ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে সমস্যা ও সম্ভাবনা
জ্ঞান ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। যেমন:
এক. বহুমূখী শিক্ষা ব্যবস্থা:
জ্ঞানের ইসলামীকরণের পথে একটি প্রকট সমস্যা হচ্ছে দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা। একমুখী শিক্ষা হলে দ্রুত সংষ্কার করা যেত। দুমুখী বা বহুমুখী শিক্ষার কারণে সমাজের অধিবাসীদের মধ্যে চিন্তা চেতনার ফারাক শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষায় পশ্চিমা জ্ঞান বিজ্ঞান কোন বাছ বিচার না করেই গ্রহণ করা হচ্ছে। পরিবেশ এমনভাবে তৈরী করা হয়, বিভিন্নমুখী শিক্ষার ফলে জ্ঞানের প্রতি বিভিন্ন ধর্মী দৃষ্টিভঙ্গী লালন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দুই: দীর্ঘকালের স্থবিরতা:
দীর্ঘকালের স্থবিরতার কারণে মুসলমানরা চিন্তা চেতনায় ইসলামী জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন অ ইসলামী জ্ঞানই যেন স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়েছে। ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি অনীহা উল্লেখযোগ্য। সমসাময়িক চিন্তাভাবনার প্রতি মুসলিম যুব সমাজ ঝুকে পড়েছে আধুনিকতার চাকচিক্যে।
তিন: চাকরী বা কর্মক্ষেত্রের দৈন্যতা:
ধর্মীয় জ্ঞানের চর্চায় চাকরী নেই। আদর্শিক জীবন গঠনে ধর্মীয় জ্ঞানের অবদান থাকলেও তার প্রতি অবহেলা করা হয়। এমনকি ধর্মীয় জ্ঞানের মাঝে নিহিত বৈষয়িক ব্যবস্থা থাকলেও তা জীবনে কার্যকর করা হচ্ছে না। কারণ সে সব নৈতিকতা পূর্ণ। তাই উপনিবেশিক আমল থেকে দূর্নীতিপরায়ন প্রশাসনের অধীনে গড়ে উঠা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ইসলামী জ্ঞানের আলোকে চাকুরী ক্ষেত্র নিরূপিত না হওয়ায় এ ক্ষেত্রে দিন দিন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চার: মুসলিম নেতৃবৃন্দের উদ্যোগের অভাব:
মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইসলামের কার্যকলাপের প্রতি খুব একটা উদ্যোগী নন। তাদের কার্যকলাপ পরিকল্পনা ভিত্তিক না হয়ে অধিকাংশ সময়ে আবেগতাড়িত বা অন্ধ ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা দ্বিধা দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত হয়। জ্ঞান ইসলামীকরণে তেমন উদ্যোগ নেয় না বা এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও করে না।
পাঁচ: আধুনিক পশ্চিমা জ্ঞানের অভাব:
মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের প্রভাবে ধর্মের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ পশ্চিমাদের জ্ঞানের মূল উতস ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণা থাকলে তারা সে ধরণের চেতনায় প্রভাবিত হতো না।
ছয়: মিডিয়ায় মুসলমানদের আধিপত্যের অভাব:
সমগ্র বিশ্বে দ্রুত তথ্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মিডিয়া যথা- টিভি, স্যাটেলাইট, মোবাইল রেডিও ইন্টারনেট পত্রিকা ইত্যাদি শক্তিশালী মিডিয়া ব্যবহৃত হচ্ছে। মিডিয়ায় ইসলাম বিরোধী ইয়াহুদী ব্লক সহ পশ্চিমা বিশ্ব তথা আমেরিকা, ইংল্যান্ডের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে মুসলমানদের সম্পর্কে যে কোন বানোয়াট তথ্য মুহর্তে বিশ্বের আনাচে কানাচে পৌছিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ সব ক্ষেত্রে মুসলমানদের কর্তৃত্ব নেই বললেই চলে। ইসলামী জ্ঞানের প্রতি বিশ্বজনমত বিষিয়ে তোলা হচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে মিথ্যাচার করে। এটিও একটি বড় সমস্যা।
সাত: পর্যাপ্ত উপকরণের অভাব
