২৫। হযরত আবু জার গিফারীর ইসলাম গ্রহণ
হযরত আবু যার গিফারী তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা নিম্নরূপে বর্ণনা করেছেনঃ আমি যখন জানতে পারলাম যে, মক্কায় এমন এক ব্যক্তির আগমন ঘটেছে, যিনি নিজেকে নবী বলে দাবী করেন, তখন আমি আমার ভাইকে ঐ ব্যক্তির(মুহাম্মদ সাঃ) নিকট পাঠালাম এবং তাঁর সম্পর্কে সবিস্তারে জেনে আসতে বললাম। সে গেল, তাঁর সাথে দেখা করলো এবং ফিরে এসে আমাকে জানালো যে, তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি সৎ কাজের আদেশ দেন এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ করেন। কিন্তু আমি তার এই বিবরণে সন্তুষ্ট হতে পারলাম না।
অগত্যা আমি নিজে কিছু খাবার এবং একটি লাঠি নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মক্কায় পৌঁছে আমি এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। আমি তাকে চিনতামও না, আবার কোরেশদের ভয়ে কাউকে তার কথা জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না। তাই আমি যমযমের পানি পান করে দিন কয়েক মসজিদুল হারামেই কাটিয়ে দিলাম।
একদিন আলী আমার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ মনে হয় তুমি বহিরাগত। আমি বললামঃ সত্যিই তাই। তিনি বললেনঃ তবে আমার বাড়ি চল। আমি তার সাথে চললাম। পথে তিনিও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, আমিও তাকে কিছু বললাম না। আলীর বাড়িতে রাত কাটিয়ে ভোর বেলা আবার মসজিদুল হারামে গিয়ে হাজির হলাম। ভাবলাম, সুযোগমত কাউকে জিজ্ঞাসা করবো। কিন্তু এদিনও তেমন সুযোগ হলো না।
আলী আজও আমার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেনঃ লোকটা কি থাকার কোনো জায়গাই পেলনা যে, মসজিদুল হারামেই ক্রমাগত থাকতে আরম্ভ করেছে? আমি বললামঃ না ভাই, জায়গা পাইনি। তিনি বললেনঃ আমার সাথে চল। পথিমধ্যে তিনি বললেন, তোমার হয়েছে টা কী? কী চাও এখানে? আমি বললাম, আমার ব্যাপারটা যদি গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন তাহলে বলতে পারি। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন। আমি তখন তাকে সমস্ত কথা খুলে বললাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে। তুমি আমার সাথে চল। আমি সেই ব্যক্তির কাছেই যাচ্ছি। আমি যেখানে প্রবেশ করবো, তুমিও সেখানেই প্রবেশ করবে। আর পথিমধ্যে যদি তোমার জন্য ক্ষতিকর কোনো লোক দেখি, তাহলে আমি জুতা ঠিক করার ভান করে বসে পড়বো, তুমি চলতে থাকবে। তাহলে কেউ তোমাকে আমার সাথী বলে সন্দেহ করবে না।
এরপর আমি তাকে অনুসরণ করে চলতে লাগলাম। অবশেষে তিনি রাসূল(সা) এর কাছে উপনীত হলেন এবং আমিও উপনীত হলাম। আমি নবীকে বললাম, আমার সামনে ইসলাম পেশ করুন। তিনি পেশ করলেন। আমি তৎক্ষণাত ইসলাম কবুল করলাম। তিনি আমাকে বললেন, হে আবু যার, তোমার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটা আপাততঃ কারো কাছে প্রকাশ না করে সরাসরি নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাও। তারপর আমাদের বিজয় হলে এসো। আমি বললাম, আল্লাহর কসম, এই বাণী আমি নিশ্চয়ই লোক সমক্ষে প্রকাশ করবো। এই বলে মসজিদুল হারামে এসে কুরাইশদেরকে সম্বোধন করে বললামঃ হে কুরাইশগণ, শোন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।
আর যায় কোথায়। আমাকে ধর্মত্যাগী বলে গালি দিয়ে সবাই ধর ধর করে তেড়ে এলো এবং আমাকে পিটিয়ে আধামরা করে ফেললো। আব্বাস এসে আমাকে রক্ষা করলেন। পরদিন আবার একইভাবে ঘোষণা করলাম এবং কুরাইশদের হাতে একইভাবে গণপিটুনি খেলাম। এই ছিল আমার ইসলাম গ্রহণের প্রথম অবস্থা।
শিক্ষাঃ অতিমাত্রায় বৈরী পরিবেশে নিজের ইসলামী পরিচয় প্রকাশ করে বিপদ ডেকে আনা অত্যন্ত দুঃসাহসিকতার কাজ। হযরত আবু যারের সিদ্ধান্তটি ছিল নিতান্ত ব্যক্তিগত ও ব্যতিক্রমধর্মী। সাধারণ মানুষের পক্ষে এরূপ করা উচিত নয়।
২৬। পিতামাতাকে অসন্তুষ্ট করার পরিণাম
ইমাম তাবরানী ও ইমাম আহমদ একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। রাসূল(সা) এর যুগে আলকামা নামে মদীনায় এক যুবক বাস করতো। সে নামায, রোযা ও সাদকার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত বন্দেগীতে অত্যন্ত অধ্যবসায় সহকারে লিপ্ত থাকতো। একবার সে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে তার স্ত্রী রাসূল(সা)এর কাছে খবর পাঠালো যে, “আমার স্বামী আলকামা মুমূর্ষ অবস্থায় আছে। হে রাসূল, আমি আপনাকে তার অবস্থা জানানো জরুরী মনে করছি।” রাসূল(সা) তৎক্ষণাৎ হযরত আম্মার, সুহাইব্ ও বিলাল(রা) কে তার কাছে পাঠালেন। তাদেরকে বলে দিলেন যে, “তোমরা তার কাছে গিয়ে তাকে কালেমায়ে শাহাদাত পড়াও।” তারা গিয়ে দেখলেন, আলকামা মুমূর্ষ অবস্থায় আছে। তাই তারা তাকে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” পড়াতে চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু সে কোনো মতেই কলেমা উচ্চারণ করতে পারছিল না। অগত্যা তারা রাসূল(সা) এর কাছে খবর পাঠালেন যে, আলকামার মুখে কলেমা উচ্চারিত হচ্ছে না। যে ব্যক্তি এই সংবাদ নিয়ে এসেছিল, তার কাছে রাসূল(সা) জিজ্ঞাসা করলেনঃ “আলকামার পিতামাতার মধ্যে কেউ কি জীবিত আছে?” সে বললো, “হাঁ রাসূল, তার বৃদ্ধ মা কেবল বেঁচে আছেন।” রাসূল(সা) তাকে তৎক্ষণাৎ আলকামার মায়ের কাছে পাঠালেন এবং তাকে বললেন, “তাকে গিয়ে বল যে, তুমি যদি রাসূল(সা) এর কাছে যেতে পার তবে চল, নচেত অপেক্ষা কর, তিনি তোমার সাথে সাক্ষাত করতে আসছেন।” দূত আলকামার মায়ের কাছে উপস্থিত হয়ে রাসূল(সা) যা বলেছেন তা জানালে আলকামার মা বললেন, “রাসূল(সা) এর জন্য আমার প্রাণ উৎসর্গ হোক। তার কাছে বরং আমিই যাবো।” বৃদ্ধা লাঠিতে ভর দিয়ে রাসূল(সা) এর কাছে এসে সালাম করলেন। রাসূল(সা) সালামের জবাব দিয়ে বললেন, “ওহে আলকামার মা, আমাকে আপনি সত্য কথা বলবেন। আর যদি মিথ্যা বলেন, তবে আল্লাহর কাছ হতে আমার কাছে ওহী আসবে। বলুনতো, আপনার ছেলে আলকামার স্বভাব চরিত্র কেমন ছিল?” বৃদ্ধা বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল! সে প্রচুর পরিমাণে নামায, রোযা ও সাদকা আদায় করতো।” রাসূল(সা) বললেনঃ “তার প্রতি আপনার মনোভাব কী?” রাসূল(সা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট।” রাসূল(সা) বললেন, “কেন?” বৃদ্ধা বললেন, “সে তার স্ত্রীকে আমার উপর অগ্রাধিকার দিত এবং আমার আদেশ অমান্য করতো।” রাসূল(সা) বললেন, “আলকামার মায়ের অসন্তুষ্ট হেতু কলেমার উচ্চারণে আলকামার জিহবা আড়ষ্ট হয়ে গেছে।” তারপর রাসূল(সা) বললেন, “হে বিলাল যাও, আমার জন্য প্রচুর পরিমাণে কাষ্ঠ জোগাড় করিয়া নিয়া আস।”
