পরিশিষ্ট
ইতিপূর্বে পঞ্চম সংস্করণের (উর্দূ) ভুমিকায় বলা হয়েছে যে, এই কিতাবের সাথে একটি পরিশিষ্ট সংযোজিত হয়েছে। এ কিতাবের আলোচনায় আমি যে সব প্রসংগের অবতারণা করেছি সে সম্পর্কে মাঝে মাঝে যে সব প্রশ্ন করা হয়েছে এবং তার যে জবাব আমি দিয়েছি, তা একত্রিত করে পাঠকবর্গের সম্মুখে উপস্থাপিত করাই এর উদ্দেশ্য। বিভিন্ন ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় যে সব প্রশ্ন আমা র নিকট এসেছে, তা জবাব সহ এখানে উদ্ধৃত করছি। আমা করি, এগুলি অধ্যয়ন করার পর -আর যাঁদের মনে এ ধরনের প্রশ্নও সন্দেহ আছে-তাদের প্রশ্নও সন্দেহ নিরসনের জন্যেও এগুলো যথেষ্ট কার্যকরী হবে।
তাজদীদের প্রকৃতি ও ইমাম মেহদী
প্রশ্ন
ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন কিতাবটি যে কত উন্নতমানের আলোচনা সম্বলিত তা ‘মুজাদ্দিদের কাজ কি?’ শিরোনামায় লিখিত প্রবন্ধ ও বিভিন্ন মুজাদ্দিদগণের কার্যাবলীর বিস্তারিত বিবরণ থেকে যে কোন বিচক্ষণ ব্যক্তি অবশ্যি অনুমান করতে পারবেন। তবুও এর কয়েকটি দিক ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। সেগুলি নীচে উল্লেখ করছিঃ
(১) ইমাম গাজ্জালীর (র) আলোচনার শেষের দিকে আপনি যে তিনটি দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ (ক) হাদীসে শাস্ত্রে ইমামের দুর্বলতা, (খ) তাঁর ওপর যুক্তিবাদিতার আধিপত্য এবং (গ) তাসাউফের দিকে প্রয়োজনাতিরিক্ত ঝুঁকে পড়া। ইমামের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ এহইয়াউল উলুম ও কিমিয়ায়ে সাআদাত থেকে কি এসবের প্রমাণ পাওয়া যায়? এ কিতাব গুলোয় তিনি যে তাসাউফ বর্ণনা করেছেন, তা কি ত্রুটি মুক্ত নয়? উপরন্ত যুগের মুজাদ্দিদকে কি তাঁর সমকালীন ব্যক্তিবর্গের তুলনায় বেশী পরিমাণ নির্ভুল জ্ঞান দান করা হয় না? অন্যথায় সমগ্র যুগে তিনি বৈশিষ্টের অধিকারী হন কেন?
(২) মুজাদ্দিদে আলফিসানি ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ সম্পর্কে আপনি লিখেছেন যে, হযরত মুজাদ্দিদে আলফিসানির যুগে থেকে নিয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর প্রতিনিধিবৃন্দের সময় পর্যন্ত যাবতীয় সংস্কারমূলক কাজে যে জিনিসটি প্রথম আমার চোখে বাধে, তা হলো এই যে, তাঁরা তাসাউফের ব্যাপারে মুসলমানদের রোগ পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেনিন এবং অজানিতভাবে তাঁদের কে পুনর্বার সেই খাদ্য দান করেন যা থেকে তাদেরকে পূর্ণরূপে দূরে রাখার প্রয়োজন ছিল। হযরত মুজাদ্দিদ ও শাহ সাহেব সম্পর্কে এ কথা মেনে নেয়া কঠিন যে, তাঁদের দৃষ্টি এতো অপরিপক্ক ছিল যার ফলে তাসাউফের বাপারে মুসলমানদের রোগ সম্পর্কে তাঁরা পুরোপুরি ধারণা করতে পারেননি। তাঁরা জাগতিক বিদ্যার সাথে সাথে আধ্যাত্মিক বিদ্যারও (কাশফ ও ইলহামের মাধ্যমে ) যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। তাছাড়া তাঁরা মুজাদ্দিদ হবার দাবীও করেন, এ কথা মওলানা আজাদ তাঁর ‘তাজকিরা’য় উল্লেখ করেছেন। হযরত মুজাদ্দিদ তাঁর পত্রাবলীতে লিখেছেন যে, নবুয়্যাতের হাজার বছর পর তিনিই মুজাদ্দিদরূপে আগমন করেছেন। এসব কথার পরিপ্রক্ষিতে স্বভাবিকভাবে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলোর উদ্ভব হয়ঃ
(ক) হযরত মুজাদ্দিদ ও শাহ সাহেব নিজেদেরকে যে মুজাদ্দিদ বলে ঘোষনা করেন তাদের ও ঘোষনা কি খোদার নির্দেশানুযায়ী ছিল না? উপরন্ত তাদের রচনাবলীতে যে কাশফ ও ইলহামের উল্লেখ আছে তাঁর তাৎপর্য কি? তাঁরা শরিয়তের আইন অনুযায়ী মুজাদ্দিদ হন, না প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী?
(খ) এই ধারণা কি সত্য যে, মুজাদ্দিদ অবশ্যি তাঁর জামানার বিশিষ্ট ব্যক্তি হন? তিনি শ্রেষ্ঠতম শরিয়তবিদ ও দ্বীনি তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী হন? এবং এই সংগে তিনি খোদার নিকটতম ব্যক্তি ও হন? অন্যথায় আর সবাইকে বাদ দিয়ে একমাত্র তাঁকে এই বিরাট কার্য সম্পাদনের জন্যে নির্বাচিত করা হয় কেন?
(গ) ‘মুবাশশিরাত’-সুসংবাদসমূহের তাৎপর্য কি?
(ঘ) প্রতি শতকের অগ্রভাগে একজন করে মুজাদ্দিদের আগমন হবে, এ হাদীস কি সত্য নয়? আর নিজের মুজাদ্দিদ হওয়া সম্পর্কে কি তিনি অবগত থাকবেন না? এটা কি তার জন্যে জরুরি নয়?
(৩) ইমাম মেহদী সম্পর্কে আপনি লিখেছেন যে, তিনি সাধারণ আলেমগণের বর্ণনা থেকে অনেক ভিন্ন ধরণের হবেন। অথচ আলেমগনের নিকট শুনেছি যে, ইমামের নাম ও বংশ ছাড়াও আরো ভিন্ন আলামত হাদীসে উল্লেখিত আছে। তিনি বিশেষ পরিবেশে বিশেষ আলামতসহ আবির্ভূত হবেন। লোকেরা তাঁকে চিনে ফেলবে এবং জোরপূর্বক তাঁর হাতে বায়েতত হয়ে তাঁকে শাসক নিযুক্ত করবে। আর ইত্যবসরে আসমান থেকে আওয়াজ আসবে যে, ইনি আল্লাহর খলিফা ইমাম মেহদী। কিন্তু আপনি বলছেন যে, দাবীর মাধ্যমে কার্যারম্ভ করার অধিকার নবী ছাড়া আর কারুর নেই এবং নবী ছাড়া আর কেউ -ই নিশ্চিতভাবে জানেন না যে, তিনি কোন খেদমতে নিযুক্ত হয়েছেন। মেহদীবাদ দাবী করার জিনিস নয়, কাজ করে দেখিয়ে দিয়ে যাবার জিনিস। এ ধরনের দাবী যারা করেন আর যারা তার উপর ঈমান আনেন, আমার মতে তারা উভয়ই নিজেদের জ্ঞানের স্বল্পতা ও নিম্নস্তরের মানসিকতার পরিচয় দেন।
আমার প্রশ্ন হলো উপরোল্লিখিত আলামত ও অবস্থা বহু আলেম (যেমন মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর বই বেহেশতী জেওর দেখুন) বর্ণনা করেছেন। তাঁদের এই বর্ণনাবলী কি নির্ভুল হাদীস ভিত্তিক নয়? যদি হয়ে থাকে, তাহলে আপনার বর্ণনার পেছনে কি যুক্তি আছে?