ইসলামের আলোকে জ্ঞান তত্ত্বের উপর বইয়ের অভাব রয়েছে। জ্ঞানকে কিভাবে ইসলামীকরণ করা যাবে, তার উপর সহজ সাবলীল গ্রন্থ বাজারে তেমনটি নেই। এ বিষয়টি এখনো বিশেষজ্ঞদের কাজ বলে প্রচলিত। সাধারণ শিক্ষিতদের ধরা ছোয়ার বাইরে এর অবস্থান হওয়ার কারণে এটি মুসলিম সমাজকে তেমনভাবে আকৃষ্ট করতে পারছে না। এ ছাড়া, এ বিষয়ে পত্র পত্রিকা ও জার্ণালের অভাব রয়েছে। যে জন্য উন্নয়নকৃত ধারণাগুলো দ্বারা সহজে উপকৃত হওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে উপকরণসমূহের অভাব রয়েছে এবং যা আছে, তাও দুস্প্রাপ্য। এছাড়া জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার আলোকে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় রচিত বইয়ের সংখ্যা একান্তই নগন্য।
আট: উন্নত কারিকুলাম ও সিলেবাসের অভাব:
জ্ঞান ইসলামীকরণের আলোকে উন্নত কারিকুলাম ও সিলেবাসের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে শুধু মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোন স্কুল বা কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে কার্যকর করার মতো পূর্ণাঙ্গ কারিকুলাম ও সিলেবাস নেই। মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েও চাকুরীর বাজারের কথা চিন্তা করে ইসলামীকরণের আলোকে সিলেবাস ও কারিকুলাম কার্যকর করা থেকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে আসছে।
নয়: মুসলমানদের ঐক্য ও ভাতৃত্ববোধের অভাব
মুসলিম সমাজের মূল সূত্র হচ্ছে ঐক্য ও ভাতৃত্ববোধ। কিন্তু বর্তমানে এ ক্ষেত্রেই সংকট বিরাজমান। যে জন্য ইন্টেলেকচুয়াল পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেও অনৈক্যের কারণে উদ্যোগ সমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায় না। মুসলিম সমাজের বাস্তবতার আলোকে তাদের জ্ঞান ও শিক্ষা কাঠামো ও বিন্যাস কি ধরণের হবে এ ব্যাপারে আজোবধি ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।
দশ: ইসলামী চেতনার অভাব:
মুসলিম সমাজে কাঙ্খিত চেতনার অভাব রয়েছে। মুসলিম উম্মাহ নিজেদের ঈমান ও স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন নয়। এমনকি মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েও ইসলামীকরণের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের যৌথ নীলনক্সার সামনে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগসমূহ ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
বার: অর্থনৈতিক সংকট:
এক সময় আরব বিশ্বের পেট্রো ডলারে জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলনটি সারাবিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সন্ত্রাসের অপবাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামী প্রতিষ্ঠান সমূহের অর্থসম্পদ আমেরিকা ও ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ আটকিয়ে দিচ্ছে। এমনকি মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সরকার ও জনগণের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করছে সে সব প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন না করার জন্য এবং অর্থ সঞ্চালন না করার জন্য। জ্ঞান ইসলামীকরণ প্রতিষ্ঠান সমূহ বর্তমানে এ সমস্যার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
মোটকথা: জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজটি ইসলামী দাওয়াতী কাজের অংশ। তাই ইসলামী দাওয়াতকে ঠেকাতে যেয়ে ইসলাম বিরোধী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ পথে বিভিন্ন বাধা সৃষ্টি করছে। যে কারণে বিভিন্ন দিক দিয়ে জ্ঞান ইসলামীকরণ তৎপরতাটিও আক্রান্ত হচ্ছে।
