মহাকবি হাফিজ
ইরানের সিরাজনগরী। বাহাউদ্দিন সিরাজ এর অধিবাসী। তিনি একজন ব্যবসায়ী। তার ঘরে জন্মগ্রহণ করে এক ফুটফুটে ছেলে। চেহারা যেন সূর্যের আলোর মত উজ্জ্বল। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। পিতা আদর করে নাম রাখলেন শামসুদ্দীন। অর্থাৎ দ্বীনের সূর্য্য। তাদের পরিবারটি ধর্মকর্মে নিষ্ঠাবান। ইসলারেম যাবতীয় হুকুম আহকাম সঠিকভাবে মেনে চলেন। একারণে পিতার মনের ইচ্ছা এই ছেলে শুধুমাত্র চেহারা সুরতে সুন্দর হলেই চলবৈ না, বরং তাকে হতে হবে একজন সত্যিকার জ্ঞানী লোক। যিনি আল্লাহকে চিনতে পারবেন আর নেক আমলের দ্বারা দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণ ও মঙ্গল করবেন।
শামসুদ্দিনের পরিবারের সকলেই নামাজ রোজা ও অন্যান্য এবাদত বন্দেগীতে পাকা ছিলেন। তিনি এই পরিবেশেই বড় হতে থাকেন। ছোড় বেলাতে তাকে কুরআন পড়তে পাঠানো হয়। তিনি অল্প দিনেই তা মুখস্থ করে ফেলেন। এ কারণে তাকে সকলে হাফিজ বলে ডাকতো।
শামসুদ্দিনকে শিক্ষালাভের জন্য বিদ্যালয় ভর্তি করা হয়। তিনি কম সময়ের মধ্যে আরবী ও ফারসী বাষায় গভীর জ্ঞঅন অর্জন করেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন খুবেই বুদ্ধিমান ও মেধাবী। হঠাৎ করে তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ফলে তাকে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হয়। দারিদ্রের কারণে তার পক্ষে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হল না। বাধ্য হয়ে তাকে অর্থ উপার্জনের দিকে মনযোগ দিতে হল। তিনি সিরাজনগরে একটি নব প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান শুরু করেন। দীর্ঘদিন এখানে তিনি শিক্ষকতা করেন। এসময় তিনি গজল ও কবিতা রচনা করতেন।
একবার তিনি ‘বাবা কোহী’ নামের এক বিখ্যাত দরবেশের মাজারে যান। সেখানে তিনি নীরবে আল্লাহপাকের কাছে নিজের দুরবস্থা ও দুঃখের কথা প্রকাশ করলেন। এ সময় তার চোখ থেকে অশ্রু বের হতে লাগল। তিনি পরদিন রাতে স্বপ্ন দেখলেন, একজন দরবেশ যেন তাকে কিছু খেতে দিলেন। তিনি তা’ খেলেন। এরপর দরবেশ তাকে বললেন, যাও এখন হতে সব দরজাই তোমার জন্র খোলা। পরদিন সকালেই তিনি অবিশ্বাস্য একটি সুন্দর গজল রচনা করলেন। চারদিকে তার গজলের প্রশংসা শুরু হল। এরপর তিনি জনগণের কাছে কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। সারা েইরানে তার সুখ্যাতি ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
তাঁর আসল নাম শামসুদ্দিনের কথা লোকে ভুলে গেল। সকলেই তাকে হাফিজ বলেই চেনে। তিনি সহজ সরল জীবন যাপন পছন্দ করতেন। রাজকীয আড়ম্বর মোটেই পছন্দ হত না। এজন্য রাজাবাদশাহদের কাছ থেকে দূরে থাকতেন। একবার বাগদাদের খলিফা সুলতান আহমদ তাকে রাজ দরবারে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু তিনি কবিকে পেলেন না। এতে ক্ষুব্ধ হলেও তিনি অবিবেচক ছিলেন না। তাই উপহার সামগ্রী হাফিজের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলেন।