জবাব
আপনার প্রশ্নাবলীর জবাব দেবার পরিবর্তে আমি কতিপয় বিষয়ৈর ব্যাখ্যা করা জরুরী মনে করি যেগুলি হৃদয়ংগম করার পর আপনার বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন।
একঃ আমাদের নিকট এমন কোন উপায়-উপকরণ নেই, যার মাধ্যমে আমরা নিশ্চয়তা সহকারে একথা বলতে পারিযে, উমুক ব্যক্তি মুজাদ্দিদ ছিল আর উমুক ছিল না। কোন ব্যক্তির কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে পরবর্তী যুগের লোকেরা বা তাঁর সমকালীন জনসমাজ তার মুজাদ্দিদ হওয়া বা না হওয়া সম্পর্কে রায় কায়েম করে এসেছে। আগের বহুলোক সম্পর্কে আলেম সমাজ এ রায় রাখেন যে, তাঁরা মুজাদ্দিদ ছিলেন। কিন্তু আবার অনেকে তাদেরকে মুজাদ্দিদ বলে স্বীকার করেননি। তাদের কারুর সাথে কোন আলামতও নেই যার সাহায্যে তাদের মর্যাদা নির্ধারণ করা যেতে পারে।
দুইঃ তাজদীদ কোন দ্বীনি মর্যাদার নাম নয়। কাজেই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ্ থেকে কোন ব্যক্তির শরিয়তের আইন অনুযায়ী মুজাদ্দিদ হবার প্রশ্নই নেই এবং তাঁকে মুজাদ্দিদ বলে স্বীকার করা না করার ফলে কোন ব্যক্তির দ্বীনি আকিদার ওপর ভালো-মন্দ প্রভাব পড়ে না। এটি একটি পদমর্যাদা। কোন ব্যক্তির কার্যাবলীর প্রেক্ষিতেই তাঁকে এই পদমর্যাদা দান করা হয়। কোন ব্যক্তি দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্যে যে কোন পর্যায়ের কোন কার্য সম্পাদন করেন তাঁকে মুজাদ্দিদ বলা যেতে পারে। অবশ্যি অন্য কারুর মতে ঐ ব্যাক্তির কার্যটি যদি উল্লেখিত মর্যাদার অধিকারী না হয়, তাহলে তিনি তাঁর মুজাদ্দিদের মর্যাদা অস্বীকার করতে পারে। অবিবেচক লোকেরা এ বিষয়টিকে অনর্থক গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে দিয়েছে। নবী করিম (স) যে খরব দিয়েছিলেন তা, শুধু এতটুকুনই ছিল যে, আল্লাহ তায়ালা এ দ্বীনকে বিলুপ্ত হতে দেবেন না। বরং প্রত্যেক শতকের অগ্রভাগে এমন এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের আবির্ভাব ঘটাবেন যিনি বা যাঁরা ইসলামের অস্পষ্ট চিন্তাগুলোকে পুনর্বার সুস্পষ্ট করবেন। হাদীসে উল্লেখিত মান শব্দটি আরবীতে কেবল এক ব্যক্তি অর্থে ব্যবহৃত হয় না। এর অর্থ বহু ব্যক্তিও হয়। এ হাদীসে এমন কোন শব্দও নেই যার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, মিজাদ্দিদকে মুজাদ্দিদ বলে চিনে নেওয়া জরুরী হবে।
তিনঃ কোন ব্যক্তির মুজাদ্দিদ হবার অর্থ এ নয় যে, তিনি সব দিক দিয়ে একজন ‘মরদে কামেল’ আদর্শ ব্যক্তি এবং তার কার্যবলী দোষত্রুটি মুক্ত। তাকে মুজাদ্দিদ মেনে নেবার জন্যে কেবল তার সামগ্রিক কার্যাবলীর এ সাক্ষ্য দানই যথেষ্ট যে, তা সংস্কারমূলক। কিন্তু কাউকে মুজাদ্দিদ বলে মেনে নেবার পর তাঁকে নির্দোষ ও নিষ্পাপ মনে করলে এবং তার প্রত্যেকটি কথার ওপর ঈমান আনলে আমাদের বিরাট ভুল হবে। নবীর ন্যায় মুজাদ্দিদ নিষ্পাপ হন না।
চারঃ উম্মতের মুজাদ্দিদগণের কার্যাবলীর ওপর আমি যে মন্তব্য করেছি তা অবশ্যি আমার ব্যক্তিগত অভিমত। আমার যে কোন মতের সাথে বিরোধ করার অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির আছে। আমি যেসব যুক্তির ভিত্তিতে কোন মত প্রকাশ করেছি। তার ওপর যদি আপনা নিশ্চিত হন তো ভালই, আর যদি নিশ্চিত না হন, তাহলেও কিছু আসে যায় না। তবে আমি এতটুকুন অবশ্যি চাই যে, যুক্তি ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে কোন মতকে বর্জন বা গ্রহণ করবেন বুজুর্গ পূজার প্রবণতায় প্রভাবিত হয়ে নয়।
পাঁচঃ বিগত জামানায় কোন কোন মনীষী অবশ্যি নিজেদেরকে সম্পর্কে কাশফ ও ইলহামের মাধ্যমে এ খবর দেন যে, তারা নিজেদের জামানার মুজাদ্দিদ। কিন্তু তাঁরা এ অর্থে কোন দাবী করেননি যে, তাঁদেরকে মুজাদ্দিদ মেনে নেয়া লোকদের জন্যে জরুরী এবং যে তাঁদেরকে স্বীকার করবে না সে গোমরাহ। দাবী করে তা স্বীকার করার জন্যে আহবান জানানো এবং তা স্বীকার করিয়ে নেবার চেষ্টা করা আধো কোন মুজাদ্দিদের কাজ নয়। যিনি এ কাজ করেন তিনি নিজেই তাঁর এ কাজ থেকে প্রমাণ করেন যে, তিনি আসলে মুজাদ্দিদ নন।
ছয়ঃকাশফ ও ইলহাম ওহির ন্যায় কোন নিশ্চিত জিনিস নয়। তার মধ্যে এমন কোন অবস্থা হয় না, যার ফলে যে ব্যক্তির কাশফ হয়, তিনি উজ্জল দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারেন যে, এ কাশফ বা ইলহাম খোদার পক্ষ থেকে হচ্ছে, এর মধ্যে কামবেশী বিভ্রান্তির অবকাশ আছে। এজন্যে আলেমগণ এ কথা স্বীকার করেন যে, কাশফ ও ইলহামের সাহায্যে শরিয়তের কোন বিধান প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয় না। এবং এই উপায়ে লব্ধজ্ঞান দলিল নয় এবং যে ব্যক্তির কাশফ ও ইলহামের লব্ধবস্তুর আনুগত্য করা জায়েজ নয়।
সাতঃ ইমাম মেহদী সম্পর্কে আমি এখানে যা কিছু লিখেছি আমার কিতাব ‘রিসায়েল ও মাসায়েলে’ সে সম্পর্কে এর চাইতে ও বিস্তারিত আলোচনা করেছি৩৯। মেহেরবানী করে এসব আলোচনা দেখুন। এ থেকে আপনি জানতে পারবেন যে, উল্লিখিত হাদীসগুলোর ব্যাপারে আলেমগন যে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন সে সম্পর্কে আমি কি অনুসন্ধান চালিয়েছি। আমি ঐ সকল আলেমকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করি। কিন্তু কোন আলেমের প্রত্যেকটি কথা মেনে নেবার অভ্যাস আমার নেই। (তর্জমানুল কোরআন, জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী, ১৯৫১) । (৩৯) এই গ্রন্থের ১৬১থেকে ১৭২পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত এ আলোচনা দেখুন।
কাশফ ও ইলহামের তাৎপর্য এবং কতিপয় মুজাদ্দিদের দাবী
প্রশ্ন
আপনার তর্জতানুল কোরআন পত্রিকার ১৯৫১সালের জানুয়ারী ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় এক প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন যে, ‘বিগত যুগের কতিপয় বুজুর্গ অবশ্যি নিজেদের সম্পর্কে কাশফ ও ইলহামের মাধ্যমে এ খবর দেন যে, তারা নিজেদের জামানার মুজাদ্দিদ। কিন্তু এ অর্থে কোন দাবী করেননি যে, তাঁদেরকে স্বীকার করে নেয়া লোকদের জন্যে জরুরী এবং যে তাঁদের কে স্বীকার করবে না সে গোমরাহ। আপনার এ কথা সত্য মনে হয় না। কেননা হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র) অনায়াসে দাবী করে বসেছেন যে, আমাকে আল্লাহ তায়ালা জানিয়েছেন যে, তুমি এ জামানার ইমাম। লোকদের তোমার অনুসরণকে নাজাতের উপায় মনেকরা উচিত। উদাহরণ স্বরূপ তাফহীমাতে ইলাহিয়া, দ্বিতীয় খণ্ড ১২৫পৃষ্ঠা দেখুন। হযরত শাহ সাহেবের এ দাবী সত্য ছিল কিনা? যদি তাঁর দাবী সত্য হয়, তাহলে আপনার একথা সত্য নয়, যা আপনি উপরোল্লিখিতের পর লিখেছেন যে,
“দাবী করে তাকে স্বীকার করে নেয়ার জন্যে আহবান জানানো এবং তাকে স্বীকার করাবার চেষ্টা করা আদৌ কোন মুজাদ্দিদের কাজ নয়। আবার আপনি উপেরোল্লিখিত বাক্যের পর লিখেছেনঃযে ব্যক্তি এ কাজ করে সে নিজেই নিজের কাজ থেকে একথা প্রমাণ করে যে, সে আসলে মুজাদ্দিদ নয়”।
আপনার এ কাথাগুলোর ভিত্তি কি? কোরআন মজীদ, নবী করিমের হাদীস, না আপনি নিজের ইজতিহাদের ভিত্তিতে এ ফতোয়া দিয়েছেন? একই পত্রিকার একই পৃষ্ঠায় ষষ্ঠ নম্বরে আপনি লিখেছেনঃ
“কাশফ ও ইলহাম ওহির ন্যায় কোন নিশ্চিত জিনিস নয়। তার মধ্যে এমন কোন অবস্থা হয় না, যার ফলে যে ব্যক্তির কাশফ হয় তিনি উজ্জ্বল দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারেন যে, এ কাশফ বা ইলহাম খোদার পক্ষ থেকে হচ্ছে”।
আপনার এ কথাও আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলছেন, না এটাও আপনার ইজতিহাদ? অথবা কোরআন মজীদ বা রাসূলের হাদীসের ভিত্তিতে একথা বলছেন?
মুসলিম জাতির কামেল ব্যক্তিগণের কাশফ ও ইলহামের অবস্থা যদি এই হয়ে থাকে তাহলে তারা যে উত্তম জাতি তারই বা দশা কি? অথচ পূর্ববর্তী উম্মতগণের মধ্যে মহিলারাও খোদার ওহি লাভ করতেন। আবার খোদার এমন বান্দাও ছিলেন যাদের কাশফ ও ইলহামের এমন উন্নত পর্যায়ের ছিল যে, একজন মহানবীকেও প্রশ্ন করে লজ্জিত হতে হয়। কিন্তু সুবহানাল্লাহ ! মুহাম্মদ (স) এ উম্মতের কামেল ব্যক্তিগণের কাশফ ও ইলহাম এমন অদ্ভুত ধরনের ছিল যে, এসব আল্লাহতায়ালার পক্ষে থেকে কিনা, এ সম্পর্কে তরা নিশ্চিতভাবে জানতেন না। তাহলৈ যে সমস্ত কাশফ ও ইলহামের দ্বীনের কোন লাভ ছিলনা এবং যাদের ওপর এসব অবতীর্ণ হতো তাদের ঈমান যখন এর ফলে বৃদ্ধি হতো না বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার কারণে এগুলো এক ধরনের আপদ ছিল তখন তাদের ওপর সে সমস্ত কাশফ ও ইলহাম অবতীর্ন করার আল্লাহ তায়ালার কি প্রায়োজন ছিল?
