তৃতীয় পরিচ্ছেদ
জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রমের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ:
উৎপত্তি:
ইসলামী জ্ঞানতত্ত্বের আলোকে জ্ঞানের উতস আল্লাহ তাআলা। তিনিই মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন জ্ঞান, যা তারা জানত না। ইরশাদ হয়েছে: আলকুরআনে আরো বলা হয়: ক্বালা তাআলা: আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়ালাম।
‘তিনি মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জ্ঞাত ছিল না।’ (সূরা আলাক্ব: ৫)
তিনি প্রথম মানুষ আদম আ: কে সৃষ্টি করে জ্ঞান দান করেন। ইরশাদ হয়েছে: ক্বালা তাআলা: ওয়া আল্লামা আদামাল আসমা আকুল্লাহা।
তিনি আদমকে সকল কিছুর নাম পরিচয় শিক্ষা দেন। (সূরা বাকারা: ৩১)।
তিনি আদম আ: জীবন চলার জন্য সঠিক জ্ঞান দান করেন এবং প্রশিক্ষণের জন্য জান্নাতে কিছুদিন বসবাস করার অনুমতি দেন। তখন মানব জাতির দুশমন ইবলিস শায়তান এসে ভ্রান্ত জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করে বলে আমি কী তোমাকে এমন একটি গাছ সম্পর্কে জ্ঞান দান করব, যার ফল ভক্ষণ করলে তুমি চিরস্থায়ীভাবে জান্নাতে থেকে যাবে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে: ফাওয়াসওসা ইলাইহিশ শায়তানু ক্বালা ইয়া আদামা হাল আদুল্লুকা আলা শাজারাতিল খুলদি ওয়া মুলকিল লা এবলা।
‘শায়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল। আর বলল, হে আদম! আমি কী তোমাকে চিরঞ্জীবনী গাছ ও রাজত্বের সন্ধান দিব যা কোন দিন শেষ হবে না।’ (সূরা: ত্বহা: ১২০)
যা হোক শায়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রতারণামূলক তথ্য বা জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেন। পরিণতিতে তাকে জান্নাত থেকে বের হতে হয়। শায়তান প্রদত্ত জ্ঞান সংশোধন করে আল্লাহ পাক আদমকে অবহিত করেন যে, এ তোমার শত্রু। তার ব্যাপারে তুমি সতর্ক থাকবে। এভাবেই জ্ঞানের ইসলামীকরণ কার্যক্রমের উন্মেষ ঘটে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে: ফাআযাল্লাহুমুশ শায়তানু আনহা ফাআখরজাহুমা মিম্মা কানা ফীহি ওয়াক্বুলনাহ বিত্বূ বা’ধুকুম লিবা’ধিন আদুউল্লাকুম ফিল আরদ্বি মুসতাক্বাররাউঁ ওয়া মাতাআন ইলা হীন। ফাতালাক্বা আদামা মির রব্বিহী কালিমাতিং ফাতাবা ইলাইহি। ইন্নাহু হুয়াততাওয়াবুর রহীম। ক্বুলনাহ বিত্বূ মিনহা জামীআ। ফাইম্মা এ’তিয়ান্নাকুম মিন্নী হুদাং ফামাং তাবিআ হুদা এফালা খাওফুন আলাইহিম ওলা হুম এহযানূন।
‘শায়তান আদম ও হাওয়াকে বিচ্যুত করল এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে বের করে দিল। আমি তখন বললাম, তোমরা সকল যমীনে নেমে যাও পরষ্পরে শত্রু হিসেবে। এ যমীনে নির্দিষ্টকাল তোমাদের জন্য অবস্থান স্থল ও ভোগ্য বস্তু রয়েছে। অত:পর আদম তার প্রভুর নিকট থেকে কতিপয় বাণী প্রাপ্ত হন। এর ভিত্তিতে তিনি তাওবা করেন তথা ইসলামী চেতনা গ্রহণ করেন। আল্লাহ তাওবা কবুলকারী দয়াময়।
আমি বললাম তোমরা সকলে যমীনে নেমে যাও। যখন আমার নিকট থেকে পথ নির্দেশ আসবে তখন যারা আমার পথনির্দেশ অনুসরণ করবে, তাদের জন্য কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্থও হবে না।’ (সূরা বাকারা: 3৩৬-৩৮)।
এভাবে জ্ঞান ইসলামীকরণের কার্যক্রম উন্মেষের পর এটি বর্তমানকাল পর্যন্ত কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করে। যা নিম্নরূপ:
ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়:
প্রথম পর্যায়: নবুওয়াতী ধারা:
হযরত আদম আ: এর পর মানব জাতি যখনই আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও হেদায়েত থেকে বিচ্যুত হয়ে অজ্ঞানতার প্রতি, মিথ্যার প্রতি ধাবিত হয়েছে, তখনই যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে। তারা মানব সমাজে প্রচলিত জ্ঞান সংশোধন করেন এবং ইসলামী জ্ঞানকে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেন। তাদের সকলের কাজ জ্ঞান ইসলামী করণ কাজের আওতাভুক্ত। এভাবে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সা: আগমন করেন এবং জ্ঞান ইসলামীকরণে সামগ্রিক প্রচেষ্টা নিয়োগ করেন। তাঁর মাধ্যমে প্রাপ্ত কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান ও তাঁর যুগ এ ক্ষেত্রে সকল যুগের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট মডেল।
দ্বিতীয় পর্যায়: মধ্যযুগে গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞানের আগ্রাসন মোকাবেলা:
