্গ করে চলে গেলেন। খোদার কসম, যাঁর মতো নির্মল ও কোমল অন্তর, নিঃস্বার্থ, অহিংসুক, দূরদর্শী এবং জনগণের হিতাকাঙ্খী আমি আর দেখি নি। তাঁর আত্মার মাগফেরাতের জন্য সকলেই দোয়া করুন’।
হিজরী ১৮ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন। এ সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল আটান্ন বছর।
হযরত ওবায়দাহ (রা)-এর লাশের জানাযা পড়ান মুয়াজ বিন জাবাল (রা)। দাফন করার সময় কবরে নামেন মুয়াজ, আমর ও দাহক। লাশ দাফনের পর হযরত মুয়াজ (রা) বলেন, ‘আবূ ওবায়দা, আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন। আল্লাহর কসম! আমি আপনার সম্পর্কে যতটুকু জানি কেবল ততটুকুই বলবো, অসত্য কোন কিছু বলবো না। কারণ, আমি আল্লাহর শাস্তির ভয় করি। আমার জানা মতে আপনি ছিলেন আল্লাহকে অত্যাধিক স্মরণকারী, বিনম্রভাবে যমীনের ওপর বিচরণকারী ব্যক্তিদের একজন। আর আপনি ছিলেন সেই সব ব্যক্তিদের অন্যতম যাঁরা তাঁদের রবের উদ্দেশ্যে সিজদারত ও দাঁড়ানো অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করে এবং যাঁরা খরচের সময় অপচয়ও করে না, কার্পণ্যও করে না বরং মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করে থাকে’।
হযরত আবূ ওবায়দাহ (রা) প্রায়ই পরকালের ভয়ে কান্নাকাটি করতেন। কারণ জীবনের শেষ দিকে তার সহায় সম্পদ প্রচুর হয়েছিল। এ প্রসংগে তিনি নিজেই বলেছেন, এখন দেখছি, আমার বাড়ি খাদেমে এবং আস্তাবল ঘোড়ায় ভরে গেছে। হায় আমি কিভাবে রাসূলুল্লাহকে (সা) মুখ দেখাবো? রাসূল (সা) বলেছিলেন, সেই ব্যক্তিই আমার সর্বাধিক প্রিয় হবে, যে ঠিক সেই অবস্থায় আমার সাথে মিলিত হবে যে অবস্থায় আমি তাকে ছেড়ে যাচ্ছি।
হযরত আবূ ওবায়দাহ ছিলেন, দীর্ঘাঙ্গী হালকা পাতলা গড়ন, গৌরকান্ত ও প্রজ্জ্বল মুখমণ্ডলের অধিকারী। তিনি দেখতে এতো সৌম দর্শন ছিলেন যে সবারই চোখ জুড়িয়ে যেতো। তাকে দেখার সাথে সাথে ভেতরে ভেতরে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জাগ্রত হতো। রাসূল (সা)-এর ভাষায় তিনি ছিলেন জাতির বিশ্বাস ভাজন ব্যক্তি। সর্বোপরি তিনি ছিলেন ঐ সম্মানীত দশজন সাহাবীর একজন যাঁরা পৃথিবীতে বেঁচে থাকতেই বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন।
হযরত সাঈদ ইবন যায়িদ (রা)
‘আপনারা জেহাদ করবেন আর আমি বঞ্চিত থাকবো, আমি তা সহ্য করতে পারবো না। যে গভর্নরের পদ গ্রহণ করে আমার জেহাদকে কোরবানী দিতে হবে, আমার পক্ষে তা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং পত্র পাওয়া মাত্র অনতিবিলিম্বে অপর একজনকে আমার স্থলে প্রেরণ করুন। অতিতাড়াতাড়িই আমি আপনার খেদমতে হাজির হতে চাই’। এ ছিলো সদ্য দামেস্কের গভর্নর পদ প্রাপ্ত হযরত সাঈদ (রা)-এর অভিমত। দামেস্ক ও ইয়ারমুকের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হযরত আবু ওবাইদাহ, হযরত সাঈদ ইবন যায়িদ (রা) কে দামেস্কের গভর্নর করে পাঠালে তিনি এ উক্তি করেন।
তাঁর নাম সাঈদ। ডাকনাম আবুল আওয়ার। আব্বার নাম যায়িদ এবং মার নাম ফাতিমা বিনতে বাজা। তাঁর বংশগত শাজরা এ রকম- সাঈদ ইবন যায়িদ, ইবন আমর, ইবন কোযাইল, ইবন আবদুল ওযযা, ইবন রিয়াহ, ইবন আবদুল্লাহ, ইবন কুরয, ইবন যারাহ, ইবন আদী, ইবন কা’ব ইবন লুওয়াই আল কারশী আল আদাভী। ঊর্ধ্বতন পুরুশ কাব ইবন লুওয়াই পর্যন্ত গিয়ে রাসূল (সা)-এর বংশের সাথে মিলিত হয়েছে।