কবি হাফিজের কবিতায় রয়েছে জ্ঞানের অতুলনীয় রত্নভান্ডার। বিশ্ব প্রকৃতি ও মানব জীবনের গভীর রহস্য তার কবিতার প্রতিটি বাক্যে ফুটে ওঠেছে। েএর মধ্যে দেওয়ান-ই হাফিজ’ দুনিয়া জোড়া সাড়া জাগানো এক পুস্তক। হাফিজ মূলতঃ গীতি কবিতা লিখতেন। এর মধ্যে কোনটা সনেট জাতীয় আবার কোনটা গজল। দেওয়ান-ই হাফিজ’ এর কবিতা ও গজল গুলো যেন প্রেমের এক অমর কাব্য। কবি তার জীবন কালে তার লেখাগুলো একত্রিত করে যাননি। জনপ্রিয় গজল হিসেবে সেগুলো মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত। তার বন্ধু গুল আন্দাম সেগুলো সংগ্রহ ও সংকলন করেন। এর সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।
কবি হাফিজ যখন যুবক। তার গজল ও কবিতা রচিত হবার পর পরেই তা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বিশেষ করে যুবক ও তরুনরা কবির এসব কবিতার ভক্ত। সিরাজনগরীতে শাখে নাবাত নামে এক সুন্দরী মহিলা থাকতেন। তিনি হাফিজের কবিতা পড়ে তার প্রেমে পড়ে যান। কবি হাফিজ একথা জানতে পেরে তাঁকে দেখেন এবং পছন্দ করে বিয়ে করেন। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখেই কাটছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কবি পত্নী ইন্তেকাল করলেন। এর ফলে কবির হৃদয় রাজ্যে তুমুল ঝড় সৃষ্টি হয়। হতার জীবন দুঃখ কষ্টে ভরে যায়। এরপর কবি আর বিয়ে করেননি।
হাফিজ জীবিত কালই অনেকের বিরাগভাজন হন। তারা তার নামে নানান অপপ্রচার চালায়। কবিও তার নিন্দুকদের প্রতি কটাক্ষ করে কবিতা রচনা করেন। হাফিজ সে সময় প্রচলিত অনেক রীতিনীতিকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি যুক্তি তর্ক দিয়ে সে সবের সমালোচনা করতেন। অনেকে তার এসব সমালোচনা পছন্দ করত না।
কবি তার পত্নী শাখে নাবাতাকে গভরভাবে ভালোবাসতেন। পত্নীর স্মরণে তিনি রচনা করেছেন বহু প্রেমের কবিতা ও গজল। তার স্মৃতিকে ধরে রেখে তিনি বাকী জীবনটা কাটিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, তোমার ভালবাসা আমার মন ও প্রাণের কাষ্ঠফলক থেকে কখনো মুছে যাবার নয়। তোমার প্রেমের মাধুরী আমার স্মৃতি হতে কখনো দূরীভূত হবার নয়।
কবির আরো বলেন, তোমার প্রেম আমার মনপ্রঅণ এমন ভাবে অধিকার করে বসেছে যে আমার মাথাও যদি কেটে নেয় তথাপি আমার প্রাণ হতে তোমার ভালবাসা আলাদা হবে না।
সে যুগে ধর্মের নামে অনেকে বাড়াবাড়ি করতেন। সে যুগে প্রচলিত ৪টি মাজহাব কবি মানতেন না। তিনি খোদা প্রেমে বিভোর ছিলেন। তাই সহজভাবে তিনি নিজেকে সকল মাজহাব থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছেন। অনেকে তাকে জিজ্ঞেস করতো- আপনি কোন মাজহাবের মুসলমান। জবাবে তিনি বলেন,
নাহি হানাফী, শা’ফী, হাম্বলী মালেকী
প্রেম মম এক ধর্ম, অন্য কিছু নাজি জানি।
তিনি প্রেমের মাধ্যমে আল্লাহকে পেতে চাইতেন। এজন্য বাস্তব জীবনে নামাজরোজা ও ইসলামের অন্যসকল নিয়ম কানুন যথাযথভাবে পালন করতেন।
হাফিজ ১৩৮৯ সালে সিরাজনগরে ইন্তেকাল করেন। তবে ইন্তেকালের পর তার দাফন নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। কেউ কেউ কবির জানাজা পড়তে রাজী হলেন না। কবি নিজেকে পাপী মাতাল বলেছেন। এ কারণেই তাদের এই মনভাব। অথচ কবিতায় এসব শব্দ রূপক হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। মাতাল মদ খেয়ে নেশা করলেই হয় না। এ শব্দটি প্রেমের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। যেমন- তোমার প্রেমের শরাপ পানেস আমি হয়েছি মাতাল। এখানে শরাব বলতে মদ বোঝায় না আবার মাতাল বলতে মদ খোরকে বাঝায় না।
