পঞ্চম পরিচ্ছেদ
জ্ঞান ইসলামীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ
জ্ঞান ইসলামীকরণের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাবিদ বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। নিম্নে কয়েক জনের মতামত উল্লেখ করা হলো:-
*ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর মতামত:
আধুনিক বিশ্বে জ্ঞান ইসলামীকরণ আন্দোলনের অগ্রপথিক হলেন ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী। তার মতে আধুনিক জ্ঞানের ইসলামীকরণ একটি মহান পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে, যদি সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের অংশ হিসাবে মুসলিম বিশ্বে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বাধ্যতামূলক কোর্স হিসেবে চালু করা হয়।
জ্ঞানের ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি যেসব মতামত দিয়েছেন, তা অতি সংক্ষেপে নিম্নরূপ-
প্রথম ধাপ: আধুনিক জ্ঞান আয়ত্তে আনা ও শ্রেণিবিন্যাসকরণ:
পশ্চিমা আধুনিক জ্ঞানের শাখাগুলোকে অবশ্যই শ্রেণি, নীতি, পদ্ধতি, সমস্যা ও বিষয়বস্তু অনুযায়ী বিন্যস্ত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সূচীপত্রের তালিকা বা কোর্সের সিলেবাসের আলোকেই এই বিন্যাস করতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপ: জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার জরিপ:
জ্ঞানের প্রতিটি শাখার উপর জরিপ চালাতে হবে এবং এ সম্পর্কিত নিবন্ধে এর উতপত্তি ও ঐতিহাসিক বিকাশ, বিকাশের পদ্ধতি, দৃষ্টিপাতের ব্যাপকতা এবং এর পক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের অবদানের উপর আলোকপাত করতে হবে। এ ধাপের উদ্দেশ্য হলো পাশ্চাত্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে উতকর্ষ সাধিত হয়েছে মুসলমানদেরকে সে সম্পর্কে অনুধাবন করতে সাহায্য করা।
তৃতীয় ধাপ: ইসলামী জ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জন ও আয়ত্তে আনা:
জ্ঞানের সংশ্লিষ্ট বিষয়টির সাথে ইসলামের বিস্তৃত সামুজ্য অন্বেষণের আগেই ঐ বিষয় সম্পর্কে ইসলামী জ্ঞান কী বলতে চায় তা উদঘাটন করা আবশ্যক। এই ৩য় ধাপের আধুনিক জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাথে সম্পর্কযুক্ত ইসলামী জ্ঞান অধ্যয়নের জন্য এর কয়েক খণ্ড সংকলন প্রণয়ন করতে হবে।
চতুর্থ ধাপ:
অতীতের মনীষীরা তাদের সমকালীন সমস্যার প্রেক্ষিতে ইসলামী জ্ঞান অধ্যয়ন করেছেন। তাদের গবেষণাকর্ম সে সময়ের ঐতিহাসিক পটভূমিতে বিশ্লেষণ এবং জীবন ও চিন্তার অন্যান্য বিভাগের সাথে সমসাময়িক সমস্যার সম্পর্ক চিহ্নিত করে তুলতে হবে। ইসলামী জ্ঞানের অবদানের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের ফলে নি:সন্দেহে ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপর ব্যাপক আলোকপাত হবে। ইসলামী জ্ঞানের বিশ্লেষণ বিক্ষিপ্তভাবে করলে চলবে না। ইসলামী চিন্তাবিদদেরকে এর একটি অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করে ক্রমবিন্যাস করতে হবে।সর্বোপরি প্রধান নীতিসমূহ, প্রধান সমস্যাদি এবং বর্তমান সমস্যার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয়গুলো ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা কৌশলের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
পঞ্চম ধাপ: বর্তমান জ্ঞান শাখাগুলোর সাথে ইসলামের সুনির্দিষ্ট সাযুজ্য স্থাপন:
উপরি উল্লিখিত ৪টি ধাপ ইসলামী চিন্তাবিদদের সামনে সমস্যার রূপরেখা তুলে ধরেছেন। এখন জ্ঞানের প্রতিটি বিষয়ের সাথে ইসলামী জ্ঞানের সুনির্দিষ্ট প্রাসঙ্গিকতা উভয়ের অভিন্ন অবদানের আলোকে নির্ণয় করতে হবে। প্রথমত: আধুনিক জ্ঞানের সংশ্লিষ্ট শাখা যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে সে ব্যাপারে ইসলামী জ্ঞান কুরআন নাজিল হওয়া থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কী অবদান রেখেছে। দ্বিতীয়ত: জ্ঞানের ঐ বিষয়ের সাথে ইসলামের অবদান কতটুকু সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য পূর্ণ? ইসলামী জ্ঞান আধুনিক জ্ঞানের কোন কোন ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ, অপূর্ণ বা প্রেক্ষিত ও পরিধি অতিক্রম করে গেছে। তৃতীয়ত: আধুনিক জ্ঞানের যেসব শাখায় ইসলামী জ্ঞানের অবদান সামান্য বা শূন্য। সেক্ষেত্রে মুসলমানরা ঐ ঘাটতিপূরণ, সমস্যা নির্ণয় ও প্রেক্ষিত প্রসারিত করার লক্ষ্যে কোন পন্থায় অগ্রসর হবে?
