মুজাদ্দিদের কাজ কি?
মুসলিম জাতির মুজাদ্দিদগণের কার্যাবলী বিশ্লেষণ করার পূর্বে তাঁরা যে তাজদীদ বা সংস্কারমূলক কার্যাবলী সম্পাদন করেন সে সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা উচিত।
অভিনবত্ব ও সংস্কারের মধ্যে পার্থক্য
সাধারণত অভিনব কাজ ও সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে পার্থক্য করা হয় না এবং প্রত্যেক অভিনব কার্য সম্পাদনকারীকে সংস্কারক বা মুজাদ্দিদ আখ্যা দেয়া হয়। মানুষের ধারণা, যে ব্যক্তি কোন একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে জোরেশোরে তার প্রচলন শুরু করে, সেই মুজাদ্দিদ। বিশেষ করে যেসব লোক মুসলিম জাতির অবনতি প্রত্যক্ষ করে তাদেরকে জাগতিক দিক দিয়ে রক্ষা করার জন্যে প্রচেষ্টা চালায় এবং সমকালীন আধিপত্যশালী জাহেলিয়াতের সং গে আপোষ করে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের একটি অভিনব ‘মিশ্রণ’ তৈরী করে অথবা নিছক মুসলিম নামটি বাকী রেখে সমগ্র জাতিকে পূর্ণরূপে জাহেলীয়াতের রঙে রঞ্জিত করে দেয় তাদেরকে মুজাদ্দিদ আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। অথচ তারা মুজাদ্দিদ নয়, তারা অভিনব কার্য সম্পাদনকারী মুতাজাদ্দিদ। তারা কোনো সংস্কারমূলক কাজ করে না, নতুন কোনো কাজ তাদের দ্বারা সাধিত হয় মাত্র। আর মুজাদ্দিদের কাজ এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। জাহেলিয়াতের সংগে আপোষ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করার নাম সংস্কার নয়। ইসলাম ও জাহেলিয়াতের অভিনব মিশ্রণ তৈরী করাও কোনো সংষ্কারমূলক কাজ নয়। বরং ইসলামকে জাহেলীয়াতের দূষিত পানি থেকে ছেঁকে পৃথক করে নিয়ে কোনো না কোনো পর্যায়ে তাকে তার সত্যিকার নির্ভেজাল আকৃতিতে পুনর্বার অগ্রসর করার প্রচেষ্টা চালানোই মুজাদ্দিদের কাজ। এদিক দিয়ে মুজাদ্দিদ হন জাহেলিয়াতের ব্যাপারে কঠোর আপোষহীন মনোভাবের অধিকারী। জীবনে নগন্যমত অংশেও তিনি জাহেলিয়াতের অস্তিত্বের সমর্থক নন।
মুজাদ্দিদের সংজ্ঞা
মুজাদ্দিদ নবী নন, কিন্তু তাঁর প্রকৃতি নবুয়াতের প্রকৃতির অনেক নিকটতর। মুজাদ্দিদ হন স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী। সত্য উপলব্ধি করার মতো গভীর দৃষ্টি তার সহজাত। সব রকমের বক্রতা দোষমুক্ত সরল বুদ্ধিরবৃত্তিতে তাঁর মনোজগত পরিপূর্ণ। প্রান্তিকতার বিপদমুক্ত হয়ে মধ্যম পন্থা অবলম্বের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করার বিশেষযোগ্যতা তার বৈশিষ্ট। নিজের পরিবেশ এবং শতাব্দীর পুঞ্জীভূত ও প্রতিষ্ঠিত বিদ্বেষমুক্ত হয়ে চিন্তা করার শক্তি, যুগের বিকৃত গতিধারার সংগে যুদ্ধ করার ক্ষমতা ও সাহস, নেতৃত্বের জন্মগত যোগ্যতা এবং ইজতিহাদ ও পুনর্গঠনের অস্বাভাবিক ক্ষমতা মুজাদ্দিদের স্বকীয় বস্তু। এ ছাড়াও ইসলাম সম্পর্কে তিনি হন দ্বিধামুক্ত পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। দৃষ্টিভংগী ও বুদ্ধি-জ্ঞানের দিক দিয়ে তিনি হন পুর্ণ মুসলমান। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর খুঁটিনাটি ব্যাপারে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে পার্থক্য করা এবং অনুসন্ধান চালিয়ে দীর্ঘকালের জটিল আবর্ত থেকে সত্যকে উঠিয়ে নেয়া মুজাদ্দিদের কাজ। এইসব বিশেষ গুণের অধিকারী না হয়ে কোন ব্যক্তি মুজাদ্দিদ হতে পারে না। আর এইসব গুনাবলীই নবীর মধ্যে থাকে, তবে সেখানে থাকে এর চাইতে অনেক বেশী হারে।
মুজাদ্দিদ ও নবীর মধ্যে পার্থক্য
কিন্তু একটি মৌলিক বিষয় মুজাদ্দিদ ও নবীর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। নবী ঐশী নির্দেশে তাঁর পথে নিযুক্ত হন। তিনি নিজের নিয়োগ সম্পর্কে অবগত থাকেন। তাঁর নিকট ‘ওহি’ নাযিল হয়। নবুয়াতের দাবীর মাধ্যমেই তিনি নিজের কাজের সূচনা করেন। তিনি মানুষকে নিজের দিকে আহবান করেন। তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করা বা না করার ওপর মানুষের মুমিন ও কাফের হওয়া নির্ভরশীল। বিপরীত পক্ষে মুজাদ্দিদ এর মধ্যে কোন একটিরও অধিকারী নন। মুজাদ্দিদ যদি নিযুক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে হন প্রাকৃতিক আইনের মাধ্যমে -খোদার নির্দেশে নয়। অনেক সময় নিজের মুজাদ্দিদ হওয়া সম্পর্কেও তিনি অবগত থাকেন না। বরং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবনের কার্যাবলী পর্যালোচনা করে মানুষ তাঁর মুজাদ্দিদ হওয়া সম্পর্কে জানতে পারে। তাঁর ওপর ইলহাম (খোদার পক্ষ থেকে মনের মধ্যে তত্ত্বজ্ঞানের উদ্ভব) হওয়া অপরিহার্য নয়। আর ইলহাম হলেও সে সম্পর্কে যে তিনি অবশ্যি সচেতন থাকবেন, এমন কোন কথাও নেই। তিনি কোন দাবীর মাধ্যমে নিজের কাজের সূচনা করেন না এবং এমন করার অধিকারও তাঁর নেই। কেননা তাঁর উপর ঈমান আনা বা না আনার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর যুগের সবল সৎ উন্নত চরিত্র বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ধীরে ধীরে তাঁর চতুর্দিকে একত্রিত হয়্ কেবল সেই সকল লোক তাঁর থেকে পৃথক থাকে, যাদের প্রকৃত কোনো প্রকার বক্রতা দোষে দুষ্ট। কিন্তু তবুও মুসলমান হওয়া তাঁকে স্বীকার করে নেয়ার শর্ত সাপেক্ষ নয়। ১ এ সমস্ত পার্থক্যসহ মুজাদ্দিদকে মোটামুটিভাবে নবীর পর্যায়ের কাজই করতে হয়।
মুজাদ্দিদের কাজ
মুজাদ্দিদের কাজের নিম্নলিখিত বিভাগসমূহ উল্লেখযোগ্যঃ
১। নিজের পরিবেশের নির্ভূল চিত্রাংকন। অর্থাৎ পরিস্থিতি পূর্ণরূপে পর্যালোচনা করার পর জাহেলিয়াত কোথায় কতটুকুন অনুপ্রবেশ করেছ, কোন পথে তার আগমন হয়েছে, তার শিকড় কোথায় এবং কতদূর বিস্তৃত, ইসলামের অবস্থা বর্তমানে কোন পর্যায়ে এসব সঠিকভাবে বুঝে নেয়া।
২। সংস্কারের পরিকল্পনা প্রণয়ন। অর্থাৎ বর্তমানে কোথায় আঘাত করলে জাহেলিয়াতের বাঁধন টুটে যাবে এবং ইসলাম পুনর্বার সমাজ জীবনের ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ পাবে, তা নির্ধারণ করা।
৩। নিজের সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ। অর্থাৎ নিজে কতটুকুন শক্তির অধিকারী এবং কোন পথে সংস্কার করার শক্ত তাঁর আছে, এ সম্পর্কে নির্ভুল আন্দাজ করা।
(১) অনেকে এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন করেন যে, মুজাদ্দিদগণের মধ্যে কেউ তাঁদের মুজাদ্দিদ হবার দাবী করেছেন। যেমন মুজাদ্দিদে আলফিসানি (রঃ) ও শাহ ওলিউল্লাহ (রঃ) । কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন যে, এই শ্রদ্ধেয় মুজাদ্দিদদ্বয় কেবল নিজেদের এস্থানে অধিষ্ঠিত হবার কথাই প্রকাশ করেছেন। তাঁরা কোন দাবী পেশ করেননি। তাদের কোন কাজ থেকে এ কথা প্রমাণ হয় না যে, তাঁরা মানুষকে নিজেদের দিকে আহবান করেছেন। এবং নিজেদেরকে মুজাদ্দিদ বলে মেনে নেবার দাবী জানিয়েছেন। অথবা তাঁরা এ কথাও বলেননি যে, যে তাদেরকে মুজাদ্দিদ বলে মেনে নেবে, কেবল সেই মুমিন হবে এবং নাজাত লাভ করবে। ৪। চিন্তারাজ্যে বিপ্লব সৃষ্টির প্রচেষ্টা। অর্থাৎ মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তন করা, আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা ও নৈতিক দৃষ্টিভংগীকে ইসলামের ছাঁচে গড়ে তোলা, শিক্ষা ও অনুশীলন ব্যবস্থার সংস্কার করা, ইসলামী শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং সামাগ্রিকভাবে ইসলামী মানসিকতাকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করা।
৫। সক্রিয় সংস্কার প্রচেষ্টা। অর্থাৎ জাহেলী রসম-রেওয়াজসমূহ খতম করে দেয়া, নৈতিক চরিত্র ও বৃত্তিসমূহকে পরিচ্ছন্ন করা, মানুষের মধ্যে পুনর্বার শরিয়তের আনুগত্যের প্রবল প্রেরণা সৃষ্টি করা এবং পূর্ণ ইসলামী নেতৃত্ব দানের মতো লোক তৈরী করা।
৬। দ্বীনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইজতিহাদ করার প্রচেষ্টা। অর্থাৎ দ্বীনের মূলনীতিসমূহ হৃদয়ঙ্গম করা, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সমকালীন তমুদ্দুনিক পরিস্থিতি ও তমুদ্দুনিক উন্নতির নির্ভুল দিক নির্ধারণ করা এবং শরিয়তের মূলনীতির আওতায় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তমুদ্দুনের পুরাতন নকশায় পরিবর্তনের এমন পদ্ধতি নির্ণয় করা যার ফলে শরিয়তের প্রাণবস্তু অবিকৃত থাকে তার উদ্দেশ্যাবলী পূর্ণ হয় এবং তমুদ্দুনের নির্ভুল উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইসলাম দুনিয়াকে নেতৃত্ব দান করতে সক্ষম হয়।
৭। প্রতিরক্ষামূলক প্রচেষ্টা। অর্থাৎ ইসলামকে দাবিয়ে দিতে বা নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করা এবং তার শক্তি নির্মূল করে ইসলামের বিকাশের পথ প্রশস্ত করা।
৮। ইসলামী ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন। অর্থাৎ জাহেলিয়াতের হাত থেকে কর্তৃত্বের চাবিকাঠি ছিনিয়ে নিয়ে পুনর্বার সরকারকে সেই ব্যবস্থার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা, যাকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খিলাফত নামে আখ্যায়িত করেছেন।
৯। বিশ্বজনীন বিপ্লব সৃষ্টি। অর্থাৎ একটি মাত্র দেশে অথবা যে সব দেশে মুসলমান পূর্ব থেকেই আছে কেবল সেখানেই ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেই ক্ষান্ত না হওয়া। বরং এমন একটি শক্তিশালী বিশ্বজনীন আন্দোলন সৃষ্টি করা, যার ফলে ইসলামের সংস্কারমূলক ও বিপ্লব দাওয়াত সাধারণ্যে বিস্তার লাভ করে, ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি সমগ্র দুনিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়, সমগ্র দুনিয়ার তমুদ্দুনিক ব্যবস্থায় এক ইসলামী বিপ্লব সূচিত হয় এবং মানব জাতির নৈতিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ইসলামের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।
এই বিভাগগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, ইসলামী পুনরুজ্জীবনের কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তিদের জন্যে প্রথম বিভাগ তিনটি অপরিহার্য। কিন্তু অবশিষ্ট ছয়টি বিভাগের প্রত্যেকটি মুজাদ্দিদ হবার অপরিহার্য শর্তের মধ্যে গণ্য নয়। বরং এগুলোর মধ্যে থেকে কোন একটি, দুটি, তিনটি, চারটি বিভাগে উল্লেখ্যযোগ্য কার্য সম্পাদন করলে তাঁকে মুজাদ্দিদ গণ্য করা যেতে পারে। তবে এ ধরনের মুজাদ্দিদ আংশিক মুজাদ্দিদ হবেন। পূর্ণ মুজাদ্দিদ কেবল তিনিই হবেন, যিনি উল্লিখিত বিভাগের প্রত্যেকটিতে পূর্ণ কার্য সম্পাদন করে নবুয়াতের উত্তরাধিকারিত্বের হক আদায় করবেন।
কামেল বা আদর্শ মুজাদ্দিদ
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখনো কোনো কামল মুজাদ্দিদের আবির্ভাব ঘটেনি। হযরত উমন ইবনে আবদুল আযীয (রঃ) এ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি সফলকাম হতে পারেননি। তাঁর পর যত মুজাদ্দিদ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকে কোন একটি বিশেষ বিভাগে অথবা একাধিক বিভাগে কাজ করেছেন, কামেল মুজাদ্দিদের স্থান এখনো শূন্য আছে। কিন্তু বিবেক -বুদ্ধি, মানব-প্রকৃতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি এমনি একজন নেতার জন্ম দাবী করে। তিনি এ যুগে অথবা যুগের হাজারো আবর্তনের পর জন্মলাভ করতে পারেন। তাঁরই নাম ইমামুল মেহদী। নবী করিম (সঃ) হাদীসে তারই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। ২
আমি বলতে পারি না সনদের দিক দিয়ে হাদীসটি কোন পর্যায়ের। কিন্তু অর্থের দিক দিয়ে হাদীসটি এ সম্পর্কে বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদীসের সংগে সামঞ্জস্যশীল। এ হাদীসটিতে ইতিহাসের পাঁচটি পর্যায়ের দিকে ইশারা করা হয়েছে। তার মধ্য তিনটি পর্যায় অতিক্রম হয়ে গেছে এবং চতুর্থ পর্যায়টি বর্তমানে চলছে। শেষের যে পঞ্চম পর্যায়টি সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বানী করা হয়েছে, সমস্ত আলামত এ কথা ঘোষণা করেছে যে, মানুসের ইতিহাস দ্রুত সেদিকে অগ্রসর হচ্ছে। মানুষের গড়া সমস্ত মতবাদের পরীক্ষা হয়ে গেছ এবং তা ভীষণভাবে ব্যর্থও হয়েছে। বর্তমানে ক্লান্ত -পরিশ্রান্ত মানুষের ইসলামের দিকে অগ্রসর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
আজকাল অনেকেই অজ্ঞতাবশতঃ এ নামটি শুনেই নাসিকা কুঞ্চন করে থাকেন। তাদের অভিযোগ ভবিষ্যতে আগমনকারী ‘মর্দে কামেল’ এর প্রতীক্ষায় অজ্ঞ-অশিক্ষিত মুসলমানদের কর্মশক্তি জড়ত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। তাই তাদের মতে যে সত্যের ভূল অর্থ গ্রহণ করে অশিক্ষিত লোকেরা নিষ্কর্মা হয়ে যায় তার আদপে সত্য হওয়াই উচিত নয়। উপরন্তু তারা এও বলেন যে, প্রত্যেকটি ধর্মবিশ্বাসী জাতির মধ্যে কোনো না কোনো অদৃশ্যলোক হতে আগমনকারী ব্যক্তি সম্পর্কিত বিশ্বাসের অস্তিত্ব আছে। কাজেই এটি নিছক একটি ভ্রান্ত ধারণা। কিন্তু আমি বুঝিনা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফার (সঃ) ন্যায় অন্যান্য নবীগণও যদি নিজেদের জাতিদেরকে এ সু-সংবাদ দিয়ে গিয়ে থাকেন যে, মানব জাতির পার্থিব জীবন শেষ হবার আগে ইসলাম একবার সমগ্র পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হবে এবং মানুষের রচিত সমস্ত ইজমের ব্যর্থতার পর অবশেষে বিপর্যস্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ খোদার রচিত এই ইজমের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে এবং খোদার এ দার মানুষ এমন এক বিরাট ও মহান নেতার বদৌলতে লাভ করবে, যিনি নবীদের পদ্ধতিতে কাজ করে ইসলামকে তার নির্ভুল আকৃতিতে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করবেন, তাহলে তাতে ভ্রান্ত ধারণার অবকাশ কোথায়? সম্ভবতঃ নবীদের বাণী থেকে পৃথক হয়ে এ বিষয়টি দুনিয়ায় বিভিন্ন জাতির মধ্যে ছড়িযে পড়েছে। এবং অজ্ঞতার কারণে মানুষ তাকে তার আসল ধ্যান ধারণা থেকে বিচ্যুত করে ভ্রান্ত ধারণার আবরণে জড়িয়ে ফেলেছে।
(২) যদিও ভবিষ্যৎ বাণীগুলো মুসলিম, তিরমিযি, ইবনে মাজা, মুসতাদরাক প্রভৃতি কিতাবসমুহের বহুস্থানে উল্লেখিত হয়েছে, তবুও ইমাম শাতবী (র) ‘মাওয়াফিকাত’ কিতাবে এবং মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (র) তাঁর ‘মানসবে ইমামত’ কিতাবে যে হাদীস বর্ণনা করেছেন এখানে তার উল্লেখ লাভজনক হবেঃ
আরবি——————————————————————
“তোমাদের দ্বীনের আরম্ভ নবুয়াত ও রহমতের মাধ্যমের এবং তা তোমাদের মধ্যে থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ চান। অতঃপর মহান আল্লাহ তা উঠিয়ে নেবেন। তারপর নবুয়াতের পদ্ধতিতে খিলাফত পরিচালিত হবে যতদিন আল্লাহ চান। অতঃপর আল্লাহ তাও উঠিয়ে নিবেন”।