বৃদ্ধা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, কাষ্ঠ দিয়ে কী করবেন?” রাসূল(সা) বললেন, “আমি ওকে আপনার সামনেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেব।” বৃদ্ধা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল। আমার সামনেই আমার ছেলেকে আগুন দিয়ে পোড়াবেন। আমি তা সহ্য করতে পারবো না।” রাসূল(সা) বললেন, “ওহে আলকামার মা, আল্লাহর আযাব এর চেয়েও কঠোর এবং দীর্ঘস্থায়ী। এখন আপনি যদি চান যে, আল্লাহ আপনার ছেলেকে মাফ করে দিক, তাহলে তাকে আপনি মাফ করে দিন এবং তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। নচেত যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ তার কসম, যতক্ষণ আপনি তার উপর অসন্তুষ্ট থাকবেন, ততক্ষণ নামায, রোযা ও সাদকা দিয়ে আলকামার কোনো লাভ হবে না।” একথা শুনে আলকামার মা বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল, আমি আল্লাহকে, আল্লাহর ফেরেশতাদেরকে এবং এখানে যে সকল মুসলমান উপস্থিত তাদের সকলকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমি আমার ছেলে আলকামার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছি।” রাসূল(সা) বললেনঃ “ওহে বিলাল, এবার আলকামার কাছে যাও। দেখ, সে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলতে পারে কিনা। কেননা, আমার মনে হয়, আলকামার মা আমার কাছে কোনো লাজ লজ্জা না রেখে যথার্থ কথাই বলেছে।” হযরত বিলাল(রা) তৎক্ষণাত গেলেন। শুনতে পেলেন, ঘরের ভেতর থেকে আলকামা উচ্চস্বরে উচ্চারণ করছে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু”। অতঃপর বিলাল গৃহে প্রবেশ করে উপস্থিত জনতাকে বললেনঃ শুনে রাখ, আলকামার মা অসন্তুষ্ট থাকার কারণে সে প্রথমে কলেমা উচ্চারণ করতে পারে নি। পরে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়ায় তার জিহবা কলেমা উচ্চারণে সক্ষম হয়েছে। অতঃপর আলকামা সেদিনই মারা যায় এবং রাসূল(সা) নিজে উপস্থিত হয়ে তার গোসল ও দাফনের নির্দেশ দেন, জানাযার নামায পড়ান ও দাফনে শরীক হন। অতঃপর তার কবরে দাঁড়িয়ে রাসূল(সা) বললেন, “হে আনসার ও মুহাজেরগণ! যে ব্যক্তি মায়ের উপর স্ত্রীকে অগ্রাধিকার দেয় তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতাগণ ও সকল মানুষের অভিসম্পাত! আল্লাহ তার পক্ষে কোনো সুপারিশ কবুল করবেন না। কেবল তওবা করে ও মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করে তাকে সন্তুষ্ট করলেই নিস্তার পাওয়া যাবে। মনে রাখবে, মায়ের সন্তুষ্টিতেই আল্লাহর সন্তোষ এবং মায়ের অসন্তোষেই আল্লাহর অসন্তোষ।”
শিক্ষাঃ ১। আল্লাহর ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে পিতা মাতাকে সন্তুষ্ট রাখার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত এবং মৃত্যুর পূর্বে পিতামাতার কাছ হতে ক্ষমা চেয়ে নেয়া উচিত।
২। মুমূর্ষ ব্যক্তিকে কালেমা পড়ানোর চেষ্টা করা ঘনিষ্ঠ লোকদের কর্তব্য।
২৭। কুরাইশ নেতাগণের গোপনে রাসূলুল্লাহর(সা) কুরআন পাঠ শ্রবণ
বর্ণিত আছে যে, একদিন রাতে আবু সূফিয়ান বিন হারব, আবু জাহল বিন হিশাম এবং আখনাস বিন শুরাইক-এই তিনজন শীর্ষস্থানীয় কুরাইশ নেতা রাসূল(সা) এর কুরআন পাঠ শ্রবণের কৌতুহল কোনোভাবেই চেপে রাখতে না পেরে গোপনে বেরিয়ে পড়লো। এ সময় তিনি নিজের বাড়িতে তাহাজ্জুদের নামাযে কুরআন পড়ছিলেন। এই তিনজনের প্রত্যেকে এমন একটি জায়গা নিয়ে বসে পড়লো, যেখান থেকে সহজেই তেলাওয়াত শুনা যায়। অথচ নিজেদের অবস্থা গোপন থাকে। তারা এমন দূরত্বে অবস্থান করতে লাগলো যে, কে কোথায় বসেছে তা কেউ জানতে পারে নি। রাতভর তারা পরম আগ্রহ সহকারে কুরআন পাঠ শুনলো। সকালে বাড়ীর দিকে ফিরার পথে পরস্পরের সাক্ষাত হলো। প্রত্যেকে পরস্পরকে তিরস্কার করে বলতে লাগলো, “ছি ছি! এ কাজ আর কখনে করো না। তোমাদের বখাটে চেলা চামুন্ডাদের কেউ যদি তোমাদের এভাবে দেখে ফেলে, তাহলে আর রক্ষা নেই। তারা একটা খারাপ ধারণা নিয়ে বসবে।” তারপর সবাই চলে গেল।
পরদিন রাতে আবার তিনজনই নিজ নিজ জায়গায় এসে বসলো এবং সারারাত ধরে রাসূল(সা) এর কুরআন পড়া শুনলো। সকাল বেলা আবার পরস্পরে সাক্ষাত এবং একই ধরনের আলাপ বিনিময় হলো। তারপর সবাই চলে গেল। তৃতীয় দিনও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। এবার তারা চূড়ান্তভাবে অঙ্গীকার করলো যে, এমন কাজ আর কখনো করবে না। তারপর সবাই বিদায় নিলো।
পরদিন সকালে বৃদ্ধ আখনাস তার লাঠিটা ভর করে রওনা হলো। প্রথমে আবু সুফিয়ানের কাছে হাজির হলো। সে বললোঃ “ওহে হানযালার বাবা! মুহাম্মদের কাছ থেকে যা শুনলে সে সম্পর্কে তোমার মতামত কি?” আবু সুফিয়ান বললো, “আল্লাহর কসম, আমি কিছু কথা এমন শুনেছি, যা আমি জানি এবং তার অর্থও বুঝি। আবার কিছু কথা এমনও শুনলাম যার অর্থ বুঝলাম না।” আখনাস বললো, “আল্লাহর কসম, আমার অবস্থাও তদ্রুপ।”