ষষ্ঠ ধাপ: আধুনিক জ্ঞানের বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা:
এ পর্যায়ে আধুনিক জ্ঞানকে ইসলামের দৃষ্টিতে পুঙ্খানুপঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। জ্ঞানের ইসলামীকরণের লক্ষ্যে এটি একটি প্রধান পদক্ষেপের মর্যাদা রাখে।
সপ্তম ধাপ: ইসলামী জ্ঞানের উৎস পর্যালোচনা: উৎকর্ষ
আধুনিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যার প্রেক্ষিতে ঐশী বাণী উপলদ্ধি সাযুজ্য ৩টি ক্ষেত্রে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। প্রথমত: সরাসরি ওহীর সূত্র এবং ইতিহাসে প্রাপ্ত রাসূল সা: (অর্থাত কুরআন ও হাদীস), তাঁর সাহাবী রা: এবং তাদের উত্তরসূরীদের সুষ্পষ্ট দৃষ্টান্তের আলোকে ইসলামী দর্শন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বব্যাপী উম্মাহর বর্তমান চাহিদা এবং তৃতীয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাবতীয় আধুনিক জ্ঞান। মানব জীবনের ইসলামী জ্ঞানের অবদান মূল্যায়নের এই গুরুদায়িত্ব অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের উপরেই ন্যস্ত হওয়া আবশ্যক। তাদেরকে একই সাথে মুসলমানদের চাহিদা এবং আধুনিক জ্ঞানে অভিজ্ঞ হতে হবে। ইসলামী জ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যথাসম্ভব পর্যাপ্ত ও সঠিক উপলদ্ধি অর্জনে তাদেরকে সাহায্য করবেন।
অষ্টম ধাপ: উম্মাহর প্রধান সমস্যাবলী জরিপ করা:
উম্মাহর সমস্যাদির সামগ্রিক কারণ, লক্ষণ, অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সাথে সংঘাত এবং পরিণাম সম্পর্কে বাস্তব ও পুংখানুপুংখ পর্যালোচনা তথা জরিপ করা আবশ্যক।
নবম ধাপ: মানব জাতির সমস্যা জরিপ:
ইসলামী চিন্তাবিদদের দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামের আলোকে আজকের বিশ্বের সমস্যা সমাধানে ব্রতী হওয়া সমগ্র মানবজাতির সমস্যা জরিপ করতে হবে। কেননা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের দায়িত্ব ইসলামী দর্শনের উপর ন্যস্ত।
দশম ধাপ: সৃজনশীল বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ:
মানবজীবনের প্রত্যেক বিভাগের ইসলাম সম্মত রূপ কি এবং কিভাবে উভয় জ্ঞানের সমন্বিত কাঠামোকে উম্মাহ ও মানবজাতির কল্যাণে এগিয়ে নেয়া হবে? একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা সমস্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিশেষ প্রকৃতির প্রেক্ষিতে মুসলমানদের জন্য কোন পন্থা বেছে নেয়া বৈধ? এটা নিশ্চিত যে, প্রত্যেক বিষয়েই বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনের সুযোগ রয়েছে যা ইসলামী আদর্শের নিকটবর্তী বা দূরবর্তী হতে পারে, হতে পারে কম বা বেশি কার্যকর কিংবা যা ইসলামী লক্ষ্য অর্জন ত্বরান্বিত বা বাধাগ্রস্থ করতে পারে। এর মধ্যে কোন পথটি সম্ভব, প্রয়োজনীয়, অপরিহার্য, বাঞ্ছনীয় বা বৈধ? সংশ্লিষ্ট সমস্যার সাথে ইসলামের কার্যকারিতা পরিমাপ করা হবে? সৃজনশীল সমন্বিত তত্ত্বের অবদান প্রকাশ, পরীক্ষা ও মূল্যায়নের নীতিই বা কি হবে? কোন নীতির আলোকে এতে সংশোধন ও পরিবর্তন আনা হবে এবং এগুলোর অগ্রগতি ও ফলপ্রসূতা পর্যবেক্ষণ-মূল্যায়ন করা হবে? সমস্যা সমাধান প্রচেষ্টায় উপরি উল্লিখিত প্রশ্নগুলো গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে।
একাদশ ধাপ: ইসলামী কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন বিষয়ের পুনর্বিন্যাস ও পাঠ্যপুস্তক রচনা:
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক নতুন নতুন ধ্যান ধারণার আলোকেই লিখে যেতে হবে শুধু তা নয়, বরং বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে ব্যক্তি বিশেষের রচনাবলী ব্যাপকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে ইসলামী জ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট আধুনিক জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা ও সামঞ্জস্য বিধান করা যায়। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যপুস্তক রচনা জ্ঞানের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত ধাপ। এ কাজটিই পূর্বোল্লিখিত সকল ধাপের প্রক্রিয়ার সাফল্যের মুকুট পরিয়ে দেয়।
দ্বাদশ ধাপ: ইসলামী জ্ঞানের প্রসার:
রচিত পুস্তকাদি উদ্দেশ্য যেন একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের জন্য না হয়। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দ্বীনের জন্য প্রণীত রচনাবলী কাগজ, কালি ও ছাপা বাঁধাইয়ের খরচ যে যোগাতে পারবে সেই তা প্রকাশের অধিকার রাখবে। দ্বিতীয়ত: এসব পুস্তক রচনার উদ্দেশ্য থাকবে সমগ্র মানবজাতির জন্য। তৃতীয়ত: এই কর্ম পরিকল্পনার আওতায় রচিত বইপত্র মুসলিম বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানাতে হবে। স্বভাবত সেগুলো বিভিন্ন দেশের স্ব-স্ব ভাষায় অনুবাদও করতে হবে।
ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী জ্ঞানের ইসলামী রূপায়নে এছাড়াও সহায়ক উপায় হিসেবে নিম্নোক্ত কাজগুলোর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন-
১. সম্মেলন ও সেমিনার করতে।
২. ফ্যাকাল্টি প্রশিক্ষণের জন্য শ্রেণি কর্মশালার আয়োজন করা উচিত। তিনি জ্ঞানের ইসলামীকরণের বাস্তবায়ন সম্পর্কে আরো বলেন-
ক) এ ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের জন্য সম্মানী নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
খ) শিক্ষা সংক্রান্ত বইপত্র প্রণয়নের জন্য কেবল যোগ্যতম ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের যাতে নিয়োগ করা হয় সেদিকে সর্বতোভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৩. বইপত্র প্রণয়নের কাজটি বৃহদাকার হলে তা ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন বিদ্বানকে দেয়া উচিত যাতে নির্দিষ্ট সময়ে কাজটি শেষ হয়।
৪. জ্ঞানের ইসলামীকরণ কাজের জন্য প্রতিটি মুসলিম দেশ থেকে তহবিল সংগ্রহ করা প্রয়োজন।১১
*প্রফেসর ড. সৈয়দ আলী আশরাফ এর মতামত:
ড. সৈয়দ আলী আশরাফ রহ. এর মতে জ্ঞানকে প্রথমে নিম্নরূপ বিভাজন করে কারিকুলাম তৈরী করতে হবে-
আল্লাহ তাআলা সব জ্ঞানের উৎস:
১) আল্লাহ তাআলার সাথে মানুষের সম্পর্ক এর ভিত্তিতে যে জ্ঞান, সেটা হলো ধর্মভিত্তিক। যথা: কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, উসূলে ফিকহ, আকিদা ইত্যদি।
২)মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, এর ভিত্তিতে যে জ্ঞান সেটা হলো মানব বিজ্ঞান।যথা: বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি।
৩) মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক এর ভিত্তিতে যে জ্ঞান, সেটা হলো প্রকৃতি বিজ্ঞান। যথা: অংক, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ইত্যাদি।
অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলী আশরাফ রহ. এর মতে জ্ঞান ও শিক্ষা ইসলামীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ হবে নিম্নরূপ:-
ক. এমন একটি শিক্ষায়তন গড়ে তুলতে হবে যেখানে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা লাভ করবে।
খ. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষাদান করাতে দক্ষক রে তুলতে হবে।
11 ড. ফারুকী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৮-৬৬।
গ. একটি গবেষণাগার থাকবে যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জ্ঞান বিজ্ঞানের ভিত্তিমূলে Secular ভাবধারার পরিবর্তে ইসলামী ভাবধারা প্রতিষ্ঠার কাজ চালাতে এবং সেই ভাবধারার ভিত্তিতে শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যসংক্রান্ত অন্যান্য যাবতীয় বস্তু তৈরীর ব্যবস্থা থাকবে।
ঘ. এ সমস্ত জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে মানুষকে সে পথে পরিচালিত করা যে পথ অনুসরণ করে মানুষ আল্লাহর খলিফা হবার যোগ্যতা অর্জন করে।
জ্ঞানের বা শিক্ষার ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে তিনি Faith Based Education এর কথা বলেছেন।
ড. ত্বাহা জাবির আলওয়ানীর মতামত:
আলকুরআন ও মহাবিশ্ব অধ্যয়নের মাঝে সমন্বয় ধারা রচনার গুরুত্ব দায়িত্ব সেই পালন করতে পারবে যে আলকুরআনের জ্ঞান অর্জন করেছে এবং অন্যান্য জ্ঞান বিজ্ঞানে যথেষ্ট পরিমাণ অংশ আয়ত্ত করেছে। যেন উভয় প্রকার জ্ঞান দ্বারা আলকুরআন, মহাবিশ্ব ও মানুষের সংমিশ্রিত ম্যাথডোলজি উন্মোচিত করা যায়। এ জন্য ‘ইসলামীকরণ’ Islamization এর মূলনীতি সমূহ নিম্নবর্ণিত ভিত্তির উপর দাড় করানো হয়:
এক: জ্ঞানের জগতে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী পুনর্গঠন করা। যে দৃষ্টিভঙ্গী নির্মল নিখাদ ইসলামী আকীদা বিশ্বাস ধ্যান-ধারণার মৌলিক উপাদান ও বৈশিষ্ট্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেন কোন বিষয় উপেক্ষা না করেই মৌলিক চূড়ান্ত প্রশ্নমালার উত্তর দিতে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা সক্ষম বলে গণ্য করা সম্ভব হয়। শিক্ষা সমীক্ষণে সক্ষম ব্যক্তিসত্তার শক্তি সামর্থ্য গড়ে তুলতে হবে। সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে যা আয়ত্ত করা ও চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। একই সময়ে তা পদ্ধতি বিজ্ঞান উদ্ভাবনেও সামর্থ্য প্রদান করবে। এমনিভাবে তা জ্ঞান গত ব্যাখ্যায় সামর্থবান করে তুলবে। যে ব্যাখ্যা আবেগ উদ্দীপনার উপর নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি বিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
দুই: আল কুরআনের পদ্ধতি বিজ্ঞানের আলোকে ও নির্দেশনায় ইসলামী পদ্ধতি বিজ্ঞানের মূলনীতি গঠন, রূপায়ন ও অনুসন্ধান কার্যক্রম পুনর্গঠন। কেননা একক ও আংশিক অধ্যয়নের ফলে ঐ ইসলামী পদ্ধতি বিজ্ঞান নানা দিক দিয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যে অধ্যয়ন আলকুরআনকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করেছে, জীবন জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। অপরদিকে ঐ একক ও বিচ্ছিন্ন অধ্যয়ন প্রক্রিয়া পূর্বে ও বর্তমানেও আলকুরআনের গণ্ডিবহির্ভূত অবস্থানে থেকে সৃষ্টিজগত ও মানুষকে অধ্যয়ন করছে। তাই ইসলামি পদ্ধতি বিজ্ঞানকে পুনর্গঠন করতে হবে, যেন মুসলিম মানস ঐসব চিন্তাধারাগত ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারে। যে সব ব্যাধি সে মুসলিম মানসকে পঙ্গু করে দিয়েছে। যেমন গায়েব তথা অদৃশ্যের সঙ্গে দৃশ্যমান জগতের সম্পর্ক, ওহীর সঙ্গে যুক্তির সম্পর্ক, ঘটনাসমূহের সাথে কার্যকরণের সম্পর্ক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় অনুধাবনে সে মুসলিম মানস কিংকর্তব্যবিমূঢ় হচ্ছে। এতে স্থিতিশীলতার পরিচয় দিতে পাচ্ছেনা।
তিন: এ পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গীতে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সাথে আচরণের পদ্ধতিও পুনর্গঠন করা। যেখানে আলকুরআনকে পথ, পদ্ধতি, জ্ঞানের উতস এবং কৃষ্টি ও সভ্যতার সৌধ নির্মাণের উপাদান সমূহের উতস হিসেবে গণ্য করা হবে। এর জন্য এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উলূমুল কুরআন তথা কুরআনিক জ্ঞান বিজ্ঞান সমূহের পুননির্মাণ ও পুনর্গঠন করা চাই। আল কুরআনের আয়াতসমূহের খেদমতে যে সব ধ্যান ধারণা সৃষ্টি হয়েছে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে মিলেছে, তার অনেক কিছুই হয়ত এ পুনর্গঠন ক্ষেত্রে এড়িয়ে যেতে হবে। আরব জনগণ আলকুরআন বুঝেছে তার রচনার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যসমূহের ভিত্তিতে। যে সব বৈশিষ্ট্য প্রথম দিকে ছিল খুবই সহজ সরল প্রকৃতির এবং সামাজিক দিক দিয়েও চিন্তাধারায় ছিল ভাষাগত ধাচে এবং শ্রুত বিষয়াদি হিসেবে। যে সব শ্রুত বিষয়ে প্রধান বিবেচ্য বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাড়িয়েছিল, সনদ বা বর্ণনাগত সূত্রের সহীহ হওয়া তথা বিশুদ্ধতা আছে কি না, তা লক্ষ্য রাখা এবং সুদৃঢ় করার বিষয়টি সে সময়ে সর্বোন্নত জ্ঞানের বিষয় হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছিল। আলকুরআন ও হাদীসে নববী সংশ্লিষ্ট জ্ঞান বিজ্ঞান যখন সরকারীভাবে সংকলিত হচ্ছিল, তখন তাতে ঐ বৈশিষ্ট্যসমূহও প্রতিভাত হয়। এমনিভাবে এর পাশাপাশি ঐ সংকলন পর্যায়ে আরবী ভাষা ও তার আলংকরিক বৈশিষ্ট্যসমূহও প্রকাশিত হয়। আর তার দাবী অনুসারে শব্দ ও বাক্য গঠন প্রক্রিয়ার মাঝে পার্থক্য করার প্রবণতারও উন্মেষ ঘটেছিল। আর এটাই ছিল সে সময়ে প্রচলিত পদ্ধতি বিজ্ঞান। কিন্তু বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিষয়ের পদ্ধতিগত অনুধাবনের চেতনা প্রাধান্য লাভ করেছে। যেমনি এখন আরো প্রাধান্য লাভ করেছে বিভিন্ন সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী সম্পর্কের বিশ্লেষণ ও