শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবীর কার্যাবলী
হযরত মুজাদ্দিদে আলফি সনির (র) ইন্তেকালের পর এবং বাদশাহ আলমগীরের ইন্তেকালের চার বৎসর পূর্বে দিল্লীর শহরতলীতে হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন১৭। এদিকে তাঁর জামানা ও পরিবেশ এবং অন্য দিকে তাঁর কার্যাবলীকে সামনাসামনি রেখে বিচার করতে অগ্রসর হলে মানুষ হতবাক হয়ে যায় যে, সে যুগের এহেন গভীর দৃষ্টি, চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তির জন্ম কেমন করে সম্ভব হলো!ফররুখ সায়র, মুহম্মদ শাহ রংগীলা ও শাহ আলমের ভারতবর্ষকে কে না জানে! সেই অন্ধকার যুগে শিক্ষা লাভ করে এমন একজন মুক্ত বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন চিন্তানায়ক ও ভাষ্যকর জনসমক্ষে আবির্ভূত হন যিনি জামানা ও পরিবেশের সকল বন্ধন মুক্ত হয়ে চিন্তা করেন, আচ্ছন্ন ও স্থবির জ্ঞান ও শতাদ্ধীর জমাট বাঁধা বিদ্বেষের বন্ধন ছিন্ন করে প্রতিটি জী বন সমস্যার ওপর অনুসন্ধানী ও মুজতাহিদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং এমন সাহিত্য সৃষ্টি করে যান -যার ভাষা বর্ণনাভংগী, চিন্তা, আদর্শ গবেষণালব্ধ বিষয় ও সিদ্ধান্ত সমূহের ওপর সমকালীন পরিবেশের কোনো ছাপ পড়েনি। এমনকি তাঁর রচনা পাঠ করার সময় মনে এতটুকু সন্দেহেও উদয় হয় না যে, এগুলো এমন এক স্থানে বসে রচনা করা হয়েছে যার চতুর্দিকে বিলাসিতা, ইন্দ্রিয়পূজা, হত্যা, লুটতরাজ, জুলুম, নির্যাতন, অশান্তি ও বিশৃংখলার অবাধ রাজত্ব চলছিল।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মানব ইতিহসের এমন এক বিশেষ শ্রেণীর নেতৃবৃন্দের অন্তর্ভুক্ত যারা হামেশা মতবাদের বিভ্রান্তি মুক্ত করে চিন্তা ও গবেষণার একটি পরিছন্ন ও সরল রাজপথ তৈরী করেন এবং মানস জগতে সমকালীন পরিস্থিতির বিরুদ্ধে অস্থিরতা সৃষ্টি করে নব সৃষ্টির এমন এক অসুন্দরের ধ্বংস সাধন এবং ন্যায় সত্য ও সুন্দরের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে একটি আন্দোলন জন্মলাভ করে। এ ধরনের নেতা কদাচিৎ নিজের চিন্তা ও মতাদর্শ অনুযায়ী নিজেই একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং বিকৃত পৃথিবীকে ভেঙে চুরে স্বহস্তে একটি নতুন পৃথিবী গঠন করার জন্যে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত বিরল। এই ধরনের নেতৃবৃন্দের আসল কাজ হয় এইযে, তাঁরা সমালোচনার ছুরি চালিয়ে শত শত বছরের বিভ্রান্তজাল ছিন্ন ভিন্ন করেন, বৃদ্ধি ও চিন্তাজগতে নতুন আলোকে শিখার উন্মেষ ঘটান, জীবনের বিকৃত অথচ শক্তিশালী কাঠামোটি ভেঙে তার ভগ্নাবশেষ থেকে আসল ও দীর্ঘস্থায়ী সত্যকে পৃথক করে দুনিয়ার সম্মুখে উপস্থাপিত করেন। এ কাজ অত্যান্ত ব্যাপক ও বিরাট। তাই এ কার্য সম্পাদনকারী আবার নিজেই কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করে কার্যতঃ জাতিগঠনের কাজেও আত্মনিয়োগ করেবেন এ অবসর তিনি কদাচিৎ লাভ করতে পারেন। যদিও শাহ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর রচিত তাফহীমাতে ইলাহিয়া গ্রন্থের একস্থানে এ সম্পর্কে কিছুটা ইংগিতও দিয়েছেন যে, স্থান -কালের উপযোগী হলে তিনি যুদ্ধ করেও কার্যতঃ সংশোধন করার যোগ্যতাও রাখতেন১৮। কিন্তু আসলে এ জাতীয় কোনো কাজ তিনি কারেননি। সমালোচনা ও চিন্তার পুনর্গঠনের ব্যাপারেই তাঁর সমগ্র শক্তি নিয়োজিত ছিল। এ বিরাট কাজ থেকে তিনি এতটুকুও অবসর পাননি। নিজের নিকটতম পরিবেশের সংশোধনের জন্যে সামান্যতম পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফুরসতও তাঁর ছিলনা। (১৭) জন্ম ১১১৪হিজরী (১৭০৩খৃঃ) ও মৃত্যু ১১৭৬ হিজরী (১৭৬৩ খৃঃ) (১৮) তাফহীমাতে, প্রথম খণ্ড, ১০১পৃষ্ঠাঃ———————————————————– অর্থাৎ যদি সে যুগে যুদ্ধ করে মানুষের সংশোধন সম্ভব হতো এবং এ জন্যে প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ ও লাভ করা যেতো, তাহলে এ ব্যক্তি (শাহ ওয়ালিউল্লাহ) দস্তুরমতো যুদ্ধো করতো। এবং সে যুদ্ধের ব্যাপারেও অত্যন্ত পারদর্শী। মহাবীর রুস্তম ও আসফেন্দিয়ারের যুদ্ধ কৌশল ও শৌর্যবীর্য তার নিকট নিতান্তই তুচ্ছ। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা এ কথা আলোচনা করবো যে, তিনি যে পথ পরিস্কার করেছিলেন, তার ভিত্তিতে সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাবার জন্যে অন্য একদল লোকের প্রয়োজন ছিল এবং মাত্র অর্ধশতাব্ধীর মধ্যেই তারা তার নিজেরই শিক্ষা ও অনুশীলনগাহের মধ্য থেকে শক্তি ও পরিপুষ্ট লাভ করে কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করেন।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ (র) সংস্কারমূল কার্যাবলীকে আমরা প্রধানতঃ দু;ভাগে বিভক্ত করতে পারি। এক, সমালোচনাও সংশোধনমূলক। দুই, গঠনমূল। এই উভয় কার্যবলীকে আমি পৃথক পৃথকভাবে বর্ণনা করবো।
সমালোচনা ও সংশোধন
