১৪। হযরত খাব্বাব (রা) এর ত্যাগ ও কুরবানী
হযরত ওমর(রা) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নগ্ন তরবারী হাতে নিয়ে যেদিন রাসূল(সা) কে হত্যা করতে রওয়ানা হয়েছিলেন, সেইদিন পথিমধ্যে নিজের বোন ও ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের খবর পেয়ে সাময়িকভাবে গন্তব্য স্থান পরিবর্তন করেন এবং প্রথমে বোন ভগ্নিপতিকে ইসলাম গ্রহণের শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বোনো বাড়ীতে গিয়ে দেখতে পান তারা কুরআন পড়ছে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পড়াচ্ছিল তিনি ছিলেন খাব্বাব ইবনে আরত(রা)। হযরত ওমর বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই খাব্বাব প্রাণভয়ে আত্মগোপন করেন। কেননা বোন ভগ্নিপতি রক্তের টানে রক্ষা পেলেও সেদিন খাব্বারের বাঁচার কোনো আশা ছিল না ওমরের নগ্ন তরবারী হতে। সেদিন যা হবার তা হলো। প্রথম সাক্ষাতে বোন ভগ্নিপতি কিছু মার খেলেও কুরআনের আয়াত ক’টি পড়ে তাঁর আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি রাসূলের(সা) কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। খাব্বাবের সাথে হযরত ওমরের হয়েছিল সেইদিন প্রথম সাক্ষাত। তারপর দরিদ্র খাব্বাবের উপর মক্কার কোরেশদের আরো অনেক নির্যাতন হয়েছে। হযরত ওমর শুনেছেন, কিন্তু প্রতিকার করতে পারেন নি।
কিন্তু আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে হযরত ওমরের সামনে বসে আছেন মহান ত্যাগী সাহাবী খাব্বাব। আজ ইসলাম বিজয়ী আসনে অধিষ্ঠিত। হযরত ওমর আজ মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা। তাওহীদ ও রিসালাতের সাথে সংঘর্ষে কুফর ও শিরক চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। জাহেলিয়াতের অন্ধকার দূর হয়ে ইসলামের আলোকে চারদিক উদ্ভাসিত। কিন্তু হযরত ওমরের(রা) প্রবল ইচ্ছা, খাব্বাবের সেই নির্যাতনের কাহিনীগুলো শুনবেন। তাই জিজ্ঞাসা করলেন, “ইসলাম গ্রহণের পর আপনার উপর কি ধরনের নির্যাতন হয়েছে, একটু বলবেন?”
হযরত ওমরের প্রশ্ন হযরত খাব্বাবকে আবার দূর অতীতে টেনে নিয়ে গেল এবং মক্কার ১৩ বছরের সেই রক্তক্ষরা দিনগুলিকে তার চোখের সামনে হাজির করলো। সে নির্যাতনে ঈমান ও একীনে উজ্জীবিত মর্দে মুমিনরা ছাড়া আর কেউ তেরো বছর তো দূরের কথা, তেরো দিনও বরদাশত করতে পারতো না। হযরত খাব্বাব কোন্ কাহিনী দিয়ে শুরু করবেন এবং কোনটা বাদ্ দিয়ে কোনটা বলবেন। তাই ভেবে ভেবে কয়েক মুহুর্ত নীরবে কাটিয়ে দিলেন। শেষে বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না। অবশেষে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিজের জামা খুলে কোমরের একটি অংশ আমিরুল মোমেনীনকে দেখালেন। জায়গাটা ছিল জখমের চিহ্নে পরিপূর্ণ। আমীরুল মুমিনীন দেখামাত্র চিৎকার করে বলে উঠলেনঃ
“আল্লাহু আকবার! এই নাকি আপনার কোমর। আমি তো আজ পর্যন্ত কোন মানুষের এমন কোমর দেখি নি।”
খাব্বাব বললেন, “জি, আমিরুল মোমেনীন, কতবার যে আমাকে লোহার বর্মসহ তপ্ত মরুভূমিতে টেনে হিচড়ে বেড়ানো হয়েছে এবং কতবার যে আমার কোমরের চর্বিতে ওদের আগুন নিভেছে, তা আমি স্মরণ করতে পারি না। তারপর আল্লাহর শোকর যে, একদিন আমরা সমস্ত নির্যাতন থেকে মুক্তি পেলাম।”
সহসা হযরত খাব্বাব কান্না শুরু করে দিলেন।
হযরত ওমর বললেন, “ খাব্বাব, আজ কেন কাঁদছেন?”