নবুওয়াতী ধারায় রচিত জ্ঞান ভাণ্ডারে পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবীগণের যুগ অতিবাহিত হয়। তারা নতুন কোন সমস্যা দেখা দিলে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ব্যক্তিগতভাবে এবং সামষ্টিকভাবে ইজতিহাদ করেছেন। ইসলামীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবস্থাদি চালু করেছেন। এভাবে তাবেঈন তথা উমাইয়াদের যুগ অতিবাহিত হয়। কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির প্রেক্ষাপটে মুসলমানগণ এমন এমন এলাকায় গমন করেন, যেখানে গ্রীক রোমান জ্ঞান বিজ্ঞান প্রচলিত ছিল। তখন অতি উতসাহ ভরে ও অমুসলিমদের প্রভাবে কিছু মুসলিম পণ্ডিত আব্বাসীয় আমলে গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞান আরবীতে অনুবাদ করে আলোচনা শুরু করেন। তখন চার ধরণের দৃষ্টিভঙ্গীর উন্মেষ ঘটে।
ক. প্রচণ্ড প্রভাবিত হওয়া:
বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক পর্যায়ে মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধিজ্ঞানের উপর অফুরন্ত নির্ভরশীলতার উন্মেষ ঘটে। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে মুসলিম মুতাযেলী সম্প্রদায়। তারা গ্রীক দর্শনের প্রচণ্ড ভক্ত বনে যায়। তাদের মধ্যে একদল গ্রীক যুক্তি বিদ্যায় আকৃষ্ট হয়ে জ্ঞানের সকল পর্যায়ে গ্রীক মানতিক তথা যুক্তিবিদ্যা প্রয়োগ করতে শুরু করে। তাদের বুদ্ধিভিত্তিক মূলনীতির বাইরে কিছু হলে তা পরিহার বা উপেক্ষা করতে শুরু করে।
খ. প্রত্যাখ্যান:
অপরদিকে কুরআন সুন্নাহে আকড়িয়ে ধরা উলামায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিছগণ গ্রীক দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞান প্রত্যাখ্যান করে। তারা মনে করেন, জীবন পরিচালনার জন্য কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানই যথেষ্ট।
গ. সমন্বয় সাধনের চেষ্টা:
গ্রীক দর্শন অধ্যয়ন ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় লিপ্ত কিছু ব্যক্তি মুসলিম দার্শনিক বলে আত্মপ্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে মুতাযেলা সহ অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিও ছিলেন। তার মধ্যে আবু নসর ফারাবীর মত কিছু ব্যক্তি ইসলামী চিন্তাধারা ও গ্রীক চিন্তাধারার মাঝে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন।
ঘ. অসারতা প্রমাণ:
অপরদিকে আবুল হাসান আশআরীর মতো কিছু কালাম শাস্ত্রবিদ মুতাযেলী মতবাদ পরিত্যাগ করে মুতাযেলী মতবাদ ও গ্রীক দর্শনের বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য খন্ডন করার কাজে আত্ম নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে ইমাম আবু হামেদ গাযালী এসে তাহাফাতুল ফালাসাফা লিখে গ্রীক দর্শনের খন্ডন করেন এবং এর অসারতা প্রমাণ করেন। অত:পর ইবন তাইমিয়া প্রমাণ করেন যে, শুধু গ্রীক দর্শন অসার নয়, বরং এ দর্শন যে ভিত্তি ও পদ্ধতির উপর প্রতিষ্টিত তাও অসার। এ বিষয়ে তিনি আর রাদ্দু আলাল মানতিকিয়্যিন নামক গ্রন্থ লেখে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
তৃতীয় পর্যায়: দ্বীনী জ্ঞান বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবিতকরণের প্রয়াস:
এ পর্যায়ে এসে উলামায়ে কেরাম গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিবর্তে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবীতকরণের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এক্ষেত্রে পথিকৃত হলেন ইমাম আবু হামেদ গাযালী। এ লক্ষ্যে তিনি রচনা করেন ‘ইহইয়াউ উলুমিদ দ্বীন’ (দ্বীনি জ্ঞান সমূহের পুনরুজ্জীবীতকরণ)। অবশ্য কিছু রচনায় গ্রীক যুক্তিবিদ্যা তথা মানতিক থেকে তিনি একেবারে বের হয়ে আসেন নি। তবে তিনি তা ইসলামী ভাবধারায় গ্রহণ বর্জন করেছেন। এর প্রতিফলন ঘটে উসূলে ফিকহ তথা ইসলামী গবেষণা পদ্ধতির উপর লেখা তাঁর অমর গ্রন্থ ‘আল মুস্তাসফা ফী ইলমিল উসূল’ নামক গ্রন্থে। এর ভূমিকায় তিনি মানতিকী তথা যুক্তি বিদ্যার স্টাইলে ব্যাপক আলোচনা করেছেন।
একই ধারায় শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া এ ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। বিশেষত তার রচিত কয়েকটি গ্রন্থে। তন্মধ্যে: আর রাদ্দু আলাল মানতিকিয়্যিন, ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম, কিতাবুল ঈমান, রাফউল মালাম আন আইয়্যিম্মাতিল আলাম, বিভিন্ন ফাতাওয়া ইত্যাদি গ্রন্থে। এ জন্যে জ্ঞান ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে ইবন তাইমিয়াকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়।৬
