৩২। মানুষের পরিণাম তার শেষ কর্মের উপর নির্ভরশীল
হযরত আবু হুরায়রা(রা) বর্ণনা করেন যে, আমরা খায়বরের যুদ্ধে রাসূল(সা) এর সাথে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তখন ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে দাবী করতো এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূল(সা) বললেনঃ “এই ব্যক্তি দোজখবাসী।” তারপর যুদ্ধ শুরু হলে লোকটি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করলো এবং আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হলো। এক সময় আঘাতের চোটে সে অচল হয়ে পড়লো। তখন এক সাহাবী এসে রাসূল(সা)কে বললেন, “ওহে আল্লাহর রাসূল! ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে আপনার মত কী? যে ব্যক্তিকে আপনি দোযখবাসী বলেছিলেন, সেতো প্রচন্ডভাবে যুদ্ধ করছে এবং আহত হয়েছে।” নবী করীম(সা) বললেন, “শুনে রাখো, সে দোজখবাসী।” এতে কোন কোন মুসলমান সন্দেহ পোষণ করতে লাগলেন।
ইত্যবসরে লোকটি ক্ষতস্থানের তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো। অতঃপর সে নিজের তীর হাতে নিয়ে তা দিয়ে নিজের গলা ফুঁড়ে আত্মহত্যা করলো। এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে বহুসংখ্যক সাহাবী রাসূল(সা) এর কাছে ছুটে গিয়ে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আপনার কথাকে সত্যে পরিণত করেছেন। অমুক লোকটিতো নিজের গলা ফুঁড়ে আত্মহত্যা করেছে।” তখন রাসূল(সা) বললেন, “ওহে বিলাল! ওঠো। জনগণের মধ্যে ঘোষণা করে দাও যে, মুমিন ব্যতীত কেউ বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর পাপী লোক দ্বারাও আল্লাহ কখনো কখনো এ দ্বীনের সাহায্য করে থাকেন।”
অন্য রেওয়ায়াতে আছে, রাসূল(সা) বললেনঃ কোন কোন বান্দা দোযখীর ন্যায় আমল করে, অথচ সে বেহেশতবাসী। আবার কোন কোন বান্দা বেহেশতবাসীর ন্যায় কাজ করে, অথচ সে দোজখবাসী। আর মনে রাখবে, কর্মের ফলাফল শেষ কর্মের উপর নির্ভরশীল।
শিক্ষাঃ আত্মহত্যা শুধু কবীরা গুনাহ তথা মহাপাপই শুধু নয়, বরং তা ঈমানকেও ধ্বংস করে দেয় এবং সকল কৃত সৎ কাজ বিনষ্ট করে দেয়। তাই আত্মহত্যাকারী শত ভালো কাজ করলেও দোজখবাসী হয়ে থাকে।
৩৩। বিনা তদন্তে কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ ও অপপ্রচার
মুসনাদে আহমদের বরাত দিয়ে ইবনে কাছীর বর্ণনা করেন যে, বনুল মোস্তালিক গোত্রের সরদার, উম্মুল মুমিনীন হযরত জুয়াইরিয়ার পিতা হারেছ ইবনে যেরার রাসূল(সা) এর দরবারে হাজির হলে তিনি তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং যাকাত প্রদানের আদেশ দিলেন। হারেস ইসলামের দাওয়াত কবুল এবং যাকাত প্রদানের ওয়াদা করে বললেনঃ এখন আমি নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে তাদেরকেও ইসলাম ও যাকাত প্রদানের দাওয়াত দেব। যারা আমার কথা মানবে ও যাকাত দিবে, আমি তাদের যাকাত একত্রিত করে আমার কাছে জমা রাখবো। আপনি অমুক মাসের অমুক তারিখ পর্যন্ত কোন দূত আমার কাছে পাঠাবেন। আমি তার কাছে যাকাতের জমাকৃত অর্থ দিয়ে দেব। এরপর হারেস ওয়াদা অনুযায়ী যাকাতের অর্থ জমা করলেন এবং দূত আগমনের নির্ধারিত মাস ও তারিখ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কোন দূত না আসায় হারেসের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হলো। তিনি ভাবলেন, হয়তো রাসূল(সা) কোন কারণে আমাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। নতুবা ওয়াদা অনুযায়ী দূত না পাঠানোর কোন কারণ থাকতে পারে না। হারেস তার এই আশংকার কথা ইসলাম গ্রহণকারী নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছেও ব্যক্ত করলেন। অতঃপর সবাই মিলে একদিন রাসূল(সা) এর কাছে যাবেন বলে স্থির করলেন।
এদিকে নির্ধারিত তারিখে রাসূল(সা) ওলীদ বিন ওকবাকে যাকাত গ্রহণের জন্য পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ওলীদের মনে এই ধারণা জন্মে যে, যেহেতু এই গোত্রের সাথে তার পুরনো শত্রু রয়েছে, তাই তারা হয়তো তাকে একা পেয়ে হত্যা করে ফেলবে। এই আশংকার ভিত্তিতে তিনি আর একা অগ্রসর না হয়ে সেখান থেকেই ফিরে আসেন এবং রাসূল(সা) কে গিয়ে বলেন যে, তারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে এবং আমাকেও হত্যা করার হুমকি দিয়েছে। তখন রাসূল(সা) রাগান্বিত হয়ে হযরত খালীদ বিন ওলীদের নেতৃত্বে একদল মুজাহিদ প্রেরণ করেন। ঠিক এই সময়ে হারেস মদীনার উপকন্ঠে উপস্থিত হয়ে এই মুজাহিদ বাহিনীকে দেখতে পান। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা কোন গোত্রের দিকে রওনা হয়েছেন। তারা বললেন, আমরা তোমাদের গোত্রের দিকেই যাচ্ছি। হারেস কারণ জিজ্ঞেস করলে তাকে ওলীদ বিন উকবার কথিত পুরো কাহিনী শুনানো হলো। তাকে বলা হলো যে, বনুল মুস্তালিক গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে ওলীদকে হত্যা করার ফন্দী আঁটছে। এ কথা শুনে হারেস বললেন, আল্লাহর কসম আমি ওলীদ বিন উকবাকে দেখিনি। সে আমার কাছে যায়নি। অতঃপর হারেস রাসূল(সা) এর কাছে উপস্থিত হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি যাকাত দিতে অস্বীকার করেছ এবং আমার দূতকে হত্যা করতে চেয়েছ? হারিস বললেন, কখনো নয়। আল্লাহর কসম, সে আমার কাছে যায়নি এবং আমি তাকে দেখিওনি। নির্ধারিত সময়ে আপনার দূত যায়নি বলে আমার আশংকা হয় যে, আপনি হয়তো কোন ত্রুটির কারণে আমাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
কোন কোন রেওয়ায়াতে আছে যে, ওলীদ বিন উকবা রাসূল(সা) এর নির্দেশ মোতাবেক বনুল মোস্তালিক গোত্রে পোঁছেন। গোত্রের লোকেরা আগেই জানতো যে, রাসূল(সা) এর দূত অমুক তারিখে আসবে। তাই তারা অভ্যর্থনার উদ্দেশ্যে বস্তি থেকে বেরিয়ে আসে। ওলীদ সন্দেহ করলেন যে, তারা বোধ হয় পুরনো শত্রুতার কারণে তাকে হত্যা করতে এগিয়ে আসছে। তাই তিনি সেখান থেকেই ফিরে আসেন এবং রাসূল(সা) এর কাছে নিজ ধারণা অনুযায়ী অভিযোগ পেশ করলেন যে, তারা যাকাত দেয়ার পরিবর্তে আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে। তখন রাসূল(সা) খালিদ বিন ওলীদকে প্রেরণ করলেন এবং বলে দিলেন যে পূর্ণ তদন্ত ও অনুসন্ধানের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। খালিদ বিন ওলীদ রাতের বেলায় বস্তির নিকট পৌঁছে গোপনে কয়েকজন গুপ্তচর পাঠিয়ে দিলেন। তারা ফিরে এসে সংবাদ দিল যে তারা সবাই ঈমান ও ইসলামের উপর অটল আছে এবং যাকাত দিতে প্রস্তুত আছে। তাদের মধ্যে ইসলামের বিপরীত কিছুই নেই। খালেদ ফিরে এসে রাসূল(সা) এর নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআনের সূরা আল হুজরাত নাযিল হয়। বিশেষত এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত আয়াতটি হলোঃ