কবি হাফিজের লাশ পড়ে আছে। কিন্তু বিরোধ বেধেছে তিনি সত্যিকার খাঁটি মুসলমান কিনা তা নির্ধারণ করা নিয়ে। একদল বলছে, এতে কোন সন্দেহ নেই তিনি একজন ভাল মুসলমান। অপর দল তাঁকে প্রকৃত মুসলমান বলে মানতে রাজী নয়। এই বিরোধের ব্যাপারে শালিস বসলো। সিদ্ধান্ত হল, কোন এক ব্যক্তি কবির একটি কাব্য সংকলন খুলবেন যেখানে কবির ঈমানের সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাবে।
হাফিজের কাব্যগ্রন্থ খোলা হয়। সেখানে যে শ্লোকটি রয়েছে তা’তে সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। কবি লিখে গেছেন,
ফিরিয়ে দিওনা ক্ষোভ ভরে, চরন তোমার
হাফিজের জানাজা হতে
হতে পারে সেপাপ পঙ্কে নিমজ্জিত
কিন্তু জান্নাতে সে যাবে।
এরপর আর কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই মিলে মহা সমারোহে কবির জানাজা ও দাফন কাজ সম্পন্ন করলেন। সিরাজনগরের ৩ কিলোমিটা দূরে একটি গাছের নীচে তার কবর দেয়া হয়। পরবর্তীকালে মোগল সম্রাট বাবর সিরাজনগর দখল করে হাফিজের কবর সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেন। তিনি সেখোনে সমাধি স্তম্ভও নির্মাণ করান। সেখানে বহুমূল্যবান কালপাথরে কবির লেখা কিছু কবিতা খোদাই করে সমাধি স্তম্ভে লাগিয়ে দেয়া হয়। পারস্য সম্রাট খান জান্দ কবির মাজারের আরো সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেন। কবির সমাধির চারদিকে রয়েছে বাগান। হাফিজের প্রিয় সাইপ্রেস গাছ এ বাগানে শোভা পাচ্ছে।
বর্তমানে কবি হাফিজের নাম অনুসারে ঐ স্থানের নাম করণ করা হয়েছে হাফিজিয়া। কবি আজ চির নিদ্রায় শায়িত। বর্তমানে দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার লোক এসে মাজার জেয়ারত করে। কবির সমালোচকরা মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু কবির গজল ও কবিতা টিকে আছে। আজও মানুষ ভক্তিভরে দিওয়ান-ই-হাফিজ পাঠ করে। আজ জ্ঞানী গুণী ও পন্ডতরা কবির অমর ও শাশ্বত প্রেমের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে পড়েন।
আল বেরুনী
ইরানের একটি স্থানের নাম বেরুন। সেখানে জন্ম হয় আবু রায়হানের। সেটা ছিল ৯৭৩ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর। তাঁর আসল নাম ছিল আবু রায়হান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বেরুনী। ইতিহাসের তিনি বেরুনী নামে সবচেয়ে বেশী পরিচিত হন।
তাঁর বাল্যকাল কাটে বাদশাহ আবু মনসুর বিন আলী বিন ইরাকের তত্ত্বাবধানে। তাঁর নিযুক্ত শিক্ষকের কাছে তিনি পবিত্র কোরআন ও হাদিস শিক্ষা করেন। পরে জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখার নাম পরা পন্ডিতদের কাছে তিনি সকল বিষয়ে অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করেন। ২২ বছর পর্যন্ত শিক্ষালাভ করে তিনি বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হন।
আব্বাসীয় বংশের খলিফারা তখন মুলমানবিশ্বের নেতা ছিলেন। কিন্তু খলিফাদের অযোগ্যতা ও দুর্বলতার কারণে তাদের সাম্রাজ্যের গোলযোগ দেখা দেয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীন রাজাদের উদ্ভব হয়। এসময় খাওয়ারিজম প্রদেশেও দু’জন রাজা রাজত্ব করতেন। এদের একজন হলেন দক্ষিণাংশের আবু আবদুল্লাহ এবং উত্তরাংশের মামুন বিন মাহমুদ। আবু আবু আবদুল্লাহ আল বেরীন দেখাশুনা করতেন। ৯৫৫ খৃষ্টাব্দে মামুন বিন মাহমুদআবু আবদুল্লাহকে পরাজিত করে হত্যা করেন। এর ফলে তার রাজত্বও মামুনের হাতে চলে আসে। এর ফলে আল বেরুনী অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। তিনি খাওয়ারিজম ছেড়ে চলে যান। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তাকে অনাহারে আর অর্ধাহারে থাকতে হয়েছে। কিন্তু তিনি পথে নেছেন তাকে চলতেই হবে। এসময় জুরজানে পৌঁছে সেখানকার রাজা কাবুসের সুনজরে তিনি পড়েন। রাজা জানতে পারেন এই পথিক বিশ্ববিখ্যাত পন্ডিত আল বেরুনী। তাঁর নাম ধাম জানতে পেরে রাজা তাকে অনেক যত্ন করে নিজের দরবারে নিয়ে আসেন। রাজা কাবুস জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করতেন। তিনি জ্ঞানী ও পন্ডিতদের খুব পছন্দ করতেন।
রাজা কাবুস আল বেরুনীর জন্য ভাল থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। এখানে দিনগুলো তার সুখেই কাটতে থাকে। কিন্তুতিনি তার তত্ত্বাবধায়ক বাদশাহের কথা কখনও ভুলতে পারেননি। রাজা কাবুসের কাছে থাকাকালে তিন ‘আসারুল বাকিয়া’ ও তাজরী দু’শ শুয়াত’ নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ তিনি তার আমারুল বাকিয়া গ্রন্থটি রাজা কাবুসের নামে উৎসর্গ করেন।
খাওয়ারিজমের রাজা সুলতান মামুন বিন মাহমুদ জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধক ছিলেন। তিনি জ্ঞানীদের কদর করতেন। আল বেরুনীর কথা শুনে তাকে নিজের দরবারে পেতে চাইলেন। তার কাছে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠালেন। আল বেরুনী সুলতানের অনুরোধে ১০১১ খৃষ্টাব্দে মাতৃভূমি খাওয়ারিজমে ফিরে আসেন।সুলতান তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে আল বেরুনী জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা ও সাধনা চালিয়ে যেতে থাকেন। তিন মান মন্দির প্রতিষ্ঠা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেকষণ কাজ চালান। খাওয়ারিজমের তিনি ৬/৬ বছর পর্যন্ত ছিলেন। এ সময়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন।
গজনীর সুলতান মাহমুদ জ্ঞানী ও পন্ডিতদের খুব সম্মান করতেন। তাঁর শাহী দরবারে প্রতিদিন দেশ বিদেশে জ্ঞানী ও গুনীদের মধ্যে বিজ্ঞান ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হত। সুলতান মামুনের রাজদরবারের জ্ঞানী ব্যক্তিদের গজনীতে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। পত্র পেয়ে আল বেরুনী গজনীতে সুলতান মাহমুদের সঙ্গী হিসেবে ১০১৬ থেকে ১০১৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত গজনীতে ছিলেন। সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভার আক্রমণ করেন। আল বেরুনী সুলতান মাহমুদের সাথে কয়েকবার ভারতে আসেন। তিনি সে সময়কার ভারতের শিল্প, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের সমৃদ্ধি দেখে অবাক হন। পরবর্তীতে তিনি ১০১৯ থেকে ১০২৯ পর্যন্ত মোট দশ বছর ভারতে থাকেন। এ সময় ভারতের জ্ঞানী গুণী ও পন্ডিতদের সাথে তিনি ভূগোল, গণিত ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে মতের আদান প্রদান করেন। ভারত থেকে ফিরেই তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাবুল হিন্দ।’ সে সময়ের ভারতীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও ধর্মীয় নিয়ম কানুন জানার জন্যে এটি একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ।
বিখ্যাত পন্ডিত অধ্যাপত হামার নেহের আল বেরুনী সম্পর্কে বলেন, ভারতের জনগন ও সেদেশের সম্পর্কে আল বেরুনী গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। এর ফলে তিনি তার কিতাবুল হিন্দ গ্রন্থে একাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ভারতের সভ্যতা সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য প্রদান করেন।
আল বেরুনী ভার থেকে গজনীতে ফেরার কিছুদিন পরেই সুলতান মাহমুদ ইন্তেকাল করেন। তাঁর পুত্র মাসউদ ১০৩১ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। সুলতান মাসউদও আল বেরুনীকে খুবই সম্মান করতেন। এ সময় আল বেরুনী ‘কানুনে মাসউদী’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটি তাঁর সেরা বেই। সুবিশাল এই গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে, তৃতীয খন্ডে ত্রিকোনমিতি, চতুর্থখন্ডে আকৃতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান, পঞ্চম খন্ডে গ্রহ, দ্রাঘিমা, চন্দ্রসূর্যে্যর মাপ, ষষ্ঠ খন্ডে সূর্যের গতি, সপ্তম খন্ডে চন্দ্রের গতি অষ্টম খন্ডে চন্দ্রের দৃশ্যমা ও গ্রহণ, নবম খন্ডে স্থির নক্ষত্র, দশমখন্ডে ৫টি গ্রহ নিয়ে েএবং একাদশ খন্ডে জোতিষ বিজ্ঞান নিয়ে আলেঅচনা করা হয়। গ্রন্থটি সুলতান মাসউদের নামে নামকরণ করায় তিনি খুশী হন ও বহু মূল্যবান পৌপ্যমুদ্রা উপহার দেন। আল বেরুনী সেসব রৌপ্য মুদ্রা রাজকোষে জমা দিয়ে দেন। কেননা নি তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন সম্পদ বা অর্থকড়ি কখনও নিজের কাজে জমা রাখতেন না। এমনই নির্লোভ ও ভালমানুষ ছিলেন আল বেরুনী।
আল বেরুনী বিভিন্ন বিষয়ে মানব জাতির জন্য অবদান রেখে গেছেন। তিনি তার বিভিন্ন গ্রন্থে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়, বিভিন্ন সভ্যতার ইতিহাস, মৃত্তিকাতত্ত্ব সাগর তত্ত্ব এবং আকাশ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ইউরোপীয় পন্ডিতগণ আল বেরুনীর জ্ঞানের প্রশংসা করেছেন। তারা বলেন, আল বেরুনী নিজেই বিশ্বকোষ। এছাড়া তিনি একজন ভাষাবিদও ছিলেন। এক্ষেত্রে তার খ্যাতি ছিল। তিনি আরবী, ফার্সী, সিরীয়, গ্রীক, সংস্কৃতি, হিব্রু, প্রভৃতি ভাষায় পন্ডিত ছিলেন। ত্রিকোনোমিতিতে তিনি বহু তথ্র আবিষ্কার করেন।
কোপার্নিকাস বলেন, পৃথিবী সহ গ্রহগুলো সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে। অথচ কোপার্নিকাসের জন্মের ৪২৫ বছর আগে আল বেরুনী বলে গেছেন, পৃথিবী বৃত্তিক গতিতে ঘোরে। তিনি টলেমি ও িইয়াকুবের দশমিক অংকের গননায় ভুল ধরে দিয়ে তার সঠিক সমাধান দেন। তিনিই সর্বপ্রথম অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেন। তিনিই প্রথম প্রাকৃতিক ঝর্ণাও আর্টেজিয় কূপের রহস্য উদঘাটন করেন। তিনি একজন খ্যাতনামা জ্যোতিষী ছিলেন। তিনি যেসব ভবিষ্যদ্বানী করতেন সেগুলো সঠিক হত। তিনি শব্দের গতির সাথে আলোর গতির পার্থক্য নির্ণয় করেন। তিনি এরিষ্টটলের ‘হেভেন’ গ্রন্থের ১০টি ভুল বের করেন। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্কটিও তিনি আবিষ্কার করেন।
