আধুনিক যুগঃ ইসলাম কৌশল ও কর্মসূচি
প্রফেসর ড. ইউসুফ আল কারযাভী
অনুবাদঃ মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জী
প্রথম সংস্করণের প্রকাশকের কথা
মুসলিম বিশ্বের বর্তমান সমস্যা হলো, মুসলিম বিশ্ব সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। মুসলিম বিশ্ব গতিশীল নয়। এর প্রধান কারণ, মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব উম্মাহর মৌলিক সমস্যা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। তারা ব্যর্থ হয়েছে একটি কার্যকর কৌশল নির্মাণ ও কর্মসূচি গ্রহণে যা তাদেরকে বর্তমান অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে। এই হলো সার্বিক অবস্থা।
বাংলাদেশে যারা সংস্কার ও রেনেসাঁর নামে কাজ করছে তারা কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে সক্ষম না হওয়ার কারণে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে যারা এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা তাদের কাজের অগ্রাধিকারের তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণ করতে সক্ষম হননি- কোন কাজটি আগে করতে হবে এবং কেন?
ইসলামিক ইনফরমেশন ব্যুরো বাংলাদেশ একটি বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ব্যুরোর লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ সংস্কারের নিমিত্তে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি নির্মাণ করা। এ উদ্দেশ্যে ব্যুরো পাঠকদের জন্য প্রফেসর ড. ইউসুফ আল কারযাভী রচিত প্রাইওরিটিস অব দি ইসলামিক মুভমেন্ট ইন দি কামিং ফেস– এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করছে। আমাদের বিশ্বাস এ গ্রন্থটি বাংলাদেশে যারা সমাজ সংস্কারে কাজ করছে তাদের সুখনিদ্রা ভাঙতে সক্ষম হবে এবং তাদের মাঝে গতিশীলতা আনতে সহায়ক হবে। আশা করা যায় বইটি সমাজ কর্মীদের উজ্জীবিত করবে এবং তাদের মাঝে প্রাণসঞ্চার করার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সামাজিক পরিবর্তন আনতে সক্রিয় ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটকের ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
ড. কারযাভীর এ গুরুত্বপূর্ণ বইটি দার আল নসর, কায়রো থেকে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণ থেকে অনুবাদ করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জী। অনুবাদের কাজ প্রাথমিকভাবে শেষ হওয়ার মুহূর্তে বইটির একটি পরিমার্জিত ও সংশোধিত সংস্করণ যা এয়োকেনিং পাবলিকেশনস, যুক্তরাজ্য প্রকাশ করে তা আমাদের হস্তগত হয়। ফলে বাংলা অনুবাদের পূনর্বিন্যাস করার প্রয়োজন দেখা দেয়। জনাব সানাউল্লাহ আখুঞ্জী তার নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে এর পুনর্বিন্যাস, পরিমার্জন ও সংশোধনের জন্য সময় দিতে অপারগ হওয়ায় প্রকাশককেই বইটির পুনর্বিন্যাস ও সম্পাদনার কঠিন কাজটি গ্রহণ করতে হয়। আমাকে এ কাজে সহায়তা করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক চৌধুরী ও কবি ওমর বিশ্বাস। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এরপরও যদি বাংলা অনুবাদে কোনো ভুলত্রুটি থেকে থাকে তাহলে তার দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে বইয়ের সম্পাদক ও প্রকাশকের। কেননা, সংশোধিত ইংরেজি অনুবাদের সাথে সাযুজ্য বজায় রেখে বাংলা অনুবাদ সাজানো হয়েছে যা জনাব সানাউল্লাহ শারীরিক অসুস্থতার জন্য দেখে দিতে পারেননি। এখানে পবিত্র কোরআনের আয়াতের অনুবাদের ক্ষেত্রে আমরা কোনো প্রকাশিত কোরআনের বাংলা অনুবাদের সাহায্য নেইনি। বরং আয়াতের বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে ড. কারযাভীর সংশোধিত ইংরেজি অনুবাদের বই থেকে। যে কারণে আমরা ‘‘কোট’’ ‘‘আনকোট’’ চিহ্ন ব্যবহার করিনি। একথা হাদিসের অনুবাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জনাব শফিক চৌধুরী বইয়ের প্রারম্ভিক কথা, ইংরেজী সংস্করণের সম্পাদকের কথা ও লেখকের মুখবন্ধ অনুবাদ করেছেন। কবি ওমর বিশ্বাস অনুবাদ করেছেন লেখক পরিচিত ও প্রকাশকের কথা।
