বিশেষজ্ঞদের যোগ্যতা
জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ তৈরীর লক্ষ্যে প্রচেষ্টা জোরদার করা উচিত। আমরা এখন বিশেষজ্ঞায়নের যুগে বাস করছি, যার বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বিশেষজ্ঞ। আমরা সেই যুগে বাস করছি না যখন জ্ঞানতাপস প্রতিভাধর ব্যক্তিরা জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখায় মতামত প্রকাশ করতেন। কেবল বুদ্ধিই যথেষ্ট নয়, না বুদ্ধির দীপ্তি, না প্রতিভা।
প্রয়োজন হচ্ছে বিশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা যা সময়ের সাথে তাল মিলাতে সক্ষম হবে, চাহিদা মিটাতে পারবে এবং নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনে উৎকর্ষতার স্বাক্ষর রাখবে। সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছেঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ আল্লাহ সব কিছুর মধ্যে নৈপূণ্য নিহীত রেখেছেন। [আন নাওয়াস ইবন সামানের সূত্রে মুসলিম–এ বর্ণিত।] এবং আল্লাহতায়ালা খুশি হন যখন তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করে। [হযরত আয়েশার র. সূত্রে আল বায়হাকীতে বর্ণিত।]
আমাদের যুগে কেবল বিশেষজ্ঞায়নের মাধ্যমে উৎকর্ষতা সম্ভব। একটি ওয়াজিবকে পূর্ণতা দান করার জন্য যে পদক্ষেপ নেয়া হয় তাও ওয়াজিব।
উদাহরণস্বরূপ গণসংযোগ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহুমুখী বিশেষজ্ঞায়নের কথাই ধরুন। একটি পাণ্ডুলিপি তৈরী করা একটি বিজ্ঞান, আবার তাকে চিত্রনাট্যরূপ দেয়াও বিজ্ঞান, এটির পরিচালনাও বিজ্ঞান। একইভাবে এতে অভিনয় করা ও এর বিপণন করাও বিজ্ঞান। এভাবে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত বিশেষায়িত জ্ঞানের একটি দীর্ঘ তালিকা তৈরী করা সম্ভব।
রেডিওর জন্যে অনুষ্ঠান নির্দেশনা এক ধরণের কাজ। টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্দেশনা আরেক ধরণের। আবার মঞ্চ নির্দেশনা ও সিনেমা পরিচালনা দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। আজকে গণমাধ্যমের কাজ এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে সকল শিল্পকলার সম্মিলন ঘটেছে। দক্ষতার সাথে এসব বিষয় শেখার জন্যে বহু ইনস্টিটউট ও কলেজ রয়েছে যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা উচ্চতর ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা লাভ করছে।
জ্ঞানের এসব শাখার ইসলামীকরণ কখনোই সম্ভব হবে না যদি আমরা বিশেষজ্ঞদের সাহায্য না নেই। কেবল তারাই এ ক্ষেত্রের জন্যে ইসলামী বিকল্প হতে পারেন।
ইসলামী আন্দোলন মেধায় সমৃদ্ধ। কিন্তু এর মেধাবী জনবল উপযুক্ত ক্ষেত্র ও অবস্থানে যথার্থভাবে নিয়োগ করা হয় না। আমরা প্রায়ই মেডিসিন, ফার্মাকোলজি অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং এর মতো কতিপয় ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের জটলা দেখি। কিন্তু বিজ্ঞানের বিরল শাখাগুলোকে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের সংখ্যা খুবই কম।
এ অবস্থা মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণসংযোগের মতো মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সাধারণত তরুণরা এসব বিষয়কে অবজ্ঞা করে ফলিত বিজ্ঞানে দিকে ঝুঁকে পড়ে। অথচ এসব বিজ্ঞান সমাজের জন্য অধিকতর প্রয়োজনীয় এবং তা সমাজকে প্রভাবিত করে। এ জন্যই যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের ইহুদীরা এক্ষেত্রে একচেটিয়া কর্তৃত্ব স্থাপন করে অধিকাংশ গুরুত্বপুর্ণ পদ দখল করে নিয়েছে যেন তারা তাদের মর্জি মাফিক স্বীয় স্বার্থে এসব পরিচালনা করতে পারে।
বহু বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ মানবিক বিজ্ঞান ও সাহিত্য সাধনায় যোগ্য ও আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক চাপের দরুন ফলিত বিজ্ঞান নিয়ে অধ্যয়নে বাধ্য হয় অথচ তার সামর্থ্য ও আগ্রহ যেদিকে সেখানে তার মেধা ব্যবহার করতে পারলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অধিকতর ফল লাভ করা সম্ভব হতো।