তারপর শুরু হবে দৃষ্ট রাজতন্ত্রের জামানা এবং যতদিন আল্লাহ চাইবেন তা প্রতিষ্ঠিত থাকবে, তারপর আল্লাহ তাও উঠিয়ে নিবেন।
অতঃপর জুলুমতন্ত্র শুরু হবে এবং তাও আল্লাহ যতদিন চাইবেন ততদিন থাকবে অতঃপর আল্লাহ তাও উঠিয়ে নেবেন।
অতঃপর আবার নবুয়াতের পদ্ধতিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। নবীর সুন্নত অনুযায়ী তা মানুষের মধ্যে কাজ করে যাবে। এবং ইসলাম পৃথিবীতে তার কদম শক্তিশালী করবে। সে সরকারের ওপর আকাশবাসী ও দুনিয়াবাসী সবাই খুশী থাকবে। আকাশ মুক্ত হৃদয়ে তার বরকত বর্ষণ করবে এবং পৃথিবী তার পেটের সমস্ত গুপ্ত সম্পদ উদগীরণ করে দেবে।
ইমাম মেহদী
মুসলমানদের মধ্যে যারা ইমাম মেহদীর আগমনের ওপর বিশ্বাস রাখেন তারা যথেষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে অবস্থান করছেন এবং তাদের বিভ্রান্তি এর প্রতি অবিশ্বাসী নতুন প্রথা প্রবর্তনকারী মুতাজাদ্দিদের থেকে কেনো অংশে কম নয়। তাঁরা মনে করেন, ইমাম মেহদী পুরাতন যুগের কোনো সুফী ধরনের লোক হবেন। তসবিহ হাতে নিয়ে অকস্মাৎ কোনো মদ্রাসা বা খানকাহ থেকে বের হবেন। বাইরে এসেই ‘আনাল মেহদী’ -আমিই মেহদী বলে চর্তুদিকে ঘোষণা করে দেবেন। ওলামা ও শায়খগণ কিতাব পত্র বগলে দাবিয়ে তাঁর নিকট পৌঁছে যাবেন এবং লিখিত চিহ্ন সমূহের সঙ্গে তাঁর দেহের গঠন প্রকৃতি মিলিয়ে দেখে তাকে চিনে ফেলবেন। অতঃপর বাইয়াত গ্রহণ শুরু হবে এবং জিহাদের এলান করা হবে। সাধনাসিদ্ধ দরবেশ এবং পুরাতন ধরনের গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসীরা তাঁর পতাকাতলে সমবেত হবেন। নেহাত শর্ত পূরণ করার জন্যে নামমাত্র তলোয়ার ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে, নয়তো আসলে বরকত ও আধ্যাত্মিক শক্তি বলেই সব কাজ সমাধা হয়ে যাবে। দোয়া-দরুদ-জেকের-তাসবিহের জোরে যুদ্ধ জয় হবে। যে কাফেরের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হবে সে-ই তড়পাতে তড়পাতে বেহুশ হয়ে যাবে এবং নিছক বদদোয়ার প্রভাবে ট্যাংক ও জংগী বিমানসমূহ ধ্বংস হয়ে যাবে।
মেহদীর আবির্ভাব সম্পর্কে সাধারণ লোকদের মধ্যে অনেকটা এই ধরনের বিশ্বাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু আমি যা অনুধাবন করেছি, তাতে দেখছি ব্যাপার সম্পূর্ণ উল্টো। আমার মতে আগমনকারী ব্যক্তি তার নিজের যুগের একজন সম্পূর্ণ আধুনিক ধরনের নেতা হবেন। সমকালীন সকল জ্ঞানবিজ্ঞানে তিনি হবেন মুজতাহিদের ন্যায় গভীর জ্ঞান সম্পন। জীবনের সকল প্রধান সমস্যাকে তিনি ভালভাবে উপলব্ধি করবেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতার দিক দিয়ে সমগ্র বিশ্বে তিনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত করবেন এবং সকল আধুনিকদের চাইতে বেশী আধুনিক প্রমানিত হবেন। আমার আশংকা হয়, তাঁর নতুনত্বের বিরুদ্ধে মৌলবী ও সুফী সাহেবরাই আগে চিৎকার শুরু করবেন। উপরন্ত আমার মতে সাধারণ মানুষের থেকে তাঁর দৈহিক গঠন ভিন্ন রকমের হবে না এবং নিশানী দেখে তাঁকে চিহ্নিত করাও যাবে না। এবং তিনি নিজের মেহদী হবার কথাও ঘোষণা করবেন না। বরং হয়তো তিনি নিজেও জানবেন না যে, তিনি মেহদী। তাঁর মৃত্যুর পর সম্ভবত তাঁর কার্যাবলী প্রত্যক্ষ করে মানুষ জানবে যে, তিনিই ছিলেন নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠাকারী মেহদী। এতদিন তাঁরই আগমনের সুসংবাদ শুনানো হয়েছিল। ৩
(৩) এ স্থানে যেসব সন্দেহের অবতারণা করা হয়, বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে তার জবাব দেয়া হয়েছে।
ইতিপূর্বে আমি বলেছি যে, দাবীর মাধ্যমে কার্যারম্ভ করার অধিকার নবী ছাড়া আর কারুর নেই এবং নবী ছাড়া আর কেউই নিশ্চিতভাবে জানেন না যে, তিনি কোন খেদমতে নিযুক্ত হয়েছেন। ‘মেহদীবাদ’ দাবী করার জিনিস নয়, কাজ করে দিখিয়ে দিয়ে যাবার জিনিস। এ ধরনের দাবী যারা করেন এবং যারা তাঁর ওপর ঈমান আনেন, আমার মতে, তাঁরা উভয়েই নিজেদের জ্ঞানের স্বল্পতাও নিম্নস্তরের মানসিকতার পরিচয় দেন।
মেহদীর কাজের ধরন সম্পর্কে আমি যতটুকু ধারণা রাখি, তাও এসব লোকের ধারণা থেকে সম্পর্ণ ভিন্নতর। তাঁর কাজের কোনো অংশে কেরামতি অস্বাভাবিকতা, কাশ্ফ, ইলহাম, চিল্লা ও মুজাহাদা-মুরাকাবার কোনো স্থানই আমি দেখি না। আমি মনে করি একজন বিপ্লবী নেতাকে যেভাবে এ দুনিয়ায় দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার পর্যায় অতিক্রম করতে হয়, অনুরূপভাবে মেহদীকেও সেইসব পর্যায় অতিক্রম করতে হবে। তিনি নির্ভেজাল ইসলামের ভিত্তিতে একটি নতুন চিন্তাগত (SchoolofThought) গড়ে তুলবেন। মানুষের চিন্তা ও মানসিকতার পরিবর্তন করবেন। একটি বিপুল শক্তিধর আন্দোলন গড়ে তুলবেন। এ আন্দোলন একই সংগে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উভয়ই হবে। জাহেলিয়াত তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে পিষে ফেলতে চাইবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে জাহেলীয়াতের কর্তৃত্বকে উল্টিয়ে দূরে নিক্ষেপ করবে এবং একটি শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করবে। এ রাষ্ট্রে একদিকে ইসলামের পূর্ণ প্রাণশক্তি কর্মকতৎপর হবে আর অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক উন্নতি চরম পর্যায়ে উপনীত হবে। এ প্রসংগে হাদীসে বলা হয়েছে যে, তার শাসনে আকাশ ও পৃথিবী উভয় স্থানের অধিবাসীরা সন্তুষ্ট হবে। আকাশ বিপুলভাবে তাঁর বরকতসমূহ নাযিল করবে এবং পৃথিবী তার পেটে রক্ষিত সমস্ত সম্পদ উদগীরন করবে।
ইসলাম একদিন সমগ্র দুনিয়ার চিন্তাধারা, তমুদ্দুন ও রাজনীতির ওপর বিপুলভাবে প্রভাব বিস্তার করবে, এ আশা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এমন একজন বিরাট নেতার জন্মলাভ ও নিশ্চিত, যার সর্বব্যাপী ও শক্তিশালী নেতৃত্বে এ বিপ্লব অনুষ্ঠিত হবে। যারা এ ধরনের নেতার আবির্ভাবের কথা শুনে অবাক হন, তাদের বুদ্ধিবৃত্তি দেখে আমি অবাক হই। খোদার এ দুনিয়ায় যদি লেনিন ও হিটলারের মতো মিথ্যাচারী নেতার আবির্ভাব হতে পারে, তাহলে একজন সত্য ও হেদায়েতের ইমামের আবির্ভাবকে সুদূর পরাহত মনে করা হচ্ছে কেন?
নবীদের মিশন
এই সভ্যতা-সংস্কৃতিকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে ধারাবাহিকভাবে নবীগণকে প্রেরণ করা হয়েছিল।
বৈরাগ্যবাদী সভ্যতাকে বাদ দিলে অন্য যে সমস্ত জাহেলিয়াত বা ইসলাম ভিত্তিক সভ্যতা জীবন সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শের ধারক ও দুনিয়ার ব্যবস্থা পরিচালনার জন্যে একটি সর্বব্যাপী পদ্ধতির অধিকারী, তারা স্বভাবতঃ কর্তৃত্ব, ক্ষমতা দখল, শাসন ক্ষমতা স্বহস্তে গ্রহণ এবং নিজের মনের মত করে জীবনের নকশা তৈরী করতে চায়। রাষ্ট্র ক্ষমতা ছাড়াই কোনো বিধান ও মতবাদ পেশ করা অথবা তার ভক্ত হওয়া নিতান্তই অর্থহীন। সংসার বৈরাগী তো দুনিয়ার ব্যবস্থা পরিচালনা করতেও নারাজ। বরং এ এক বিশেষ ধরনের ‘সুলুক’- পদ্ধতির মাধ্যমে সে বাইরে থেকে নিজের কাল্পনিক নাজাতের মঞ্জিলে পৌঁছে যাবার চিন্তায় মগ্ন থাকে। তাই সে রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের প্রয়োজন বোধ করে না এবং তা চায়ও না। কিন্তু যে সভ্যতা দুনিয়ার ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য এক বিশেষ পদ্ধতির দাবীদার এবং এই পদ্ধতির অনুসরণের মধ্যে মানবতার কল্যাণ ও নাজাত মনে করে, তার কর্তৃত্বের চাবিকাঠি হস্তগত করার জন্যে প্রচেষ্টা চালানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। কেননা নিজের নকশাকে কার্যকরী করার শক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তার নকশা বাস্তব জগতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বরং তা মানুষের মনে এবং কাগজের বুকেও বেশীক্ষণ অবস্থান করতে পারে না। যে সভ্যতার হাতে কর্তৃত্ব থাকে, দুনিয়ার সমস্ত কার্যাবলী তারই নক্শা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। সে জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিন্তা, শিল্পও সাহিত্যকে পথ প্রদর্শন করে। সে নৈতিক চরিত্রের কাঠামো তৈরী করে। সে সাধারণ শিক্ষা ও অনুশীলনীর আয়োজন করে। তার বিধানের ভিত্তিতে তমুদ্দুনের সমগ্র ব্যবস্থা গড়ে উঠে। তারই নীতি জীবনের সকল বিভাগে সক্রিয় থাকে। এজন্যে যে সভ্যতার নিজের কোনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নেই, জীবনের কোথাও তার জন্যে একটুও স্থান নেই। এমনকি দীর্ঘকাল বিজয়ী সভ্যতার প্রবল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকাকালে বিজিত সভ্যতাসমূহ কর্মজগত থেকে দূরে সরে পড়ে। তার ব্যাপারে দরদী দৃষ্টিভংগীর অধিকারী ব্যক্তিদের মনেও এ পদ্ধতি দুনিয়ায় চলতে পারে কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। তার তথাকথিত ধারক ও বাহকগণ এবং তার নেতৃত্বের স্বকপোলকল্পিত উত্তরাধিকরীরাও বিরোধী সভ্যতার সংগে আপোস এবং কিছুটি দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে দফারফা করতে উদ্যত হয়। অথচ কর্তৃত্বের প্রশ্ন দুটি নীতিগতভাবে সম্পূর্ন ভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতি এ শরিকানা বরদাশতও করতে পারে না। শরিকানা ও বাটোয়ারা সম্ভব মনে করা স্বল্পবুদ্ধির প্রমাণ এবং একমাত্র ঈমান ও হিম্মতের অভাব হেতু এ ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করা যেতে পারে।
কাজেই ‘হুকুমাতে ইলাহিয়া’ কায়েম করে খোদার তরফ থেকে নবীগণ যে জীবন ব্যবস্থা এনেছিলেন তাকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁদের মিশনের চুড়ান্ত লক্ষ্য। ৪ (৪) বর্তমান যুগে অনেক ধর্মভীরু লোক প্রায়ই বলে থাকেন যে, রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ জীবনের উদ্দেশ্য নয় বরং তা প্রদান করার জন্য ওয়াদা করা হয়েছে। একথা যারা বলেন, তাদের মন-মগজে রাষ্ট্র ক্ষমতা সম্পর্কে নিছক এই ধারণাই কার্যকরী আছে যে, এটি খোদা প্রদত্ত একটি পুরষ্কার। এটি যে, একটি কর্তব্য এবং খেদমত, সে ধারণা তাদের নেই। তাঁরা জানেন না যে, দ্বীনকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে যে, রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রয়োজন তা অর্জন করা খোদার শরিয়তের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং এ জন্যে জিহাদ করা ফরজ।
তাঁরা জাহেলিয়াত পন্থীদেরকে এ অধিকার দিতে প্রস্তুত ছিলেন যে, ইচ্ছা করলে তারা নিজেদের জাহেলী আকিদা-বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। কিন্তু কর্তৃত্বের চাবিকাঠি তাদের হাতে তুলে দেবার এবং মানব জীবনের যাবতীয় বিষয়াবলীকে বলপ্রয়োগে জাহেলীয়াতের আইন-কানুন অনুযায়ী পরিচালিত করার অধিকার তাদেরকে দিতে কোনো দিন প্রস্তুত হয়নি এবং স্বভাবতঃ দিতেও পারতো না। এজন্য প্রত্যেক নবীই রাজনৈতিক বিপ্লব সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। অনেকের প্রচেষ্টা কেবল ক্ষেত্র প্রস্তুত করা পর্যন্তই ছিল -যেমন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। অনেকে কার্যতঃ বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করেছিলেন; কিন্তু হুকুমাতে ইলাহিয়া কায়েম করার আগেই তাঁদের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল; যেমন ঈসা আলাইহিস সালাম। আবার অনেকে এ আন্দোলন সাফল্যের মঞ্জিলে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন-যেমন হযরত ইউসুফ আলায়হি ওয়াসাল্লাম, হযরত মূসা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।
নবীর কাজ
নবীগণের কার্য পর্যালোচনা করলে আমরা মোটামুটি নিম্নলিখিত বিষয়গুলি পাইঃ
১। সাধারণ মানুষের মধ্যে চিন্তার বিপ্লব সৃষ্টি করা। নির্ভেজাল ইসলামী দৃষ্টিভংগী, চিন্তাপদ্ধতি ও নৈতিক বৃত্তি তাদের মধ্যে এমন পরিমাণে সংযোজিত করতে হবে যাতে করে তাদের চিন্তা-পদ্ধতি, জীবনের উদ্দেশ্য, মূল্য ও মর্যাদার মানদণ্ড এবং কাজের ধরন পূর্ণতঃ ইসলামের ছাঁচে ঢালাই হয়ে যায়।
২। এ শিক্ষায় প্রভাবিত লোকদের একটি শক্তিশালী দল গঠন করে জাহেলিয়াতের হাত থেকে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে প্রচেষ্টা চালানো। এবং এই প্রচেষ্টায় সমকালীন তমুদ্দুনের যাবতীয় উপায়-উপকরণের আশ্রয় গ্রহণ করা।
৩। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করে তমুদ্দুনের সমস্ত বিভাগকে নির্ভেজাল ইসলামের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করা। এই জন্যে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা, যার ফলে একদিকে ইসলামী বিপ্লবের সীমানা বিশ্বের বুকে ব্যাপকতর হতে থাকবে এবং অন্যদিকে প্রচার ও বংশ-বৃদ্ধির মাধ্যমে ইসলামী জামায়াতে যেসব নতুন সদস্য ভর্তি হতে থাকবে, ইসলামী পদ্ধতিতে তারা মানসিক ও নৈতিক শিক্ষালাভ করতে থাকবে।
খেলাফতে রাশেদা
শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তেইশ বছরের মধ্যে এ সমস্ত কার্য পূর্ণরূপে সম্পাদন করেন। তাঁর পর আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) ও ওমর ফারুক (রাঃ) এর ন্যায় দুজন আদর্শ নেতার নেতৃত্বলাভের সৌভাগ্য ইসলামের হয়। তাঁরা রাসুলুল্লাহর ন্যায় এ সর্বব্যাপী কাজের সিলসিলা জারি রাখেন। অতঃপর হযরত উসমান (রাঃ) -এর হাতে কর্তৃত্ব আসে এবং প্রথম প্রথম কয়েক বছর রাসূলুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি পূর্ণরূপে জারি থাকে।
জাহেলিয়াতের আক্রমন