শাহ ওয়ালিঊল্লাহ সমালোচকের দৃষ্টি নিয়ে সমগ্র ইসলামী ইতিহাস পর্যালোচনা করেন। আমর জানা মতে, শাহ ওয়ালিউল্লাহ প্রথম ব্যক্তি যাঁর দৃষ্টি ইসলামের ইতিহাস ও মুসলমানের সূক্ষা ইতিহাসের মৌল পার্থক্য পর্যন্ত পৌঁছে যিনি ইসলামী ইতিহাসের দৃষ্টি থেকে মুসলিম ইতিহাসের সমালোচনা ও পর্যালোচনা করেন। এভাবে তিনিই সর্বপ্রথম একথা অবগত হবার চেষ্টা করেন যে, বিভিন্ন শতকে ইসলাম গ্রহণকারী জাতিসমূহের মধ্যে আসলে ইসলাম কি অবস্থায় থাকে। এটি বড়ই নাজুক বিষয়বস্তু আগেও কিছু লোক এ ব্যাপারে বিভ্রান্তির শিকার হন এবং আজও হয়েছেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহর পর এমন একজন লোকেরও আবির্ভাব ঘটেনি যাঁর মনে মুসলীম ইতিহাস ছাড়া আসলই ইসলামী ইতিহাসের কোনো পৃথক ধারণা ছিল। শাহ ওয়ালিউল্লাহর রচনার বিভিন্ন অংশে এ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ইংগিত রয়েছে। বিশেষ করে ‘ইযালাতুল খিফা’ গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১২২পৃষ্ঠা থেকে ১৫৮পৃষ্ঠা ১৯পর্যন্ত তিনি ধারাবাহিকভাবে মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে প্রত্যেক যুগের বিশেষত্ব এবং প্রত্যেক যুগের ফিতনা বিবৃত প্রসংগে এ সম্পর্কিত সুষ্পষ্ট ইংগিতবহ নবী করিমের (স) ভবিষ্যত বানীগুলিও উদ্ধৃত করেন। এ আলোচনায় মোটামুটি মুসলমানদের আকিদ-বিশ্বাস, শিক্ষা, চরিত্র, তমুদ্দুন ও রাজনীতিতে সংমিশ্রিত সকল প্রকার জাহেলিয়াতের দিকে অংগুলি নির্দেশ করা হয়।
(১৯) ১২৮৬হিজরীতে বেরিলী হতে প্রকাশিত ‘ইযালাতুল খিফা’ গ্রন্থ হতে আমি এ আলোচনা পেশ করেছি। অতঃপর গলদের স্তুপের মধ্যে অনুসন্ধান চালিয়ে তিনি এ কথা জানার চেষ্টা করেন যে, এর মধ্যে মৌলিক গলদ কোনগুলি যেখান থেকে সকল গলদের ধারা প্রবাতহিত হয়েছে। অবশেষে তিনি দুটি বিষয়ের প্রতি অংগুলি নির্দেশ করেন। একট হলো, খিলাফত থেকে রাজতন্ত্রের দিকে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের গতি পরিবর্তন এবং অন্যটি হলো, ইজতিহাদের প্রাণশক্তির মৃত্যু ও মন-মস্তিষ্কের ওপর অন্ধ অনুসারিতার বিপুল আধিপত্য।
প্রথম গলদটি সম্পর্কে তিনি ‘ইযালায়’ বিস্তারিত আলোচানা করেন। খিলাফত ও রাজতন্ত্রের নীতিগত ও পারিভাষিক পার্থক্যকে যেমন সুষ্পষ্ট ভাবে তিনি বর্ণনা করেন এবং হাদীসের সাহায্য যেভাবে তার ব্যাখ্যা করেন তাঁর পূর্বেকার লেখকদের রচনায় তার দৃষ্টান্ত বিরল। অনুরূপভাবে এই বিপ্লবের ফলাফলকে তিনি যেমন পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেন, পূর্ববর্তীদের রচনায় তেমনটি দেখা যায় না। এক স্থানে তিনি লেখেনঃ
“ইসলামের আরকানসমূহকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে বিরাট গলদ দেখা দিয়েছে। ….হযরত উসমানের (রা) পর কোনো শাসক হজ্জ কায়েম করেননি বরং নিজের প্রতিনিধি প্রেরণ করতে থাকেন। অথচ হজ্জ কায়েম করা খিলাফতের অপরিহার্য বিষয়সমূহের অন্যতম। সিংহাসনে আরোহন করা শাহী তাজ পরিধান করা এবং পূর্ববর্তী বাদশাহগণের স্থানে উপবেশন করা যেমন কাইসারের জন্যে বাদশাহীর চিহ্ন হিসেবে পরিগণিত হতো অনুরূপভাবে নিজের কর্তৃত্বে হজ্জ প্রতিষ্ঠিত করা ইসলামে খিলাফতের আলামত রূপে পরিচিত’’। ২০
আর এক স্থানে লেখেনঃ
“পূর্বে উপদেশ ও ফতোয়া দুটিই খলিফার রায়ের ওপর নির্ভর করতো। খলিফা ছাড়া কারুর উপদেশ ও ফতোয়া প্রদান করার অধিকার ছিল না কিন্তু এ বিপ্লবের পর উপদেশ ও ফতোয়া উভয়ই তত্ত্বাবধান মুক্ত হয় বরং পরিবর্তীকালে ফতোয়া দানের জন্যে এমনকি সৎ লোকদের দলেন পরামর্শের ও কোন শর্ত ছিল না”। ২১
অতঃপর বলেনঃ
“এদের সরকার অগ্নি উপাসকদের সরকারের ন্যায়। তবে পার্থক্য এতটুকুন যে, এরা নামাজ পড়ে এবং মুখে কালেমায়ে শাহাদাত উচ্চারন করে। এই পরিবর্তনের মধ্যে আমাদের জন্ম। জানিনা পরবর্তীকালে আল্লাহ তায়ালা আরো বা কি দেখাতে চান”। ২২
দ্বিতীয় গলদটি সম্পর্কে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইযালাতুল খিফা, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, বুদুরে বাজিগাহ, তাফহিমাত, মুসাফ্ফা, মুসাওওয়া, এবং তাঁর অন্যান্য প্রায় সকল গ্রন্থই দুঃখ প্রকাশ করেন।
ইযালায় বলেনঃ
“সিরীয় শাসকদের (উমাইয়া সরকার) পতনকাল পর্যন্ত, কেউ নিজেকে হানাফী বা শাফেয়ী বলে দাবী করতো না। বরং সবাই নিজেদের ইমাম ও শিক্ষাকগণের পদ্ধতিতে শরিয়তের প্রমাণ সংগ্রহ করতেন। ইরাকী শাসকদের (আব্বাসীয় সরকার) জামানায় প্রত্যেকেই নিজের জন্যে একটি নাম নির্দিষ্ট করে নেয়। তাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে, নিজেদের মযহাবের বড় বড় নেতাদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত কোরআন ও সুন্নতের দলিলের ভিত্তিতে তারা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো না। এভাবে কোরআন ও সুন্নতের ব্যাখ্যার ফলে অনিবার্যরূপে যেসব মতবিরোধ সৃষ্টি হতো, সেগুলো স্থায়ী বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৩
অতঃপর আরব শাসকদের পতনের পর অর্থাৎ তুর্কী শাসনামলে লোকেরা বিভিন্ন দেশে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা প্রত্যেকেই নিজের ফিকাহ ভিত্তিক মযহাব থেকে যা কিছু স্মরণ করতে সক্ষম হয়, সেটুকুকেই আসল দ্বীনে পরিণত করে। পূর্বে যেবস্তু কোরআন ও হাদীসের সুত্র উদ্ভূত মযহাব ছিল এখন তা স্থায়ী সুন্নতে পরিণত হয়। এখন তাদের বিদ্যা ও জ্ঞান নির্ভর করতে থাকে কোরআন ও সুন্নাহ থেকে সংগৃহীত বিধানাবলীর সংগ্রহ এবং কোরআন ও সুন্নাহ থেকে সংগৃহীত খুঁটিনাটি বিষয়ের ভিত্তিতে খুঁটিনাটি বিষয় সংগ্রহ করার ওপর”। ২৪
