হযরত আলী ইবন আবু তালিব (রা)
রাসূল (সা)-এার যুগে কোন একদিন তিনজন লোক পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এদের একজনের কাছে পাঁচটি রুটি ও সেই পরিমাণ তরকারী, দ্বিতীয় জনের কাছে তিনটি রুটি ও সমপরিমাণ তরকারী ছিল কিন্তু তৃতীয় জনের কাছে কিছুই ছিল না। পথ চলতে চলতে খাবার সময় উপস্থিত হলে তিনজন একসঙ্গে বসে খেলো। তৃতীয় জন খাবারপ এদের নিকট থেকে বিদায় হয়ে গেলো এবং যাবার সময় আটআনা পয়সা দিয়ে গেলো। কিন্তু গোল বাঁধলো ঐ পয়সা নিয়ে। প্রথম ব্যক্তি অর্থাৎ পাঁচটি রুটির মালিক বললো, যেহেতু রুটি ছিলো আমার পাঁচটি আর তোমার নিতটি সেহেতু পয়সা আমি পাবো পাঁচ আনা আর তুমি পাবে তিন আনা। দ্বিতীয় জনের দাবি আমার রুটি তিনটি আর তোমার পাঁচটি একথা সত্য, তবে যেহেতু রুটি সবাই সমান খেয়েছি সেজন্য পয়সাও সমান সমান ভাগ হবে। অর্থাৎ তুমি চার আনা আমি চার আনা। এভঅনে অনেকক্ষণ তর্কাতর্কির পর যখন কেউ কারো দাবি ছাড়লো না তখন তারা হযরত আলী (রা)-এর নিকট এসে বিচার প্রার্থনা করলো। হযরত আলী সব শুনে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে প্রথম ব্যক্তির প্রস্তাবানুযায়ী তিন আনা নিয়ে খুশী হতে বললেন। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তি গো ধরে বললো, না জনাব! আমি আপনার পক্ষ থেকেই বিচার আশা করি’। হযরত আলী তখন বললেন, ‘আমার বিচার অনুযায়ী তুমি পাবে এক আনা আর প্রথম ব্যক্তি পাবে সাত আনা’।
হযরত আলীর কথা শুনে দ্বিতীয় ব্যক্তির চক্ষুতো ছানাবড়া! তার অবাক হবার ভাব দেখে হযরত আলী বললেন, ‘বুঝলে না! তোমাদের কথানুযায়ী তোমাদের মোট রুটি ছিলো আটটি। কিন্তু তিনজন মানুষ তো আর আটটি রুটি সমান ভাগ করে খেতে পারে না। তাই প্রত্যেকটি রুটিকে যদি সমান তিনভাগে ভাগ করা হয় তাহলে আটটিতে হয় মোট চব্বিশটি টুকরা, আর প্রত্যেকের ভাগের ভাগ পড়ে আট টুকরা করে। এখঅনে তোমার রুটি ছিলো তিনটি, তাতে হয় নয়টি টুকরা। এই নয়টির মধ্যে তুমি খেয়েছো আটটি, তাতে হয় নয়টি টুকরা। এই নয়টির মধ্যে তুমি খেয়েছো আটটি, আর থাকে মাত্র একটি। অপর দিকে প্রথম ব্যক্তির পাঁচটি রুটিতে হয় পনেরটি টুকরা –সে খেয়েছে আটটি টুকরা। তাহলে বাকী থাকে সাতটি টুকরা। তাই প্রথম ব্যক্তি তার সাত টুকরার জন্য পাবে সাত আনা আর তুমি তোমার এক টুকরার জন্য পাবে এক আনা’। দেখলে তো কি সুন্দর বিচার। আর এ বিচার ক্ষমতার কারণেই রাসূল (সা) হযরত আলীকে ইয়েমেনের বিচারপতি নিযুক্ত করেছিলেন।
নাম আলী। পুরো নাম আলী ইবন আবূ তালিব। ডাক নাম ছিলো আবুল হাসান ও আবূ তুরাব। তাঁর উপাধি ছিলো হায়দার, মুরতাজা ও আসদুল্লাহ। আব্বার নাম আবূ তালিব আবদু মান্নাফ, মায়ের নাম ফাতিমা বিনতে আসাদ। ঘটনাক্রমে আব্বা আম্মা উভয়ের কুরাইশ বংশের হাশিমী শাখার লোক। সব থেকে আনন্দের কথা হলো তিন স্বয়ং নবী করীম (সা)-এর আপন চাচাত ভাই।
মহানবী (সা)-এর ত্রিশ বছর বয়সে হযরত আলী কাবা ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত আলী (রা) ছাড়া অন্য কেউই কাবা ঘরের মত জায়গায় জন্মগ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন নি। তা’ছাড়া তাঁর যে দুটি নাম হায়দার ও আলী রাখা হয়েছিলো তাও ছিলো ব্যতিক্রমধর্মী। সত্যি বলতে কি এর পূর্বে সমগ্র আরবে এ ধরনের নাম আর কারো ছিলনা। সে জন্য আবূ তালিব এ নামকে এলহামী নাম বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূল (সা)-এর চাচা আবূ তালিব ছিলেন দরিদ্র মানুষ। তা’ছাড়া তাঁর পরিবারের লোকসংখ্যাও ছিলো বেশী। হযরত আলী (রা)-এর বয়স যখন পাঁচ বছর আরব দেশে তখণ খাদ্যাভাব দেখা দেয়, তাই চাচার ওপর থেকে চাপ কমানোর জন্য মহানবী (সা) আলী (রা) কে নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেন। এরপর আলী (রা) আর পিতার সংসারে ফিরে যাননি। রাসূল (সা) যখন নবূওয়ত প্রাপ্ত হন তখন আলী (রা)-এর বয়স দশ-এগার বছর হবে। আলী একদিন অবাক হয়ে দেখলেন ঘরের ভেতর রাসূল (সা) ও হযরত খাদিজা (রা) মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আছে অর্থাৎ সিজদাহ করছেন। আলী (রা), ‘এ কি হচ্ছে জানতে চাইলে’। রাসূল (সা) বললেন, ‘এক আল্লাহর ইবাদত করছি। তোমাকে এ পথে আসার দাওয়াত দিচ্ছি’।
হযরত আলী নির্দ্বিধায় দাওয়াত কবূল করলেন।
পুরুষদের মধ্যে কে প্রথম ইসলাম কবূল করেন এ নিয়ে মতভেদ আছে। সালমান ফারসী (রা) ও ইবন আব্বাস (রা)-এর বর্ণনা মতে হযরত খাদিজা (রা)-এর পর হযরত আলী প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে সবাই এ ব্যাপারে একমত যে, মহিলাদের মধ্যে উম্মুল মূ’মিনীন হযরত খাদিজাতুল কুবরা, বয়স্কদের দশ্যে হযরত আবূ বকর, দাসদের মধ্যে যায়িধ বিন হারিসা, কিশোরদের মধ্যে হযরত আলী (রা) প্রথম ইসলাম কবূল করেন।
নবুওয়তের চতুর্থ বছরে আত্মীয় স্বজনের নিকট দাওয়াদ পৌঁছানোর নির্দেশ আসলে রাসূল (সা) সাফা পর্বতের ওপর দাঁড়িয়ে, ‘হে আহলে গালেব’ বলে হাক ছাড়লেন। এ ডাকে কোরাইশগণ পর্বতের পাদদেশে একত্রিত হলো কিন্তু রাসূল (সা)-এর কথা শুনে তারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং আজে বাজে কথা বলে চলে গেলো। এরপর হযরত আলীর সহযোগিতায় রাসূল (সা) নিজ বাড়িতে কিছু লোককে আপ্যায়নের জন্য দাওয়াত দিলেন। এতে আবূ লাহাব, আবূ তালিব, হযরত হামযা, হযরত আব্বাসসহ প্রায় চল্লিশজন লোক উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে রাসূল (সা) বললেন, ‘হে আবদুল মুত্তালিবের সন্তানগণ। আমি তোমাদের জন্য সেই বস্তু নিয়ে এসেছি, যা তোমাদেরকে ইহ-পরকালের উত্তম নেয়ামতসমূহ দিয়ে ভূষিত করবে। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি যে আমাকে এ কাজে সাহায্য করবে?’