যুক্তি ভিত্তিক পর্যালোচনা করার প্রবণতা। যাতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক নিয়ম নীতিমালা ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এ সবকে সমাজ ও সভ্যতার বিভিন্ন বিষয়ের সাথে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। সুতরাং আলকুরআন অনুধাবন ও অধ্যয়নে সহায়ক সকল জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি নতুনভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন। তাই এ মহা গ্রন্থটি অধ্যয়নের সাথে মহাবিশ্ব অধ্যয়নের সমন্বয় ও আন্তসম্পর্কীয় পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এমনিভাবে এ প্রক্রিয়াটিকে মুক্ত করতে হবে ঐ পর্যায়ের তাফসীর ও তাবীলের অনেক কিছু থেকে। প্রত্যাখ্যাত ইসরাঈলী বর্ণনার মত আরো অনেক কিছু আনুপাতিক হারে পরিত্যাগ করার ক্ষেত্রে দৃঢ়ভাবে নিবিষ্ট হতে হবে। আল কুরআন অধ্যয়ন পদ্ধতিকে আয়াত নাযিল হওয়ার পন্থা, এ সবের পূর্বাপর সম্পর্কের সাথে পূর্ণ মিলন ঘটাতে হবে। যেন এর দ্বারা মহামহিম কিতাব আলকুরআনের চ্যালেঞ্জের বিভিন্ন দিক সমূহ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আর সে গ্রন্থের অলৌকিকতার বিভিন্ন দিকের সাথে তার সামাজিক ও পদ্ধতি বিজ্ঞানগত দিকটিও সংযোজন করা উচিত। যেন তার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জটি অনিমেষ রূপে প্রমাণিত হয় এবং তার অলৌকিকতা বিদিত হয়। আর এটাই তো তার সাধারণী হওয়া ও সার্বিকতার পক্ষে প্রথম পদ্ধতিগত দলীল।
চার: পদ্ধতি বিজ্ঞানের ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে পবিত্র সুন্নতে নববীর সাথে আচরণ পদ্ধতিও পুনর্গঠন করতে হবে। যেখানে বিশুদ্ধ ও পবিত্র সুন্নতে নববীকেও পথ, পদ্ধতি ও জ্ঞানের উতস এবং কৃষ্টি ও সভ্যতার সৌধ নির্মাণের উপাদান সমূহের উতস হিসেবে গণ্য করা হবে। রাসূলুল্লাহ সা: এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারতেন, তারা তার অনুসরণ ও অনুকরণ করতেন। সে পর্যায়টি ছিল সরাসরি যোগাযোগের যুগ। যখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার নিকট থেকে তোমাদের হজ্জ্ব সম্পাদনের কার্যাবলী শিখে নাও। তিনি আরো বলেছিলেন, তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছো, সেভাবে সালাত আদায় কর। সুতরাং বাস্তবে অনুসরণ ও অনুকরণের বিষয়দ্বয় রাসূল সা: এর কর্মতৎপরতার উপর নির্ভরশীল। রাসূল সা: আল কুরআনের শিক্ষাকে নিজ কাজে রূপায়ন করতেন। তিনি তা রূপায়ন করতেন বাস্তবতার ভিত্তিতে এবং আলকুরআনের নির্দেশনা ও জীবনের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে। মহানবী সা: কর্তৃক আল কুরআনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত কুরআনিক পদ্ধতির উপাদান সমূহ এবং ততকালীন সমাজ বাস্তবতার মাঝে পার্থক্যের পরিধি সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। যে বাস্তবতা বিরাজমান ছিল সে সমাজ সদস্যদের বুদ্ধিবৃত্তি, চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানের পরিমাপ বা সামর্থের ভিত্তিতে এবং সেখানে প্রচলিত জ্ঞান পরিমণ্ডলে সেই বাস্তবতার সামাজিক ও চিন্তা-চেতনাগত বাধ্যবাধকতা বা শর্ত সমূহের আলোকে। এ জন্য সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যারা হাদীস বর্ণনা করতেন, তারা মহানবী সা: এর জীবনের কোন অংশ সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকতে চাইতেন না। তাঁর জীবনের সকল দিক সম্পর্কে জানার জন্য তারা পাগলপারা তথা প্রচণ্ড আগ্রহ পোষণ করতেন। কেননা বিভিন্ন বিষয়ে পদ্ধতি সম্পর্কে অবহতির জন্য এটাই ছিল একমাত্র অবলম্বন। এ জন্য দেখা যায়, সুন্নাহর ক্ষেত্রে রাসূল সা: এর বাণী, কাজ ও সম্মতিসমূহের বিশাল সমাবেশ ঘটেছে। একই কারণে আমরা তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পেয়েছি। যাতে আমরা এমনকি তাঁর সকাল সন্ধায় দৈনন্দিন কার্যাবলী, তার সন্ধি স্থাপন, যুদ্ধ, শিক্ষা-দীক্ষা, বিচার ফয়সালা, নেতৃত্ব, ফাতওয়া, মানবীয় আচার আচরণ ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। এ সব ক্ষেত্রে তাঁর অনুসৃত কর্মপন্থা সমাজ পরিষ্থিতির সাথে তাঁর আচার আচরণ পদ্ধতি বা নিয়মনীতি স্পষ্ট করে দিয়েছে। মহানবী সা: যে পরিবেশে বসবাস করেছেন ও কর্মততপর ছিলেন, এসব বিস্তারিত তথ্যসমূহ সে পরিবেশ ও বাস্তবতার বৈশিষ্ট্যসমূহ স্পষ্ট করে দিয়েছে। ঐ বাস্তব অবস্থাটি গঠন ও মননে বর্তমান আমাদের অবস্থা থেকে নি:সন্দেহে ভিন্ন ছিল।