সাঈদ (রা) সেই সৌভাগ্যবান পিতার সন্তান যিনি ইসলামের আগমনের পূর্বেই পৌত্তলিকতা ও শিরক থেকে নিজেকে হেফাজত করে তাওহীদের আলোকে আলোকিত হন। আইয়ামে জাহেলিয়াতের সেই যুগেও তিনি সকল প্রকার অশ্লীলতা ও পাপাচার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন। এমন কি মুশরিকদের হাতে জবাই করা জন্তুর গোশত পর্যন্ত তিনি স্পর্শ করেন নি।
বোখারী শরীফে বর্ণিত একটা ঘটনা থেকে জানা যায় যে, নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে একদিন তানঈমের পথে ওয়াদিয়ে বালদাহ নামক স্থানে সাঈদের (রা) পিতা যায়িদের সাথে রাসূল (সা) কে খাবার দিলে তিনি খেতে অস্বীকার করেন। এরপর যায়িদকে দেয়া হলে তিনিও তা খেতে অস্বীকৃতি জানান এবং বলেন, ‘আমি তোমাদের মূর্তির জন্য যবাইকৃত খাদ্য খাইনা’।
শুধু তাই নয় তিনি দেবদেবীর নামে জন্তু জবাই করার তীব্র প্রতিবাদ পর্যন্ত করেছেন। কোন এক উৎসবের সময় যায়িদ দেখতে পান কুরাইশদের ধনী ব্যক্তি গৃহপালিত পশুকে জাকজমকের সাথে সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের আরাধ্য দেবদেবীর সামনে বলি দেওয়ার জন্য। এ দৃশ্য দেখে তিনি কাবার দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে বললেন, ‘কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! এ ছাগল গুলি সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। তিনিই আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে তাদের পান করান, যমীনে ঘাস সৃষ্টি করে তাদের আহার দান করেন। আর তোমরা অন্যের নামে সেগুলি যবাই করো? আমি তোমাদেরকে একটি মূর্খ সম্প্রদায় হিসাবে দেখতে পাচ্ছি’।
যায়িদ-এর এহেন উক্তি শুনে চাচা আল খাত্তাব মানে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাবের আব্বা তাঁর গালে বসিয়ে দিল প্রচণ্ড এক থাপ্পড়। তারপর বললো, ‘তোর সর্বনাশ হোক! তোর মুখ থেকে এধরনের বাজে কথা সব সময় শুনেও সহ্য করে আসছি। সহ্যের সীমা আমাদের এখন অতিক্রম করে গেছে’। এতেও খাত্তাবের রাগ যখন পড়লনা তখন যায়িদের বিরুদ্ধে গোত্রের সহজ সরল লোকদেরকে লেলিয়ে দিলো। পরিস্থিতি এতদূর গড়ালো যে শেষ পর্যন্ত যায়িদ মক্কাতে টিকতে না পেরে হিরা গুহায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু তবুও খাত্তাব খুশি হতে পারলোনা, সে একজন কুরাইশ যুবককে সর্বদা পাহারায় রাখলো –যায়িদ যেনো মক্কার প্রবেশ করতে না পারে।
অবশ্য যায়িদ গোপনে –ওসমান ইবনুল হারিস, আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ, ওরাকা ইবন নাওফিল, উমাইমা বিনতু আবদুল মুত্তালিবের সাথে মিলিত হয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আল্লাহর কসম। আপনারা নিশ্চিত ভাবে জেনে রাখুন, আপনাদের এ জাতি কোন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নেই। তারা দ্বীনে ইবরাহীমকে বিকৃত করে ফেলেছে; তারা বিরুদ্ধাচরণ করে চলেছে। আপনারা যদি মুক্তি চান তো নিজেদের জন্য একটি দ্বীন অনুসন্ধান করুন”।
যায়িদ সেই যুগেও একজন তওহীদবাদী হওয়ার কারণে গর্ভবোধ করতেন। হযরত আয়েশা (রা)-এর বড় বোন হযরত আসমা (রা) বলেন, ‘একদিন আমি যায়িদকে কা’বা ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখেছি। তিনি বলছিলেন, ‘হে কুরাইশরা! আমি ব্যতীত তোমাদের কেউই ইবরাহীম (আঃ)-এর ধর্মাবলম্বী নও’।