আল বেরুনী সুক্ষ্ম ও শুদ্ধ গণনার একটি বিস্ময়কর পন্থা আবিষ্কার করেন। তার বর্তমাননাম দি ফরমুলা অব হিন্টার পোলেশন। পাশ্চাত্যের পন্ডিতরা এটাকে নিউটানের আবিষ্কার বলে প্রচার করছেন। অথচ তার ৫৯২ বছর আগেই আল বেরুনী এটি আবিষ্কার করেন। একে ব্যবহার করে তিনি বিশুদ্ধা সাইন তালিকা তৈরী করেন। এ ফর্মুলা পূর্ণতাদান করে তিনি একটি ট্যানজেন্ট তালিকাও তৈরী করেন। বিভিন্ন প্রকার ফুলের পাপড়ি সংখ্যা হয় ৩, ৪, ৫, ৬ ৈএবং ১৮ হবে কিন্তু কখনো ৭ বা ৯ হবে না। তিনিই প্রথম এ সত্র আবিষ্কার করেন।
আল বেরুনী চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি বহুরোগের ঔষধ তৈরীর কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ১১৮। তিনি বিজ্ঞঅন, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা ও ইতিহাস বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘কিতাবুল তাফহিম’। এটি ৫৩০ অধ্যায়ে বিভক্ত। এতে অংক, জ্যামিতি ও বিশ্বের গঠন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি ‘আল আরসুল বাকিয়া’ আলাল কুবানিল কালিয়া’ গ্রন্থে পৃথিবীর প্রাচীন কালের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। যিজে আববন্দ (নভোমন্ডল) ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত। আল ফি যিজে খাওয়ারিজমি (যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে) তার আরও দুটি দু’টি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
আল বেরুনী সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় এক মহাপন্ডিত। তাঁর ও অন্যান্য মুসলিম বিজ্ঞানী ও জ্ঞান সাধখদের মৌলিক আবিস্কারের ওপরই গড়ে ওঠেছে আজকের আধুনিক বিজ্ঞান। তাদের অবদানকে অস্বীকার করা অকৃতজ্ঞতার পরিচয়। বরং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের অবদান স্বীকার করে নেয়াই হবে সঠিক ও যুক্তিসম্মত কাজ।
আল বেরুনী এত বড় পন্ডিত হওয়ার পরেও ছিলেন একজন সৎ ও ভাল লোক। তিনি খুবই ধার্মিক ছিলেন। তার মনে কোন গৌরব বা অহংকার ছিল না। তিনি সঠিকভাবে নামায রোজা করতেন এবং ইসলামের সকল হুকুম আহকাম মেনে চলতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর অর্জিত জ্ঞান খুবই সামান্য। সকল জ্ঞানের উৎস হলেন আল্লাহ। তিনি ৬৩ বছর বয়সে কঠিন অসুখে পড়েন। বহু চিকিৎসার পরেও তিনি আর সুস্থ হতে পারেননি। অবশেষে ৭৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল ক রেন। এটি ছিল ১০৪৮ খৃষ্টাব্দের ১৩ই ডিসেম্বর রোজ শুক্রবার।
প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক জর্জ সার্টন বলেছৈন, আল বেরুনী সকল যুগের ও সকল দেশের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানের অন্যতম। সভ্যতার ইতিহাসে তাঁর যে বিরাট অবদান রয়েছে, কোনদিন তা’ মুছে যাবার নয়।