কিন্তু একদিকে ইসলামী রাষ্ট্রর দ্রুত বিস্তারের কারণে কাজ প্রতিদিন অধিকতর কঠিন হতে যাচ্ছিল এবং অন্যদিকে হযরত উসমান (রাঃ) যাঁর ওপর এ বিরাট কাজের বোঝা রক্ষিত হয়েছিল, তিনি তাঁর মহান পূর্বসুরীদেরকে প্রদত্ত যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন না। ৫ (৫) কতিপয় মুফতি সাহেবান এ বাক্যটিকে হযরত উসমানের (রাঃ) প্রতি অমর্যাদাকর বলে চিহ্নিত করেছেন। অথচ আমার বক্তব্য শুধু এতটুকুন যে, হযরত উসমানের (রাঃ) মধ্যে শাসন পরিচালনার এমন কতিপয় গুণাবলী অভাব ছিল, যা হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) ও হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় ছিল। এটি ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় এবং ইতিহাসের ছাত্ররা এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারেন। এটি ফিকাহ ও কালামের বিষয়বস্তু নয়। কাজেই ফতোয়া প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ফতোয়ার আকারে এ সম্পর্কে কোনো রায় প্রকাশ করা যেতে পারে না। তাই তাঁর খিলাফত আমলে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে জাহেলিয়াত সমাজ ব্যবস্থা অনুপ্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে। হযরত উসমান (রাঃ) নিজের শির দান করে এই বিপদের পথরোধ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তা রুদ্ধ হয়নি। অতঃপর হযরত আলী (রাঃ) অগ্রসর হন। তিনি ইসলামের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে জাহেলিয়াতের পাঞ্জা থেকে উদ্ধার করার জন্যে চরম প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু তিনি জীবন দান করেও এই প্রতিবিপ্লবের পথ রোধ করতে পারেন নি। অবশেষে নবুয়্যাতের পদ্ধতির পরিচালিত খিলাফতের জামানা শেষ হয়ে যায়। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র তার স্থান দখল করে। এভাবে রাষ্ট্রের বুনিয়াদ ইসলামের পরিবর্তে আবার জাহেলিয়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর জাহেলিয়াত ক্যানসার ব্যাধির ন্যায় ধীরে ধীরে সমাজদেহে তার বাহু বিস্তার করতে থাকে। কেননা কর্তৃত্বের চাবিকাঠি এখন ইসলামের পরিবর্তে তার হাতে ছিল এবং রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হবার পর তার প্রভাবের অগ্রগতি রোধ করার ক্ষমতা ইসলামের ছিলনা। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এইযে, জাহেলিয়াত উলঙ্গ ও আবরণ মত্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি, বরং মুসলমান-এর রূপ ধারণ করে এসেছিল। প্রকাশ্য নাস্তিক, মুশরিক বা কাফেরের মুখোমুখি হলে হয়তো মোকাবিল করা সহজ হতো। কিন্তু সেখানে প্রথমেই ছিল তৌহিদের স্বীকৃতি, রিসালাতের স্বীকৃতি, নামায ও রোযা সম্পাদন এবং কোরআন ও হাদীস থেকে যুক্তিপ্রমাণ গ্রহণ আর তার পেছনে জাহেলিয়াতের নিজের কাজ করে যাচ্ছিল। একই বন্তুর মধ্যে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সমাবেশ এমন কঠিন জটিলতা সৃষ্টি করে যে, তার সঙ্গে মোকাবিলা করা হামেশা জাহেলিয়াতের সঙ্গে মোকাবিলা করার চাইতে বেশী কঠিন প্রমানিত হয়েছে। উলঙ্গ জাহেলিয়াতের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে লক্ষ লক্ষ মুজাহেদীন মাথায় কাফন বেঁধে সহযোগিতা করতে অগ্রসর হবে এবং কোনো মুসলমান প্রকাশ্যে জাহেলিয়াতকে সমর্থন করতে পারবে না। কিন্তু এই মিশ্রিত জাহেলিয়াতের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে শুধু মুনাফিকরাই নয়, অনেক খাঁটি মুসলামনও তার সমর্থনে কোমর বেঁধে অগ্রসর হবে এবং শুধু তাই নয়, বরং ঐ জাহেলিয়াতের সংগে যুদ্ধকারীকে উল্টো দোষারোপ করা হবে। জাহেলী নেতৃত্বের সিংহাসনে এবং জাহেলি রাজনীতির মসনদে মুসলমানের সামসীন হওয়া, জাহেলী শিক্ষায়তনে মুসলমানের শিক্ষকতা করা এবং জাহেলিয়াতের আসনে মুসলমানের মুর্শেদ হিসেবে উপবেশন করা এক বিরাট প্রতারণা বৈ কিছুই নয়। এবং খুব কম লোক এই প্রতারণা থেকে বাঁচতে পারে।
এই প্রতিবিপ্লবের সবচাইতে ভয়াবহ দিক এই যে, ইসলামের আবরণে তিন ধরনের জাহেলিয়াতই তাদের শিকড় গাড়তে শুরু করে এবং তাদের প্রভাব প্রতিদিন অধিকতর বিস্তার লাভ করতে থাকে। নির্ভেজাল জাহেলিয়াত রাষ্ট্র ও সম্পদ করায়ত্ত করে। নামে খিলাফত কিন্তু আসলে ছিল সেই রাজতন্ত্র যাকে খতম করার জন্যে ইসলামের আগমন হয়েছিল।
বাদশাহকে ‘ইলাহ’ বলার হিম্মত কারুর ছিল না, তাই ‘আস–সুলতানু যিল্লুল্লাহ’৬-এর তালাশ করা হয়। এই বাহানায় ইলাহ যে আনুগত্য লাভের অধিকারী হন বাদশাহরাও তার অধিকার লাভ করে। এই রাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় আমির-ওমরাহ, শাসকবর্গ, গভর্ণরবৃন্দ, সেনাবাহিনী ও সমাজের কর্তৃত্বশালী লোকদের জীবনে কম-বেশী নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের দৃষ্টিভংগী বিস্তার লাভ করে। এই দৃষ্টিভংগী তাদের নৈতিক বৃত্তি ও সামাজিকতাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়। অতঃপর সস্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবেই এই সংগে জাহেলিয়াতের দর্শন, সাহিত্য এবং শিল্পও বিস্তার লাভ করতে থাকে। এবং বিভিন্ন বিদ্যা ও শাস্ত্রও এই পদ্ধতিতে সংকলিত ও রচিত হতে থাকে। কেননা এসব জিনিস অর্থও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভরশীল। আর যেখানে অর্থ ও রাষ্ট্র জাহেলিয়াতের আয়ত্তাধীন সেখানে তাদের ওপরও জাহেলিয়াতের কর্তৃত্ব অনিবার্য। কাজেই এ কারণেই গ্রীক অনারব দর্শন বিদ্যা ও সাহিত্য ইসলামের সংগে সংযুক্ত বলে কথিত সমাজের মধ্যে অনুপ্রবেশ করার পথ খুঁজে পায়। এ সাহিত্যের প্রভাবে মুসলমানদের মধ্যে ‘কালাম’ শাস্ত্রের বিতর্ক শুরু হয়, মোতাজিলা মতবাদের উদ্ভব হয়, নাস্তিকতা ও ধর্ম বিরোধিতা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে থাকে এবং ‘আকিদার’ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ নতুন নতুন ‘ফেরকা’ -সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়। এখানেই শেষ নয় বরং যে সমস্ত জাতিকে ইসলাম নৃত্য, গীত ও চিত্রাংকনের ন্যায় নির্ভেজাল জাহেলী শিল্প-সংস্কৃতির হাত থেকে উদ্ধার করেছিল তাদের মধ্যে এগুলো আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ৭
(৬) হাদীসে এ শব্দটির উল্লেখ আছে, এতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এর সম্পর্ণ ভুল অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। আরবী ভাষায় সুলতানের আসল অর্থ হলো কর্তৃত্ব। কর্তৃত্বশালীর জন্যে এ শব্দটি নিছক কৃত্রিম অর্থে ব্যবহৃত হয়। নবী (স) এ শব্দটিকে কৃত্রিম অর্থে নয় বরং তার আসল অর্থে ব্যবহার করেছেন। নবী করিমের (স) ইরশাদের অর্থ হলো এই যে, রাষ্ট্র ও কর্তৃত্ব আসলে আল্লাহ তাআলার কর্তৃত্বের প্রতিচ্ছায়া মাত্র। যে ব্যক্তির ওপর এ প্রতিচ্ছায়া পড়বে, সে যদি তার সম্মান বহাল রাখে অর্থাৎ হক ও ইনসাফ অনুযায়ী রাষ্ট্র চালায় তাহলে আল্লাহতাআলা সম্মান দান করবেন। আর যে ব্যক্তি খোদার এই ছায়াকে অপমান করবে অর্থাৎ জুলুম ও স্বার্থবাদিতার সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করবেন। নবী করিমের এই জ্ঞানপূর্ণ বাণীকে বিকৃত করে লোকেরা বাদশাহকে খোদার প্রতিচ্ছায়া গণ্য করেছে এবং নবী করিমের (স) উদ্দেশ্যের প্রতিকূলে এটিকে বাদশাহ পূজার বুনায়াদে পরিণত করেছে। (৭) মাওলানা শিবলী নোমানী ও জাস্টিস আমির আলীর মতো লোকেরা ঐ সব বাদশাহন এহেন কার্যাবলীকে ইসলামী তাহজীব ও তমুদ্দুনের খেদমত বলে গণ্য করেছেন। শের্ক মিশ্রিত জাহেলিয়াত জনগণের ওপর হামলা করে তাদেরকে তৌহিদের পথ থেকে সরিয়ে গোমরাহির অসংখ্য পথে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। একমাত্র সুস্পষ্ট মূর্তিপূজা অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি, নয়তো এমন কোনো ধরনের শের্ক ছিল না, যা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত হয়নি। পুরাতন জাহেলী মতবাদে বিশ্বাসি জাতিসমূহে যে সমস্ত লোক ইসলামের আওতায় প্রবেশ করে, তারা অনেকে শের্কের ধারণা ও মতবাদ নিজেদের সংগে করে নিয়ে আসে। এখানে তাদেরকে শুধু এতটুকুন কষ্ট করতে হয় যে, পুরাতন মাবুদগণের স্থলে তাদেরকে মুসলীম মনীষীদের মধ্যে থেকে কতিপয় নতুন মাবুদ তালাশ করতে হয়, পুরাতন মঠ -মন্দিরের স্থলে আউলিয়া -দরবেশগণের সমাধির ওপর সন্তুষ্ট থাকতে হয় এবং ইবাদতের পুরাতান আচার-অনুষ্ঠানের স্থলে নতুন আচার-অনুষ্ঠান উদ্ভাবন করতে হয়। এ কাজে দুনিয়াদার আলেম সমাজ তাদেরকে বিপুলভাবে সাহায্য করে এবং শের্ককে ইসলামের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করার পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতো তার দূর করে দেয়। তারা অত্যন্ত দুঃসাহসিকতার সংগে কোরআনের আয়াত ও হাদিসের বাণী বিকৃত করে ইসলামে আউলিয়া পূজা ও কবর পূজার জন্যে স্থান সংকুলান করে। শের্কের কাজ করার জন্যে ইসলামের পরিভাষা থেকে শব্দ সংগ্রহ করে এই নতুন শরিয়তের জন্যে আচার-অনুষ্ঠানের এমন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে যে, তা সুস্পষ্ট ও বড় শের্কের আওতায় পড়ে না। এই সূক্ষা শিল্পীসুলভ সাহায্য ছাড়া ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করার পথ আবিষ্কার করা শের্কের পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব হতো না।
বৈরাগ্যবাদী জাহেলিয়াত ওলামা, মাশায়েখ, সুফী ও পরহেজগার লোকদের ওপর হামলা করে এবং তাদের মধ্যে সেইসব ত্রুটি বিস্তার করতে থাকে, যেগুলোর দিকে আমি ইতিপুর্বে ইশারা করেছি। এই জাহেলিয়াতের প্রভাবে মুসলিম সমাজে প্লেটোবাদী দর্শন, বৈরাগ্যবাদী চারিত্রিক আদর্শ এবং জীবনের প্রতিক্ষেত্রে নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভংগী প্রসার লাভ করে। এই জীবন দর্শনটি শুধু সাহিত্য ও জ্ঞান সাধানাকেই প্রভাবিত করেনি বরং প্রকৃতপক্ষে সমাজের সৎ লোকদেরকে মরফিয়া ইনজেকশান দিয়ে স্থবিরত্বে পৌঁছিয়ে দিয়েছে, রাজতন্ত্রের জাহেলী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে, ইসলামী জ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে জড়তা ও সংকীর্ণ চিন্তার উদ্ভব ঘটিয়েছে এবং সমগ্র দ্বীনদারীকে কতিপয় বিশেষ ধর্ম-কর্মের সীমাবদ্ধ করেছে।
মুজাদ্দিদের প্রয়োজন
এই তিন ধরনের জাহেলিয়াতের ভীড় থেকে ইসলামকে উদ্ধার করে পুনরায় তাকে সবল ও সতেজ করার জন্যে মুজাদ্দিদগণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ থেকে এ ধারণা করা ঠিক নয় যে, জাহেলিয়াতের এই সয়লাবে ইসলাম একেবারেই ভেসে গিয়েছিল এবং জাহেলিয়াত পুর্ণতঃ বিজয়লাভ করেছিল। সত্যি বলতে কি, যেসব জাতি ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল অথবা পরে প্রভাবিত হয়, তাদের জীবনে ইসলামের সংষ্কারমূলক প্রভাব কম-বেশী চিরকাল বর্তমান থাকে। ইসলামের প্রভাবেই বড় বড় স্বৈরাচারী ও দায়িত্বহীন বাদশাহরা কখনো কখনো ভয়ে কেঁপে উঠতো এবং সততা ও ন্যায়ের পথ অবলম্বন করতো। ইসলামের গুনেই রাজতন্ত্রের অন্ধকারময় ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে আমরা নেকী ও নৈতিক সততার প্রোজ্জ্বল শিখা প্রত্যক্ষ করি। যেসব শাহী খান্দান নিজেরকে খোদার ন্যায় পরাক্রমশীলী মনে করতো তাদের মধ্যে একমাত্র ইসলামেরই কারণে অনেক দ্বীনদার খোদাভীরু এবং ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিত্বের উদ্ভব হয় তাঁরা রাজশক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যথাসম্ভব দায়িত্বের সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। এমনি ভাবে শাহী দরবারে দর্শন ও বিজ্ঞানের শিক্ষায়তনে ব্যবসায় ও শিল্পের কৃমস্থলে, চিত্তশুদ্ধি ও সংসার বিরাগীর খানকায় এবং জীবনের অন্যান্য বিভাগেও ইসলাম অনবরত কমবেশী নিজের পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে। জনগনের মধ্যে শের্ক মিশ্রিত জাহেলিয়াতের অনুপ্রবেশ সত্ত্বেও ইসলাম হামেশা আকিদা-বিশ্বাস, নৈতিক-চরিত্র ও সামাজিকতার মধ্যে সংস্কারমূলক ও প্রতিরোধমূলক উভয় দিক দিয়ে নিজের অনুপ্রবেশ জারি রাখে, যার ফলে মুসলিম জাতির চারিত্রিক দান মোটামোটি অমুসলিম জাতিসমূহের থেকে হামেসা উন্নত থাকে। এছাড়া প্রতি যুগে এমন লোক ও সবসময় ছিল, যারা দৃঢ়তার সাথে ইসলামী নীতি অনুসরণ করে এবং ইসলামি জ্ঞান ও কর্মেকে নিজের জীবনে এবং নিজের সীমিত পরিবেশে জীবিত রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু নবী প্ররণের যে আসল উদ্দেশ্য ছিল তার জন্যে এ দুটো জিনিস অকিঞ্চিত ছিল। জাহেলীয়াতের হাতেই কর্তৃত্ব থাকবে এবং ইসলাম নিছক একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর শক্তি হিসেবে কাজ করবে, এ যেমন যথেষ্ট ছিল না তেমনি এও যথেষ্ট ছিলনা যে, এখানে ওখানে দুচারটি লোকেরা সীমিত জীবন ক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত থাকেবে আর বৃহত্তর সমাজ জীবনে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মিশ্রিত উপাদান প্রসার লাভ করতে থাকবে। কাজেই প্রতিযুগে দ্বীন এমন শক্তিশালী ব্যক্তি, দল ও প্রতিষ্ঠানের মুখাপোক্ষী ছিল এবং আজো আছে, যারা বিপথে পরিচালিত জীবনধারা পরিবর্তন করে তাকে পুনর্বার ইসলামের পথে অগ্রসর করতে সক্ষম।
‘মাই ইউজাদ্দিদুলাহা দীনাহা’ হাদীসটির ব্যাখা
নবী করিম (সঃ) তাঁর একটি হাদীসে এরই খবর দিয়েছেন। হাদীসটি আবু -দাউদে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটি হলোঃ
————————————————–
‘প্রত্যেক শতকের শিরোভাগে আল্লাহতায়াআলা এই উম্মতের জন্যে এমন লোক সৃষ্টি করবেন যিনি তার জন্যে তার দ্বীনকে সবল ও সতেজ করবেন’।
কিন্তু এ হাদীস থেকে অনেক লোক তাজদীদ ও মুজাদ্দেদীন সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভূল ধারণা গ্রহণ করেছেন। তাঁরা ‘আলা রাসে কুল্লি মেয়াতিন’ প্রতি শতকের শিরোভাগে-থেকে এই অর্থ নিয়েছেন যে, প্রতি শতকের শুরুতে বা শেষভাগে আর ‘মাই ইউজাদ্দিদুলাহা দ্বীনাহা’ যিনি তাঁর জন্যে তার দ্বীনকে সবল ও সতেজ করবেন-থেকে এই অর্থ নিয়েছেন যে, এ কাজ নিশ্চয়ই এক ব্যক্তিই করবে। তাই তারা ইসলামের অতীত ইতিহাসে প্রতি শতকের শুরুতে বা শেষভাগ জন্মগ্রহণ করেছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন এবং দ্বীনের সংস্কারের কাজও করেছেন এমন লোকদের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। অথচ ‘রাস’ এর অর্থ শুরু বা শেষ ভাগ নয়। প্রত্যেক শতকের শিরোভাগে কোনো ব্যক্তি বা দলকে প্রেরণকরার পরিষ্কার অর্থহলো এই যে, তারা সমকালীন জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিন্তা, ও কর্মের গতিধারার ওপর সুস্পষ্ট প্রভাব বিস্তার করবেন। আর ‘মান’ শব্দটি আরবী ভাষায় একবচন ও বহুবচন উভয়ের জন্যে ব্যবহৃত হয়। তাই মান অর্থ এক ব্যক্তিও হতে পারে এবং বহু ব্যক্তিও হতে পারে, আবার সমগ্র প্রতিষ্ঠানও হতে পারে। নবী করিম (সঃ) যে খবর দিয়েছেন তার সুষ্পষ্ট অর্থ হলো এই যে, ইনশাআল্লাহ ইসলামী ইতিহাসের কোনো এক শতাব্দীও এমন লোকদের থেকে বঞ্চিত থাকবেনা যারা জাহেলীয়াতের তুফানের মোকাবিলা করবেন এবং ইসলামকে তার আসল প্রাণশক্তি ও আকৃতিতে পুনর্বার প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে প্রচেষ্ঠা চালাবেন। এক শতাব্দীতে যে শুধু একজন মুজাদ্দিদ হবেন এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এক শতাব্দীতে একাধিক ব্যক্তি ও দল এ কার্য সম্পাদন করতে পারেন। সমগ্র মুসলিম জাহানের জন্যে যে শুধু একজন মুজাদ্দিদ হবেন এরও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। একই সময়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ব্যক্তি দ্বীনের তাজদীদের জন্যে প্রচেষ্টা চালাতে পারেন। এ প্রসংগে যে ব্যক্তি কোনো কার্য সম্পাদন করবেন তাকেই যে, মুজাদ্দিদ উপাধি দান করা হবে, এমনও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এ উপাধি একমাত্র তাদেরকেই দান করা যেতে পারে, যাঁরা দ্বীনের তাজদীদের জন্যে কোনো বিরাট ও বিশিষ্ট কার্য সম্পাদন করেন।