হযরত খাব্বাব চোখের পানি ফেলতে ফেলতে জবাব দিলেন, “আমি কাঁদছি এজন্য যে, জেহাদের পর জেহাদ করে বিজয় অর্জন করার পর আল্লাহ আমাদের জন্য সুখ সমৃদ্ধি ও ধন দৌলতের দ্বার খুলে দিয়েছেন। আমাদের মাথার উপর সম্মান ও মর্যাদার পতাকা উড়ছে। আমার আশংকা হয় যে আমাদের ক্ষুদ্র ও সৎ কাজগুলির প্রতিদান দুনিয়াতেই দিয়ে দেয়া হচ্ছে কি না এবং আখেরাতে আমাদের খালি হাতে উঠতে হবে কি না।”
এই নিঃস্বার্থ ত্যাগী পুরুষ ইন্তিকালের সময় ওসিয়ত করেন, “ আমাকে তোমরা লোকালয়ে নয়, কুফার জংগলে কবর দিও। জংগল আমাকে ডাকছে।”
তাঁর ইন্তিকালের পর একদিন হযরত আলী(রা) তাঁর কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, “আল্লাহ খাব্বাবের ওপর রহমত করুন। তিনি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ইসলাম গ্রহণ করেন, সানন্দে হিজরত করেন, জেহাদে জীবন কাটান এবং মুসিবতের পর মুসিবত বরদাশত করেন। অথচ নিজের প্রয়োজনের চেয়ে এক চুলও বেশি পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেন নি।”
১৫। হযরত ওমরের(রা) শাসনে প্রজাদের সম অধিকার
মিশর বিজয়ী সেনাপতি আমর ইবনুল আস তখন মিশরের গভর্নর। তাঁর শাসনে মিশরের জনগণ বেশ শান্তিতেই কাটাচ্ছিল। কিন্তু তাঁর একটা বেয়াড়া ছেলে তাঁর ন্যায়পরায়নার সুনাম প্রায় নষ্ট করতে উদ্যত হয়েছিল। সে যখনই পথে বেরুত, সবাইকে নিজের চালচলন দ্বারা বুঝিয়ে দিত যে, সে কোনো সাধারণ মানুষ নয়, বরং গভর্নরের ছেলে।
একদিন সে জনৈক মিশরীয় খৃস্টানের ছেলেকে প্রহার করলো। দরিদ্র মিশরীয় গভর্নরের কাছে তার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস পেল না। তাই নীরবে হজম করলো। কয়েকদিন পর তার জনৈক প্রতিবেশি মদীনা হতে ফিরে এসে জানালো যে, খলিফা ওমর অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ শাসক। তিনি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করেন এবং কেউ কারো ওপর যুলুম করেছে জানলে কঠোর শাস্তি দেন। এ কথা শুনে ঐ মিশরীয় খৃস্টান একটি উটের পিঠে চড়ে দীর্ঘ সতেরো দিন চলার পর মদীনায় খলিফার কাছে পৌছলো এবং গভর্নরের ছেলের বিপক্ষে মোকদ্দমা দায়ের করলো। হযরত ওমর তৎক্ষণাত হযরত আমর ইবনুল আস এবং তার ছেলেকে মদীনায় ডেকে আনলেন। অতঃপর বিচার বসলো।
সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা হযরত আমর ইবনুল আসের(রা) ছেলে দোষী প্রমাণিত হলো। খলিফা ওমর(রা) অভিযোগকারীর ছেলেকে দেখিয়ে বললেন, সে তোমাকে যেভাবে যে কয়বার প্রহার করেছে তুমিও সেই কয়বার তদ্রুপ প্রহার কর। ছেলেটি যথাযথভাবে প্রতিশোধ নিল।
তারপর খলিফা বললেন, “প্রজারা শাসকের দাস নয়। শাসকরা প্রজাদের সেবক। প্রজারা ঠিক তেমনি স্বাধীন যেমন তাদের মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হবার সময় স্বাধীন ছিল।”
১৬। হযরত ওমর(রা) ও গভর্নর হরমুযান
পারস্যের নাহাওয়ান্দ্র প্রদেশের গভর্নর হরমুযান ইসলামের এক কট্টর দুশমন ছিল। সে মুসলমানদের সাথে পারস্যের যুদ্ধ বাধানোর প্রধান হোতা ছিল। সে নিজেও খুবই শৌর্য বীর্যের সাথে যুদ্ধ করেছিল। অবশেষে হরমুযান মুসলমানদের হাতে ধরা পড়ে ও কারাবন্দী হয়। কারাবন্দী হবার পর সে ভেবেছিল এবার আর তার রেহাই নেই। মুসলমানরা হয় তাকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিবে নচেৎ মৃত্যুদন্ড দিবে। কারণ তার অতীত কার্যকলাপ দ্বারা সে মুসলমানদের সাথে নিজের সম্পর্ক খুবই খারাপ করে ফেলেছিল। কিন্তু তাকে এই দুই শাস্তির কোনোটাই দেওয়া হলো না। তাকে কিছু করের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হলো। হরমুযান নিজের রাজধানীতে ফিরে এল, তৎক্ষণাত আরো দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে বিদ্রোহী তৎপরতা শুরু করলো এবং এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে ফিরে এলো। এবারও হরমুযান ধরা পড়ে বন্দী হলো। হরমুযানকে পাকড়াও করে যখন হযরত ওমরের(রা) কাছে নিয়ে আসা হলো তখন হযরত ওমর তাঁর উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন। বন্দী এবার তার মৃত্যুদন্ড সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত ছিল। প্রতি মুহুর্তে সে তাই মৃত্যুর আশংকা করেছিল।
সহসা হযরত ওমর জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমিই নাহাওয়ান্দ্রের বিদ্রোহী গভর্নর?
হরমুযানঃ জ্বি, আমিই।
হযরত ওমরঃ তুমি কি সেই ব্যক্তি যে বার বার মুসলমানদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে?
হরমুযানঃ জ্বী, আমিই।
হযরত ওমরঃ এ ধরনের শাস্তি যে মৃত্যুদন্ড তা তুমি জান?
হরমুযানঃ জ্বী, জানি।
হযরত ওমরঃ বেশ, তাহলে তুমি এই শাস্তি এখনি নিতে প্রস্তুত?
হরমুযানঃ আমি প্রস্তুত। তবে মৃত্যুর পূর্বে আপনার নিকট আমার্ একটিমাত্র আবেদন আছে।
হযরত ওমরঃ সেটি কী?
হরমুযানঃ আমি খুব পিপাসা বোধ করছি। আমি এক গ্লাস পানি চাইতে পারি?
হযরত ওমরঃ অবশ্যই।
এই সময় হযরত ওমরের নির্দেশে তাকে এক গ্লাস পানি দেয়া হলো।
হরমুযানঃ আমিরুল মু’মিনীন, আমি আশংকা করছি যে, আমি পানি খাওয়ার সময়েই আমার মস্তক ছিন্ন করা হতে পারে।
হযরত ওমরঃ কখনো নয়। তোমার এই পানি খাওয়া শেষ হবার আগে কেউ তোমার চুলও স্পর্শ করবে না।
হরমুযানঃ (একটু থেমে) আমিরুল মু’মিনীন, আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন যে আমি এই পানি খাওয়া শেষ না করা পর্যন্ত আপনারা আমার চুলও স্পর্শ করবেন না। আমি পানি পান করবো না। (এই বলেই সে পানি ঢেলে ফেলে দিল)। এখন আপনি আমাকে হত্যা করতে পারেন না।
হযরত ওমরঃ (মুচকি হেসে) ওহে গভর্নর, এটা তোমার চালাকী। যাহোক, ওমর যখন কথা দিয়েছে, তখন সে তার কথা রাখবেই। যাও, তুমি মুক্ত।
এর কিছুকাল পরে একদিন হরমুযান একদল সঙ্গী পরিবেষ্টিত হয়ে আবার মদীনায় এল এবং হযরত ওমরের সাথে সাক্ষাত করলো। সে বললো, “আমিরুল মু’মিনীন, এবার আমি নতুন জীবনের সন্ধানে এসেছি। আমাদের সবাইকে ইসলামে দীক্ষিত করুন।”
১৭। হযরত ওমরের(রা) ন্যায় বিচারের আর একটি উদাহরণ
একবার কিছু সুগন্ধী দ্রব্য বাহরাইন থেকে হযরত ওমরের নিকট পাঠানো হলো। তিনি সমবেত জনতাকে লক্ষ্য করে বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে এই সুগন্ধী দ্রব্যটিকে মেপে সমান ভাগ করে মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করতে পারে?”