এরপর তার কাছ হতে বিদায় নিয়ে সে আবু জাহলের কাছে গেল। আবু জাহলকে বললোঃ “ওহে আবুল হিকাম, মুহাম্মদের কাছে যা শুনলে সে সম্পর্কে তোমার অভিমত কি?” সে বললো, “কি আর বলবো? আমরা আর বনু আবদ মানাফ-এ দুটি কুরাইশী গোত্র আবহমান কাল ধরে মান ইজ্জত নিয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করে এসেছি। আপ্যায়ন ও ভোজের আয়োজন তারাও করেছে, আমরাও করেছি। সামাজিক দায়দায়িত্ব তারাও বহন করেছে, আমরাও করেছি। সব কিছুতে আমরা যখন সমানে সমানে টক্কর দিয়ে চলেছি, তখন হঠাৎ তারা বলে উঠলোঃ আমাদের ভেতর একজন নবী আছে, যার কাছে আকাশ হতে ওহী আসে। এত বড় একটা জিনিসে আমরা তাদের সমকক্ষ হব কি করে? আল্লাহর কসম, আমরা তার উপর কখনো ঈমান আনবো না এবং কক্ষনো তাকে স্বীকৃতি দেব না।” ও কথা শুনে তার কাছ হতে বিদায় নিল। (সীরাতে ইবনে হিশাম)।
শিক্ষাঃ এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আল্লাহর দ্বীনের বিরোধীতা যারাই করে, তারা তাকে সত্য জেনেই নিছক কায়েমী স্বার্থের কারণেই করে। তাছাড়া তাদের ভিতর একটা হীনমন্যতা সক্রিয় থাকে। আবু জাহল প্রমুখ কুরাইশ নেতাদের মধ্যে হীনমন্যতার কারণ ছিল এই যে, ওহীর কারণে বনু হাশেমের সাথে তাদের সমকক্ষতা ও ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং বনু হাশেমের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয়। আর এ যুগে কোনো ইসলামী আন্দোলনের বিরোধীরা হীনমন্যতায় ভুগবে এজন্য যে, ইসলামী আন্দোলনের লোকেরা এত উন্নত মানের চরিত্র ও নিঃস্বার্থ জনসেবার নমুনা পেশ করে থাকে, যার সমকক্ষ তারা কখনো হতে পারবে না। তাই ইসলামী চরিত্র সম্পন্ন লোকদের হাতে কখনো ক্ষমতা গেলে দেশবাসী দুর্নীতিমুক্ত শাসনের স্বাদ পাবে। ফলে ধর্মহীন শক্তিগুলোকে জনগণ আর কখনো ক্ষমতায় আসতে দেবে না। এ কারণে এ যুগের প্রতিষ্ঠিত জাহেলী শক্তিও সর্বশক্তি দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে থাকে।
এ ঘটনা থেকে আরো জানা যায় যে, ইসলামের শত্রুদেরও সাধারণ মনস্তত্ব হলো ইসলামের তাত্ত্বিক বিষয় তাদের জানার প্রচ্ছন্ন কৌতুহল থাকে। নেতৃস্থানীয় লোকেরা এ কৌতুহল পার্থিব স্বার্থের কারণে করে থাকে। কিন্তু শত্রুতা যতই তীব্র হয়, তাদের প্রভাবাধীন সাধারণ মানুষের মনে ইসলামকে জানার আগ্রহ ততই প্রবল হয়ে থাকে।
২৮। তাবুক অভিযানে অনুপস্থিত তিন সাহাবীর তওবার কাহিনী
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের সেনাপতিত্বে যে কয়টি যুদ্ধ বা যুদ্ধাভিযান সংঘটিত হয়, তন্মধ্যে তাবুক যুদ্ধাভিযান ছিল অন্যতম। যদিও প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতির কারণে এ যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সংঘটিত হয় নি। কিন্তু তথাপি যুদ্ধের নির্ধারিত স্থান তাবুক –এ মুসলিম বাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে ও সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সদলবলে যেতে হয়েছিল। মক্কা বিজয়ের পর এটাই ছিল ইসলামের সর্বশেষ বৃহত্তম যুদ্ধাভিযান। এই অভিযানের জন্য সাহাবায়ে কেরামের কারো শারীরিক অনুপস্থিতির অনুমতিতো ছিলই না, অধিকন্তু প্রত্যেক সাহাবীকে সাধ্যমতো সর্বোচ্চ পরিমাণ আর্থিক সাহায্য দেওয়ার আহবান জানানো হয়েছিল। তাবুক অভিযানের প্রাক্কালে যখন আর্থিক সাহায্য চাওয়া হয়, তখন হযরত ওমর(রা) নিজের সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তির অর্ধেক আর হযরত আবু বকর(রা) সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি দান করেছিলেন।
কিন্তু তিনজন সাহাবী এই যুদ্ধে অপ্রত্যাশিতভাবে বিনা ওজরে অনুপস্থিত থাকেন। তারা হলেন কা’ব বিন মালেক, হিলাল ইবনে উমাইয়া ও মুরারা বিন রাবী। এই তিনজন সাহাবী সম্পর্কে অপর কোনো সাহাবীর এমনকি স্বয়ং রাসূল(সা) এরও কখনো কোনো অভিযোগ বা সংশয় ছিল না। তাঁদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় কোনো খাদ ছিল না। তথাপি সর্বোচ্চ গুরুত্ববহ এই অভিযানে তারা সম্পূর্ণ বিনা ওজরে অনুপস্থিত ছিলেন। এ সংক্রান্ত বিশদ ঘটনা স্বয়ং হযরত কা’ব ইবনে মালেক বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনা নিম্নরূপঃ
কা’ব বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(সা) এর নেতৃত্বে যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তন্মধ্যে তাবুক ও বদর ছাড়া আর কোনোটিতেই আমি অনুপস্থিত থাকিনি। তবে বদর যুদ্ধে যারা অনুপস্থিত ছিলেন তাদের কাউকে আল্লাহর আক্রোশের সম্মুখীন হতে হয়নি। কেননা বদর যুদ্ধে রাসূল(সা) এর উদ্দেশ্য ছিল কুরাইশদের কাফেলাকে ধাওয়া করা। এরূপ করতে গিয়ে হঠাৎ এক সময় যুদ্ধ বেঁধে যায়। আকাবার রাতে রাসূল(সা) ইসলামের উপর দৃঢ়ভাবে টিকে থাকা এবং ইসলাম ও রাসূল(সা) কে সাহায্য করার জন্য যে ৭০ জন এর কাছ হতে শপথ গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। ঐ রাতটি আমার কাছে যুদ্ধের চেয়েও প্রিয় ছিল।
তাবুক যুদ্ধের সময় আমি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ও স্বচ্ছল অবস্থায় ছিলাম। এ সময় আমার কাছে দুটো সওয়ারী ছিল, যা এর আগে কখনো ছিল না। রাসূল(সা) এর নিয়ম ছিল, যখনই কোনো যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতেন, কখনো পরিষ্কারভাবে স্থান, এলাকা বা কো্ন্ দিকে যাওয়া হবে তাও পর্যন্ত জানাতেন না। কিন্তু তাবুক যুদ্ধের সময়টা ছিল ভীষণ গরমের সময়। পথও ছিল দীর্ঘ এবং তার কোথাও গাছপালা, লতাপাতা ও পানি ছিল না আর শত্রুর সংখ্যাও ছিল অত্যধিক। তাই রাসূল(সা) যুদ্ধের সকল প্রয়োজনীয় জ্ঞাতব্য বিষয় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, যাতে তারা ভালোভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। এ সময় রাসূল(সা) এর সহযোদ্ধার সংখ্যা ছিল বিপুল। তবে তাদের নামধাম লেখার জন্য কোনো খাতাপত্র বা রেজিস্টার ছিল না। এ যুদ্ধ থেকে অনুপস্থিত থাকতে চায়-এমন লোক একজনও ছিল না। তবে সকল সাহাবী এও মনে করতেন যে, কেউ যদি অনুপস্থিত থাকে, তবে আল্লাহর ওহী না আসা পর্যন্ত রাসূল(সা) তা জানতে পারতেন না।