বস্তুত মানবিক বিজ্ঞানের গুরুত্ব ও এর গুরুতর প্রভাব থাকা সত্ত্বেও এ শাখায় মুসলমানদের ঘাটতি খুবই প্রকট। এমন কি সাহিত্যের ক্ষেত্রে অর্থাৎ ছোটগল্প, সাহিত্য সমালোচনা ইত্যাদিতেও ঘাটতি উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে দীপ্তিমান কোনো তরুণের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সাহিত্যচর্চা করলেও অন্যদের মতো প্রয়োজনীয় প্রচার সুবিধা পায় না অথচ বামপন্থীসহ অন্যরা এক্ষেত্রে পরস্পরকে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
তথ্য ও গবেষণা
সমসাময়িককালে ইসলামী আন্দোলনের একটি অতি প্রয়োজনীয় চাহিদা হচ্ছে একটি ডাটা ব্যাংক অথবা তথ্য ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন যা এ যুগের তথ্য বিপ্লবের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উপযুক্ত বিশেষজ্ঞদের এ কেন্দ্রে নিয়োগ দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালার দিক নির্দেশনা হচ্ছেঃ আর তোমাকে সর্বজ্ঞ আল্লাহর ন্যায় কেউই অবহিত করতে পারবে না (সূরা ফাতিরঃ ১৪)। সেই সঙ্গে একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা মোতাবেক অত্যাধুনিক সাজসরঞ্জাম ও জনবল দিয়ে এ কেন্দ্রকে সুসজ্জিত করতে হবে।
তথ্য সংগ্রহের সূত্র ও উপায়, তথ্য সংরক্ষণ, শ্রেণীবিন্যাস ও পুনরুদ্ধারের উপায়ও বহুমুখী হয়েছে। আমরা এসব উপায় উপকরণ ব্যবহারের কোনো পদক্ষেপ নিয়েছি কি?
শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে অন্যদের ব্যাপার বাদ দিলেও নিজেদের সম্পর্কিত অর্ধেক তথ্যও আমাদের জানা নেই। অথচ শত্রুরা আমাদের ব্যাপারে সকল খবর রাখে।
কয়েকজন আরব ভাই যারা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উপর কাজ করছিলেন তাদের সাথে আমি ইস্তাম্বুলে যাই। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তুর্কমেন প্রজাতন্ত্র থেকে আগত কয়েকজন ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। তারা আমাদেরকে জিজ্ঞেস করে- লৌহযবনিকার অন্তরালে আটকে থাকা তুর্কমেনিস্তান ও অন্যান্য প্রজাতন্ত্রের আপনাদের ভাইদের জন্য আপনাদের সাহায্য এখন কোথায়, যারা স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করতে সক্ষম? তাদের এখন ধর্মীয়, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ সকল প্রকার সাহায্য ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দরকার। কোথায় সেই সাহায্য ও বিশেষজ্ঞ? কে তাদেরকে সাহায্য দেবে?
গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রয়কার কার্যফল পাওয়ার সাথে সাথে খৃস্টান ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের কাছে সকল তথ্য, উপাত্ত, পরিসংখ্যান এবং চিহ্নসম্বলিত মানচিত্র তৈরী ছিল। ফলে সঙ্গে সঙ্গে বাইবেল ও অন্যান্য বইপত্র বিতরণ করা এবং সর্বত্র মিশনারীদের পাঠানো হয়। তখন থেকে এ স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রায় ২০০০ গীর্জা নতুন স্থানে নির্মাণ অথবা পুনর্নির্মাণ বা ধ্বংসন্মুখ গীর্জাগুলোকে আবার নতুন করে সাজানো হয়। গির্জা ও তাদের লোকজন এখনো সেখানে এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে ইসলামী কাজ কোথায়?
আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা আমাদের সেখানকার ভাইদের সম্পর্কে কী জানেন? তাদের সংখ্যা, তাদের দেশ, ইতিহাস, বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি এবং তাদের চাহিদা কী? আমি জানতে পারলাম, তাদের সম্পর্কে আমরা সামান্যই জ্ঞান রাখি এবং এমন একটি ইসলামী প্রতিষ্ঠানের কথাও জানি না যার কাছে তাদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত ও প্রামাণ্য তথ্যাদি আছে যা কাজে লাগানো যেতে পারে।
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামী আন্দোলনকে যুগোপযোগী ধারায় গড়ে তুলতে হবে। এজন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং লক্ষ্য অর্জনে আন্দোলনের আশপাশের মুসলমানদের সকল শক্তির সমাবেশ ঘটাতে হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে আসুন আমরা এ প্রার্থনা করিঃ
হে আল্লাহ, আমাদের আজকের দিনটিকে গতকালের চেয়ে ভালো করুন এবং আগামীকালকে আজকের দিনটির চেয়েও ভালো করুন। আমাদের সকল কাজে আপনার রহমত বষর্ণ করুন। আমীম!