মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল রাযী
মুসলমান চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁরা চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ঔষূধ তৈরীর নিয়মকানুন সম্পর্কিত বই পুস্তক রচনায় অসামান অবদান রেখেছেন। এদের মধ্যে আল রাযী ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।
ইরানের রাজধানী তেহরান। তেহরানের একটি এলাকার নাম রায়নগর। এখানেই জন্ম হয় আবু বকর মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়ার। সেটা ছিল ৮৮৫ খৃষ্টাব্দ। রায়নগর ছিল একটি শিক্ষা কেন্দ্র। এটি মৃৎ শিল্পের জন্যেও প্রসিদ্ধ ছিল। জন্মভূমির নামানুসারে আবু বকর রাযী নাম ধারণ করেন।
প্রায় ২০ বছর বয়সে বিদ্যা শেখার জন্য তিনি বাগদাদে যান। সেখানে বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ ইবনে ইসহাকের কাছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। রসায়ন শাস্ত্রেও তার অনেক দখল ছিল। বাগদাদে থাকাকালে তিনি গ্রীক চিকিৎসা বিজ্ঞঅন/ইরানী চিকিৎসা প্রণালী এবং ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি পদার্থ বিজ্ঞান ও দর্শনেও পন্ডিত ছিলেন।
শিক্ষা শেষ হওয়ার পর তিনি কিছুদিন জুন্দেশাপুর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষানবিশীকরেন। িএ সময় চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সবধরনের রোগী তাঁর কাছে আসতে থাকে। তাঁর চিকিৎসায় রোগী ভাল হয়ে যেত। এর ফলে মানুষ তার দোয়া করতো। তিনি জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় বেশী মন দিতে পারলেন না। বরং চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়েই সারাজীবন কাটান। সেকালে বাগদাদে তার মতো এত বড় চিকিৎসক আর কেউ ছিল না। তিনি খলিফা আল মুক্তাদিরের প্র্রদান চিকিৎসক ছিলেন। খলিফার অনুরোধে তিনি কয়েক বছর রায়, জুন্দেশাপুর ও বাগদাদে সরকারী হাসপাতালে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। িএ সময় পশ্চিম এশিয়অ ও পূর্ব ইউরোপ থেকে দলে দলে রোগীরা নিরাময়ের আশায় তাঁর কাছে ছুটে আসতো। খৃষ্টানরা ও ইহুদীরা পর্যন্ত তার কাছে থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভীড় জমাতো।
আল রাযী আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রণালীর মতো তাঁর নিজস্ব প্রণালীতে চিকিৎসা করতেন। তাঁর শিক্ষাদানও ছিল উন্নত ধরনের। তিনি ছাত্রদের হাতে কলমে শেখাতেন। তিনি ছাত্রদর হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের সেবা যত্ন করে প্রত্যক্ষ্য জ্ঞান লাভের কথা বলতেন। সার্জারি বা শল্য চিকিৎসাতেও তার জোড়া মেলা ছিল ভার। তিনি গ্রীকদের চেয়ে উন্নত ভাবে সার্জারি করতেন। তখনকার দিনে রাযীর হাতে চিকিৎসা লাভকে রোগীরা আল্লাহর অপূর্ব নিয়ামত মনে করতো। তার হাতে চিকিৎসা করতেই তারা নিজেদেরে নিরাপদ ভঅবতো। রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় তিনি পচুর অর্থ আয় করতে থাকেন। তিনি ৪০ বছর পর্যন্ত চিকিৎসায় নিয়োচিত থেকে বহু জ্ঞান লাভ করেন। তিনি কয়েক বছর নানান দেশে সফর করেন। সে সময় বিভিন্ন দেশের রাজা বাদশাহরা তাকে বহু উপহার দেন।