তিনি যে চারজন কুরাইশকে দ্বীন অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়েছিলেণ তার মধ্যে ওয়ারাকা খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। অন্যরা কোন সিদ্ধানতন্তে পৌঁছাতে পারেননি। আর যায়িদ এর জীবনে ঘটলো ভিন্নতরো ঘটনা। তিনি প্রকৃত দ্বীন অনুসন্ধানের মানসে ইহুদী ও খৃষ্টান আলেমদের নিকট গেলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি ইহুদী ও খৃষ্ট ধর্ম সম্পর্কে অবগত হলাম; কিন্তু সে ধর্মে মানসিক শান্তি পাওয়ার মতো তেমন কিছু না পেয়ে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলাম। এক পর্যায়ে আমি শাম দেশে এসে উপস্থিত হলাম। আগেই শুনেছিলাম সেখানে একজন ‘রাহিব’ সংসার ত্যাগী ব্যক্তি আছেন, যিনি আসমানী কিতাবে অভিজ্ঞ। আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে আমার কাহিনী বিবৃত করলাম। আমার কথা শুনে তিনি বললেন, ‘ওহে মক্কাবাসী ভাই, আমার মনে হচ্ছে আপনি দ্বীনে ইবরাহীম অনুসন্ধান করছেন’।
বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি তাই অনুসন্ধান করছি’।
তিনি বললেন, ‘আপনি যে দ্বীনের সন্ধান করছেন, আজকের দ্বীনেতো তা পাওয়া যায় না। তবে সত্য তো আপনার শহরে। আল্লাহ আপনার কওমের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তি পাঠাবেন যিনি দ্বীনে ইবরাহীম পুনরুজ্জীবিত করবেন। আপনি যদি তাঁকে পান তো তাঁর অনুসরণ করবেন’।
যায়িদ দ্রুত ম্ককার দিকে রওনা হলেন। কিন্তু পথিমধ্যে একদল ডাকাত কর্তৃক তিনি আক্রান্ত ও নিহত হন। ফলে মহানবী (সা)-এর সাক্ষাত তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। তবে জানা যায় তিনি মৃত্যুর আগে আকাশের দিকে মুখ তুলে দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ! যদিও এ কল্যাণ থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেন, আমার পুত্র সাঈদকে তা থেকে আপনি নিরাশ করবেন না’। যায়িদের এ দোয়া আল্লাহ পাক কবূল করেছিলেন। ইসলাম প্রচারের প্রথম ভাগে যাঁরা ইসলাম কবূল করেন হযরত সাঈদ (রা) তাঁদেরই একজন। সম্ভবত তাঁর পূণ্যাত্মা পিতা যায়িদের দোয়ার কারণেই তিনি দাওয়াত পাওয়ার সাথে সাথে বিনা বাক্য ব্যয়ে তা কবুল করেন। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র বিশ বছর। তিনি তাঁর স্ত্রী ফাতিমা বিনতে খাত্তাবসহ ইসলাম গ্রহণ করেন। তোমরা শুনলে খুশি হবে যে, সাঈদ (রা)-এর স্ত্রী ফাতিমা ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাবের বোন। আর এই বোন ও ভগ্নীপতিকে ইসলাম গ্রহণের অপরাধে শাস্তি দিতে গিয়েই ওমর (রা) ইসলাম কবুল করেন। অর্থাৎ সাঈদ ও তাঁর স্ত্রী ফাতিমার দাওয়াতেই হযরত ওমর (রা) ইসলাম কবূল করেন।
ইসলাম কবূলের পর কাফের মুশরিকতের অত্যাচারে মক্কায় হিজরত করেন। মদীনায়র তিনি হযরত রেফায়া ইবন আবদুল মুনযের-এর মেহমান হন। পরে রাসূল (সা) সাঈদ (রা) ও হযরত রাফে ইবন যায়িদকে (রা) গুপ্তচর হিসাবে পাঠান। তাঁরা শাম দেশের সীমান্তবর্তী তুজবার নামক স্থানে কশদ জোহানীর মেহমান হন। কোরাইশ বাণিজ্য কাফেলা সীমান্ত অতিক্রম করার পর পরই গুপ্তচরদ্বয় দ্রুত মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা হন সংবাদটি রাসূল (সা)-এর নিকট পৌঁছানোর জন্য।