জবাব
ওহি ও ইলহামের বিভিন্ন অর্থ সংমিশ্রিত করে আপনি ভুল করেছেন। এক ধরণের ওহি আছে যাকে ‘জিবিল্লি’ বা প্রাকৃতিক ওহি বলা হয়। এর মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে তার কর্তব্য শিক্ষা দেন। এ ওহি মানুষের তুলনায় জানোয়ারদের ওপর এবং সম্ভবতঃতার তুলনায় উদ্ভিদ ও জড় পদার্থের ওপরই বেশী অবতীর্ণ হয়। দ্বিতীয় ধরনের ওহিকে বলা হয় আংশিক ওহি। এ ওহির মাধ্যমে কোন বিশেষ সময় আল্লাহ তায়ালা কোন বান্দাহকে জীবন সমস্যার মধ্যে থেকে কোন এক সমস্যা সম্পর্কে কোন জ্ঞান কোন হেদায়েত অথবা কোন কৌশল শিক্ষা দান করেন। এ ওহি সাধারণ মাণুষের ওপর প্রায়শঃই অবতীর্ণ হয়। ওহির বদৌলতেই দুনিয়ার বড় বড় আবিষ্কারসমূহ সাধিত হয়েছে। বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের ঘটনা এরি মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্যে এরি শক্তি সক্রিয় দেখা যায়। কোন বিষেশ সময় কোন প্রকার চিন্তাভাবনা ছাড়াই হঠাৎ এক ব্যক্তির মনে একটি চিন্তার উদয় হয় এবং তার মাধ্যমে তিনি ইতিহাসের গতিধারার ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করেন। হযরত মুসা (আ) মাতার ওপর এ ধরনের ওহি অবতীর্ণ হয়েছিল। এই দুই ধরনের ওহি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক আর এক ধরনের ওহি আছে যার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা নিজের কোন বান্দাকে অদৃশ্য বিষাবীতে সম্পর্কে অবগত করান, তাঁকে জীবনব্যস্থা সম্পর্কে নির্দেশ দান করেন যাতে করে তিনি সেই জ্ঞান ও নির্দেশকে সাধারণ মানুষের নিকট পৌঁছতে পারেন এবংতাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের রাজ্যে প্রবশে করাতে সক্ষম হন। এ ওহি একমাত্র নবীদের ওপর অবতীর্ণ হয়। কোরআন থেকে পরিষ্কার জানা যায়া যে, এ ধরনের জ্ঞান -তাকে ‘এলকা’, কাশফ বা ইলহাম যাই বলা হোক না কেন অথবা পারিভাষিক অর্থে তাকে ওহি আখ্যাদান করা হলেও তা একমাত্র রসুল ও নবী ছাড়া কারুর ওপর অবতীর্ণ হয় না। উপরন্ত এ জ্ঞান নবীদেরকে এমনভাবে দান করা হয়, যার ফলে এটি যে খোদা প্রদত্ত, শয়তানের অনুপ্রবেশমুক্ত এবং নিজের ব্যক্তিগত চিন্তা, ধারণা, ইচ্ছা ও বাসনার ছিটেফোটাও এর মধ্যে নেই, সে সম্পর্কে পূর্ণ বিশ্বাস ও নিশ্চয়তা লাভ করা হয়। এ জ্ঞানই শরিয়তের দলিল ও প্রমাণ স্বরূপ এবং এর আনুগত্য প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর ফরজ। এই জ্ঞান অন্য মানুষের নিকট পৌঁছাবার এবং এর ওপর ঈমান আনার জন্যে খোদার সকল বান্দার প্রতি আহবান জনাবার উদ্দেশ্যই নবীগণ নিযুক্ত হন।
নবী ছাড়া অন্য কোন মানুষ যদি কখনও এই তৃতীয় শ্রেণীর জ্ঞান লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন তাহলে তা এতোই আবছা ও অস্পষ্ট ইশারায় পর্যায়ে থাকে যে, তাকে যথাযথভাবে বুঝবার জন্যে নবীর ওপর অবতীর্ণ ওহির আলোকে সাহায্য গ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে (অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নতের মানদণ্ডে তার সত্য মিথ্যা যাচাই করা এবং সত্য হলে তার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা) এ ছাড়া যে ব্যক্তি তার ইলহামকে হেদায়েতের স্বতন্ত্র মাধ্যম মনে করে এবং নবীর ওপর অবতীর্ণ ওহির মানদণ্ডে যাচাই না করেই তাকে কার্যকরী করে এবং অন্যকেও তার অনুসরণ করার জন্যে আহবান জানায়, তার অবস্থা সরকারী টাকশালের মোকাবিলায় নিজের টাকশাল চালুকারী জাল মুদ্রা প্রস্তুতকারীর ন্যায়। তার এ কার্যই প্রমান করে যে, আসলে খোদার পক্ষ থেকে তার নিকট ইলহাম হয়নি।
এ পর্যন্ত আমি যা কিছু বললাম, কোরআনের বিভিন্ন স্থানে এ কথা গুলো সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশেষ করে সুরায়ে ‘জ্বীন’ এর আয়াতে এ বিষয়টি একেবারে দ্ব্যর্থহীন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
——————————————– আপনি যদি এ কথাটি বুঝবার চেষ্টা করেন তাহলে আপনি নিজেই জানতে পারবেন যে, উম্মতের সৎ ও সংশোধন কার্যে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গকে নবীর ন্যায় কাশফ ও ইলহাম দান না করার কারণ কি? প্রথম জিনিসটি আল্লাহতায়ালা এ জন্যে দান করেননি যে, নবী ও উম্মতের মধ্যে এরি ভিত্তিতে পার্থক্য সুচিত হয়েছে। কাজেই একে কেমন করে দূর করা যেতে পারে। আর দ্বিতীয় জিনিসটি দেবার কারণ হলো এই যে, নবীর পর যেসব লোক তার কার্যাবলীকে জারী রাখার চেষ্টা করেন তাঁরা ইসলামী বিধানাবলীর মধ্যে গভীর অন্তদৃষ্টি ও ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য খোদার পক্ষ থেকে সঠিক নেতৃত্বের মুখাপেক্ষী হন। এ জিনিসটি অবচেতনভাবে প্রত্যেক আন্তরিকতাসম্পন্ন ও নির্ভুল চিন্তা সমন্বিত ইসলাম সেবীকে দান করা হয়। কিন্তু যদি কাউকে সচেতনভাবে দান করা হয় তাহলে সেটা খোদর পক্ষ থেকে পুরস্কারস্বরুপ।
আপনার দ্বিতীয় মৌলিক ত্রুটি হলো এই যে, আপনি নবী ও অ-নবীর মর্যাদার নীতি গত পার্থক্যকে আদৌ বুঝেননি। কোরআনের পরিপ্রেক্ষিতে একমাত্র নবীই এ মর্যাদান অধিকারী যে, তিনি শরিয়তের বিধান অনুযায়ী খোদার পক্ষ থেকে নিযুক্ত হন এবং একমাত্র তিনিই মানুষকে তাঁর ওপর ঈমান আনার ও তাঁর আনুগত্য কবুল করার জন্যে আহবান করার অধিকার রাখেন। এমন কি যে তাঁর ওপর ঈমান আনে না সে খোদাকে স্বীকার করা স্বত্ত্বেও কাফের হয়ে যায় দ্বীনি ব্যবস্থায় নবী ছাড়া আর কেউ এ মর্যাদার অধিকারী নয়। যদি কেউ এ মর্যাদার দাবীদার হয় তাহলে আমরা তার দাবীর বিপক্ষে প্রমাণ পেশ করবো না বরং তাকে নিজের দাবীর স্বপক্ষে প্রমাণ পেশ করা উচিত্। তাঁকে অবশ্যি বলতে হবে যে কোরআন ও হাদীসে কোথায় নবী ছাড়া অন্য কাউকে এ অধিকার দান করা হয়েছে যে, তিনি মানুষের সম্মুখে তাঁর এই পদে প্রতিষ্ঠিত হবার দাবী করবেন এবং এ দাবী মেনে নেয়ার জন্যে মানুষকে আহবান জানাবেন? তাছাড়া যে এই দাবী স্বীকার করবে না সে নিছক দাবীদারের দাবীকে স্বীকার না করার কারণে জাহান্নামী ও কাফের হয়ে যাবে, একথাও অবশ্যি তাঁকে প্রমাণ করতে হবে।
এর জবাব যদি কেউ———– এর বরাত দেন অথবা মেহদীর আগমন সম্পর্কিত হাদীসগুলি পেশ করেন তাহলে আমি বলবো যে, সেখানে কোথাও মুজাদ্দিদ বা মেহদীকে উরোল্লিখিত অধিকার দান করা হয়নি। সেখানে কি এ কথা লেখা আছে যে, তাঁরা নিজেদেরকে মুজাদ্দিদ বা মেহদী বলে দাবী করেন আর যারা সে দাবী মানবে একমাত্র তারাই মুসলমান থাকবে আর বাকী সবাই কাফের হয়ে যাবে?