তাঁর স্ত্রী হযরত আতেকা বললেন, “আমিরুল মু’মিনীন, আমি পারবো।”
হযরত ওমর বললেন, “আতেকা ছাড়া আর কেউ আছে কি?”
হযরত আতেকা বললেন, “আমিরুল মু’মিনীন, আমি মেপে দিলে অসুবিধা কী?”
হযরত ওমর বললেন, “আমার আশংকা হয় যে, মাপার সময় তুমি জিনিসটা হাত দিয়ে ধরবে এবং তোমার হাত সুবাসিত হয়ে যাবে। অতঃপর সেই সুবাসিত হাত তুমি মুখে মেখে নেবে এবং সুগন্ধী উপভোগ করবে। অন্যদের চাইতে এতটুকু বাড়তি সুবিধা তুমি পেয়ে যাও, তা আমি পছন্দ করি না।”
শিক্ষাঃ
একজন সাধারণ মুসলমানের জন্য স্বীয় স্ত্রী বা অধীনস্তদের ওপর এত কঠোরতা আরোপ না করলেও চলতো। কিন্তু খলীফা বা যে কোনো স্তরের নেতৃবৃন্দের পক্ষে এরূপ কঠোর ও সূক্ষ্ম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। কারণ নেতামাত্রই আদর্শ ও অনুকরণীয় ব্যক্তি। তার পক্ষে নিজেকে এবং নিজের ঘনিষ্ঠজনদেরকে বিন্দুমাত্রও ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই।
১৮। হযরত ওমর কর্তৃক স্বীয় পুত্রের বিচার
একবার হযরত ওমরের নিকট একটি অভিযোগ এল যে, তার পুত্র আবু শাহমা মদ খেয়েছে। অভিযোগটা অন্যান্য লোকের কানেও এল। অনেকে ফিসফিসানি শুরু করে দিল যে, এবার দেখবো খলিফার আইনের শাসন নিজের ছেলের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হবে। কিন্তু তাদের ধারণাটা অচিরেই মাঠে মারা গেল। কেননা অন্যরা শৈথিল্য দেখাতে পারে এই আশংকায় হযরত ওমর তাঁর ছেলের মামলা আদালতে না পাঠিয়ে নিজের হাতে তুলে নিলেন।
ছেলের মদ খাওয়ার সত্যতা প্রমাণিত হলো। ইসলামী আইনে এর শাস্তি ৮০ ঘা বেত্রদন্ড। এবারও হযরত ওমর অন্যের ওপর নির্ভর করলেন না। কেননা অন্যরা দুর্বলতা দেখাতে পারে। তিনি নিজেই পুরো ৮০ ঘা বেত্রদন্ড। এবারও হযরত ওমর অন্যের উপর নির্ভর করলেন না। কেনান অন্যরা দুর্বলতা দেখাতে পারে। তিনি নিজ হাতেই পুরো ৮০ টা বেত্রাঘাত নিজের ছেলের পিঠে লাগালেন। আবু শাহমা এই শাস্তিতে মারা গেলেন। কিন্তু হযরত ওমর আল্লাহর শোকর আদায় করলেন যে, তিনি তাকে এমন কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছেন। কোনো কোনো রেওয়ায়াতে আছে যে, ৮০টি বেত্রাঘাতের কয়েকটি বাকী থাকতেই ছেলে মারা গেলে হযরত ওমর তার কবরের ওপর বাকী বেত্রাঘাতগুলো করেন।
শিক্ষাঃ
ইসলামী আইন ও নীতিমালা প্রয়োগের ব্যাপারে কোনো আপোষের অবকাশ নেই। আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ সাক্ষী হিসাবে ইনসাফ কায়েম কর, এমনকি তা যদি তোমাদের নিজেদের, পিতামাতার ও ঘনিষ্টজনদের বিরুদ্ধেও যায়।”
১৯। সততার পুরস্কারঃ
রাত প্রায় দুপুর গড়িয়ে চলছে। ঘুমন্ত মদীনা নগরী। এরই অলিগলি দিয়ে ধীরপদে প্রতিদিনের মত হেটে চলেছেন ছদ্মবেশী খলীফা হযরত ওমর। খোঁজ খবর নিচ্ছেন প্রজাদের। হঠাৎ একটি কুঁড়েঘর থেকে ফিসফিস করে একটি কথোপকথন তাঁর কানে ভেসে এল। খলীফা দাঁড়িয়ে গেলেন পুরো কথোপকথন শুনতে। এক বৃদ্ধা মহিলা তার মেয়েকে বলছে, “দুধ বেঁচতে দেয়ার সময় একটু পানি মিশিয়ে দিসনা কেন? তুই তো জানিস, কি অভাব আমাদের। ঐটুকু দুধে আর ক’টা পয়সা হবে। একটু পানি মেশালে কিছুটা স্বচ্ছলতার মুখ দেখা যেত।”
“কিন্তু তুমি খলীফার আদেশ ভুলে গেলে, আম্মী? তিনি যে বলেছেন কেউ যেন দুধের সাথে পানি না মেশায়।”
“বলেছেন, তাতে কী হয়েছে? খলীফা বা তার কোনো কর্মচারী তো আর দেখতে আসছেন না আমরা কী করছি।”
“কিন্তু আম্মী, তিনি বা তার কোনো কর্মচারী দেখুক বা না দেখুক, তার আদেশতো প্রত্যেক মুসলমানের মেনে চলা দরকার। তা ছাড়া খলীফা যদি নাও জানেন, আল্লাহ তো জানবেন। তিনি তো সব কিছু দেখেন, শোনেন এবং জানেন।”
খলীফা নীরবে প্রস্থান করলেন। নিজের সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “শুনলে তো? এই মেয়েটাকে কী পুরস্কার দেয়া যায় তার সততার জন্য?”
“তাকে বড়সড় একটা পুরস্কার দেয়া উচিত। ধরুন, এক হাজার দিরহাম।”
“না, তা যথেষ্ট নয়। আমি তাকে সততার সর্বোচ্চ পুরস্কার দেব। আমি তাকে আপন করে নেব।”
খলীফার সঙ্গী অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, খলীফা কী পুরস্কার দিতে চান?”