বিশিষ্ট গবেষক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান কায়রো থেকে প্রকাশিত বইটি সরবরাহ করেন- যে কারণে আমরা বইটির অনুবাদের কাজে হাত দিতে সক্ষম হই। জনাব শাহ্ আবদুল হান্নান যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত বইটির সংশোধিত সংস্করণ আমাদেরকে দেন। ফলে বইটির পরিমার্জন, সংশোধন ও পুনর্বিন্যাস করা সহজ হয়। আমরা তাদের উভয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমাদের অনুরোধে [email protected] ড. কারযাভীর একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠায়। এজন্য আমরা www.islamonline.net এর কাছেও কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ জনাব শফিক চৌধুরী ও কবি ওমর বিশ্বাসকে বইটি পুনর্বিন্যাস ও সম্পাদনার কাজে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সহায়তার জন্য। কবি ওমর বিশ্বাস ভালোবাসার স্বাক্ষর হিসেবে বইটির প্রুফ দেখে দেয়ার মতো কষ্টকর কাজটি করেন। উল্লেখ্য বইটির বানান রীতির ক্ষেত্রে দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া যথাসম্ভব বাংলা একাডেমীর ‘বাংলা বানান-অভিধান’ অনুসরণ করা হয়েছে। স্নেহাস্পদ আহমদ হোসেন মানিক বইয়ের জন্য মূল্যবান সময় ব্যয় করেছে। সর্বোপরি জনাব সানাউল্লাহ আখুঞ্জী বইটির একটি সুন্দর অনুবাদ উপহার দেন। আমি তাদের সকলের কাছে ঋণী।
১৯৯৫ সালের মে মাসে ইসলামিক ইনফরমেশন ব্যুরো বাংলাদেশ ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী রচিত গ্রন্থ জ্ঞানঃ ইসলামী রূপায়ণ প্রকাশ করে। আমার বিশিষ্ট বন্ধু মাহবুবুল হক আমার অনুরোধে এ বইটি অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। বইটি অনুবাদের ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকীর এ অনবদ্য বইটি প্রকাশের সুযোগ দেয়ার জন্য আমি জনাব মাহবুবুল হকের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। স্নেহাস্পদ আতা সরকার সার্বিক প্রকাশনা তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে এ বইটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। আমি দেরিতে হলেও তাদের কাছে ঋণ স্বীকার করছি।
শাহ আবদুল হালিম
চেয়ারম্যান
ইসলামিক ইনফরমেশন ব্যুরো বাংলাদেশ
প্রারম্ভিক কথা
তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল যুবক হাসান আল বান্না তার মাতৃভাষা ইংরেজিতে ‘প্রাইওরিটিস অব দি ইসলামিক মুভমেন্ট ইন দি কামিং ফেস’ বইটির সংশোধিত অনুবাদের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেছেন। এ বইটির ইংরেজি অনুবাদের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছেঃ
১. সমসাময়িক ফিকাহ