মুসাফ্ফায় লেখেনঃ
“আমাদের জামানার নির্বোধ ব্যক্তিরা ইজতিহাদের নামে ক্ষেপে ওঠে। এদের নাকে উটের মতো দড়ি বাঁধা আছে। এরা জানে না, কোন দিকে যাচ্ছে। এদের ব্যাপারেই ভিন্ন রকমের। ঐসব ব্যাপার বুঝায় যোগ্যতাও এ বেচারাদের নেই”। ২৫
(২০) ইযালাতুল খিফা, প্রথম খণ্ড, ১২৩-১২৪পৃষ্ঠা।
(২১) ইযালাতুল খিফা, প্রথম খণ্ড, ১৩০পৃষ্ঠা।
(২২) ইযালাতুল খিফা, প্রথম খন্ড, ১৫৭পৃষ্ঠা।
(২৩) ইযালাতুল খিফা, প্রথম খন্ড, ১৫৭পৃষ্ঠা।
(২৪) ইযালাতুল খিফা, প্রথম খণ্ড, ১৫৭পৃষ্ঠা।
(২৫) মুসাফ্ফা, প্রথম খণ্ড, ১১পৃষ্ঠা।
‘হুজ্জাতুলল্লাহহিল বালেগা’র সপ্তম অধ্যায়ে ও ‘ইনসাফে’শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র) এ রোগের পূর্ণ ইতিহাস বিবৃত করেন এবং এর দ্বারা সৃষ্ট যাবতীয় ত্রুটির প্রতি অংগুলি নির্দেশ করেন।
ঐতিহাসিক সমালোচনার পর শাহ ওয়ালিউললাহ সমকালীন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন এবং নাম উল্লেখ করে প্রত্যেকের দোষ-ত্রুটি বিবৃত করেন।
তাফহিমাতের একস্থানে লেখেনঃ
“এই ওসিয়তকারী (অর্থাৎ শাহ ওয়ালিউল্লাহ ) এমন এক যুগে জন্মগ্রহণ করেছে যখন মানুষ তিনটি বিষয়কে মিশ্রিত করে ফেলেছেঃ
(১) কুতর্ক: গ্রীক বিদ্যাসমূহের মিশ্রনের ফলে এর উদ্ভব হয়েছে। লোকেরা কালাম শাস্ত্রের বিতর্কে মশগুল হয়ে গেছে। এমন কি আকিদা-বিশ্বাসের প্রশ্নে এমন কোনো আলোচনা হয় না যার মধ্যে অনর্থক যুক্তিভিত্তিক বিতর্ক থাকে।
(২) অনুভূতির আনুগত্য: সুফিদের জনপ্রিয়তা ও তাদের ভক্তদলে শামিল হবার কারণে এর উদ্ভব হয়েছে। প্রাচ্য ও পাশ্চত্যের সমগ্র এলাকায় এ জিনিসটি আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এমন কি এই সুফিদের কথা ও কর্ম সাধারণ মানুষের মনের ওপর কোরআন ও সুন্নত তথা সকল জিনিসের চাইতে বেশী আধিপত্যশালী। তাঁদের তত্ত্বকথা ও ইংগিতসমূহ অস্বীকার করে অথবা এগুলোকে আমল না দেয় সে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে না। এবং সৎলোকদের মধ্যোই গণ্য হয় না। মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যে, সুফিদের ইশারা ইংগীত বর্জিত বক্তৃতা করে। মাদ্রাসায় অধ্যাপনারত এমন কোনো আলেমও নেই, যে তাদের কথায় বিশ্বাস ও দৃঢ় প্রত্যয় পোষণ না করে। অন্যথায় তারা নির্বোধ বিবেচিত হয়। আবার আমির-ওমরাহদের এমন কোনো মজলিস নেই সেখানে মাধুর্য, সূক্ষ্ম রুচিবোধ ও শিল্পকারিতার জন্যে সুফিদের কবিতা ও তত্ত্বকথা ব্যাপকভাবে ব্যবহার না করা হতো।
(৩) খোদার প্রতি আনুগত্য: মুসলিম মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে এটি মুসলমানদের জন্যে অপরিহার্য ছিল। “আবার এ যুগের একটি অন্যতম রোগ হলো এই যে, প্রত্যেকে নিজের মত অনুযায়ী চলছে। এরা লাগামহীনভাবে চলছে কেনো নিয়ন্ত্রন নেই, কোরআন ও হাদীসের কোনো আলংকারিক বিষয়ে এসে স্তব্ধ হয়েও যায় না এবং এদের জ্ঞানসীমার বহির্ভূত কোনো বিষয়ে অনুপ্রবেশ করা থেকেও বিরত হয় না। প্রত্যেকে নিজের বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে খোদাও রসূলের নির্দেশাবলীর অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করেছে এবং এ ব্যাপারে নিজে যা বুঝতে সক্ষম হয়েছে তার ভিত্তিতে অন্যের সংগে বিতর্ক ও কুতর্কে লিপ্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও আর একটি রোগ দেখা দিয়েছে। হাম্বলীও শাফেয়ী প্রভৃতি ফিকাহর মধ্যে তীব্র বিরোধ পরিদৃষ্ট হচ্ছে। প্রত্যেকে নিজের পদ্ধতিকে একমাত্র সত্য মনে করেছে এবং অন্যের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করেছে। প্রত্যেক মযহাবে খুঁটিনাটি ও পুংখানুপংখু বর্ণনার আদিক্য, আর এই সবিস্তার বর্ণনার ভিড়ে সত্য প্রচ্ছন্ন হয়ে গেছে। ”
ঐ বইয়ের আর এক স্থানে লেখেনঃ
“কোনো ন্যায়সংগত অধিকার ছাড়াই যেসব পীরজাদা বাপ-দাদার গদীনশীন হয়েছে, তাদেরকে আমি বলিঃ তোমরা কেন এইসব পৃথক পৃথক দল গঠন করে রেখেছো? তোমাদের প্রত্যেকেই নিজের নিজের পথে চলছো কেন? আল্লাহতাআলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর যে পথটি অবতীর্ণ করেছিলেন সেটি পরিত্যাগ করেছো কেন? তোমাদের প্রত্যেকে ইমামে পরিণত হয়েছে। মানুষকে নিজেদের দিকে আহবান জানাচ্ছে। নিজেদেরকে হেদায়েরতকারী ও হেদায়েতদানকারী মনে করছে অথচ সে নিজে পথভ্রষ্ট এবং মানুষ কে পথভ্রষ্ট করছে। পার্থিব স্বার্থের খাতিরে যারা মানুষের নিকট থেকে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে তাদের প্রতি আমরা বিন্দুমাত্র ও সন্তুষ্ট নেই। আর যারা দুনিয়ার স্বার্থের খাতিরে জ্ঞান অর্জন করে অথবা মানুষকে নিজেদের দিকে আহবান করে তাদের দ্বারা নিজেদের পার্থিব কামনা চরিতার্থ করে, তাদের প্রতিও আমরা সন্তুষ্ট নই। তারা সবাই দস্যু, দজ্জাল, মিথ্যুক, প্রবঞ্চক, ও প্রবঞ্চিত। ….’’