রাসূল সা: তাঁর সুন্নাহর মাধ্যমে কুরআনিক পদ্ধতি ও বাস্তবতার মাঝে বন্ধন রচনা করতেন। সুতরাং মহানবী সা: যে বাস্তবতায় বসবাস করতেন, তা এড়িয়ে গেলে তার সুন্নাহর অনেক কিছুই অনুধাবন করা কঠিন হবে। তিনি ভাস্কর্য নির্মাণ ও চিত্রাঙ্কনের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন এবং যারা মূর্তি তৈরী করে বা চিত্রাঙ্কন করে, তাদেরকে কিয়ামত দিবসে ১২ তথা আখেরাতে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হিসেবে গণ্য করেন। কিন্তু এটা বুঝা উচিত নয় যে, তখন তার সে নিষেধাজ্ঞাটি ছিল দেহাবয়ব কেন্দ্রিক সকল প্রকার নান্দনিকতার বিরুদ্ধে। তার সে নিষেধাজ্ঞাটি সাধারণী ও সর্বব্যাপী ছিল না। যদি এ নিষেধাজ্ঞাটির দ্বারা তাই বুঝানো হয়, তা হলে এটা আল্লাহর নবী হযরত সুলায়মান আ: কর্তৃক শিল্পকর্ম ও সে সম্পর্কে তার ধারণার সাথে পরস্পর বিরোধী হয়ে যাবে। কেননা হযরত সুলায়মান তার সৈন্যবাহিনীর অন্তর্গত জিনদেরকে তার চাহিদানুসারে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও চিত্রাঙ্কন করতে নিয়োগ করেছিলেন। তাই এটা মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা: এর নিষেধাজ্ঞার সাথে পরষ্পর বিরোধী হয়ে যাবে, যদি এ নিষেধাজ্ঞাটিকে সর্বব্যাপী ধরা হয়। এমনিভাবে বর্তমান সমসাময়িক কালে এ বিষয়ে অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন বা যুক্তি তর্ক সৃষ্টি করে বলেন, এ সব শিল্প কর্মের দ্বারা আমাদের এসব ভাস্কর্যের ইবাদাত করা লক্ষ্য নয়। তা হলে এ চিত্রাঙ্কন বা শিল্পকর্ম হারাম হবে কেন? সুতরাং মহানবী সা: এর ঐ নিষেধাজ্ঞাটি এ দাবীর সাথেও পরস্পর বিরোধী নয়। এছাড়া, কোন খন্ডিত ফাতওয়ার মাধ্যমে ঐ ধরণের চিত্রকর্ম তৈরীর বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে না যে, এ ধরণের চিত্রকর্ম হালাল আর ঐ ধরণের চিত্রকর্ম নিষিদ্ধ। বরং এসব ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা ও পদ্ধতির প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তার পদ্ধতি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিতে গিয়ে যেখানে তিনি বলে ছিলেন, তোমার জাতি যদি নওমুসলিম না হতো, কুফরী অবস্থা থেকে সদ্যমুক্ত না হতো,তাহলে আমি এ কাজটি অবশ্যই করতাম, অবশ্যই করতাম।’১৩
বস্তুত, মূর্তি ভাস্কর্য পূজা থেকে সদ্যমুক্ত একটি জাতির মধ্যে রাসূল সা: মূর্তি শিল্প এবং এর প্রচার প্রসারের মূলোচ্ছেদ করছিলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মহানবী সা: এর বানী ও সুন্নাহকে বিচ্ছিন্ন ভাবে না ধরে তার ভিত্তিতে একটি সুব্যবস্থিত ও সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে পৌঁছানো প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনা করতে যেয়ে দেখা যায়, তার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বলা কথাগুলোকে মতানৈক্যকারীগণ পৃথক পৃথক মতামতে রূপান্তর করেছেন। এ পর্যায়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বলা ঐসব কথার ভিত্তিতে কখনো কখনো একটি বিষয়ে যা ধরে নিতে হয়, আবার এর বিপরীতও ধরে নেয়া যায়। এ যেন বিভিন্ন মাযহাবের ইমামগণের মতামতের ন্যায় অবস্থা। যেখানে একই বিষয়ে তাদের পরস্পরবিরোধী মত পাওয়া যায়।
———————-
১২ এ মর্মে হাদীসটি (কিয়ামতের দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে মূর্তি তৈয়ারকারীরা ও চিত্রকররা) ইমাম নাসাঈ তার সুনান গ্রন্থের ঈমান ও তার শাখা অধ্যায়ের ‘সবচেয়ে কঠিন শাস্তি যে মানুষকে দেয়া হবে’ নামক পরিচেছদে বর্ণনা করেন ( পৃ. ৫৩-৫৬)।
১৩ এখানে হাদীসটি ইমাম নাসাঈ তার সুনানে যাকাত অধ্যায়ের ‘কাবা তৈরীকরণ’ পরিচ্ছেদে বর্ণনা করেন। যেখানে উল্লেখ আছে: হে আয়েশা! তোমার জাতি যদি কুফুরী অবস্থা থেকে সদ্য মুক্ত না হতো, তাহলে এ কাবাঘর ভেঙ্গে হযরত ইবরাহীম আ: যে ভিত্তির উপর তৈরী করেছিলেন একে আমি সে ভিত্তির উপর দাড় করাতাম। আর আমি এর পশ্চাত দরজা রাখতাম…।