“হে মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন খবর নিয়ে আসে, তবে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।”
শিক্ষাঃ এই ঘটনা এবং এই ঘটনা উপলক্ষে অবতীর্ণ সূরার সংশ্লিষ্ট আয়াতের প্রধান শিক্ষা এই যে, কোন প্রচারণা চাই তা মৌখিক হোক বা লিখিত হোক-বক্তা বা লেখকের চারিত্রিক মান ও খবরের গুরুত্ব বিবেচনা করে গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে। খবর যদি এমন গুরুতর হয় যে, তার ভিত্তিতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত হতে পারে তবে তা তদন্ত ছাড়া গ্রহণ করা যাবে না। সংবাদদাতা অসৎ হলে তো নয়ই, এমনকি সৎ হলেও না। কেননা খবরটি তার ইচ্ছাকৃত অপপ্রচার না হয়ে ভুল বোঝাবুঝির কারণেও হতে পারে। আর ফাসেক বা অসৎ লোক হলেতো তা গ্রহণ করাই যাবে না তদন্ত ছাড়া। কেননা তা একটা নিরেট মিথ্যাচারও হতে পারে। রাসূল(সা) বলেছেন, একজন লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তাই বলে বেড়ায়।
৩৪। বদর যোদ্ধাদের মর্যাদা
বিভিন্ন সহীহ রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, বদর যুদ্ধের পর মক্কা বিজয়ের কিছু আগে মক্কার সারা নাম্নী একজন গায়িকা মহিলা মদীনায় আগমন করে। রাসূল(সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি হিজরত করতে এসেছ? সে বললো, না। রাসূল(সা) বললেন, তাহলে কি করতে এসেছ? সে বললো, আপনারা মক্কার সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক ছিলেন। আপনাদের উপর নির্ভর করেই আমি জীবিকা নির্বাহ করতাম। এখন মক্কার বড় বড় সর্দাররা বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছে। আর আপনারাও এখানে চলে এসেছেন। ফলে আমার জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমি অনন্যোপায় হয়ে আপনাদের সাহায্য চাইতে এসেছি। রাসূল(সা) বললেন, তুমি মক্কার পেশাদার গায়িকা। যে যুবকরা তোমার গানে মুগ্ধ হয়ে তোমাকে অনেক অর্থ দিত তারা কোথায়? সে বললো, বদর যুদ্ধের পর তাদের গান বাজনার জৌলুস শেষ হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত তারা কেউ আমার খোঁজ নেয়নি। অতঃপর রাসূল(সা) কোরেশ বংশীয় মোহাজেরদেরকে তাকে সাহায্য করার জন্য উৎসাহ দিলেন। তাঁরা তাকে কিছু নগদ অর্থ ও কাপড় চোপড় দিয়ে বিদায় দিল।
এ সময় মক্কার কাফেররা হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করেছে। ফলে রাসূল(সা) কাফেরদের বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনার সংকল্প নিয়ে গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই প্রস্তুতির কথা যেন কিছুতেই মক্কার লোকেরা আগে ভাগে জানতে না পারে, সেজন্য তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে গোপনীয়তা রক্ষা করতে যাচ্ছিলেন।
মদীনায় যারা প্রথম প্রথম হিজরত করেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী হাতেম ইবনে আবি বালতা’য়া। ইয়েমেনী বংশোদ্ভূত এই সাহাবী ইসলাম গ্রহণের পর মক্কায়ই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। মক্কায় তাঁর রক্ত সম্পর্কীয় বা ঘনিষ্ঠ কোন আত্মীয় স্বজন ছিল না। তিনি হিজরত করে মদীনায় চলে যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা মক্কায়ই ছিল। রাসূল(সা) ও অন্যান্য সাহাবীদের হিজরতের পর মক্কায় অবস্থানরত মুসলমানদের উপর কাফেররা নানাভাবে জুলুম করতো। যে সব মোহাজিরের আত্মীয় স্বজন মক্কায় ছিল, তাদের সন্তান সন্তনিরা কোন রকমে নিরাপদ থাকতো। হাতেবের কোন আত্মীয় স্বজন না থাকায় তার পরিবার পরিজন মারাত্মক ঝুঁকি ও নির্যাতনের সম্মুখীন ছিল। তাই তিনি ভাবলেন, তার পরিবারকে রক্ষা করার মত কেউ যখন নেই, তখন তিনি যদি মক্কাবাসীদের উপকার করে তাদের সহানুভূতি অর্জন করেন, তাহলে তারা হয়তো তার পরিবারের উপর জুলুম করবে না। তাই ঐ গায়িকা মহিলার মক্কা গমনকে তিনি একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে করলেন।
হাতেবের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, রাসূল(সা) কে আল্লাহ তায়ালা মক্কা অভিযানে বিজয় দান করবেন। তাই তিনি যদি আগেভাগে মক্কা অভিযানের বিষয়টি মক্কাবাসীর নিকট ফাঁস করে দেন, তাহলে তাঁর কিংবা ইসলামের কোন ক্ষতি হবে না। তিনি ভাবলেন, একটি পত্র লিখে মক্কাবাসীকে জানিয়ে দিবেন যে, রাসূল(সা)মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এতে তাঁর পরিবারের হেফাজতের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তাই তিনি একটি চিঠি লিখে গায়িকা সারার হাতে দিয়ে দিলেন, যাতে সে মক্কার বিশিষ্ট লোকদের নিকট তা পৌঁছিয়ে দেয়। গায়িকা চিঠিটি নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। (তাফসীরে কুরতুবী, মাযহারী)।
এদিকে রাসূল(সা) কে আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে ব্যাপারটা জানিয়ে দিলেন এবং মহিলাটি কোন পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাও জানালেন।
বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূল(সা) হযরত আলী, আবু মুরসাদ ও যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে আদেশ দিলেন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে মহিলাকে ধরার জন্য। তার কাছে মক্কাবাসীর নামে হাতেব ইবনে বালতায়ার চিঠি আছে। তাকে পাকড়াও করে চিঠিটি উদ্ধার করে নিয়ে এস। তারা দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে পথিমধ্যেই তাকে ধরে ফেললেন। তারা মহিলাকে বললেন, তোমার কাছে একটা চিঠি আছে ওটা দিয়ে দাও। সে বললো, আমার কাছে কোন চিঠি নেই। তারা প্রাথমিক তল্লাশীতে কোন চিঠি পেলেন না, কিন্তু তারা দমলেন না। কেননা রাসূল(সা) এর কথা মিথ্যা হতে পারে না। তাই তারা কঠোর ভাষায় বললেন, চিঠিটা বের করে দাও। নচেত আমরা তোমাকে নগ্ন করে তল্লাশী করবো।
সে নিরুপায় হয়ে চিঠিটা বের করে দিল। আমরা চিঠিটা নিয়ে রাসূল(সা) এর কাছে হাজির হলাম। হযরত ওমর(রা) ঘটনা শুনেই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেনঃ হে রাসূল! এই ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও সমস্ত মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সে আমাদের গোপন তথ্য কাফেরদের কাছে লিখে পাঠিয়েছে। অতএব, অনুমতি দিন। আমি ওর গর্দান উড়িয়ে দিই।