“নিজেদেরকে উলামা আখ্যাদানকারী তালেবে ইলমদেরকেও আমি বলিঃ নির্বোধের দল ! তোরা গ্রীকদের বিদ্যা, ব্যাকরণ ও অলংকার শাস্ত্রের গোলক ধাঁধায় আটকে পড়েছো আর মনে করছো যে, বিদ্যা-বুদ্ধি এগুলির নাম। অথচ বিদ্যা খোদার কিতাবের আয়াতে সুস্পষ্ট অথবা তাঁর রসূলের মাধ্যমে প্রমানিত সুন্নতের মধ্যে নিহিত। ….তোমরা পূর্ব্বর্তীফকিহগেরন খুঁটিনাটি ও বিস্তারিত বর্ণনাবলীর মধ্যে ডুবে গিয়েছো। তোমরা কি জানো না যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা বলেছেন, সেটিই একমাত্র হুকুম? তোমাদের অধিকাংশ লোকের অবস্থা হলো যে, নবীর কোনো হাদীস যখন তাদের নিকট পৌঁছুয়, তখন তারা তার ওপর আমল করে না। তারা বলেঃ আমরা তো অমুক মযহাবের ওপর আমল করি, হাদীসের ওপর নয়। অতঃপর তারা বাহানা পেশ করে যে, জনাব! হাদীস বুঝা ও সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বিশেষজ্ঞ ও পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী লোকদের কাজ, তা ছাড়া এ হাদীসটি পূর্ববরতী ইমামগণের দৃষ্টিসীমার বাইরে ছিল না নিশ্চয়ই। তাহলে তাদের এ হাদীসটি পরিত্যাগ করার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ থাকবে। জেনে রেখ! এটি আদৌ দ্বীনের পথ নয়। যদি তোমরা তোমাদের নবীর (স) প্রতি ঈমান এনে থাকো, তাহলে কোনো মযহাবের বিপক্ষে বা স্বপক্ষে যাই হোক না কেন, তাঁর ইত্তেবা করো। ….’’
“আমি ওয়াজ-নসিহতকারী, আবেদ ও খানকাহবাসীদেরকে বলিঃ হে তাকওয়া ও পরহেজগারীর দাবিদারগণ। তোমরা যত্রতত্র ছুটে বেড়াচ্ছো এবং ভালো-মন্দ সবকিছু হস্তগত করছো। তোমরা মানুষকে মিথ্যা ও মনগড়া বিষয়ের দিকে আহবান করছো। তোমরা খোদার বান্দাদের জীবনের পরিধি সংকীর্ণ করে দিয়েছো। অথচ তোমরা সংকীর্ণতা নয়, ব্যাপকতার জন্যে আদিষ্ট ছিলে। তোমরা অপ্রকৃতিস্থ খোদাপ্রেমিকদের কথাকে নির্ভরশীল বলে মেনে নিয়োছো। অথচ এসব বিক্ষিপ্ত করার নয়, বেঁধে তুলে রাখবার জিনিস….। ”
“আমি আমির -ওমরাহকে বলিঃ তোমাদের কি খোদার ভয় নেই?তোমরা ধ্বংসশীল আরাম -আয়েশের সন্ধানে লিপ্ত হয়ে সাধারণ মানুষকে পরস্পর সংগ্রামে লিপ্ত হবার জন্যে ব্যাপক সুযোগ দান করছো। প্রকাশ্যে শরাব পান করা হচ্ছে তোমরা বাধা দিচ্ছো না। প্রকাশ্যে ব্যভিচার, শরাব পান ও জুয়া খেলার আড্ডা চালু আছে অথচ তোমরা এইগুলো বন্ধ করার কোন ব্যবস্থা করছো না। এই বিরাট দেশে সুদীর্ঘ কাল থেকে শরিয়তের আইন অনুযায়ী কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি। তোমরা যাকে দুর্বল মনে কর, তাকে খেয়ে ফেলো আর যাকে শক্তিশালী মনে কর, তাকে ছেড়ে দাও। নানা রকম খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ, স্ত্রীদের মান-অভিমান এবং গৃহ ও বস্ত্রের বিলিসিতার মধ্যেই তোমরা ডুবে গিয়েছো। একবার খোদার কথা চিন্তা করো না….। ”
“ আমি সৈন্যদেরকে বলিঃ আল্লাহ তোমাদেরকে জিহাদ করার জন্যে হকের কালেমা বুলন্দ করার জন্যে এবং শের্ক ও মুশরিকদের শক্তি নাশ করার জন্যে সৈন্য পরিণত করেছিলেন। এ কর্তব্য উপেক্ষা করে তোমরা ঘেড়সওয়ারী অস্ত্রসজ্জা করাকেই নিজেদের পেশায় পরিণত করছো। বর্তমানে জিহাদের নিয়ম ও উদ্দেশ্যের সংগে তোমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থ উপার্জন করার জন্যে তোমরা সেনাবাহিনীতে চাকুরী নিয়েছো। তোমরা ভাং ও শরাব পান করো, দাড়ি মুণ্ডন করো ও গোঁফ লম্বা করো, মানুষের ওপর জুলুম নির্যাতন চালাও। তোমাদের মধ্যে হালাল -হারামের রুজির পার্থক্য ঘুচে গেছে। খোদার কসম, একদিন তোমাদেরকে এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে, তারপর তোমরা কি কাজ করে এসেছো সে সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদেরকে অবগত করাবেন….”
“ আমি শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষকে বলিঃ বিশ্বস্ততা ও আমানতদারী তোমাদের নিকট থেকে বিদায় গ্রহণ করেছে। নিজের প্রতিপালকের বন্দেগী থেকে তোমরা গাফেল হয়ে গিয়েছো এবং খোদার সাথে শের্কে লিপ্ত হয়েছো। তোমরা গায়রুল্লাহন জন্যে কোরবানী কারো এবং মাদার সাহেব ও সালার সাহেবের কবরে গিয়ে হজ্জ সম্পদান করো। এগুলী তোমাদের নিকৃষ্টতম কাজ। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তির অবস্থা কিছুটা স্বচ্ছল হয়, সে নিজের খানা-পিনা ও পোশাক-পরিচ্ছদের ওপর এত বেশী খরচ করে যে তার আয় তার জন্যে যথেষ্ট হয় না। তখন পরিবার পরিজনের অধিকার গ্রাস করে অথবা শরাব পান ও বারবনিতাদের মধ্যে নিজে ইহকাল ও পরকাল উভয়টাই নষ্ট করে….। ”
“অতঃপর মুসলমানদের দল-উপদলকে সমষ্টিগত ভাবে সম্বোধন করে বলিঃ হে বনি আদম! তোমরা নিজেদর চরিত্র নাশ করছো। তোমরা সংকীর্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছো। শয়তান তোমাদের সংরক্ষকে পরিণত হয়েছে। তোমাদের পুরুষরা নারীদেরকে লাঞ্ছিত ও পদদলিত করে রেখেছে। হালাল তোমাদের মুখে বিস্বাদ ঠেকেছে……। ”