উপরন্ত এর জবাবে একথা বলাও অসংগত যে, যে ব্যক্তি দ্বীনের পুনরুজ্জীবন ও দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সক্রিয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সাথে সহযোগীতা না করে তাঁর বিরোধাতা করা নাজাতের কারণ হতে পারে না। এতে সন্দেহ নেই যে, এ ধরনের কাজ হামেশা হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারিতে পরিণত হয়। এ কাজের সহযোগিতা হওয়াই মানুষের হক-পরস্ত হবার আলামত। তবে এ নীতির ভিত্তিতে এ পার্থক্য সৃষ্টি হয় যে দ্বীনের পুনরুজ্জীবন ও দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালানো প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। কিন্তু কোন দাবীদারের দাবীকে স্বীকার করে নেয়া যে ঈমানের দাবী এবং নিছক এক ব্যক্তির মুজাদ্দিদ অথবা মেহদী হবার দাবী স্বীকার না করা হলেই নাজাত থেকে বঞ্চিত হতে হবে, এমন কোন কথা নেই।
এবার শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র) ও মুজাদ্দিদে আলফিসানির (র) দাবীর আলোচনায় আসা যাক। আমি এজন্য যথেষ্ট নিন্দিত যে, পূর্ববর্তী মনীষীদেরকে আমি নিষ্পাপ মনে করিনা, তাদের নির্ভুল কাজকে নির্ভুল বলার সাথে সাথে তাঁদের ভুলটিকে ও ভুল বলে থাকি। আমরা আশংকা এ ব্যাপারেও যদি কিছু দ্ব্যর্থহীন আলোচনা করি, তাহলে আমার অপরাধগুলোর মধ্যে আরো একটি অপরাধের সংখা বেড়ে যাবে। কিন্তু দুনিয়ার মানুষের চাইতে খোদাকে অধিক ভয় করা উচিত। তাই যে যা বলুন না কেন, আমি অবশ্যি এ কথা না বলে থাকতে পারি না যে, নিজেদের সম্পর্কে এই উভয় মনীষীর মুজাদ্দিদ দাবী এবং নিজেদের বক্তব্যকে বার বার কাশফ ও ইলহামের বরাত দিয়ে পেশ করা তাদের অন্যতম ত্রুটি। আর তাদের এই ত্রুটিই পরবর্তীকালে বহু ক্ষুদ্রমনা ব্যক্তিকে বিভিন্ন দাবী করার ও উম্মতের মধ্যে নতুন ফিতনা সৃষ্টি কার সাহস জুগিয়েছে। কোন ব্যক্তি ইসলামি পুনরুজ্জীবনের জন্যে যদি কোন কার্য সম্পাদন করার সুযোগ লাভ তাহলে তার তা সম্পাদন করা উচিত অতঃপর খোদার নিকট তার কি মর্যাদা হবে সে বিষয়টির সিদ্ধান্ত খোদার ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। আল্লাহতায়ালা মানুষের নিয়ত ও কার্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবং নিজের মেহেরবানীতে সেগুলি কবুল করে আখেরাতে মানুষকে যে মর্যাদা দান করেন সেটিই মানুষের আসল মর্যাদা। মানুষ নিজে যে মর্যাদা দাবী করে অথবা লোকেরা তাকে যে মর্যাদা দান করে সেটি তার আসল মর্যাদা নয়। নিজের জন্যে নিজেই উপাধি ও পদবী নির্ণয় করা দাবী সহকারে সেগুলি বিবৃত করা এবং নিজ মুখে নিজের মর্যাদার কথা ঘোষনা করা কোন ভালো কাজ নয়। পরবর্তী কালে সুফীসুলভ মনোভাব ও রুচি এ জিনিসটিকে বরদাশত করে নেয় এবং একে চমৎকারিত্ব দান করে। এমন কি মহান ব্যক্তিরাও এ বিষয়টির মধ্যে কোনগলদ দেখতে পাননি। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন ও মুজতাহিদ ইমামগণের আমলে এর অস্তিত্বই ছিল না। আমি শাহ সাহেব ও মুজাদ্দিদ সাহেবের কার্যকে অত্যন্ত সম্মান করিএবং তাদের কোন ভক্তের চাইতে আমি তাঁদের কে কম শ্রদ্ধা করি না। কিন্তু তাদের যেসব কার্যাবলী আমি বুঝতে অক্ষম হয়েছে, তার মধ্যে এটি অন্যমত। আর সত্যি বলতে কি তাঁরা কাশফ ও ইলহমের বরাত দিয়ে তাঁদের কথা পেশ করেন নিছক এ জন্যে আমি কখনো তাঁদের কোন কথা স্বীকার করিনি। বরং যখনই স্বীকার করেছি একমাত্র এ জন্যে স্বীকার করেছি যে, তার পেছনে শক্তিশালী প্রমাণ আছে অথবা যুক্তি ও তথ্যের দিক দিয়ে কথাটি সত্য মনে হয়। অনুরূপভাবে আমি যে তাঁদেরকে মুজাদ্দিদ মেনে নিয়েছি, এটিও আমার নিজস্ব অভিমত। তাঁদের কার্যাবলী প্রত্যক্ষ করে আমি ব্যক্তিগতভাবে এ রায় কায়েম করেছি। তাঁদের দাবীর পরিপেক্ষিতে এটিকে একটি আকিদা হিসেবে আমি গ্রহণ করিনি।
তাসাউফ ও শায়খকে ধ্যান করা
প্রশ্ন
আমি পরিপূর্ণ আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার সাথে আপনার দাওয়াত অধ্যয়ন করেছি। সলফি (চার ইমামের মযহাবের অনুসারি নয়) হওয়া সত্ত্বেও আমি নিজেকে আপনার ইসলামী আন্দোলনের একজন নগণ্য খাদেম ও সমর্থক মনে করি। এবং আমার সাধ্যমতো এ আন্দোলনকে পরিব্যাপ্ত করার জন্যে ও প্রচেষ্টা চালাই। সম্প্রতি তাসাউফ ও শায়খের ধ্যানে মগ্ন হওয়া সম্পর্কে কতিপয় বিষয় আমার মনে নানান প্রশ্নের অবতারণা করেছে। আপনি অনারব বেদআতকে ‘মোবাহ’ গণ্য করেছেন। অথচ আপনার এতদিনকার সমস্ত রচনাবলী এর বিরুদ্ধের কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করাই আমাদের সমগ্র দাওয়াতের কেন্দ্রবিন্দু, তখন খোদা না-খাস্তা যদি আমরা কোন বেদআতকে স্বীকার করে নেই, তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে সমস্ত বেদআতকে এই আন্দোলনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ দেয়া। মেহেরবানী করে আমার এই কথাগুলো সম্পর্কে চিন্তা করে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাসাউফ ও শায়খের ধ্যানে মগ্ন হওয়া সম্পর্কে আপনার মতামত কি এবং এ ব্যপারে আসল পন্থাই বা কি তা জানাবেন। আশা করি, তর্জমানুল কোরআনে বিস্তারিতভাবে বিষয়টি আলোচনা করবেন।
জবাব
আমার কোন একটি বাক্য থেকে আপনার মনে যে সন্দেহ সৃষ্টি হযেছে তা কোনদিন সৃষ্টি হতো না, যদি আপনি এ প্রসংগে আমার অন্যান্য স্পষ্ট রচনাবলীও পাঠ করতেন। যাহোক তবুও আমি আপনার প্রশ্নগুলোর সুস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত জবাব দিচ্ছি।
(১) তাসাউফ কোন একটি জিনিসের নাম নয় বরং অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন জিনিস এ নামে আখ্যায়িত হয়েছে। আমরা যে তাসাউফের সত্যতা স্বীকার করি, সেটি এক জিনিস আর যার প্রতিবাদ করি সেটি অন্য জিনিস। আবার যে তাসাউফের আমরা সংশোধন চাই, সেটি এ দুটি থেকে ভিন্নতর অন্য এক জিনিস:
ইসলামের প্রাথমিক যুগের সুফীগণের মধ্যে এক ধরনের তাসাউফের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেমন ফুযাইল বিন ইয়াজ (র) , ইব্রাহিম আদহাম (র) , মারূফ কারখী (র) এর কোন পৃথক দর্শন ছিল না, কোন পৃথক পদ্ধতি ছিল না। তাঁদের চিন্তা ও কর্ম কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ছিল। আর কোরআনের উদ্দেশ্যেই ছিল তাঁদের ঐ সব চিন্তা ও কর্মের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ খোদাকে কেন্দ্র করে এবং একমাত্র খোদার জন্যে।
——————————————-
আমরা এই তাসাউফের সত্যতা স্বীকার করি। শুধু সত্যতা স্বীকারই করি না বরং তাকে জীবন্ত ও পরিব্যাপ্ত করতে চাই।
দ্বিতীয় প্রকারের তাসাউফের মধ্যে গ্রীক দর্শন, বৈরাগ্রবাদ, জরখুষ্ট্রিয় মতবাদ ও বেদান্ত দর্শনের মিশ্রণ ঘটেছে। এতে খৃষ্টান ও হিন্দু যোগীদের পদ্ধতি শামিল হয়ে গেছে। শের্ক মিশ্রিত চিন্তা ও কর্ম এর সাথে সংমিশ্রিত হয়েছে। শরিয়ত তরিকত মারেফত এখানে পৃথক পৃথক বিষয়। তাদের পরস্পরের মধ্যে কমবেশী সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা পরস্পরের বিপরীত ধর্মী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে মানুষকে পৃথিবীতে খোদার খলীফার দায়িত্ব সম্পাদনকারী হিসেবে তৈরী করার পরিবর্তে সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজের জন্যে তৈরী করা হয়। আমরা এ তাসাউফের বিরোধাতা করি। আমাদের নিকট একে বিলুপ্ত করা খোদার দ্বীনকে কায়েম করার জন্যে আধুনিক জাহেলীয়াতের বিলুপ্তির ন্যায় সমপর্যায়ের জরুরী বিষয়।
এই দুই ছাড়া তৃতীয় এক ধরনের তাসাউফ আছে। এতে প্রথম ধরনের তাসাউফের কিছু অংশ এবং দ্বিতীয় ধরনের তাসাউফে কিছু অংশ সংমিশ্রিত অবস্থায় পাওয়া যায়। এই তাসাউফের পদ্ধতিসমূহ এমন কতিপয় মনীষী প্রণয়ন করেন যাঁরা আলেম ও সদিচ্ছা সম্পন্ন ছিলেন কিন্তু নিজের যুগের প্রধান বিষয়সমুহও পূর্ববর্তী যুগের প্রভাব থেকে পুরোপুরি সংরক্ষিত ছিলেন না। তাঁরা ইসলামের আসল তাসাউফেকে বুঝবার এবং তার পদ্ধতিসমুহকে জাহেলি তাসাউফের মিশ্রন মুক্ত করার জন্যে পূর্ণ প্রচেষ্টা চালান কিন্তু এ সব সত্ত্বেও তাদের মতবাদে জাহেলী তাসাউফের কিছু না কিছু প্রভাব এবং তাদের কার্যবলীতে বহিরাগত কার্যাবলীর কিছু না কিছু প্রভাব রয়ে গেছে। এ সম্পর্কে তাঁদের মনে এ ধারণা জন্মে যে এগুলো কোরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা বিরোধি নয় অথবা কমপক্ষে ব্যাখ্যার মাধ্যমে এগুলোকে বিরোধহীন মনে করা যেতে পারে। উপরন্ত এ তাসাউফের উদ্দেশ্য এবং ফলাফলও ইসলামের উদ্দেশ্য ও তার প্রয়োজনীয় ফলাফল থেকে কমবেশী বিভিন্ন। মানুষকে সুস্পষ্টরূপে খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার জন্যে পালন করার জন্যে তৈরী করা তার উদ্দেশ্যই নয় কোরআন বাক্য দ্বারা যে জিনিসের কথা বিবৃত করেছে তা তৈরী করাও তার উদ্দেশ্য নয়। তার মাধ্যমে এমন লোকও তৈরী হয়নি যে দ্বীনের পূর্ণ স্বরুপকে উপলব্ধি করে তাকে প্রতিষ্ঠিত করা জন্যে চিন্তা করতে এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করার যোগ্যতা সম্পন্ন হতে পারে। এই তৃতীয় শ্রেণীর তাসাউফের আমরা পূর্ণ বিরোধিতা করি না আবার পূর্ণ সমর্থনও করি না। বরং তার সমর্থক ও অনুগতদের নিকট আমাদের আরজ হলো এইযে, মেহেরবানী করে মহান ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধাকে স্বস্থানে রেখে আপনি কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে এই তাসাউফের ওপর সমালোচনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন এবং একে সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করুন। উপরন্ত যে ব্যক্তি এই তাসাউফের কোন বিষয়কে কোরআন ও সুন্নাহের বিরোধী দেখার কারণে তার সাথে মতবিরোধ করে, আপনি তার মতের সাথে বিরোধ করুন বা তাকে সমর্থন করুন -অবশ্যি তার এই সমালোচানা অধিকার অস্বীকার করতে পারেন না। এবং খামাখা তার নিন্দাবাদে মুখর হতে পারেন না।
(২) শায়খের আকৃতি ধ্যান সম্পর্কে আমার মত হলো এই যে, এ প্রসংগে দুটি দিক আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো একটি কার্য হিসেবে আর দ্বিতীয়টি হলো খোদার নিকটবর্তী হবার একটি মাধ্যম হিসেবে।
প্রথম অবস্থায় এ কার্যটির কেবল বৈধতা ও অবৈধতার প্রশ্নে ঔঠে। মানুষ কোন নিয়তে এ কার্য করে, তারি ওপর এর সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। একটি নিয়ত এমন আছে যার পরিপ্রেক্ষিতে একে হারাম বলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। দ্বিতীয় নিয়তটি এমন যার পরিপ্রেক্ষিতে কোন ফকিহর পক্ষে একে অবৈধ বলা কঠিন হয়ে পড়ে। এর দৃষ্টান্ত এমনঃ যেমন আমি কোন ব্যক্তিকে একটি অপরিচিত মহিলার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকতে দেখে তাকে জিজ্ঞাস করলাম তুমি কি করছো? সে জবাব দিলোঃ আমার সৌন্দর্য পিপাসা নিবৃত্ত করছি। বলাবাহুল্য আমাকে বলতে হবে যে, তুমি অবশ্যি একটি খারাপ কাজ করছো। অন্য একজনকে এ কাজ করতে দেখে তাকে জিজ্ঞাস করায় সে বললোঃ আমি একে বিয়ে করতে চাই। এ অবস্থায় আমাকে বাধ্য হয়ে বলতে হবে যে, তোমার এ কাজ অবৈধ নয়। কারণ সে তার এমন একটি কারণ বিবৃত করছে যাকে শরিয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ বলা যেতে পারে না।
শায়খের চিত্র ধ্যান করার দ্বিতীয় পদ্ধতিটি সম্পর্কে আমার মনে কোনদিন সন্দেহ ছিলনা, আজও নেই এবং অনেক মহান ব্যক্তির সাথে এর সম্পর্ক দেখালেও এভাবে সম্পাদিত কার্যটি পূর্নতঃ অবৈধ। আমার মতে, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করার ও তা বৃদ্ধি করার মাধ্যম বিবৃত করার ব্যাপারে আল্লাহ এবং তাঁর রসুল কখনো কোন প্রকার ত্রুটি করেননি। তাহলে তাঁদের বিবৃত মাধ্যমের ওপরই আমরা নির্ভর করবো না কেন? কেন আমরা এমন মাধ্যম উদ্ভাবন করতে সচেষ্ট হবো, যা সংশয়ে পরিপূর্ণ এবং যার ব্যাপারে সামান্য অসতর্কতা মানুষকে নিশ্চিত ও সুস্পষ্ট গোমরাহীর দিকে পরিচালিত করতে পারে?