একইভাবে তাঁর শিষ্য ইবনুল কায়্যিমও ব্যাপক অবদান রাখেন। বিশেষত তাঁর রচিত মাদারিজুস সালিকীন, আস সাওয়াইকুল মুরসালা, কিতাবুর রুহ, ইলামুল মুওয়াক্কিয়িন, আত তুরুকুল হিকামিয়্যা ইত্যাদি গ্রন্থে। অপরদিকে স্পেনের বিভিন্ন মুসলিম শিক্ষায়তনে অধ্যয়ন করে তাদের প্রভাবে খ্রিস্টান স্কলাস্টিক বা ধর্মবিদরা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে সেন্ট টমাস একুইনাসের আমল থেকে গ্রীক দর্শনের আলোকে খ্রিস্টীয় মতবাদ সংস্কারের চেষ্টা করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জ্ঞানকে খ্রিস্টিয় ধারায় সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে কেউ কেউ একে খ্রিস্টায়নের সূচনা বলে আখ্যায়িত করেন।৭
চতুর্থ পর্যায়: ইজতিহাদে মন্দাভাব ও উম্মাহর পশ্চাতপদতা:
থ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর পর থেকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে মাযহাবী চেতনার ব্যাপক প্রসারের কারণে কুরআন ও সুন্নাহের উপর সরাসরি ইজতিহাদের মাত্রা হ্রাস পেতে থাকে। তখন সুফী, আশআরী ও যাহেরী ফকীহগণের মাধ্যমে ওহী জ্ঞান ও আকলের মাঝে দ্বন্ধ সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ইজতিহাদের ক্ষেত্রে মন্দাভাব দেখা যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের পর এ মন্দাভাবটির আরো প্রসার ঘটে।
অপরদিকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপে মুসলিম জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রভাবে আলোকিত যুগ শুরু হয়। সেখানে ধর্মীয় স্তর থেকে নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটলে নতুন নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। এগুলো মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার পর ইজতিহাদের দৈন্যতার কারণে মুসলিম স্কলারগণ এগুলোকে ইসলামের আলোকে মূল্যায়নে যথাযথ গুরুত্বারোপ করেননি। ফলে মুসলিম শাসকবর্গ এ সব দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপ থেকে আমদানী করতে শুরু করেন। বিশেষত তুরস্কের উসমানী খিলাফতের মাধ্যমে এগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটে।
এভাবে মুসলমানগণ জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতৃত্ব হারায়। যদিও তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মতাত্ত্বিক ও বৈষয়িক বিষয়ের সমন্বয় ছিল, কিন্তু বৈষয়িকতায় পশ্চাতপদতার কারণে তা সমসাময়িক বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে যথাযথ সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেনি।
——————-
৬. দ্র: ড. ত্বাহা জাবির আলওয়ানী, ইবন তাইমিয়া ওয়া ইসলামিয়্যাতুল মা’রিফা।
৭. ঢাকাস্থ ইসলামী একাডেমী কর্তৃক আয়োজিত ডিসকের্সে ড. এমাজ উদ্দীন একে খ্রিস্টায়ন বলে আখ্যায়িত করেন। ( গ্রন্থনা: ইশারফ হোসেন)।
অবশ্য সে সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (১৭৬২ খ্রি.) ও হিজাযে শায়খ মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব নজদী ( মৃ. ১৭৮৭ খ্রি.) সংস্কারের চেষ্টা করেন এবং মুক্তভাবে ইজতিহাদ করার প্রয়াস চালান। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ: এর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের নির্যাস তুলে ধরে সমাজের জন্য তার কল্যাণকারিতা তুলে ধরে চেষ্টা করেন। এ পদক্ষেপটিকেও জ্ঞান ইসলামীকরণের প্রচেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম প্রশাসকগণ এ সব প্রচেষ্টা দ্বারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত হননি।
পঞ্চম পর্যায়: নব জাগরণ ও আধুনিকায়ন:
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ও উনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম সমাজে আধুনিকায়নের জোয়ার বয়ে যায়। ইউরোপীয় রেনেসাঁয় ‘জ্ঞানবিপ্লব’ ঘটে। কিন্তু আধুনিকায়নের মানদণ্ড কি হবে। এ নিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও উলামার মাঝে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে কটি নিম্নরূপ:
ক. সেকুলারায়নের প্রচেষ্টা:
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশেষত ইউরোপে চার্চের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় শাসক শ্রেণী ও বিজ্ঞানীদের যৌথ অবস্থান গ্রহণ করায় সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (Secularism) এর জন্ম নেয়। তখন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সমাজবিজ্ঞানীগণ ধর্মকে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করে লেখালেখি শুরু করে। ফলে রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ধর্মের প্রভাভমুক্ত করার প্রয়াস চলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদিতার প্রসারের সাথে সাথে এসব অঞ্চলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সয়লাব বয়ে যায়। তারা তাদের সুবিধার্থেই মুসলিম সমাজকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনা আয়োজন করে। যে জন্য চিরাচরিত শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা চালায় এবং ইসলামী শিক্ষা সংস্কার ও আধুনিকায়নের নামে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানকে খাট ছাট করতে শুরু করে। বিশেষ করে বৃটিশ বেনিয়ারা ভারত এবং সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্স মিসর দখল করার পর এ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল।