“হে বনি আদম! তোমরা এমন সব নিকৃষ্ট রসম-রেওয়াজের অনুসারী হয়েছো, যার ফলে দ্বীন পরিবর্তীত হয়ে গেছে। যেমন আশুরার দিন তোমরা একত্রিত হয়ে কুকর্মে লিপ্ত হও। একটি দল ঐ দিনটিকে মাতমের দিনে পরিণত করেছে। তোমরা কি জান না যে, সকল দিনের মালিক আল্লাহ এবং সকল দুর্ঘটনা তাঁরই ইচ্ছায় সংঘটিত হয়? হযরত হোসাইন (রা) -কে যদি ঐ দিন শহীদ করা হয়ে থাকে, তাহলে এমন কোন দিন আছে যেদিন খোদার কোনো প্রিয়তম বান্দার মৃত্যু সংঘটিত হয়নি? কিছু লোক ঐ দিনটিকে খেলার দিনে পরিণত করেছে। অতঃপর শবেবরাতের দিন তোমরা মূর্খ জাতিদের ন্যায় খেলা-ধুলায় মত্ত হও। তোমাদের একটি দল মনে করে যে, ঐ দিন মুর্দাদের নিকট্ বেশী করে খাদ্য পাঠানো উচিত। যদি তোমাদের এ ধারণার পেছনে কোনো সত্যতা থাকে তাহলে এ ধারণা ও কার্যের সমর্থনে কোনো দলিল পেশ করো। আবার তোমরা এমনসব রসমও বানিয়ে রেখেছো যার ফলে তোমাদের জীবনধারা সংকীর্ণতর হয়ে আসছে। যেমন বিবাহে অমিতব্যয়িতা, তালাককে নিষিদ্ধ কর্মে পরিণত করা, বিধবা মেয়েদেরকে অবিবাহিত বসিয়ে রাখা। এই ধরনের রসম-রেওয়াজের পেছনে তোমরা নিজেদের জীবন ও সম্পদ নষ্ট করেছো। অথচ এই রসম-রেওয়াসমুহ বর্জন করে তোমাদেরকে এমন পথে চলা উচিত ছিল যে পথ কঠিন নয় বরং সহজ। তোমরা মৃত্যু ও দুঃখকে ঈদে পরিণত করেছো। মনে হয় যেন তোমাদের ওপর ফরজ করে দেয়া হয়েছে যে, কারুর মৃত্যু হলে তার আত্মীয়স্বজনকে বিরাট ভোজসভা অনুষ্ঠান করতে হবে। তোমরা নামাজ থেকে গাফেল হয়ে গেছো। অনেকে নিজের কাজ-কারবারে এত বেশী ব্যস্ত থাকে যে, নামাজ পড়ার সময় পায় না। অনেকে বিলাসিতা ও খোশগল্পের মধ্যে এত বেশী মশগুল থাকে যে, নামাজের কথা বিস্মৃত হয়ে যায়। তোমরা জাকাত থেকে গাফেল হয়ে গেছো। তোমাদের মধ্যে এমন কোনো ধনী নেই যে, বাইরের বহুলোকের খাওয়ার দায়িত্ব নেয়নি। তারা ঐ সমস্ত লোকেরা খাওয়া -পরার দায়িত্ব পালন করে কিন্তু কখনো জাকাত ও ইবাদতের নিয়ত করে না। তোমরা রমজানের রোজাও নষ্ট করো। এ জন্যে নানান ওজর পেশ করে থাকো। তোমরা নিতান্ত অকর্মণ্য ও অবিবেচক হয়ে পড়েছো। তোমাদের ভরণ-পোষণ বাদশাহ প্রদত্ত ওজীফা ও পদমর্যাদার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যখন তোমাদের বোঝা বহন করার জন্য বাদশাহদের ভাণ্ডার অপারগ হয়, তখন তারা প্রজাদের ওপর নাহক জুলুম নির্যাতন চালাত শুরু করে….। ” ২৬
তাফহীমাতের আর এক স্খানে বলেনঃ
“ যারা মনষ্কামনা পূর্ণ করার জন্যে আজমীর অথবা সালারে মাসউদের কবরে বা ওই ধরনের অন্যান্য স্থানে যায়, তারা এত বড় গোনাহ করে যে, হত্যা ও জিনার গোনাহ তার তুলনায় কিছুই নয়। এর মধ্যে আর নিজের মনগড়া মাবুদের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? যারা ‘লাত’ ও ‘উজ্জা’-এর নিকট প্রার্থনা করতো তাদের কাজ থেকে কোন দিক দিয়ে পৃথক? হাঁ, অবশ্যি এতটুকুন পার্থক্য আছে যে, তাদের তুলনায় এদেরকে আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কাফের বলতে দ্বীধা করি। কেননা এদের এই বিশেষ ব্যাপারে নবী করিমের সুস্পষ্ট নির্দেশ নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি কোন, মৃতকে জীবিত গণ্য করে তার নিকট্ মনষ্কামনা পূর্ণ করার জন্য প্রার্থনা করে, নীতিগতভাবে তার দিল গোনাহে লিপ্ত হয়। ২৭
এ উদ্ধৃতি বেশ দীর্ঘ হয়ে গেলো। কিন্তু তবুও তাফহীমাত দ্বিতীয় খণ্ডের আরো কতিপয় উদ্ধৃতি পাঠকদের সম্মুখে উপস্থাপিত করা নেহায়েত জরুরী মনে করি। শাহ ওয়ালিউল্লাহ বলেনঃ
“হাদীসে বর্ণিত আছেঃ নবী করিম (স) বলেন যে, তোমরাও অবশেষে তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিদের পদ্ধতি অবলম্বন করবে। তারা যেখানে সেখানে পা রেখেছিল তোমরাও ঠিক সেখানে পা রাখবে। এমন কি তারা যদি কেনো গো সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়ে থাকে, তাহলে তোমরাও সেখানে হাত ঢুকাবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেন, ”হে খোদার রসূল! পূর্ববর্তী উম্মতগণ বলতে কি আপনি ইহুদী ও ঈসায়ীদের দিকে ইংগিত করেছেন? নবী করিম (স) বলেন, ”তারা ছাড়া আর কারা হতে পারে?’’ এই হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম উভয়েই বর্ণনা করেছেন।
“খোদার রসূল (স) ঠিকই বলেছেন। আমার এই চর্মচক্ষে সেইসব দুর্বল ঈমানের অধিকারী মুসলমানদেরকে প্রত্যক্ষ করেছি, যারা সৎ লোকদেরকে খোদার পরিবর্তে মাবুদে পরিণত করেছে এবং ইহুদী ও ঈসায়ীদের ন্যায় নিজেদের অলি-আওলিয়ার কবরসমুহের সিজদা করছে। আমরা এমন লোকও দিখেছি যারা নবী করিমের (স) বাণী বিকৃত করে এ কথা তাঁরই মুখ নিঃসৃত বলে দাবী করেন যে, নেক লোকেরা খোদার জন্যে এবং গোনাহগার লোকেরা আমার জন্যে। এটি ঠিক ইহুদীদের (আমাদেরকে কখনো দোজখে প্রবেশ করানো হবে না, আর হলেও মাত্র কয়েকদিনের জন্যে) কথাটির মতো। সত্যি বলতে কি আজকাল প্রত্যেক দলের মধ্যে দ্বীনকে বিকৃত করার প্রবণতা বিস্তার লাভ করেছে। সুফিদের অবস্থা দেখো, তাঁদের মধ্যে এমনসব কথার অবাধ প্রচলন দেখা যাচ্ছে, যা কোরআন ও সুন্নার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়, বিশেষ করে তৌহিদের প্রশ্নে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, তাঁরা শরিয়তের কোনো পারোয়া করেন না। ফকিহদের ফিকাহকে দেখো, তার মধ্যে এমন সব কথা আছে যার উৎসের কোনো সন্ধানই পাওয়া যায় না। যেমন দশ হাত দৈর্ঘ ও দশ হাত প্রস্থ বিশিষ্ট স্থানের পানির বিষয়২৮ এবং কূপের পানি পাক করার বিষয়টি২৯। এ ছাড়া যুক্তিশাস্ত্রবিদ, কবি, বিত্তশালী ও জনগণের বিকৃতির তো কূল -কিনারা নেই”। ৩০
এ উদ্ধৃতিগুলি থেকে একটা মোটামুটি ধারণা লাভ করা যেতে পারে যে শাহ ওয়ালিউল্লাহ কত বিস্তারিত ভাবে মুসলামনদের অতীত ও বর্তমান পর্যালোচনা করেছেন এবং কত ব্যাপকভাবে এর সমালোচনা করেছিলেন।