শিক্ষিত মুসলিম যুবকদের জন্য সমসাময়িক কালের ফিকাহ প্রয়োজন, বিশেষত যারা পাশ্চাত্যে বাস করে। তাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন দিক নির্দেশনা গ্রহণ করছেন। এর মধ্যে রয়েছে উগ্রবাদিতা, ফেতনা বা বিভ্রান্তিকর মতবাদ, অপরকে কাফের সাব্যস্ত করার প্রবণতা ও অনমনীয় মনোভাব। তারা অন্য মুসলমানদের প্রতি রূঢ় আচরণ করে। যে দেশে বসবাস করে সেখানকার লোকদের প্রতি শত্রুতাভাব প্রদর্শন করে। যদিও তারা সেখানে দুর্বল সংখ্যালঘু। তারা নিজ মাতৃভূমি থেকে পরিত্যক্ত। তাদের অনেকেই স্বদেশ থেকে বিতাড়িত। এমন কি তাদের স্বদেশের সরকার পশ্চিমাদেশের সরকারকে তাদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছে। অথচ পশ্চিমা সরকার এদের আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি নানারকম সমাজকল্যাণমুলক সুবিধা দিয়েছে। তারা সেখানে শিক্ষা, ব্যবসা, মসজিদ নির্মাণ, সামাজিক কেন্দ্র ও স্কুল নির্মাণের সুযোগ লাভ করেছে।
যারা তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছেন সে সব লোকের প্রতি এ ধরণের লোকদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছে সৎ কাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কি হতে পারে (সূরা আর রাহমানঃ ৬০)। এ ধরণের কথা হাদিসেও উল্লেখিত হয়েছেঃ যে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা দেখায় না। এর পরিবর্তে তারা মুসলিম দেশগুলোতে রচিত সেই সব সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়, যে সব দেশে কয়েক শতাব্দী ধরে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। যখন পথভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তি দেখা যায়, তখন পণ্ডিত ও ইসলাম প্রচারকরা কঠোর সমালোচনা ও নিন্দনীয় ভাষায় তাদেরকে বিরোধিতা করেন এবং নির্ভেজাল মূলে ফিরতে আহ্বান জানান।
এ ধরণের আহ্বান ও বই-পুস্তক, সেই সব মুসলিম দেশ থেকে আমদানী করা হয়, যেখানে পণ্ডিত ও দ্বীনের প্রচারকরা স্বৈরশাসক ও একনায়ক শাসকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এক আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। এটি জন্ম দিয়েছিল এক ভারসাম্যহীন ইসলামী চিন্তাধারার যার ভিত্তি ছিল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা, কাউকে কাফের বলা। এমন কি শাসক ও সমাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা এবং যে কোনো ধরণের সংলাপের আহ্বান বা স্বাধীনতার প্রতি সন্দেহ পোষণ করা। এসব সাহিত্য তাদের মূল পরিবেশ থেকে পাশ্চাত্যে আমদানি করা হয়। এ ক্ষেত্রে ফিকাহর মৌলনীতি কোনোভাবেই বিবেচনা করা হয়নি- আর তা হচ্ছে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ফতোয়া পরিবর্তনশীল। মুসলমানদের বর্তমান দুর্বলতার অবস্থানের কথাও বিবেচনা করা হয়নি।
সারা বিশ্ব যখন তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করছিল, তখন যে সব সরকার দাওয়াতী কাজ চালাতে ও দ্বীন প্রচারকদেরকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা এবং স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রদান করছে- তখন সে সরকারগুলোর সঙ্গে বৈরিতা সৃষ্টির পিছনে কি প্রজ্ঞা ও উদ্দেশ্য থাকতে পারে? ইসলামী রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যখন মুসলিম সরকারগুলো ব্যর্থ হযেছে তখন সে দায়িত্ব পাশ্চাত্যে বসবাসকারী সংখ্যালঘুদের উপর চাপিয়ে দেয়ার কি যৌক্তিকতা থাকতে পারে যারা বর্ণবাদের হুমকির সম্মুখীন। বিভিন্ন মুসলিম গ্রুপের মধ্যে বিভেদে এ সংখ্যালঘুদের জড়িয়ে কি উপকার হবে যখন এ মতপার্থক্যের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। আর উম্মাহর পণ্ডিতদের মধ্যে কোনো বিশেষ মুসলিম গ্রুপকে কাফের অভিহিত করা সম্পর্কে কখনই কোনো ঐকমত্য ছিল না।
উপরোল্লিখিত অজ্ঞতার সৃষ্ট বিষয়গুলোর কোন ব্যাখ্যা নেই। এসবের একটি দীর্ঘ বিবরণ ড. কারযাভী তার বইয়ে দিয়েছেন এবং অগ্রাধিকারের ফিকাহ, ভারসাম্যের ফিকাহ ও বাস্তবতার ফিকাহর রূপরেখা তুলে ধরেছেন।