রাসূল(সা) হাতেবকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার এই কাজের কারণ কি? হাতেব বললেন, হে রাসূল! আমার ঈমানে কোন ত্রুটি হয়নি। ব্যাপার এই যে, আমি ভাবলাম, আমি যদি মক্কাবাসীর একটু উপকার করি, তাহলে তারা আমার পরিবারের কোন ক্ষতি করবে না। ভেবে দেখুন, আমিই একমাত্র মোহাজের, যার কোন আপনজন মক্কায় নেই। অথচ আমার পরিবার মক্কায় রয়েছে। অন্য সবার স্বগোত্রীয়রা তাদের পরিবারের তদারকী করে। কিন্তু আমার তেমন কেউ নেই।
রাসূল(সা) হাতেবের বক্তব্য শুনে বললেন, সে সত্য বলেছে। অতএব, তোমরা তার সম্পর্কে ভাল ছাড়া মন্দ বলো না। হযরত ওমর(রা) তথাপি ঈমানের আবেগে অধীর হয়ে তার আগের কথাটি পুনরায় উচ্চারণ করলেন। তখন রাসূল(সা) বললেন, সে একজন বদর যোদ্ধা। আল্লাহ তায়ালা বদর যোদ্ধাদের সকল গোনাহ মাফ করেছেন এবং তাদের জন্য জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন। কোন কোন রেওয়ায়াতে আছে, রাসূল(সা)বলেন-“আল্লাহ হয়তো বদর যোদ্ধাদের বলে দিয়েছেন, তোমরা যা খুশী তাই কর”। এই কথা শুনে হযরত ওমর(রা) চোখের পানি ফেলে দিয়ে বললেন, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই(সা) ভাল জানেন। (ইবনে কাছির)। কোন কোন রেওয়ায়াতে হাতেবের এ উক্তিও বর্ণিত হয়েছে-আমি এই কাজ ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য করিনি। কেননা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, রাসূল(সা) বিজয়ী হবেনই। মক্কাবাসী জেনে গেলেও ক্ষতি হবে না।
শিক্ষাঃ (১) এই ঘটনা হতে প্রমাণিত হয় যে, বদর যুদ্ধের ন্যায় ঈমানের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সাহাবায়ে কিরামের ভুলত্রুটি আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর এ ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মুমিনদেরকে তাদের ভুল ত্রুটির জন্য সন্দেহের চোখে দেখা উচিত নয় এবং বিনা তদন্তে ত্বড়িত সিদ্ধান্ত নেয়াও উচিত নয়।
(২) ক্ষমার ঘোষণা সত্ত্বেও এটা মানতে হবে যে, এ ধরনের কাজ ভুল। মুসলমানদের স্বার্থের ক্ষতিকর কোন কাজ কোন অবস্থায়ই করা চাই না। হয়ত হাতেবের এই ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে সূরা মুমতাহিনা নাযিল হয় এবং তাতে এ কাজের কঠোর সমালোচনা করে মুসলমানদেরকে কাফেরদের সাহায্য ও সহানুভূতি গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়। কাজটি যদি ভুল ও অন্যায় না হতো তাহলে রাসূল(সা) চিঠিটা আটকাতেন না এবং সূরা মুমতাহিনায় এর সমালোচনা হতো না।
৩৫। সুরাকার বিবেক জেগে উঠলো
সুরাকা ইবনে মালেক। কুরাইশ বংশের এক দুঃসাহসী যুবক। রাসূল(সা) যেদিন হযরত আলীকে(রা) বিছানায় শুইয়ে রেখে হযরত আবু বকরকে (রা) সাথে নিয়ে মদীনায় হিজরত করার জন্য মক্কা হতে বেরুলেন, সেই দিনই কুরাইশ নেতারা ঘোষণা দিল যে, মুহাম্মদকে যে ব্যক্তি খুঁজে ধরে আনতে পারবে, তাকে একশো উট পুরস্কার দেয়া হবে। এই পুরস্কার লাভের আশায় চারিদিকে ঘোড়া ছুটাতে লাগলো দুর্ধর্ষ যুবক সুরাকা ইবনে মালেক এবং আরো অনেকে। রাসূল(সা) ও আবু বকর(রা) দিন কয়েক মক্কার পার্শ্ববর্তী সূর পর্বত গুহায় কাটিয়েছিলেন। সে সময়ে অনেকেই তাদের ঘোড়ার পদচিহ্ন ধরে সূর পর্বত গুহার কাছে গিয়েছিল। কিন্তু গুহার মুখে আল্লাহ নিযুক্ত রক্ষী মাকড়সা জাল বুনে তাদের গতি রোধ করে দেয়। সবাই মনে করলো যে, তারা এই গুহার ভিতরে থাকলে মাকড়সার জাল ছিঁড়ে যেত। অগত্যা সবাই ওখান থেকে ফিরে যায়। এরপর মুহাম্মদ(সা) ও আবু বকর(রা) কে খোঁজার চেষ্টা থেকে সুরাকা ছাড়া আর সবাই বিরত হয়। একা সুরাকা মক্কার চারিপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে।
যেদিন আল্লাহর হুকুমে হযরত আবু বকরকে সাথে নিয়ে রাসূল(সা) সূর পর্বত গুহা হতে বেরিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন সেদিন সহসা সূরাকার নজরে পরে গেলেন। তারা দু’জন যাচ্ছিলেন উটের পিঠে সওয়ার হয়ে। তাই সূরাকা ঘোড়া ছুটিয়ে খুব দ্রুত তাদের কাছে পৌঁছে গেল। পেছনে ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনে দুজনেই চমকে উঠলেন। দেখলেন পেছনে অতি নিকটেই যমদূতের মত আসছেন সূরাকা ইবনে মালেক। হযরত আবু বকর(রা) যিনি সূর পর্বতের গুহায় বসেও এক একবার কাফেরদের পদ শব্দে চমকে উঠে রাসূল(সা)কে নিজের অজানা আশংকার কথা জানাচ্ছিলেন, তখন রাসূল(সা) তাকে এই বলে প্রবোধ দিচ্ছিলেন যে, “আবু বকর চিন্তা করোনা, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।” সেই প্রবোধ বাক্যে আবু বকর শান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন? সে সময় আর যা হোক, কাফেররা তাঁদের সাক্ষাত দেখতে পায় নি। কিন্তু এখন কী হবে? এখন যে শত্রু তাদেরকে সরাসরি দেখতে পাচ্ছে, দিনের আলোয় দেখে চিনতেও পারবে এবং ঘোড়সওয়ারের পক্ষে উষ্ট্রারোহীকে ধরা একেবারেই সহজ। ওদিকে সূরাকা বিকট শব্দে শাসাচ্ছে আর বলছে, আবু বকর, এখন তোমাদের আর নিস্তার নেই। ছুটাছুটি করে লাভ নেই। থামো। রাসূল(সা) আবু বকরের বিহবল অবস্থা দেখে আবারও তাকে শান্ত হতে বললেন এবং বললেন, “ভয় পেয়োনা, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।”
আবু বকর যতটা দ্রুত সম্ভব উটকে হাঁকাতে লাগলেন। ওদিকে সূরাকা যখন একেবারে তাঁদের কাছে এসে পড়লো, তখন ঘটলো এক অভাবনীয় ঘটনা। সূরাকার ঘোড়ার পা হাঁটু সমান মাটিতে দেবে গেল। সূরাকা অনেক চেষ্টা করে তাকে উঠালো। ইত্যবসরে রাসূল(সা) ও আবু বকর(রা) আরো বেশ খানিকটা দূরে চলে এলেন। সূরাকা আবার প্রবল জোরে ঘোড়া হাঁকাতে লাগলো। আবার কাছে এসে গেল। কিন্তু আবার সেই ঘটনা ঘটলো। আবারো সূরাকার ঘোড়ার পা হাঁটু সমান মাটিতে দেবে গেল। সূরাকা আবার তাকে ওঠালো এবং আবার হাঁকিয়ে কাছে চলে গেল। আবারো একই ঘটনা ঘটলো। এভাবে ক্রমাগত কয়েকবার ঘটার পর সূরাকার বিবেক জেগে উঠলো। সে আর তাদের পদানুসরণ না করে ফিরে গেল আবু জাহলের কাছে। তখন আবু জাহলের নাম ছিল “আবুল হিকাম” অর্থাৎ বুদ্ধিমান বা প্রাজ্ঞ। আবু জাহল যখন তাকে তার অভিযান সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলো সে একটি কবিতার মাধ্যমে পুরো ঘটনা বিবৃত করলো। কবিতাটির প্রথম কয়টি লাইন এরূপঃ
“ওহে আবুল হিকাম, তুমি যদি আমার ঘোড়ার অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে যে, কিভাবে তার পাগুলো মাটিতে দেবে যাচ্ছিল, তাহলে তুমি অবাক হতে এবং তোমার কোন সন্দেহ থাকতো না যে, মুহাম্মদ(সা) একজন নবী ও পথপ্রদর্শক, তাঁর মুকাবিলা করার ক্ষমতা কারো নেই।”
যতদূর জানা যায়, সূরাকা এরপর ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু নিজের মুসলমান হওয়ার কথা গোপন রাখেন এবং মক্কাতেই অবস্থান করেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি রাসূল(সা) এর সাথে দেখা করেন এবং প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন।
শিক্ষাঃ সত্যকে উপলব্ধি করার পর সত্যের বিরোধীতা করা হতে বিরত হলে আল্লাহর গযব হতে রক্ষা পাওয়া ও হেদায়াতের আশা করা যায়।
৩৬। হযরত খুবাইবের শাহাদাত
ওহুদ যুদ্ধের পর আযল ও কারাহ গোত্রের একদল লোক রাসূলুল্লাহ(সা) এর নিকট এসে বললোঃ হে রাসূল! আমাদের গোত্রে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাই আপনার সাহাবীদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন। তারা আমাদেরকে কুরআন পড়াবেন এবং ইসলামের বিধিসমূহ শিখাবেন। রাসূল(সা) তাদের কথামত সরল বিশ্বাসে আসেম ইবনে সাবেত, খুবাইব ইবনে আদী এবং যায়েদ ইবনে দাখিনা সহ ছয়জন মতান্তরে দশজন সাহাবীকে পাঠিয়ে দেন। অপরদিকে এক স্থানে কাফেরদের দুইশত যোদ্ধা মুসলমানদের এই সংক্ষিপ্ত জামাতটির অপেক্ষা করিতেছিল। মুসলমানদের জামাত তখন তথায় পৌছিলেন তখন নাঙ্গা তরবারী বিজলীর শক্তিতে তাঁহাদের অভ্যর্থনা করিল। মুসলমানরা যদিও কোরআনের বাণী প্রচার করিতে বাহির হইয়াছিলেন, কিন্তু একেবারে নিরস্ত্র ছিলেন না। সংকট দেখার সঙ্গে সঙ্গেই দুইশত তরবারির সম্মুখে দশটি তরবারিও কোষমুক্ত হইল এবং উভয়পক্ষে তুমুল সংগ্রাম শুরু হইয়া গেল। আটজন সাহাবী বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করিয়া শহীদ হইয়া গেলেন। হযরত খুবাইব ইবনে আদী এবং যায়েদ ইবনে দাসেনা (রা) নামক দুই সিংহপুরুষ গ্রেফতার হইয়া গেলেন। সুফিয়ান হোযালী এই দুই বীরকে মক্কায় লাইয়া গিয়া নগদ মূল্যে মক্কার হিংস্র পশুদের নিকট বিক্রয় করিয়া আসিল।
উভয় বন্দীকেই হারেস ইবনে আমেরের গৃহে রাখা হইল। কাফেররা এইরূপ নির্দেশ দিল, তাহাদের রুটি বা পানি কিছুই যেন দেওয়া না হয়। হারেস অক্ষরে অক্ষরের নির্দেশ পালন করিল। বন্দীদের জন্য খাবার সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল।
মুসলমানদের জামাত তখন তথায় পৌছিলেন তখন নাঙ্গা তরবারী বিজলীর শক্তিতে তাঁহাদের অভ্যর্থনা করিল। মুসলমানরা যদিও কোরআনের বাণী প্রচার করিতে বাহির হইয়াছিলেন, কিন্তু একেবারে নিরস্ত্র ছিলেন না। সংকট দেখার সঙ্গে সঙ্গেই দুইশত তরবারির সম্মুখে দশটি তরবারিও কোষমুক্ত হইল এবং উভয়পক্ষে তুমুল সংগ্রাম শুরু হইয়া গেল। আটজন সাহাবী বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করিয়া শহীদ হইয়া গেলেন। হযরত খুবাইব ইবনে আদী এবং যায়েদ ইবনে দাসেনা (রা) নামক দুই সিংহপুরুষ গ্রেফতার হইয়া গেলেন। সুফিয়ান হোযালী এই দুই বীরকে মক্কায় লাইয়া গিয়া নগদ মূল্যে মক্কার হিংস্র পশুদের নিকট বিক্রয় করিয়া আসিল।
উভয় বন্দীকেই হারেস ইবনে আমেরের গৃহে রাখা হইল। কাফেররা এইরূপ নির্দেশ দিল, তাহাদের রুটি বা পানি কিছুই যেন দেওয়া না হয়। হারেস অক্ষরে অক্ষরের নির্দেশ পালন করিল। বন্দীদের জন্য খাবার সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল।
একদিন হারেসের শিশুপুত্র একটি ছুরি লইয়া খেলিতে খেলিতে বন্দী হযরত খুবাইবের নিকট পৌছিয়া গেল। দীর্ঘ কয়েকদিনের ক্ষুধার্ত পিপাসায় কাতর আল্লাহর এই নেক বান্দা হারেসের শিশুকে কোলে তুলিয়া লইলেন এবং তাহার হাত হইতে ছুরি লইয়া মাটিতে রাখিয়া দিলেন। ইতিমধ্যেই হারেসের স্ত্রী আসিয়া দেখিল, খুবাইব শিশু ও ছুরি সম্মুখে লইয়া বসিয়া আছেন। স্ত্রীলোকটি মুসলিম চরিত্র সম্পর্কে কিছই জানিত না। এই মারাত্মক অবস্থা দেখিয়া ভয়ে আতঙ্কে তাহার প্রাণ শুকাইয়া গেল এবং অধীর কণ্ঠে চিত্কার করিতে শুরু করিল। হযরত খুবাইব (রা) স্ত্রীলোকটিকে অধীরতা অনুভব করিতে পারিয়া বলিতে লাগিলেন, “ভগ্নী, আপনি শান্ত হউন, আমি এই নিষ্পাপ শিশুটিকে হত্যা করিব না। মুসলমানরা জুলুম করেনা।” এই কথা বলিয়াই হযরত খুবাইব শিশুটিকে কোল হইতে নামাইয়া দিলেন। শিশু ছুটিয়া গিয়া মায়ের কোলে উঠিয়া পড়িল।
কোরায়শ দল কয়েকদিন অপেক্ষা করিল, কিন্তু অনাহারে যখন মৃত্যু হইল না তখন তাঁহাকে হত্যা করার জন্য তারিখ ঘোষণা করা হইল। খোলা ময়দানে একটি কাষ্ঠফলক পোঁতা হইল। কোরায়শ দল ফলকটির চারিধারে তরবারি ও বর্শা উঠাইয়া দাঁড়াইল। কেহ কেহ তরবারি ভাজিতে ছিল। কেহ কেহ ধনুকে তীর সংযোজন করিতেছিল। এমনবস্থায় ঘোষণা করা হইল, খুবাইবকে আনা হইতেছে। মুহূর্তে ময়দান সরগরম হইয়া উঠিল। উত্সুক দর্শকের দল চারিদিকে ছুটাছুটি করিতে শুরু করিল। কিছু লোক অস্ত্র ঠিক করিতে করিতে বন্দীর উপর আক্রমণ করিয়া পৈশাচিক উপায়ে রক্ত প্রবাহিত করার জন্য প্রস্তুহ হইল।
বীর মুসলিম হযরত খুবাইব (রা) এক পা এক পা করিয়া বধ্যভূমির দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। তাঁহাকে শূলের নীচে আনিয়া খাড়া করা হইল। এক ব্যক্তি তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিল, খুবাইব, আমরা তোমার এই বিপদে দুঃখ অনুভব করিতেছি। এখনও যদি তুমি ইসলাম ত্যাগ কর তবে তোমাকে মুক্তি দেওয়া যাইতে পারে।
হযরত খুবাইব (রা) সম্বোধনকারীর দিকে মুখ করিয়া বলিতে লাগিলেন, ইসলামই যদি অবশিষ্ট না থাকে, তবে জীবন রক্ষা অর্থহীন। এই দৃঢ়তাব্যঞ্জক জবাব জনতার মধ্যে বিদ্যুতের ন্যায় ছড়াইয়া পড়িল। ক্ষণিকের জন্য উত্তেজিত জনতা স্তব্ধ নীরব হইয়া গেল।
দ্বিতীয় এক ব্যক্তি অগ্রসর হইয়া বলিল, “খুবাইব, কোন অন্তিম ইচ্ছা থাকিলে বলিতে পার।”
হযরত খুবাইব (রা) জবাব দিলেন, “মাত্র দুই রাকাত নামায পড়িতে চাই; অন্য কোন ইচ্ছা নাই।” জনতা জানাইয়া দিল, ভাল কথা- শীঘ্র সারিয়া নাও। ফাঁসির রজ্জু প্রস্তুত ছিল, হযরত খুবাইব (রা) নীচে দাঁড়াইয়া প্রাণ ভরিয়া শেষ বারের মত প্রিয়তমের এবাদত করিতে প্রস্তুত হইলেন। হৃদয়ের নিষ্ঠা ও অনুরাগ নিংড়ানো এই মুখ প্রিয়তমের গুণগান করিতে যাইয়া বন্ধ হইতে চাহিল না। যে দুই হাত মহান আল্লাহর সম্দুখে বন্ধ হইয়াছিল, তাহা আর খুলিতে চাহিল না। রুকুর উদ্দেশে অবনত কোমর আর সোজা হইতে চাহিল না। মাটির বিছানা হিইতে সেজ্দার অনুরাগ শেষ হইল না! চক্ষুযুদগল হইতে এত বিনয়ের অশ্রু প্রবাহিত হইতে চাহিল, যেন শরীরের প্র্রতি রক্তবিন্দু অশ্রু হইয়া চোখের কোণে নামিয়া আসে। আল্লাহর এই ঊষর পৃথিবী যেন অশ্রু সিঞ্চনীতে জান্নাতুল ফেরদাউসের প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরিয়অ উঠে!
হযরত খুবাইবের প্রেমিক অন্তরে আত্মনিবেদনের আনন্দে মত্ত ছিল, কিন্তু হঠাৎ তিনি অন্তর হইতে এক নূতন আহ্বান শুনিতে পাইলেন, এই আহ্বান বুঝি একমাত্র শহীদের অন্তরই অনুভব করিতে পারে। তিনি যেন অনুভব করিলেন, নামায অধিক লম্বা করিলে কাফেরগণ এই কথা ভাবিতে শুরু করিবে, তাঁহার মুসলিম অন্তর বুঝি মৃত্যু ভয়ে ভীত হইয়া গিয়াছে। এই কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ডান দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিলেন, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। কাফেরদের তরফ হইতে কোন জবাব আসিল না, কিন্তু তাহাদের অগণিত তীরের তীক্ষ্ম মুখ উবং উত্তোলিত তরবারির তীক্ষ্মধার যেন সজীব হইয়া সালামের জবাব দিয়া উঠিল। তিন বাম দিকে মুখ ফিরাইয়াও সালামের বাণী উচ্চারণ করিলেন। কাফেরকুলের নির্বাক জামাত উহারও কোন জবাব দিতে পারিল না, কিন্তু অগণিত বর্শার সুচিতীক্ষ্ম ফলক যেন বলিয়া উঠিল, হে ইসলামের অমর মোজাহেদ, তোমার উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হউক।
মরদে মোজাহেদ হযরত খুবাইব (রা) সালাম ফিরাইয়া শূলের নীচে আসিয়া দাঁড়াইলেন। কাফেররা তাঁহাকে কাষ্ঠের সহিত বন্ধন করতঃ তীক্ষ্মধার তীর ছুঁড়িয়া তাঁহার খোদা প্রেমের শেষ পরীক্ষা লইতে শুরু করিল। একব্যক্তি পূর্বেই মানাযের বিছানায় মরদে মুমিনের যে পবিত্র রক্ত অশ্রুর বন্যায় প্রবাহিত হইয়া আসিতেছিল, তাহাই শত ছিদ্র দিয়া বাহির হইতে শুরু করিল। হযরত খুবাইবের এই ধৈর্য কি অপূর্ব! শূলের স্তম্ভের সহিত তাঁহার সর্বশরীর আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা রহিয়াছে। তৎপর এক এক তীর আসিয়া তাঁহার শরীরে এপার ওপার হইয়া যাইতেছে। তীক্ষ্মধার বর্শা তাঁহার বুকের পাঁজর ভেধ করিয়া বিদ্ধ হইতেছে। এক একটি আঘাত তিনি নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করিতেছেন, কিন্তু এই অবস্থায়ও তিনি ইসলামের কঠোর স্বীকারোক্তিতে অটল রহিয়াছেন। দুঃখ-বেদনার এই প্রলয়ও তাঁহার অন্তরকে ইসলামের উপর হইতে হটাইতে পারিতেছে না।
এই সময় আর এক ব্যক্তি আসিয়া তাঁহার বুকে বর্শা রাখিল। ধীরে ধীরে তাহা এতটুকু বিদ্ধ করিল যে, অর্ধেকটুকু ফলক তাঁহার শরীরে প্রবিষ্ট হইয়া গেল। এই সময় আক্রমণকারী তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “এখন তোমার স্থানে যদি মোহাম্মদকে বাঁধিয়া তোমাকে মুক্তি দেওয়া হয়, তবে তুমি কি উহা পছন্দ করিবে?” ধৈর্যেরে প্রতিমূর্তি হযরত খুবাইব (রা) একটি একটি করিয়া অস্ত্রের কঠিন আঘাত সহ্য করিতেছিলেন, কিন্তু তাঁহার নিকট পাপাত্মার এই একমাত্র বাক্যবাণ যেন সহ্য হইল না। যবানের এক এক ফোঁটা রক্ত যদিও ইতিপূর্বেই নিঃশেষে ঝরিয়া পড়িয়াছিল, তবুও এই শুষ্ক মুখেই নূতন শক্তি দেখা দিল। জ্বালাময়ী ভাষায় তিনি বালিতে লাগিলেন, “নিষ্ঠুর! খোদা জানেন, আমি তিলে তিলে প্রাণ দিয়া দিতে পারি, কিন্তু আল্লাহর রসূলের পায়ে একটি কাঁটা বিদ্ধ হওয়ার দৃশ্যও সহ্য করিতে আমি প্রস্তুত নই।”
নামায পড়ার পর হইতে হযরত খুবাইবের উপর যে কঠিন বিপদ নামিয়া আসিতেছিল তাহার প্রত্যেকটি আঘাতই তিনি অম্লান বদনে সহ্য করিয়া চলিয়াছিলেন, তাঁহার প্রশান্ত যবান হইতে এক একটি আঘাতের সহিত এক একটি কবিতা বাহির হইয়া আসিতেছিল। প্রশান্ত কণ্ঠে তিনি বলিতেছিলেন,-“
১. লোক দলে দলে আমার চারিদকে সমবেত হইয়াছে। কবিলা, জামাত সকলেরই যেন এখানে উপস্থিতি বিশেষ প্রয়োজনীয় হইয়া পড়িয়াছে।
২. এই সমাবেশ একমাত্র শক্রুতা প্রদর্শনের জন্য অনুষ্ঠিত হইয়াছে। ইহারা আমার বিরুদ্ধে জিঘাংসা বৃত্তিরই প্রদর্শন করিতেছে মাত্র এবং আমাকে এখানে মৃত্যুর খুঁটির সহিত বাঁধিয়া রাখা হইয়াছে।
৩. ইহারা এই প্রদর্শনীতে স্ত্রীলোক ও শিশুদিগকে সমবেত করিয়া একটি উচ্চ মঞ্চের একত্রিত করিয়া রাখিয়াছে।
৪. ইহারা বলে, যদি ইসলাম অস্বীকার করি তহবে আমাকে মুক্ত করিয়া দিবে, কিন্তু আমার পক্ষে ইসলাম পরিত্যাগের চাইতে মৃত্যু কবুল করা যে অনেক সহজ। আমার চক্ষু হইতে যদিও অশ্রু ঝরিতেছে, তথাপি আমার অন্তর সম্পূর্ণ শান্ত।
৫. আমি শত্রুর সম্মুখে মস্তক অবনত করিব না, কাহারও বিরুদ্ধে ফরিয়াদও করিব না। আমি ভীত হইব না। কেননা, আমি জানি, আল্লাহর সান্নিধ্যেই যাইতেছি।
৬. আমি মৃত্যুতে ভয় করি না, কেননা আমি জানি, সর্বাবস্থায়ই মৃত্যু আসিবে। আমার কেবল একটি ভয় আছে এবং তাহা দোযখের আগুনের ভয়।
৭. আরশের মালিক আমার দ্বারা সেবা করাইয়াছেন এবং দৃঢ়তা অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়াছেন। কাফেররা এখন আমার শরীর টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিয়াছে, এতক্ষণে আমার সকল আশাই শেষ হইয়া গিয়াছে।
৮. আমি আমার এই অসহায়তা, নিঃসঙ্গতার জন্য কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটই ফরিয়াদ করিতেছি। জানি না আমার মৃত্যুর পর উহাদের কি ইচ্ছা! যত কিছুই হউক, আল্লাহর পথে যখন আমি জীবন দান করিতেছি, তখন উহারা যাহা কিছুই করুক না কেন, ইহাতে আমার আর কোন ভাবনা নাই।” এরপর হযরত খুবাইবকে শহীদ করা হয়।
শিক্ষাঃ হযরত খুবাইবের শাহাদাত আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকারীদের জন্য অত্যন্ত শিক্ষাপ্রদ ও চমকপ্রদ ঘটনা। এমন লোমহর্ষক নির্যাতন ও হত্যার মুখে অবিচল থাকা অত্যন্ত মজবুত ঈমানের পরিচায়ক যা আল্লাহর রহমত ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এই ঘটনার আরো একটি শিক্ষা এই যে, ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের শত্রুর দুরভিসন্ধি, চক্রান্ত ও ধাপ্পাবাজী সম্পর্কে সাবধান হতে হবে। আল্লাহর রাসূলের জীবদ্দশায় এরূপ ঘটনা ঘটিয়ে আল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে দিয়েছেন।
৩৭। আবু জাহলের জুলুম প্রতিরোধে রাসূলুল্লাহ (সা)
জাহেলিয়াতের যুগে আবু জাহল জনৈক ইয়াতিমের অভিভাবক ছিল। সে ঐ ইয়াতিমের পৈতৃক সম্পত্তি দেখাশুনার নামে নিজেই ভোগ দখল করত এবং ইয়াতিমকে তার কোন অংশই দিত না। একদিন সেই ইয়াতিম বালক তার কাছে এসে পিতার পরিত্যক্ত সম্পত্তির কিছু অংশ চাইল। তার গায়ে তখন কাপড় চোপড়ও ছিল না। কিন্তু পাষন্ড আবু জাহল তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করলোনা। ছেলেটি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে হতাশ হয়ে ফিরে চলল। কোরায়েশ নেতাদের কয়েকজন দুষ্টুমি করে তাঁকে বললোঃ “মুহাম্মদের(সা) কাছে নালিশ করে দে। সে আবু জাহলের কাছে সুপারিশ করে তোর সম্পত্তি আদায় করে দেবে।” আসলে তাদের মতলব ছিল আবু জাহলের সাথে একটা টক্কর লাগিয়ে দিয়ে রাসূল(সা) কে জব্দ করা। ছেলেটি জানতোই না যে, আবু জাহলের সাথে তার সম্পর্ক কী এবং তারা কোন্ উদ্দেশ্যে তাকে এই পরামর্শ দিচ্ছে। সে সরল মনে রাসূল(সা)এর কাছে হাজির হলো এবং নিজের পুরো ঘটনা বর্ণনা করলো।
রাসূল(সা) তৎক্ষণাত উঠলেন এবং তাঁর কট্টর দুশমন আবু জাহলের কাছে চলে গেলেন। তাঁকে দেখে আবু জাহল স্বাগত জানালো। তিনি যখন বললেন যে, এই ছেলেটার পাওনা দিয়ে দাও, তখন সে নির্বিবাদে মেনে নিল এবং তার পাওনা দিয়ে দিল। ওদিকে কুরায়শ নেতারা অপেক্ষায় ছিল আবু জাহল ও মুহাম্মদের(সা) মধ্যে কী কান্ড ঘটে তা দেখার জন্য। তারা একটা মজার সংঘর্ষ ঘটার খবরের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু যখন পুরো ঘটনার খবর পেল, তখন অবাক হয়ে গেল এবং আবু জাহলকে এসে ভৎসর্না করতে লাগলো যে, সে এমন সুযোগ হাতছাড়া করলো কেন এবং সেও ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে বলে চিৎকার করতে লাগলো। আবু জাহল তাদেরকে বললোঃ “আল্লাহর কসম, আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করি নি। কিন্তু আমি দেখতে পেলাম যেন মুহাম্মদের ডানে ও বামে এক একটা বর্শা রয়েছে, আমি তার কথামত কাজ না করলে তা আমার বুকের মধ্যে ঢুকে যাবে।”
শিক্ষাঃ ইয়াতিম ও দুস্থ মানুষের উপর কেউ নির্যাতন করলে তা নীরবে বরদাশত করা উচিত নয়। সমাজের প্রভাবশালী লোকদের উচিত আল্লাহর উপর ভরসা করে যুলুম প্রতিরোধের চেষ্টা করা। যালেমদের সাধারণতঃ মনোবল কম থাকে। দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে তারা প্রায়ই হার মানে। এ কাজে একাকী অগ্রসর হলেও আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার আশা করা যায়।
৩৮। বীরে মাউনার হৃদয়বিদারক ঘটনা
চতূর্থ হিজরীর সফর মাসে নাজদ থেকে আবু বারা আমের ইবনে মালিক ইবনে জা’ফর রাসূলুল্লাহ (সা) র সাথে দেখা করতে মদীনায় আসে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সামনে ইসলাম পেশ করেন এবং তাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। সে ইসলাম গ্রহণও করলো না, ইসলামের বিরুদ্ধেও কিছু বললো না। সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আপনি যদি কিছুসংখ্যক সাহাবীকে নাজদবাসীর কাছে পাঠিয়ে দেন এবং তারা তাদেরকে আপনার দ্বীনের প্রতি দাওয়াত দেন, আমার মনে হয়, তাহলে তারা আপনার দ্বীন গ্রহণ করনে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “নাজদবাসী তাদের ক্ষতি করতে পারে বলে আমার আশংকা হয়।” আবু বারা বললেন, “আমি তদের নিরাপত্তার জিম্মাদার। আপনি তাদেরকে পাঠিয়ে দিন। তারা জনগণকে আপনার দ্বীনের দিতে দাওয়াত দিক।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের মধ্য থেকে বাছা বাছা চল্লিশজন সুযোগ্য সাহাবীকে বনু সায়েদা গোত্রের বিশিষ্ট সাহাবী মুনযির ইবনে আমরের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিলেন। মুনযির ‘মুয়ান্নিক লিয়ামুত’ [তাঁকে এ উপাধিদানের কারণ হলো, তিনি শাহাদাত লাভের জন্য দ্রুতগতিতে ধাবমান হন।] (দ্রুত মৃত্যুকে আলিঙ্গনকারী) নামে অভিহিত হতেন। তাঁর সুযোগ্য সঙ্গী ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী হারেস ইবনে ছিম্মা, হারাম ইবনে মিলহান, উরওয়া ইবনে আসমা, নাফে ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারকা ও আবু বাক্র সিদ্দীকের (রা) মুক্ত গোলাম আমের ইবনে ফুহাইরা। তাঁরা রওয়ানা দিয়ে বীরে মাউনাতে গিয়ে অবস্থান করলেন। এই জলাশয়টি বনু আমেরের আবাসভূমি ও বনু সুলাইমের প্রস্তরময় এলাকার মাঝখানে অবস্থিত। উভয় এলাকাই জলাশয়টির নিকটবর্তী হলেও বনু সুলাইমের এলাকা ছিল অধিকতর নিকটবর্তী।
ইসলামের কট্রর দুশমন আমের ইবনে তুফাইলের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি নিয়ে গেলেন হারাম ইবনে মিলহান (রা)। তিনি যখন তার কাছে উপস্থিত হলেন, তখন সে চিঠির দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে হারাম ইবনে মিরহানকে হত্যা করলো। তারপর বাদবাকী সাহাবীদেরকেও খতম করার জন্য সে বনু আমেরের সাহায্য চাইলো। কিন্তু বনু আমের তার অনুরোধ এই বলে প্রত্যাখ্যান করলো যে, “ আমরা বনু বারার প্রতিশ্রƒতি ভঙ্গ করতে চাই না। আবু বারা তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে।” আমের অগত্যা সুলাইমের কয়েকটি উপগোত্রের সাহায্য চাইল। তারা সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হলো এবং তাদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। সাহাবাগণ তাদেরকে দেখে তরবারী হাতে নিলেন এবং লড়াই করতে করতে শহীদ হলেন। শুধু কা’ব ইবনে যায়িদ রক্ষা পেলেন। কাফিররা তাঁকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে যায়। অথচ তিনি বেঁচে ছিলেন। অনেক রক্তপাতের দরুণ দুর্বল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিহতদের স্তূপের মধ্য থেকে প্রাণ নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে যান এবং পরে খন্দকের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।
আক্রান্ত হবার সময় দু’জন সাহাবী আমর ইবনে উমাইয়া দামরী ও জনৈক আনসারী [মুনযির বিন মুহাম্মাদ বিন উকবা। ] সাহাবী কোন কারণে দল থেকে কিছুদূরে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা তাঁদের সঙ্গীদের বিপদের কথা জানতেন না। কিন্তু তাঁদের মাথার ওপর কতকগুলো পাখী উড়তে দেখে তাঁদের মনে সন্দেহ জাগে। তাঁরা ভাবলেন, পাখীগুলোর ওড়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। তাঁরা তাঁদের অবস্থা দেখবার জন্য এগিয়ে গেলেন। দেখলেন সবাই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর তাঁদের ওপর আক্রমণকারী দলকেও উপস্থিত দেখলেন। আনসারী আমর ইবন উমাইয়াকে বললেন, “এখন আমাদের কি করা উচিত বলে মনে করেন?” তিনি বললেন, “আমার ইচ্ছা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে গিয়ে দেখা করি এবং সমস্ত ব্যাপার তাঁকে জানাই।” আনসারী বললেন, “যে রণক্ষেত্রে মুনযির ইবনে আমর শহীদ হয়েছেন সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে আমি পালাতে চাই না। আমি নিজে কখনো লোকমুখে হত্যাকান্ডের খবর শোনার অপেক্ষায় বসে থাকতাম না।” অতঃপর তিনি লড়াই করে শহীদ হলেন।
আমর ইবনে উমাইয়াকে কাফিররা আটক ও বন্দী করলো। তিনি মুদার গোত্রের লোক একথা শুনে আমের ইবনে তুফাইল তাঁর কপালের চুল কেটে নিল এবং তাঁর মায়ের একটা দাস মুক্ত করার মানত ছিল মনে করে তাঁকে সেই বাবদে মুক্তি দিল। এরপর আমর ইবনে উমাইয়া মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মদীনার অনতিদূরে অবস্থিত কারকারাতে পৌঁছলো বনু আমেরের দুই ব্যক্তি এসে তাঁর সাথে একই ছায়ায় বিশ্রাম নিতে লাগলো। বনু আমেরের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটা নিরাপত্তা ও আনাক্রমণ চুক্তি যে ছিল, সেকথা আমর জানতেন না। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, তারা বনু আমের গোত্রের লোক। তিনি একটু অপেক্ষা করলেন। যেই তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো অমনি উভয়ের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা করলেন। তাঁর ধারণা ছিল, বনু আমের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের হত্যাকা- চালিয়েছে এবং সে কারণে বনু আমের থেকে প্রতিশোধ নেয়া উচিত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট উপনীত হয়ে আমর ইবনে উমাইয়া সমস্ত ঘটনা জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যে দু’জনকে হত্যা করেছো, তাদের জন্য আমাকে রক্তপণ (দিয়াত) দিতে হবে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ ঘটনা আবু বারাই ঘটালো। আমি এটা অপছন্দ করেছিলাম এবং শংকিত ছিলাম।” আবু বারা ঘটনা জানতে পেরে খুবই দুঃখিত হলেন। আমের ইবনে তুফাইল তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়ে দেয়ার এবং তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের ওপর বিপদ নেমে আসায় আবু বারা ক্ষোভ প্রকাশ করে। নিতদের মধ্যে আমের ইবনে ফুহাইরাও ছিলেন। হিশাম ইবনে উরওয়াহ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমের ইবনে তুফাইল বলতো, “ঐ দলের ভেতরে একটি লোক ছিল যাকে হত্যা অব্যবহিত পর তাঁকে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে দেখলাম। অবশেষে দেখলাম সে যেন আকাশে উঠে উধাও হয়ে গেছে। কে সেই, লোকটি?” লোকেরা বললো, “সে আমের ইবনে ফুহাইরা।” [হযরত আবু বকর সিদ্দিকের মুক্ত সাবেক ক্রীতদাস এবং রাসূল (সা) ও আবু বকরের মদীনায় হিজরতকালীন পথপ্রদর্শক।]
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন যে, আমের ইবনে তোফায়েলের সহযোগী জাবার পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি তার ইসলাম গ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেনঃ বীরে মাউনার ঘটনার সময় আমি বর্শা দিয়ে একবার একজন সাহাবীর দু’কাঁধের মাঝখানে যখন আঘাত করলাম এবং বর্শা যখন তাঁর বুক ভেদ করে বেরিয়ে গেল, তখন ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্তকে সে দু’হাতে মুখে মাখাচ্ছিল আর বলছিলঃ “ফুযতু ওয়া রাব্বিল কা’বা।” অর্থাৎ, কাবার প্রভুর শপথ, আমি সফল হয়েছি। একথা শুনে আমি মনে মনে বললা, “এ ব্যক্তি আমার হাতে খুন হলো তার আবার সাফল্য এল কোত্থেকে? পরে আমি অনেকের কাছে একথার মর্ম জিজ্ঞাসা করি। তারা আমাকে জানায় যে, সে নিজের শহীদ হওয়াকেই সাফল্য বলে বিশ্বাস করতো। আর এ বিশ্বাস শুধু তার একার নয়, প্রত্যেক মুমিনেরই।
শিক্ষাঃ শাহাদাত বাহ্যতঃ ব্যর্থতা মনে হলেও আসলে তা মুমিনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। কুরআনে আল্লাহ বলেছেনঃ “নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের কাছ হতে তাদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। ফলে হত্যা করে ও নিহত হয়। …………….আর এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় সাফল্য।”(সূরা তাওবা)।
৩৯। মুমিনের নামায
একবার রাসূলুল্লাহ(সা) জানতে পারলেন যে, নাজদে দুটি গোত্র মদীনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি কালবিলম্ব না করে সাতশো সাহাবীকে সাথে নিয়ে যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে নাজদ অভিমুখে যাত্রা করলেন। হযরত উসমান ইবনে আফফানকে তিনি মদীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করে রেখে গেলেন। যথাস্থানে পৌঁছে তিনি মদীনার ‘যাতুর রিকা’ নামক পর্বতবেষ্টিত এক উপত্যকায় শিবির স্থাপন করলেন। এ কারণে এ অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘গাযওয়াজে যায়তুর রিকা’।
রাসূলুল্লাহ(সা) এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর ত্বড়িত উপস্থিতির ফলে শত্রুদল এতই ঘাবড়ে গেল যে, তারা রণে ভংগ দিয়ে চতূর্দিকে পালিয়ে গেল। ফলে যুদ্ধ না করেই রাসূল(সা) সসৈন্যে মদীনায় ফিরে এলেন। তবে এই অভিযানকালে আর একটি চকমপ্রদ ঘটনা ঘটে যা মুসলমানদের জন্য শিক্ষা ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। এই অভিযানকালে রাসূল(সা) এর তাবু পাহারা দেয়ার জন্য প্রতি রাত্রে পালাক্রমে কয়েকজন করে সাহাবীকে নিয়োগ করা হয়। যেদিন হযরত আব্বাদ(রা) ও আম্মার ইবনে ইয়াসার(রা)কে পাহারার কাজে নিয়োগ করা হয়, সেই দিনই ঘটে এই মর্মস্পর্শী ঘটনা।
হযরত আব্বাদ ও হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার পরস্পরে পুরো রাতটাকে এভাবে ভাগ করে নিয়েছিলেন যে, প্রথম ভাগে পাহারার দায়িত্ব হযরত আব্বাদের উপর এবং শেষের অংশ হযরত আম্মারের ওপর পড়লো। হযরত আব্বাদের পাহারার পালা শুরু হলো। তিনি ছিলেন অত্যধিক নফল নামাযের ভক্ত। তাই ভাবলেন, এত দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে লাভ কী? সময়টা নামায পড়ে কাটিয়ে দেয়া যাক। তাই তিনি নফল নামাযের নিয়ত করে নামাযে সূরা কাহাফ পড়া শুরু করে দিলেন। ওদিকে হযরত আম্মার ঘুমিয়ে পড়লেন। হযরত আব্বাদ যখন নামাযে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সূরা পাঠরত তখন চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। এক কাফের সন্তর্পণে সামনে এল। সে দূর থেকে স্পষ্ট দেখতে পেল না যে, কোন পাহারাদার আছে কি না। তবে দূর থেকে হযরত আব্বাদকে একটা গাছ মনে করল। আবার তার মনে সন্দেহ হলো যে, ওটা গাছ না হয়ে একটা মানুষও হতে পারে। তাই সে নিজের সন্দেহ ভঙ্গনের জন্য তাকে লক্ষ্য করে একটা তীর ছুঁড়লো। তীর হযরত আব্বাদের পিঠে গিয়ে ঢুকলো, কিন্তু নামায ছাড়লেন না। কাফেরটি সন্দেহমুক্ত হওয়ার জন্য একে একে তিনটি তীর ছুঁড়লো। প্রত্যেকটি তীর তাঁর গায়ে বিদ্ধ হয়ে প্রবল রক্তপাত ঘটালো। অগত্যা তিনি বাধ্য হয়ে নামায ছেড়ে দিয়ে হযরত আম্মারকে ঘুম থেকে ডাকলেন। ইত্যবসরে তাঁর নড়াচড়া টের পেয়ে এবং কথাবার্তা শুনে শত্রু সৈন্যটি নীরবে প্রস্থান করলো। হযরত আম্মার তাঁকে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি প্রথম তীরের সাথে সাথেই আমাকে ডাকলেন না কেন?”
হযরত আব্বাদ বললেনঃ আমি নামাযে সূরা কাহাফ পাঠ করছিলাম। এতে এত মজা লাগছিল যে সূরা শেষ না করে কিছুতেই নামায ছাড়তে ইচ্ছা করছিল না।
হযরত আব্বাদ (রা) হযরত আবু বকর(রা) এর খেলাফতকালে মুরতাদদের বিরুদ্ধেও জিহাদে অংশগ্রহণ করেন এবং ভন্ড নবী মুসাইলামার বিরুদ্ধে জিহাদ করতে গিয়ে শহীদ হন।
শিক্ষাঃ (১) শত্রুর আক্রমণের প্রস্তুতির কথা জানার পর চুপ করে বসে না থেকে আক্রমণ প্রতিহত করার যথাসাধ্য প্রস্তুতি নেয়া উচিত।
(২) নামাযে পঠিত কুরআনের অর্থের দিকে খেয়াল রাখলে নামাযে মনোনিবেশ করা সহজ হয়।
৪০। মুমিনের আতিথেয়তা
একবার এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে এসে বললোঃ আমি অনাহারে আছি। রাসূল(সা) তৎক্ষনাত অন্য এক ব্যক্তিকে নিজের এক স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে কিছু খাবার আনতে বললেন। কিন্তু রাসূল(সা) এর ঐ স্ত্রী জানালেন যে, তাঁর কাছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। অতঃপর একে একে সকল স্ত্রীর কাছে খাবার চেয়ে পাঠালেন। কিন্তু প্রত্যেকের কাছে একই জবাব পেলেন যে, পানি ছাড়া আর কিছুই নেই।
অতঃপর রাসূল(সা) তাঁর সাহাবীগণের কাছে জানতে চাইলেন যে, তোমাদের কারো এই ব্যক্তিকে আজকের মত আতিথেয়তা করার ক্ষমতা আছে কি? আনসারদের একজন বললেনঃ “হে রাসূল! আমি প্রস্তুত।” তিনি লোকটিকে নিয়ে তাঁর পরিবারের কাছে গেলেন এবং তাঁর স্ত্র্রীকে বললেনঃ “আল্লাহর রাসূলের মেহমানকে যতন কর।” স্ত্রী বললেনঃ “আমার ছেলেমেয়েদের খাবার ছাড়া আর কিছু নেই।” সাহাবী বললেনঃ “বেশ তো। ওদেরকে অন্য বিষয়ের দিকে আকৃষ্ট করে রাখ। তারপর রাতের খাবার চাইলে ঘুম পাড়িয়ে রাখ। আর আমাদের মেহমান খেতে আসলে আলো নিভিয়ে দাও আর এরূপ ভান কর যেন আমরাও সাথে খাচ্ছি।” অতঃপর তারা একত্রে বসলেন। কিন্তু শুধু মেহমান তৃপ্ত সহকারে আহার করলো। আর তারা উভয়ে এবং ছেলেমেয়েরা অনাহারে রাত কাটিয়ে দিলেন। সকাল বেলা তিনি যখন রাসূল(সা) এর নিকট এলেন, তখন দেখলেন, রাসূল(সা) পুরো ঘটনা ওহীর মাধ্যমে জেনে ফেলেছেন। তিনি বললেন, “তোমরা দু’জনে তোমাদের মেহমানের সাথে রাত্রে যে ব্যবহার করেছ, তাতে আল্লাহ তায়ালা মুগ্ধ হয়েছেন।”(বুখারী ও মুসলিম)।
শিক্ষাঃ মেহমানের যত্ন করা ইসলামের অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। এমনকি প্রয়োজনে নিজেরা অভুক্ত থেকেও মেহমানকে আপ্যায়ন করা উচিত।
৪১। মুমিনর আত্মসংযম
এক রণাঙ্গনে মুসলমান বাহিনীর সাথে কাফেরদের প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে। হযরত আলী(রা) এক অমুসলিম যোদ্ধাকে ধরাশায়ী করে তার বুকের উপর চড়ে বসেছেন। হাতে নগ্ন তরবারী। এখনি তার বুকে বসিয়ে দিবেন। সহসা ধরাশায়ী অমুসলিম সৈনিকটি তার শেষ অস্ত্র চালাতে গিয়ে বুকের ওপর চেপে বসা হযরত আলীর(রা) মুখে থুথু দিয়ে ভরে দিল। হযরত আলী(রা) এক মুহুর্ত থমকে বসে রইলেন। তারপর তার বুকের উপর থেকে উঠে আসলেন। তরবারি দূরে নিক্ষেপ করে বললেন, “যাও, তুমি মুক্ত।”
কাফের সৈনিকটি তো হতবাক। সে যে একটি যুদ্ধের ময়দানে রয়েছে একথা ভুলে গেল। সে জিজ্ঞাসা করলোঃ আলী তোমার কি হয়েছে? আমাকে অমন হাতের মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দিলে যে!
হযরত আলী(রা) বললেনঃ ময়দানে তোমাদের সাথে যে যুদ্ধ চলছিল সেটা চলছিল ইসলামের সাথে। কিন্তু যে মুহুর্তে তুমি আমার মুখে থুথু দিলে, তখন তোমার ওপর আমার প্রচন্ড আক্রোশ সৃষ্টি হলো। সেটা ছিল আমার ব্যক্তিগত আক্রোশ। এই আক্রোশের বশে তোমাকে হত্যা করলে গুনাহ হবে। তাই ক্রোধ সম্বরণ করলাম।
সৈনিকটি তৎক্ষণাত বললোঃ “যে ধর্ম তোমাকে এমন কঠিন মুহুর্তেও আত্মসংযম শিক্ষা দেয়, তাতে আমাকেও দীক্ষিত কর।” এই বলে সে ইসলাম গ্রহণ করলো।
শিক্ষাঃ ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে কারো ওপর আক্রমণ করা জায়েজ নয়। তবে আত্মরক্ষার জন্য সর্বাবস্থায় যুদ্ধ করা কর্তব্য।