প্রকৃতপক্ষে যাকে রাসূল সা: এর অনুসরণ ও অনুকরণ বলে অভিহিত করা যায়, আল কুরআন নাযিল হওয়ার যুগে আরব সমাজ তাতেই ছিল ব্যাপৃত ও নিবিষ্ট। তারা তাঁর নিকট থেকে একটি ব্যবহারিক মডেল বা আদর্শ লাভ করে। তাদের জীবন যাপন যাত্রা প্রণালী ও বাস্তবতা অনুসারে সে মডেলটি একটি পদ্ধতির রূপ নেয়। এ পর্যায়ে রাসূল সা: এর ঐ অনুসরণ ও অনুকরণের পথ ধরেই হাদীস ও অন্যান্য বর্ণিত বিষয়সমূহের সাথে ব্যবহারিক নীতিমাল সংক্রান্ত ধারণাসমূহের উন্মেষ ঘটে। তবে এর সাথে খন্ডিত ব্যবহার থেকে হাদীসের কার্যকারিতা হ্রাস করার প্রচেষ্টা উদ্ভুত হয়। আর এর অন্তরালে দেখা যায়, কেউ কেউ বাতেনী ব্যাখ্যা, প্রতীকী ও ইশারা-ইঙ্গিত ভিত্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের আশ্রয় নেয়। হাদীসের বাহ্য অর্থের গন্ডি মুক্ত হতেই হয়ত তারা এ পদক্ষেপটি নিয়ে থাকে। কিন্তু বিষয়টি এখানেই থেমে যায়নি। বরং এ ক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল অবস্থা বা বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়। এরপর মাথাচাড়া দিয়ে উঠে গোটা সুন্নাহ বা তার অংশ বিশেষের যথার্থ ও যৌক্তিকতা সম্পর্কিত সমস্যাসমূহ। আমরা এখনো যার ঝামেলা বহন করছি ও গ্লানি টেনে যাচ্ছি। হাঁ, আমরা যদি সুন্নাহর ব্যবহার নীতিমালা সম্পর্কে কুরআনিক ম্যাথডোলজি পর্যন্ত পুরাপুরি পৌঁছতে পারতাম, যে ম্যাথডোলজি সুন্নাহের সকল শাখা প্রশাখার সাথে আচরণ বিধি নিয়ন্ত্রণ করতো, তা হলে এর আওতায় সুন্নাহর ঐ সব শাখা প্রশাখায় বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন বিষয়াদি অনুধাবন করা যেত। এসব অনুধাবন করা যেত শরীআর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমূহ স্পষ্ট করার ভিত্তিতে।
সমসাময়িক বুদ্ধিবৃত্তিক মানসব সব সময় বিভিন্ন বিষয়ের সুশৃঙ্খল বাস্তব ব্যবস্থাপনা অনুসন্ধান করে। এ বুদ্ধিগত মনোবৃত্তি চেষ্টা করে এমন একটি ম্যাথডোলজি অনুসরণ ও কার্যকর করতে যার বিভিন্ন দিক পরিপূর্ণ। এ ম্যাথডোলজির মাধ্যমেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা হবে। কুরআন সুন্নাহ এবং বিশ্বজনীন ও আঞ্চলিক পর্যায়ের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে আচরণ করার ক্ষেত্রে চিন্তাধারা গত আন্দোলনের এটাই হবে বাস্তব ভিত্তিক মডেল বা ছাঁচ। এ ম্যাথডোলজির মাধ্যমেই কুরআন মাজীদের লক্ষ্য সমূহে পৌঁছা যাবে, সুন্নতে নববী অনুধাবন করা যাবে। তখন কেউ অতীতের গর্ভে আশ্রয় নেয়া বা বাতেনী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার কাজে নিপতিত হবে না। এমনিভাবে কেউ নিপতিত হবে না তাজদীদী কাজে তথা নব নব সংস্কারমূলক প্রচেষ্টাতেও। যার ভিত্তিতে পুনর্বিন্যাস মূলক নবসংযোজন বিয়োজন বা বর্তমান যুগোপযোগী করার জন্য অতীতকে নতুন বেশে ভূষিত করা। না, কুরআন সুন্নাহর পদ্ধতি বিজ্ঞান অনুসরণ করতে পারলে এসবের দরকার হবে না।
পাঁচ: আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ইসলামী ঐতিহ্য তথা জ্ঞান ভান্ডার অধ্যয়ন ও অনুধাবন কাজটিও পুনর্গঠন করতে হবে। এগুলো জ্ঞান ও যুক্তি ভিত্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, যাচাই বাছাই, সমালোচনা, পর্যালোচনা মূলক পাঠ করতে হবে। এর মাধ্যমেই আমরা তিনটি চক্র বা বৃত্ত থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব। যে তিনটি চক্র আধুনিক কালে আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান ভান্ডারের সাথে আচরণ বিধি নিয়ন্ত্রণ করছে। এ তিনটি চক্র হলো: অতীত উত্তরাধিকার ভান্ডারের সব কিছু প্রত্যাখ্যানকারী চক্র, সবকিছু গ্রহণকারীচক্র, ম্যাথডোলজি ব্যাতিরেকেই বাছাই করে চলার চক্র। আমাদের উত্তরাধিকার জ্ঞান ভান্ডারের সাথে যথাযথ আচরণ করার ক্ষেত্রে এ তিন চক্রের মাধ্যমে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব নয়। এমনিভাবে এ ভান্ডার থেকে যে সব ক্ষেত্রে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন, তা ঐ তিন চক্রের মাধ্যমে সম্ভব নয়।