২.কর্মবাদ ফিকাহ
ইসলামী চিন্তার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত হচ্ছে এ বইটি- যদিও ড. কারযাভী এর উপাদান পবিত্র কোরআন, সুন্নাহ, খোলাফায়ে রাশেদীনের ঐতিহ্য, ফিকাহর পণ্ডিত এবং ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক সংস্কারকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন।
তা সত্ত্বেও একথা সত্য ড. কারযাভীর পূর্বে আর কেউই সাফল্যের সঙ্গে সকল আহরিত বিষয়কে বিন্যাসের মাধ্যমে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করতে পারেননি। তিনি আমাদের বর্তমান সমস্যাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে তার সমাধানও বের করেছেন। এগুলো তিনি করেছেন নিখুঁত ব্যাখ্যা, যৌক্তিক ও জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
শায়খ মুহাম্মদ আল গাজালীর পাশাপাশি এ বইটি ড. কারযাভীর একটি কঠোর প্রচেষ্টার ফসল। তিনি এ বইতে সমসাময়িক কালের ইসলামী আন্দোলনের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তিনি আন্দোলনের ব্যাধির মূল কারণ উদঘাটন ও তা সমাধানের পথ নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বিষয়গুলো তিনি তার বিভিন্ন বইতেও আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- ‘দি ফেনমেনন অফ এক্সটিমিজন ইন তাকফির’ ‘ইসলামিক এয়োকেনিং বিটুইন রিজেকশন এন্ড এক্সট্রিমিজম’ এবং ‘হোয়্যার ইজ দি রং’।
এছাড়াও এ বইটিতে বিকল্প ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি এবং পদ্ধতির রূপরেখা দেয়া হয়েছে। অপরদিকে এর আগের বইগুলোতে ব্যাপক বিশ্লেষণ, সমালোচনা ও মূল্যায়নের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। নতুন ধরণের উসূল বা মৌলিক নীতি, ইসলামে কর্মবাদ, ফিকাহ, বাস্তব অভিজ্ঞতার ফিকাহ, ধর্মীয় ফিকাহর প্রয়োজন ও তা বাস্তবায়ন পদ্ধতির উন্নয়ন ও প্রবর্তন করার ক্ষেত্রে তার অবদান প্রশংসনীয়।
বস্তুত ইসলামের বর্তমান অবস্থার জন্য ইসলামী সাহিত্যের অভাব একটি অন্যতম প্রধান কারণ। ইসলামী দাওয়াত সম্পর্কিত বহু সাহিত্য রচিত হয়েছে যেগুলো অবাস্তব যুক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ, যা সমসাময়িক সমস্যা ও স্থানের প্রকৃতির সাথে সম্পর্কহীন। পূর্বসূরিরা আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন তাই শেষ কথা। এর উন্নয়ন, উদ্ভাবন ও নবায়নের কোনো সুযোগ নেই। বিভিন্ন ইসলামী পরিবেশ থেকে নেয়া চিন্তা ও আচরণ পাশ্চাত্যের ইসলামী সার্কেলেও একই ধরণের বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এর ফলে কোনটি নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় এবং কোনটি অনির্দিষ্ট ও পরবর্তনীয় সে সম্পর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। আর এসব অহেতুক তর্ক কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি। এসব বিভ্রান্তি সংশোধন করাই এ বইটির উদ্দেশ্য যাতে দেখানো হয়েছে যে ইসলাম ও তার ঐতিহ্য যুক্তিসঙ্গতভাবে বাস্তবমুখী পদ্ধতির মাধ্যমে বাস্তবতাকে মোকাবিলা, উপলব্ধি ও পরিবর্তন করে।
৩. লেখকের পাণ্ডিত্য
সমসাময়িক কালের বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামিক চিন্তা-চেতনা ও দাওয়াতের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসেবে ড. ইউসুফ আল কারযাভীর নাম উচ্চারণ করলে অত্যুক্তি করা হবে না। এর কারণ হচ্ছেঃ