এহেন আহবানের পরও কুরাইশ নেতৃবৃন্দ চুপ থাকলো, কেউ কোন কথা বললো না। হঠাৎ কিশোর আলী দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি আপনাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কম বয়সী আর রুগ্ন। তবুও আমি আপনাকে সাহায্য করবো’। একথা তিনি রাসূল (সা)-এর আহবানের প্রেক্ষিতে তিনবার বললেন। তৃতীয়বার বলার পর রাসূল (সা) বললেন, ‘তুমিই আমার ভাই এবং ওয়ারিশ হবে’। সত্যি কথা হলো এরপর সর্বাবস্থায় আলী (রা) মহানবী (সা)-এর সাহায্যকারী ছিলেন।
যতই দিন যেতে লাগলো মুসলমানদের ওপর কাফির মুশরিকদের অত্যাচার নির্যাতন বেড়ে চললো। এক পর্যায়ে নবী (সা)-এর নির্দেশে কিছু লোক হাবশায় হিযরত করলেন, পরবর্তীতে মদীনায়। নবূয়াত প্রাপ্তির তেরো বছরে আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল (সা)-এর হিজরত করার হুকুম হলো। ওদিকে কুরাইশগণ ইসলামের অগ্রযাত্রা রুখতে না পেরে খোদ রাসূল (সা) কেই হত্যার ষড়যন্ত্র করলো। ঠিক হিজরতের দিন তারা রাসূল (সা)-এর বাড়ি ঘেরাও করলো। কাফিররা সন্দেহ না করে এ জন্যে নবী (সা) হযরত আলীকে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিলেন এবং গোপনে বাড়ি থেকে সিদ্দিকে আকবরের হাত ধরে বের হয়ে গেলেন। এদিকে রাসূল (সা) কে নিরাপদে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ দিতে পেরে শেরে খেঅদা নিশ্চিন্তে ঘুমালেন। তিনি জানতেন, যে কোন মুহুর্তে কাফেররা ঘরে ঢুকে মুহাম্মদ (সা) মনে করে এক কোপে তাকে দু’খণ্ড করে ফেলতে পারে, নির্মমভাবে তাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু যাঁর মনে রয়েছে আল্লাহর ভয়, সে কি কখনো মানুষের ভয়ে ভীত হয়? রাসূল (সা)-এর জন্য জীবন দেয়া তো পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।
সকাল হতে না হতেই কাফেররা ঘরে ঢুকে দেখলো মুহাম্মদ (সা)এর জায়গায় শুয়ে আছে তারই ভক্ত, আপন চাচাতো ভাই আলী ইবন আবূ তালিব। নিশ্চিত শিকার হাত ছাড়া হওয়ায় কাফেরগণ ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে গেলো।
রাসূল (সা) যখন আলীকে নিজ বিছানায় রেখে যান তখন তাকে বলেন, ‘আমি চললাম। তুমি এ সমস্ত আমানত তাদের মালিকের নিকট পৌঁছে দিয়ে চলে এসো’। হযরত আল নিজেই এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনা রওয়ানা হওয়ার পূর্বে আমাকে নির্দেশ দিলেন, আমি মক্কায় থেকে যাবো এবং লোকদের যে সব আমানত তাঁর কাছে আছে তা ফেরত দেবো। এ জন্যই তো তাঁকে ‘আল-আমীন’ বলা হতো’।
আমি তিনদিন মক্কায় থাকলাম। তারপর রাসূলুল্লাহর (সা) পথ ধরে মদীনার দিকে বেরিয়ে পড়লাম। অবশেষে বানূ ‘আমর ইবন আওয়াফ যেখানে রাসূল (সা) অবস্থান করছিলেন, আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। কুলসুম ইবন হিদামের বাড়িতে আমার আশ্রয় হলো’। রাসূল (সা) হযরত আলীকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন কিন্তু এ ঘটনায় তিনি এতো খুশি হয়েছিলেন যে, আলী যখন মদীনায় তাঁর কাছে পৌঁছুলেন তখন তিনি তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, কপালে চুমো দিলেন, এমনকি নিজ হাতে আলীর পোষাকের ধূলোবালি ঝেড়ে দিলেন।
মাদানী জীবনে রাসূল (সা) যখন মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেন তখন এক পর্যায়ে হযরত আলী রাসূল (সা) কে বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা) আপনি আমাকে তো কারো ভাই বানাইয়ে দিলেন না’। একথা শুনে রাসূল (সা) আলীর কাঁধে একটি হাত রেখে বললেন, ‘হে আলী! দুনিয়া এবং আখিরাতে তুমিই আমার ভাই’। বুঝতেই পারছো হযরত আলী কত বড় সৌভাগ্যবান মানুষ ছিলেন। অবশ্য পরে রাসূল (সা) হযরত আলী ও সাহল বিন হুনাইফের মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছিলেন।
হিজরী দ্বিতীয় সনে নবী নন্দিনী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (রা)-এর সাথে হযরত আলী (সা) শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। স্বয়ং নবী (সা) এ বিয়ে পড়ান এবং নিজের অজুর পানি দুলহা ও দুলহীনের ওপর ছিটিয়ে দিয়ে দোয়া করেন। নবী (সা)-এর দৃষ্টিতে ফাতিমার জন্য হযরত আলীই ছিলেন উপযুক্ত পাত্র। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘যদি আল না হতো, তাহলে ফাতিমার জন্য স্বামী পাওয়া যেতো না’।
শেরে খোদা হযরত আলী একমাত্র তাবুক অভিযান ছাড়া অন্য সকল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। বদরের যুদ্ধে যে দুটি কালো রংয়ের পতাকা মুসলমানদের ছিলো তার একটি ছিলো মহানবী (সা)-এর হাতে অপরটি হযরত আলী (রা) এর হাতে। বদরের যুদ্ধে মুসলমান সৈন্যদের জন্য উপযুক্ত স্থানও আলী নির্বাচন করেন। এ যুদ্ধে প্রথমেই উভয় পক্ষের তিনজন করে যোদ্ধা মুখোমুখি হয় –রাসূল (সা)-এর ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র আলী স্বয়ং প্রতিপক্ষ ওলীদকে আক্রমণ করে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেন। এরপর শাইবাকে হযরত উবাইদা (রা)-এর উপর আক্রমণ করতে দেখে আলী মুহুর্তের মধ্যে শাইবাকে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করেন। এরই ফলে পুরো যুদ্ধের মোড় পাল্টে যায়। এবং মুসলশানদের জয় হয়। এরই ফলে পুরো যুদ্ধের মোড় পাল্টে যায়। এবং মুসলমানদের জয় হয়। এমনিভাবে সকল যুদ্ধে তিনি বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। যার কারণেই রাসূল (সা) তাঁকে হায়ধার উপাধিতে ভূষিত করেন এবং ‘জুলফিকার’ নামক তরবারিটি উপহার দেন। সব থেকে আনন্দের কথা হলো রাসূল (সা)-এর যুগের সকল যুদ্ধেই তিনি ছিলেন মুসলমানদের নিশানবর্দার বা পতাকাবাহী। বদর যুদ্ধের কথা তো আগেই বলেছি। ওহুদের যুদ্ধে যে ক’জন মুজাহিদ রাসূল (সা) কে রক্ষা করার জন্য জানবাজী রেখে বুহ্য রচনা করেছিলেন, হযরত আলী তাদের অন্যতম।
খন্দকের যুদ্ধের প্রথমে, ‘আমর বিন আবদে উদ্দ বর্ম পরে বের হলো। সে হুংকার ছেড়ে বললো, ‘কে আমার সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে? আলী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী, আমি প্রস্তুত। রাসূল (সা) বললেন, ‘এ হচ্ছে আমর তুমি বসো’। এভাবে আমর তিনবার আহবান করলো, হযরত আলীও তিনবার রাসূল (সা)-এর কাছে অনুমতি চাইলেন। শেষ বারও রাসূল (সা) বললেন, সে তো আমর। উত্তরে আলী (রা) বললেন, ‘তা হোক’। এরপর উভয়ে মুখোমুখি হলো এ সময়ে আলী একটি কবিতা আবৃতি করছিলেন। আমর খাপ থেকে তরবারী বের করেই আলী’র ঢাল এক আঘাতেই ফেড়ে ফেললো। আলীও পাল্টা আঘাতে আমরকে ধরাশায়ী করে ফেললেন। এ দৃশ্য দেখে খোদ রাসূল (সা) আনন্দে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে ওঠেন। আমরকে নিকেশ করে আলী নিজের একটি কবিতা আবৃতি করতে করতে রাসূলের কাছে ফিরে আসেন।
খাইবার অভিযানের কথা তো তোমরা নিশ্চয় জানো। যখন হযরত আবূ বকর (রা) হযরত ওমর (রা) কিল্লাগুলি দখল করতে ব্যর্থ হলেন তখন রাসূল (সা) বললেন, ‘কাল আমি এমন এক বীরের হাতে ঝাণ্ডা তুলে দেবো, যে আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের প্রিয়পাত্র। তারই হাতে কিল্লাগুলির পতন হবে’। পরদিন সকালে সবাই জানলো এ দায়িত্বের ভার পড়েছে হযরত আলী হায়দারের ওপরে। হযরত আলী (সা) কিল্লাহর নিকটবর্তী হলে দেওয়ালের ওপর হতে জনৈক ইহুদী জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কি? হযরত আলী বললেনে, আলী ইবনে আবূ তালিব। অতপর ইহুদি বললেন, আমি তওরাত কিতাবে পাঠ করেছি, এই ব্যক্তি যবরদস্ত এবং দুঃসাহসী বীর। জয় করা ছাড়া এই ব্যক্তি এই স্থান ছাড়বে না। সুতরাং তাঁকে বিনা রক্তপাতে কিল্লা ছেড়ে দিলেই ভাল হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা –ইহুদির এই সু পরামর্শ কেউ গ্রহণ করেনি।
খায়বার জয় করে ফিরলে রাসূল (সা) আলীর কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে বললেনৈ, ‘তোমার এ কাজে আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ খুশী হয়েছেন’।
তোমাদেরকে পূর্বেই বলেছি তাবুক যুদ্ধে আলী (রা) অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। এর কারণ ছিলো তাবুক অভিযানকালে স্বয়ং রাসূল (সা) তাঁকে মদীনায় স্থলাভিষিক্ত করে যান। অবশ্য আলী (রা) যুদ্ধেই যেতে চেয়েছিলেন। এ সময় তিনি মহানবী (সা)-এর কাছে আরজ করেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি যাচ্ছেন, আর আমাকে নারী ও শিশুদের কাছে ছেড়ে যাচ্ছেন?’ উত্তরে রাসূল (সা) বলেন, ‘হারুণ যেমন ছিলেন মূসার, তেমনি তুমি হচ্ছো আমার প্রতিনিধি। তবে আমার পরে কোন নবী নেই’।
অষ্টম হিজরী সনে মক্কা বিজয় সংগঠিত হয়। এ সময়ে হযরত আলী মুহাজিরীনদের পতাকাবাহী ছিলেন। কাবা ঘরে প্রবেশ করে রাসূল (সা) হাজরে আসওয়াদে চুমা খেলেন এরপর মূর্তিগুলো বাইরে ফেলে দিলেন। একটি মূর্তি অপেক্ষাকৃত উচু জায়গায় থাকায় রাসূল (সা) হযরত আলীকে নিজ কাঁধে উঠিয়ে সেটা নামিয়ে ফেলেন।