কিন্তু কোরাইশ বাণিজ্য কাফেলার লোকেরা বিষয়টি কিছুটা আঁচ করতে পেরে তাদের পথ পরিবর্তন করে সমুদ্র তীরবর্তী পথ ধরে চলা শুরু করে। এই বাণিজ্য কাফেলা ও মক্কা থেকে আগত তাদের সশস্ত্র সাহায্য কারীরা একত্রিত হয়ে বদর নামক স্থানে মুসলমানদের মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধই ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ নামে খ্যাত। মুসলমানেরা মাত্র ৩১৩ জন সৈন্য নিয়ে ১০০০ জন কোরাইশ সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করে এবং বিজয়ী হয় ও ৭০ জন বন্দী হয়। তোমরাশুনে খুশি হবে এ যুদ্ধেই আবূ জেহেল নিহত হয়।
হযরত সাঈদ (রা) ও হযরত তালহা (রা) যখন মদীনায় পৌঁছান, তখন বদরের যুদ্ধ শেষ করে মুসলিম গাজীগণ মদীনায় ফিরছিলেন। যদিও এ যুদ্ধে সাঈদ (রা) সরাসরি অংশ গ্রহণ করতে পারেননি, তবুও যেহেতু এ ব্যাপারেই রাসূল (সা) তাঁদেরকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তাই বদরের যুদ্ধে প্রাপ্ত মালে গণীমতের ভাগও তাঁকে দেওয়া হয়। এমন কি রাসূল (সা) তাঁকে জেহাদের ভাগও তাঁকে দেওয়া হয়। এমন কি রাসূল(সা) তাঁকে জেহাদের সওয়াব প্রাপ্ত হওয়ারও সুসংবাদ দেন। বদর যুদ্ধ ছাড়া বাকী সকল যুদ্ধে হযরত সাঈদ (রা) অংশ গ্রহণ করেন এবং বীরত্বের পরিচয় দেন। পারস্যের কিসরা ও রোমের কায়সারের সিংহাসন পদানত করার ব্যাপারে তিনি বিরাট ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বীরত্বের কারণেই ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয়। ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমান পক্ষে সৈন্য সংখ্যা ছিল ছাব্বিশ হাজার বা তার কাছাকাছি। অপরদিকে রেমানা বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল একলক্ষ বিশ হাজার। শত্রুপক্ষের এ বিশাল বাহিনী দেখে মুষ্ঠিমেয় মুসলিম সৈন্যরা যখন হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো, তখন মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি আবূ উবাইদাহ এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা পেশ করেন। এ বক্তৃতা শুনে মুসলিম বাহিনীর একজন সৈনিক বেরিয়ে এসে আবূ উবাইদাহকে বললেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ মুহুর্তে আমি আমার জীবন কুরবানী করবো’। সাঈদ (রা) বলেন, ‘আমি তাঁর কথা শুনা মাত্রই দেখতে পেলাম সে তাঁর তরবারি কোষমুক্ত করে আল্লাহর শত্রুদের সাথে সংঘর্ষের জন্য অগ্রসর হচ্ছে। এ অবস্থায় আমি দ্রুত মাটিতে লাফিয়ে পড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে অগ্রসর হলাম। এবং আমরা বর্শা হাতে প্রস্তুত হয়ে গেলাম। শত্রুপক্ষের প্রথমযে ঘোড়সওয়ার আমাদের দিকে এগিয়ে এলো আমি তাকে আঘাত করলাম। তারপর অত্যন্ত সাহসিকতারসাথে শত্রু বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আল্লাহ তা’আলা আমার অন্তর থেকে সকল প্রকার ভয়ভীতি একেবারেই দূর করে দিলেন। অতঃপর মুসলিম বাহিনী রোমান বাহিনীর ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালালো এবং তাদেরকে পরাজিত করলো’।
দামেস্ক অভিযানেরকথা তো তোমাদের প্রথমেই বলেছি যে, তিনি দামস্তের গভর্নরের পদ ত্যাগ করে যুদ্ধের ময়দানে চলে আসেন। বুঝতেই পারছো তিনি ছিলেন কতবড় যোদ্ধা ও ঈমানদার মানুষ। যিনি কিতা ক্ষমতার মসনদ ত্যাগ করে নিজের জীবনকে তলোয়ারের ছায়ায় পেশ করেছেন।
হযরত সাঈদ (রা) অত্যন্ত নির্লোভ একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিলো একান্তই সাদা সিধা! আতীক নামক স্থানে তাঁর কিছু জমি ছিলো। এ জমির আয় থেকেই তিনি কোন রকম জীবন যাপন করতেন। কোন ধরনের উচ্চাকাংক্ষা তাকে কখনো স্পর্শ করেনি। তাঁর এই দরিদ্র অবস্থা দেখে শেষ বয়সে হযরত ওসমান (রা) তাঁকে কিছু জমি দান করেন।