মুসলিম জাতির কতিপয় বড় বড় মুজাদ্দিদ ও তাঁদের কার্যাবলী
ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন করে আমি ভবিষ্যতের প্রধান মুজাদ্দিদের উল্লেখ পূর্বাহ্নেই করলাম। এর কারণ হলো এই যে, মানুষ কামেল মুজাদ্দিদের মর্যাদা ও স্থান সম্পর্কে আগেই ওয়াকিফহাল হয়ে যাবে। এতে করে তাদের জন্যে প্রত্যাশিত পূর্ণতার মোকাবিলায় আংশিক সংস্কারমূলক কার্যাবলীর মর্যাদা ও স্থান উপলব্ধি করা সহজ হবে। এ পর্যন্ত যতগুলো সংস্কারমুলক কার্যাবলী সম্পাদিত হয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র এবার আমি তুলে ধরবো।
উমর ইবেন আবদুল আযীয
ইসলামের প্রথম মুজাদ্দিদ হলেন হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) । ৮রাজ পরিবারে তাঁর জন্ম। বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে দেখেন পিতা মিসরের ন্যায় বিরাট দেশের গবর্ণর। আরো বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে নিজেও উমাইয়া সরকারের অধীনের গবর্ণন পদে নিযুক্ত হন। বনু উমাইয়া বংশীয় বাদশাহগন যে সমস্ত জায়গীরের সাহায্যে নিজেদের খান্দানকে বিপুল ধনশালী করেন, তাতে তাঁর এবং তাঁর পরিবার পরিজনেরও বিরাট অংশ ছিল। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির আয় ছিল বার্ষিক ৫০ হাজার আশরাফি। বিত্তশালীর ন্যায় শান শওকতের সংগে জীবন যাপন করতেন। পোশাক-পরিচ্ছেদ, খানা পিনা, বাড়িঘর, যান-বাহন স্বভাব-চরিত্র, সবই ছিল শাহজাদার ন্যায়। এই পরিপ্রক্ষিতে পরবর্তিকালে তিনি যে কার্য সম্পাদন করেন, তার সংগে তাঁর পরিবেশের কোনো দূরতম সম্পর্কও ছিল না। কিন্তু তাঁর মাতা ছিলেন হযরত উমরের (রা) পৌত্রী। (৮) তিনি ৬১হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। এবং ১০১ হিজরীতে ইন্তাকাল করেন। নবী করীমের (স) ওফাতের ৫০ বছর পর তাঁর জন্ম হয়। তাঁর যুগে অগণিত সাহাবা ও তাবেঈন জীবিত ছিলেন। শুরুতে তিনি হাদীস ও ফিকাহর পূর্ণ শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এমনকি তিনি প্রথম শ্রেণীর মুজাদ্দিদের মধ্যে গণ্য হতেন এবং ফিকাহ শাস্ত্র ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখতেন্ কাজেই নবী করীম (স) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে তমুদ্দুনের বুনিয়াদ কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং খেলাফত রাজতন্ত্র পরিবর্তিত হবার পর এ বুনিয়াদ সুমুহে কোন ধরণের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তত্ত্বগত দিক দিয়ে একথা জানা ও উপলব্ধি করা তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন ছিলনা। অবশ্য কার্যতঃ যে জিনিসটি তাঁর পথের প্রতিবন্ধক হতে পারতো, তা হলো এই যে, তাঁর নিজেরই খান্দান ছিল এই জাহেলী বিপ্লবের স্রষ্টা। এই বিপ্লব থেকে পূর্ণতঃ ও বিপুলভাবে লাভবান হচ্চিল তাঁর পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, তিনি নিজে এবং তাঁর সন্তান-সন্ততি। তাঁর বংশগত স্বার্থ, ব্যক্তিগত লালসা এবং ভবিষ্যত বংশধরদের পার্থিব মঙ্গলের জন্যে তাকেও নিজের রাজতখতে ফেরাউনের ন্যায় জেঁকে বসা উচিত ছিল। নিজের বিদ্যা-বুদ্ধির, জ্ঞান, ও বিবেককে নিরেট বস্তুগত লাভের মোকাবিলায় কোরবান করে দিয়ে হক, ইনসাফ, নৈতিকতা ও নীতিবাদিতার গোলক ধাঁধাঁয় পদার্পণ না করাই তার জন্যে বেহতের ছিল। কিন্তু৩৭ বছর বয়সে নিহাত ঘটনাক্রমে যখন তিনি রাজতখতের অধিকারী হন এবং অনুভব করতে পারেন যে, কি বিপুল-বিরাট দায়িত্ব তাঁর কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তখন আচানক তাঁর জীবনের ধারা পাল্টে যায়। বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃনা করাই তিনি জাহেলিয়াতের মোকাবিলায় নিজের জন্যে ইসলামের পথ বেছে নেন। যেন এটি তাঁর পূর্বাস্থিরিকৃত সিদ্ধান্ত ছিল।
বংশানুক্রমিক পদ্ধতিতে তিনি রাজতখতের মালিক হন। কিন্তু বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করার সময় জনসমাবেশে তিনি পরিষ্কার বললেনঃ আমি তোমাদেরকে নিজের বাইয়াত থেকে আজাদ করে দিচ্ছি, তোমরা নিজেদের ইচ্ছামতো কাউকে খলিফা নির্বাচন করতে পারো। অতঃপর জনসাধারণ যখন সর্বসম্মতভাবে এবং সাগ্রহে বললো যে, আমরা আপনাকেই নির্বাচন করছি, তখনই তিনি স্বহস্তে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
অতঃপর রাজকীয় জাঁজমক, ফেরাউনের শাসন পদ্ধতি, কাইসার ও কিসরার দারবারী নিয়ম-নীতি সবই বিদায় করে দেন। এবং প্রথম দিনেই রাজযোগ্য সবকিছুই পরিত্যাগ করে মুসলমাদের মধ্যে তাদের খলিফার যোগ্য পদ্ধতি গ্রহণ করেন।
অতঃপর রাজবংশের লোকেরা যেসব বৈশিষ্টের অধিকারী ছিলেন, সেদিকে তিনি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। তাদেরকে সবদিক দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের সমপর্যয়ে নামিয়ে আনের তাঁর নিজের জায়গীর সহ অন্যান্য যেসব জায়গীর রাজবংশের দখলে ছিল সবগুলিই বায়তুলমালে ফিরিয়ে দেন। এ পরিবর্তনের ফলে তাঁর নিজের যে, ক্ষতি হয় সে সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষট যে, তার বার্ষিক আয় পঞ্চাশ হাজারের পরিবর্তে মাত্র দুশো আশরফিতে নেমে আসে। বায়তুলমালের অর্থকে তিনি নিজের এবং নিজের খান্দানের জন্যে হারাম করে দেন। এমনকি খলিফা হিসেবে বেতনও গ্রহণ করেননি। নিজের জীবনের সমগ্র রূপটিই বদলিয়ে দেন। খলিফা হবার আগে রাজোচিত শান-শওকতের সংগে জীবন যাপন আর খলিফা হবার সংগে সংগেই ফকিরি জীবন অবলম্বন ৯, অবশ্যই বিস্ময়ের ব্যাপার।
স্বগৃহ ও পরিজনদের সংশোধনের পর তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে নজর দেন। অত্যাচারী গভর্ণরদেকে বরখাস্ত করেন। এবং গভর্ণরদের দায়িত্ব সম্পাদন করার জন্যে সৎলোকদের অনুসন্ধান করে বের করেন। সরকারের প্রশাসনিক র্কমচারিবৃন্দের নিয়মকানুন মুক্ত হয়ে প্রজাদের জান মাল, ইজ্জত-আবরুর ওপর অনাধিকার হন্তক্ষেপ করার অধিকারী হয়ে বসেছিল। তিনি তাদেরকে পুনর্বার আইন-শৃংখলার অনুগত করেন এবং আইনের রাজত্ব কায়েম করেন। কর নির্ধারণের সমগ্র নীতি-নিয়মই পরিবর্তিত করেন। এবং আবগারীসহ বনি উমাইয়া বাদশাহগন যে সমস্ত অবৈধ ও অন্যান্য কর বসিয়েছিলেন সেগুলোকে সংগে সংগেই বাতিল করে দেন। জাকাত আদায়ের জন্যে যে ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তা নতুনভাবে সংশোধন করেন এবং বাইতুল মালের অর্থকে পুনর্বার সাধারণ মুসলামনদের কল্যাণের জন্যে ওয়াকফ করে দেন। অমুসলিম প্রজাদের সাথে যেব অন্যায় আচরণ করা হয়েছিল সংগে সংগেই তার প্রতিকার করেন। তাঁদের যেসব উপাসনালয় অন্যায় ভাবে দখল করা হয়েছিল সেগুলো তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। (৯) জীবনীকাররা বলেন যে, খলিফা হবার আগে হাজার দিরহাম মূল্যের পোশাক উমর ইবেন আবদুল আযীযের পছন্দ হতো না, কিন্তু খলিফা হবার পর চাঁর-পাঁচ দিরহামের মূল্যের পোশাকও নিজের জন্যে বড়ই মূল্যবান মনে করতেন। তাদের যেসব জমি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল, তা তাদেরকে ফেরত দেন। শরীয়তের দৃষ্টিতে তাদের প্রাপ্য যাবতীয় অধিকার পুনর্বার তাদেরকে প্রদান করেন। বিচার বিভাগকে সরকরের শাসন বিভাগের অধীনতা মুক্ত করেন। এবং মাণুষের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার নিয়ম ও স্পিরিট উভয়কেই সরকারী ব্যবস্থার প্রভাবমুক্ত করে ইসলামী নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন। এভাবে হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের হাতে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবন লাভ করে।
অতঃপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সাহায্যে তিনি অর্ধ শতাব্দীকালের জহেলী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারণে সমাজ জীবনের চতুর্দিকে বিস্তার লাভকারী জাহেলীয়াতের নিদর্শন সমূহকে জনগণের মানসিক নৈতিক ও সমাজ জীবন থেকে নির্মূল করতে উদ্যেগী হন। বিকৃত আকিদা-বিশ্বাসের প্রচার ও প্রসার বন্ধ করে দেন। ব্যাপকভাবে জনশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। কোরআন, হাদীস ও ফিকাহর শিক্ষার দিকে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর দৃষ্টি পুনর্বার আকৃষ্ট করেন এবং এমন একটি তত্ত্বগত আন্দোলন গড়ে তুলেন যার প্রভাবে ইসলামে আবু হানিফা (র) , মালিস (র) , শাফেয়ী (র) ও আহমদ ইবনে হাম্বলের (র) ন্যায় মুজতাহিদগণের আবির্ভাব হয়। শরীয়তের আনুগত্য করার প্রেরণা মানুষের মধ্যে নতুন করে সঞ্জীবিত করেন। রাজতন্ত্রের বদৌলতে সৃষ্ট শরাব পান, চিত্রাংকন ও বিলাসিতার ব্যাধি নির্মূল করেন। এবং যে সব উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্যে ইসলাম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, মোটামুটি তিনি সেগুলো পূর্ণ করেন অর্থাৎ
———————————————————-
অতি অল্প সময়ের মধ্যে জনজীবন এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর এই সরকার পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করে। জনৈক বর্ণনাকারী বলেন, ওলিদের আমলে লোকেরা তাদের আলাপ-আলোচনায় বৈঠকে অট্রালিকা ও উদ্যান সম্পর্কে আলোচনা করতো। সোলায়মান ইবনে আবদুল মালিকের জামানায় ইন্দ্রিয় লিপ্সার দিকে জনগণ আকৃষ্ট হয়। কিন্তু ওমর ইবনে আবদুল আযীয খলিফা হাবার পর এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, কোথাও চারজন লোক একত্রিত হলেই সেখানে নামাজ, রোজা ও কোরআন সম্পর্কিত আলোচনা শুরু হয়ে যেতো। অমুসলিম প্রজাদের ওপর এই সরকারের এত বেশী প্রভাব পড়ে যে, এই অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার অমুসলামন ইসলাম গ্রহণ করে এবং জিজিয়ার আয় আচানাক এতটা হ্রাসপ্রাপ্ত হয় যে, তার ফলে রাষ্ট্রিয় কোষাগারও প্রভাবিত হয়ে পড়ে। ইসলামী রাষ্ট্রের চারপাশে যেসব অমুসলিম রাষ্ট্র ছিল হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করেন। তাদের মধ্য থেকে একাধিক রাষ্ট্র ইসলাম গ্রহণ করে। তৎকালে ইসলামী রাষ্ট্রের সবচাইতে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল রোম সাম্রাজ্য। প্রায় এক শতাব্দীকাল তাদের সঙ্গে যুদ্ধ চলছিল। হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের সময়েও তাদের সংগে রাজনৈতিক সংঘর্ষ জারি ছিল। কিন্তু রোম সাম্রাজ্যের ওপর তাঁর বিরাট নৈতিক প্রভাব পড়েছিল। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে রোম সম্রাট যে মন্তব্য করেন তা থেকেই তা আন্দাজ করা যায়ঃ
“ কোনো সংসার বৈরাগী যদি সংসার ত্যাগ করে নিজের দরজা বন্ধ করে নেয় এবং ইবাদতের মশগুল হয়ে যায়, তাহয়ে আমি তাতে মোটেই অবাক হই না। কিন্তু আমি অবাক হই সেই ব্যক্তির ব্যাপারে, যার পদতলে ছিল দুনিয়ার বিপুল সম্পদ-সম্পত্তি আর সে তা হেলায় ঠেলে ফেলে দিয়ে ফকিরের ন্যায় জীবনযাপন করে”।
ইসলামের প্রথম মুজাদ্দিদ কেবলমাত্র আড়াই বছর কাজ করার সুযোগ পান। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে বিরাট বিপ্লব সৃষ্টি করেন। কিন্তু বনি উমাইয়ার প্রত্যেক ব্যক্তিই তাঁর শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামের জীবনের মধ্যে তাদের মৃত্যু নিহিত ছিল। কাজেই এই সংস্কারমূলক কাজকে তারা কেমন করে রবদাশত করতে পারতো। অবশেষে তারা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে বিষপান করালেন এবং মাত্র ৩৯বছর বয়সে দ্বীন ও মিল্লাতের এই নিঃস্বার্থ খাদিম দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। তিনি যে, সংস্কারমূলক কাজের সূচনা করেছিলেন, তা প্রায় পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। আর শুধুমাত্র বংশানুক্রমিক মনোনয়নের পদ্ধতি খতম করে তদস্থলে নির্বাচন ভিত্তিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজটুকু বাকী ছিল। এ সংস্কার পরিকল্পনাটি তার সম্মুখে ছিল। তিনি নিজের এ পরিকল্পনাটি প্রকাশও করেছিলেন। কিন্তু সমাজ জীবন থেকে উমাইয়া শাসনের প্রভাব নির্মূল করা এবং সাধারণ মুসলমানদের নৈতিক ও মানসিক অবস্থাকে খিলাফতের বোঝা বহন করার জন্যে তৈরী করা নিতান্ত সহজ ছিল না। মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে তা সম্পাদিত হতে পারতো না।
চার ইমাম
দ্বিতীয় উমরের (র) ইন্তেকালের পর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের চারিকাঠি পুনর্বার ইসলাম থেকে জাহেলিয়াতের দিকে স্থানান্তরিত হয় এবং তিনি যে কার্য সম্পাদন করেছিলেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। কিন্তু তবুও ইসলামী মানসে তিনি যে জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন এবং যে তত্ত্বগত আন্দোলনের ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন তার অগ্রগতি রোধ করার শক্তি কারুর ছিলনা। বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাসীয়দের বেত্রদণ্ড ও আশরফির থলি এ আন্দোলনের পথরোধ করে দাঁড়ায়। কিন্তু তাদের সব জারিজুরি নিস্ফল হয়। এই আন্দোলনের প্রভাবে কোরআন ও হাদীস শাস্ত্রে গবেষণা ইজতিহাদ ও নীতি-নির্দেশ সংকলন ও প্রণয়নের বিরাট কার্য সম্পাদিত হয়। দ্বীনের মূলনীতি থেকে বিস্তারিত ইসলামী আইন প্রণয়ন করা হয় এবং একটি ব্যাপক তমুদ্দুনিক ব্যবস্থাকে ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালিত করার জন্যে যত প্রকার নিয়মাবলী ও কর্ম পদ্ধতির প্রয়োজন খুঁটিনাটি বিষয়সহ তার প্রায় সমস্তই প্রণয়ন করা হয়। দ্বিতীয় শতকের শুরু থেকে প্রায় চতুর্থ শতক পর্যন্ত এ কাজ পূর্ন শক্তিতে চলতে থাকে।