নবম হিজরী সনে সিদ্দিকে আকবরকে আমীরুল হজ্ব নিযুক্ত করা হয়। পরে সূরা বারাআত নাযিল হলে কাফিরদের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি বাতিলের জন্য নবী (সা) আলী (রা) কে প্রতিনিধি করে পাঠান। হযরত আলী জনসাধারণকে জানালেন, ‘এই বছরের পর হতে কোন মুশরিক হজ্জ্ব করতে পারবেনা এবং কোন ব্যক্তিই উলঙ্গ অবস্থায় কাবা ঘরে তাওয়াফ করতে পারবেনা। আর যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে কোন প্রকারের ওয়াদা করেছে সে যেন তা পূর্ণ করে।
দশম হিজরীতে রাসূল (সা) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আলী (রা) কে ইয়েমেন পাঠান। আলী ইয়েমেন রওয়ানা হওয়ার সময় স্বয়ং রাসূলে খোদা তাঁর মাথায় পাগড়ী পরিয়ে দেন এবং দোয়া করেন। অল্প দিনের মধ্যেই ইয়েমেনবাসী ইসলাম কবুল করে। আলী (রা) যখন ইয়েমেন ছিলেন তখন তাঁকে দেখার জন্য রাসূল (সা) ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি দোয়া করেন, ‘আলীকে না দেখে যেনো আমার মৃত্যু না হয়’। বিদায় হজ্জ্বের দিন আলী ইয়েমেন থেকে এসে হাজরি হন।
রাসূল (সা)-এর ওয়াতের পর গোসল দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন যিনি তিনি হলেন আলী (রা)।
হযরত আলী তাঁর পূর্ববর্তী তিনজন খলীফাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। তিনি কখনই পদলোবী ছিলেন না। সে জন্যই হযরত ওসমানের শাহাদাতের পর তিনি খলীফার দায়ভার নিতে চাননি। পরে মদীনা বাসীদের চাপাচাপির কারণে তিনি খেলাফতের দায়িত্ব নিতে রাজি হন। তবে তিনি শর্ত দেন যে, তাঁর বাইয়াত প্রকাশ্যে হতে হবে। পরে মসজিদে নব্বীতে সর্বসম্মতিক্রমে তিনি খলীফা নির্বাচিত হন। মাত্র ১৫/১৬ জন বাদে সবাই তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। বিদ্রোহীরা খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য যে তিনজনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন তাঁরা হলেন হযরত তালহা, যুবাইর, ও আলী (রা)। হযরত ওমর (রা) মৃত্যুর পূর্বে খলীফা মনোনয়নের জন্য ছয়জন সাহাবীর নাম বলে যান। হযরত আলী তাঁদের অন্যতম। তিনি এ সময় আলী সম্বন্ধে মন্তব্য করেন, ‘লোকেরা যদি আলীকে খলীফা বানায়, তবে সে তাদেরকে সঠিক রাস্তায় পরিচালিত করতে পারবে’। খলীফা থাকা কালে হযরত ওমর একবার বায়তুল মাকদাস সফর করেন। এই সফরকালীন সময়ের জন্য তিনি আলীকে (রা) তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। মানে হযরত আলী (রা) খলীফা হওয়ার পূর্বেই দু’দুবার এ পদে স্থলাভিষিক্ত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। পূর্বেই বলেছি তাবুক অভিযান কালে খোদ নবী (সা) তাঁকে এ দায়িত্ব দেন।
একটা জিনিস তোমাদের পরিস্কারভাবে জানা দরকার, ইসলাম প্রচারের প্রথম থেকেই মুসলশানদের ঘরে বাইরে শত্রু-রাসূল (সা)-এর যুগেই যেমন প্রকাশ্যে কাফেররা শত্রুতা করতো, তেমনি ভেতরে ভেতরে মোনাফিকরাও শত্রুতা করতো। হযরত ওসমান (রা)-এর সময় এসে মোনাফিকরা খুবই সুকৌশলে কাজ শুরু করে এবং হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতের ফলে তা আরো বিস্তৃতি লাভ করে। হযরত আলী (রা) এমনি এক দুঃখজনক পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের খলীফা হন। খেলাফত প্রাপ্তির পরপরই তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় হযরত ওসমান হত্যার বিচার করার জন্য। কিন্তু ঘটনা এমন ছিলো যে, হত্যাকারী কে তা সঠিক করে কেউ জানতো না। ওসমান (রা)-এর স্ত্রী নাইলা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কাউকে চিনতে পারেন নি। ফলে কাউকে সাজা দেয়া যাচ্ছিলো না। চক্রান্তকারীরা এ সুযোগটিই গ্রহণ করলে তাদের প্রচারণায় কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবাও ওসমান হত্যার বিচার দাবী করলেন। এঁদের মধ্যে হযরত আয়েশা (রা), হযরত তালহা (রা), হযরত যুবাইরের (রা)-এর মতো ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তাঁরা হযতর আয়েশা (রা)-এর নেতৃত্বে মক্কা থেকে বসরার দিকে যাত্রা করেন, সেখানে ওসমান হত্যার বিচার দাবি কারীদের সংখ্যা ছিলো বেশী।
এহেন সংবাদে হযরত আলী (রা) সেনাদলসহ সেখানে পৌঁছান এবং দু’বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়। যেহেতু উভয় পক্ষ সততার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো তাই আলাপ আলোচার পর বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু চক্রান্তকারীরা এ ধরনের পরিস্থিতির পক্ষে ছিলো না। তাই তারা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রাতের আঁধারে এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর আক্রমণ চালায়, আর প্রচার করতে থাকে যে অপর পক্ষ সন্ধির সুযোগ নিয়ে আক্রমণ চালিয়েছে। এতে যুদ্ধ আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। উভয় পক্ষে প্রচুর শহীদ হয়। শেষমেষ হযরত আয়েশা (রা) কে হযরত আলী (রা) বুঝাতে সক্ষম হন। তিনি মদীনায় ফিরে আসেন। কিন্তু অত্যণ্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, এই ভয়াবহ যুদ্ধে আশারায়ে মুবাশশারার দু’জন সম্মানিত সদস্য হযরত তালহা (রা) ও যুবাইর (রা) শহীদ হন। এ যুদ্ধ হিজরী ৩৬ সনের জমাদিউস সানি মাসে সংঘটিত হয়। মুসলমানদের মধ্যে এটাই প্রথম আত্মঘাতি যুদ্ধ। এটাকে জংগে জামাল বা উটের যুদ্ধ বলা হয়।
হযরত আলী (রা)-এর শাসনামলে আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় সিরিয়ার শাসনকর্তা হযরত মোয়াবিয়া (রা)-র সাথে। এ যুদ্ধকে সিফফিনের যুদ্ধ বলে। আলী (রা) মিমাংসার জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। হযরত মোয়াবিয়া (রা)-র মূল কতা ছিল হযরত ওসমানের (রা) হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তিনি আলীকে খলীফা হিসাবে মানবেন না। আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো নিজে খলীফা হওয়া তাই তিনি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই হযরত ওসমানের রক্তমাখা জামা ও ওসমানের স্ত্রী নায়েলার কর্তিত আঙ্গুল হযরত আলীর (রা) বিরুদ্ধে জনসাধারণকে উত্তেজিত করার মানসে সিরিয়ায় প্রদর্শন করলেন। তাঁর লোকেরা এও বলে বেড়াতে লাগলো যে, ‘হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতে হযরত আলী’র (রা) সক্রিয় অংশ রয়েছে এবং হন্তারা তাঁরই আশ্রয়ে রয়েছে। সুতরাং হযরত ওসমানের (রা)-এর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হযরত আমীর মোয়াবিয়া (রা)-এর সাহায্য করা এবং তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়া প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয’।
ফলে হিজরী ৩৭ সনের সফর মাসে হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়ার (রা) সৈন্যগণ সিফফীন নামক স্থানে পরস্পর মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মুনাফিকগণ এ্টাই চাচ্ছিলো। তারা অতি উৎসাহের সাথে উভয়ে পক্ষকে নানা রকম ভাবে যুদ্ধে উৎসাহিত করে। কারণ উভয় পক্ষে ছিল গাপটি মেরে থাকা প্রচুর মুনাফিক। এই যুদ্ধে বিশিষ্ট সাহাবী আম্মার বিন ইয়াসির, খুযাইমা ইবন সাবিত, আবূ আম্মার আল মাযিনী প্রমুখ সাহাবীসহ হাজার হাজার মুসলমান শহীদ হন। প্রকাশ থাকে যে আম্মার বিন ইয়াসির সম্বন্ধে রাসূল (সা) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন,
‘আফসোস একটি বিদ্রোহী দল আম্মারকে হত্যা করবে’।
যুদ্ধে অবশ্য হযরত আলীর জিত হতে যাচ্ছিল কিন্তু মুয়াবিয়া (লা) নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে সন্ধির প্রস্তাব দিলেন। তাঁর সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরআন ঝুলিয়ে বলতে লাগলো, ‘এই কুরআন আমাদের দ্বন্দ্বের ফয়সালা করবে’। অতএব যুদ্ধে বিরতি ঘোষিত হলো। আসলে হযরত আলী তো সময় চাচ্ছিলেন শান্তি কিন্তু যুদ্ধবাজ মুনাফিকরা তো তাঁকে ঘরে থাকতে দেয়নি। আবূ মূসা আশয়ারী হযরত আলীর পক্ষে এবং আমর ইবনুল আস হযরত মুয়াবিয়ার পক্ষে সালিশ নিযুক্ত হলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমর ইবনুল আসের ধূর্তামীর জন্য সালিশী বোর্ড শান্তি স্থাপনে ব্যর্থ হয়। মুসলমানরা দুমাতুল জান্দাল থেকে ফিরে আসেন। তখন থেকে মুসলিম খিলাফত দু’ভাবে ভাগ হয়ে যায়।
সিফফিনের যুদ্ধের পর হযরত আলীর দল থেকে বারে হাজার লোক বের হয়ে হারুরায় চলে যায়। এরা ‘খারেজী’ নামে পরিচিত। অত্যন্ত চরম পন্থী এ দলটিকে বোঝানোর জন্য হযরত আলীর পক্ষ থেকে যথেষ্ট চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু সবই পণ্ডশ্রম হয়। তারা প্রচার করতে থাকে দ্বীনের ব্যাপারে কাউকে হাকাম বা সালিশ মানা কুফরী কাজ। সেই অনুযায়ী হযরত আলী আবূ মূসা আশয়ারীকে সালিশ মেনে কুরআনের খেলাপ কাজ করেছেন। অতএব হযরত আলী তাঁর আনুগত্য দাবী করার বৈধতা হারিয়ে ফেলেছেন। এদের সাথেও হযরত আলী’র নাহরাওয়ান নামক স্থানে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বলা যায় এ যুদ্ধে খারেজীদের শক্তি প্রায় খতম হয়ে যায়।