এ প্রসংগে এ আলোচনা নিতিগতভাবে অবান্তর যে, অন্যান্য যাবতীয় ব্যাপারে যখন শরিয়তের গন্তব্য পৌঁছার জন্যে আমরা মোবাহ মাধ্যমসমুহ গ্রহণ করার অধিকার রাখি, তখন আত্মশুদ্ধি এ খোদার নৈকট্য লাভের ব্যাপারে আমাদের কেনইবা ঐ মাধ্যমসমুহ ব্যবহার করার অধিকার থাকবেনা? এ যুক্তি নীতিগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। কেননা দীনের দুটি বিভাগ পরস্পর ভিন্ন প্রকৃতির অধিকারী। একটি বিভাগ হলো খোদার সাথে সম্পর্কের আর দ্বিতীয় বিভাগটি হলো মানুষ ও দুনিয়ার সাথে সম্পর্কের। প্রথম বিভাগটির নীতি হলো এই যে, এতে খোদার ও তাঁর রসূলের বিবৃত ইবাদত ও পদ্ধতির ওপর আমাদের নির্ভর করা উচিত। এতে কোনপ্রকার কমতি বাড়তি করার অধিকার আমাদের নেই। কেননা কোরআন ও সুন্নাহ ছাড়া আমাদের নিকট খোদার জ্ঞান ও তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার পদ্ধতির জ্ঞান অর্জন করার তৃতীয় কোন মাধ্যম নেই। এ ব্যাপারে যাবতীয় হ্রাসবৃদ্ধির বেদআতের শামিল এবং প্রত্যেকটি বেদআত গোমরাহির নামান্তর। যা কিছু নিষিদ্ধ নয়, তা মোবাহ, এনীতি এখানে অচল। বরং এর বিপরীত পক্ষে এখানে নীতিত হলো এই যে, যা কিছু কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক নয়, তা বেদআত। এখানে কিয়াসের (সদৃশ ঘটনা হতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ) মাধ্যমেও যদি কোন বিষয় স্থিরিকৃত হয়, তাহলে ও অবশ্যি কোরআন ও সুন্নাতে তার কোন ভিত্তি থাকতে হবে। বিপরীত পক্ষে মানুষের সাথে সম্পর্কে ও দুনিয়ার সাথে সম্পর্কের বিভাগসমূহে মোবাহ বিষয়সমূহ সুস্পষ্ট। যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার আনুগত্য করুন। যে সম্পর্কে নিষেধ করা হয়েছে তা থেকে বিরত থাকুন। এবং যে বিষয়ে কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি, যদি তার সাঞ্জস্যশীর কোন বিষয়ে কোন নির্দেশ পাওয়া যায়, তাহলে তার ওপর কিয়াস করুন। অথবা যদি কিয়াসেরও সুযোগ না থাকে, তাহলে ইসলামের সাধারণ নীতি অনুযায়ী মোবাহ সমুহের মধ্য হতে যে বিষয় ও পদ্ধতিকে ইসলামী ব্যবস্থার মেজাজ অনুযায়ি পান, তাকে গ্রহণ করুন। এ বিভাগে আমাদেরকে এ আজাদী দান করার কারণ হলো এই যে, আমরা যেন পৃথিবী, মানুষ ও পার্থিব বিষয়াবলী সম্পর্কিত জ্ঞান আহরণ করার যুক্তি ও তত্ত্বগতউপকরণ কমপক্ষে এতটুকুন অবশ্যি অর্জন করি, যার ফলে খোদর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের নেতৃত্ব লাভ করার পর আমরা ভালোকে মন্দ থেকে এবং সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করতে পারি। কাজেই এ আজাদী কেবল ঐ বিভাগ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। তাকে প্রথম বিভাগটি পর্যন্ত বিস্তৃত করে, যা কিছু নিষিদ্ধ নয়, তাকে মোবাহ মনে করে খোদার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা অথবা অন্যের কাছ থেকে আহরণ করে তা গ্রহণ করা একটি মৌলিক ত্রুটি। এই ত্রুটির কারণে খৃষ্টানরা ‘রাহবানিয়াত’ আবিস্কার করে, কোরআনে এর নিন্দা করা হয়েছে। (তর্জমানুল কোরআন, জমাদিউল আউয়াল, ’৭১হিঃ, ফেব্রুয়ারী, ৫২খৃঃ)
একটি মিথ্যা দোষারোপ ও তার জবাব
প্রশ্ন
আপনার ওপর দোষারোপ করা হয় যে, আপনি আসলে নিজে মুজাদ্দিদ বা মেহদী হবার দাবীদার। অথবা পর্দান্তরালে থেকে নিজেকে মুজাদ্দিদ বা মেহদী বলে স্বীকার করাবার জন্যে চেষ্টা করছেন। এ দোষারোপের তাৎপর্য কি?