পরদিন সকালে খলীফা মেয়েটিকে তার দরবারে ডেকে পাঠালেন। মেয়েটি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে হাজির হলো মুসলিম সাম্রাজ্যের মহাশক্তিধর শাসকের সামনে।
খলীফা তাঁর ছেলেদের ডাকলেন। তাদেরকে শোনালেন গতরাতে তার শোনা আলাপচারিতার কথা। তারপর বললেনঃ “হে আমার ছেলেরা, আমি চাই তোমাদের কোন একজন এই মেয়েটিকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করুক। কেননা এর চেয়ে ভালো কোনো পাত্রী আমি তোমাদের জন্য জোগাড় করতে পারবো বলে মনে হয় না।”
একটি ছেলে পিতার প্রস্তাবে রাজী হলো। মেয়েটিও সম্মতি দিল। আর সে খলীফার সম্মানিত পুত্রবধূতে পরিণত হলো। বর্ণিত আছে যে, পরবর্তীকালে দ্বিতীয় ওমর নামে পরিচিত ও পঞ্চম খোলাফায়ে রাশেদ নামে আখ্যায়িত মহান শাসক ওমর বিন আবদুল আযীয এই মেয়েরই দৌহিত্র ছিলেন।
শিক্ষাঃ এই ঘটনাটি একদিকে যেমন প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের সততার এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলে ধরে, অপরদিকে তেমনি মুসলিম নেতৃবৃন্দ সততার কেমন মর্যাদা দিতেন ও কদর করতেন, তাও এ ঘটনা থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়। মনে রাখতে হবে, গুণের কদর দিতে না পারলে সমাজে সদগুণের বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়।
২০। কাযী শুরাইহের ন্যায়বিচার
একবার হযরত ওমর (রা) জনৈক বেদুইনের কাছ থেকে একটি ঘোড়া কিনলেন। ঘোড়ার দাম পরিশোধ করেই তিনি ঘোড়ায় চড়লেন এবং তাকে হাঁকিয়ে নিয়ে গেলেন। কিছুদূর যেতেই ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে খোঁড়া হয়ে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ ঘোড়াকে পিছনের দিকে ফিরিয়ে ঐ বেদুইনের কাছে নিয়ে গেলেন। হযরত ওমর ভেবেছিলেন ঘোড়াটির আগে থেকেই পায়ে কোনো খুঁত ছিল, যা সামান্য ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে গেছে। তিনি ঘোড়ার মালিককে বললেন, “তোমার ঘোড়া ফেরত নাও। এর পা ভাঙ্গা।”
সে বললোঃ “আমিরুল মু’মিনীন! আমি ফেরত নিতে পারবো না। কারণ আমি যখন বিক্রী করেছি, তখন ঘোড়াটি ভাল ছিল।”
হযরত ওমর বললেনঃ “ঠিক আছে। একজন সালিশ মানা হোক। সে আমাদের বিরোধ মিটিয়ে দিবে।”
লোকটি বললোঃ শুরাইহ বিন হারিস কান্দী নামে একজন ভালো জ্ঞানী লোককে আমি চিনি। তাকেই শালিশ মানা হোক। হযরত ওমর রাজী হলেন। উভয়ে শুরাইহের খলিফাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আমিরুল মু’মিনীন! আপনি কি ঘোড়াটি সুস্থ অবস্থায় কিনেছিলেন?”
হযরত ওমর বললেন, হ্যাঁ।
শুরাইহ বললেন, তাহলে হয় আপনি ঘোড়াটি মূল্য দিয়ে কিনে নিন। নচেত যে অবস্থায় কিনেছিলেন সে অবস্থায় ফেরত দিন।
এ কথা শুনে খলিফা ওমর(রা) চমৎকৃত হয়ে বললেনঃ “এটাই সঠিক বিচার বটে। তুমি সম্পূর্ণ নির্ভূল মত ও ন্যায্য রায় দিয়েছ। তুমি কুফা চলে যাও। আজ থেকে তুমি কুফার বিচারপতি।”
সেই থেকে দীর্ঘ ষাট বছর যাবত পর্যন্ত তিনি মুসলিম জাহানের বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। যতদূর জানা যায়, হযরত আলীর সময়ে তিনি খলিফার বিরুদ্ধে অনুরূপ আর একটি রায় দিয়ে প্রধান বিচারপতির পদে উন্নীত হন। তারপর উমাইয়া শাসনকালে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অবর্ণনীয় অত্যাচারে বিরক্ত হয়ে তিনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কোনো শাসকই তাকে পদচ্যূত করার সাহস পান নি।
হযরত আলী(রা) একবার তাঁর অতিপ্রিয় বর্ম হারিয়ে ফেললেন। কিছুদিন পর জনৈক ইহুদীর হাতে সেটি দেখেই চিনে ফেললেন। লোকটি কুফার বাজারে সেটি বিক্রয় করতে এনেছিল। হযরত আলী তাকে বললেনঃ “এতো আমার বর্ম। আমার একটি উটের পিঠ থেকে এটি অমুক রাত্রে অমুক জায়গায় পড়ে গিয়েছিল।”
ইহুদী বললোঃ “আমীরুল মুমিনীন! ওটা আমার বর্ম এবং আমার দখলেই রয়েছে।”
হযরত আলী পুনরায় বললেনঃ “এটি আমারই বর্ম। আমি এটাকে কাউকে দানও করি নি, কারো কাছে বিক্রয়ও করি নি। এটি তোমার হাতে কিভাবে গেল?”
ইহুদী বললোঃ “চলুন, কাযীর দরবারে যাওয়া যাক।”
হযরত আলী(রা) বললেনঃ “বেশ, তাই হোক। চলো।” তারা উভয়ে গেলেন বিচারপতি শুরাইহের দরবারে। বিচারপতি শুরাইহ উভয়ের বক্তব্য জানতে চাইলে উভয়ে বর্মটি নিজের বলে যথারীতি দাবী জানালেন।
বিচারপতি খলিফাকে সম্বোধন করে বললেনঃ “আমিরুল মু’মিনীন! আপনাকে দু’জন সাক্ষী উপস্থিত করতে হবে। হযরত আলী বললেনঃ “আমার ভৃত্য কিম্বার এবং ছেলে হাসান সাক্ষী আছে।”
শুরাইহ বললেনঃ “আপনার ভৃত্যের সাক্ষ্য নিতে পারি। কিন্তু ছেলের সাক্ষ্য নিতে পারবো না। কেননা বাপের জন্য ছেলের সাক্ষ্য শরীয়তের আইনে অচল।”
হযরত আলী বললেনঃ “বলেন কি আপনি? একজন বেহেশতবাসীর সাক্ষ্য চলবে না? আপনি কি শোনেন নি, রাসূল(সা) বলেছেন, হাসান ও হোসেন বেহেশতের যুবকদের নেতা?”