নাহরাওয়ানের যুদ্ধের পর খারেজী সম্প্রদায়ের আবদুর রহমান ইবনে মুলজিম, আল বারাক ইবন আবদুল্লাহ ও আমর ইবন বকর আত তামীমী নামক তিন ব্যক্তি গোপনে এক বৈঠক করে। এ বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত নিয় যে আলী, মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস এই তিনজনের কারণেই মুসলমানদের এত অশান্তি। তাই এঁদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক হযরত আলীকে ইবনুল মুলজিম, মুয়াবিয়াকে আল বারাক এবং আমর ইবনুল আসকে আমর হত্যার দায়িত্ব নিলো। তারা প্রতিজ্ঞা করলো, ‘মারবে না হয় মরবে’।
কাজটির জন্য সময় বেছে নেয়া হয় ৪০ হিজরী সনের ১৭ই রমজান ফজরের ওয়াক্ত। এরপর যে যার গন্তব্যে চয়ে যায়।
অভ্যাস মত হযরত আলী নামায পড়ার জন্য মানুষ-জনকে ডাকতে ডাকতে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, এ সময়ে ওঁৎ পেতে থাকা পাপিষ্ট ইবনে মুলজিম তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তিনি আহত হন। আহতাবস্থায় ঐ দিনই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
এক্ দিনে হযরত মুয়াবিয়াও একই সমেয় আহতন হন কিন্তু তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। আর আমর ইবনুল আস ঐ দিনই অসুস্থ ছিলেন তাই মসজিদে যাওয়া হয়নি। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে ইমামতির জন্য মসজিদে যাচ্ছিলেন পুলিশ প্রধান খারেজা ইবনে হুজাফা। তাঁকেই আমর ইবনুল আস মনে করে শহীদ করা হয়।
হযরত আলী (রা) মোট চার বছর নয় মাস খিলাফতের দায়িত্বে ছিলেন। নানা জটিলতার মধ্যেও তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি ছিলেন ঐ সময়ে একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। বিচারের ক্ষেত্রে আলী’র তুলনা আলী নিজেই। হযরত ওমর (রা) বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে সর্বোত্ত ফায়সালাকরী আলী’। তাঁর সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য হযরত ওমর প্রায়ই বলতেন, ‘আলী না থাকলে ওমর হালাক হয়ে যেতো’।
আলী (রা) নিজেকে সব সময় অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতই মনে করতেন। তিনি নিজে দরিদ্র ছিলেন কিন্তু কোন অভাবী মানুষ তার দরোজা থেকে ফিরতো না। এজন্য তাঁকে প্রায়ই সপরিবার উপোষ থাকতে হতো। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। সর্বদা মোটা কাপড়ের পোশাক পরতেন, তাও আবার তালি দেওয়া। তিনি অনেক সময় মাটিতেই শুয়ে কাটাতেন। একবার রাসূল (সা) তাঁকে মাটিতে শোয়া অবস্থায় দেখে ঠাট্টা করে বললেন, ‘ইয়া আবা তূরাব’। এখান থেকেই তিনি ‘আবূ তূরাব’ নামে পরিচিত হন।
হযরত আলী ছিলেন কুরআনের হাফিয। রাসূল (সা)-এর তত্ত্বাবধানেই তাঁর শিক্ষাজীবন কাটে। তিনি একজন শ্রেষ্ঠ মুফাসসির ছিলেন। তিনি খুব বড় পণ্ডিত ছিলেন। রাসূল (সা) নিজেই বলেছেন, ‘আমি জ্ঞানের নগরী আর আলী সেই নগরের প্রবেশদ্বার’। তিনি বহু হাদীস বর্ণণা করেছেন। পূর্ববর্তী খলীফাদের যুগে যাঁরা ফতোয়া দিতেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।
হযরত আলী ছিলেন একজন বড় কবি ও সুবক্তা। তার একটি ‘দীওয়ান’ পাওয়অ গেছে। যাতে অনেকগুলি কবিতার মোট ১৪০০ শ্লোক বর্তমান। ‘নাহজুল বালাগা’ নামে তাঁর বক্তৃতার একটি সংকলন আছে।
হযরত আলী তাঁর নিজের সম্বন্ধে বলেছেন, ‘আমি যা বল ছি তা কুরআনের কাছে জিজ্ঞেস করো। আমি ঠিক বলছি কিনা। আল্লাহর কসম। এমন কোন আয়াত নেই যা আমি জানি না। তা রাতে নাজিল হয়েছে বা দিনে, যুদ্ধের ময়দানে নাজিল হয়েছে বা পর্বতের গুহায়। অর্থাৎ যেখানেই নাযিল হয়ে থাকুক না কেন, সমস্তই আমার জানা আছে’। তাঁর ব্যাপারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেন, ‘খোদার কসম। রাসূল (সা)-এর পর সমস্ত এলেমকে দশভাগ করে আলীকে একাই নয়ভাগ দেওয়া হয়েছে। আর মাত্র এক দশমাংশ অপরাপর সমস্তের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে’।
আলী (রা)-এর জীবন অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। ইমাম আহমদ (র) বলেন, ‘আলী’র (রা) মর্যাদা ও ফযীলত সম্পর্কে রাসূল (সা) থেকে যতো কথা বর্ণিত হয়েছে, অন্য কোন সাহাবী সম্পর্কে তা হয়নি’।
হযরত মুয়াবিয়া (রা) হযরত আলীর পুরাতন বন্ধু যেরার ইবন যামরার কাছে আলী (রা)-এর চরিত্র সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত দূরদর্শী, দুঃসাহসী, শক্তিশালী, ন্যায়বিচারক, প্রতিটি কথা এলেম ও হেকমতে পরিপূর্ণ, দুনিয়া ও দুনিয়ার নেয়ামতের প্রতি আন্তরিক ঘৃণা পোষণকারী, রাত্রি জাগরণে আনন্দিত, পরকালের চিন্তায় মগ্ন, ঋতু এবং যুগ পরিবর্তনের আশ্চর্যান্বিত, সাদাসিধা পোশাক পরিধানকারী, সাধারণ আহার্যে অভ্যস্ত, মানবতার দিশারী, দানবীর, গরীবদের প্রতি আন্তরিক এবং স্নেহবান, ন্যায়ের সমর্থন ও অন্যায়ের ঘোর বিরোধিতা ছিল হযরত আলী (রা)-এর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য’ অতপর মুয়াবিয়া বলেন, আল্লাহ কসম, আবুল হাসান এমনই ছিলেন’।
আসলে হযরত আলী ছিলেন, মুসলমানদের জন্য অহংকার। এ জন্যই রাসূল (সা বলেছেন, ‘একমাত্র মুমিনরা ছাড়া তোমাকে কেউ ভালবাসবেনা এবং একমাত্র মুনাফিকরা ছাড়া তোমাকে কেউ হিংসা করবে না’।
হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা)
নাঙ্গা তলোয়ার হাতে ভীড় ঠেলে এগিয়ে আসছে এক কিশোর। অসম্ভব উত্তেজনা তার চোখে মুখে। রাসূল (সা)-এর কাছাকাছি আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘যুবাইর! এ সব কি? যুবাইর নামের কিশোরটি উত্তর দিলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি জানতে পেরেছি যে, আপনাকে মুশরিকরা গ্রেফতার করেছে। তাই আমি তার প্রতিশোধ নিতে আগমন করেছি’। যুবাইরের কথা শুনে নবী (সা) খুশি হলেন এবং তার জন্য দোয়া করলেন। জানা যায় যুবাইরের এই তলোয়ারই মুশরিকদের বিরুদ্ধে কোষ মুক্ত প্রথম তলোয়ার।
নাম যুবাইর, ডাকনাম আবূ আবদুল্লাহ আর উপাধি ছিলো হাওয়ারীয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)। আব্বার নাম ‘আওয়াম’ এবং মায়ের নাম সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব। যুবাইর (রা)-এর মা সাফিয়া ছিলেন নবী (সা)-এর আপন ফুফু। অর্থাৎ যুবাইর ছিলেন নবী (সা) এর ফুফাত ভাই। হযরত খাদিজা (রা) ছিলে হযরত যুবাইর (রা)-এর ফুফু। অপর দিকে হযরত আয়েশা (রা)-এর সহোদরা প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দিকের কন্যা আসমাকে বিয়ে করায় যুবাইর ও রাসূল (সা)-এর মধ্যে ছিল নানা আত্মীয়তার বন্ধন।
যুবইর (লা) জন্মগ্রহণ করেন হিজরতের আটাশ বছর পূর্বে। তাঁর বাল্যকাল সম্বন্ধে কিছুই জানা যায়না। তবে এটুকু জানা যায় যে, তাকে বীর পুরুষ, আত্মসংযমী, আত্মপ্রত্যয়ী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য তাঁর মা সাফিয়ার প্রচেষ্টার কোন অন্ত ছিলো না। এমন কি তাঁর চাচা নওফেল বিন খুওয়াইলিদ ভীষণভাবে ক্ষেপে গিয়ে সাফিয়াকে বললেন, ‘এভাবে মারতে মারতে ছেলেটাকে তুমি মেরেই ফেলবে’। এরপর তিনি বানূ হাশিমের লোকদের ডেকে বললেন, ‘তোমরা সাফিয়াকে বুঝাওনা কেনো?’ এর উত্তরে সাফিয়া বললেন, ‘যারা বলে আমি তাকে দেখতে পারিনা, তারা মিথ্যা বলে। আমি তাকে একজন্য মারধোর করি যাতে সে বুদ্ধিমান হয় এবং পরবর্তী জীবন শত্রু সৈন্য পরাজিত করে গণিমতের মাল লাভে সক্ষম হয়’।
আনন্দের কথা হলো অল্প বয়স থেকেই যুবাইর সত্যি সত্যিই পাহলোয়ান হয়ে উঠেছিলেন। অন্তত একটা ঘটনায় এর প্রমাণ মেলে, একদিন মক্কার এক বলিষ্ঠ দেহের যুবকের সাথে তার মোকাবিলা হয়। এক পর্যায়ে যুবাইর তাকে এইছা মার দিলেন যে, যুবকটির একটি হাতই ভেঙে গেলো। যুবকটির এহেদ দুরবস্থা দেখে লোকেরা বিচারের জন্য তাকে নিয়ে যুবাইরের মায়ের নিকট এলো। কিন্তু আশ্চর্য! যুবাইরের মা সাফিয়া এ ঘটনায় তো মর্মাহত হলেনই না, উল্টো তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা যুবাইরেকে কেমন দেখলে –সাহসী না ভীরু?’
মাত্র ষোল বছর বয়সেই যুবাইর (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। যতদূর জানা যায় তিনি প্রথম পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।
ইসলাম গ্রহণের পর পরই অন্যান্যদের মতো তাঁর ওপরও অত্যাচার নির্যাতন নেমে আসে। তাঁর চাচা তাঁকে ইসলাম থেকে ফিরানোর জোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে ক্ষেপে গিয়ে তাঁর ওপর নির্যাতন শুরু করেন। কখনো হোগলায় পেঁচিয়ে দড়ি বেধে নাকে ধোঁয়া দিতো। ফলে তার জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠতো। তবুও তিনি ইসলাম ত্যাগ করেননি, বরং তিনি বলতেন, যতো কিছুই করুননা কেন আমি আবার কাফির হতে পারিনা’। কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে প্রথমে তিনি হাফশায় হিজরত করেন। পরে হাফশা থেকে ফিরে এসে শুনেন রাসূল (সা) মদীনায় হিজরত করেছেন। অতএব তিনিও মদীনায় হিজরত করেন।
রাসূল (সা) অন্যান্যদেরকে যেমন ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন, তেমনি মক্কায় থাকা কালে যুবাইর (রা) ও তালহা (রা)-এর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করিয়ে দেন। পরে যুবাইর (রা) যখন হিজরত করে মদীনায় আসেন তখন রাসূল (সা) আবার সালামা ইবন সালামা আনসারীর সাথে তাঁর ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করিয়ে দেন। এই সালামা (রা) ছিলেন আকাবার বায়াত গ্রহণকারীদের অন্যতম ও মদীনার একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব।