এই যুগের মুজাদ্দিদগনের মধ্যে চারজন ইমামের নামই (১০) উল্লেখযোগ্য। ফিকাহর চারটি মযহাব তাঁদের চারজনের সংগে সম্পর্কিত। তারা ছাড়াও আরো বহু সংখ্যক মুজতাহিদ ছিলেন। কিন্তু যে কারণে তাদের মরতবা মুজতাহিদের পর্যায় থেকে মুজাদ্দিদের পর্যায়ে উন্নীত হয় তা হলো এইঃ- প্রথমতঃ তাঁরা নিজেদের গভীর দৃষ্টিশক্তি ও অস্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে এমন চিন্তাধারার জন্ম দেন, যার বিপুল শক্তি সম্ভার সাত-আট শতাব্দী পর্যন্ত মুজতাহিদ পয়দা করতে থাকে। (১০) ইমাম আবু হানিফা (র) ৮০হিজরীতে (৬৯৯ খৃঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং ইন্তেকাল করেন ১৫০হিজরীতে (৭৬৭খৃঃ) । ইমাম মালিক (র) জন্মগ্রহণ করেন ৯৫ হিজরীতে (৭১৪খৃঃ) এবং ইন্তেকাল করেন ১৭৯ হিজরীতে (৭৯৮খৃঃ) ইমাম শাফেয়ী (র) জন্মগ্রহণ করেন ১৫০হিজরীতে (৭৬৭খৃঃ) ইন্তেকাল করেন ২৪০হিজরীতে (৮৫৪খৃঃ) । ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) জন্মগ্রহণ করেন ১৬৪ হিজরীতে (৭৮০খৃঃ) এবং ইন্তেকাল করেন ২১৪ হিজরীতে (৮৮৫খৃঃ) তাঁরা দ্বীনের মূলনীতিসমূহ থেকে খুটিনাটি বিষয়াবলী উদ্ভাবন করার এবং জীবনের বাস্তব বিষয়াবলী শরিয়তের নীতি সমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত করার এমন সার্বজনীন পদ্ধতির প্রবর্তন করেন যার ফলে পরবতীকালে তাঁদের ঐ পদ্ধতির ভিত্তিতেই যাবতীয় ইজতিহাদমূলক কার্যাদি সম্পাদন সম্ভব হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এ সম্পর্কিত কোন কার্য তাদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হবে না।
দ্বিতীয়তঃ রাজসরকারের সাহায্য ব্যতিরেকে তার সবরকম অনুপ্রবেশ মুক্ত হয়ে বরং তার অনুপ্রবেশের তীব্র মোকাবেলা করে তাঁরা এসব কার্য সম্পাদন করেন। এ ব্যাপারে তাঁরা এমন এমন কষ্ট ভোগ করেন যার কল্পনা করতেও শরীর শিহরিয়ে ওঠে। ইমাম আবু হানিফা (র) বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাস উভয় আমলেই বেত্রদণ্ড ও কারাদণ্ড ভোগ করেন। এমন কি অবশেষে তাকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করা হয়। ইমাম মালিককে (র) আব্বাসী বাদশাহ মনসুরের আমলে ৭০বেত্রদণ্ড দেয়া হয় এবং ভীষণভাবে তাঁকে পিছমোড়া করে বাঁধা হয় যে তাঁর হস্তদ্বয় শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের ওপর মামুন, মোতাসিম ও ওয়াসিক তিনজনের আমলেই অনবরত নির্যাতন চালানো হয়। তাঁকে এত বেশী মারপিট করা হয় যে সম্ভবতঃ উট ও হাতী সেই মারের পর জীবিত থাকতে পারতো না। অতঃপর মুতাওয়াক্কিলের আমলে তাঁর ওপর এর বেশী রাজকীয় পুরস্কার, সম্মান ও ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয় যে, তিনি ঘাবড়িয়ে গিয়ে চিৎকার করে ওঠেনঃ
———————-
“ঐ মারপিট এবং কারাদন্ডের চাইতেও এগুলো আমার ওপর অধিকতর কঠিন বিপদ”। কিন্তু এসব সত্ত্বেও এ মনীষীগণ দ্বীনি ইলম সংকলন ও প্রণয়নের ব্যাপারে শুধু রাজ-প্রভাব ও অনুপ্রবেশের পথরোধই করেননি বরং এমন পদ্ধতির প্রচলন করে যান, যার ফলে পরবর্তিকালে সমস্ত ইজতিহাদমূলক ও মৌলিক রচনার কাজ পূর্ণরূপে রাজদরবারের প্রভাবমুক্ত থাকে। এরই ফলস্বরুপ আজ ইসলামী আইন এবং কোরআন ও হাদীস শাস্ত্রের যতগুলো নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য বই আমরা লাভ করেছি, তাতে জাহেলিয়াতের সামান্য গন্ধ পর্যন্তও নেই। এ জিনিসগুলো এমনি পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন অবয়বে বংশানুক্রমিকভাবে স্থানান্তরিত হয় যে, বাদশাহ ও আমীর-ওমরাহদের কয়েক শতাব্দীকালীন ইন্দ্রিয় লিপ্সা ও বিলাসিতা এবং জনসাধারণের নৈতিক অবনতি এবং আকিদা-বিশ্বাস ও তমুদ্দুনিক বিকৃতির যে সয়লাব প্রবাহিত হয়, তা যেন জ্ঞানের এই স্তুপকে স্পর্শও করতে পারেনি এবং তার কোনো প্রভাব এর ওপর পরিলক্ষিত হয় না।
ইমাম গাজ্জালী (র)
উমর ইবনে আবদুল আযীযের পর রাষ্ট্র ও রাজনীতির লাগাম স্থায়ীভাবে জাহেলিয়াতের হাতে স্থানান্তরিত হয় এবং বনি উমাইয়া বনি আব্বাস ও তারপর তুর্কী বংশোদ্ভূত বাদশাহদের কর্তৃত্বের যুগ শুরু হয়্ এই বাদশাহ গণ যে কার্য সম্পাদন করেন তার সংক্ষিপ্তসার হলো এই যে, একদিকে তারা গ্রীক রোম ও অনারব দেশের জাহেলী দর্শনসমূহ হুবহু মুসলমানদের মধ্যে চালিয়ে দেন এবং অন্যদিকে নিজেদের অর্থ ও শক্তিবলে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প, সংস্কৃতি ও সামাজিকতার মধ্যে ইসলাম -পূর্ব যুগের জাহেলীয়াতের যাবতীয় বিবৃত ব্যবস্থা ব্যাপক প্রচলন করেন। বনি আব্বাসীয় রাজবংশের অবনতির কারণে ক্ষতির পরিমাণ আরো বর্ধিত হয়। প্রথম দিকের আব্বাসীয় খলিফাদের পর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ক্ষমতা যাদের হাতে স্থানান্তরিত হয় তারা দিনী ইলম থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিলেন। কাজী ও মুফতির পদে যোগ্যতার লোক নির্বাচন করার যোগ্যতাও তাদের ছিলনা। নিজেদের মূর্খতা ও আয়েশ পরস্তির কারণে শরিয়তের নির্দেশাবলী প্রবর্তনের কাজ তারা এমন গতানুগতিক পদ্ধতিতে করতে চাইতেন যাতে কোনো প্রকার কষ্ট স্বীকার করার প্রয়োজন না হয়। আর এ জন্যে অন্ধ অনুসারিতার পথই ছিল উপযোগী। উপরন্ত স্বার্থবাদী আলেম সমাজ তাদেরকে মযহাবী বিতর্কযুদ্ধ আয়োজনে অভ্যস্থ করে তোলেন। অতঃপর রাজানুগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এ ব্যাধি এতদূর বিস্তার লাভ করে যে, এর ফলে সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রে ফেরকাবাজী মতবিরোধ ও হানাহানি মহামারির ন্যায় প্রসার লাভ করে। আমীর-ওমরাহ ও বাদশাহদের জন্যে এই নিছক একটি আমোদ ও বিলাসিতা। কিন্তু সাধারণের জন্যে এটি কাচির কাজ করে এবং তাদের দ্বীনি ঐক্যকে কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়। পঞ্চম শতকে পৌঁছতে পৌঁছতে অবস্থা এই পর্যায়ে এসে যায় যেঃ
(১) গ্রীক দর্শনের প্রচারের ফলে আকিদা-বিশ্বাসের বুনিয়াদ নড়ে ওঠে। মুহাদ্দিস ও ফকিহগণ ন্যায়শাস্ত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন। তাই তারা দ্বীনকে যুগের চাহিদা অনুযায়ী যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে বুঝাতে পারতেন না এবং ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে আকিদা বিশ্বাসের গোমরাহীকে দাবিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। ন্যায়শাস্ত্রে যারা বিপুল জ্ঞানের অধিকারী বলে পরিচিত ছিলেন তাঁরা কেবল ইসলামী শাস্ত্রে পরাদর্শী ছিলেন না। বরং ন্যায়শাস্ত্রেও ইজতিহাদ করার মতো যোগ্যতা তাদের ছিলনা। তারা গ্রীক দার্শনিকদের দাস ছিলেন। সমালোচনার দৃষ্টিতে এই গ্রীক সাহিত্য পর্যালোচনা করার মতো গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন লোকও তাদের মধ্যে ছিল না। গ্রিক ওহীকে অপরিবর্তনীয় মনে করে তারা হুবাহু তাকে স্বীকার করে নেন এবং আসমানী ওহীকে গ্রীক ওহী অনুযায়ী ঢালাই করার জন্যে তাকে বিকৃত করতে উদ্যেগী হন। এ পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মুসলমান ইসলামকে যুক্তিবিরোধী মনে করতে থাকে। তার প্রত্যেকটি বিষয় তাদের চোখে সন্দেহপূর্ণ হিসাবে প্রতিভাত হয়। তারা মনে করতে থাকে যে, আমাদের দ্বীন লজ্জাবতী লতার ন্যায় স্পর্শকাতর, বুদ্ধির পরীক্ষার সামান্য স্পর্শেই তা ঝিমিয়ে পড়ে। ইমাম আবুল হাসান আশয়ারী ও তাঁর অনুসারীরা এই ধারার পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন। এ দলটি ইলমে কালাম সম্পর্কে অবগত ছিলেন কিন্তু ন্যায় শাস্ত্রের দুর্বলতগুলো সম্পর্কে তাঁরা মোটেই ওয়াকেফহাল ছিলেন না। তাই তাঁরা এই ব্যাপক ও সর্ব পর্যায়ের আকিদা বিকৃতির গতি পরিবর্তন করতে পুরোপুরি সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। বরং মোতাজিলাদের প্রতি জিদের বশে তাঁরা এমন অনেক কথা গ্রহণ করেন, যা আসলে দ্বীনি আকিদার অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
(২) মূর্খ শাসকের প্রভাবে এবং দ্বীনি ইলমসমূহ বস্তুগত উপায়- উপকরণের সাহায্য বঞ্চিত হবার কারণে ইজতিহাদের ধারা শুকিয়ে যায় অন্ধ অনুসারিতার ব্যাধি বিস্তারলাভ করে, মজহাবী মতবৈষম্য অধিকতর ব্যাপক ও প্রবল হয়ে খুঁটিনাটি বিষয়ৈর ভিত্তিতে নতুন নতুন ফেরকা সৃষ্টি করে এবং এসব ফেরকার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব মুসলমানদেরকে যে, ———– (জলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ওপর) এর পর্যায়ে স্থাপন করে।
(৩) পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত মুসলিম জাহানের সর্বত্র নৈতিক অবনতি দেখা যায়। কোনো একটি শ্রেণীও এর প্রভাবমুক্ত থাকেনি। মুসলমানদের সমাজ জীবন কোরআন ও নবুয়্যাতের আলোক থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত হয়ে যায়। হেদায়েত ও পথের সন্ধানে খোদার কিতাব এবং রসূলের সুন্নতের দিকে ফিরে আসা উচিত, একথা আলেম সমাজ আমীর-ওমরাহ ও জনসাধানণ সবাই বিস্মৃত হয়।
(৪) রাজদরবারী, রাজপরিবার ও শাসক শ্রেণীর বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও স্বার্থবাদী যুদ্ধের কারণে অধিকাংশ স্থলে প্রজাসাধারণ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছিল। অবৈধ করের বোঝা তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছিল। যেসব বিদ্যা কৃষ্টি-তমুদ্দুনকে প্রকৃতপক্ষে লাভবান করে, সেগুলো ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। রাজদরবারে যেসব শিল্প মর্যাদাসম্পন্ন ছিল কিন্তু নৈতিক বৃত্তিও তমুদ্দেনের জন্যে ছিল ধ্বংসের কেবল সেগুলিরই ডংকা বাজছিল। চারপাশের অবস্থা ও নিদর্শনসমূহ সুস্পষ্টভাবে ঘোষনা করছিল যে, ব্যাপক ধ্বংসের সময় নিকটবর্তী।
পঞ্চম শতকের মধ্যভাগে এহেন পরিস্থিতিতে ইমাম গাজ্জালী জন্মগ্রহণ করেন১১। সে যুগে যে শিক্ষা পার্থিব উন্নতির বাহন হতে পারতো, প্রথমতঃসেই ধরনের শিক্ষা তিনি লাভ করেন। বাজারে যেসব বিদ্যার চাহিদা ছিল, তাতেই তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেন। অতঃপর এ বস্তুকে নিয়ে তিনি ঠিক সেখানেই পৌঁছেন সেখানকার জন্যে এটি তৈরী হয়েছিল এবং তৎকালে একজন আলেম যতদূর উন্নতির কল্পনা করতে পারতেন, ততদূর তিনি পৌঁছে যান।
তিনি তৎকালীন দুনিয়ার বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় বাগদাদের নেজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকটর নিযুক্ত হন। নেজামুল মুলক তুসী মালিক শাহ সালজুকী ও বাগদাদের খলিফার দরবারে যোগ্য আসন লাভ করেন। সমকালীন রাজনীতিতে এত বেশী প্রভাব বিস্তার করেন যে, সালজুকী শাসক ও আব্বাসীয় খলিফার মধ্যে সৃষ্ট মতবিরোধ দুর করার জন্যে তাঁর খেদমত হাসিল করা হতো। পার্থিব উন্নতির এই পর্যায়ে উপনিত হবার পর অকস্মাৎতাঁর জীবনে বিপ্লব আসে। নিজের যুগের তত্ত্বগত নৈতিক ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও তমুদ্দুনিক জীবনধারাকে যত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন, ততই তাঁর মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে থাকে এবং ততই বিবেক তারস্বরে শুরু করে যে, এই পুঁতিগন্ধময় সমুদ্রে সন্তরণ করা তোমার কাজ নয়, তোমার কাজ অন্য কিছু। অবশেষে সমস্ত রাজকীয় মর্যাদা, লাভ, মুনাফা, ও মর্যদাপূর্ণ কার্যসমূহেকে ঘৃণাভাবে দূরে নিক্ষেপ করেন। কেননা এগুলোই তার পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর ফকির বেশে দেশ পর্যটনে বেরিয়ে পড়েন। বনে-জংগলে ও নির্জন স্থানে বসে নিরিবিলিতে চিন্তায় নিমগ্ন হন। বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মুসলমানদের সংগে মেলামেশা করে তাদের জীবনধারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। দীর্ঘকাল মোজাহাদা ও সাধনার মাধ্যমে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে থাকেন। ৩৮ বছর বয়সে বের হয়ে পূর্ণ দশ বছর পর ৪৮বছর বয়সে ফিরে আসেন। ওই দীর্ঘকালীন চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের পর তিনি যে কার্য সম্পাদন করেন তা হলো এই যে, বাদশাহদের সংগে সম্পর্কেচ্ছেদ করেন। এবং তাদের মাসোহারা গ্রহণ করা বন্ধ করেন। বিবাদ ও বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকার জন্যে শপথ করেন। সারকারী প্রভাবাধীনে পরিচালিত শিক্ষায়তনসমূহে কাজ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং তুসে নিজের একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান কায়েম করেন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি নির্বাচিত ব্যক্তিদের বিশেষ পদ্ধতিতে তালিম দিয়ে তৈরী করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু সম্ভবতঃ তাঁর এ প্রচেষ্টা কোনো বিরাট বৈপ্লবিক কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম হয়নি, কেননা এ পদ্ধতিতে কাজ করার জন্যে তাঁর আয়ু তাঁকে পাঁচ ছয় বছরের বেশী অবকাশ দেয়নি।
ইমাম গাজ্জালী (র) এর সংস্কারমূলক কাজের সংক্ষিপ্তসার হলো এইঃ
এক.
গ্রীক দর্শন গভীরভাবে অধ্যায়ন করার পর তিনি তার সমালোচানা করেন এবং জবরদস্ত সমালোচানা করেন যে, তার যে শ্রেষ্ঠত্ব ও শক্তিমত্তা মুসলমানদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, তা হ্রাসপ্রাপ্ত হয় এবং লোকেরা যে সমস্ত মতবাদকে চরম সত্য বলে মেনে নিয়েছিল, কোরআন ও হাদীসের শিক্ষাসমূহকে যার ফলে ছাঁচে ঢালাই করা ছাড়া দ্বীনের উদ্ধারের আর কোন উপায় পরিদৃষ্ট হচ্ছিল না, তার আসল চেহারা অনেকাংশে জনগণের সম্মুখে উম্মক্ত হয়ে যায়। ইমামের এই সমালোচানার প্রভাব শুধু মুসলমান দেশসমূহেই সীমাদ্ধ থাকেনি বরং ইউরোপে উপনীত হয় এবং সেখানে গ্রীক দর্শনের কর্তৃত্ব খতম করার এবং আধুনিক সমালোচনা ও গবেষণা যুগের দ্বারোদঘাটন করার ব্যাপারে অংশগ্রহণ করে।
দুই.
ন্যায় শাস্ত্র গভীর জ্ঞান না রাখার কারণে ইসলামের সমর্থকগণ দার্শনিক ও মুতাকাল্লিমদের মোকাবিলায় যেসব ভুল করছিল তিনি সেগুলো সংশোধন করেন। পরবর্তীকালে ইউরোপের পাদ্রিরা যে ভুল করেছিল ইসলামের এই সমর্থকরা ঠিক সেই পর্যায়ে ভূল করে চলছিল। অর্থাৎ ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাসের যুক্তি প্রমাণকে কতক সুস্পষ্ট অযৌক্তিক বিষয়াবলীর ওপর নির্ভরশীল মনে করে অযথা সেগুলোকে মূলনীতি হিসেবে গণ্য করা, অতঃপর ঐ মনগড়া মূলনীতিগুলোকেও ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাসের মধ্যে শামুল করে যারা সেগুলো অস্বীকার করে তাদেরকে কাফের গণ্য করা আর যে সমস্ত দলিল প্রমান অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণের সাহায্যে মনগড়া ঐ নীতিগুলোর গলদ প্রমাণিত হয়, সেগুলোকে ধর্মের জন্যে বিপদস্বরুপ মনে করা। এ জিনিসটিই ইউরোপকে নাস্তিক্যবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। মুসলিম দেশ সমুহে এ জিনিসটিই বিপুল বিক্রমে কাজ করে যাচ্ছিল এবং জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করছিল। কিন্তু ইমাম গাজ্জালী যথাসময়ে এর সংশোধন করেন। তিনি মুসলমানদেরকে জানান যে, অযৌক্তিক বিষয়সমুহের ওপর তোমাদের ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাসের প্রমাণ নির্ভরশীল নয় বরং এর পেছনে উপযুক্ত প্রমাণ আছে। কাজেই ঐ গুলোর ওপর জোর দেয়া অর্থহীন।
তিন.