খ. পাশ্চাত্যায়নের প্রচেষ্টা:
ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বের কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবি ও নেতা মুসলিম সমাজকে পাশ্চাত্যের মডেলে পুনর্গঠনের চেষ্টা করেন। তুরস্কের উসমানী খিলাফত বিশেষত সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ (১৮০৮-১৮৩৯ খ্রি.) পাশ্চাত্যের মডেলে সামরিক বিভাগ সংস্কার করতে যেয়ে প্রশাসনিক ও শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার আনার জন্য সভাসদীয় কিছু আলেমের সাথে পরামর্শ করেন। তারাও এ ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করে। ফলে তখন তুরস্কে পাশ্চাত্য ব্যবস্থা ব্যপকভাবে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে ১৯২৪ সালে উসমানী খিলাফতের পতনের পর তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্য মুছে ফেলে ইউরোপের আদলে তুরস্ককে গড়ার জন্য সর্বোত চেষ্টা নিয়োজিত করে। এদিকে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার যেসব অঞ্চল বৃটিশ, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগালরা দখল করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে সে সব এলাকাতেও পাশ্চাত্যায়নের চেষ্টা চালায়। এ ক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়া ও কাজ করার জন্য ইউরোপ থেকে কিছু প্রাচ্যবিদ (Orientalist) বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসে। এমনকি সে অঞ্চলে দেশীয় মুসলিমও এগিয়ে আসে তাদের সহযোগিতায়। যেমন মিসরের ত্বহা হোসাইন, মুহাম্মদ সালামা প্রমূখ মিসরকে পাশ্চাত্যায়নের জন্য সামগ্রিক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিল।
গ. সমন্বয়ের প্রচেষ্ঠা
মুসলিম চিন্তাধারা ও সমাজকে আধুনিকায়নের নামে পাশ্চাত্যায়ন প্রচেষ্টার পাশাপাশি আরেকদল মুসলিম বুদ্ধিজীবী পাশ্চাত্য দর্শন ও ব্যবস্থাপনার সাথে ইসলামের সমন্বয় সাধনেরও চেষ্টা করেছিলেন। তন্মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের স্যার সৈয়দ আহমদ (মৃ. ১৮৯৮), মিসরের আলী আবদুর রাজ্জাক, মুহাম্মদ আলী জাওহারী প্রমূখ এ ক্ষেত্রে কিছু কাজ করেন। কিন্তু এ কাজ করতে যেয়ে পাশ্চাত্যের চিন্তা চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে এর সাথে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে খাট ছাট করতে বা ব্যাখ্যা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি।
ঘ. প্যান ইসলামিযম আন্দোলন:
পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন একত্রিত হয়ে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের মধ্যে বাটোয়ারা করে দখল করছিল, তখন বিশ্বের সমস্ত মুসলমানকে একই খলীফার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য প্যান ইসলামিযম (Pan -Islamism) বা বিশ্ব ইসলামীবাদ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। এ আন্দোলনের অগ্রনায়ক ছিলেন আফগানিস্তানের বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী সায়্যিদ জামাল উদ্দিন আফগানী (মৃত: ১৯৭০ খ্রি.) এছাড়া, তুরস্কের সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ ছিলেন এ আন্দোলনের একজন বড় সমর্থক। জামাল উদ্দীন আফগানী সারা বিশ্ব ঘুরে মুসলমানদেরকে সচেতন করতে থাকেন। তিনি মিসরে শায়খ মুহাম্মদ আবদুহু (মৃত ১৯০৫) ও সায়্যিদ রাশীদ রেদার মত কিছু শিষ্য পেয়ে যান। তাঁর নিজের ও শিষ্যদের বক্তব্য ছিল, পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ নয়। ইসলামী চিন্তা ধারা ও সমাজ সংস্কার করতে হবে। মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ কাজে তারা আল উরওয়াতুল উসকা নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর মাত্র সতেরটি সংখ্যার মাধ্যমে মুসলিম চিন্তা ধারা সংস্কারের ব্যাপক কর্মসূচী উপস্থাপন করা হয়। অত:পর সায়্যিদ রেদা প্রকাশিত আল মানার পত্রিকাটিও একই ভূমিকা পালন করে। এ জন্য জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে এ আন্দোলনটি একটি মাইলফলক। কিন্তু পরবর্তীতে সে খিলাফতের পতনের পর এ আন্দোলন তুরস্কে ম্লান হয়ে গেলেও এ আন্দোলনের ছোয়ায় মুসলিম উম্মাহর মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে। বরং ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হয়।