দুঃসাহসী একজন মর্দে মুজাহিদ ছিলেন হযরত যুবাইর (রা)।
বদর যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। শত্রু পক্ষের কাছে যুবাইর নামটাই ছিল মারাত্মক ত্রাস সৃষ্টিকারী। তিনি যে সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন সে সব ক্ষেত্রে শত্রুদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছেন। বদর যুদ্ধে দিন এক মুশরিক যোদ্ধা উঁচু টিলার উপর উঠে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের জন্য আহবান জানালে জুবাইর দেরি না করে তাকে মুহুর্তে জাপ্টে ধরেন এবং দুজনেই গড়াতে গড়াতে নীচে আসতে থাকেন। এ দৃশ্য দেখে রাসূল (সা) বলেন, ‘এদের মধ্যে যে প্রথম মাটিতে পড়বে, সে নিহত হবে’। রাসূল (সা)-এর ভবিষ্যদ্বানী সত্যে পরিণত হলো, মুশরিকটি প্রথমে মাটিতে পড়ে –যুবাইর দেরি না করে তরবারির এক আঘাতে তাকে হত্যা করে।
এই একই যুদ্ধে সর্বাঙ্গে বর্মাচ্ছাদিত উবাইদা ইবন সাঈদের সাথে তাঁর মোকাবিলা হয়। উবাইদার শুধু দু’টি চোখই খোলা ছিল। যুবাইর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চোখ তাক করে তীর ছুড়লেন, তীর চোখ ভেদ করে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেলো। যুবাইর অনেক কষ্টে উবাইদের লাশের উপর বসে তীরটি বের করতে সক্ষম হন। তবে তীরটি বেঁকে গিয়েছিলো। এই ঘটনাটি এতো গুরুত্বপূর্ণ চিলো যে স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রাসূল (সা) নিজে তীরটি সংরক্ষণ করেন। রাসূল (সা)-এর ওফাতের পর তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রা) পর্যন্ত তীরটি তাঁদের নিকট ছিল। পরে হযরত ওসমান (রা) শাহাদাত বরণ করলে হযরত যুবাইর (রা) তীরটি নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেন এবং শাহাদাত বরণ করা পর্যন্ত তা সংরক্ষণ করেন। বদর যুদ্ধে তিনি এতো বীর বিক্রমে লড়েছিলেন এবং তরবারি চালিয়ে ছিলেন যে, তাঁর তরবারির ধার পড়ে গিয়েছিলো। তিনি এতো মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন যে, তার শরীরে অসংখ্য ক্ষতের সৃষ্টি হয়। একটি ক্ষত তো চিরদিতের মতো স্থায়ী হয়ে যায়। এ ব্যাপারে তাঁর ছেলে উরওয়া (রা) বলেন, ‘আমরা সেই গর্তে আঙ্গুল ঢুকিয়ে খেলা করতাম’।
বদর যুদ্ধে তিনি হলুদ পাগড়ী পরা অবস্থায় ছিলেন। তাঁর এ পোশাকে দেখে রাসূল (সা) বলেন, ‘আজ ফেরেশতাগণ এ রংয়ের পোশাক পরে এসেছেন।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপাকের সময় রাসূল (সা) কে কেন্দ্র করে যে জানবাজ সাহাবীরা প্রতিরো ব্যুহ তৈরী করেছিলেন, হযরত যুবাইর (রা) ছিলেন তাদের অন্যতম।
খন্দকের যুদ্ধে যুজাইর (রা)-এর উপর দায়িত্ব পড়ে যেদিককার প্রতিরক্ষার সে দিকে মহিলারা অবস্থান করছিলেন। মদীনার ইয়াহুদি গোত্র বানূ কুরাইজা এ যুদ্ধে মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে। বিষয়টি পরিস্কার ভাবে জানার জন্য রাসূল (সা) কোন একজনকে পাঠাতে চাইলেন। এ জন্য তিনি তিরবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে য তাদের সংবাদ সংগ্রহ করতে পারে?’ তিনবারই যুবাইর (রা) উত্তর দেন, ‘আমি’। নবী (সা) তাঁর এহেন উত্তরে খুশী হয়ে বলেন, ‘প্রত্যেক নবীরই থাকে হাওয়ারী। আমার হাওয়ারী যুবাইর’।
আসলে বানূ কুরাইযা গোত্রের সংবাদ সংগ্রহ করা ছিলো খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। এ জন্য রাসূল (সা) যুবাইরের বীরত্বে অভিভূত হয়ে বলেন, ‘আমার বাপ মা তোমার নামে উৎসর্গ হোক’।
পরিখা’র যুদ্ধেল পর বানূ কুরাইজার যুদ্ধ ও বাইয়াতে রিদওয়ানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। খাইবার যুদ্ধের সময় তিনি প্রচণ্ড সাহসিকতার পরিচয় দেন। এই যুদ্ধের ইয়াহুদী নেতা মুরাহহিব নিহত হয়। ফলে তার ভাই ইয়াসির ভয়ানক চটে গিয়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে এসে দ্বন্দ্ব আহবান জানালো। ইয়াসিরের মোবাকিলায় যুবাইর (রা) গিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু ইয়াসিরের শরীর এতই তাগড়া ছিলো যে যুবাইর(রা)-এর মা সাফিয়া ভড়কে গিয়ে বলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা)! আমার সন্তান আজ শহীদ হয়ে যাবে। উত্তরে রাসূল (সা) বললেন, ‘না, না যুবাইর শহীদ হবে না; বরং যুবাইর ইয়াসিরকে হত্যা করবে’। ফলে তাইই হলো। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর যুবাইর ইয়াসিরকে তলোয়ারের এক কোপে দুখণ্ড করে ফেললেন।
মানবিক দুর্বলতার কারণে প্রখ্যাত সাহাবা হাতিব বিন আবী বালতায়া (রা) মক্কা অভিযানের সমস্ত খবর জানিয়ে কুরাইশদের নিকট গোপনে এক মহিলাকে চিঠিসহ পাঠান। অহীর মাধ্যমে রাসূল (সা)-এর খবর জানতে পারেন এব মহিলাকে গ্রেফতার করার জন্য একটি ক্ষুদ্র দল পাঠান। হযরত যুবাইর (রা) ছিলেন এ দলের অন্যতম সদস্য।
হিজরী আট সনে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়। মক্কা বিজয় কালে দশহাজার সৈন্য রাসূল (সা)-এর সঙ্গী হয়। তিনি এই দশহাজার সৈন্য নানা ছোট বড় দলে ভাগ করেন। সব থেকে ক্ষুদ্র এবং শেষ দলটির সাথীহন রাসূল (সা) নিজে। আর এ দলের সেনাপতিত্ব করার সৌভাগ্য অর্জন করেন যুবাইর (রা)। মক্কায় প্রবেশের পর শান্তি স্থাপিত হলে হযরত মিকদাদ ও যুবাইর (রা) ঘোড়ায় ছড়ে রাসূল (সা)-এর কাছে উপস্থিত হলেন। রাসূল (সা) উঠে দাঁড়িয়ে নিজ হাতে উভয়ের মুখমণ্ডল ধূলোবালি ঝেড়ে দিলেন।
মক্কা বিজয়ের পর মদীনা ফেরার পথে হুনাইনের যুদ্ধে সংঘঠিত হয়। এ যুদ্ধে যুবাইর (রা) অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি একাকী কাফেরদের একটি গোপন ঘাটির নিকট পৌঁছে যান। তাঁকে দেখে এক ব্যক্তি সঙ্গীদেরকে বললো, ‘আমাদের প্রভু লাভ এবং ওযযার কসম! ঘোড়ার আরোহী এই লম্বা ব্যক্তি নিশ্চয় যুবাইর। সাবধান! প্রস্তুত হও এবং সকলে প্রস্তুত থাকো। কারণ যুবাইরের আক্রমন অত্যন্ত মারাত্মক’। লোকটির বক্তব্য শেষ হতে না হতেই মুশরিকরা আকস্মিকভাবে যুবাইরকে ঘিরে ফেললো। কিন্তু যুবাইর (রা) অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে শত্রুব্যূহ ভেদ করলেন, এমনকি একাই সেই ঘাটির মুশরিকদের পরাজিত করে ঘাটি দখল করেন।
হযরত ওমর (রা)-এর খিলাফত কালে ইয়ারমুকের যুদ্ধে যুবাইর(রা) দুঃসাহসিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিলে মুসলিম সৈন্যরা তাঁর নেতৃত্বে রোমান বাহিনীর মধ্যভাগে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। হযরত যুবাইর (রা) অত্যণ্ত ক্ষীপ্রতার সাথে আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং রোমান বাহিনীর প্রতিরোধ ব্যূহভেদ করে অপর প্রান্তে পৌঁছে যান। কিন্তু তাঁর সংগীরা তাঁকে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থা দেখে তিনি পুনরায় রোমান বাহিনীর ব্যূহ ভেদ করে নিজ বাহিনীর কাছে ফিরে আসেন। কিন্তু আসার সময় মারাত্মকভাবে আহত হন। এ সময় তিনি ঘাড়ে দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন। তাঁর ছেলে উরওয়া বলেন, ‘বদরের পর এটা ছিল দ্বিতীয় যখম, যার মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ছেলে বেলায় আমরা খেলতাম’। খুশির কথা হলো তাঁর এ দুঃসাহসিক আক্রমণের কারণেই রোমান বাহিনীর ছত্রভঙ্গ ও পরাজিত হয়।
মিসরের ফুসতাত কিল্লা জয়ের সময় ঘটলো এক চমকপ্রদ ঘটনা। হযরত আমর ইবনুল আসের (রা)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর ফুসতাত কিল্লা সাত মাস অবরোধ করে রেখেও দখল আনতে পারছিলো না। শেষ মেষ হযরত ওমর (রা) দশহাজার সৈন্য ও চারহাজার সেনা অফিসারকে আমর (রা)-এর সাহায্যের জন্য পাঠালেন। তিনি লিখে পাঠালেন এ অফিসারার এক এক জন একহাজার সৈন্যের সমান। হযরত যুবাইর (রা) ছিলেন এ সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন। দীর্ঘ অবরোধের পরেও যখন কিল্লা জয়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো না, তখন একদিন যুবাইর (রা) বললেন, ‘আজ আমি মুসলমানদের জন্য আমার জীবন কুরবান করবো’। যেই বলা সেই কাজ। যুবাইর (রা) উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে মই লাগিয়ে কিল্লায় উঠে গেলেন। আর কিল্লায় চড়েই নারায়ে-তকবীর ধ্বনি দিতে শুরু করলেন, সাথে সাথে নীচে থেকে মুসলিম সৈন্যরা আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুললো। এহেন ঘটনায় খৃষ্টানরা হতভম্ব হয়ে গেল এবং সন্ত্রস্তভাবে ছুটাছুটি শুরু করলো। এ সুযোগ যুবাইর (রা) কিল্লার দরোজা খুলে দিলেন –সংগে সংগে মুসলিম বাহিনী কিল্লায় প্রবেশ করলো।
দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা) মৃত্যু শয্যায় যে ছয় জনের ভেতর খলীফা নির্বাচন করার জন্য বলে যান হযরত যুবাইর (রা) তাঁদের একজন।