শেষ বয়সে আল রাযীর দু’চোখে ছানি পড়ে। এর ফলে তিনি অন্ধ হয়ে পনে। তাকে অস্ত্র চিকিৎসা নেয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি অস্বীকার করে বলেন, বহুদিন যাবত আমি দুনিয়ার রূপ দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তিনি ৬৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
আল রাযী আল কেমির চর্চা করতেন। তিনি নানা প্রকার এলকোহলত স্পিরিটও আবিষ্কার করেন। তিনি কিবাতুল আসরার (রহস্যের গ্রন্থ) নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। জিরার্ড ১১৮৭ খৃষ্টাব্দে এটিকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদন করেন। চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এই বইটি ইউরোপের সকল বিদ্যালয়ে পাঠ্য পুস্তক ছিল।
তিনিই প্রথম পদার্থের শ্রেণী বিভাগ করে রাসায়নিক পদার্থকে উদ্ভিদ প্রাণী ও খনিজ হিসেবে বিভক্ত করেছেন। বর্তমানেও তার এই পদ্ধতি আধুনিক হিসেবে স্বীকৃত। খনিজ দ্রব্যকে তিনি তরল ও নিরেট দ্রব্য পাথর, গন্ধক, সোহাগ ও লবনে বিভক্ত করেছেন। তিনি উদ্বায়ী ও অনুদ্বায়ী স্পিরিটে পার্থক্য দেখিয়ে গন্ধক, পারদ, আর্সেনিক ও আল এমোনেয়াককে স্থান দিয়েছেন। তিনি কৃত্রিম উপায়ে বরফ তৈরী করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। কেননা সে সময় পানি থেকে বরছ তৈরীর প্রণালী মানুষ জনত না।
আল রাযী চিকিৎসা বিজ্ঞানে একশোটি বই রচনা করেন। অন্যান্য বিষয়েও একশোটি বই রচনা করেন। প্রায় প্রত্যেক রোগ সম্পর্কেই তিনি ছোট ছোট বই লিখে গেছেন। মানুষের কিডনী ও গল ব্লাডারে কেন পাথর হয় সে সম্পর্কে তিনি একটি মৌলিক তথ্যপূর্ণ বই লিখেছেন। তিনি লাশ কাটার বিষয়েও আলোচনা করেছেন। কিন্তু তিনি বসন্ত ও হাম রোগ সম্পর্কে সর্বপ্রথম বিজ্ঞান সম্মত আলোচনা করেন। এই একটি মাত্র কারণেও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ সম্পর্কে তিনি রচনা করেন “আল জুদারী ওয়াল হাসবাহ” নাম গ্রন্থটি। এটি ল্যাটিন ও ইউরোপের সকল ভাষাকে অনুবাদ হয়। শুধামাত্র ইংরেজী ভাষাতেই এটি ৪০ বার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়।
ইরানে থাকাকালে আল রাযী চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিখ্যাত গ্রন্থ “কিতাবুল মুনসরী” রচনা করেন। ১৫ শতকে এই বইটি ল্যাটিন অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। এছাড়া তিনি আরেকটি চিকিৎসা গ্রন্থ কিতাব আল মুলুকী রচনা করেন।
আল রাযীর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে “আল হাবী”। এতে সর্বপ্রকার রোগ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া এটি একই সাথে চিকিৎসা প্রণালী ও ঔষুধের ব্যবস্থা সম্বলিত একখানি অভিধান। এই বিরাট বইয়ের ২০টি খন্ড আছে। সিসিলির রাজা প্রথম চার্লসের আদেশে ইহুদী চিকিৎসক ফারাজ ইবনে সলিম এটিকে ভাষায় অনুবাদ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ অবদান হিসেবে আল হাবী ইউরোপীয়দের মনে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করে। আল হাবীর নবম খন্ডটি ইউরোপের প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পাঠপুস্তক হিসেবেষোল শত পর্যন্ত নির্দিষ্ট ছিল। এই বইটিতে আল রাযী প্রত্যেক রোগ সম্বন্ধে প্রথমে গ্রীক, সিরিয়, আরবী, ইরানী ও ভারতীয় চিকিৎসা প্রণালীর বিস্তারিত বর্ণনা দেন তারপর নিজের মতামত ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। আল হাবী ও আল জুদারী ওয়াল হাসবাহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের অসাধারণ গ্রন্থ। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম চিকিৎসাবিদ এবং বিশ্বের সকল যুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের অন্যতম। িইবনে সিনা ও রুশ্দের পর আল রাযীর মত কোন মুসলিম মনীষী শিক্ষা ও রেনেসাঁয় তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