তিনি ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস ও মুলনীতিসমূহের এমন যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা পেশ করেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে কমপক্ষে সে যুগে এবং তার পরবর্তী কয়েক যুগ পর্যন্ত ন্যায়শাস্ত্র ভিত্তিক কোনো কোনো প্রকার আপত্তি উত্থাপিত হতে পারতো না। এই সংগে তিনি শরিয়তের নির্দেশাবলী এবং ইবাদতের গূঢ় রহস্য ও যৌক্তিকতাও বর্ণনা করেন এবং এমন একটি চিত্র পেশ করেন যার ফলে ইসলাম যুক্তি ও বুদ্ধির পরীক্ষার বোঝা বহন করতে পারবে না বলে যে ভুল ধারণা মানুষের মনে স্থানলাভ করেছিল, তা বিদূরিত হয়।
চার.
তিনি সমকালীন সকল মযহাবী ফেরকা এবং তাদের মতবিরোধ পূর্ণরূপে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে ইসলাম ও কুফরের পৃথক পৃথক সীমারেখা নির্ধারণ করেন এবং কোন সীমারেখার মধ্যে মানুষের জন্যে মত প্রকাশ ও ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা আছে, কোন সীমারেখা অতিক্রম করার অর্থ ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া ইসলামের আসল আকিদা বিশ্বাস কি কি এবং কোন কোন জিনিসকে অনর্থন ইসলামী আকিদার মধ্যে শামিল করা হয়েছে তা বিবৃত করেন। তাঁর এই পর্যালোচনার ফলে পরস্পর বিবদমান ও পরস্পর কাফের আখ্যাদানকারী ফেরকাসমুগের সুড়ঙ্গের মধ্য হতে অনেক বারুদ বের হয়ে যায় এবং মুসলমানদের দৃষ্টিভংগীতে ব্যাপকতা সৃষ্টি হয়।
পাঁচ.
তিনি দ্বীনের জ্ঞানকে সঞ্জীবিত ও সতেজ করেন। চেতনাবিহীন ধার্মিকতাকে অর্থহীন গণ্য করেন। অন্ধ অনুসৃতির কঠোর বিরোধাতা করেন। জনগণকে পুনর্বার খোদার কিতান ও রসূলের সুন্নতের উৎস ধারার দিকে আকৃষ্ট করেন। ইজতিহাদের প্রাণশক্তিকে সঞ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। এবং নিজের যুগের প্রায় প্রত্যেকটি দলের ভ্রান্তি ও দূর্বলতার সমালোচনা করে তাদেরকে ব্যাপকভাবে সংশোধনের আহবান জানান।
ছয়.
তিনি পুরাতন জরাজীর্ন শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করেন এবং একটি নয়া শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনা পেশ করেন। সে সময় পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে যে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল, তার মধ্যে দুই ধরনের ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছিল। প্রথমটি হলো এই যে, দ্বীন ও দুনিয়ার শিক্ষাব্যস্থা পৃথক ছিল। এর ফলস্বরূপ দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে পৃথকীকরণ দেখা দেয়। ইসলাম এটিকে মূলতঃভ্রান্ত মনে করে। দ্বিতীয়টি এই যে, শরিয়তের জ্ঞান হিসাবে এমন অনেক বিষয় পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছিল, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ন ছিল না। এর ফলে দ্বীন সম্পর্কে জনগনের ধারণা ভ্রান্তিতে পরিপূর্ন হয়ে যায় এবং কতিপয় অপ্রয়োজনীয় বিষয় গুরুত্ব অর্জন করার কারণে ফিরকাগত বিরোধ শুরু হয়। ইমাম গাজ্জালী (র) এই গলদগুলো দূর করে একটি সুসামঞ্জস্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর সমকালীন লোকেরা তাঁর এই মহান কর্মকাণ্ডের ঘোর বিরোধিতা করে। কিন্তু অবশেষে সকল মুসলিম দেশে এ নীতি স্বীকৃতি লাভ করে এবংপরবর্তীকালে যতগুলো শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় তার সবগুলোই ইমাম নির্ধারিত পথেই প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানকাল পর্যন্ত আরবী মাদ্রাসাসমুহের কারীকুলামে যে সমস্ত ব্ই শামিল আছে, তার প্রাথমিক নকসা ইমাম গজ্জালী (র) তৈরী করেন।
সাত.
তিনি জনসাধারণের নৈতিক চরিত্র পূর্ণরূপে পর্যালোচনা করেন। উলামা, মাশায়েখ, আমির-ওমরাহ, বাদশাহ ও জনসাধাণের প্রত্যেকের জীবন প্রণালী অধ্যয়নের সুযোগ তিনি পান। নিজে পরিভ্রমন করে প্রাচ্য জগতের একটি অংশের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর এহইয়া -উল-উলুম কিতাবটিএই অধ্যায়নের ফল। এ কিতাবে তিনি মুসলমানদের প্রত্যেকটি শ্রেণীর নৈতিক অবস্থার সমালোচনা করেন, প্রত্যেকটি দুষ্কৃতির মূল এবং তার মনস্তাত্ত্বিক ও তমুদ্দুনিক কারণসমুহ অনুসন্ধান করেন এবং ইসলামের নির্ভুল ও সত্যিকার নৈতিক মানদণ্ড পেশ করার চেষ্টা করেন।
আট.
তিনি সমকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থারও অবাধ সমালোচনা করেন্ সমকালীন শাসক গোষ্ঠিকেও সরাসরি সংশোধনের দিকে আকৃষ্ট করতে থাকেন এবং এই সংগে জনগণের মধ্যেও জূলুম-নির্যাতনের সম্মুখে স্বেচ্ছায় নত না হয়ে অবাধ সমালোচনা করার প্রেরণা সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। এহইয়া-উল-উলুম এর একস্থানে লেখেনঃআমাদের জামানার সুলতানদের সমস্ত বা অধিকাংশ ধন-সম্পদ হারাম। আর একস্থানে লেখেন এই সুলতানদের নিজেদের চেহারা অন্যকে না দেখানো উচিত এবং অন্যদের চেহারা না দেখা উচিত। এদের জুলুমকে ঘৃণা করা এদের অস্তিত্বকে পছন্দ না করা, এদের সংগে কোন প্রকার সম্পর্ক না রাখা এবং এদের সংগে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের থেকেও দূরে অবন্থান করা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে অপরিহার্য। অপর একস্থানে দরবারে প্রচলিত আদব -কায়দা ও বাদশাহ পুজার সমালোচনা করেন বাদশাহ ও আমির -ওমরাহর অনুসৃত সামাজিক রীতিনীতির নিন্দা করেন, এমনকি তাদের দালান কোঠা পোশাক-পরিচ্ছদ গৃহের সাজসরঞ্জাম সব কিছুকেই নাপাক গণ্য করেন। শুধু এখানেই ক্ষান্ত হননি বরং তিনি নিজের যুগের বাদশাহদের নিকট একটি বিস্তারিত পত্র লেখেন। পত্রের মাধ্যমে তাঁকে ইসলাম প্রবর্তিত রাষ্ট্র পদ্ধতির দিকে আহবান জানান, শাসকের দায়িত্ব বুঝান এবং তাঁকে জানান যে, তাঁর দেশে যে জুলুম হচ্ছে তা তিনি নিজেই করেন বা তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীরা করেন, সবকিছুর জন্যে তিনিই দায়ী। একবার বাধ্য হয়ে রাজ দরবারে যেতে হয় তখন আলোচনা প্রসংগে বাদশাহর মুখের ওপর বলেনঃ
“স্বর্ণ অলংকারের ভারে তোমার ঘোড়ার পিঠ ভাঙেনি তো কি হয়েছে, অনাহারে -অর্ধহারে মুসলমানদের পিঠতো ভেঙে গিয়েছে”।
তাঁর শেষ যুগে যে সকল উজির নিযুক্ত হন তাদের প্রায় সবার নিকট তিনি পত্র লেখেন এবং জনগনের দুরবস্থার প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জনৈক উজিরকে লেখেনঃ
“জুলুম সীমা অতিক্রম করেছে। যেহেতু আমাকে স্বচক্ষে এসব দর্শন করতে হতো তাই নির্লজ্জ ও নির্দয় জালেমদের কীর্তিকলাপ প্রত্যক্ষ না করার জন্যে প্রায় এক বছর থেকে আমি তুসের আবাস উঠিয়ে নিয়েছি”।
ইবনে খালদুনের বর্ণনা মতে এতদূর জানা যায় যে, তিনি পৃথিবীর যে কোনো এলাকাতেই হোক না কেন নির্ভেজাল ইসলামী নীতি ও আদর্র্শের ভিত্তিতে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করতেন। কাজেই তাঁর ইংগিতেই দুর প্রতীচ্যে (আফ্রিকায়) তাঁর জনৈক ছাত্র, মুওয়াহিদ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ইমাম গাজ্জালীর কর্মকাণ্ডে এই রাজনৈতিক রূপ ও রং নেহাতই গৌণ ছিল। রাজনৈতিক বিপ্লব সাধনের জন্যে তিনি কোনো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাননি এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর সামান্যতম প্রভাব ও বিস্তার করতে সক্ষম হননি। তাঁর পরবর্তীকালে জাহেলীয়াতের কর্তৃত্বাধীনে মুসলিম জাতিসমূহের অবস্থা উত্তরোত্তর অবনতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এমনকি এক শতাব্দির পর তাতারীরা তুফানের ন্যায় মুসলিম দেশসমুহের ওপর দিয়ে ছুটে চলে এবং তাদের সমগ্র তমুদ্দুনকে বিধ্বস্ত করে দেয়।
ইমাম গাজ্জালীর (র) সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে কতিপয় তত্ত্ব ও চিন্তাগত ত্রুটিও ছিল। এ গুলোকে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। হাদীস শাস্ত্রে দুর্বল হবার কারণে তাঁর কার্যাবলীতে এক ধরনের ত্রুটি দেখা দেয়। ১২ দ্বিতীয় ধারণের ত্রুটি তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির ওপর যুক্তিবাদিতা ও ন্যায় শাস্ত্রের কর্তৃত্বের কারণে সৃষ্টি হয়। তৃতীয় ধরনের ত্রুটির উৎপত্তি হয় তাসাউফের দিকে প্রয়োজনাতিরিক্ত ঝুঁকে পড়ার কারণে।
এই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠে ইমাম গাজ্জালীর (র) আসল কাজ অর্থাৎ ইসলামের চিন্তাগত ও নৈতিক প্রমাণশক্তিকে সঞ্জীবিত করার এবং বেদআত ও গোমরাহির নির্দশনসমূহ চিন্তা জগত ও তমুদ্দুনিক জীবনধারা থেকে ছাঁটাই করার কাজকে যিনি অগ্রসর করেণ তিনি হচ্ছেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) ।
১২.ইমাম গাজ্জালী তাঁর এহইয়া-উল-উলুম কিতাবে এমন অনেক হাদীস উদ্ধৃত করেছেন, যে গুলোর সনদ পাওয়া যায় না, তাজদ্দিন সাবাকী তাঁর তাবকাতে শাফেঈয়ায় সেগুলো একত্রিত করেছেন। – (দেখুন-তাবকাত চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৪৫ থেকে ১৮২)
ইবনে তাইমিয়া (র)
ইমাম গাজ্জালীর (র) দেড়শো বছর পর হিজরী সপ্তম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) জন্মগ্রহণ ১৩করেন। তখন তাতারীদের হামলায় সিন্ধু নদ থেকে নিয়ে ফোরাত নদীর তীরভূমি পর্যন্ত বিশাল ভুখণ্ডে মুসলিম জাতি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। এখন তারা সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। অনবরত পঞ্চাশ বছরের এই পরাজয়, নিরবচ্ছিন্ন আতংক, অশান্তি ও বিশৃংখলাপূর্ন অবস্থা এবং বিদ্যা, সভ্যতা-সংস্কৃতির কেন্দ্রসমূহের ধ্বংস মুসলমানদেরকে অবনতির অতল গহবরে নামিয়ে দিয়েছিল্ ইমাম গাজ্জালীও তাদের মধ্যে এতটা অবনতি প্রত্যক্ষ করেননি। নয়া তাতারী আক্রমণকারীরা যদিও ইসলাম কবুল করছিল কিন্তু জাহেলীয়াতের ব্যাপারে এ শাসকগণ এদের পূর্ববর্তী তুর্কী শাসকদের চাইতে কয়েক পদ অগ্রসর ছিল। তাদের প্রভাবাধীনে এসে জনগণ, আলেম সমাজ, মাশায়েখ, ফকিহ ও কাজীগণের নৈতিক চরিত্র আরো বেশী অধঃপতিত হতে থাকে১৪। অন্ধ অনুসৃতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তার ফলে বিভিন্ন ফিকাহ ও কালাম শাস্ত্র ভিত্তিক মযহাবসমূহ যেন স্বতন্ত্র দ্বীনে পরিনত হয়। ১৫ইজতিহাদ গোনাহে পরিণত হয়। (১৩) ৬৬১ হিজরীতে (১২৬২ খৃঃ) জন্মগ্রহণ করেন এবং ইন্তেকাল করেন ৭২৮ হিজরীতে (১৩২৭ খৃঃ) (১৪) তৎকালীন আলেম সমাজের অবস্থা এতই শোচনীয় ছিল যে, হালাকু খান বাগদাদ দখল করার পর আলেমদের নিকট ন্যায়পরায়ণ কাফের সুলতান ও জালেম মুসলিম সুলতানের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে ফতোয়া তলব করলে আলেম সমাজ নির্বিবাদে ফতোয়া দিয়ে বসেন যে, ন্যায়পরায়ণ কাফের সুলতান জালেম মুসলিম সুলতানের চাইতে শ্রেষ্ঠ। তৎকালীন সমাজ নায়কদের অবন্থা ছিলঃ তাতারীদের ধ্বংস অভিযান থেকে মুসলমানদের বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র মিসর ও সিরিয়া নিষ্কৃতি লাভ করেছিল। এ রাষ্ট্রদ্বয়ের আইন-কানুন দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। এক, ব্যক্তি সম্পর্কিত আইন। এর কার্য ক্ষেত্র ছিল কেবল বিবাহ তালাক মিরাছ প্রভৃতি ধর্মীয় ব্যাপারে সীমাবদ্ধ। এসব ব্যাপারে শরীয়ত অনুযায়ী ফয়সালা হতো। দুই, রাষ্ট্রিয় আইন। এ আইন দেওয়ানী ও দেশের সমস্ত ব্যবস্থার ওপর কার্যকরী ছিল। এর ভিত্তি স্থাপিত ছিল পুরোপুরি চেংগিজী নিয়ম পদ্ধতির ওপর। উপরন্ত দেশে শরিয়তের যতটুকুন ব্যক্তি সম্পর্কিত আইনের প্রচলন ছিল তা ছিল শুধুমাত্র জনগণের জন্যে। আর শাসক সমাজ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ব্যাপারেও শরিয়তে মুহাম্মদীর পরিবর্তে চেংগিজী আইনের আনুগত্য করতো। তাদের অনৈসলামী দৃষ্টিভংগি সম্পর্কে শুধু এতটুকুন বলাই যথেষ্ট যে, মেকরিজির বর্ণনা মতে তারা নিজেদের রাষ্ট্রসীমার মধ্যে বেশ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপক অনুমতি দান করেছিল। পতিতাদের ওপর তারা কর ধার্য করেছিল এবং সেই কর বাবদ যাবতীয় অর্থ ইসলামী রাস্ট্রের কোষাগারে জমা হতো। ইবনে তাইমিয়ার সমকালীন আলেম ও সুফীগণের অধিকাংশই এইসব সরকারের বৃত্তিভোগী ছিল। আল্লাহর দ্বীনের এই মজলুম অবস্থা তাদের মনে মুহুর্তের জন্যেও ভাবান্তর সৃষ্টি করেনি। তবে যখন ইবনে তাইমিয়া অবস্থার সংশোধনে অগ্রসর হলেন তখন আচানক তাদের ইসলামী জোশ জেগে উঠলো এবং ফতোয়া দিতে শুরু করলো যে, এ ব্যক্তি নিজে গোমরাহ এবং মানুষকে গোমরাহ করছে। এ ব্যক্তি খোদার দেহ আছে বলে বিশ্বাস করে। এ ব্যক্তি পূর্ববর্তীদের পথ হতে বিচ্যুত হয়ে গেছে। এ ব্যক্তি তাসাউফ ও তাসাউফ পন্থিদের শত্রু। এ ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম ও ইমামগণের সমালোচনা করে। এ ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে নতুন নতুন বিষয় উদ্ভবন করছে। এর পেছনে নামাজ পড়া জায়েয নয় এবং এর সমস্ত কিতাব জ্বালিয়ে দেওয়া উচিত। (১৫) এ পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্যেও শুধু একটি নমুনা যথেষ্ট। দামেস্ক একটি মাদ্রাসার (মাদ্রাসায়ে রাওয়াছিয়া) প্রতিষ্ঠাতা নিজের ওয়াকফনামায় লিখে রেখেছিলেন যে, এ মাদ্রাসায় ঈসায়ী, ইহুদী ও হাম্বলীরা ভর্তি হতে পারবে না। এ থেকেই আন্দাজ করা যেতে পারে যে, ফিকাহ ও কালামের খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যার ফলে একজন শাফেয়ী ও আশয়ারী (কালাম শাস্ত্রের জনৈক ইমাম আবুল হাসান আশয়ারীর সমর্থক) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের অনুসারীদেরকে ইহুদী ও ঈসায়ীদের সাথে শামীল করতে দ্বিধা করতেন না। বেদআত ও পৌরানিক বিষয়াবলী শরীয়তের বিধানে পরিণত হয়। কোরআন ও সুন্নাতকে আঁকড়িয়ে ধরা অমার্জনীয় গোনাহ বলে বিবেচিত হয়। তৎকালে অশিক্ষিত ও গোমরাহ জনসাধারণ, দুনিয়া পূজারী বা সংকীর্ণমনা আলেম সমাজ ও মূর্খ জালেম শাসক শ্রেণীর ত্রয়ী সম্মিলন এমন জোরদার ফৌজদারী হয়ে ওঠে যে, এই এই সম্মিলিত জোটের বিরুদ্ধে কারুর সংস্কার ও সংশোধনের প্রোগ্রাম নিয়ে অগ্রসর হওয়া কসাইর ছুরির নীচে নিজের গলা বাড়িয়ে দেয়ার চাইতে কিছু কম ছিল না। এ কারণেই যদিও তখন নির্ভুল চিন্তার অধিকারী, ব্যাপক দৃষ্টিসম্পন্ন ও সত্য উপলব্ধিকারী ওলামার অভাব ছিল না। এবং হকের পথে অগ্রসর সত্যানুসারী ও আসল সুফীর সংখ্যাও যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এসব সত্ত্বেও সেই অন্ধকার যুগে সংস্কারের ঝাণ্ডা বুলন্দ করার সাহস একজন মাত্র আল্লাহর বান্দার হয়েছিল।