ঙ. ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ:
প্যান ইসলামীবাদের প্রভাবে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে মুসলিম বিশ্বে এমনকিছু চিন্তাবিদের উদ্ভব হয়, যারা পাশ্চাত্য দর্শনের প্রাধান্যকে সমালোচনার সুম্মুখীন করেন। তারা পশ্চিমা বিশ্বের ভাল ভাল বিষয়গুলো গ্রহণ করা এবং যা ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, তা বর্জন করার আহবান জানান। সাথে সাথে কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য ব্যাপক চিন্তাভাবনা ও গবেষণা চালান এবং মুসলিম সমাজ সংস্কার ও সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। এ ক্ষেত্রে মিসরের হাসানুল বান্না ও তার প্রতিষ্টিত ইখওয়ানুল মুসলিমীন ( প্রতিষ্ঠা ১৯২৮খ্রি.) এর সাথে জড়িত ও সমর্থনকারী আলেমগণের অবদান সবচেয়ে বেশী। তন্মধ্যে: শহীদ আবদুল কাদের আওদা, সায়্যিদ কুতুব, মুহাম্মদ কুতুব, মুহাম্মদ গাযালী প্রমূখের নাম উল্লেখ্য। এমনিভাবে তৎকালীন ভারতের আল্লামা শিবলী নোমানী, রেনেসার কবি ড. আল্লামা ইকবার (মৃত ১৯৩৮) ও মাওলানা আবুল আলা মওদুদী প্রমূখ এক্ষেত্রে অবদান রাখেন। মাও. মওদুদী তার তরজুমানুল কুরআন পত্রিকা ও অন্যান্য বই পুস্তকের মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। উপরে বর্ণিত সকল মুসলিম চিন্তাবিদ প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যেন, ইসলাম ও পশ্চিমা সভ্যতার মাঝে পার্থক্য আছে। তাই ঢালাওভাবে সবকিছু গ্রহণ করা যাবে না। কুরআন সুন্নাহর আলোকে আধুনিক যুগ প্রেক্ষাপটেও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তারা প্রচলিত অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও আইন ইত্যাদি ইসলামীকরণের জন্য প্রচুর লেখালেখি করেন এবং গ্রন্থাদি রচনা করেন।
৬ষ্ঠ পর্যায়: শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামায়ন:
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মুসলিম উম্মাহর প্রাজ্ঞ উলামা ও নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করতে শুরু করলেন যে, মুসলিম উম্মাহর সংকট উত্তরণের পথ শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামের আলোকে সংষ্কার ও আধুনিকায়ন। এর মাধ্যমেই মানব সমাজ ইসলামীকরণ করা সম্ভব। ১৯০৮ সালেই বঙ্গীয় অঞ্চলে মাও. আবু নসর ওহীদ সাধারণ শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার মাঝে সমন্বয়ধর্মী একটি পরিকল্পনা তৈরী করেন। এ জন্য তিনি মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, ভারতে মাওলানা শিবলী নোমানী সহ অনেক পণ্ডিতের সাথে মতবিনিময়। তৎকালীন বৃটিশ ভারতের ইংরেজ শাসক ও বুদ্ধিজীবিরা এতে উষ্মা প্রকাশ করলেও একে এ রিপোর্টকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় অঞ্চলে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়। ইসলাম প্রচার ও বিশেষজ্ঞ তৈরীর জন্য ১৯১৫ সালে মাও: মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী কর্তৃক ‘আরবী বিশ্ববিদ্যালয়’ পরিকল্পনা এবং বৃটিশ সরকার কর্তৃক গঠিত মাওলাবক্স কমিটি (১৯৩৮) মাদরাসা শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে এ অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় (University of Islamic Learning) প্রতিষ্ঠার রিপোর্ট তৈরী করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ বেনিয়া তা বাস্তবায়ন করেনি।
ইতোমধ্যে ১৯৩০ সালে মিসরের আল আযহার ও মরক্কো ফাসের কায়রোয়ান বিশ্ববিদ্যালয় সংষ্কার ও উন্নয়ন করা হয়। তাতেও আধুনিক শিক্ষার বিভিন্ন শাখার আলোকে বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে সে সব শাখায় ইসলামী চিন্তা চেতনা প্রবিষ্ট করানোর প্রয়াস চলে।
অপরদিকে ভারতে দেওবন্দ মাদরাসায় হাদীছ ও দরসের পাশাপাশি দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়নের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সমসাময়িক কালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের নদওয়াতুল উলামার শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী ও প্রচলিত অর্থে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে কারিকুলাম তৈরী করে তা পঠন পাঠনের ব্যবস্থা করা হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন মাও: সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী।