জবাব
তর্জমানুল কোরআনে বহুবার এ দোষারোপের প্রতিবাদ করা হয়েছে। তাই এবার কোন নতুন জবাব দেবার পরিবর্তে আমার আগের জবাবগুলোই উদ্ধৃত করছি।
সর্বপ্রথম ১৯৪১সালে মওলানা মুনাজির আহসান গীলনী করুণাবশতঃ নিম্নস্বরে আমাকে এ সন্দেহ প্রকাশ করেন। এর জবাবে আমার সন্দেহ নিরসন নামক প্রবন্ধে আমি আরজ করেছিলামঃ
“আমার সাহসসুলভ শব্দাবলী থেকে সম্ভ্বতঃ আপনার মনে এ ধারণা জন্মেছে যে, আমি নিজেকে বিরাট কিছু মনে করি এবং কোন বিরাট মর্যাদার আশা পোষণ করি। অথচ আমি যা কিছু করছি কেবল নিজের গোনাহ মাফ করাবার জন্যে করছি। নিজের মূল্য আমি খুব ভাল করেই জানি। বিরাট মর্যাদা তো দুরের কথা যদি কেবল শাস্তি থেকেও নিস্কৃতি পাই, তাহলেও আশাতিরিক্ত মনে করি”।
(তর্জমানুল কোরআন, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নবেম্বর, ১৯৪১)
অতঃপর এ সময় মওলানা সাইয়েদ সোলায়মান নদবী (র) আমার একটি বাক্য ওলট পালট করে তা থেকে এ অর্থ গ্রহণ করার চেষ্টা করেন। যে আমি মুজাদ্দিদ হবার দাবীদার। অথচ ঐ বাক্যের মধ্যে আমি নিজের নগন্য প্রচেষ্টাবলীকে দ্বীনের তাজদীদের প্রচেষ্টার মধ্যে একটি প্রচেষ্টা বলে গন্য করেছিলাম। তাঁর এই সুষ্পষ্ট দোষারোপের জবাবে আমি বলেছিলামঃ
“কোন কাজকে তাজদীদের কাজ বলার এ অর্থ হয় না যে, যে ব্যক্তি তাজদীদের কাজ করবে তাকে মুজাদ্দিদ পদবীও দান করতে হবে। আর শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হওয়া তো অনেক বড় কথা। ইট উঠিয়ে নিয়ে প্রাচীর নির্মাণ করা অবশ্যি একটি গঠনমূলক কাজ। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, যে ব্যক্তি কয়েকটি ইট উঠিয়ে নিয়ে বসিয়ে দেবে। তাকে ইঞ্জিনিয়ান বলা হবে আর ইঞ্জিনিয়ার ও সাধারণ নয় শতাব্ধীর ইঞ্জিনিয়ার? অনুরুপ ভাবে কোন ব্যক্তি নিজের কাজকে যদি তাজদিদী কাজ বা তাজদিদী প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করে যখন বাস্তবে দ্বীনের তাজদীদের উদ্দেশ্যই সে এ কাজ করে তখন সেটি হয় নিছক একটি বাস্তব ঘটনার প্রকাশ এবং তার অর্থ এ হয় না যে, সে মুজাদ্দিদ হবার দাবী করছে এবং তার শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হতে চায়। ক্ষুদ্রমনা লোকেরা অবশ্য সামান্য কাজ করে বড় বড় দাবী করতে থাকে বরং দাবীর আকারেই কাজ করার বাসনা করে। কিন্তু কোন জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট আশা করা যায় না, যে, তিনি কাজ করার পরিবর্তে নিছক দাবী করবেন। দ্বীনের তাজদীদের কাজ ভারতবর্ষে ও ভারতবর্ষের বাইরে অনেকে করেছেন। মওলানা সাহেবকেও (অভিযোগকারী) আমরা এরি মধ্যে গণ্য করি। আমিও নিজের সামর্থ মোতাবেক এ কার্যে অংশ গ্রহণ করার চেষ্টা করেছিএবং বর্তমানে আমরা কতিপয় দ্বীনের খেদমতকারী একটি জামায়াতের আকারে এ কার্য সম্পাদন করার চেষ্টা করছি। আল্লাহতায়ালা যার কাজের মধ্যে এমন বরকত দান করবেন যে, তার ফলে তার হাতে যথার্থ খোদার দ্বীনের তাজদীদের কার্য সম্পন্ন হবে, আসলে তিনিই হবেন মুজাদ্দিদ। দাবী করা বা দুনিয়ার কাউকে মুজাদ্দিদ উপাধি দান করা আসল জিনিস নয়। বরং আসল জিনিস হলো এই যে, মাণুষেকে এমন কাজ করে তার যথার্থ মালিকের নিকট পৌছতে হবে যে, সেখানে যেন সে মুজাদ্দিদের মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়। মওলানার জন্যে আমি এ জিনিসটিরই দোয়া করি। এবং তিনিও যদি অন্যের জন্যে এই দোয়া করেন যে, আল্লাহতায়ালা যেন তার সাহায্যে দ্বীনের এমনি সব কার্য সম্পাদন করেন, তাহলেই বেহতের হবে। আমি আশ্চর্য হই যে, অনেক ইসলামী শব্দ কে খামাখা বিভীষিকা বানিয়ে রাখা হয়েছে। দুনিয়ার কোন ব্যক্তি রোম জাতির গৌরব পুনরুদ্ধারের দাবী নিয়ে অবতীর্ণ হয় আর রোম জাতীয়তাবাদের পুজারিরা তাঁকে স্বাগত জানায় কোন ব্যক্তি বৈদিক সভ্যতার পুনরুজ্জীবনের দাবী নিয়ে অগ্রসর হয়, আর হিন্দুরা তাকে সমর্থন জানায়। কোন ব্যক্তি গ্রীক শিল্পকে পুররুজ্জীবিত করার ইচ্ছায় এগিয়ে আসে আর শিল্পানুরাগীরা তার হিম্মত বাড়িয়ে দেয়। এ সকল সংস্কারমূলক কার্যাবলির মধ্যে একমাত্র খোদার দ্বীনের সংস্কারটা কি এমন একটি অপরাধ যে, তার নাম উচ্চারণ করতে লজ্জা অনুভব করবে এবং কেউ এ ধরনের চিন্তা প্রকাশ করলেই খোদার পূজারীরা তার পিছনে লেগে যাবে?” – (তর্জমানুল কোরআন, ডিসেম্বর ১৮৪১, জানু, ও ফেব্রু, ১৮৪২)
এই সুস্পষ্ট বিবরনের পরও আমাদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তাঁদের প্রচারণা বন্ধ করেননি। কেননা মুসলমানদেরকে আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার জন্যে যে সমস্ত অস্ত্র প্রয়োগ করার প্রয়োজন ছিল তন্মধ্যে আমার বিরুদ্ধে কোন প্রকার দাবী করার অভিযোগ উত্থাপন করাও একটি অস্ত্র ছিল। কাজেই ১৯৪৫ও ৪৬সালে অনবরত এ সন্দেহ চতুর্দিকে ছড়ানো হয়েছে যে, এ ব্যক্তি মেহদী দাবী করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সম্পর্কে আমি ১৯৪৬ সালের জুন সংখ্যা তর্জমানুল কোরআনে লিখেছিলামঃ
“যাঁরা এ ধরনের সন্দেহ পোষণ করে মানুষকে জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত থেকে দুরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন, আমি তাদেরকে এমন একটি ভয়াবহ শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত করেছি যে, তা থেকে তারা কোনক্রমেই নিষ্কৃতি লাভ করতে পারবে না। সে শাস্তি হলো এই যে, ইনশাআল্লাহ আমি সব রকমের দাবী থেকে নিজেকে নিষ্কলুষ রেখে আমার খোদার সমীপে হাযির হয়ে যাবো এবং তারপর দেখবো যে, এরা খোদার সম্মুখে নিজেদের এইসব সন্দেহ এবং এগুলো বিবৃত করে মানুষকে হকের পথে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত রাখার স্বপক্ষে কি সাফাই পেশ করেন”।
এসব লোকের দিলে যদি কিছু পরিমাণ খোদাভীতি ও পরকাল বিশ্বাস থাকতো, তাহলে আমার এ জবাবের পর তাদের মুখে পুনর্বার এ অভিযোগ শুনা যেতো না। কিন্তু কেমন নির্ভীকভাবে আজ আবার সেই অভিযোগগুলোকে ছড়ানো হচ্ছে, তা সবাই প্রত্যক্ষ করছেন। তর্জমানুল কোরআনের সম্প্রতিক সংখ্যাসমুহে এ সম্পর্কে যা কিছু লিখেছি তা অধ্যায়ন করার পরও এদের কারুর মুখে অপপ্রচার একটু ও বাধছে না। আখেরাতের ফয়সালা অবশ্যি খোদার হাতে কিন্তু আমাকে জানান এ ধরনের কার্যকলাপের ফলে দুনিয়ায় আলেম সমাজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত থাকার আশা আছে কি?
মজার কথা হলো এই যে, ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন কিতাবের বিভিন্ন বাক্যের ওপর এসব সন্দেহের ভিত্তি স্থাপন করা হযেছে এবং তার উদ্ধৃতাংশ বিভিন্ন রঙে রঙিন করে জনসমক্ষে উপস্থাপিত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। অথচ তারই পৃষ্ঠায় আমার এ কথাগুলো আছেঃ
“দাবীর মাধ্যমে কার্যারম্ভ করার অধিকার নবী ছাড়া আর কারুর নেই এবং নবী ছাড়া আর কেউ নিশ্চিতভাবে একথা জানেন না যে, তিনি কোন কার্যে আদিষ্ট হয়েছেন মেহদী কোন দাবী করার জিনিস নয়। এ ধরনের দাবী যাঁরা করেন আর যাঁরা এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন আমার মতে তাঁরা উভয়েই নিজেদের জ্ঞানের স্বল্পতার ও মানসিক অধোগতির প্রমাণ পেশ করেন”।
আজ যেসব লোক আমার বই থেকে উদ্ধৃতাংশ পেশ করেন তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন যে, আমার ঐ বইয়ে উল্লেখিত কথাগুলো কি তাদের নজরে পড়েনি? অথবা তারা জ্ঞানের ওগুলো প্রচ্ছন্ন রেখেছেন? – (তর্জমানুল কোরআন, যিলকদ, যিলহজ্জ, ‘৭০হিঃ সেপ্টেম্বর ১৯৫১খৃঃ)
আল মেহদীর আলামত ও ইসলাম ব্যবস্থায় তার স্বরূপ
প্রশ্ন
ইমাম মেহদীর আবির্ভাব সম্পর্কে আপনি ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন কিতাবে যা লিখেছেন, তাতে দ্বিমতের অবকাশ আছে। আপনি মেহদীর জন্যে কোন বিশেষ আলামত স্বীকার করতে রাজি নন। অথচ হাদীসে মেহদীর আলামতের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে এ ক্ষেত্রে এসব হাদিসকে কেমন করে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব?