এ ধরনের সমালোচনার অপরিহার্য ফল এই দাঁড়ায় যে, সমাজে যত সৎ লোক থাকে, যাদের বিবেক ও ঈমানে জীবন প্রবাহ এবং অন্তরে ভালো-মন্দের পার্থক্য বিরাজাত থাকে, পরিস্থিতির অবনতির অনুভূতি তাদেরকে এবং তাদের চিত্তকে অস্থির করে তোলে। তাদের ইসলামী অনুভূতি তীব্রতর হয় এবং নিজেদের চতুষ্পার্শের জীবনধারায় জাহেলিয়াতের প্রত্যেকটি চিহ্ন তাদের চোখে কাঁটার মত বিঁধে। তাদের পার্থক্য ক্ষমতা এত বেড়ে যায় যে, জীবনের প্রত্যেক অংশে তারা ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মিশ্রণ বিশ্লেষণ করতে তৎপর হয়। তাদের ঈমানী শক্তি এমনভাবে জেগে ওঠে যে, জাহেলিয়াতের কাঁটাবনে প্রত্যেকটি কাঁটা তাদেরকে সংস্কার ও সংশোধনের জন্যে অস্থির করে তোলে। অতঃপর পুনর্গঠনের একটি সুস্পষ্ট নকশা তাদের সম্মুখে পেশ করা মুজাদ্দিদের জন্যে প্রয়োজন হয়ে পড়ে, যাতে করে বর্তমান অবস্থাকে পরিবর্তন করে যে নতুন রূপ দান করেত হবে তার ওপর তারা নিজেদের দৃষ্টিকে কেন্দ্রীভূত করতে এবং নিজেদের সকল কার্য ও প্রচেষ্টাকে সেই উদ্দেশ্যে উৎসর্গীত পারে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইতিপূর্বে সমালোচনার কাজটি যেমন ব্যাপক ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করেছিলেন এই গঠনমূলক কাজটিও অনুরূপভাবে সম্পাদন করেন।
(২৬) তাফহীমাতে ইলাহিয়া, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৪-২১৯
(২৭) তাফহীমাতে ইলাহিয়া, দ্বিতীয় খণ্ড, ৪৫পৃষ্ঠা
(২৮) অর্থাৎ হাউজ দশ হাত লম্বা ও দশ হাত চওড়া না হলে তার পানি ‘মায়ে কাসীর’ বা বেশী পানি বলে গণ্য হবে না।
(২৯) অর্থাৎ কোন প্রাণী কূয়ায় পড়লে কত বালতি পানি বের করে দিতে হবে।
(৩০) তাফহীমাতে ইলাহিয়া, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৪-১৩৫।
গঠনমূলক কাজ
গঠনমুলক ব্যাপারে তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো এই যে, তিনি ফিকাহশাস্ত্র একটি যুক্তিপূর্ণ মধ্যমপন্থা পেশ করেন। এতে একটি বিশেষ মযহাবের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও অন্য একটি মযহাবের সমালোচনা করা হয়নি। একজন গভীর অনুসন্ধানকারীর ন্যায় তিনি সকল ফিকাহভিত্তিক মযহাবের নীতি-পদ্ধতি অধ্যায়ন করেন এবং স্বাধীনভাবে রায় কায়েম করেন। কোনো মযহাবের কোনো বিষয়ের স্বপক্ষে যুক্তি প্রমাণ লাভ করার কারণেরই তিনি তার প্রতি সমর্থন জানান সেই মযহাবের সাফাই গাইবার জন্যে ওয়াদাবদ্ধ হয়ে তিনি তার প্রতি সমর্থন জানননি। আবার কোনো মযহাবের কোনো কোনো বিষয়ের বিরোধিতা এ জন্যে করেছেন যে, যুক্তি ও প্রমাণ তার বিরুদ্ধে পেয়েছেন-এ জন্যে নয় যে, ঐ মযহাবের বিরুদ্ধে তার মনে কোনো প্রকার বিদ্বেষ আছে। এ কারণেই কোথাও তাঁকে হানাফী, কোথাও শাফেয়ী, কোথাও মালিকী আবার কোথাও হাম্বলী রূপে দেখা যায়। যেসব লোক একটি বিশেষ মযহাবের জোয়াল কাঁধে করে নিয়েছে এবং সকল বিষয়ে তাই আনুগত্য করার জন্যে কসম খেয়ে বেসেছে, তিনি তাদেরও বিরোধিতা করেন। অনুরূপ ভাবে তাদেরও বিরোধিতা করেন, যারা বিভিন্ন মযহাবের ইমামগণের মধ্যে কোনো বিশেষ একজনের বিরোধিতা করার জন্যে কসম খেয়ে বসেছে। এই উভয় পথের মাঝামাঝি তিনি একটি ভারসাম্যমূলক পথে অগ্রসর হন, যার ওপর প্রত্যেক সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তি নিশ্চিন্ত হতে পারে। তাঁর ‘ইনসাফ’বইয়ে তাঁর এই পদ্ধতির প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর ‘মুসাফ্ফা’এবং অন্যান্য বইতেও এই মতবাদের পুনরাবৃত্তি হয়েচে।
তাফহীমাতের এক স্থানে লেখেনঃ
“আমার মনে একটি চিন্তার উদগম হয়েছে যে, আবু হানিফা ও শাফেয়ীর মযহাব মুসলিম উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত। এ দুজনের মযহাবকে সর্বাধিক সংখ্যক লোক অনুসরণ করে এবং বইপত্রও এদেরই সবচাইতে বেশী। ফকিহ, মুহাদ্দিস, মুফাস্সীর, মুতাকাল্লিম ও সুফিদের অধিকাংশই শাফেয়ী মযহাবের অনুসারী। অন্যদিকে সরকার ও জনসাধারণের বেশীর ভাগ হানাফী মযহাবের অনুসারী। বর্তমানে আসমানীতত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যশীল সত্য বিষয়টি হলোঃ এই দুটি মযহাবকে একটি মযহাবের রূপ দান করা, উভয় মযহাবের বিষয়াবলীকে নবী করীমের (স) হাদীসের মাধ্যমে যাচাই করা। যা কিছু হাদীসের অনুসারী হবে, তাকে প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং যার কোন উৎস না পাওয়া যায়, তাকে বাতিল করা। অতঃপর যাচাই-বাছাইর পর যে মতগুলি প্রতিষ্ঠিত থাকবে সেগুলি সম্পর্কে যদি উভয় মযহাবই ঐক্যমতে পৌঁছে তাহলে সেগুলিকে অবশ্যি দাঁত দিয়ে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধরা উচিত। আর যদি সেগুলির ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে মতবিরোধ থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে উভয়ের মতই স্বীকার করে নেয়া উচিত এবং এই উভয় মত কার্যকরী করাকে নির্ভুল গণ্য করা উচিত। সেগুলি সম্পর্কে মতবিরোধ কোরআনে কেরাতের বিভিন্নতার সমপর্যায়েভূক্ত হবে অথবা রুখসাত ও আযীমতের ৩১মধ্যকার পার্থক্যের সমপর্যায়ভুক্ত হবে অথবা এই পার্থক্য হবে কোন জটিল বিষয় থেকে বের হবার দুটি পথের পার্থক্যের ন্যায়। যেমন, একাধিক কাফ্ফারা ৩২অথবা দুটি সমান মোবাহ পদ্ধতির অবস্থার ন্যায় হবে। ইনশাআল্লাহ এই চারটি দিক ছাড়া পঞ্চম দিকের কোন সম্ভবনা নেই। ” ৩৩
ইনসাফ -এ তিনি এর চাইতেও বিস্তারিতভাবে নিজের রায় পেশ করেছেন। বিশেষ করে তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি যা লিখেছেন তা এমন পর্যায়ের যে, আহলে হাদীস (সরাসরি হাদীসের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান অনুসন্ধান কারী) ও আহলে তাখরীজ (ইমামগণের ইজতিহাদের অনুসারী) উভয়কেই সে সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-বিশ্লেষণ করা উচিত। এ-আলোচনায় তিনি যে, পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তাহলো আহলে হাদীস ও আহলে তাখরীজ উভয় পদ্ধতিকে অবহিত করা। অনুরূপভাবে হুজ্জাতুল্লিহিল বালিগার সপ্তম অধ্যায়ে এ সম্পর্কিত যে আলোচনা করেছেন, তাও প্রণিধানযোগ্য।