সম্ভাবনা:
এত কিছুর পরও এ ক্ষেত্রে সফলতার সম্ভাবনাও বিশাল। যেমন:
এক: ইসলাম সম্পর্কে মুসলমানগণ নিকট অতীত থেকে একটু বেশি সচেতন। তাদের এ সচেতনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দুই: ইসলামের প্রতি ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াবাসী অমুসলিমদের আগ্রহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিন: জ্ঞান ইসলামীকরণে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। অতীতে এ ধরণের প্রতিষ্ঠান দেখা যায়নি।
চার: এ বিষয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাধর্মী জার্ণাল প্রকাশিত হচ্ছে।
পাঁচ: এ বিষয়ে গবেষণায় ক্রমেই বুদ্ধিজীবীমহলে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হচ্ছে।
ছয়: জ্ঞানের জগতে পশ্চিমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
সাত: পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যায়ের ন্যায় মুসলমানরাও কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের মডেল ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এতে জ্ঞান ইসলামীকরণের পথকে সুগম করেছে।
আট: বিশ্বে অনেক মুসলিম দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে বিন্যাস করতে চাইছে এবং এ লক্ষ্যে নতুন নতুন চাকরীর ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে। জ্ঞান ইসলামীকরণের পথে এটিও একটি ইতিবাচক দিক।
উপসংহার:
জ্ঞান ইসলামীকরণ করতে হবে। পাশ্চাত্যের সবকিছু বিনা বিচারে গ্রহণ করা সঠিক পদ্ধতি নয়। তাদের নির্দিষ্ট দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। সেভাবেই তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের বিন্যাস করেছে। তাই এটা ইসলামী সমাজ দর্শনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই মিল না থাকলে বিপর্যয় দেখা দেবে। যেমন: রক্তের গ্রুপ না মিলিয়ে রক্ত পুশ করলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। তাই মেচিং এর গুরুত্ব আছে। পরিশেষে বলতে চাই জ্ঞান ও শিক্ষা উভয়টি ইসলামীকরণ প্রয়োজন। শুধু জ্ঞান ইসলামীকরণই যথেষ্ট নয়। কারণ জ্ঞান বিতরণ প্রক্রিয়া যদি ইসলামীকরণ না হয়, তাহলে জ্ঞান যথাযথভাবে উপস্থাপিত না হয়ে বিকৃত আকারেও উপস্থাপিত হতে পারে।
বাংলাভাষায় রচিত লেখকের কতিপয় গ্রন্থ
- বাংলাদেশে ইসলামী দাওয়াতের পথে সমস্যা ও সমাধান।
- তাফসীরুল কুরআন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
- মাতৃভাষা আন্দোলন ও ইসলাম
- ইসলামী দা’ওয়াহ বিষয়ের ভূমিকা
- ইসলামী দাওয়াতের পদধতি ও আধুনিক প্রেক্ষাপট
- ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস
- পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণের দাওয়াত
- মহানবী সা: এর দাওয়াত
- সুন্নাতে রাসূল সা: এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ও তার জবাব
- ইসলামী শারীয়াতের ইজতিহাদের স্বরূপ
- যুগে যুগে ইসলামী দাওয়াহ
- ইসলাম ও বিশ্বায়ন
- ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ইসলাম
- ইসলামী দাওয়াহ বিজ্ঞান: উতপত্তি ও ক্রমবিকাশ
- ইসলামী দাওয়াহ বিজ্ঞানের স্বরূপ
- তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব: পরিচয় ও ইতিহাস
- বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম
- জ্ঞান ইসলামীকরণ: স্বরূপ ও প্রয়োগ
- তুলনামূলক আইন ব্যবস্থা
- ইসলামী শারীআতের সুন্নাতে রাসূল সা: এর মর্যাদা
- তুলনামূলক আইন ও ইসলাম (দুখন্ড)
সমাপ্ত