শুরাইহ বললেনঃ “শুনেছি আমিরুল মু’মিনীন! তবু আমি বাপের জন্য ছেলের সাক্ষ্য গ্রহণ করবো না।” অনন্যোপায় হযরত আলী ইহুদীকে বললেনঃ “ঠিক আছে। বর্মটা তুমিই নিয়ে নাও। আমার কাছে এই দু’জন ছাড়া আর কোনো সাক্ষী নেই।”
ইহুদী তৎক্ষণাৎ বললোঃ “আমিরুল মু’মিনীন! আমি স্বয়ং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ওটা আপনারই বর্ম। কি আশ্চর্য! মুসলমানদের খলিফা আমাকে কাজীর দরবারে হাজির করে আর সেই কাযী খলিফার বিরুদ্ধে রায় দেয়। এমন সত্য ও ন্যায়ের ব্যবস্থা যে ধর্মে রয়েছে আমি সেই ইসলামকে গ্রহণ করেছি। আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু………..।”
অতঃপর বিচারপতি শুরাইহকে সে জানালো যে, “খলিফা সিফফীন যুদ্ধে যাওয়ার সময় আমি তাঁর পিছু পিছু যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তাঁর উটের পিঠ থেকে এই বর্মটি পড়ে গেলে আমি তা তুলে নিই।”
হযরত আলী(রা) বলেনঃ “বেশ! তুমি যখন ইসলাম গ্রহণ করেছ, তখন আমি ওটা তোমাকে উপহার দিলাম।”
এই লোকটি পরবর্তীকালে নাহরাওয়ানে হযরত আলীর নেতৃত্বে খারেজীদের সাথে যুদ্ধ করার সময় শহীদ হন।
আর একবার কাযী শুরাইহের ছেলে জনৈক আসামীর জামিন হয়। আসামী জামিনে মুক্তি পেয়ে পালিয়ে গেলে শুরাইহ আসামীর বিনিময়ে ছেলেকে জেলে আটকান। যতদিন আসামীকে খুঁজে পাওয়া যায় নি ততদিন সে জেলে আটক এবং কাযী সাহেব স্বয়ং বন্দী ছেলের জন্য জেলখানায় খাবার দিয়ে আসতেন।
কাযী শুরাইহের আর এক ছেলে একবার এক গোত্রের সাথে জমিজমা সংক্রান্ত মোকদ্দমার সম্মুখীন হন। মোকদ্দমাটি শুরাইহের আদালতেই আসার কথা ছিল। তাই পিতার সাথে আগেভাগেই পরামর্শ করার জন্য ছেলেটি একদিন বললোঃ আব্বা, আপনি আমার মামলার বিবরণটি পুরোপুরি শুনে আমাকে বলুন আমার জেতার সম্ভাবনা আছে কি না। যদি থাকে তাহলে আমি মামলাটি রুজু করবো। নচেত বিরত থাকবো। বিচারপতি শুরাইহ পুরো ঘটনা শুনে ছেলেকে মামলা রুজু করার পরামর্শ দিলেন।
যথাসময়ে মামলার শুনানি শুরু হলো। শুনানী শেষে শুরাইহ নিজের ছেলের বিরুদ্ধে রায় দিলেন।
রাত্রে বাসায় এসে ছেলে পিতার কাছে অনুযোগের সুরে বললোঃ “আব্বা, আপনি আমাকে এভাবে অপমান করলেন! আমি যদি আগেভাগে আপনার পরামর্শ না নিতাম, তা হলেও একটা সান্তনা ছিল। কিন্তু…..।”
কাযী শুরাইহ বললেনঃ “হে বৎস! তুমি আমার কাছে পৃথিবীর সবার কাছ হতে প্রিয়; কিন্তু তোমার কাছ হতেও আল্লাহ আমার কাছে অনেক বেশী প্রিয়। আমি জানতাম, তোমার বিপক্ষের দাবীই সঠিক ও ন্যায়সংগত। কিন্তু তোমাকে সেটা জানিয়ে দিলে তুমি তাদের সাথে এমনভাবে আপোষ করে নিতে পারতে, যার ফলে তাদের প্রাপ্য অংশ বিশেষ তোমাকে দিতে হতো। তেমনটি ঘটলে আল্লাহ আমার উপর নারাজ হতেন। এজন্যই আমি তোমাকে মামলা আদালতে আনবার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এখন তোমার খুশি হওয়া উচিত যে, তুমি অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পত্তি দখল করা থেকে রক্ষা পেলে।”
বর্ণিত আছে যে, বিচারপতি শুরাইহ যখন কোনো মামলার শুনানী গ্রহণ করতেন, তখন সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদেরকে সাক্ষ্য দেওয়ার ভয়াবহ পরিণাম স্মরণ করিয়ে দিতেন এবং বলতেন, “তোমাদের সাক্ষ্যের ওপরই এই মামলার রায় নির্ভরশীল। এখনো সময় আছে, তোমরা ইচ্ছা করলে সাক্ষ্য না দিয়েও চলে যেতে পারো।”
এরপরও যখন সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে চাইতো, তিনি সাক্ষ্য নিতেন এবং রায় দেয়ার সময় বিজয়ী পক্ষকে হুশিয়ার করে দিতেন যে, “শুধুমাত্র সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই আমি এই রায় দিলাম। আল্লাহ যা হারাম করেছেন, এই রায়ের দ্বারা তা হালাল হবে না।”
সম্ভবতঃ এসব দুর্লভ গুণ বৈশিষ্ট্যের কারণেই হাজার হাজার জ্ঞানীগুণী সাহাবী বেঁচে থাকা সত্ত্বেও হযরত ওমরের আমল থেকে শুরু করে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের শাসনামল পর্যন্ত দীর্ঘ ৬০ বছরব্যাপী কাযী শুরাইহ মুসলিম জাহানের প্রধান বিচারপতির পদে বহাল আছেন।
২১। হযরত উসমানের দানশীলতা ও মিতব্যয়িতা
একদিন এক নিঃস্ব লোক রাসূলের নিকট এসে কিছু সাহায্য চাইল। তখন রাসূলের নিকট কিছুই ছিল না। তিনি লোকটাকে হযরত উসমানের নিকট পাঠালেন। দরিদ্র ব্যক্তিটি হযরত উসমানের গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখে যে একদল পিঁপড়ে বেশ কিছু শস্য একটি স্তুপ থেকে গর্তে নিয়ে যাচ্ছে। হযরত উসমান শস্যগুলো একত্রিত করে কিছু শস্য পিঁপড়ের গর্তের কাছে ছড়িয়ে বাকীগুলি আবার স্তুপে রেখে দিচ্ছিলেন। লোকটি ধারণা করলো যে হযরত উসমান বড় কৃপণ। সে মনে মনে ভাবলো যে দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও সে নিজে পিঁপড়ের মুখ হতে শস্য কেড়ে নিতো না। তাই কিছুই না চেয়ে লোকটি চলে গেল।
পরদিন লোকটি আবার রাসূলের নিকট উপস্থিত হল এবং কিছু চাইল। সে রাসূলকে জানাল যে, কৃপণ উসমানের (রা) নিকট কিছুই আশা করা যায় না, তাই সে কিছুই চায় নি। রাসূল(সা) তাকে আবার হযরত উসমানের নিকট পাঠালেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেল এবং দেখতে পেল যে হযরত উসমান(রা) তাঁর চাকরকে বাতির সলতে উঁচু করে দেয়ার দায়ে বকাঝকা করছেন। কারণ তাতে অধিক তেল খরচ হয়। দরিদ্র লোকটি মনে মনে ভাবলো যে তার বাড়িতে আলো আরো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে এবং সে কখনও এরূপ তেলের হিসাব করে না। হযরত উসমানের কৃপণতা সম্বন্ধে তার ধারণা আরো জোরদার হলো। কিছু না চেয়েই সে আবার রাসূল(সা) এর নিকট ফিরে গেল। হযরত উসমানের বিরুদ্ধে কৃপণতার অভিযোগ শুনে রাসূল(সা) মৃদু হাসলেন এবং লোকটিকে আবার বললেন হযরত উসমানের কাছে ফিরে যেতে এবং কিছু চাইতে।
তৃতীয়বার লোকটি হযরত উসমানের নিকট এসে দেখে যে হযরত উসমানের বাড়ীতে তুলা শুকাতে দেয়া হয়েছে। ঢেকে দেয়া হয়েছে জাল দিয়ে। জালের নিচ হতে কিছু তুলা উড়ে উড়ে যাচ্ছিল। হযরত উসমান সেগুলিকে ধরে আবার জালের নিচে রাখছেন। লোকটির মন অত্যন্ত বিরূপ হয়ে উঠলো। ভাবলো এমন কৃপণও কি কিছু দান করতে পারে? তবুও যেহেতু রাসূল তাকে তিনবার উসমান(রা) এর কাছে পাঠিয়েছেন, তাই সে গিয়ে কিছু চাইলো।
হযরত উসমান ভাবলেন, লোকটিকে কি দেওয়া যায়, যে লোককে রাসূল (সা) তার নিকট সাহায্যের জন্য পাঠিয়েছেন, তার চাইতে সাহায্য নেওয়ার যোগ্য আর কে হতে পারে?
তখন দেখা গেল বেশ দূরে একটি সরু রেখা। রেখাটিকে একটি উটের কাফেলা বলেই মনে হলো। কিছুক্ষণ পর হযরত উসমান বুঝতে পারলেন, যে কাফেলা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় গিয়েছিল সেটিই ফিরে আসছে। হযরত উসমান তাকে লিখে দিলেন যে ঐ কাফেলার সবচেয়ে ভাল উটটি এবং যার উপর সবচেয়ে বেশি দ্রব্যসম্ভার আছে সেটিই সে নিতে পারে। লোকটি প্রথম মনে করলো যে হযরত উসমান তামাসা করছেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরও লোকটি তার দান সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে পারলো না। সন্দিগ্ধ চিত্তে সে গেল কাফেলার নিকট। সবচেয়ে ভালো এবং প্রথম উটটিই তার পছন্দ হলো। সেটি সে নিতে চাইল। কাফেলার পরিচালক অনুমতি দিল। কিন্তু মরুভূমিতে চলাকালে প্রথম উটটিকে কাফেলা হতে সরিয়ে নেয়া সহজ নয়। সবগুলো উটই প্রথমটিকে অনুসরণ করল। কাফেলার পরিচালক তখন লোকটিকে বললো যে আস্তানায় ফিরে যাওয়ার পর উটটি দেয়া হবে। হযরত উসমানের নিকট খবর দেয়া হল যে, একটি উটকে কাফেলা হতে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয় নি। তাই তখন তার নির্দেশ পালন করা হয় নি। খবর শুনে হযরত উসমান(রা) বললেন, হয়ত আল্লাহর ইচ্ছা এই যে, কাফেলার সবগুলি উটই লোকটি পাবে। অতঃপর তিনি কাফেলার পরিচালককে নির্দেশ দিলেন যে সবগুলো উটই যেন লোকটিকে দেয়া হয়। লোকটিতো বিস্ময়ে অবাক! অতো বড় কৃপণের কিভাবে এতো বড় দান করা সম্ভব হলো? হতবাক হয়ে সে তার পূর্ববর্তী তিন অভিজ্ঞতা জানাল এবং দু’প্রকার ব্যবহারের তাৎপর্য কি জানতে চাইল।
হযরত উসমান যে জবাব দিলেন তার সারমর্ম এই যে, আল্লাহ বিশ্বের সমস্ত সম্পদের মালিক, মানুষ হলো তত্ত্বাবধানকারী বা পাহারাদার। সে শুধু আল্লাহর ইচ্ছানুসারে সম্পদ নিজের জন্য এবং সমাজের অপরাপর ব্যক্তির কল্যাণের জন্য ব্যয় করতে পারবে। মানুষের কাজ হলো আল্লাহর সম্পদ নিজের মর্জিমত রক্ষণাবেক্ষণ করা। যদি কোনো ব্যক্তির তত্ত্বাবধানকালে কোনো সম্পদের এক কণামাত্র বিনষ্ট হয় তবে তার জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সম্পদের অধিকার শুধু বিশেষ সুবিধা নয়, বরং একটি বিরাট দায়িত্ব।”
শিক্ষাঃ মুমিনকে অবশ্যই দানশীল হতে হবে, কিন্তু সে কখনো অপচয়কারী ও অপব্যয়কারী হতে পারবে না। কেনান “অপচয়কারী ও অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।”(আল কুরআন)।
২২। সাতশো গুণ লাভ
হযরত আবু বকর(রা) এর খেলাফতকালে এক দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। খাদ্যদ্রব্য একেবারেই দুর্লভ হয়ে পড়ে এবং মানুষের দুঃখ দুর্দশা চরম আকার ধারণ করে। সেই সময় হযরত উসমানের প্রায় এক হাজার মন গমের একটি চালান বিদেশ হতে মদীনায় পৌঁছলো। শহরের কয়েকজন ব্যবসায়ী তাঁর কাছে এল। তারা তাঁর সমস্ত গমের চালান ৫০% লাভে কিনে নেয়ার প্রস্তাব দিল। সেই সাথে তারা এও ওয়াদা করল যে, তারা দুর্ভিক্ষ পীড়িত জনগণের দুর্দশা লাঘবের জন্যই এটা কিনতে চেয়েছে।
হযরত ওসমান(রা) বললেন, “তোমরা যদি আমাকে এক হাজার গুণ লাভ দিতে পার, তবে আমি দিতে পারি। কেননা অন্য একজন আমাকে সাতশো গুণ লাভ দিতে চেয়েছেন।”
ব্যবসায়ীরা বললো, “বলেন কি? চালান মদীনায় আসার পর তো আমরাই প্রথম এলাম আপনার কাছে। সাতশো গুণ লাভের প্রস্তাব কে কখন দিলো?”