ইবনে তাইমিয়া (র) কোরআনে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। এমনকি হাফেজ যাহবী (র) সাক্ষ্য দেন যে, ——–তাফসীরে তো ইবনে তাইমিয়া (র) বিপুল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি হাদীসের ইমাম ছিলেন। এমন কি বলা হয়———————- (যে হাদীসটি ইবনে তাইমিয়া জানেন না, সেটি আদতে হাদীসই নয়) । ফিকাহ শাস্ত্রে তাঁর জ্ঞান এত গভীর ছিল যে, নিঃসন্দেহে তিনি স্বতন্ত্র মুজতাহিদের মর্যাদা লাভ করেন। যুক্তি শাস্ত্র ও কালাম শাস্ত্রে নিজেদের গভীর জ্ঞান সম্পর্কে যাঁদের গর্ব ছিল তাঁরাও তাঁর নিকট শিশুবৎ গণ্য হতেন। ইহুদী ও খৃষ্টানদের সাহিত্য, তাদের ধর্মীয় সম্প্রদায়সমূহের বিরোধ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টি এতই প্রখর ছিল যে, গোল্ড জিহারের মতে যে ব্যক্তি তাওরাতে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে আলোচনা করতে চায় তাকে অবশ্যি ইবনে তাইমিয়া গবেষণার মুখাপেক্ষী হতে হবে। এসব গভীর তত্ত্বজ্ঞানের সাথে সাথে তাঁর সাহস ও হিম্মতেরও তুলনা ছিল না। সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে কখনো কোনো বৃহত্তর শক্তিকে তিনি ভয় করেননি। এমন কি এ জন্যে বহুবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়ে এবং অবশেষে কারাগারেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ জন্যে ইমাম গাজ্জালীর (র) পরিত্যাক্ত কাজকে তিনি অধিকতর নিপুণতার সাথে অগ্রবর্তী করতে সক্ষম হন।
ইবনে তাইমিয়ার (র) সংস্কারমূলক কার্যাবলীর সংক্ষিপ্ত সার হলোঃ
১। তিনি ইমাম গাজ্জালীর চাইতেও অনেক বেশী কঠোর ও তীব্রভাবে গ্রীক যুক্তি ও দর্শন শাস্ত্রের সমালোচনা করেন এবং তার দুর্বলতাসমূহ এমনভাবে প্রকাশ করেন যার ফলে যক্তি ও বুদ্ধির ক্ষেত্রে তার আধিপত্য চিরকালের জন্যে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই ইমামদ্বয়ের সমালোচনার প্রভাব কেবল প্রাচ্য দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং তা পাশ্চাত্যেও পৌঁছে। কাজেই ইউরোপে এরিষ্টটলের যুক্তিবাদিতা ও খ্রষ্টান ভাষ্যকারগণের গ্রীক প্রভাবিত দার্শনিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সমালোচানার আওয়াজ ওঠে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার আড়াইশ বছর পর।
২। ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস, হুকুম -আহকাম ও আইন-কানুনের সমর্থনে তিনি এমন জোরদার যুক্তি প্রমাণের অবতারণা করেন যা ইমাম গাজ্জালীর যুক্তি-প্রমাণের চাইতেও বেশী বুদ্ধিগ্রাহ্য ছিল এবং ইসলামের সত্যিকার প্রাণশক্তির ধারক হবার দিক দিয়েও তাঁর থেকে অনেক বেশী অগ্রবর্তী ছিল। ইমাম গাজ্জালীর (র) বর্ণনাও যুক্তি নির্ণয়ের ওপর পারিভাষিক যুক্তি শাস্ত্রের বিপুল প্রভাব ছিল। ইবেন তাইমিয়া (র) এ পথ পরিহার করে সাধারণ জ্ঞানের ওপর বর্ণনা প্রকাশ ভংগী ও যুক্তি প্রদর্শনের ভিত্তিস্থাপন করেন। এটিই অধিকতর স্বাভাবিক অধিকতর প্রভাবশালী এবং কোরআন ও সুন্নতের অধিকতর নিকটবর্তী ছিল। এ নতুন পথটি পূর্ববর্তী পথগুলি থেকে সম্পর্ণ ভিন্নতর ছিল। যাঁরা দ্বীনের ধারক ও বাহক ছিলেন তাঁরা কেবলমাত্র শরিয়তের নির্দেশাবলী উদ্ধৃত করতেন সেগুলো বুঝতে পারতেন না। আর যাঁরা কালাম শাস্ত্রের গোলক ধাঁধায় আটকে পড়েছিলেন, তাঁরা দর্শন শাস্ত্রের কচকচি ও পারিভাষিক যুক্তি শাস্ত্রের মাধ্যমে বুঝবার চেষ্টা করার কারণে কোরআন ও সুন্নতের উচ্চতর প্রাণবস্তুকে কমবেশী হারিয়ে ফেলেছিলেন। ইবনে তাইমিয়া (র) ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস ও শরিয়তের নির্দেশাবলীকে তার আসল প্রাণবস্তুসহ পুরোপুরি বিবৃত করেন। অতঃপর সেগুলো বুঝবার জন্যে এমন সোজা ও স্বাভাবিক পস্থা অবলম্বন করেন, যার সম্মুখে মাথানত করা ছাড়া বুদ্ধির জন্যে দ্বিতীয় কোনো পথ ছিল না। ইমামের এই মহান কার্যের প্রশংসা করতে গিয়ে হাদীসের ইমাম আল্লামা যাহাবী বলেনঃ
—————————————
অর্থাৎ ইবনে তাইমিয়া নির্ভেজাল সুন্নত ও পূর্ববর্তীগণের পদ্ধতি সমর্থন করেন এবং এর সমর্থনে এমন সব যুক্তি প্রমাণ ও এমন পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করেন যার দিকে ইতিপূর্বে কারুর দৃষ্টিই পড়েনি।
৩। তিনি শুধু অন্ধ অনুসৃতির প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত হননি বরং ইসলামের প্রথম যুগের মুজাহিদগণের অনুসৃত পথে ইজতিহাদ করেও দেখিয়ে দেন। তিনি কোরআন সুন্নাহ ও সাহাবাদের জীবন থেকে সরাসরি প্রমাণ সংগ্রহ করে এবং বিভিন্ন ফিকাহ ভিত্তিক মযহাবের মতবিরোধের স্বাধীন ও ন্যায় ভিত্তিক পর্যালোচনা করে অসংখ্য বিষয়ের অবতারণা করেন। এর ফলে ইজতিহাদের পথ নতুনভাবে আবিস্কৃত হয় এবং লোকেরা ইজতিহাদ শক্তির ব্যবহার পদ্ধতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এই সংগে তিনি ও তাঁর মহান শাগরিদ ইবনে কাইয়েম শরিয়তের হিকমত এবং নবী করিমের (স) আইন প্রণয়ন পদ্ধতির ওপর এমন সূক্ষা গবেষণা কার্য সম্পাদান করেন যে, তার দৃষ্টান্ত শরিয়তের ইতি পূর্বেকার সাহিত্যে বিরল। তাঁদের পর যাঁরা ইজতিহাদ করেছেন তাঁদের জন্যে এ সাহিত্য উত্তম পথ-প্রদর্শকের কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতেও করতে থাকবে।
৪। তিনি বেদআত, মুশরিকী রসম রেওয়াজ এবং আকিদা-বিশ্বাস ও নৈতিক ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করেন। এই জন্যে তিনি কঠিন বিপদের সম্মুখিন হন। ইসলামের পরিষ্কার ঝরণা ধারায় এ পর্যন্ত যতগুলো অস্বচ্ছ স্রোতের মিশ্রণ ঘটেছিল ইমাম ইবনে তাইমিয়া তার কোনো একটিকেও নিষ্কৃতি দেননি। তাদের প্রত্যেকটির বিরুদ্ধে তিনি কঠোর সংগ্রাম চালান এবং প্রত্যেকটিকে ছেঁটে বের করে দিয়ে নির্জলা ইসলামের পদ্ধতিকে পৃথকভাবে দুনিয়ার সম্মুখে পেশ করেন। এই সমালোচনা পর্যালোচনার ক্ষেত্রে তিনি কারুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেননি। বিরাট খ্যাতিমান ও কীর্তিমান পুরুষ -যাদের খ্যাতি ও কীর্তির ডংকা সমগ্র মুসলিম দুনিয়ায় বাজতো যাঁদের নাম শুনে মানুষের মাথা নত হয়ে আসতো তাঁরাও ইবনে তাইমিয়ার সমালোচনা থেকে রেহাই পাননি। এমন অনেক কার্য ও পদ্ধতি যা, শতাব্দীর পর শতাব্দী থেকে ধর্মীয় রূপ পরিগ্রহ করেছিল, যাদের বৈধতা বরং মুস্তাহাব হওয়ার স্বপক্ষে যুক্তিপ্রমাণ তৈরী করা হয়েছিল, এবং হকপরস্ত আলেম সমাজও যে ব্যাপারে দুর্বলতা প্রদর্শন করেছিলেন, ইমাম ইবনে তাইমিয়া সেগুলোকে পুরোপুরি ইসলাম বিরোধী হিসেবে পরিগণিত করেন এবং জোরেশোরে তাদের বিরোধিতা করেন। এই মুক্ত ও সত্য কথনের কারণে দুনিয়ার একটি বিপুল বিরাট অংশ তাঁর শত্রুতে পরিণত হয় এবং তাদের শত্রুতার জের আজো চলে আসছে। তাঁর সমকালীন লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে তাঁকে একাধিকবার কারাগারে পাঠান, আর পরবর্তীগণ তাঁর বিরুদ্ধে কুফরী ও গোমরাহির ফতোয়া প্রদান করে নিজেদের কলিজা ঠাণ্ডা করেন। কিন্তু নির্ভেজাল ও সত্যিকার ইসলামের আনুগত্যের যে শিংগা তিনি ফুঁকেছিলেন তার বদৌলতে সমগ্র দুনিয়ায় একটি স্থায়ী আলোড়ন সৃষ্টি হয়-তার প্রতিধ্বনি আজও শ্রুত হচ্ছে। এই সংস্কারমূলক কার্যাবলীর সাথে সাথে তিনি তাতারীদের বর্বরতা ও পাশবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে অন্ত্রধারণ করে সংগ্রাম ক্ষেত্রেও অবতীর্ন হন। তৎকালে মিসর ও সিরিয়া এই সয়লাবের আওতাভুক্ত ছিল। ইমাম ইবনে তাইমিয়া সেখানকার সাধারণ মুসলমান ও বিত্তশালীদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলেন এবং তাদেরকে তাতারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ করেন। তাঁর সমকালীন লোকেরা সাক্ষ্য দেয় যে, মুসলমানেরা তাতারীদের ভয়ে এতই সন্ত্রস্ত থাকতো যে, তাদের নাম শুনেই কেঁপে উঠতো এবং তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে ভয় করতো। কিন্তু ইবনে তাইমিয়া তাদের মধ্যে জেহাদের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে তাদের সুপ্ত বীরত্বকে জাগ্রত করেন। তবুও একথা সত্য যে, তিনি এমন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হননি, যার ফলে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিপ্লব সূচিত হতো এবং কর্তৃত্বের চাবিকাঠি জাহেলিয়াতের রাষ্ট্র হাত থেকে ইসলামের হাতে স্থানান্তরিত হতো।
শায়খ আহমদ সরহিন্দি (র)
হিজরী সপ্তম শতকে তাতারী ফিতনা হিন্দুকুশ পর্বতের ওদিকের সমগ্র ভুখণ্ডকে নেস্তনাবুদ করে দেয়, কিন্তু হিন্দুস্তান তার অশুভ ছোবল থেকে রেহাই পায়। ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কারণে এখানকার সুধী ও নেতৃসমাজের মনে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়। দুনিয়ার বাহ্যিক চাকচিক্যে মুগ্ধ ব্যক্তিরা হামেশাই এই ভ্রান্ত ধারণার সম্মুখীন হয়েছে। খোরাসান ও ইরাকের যাবতীয় দুষ্কৃতি এখানে লালিত হতে থাকে। এখানেও চলে বাদশাহের খোদায়ী কর্তৃত্ব। আমির-ওমরাহ ও বিত্তশালীদের বিলাসিতা অন্যায়ভাবে অর্থোপার্জন ও অন্যায় পথে ব্যয় এবং জুলুম নির্যাতনের রাজত্ব অবাধে চলতে থাকে। খোদা সম্পর্কে গাফলতি ও দ্বীনের সহজ-সরল পথ থেকে দূরে অবস্থান করার নীতি এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। ধীরে ধীরে বাদশাহ আকবরের শাসনামলে পৌঁছে গোমরাহী তার শেষ সীমান্তে উপনীত হয়।
আকবরের দরবারে এ ধারণা অত্যান্ত প্রবল ও ব্যাপক ছিল যে, ইসলাম মূর্খ ও অশিক্ষিত বুদ্ধুদের মধ্যে জন্মলাভ করেছিল। তা কোনো সুসভ্য ও সংস্কৃতিবান জাতির উপযোগী নয়। নবুয়্যাত, ওহি, হাশর-নশন, বেহেশত ও দোজখ প্রভৃতি ইসলামের মূল আকিদা-বিশ্বাসসমূহ বিদ্রূপের বস্তুতে পরিণত হয়। কোরআনের খোদার কালাম হবার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা হয়। ওহির অবতরণ বুদ্ধিবিরোধী গণ্য হয়। মৃত্যুর পর শাস্তি ও পুরস্কার অনিশ্চিত বলে বিবেচিত হয়। তবে জন্মান্তরবাদ সকল দিক দিয়েই সম্ভবপর ও সত্য বলে গৃহীত হয়। নবীর মিরাজকে প্রকাশ্যে অসম্ভব গণ্য করা হয়। নবী করীমের (স) ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করা হয়। বিশেষ করে তাঁর সহধর্মিনীদের সংখ্যা ও তাঁর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত জেহাদসমূহের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আপত্তি করা হয়। এমন কি আহমদ ও মুহাম্মদ শব্দও বিরক্তিকর ঠেকে এবং যাদের নামের সাথে ঐ শব্দদ্বয় যুক্ত ছিল, তাদের নাম পরিবর্তন করা হয়। স্বার্থবাদী আলেমগণ নিজেদের বইপত্রের ভূমিকায় নাত লেখা বন্ধ করে। অনেক জালেম গোস্তাখীর চরম সীমানায় উপনীত হয়ে দাজ্জালের চিহ্ন সমূহ মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের মধ্যে আবিষ্কার করে ———শাহী দেওয়ানখানায় নামাজ পড়ার মতো বুকের পাটা কারুর ছিল না। আবুল ফজল নামায রোজা, হজ্জ ও অন্যান্য ইসলামী ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কঠোর আপত্তি উত্থাপন করে এবং এগুলোকে উপহাস করে। কবিকুল এসব ঐতিহ্যের নিন্দাবাদে কাব্য রচনা করে। এসব কাব্য-কবিতা সাধারণ মানুষের নিকটও পৌঁছায়।