হযরত ওসমান (রা)-এর বাড়ি বিদ্রোহীরা ঘিরে ফেললে তাঁর ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার জন্য যুবাইর (রা) স্বীয় পুত্র হযরত আবদুল্লাহকে (রা) নিয়োগ করেন। হযরত আলী (রা)-এর খিলাফত কালে হযরত ওসমানের শাহাদাতের ঘটনা নিয়ে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। হযরত তালহা ও যুবাইর (রা) মক্কায় গিয়ে হযরত আয়েশা (রা)-এর সাথে মিলিত হন। তারা উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে দীর্গ আলোচনা করেন এবং মদীনায় না গিয়ে বসরার দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রচুর লোক তাঁদের সঙ্গী হন। এদিকে হযরত আলী (রা) এ সংবাদে তাঁদের প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং বসরার নিকটবর্তী ‘যীকার’ নাকম স্তানে দুই বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়। সময়টা ছিল হিজরী ৩৫ সনের ১০ই জমাদিউল উখরা।
ইতিহাসে এ যুদ্ধকেই জংগে জামাল বা উটের যুদ্ধ বলে।
উভয় দল সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। এ জন্য শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ আলোচনা হয়ে শান্তি স্থাপনের কাছাকাচি পৌঁছলে, উভয় পক্ষে ঘাপটি মেরে থাকা মুনাফিকরা তাতে বাঁধ সাধলো এবং যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিলো। এক পর্যায়ে হযরত আলী (রা) একাকী যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে এসে যুবাইর (রা) কে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে আবূ আবদুল্লাহ! সেই দিনের কথা তোমার মনে আছে কি? আমরা উভয়ে পরস্পরের হাতে হাত রেখে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্মুখ দিয়ে যাচ্ছিলাম। রাসূল (সা) বলেছিলেন, ‘হে যুবাইর! তুমি একদিন আলীর বিরুদ্ধে না হক যুদ্ধ করবে’।
উত্তরে একদিন আলীর বিরুদ্ধে না হক যুদ্ধ করবে’।
উত্তরে হযরত যুবাইর (রা) বললেন, ‘হ্যাঁ তিনি বলেছিলেন। যদিও আমি তা স্মরণ রাখতে পারিনি। তবে এখন আমার মনে পড়ছে’।
হযরত আলী (রা) আর কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে গেলেন কিন্তু সত্যের সৈনিক যুবাইর (রা)-এর মধ্যে বিপ্লব ঘটে গেলো। তিনি দ্রুত হযরত আয়েশা (রা)-এর নিকট হাজির হয়ে বললেন, ‘আমি ভুল বুঝাবুঝির ওপর ছিলাম। হযরত আলী (রা)_ আমাকে রাসূল (সা)-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন’। আয়েশা (রা) বললেন, ‘এখন আপনার উদ্দেশ্য কি?’ যুবাইর (রা) উত্তরে বললেন, ‘এখন আমি এ সব ঝগড়া থেকে বিরত থাকতে চাই’।
উপস্থিত যুবাইর (রা)-এর পুত্র আবদুল্লাহ (রা) প্রশ্ন করলেন, ‘তা হলে আপনি আমাদেরকে উভয় সমস্যার মধ্যে ফেলে আলী (রা)-এর ভয়ে পালাচ্ছেন’।
উত্তরে যুবাইর (রা) বললেন, ‘আমি কসম করেছি, আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো না’। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা) বললেন, ‘কসমের কাফফারা দেওয়াও তো অসম্ভব কিছু নয়’। এই বলে তিনি স্বীয় গোলাম মাকগুলকে আযাদ করে দিলেন।
যুবাইর (রা) বললেন, ‘বাবা! হযরত আলী (রা)-এর ভয়ে নয়, বরং আমার মনই একাক করতে চাচ্ছে না। এরপর হযরত আলী রাসূল (সা)-এর এমন এক কথা মনে করিয় দিয়েছেন। যার ফলে আমার আগ্রহ উদ্দীপনা নিস্তেজ হয়ে গোছে। নিঃসন্দেহে আমি অন্যায় পথে ছিলাম। আসো, তুমিও আমার সাধে যুদ্ধ বিরতি মেনে চলো’।
হযরত আবদুল্লাহ (সা) অস্বীকার করলে তিনি বসরার দিকে রওয়ানা দিলেন। এ সময় আহনাফ বিন কায়েসের কথামত আমার বিন জারমুজ যুবাইর (রা)-এর পিছু নেয় এবং বসরা থেকে কিছু দূরেই সশস্ত্র অবস্থায় তার সংগে মিলিত হয়। জারমুজ যুবাইর (রা)-এর কাছে এসে বললো, ‘আবূ আবদুল্লাহ। জাতিকে আপনি কি অবস্থায় ছেড়ে এলেন?’ যুবাইর (রা) বললেন, ‘তারা একে অপরের গলায় ছুরি চালাচ্ছে’। পুনরায় ইবনে জারমুজ বললেন, ‘আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। তাই এ ঝগড়া থেকে দূরে যেতে চাই’। ইবনে জারমুজ বললো, ‘চলুন সেদিকে আমিও যাবো’। দু’জন এক সংগে চললেন। জোহরের সময় হলে যুবাইর (রা) থামলেন। সে সময়ে ইবন জারমুজ তাঁর সাথে সালাত আদায়ের ইরাদা পেশ করলে যুবাইর (রা) বললেন, ‘আমি তোমাকে আশ্রয় দান করছি। তুমি কি আমার সাথে সেই ব্যবহার করবে?’ ইবন জারমুজ বললো, ‘অবশ্যই’।
এরপর উভয়ে সালাতে দাঁড়ালেন। সেজদারত হওয়ার সাথেসাথে বিশ্বাসঘাতক বেঈমান ইবন জারমুজ আশারায়ে মোবাশশারার অন্যতম সদস্য নবী হাওয়ারী হযরত যুবাইর (রা)-এর মাতা তলোয়ারের এক আঘাতে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন।
যুবাইর (রা) কে শহীদ করার পর নরাধম ইবন জারমুজ তার তলোয়ার লৌহবর্ম ইত্যাদি নিয়ে আলী (রা)-এর দরবারে হাজির হয়ে গর্বের সাথে তার কৃতকার্জের বর্ণনা দিলো। হযরত আলী (রা) সেদিকে কর্ণপাত না করে যুবাইর (রা) তলোয়ারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আহ! এই সেই তলোয়ার যা দিয়ে যুবাইর (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওপর থেকে বহুবার মুসীবতের পাহাড় হটিয়ে গিয়েছেন। হে জারমুজ! আমি তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি যে, জাহান্নাম তোমার জন্য অপেক্ষা করছে’। হযরত যুবাইর (রা)-এর শাহাদাতের সনটি ছিল হিজরী ৩৬। শাহাদাতের পর তাঁর লাশ ‘আসা সিবা’ উপত্যকায় দাফন করা হয়।
হযরত যুবাইর (রা) ছিলেন দ্বীনের ব্যাপারে অত্যণ্ত সাবধানী একজন সাহাবী। তিনি রাসূল (সা)-এর হাওয়ারী ও সার্বক্ষণিক সংগী হওয়া সত্ত্বেও খুব কম সংক্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে হযরত আবদুল্লাহ (রা) জানতে চাইলে তিনি ছেলেকে উত্তর দেন, ‘বেটা অন্যদের থেকে রাসূলের (সা) সাহচর্য ও বন্ধুত্ব আমার কোন অংশে কম ছিলো না। যেদিন ইসলাম কবুল করেছি, সেদিন থেকে রাসূলের (সা) সাহচর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। কিন্তু তাঁর এ সতর্কবাণীটি আমাকে দারুণভাবে সাবধান করেছে, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার আবাস ঠিক করে নেয়’।
যুবাইর (রা) বিপদ আপদ বালা মুছীবনতে থোড়ায় কেয়ার করতেন, এমনকি মৃত্যু ভয়েও তিনি কখনো ভীত হতেন না। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর জীবনে প্রচুর উদাহরণ রেখে গেছেন। ইসকান্দারিয়া অবরোধের সময় সিঁড়ি লাগিয়ে তিনি কিল্লার ভেতর ঢুকতে চাইলে সঙ্গীরা বললেন, ভেতরে মারাত্মক প্লেগ’। জবাবে এ অকুতোভয় সৈনিক বললেন, ‘আমরা তো যখন ও প্লেগের জন্যই এসেছি। সুতরাং মৃত্যু ভয় কেন? এরপর তিনি নির্ভয়ে কিল্লায় প্রবেশ করলেন।
উহুদের যুদ্ধে তাঁর মামা হযরত হামজা (রা) শহীদ হন। এ সংবাদে তাঁর মা সাফিয়া ভাইয়ের লাশ দাফনের জন্য দু’টুকরো কাপড় পাঠান। কিন্তু মামার পাশেই তিনি একজন আনসারী ব্যক্তির লাশ দেখতে পেলেন। একটি লাশের জন্য দু’প্রস্থ কাপড় অথচ অন্যটি কাপড় বিহীন এটা তাঁর কাছে দৃষ্টিকটু মনে হলো ‘তাই তিনি কাপড় দু’টি লটারীর মাধ্যমে ভাগ করলেন, যাতে পক্ষপাতিত্ব না হয়। আসলে কাপড় দু’টি ছোড় বড় ছিলো –এজন্য এ সাবধানতা। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছো ইসলামী শাসনের প্রতি তিনি কেমন অনুগত ছিলেন।
দানশীলতা, উদারতা, আমনতদারী, পরোপকারীতা ইত্যাদি গুণে যুবাইর (রা) ছিলেন গুণান্বিত। যুবাইর (রা) ছিলেন অসম্ভব একজন ধনী ব্যক্তি। তার কাছে এক হাজার গোলাম ছিলো। তারা প্রতিদিন প্রচুর আয় করতো। এ আয়াতের এক পয়সাও তিনি নিজের জন্য বয় করতেন না, সম্পূর্ণ অর্থই দনা করে দিতেন। তিনি এতই ধনী ব্যক্তি ছিলেন যে মৃত্যুকালে তাঁর নিকট পাঁচ কোটি দুইলক্ষ দিরহামের স্থাব সম্পত্তি ছিলো। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে তাঁর অনেকগুলি বাড়িঘরও ছিলো। অবশ্য তিনি বেশ ঋণীও ছিলেনে। এ ঋণ ছিল আমানতকারীদের। তিনি আমানতকারীদের বলতেন, এ মাল আমি আমানত রাখছিনা, বরং ঋণ নিচ্ছি। এভঅবে ঋণ হলে শোধ দেয়ার তাগিদ জন্মাবে’।
ঋণের ব্যাপারে তিনি ছেলেকে অছিয়ত কলে বলেন, ‘বাবা! ঋণের প্রতি আমার মন সর্বদা চিন্তিত। তাই আমার মাল বিক্রয় করে সর্বপ্রথমক আমার ঋণ পরিশোদ করো। অতঃপর যা অবশিষ্ট থাকে তার থেকে এক তৃতীয়াংশ শুধু তোমার সন্তানের জন্য অসিয়ত করছি। তবে যদি মাল দিয়ে সম্পূর্ণ কাজ সমাধা না হয়, তাহলে আমার মাওলার কাছে চেয়ে নিও’। আবদুল্লাহ (রা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার মাওলা কে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার মাওলা সেই প্রভু রাব্বুল আলামীন, যিনি আমাকে কোন রকম মুসীবতের সময়ই সাহায্য করেছেন’।
তিনি অত্যন্ত দায়িত্ববান লোক ছিলেন। অত্যধিক ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি পরিবার পরিজনের প্রতি যথেষ্ট যত্মবান ছিলেন। বিশেষ করে তিনি পুত্র আবদুল্লাহর (রা) বাচ্চাদেরকে খুবই মহব্বত করতেন। তিনি নিজের ছেলেদের শিক্ষা দিক্ষার ব্যাপারেও খুবই সজাগ মানুষ ছিলেন। আবদুল্লাহর (রা) বয়স যখন মাত্র দশবছর তখন তিনি তাঁকে যুদ্ধের বাস্তবতা থেকে শিক্ষা গ্রহণেল জন্য দর্শক হিসাবে ইয়ারমুকের যুদ্ধে নিয়ে যান।
ধনী হওয়া সত্ত্বেও তিনি খাওয়া দাওয়া ও পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে সাদাসিধা ছিলেন। তবে যুদ্ধের সময় তিনি রেশমী পোশাক পরতেন। রাসূল (সা) তাঁকে বিশেষভাবে এ অনুমতি দিয়েছিলেন। আর তিনি কারুকার্য খচিত যুদ্ধাস্ত্র পছন্দ করতেন। তাঁর তলোয়ারের বাটটি ছিল রৌপ্য নির্মিত।
হযরত যুবাইর (রা) ছিলেন একজন দক্ষ ব্যবসায়ী। আনন্দের কথা হলো তিনি জীবনে যে ব্যবসায়ে হাত দিয়েছেন, সব তাতেই তিনি প্রচুর পরিমাণে লাভবান হয়েছেন।
বহু যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার কারণে তাঁর দেহ ছিলো ক্ষত বিক্ষত। এ ব্যাপারে আলী ইবনে খালিদ বলেন, ‘আমাদের কাছে মুসেল থেকে একটি লোক এসেছিলেন, তিনি বর্ণনা করেন, ‘আমি যুবাইর (রা)-এর সফরসঙ্গী ছিলাম। সফরের এক পর্যায়ে আমি তাঁর দেহে এমন সবআঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলাম যা অন্য কারো দেহে আর কখনো দেখিনি’।
ব্যক্তি হিসাবে হযরত তালহা (রা) ও হযরত যুবাইর (লা) কেমন ছিলেন তা হযরত মুয়াবিয়া (রা) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাদের দু’জনের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। আল্লাহর কসম, তাঁরা দু’জনই ছিলেন অত্যন্ত সংযমী, পুণ্যবান, সৎকর্মশীল, আত্মসমর্পণকারী, পুত পবিত্র, পবিত্রতা অর্জনকারী ও শাহাদাত বরণকারী’।
হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা)
‘এটা দিয়েই তোমরা আমার কাফন বানাবে। বদরের যুদ্ধে এ যুব্বাটা পরেই কাফিরতের বিরুদ্ধে লড়েছিলাম। আমার ইচ্ছে আল্লাহর দরবারে এটা নিয়েই আমি উপস্থিত হই’। মৃত্যুর আগে হযরত সাদ (রা) বহু সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও একটি পুরানো পশমী জুব্বা দেখিয়ে উপরিউক্ত অছিয়ত করে যান।
তাঁর নাম সা’দ। ডাকনাম আবূ ইসহাক। পরবর্তীতে তিনি সা’দ ইবন আবী ওয়াকক্কাস নামে পরিচিত হন। আব্বার নাম আবূ ওয়াক্কাস মালেক। মায়ের নাম হামনা। তাঁর বংশ তালিকা এ রকম –সা’দ ইবন মালেক, ইবনে ওয়াহব, ইবন আবদে মোনাফ, ইবন যোহর, ইবন নযর, ইবন কেনানা আল কারশী আযযোহারী। এ তথ্য মতে তিনি যোহরী গোত্রের লোক ছিলেন। রাসূল (সা)-এর মাতা আমিনাও এ যোহরী গোত্রের ছিলেন। এদিক দিয়ে হরযত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাসূল (সা)-এর মাতুল ছিলেন। অবশ্য রাসূল (সা) বহু বারই একথা উল্লেখ করেছেন যে, ‘সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা) আত্মীয়তার দিক দিয়ে আমার মামা হন’।
সা’দ (রা) মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইসলাম কবূল করেন। প্রথম খলীফা হযরত সিদ্দীকে আকবরের দাওয়াত পেয়ে সা’দ (রা) রাসূল (সা) নিকট হাজির হন এবং ইসলাম কবূল করেন। প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি একজন। তিনি নিজেকে তৃতীয় মুসলমান বলে দাবী করেছেন। তবে ঐতিহাসিকভাবে যেটা সত্য তা হলো তিনি ৭ম অথবা ৮ম ইসলাম গ্রহণকারী মুসলমান। যাহোক তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এ সংবাদ তাঁর মায়ের কানে পৌঁছানো মাত্র তাঁর মা হামনা খুব হৈ চৈ ও কান্নাকাটি শুরু করে দেন। এমনকি তিনি ঘোষণা দেন ‘সা’দ যতক্ষণ মুহাম্মদের রিসালাতের অস্বীকৃতি ঘোষণা না দেবে ততক্ষণ আমি কিছু খাবোনা, কিছু পান করবো না, রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য ছায়াতেও আসবো না। মার আনুগত্যের হুকুম তো আল্লাহও দিয়েছেন। আমার কথা না শুনলে অবাধ্য বলে বিবেচিত হবে এবং মার সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না’।
মাতৃভক্ত সা’দ তাঁর মায়ের এহেন ঘোষণায় খুব অস্থিত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি রাসূল (সা)-এর খেদমতে হাযির হয়ে সব ঘটনা খুলে বললেন। রাসূল (সা) জবাব দেওয়ার পূর্বেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আনকাবুতের ৮৯ নং আয়াতটি নাযিল করেন, ‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার প্রতি ভালো ব্যবতার করতে। তবে তারা যদি তোমার ওপর বল প্রয়োগ করে, আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে বলে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদের আদেশ অমান্য করো’।
এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর সা’দ (রা)-এর চিত্ত চাঞ্চল্য কমে এলো। তিনি তাঁর মাকে বার বার বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁর মা কোন কথাই শুনলেন না –তিনদিন তিনি তার সিদ্ধান্তের ওপরে অটল থাকার পর সা’দ (রা) বাধ্য হয়ে তাঁর মাকে জানিয়ে দিলেন, ‘মা তোমার মতো হাজারো মা যদি আমার ইসলাম ত্যাগ করার জন্য জিদ ধরে পানাহার ছেড়ে দেয় এবং মৃত্যুবরণকরে, তবুও যে সত্যদ্বীনকে বুঝে শুনে গ্রহণ করেছি, তা ত্যাগ করা সম্ভব নয়’। এ সত্য কথাগুলো শুনার পর সা’দ (রা)-এর মায়ের মন ক্রমান্বয়ে ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং এক পর্যায়ে তিনি মুসলমান হন। সা’দের পিতা আবী ওয়াক্কাসও মুসলমান হয়েছিলেন।
ইসলামের প্রথম যুগে যাঁরা ইসলাম কবুল করেছিলেন তাঁরা প্রথম প্রথম গোপনে ইসলাম পালন করতেন। নবুয়াতের তৃতীয় বছরে সুলাইম গোত্রের নওমুসলিম আমর ইবন আব্বাস শিয়াবে আবূ তালিবের এক কোনো সালাত আদায় করছিলেন। কিন্তু কোরাইশরা এ দৃশ্য দেখে ফেলে এবং তাঁর প্রতি পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে হযরত সা’দসহ দু’একজন মুসলমানও এগিয়ে আসেন ও তাদের আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানান। কথা কাটাকাটি হতে হতে একপর্যায়ে তা হাতাহাতিতে রূপ নেয়। এ সময় হযরত সা’দ (রা) পাশে পড়ে থাকা উটের এক খণ্ড হাড় তুলে নিয়ে একজন কাফিরকে মনমত পিটুনী দেন। এতে লোকটির শরীর তো রক্তাক্ত হয়ই, সাথে সাথে মাথাও যায় ফেটে। সত্যি বলতে কি এটাই ছিলো ইসলামের জন্য প্রথম রক্তপাত, যা হযরত সা’দ (সা)-এর হাতেই ঘটেছিলো।
কোরাইশদের অত্যাচারে মক্কায় টিকতে না পেরে মুসলমানরা মদীনায় হিজরত করা শুরু করলে প্রথম মদীনায় পৌঁছান মুসয়াব ইবন উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতূম (রা)। এরপর চারজনের একটি ক্ষুদ্র কাফেলা মদীনায় গমন করে। এদের মধ্যে ছিলেন সা’দ (রা)। এ ব্যাপারে হযরত বারা ইবন আযিব (রা) বলেন, ‘সর্ব প্রথম আমাদের নিকট আগমন করেন মুসয়াব ইবন উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুম (রা০। এ দু’ব্যক্তি মদীনা বাসীদের কুরআন শিক্ষা দিতেন। অতপর বিলাল, সা’দ ও আমার বিন ইয়াসির (রা) আগমন করেন’। অন্য এক বর্ণনা মতে জানা যায় যে সা’দ (রা) এর সাথে তাঁর ভাই উমাইরও হিজরত করেন। জানা যায় তাঁরা মদীনায় এসে পূর্বেই মদীনায় অবস্থানকারী তাঁদের অন্য এক ভাই উতবা ইবন আবী ওয়াক্কাসের বাড়িতে উঠেন এবং সেখানেই অবস্থান করেন। উমাইর (রা) প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম একজন।
মুসলমানগণ মদীনায় হিজরত করার পরও কোরাইশদের আক্রমণের আশঙ্কা থেকে দূরে থাকতে পারলেন না। বরং সর্বদা তাদেরকে সচেতন থাকতে হতো কখন তারা আক্রমণ করে বসে। সে জন্য রাসূল (সা) কোরাইশদের গতি বিধি লক্ষ্য রাখতে হযরত আবদ ইবনুল হারেসের নেতৃত্বে ষাট থেকে আশি জন অশ্বারোহী প্রেরণ করেন। এ দলে হযরত সা’দ (রা) ছিলেন। এক পর্যায়ে তারা যখন হেযাযের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় গিয়ে পৌঁছায় তখন একদল কোরাইশ বংশীয় মুশরিকের দেখা পান। যেহেতু মুসলমানরা শুধু অবস্থা জানার জন্য ঘুরে ফিরছিলেন তাই কোন যুদ্ধ হলো না। কিন্তু হযরত সা’দ (রা) উত্তেজিত হয়ে মুশরিকদের লক্ষ্য করে তীর চালনা করেন। তোমরা শুনলে পুলকিত হবে যে, এ তীরই আল্লাহর রাস্তায় চালানো সর্বপ্রথম তীর।
স্বয়ং রাসূলের (সা) নেতৃত্বে হিজরী দ্বিতীয় সনের রবিউসসানী মাসে কোরাইশদের গতি বিধি লক্ষ্য রাখতে দুশো সাহাবীর একটি দল মদীনা থেকে বের হন। এ দলের পতাকাবাহী ছিলেন হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা)। এবার বাওয়াত নামক স্থানে ছোট ধরনের একটি সংঘর্ষ হয়।
রাসূল (সা) বদর যুদ্ধে দু’একদিন আগে কুরাইশদের অবস্থা জানার জন্য যে ক্ষুদ্র দলটি প্রেরণ করেন হযরত সা’দ (রা) তাঁদের মধ্যে ছিলেন। দলটি ক্ষুদ্র হলেও এরা কুরাইশদের দু’জন চরকে গ্রেফতার করে রাসূল (সা)-এর কাছে আনেন। রাসূল (সা) গুপ্তচরদ্বয়ের নিকট হতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেন।
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ হচ্ছে বদরের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হযরত সা’দ (রা) ও তাঁর বাই হযরত উমাইর (রা) অসম্ভব সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন। হযরত উমাইর (রা) এ যুদ্ধে শহীদ হন। হযরত সা’দ (রা) সরদার সাঈদ ইবনুল আসকে হত্যা করেন। সাঈদের একটি চমৎকার তরবারি ছিলো, যা হযরত সা’দ (রা)-এর পছন্দ হয়। যুদ্ধের পর তরবারি খানা তিনি রাসূল (সা)-এর নিকট আনেন এবং নিজে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পেশ করেন। কিন্তু তখনও গণিমতের মাল সম্পর্কে আল্লাহর কোন নির্দেশ না আসাতে সা’দ কে বিমুখ হতে হয়। হযরত সা’দ (রা) ফিরে যেতে যেতে সূর আনফাল নাযিল হয়। সাথেসাথে রাসূল (সা) সা’দকে ডেকে বললেন, ‘তোমার তলোয়ার নিয়ে যাও’।