এই মধ্যমপন্থা গ্রহণ করার ফলে বিদ্বেষ, সংকীর্ণমনতা, অন্ধ অনুসৃতি ও অনর্থক দীর্ঘ আলোচনায় সময় নষ্ট করার অবসান ঘটে এবং ব্যাপক দৃষ্টিভংগীসহ অনুসন্ধান ও ইজতিহদের পথ উন্মুক্ত হয়। এ জন্যেই শাহ ওয়ালিউল্লাহ এই সঙ্গে ইজতিহাদের প্রয়োজনের ওপরও জোর দেন। এবং তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি বইতে বিভিন্ন আলোচনায় বিভিন্নভাবে ইজতিহাদ ও অনুসন্ধান করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ মুসাফফার ভূমিকা থেকে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃতি করছি:
“ইজতিহাদ প্রতি যুগে ফরজে কেফায়া। এখানে ইজতিহাদ অর্থ হলো শরিয়তের বিধানাবলী সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন এবং তাদের বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি বিষয়ের ব্যাখ্যা অনুধাবন করে শরিয়তের আইন-কানুনকে যথাযথভাবে সংযোজন ও সংগঠন করা, তা কোনো বিশেষ মযহাব প্রণেতার অনুসারীও হতে পারে। আর ইজতিহাদ প্রতি যুগে ফরজ হবার যে কথা বলেছি, তা এ জন্য যে, প্রতি যুগে অসংখ্য সমস্যার সৃষ্টি হয। সেগুলো সম্পর্কে খোদর নির্দেশ জানা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। আর ইতিপুর্বে যে সমস্ত বিষয় লিপিবদ্ধ ও সংকলিত হয়েছে, তা এ ব্যাপারে যথেষ্ট হয় না বরং তার মধ্যে নানান মতবিরোধ ও থাকে। শরিয়তের মৌল বিধানের দিকে প্রত্যাবর্তন না করলে এ মতবিরোধ দূর হওয়া সম্ভব হয় না। এ ব্যাপারে মুজতাহিদগণ যে পদ্ধতি নির্ণয় করেছিলনে তাও মাঝপথে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। কাজেই এক্ষেত্রে ইজতিহাদ ছাড়া গত্যন্তর নেই। ” ৩৪
শাহ ওয়ালিউল্লাহ শুধু ইজতিহাদের ওপর জোরই দেননি বরং তিনি বিস্তারিতভাবে ইজতিহাদের নিয়ম-নীতি সংবিধান ও শর্তাবলী বর্ণনা করেছেন। ইজালাতুল, খিফা, হুজ্জাতুল্লাহল বালিগাহ, আকদুল জীদ, ইনসাফ, বুদুরে বাজিগাহ, মুসাফ্ফাপ্রভৃতি গ্রন্থে কোথাও তার নিছক ইংগিত আবার কোথাও বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। (৩১) কোনো কাজ না করার ব্যাপারে শরিয়ত কর্তৃক সুবিধা প্রদানকে রুখসত এবং শরিয়ত কর্তৃক সুবিধা প্রদান করা সত্ত্বেও ঐকাজ করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হওয়াকে আজীমত বলা হয়। অনুবাদক
(৩২) যেমন ইচ্ছা করে কোনো রোজা ভাঙলে তার কাফ্ফারা আদায়ের নিয়ম হলো এইযে, পরপর ৬০টি রোজা রাখতে হবে অথবা ৬০জন দরিদ্রকে খাওয়াতে হবে। দুটির যে কোনো একটি গ্রহণ করলেই চলবে।
(৩৩) তাফহীমাতে ইলাহিয়া, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ২১১-২১২
(৩৪) মুসাফ্ফা প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠাঃ১১
উপরন্ত তাঁর লিখিত বই-পুস্তকে যেখানেই তিনি কোনো বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, একজন সত্যানুসন্ধানী ও মুজতাহিদের ন্যায় তা করেছেন। অর্থাৎ বই -পুস্ত অধ্যয়ন করে মানুষ শুধু ইজতিহাদের নীতি-নিয়মই জানতে পারবে না বরং এই সংগে এ বিষয়ে শিক্ষালাভ ও করতে পারবে। উল্লেখিত কাজ দুটি শাহ ওয়ালিউল্লাহর পূর্ববর্তী লোকেরাও করেছেন। কিন্তু যে কাজ তাঁর পূর্বে আর কেউ করেনি, তাহলো এই যে, তিনি ইসলামের সমগ্র চিন্তা, নৈতিক, তমুদ্দুনিক ও শরিয়ত ব্যবস্থাকে লিপিবদ্ধ আকারে পেশ করার চেষ্টা করেছেন। এ কাজের ব্যাপারে তিনি তাঁর পূর্ববর্তীগণের থেকে অনেক অগ্রবর্তী হয়েছেন। যদিও প্রথম তিন চার শতকে অনেক বেশী ইমামের আবির্ভাব হয়েছে এবং তাদের কার্যবলী পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার দেখা যাবে যে, তাদের চিন্তারাজ্যে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাংগ চিত্র ছিল এবং অনুরূপভাবে পরবর্তী শতাব্দীগুলোয়ও এমন অনেক অনুসন্ধানকারীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যাদের সম্পর্কে ধারণা করা যায় না যে, তাঁদের চিন্তারাজ্যে এ চিত্র শূন্য ছিল; তবুএ তাদের একজন সুনিয়ন্ত্রিত ও যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যবস্থাকে একটি ব্যবস্থা হিসাবে লিপিবদ্ধ করার দিকে দৃষ্টি দেননি। এ সম্মান শাহ ওয়ালিউল্লাহর জন্য নির্ধারিত হয়েছিল যে, তিনিই হবেন এ পথের পথিকৃত। তাঁর গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটিই হুজ্জাতুল্লাহ ও বুদুরুল বাজিগাহ গ্রন্থদ্বয়ের আলোচ্য বিষয়। প্রথমোক্ত গ্রন্থে এ আলোচনা অধিকতর বিস্তারিত এবং শেষোক্ত গ্রন্থে প্রায়শঃই দার্শনিক দৃষ্টিভংগী সমন্বিত।
এই পুস্তকসমূহে তিনি অতিপ্রাকৃত বিষয়াবলী থেকে আলোচনা শুরু করেছেন। ইতিহাসে এই প্রথমবার আমরা এক ব্যক্তিকে ইসলামী দর্শন লিপিবদ্ধকরণের ভিত্তিস্থাপন করতে দেখি। এর আগে মুসলমানরা দর্শন সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন ও লিখেছেন, লোকেরা নিছক অজ্ঞতাবশতঃ তাকে “ইসলামী দর্শন’’নামে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ তা ইসলামী দর্শন নয়, মুসলিম দর্শন। তার বংশসূত্র গ্রীস, রোম, ইরান ও হিন্দুস্তানের সাথে সম্পর্কিত। আসলে যে বস্তুটি এই নামে আখ্যায়িত করার যোগ্য দিল্লীর এই শায়খই সর্বপ্রথম তার ভিত্তিস্থাপন করেন। যদিও পরিভাষায়র ক্ষেত্রে পুরাতন দর্শন ও কালাম শাস্ত্র অথবা দর্শন ভিত্তিক তাসাউফের শব্দসম্ভারের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন এবং অচেতনভাবে সেখানকার বহু চিন্তা ও ধারণা গ্রহণ করেছেন যেমন প্রথম প্রথম প্রত্যেক নতুন পথ আবিষ্কারকের জন্যে স্বভাবতই অপরিহার্য হয়ে পড়ে -তবুও গবেষণা অনুসন্ধানের নয়া দারোদঘাটনের ক্ষেত্রে এটি একটি বিরাট প্রচেষ্টা। বিশেষ করে এমন চরম অবনতির যুগে এত বড় শক্তিশালী যুক্তিধর্মী ব্যক্তিত্বের প্রকাশ একটি বিস্ময়কর ঘটনা।