বাহাই মতবাদের ভিত্তি আসলে আকবরের জামানায় স্থাপিত হয়। এ সময়েই এ মত পেশ করা হয় যে, মুহাম্মদ (স) এর পর এক হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং এ দ্বীনের মেয়াদও ছিল এক হাজার বছর। তাই বর্তমানে এ দ্বীন বাতিল হয়ে গেছে এবং এর স্থলে এখন নতুন দ্বীনের প্রয়োজন। মুদ্রার মাধ্যমে এ মতবাদের প্রচার শুরু হয়। কেননা সেযুগে এইটিই ছিল প্রচারণার সবচাইতে শক্তিশালী মাধ্যম। অতঃপর একটি নয়া দ্বীন ও একটি নয়া শরিয়তের ভিত্তি স্থাপন করা। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মকে মিলিয়ে একটি মিশ্রিত নতুন ধর্ম তৈরী করা যাতে করে সরকারের শাসন শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। দরবারের তোষামোদকারী হিন্দুরা নিজেদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে ভবিষ্যদ্বাণী শুনাতে থাকে যে, অমুক যুগে একজন গোরক্ষক মহাত্মা বাদশাহ জন্মলাভ করবেন। অনুরূপভাবে অর্থপূজারী আলেমগণও আকবরকে মেহদী, যুগস্রষ্টা, মুজতাহিদ, ইমাম প্রভৃতি প্রমাণ করার চেষ্টা করে। জনৈক তাজুল আরেফিন সাহেব এতদূর অগ্রসর হন যে, তিনি আকবরকে আদর্শ মানব ও যুগনেতা হবার কারণে তাঁকে খোদার প্রতিবিম্ব বলে প্রচার করেন। সাধারণ মাণুষকে বুঝবার জন্যে বলা হয় যে, সত্য ও সততা (বিশ্বজনীন সত্য) দুনিয়ার সকল ধর্মের মধ্যেই আছে। কোনো একটি মাত্র ধর্ম সত্যের ইজারাদার নয়। কাজেই সকল ধর্মে যে সব সত্য আছে সেগুলির সমন্বয়ে একটি পূর্ণাংগ পদ্ধতি প্রণয়ন করা উচিত। জনগণকে ব্যাপকভাবে সেদিকে আহবান করতে হবে, যাতে করে সকল র্ধমের বিরোধের অবসান ঘটে। এই পূর্ণাংগ পদ্ধতির নাম দ্বীনে ইলাহী। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ আকবর খলিফাতুল্লাহ এই নতুন ধর্মের কলেমা নির্ধারিত হয়। যারা নতুন ধর্মে প্রবেশ করতো, তাদেরকে তাদের পিতা-প্রপিতাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত দ্বীন ইসলাম থেকে তওবা করে দ্বীনে ইলাহী আকবর শাহী এর মধ্যে প্রবেশ করতে হতো। আর দ্বীনে ইলাহীতে প্রবেশ করার পর তাদেরকে ‘চেলা’ আখ্যা দেয়া হতো। সালামের পদ্ধতি পরিবর্তন করে নিয়ম করা হয় যে, সালামকারী ‘আল্লাহু আকবর’ ও জবাবদাতা ‘জাল্লে জালালুহু’ বলবে। মনে রাখবেন বাদশাহর নাম জালালুদ্দিন ও তাঁর উপাধি ছিল আকবর। চেলাদেরকে বাদশাহর চিত্র দেয়া হতো তারা সেটি পাগড়ির গায়ে লাগিয়ে রাখতো। রাজপূজা এ ধর্মের একটি অংশ ছিল। প্রত্যেক দিন সকালে বাদশাহর দর্শনলাভ করা হতো। বাদশাহকে দর্শন করার সৌভাগ্য লাভ করার পর তাঁকে সিদজা করা হতো। আলেম ও সুফিগণ তাঁদের কামনা -বাসনা পূরণের এই কেবলা ও কাবাকে বেধড়ক সিজদা করতো এবং এই সুস্পষ্ট শের্ককে ‘সম্মানের সিজদা’ ও ‘মৃত্তিকা চুম্বন’ এর ন্যায় শব্দের আবরণে ঢেকে রাখতো। নবী (স) এই অভিশপ্ত বাহানাবাজী সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এমন এক যুগ আসবে যখন লোকেরা হারাম জিনিসের নাম পরিবর্তন করে তাকে হালাল বলে গণ্য করবে।
এই নতুন ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করার সময় বলা হয়েছিল যে, পক্ষপাতহীনভাবে সকল ধর্মের ভালো কথাগুলো এতে গ্রহণ করা হবে;কিন্তু আসলে ইসলাম ছাড়া প্রত্যেক ধর্মের এতে স্থান হয়। এবং একমাত্র ইসলাম ও ইসলামী আইন কানুনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হয়। অগ্নি উপাসকদের নিকট থেকে অগ্নি-পুজাকে গ্রহণ করা হয়। আকবরী মহলে চিরস্থায়ী আগুন জ্বালানো হয় এবং বাতি জ্বালাবার সময় সম্মানের সংগে দাঁড়াবার রীতি প্রচলন করা হয়। ঈসায়ীদের নিকট থেকে ঘন্টা বাজানো তিন প্রভুর প্রতিকৃতির পূজা এবং এই ধরণের কতিপয় জিনিস গ্রহণ করা হয়। সবচাইতে বেশী মেহেরবানী করা হয় হিন্দুধর্মের ওপর। কেননা এটি ছিল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম এবং রাজশাসনের ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্যে একে তোয়াজ করার প্রয়োজন ছিল। কাজেই গরুর গোশত হারাম ঘোষণা করা হয়। হিন্দুদের উৎসবসমূহ যেমনঃ দেওয়ালী, দশোহারা, রাখী, পূণম, শিররাত্রি প্রভৃতিকে পূর্ণ হিন্দুরীতি অনুযায়ী পালন করার ব্যবস্থা করা হয়। রাজমহলে প্রতিদিন হাওয়ান অনুষ্ঠিত হতে থাকে। প্রতিদিন চার বার সূর্যোপসনা করা হতো। সূর্যোর একহাজার নাম জপ করা হতো। সূর্যের নাম উচ্চারিত হলে সঙ্গে সঙ্গে বলা হতো তার শক্তি মহান। কপালে তিলক লাগানো হতো। কোমর ও কাঁধে পৈতা বাধা হতো। গরুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। জন্মান্তরবাদকে স্বীকার করে নেয়া হয় এবং ব্রাহ্মণদের নিকট থেকে তাদের অন্যান্য বহু আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করা হয়। ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মের সাথে এ ব্যবহার করা হয়। আর ইসলামের ব্যাপারে বাদশাহ ও তাঁর দরবারীদের প্রতিটি কার্যই প্রমান করছিল যে, ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের মন বিদ্বেষ পরিপূর্ণ। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পক্ষ থেকে দরবারের মেজাজ অনুযায়ী দার্শনিক ও সুফিদের ভাষায় ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে যে কথা পেশ করা হতো তাকে আসমানি ওহি মনে করা হতো এবং তার মোকাবিলায় ইসলামী শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করা হতো। মুসলমান আলেমগণ যদি ইসলামের পক্ষ থেকে কোন কথা বলতেন অথবা কোন গোমরাহির বিরোধিতা করতেন তাদেরকে ফকিহ আখ্যা দান করা হতো। তাদের বিশেষ পরিভাষায় এর অর্থ ছিল বির্বোধ ব্যক্তি এবং যে ব্যক্তির কথায় কর্ণপাত করার প্রায়োজন হয় না। ধর্মসমূহ সম্পর্কে অনুসন্ধান করার জন্যে চল্লিশ ব্যক্তির একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি অত্যন্ত উদারতা ও ভক্তির সংগে বিভিন্ন ধর্মসমূহ অধ্যায়ন করে কিন্তু ইসলামের নাম উঠতেই তার প্রতি বিদ্রুপবান নিক্ষেপ করা হতো; আর কোন ইসলাম সমর্থক এর জবাব দিতে চাইলে তার মুখ বন্ধ করে দেয়া হতো। ইসলামের সঙ্গে শুধু এ আচরন করেই ক্ষান্ত থাকা হয়নি বরং কার্যতঃ প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে ইসলামী নির্দেশাবলী পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়। সূদ, জুয়া ও শরাবকে হালাল করা হয়। নওরোজ উৎসবে রাজসভায় শরাব ব্যবহার অপরিহার্য ছিল। এমন কি কাজী ও মুফতি পর্যন্ত শরাব পান করে ফেলতো। দাঁড়ি চেঁছে ফেলার ফ্যাশান প্রবর্তন করা হয় এবং বৈধতার স্বপক্ষে প্রমাণ পেশ করা হয়। চাচাত ও মামাত বোনদের সঙ্গে বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পুরুষদের জন্যে ১৬বছর ও মেয়েদের জন্যে ১৪বছর বিয়ের বয়স নির্ধারিত হয়। একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। রেশম ও স্বর্ণের ব্যবহার বৈধ গণ্য করা হয়। সিংহ ও বাঘের গোশত হালাল ঘোষণা করা হয় এবং ইসলামের প্রতি জিদের বশর্তী হয়ে শূকরকে শুধু পাকই নয় বরং একটি অতি পবিত্র প্রাণী বলে ঘোষণা করা হয়। এমন কি সকালে বিছানা ছেড়ে সর্বপ্রথম শূকর দর্শনকে বড়ই মোবারক মনে করা হতো। মৃত দেহকে কবরস্থ করার পরিবর্তে পুড়িয়ে ফেলা বা পানিতে ভাসিয়ে দেওয়াকে ভালো গণ্য করা হয়। আর যদি কেউ একান্তই কবরস্থ করতে চাইতো তাহলে পদদ্বয় কেবলার দিকে স্থাপন করার জন্যে তাকে পরিমর্শ দেয়া হতো। আকবর নিজেও ইসলামের প্রতি জিদের বশবর্তী হয়ে পদদ্বয় কেবলার দিকে রেখে শয়ন করতেন। সরকারের শিক্ষানীতিও পূর্ণ ইসলাম বিরোধী ছিলো। আরবী ভাষা শিক্ষা এবং ফিকাহ ও হাদীস অধ্যায়নকে অপছন্দ করা হতো। যারা এসব বিদ্যা অর্জন করতো তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা হতো। দ্বীনি এলমের পরিবর্তে দর্শন, তর্কশাস্ত্র, অংক, ইতিহাস ও এই ধরণের অন্যান্য বিদ্যাসমূহ সরকারী সাহায্য লাভ করে। ভাষার মধ্যে হিন্দী রীতি সৃষ্টি করার দিকে বিশেষ আগ্রহ ছিল। আরবী শব্দবলীকে ভাষার চৌহদ্দি থেকে বহিষ্কৃত করারও প্রস্তাব ছিলো। এ অবস্থায় দ্বীনি মাদ্রাসাগুলো ছাত্র শূন্য হয়ে যেতে থাকে এবং অধিকাংশ আলেম দেশত্যাগ করতে শুরু করে।
এ ছিল সরকারের অবস্থা। অন্যদিকে জনগণের অবস্থাও এর চাইতে মোটেই উন্নত ছিল না। বিদেশগতরা ইরান ও খোরাসানের নৈতিক ও আকিদাগত ব্যাধি সঙ্গে করে এনেছিল। আর যারা ভারতে মুসলামান হয়ে ছিল তাদের ইসলামী শিক্ষা ও অনুশীলনের কোন বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না। তাই তারা পুরাতন জাহেলিয়াতের বহু রীতি-পদ্ধতি তাদের চিন্তা ও বাস্তব জীবনে ধারণ করেছিল। এই দুই ধরনের মুসলমানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এক অদ্ভুত মিশ্রণ তৈরী হয়েছিল। তার নাম দেয়া হয়েছিল ইসলামী তমুদ্দুন। তাতে শের্কের সংমিশ্রণ ছিল, বংশ ও শ্রেণীভেদ ছিল, কাল্পনিক ও পৌঁরাণিক চিন্তা ধারণা ছিল এবং নব আবিষ্কৃত রসম-রেওয়ায়েজ সম্বলিত একটি নতুন শরিয়তও ছিল। দুনিয়াপূজারী ওলামা ও মাশায়েখগণ শুধু এই অদ্ভুত মিশ্রণটির সাথে সহযোগিতা করেই ক্ষান্ত থাকেনি বরং তারা এই নতুন ‘মত’ এর পৌরহিত্যও গ্রহণ করেছিল। জনসাধারণ তাদেরকে নজরানা পেশ করতো আর তারা জনগণকে মযহাবী বিরোধের তোহফা দান করতো।
পীরসাহেবানদের মাধ্যমে আর একটি রোগও বিস্তার লাভ করেছিল। নয়াপ্লেটোবাদ, বৈরাগ্যবাদ (Stoicism) , মনুবাদ ও বেদান্তবাদের সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত ধরণের দর্শন ভিত্তিক তাসাউফ জন্মলাভ করে। ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস ও নৈতিক ব্যবস্থায় তাকে স্থান দেয়া হয়। তরিকত ও হকিকতকে ইসলামী শরীয়ত থেকে পৃথক এবং তার থেকে মুখাপেক্ষীহীন গণ্য করা হয়। বাতেনের এলাকা জাহের থেকে পৃথক করে নেয়া হয়। এ এলাকার আইনে হালাল ও হারামের সীমানা বিলুপ্ত ইসলামী বিধিনিষেধসমূহ কার্যতঃ বাতিল এবং সমস্ত ক্ষমতা ইন্দ্রিয় লিপ্সার হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। ইচ্ছা মতো কোনো হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করা ছিল এ আইনের বৈশিষ্ট। এই সাধারণ পীরদের থেকে যার অবস্থা ভালো ছিল সেও কম বেশী ঐ দর্শন ভিত্তিক তাসাউফ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বিশেষ করে সর্বেশ্বরবাদের ভ্রান্ত ধারণা সমস্ত কর্মক্ষমতা হরণ করে নেয়।
এহেন পরিস্থিতিতে আকবরের শাসনামলের প্রথম দিকে শায়খ আহমদ সরহিন্দি জন্মগ্রহন করেন১৬। সেকালের সর্বাধিক উন্নত চরিত্রের লোকদের নিকট তিনি শিক্ষালাভ করেন। তাঁরা নিজেদের চতুষ্পার্শের বিকৃতির মোকাবিলা করার ক্ষমতা না রাখলেও কমপক্ষে নিজেদের ঈমান ও আমলকে সংরক্ষিত রেখেছিলেন এবং যথাসাধ্য অন্যের সংশোধনও করতেন। বিশেষ করে হযরত শায়খ আহমদ সবচাইতে বেশী লাভবান হন হযরত বাকিবিল্লাহর সাহচর্যে। হযরত বাকিবিল্লাহ সে যুগের অন্যতম উন্নত চরিত্র সম্পন্ন বুজর্গ ছিলেন। কিন্তু হযরত শায়খের নিজের যোগ্যতাও ছিল অপরিসীম। হযরত বাকিবিল্লাহর সাথে তাঁর প্রথম সংযোগ স্থাপিত হয় তখনই হযরত বাকিবিল্লাহ তাঁর সম্পর্কে নিজের এক বন্ধুকে নিম্মলিখিত পত্র লেখেনঃ
“সম্প্রতি সরহিন্দ থেকে শায়খ আহমদ নামে এক ব্যক্তি এসেছে। বিপুল দ্বীনি জ্ঞানের অধিকারী। কর্মক্ষমতাও ব্যাপক। ফকিরের সাথে কয়েকদিন তার আলোচনা হয়েছে। এ সময়ে তার যে অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছি তার পরিপ্রক্ষিতে আশা করা যায় যে, পরবর্তীকালে এ ব্যক্তি একটি আলোকবর্তিকার আকারে সমগ্র দুনিয়াকে উজ্জল করবে”।
এ ভবিষ্যদ্বাণী পরাবর্তীকালে সত্য প্রমাণিত হয়। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় তৎকালে বহুসত্যনুসারী ওলামা ও সুফি বর্তমান ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে তিনি একাই সমকালীন ফিতনাসমূহের মোকাবিলা ও ইসলামী শরিয়তের সাহায্য করার জন্যে অগ্রসর হন। রাজশক্তির মোকাবিলায় তিনি একাই ইসলামী পুনরুজ্জীবনের সংগ্রাম পরিচালনা করেন। এই নিঃসহায় ও নিঃসম্বল ফকিরটি একাকী প্রকাশ্যে ও খোলাখুলিভাবে সরকারী সাহায্য পুষ্টগোমরাহীর মোকাবিলা করেন। এবং সরকারী রোষানলে পতিত শরিয়তের পক্ষ সমর্থন করেন। সরকার তাকে দমন করার জন্যে যাবতীয় অস্ত্র প্রয়োগ করে, এমনকি তাঁকে কারাগারেও প্রেরণ করে। কিন্তু অবশেষে তিনি ফিতনার গিত পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। ‘সম্মানের সিজদা’ না করার কারণে জাহাংগীর তাঁকে গোয়ালিয়র দুর্গে প্রেরণ করেন। কিন্তু অবশেষে জাহাংগীর নিজেই তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েন এবং নিজ পুত্র খুররমকে -যিনি পরবর্তীকালে শাহাজাহান উপাধি লাভ করে তখতনশীন হন -তার ছাত্রের দলে ভর্তি করে দেন। ফলে ইসলামের ব্যাপারে সরকারের বিরোধ ও বিদ্বেষ সম্মানেররূপ লাভ করে। দ্বীনে ইলাহি আকবরশাহী তার দরবারী শরিয়ত প্রণেতাদের সৃষ্ট যাবতীয় বেদআতসহ বিদায় গ্রহণ করে। ইসলামী বিধানাবলীর মধ্যে যে সমস্ত পরিবর্তন -পরিবর্ধন করা হয় তা স্বভাবতই বাতিল হয় যায়। সরকার যদিও রাজানুগত ছিল তবুও এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে এতটুকু পরিবর্তন সাধিত হয় যে, ইসলামী শিক্ষা ও শরিয়তের বিধানাবলীর ব্যাপারে তার মনোভাব কাফেরসুলভ হবার পরিবর্তে হয় ভক্তসূলভ। শায়খের মৃত্যুর তিন-চার বছর পর আলমগীরের জন্ম হয়। সম্ভবতঃ শায়খের পরিব্যাপ্ত সংস্কারমূলক কার্যবলীর প্রভাবেই তৈমুর বংশে এই শাহযাদাটি এমন তত্ত্বগত ঔ নৈতিক শিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হন যার ফলে আকবরের ন্যায় শরিয়ত ধ্বংসকারীর প্রপুত্র শরিয়তের খাদেম পরিণত হন।
শায়খের কার্যাবলী শুধু এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় যে, ভারতের রাষ্ট্র কর্তৃত্বের পূর্ণতঃ কুফরীর দিকে চলে যাবার পথে তিনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন এবং আজ থেকে তিন -চারশো বছন আগে এখানে ইসলামের নাম নিশানা মিটিয়ে দেবার জন্যে যে বিরাট ফিতনার সয়লাব প্রবাহিত হয় তার গতিধারাও পরিবর্তিত করে দেন। বরং এছাড়া আরো দুটো বিরাট কার্যও তিনি সম্পাদন করেন। এক, দার্শনিক ও বৈরাগ্যবাদী ভ্রষ্টতার কারণে তাসাউফের নির্মল ঝরণাধারায় যেসব ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত হয়ে যায়, তা থেকে তাকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে ইসলামের নির্ভেজাল ও আসল তাসাউফ পেশ করেন। দুই, তৎকালে জনসাধারণের মধ্যে যে সব জাহেলি রসম -রোওয়াজ বিস্তার লাভ করে তিনি তার কঠোর বিরোধিতা করেন এবং আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব ও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে শরিয়ত অনুসারিতার এক শক্তিশালী আন্দোলন পরিচলনা করেন। এই আন্দোলনের হাজার হাজার সুদক্ষ কর্মী কেবল ভারতের বিভিন্ন এলাকায়ই নয় বরং মধ্য এশিয়ায়ও পৌঁছে যায় এবং সেখানকার জনগণের চরিত্র ও আকিদার সংস্কার সাধনের প্রচেষ্টা চালায়। এই কার্যাবলীর কারণেই হযরত শায়খ সরহিন্দি মুসলিম মুজাদ্দিদগণের মধ্যে স্থানলাভ করেছেন।