হযরত ওসমান বললেন, “এই প্রস্তাব আমি পেয়েছি আল্লাহর কাছ থেকে। আমি এই চালানের সমস্ত গম বিনামূল্যে গরীবদের মধ্যে বিতরণ করবো। এর বিনিময়ে আল্লাহ আমাকে সাতশো গুণ বেশি পূণ্য দিবেন বলে ওয়াদা করেছেন।”
শিক্ষাঃ পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ২৬১ নং আয়াতে এই ওয়াদার উল্লেখ রয়েছে। হযরত ওসমান(রা) সম্ভবত ঐদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। হযরত ওসমানের মহানুভবতার এই ঘটনা বিপন্ন মানুষের সেবাকে ইসলাম কত গুরুত্ব দেয়, তারই প্রমাণ বহন করে। জনসেবা ও ত্যাগের এই মনোভাব বিশেষভাবে ধনীদের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়া খুবই জরুরী।
২৩। হযরত আলীর (রা) খোদাভীতি
হযরত আলী(রা) তখন মুসলিম জাহানের খলিফা। একদিন তার ছোটভাই আকীল তার কাছে এসে নিজের অনেক অভাব অভিযোগের কথা জানালেন এবং তাকে কিছু সাহায্য দেয়ার অনুরোধ করলেন। হযরত আলী বললেন, জনগণের সম্পদের কোষাগার বাইতুল মাল থেকে আমি তোমাকে এক কপর্দকও দিতে পারবো না। মাসের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আমি বেতন পেলে তা থেকে তোমাকে কিছু দেয়া হবে। হযরত আকীল বললেন, আপনি নিজের বেতন অগ্রিম নিয়ে নিন। হযরত আলী বললেন, আমার বেতন অন্য সকলের বেতনের সাথে আসবে। অগ্রিম নেয়ার কোনো অধিকার আমার নেই। হযরত আকীল নাছোড়বান্দা। তিনি বললেন, একটা কিছু করুন। আমার সংসার চলছে না। যেভাবেই হোক আমাকে কিছু সাহায্য দিন। হযরত আলী বললেন, বাজারের কোনো দোকান থেকে তালা ভেঙ্গে কিছু নিয়ে নাও। আকীল বললেন, ওটাতো চুরি বা ডাকাতি বলে গণ্য হবে। হযরত আলী(রা) বললেন, এই মুহুর্তে আমি যদি বাইতুল মাল থেকে তোমাকে কিছু দেই তবে তাও চুরি বা ডাকাতি বলে গণ্য হবে। কেননা ওটা জনগণের সম্পদ এবং জনগণ আমাকে ওখান থেকে নেয়ার অনুমতি দেয় নি।
অগত্য হযরত আকীল হযরত মোয়াবিয়ার নিকট গেলে তিনি তাকে একশো দিরহাম দিয়ে বললেন, তুমি মসজিদে দাঁড়িয়ে সকলকে জানাবে যে, আলীর কাছে সাহায্য চেয়ে পাইনি, কিন্তু মোয়াবিয়ার কাছে চেয়ে পেয়েছি।
ইত্যবসরে হযরত আকীল হযরত আলীর বক্তব্যের যৌক্তিকতা বুঝতে পারলেন। তিনি মসজিদে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আলীর কাছে অন্যায়ভাবে সাহায্য চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি খোদাভীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আর মোয়াবিয়ার কাছে সাহায্য চাইলে তিনি খোদাভীতির পরিবর্তে আমাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
২৪। অধিক সম্পদের মোহ ও কৃপণতার পরিণাম
একবার সালামা ইবনে হাতেম আনসারী নামক এক সাহাবী রাসূল(সা) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল(সা), আমার জন্য দোয়া করুন, যেন আমি অনেক বড় ধনী হতে পারি। রাসূল(সা) বললেন, আমি যে নীতি অনুসরণ করে চলেছি, তা কি তোমার পছন্দ নয়? আল্লাহর কসম, আমি ইচ্ছা করলে মদীনার পাহাড়গুলো সোনা হয়ে আমার সাথে সাথে ঘুরতো। কিন্তু এমন ধনী হওয়া আমার পছন্দ নয়। এ কথা শুনে লোকটি ফিরে গেল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর আাবার ফিরে এল। এবার সে বললোঃ হে রাসূল(সা)! আমি ওয়াদা করছি যে, আমি যদি ধনী হয়ে যাই তাহলে প্রত্যেক হকদারকে তার প্রাপ্য হক পৌঁছে দেব। এ কথা শুনে রাসূল(সা) তার বিপুল ধনসম্পদ হোক-এই মর্মে দোয়া করলেন। এর ফলে তার ছাগল ভেড়া প্রভৃতিতে অসাধারণ প্রবৃদ্ধি দেখা দিল। ফলে মদীনার যে জায়গায় সে বাস করতো তাতে আর তার স্থান সংকুলান হতো না। সে মদীনার বাইরে চলে গেল। তবে যোহর ও আসরের নামায মদীনার মসজিদে নববীতে পড়তো। তার অন্যান্য নামায সে নিজের বাসস্থানেই পড়তো।