এ দর্শনে শাহ ওয়ালিউল্লাহ বিশ্বজাহান ও বিশ্বজাহের মধ্যে মানুষ সম্পর্কে একটা ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন, যা ইসলামের নৈতিক ও তমুদ্দুনিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল ও তার সমভাবাপন্ন প্রকৃতির অধিকারী হতে পারে। অথচ অন্য কথায় তাকে যদি ইসলাম বৃক্ষের কাণ্ড গণ্য করার হয়, তাহলে সেই কাণ্ড এবং তা থেকে যে বৃক্ষের উদ্ভব হয়েছে তার মধ্যে বস্তুতঃকোনো স্বাভাবিক পার্থক্য অনুভূত হতে পারে না৩৫। আমি আশ্চর্য হই যখন কোনো কোনো ব্যক্তিকে এ কথা বলতে শুনি যে, “শাহওয়ালিউল্লাহ বেদান্ত দর্শন এ ইসলামী দার্শনের সুত্র মিলিয়ে নয়া ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্যে চিন্তার বুনিয়াদ সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিলেন। ” তাঁর গ্রন্থসমূহে এ প্রচেষ্টার কোন সন্ধানই আমি পাইনি। আর যদি সত্যিই এর কোনো সন্ধান পেতাম, তাহলে খোদার শপথ শাহ সাহেবের নাম মুজাদ্দিদগণের তালিকা থেকে কেটে বাদ দিয়ে আমি তাঁকে মুজাজাদ্দিদগণের কাতারে দাঁড় করিয়ে দিতাম।
নৈতিক ব্যবস্থার ওপর তিনি একটি সমাজ দর্শনের ইমারত নির্মাণ করেন। ‘ইরতিফাকাত’ (মানুষের দৈনন্দিন কার্যাবলী) শিরোনামায় তিনি এর বর্ণনা শুরু করেন। এ প্রসংগে পারিবারিক জীবন সংগঠন, সামজিক আদব-কায়দা, রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, কর ব্যবস্থা, দেশ শাসন, সামরিক সংগঠন প্রভৃতি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন এবং এই সংগে সমাজ সভ্যতার বিপর্যয় ও বিকৃতি সৃষ্টির কারণসমুহের ওপর আলোকপাত করেন।
অতঃপর তিনি শরিয়ত, ইবাদত, আহকাম ও আইন-কানুনের পূর্ণাংগ ব্যবস্থা পেশ করেন এবং প্রত্যেকটি জিনিসের গুরুত্ত্ব বুঝতে থাকেন। ইমাম গাজ্জালী (র) তাঁর পূর্বে যে কাজ করেছিলেন এই বিশেষ বস্তুর ওপর তাঁর কাজ সেই একই পর্যায়ের। আর স্বাভাবিকভাবেই এ পথে তিনি ইমাম গাজ্জালী থেকে অনেক দূরে অগ্রসর হয়ে গেছেন।
শেষের দিকে তিনি বিভিন্ন জাতির ইতিহাস ও আইন-কানুনের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করেন। কমপক্ষে আমার জানা মতে, তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম ও জাহেলিয়াতের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের একটি আবছা ধারণা পেশ করেন।
(৩৫) মুসলামনদের মধ্যে যে দর্শনের প্রচলন ছিল ইসলামের বাস্তব নৈতিক ও আকিদাগত ব্যাবস্থার সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না। এ জন্যে তার প্রচলন যত বেশী বৃদ্ধি হয়েছে মুসলমানদের জীবনে ততবেশী বিকৃত হয়েছে। বিশ্বাস দুর্বল হবার সাথে সাথে চরিত্র ও দুর্বল হয়েছে এবং সংগে সংগে কর্মশক্তিও শিথিল হয়েছে। পরস্পর বিরোধী চিন্তার দ্বন্দ্বের এটি স্বাভাবিক ফল। আধুনিক পাশ্চত্য দশর্ণের প্রচলনেও এই একই ফলের প্রকাশ ঘটেছে। কেন না পাশ্চত্য দর্শনও কোনোক্রমে ইসলামী ব্যবস্থার চিন্তার ভিত্তি প্রস্তরে পরিণত হতে পারে না।
ফলাফল
ইসলামী জীবন ব্যবস্থার এহন যুক্তিগ্রাহ্য এ সুসংরোচিত খসড়া পেশ হবার অর্থই হলো এই যে, তা সকল সুস্থ প্রকৃতির ও বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যাক্তির জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হবে আর তাদের মধ্যে যারা অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী তারা এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রাণ উৎসর্গ করে দেবে। এই লক্ষ্যাভিমুখে অগ্রসর ব্যক্তি নিজে কার্যতঃ এমন কোনো আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করুক বা না করুক তাতে বিশেষ কোনো পার্থক্য সূচিত হবে না। কিন্তু যে বস্তুটি এর চাইতে ও বেশী আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রমাণিত হয়, তাহলো এই যে, শাহ সাহেব জাহেলী রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যকার পার্থক্যকে সুস্পষ্টরূপে জনসমক্ষে পেশ করেন এবং কেবল ইসলামী রাষ্ট্রর বৈশিষ্ট কে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে ক্ষান্ত থাকেননি বরং এ বিষয়টিকে বারবার এমন পদ্ধতিতে পেশ করেন যার ফলে ঈমানদারদের পক্ষে জাহেলী রাষ্ট্র খতম করে সে স্থলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে জন্যে প্রচেষ্টা না চালিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি ‘হুজ্জাতীল্লাহিল বালিগার মধ্যে যথেষ্ট বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে বলে মনে হয়। এ বইটিতে তিনি হাদীসের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে, ইসলামী খিলাফত ও রাজন্ত্র দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। অতঃপর একদিকে যুগে রাজতন্ত্রের পথে মুসলমানদের সামষ্টিক জীবনে অনুপ্রবেশ করে এবং পেশ করেন যা ইসলামী খিলাফতের বৈশিষ্ট্য ও শর্তাবলী এবং সেই সব অবদান পেশ করেন যা ইসলামী খিলাফত আমলে প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের উপর নাজিল হয়। এরপরও মানুষের পক্ষে নিম্চিন্তে বসে থাকা কেমন করে সম্ভব হতে পারতো?