রাসূল(সা) যখন এ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, তখন ফল পেকে গিয়েছিল এবং ছায়া খুবই ভালো লাগতো। রাসূল(সা) ও তার সাথী মুসলমানগণ পূর্ণোদ্দমে যুদ্ধের প্রস্তুতি চালাচ্ছিলেন। আমিও প্রতিদিন ভাবতাম প্রস্তুতি নেব। কিন্তু কোনো প্রস্তুতিই নেয়া হতো না। এমনিই দিন কেটে যেত। আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম, আমিতো যেকোন সময় প্রস্তুতি নিতে পারবো। ব্যস্ত হওয়ার দরকার কি? এভাবে দিন গড়িয়ে যেতে থাকে। একদিন ভোরে তিনি মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন। তখনো আমার প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। আমি মনে মনে বললাম, তারা চলে যায় যাক। আমি পথেই তাদেরকে ধরতে পারবো। তাদের রওনা হয়ে যাওয়ার পরের দিন আমি রওনা হতে চাইলাম। কিন্তু দিনটা কেটে গেলো, আমার রওনা দেয়া হয়ে উঠলো না। পরদিন সকালে আবার ইচ্ছা করলাম। কিন্তু এবারও পারলাম না রওনা দিতে। এভাবে গড়িমসির মধ্য দিয়ে দিনের পর দিন কেটে গেল। ততক্ষণে মুসলিম বাহিনী অনেক দূর চলে গেছে। আমি কয়েকবার বেরিয়ে দ্রুত বেগে তাদেরকে ধরে ফেলার সংকল্প করেও পিছিয়ে গেলাম। আফসোস তখনও যদি কাজটি সেরে ফেলতাম। কিন্তু আসলে তা বোধ হয় আমার ভাগ্যে ছিল না। রাসূল(সা) ও মুসলমানদের চলে যাওয়ার পর আমি যখন মদীনায় জনসাধারণের মধ্যে বেরুতাম, তখন পথে ঘাটে মুনাফিক ও পিড়াব্যাধিগ্রস্ত লোক ছাড়া আর কাউকে দেখতাম না। এ পরিস্থিতিতে নিজেকে দেখে আমার খুবই দুঃখ লাগতো।
রাসূল(সা) তাবুক যাওয়ার পথে আমার সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করেন নি। তবে তাবুকে পৌছে জিজ্ঞেস করেন যে, কা’বের কি হয়েছে? বনু সালামার এক ব্যক্তি বললোঃ হে রাসূলুল্লাহ! নিজের সম্পদের মায়া ও আত্মাভিমানের কারণে সে আসেনি। মুয়াজ ইবনে জাবাল এ কথা শুনে বললেনঃ “ছি, কি একটা বাজে কথা তুমি বললে! আল্লাহর কসম, তার সম্পর্কে আমরা কখনো কোন খারাপ কথা শুনিনি।” রাসূল(সা) উভয়ের বাক্য বিনিময়ের মধ্যে চুপ করে থাকলেন।
কা’ব ইবনে মালেক বলেনঃ যখন আমি জানতে পারলাম যে, রাসূল(সা) ফিরে আসছেন, তখন ভাবলাম, এমন কোনো মিথ্যা ওজর বাহানা করা যায় কিনা, যাতে আমি তাঁর অসন্তোষ থেকে রক্ষা পেতে পারি। কিন্তু পরক্ষণেই এসব চিন্তা আমার দূর হয়ে গেল। আমি মনে মনে বললাম যে, মিথ্যে ওজর দিয়ে আমি রেহাই পাব না। কারণ রাসূল(সা) ওহীর মাধ্যমে জেনে ফেলবেন। কাজেই পুরোপুরি সত্য কথা বলবো বলে স্থির করলাম। রাসূল(সা) পরদিন সকালে ফিরে এসে মসজিদে নববীতে বসলে তাবুক যুদ্ধে যারা যায়নি তারা একে একে আসতে লাগলো এবং প্রায় ৮০ জন(মতান্তরে ৮২ জন) নানারকম ওজর বাহানা পেশ করে কসম খেতে লাগলো। রাসূল(সা) তাদের ওজর মেনে নিলেন, তাদের কাছ হতে পুনরায় বায়য়াত নিলেন, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং তাদের গোপন বিষয় আল্লাহর কাছে সোপর্দ করলেন। আমিও তাঁর কাছে এলাম। আমি সালাম দিলে তিনি ঈষৎ ক্রোধ মিশ্রিত মুচকি হাসিসহ জবাব দিলেন। তারপর বসতে বলে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার কি হয়েছিল যে তাবুকে যেতে পারলে না? তুমি না সওয়ারী কিনে নিয়েছিলে? আমি বললামঃ জি, সওয়ারী কিনে নিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম, আমি যদি আপনি ছাড়া অন্য কারো সামনে বসতাম, তাহলে তার আক্রোশ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য মিথ্যা ওজর পেশ করে চলে যেতাম। কারণ কথা বলার দক্ষতা আমারও আছে। কিন্তু আমি জানি, আজ আপনার কাছে মিথ্যা বলে আপনাকে খুশি করা গেলেও আল্লাহ তায়ালা কালই সব ফাঁস করে দিয়ে আপনাকে আমার উপর অসন্তুষ্ট করে দিবেন। আর যদি সত্য বলি, তাতে আপনি অসন্তুষ্ট হলেও আল্লাহর ক্ষমা লাভের আশা আছে। আল্লাহর কসম, আমার না যাওয়ার জন্য কোন ওজর ছিল না। আল্লাহর কসম, আমি এ সময়ে সর্ব প্রকারে সুস্থ, সবল ও সক্ষম ছিলাম।
রাসূল(সা) আমার কথা শুনে বললেনঃ কা’ব সত্য কথা বলেছে। বেশ, তুমি এখন যাও। দেখ, আল্লাহ তোমার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত দেন।
আমি বিদায় নিলাম। বনু সালামার লোকেরাও আমার সাথে চলতে লাগলো। তারা আমাকে বললোঃ“আমরা তো আজ পর্যন্ত তোমার কোন পাপ কাজের কথা শুনিনি। অন্যান্যদের মত তুমিও একটা ওজর পেশ করে দিলেই পারতে। তারপর রাসূল(সা) তোমার জন্য ক্ষমা চাইতেন এবং তাতেই তোমার গোনাহ মাফ হয়ে যেত।” তারা এভাবে আমাকে ক্রমাগত তিরস্কার করতে লাগলো। ফলে এক পর্যায়ে মনে মনে স্থির করে ফেললাম, রাসূল(সা) এর কাছে ফিরে যাই এবং আগে যা বলেছি তা ভুল প্রতিপন্ন করে আসি। সহসা আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলামঃ আচ্ছা, আমার মত অকপটে সত্য বলে ভুল স্বীকার করতে তোমরা কি আর কাউকে দেখেছ? তারা বললোঃহ্যাঁ, হিলাল বিন উমাইয়া ও মুরারা বিন রবীও তোমার মতই কথা বলেছে। এই দুজনকে আমি ভালোভাবে জানতাম। তারা ছিলেন খুবই সৎলোক এবং বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। তাদের দু’জনের কথা শুনে আমি আমার পূর্বের বক্তব্যে অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এদিকে রাসূল(সা) তাবুকে অনুপস্থিত থাকা লোকদের মধ্যে আমাদের তিনজনের সাথে কথা বলা সকল মুসলমানের জন্য নিষিদ্ধ করে দিলেন। তাই লোকেরা আমাদেরকে বয়কট করে চললো। যেন আমরা তাদের একেবারেই অচেনা মানুষ। দুনিয়াটাই যেন আমার কাছে বদলে গেল। এভাবে পঞ্চাশ দিন কেটে গেল। অন্য দু’জন তো ঘরেই বসে রইলো এবং কান্নাকাটি করতে লাগলো। কিন্তু আমি বাইরে বেরুতাম এবং মসজিদে নববীতে নামায আদায় করতাম ও বাজারে ঘুরতাম। কিন্তু কেউ আমার সাথে কথা বলতো না। আমি রাসূল(সা) এর কাছে যেতাম। তিনি নামাযের পর মজলিসে বসলে সেখানেও তাকে সালাম দিতাম, আর দেখতাম, সালামের জবাবে তার ঠোঁট নড়তো কিনা। আমি তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে নামায পড়তাম। আমি বাঁকা দৃষ্টিতে তাঁকে দেখতাম আমি নামায পড়ার সময় তিনি আমার দিকে তাকাতেন, আর আমি তাকালেই মুখ ফিরিয়ে নিতেন। এ অবস্থায় অনেকদিন কেটে গেল। ক্রমে আমি অস্থির ও দিশেহারা হয়ে পড়লাম। একদিন আমার অতি প্রিয় চাচাতো ভাই আবু কাতাদাহকে সালাম করলাম। কিন্তু সে সালামের জবাব পর্যন্ত দিল না। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলামঃ হে আবু কাতাদাহ! আমি যে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে ভালোবাসি, তা কি তুমি স্বীকার কর না? সে একথার কোন জবাব দিল না। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করলেও জবাব দিল না। তৃতীয়বার আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে শুধু বললোঃ আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই(সা) ভালো জানেন। আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমি তার কাছ হতে ফিরে এলাম। এই সময় একদিন মদীনার বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। এই সময় সিরিয়ার একজন খৃস্টান কৃষক মদীনার বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে এসেছিল। সে লোকজনের কাছে আমার ঠিকানা সন্ধান করছিল। লোকেরা আমাকে দেখিয়ে দিলে সে গাসসানের রাজার একটি চিঠি আমার হাতে দিল। চিঠিতে রাজা লিখেছেঃ আমি জানতে পেরেছি যে, আপনার নেতা আপনাকে খুব কষ্ট দিচ্ছেন। অথচ আল্লাহ আপনাকে লাঞ্ছনা ও অবমাননার যোগ্য রাখেন নি। আপনি আমাদের এখানে চলে আসুন। আমরা আপনাকে সম্মানের সাথে রাখবো। চিঠিটা পড়ার সাথে সাথে আমি মনে মনে বললাম, এ আর এক পরীক্ষা। আমি তৎক্ষণাত তা চুলোর মধ্যে নিক্ষেপ করলাম।
এভাবে চল্লিশ দিন কেটে গেল রাসূল(সা) এর এক দূত আমার কাছে এসে বললোঃ রাসূল(সা) তোমাকে তোমার স্ত্রী হতে পৃথক হয়ে যাবার আদেশ দিয়েছেন। আমি বললামঃ ওকে তালাক দেব নাকি? দূত বললেনঃ না, তালাক দিতে হবে না, তবে তার কাছে যাবে না। আমার অন্য দু’জন সাথীকেও একই হুকুম দেয়া হল। আমি আমার স্ত্রীকে বললামঃ তুমি বাপের বাড়ীতে চলে যাও এবং আল্লাহর ফয়সালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। হিলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রী রাসূল(সা) এর কাছে এসে বললেনঃ হে রাসূল! আমার স্বামী বুড়ো হয়ে গেছে। তার কোন ভৃত্য নেই। আমি যদি তার দৈনন্দিন কাজকর্ম করে তার সেবা করে দেই, তাতে কি আপত্তি আছে? রাসূল(সা) বললেন, আপত্তি নেই। তবে সে যেন তোমার কাছে না আসে। আমাকেও কেউ কেউ বললো যে, তুমি রাসূল(সা) এর কাছে গিয়ে স্ত্রীর জন্য অনুমতি নিয়ে এসো। আমি বললামঃ না, আমি কোন অনুমতি আনতে যাব না। জানি না তিনি কি ভাববেন। কারণ হিলাল বিন উমাইয়া বুড়ো, আর আমি যুবক।
এভাবে আরো দশটি দিন কেটে গেল একদিন আমি ফজরের নামায পড়ে অত্যন্ত বিষন্ন মনে বসেছিলাম। সহসা কে একজন চিৎকার করে বলতে বলতে ছুটে আসতে লাগলোঃ ক্বাব ইবনে মালেক! সুসংবাদ গ্রহণ কর। আমি তৎক্ষণাত সেজদায় পড়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের মুসিবত কেটে গেছে। রাসূলুল্লাহ(সা) ঐদিন ফজরের নামাজের পর ঘোষণা দিয়েছেন যে, আল্লাহ আমাদের তাওবা কবুল করে নিয়েছেন। লোকেরা দলে দলে এসে আমাকে অভিনন্দন জানাতে লাগলো। এরপর আমি রাসূল(সা) এর সাথে সাক্ষাত করতে গেলাম। আমি দেখলাম, তিনিও আমার সুসংবাদে আনন্দিত। আমি বললামঃ হে রাসূলুল্লাহ(সা)! আমার তওবা কবুলের জন্য শুকরিয়া স্বরূপ আমার সমস্ত ধনসম্পদ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথে সদকা করে দিতে চাই। রাসূল(সা) বললেনঃ সব নয়, কিছু অংশ নিজের জন্য রেখে দাও। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ এবার আমাকে সত্য কথা বলার কারণে ক্ষমা করেছেন। কাজেই এরপর বাকী জীবন আমি সর্বদা সত্য কথাই বলতে থাকবো। আল্লাহ যেন আমাকে মিথ্যা থেকে রক্ষা করেন।
শিক্ষাঃ
(১) এই ঘটনার সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে, ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্য কথা বলার নীতিতে অটল থাকতে হবে। চাই তাতে যত কঠিন পরীক্ষাই আসুকনা কেন।
(২)আল্লাহ মোনাফেকদেরকে পরীক্ষার সম্মুখীন করেন না বরং মুমিনদেরকেই কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। এই তিন মুমিন ব্যতীত বাকী ৮২ জন মিথ্যা অজুহাত পেশ করলেও তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়নি। কারণ তারা ছিল মুনাফিক। তাই আল্লাহ তাদেরকে পরিশুদ্ধ করতে চান নি।
(৩) ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্বের অধিকার রয়েছে কুরআন হাদীসের সীমার মধ্যে নিষ্ঠাবান কর্মীদেরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য পরীক্ষার সম্মুখীন করা বা গুরুতর ভুল কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া। এ সব ক্ষেত্রে আনুগত্যের পরিচয় দিয়ে এবং কোন দিক থেকে কুপ্ররোচণা এলে তা উপেক্ষা করে পরীক্ষায় কৃতকার্য হবার চেষ্টা করতে হবে।
(৪) ইসলামী আন্দোলনের কোন পর্যায়ে কারো কোন সাফল্য বা কৃতিত্ব প্রমাণিত হলে তার জন্য যাতে অন্তরে গর্ব বা অহমিকার সৃষ্টি না হয় সেজন্য সম্ভব হলে সদকা করা উত্তম। আর সেই সাথে তওবা ইসতিগফারও অব্যাহত রাখা উচিত।
(৫) অলসতা ও সিদ্ধান্তহীনতা এই তিনজন মুজাহিদের জীবনে চরম সংকট সৃষ্টি করেছিল। কাজেই অলসতা, গড়িমসি ও সিদ্ধান্তহীনতা সর্বোতভাবে পরিত্যাজ্য।
২৯। হযরত সালমান ফারসীর ইসলাম গ্রহণ
হযরত সালমান ফারসী প্রথম জীবনে একজন অগ্নউপাসক ছিলেন। পরে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং সবশেষে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি পারস্যের ইসফাহান প্রদেশের অধিবাসী ছিলেন। তার পিতা ছিলেন একজন বিত্তশালী গ্রাম্য মোড়ল। তিনি তাকে এত বেশি স্নেহ করতেন যে, তাকে বাড়ী থেকে কোথাও যেতে দিতেন না। তিনি জানান যে, এই সময়ে তিনি অগ্নি উপাসকদের ধর্মে গভীর দক্ষতা অর্জন করেন। এক মুহুর্তের জন্যও যাতে আগুন নিভতে না পারে-এভাবে কুন্ডলী জ্বালিয়ে রাখতে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এ সময়ে ঘটনাক্রমে একটি জমি দেখাশুনার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করা হয়। এই জমি দেখতে গিয়ে তিনি পিতার অনুমতিক্রমে বাড়ীর বাইরে যাওয়া আসা করতে লাগলেন। এই সময় তার যাওয়া আসার পথের পাশে একটি খৃস্টান গীর্জা তার নজরে পড়ে। লোকজনের হৈ চৈ শুনে কৌতুহল বশতঃ তিনি সেই গীর্জার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। সেখানে তাদের উপাসনা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান এবং মনে মনে বলেন, অগ্নি উপাসকদের ধর্মের চেয়ে এই ধর্ম অনেক ভাল। ঐ দিন আর জমি দেখতে যাওয়া হলো না। তিনি সারাদিন গীর্জায় কাটিয়ে দিলেন। গীর্জার লোকদের কাছে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন যে, এই ধর্মের উৎস কোথায়? তারা জানালো যে, সিরিয়ায়। এরপর তিনি তাঁর পিতার কাছে ফিরে গেলেন। তাঁর পিতা তাঁকে জিজ্ঞাসা তুমি সারাদিন কোথায় ছিলে? সালমান গীর্জার ঘটনা খুলে বললেন। সেই সাথে এই কথাও বললেন যে, ঐ ধর্ম তাঁর কাছে ভালো লেগেছে। একথা শুনে তার বাবা বললেন, না বাবা, তোমার জন্য তোমার বাপ দাদার ধর্মই ভালো।
সালমান বললেন, না বাবা, ঐ ধর্মই ভাল। এতে তিনি তাঁকে নিয়ে ভীত হয়ে পড়লেন এবং তাঁর পায়ে শিকল পরিয়ে দিলেন। এই সময় সালমান গোপনে গীর্জায় খৃস্টানদের নিকট খবর পাঠান যে, আপনাদের কাছে সিরিয়া থেকে কোনো কাফেলা এলে আমাকে জানাবেন। কিছুদিন পর সিরিয়া থেকে একটা কাফেলা এল। তারা যথাসময়ে সালমানকে সে খবর জানালো। সালমান বলে পাঠালেন যে, এই কাফেলার কাজ যখন শেষ হবে এবং তারা সিরিয়ায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিবে, তখন আমাকে জানাবেন। তারপর কাফেলার কাজ শেষে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করলে তা সালমানকে জানানো হলো। সালমান তৎক্ষণাত স্বীয় পিতার স্নেহের শিকল ভেঙ্গে গোপনে তাদের সাথে সিরিয়ায় চলে গেলেন। সিরিয়ায় গিয়ে তিনি লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেনঃ এই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী কে? তারা তাকে জানালো যে, গীর্জার পাদ্রীই সবচেয়ে জ্ঞানী।
সালমান পাদ্রীর নিকট হাজির হয়ে বললেনঃ আমি এই ধর্মের প্রতি খুবই আগ্রহী। আমি আপনার সহচর হয়ে আপনার সেবা করতে চাই এবং আপনার কাছ থেকে ধর্ম শিখতে ও উপাসনা করতে চাই। পাদ্রী সালমানকে স্বীয় গীর্জায় থাকতে দিলেন এবং সালমান খৃস্টধর্মে দীক্ষা নিতে লাগলেন। এই সময়ে সালমান বুঝতে পারলেন যে, উক্ত পাদ্রী খুবই অসৎ। সে জনসাধারণের কাছ হতে সদকা আদায় করে এবং তা গরীবদের মধ্যে বিতরণ না করে নিজে আত্মসাৎ করে। এভাবে সে বিপুল সম্পদ সঞ্চয় করে। সালমান এরপর থেকে তাকে ঘৃণা করতে লাগলেন এবং এই স্থান ত্যাগ করার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন।
এই পাদ্রী মারা গেলে খৃস্টানরা তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য সমবেত হয়। সালমান তাদেরকে বললেনঃ এ লোকটি চরম দুর্নীতিবাজ ছিল। সে তোমাদেরকে ছদকা দিতে উপদেশ দিত। কিন্তু নিজে তোমাদের দেয়া ছদকাগুলো আত্মসাৎ করতো। তারা সালমানকে বললোঃ তোমার এসব অভিযোগ যে সত্য, তার প্রমাণ কী? তিনি এর প্রমাণস্বরূপ তার জমা করা সাতটি সোনা রূপা ভর্তি কলসি বের করে দেখালেন। তা দেখে সমবেত জনতা ক্রুদ্ধ স্বরে বললোঃ আমরা এ নরাধমকে কবর দেব না। তারপর লাশকে তারা শূলে চড়াল। তার উপর পাথর ছুঁড়লো এবং তারপর একজন নতুন যাজক নিয়োগ করলো।
নতুন যাজক ছিল একজন নিরেট সৎলোক। পৃথিবীর ধন-সম্পদের প্রতি তার কোন লালসা ছিল না। সালমান কিছুদিন তার কাছে থাকলেন। তারপর তার মৃত্যু কাছাকাছি এলে সালমান তাকে বললেনঃ জনাব, আমি তো এতদিন এখানে কাটালাম। এখন আপনার পর আমি কোথায় কার কাছে যাবো বলে দিন।
তিনি বললেনঃ বাবা! আমি যতটা খাঁটি ধর্মের অনুসারী ছিলাম, এখন তেমন আর কাউকে দেখি না। ভালো লোকেরা সব পরপাড়ে পাড়ি জমিয়েছে। এখন যারা আছে, তারা অধিকাংশই ধর্মকে খানিকটা বিকৃত করেছে, আর খানিকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। তবে মুসেলে একজন আছে খাঁটি ধর্মের অনুসারী। তুমি তার কাছে চলে যাও।
সালমান মুসেলের যাজকের কাছে গেলন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনিও মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগে নসিবেইনের এক ব্যক্তির সন্ধান দিয়ে গেলেন। অতঃপর সালমান নসিবাইনে গেলেন। সেখানেকার পাদ্রীর কাছে কিছুদিন থাকার পর তিনিও মারা গেলেন। মারা যাওয়ার সময় আম্মুরিয়ার আর একজন যাজকের সন্ধান দিয়ে গেলেন। সালমান আম্মুরিয়ায় চলে গেলেন।
আম্মুরিয়ায় কিছুদিন থাকার পর সেখানকার যাজকও মারা গেলেন। মৃত্যুর প্রাক্কালে সালমান তার কাছে একজন সৎ যাজকের সন্ধান চাইলে তিনি বললেনঃ এখন আমার জানামতে সঠিক ধর্মের কোন অনুসারী যাজক পৃথিবীতে জীবিত নেই। তবে একজন নতুন নবীর আবির্ভাবের সময় পৃথিবীতে ঘনিয়ে এসেছে। তিনি ইবরাহীম(আ) এর দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। তিনি আরব ভূমিতে আবির্ভূত হবেন এবং দুই মরুর মাঝে খেজুরের বাগানে পরিপূর্ণ জায়গায় হিজরত করবেন। তিনি হাদিয়া নিবেন কিন্তু ছদকা গ্রহণ করবেন না। তার দুই কাঁধের মাঝে নব্যুয়তের সীল থাকবে। তুমি যদি সেই দেশে যেতে পার তবে যেও।
আম্মুরিয়ায় হযরত সালমান অনেক ছাগল ভেড়া পুষতেন। তারই একপাল ছাগল ভেড়া একদল আরব বনিককে দিয়ে তিনি আম্মুরিয়া থেকে আরব চলে গেলেন। ওয়াদিল কুরাতে তারা তাকে এক ইহুদীর নিকট বিক্রী করে দিল। সালমান এই ইহুদীর খেজুরের বাগানে কাজ করতে লাগলেন। ঐ খেজুরের বাগান দেখে তিনি ভেবেছিলেন, এটাই সেই আখেরী নবীর আবির্ভাব স্থান। তাই তিনি ইহুদীর কাছে থাকতে লাগলেন।
হযরত সালমান বলেনঃ “এই সময় একদিন মদীনা হতে আমার ইহুদী মনিবের একজন আত্মীয় এল। বনু কুরায়যা গোত্রের এই ইহুদী আমাকে কিনে নিয়ে মদীনায় চলে এল। মদীনাকেই দেখে আমি চিনতে পারলাম যেন ওটা অবিকল আমার আম্মুরিয়ার ওস্তাদের বর্ণিত জায়গা। তাই আমি ওখানেই থাকতে লাগলাম। এই সময় মক্কায় রাসূল(সা) নব্যূয়ত লাভ করেছেন বলে শুনলাম। তবে তার সম্পর্কে বিস্তারিত খবরাখবর জানতে পারলাম না। কিছুদিন পর তিনি মদীনায় হিজরত করে আসলেন।
একদিন আমি খেজুর ভর্তি গাছের মাথায় চড়ে আমার মনিবের জন্য কিছু কাজ করছি। মনিব তখন আমার নিচে বসা ছিলেন। সহসা তার এক চাচাতো ভাই এসে তাকে বললোঃ আল্লাহ কায়লার বংশধরকে ধ্বংস করুন। (আওস ও খাজরাজ এই দুই গোত্রের মায়ের নাম কায়লা। তাই কায়লার বংশধর বলতে ঐ দুই গোত্রকে বুঝানো হয়েছে)। ওরা এখন মক্কা হতে আগত এক ব্যক্তির চারিপাশে ভিড় করছে। লোকটি আজই এসেছে। আওস ও খাজরাজ মনে করে সে নাকি এ যুগের নবী এবং সর্বশেষ নবী। হযরত সালমান বললেনঃ খেজুর গাছের উপর বসে আমি যখন এ খবর শুনলাম, তখন আনন্দে ও উত্তেজনায় এত বেসামাল হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি মনিবের ঘাড়ের উপর পড়ে যাব বলে আশংকা হচ্ছিল। অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে গাছ হতে নেমে এসে ঐ লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনি কার কথা যেন বলেছিলেন? অমনি আমার মনিব আমাকে ঠাস করে একটি চড় বসিয়ে দিল। সে বললোঃ তোর তা দিয়ে কি দরকার? আমি বললামঃ কিছু না. কৌতুহল বশতঃ জিজ্ঞেস করেছিলাম।
হযরত সালমান বলেনঃ এরপর আমি নিজের কাছে সঞ্চিত কিছু খাবার জিনিস নিয়ে সন্ধ্যা বেলায় গোপনে কুবাতে রাসূল(সা) এর কাছে উপস্থিত হলাম। তাকে বললামঃ আমি শুনেছি, আপনার সাথে অনেক দরিদ্র লোক রয়েছে। তাদের কাছে আমি কিছু ছদকা এনেছি। এই বলে উক্ত খাদ্য হাযির করলে তিনি সাহাবীদেরকে তা খেতে দিলেন। কিন্তু নিজে খেলেন না। তখন আমি মনে মনে বললামঃ আম্মুরিয়ার যাজক যে তিনটি আলামতের কথা বলেছে, তার একটি পেয়ে গেলাম। অতঃপর আমি সেদিনকার মত চলে এলাম।
আর একদিন আরো কিছু খাবার নিয়ে তা হাদীয়া হিসেবে পেশ করলাম। রাসূল(সা) তা নিজেও খেলেন এবং অন্যদেরকেও খাওয়ালেন। এরপর আমি দ্বিতীয় আলামতটিও পেয়ে গেলাম।
এরপর যখন তিনি বাকীযুল গারকাদ নামক কবরস্থানে তাঁর জনৈক সাহাবীর দাফন সম্পন্ন করে ফিরে আসছিলেন, তখন আমি তাঁর কাছে উপস্থিত হলাম। সেই সময় রাসূল(সা) এর গায়ে ঢিলেঢালা পোশাক ছিল। আমি নব্যুয়তের মোহরটি দেখার জন্য তাঁর ঘাড়ের উপর চোখ বুলাতে লাগলেন। রাসূল(সা) আমার চাহনির হাবভাব দেখে বুঝে ফেললেন এবং তাঁর পিঠের উপর থেকে চাদর উঠিয়ে ফেলে দিলেন। আমি তখন নব্যুয়তের মোহর দেখে চিনতে পারলাম। আমি মোহরটিতে চুমু খাওয়ার জন্য ঝুঁকে পড়লাম এবং কাঁদতে লাগলাম। রাসূল(সা) আমাকে বললেনঃ সামনে এস। আমি সামনে গিয়ে বসে পড়লাম। অতঃপর অতীতের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম।
এরপর রাসূল(সা) আমাকে ইহুদীর দাসত্ব হতে মুক্ত হবার জন্য ৪০ আউন্স স্বর্ণ দিলেন। ঐ স্বর্ণ ইহুদীকে দিয়ে আমি মুক্তি লাভ করলাম। কিন্তু বদর ও ওহুদ যুদ্ধ আমার দাসত্বকালে সংঘটিত হয়। তাই আমি তাতে অংশগ্রহণ করতে পারিনি।
শিক্ষাঃ হযরত সালমান ফারসীর ইসলাম গ্রহণের এই ঘটনা অত্যন্ত শিক্ষাপ্রদ। এর সর্বপ্রধান শিক্ষা হচ্ছে এই যে, মুহাম্মদ(সা) ছাড়া পৃথিবীতে আল্লাহ প্রেরিত আর কোন নবীর শরীয়ত অবিকৃত অবস্থায় নেই। তাই ইসলাম ছাড়া আর কোন ধর্ম সঠিক ও নির্ভুল নয়। এই সত্য ও সঠিক দ্বীনের সন্ধান লাভের জন্য হযরত সালমান ফারসী প্রথম দিন হতেই অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। আল্লাহ তাঁর অক্লান্ত সাধনাকে সফল করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা সত্যের সন্ধানরত প্রত্যেক মানুষকেই সত্যের সন্ধান দিয়ে থাকেন।
৩০। মিথ্যা সকল পাপের জননী
একবার রাসূলুল্লাহ(সা) এর নিকট এক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে বললোঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার মধ্যে তিনটি বদঅভ্যাস রয়েছেঃ মিথ্যা বলা, চুরি করা ও মদ খাওয়া। আমি তিনটি বদঅভ্যাসই ছেড়ে দিতে চাই। কিন্তু একসাথে তিনটি ছাড়তে পারছি না। আমাকে একটি একটি করে এগুলি পরিত্যাগ করার সুযোগ দিন এবং কোনটি আগে ত্যাগ করবো তা বলে দিন।
রাসূল(সা) একটু চিন্তা করে বললেনঃ তুমি প্রথমে মিথ্যা বলার অভ্যাস ত্যাগ কর। আর এই ত্যাগ করার উপর বহাল আছ কিনা, তা জানানোর জন্য মাঝে মাঝে আমার কাছে এস।
সে এতে রাজী হয়ে গেল এবং কোন অবস্থাতেই মিথ্যা বলবে না বলে দৃঢ় সংকল্প করলো।
রাত্রে সে অভ্যাসমত চুরি করতে বেরিয়ে পড়লো। কেননা এটা সে বাদ দেওয়ার ওয়াদা করেনি। কিন্তু কিছুদূর গেলেই তার মনে হলোঃ রাসূল(সা) এর সাথে দেখা করতে গেলে তিনি যদি চুরি করেছি কিনা জিজ্ঞেস করেন তা হলে তো মিথ্যা বলা যাবে না। কাজেই সত্য বলে স্বীকারোক্তি দিতে হবে। আর তাহলে রাসূল(সা) এর দরবারে অপমানতো সহ্য করতেই হবে। উপরন্তু হাতটাও কাটা যাবে। অনেক ভেবে চিন্তে সে ফিরে এল। চুরি করতে যাওয়া হলো না।
এরপর সে মদ খাওয়ার জন্য গ্লাস হাতে নিয়ে তাতে মদ ঢাললো। কিন্তু মুখে দিতে গিয়ে আবার একই প্রশ্ন তার মনে উদিত হলো। রাসূল(সা) এর দরবারে আজ হোক কাল হোক তাকে তো যেতেই হবে। তিনি যদি জিজ্ঞেস করেন, মদ খাওয়া চলছে কিনা, তাহলে কি জবাব দেব? মিথ্যা তো বলা যাবে না। আর সত্য বললে অপমান ও ৮০ ঘা বেত্রদন্ড। অতএব, মদও সে ছেড়ে দিল।
এভাবে মিথ্যা ছেড়ে দিয়ে সে একে এক সব কয়টি চারিত্রিক দোষ হতে মুক্তি পেল। রাসূল(সা) সত্যই বলেছেনঃ মিথ্যা হলো সকল পাপের জননী।
শিক্ষাঃ এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষকে ইসলামে দীক্ষিত করার একটি অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত চমকপ্রদ কৌশল শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সেই শিক্ষাটি এই যে, ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড ও চরিত্র যখন কারো অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, তখন তাকে রাতারাতি শুধরে পবিত্র করা সম্ভব হয় না। এজন্য ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে চরিত্র সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। এতে সফলতা লাভ করা সহজ হবে। এ কথা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন সঠিক, জাতির ক্ষেত্রেও তেমনি অভ্রান্ত।
৩১। মসজিদে জেরারের ঘটনা
মদীনায় আবু আমের নামক এক খৃস্টান পাদ্রী বাস করতো। তার ছেলে ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী হযরত হানযালা (রা)। শহীদ হওয়ার পর ফেরেশতারা তাঁকে গোসল দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পিতা খৃস্টধর্মের উপর অবিচল ছিল।
রাসূল(সা) হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার পর আবু আমের তাঁর সাথে সাক্ষাত করে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন আপত্তি ও সন্দেহ উত্থাপন করে। রাসূল(সা) তার সকল আপত্তির জবাব দেন। কিন্তু তবু সে সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
সে বললোঃ আমাদের দু’জনের মধ্যে যে মিথ্যুক সে যেন অভিশপ্ত ও আত্মীয় স্বজন হতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। সে রাসূল(সা) কে একথাও জানিয়ে দিল যে, সে রাসূল(সা) এর শত্রুদেরকে সবসময় সাহায্য করতে থাকবে। নিজের এই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সে বদর হতে হুনাইন পর্যন্ত সকল যুদ্ধে মুসলমানদের শত্রুদের পক্ষ অবলম্বন করে। হুনায়নের যুদ্ধে যখন হাওয়াযেনের মত বিশালাকার গোত্র মুসলমানদের কাছে হেরে গেল, তখন সে ভগ্ন হৃদয়ে তৎকালীন খৃস্টধর্মের ঘাঁটি সিরিয়ায় চলে যায় এবং আত্মীয় স্বজন হতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। এভাবে তার নিজের বদদোয়া ও অভিশাপ দ্বারা সে নিজেই ঘায়েল হয়।
জীবদ্দশায় আবু আমের পাদ্রী আজীবন ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুতা করে। এমনকি সে রোম সম্রাটকে মদীনায় আক্রমণ চালিয়ে মুসলমানদের নাম নিশানা মুছে ফেলার প্ররোচনাও দিয়েছিল।
মদীনার মুসলমানদের মধ্যে যারা বর্ণচোরা, ভন্ড ও মোনাফেক ছিল, সর্বকালের ও সর্বদেশের মোনাফেকদের মতই তারাও ইহুদী ও খৃস্টানদের ক্রীড়নক ছিল। বিশেষতঃ আবু আমেরের তারা খুবই ভক্ত ও অনুগত ছিল। আবু আমের এই মোনাফেকদের কাছে চিঠি লিখলো যে, আমি রোম সম্রাটকে মদীনা আক্রমণ করার অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু সম্রাটের বাহিনীকে সহযোগিতা করে এমন একটি দল মদীনাতেও সংগঠিত হওয়া জরুরী। এ জন্য তোমরা মদীনায় মসজিদের নাম দিয়ে একটি গৃহ নির্মাণ কর, যেন মদীনার মুসলমানদের মধ্যে কোন সন্দেহ সৃষ্টি না হয়। সেই গৃহে নিজেরাও সমবেত হও, কিছু অস্ত্র শস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম তাতে সংগ্রহ করে রাখ।
তার এ চিঠির ভিত্তিতে বারোজন মোনাফেক মদীনার কোবা মহল্লায় একটি মসজিদ নির্মাণ করলো। এই মহল্লায় রাসূল(সা) হিজরত করে এসে প্রথম অবস্থান করেছিলেন এবং একটি মসজিদ তৈরি করেছিলেন। অতঃপর তারা স্থির করলো যে, ঐ মসজিদে রাসূল(সা) দ্বারা এক ওয়াক্ত নামায পড়াবে। এতে মুসলমানদের মনে আর কোন সন্দেহ থাকবে না। তারা বুঝবে এটাও অন্যান্য মসজিদের মতই একটা মসজিদ।
তাদের একটি প্রতিনিধি দল রাসূল(সা) এর সাথে সাক্ষাত করে বুঝালো যে, কোবার বর্তমান মসজিদটি অনেক দূরে অবস্থিত। দুর্বল ও অসুস্থ লোকেরা এতদূর যেতে পারে না। তাছাড়া ওখানে সব লোকের সংকুলনাও হয় না। তাই আমরা আর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছি। আপনি এতে এক ওয়াক্ত নামায পড়ে উদ্বোধন করে দিয়ে যান।
রাসূল(সা) তখন তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। তাই ওয়াদা করলেন যে, যুদ্ধ হতে ফিরে এসে তিনি ওখানে নামায পড়াবেন। কিন্তু তাবুক হতে ফেরার পথে সূরা তাওবার সংশ্লিষ্ট আয়াত কয়টি নাযিল করে আল্লাহ তাতে নামায পড়াতে নিষেধ করলেন এবং তাকে ‘মসজিদে যেরার’ (ক্ষতিকর মসজিদ) নামে আখ্যায়িত করলেন। রাসূল(সা) এই নির্দেশ অনুসারে নামায তো পড়লেনইনা, অধিকন্তু কতিপয় সাহাবীকে পাঠিয়ে দিয়ে মসজিদটি আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিলেন।
সূরা তাওবার সংশ্লিষ্ট আয়াতে এই মসজিদটিকে তিনটি কারণে মসজিদে যেরার বলা হয়েছেঃ এক. তা দ্বারা ইসলামের ক্ষতি সাধন ও কুফরী প্রতিষ্ঠার সংকল্প করা হয়েছিল। দুই. তা দ্বারা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল। তিন. সেখানে ইসলামের শত্রুদেরক আশ্রয় দেয়ার ফন্দি আটা হয়েছিলউ।েউ
উউলউ উল্লেখিত তিনটি উদ্দেশ্যে যখন যেখানেই কোন গৃহ নির্মাণ, কোন দল বা প্রতিষ্ঠান গঠন কিংবা আর কোন ধরনের স্থাপনার কাজ করা হবে, তখন তা মসজিদে যেরারেরই পর্যায়ভুক্ত হবে এবং মুসলমানদের দায়িত্ব হবে তা প্রথম সুযোগেই ধ্বংস করা, চাই তা মসজিদ হোক বা অন্য কোন আকারেই গঠিত হোক। এ কারণে হযরত ওমর(রা) এক মসজিদের পার্শ্বে আর একটি মসজিদ নির্মাণ করতে নিষেধ করেন। অনুরূপভাবে কোন প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় নিয়োজিত দল বা সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে অন্য কোন প্রতিষ্ঠান গঠন করা বৈধ হবে না।
শিক্ষাঃ (১) মুসলমান নাম ধারণ করেও ইসলামের চিহ্নিত শত্রুদের আনুগত্য করা সুস্পষ্ট মোনাফেকীর লক্ষণ।
(২) অজ্ঞতা বা ভুলবশত কোন অন্যায় কাজের ওয়াদা করলে সেই ওয়াদা ভংগ করা শুধু জায়েয নয় বরং ওয়াজিব।