জবাব
ইমাম মেহদীর আবির্ভাব সম্পর্কে হাদীসে যে সব বর্ণনা আছে সে সম্পর্কে হাদীস বিশ্লেষনকারীগণ এত কঠোর সমালোচনা করেছেন যে, তাদের মধ্যে একটি দল আদতে ইমাম মেহদীর আবির্ভাবকে স্বীকারই করেন না। এ হাদীসগুলো যারা বর্ণনা করেছেন তাদের সমালোচান করার পর জানা যায় যে, তাদের অধিকাংশ বর্ণনাকারীই শিয়া সম্প্রদায় ভুক্ত। ইতিহাস পর্যালোচনা করেও জানা যায় যে, প্রত্যেকটি দল নিজেদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বার্থোদ্ধারের জন্যে এ হাদীসগুলো ব্যাবহার করেছেন এবং নিজেদের কোন ব্যক্তির গায়ে সংশ্লিষ্ট আলামত সমুহ লাগিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। এসব কারণে আমি এই মীমাংসায় পৌঁছেছি যে, ইমাম মেহদীর নিছক আবির্ভাবের ব্যাপারে এ হাদীসগুলের বর্ণনা সত্য কিন্তু বিস্তারিত আলামত সম্পর্কিত বর্ণনাগুলোর অধিকাংশই সম্ভ্বতঃমনগড়া এবং স্বার্থবাদীরা সম্ভবত পরবর্তীকালে এ গুলো নবী করিমের আসল বাণীর ওপর বৃদ্ধি করেছে। বিভিন্ন যুগে যেসব লোক মেহদী হবার মিথ্যা দাবী করেছে তাদের বইপত্রেও দেখা যায় যে, তাদের সকল ফেতনা সৃষ্টির মূলে এই বর্ণনাগুলোই তথ্য সরবরাহ করেছে।
নবী করিমে র (স) ভবিষ্যদ্বাণীসমুহ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করার পর আমি দেখেছি যে, তাদের ধরন কখনো মেহদির আবির্ভাব সম্পর্কিত হদিসের ন্যায় নয়। নবী করিম (স) কখনও কোন আগমনকারী বস্তুর আলামত বিস্তারিত বর্ণনা এ ভাবে দেননি। তিনি অবশ্যি বড় বড় মূল আলামত বর্ণনা করতেন কিন্তু খুঁটিনিটি বিবরণ দান তার পদ্ধতি ছিল না।
প্রশ্ন
মেহদীর আগমনের প্রয়োজনকে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন পুস্তকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে কিন্তু মেহদীর কাজ কি হবে এ সম্পর্কে হাদীসের উল্লেখ ছাড়াই নিছক নিজের কথায় বর্ণনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। হাদীসের আলোকে এগুলো বর্ণনা করাই সংগত হবে। উপরন্ত মেহদীর মর্যাদা, বৈশিষ্ট ও তার প্রতি আনুগত্যের প্রায়োজন প্রভৃতি সম্পর্কে কোন আলোচনা করা হয়নি এবং তাঁকে সাধারণ মুজাদ্দিদ গণের ন্যায় গন্য করা হয়েছে। যদিও কামিল মুজাদ্দিদ ও অপরিণত মুজাদ্দিদর শ্রেণী বিভাগ করার কারণে মনে হতে পারে যে, সম্ভবত এখানে আভিধানিক অর্থে মুজাদ্দিদ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে পারিভাষিক অর্থে নয়, তবুও মুজাদ্দিদ যখন পাপমুক্ত হন না এবং মেহদীর পাপমুক্ত হবার প্রয়োজন, তখন এই সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকার পর মেহদী কেমন করে মুজাদ্দিদের ফিরিস্তিতে শুমার করা যেতে পারে
জবাব
প্রথমতঃ হাদীসে ব্যবহৃত মেহদী শব্দটি সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত। নবী করিম (স) মেহদী শব্দ ব্যবহার করেছেন। এর অর্থ হলো সঠিক পথ প্রাপ্ত ‘হাদী’ শব্দ ব্যবহার করা হয়নি, সঠিক পথ অবলম্বনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই মেহদী হতে পারেন। বড়জোর বৈশিষ্ট প্রমান করার জন্যে আলমেহদী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর সাহায্যে আগমনকারীর কোন বিশেষ গুণ প্রকাশ করাই আসল উদ্দেশ্য আর এ বিশেষ গুণ সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে যে, আগমনকারী নবুয়্যাতের পদ্ধতিতে খেলাফতের ব্যবস্থা (খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুয়্যাত) ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার এবং পৃথিবী জুলুম নির্যাতনে ভরে যাবার পর পুনর্বার নতুন করে নবুয়্যাতের পদ্ধতিতে খেলাফত কায়েম করবেন এবং ন্যায় ই ইনসাফ দ্বারা পৃথিবীকে পরিপূণ করবেন। এ জন্যে তাঁকে বৈশিষ্ট্য শালী করার উদ্দেশ্যে মেহদী শব্দের পূর্বে আল সংযোগ করা হয়েছে। কিন্তু একথা মনে করা ভুল যে, মেহদী নামে ইসলামে কোন মর্যাদাপূর্ণ পদ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তার ওপর ঈমান আনা ও সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা নবীদের ওপর ঈমান আনা ও তাদের আনুগত্য করার ন্যায় নাজাত লাভের এবং ইসলাম ও ঈমানের জন্যে শর্তস্বরূপ। উপরন্ত মেহদী হবেন কোন নিষ্পাপ ইমাম, হাদীসে ও ধারণারও কোন অস্তিত্ব নেই। আসলে গায়ের নবীদের সম্পর্কে নিষ্পাপ হবার এই ধারণা নির্জলা শিয়া চিন্তাপ্রসূত। কোরআন ও সুন্নাহে এর কোন উল্লেখ নেই।
এ কথা ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত যে, যেসব জিনিসের ওপর ঈমান ও কুফরী নির্ভরশীল এবং যেসব বিষয়ের ওপর মাণুষের নাজাত নির্ভরশীল সেগুলো বিবৃত করার দায়িত্ব আল্লাহতায়ালা নিজের ওপর নিয়েছেন। সেসব কোরআনে বিবৃত হয়েছে। এবং কোরআনেও সেগুলো নেহাত ইশারা ইংগিতে বিবৃত করা হয়নি। বরং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সুস্পষ্টরূপে বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা নিজেও বলেন —‘মানুষকে সঠিক পথে প্রদর্শনের দায়িত্ব আমার নিজের’। কাজেই যে বিষয়টি ইসলামে এই পর্যায়ে পৌঁছে যায় তার প্রমাণ অবশ্যি কোরআন থেকে দিতে হবে। ঈমান ও কুফরী যে জিনিসটির ওপর নির্ভরশীল, নিছক হাদীসের উপর তার ভিত্তি স্থাপন করা যেতে পারে না। হাদীসে কতিপয় ব্যক্তির মাধ্যমে কতিপয় ব্যক্তির নিকট পৌঁছে। এ থেকে বড় জোর নির্ভুল ধারণা লাভ করা যেতে পারে নিশ্চিত জ্ঞান নয়। বলাবাহুল্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাহদেরকে কখনো বিপদে ফেলতে চান না। যেসব বিষয় তাঁর নিকট এত বেশী গুরুত্বপূর্ণ যে তার মাধ্যমে ঈমান ও কুফরীর পার্থক্য সৃষ্টির হয় তাকে তিনি মাত্র কতিপয় ব্যক্তির বর্ণনার ওপর ছেড়ে দিতে পারেন না। এ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলিকে অবশ্যি আল্লাহ তার কিতাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বর্ণনা করবেন। আল্লাহর রসূল সেগুলোকে নিজের পয়গম্বরীর আসল কাজ মনে করে ব্যাপক ও সাধারণ ভাবে তাদের প্রচার করবেন এবং পূর্ণ সংশয়হীন পদ্ধতিতে সেগুলো প্রত্যেক মুসলমাননের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া হবে।
মেহদী সম্পর্কে যতই টেনে -হিঁচড়ে ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, প্রত্যেক ব্যক্তিই দেখতে পারেন যে, ইসলামে তার অবস্থা এমন নয় যে তাঁকে জানার ও স্বীকার করার ওপর কোন ব্যক্তির মুসলমান হওয়া ও নাজাত লাভ নির্ভর করে। তিনি যদি এ পর্যায়ে অবস্থান করতেন তাহলে কোরআনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তা বর্ণনা করা হতো এবং নবী করিম ও (স) মাত্র দু-চারজন লোকের নিকট তা বর্ণনা করা যথেষ্ট মনে করতেন না বরং সমস্ত উম্মতের নিকট তা পৌঁছিয়ে দেবার জন্যে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতেন। তৌহিদ ও আখেরাতের কথা প্রচারের ক্ষেত্রে আমরা তাঁকে যে রূপে দেখি, এ বিষয়টি প্রচারের ক্ষেত্রে ও ঠিক সেই রূপে আমরা তাঁকে দেখতাম। আসলে যে ব্যক্তি ইসলামী জ্ঞানের ক্ষেত্রে সামান্য গভীর দৃষ্টিও রাখেন তিনি এক মুহুর্তের জন্যে একথা বিশ্বাস করতে পারেন না যে, ইসলামে যে বিষয়টির এত বেশী গুরুত্ব সেটিকে নিছক খবরে ওয়াহেদ (যে হাদীসের বর্ননাকারী কোন এক পর্যায়ে একজন দুজন বা তিনজনে এসে ঠেকে। ) এর ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। আর খবরে ওয়াহেদও এমন পর্যায়ের যে, ইমাম মুসলিমের (র) ন্যায় মুহাদ্দিসগণ সেগুলিকে নিজেদের সংকলনে স্থান দেয়া পছন্দই করেননি। (তর্জমানুল কোরআন, রবিউল আউয়াল, জমাদিউল আখের ১৩৬৪হিঃ;মার্চ -জুন ১৯৪৫খৃঃ)
মেহদী সমস্যা
প্রশ্ন
কতিপয় দ্বীনদার ও আন্তরিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন পুস্তকে আপনার ইমাম মেহদী সম্পর্কিত বর্ণনাবলীর বিরুদ্ধে হাদীসের আলোকে আপত্তি উত্থাপন করেছেন। তাদের আপত্তিসমুহ আপনার সম্মুখে পেশ করছি। একথা বলার পেছনে আমার এ অনুভূতি সক্রিয় রয়েছে যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার দাওয়াতের সমগ্র কাজে শরিয়তের আনুগত্য অপরিহার্য। কাজেই আপনার লেখনী প্রসূত প্রত্যেকটি জিনিস শরিয়ত মোতাবিক হতে হবে। আর যদি কখনো আপনার লেখনী ত্রুটিপূর্ণ মত ব্যক্ত করে তাহলে তা শুধরে নেবার ব্যাপারে যেন কোন প্রকার ইতস্ততঃভাব না থাকে।
(১) ইমাম মেহদী সম্পর্কে ৩১হতে ৩৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত যা লেখেছেন, তা আমাদের জ্ঞান অনুযায়ী হাদীস বিরোধী। এ প্রসঙ্গে আমি তিরমিযি ও আবুদাউদের সমস্ত হাদীস অধ্যায়ন করেছি। তা থেকে জানা যায় যে, কোন কোন হাদীসের বর্ণনাকারী অবশ্যি খারেজী অথবা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত;কিন্তু আবুদাউদ ও তিরমিযিতে এমন হাদীস অবশ্যি আছে যার বর্নানকারী বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী। তারা আপনার মতের সত্যতা প্রমাণ করে না বরং তার প্রতিবাদ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আবুদাউদের হাদীসটি দেখুনঃ
————————————————————-
(১) বর্তমান সংস্কারনের ২৩ হতে ২৫পৃষ্ঠা পর্যন্ত। এ থেকে হাদীসটি থেকে নিয়ে শেষ হাদীসটি পর্যন্ত পড়ুন। দেখবেন সকল বর্ণনাকারীই বিশ্বস্ত। উপরন্ত বায়হাকির একটি বর্ণনা মিশকাতের কিতাবুল ফিতানে বর্ণিত হয়েছেঃ
মেহদী তার মেহদী হওয়া সম্পর্কে অজ্ঞ থাকবে উপরোক্ত হাদীসগুলো আপনার এ কথার প্রতিবাদ করছে। বিশেষ করে এই কথাগুলো দেখুনঃ
————————————— তাছাড়া তিরমিযির একটি বর্ণনার এ কথাগুলো অনুধাবন করুনঃ
—————————————
(২) আপনি বলেছেন যে, মেহদী আধুনিক ধরনের নেতা হবেন। ….ইত্যাদি। আপনার এ দাবীর স্বপক্ষে কোন হাদীস নেই। থাকলে লিখে জানাবেন। যারা আপনার মতের বিপরিত মত প্রকাশ করে তাদের স্বপক্ষে বাস্তব প্রমাণ হলো এই যে, এতদিন পর্যন্ত যতগুলো মুজাদ্দিদ এসেছেন তাদের সবাই প্রধানতঃসুফী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
(৩) আপনার এ কথায় যে তিনি আধুনিক ধরনের নেতা হবেন সন্দেহ পোষণ করা হচ্চে যে, আপনি নিজেই ইমাম মেহদী হবার দাবী করবেন।
(৪) ’আলামতে কিয়ামত’ পুস্তুকে (লেখকঃ মওলানা শাহ রফিউদ্দিন অনুবাদকঃমৌলবী নুর মুহাম্মদ) ইমাম মেহদী সম্পর্কে মুসলিম ও বুখারীর বরাত দিয়ে কতিপয় হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধান করার পর মুসলিম ও বুখারিতে আমি এমন কোন হাদীস পাইনি। এ পুস্তুকে উদ্ধৃত একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, মেহদীর হাতে বায়েত গ্রহণ করার সময় আকাশ থেকে আওয়াজ আসবেঃ
—————————–
এ হাদীসটি সম্পর্কে আপনার কি মত?