আল রাযীই প্রথম মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার কথা চিন্তা করেন। তাঁর গ্রন্থে এ ধরনের চিকিৎসার উপকারিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। তিনি ‘মানসিক শরীর’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এতে মনোবিদ্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
আল রাযী দর্শন শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। সম্প্রতি তাঁর একটি আত্মজীবনীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এতে তিনি বলেন, তিনি গ্রীক দর্শন ভালভাবে জানেন। তিনি প্লেটোর দর্শনের উপর ভাষ্য লিখেছেন, অ্যারিষ্টটলের ন্যায়শাস্ত্রের সংক্ষিপ্ত সার রচনা করেছেন। পোরফিরির মতবাদ খন্ডন করেছেন।
আব্দুর রহমান জামী
ইরানের খোরাসান প্রদেশের একটি ছোট শহর। নামতার জাম। এই শহরে মোল্লাহ নূরউদ্দিন আবদুর রহমানের জন্ম হয়। দিনটি ছিল ৭ই নভেম্বর। আর সাল ছিল ১৪১৪। জন্মভূমি জাম থেকেই তিনি জামী উপাধ পান এবং এই নামেই বিখ্যাত হন।
তাঁর পিতা ছিলেন একজন নামকরা পন্ডিত ব্যক্তি। পিতার কাছেই তিনি আরবী ফার্সি ভাষা শেখেন। তিনি তফসিরে কোরআন, হাদিস, ফিকাহ ও আরবী ব্যাকরণ পিতার কাছ থেকেই ভালাভাবে আয়ত্ব করেন।
পিতার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে জামী বলেন, আমি যদি সত্যিই কারও ছাত্র হই, তবে তা আমার পিতার। কারণ তিনিই আমাকে ভাষা শিক্ষা দেন। ছোটবেলায় জামী খুবই দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন। বিদ্যালয়ের বাঁধা ধরার মধ্যে তিনি হাঁপিয়ে উঠতেন। সুযোগ পেলেই তিনি পালিয়ে গিয়ে খেলাধুলা করতেন। তাঁর বুদ্ধি ছিল অত্যন্ত প্রখর। মেধা ছিল তীক্ষ্ন আর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। এ কারণেই ছোট বেলা থেকেই তিনি সহজেই কঠিন পড়া মুখস্ত করতে পারতেন।
কোন সময় দেখা গেল তিনি পথে বসে খেলাধুলা করছেন। এদিকে বিদ্যালয়ে যাবার সময় হয়ে গেছে। অথচ তিনি বিদ্যালয়ের পাঠবই খুলেও দেখেননি। কাজেই তার পাঠ মুখস্থ হয়নি। হঠাৎ তিনি কোন সহপাঠির কাছ থেকে বই কেড়ে নিয়ে সেদিনের পাঠ দেখে নিলেন। তারপর ক্লাসে সুন্দরভাবে পড়া দিলেন। এতে সকলেই মুগ্ধ হয়ে যেত। এরকম ঘটনা তাঁর জীবনে বহুবার ঘটেছে।
তিনি ইতিহাস, দর্শন, সুফীতত্ত্ব, কবিতা রচনা, ছন্দ প্রকরণ ও সঙ্গীতে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। মোলআ জুনায়েদ ও খাজা আলী সমরকান্দী ছিলেন তাঁর প্রধান দু’জন শিক্ষখ। জামী এতই প্রতিভাবান ছাত্র ছিলেন যে খাজা আলীর কাছ থেকে ৪০টি পাঠ নিয়ে তাঁর শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তিনি সমরকন্দের কাজী রুমের মত পন্ডিত ব্যক্তির কয়েকটি বক্তৃতা শুনেই তাঁর সঙ্গে বিতর্কে লড়েন এবং শিক্ষককে পরাজিত করেন। উদারমনা শিক্ষক কাজী রুম এতে কোন অপমান বোধ করেননি। বরং তিনি এমন প্রতিভাবান ছাত্র পেয়ে গৌরববোধ করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, সমরকন্দ শহরের পত্তন হওয়ার পর জামীর মত এতবড় পন্ডিত আর কখনো আসেননি।