ছয়:সমসাময়িক মানব সমাজে বিরাজমান উত্তরাধিকার সম্পদ জ্ঞান ভান্ডার তথা পশ্চিমা উত্তরাধিকার জ্ঞান ভান্ডার ব্যবহার পদ্ধতিও পুনর্গঠন করতে হবে। এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে যেন এর মাধ্যমে বর্তমানে অনুসৃত আচরণ পদ্ধতিসমূহ থেকে মুসলিম মানস বের হয়ে আসতে পারে। বর্তমানের এসব পদ্ধতি বিভিন্ন দিক দিয়ে বিজ্ঞানসম্মত বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালানোর পরিবর্তে মুসলমানদেরকে পশ্চাতে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ এ প্রচেষ্টা সমূহ হওয়া দরকার ছিল পশ্চিমা উত্তরাধিকার সম্পদকে কাছে নিয়ে এসে নিবিড় করা, অত:পর তুলনা করা, তারপর পরস্পর মুখোমুখি করা। কিন্তু তা না করার কারণে যা হওয়ার তাই হয়েছে। পরিণতিতে হয় সবকিছু প্রত্যাখ্যান, না হয় বিনা বাক্যে সবকিছু গ্রহণ, অথবা বিপক্ষে না যেয়েই অন্ধভাবে বাছাই করা হয়। ১৪
এ ৬টি পদক্ষেপ বা অক্ষ বলয় বা দায়িত্ব যাই বলি না কেন- এগুলোকেই বলা হয় “জ্ঞানের ইসলামীকরণ’ (Islamization of knowledge) বা জ্ঞানের তাওহীদ ভিত্তিক পদ্ধতি (Unity of Allah Based Mathod of Knowledge) বা মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান সমূহের ইসলামীকরণ (Islamization of Humanities and Social Science) এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সমূহের ইসলামী দিকনির্দেশনা প্রদান অথবা বিজ্ঞানসমূহকে ইসলামী ভিত্তিমূলে প্রতিস্থাপন। ১৫
প্রফেসর ড. এম শমসের আলীর মতামত:
অধ্যাপক ড. এম. শমসের আলীর মতে-
১. ৬টি world conference on Musilim Education এর Document গুলো সম্পর্কে সচেতনতা awarences সৃষ্টি করতে হবে।
২. ওয়ার্কসপ করে জ্ঞান ইসলামীকরণ সম্পর্কে স্কলারদের জানাতে হবে।
৩. বাংলাদেশ সহ অনেক মুসলিম দেশের সরকার যে মক্কা ঘোষণা এর স্বাক্ষরকারী এ বিষয়ে প্রতিটি বিষয়ে মুসলিম দেশের সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।
———-
১৪ ড. ত্বহা জাবির আলওয়ানী, আলকুরআন ও মহাবিশ্ব অধ্যয়ন: সমন্বিত ধারা, বঙ্গানুবাদ ড. আবদুর রহমান আনওয়ারী, ঢাকা: বি আই আই টি.
১৫ এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দ্র: Dr. Tahe Zabir Alwani, Islamization of knowledge: Past and present.
৪. সাধারণ শিক্ষা জেনারেল এডুকেশন এবং মাদরাসা শিক্ষা এর ধর্মানুসারী মুসলমানদের এক জায়গায় বসে সমন্বিত পাঠ্যক্রম তৈরী করতে হবে।
* লেখকের নিম্ন মতামত:
আমার মতে জ্ঞান ইসলামীকরণে প্রধান কটি পদক্ষেপ নিম্নরূপ:
১। জ্ঞানের উতস বিবেচনা তথা ইন্দ্রিয়জ ও বুদ্ধিভিত্তিক উতসের পাশাপাশি কুরআন ও সুন্নাহকে জ্ঞানের উতস হিসেবে বিবেচনার আবেদন রাখা।
২. জ্ঞানের বিভাজন পুনর্মূল্যায়ন: পাশ্চাত্য সমাজে যেভাবে জ্ঞানের বিভাজন করেছে ধর্ম নিরপেক্ষভাবে, তা বের হয়ে আসতে হবে। এবং মানুষ ও সৃষ্টির সাথে আল্লাহর সম্পর্কে ভিত্তিতে জ্ঞানের বিভাজন করা।
৩. জ্ঞানের নতুনভাবে বিন্যাস করা: অর্থাত তাওহীদের আলোকে জ্ঞানের বিন্যাস করা।
৪. সমন্বয় সাধন করা: অর্থাত ইসলামের মূলনীতি ঠিক রেখে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের উদ্ভাবিত নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য থেকে উপকৃত হওয়ার লক্ষ্যে উভয় ধরণের জ্ঞানের মাঝে যৌক্তিক সমন্বয় সাধন করা।
৫. জ্ঞানের জগতে ইসলাম প্রদত্ত তত্ত্ব ও তথ্য সংযোজন করা।
৬. জ্ঞান বিশ্লেষণ, আহরণ ও বিতরণ পদ্ধতিতে ইসলামী মূল্যবোধ সংযোজন করা তথা ইসলামী চিন্তন পদ্ধতি উন্নয়ন ও অনুসরণ করা।
৭. গোটা বিশ্বে সর্বত্র ইসলামের আবেদন তুলে ধরা।
৮. যথোপযুক্ত গ্রন্থ রচনা ও সমসাময়িক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে উদাহরণ ও উপমার সংযোজন করা।
৯। ইসলামের যে সব তত্ত্ব ও মানব সমাজে প্রচলিত অন্য নামে, তা কুরআন সুন্নাহের আলোকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
১০। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে উদ্ভাবিত নতুন নতুন সমস্যার ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধের আলোকে সমাধানে শুরা ভিত্তিক ইজতিহাদ তথা গবেষণা চালানো।
১১। জ্ঞান ইসলামীকরণ কাজকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রসারিত করা।
উপরি উল্লিখিত আলোচনার পাশাপাশি এ কথাটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, জ্ঞানের ইসলামীকরণের জন্য পূর্বশর্ত হলো ব্যক্তি মানুষটি হবে তাকওয়াবান মুসলমান এবং চাই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা।