ওমর খৈয়াম
ইরানের খোরাসান প্রদেশের রাজধানী নিশাপুর। সেখানে ১০৪৪ সালে জন্ম হয় গিয়াস উদ্দিন আবুল ফতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহীম। তিনি সমগ্র বিশ্বে ওমর খৈয়াম নামে পরিচিত। খৈয়াম তার বংশগত উপাধি। এই শব্দটির মানে হচ্ছে তাঁবু নির্মাতা বা তাঁবু ব্যবসায়ী। তার বংশের কেউ হয়তো এ কাজ করতেন। সেই থেকে খৈয়াম শব্দটি তাদের নামের সাথে সংযুক্ত হয়ে গেছে। ওমর খৈয়াম বিরাট পন্ডিত লোক ছিলেন। তিনি জ্ঞানের যে তাঁবু তৈরী করেছেন তাতে আশ্রয় নিয়ে বহুলোক পান্ডিত্য অর্জনে সক্ষম হয়েছেন।
ওমর খৈয়াম বিশ্বের অন্যতমসেরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি এক সাথে অংক শাস্ত্রবিদ, চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন। তিনি ও আবেগে চতুষ্পদী কবিতা লিখতেন। এসব কবিতা রুবাইয়াত নামে খ্যাত। ইউরোপের মানুষ তাকে কবি হিসেবে চেনে ও জানে। তার কবিতাগুলো তার ইন্তেকালের ৭৩৪ বছর পর ১৮৫৭ সালে এডোয়ার্ড ফিজারেল্ড ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করেন।
ফলে তিনি ইউরোপের লোক জনের কাছে কবি হিসেবে পরিচিত হন। ওমর খৈয়ামের মনের খেয়ালে রচিত কবিতা বিশ্বের সাহিত্য অঙ্গনে তাকে অন্যতম সেরা কবির আসনে সমাসীন করেছে।
ছোট বেলা থেকেই ওমর খৈয়াম খুবই মেধাবী ও বুদ্ধিমান। পড়াশুনার প্রতি তার গভীর মনযোগ তার অসামান্য সাফল্যের অন্যতম প্রধান কার। তাঁর স্মরণ শক্তি ছিল খুবই প্রখর। যেকোন দর্শন গ্রন্থ বা বিজ্ঞানের কঠিন ও জটিল গ্রন্থগুলো কয়েকবার পড়লেই তার মুখস্থ হয়ে যেত।
তার পারিবারিনক আর্থিক অবস্থা ভল ছিল না। জ্ঞান চর্চার জন্য আমীর আবু তাহির তাকে কিছু আর্থিক সহায়তা কনে এবং রাজ্যের সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন। ফলে তার আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভাল হয়। রাষ্ট্রীয় সাহায্য পেয়ে তিনি ভোগ বিলাসে তা’ ব্যবহার করেননি। তিনি রাষ্ট্রীয় সাহায্য জ্ঞান ও সাধনা গবেষণার কাজে ব্যবহার করেন। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল জ্যোতিবির্জ্ঞান, বীজগনিত ও জ্যামিতি। দর্শন শাস্ত্রে তিনি ছিলেন মস্তবড় পন্ডিত। এত বড় পন্ডিত হয়েও তার মনে কোন অহংকার ছিল না। বরং মনের মধ্যেছিল আল্লাহর ভালবাসা। তিনি প্রতিটি কাজে কর্মে আল্লাহর স্মরণ রাখতেন। একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য তার জীবনের মুল্যবান সময় অতিবাহিত করেন। জ্ঞান চর্চার প্রতি তিনি এতই মনোযোগী ছিলেন যে কোন বই হাতে পেলেই তা তিনি পড়ে শেষ করতেন।
ওমর খৈয়াম ছিলেন সে যুগের সেরা বিজ্ঞানী। সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের অনুরোধে তিনি রাজকীয় মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই এর মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। এসময় সুলতান তাকে একটি সঠিক সৌরবর্ষপঞ্জি তৈরীর অনুরোধ জানান। ওমর খৈয়াম মাত্র ৭জন সহকর্মী বিজ্ঞানী নিয়ে অতি অল্পদিনে সাফল্যের সাথে ও নিখুঁতভাবে একটি সৌরপঞ্জি চালু করেন। তিনি সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের নাম অনুসারে এর নাম দেন আততারিখ আল জালালী অব্দ। এই জালালী বর্ষপঞ্জিতে ৩৭৭০ বছরে মাত্র ১দিনের ভ্রান্তি ছিল। আর গ্রেগরীয়ান বর্ষপঞ্জিতে ভ্রান্তি ছিল ৩৩৩০ বছরে মাত্র ১দিন। জালালী অব্দ হিজরী ৪৭১ সালের ১০ই রমজান থেকে শুরু হয়। ওমর খৈয়াম একটি নতুন গ্রহও আবিস্কার করেন।
বীজগনিতেই ওমর খৈয়ামের অবদান বেশী। তিনিই প্রথম বীজগণিতের সমীকরণ গুলো শ্রেণী বিন্যাসের চেষ্টা করেন। জ্যামিতির সমাধানে বীজগণিত এবং বীজগণিত সমাধানে জ্যামিতি পদ্ধতি তারই অভূতপূর্ব আবিষ্কার। ভগ্নাংশীয় সমীকরণের উল্লেখ ও সমাধান করে ওমর খৈয়াম সর্বপ্রথম বীজগণিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। তাঁর বীজগণিত সম্পর্কিত গ্রন্থের নাম ‘ফি আল জাবের’ ওমর খৈয়াম সর্বপ্রথম বীজগণিতের ক্ষেত্রে বাইনোমিয়াল থিউরাম’ আবিষ্কার করেন। অথচ নিউটনকে এর আবিষ্কারক মনে করা হয়। তাঁর শত শত বছর আগে বিজ্ঞানী ওমর খৈয়ামই প্রথম তা আবিষ্কার করেন।
গণিতে ওমর খৈয়ামের অবদান কম নয়। গণিত শাস্ত্রে এনালিটিক জিওমেট্রিক কল্পনা তিনিই প্রথম করেন। পরে সপ্তদশ শতাব্দীতে একজন গণিতবিদ একে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। এছাড়া পদার্থ বিজ্ঞানেও তার অবদান রয়েছে। ওমর খৈয়ামের মেধা ও চিন্তা শক্তি অনেক গভীর ছিল। একদিন ইমাম গাজ্জালী (র) ওমর খৈয়ামকে প্রশ্ন করলেন, কোন গোলক যে অংশের সাহায্যে অক্ষের উপর ঘুরতে থঅকে, গোলকের সমস্ত অংশ এক প্রকার হওয়া সত্ত্বেও এ অংশটি অন্যান্য অংশ থেকে কিভাবে আলাদা রূপে জানা সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাবে ইমাম গাজ্জালী (র) সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, সত্যের সন্ধঅন পেয়ে মিথ্যার যবনিকা অপসারিত হল। এর আগে এ বিষয়ে আমার ধারণা সঠিক ছিল না।
ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বহু গ্রন্থ রচনা করেন যান। তিন বিভিন্ন বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
১। রুবাইয়াত (মরমী কবিতা) ২। মিজান-উল-হিকাম (রসায়ন বিজ্ঞন) ৩। নিজাম উল-মূলক (রাজনীতি) ৪। আল জাবরা ওয়াল মুকাবিলা (বীজগণিত), ৫। মুশকিলাত (গণিত শাস্ত্র) ৬। নাওয়াযিম আসবিনা (ঋতুপরিবর্তন বিষয়ক) ৭। আল কাউল ওয়াল তাকলিক (মানুষের নৈতিক দায়িত্ব) ৮। রিসালা মুকাবাহ ৯। তার ইলমে কুল্লিয়াত ১০। নওরোজ নামা।
ওমর খৈয়াম যেমন পন্ডিত ছিলেন- তেমনিই আল্লাওয়ালা লোক ছিলেন। তিনি নিজের প্রচার করতেন না। সাদাসিধেভাবে জীবন কাটাতেন। এর ফলে তার দেশের লোকেরাও তাকে চিনতে পারেনি। তিনি যে কত বড় জ্ঞানী লোক তা অনেকেই জানতনা
বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী ওমর খৈয়াম ১২২৩ খৃস্টাব্দে ৭৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার ছাত্রদের শেষ বারের মত বিশেষ উপদেশে দানের জন্য আহবান জানান। এরপর তিনি ভালভাবে ওজু করেন এবং এশার নামায আদায় করেন। এসময় তিনি ছাত্রদের নসিহত করার কথা ভুলে যান। নামাজের শেষের সেজদায় গিয়ে তিনি কাঁদতে থাকেন। আর জোরে জোরে বলতে থাকেন, হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে মাফ চাচ্ছি। তোমার দয়া ও করুনার গুণে আমাকে মাফ করে দাও। এরপর তিনি আর মাথা তোলেননি। সেজদা অবস্থাতেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (র)
বিশ্বের অন্যতম সেরা সাধক কবি জালাল উদ্দিন রুমী (র) এর পিতার নাম বাহাউদ্দিন ওয়ালিদ। তিন ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত কবি ও দরবেশ। িইরানের রুম দেশের অন্তর্গত কুনিয়ার শাসক আলাউদ্দিন কায়কোবাদ দরবেশ বাহাউদ্দিনকে কুনিয়ায় আসার দাওয়াত দেন। দাওয়াত পেয়ে বাহাউদ্দিন সপরিবারে কুনিয়ায় চলে আসেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। রুম প্রদেশের নাম অনুসারে জালাল উদ্দীন রুমী নামে খ্যাতি লাভ করেন।
জালালউদ্দিন ১২০৭ খৃষ্টাব্দে ২৯শে সেপ্টেম্বর বলখ নগরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে অলৌকিক বিষয় দেখা যেত। তিন খেলাধুলা ও আমোদ প্রমোদে লিপ্ত থাকা পছন্দ করতেন না। বরং ধর্মীয় আলোচনা পছন্দ করতেন। ৬ বছর বয়স থেকে রোজা রাখতে শুরু করেন। ৭ বছর বয়সে তিনি সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এ সময় তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো।
৬ বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে ভ্রমনে যান। নিশাপুর গিয়ে বিখ্যাত কবি ও সুফী সাধক শেষ ফরিদ উদ্দিন আত্তারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। শেষ ফরিদ উদ্দিন আত্তার বালক জালা উদ্দিনের চেহারা দেখে তার উজ্জল ভবিষ্যত বুঝতে পেরে তার জন্য দোয়া করেন। তিনি তার প্রতি বিশেষ নজর রাখার জন্য পিতার প্রতি উপদেশ দেন। নিশাপুর ভেড়ে পিতা বাহাউদ্দিন পুত্র জালাল উদ্দিনকে সাথ নিয়ে হজ্ব পালন করেন। পরে বাগদাগ সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেন। এ সফর কালে পিতা পুত্রকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দান করেন।
১২৩১ সালে বাহাউদ্দিন ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুতে জালাল উদ্দিন ভেঙ্গে পড়লেন। এর ফলে তার পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটে। পিতার মৃথ্যুর আগে মাও ইন্তেকাল করেছিলেন। ফলে তিনি একদম ইতিম হয়ে পড়েন। এ সময় তার পিতার ছাত্র ও মুরিদ সৈয়দ বোরহান উদ্দিন তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনি জালাল উদ্দিনকে আবার পড়া লেখায় নিয়োজিত করলেন। তিনি তাঁকে ৭/৮ বছর পর্যন্ত শিক্ষাদান করেন।
উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য তিন চলে যান সিরিয়ায়। দামেস্কে গিয়ে তিনি সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ বছর পড়ালেখা করেন। িএরপর ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত জ্ঞানের সন্ধানে তিনি নানান দেশে যান। যেসব বিখ্যাত সাধক ও পন্ডিতদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয় তাদের মধ্যে ছিলেন, সাধক শামসুদ্দিন তাব্রীজ (র) ইবনে আল আরাবী (র) সালাউদ্দিন ও হুসামউদ্দিন। এসব ব্যক্তি তার সময়ের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও সাধক ছিলেন।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে জ্ঞানীরূপে গড়ে তোলেন। বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার লোক তাঁর কাছে আসতে থাকে। তিনি তাদের শিক্ষা দান করেন। তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল, মসনবী ও দিওয়ান। এ দু’টি গ্রন্থ তাকে অমর করে রেখেছে। বাংলা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় এই মসনবীর অনুবাদ হয়েছে।
ৈইরানে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের পর মসনবীকে যথার্থ পথ প্রদর্শক বলে মনে করা হয়। দিওয়ানে রয়েছে ৫০ হাজার শ্লোক। এগুলো সবই আধ্যাত্মিক গজর।
জালাল উদ্দিন ছিলেন মহাপন্ডিত। একই সাথে তিনি তাঁর মাবুদ আল্লাহ পাককে সঠিকভাবে চিনতে পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি যুক্তি তর্ককে প্রাধান্য দেননি। বরং বিশ্বাস ও ভক্তির উপর জোর দিয়েছেন। তিনি স্রষ্টাকে ভালবাসার মাধ্যমে পেতে চেয়েছেন। আর সেভাবেই তাকে তিনি লাভ করেছেন।
খোদাকে চেনার জন্য জ্ঞানকে বলা হয় ইলমে মারেফাত। আর খোদার দেয়া বিশেষ জ্ঞানকে বলা হয় ইলমে লাদুনি। এই জ্ঞান থাকতেল যেকোন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। জালাল উদ্দিনের মধ্যে এ দুটি জ্ঞানই পুরা মাত্রায় ছিল।
মানুষের দেহ মানবাত্মা ও আল্লাহর মধ্যে মিলনের সবচেয়ে বড় বাধা। দেহের মধ্যে যে কামনা ও বাসনা রয়েছে তা মানুষকে সব সময় সত্যপথ থেকে আলাদা করে দেয়- যা মানুষকে ব্যক্তিত্ব বা অহংকার প্রদান করে এবং তাকে ভোগ করার লিপ্সায় মত্তা করে দেয়। এই জৈব আকাংখার নাম নফ্স। নফস কে ধ্বংস করলে দেহের কর্তৃত্ব আর থাকে না। এর ফলে আত্মার স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করে। তাই নফসের বিরুদ্ধে মানুষকে আজীবন সংগ্রাম করে যেতে হয়। জালালউদ্দিনও তার সারাটা জীবন নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন।
জালাল উদ্দিন মনে করতেন বুদ্ধি, যুক্তি ও ভক্তি এক নয়। বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আল্লাহকে চেনা বোঝা ও পাওয়া যায় না। এর জন্য প্র্রয়োজন বিশ্বাস ও ভক্তি। ভক্তি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ভালবাসার পথ। আর ভক্তির উৎস হল প্রেম ও আসক্তি। তাঁর মতে আল্লাহকে বুঝতে ও চিনতে হলে ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রয়োজন। তাহলেই মনদিয়ে আল্লাহকে বুঝতে পারবে। মানুষ যখন মারেফাতের উঁচু স্তরে উঠে তার নিজের মধ্যে আল্লাহর প্রকাশ অনুভব করে তখন তার ব্যক্তিত্বের সীমারেখা কোথায় ভেসে চলে যায়। তিনি তখন সসীম হয়েও অসীমের ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। অন্য কথায় বলা যায় তিনি নিজের সীমার ভেতরেই অসীমের সন্ধান পান। তখন তিনি চরম আনন্দ লাভ করেন। এ সময় পৃথিবীর সকল ধন ঐশ্বর্য্য ও তার কাছে আসার বলে মনে হয়। মারেফাতের স্তর আর বাড়লে এমন এক পর্যায়ে আসে যখন মানুষের আত্মা ও আল্লাহর মধ্য আর কোন ভেদাভেদ থাকে না। অবস্থার নাম হল- হাল। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীই এসব কথা মানুষকে জানিয়েছেন। এই পৃথিবীতে থেকে মানুষের দেহ বজায় রেখে বান্দ কিভাবে আল্লাহ পাকের সাথে মিলে যেতে পারে তার নজিরও তিনি দেখিয়েছেন।
তিনি ভাগ্য ও পুরষ্কার সমস্যার সহজ সমাধান দিয়েছেন। তিনি বলেন, মানুষের সব কাজের নিয়ন্ত্রণ কারী আল্লাহ। আল্লাহ মানুষকে কতগুলো কাজের স্বাধীনতা দিয়েছেন। মানুষ এসব বিষয়ে নিজেই তার কর্মপন্থা নির্ধারনের অধিকার রাখে। এসব কাজের ফলাফলের জন্যও মানুষ দায়ী। কারণ এগুলো করা বা না করার এখতিয়ার মানুষকে দেয়া হয়েছে। অবশ্যই কর্মকরার শক্তি আল্লাহই তাকে দিয়েছেন। জালাল উদ্দিন এসব বিষয় সুন্দরভঅবে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। তিন নিজেও যেমন পন্ডিত ছিলেন তেমনিই ছিলেন মহাসাধক। তিনি ছিলেন খোদার প্রেমে পাগল মহান এক ব্যক্তি।
জালালউদ্দিন সাদাসিধে ভাবে চলাফেরা করতেন। যতটুকু না হলে চলে না ততটুকুই তিনি ব্যবহার করতেন। কোন কিছুতেই তার চাকচিক্য বা জাঁকজমক ছিল না। তিনি দুনিয়ার ধন সম্পদ আর মালসামানাকে কোন গুরুত্ব দিতেন না। ভোগ বিলাস তো দূরের কথা। তিনি প্রয়োজনের চেয়ে সামান্য বেশী সম্পদও গ্রহণ করতেন না। তিন খোদাকে চেনা ও জানার এবং তার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এ কারণে তার কাছে দুনিয়অর যাবতীয় সম্পদ তুচ্ছ বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার ইন্তেকালের সময় তার সঞ্চিত কোন ধন সম্পদ ছিল না।
সারা জীবনতিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং সে জ্ঞান অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করেছেন। এভাবে ৬৬ বছর বয়সে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জালাল উদ্দিন অসুস্থ। একথা সর্বত্র করেছেনকভ রাষ্ট্র হয়ে পড়লো। এর ফলে তার অগনিত ভক্ত চারদিকে থেকে ছুটে আসল তার কাছে। সে যুগের বড় বড় চিকিৎসকরা স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলন তার চিকিৎসা করতে। এদের মধ্যে চিলেন বিখ্যাত চিকিৎসক শেখ সদরুদ্দিন, আকমল উদ্দিন ও গজনফার। কিন্তু তারা ব্যর্থ হলেন। তাদের চিকিৎসা েএই খোদা প্রেমিকের দেহে কোন কাজেই এল না। এ সময় জালালউদ্দিন চিকিৎসক শেখ সদরুদ্দিকে লক্ষ্য করে বললেণ, আশেক ও মাশুকের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে একটি মাত্র পর্দার। আশেক চাচ্ছে তার মাশুকের কাছে চলে যেতে। পর্দাটা যেন দ্রুত উঠে যায়। শেখ সদরুদ্দিন বুঝতে পারলেন, জালালউদ্দিন এই পৃথিবী ছেড়ে আল্লাহর সাথে মিলিত হতে চাচ্ছেন। তাঁর আয়ু শেষ হবার পথে। জালাল উদ্দিন তার মাশুক আল্লাহর কাছে চলে যাওয়া প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় তিনি তার ভক্ত মুরিদদের সান্তনা দদিয়ে কিছু উপদেশ দিলেন।
তিনি বললেন, নিজের মন মত চলা বাদ দিতে হবে। পাপ পথ ছাড়তে হবে। নামাজ ও রোজা কখনো কাযা করা যাবে না। মনের মধ্যেও যেমন আল্লাহর ভয় রাখতে হবে তেমনিই বাইরেও আল্লাহর ভয় থাকতে হবে। বিপদ এলে সবর করতে হবে। বিদ্রোহ ও প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা রাখা চলবে না। ঘুম একথা বলার ব্যাপারে সংযম অবলম্বন করতে হবে। কাউকে কোন রকম কষ্ট দেওয়া যাবে না। সব সময় সৎ লোকদের সাথে থাকতে হবে। যার দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যাণ হয় সে রকম মানুষই শ্রেষ্ঠ। তিনি আরো বলেন, মানুষের দেহ নশ্বর। কিন্তু তার আত্মা অবিনশ্বর। দেহ ধ্বংস হবে। কিন্তু আত্মা বা রুহের কোন ধ্বংস নেই। জালালউদ্দিন ১২৭৩ খৃষ্টাব্দে ১৬ই ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন।
ইমাম গাজ্জালী
প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) এরপর আর কোন নবী রাসূল আসবেন না। যুগে যুগে পথ হারা মানুষের সামনে আদর্শবাদী ও সুন্দর চরিত্রের মানুষ আসবেন। তারা মহানবীর উম্মতের মধ্য থেকেই আসবেন। তারা নতুন কোন ধর্ম বা আদর্শ প্রচার করবেন না। বরং ইসলারেম সত্যকেই নিজেদের জীবন দিয়ে সকলের সামনে সুন্দরভাবে তুলে ধরবেন। তাদের চরিত্র ও স্বভাব হবে মার্জিত, আকর্ষণীয় ও অনুপম। তাদের চরিত্র, স্বভাব ও জীবন যাত্রা দেখে কোটি কোটি মানুষ ফিরে আসবে সত্য ও ন্যায়ের পথে। ইমাম গাজ্জালীও ছিলেন তাদেরই একজন।
সেটা ছিল একাদশ শতাব্দী। এ সময় মানুষ অশিক্ষা, সুশিক্ষা, কুসংস্কার ও নানা পাপ কাজে লিপ্ত হতে শুরু করে। অপর দিকে শিক্ষিত যুব সমাজ পাশ্চাত্যের অমুসলিম দার্শনিকদের ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে ইসলামের সত্য পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল্ এসময় সত্য ও সুন্দরের ঝান্ডা নিয়ে আলোর মশাল হাতে করে এগিয়ে এলেন মুজাহিদ ইমাম গাজ্জালী (র)।
ইরানের একটি প্রদেশের নাম খোরাসান। এই খোরাসানে তুস নগরীতে ১০৫৮ খৃষ্টাব্দে ইমাম গাজ্জালী জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম গাজ্জালীর আসল নাম আবু হামেদ মোহাম্মদ গাজ্জালী। কিন্তু সকলের কাছে তিনি ইমাম গাজ্জাীল নামেই পরিচিত। ‘গাজ্জাল’ শব্দের মানে হচ্ছে সুতা কাটা। এটা তার বংশগত উপাধি। সম্ভবত তাঁর পিতা বা তাদের বংশকে গাজ্জালী বলেই ডাকতো।
এমাম গাজ্জালীর পিতা ছিলেন গরীব। এর উপর শৈশবেই তিনি পিতাকে হারান। তাঁর মা অনেক কষ্ট করে তাকে লাল পালন করেন। পিতার ইন্তেকালে তিনি এতিম হয়ে পড়লেও মনের সাহস হারাননি। জ্ঞান লাভের প্রতি ছিল তার খুবই আগ্রহ। জ্ঞান অর্জনের সাধনায় তিনি খাবার দাবার বা ভাল পোষাকের প্রতি কোন খেয়াল করেননি।
সে সময় দু’জন আলেম জ্ঞান সাধক হিসেবে বিখ্যাত হন। িএদের একজন হলেন হযরত আহমদ ইবন আহমদ ইবনে মুহাম্মদ বারকারী এবং অপরজন হচ্ছেন হযরত আবু নসর ইসমাইল। আবু হামেদ এই দুই শিক্ষকের কাছে কোরআন, হাদীস, ফেকাহ ও বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু তিনি এতেও সন্তুষ্ট হলেন না। আরো জ্ঞান অর্জনের জন্য পাগল পারা হয়ে ছুটলেন নিশাপুরের নিযামিয়া মাদ্রাসায়। সেকালে এই নিশাপুর ছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের পীঠস্থান। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল ছিলেন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবদুল মালিক (র)। আবু হামেদ তাঁর নিকট ইসলামী দর্শন, আইন ও নানান বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন।
আবদুল মালিকের ইন্তেকালের পর আবু হামেদ চলে আসেন বাগদাদে। এখানে ছিল বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তিনি িএকটিতে অধ্যাপনা শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি গবেষণা চালাতে থাকেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার সুনাম আর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
কিন্তু তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেছেন তার মধ্যেই নিজেকে দৃপ্দ তরদে পারলেন না। সর্বদাই তার মনে একটা ব্যকুলতা একটা অতৃপ্তি-তিনি মহান আল্লহপাককে এখনো পাননি। তাকে গভীর ভাবে পাওয়ার জন্য তিনি সুখের চাকরী ছেড়ে দিলেন। কষ্ট আর দুঃখের পথে বের হয়ে পড়লেন। এ পথে যাওয়ার জন্য কেউ তার সামনে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। ধন-সম্পদ ঘর বাড়ী কোন কিছুই তাকে বেধে রাখতে পারেনি। দশটি বছর তিনি আপন ভোলা খোদা প্রেমিক দরবেশের মত ঘুরে বেড়ান নানান দেশে। এ সময় আল্লাহর এবাদত জিকির, আজকার, মোরাকাবা, শিক্ষাদান ও জ্ঞান অর্জনের মধ্যদিয়ে তার সময় কাটাতে থাকেন। জেরুজালেম থেকে মদীনায় যান। প্রিয়নবীর মাজার জিয়ারত করে মক্কায় চলে আসেন। সেখানে হজ্ব পালন করেন। পরে আলেকজান্দ্রিয়ায় যান। বেশ কিছুদিন সেখানে থাকেন। পরে ফিরে আসেন মাতৃভমি ইরানে।
আবু হামেদ সত্যিকার জ্ঞানী ছিলেন। তিনি আল্লাহর পরিচয় ও সৃষ্টি রহস্য খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন আত্মা বা রুহ সৃষ্টি রহস্য আর আল্লাহর অস্তিত্ব বৈজ্ঞানক যুক্তিতর্ক দিয়ে মীমাংসা করা যাবে না। েএরকম চেষ্ট করা নির্বোধের কাজ এবং তা’ অন্যায়। তিনি সকল প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন কোরআন, হাদিস দ্বারা। এছাড়া কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে গবেষণা চালিয়ে তিনি অনেক প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন।
আল্লাহর প্রতি সুগভীর বিশ্বাস ও দ্বীন ইসলামের প্রতি তার আস্থা ছিল পর্বতের মত অটুট। ধর্ম ও দর্শনে আবু হামেদ ছিলেন মহাপন্ডিত। তার পরেও তিনি ছিলেন বিনীয় ও নম্র। তিনি বলেন, আত্মা কখনো ধ্বংস হয় না, বরং দেহ ধ্বংস হয়। মৃত্যুর পরেও আত্মা জীবিত থাকে। কলব বা হৃদপিন্ডের সাথে আত্মার কোন সম্পর্ক নেই। হৃদপিন্ত একটা মাংসপিন্ড ছাড়া আর কিছু নয়। মৃত্যুর পরেও দেহে এর অস্তিত্ব থাকে। কিন্তু আত্মা মৃতদেহে থাকে না। মৃত্যুর পর আত্মার পূর্ণ উৎকর্ষ ও মুক্তি সম্ভব হয়। আবু হামেদ জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শের সঠিক রূপায়ন ঘটিয়েছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনটি গ্রহনীয় আর কোনটি বর্জনীয় তা’ তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। যা চিরন্তন সত্য ও বাসতব সেখানে তিনি যুক্তিকে প্রাধান্যি দিতেন না। বরং সেক্ষেত্রে তিনি ভক্তি ও অনুভূতির প্রতিই গুরুত্ব দিতেন বেশী।
আবু হামেদ অংকশাস্ত্র ও জ্যোতিবিজ্ঞানে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিন নক্ষত্র সমূহের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে ২টি গ্রন্থ রচনা করেন। িএছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় চার হাজার গ্রন্থ রচনা করেন। তার বেশীর ভাগ গ্রন্থ ইউরোপে ল্যাটিন হিব্রু ও ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তার লেখা গোটা ইউরোপে অসাধারণ প্রবাব বিস্তার করে। তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে (১)এহিয়া উল উলুমুদদীন (২) কিমিয়ায়ে সায়াদাত বা সৌভাগ্যের পরশমনি। (৩) কিতাবুল মানফিদলিন আদদালাল (৪) কিতাবুত তাকাফাতুল ফালাসিফা (৫) মিশকাতুল আনোয়ার (৬) ইয়াক্কুত্তাবলিগ (৭) মনখুল। এসব বই ইউরোপে অনুদিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আবু হামেদের এসব গ্রন্থ ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান ও সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছে। এর ফলে সে সময় মুলমান যুব সমাজ সঠিক পথের সন্ধান লাভে সক্ষম হয়।
আবু হামেদ সর্বদা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতেন। আল্লাহকে পাবার জন্য তিনি ঘরবাড়ি ছেড়েছেন। আল্লাহকে খুশী করার জন্র তিনি সারাটা জীবন দেশ বিদেশে আত্মহারা হয়ে ঘুরেছেন। মৃত্যুই বান্দা ও আল্লাহর মধ্যকার পর্দাকে সরিয়ে দেয়। তিনি তার মৃত্যুর আগমনবার্তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই যেদিন তার পৃথিবী ছাড়ার সময় হল তিনি তা বুঝতে পারলেন। সেটা ছিল ১১১১ খৃঃ। তার কোন অসুখ ছিল না। বরং সুস্থই ছিলেন তিনি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে তিনি ফজরের নামাজ আদায় করেন। িইতোপূর্বে কাফনের কাপড় নিজ হাতে তৈরী করেছিলেন। সে কাপড়টি বের করে বললেন, হে আল্লাহ, তুমি আমাকে মাফ করে দাও। তুমি তো রহমান ও রাহীম। হে আল্লাহ একমাত্র তোমাকে পাবার জন্য এবং তোমাকে চেনার জন্যই আমি সব আরাম আয়েশ ছেড়ে পথে পথে ঘুরে ফিরেছি বছরের পর বছর পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তুমি আমাকে মাফ করে দাও।
এরপর তিনি কাফনের কাপড় পরেন ও ইন্তেকাল করেন। তিনি পৃথিবী ছেড়ে গেলেও চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন সত্য ও সুন্দরের সাধক মানুষের কাছে।