ছোট বেলা থেকেই জামী পীর দরবেশদের খুবই ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। যারা আল্লাহর ভালবাসায় মতোয়ারা হয়ে দুনিয়ার সাময়িক সুখ বর্জন করেন এমন লোকরা তার কাছে প্রিয় ছিল। এজন্যে সুযোগ পেলেই তিনি ওলি দরবেশের সাথে সময় কাটাতেন। জাম তখন শিশু। তার আব্বা একজন প্রসিদ্ধ দরবেশের কোলে তাকে তুলে দিয়ে তাঁর দোয়া কামনা করেছিলেন।
জামী তখন যুবক। এ সময় অনেক নামকরা সুফীর সাথে তিনি উঠাবসা করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, শাম্সউদ্দিন মোহাম্মদ আসাদ ও ওবায়দুল্লাহ আহরার। তিনি বিখ্যাত সাধক আল সাদ আদ দীনের হাতে দীক্ষা নেন। তাঁর শিক্ষক তাকে তাসাউফের শিক্ষা দান করেন। জামী একজন সত্যিকার সাধকের মতই সব ধরনের কৃচ্ছতা অবলম্বন করে সহজ সরল জীবন যাপনের অভ্যাস করেন। সাদ আল দীন তাঁর সাধনায় মুগ্ধ হয়ে তাকে আবার লোকজনের সাথে মেলামেশার অনুমতি দেন।
জামী একবার হজ্বের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। প্রথমেই তিনি বাগদাদে এলেন। তাঁর বিরোধী পক্ষের লোকজন তাকে শায়েস্তা করার জন্র তাঁর কবিতার অংশ বিশেষ বিকৃত করেন তার বিরুদ্ধে জোরপ্রচার চালায়। ফলে জামীকে এক বিরাট সভায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলতে হয়। বাগদাদের শাসক এই সভা পরিচালনা করেন এবং এতে উপস্থিত ছিলেন, হানাফী, শাফেয়ী ও শিয়া সম্প্রদায়ের পন্ডিত ব্যক্তিগণ। তাঁর শত্রুপক্ষ কবিতাটি পাঠ করলে তিনি আসল কবিপা পাঠ করেন। তাদে ধরা পড়ে যে শত্রু পক্ষ আসল কবিতাটির প্রথম ও শেষ অংশ বাদ দিয়ে এমন একটি অংশ জুড়ে দিয়েছে যাতে বাগদাদের জনসাধারণকে সহজেই ক্ষেপানো যায়। জনগন আসল কবিটাটি শুনে খুশি হল এবং কবিকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করলো।
জামী বাগদাদে ৪মাস থাকার পর মক্কা শরীফের দিকে রওয়ানা হলেন। পথে প্রত্যেক শহরেই কবিকে বিশেষ সম্বর্ধনা জানানো হয়। আলেপ্পোতে থাকাকালে জামী পাঁচহাজার স্বর্ণমুদ্রাসহ বহু উপহার সামগ্রী পান। তুরষ্টের সুলতান দ্বিতীয় বায়যিদ এসব উপহার পাঠিয়েছিলেন। জামী তাব্রিজ যান। সেখঅনকার শাসক হাসান বেগও কবিকে সেখানে থেকে যাওয়ার জন্য বহু অনুরোধ জানান। কবি বৃদ্ধা মায়ের সাথে দেখা করার কথা জানিয়ে তাব্রিজ ত্যাগ করে খোরাসানে ফিরে আসেন। কিন্তু খোরাসানেও তার রেহাই নেই। চারদিক থেকে রাজা বাদশাহ আর সর্বস্তরের মানুষ কবিকে অজস্র উপহার সামগ্রী পাঠাতে লাগলেন। সাধক কবি জামী ভক্তদের ভালবাসার অত্যাচার থেকে বাঁচার আশায় হিরাতের এক নির্জন স্থানে চলে যান এবং এক মনে আল্লাহর বন্দেগীতে মশগুল হন। এভাবে নির্জন স্থানে থাকা কালে ১৪৯২ সালের ৯ই নভেম্বর ৭৮ বছর বয়সে জামী ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের খবরে খোরাসানে মানুষ শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অনেক যত্ন ও তাজিমের সাথে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। অনেক রাজা বাদশাহ, আমীর ওমরাহ, আলেম ও মুফতী সহ লাখ লাখ লোক তার জানাযায় শরীক হন।
জামী একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন। তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তিনি একজন অসামান্য পন্ডিতও ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত পন্ডিত নাসুলীজ বলেছৈন, কেবল কবি হিসেবেই নয়, পন্ডিত হিসেবে বিবেচটনা করলে একথা বলা যায়, জামী একজন অসামান্য প্রতিভাদীপ্ত পন্ডিত ছিলেন।
জামী তার পীর ও মারেফাতের শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতেন। তিন সমসাময়িক কবিদের মতো কখনো ধনী বা ক্ষমতাশালীদের দুয়ারে ধন্না দেননি বা চাটুকারদের মতো সুলতান বা আমীরদের প্রশংসা করে কোন কবিতা লিখে তাদের দয়া প্রার্থনা করেননি। কবি জামী তাঁর জীবিতকালেই সে সময়কার রাজাবাদশাহ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের ভালবাসা, ভক্তি ও শ্রদ্ধা লাভ করেছেন। কিন্তু এতে কিছুর পরেও কিন্তু গরীব দুঃখী মানুষকে ভুলতেন না। তিনি তাদের দুখ দূর করার জন্য অকাতরে দান করতেন।
জামী বিভিন্ন বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত তুহফা ই সামী গ্রন্থে তাঁর লিখিত ৪৬টি গ্রন্থের উল্লেখ আছে। তিনি শেখ সাদীর গুলিস্তার অনুকরণে ‘বাহারিস্তান’ (বসন্তের দেশ) নামে একটি বিখ্যাত গদ্যগ্রন্থ ১৪৮৭ সালে রচনা করেন। এতে ৮টি রওযা (উদ্যান) নামে অধ্যায় আছে প্রত্যেক রওযায় সুফী ও দরবেশ, দার্শনিক ও জ্ঞানী, সুলতান খলিফাদের ন্যায় বিচার, দানশীলতা, পেম রসিকতা ও বাকপটুতা, কবি ও অবোধ প্রাণীদের সম্পর্কে মনোরম ও চরমৎকার কাহিনী বর্ণিত আছে। বইটি গুলিস্তাঁর মতই গত্য ও পদ্যের সংমিশ্রণে লিখিত।
জামীল ‘লওয়ায়ীহ’ একটি বিখ্যাত বই। এতে তিনি আল্লাহর প্রেমিকদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি পার্থিব জ্ঞানের তুচ্ছতা ঘোষণা করে আল্লাহর পথেই জ্ঞান বিকাশের মহিমা গেয়েছেন। তিনি বলেন,
ছায়াবাজির মিথ্যা খেলায় মত্ত তুমি আজ
তাঁর হুকুমে মিলিয়ে যাবে তোমায় দিয়ে লাজ।
সঁপো হৃদয় তাঁর নিকটে নেইকো যাহার লয়
সকলকালে থাকবে যিনি হয়ো তোমা-ময়।
জামী সাতটি মসনবী কাব্য এবং তিনটি দিওয়ান বা গযল কবিতা সংগ্রহ রচনা করেন। সাতটি মসনবী কাব্যের ১টি হচ্ছে সিল সিলাতুল যাহাব। এতে সাতহাজার দুশো বয়েত আছে। এতে দার্শনিক, নৈতিক ও ধর্মীয় জ্ঞান বিষয়ক বহু উপাখ্যান আছে। আছে দ্বিতীয় কাব্য হচ্ছে সলমান ওয়া আবসাল। এটি একটি অনন্য সাধারণ রূপক কাব্য। এতে নশ্বর বিকৃত প্রেমের বন্ধনমুক্ত স্বর্গীয় অবিনশ্বর প্রেমের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। তৃতীয় কাব্য হচ্ছে, “তুহ্ফাতুল আহ্রার।” এটি একটি নীতিগর্ভকাব্য। তাঁর চতুর্থকাব্য হচ্ছে ‘সবহাতুল আবরার’ (ধার্মিকের জপমালা)। এটিও দার্শনিক, নৈতিক ও মিষ্টিক ভাবপ্রধান কাব্য। পঞ্চম কাব্য হচ্ছে, ইউসুফ ওয়া জুলায়খা। এটি একটি শ্রেষ্ঠ প্রেমমূলক কাব্য এবং সবচেয়ে বেশী প্রচারিত ও সমাদৃত। ষষ্ঠ কাব্য হচ্ছে লায়লা ওয়া মজনু এবং সপ্তম কাব্য হচ্ছে, খিরদ নামা-ই-সিকান্দারী।
জামীর কবিতা সম্পর্কে পন্ডিত মির্জা বিহরুজ বলেন, জামীর কবিতা নিজামীর কবিতা সমক্ষ। কাব্যরূপ, মাধুর্য ও সারল্যে তার কবিতা অসাধারণ। তাঁর কবিতা অনায়াসে সকলে পড়তে পারে। এজন্য তিনি ইরানের বাইরেও জনপ্রিয়। অপরদিকে নিজামীর কবিতা বুঝতে হলে ফার্সি ভাষায় গভীর জ্ঞান থাকতে হয়। পন্ডিত লোক ছাড়া অন্য কেউ নিজামীর কাব্যের মর্ম বুঝতে পারবে না।
— সমাপ্ত —