ওহুদের যুদ্ধের সেই বিভিষীকাময় পরিস্থিতিতে যে সমস্ত সৈনিক সাহাবা নবীজীকে হেফাজত করার জন্য তাঁকে ঘিরে ব্যূহ রচনা করেছিলেন, নিজেদের জানকে বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন, হযরত সা’দ (রা) ছিলেন তাঁদেরই একজন। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই বলেছেন।
‘ওহুদের দিন রাসূল (সা) তাঁর তূণীর আমার সামনে ছড়িয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘তীর মারো! আরও মারো। আমার মা বাবা তোমার প্রতি কুরবান হোক’।
ওহুদের যুদ্ধে সা’দ (রা)-এর ভাই হযরত উমাইর শহীদ হলেও অপর ভাই পাপিষ্ঠ উতবার ছুড়ে দেওয়া পাথরের আঘাতেই মহানবীর মুখমণ্ডল আহত হয়। এমন কি দাঁত শহীদ হয়। তারপর থেকে সা’দ (রা) প্রায়ই বলতেন, ‘কাফিরদের অন্য কাউকে হত্যার এত প্রবল আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল না, যেমন ছিলো উতবার ব্যাপারে। কিন্তু যখন আমি রাসূল (সা) কে বলতে শুনলাম, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের (সা) চেহারা রক্ত রঞ্জিত করেছে, তার ওপর আল্লাহর গজব আপতিত হবে, তখন তার হত্যার আকাঙ্ক্ষা আমার নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং অন্তরে প্রশান্তি নেমে আসে’।
ওহুদের যুদ্ধের ঐ বিপদের মধ্যেও একটি দৃশ্য দেখে রাসূল (সা) হেসেছিলেন। জনৈক মুশরিক বীরবিক্রমে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালাছিলো। এক সময়ে রাসূল (সা) সা’দ (রা) কে পাল্টা আক্রমণের হুকুম দিলেন, কিন্তু এ সময়ে একটি অকেজো তীর ছাড়া সা’দের নিকট আর কিছুই ছিলো না। অগত্যা ঐ তীর দিয়েই সা’দ (রা) মুশরিক কে আক্রমণ করলেন। সা’দ (রা)-এর নিশানা ছিল অব্যর্থ। তীরটি মুশরিক সৈনিকটির কপালে বিদ্ধ হতেই সে ভীষণভাবে দিশেহারা হয়ে উলঙ্গ অবস্থায় নীচে পড়ে গেলো। এ অবস্থা দেখে রাসূল (সা) হেসেছিলেন।
বদর যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত সব যুদ্ধ গুলোতেই অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সা’দ (রা) অংশ গ্রহণ করেন। মক্কা বিজয়ের পর হুনাইন, তায়েফ ও তাবুকের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন।
হযরত সা’দ (রা) নিজের জীবনের চেয়ে নবী (সা)-এর ভালমন্দের প্রতি গুরুত্ব দিতেন বেশী। খন্দকের যুদ্ধের সময় সালা পর্বতের উপত্যকার এক তাবুতে রাসূল (সা) অবস্থান করছিলেন। কোন এক রাতে ভীষণ ঠাণ্ডা পড়তে থাকে, এমন সময় রাসূল (সা) অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে? উত্তর এলো, ‘সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস’। কি ব্যাপার! কেনো এসেছো? বললেন, ‘সা’দের হাজার জীবন অপেক্ষা আল্লাহর রাসূল (সা) হচ্ছেন তার প্রিয়তম। এ অন্থকার ঠাণ্ডা রাতে আপনার ব্যাপারে আমার ভয় হলো। তাই পাহারার জন্য হাজির হয়েছি’। রাসূল (সা) বললেন, সা’দ আমার চোখ খোলা ছিলো। আমি আশা করছিলাম আজ যদি কোন নেক্কার বান্দা আমার হিফাজত করতো’।
রাসূল (সা) বিভিন্ন সময়ে হযরত সা’দ (রা)-এর জন্য দোয়া করেছেন। বিদায় হজ্বের সময়ে তিনি দারুণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি জীবনের আশংকা করছিলেন। এমতাবস্থায় রাসূল (সা০ একদিন তাঁর কপালে, বুকে ও পেটে হাত বুলিয়ে এ দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি সা’দকে শিফা দান করুন, তাঁর হিজরতকে পূর্ণতা দান করুন’। অর্থাৎ হিজরতের স্থান মদীনাতেই তাঁর মৃত্যু দান করুন। আবূ ওবাইদা ও মুসান্নার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী পারস্যের কিসরা বাহিনীকে পরাজিত করে ইরাক দখল করে নিলে কিসরা বাহিনী মহাবীর রুস্তমের নেতৃত্বে পুনরায় একত্রিত হয়ে মুসলমানদের ওপর আঘাত হানার প্রস্তুতি নেয়। হযরত ওমর (রা) এ সংবাদ পেয়ে নিজেই মুসান্নাকে সাহায্যের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন কিন্তু মজলিসে শূরা খলীফার সিদ্ধান্ত অনুমোদন না করায় সর্বসম্মতিক্রমে হযরত সা’দ (রা) কে সেনাপতি করে পাঠান হয়। সা’দ (রা)-এর রণকৌশল এত নিপূণ ছিলো যে, এ যুদ্ধে বিশাল পারস্য বাহিনী সর্বদিক থেকে ভীষণভাবে নাকানী চুবানী খায় এবং মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়।
মুসলিম বাহিনী যখন পারস্য বাহিনীকে এক এক করে পরাস্ত করছিলো তখন সা’দ (রা)-এর নিকট খবর আসলো শাহানশাহ ইয়াজদিগিরদ রাজধানী থেকে মূল্যবান সমস্ত সম্পদ সরিয়ে নিচ্ছেন। এ সংবাদে দেরী না করে সা’দ (রা) মাদায়েনের দিকে রওনা হলেন। কিন্তু ইরানীরা পূর্বেই দজলা নদীর পুলটি ধ্বংস করে দিয়েছিলো। এখানে এসে মুসলিম বাহিনী থমকে দাঁড়ালো। এ সময়ে সা’দ (রা) সৈন্য বাহিনীর উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। ভাষণ শেষ করেই তিনি নিজের ঘোড়াসহ উত্তাল দজলা মাঝে নেমে পড়েন, দেখাদেখি মুসলিম বাহিনীও তাঁর অনুসরণ করে। তাঁরা নদী পার হয়ে ওপারে উঠলে –ইরানী বাহিনী এ দৃশ্য দেখে ভয়ে চিৎকার করতে লাগলো, ‘দৈত্য আসছে, দানব আসছে, পালাও পালাও’।
সা’দবাহিনীর এ আকস্মিক আক্রমণে বাদশাহ সমস্ত ধন সম্পদ ফেলে হালওয়ানে পালিয়ে গেলো। সা’দ (রা) রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে আল্লাহর শোকর আদায় করার উদ্দেশ্যে আট রাকাত সালাতুল ফাতহ আদায় করলেন। ঐদিন ছিলো শুক্রবার, তাই সা’দ (রা) বললেন, ‘আজ এ প্রাসাদেই জুম’আর সালাত আদায় করা হবে’। সেই অনুযায়ী মিম্বর তৈরী করে সত্যি সত্যিই জুম’আর সালাত অনুষ্ঠিত হয়। এটাই পারস্যের মাটিতে প্রথম জুম’আর সালাত। পরবর্তীতে হযরত সা’দ (রা) পারস্যের মাটিতে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি কুফার গভর্ণরও হয়েছিলেন।
হযরত ওসমান যখন বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হন তখন সা’দই (রা) তাঁকে রক্ষার জন্য সর্ব প্রথম এগিয়ে আসেন। হযরত ওসমান (রা) শহীদ হওয়ার পর যে বিশৃংখলা দেখা দেয় সা’দ (রা) নিজেকে তা থেকে দূরে রাখেন। তিনি সিফফিন ও জংগে জামাল কোনো যুদ্ধেই অংশ গ্রহণ করেননি। আসলে তিনি ছিলেন অসম্ভব শান্তিপ্রিয় মানুষ। এমন কি একবার তিনি তাঁর পুত্রকে আসতে দেখে বললেন আল্লাহ এ অশ্বারোহীর অনিষ্ট থেকে আমাকে রক্ষা করুন। ছেলে যখন এসে বললো, ‘আপনি উট ও ছাগলের মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন, অথচ এদিকে লোকেরা রাষ্ট্রীয় ঝগড়ায় লিপ্ত’। সা’দ (রা) পুত্র উমার (রা)-এর বুকে হাত রেখে বললেন, ‘চুপ করো, আমি রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি, আল্লাহ ভালবাসেন নির্জনবাসী, মুত্তাকী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় যে মানুষের রাগাবিরাগের পরোয়া করে না তাকে’।
পঁচাশি বছর বয়সে মদীনা থেকে দশমাইল দূরবর্তী আকীক উপত্যকায় তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালটা ছিল হিজরী ৫৫ সন। মদীনার সে সময়কার গভর্নর মারওয়ান তাঁর নামাযে জানাজা পড়ান। মৃত্যুকালে হযরত সা’দ (রা)-এর অছিয়ত মুতাবেক বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকালীন পরিহিত পুরানো জুব্বাটি দিয়েই তাঁর কাফন তৈরী করা হয়। যা প্রথমেই উল্লেখ করেছি।
হযরত সা’দ (রা)-এর নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস এতো গভীর ছিলোযে, মৃত্যুকালীন সময়ে তাঁর পুত্র মুসয়াবের চোখে পানি দেখে তিনি বললেন, ‘আমার জন্য কেঁদোনা। আল্লাহ কক্ষণো আমাকে শাস্তি দেবেন না, আমি জান্নাতবাসী। আল্লাহ মু’মিনদেরকে তাদের সৎকাজের প্রতিদান দেবেন এবং কাফিরদের সৎকাজের বিনিময়ে তাদের শাস্তি লাঘবন করবেন’।
হযরত সা’দ (রা) অত্যন্ত মর্যাদাবান একজন সাহাবা ছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদাসহ অন্যান্যা সাহাবারাও তাকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতেন। একবার একটি হাদীসের ব্যাপারে হযরত ওমর (রা)-এর ছেলে হযরত আবদুল্লাহ তাঁর আব্বার কাছে জানতে চাইলে, পিতা ওমর (রা) জিজ্ঞেস করলেন হাদীসটি হযরত সা’দ (রা) বর্ণনা করেছেন কি না, আবদুল্লাহ (রা) বললেন, ‘হা’। তখন ওমর (রা) বললেন, ‘সা’দ যখন তোমাদের নিকট কোন হাদীস বর্ণনা করেন তখন সে সম্পর্কে কারো কাছে কিছু জিজ্ঞেস করবে না’।
বিলাল (রা)-এর অনুপস্থিতিতে তিন বার হযরত সা’দ (রা) আযান দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এমনকি রাসূল (সা) নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘বিলালকে আমার সাথে না দেখলে তুমি আযান দেবে’।
প্রভূত সম্পদের মালিক হযরত সা’দ (রা) অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। অবশ্য প্রথম জীবনে তিনি দরিদ্র লোক ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমরা রাসূল (সা)-এর সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতাম, অথচ তখন গাছের পাতা ছাড়া আমাদের খাওয়ার কিছুই থাকতো না। গাছের পাতা খাওয়ার ফলে আমাদের বিষ্ঠা হতো উট ছাগলের বিষ্ঠার মতো’। কাব্য সাহিত্যের প্রতি হযরত সা’দ (রা)-এর প্রচণ্ড আকর্ষণ ছিলো। তিনি কবিতা রচনা করেছেন বলেও প্রমাণ মিলে। প্রাচীন বই পত্রে তাঁর কিছু কবিতা সংকলিত পাওয়া যায়।
এ অসম্ভব প্রতিভাধর ঈমানদার বুজর্গ সাহাবী ছিলেন ঐ সৌভাগ্যবান দশজন সাহাবীর একজন যাঁরা জীবিত থাকতেই বেহেশতের খোশ খবর পেয়েছিলেন।