অত:পর বঙ্গীয় অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন থেমে যায়নি। এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (১৯৬৩) প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়। এ কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. এস এম হোসাইন (তাঁর একটি গ্রন্থ আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যভুক্ত) এর নেতৃত্বে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত একটি স্কীম প্রণয়ন করে সরকারের নিকট পেশ করেন। সমকালীন মুসলিম বিশ্বের শিক্ষার ইতিহাসে বঙ্গীয় অঞ্চলের এ রিপোর্টটি শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামীকরণ আন্দোলনে একটি মাইলফলক। কিন্তু ততকালীন সরকার তাও বাস্তবায়ন করেনি। এটি বাস্তবায়ন করলে হয়তো ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রটি এ ক্ষেত্রে ততকালীন মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি মডেল হতে পারতো।
এভাবে বাংলাদেশরই আরেক কৃতি সন্তান প্রফেসর ড. সৈয়দ আলী আশরাফ বর্তমান সৌদি আরবের জেদ্দাস্থ কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে অধ্যাপক থাকাবস্থায় বাংলাদেশীয় শিক্ষা আন্দোলনকে গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ১৯৭৫ সালে গবেষণা ও পরিকল্পনা করেন। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী অধ্যয়ন ও উলামার সাথে পর্যালোচনা করেন একটি শিক্ষাদর্শন সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেন এবং সে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থার উন্নতি করতে হলে সেই শিক্ষা দর্শনের আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামীকরণ করতে হবে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ততকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আবদুল্লাহ উমর নাসীফ ও ততকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী শায়খ আহমদ সালাহ জামজুম, তথ্য মন্ত্রী ড. শায়খ আবদুহু ইয়ামেনী প্রমূখ এ পরিকল্পনা সমর্থন করে এতে সার্বিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তাদের সহযোগিতায় ড. সৈয়দ আলী আশরাফ গোটা মুসলিম বিশ্ব থেকে মুসলিম শিক্ষাবিদদের নিয়ে মক্কায় বিশ্বমুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে পবিত্র নগরী মক্কায় এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫০ জন মন্ত্রীসহ প্রায় ৪৫০ জন বুদ্ধিজীবী প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করে। গোটা মুসলিম বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামীকরণের পথে এ সম্মেলনটি ছিল একটি মাইল ফলক।
এ সম্মেলনে সারা বিশ্বের মুসলিম চিন্তাবিদ এবং কয়েকজন অতিথি চিন্তাবিদ একত্রিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পৃথক পৃথক সেশনে জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে ৭দিন ব্যাপী আলোচনা শেষে তারা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার উপর জোর দেন। এবং প্রথমে কুরআনিক জ্ঞান তত্ত্বেরও আলোকে জ্ঞানের শ্রেণি বিভাগ ও শিক্ষার সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন। তারা ঐক্যমত্যে পৌঁছেন যে, শিক্ষা মানে শুধু জ্ঞান চর্চা নয়, বরং শিক্ষার মর্মমূলে বিশ্বাস, ধর্ম থাকতে হবে। অর্থাত ইসলামী জীবনাদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। মুসলিম সমাজ ও বিভিন্ন মুসলিম দেশে মুসলমানদের মধ্যে দুটি শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রচলিত ধর্মীয় শিক্ষা বা মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক গবেষণা, আলাপ আলোচনা এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের সাথে আধুনিক শিক্ষিতদের সম্পর্ক সৃষ্টি ও সমন্বয়।
সম্মেলনের সুপারিশ সমূহ কার্যকর করার জন্য একটি ফলোআপ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে শায়খ আহমদ সালাহ জামজুম এবং সেক্রেটারী হিসেবে ড. সৈয়দ আলী আশরাফ মরহুমকে নির্বাচিত করা হয়।
একই বৎসর ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) উদ্যোগে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সৌদি আরবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড সেন্টার ফর ইসলামিক এডুকেশন’। এর পরিচালক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন ড. সৈয়দ আলী আশরাফ।