হযরত মোয়াবিয়ার আমলে হযরত সাঈদ (রা)-এর বিরুদ্ধে আরওয়া বিনতে উওয়াইস নাম্নী এক মহিলা মদীনার গভর্ণর মারওয়ান ইবনহাকিমের দরবারে জমি জবর দখলের মামলা দায়ের করে। এ মামলাকে কেন্দ্র করে ঘটে এক শিক্ষণীয় ও মনে রাখার মতো ঘটনা।
আরওয়া নাম্নী ও মহিলা মারওয়ানের দরবারে গিয়ে বলে, ‘হযরত সাঈদ ইবন যায়িদ (রা)-এর জমি সংলগ্ন আমার ব্যক্তিগত কিছু জমি আছে। হযরত সাঈদ তা দখল করে নিয়ে নিজের জমির সাথে যোগ করেছেন। আমি এর বিচার চাই’।
মারওয়ান বিষয়টি কতটুকু ঠিক তা যাচাই করার জন্য লোক নিয়োগ করেন। সাঈদ (রা)-এর কাছে যখন বিষয়টি পেশ করা হলো তখন তিনি বললেন, আপনারা কি মনে করেন আমি তার ওপর যুলুম করেছি? অথচ আমি রাসূল (সা)-এর নিকট শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি অপরের কয়েক ইঞ্চি পরিমাণ জমিও যুলুম করে দখল করবে, কেয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির ঐ রকম সাতগুণ জমির হার তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে’। অতপর তিনি বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! যদি এ মহিলাটি নিজের দাবীতে মিথ্যাবাদী হয় তবে সে অন্ধ হয়ে যাক এবং যে কূপ নিয়ে সে আমার সাথে ঝগড়া করছে সে কূপই তার কবর হোক’।
এর কিছুদনি পরেই সত্যিসত্যিই মহিলাটি অন্ধ হয়ে যায় এবং বিতর্কিত কূপে পড়ে সে মারা যায়। ফলে ঘটনাটি কিংবদন্তীর মত মদীনায় ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকেরা অভিশাপ দিতে যেয়ে বলতো, ‘আল্লাহ তোমাকে অন্ধ করুন, যেমন অন্ধ করেছেন আরওয়াকে।
হযরত সাঈদ (রা) নিজেকে সকল প্রকার ঝগড়া ফাসাদ থেকে হেফাজত করেন। তাইবলে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ছাড়েননি। হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতের পর তিনি প্রায়ই কুফার জামে মসজিদে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘তোমরা হযরত ওসমান (রা)-এর সাথে যে আচরণ করেছো তাতে যদি ওহুদের পাহাড়ও কেঁপে ওঠে,তো আশ্চর্যের কিছুই নেই।
মুগীরা ইবন শো’বা তখন কুফার গভর্নর। কোন একদিন হযরত সাঈদ (রা)-এর উপস্থিতিতে জামে মসজিদে একজন কুফাবাসী মুগীরার দিকে মুখ করে হযরত আলকে গালি দিতে থাকে। সাঈদ (রা) এহেন পরিস্তিতিতে বলে ওঠেন, ‘মুগীরা, হে মুগীরা! রাসূল (সা)-এর সাহাবীদের আপনার সামনে গালি দেওয়া হবে, আর আপনি তার প্রতিবাদ করবেন না, এ দেখতে চাই না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, রাসূল (সা) বলেছেন, ‘আবূ বকর, ওমর, ওসমান, আলী, তালহা, যুবাইর, আবদুর রহমান, সা’দ (রা) এরা সবাই জান্নাতী। আর যদি তোমরা চাও তো আমি দশম জান্নাতী ব্যক্তির নাম বলতে পারি’।
অতপর জনতার অনুরোধে তিনি বললেন, ‘দশম ব্যক্তি আমি নিজে’।
হিজরী পঞ্চাশ সনে আশারায়ে মোবাশশারার এ সম্মানিত সদস্য সত্তর বছর বয়সে আকীক উপত্যকায় নিজ বাস ভবনে ইন্তেকাল করেন। হযরত সা’দ ইবন আবীওয়াক্কাস তাঁর গোসল ও কাফনের ব্যবস্থা করেন এবং আবদুল্লাহ ইবন ওমর (রা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান।
এরপর মদীনায় এনে তাঁকে দাফন করা হয়। হযরত সাঈদ (রা) এর জীবনী খুব বেশী জানা যায়নি। এ বুজুর্গ সাহাবা যুদ্ধ ক্ষেত্রে থাকতেন রাসূল (সা)-এর আগে এবং নামাযে থাকতেন পেছনে।
— সমাপ্ত —