জবাব
(১) ইমাম মেহদী সম্পর্কে যেসব হদীস বিভিন্ন হাদীস পুস্তুক লিপিবদ্ধ হয়েছে, সে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমি আমার অনুসন্ধানের সংক্ষিপ্তসার পেশ করেছি। যারা ইমাম মেহদী সম্পর্কে কোন কথা স্বীকার করার জন্যে কেবল সে কথাটি হাদীসের কোন কিতাবে উল্লিখিত থাকাই যথেষ্ট মনে করেন, অথবা অনুসন্ধানের হক আদায় করার জন্যে কেবল বর্ণনাকারীরাই সত্যবাদী কিনা একথা জানাই যথেষ্ট মনে করেন তাহলে তাদের জন্যে সেই ধরনের বিশ্বাস রাখা বৈধ যা তাঁরা হাদীসে পেয়েছেন। কিন্তু যারা এ সমস্ত হাদীস একত্রিত করে এদের তুলনামূলক অধ্যায়ন করেন এবং তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে বৈপরিত্যের সন্ধান পান, উপরন্ত যাদের সম্মুখে বনি ফাতেমা, বনি আব্বাস ও বনি উমাইয়ার সংঘর্ষের পূর্ণ ইতিহাস আছে এবং তাঁরা পরিস্কার দেখেন যে, এ সংঘর্ষে বিভিন্ন দলের স্বপক্ষে অসংখ্য হাদীস রয়েছে এবং বর্ণনাকারীদের মধ্যোও অধিকাংশ তারাই যাদের কোন এক পক্ষের সাথে প্রকাশ্য সম্পর্ক ছিল, তাদের জন্যে এ হাদীসগুলোর সমগ্র বিস্তারিত অংশকে নির্ভুল মেনে নেওয়া কঠিন। আপনি নিজেও যে হাদীসগুলি বর্ণনা করেছেন তার মধ্যেও———– অর্থাৎ কালো ঝাণ্ডার উল্লেখ আছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, কালো ঝাণ্ডা ছিল বনি আব্বাসের ঐতিহ্য। উপরন্ত ইতিহাস থেকে এও জানা যায় যে, এ ধরনের হাদিস পেশ করে বাদশাহ মেহদি আব্বাসীকে প্রতিশ্রুত মেহদী প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। এখন যদি কেউ এ বিষয়টি মেনে নেয়ার ওপর জোর দেন তাহলে তিনি একে মেনে নিতে পারেন এবং ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলর পুস্তকে আমি যে মত প্রকাশ করেছি তা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক তত্ত্বগত ও ফিকাহ সম্পর্কিত বিষয়ে আমার কথাই সবার জন্যে স্বীকার্য হবে এমন কোন কথা নেই। এসব বিষয়ে আমার কোন অনুসন্ধান কারুর জন্যে পছন্দনীয় না হলে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে প্রচেষ্টা চালানোর ব্যাপারেও আমার সাথে সহযোগিতা করা তার জন্যে হারাম হয়ে যাবে, এ কথাও ঠিক নয়। হাদীস, তাফসীর ফিকাহ প্রভৃতি শাস্ত্রে শাস্ত্রকরদের মধ্যে বিভিন্ন মতের উদ্ভব হওয়া আজকের কোন নতুন কথা নয়।
(২) প্রতিশ্রুত মেহদি আধুনিক ধরনের লীডার হবেন আমার এ কথার অর্থ এ নয় যে, তিনি দাঁড়ি চেঁছে ফেলবেন, স্যুট-কোট পরবেন এবং আপটুডেট ফ্যাসানে চলাফেরা করবেন। বরং এর অর্থ হলো এই যে, তিনি যে জামানায় পয়দা হবেন সে জামানার জ্ঞান -বিজ্ঞান অবস্থা ও প্রয়োজন সম্পর্কে পূর্ন ওয়াকেফহাল থাকবেন। সমকালিন যুগোপযোগী বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন। এবং সমকালীন বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসন্ধানের মাধ্যমে আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি ও উপায়-উপকরণ ব্যবহার করবেন। এটি একটি অকাট্য যুক্তিপূর্ণ কথা। এর জন্যে কোন হাদীসের প্রয়োজন নেই নবী করিম (স) যদি তাঁর যুগের পরিখা, কঠোর কামান (Battering Ram) , প্রস্তর নিক্ষেপন যন্ত্র প্রভৃতি ব্যবহার করতে পারেন তাহলে আগামী কোন যুগে যে ব্যক্তি নবি করিমের স্থলাভিষিক্ত হক আদায় করতে অগ্রসর হবেন তিনি অবশ্যি ট্যাংক এরোপ্লেন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সমকালীন অবস্থা ও বিষয়াবলী থেকে অসম্পর্কিত হয়ে কাজ করতে পারবেন না। শক্তির আধুনিকতম উপায়-উপকরণ লাভ করা এবং নিজের প্রভাব বিস্তৃত করার জন্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প ও কর্ম পদ্ধতি ব্যবহার করাই হলো কোন দলের উদ্দেশ্য সাধন ও কোন আন্দোলনের বিজয় লাভের স্বাভাবিক পথ।
(৩) এই যে কথাটি বললেন যে, এ থেকে সন্দেহ করা হচ্ছে তুমি নিজেই ইমাম মেহদী হবার দাবী করবে এর জবাবে আমি এছাড়া আর কিছুই বলতে পারিনা যে, এ ধরনের সন্দেহ প্রকাশ করা এমন কোন ব্যক্তির কাজ হতে পারে না যে খোদাকে ভয় করে, খোদার সম্মুখে নিজের দায়িত্বের অনুভূতি রাখে এবং খোদার এ নির্দেশও স্মরণ রাখে যেঃ——————————————- অর্থাৎ ‘অধিকাংশ সন্দেহ থেকে দুরে থাকো, অবশ্যি অনেক সন্দেহ গোণাহর কারণ’। যারা এ ধরনের সন্দেহ প্রকাশ করে মানুষকে জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত থেকে দুরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন আমি তাদেরকে এমন একটি ভীষণ শাস্তি দিতে মনস্থ করেছি, যা থেকে তারা কোনক্রমে রেহাই পেতে পারে না। আর সে শাস্তি হলো এই যে, ইনশাআল্লাহ আমি সব রকমের দাবী থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে খোদার সম্মুখে পৌঁছে যাবো। অতঃপর এই লোকেরা খোদার সম্মুখে এদের সন্দেহসমূহ এবং সেগুলো বিবৃত করে মাণুষকে হকের পথে বাধা দেবার স্বপক্ষে কি সাফাই পেশ করেন, তা আমি দেখবো।
(৪) আলামতে কিয়ামত কিতাবে যে হদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে আমি ইতিবাচক বা নেতিবাচক কিছুই বলতে পারি না। যদি তা নির্ভুল এবং সত্যি নবী করিম (সঃ) যদি এমন খবর দিয়ে থাকেন যে, মেহদির হাতে বায়েত গ্রহণের সময় আকাশ থেকে আওয়াজ আসবে যে, অর্থাৎ ইনিই আল্লাহর খলিফা মেহদী এঁর কথা শুনো ও এঁর আনুগত্য করো তাহলে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন পুস্তকে আমি এ সম্পর্কে যে রায় পেশ করেছি তা ভুল। কিন্তু আমি আশা করি না যে, নবী করিম (স) এমন কথা বলবেন। কোরআন মজিদ অধ্যায়ন করে জানা যায় যে, কোন নবীর আগমনেও আকাশ থেকে এ ধরনের আওয়াজ আসেনি। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদের (স) পর ঈমান ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার দ্বিতীয় কোন সুযোগ আসবে না, তবুও তাঁর আগমনে আকাশ থেকে এমন কোন আওয়াজ শুনা যায়নি। মক্কার মুশরিকরা দাবী করতে থাকে যে, আপনার সাথে কোন ফেরেশতা থাকতে হবে তিনিই আমাদেরকে জানাবেন যে, ইনি খোদার নবী। অথবা এমন কোন সুস্পষ্ট নিশানী থাকতে হবে, যা থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাবে আপনার নবী হবার বিষয় জানা যাবে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা তাদের এ সকল দাবী প্রত্যাখ্যান করেন এবংএগুলো গ্রহণ না করার কারণসমুহ কোরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করেছেন যে, সত্যকে পূর্ণরূপে আবরণ মুক্ত করা, যার ফলে বুদ্ধিগত পরীক্ষার অবকাশ না থাকে, এমন পদ্ধতি খোদার হিকমতের পরিপন্থি। এখন এ কথা কেমন করে মেনে নেয়া যেতে পারে যে, আল্লাহতায়ালা তাঁর এই নিয়ম একমাত্র ইমাম মেহদীর ব্যাপারে পরিবর্তন করবেন, এবং তাঁর বায়েতের সময় আকাশ থেকে আওয়াজ দেবেন যে, ইনিই খোদার খলিফা মেহদী এঁর কথা শুনো, এঁর আনুগত্য কর। (তর্জমানুল কোরআন, রজব, ১৩৬৫হিঃ, জুন, ১৯৪৬খৃঃ)
সমাপ্ত