এ সম্মেলনেরই ধারাবাহিকতায় আরো পাঁচটি আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ নিয়ে সর্বমোট ৬টি সম্মেলন। এগুলোর আলোচ্য বিষয়সহ কিছু তথ্যাদি নিম্নরূপ:
ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন | বিষয় | সাল | স্থান | দেশ |
প্রথম | ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি | ১৯৭৭ | মক্কা | সৌদিআরব |
দ্বিতীয় | শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন | ১৯৮০ | ইসলামাবাদ | পাকিস্তান |
তৃতীয় | পাঠ্যপুস্তক রচনা | ১৯৮১ | ঢাকা | বাংলাদেশ |
চতুর্থ | শিক্ষক প্রশিক্ষণ | ১৯৮২ | জাকার্তা | ইন্দোনেশিয়া |
পঞ্চম | পূর্ববর্তী সম্মেলন সমূহের মূল্যায়ন | ১৯৮৭ | কায়রো | মিসর |
ষষ্ঠ | ইসলামী শিক্ষার কর্মশালা বিশেষত স্কুল প্রতিষ্ঠার কৌশল ও কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়ন ইত্যাদি | ১৯৯৬ | কেপটাউন | দক্ষিণ আফ্রিকা |
সপ্তম পর্যায়: জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলন
জ্ঞান ইসলামীকরণ’ প্রত্যয়টি প্রথম ব্যবহার করেন মালয়েশিয়ান ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ড. সায়্যিদ মুহাম্মদ নকীব আল্ আত্তাস। তিনি ১৯৬৭ সালে পাশ্চাত্যায়নের বিকল্প হিসেবে ইসলামায়ন (Islamization) শব্দটি একটি প্রবন্ধে ব্যবহার করেন একটি অঞ্চলকে ইসলামীকরণ কার্যক্রম প্রসঙ্গে আলোচনায়। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল: Priliminary statement on a general theory of the Islamization of the Malay-Indonesian Archipelago এটি ১৯৬৯ সালে কুয়ালালামপুরথেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালে তিনি আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর থাকাবস্থায় Secular-Secularization-Secularism শিরোনামে প্রবন্ধে Islamization of knowledge এবং The Dewestemization of knowledge প্রত্যয় ব্যবহার করেন।৯
১৯৭৭ সালে মক্কায় শিক্ষা সম্মেলনে ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী উপস্থিত ছিলেন। তিনি সম্মেলনের বক্তব্যে মতামত ব্যক্ত করে বলেন, শিক্ষা তথা জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের মূলে যে জ্ঞান তা ইসলামীকরণ করতে হবে। এ জন্য মুসলিম উম্মাহর চিন্তা জগতে ও পদ্ধতিতে সংস্কার আনতে হবে। জ্ঞানের ভিত্তি মূলে ইসলামী ধ্যান ধারণা কিভাবে প্রাচীনকালে মুসলিম চিন্তাবিদরা বিভিন্ন জ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন, তার সঙ্গে আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য জ্ঞানীরা ধর্মকে বাদ দিয়ে যেসব ধারণার বশবর্তী হয়ে নানাবিধ জ্ঞান চর্চা করেছেন, এই ধ্যান ধারণাগুলোর তুলনা করে পাশ্চাত্য সেকুলার ধ্যান ধারণাকে ইসলামীকরণের প্রস্তাব করেন। ফলে একই বতসরে ইউরোপে কিছু মুসলিম স্কলারদের উদ্যোগে সুইজারল্যান্ডে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ গ্রহণ করেন। সেখানে মুসলিম উম্মাহর মানস সংকট সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। এ দুটি সম্মেলনের যৌথ চিন্তার আলোকে মনে করেন, উম্মাহর মানস সংকট উত্তরণের জন্য জ্ঞান ইসলামীকরণই বেশি জরুরী। ফলে তিনি জ্ঞান ইসলামীকরণের উপর আশির দশকের শুরুতে একটি গ্রন্থই রচনা করেন ( ১৯৮২ সালে প্রকাশিত)। ইতোমধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপে প্রবাসী কয়েখজন আরব মুসলিম স্কলারের সহায়তায় মুসলিম উম্মাহর চিন্তা ও মননের সংস্কার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৮১ সালে উত্তর আমেরিকায় তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জেনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট, International Institute of Islamic Thout সংক্ষেপে IIIT. এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নিয়োগ লাভ করেন ড. ইসমাঈল আল রাজী ফারুকী। এ প্রতিষ্ঠান এবং পাকিস্তান হিজরী নতুন শতাব্দী উদযাপন কমিটির যৌথ উদ্যোগে পরবর্তী বছরে অর্থাত ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের ইসলামাদে ‘জ্ঞান ইসলামীকরণ’ বিষয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। তখন থেকেই ড. সৈয়দ আলী আশরাফের নেতৃত্বে মক্কাভিত্তিক ‘শিক্ষা ইসলামীকরণ আন্দোলন’ এবং ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর নেতৃত্বে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট, International Institute of Islamic Thout সংক্ষেপে IIIT আমেরিকা ভিত্তিক ‘জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলন’ হিসেবে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। যদিও