এরপর তার গৃহপালিত পশুর সংখ্যা আরো বেড়ে গেল। এর ফলে নতুন জায়গাটিও তার জন্য সংকীর্ণ হয়ে দাঁড়ালো। তাই সে মদীনা হতে আরো দূরে গিয়ে থাকতে আরম্ভ করলো। সেখান থেকে সে শুধু জুমার নামায মদীনায় এসে পড়তে লাগলো। অন্যান্য নামায নিজের বাসস্থানেই পড়তো। ক্রমে তার সম্পদ আরো বেড়ে গেলে তাকে আরো দূরে চলে যেতে হলো। সেখান থেকে সে জুমার নামাযেও মসজিদে আসতে পারতো না।
কিছুদিন পর রাসূল(সা) সালাবা সম্পর্কে লোকদের কাছে খোঁজ খবর জানতে চাইলেন। তাঁকে জানানো হলো যে, সালাবার সম্পদ এত বেশি হয়েছে যে, শহরের কাছে কোথাও তার স্থান সংকুলান হয় নি। তাই এখন সে আর এদিকে আসে না। এ কথা শুনে রাসূল(সা) তিনবার বললেন, “ইয়া ওয়াইহা সালাবা!” অর্থাৎ সালাবার জন্য আফসোস।
ঠিক এই সময় যাকাতের আয়াত নাযিল হয়। তাতে রাসূল(সা)কে মুসলমানদের কাছ হতে যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়। তিনি যাকাত আদায়ের জন্য মুসলমানদের কাছে লোক পাঠালেন। কয়েকজন লোককে সালাবার কাছে পাঠালেন। আর কয়েকজনকে বনু সুলাইমের আর এক ধনীর কাছেও পাঠালেন।
যখন আদায়কারীরা সালাবার কাছে যাকাত চাইল এবং রাসূল(সা) এর লিখিত ফরমান দেখালো; তখন সালাবা বলতে লাগলো, এতো জিযিয়া কর হয়ে গেল, যা অমুসলমানদের কাছ হতে আদায় করা হয়। তারপর বললো, এখন আপনারা যান। ফেরার পথে আসবেন। তখন তারা চলে গেলেন।
পক্ষান্তরে বনু সুলাইমের ধনী লোকটি রাসূল(সা) এর আদেশ শুনে নিজের গৃহপালিত পশুর মধ্য থেকে বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মানের পশু যাকাত হিসেবে দিলেন। আদায়কারীরা বললেন, আমাদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে, উৎকৃষ্টমানের পশু যেন না নিই। বনু সুলাইমের ধনী লোকটি বললো, আমি নিজের ইচ্ছায় দিচ্ছি। দয়া করে গ্রহণ করুন।
অতঃপর আদায়কারীগণ সালাবার কাছে গেলে সে বললো, “কই, দেখি যাকাতের আইন আমাকে দেখাও। তারপর তা দেখে আবার বলতে লাগলোঃ আমি তো মুসলমান। অমুসলমানদের মত জিযিয়া কেন দিতে যাবো? যা হোক, আপনারা এখন যান। আমি পরে ভেবে চিন্তে জানাবো।”
যখন আদায়কারীরা রাসূল(সা) এর কাছে ফিরে গেল তখন সকল বৃত্তা্ন্ত শুনে রাসূল(সা) আবার তিনবার বললেন, “সালাবার জন্য আক্ষেপ!” আর সুলাইমের জন্য দোয়া করতে লাগলেন। এরপর সালাবার প্রতি ইঙ্গিত করে সূরা তাওবার একটি আয়াত নাযিল হয়। তাতে এই ধরনের লোকদের নিন্দা করা হয়, যারা সম্পদশালী হলে হকদারদের হক দিবে বলে ওয়াদা করেছে, কিন্তু পরে সেই ওয়াদা ভুলে গিয়ে কৃপণতা করতে আরম্ভ করেছে। আয়াতে বলা হয় যে, এই ধরনের লোকদের মনে আল্লাহ মোনাফেকী গভীরভাবে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন।
রাসূল(সা) যখন সালাবার জন্য তিনবার আক্ষেপ প্রকাশ করলেন এবং কুরআনের আয়াতও নাযিল হলো, তখন সেখানে সালাবার একজন আত্মীয় ছিলো। সে গিয়ে সালাবাকে সব জানালো এবং তাকে তার আচরণের জন্য তিরস্কার করলো। সালাবা ভীষণ ঘাবড়ে গেল এবং মদীনায় হাজির হয়ে বললো, “হে রাসূল! আমার যাকাত গ্রহণ করুন। রাসূল(সা) বললেন, আল্লাহ তোমার যাকাত গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। এ কথা শুনে সালাবা আফসোস করতে লাগলো।
রাসূল(সা) বললেন, “এটা তো তোমার নিজের কৃতকার্যের ফল। আমি তোমাকে হুকুম করেছিলাম। তুমি তা মাননি। এখন আর তোমার যাকাত কবুল হতে পারে না। তখন সালাবা অকৃতকার্য হয়ে ফিরে গেল। এর কিছুদিন পরেই রাসূল(সা) ইন্তিকাল করেন। এরপর সালাবা যথাক্রমে হযরত আবু বকর ও ওমর(রা) কে যাকাত গ্রহণ করতে আবেদন জানায়। কিন্তু তারা রাসূল(সা) এর নীতি অনুসরণ করেন। হযরত ওসমানও তার যাকাত গ্রহণে অস্বীকার করেন। হযরত ওসমানের খেলাফতকালেই তার মৃত্যু হয়।(মাআ’রেফুল কুরআন এর সৌজন্যে)।
শিক্ষাঃ হালাল সম্পদে ধনী হওয়ার চেষ্টা করা ও আশা করা যদিও বৈধ, তবুও এত বেশি সম্পদের লোভ করা উচিত নয়, যা মানুষকে ইসলাম হতে দূরে সরিয়ে দেয়। আর প্রাপ্ত সম্পদের যাকাত ও সদকা দিতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করা উচিত নয়।