উভয়ের লক্ষ্য মুসলিম উম্মাহর শিক্ষা ও জ্ঞানগত উন্নয়ন। তবুও উভয়ের মাঝে পদ্ধতিগত ও পরিধিগত পার্থক্য ফুটে উঠে। ড. সৈয়দ আলী আশরাফের পদ্ধতি হলো মানব প্রকৃতি ও জ্ঞান আহরণ সম্পর্কিত ইসলামী ধ্যানধারণার আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা। এটি অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক। অপরদিকে ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর নেতৃত্বে স্কলার গণের পদ্ধতি হলো উম্মাহর চিন্তাধারা ও জ্ঞান তত্ত্বের সংস্কার। অত:পর এর আলোকে সামাজিক বিজ্ঞান সমূহের ইসলামীকরণের উপর গুরুত্বারোপ করা। এ জন্য ট্রিপল আইটি থেকে American Journal of Islamic Social Science নামে একটি জার্নাল প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ সংস্থার সাথে যোগ দিয়েছে আমেরিকা ইউরোপভিত্তিক ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এসোসিয়েশন অব মুসলিম সোসিয়েল সাইন্টিস্ট (Association of Muslim Social Scientists)।
তাছাড়া, তারা মনে করেন, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে নয়, সামাজিকভাবেও জ্ঞান ইসলামীকরণ কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। এ দিক দিয়ে এর পরিধি আরো ব্যাপক। উপরোক্ত দু ব্যক্তির ধারা অনুসারে দু ধরণের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। যেমন: ড. আলী আশরাফ মরহুম মানুষের আধ্যাত্মিক দিকটি প্রাধান্য দিচ্ছিলেন, অপরদিকে ড. রাজী ও তার অনুসারীগণ সামাজিক বিজ্ঞানের উপর তথা মানব সমাজের বহিস্থ দিকের উপর প্রাধান্য দিচ্ছিলেন।
জ্ঞান ইসলামীকরণে সে সময়ে ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর সাথে মুসলিম সমাজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে আরো যারা কাজ করছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, তৎকালীন রিয়াদস্থ মুহাম্মদ ইবন সাউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুল হামিদ আবু সোলায়মান এবং ড. ত্বহা জাবির আলওয়ানী প্রমূখ। তারা উভয়ে বর্তমানের ট্রিফল আইটির দায়িত্বশীল। ড. আবু সোলায়মান ১৯৮৪ সালে মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর নিয়োগ লাভ করলে জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি সহযোগি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়। যে জন্য ১৯৮৪ সালে ও ২০০০ সালে সে বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রিফল আইটির যৌথ উদ্যোগে জ্ঞান ইসলামীকরণের উপর দুটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে ট্রিফল আইটির উদ্যোগে আরে কটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। যেমন: ১৯৮৭ সালে খার্তুমে সম্মেলন। এসব সম্মেলনে শতাধিক গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপিত ও আলোচিত হয়। এভাবে ট্রিফল আইটি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় শাখা প্রতিষ্ঠা করে। তন্মধ্যে: সৌদিআরব, বাংলাদেশ, সুদান, মিসর, নাইজেরিয়া, ব্রুনাই ইত্যাদি মুসলিম দেশের রাজধানী শহরে শাখা আছে। এমনিভাবে মালয়েশিয়াতে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট এণ্ড সিভিলাইজেশন ( International Institute of Islamic Thought And Civilization)। নামে কিছু পার্থক্য থাকলেও সারা বিশ্বব্যাপী এসব প্রতিষ্ঠান জ্ঞান ইসলামীকরণের উপর গবেষণা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রকাশনা ইত্যাদির মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে।
অষ্টম পর্যায়: জ্ঞান ও শিক্ষা ইসলামীকরণের মাঝে সমন্বয়:
জানা যায়, জীবনের শেষ সময়ে এসে বিশেষত ১৯৮৭ সালের দিকে ড. সৈয়দ আলী আশরাফ ও ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী উভয়ে একমত হন যে, পৃথকভাবে নয়, বরং জ্ঞান ও শিক্ষা উভয়টি ইসলামীকরণ করা প্রয়োজন। এটিই সর্বশেষ পর্যায়। ড. উমর নাসীফ এক সাক্ষাতকারেও ড. সৈয়দ আলী আশরাফের সর্বশেষ মত হিসেবে জ্ঞান ও শিক্ষার ইসলামীকরণ কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করেন। এমনকি এ পর্যায়ে তাকে পথিকৃত হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রকৃতপক্ষে উভয়টির মাঝে কোন দ্বন্ধ নেই। কারণ জ্ঞান হলো লক্ষ্য, আর শিক্ষা হলো জ্ঞান আহরণের উপায়। অন্যভাবে বলতে গেলে শিক্ষাকে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বলাও বাস্তবভিত্তিক নয়। কারণ সামাজিক শিক্ষা ও গণমাধ্যমেরর মাধ্যমেও শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। সুতরাং উভয়টির সমন্বিত ইসলামীকরণ কার্যক্রমই অধিক কার্যকর এবং যথার্থ।