ক. তার মধ্যপন্থী পদ্ধতি এবং আধুনিক ও ভারসাম্যপূর্ণ আবেদন। কোনো বিশেষ মাজহাবের অন্ধ অনুকরণ ও অন্যান্য সকল মাজহাবকে খারিজ করা এবং কোনো মাজহাবকেই না মানা এ দু’য়ের মধ্যে তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। একই সঙ্গে পথভ্রষ্ট ও নব উদ্ভাবিত তাসাউফপন্থী সুফিবাদ ও সত্য পথে চালিত তাসাউফপন্থীদের বিরোধিতাকারী, প্রত্যাদেশের বিরোধী হলেও যুক্তি দ্বারা পরিচালিত ও যারা প্রত্যাদেশকে বোঝার ক্ষেত্রে যুক্তির ভূমিকার বিরোধিতা করে- এসব ক্ষেত্রে তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। আর বাস্তব মধ্যপন্থার মাজহাব উম্মাহর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে যেখানে সর্বপ্রকার উগ্রপন্থা গুরুত্ব হারায়।
খ. ইসলাম সম্পর্কে তার সুবিস্তৃত ও ব্যাপক জ্ঞান রয়েছে। তিনি তার বুদ্ধিবৃত্তিক অবদানকেই একটি ক্ষেত্রেই শুধু সীমাবদ্ধ করে রাখেননি। তিনি যেমন লিখেছেন আকিদাহ্ সম্পর্কে, তেমনিভাবে লিখেছেন ইবাদাতের ফিকাহ অথবা বাস্তবতার ফিকাহ সম্পর্কে। তিনি শুধু এসব ক্ষেত্রেই নয় অন্যান্য ক্ষেত্রেও লিখছেন। তিনি কোরআন ও সুন্নাহর ফিকাহ এবং বাস্তবতা ও তার প্রয়োগের ফিকাহ সম্পর্কিত অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
তিনি ইসলামের ইতিহাসে উল্লেখিত শ্রেষ্ঠ স্কলারদের পথ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি কোরআন ও সুন্নাহর মাপকাঠিতে বিচার-বিশ্লেষণ করেন এবং তার বিরোধী হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি কোনো মাজহাবের অন্ধ অনুকরণকারীদের অন্তর্ভুক্ত নন, তবে সমৃদ্ধ ইসলামী ঐতিহ্য বাতিল করার পক্ষেও নন। তার বক্তব্য ও উপদেশ খুবই সুস্পষ্ট। তার হৃদয় আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় পূর্ণ। তিনি ইবনে আল কাইয়েমের মতো সালাফি, সুফি স্কলার ইমাম আল শাফির মতো একজন বড় লেখক ও কবি এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতো সমসাময়িক বিষয়ের উপর একজন ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন পণ্ডিত।
গ. তার অগাধ বিশ্বাস যে ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্ম বিশ্বাস নয় বরং এটি একটি অপরিহার্য কাঠামো, সংগঠন, আন্দোলন ও সংগ্রাম- যা তাকে একজন যুবক হিসেবে সংযুক্ত করেছিল সমসাময়িক কালের বৃহৎ ও প্রাচীনতম ইসলামী আন্দোলন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সঙ্গে। আন্দোলনের জন্য তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় এবং তিনি কারাভোগ করেন। আল্লাহর রহমতে কারাভোগের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি চরম ধৈর্যের পরিচয় দেন।
তা সত্ত্বেও তিনি তার ইসলামী মিশনের ঝাণ্ডা নিয়ে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য ভ্রমণ করেছেন যদিও তার বয়স এখন ৭০ এর ওপর। আল্লাহ তার প্রতি রহমত বর্ষণ করুণ। তাকে দীর্ঘ জীবন দান করুন। সারা বিশ্বব্যাপী তার এ সফরই তাকে সমসাময়িক কালের মুসলিম চিন্তাবিদ, মুসলিম জনগণ, মুসলিম যুব আন্দোলন এবং তাদের সঙ্গী-সাথীদের সাথে সুপরিচিত ও ঘনিষ্ঠ করে তুলেছে।
তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক ফতোয়া কাউন্সিলের প্রধান। একই সময়ে তিনি সমসাময়িক কালের বহু ফিকাহ কাউন্সিল, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং সক্রিয়ভাবে এদের কর্মকাণ্ডে জড়িত। তিনি নিজে মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী এবং সমসাময়িক ইসলামী চিন্তার ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তার অনুশীলনের আহ্বান জানান। বিভিন্ন ফোরাম- ইসলামিক-সেক্যুলার, মুসলিম-ক্রিশ্চিয়ান, আরব ন্যাশনালিস্ট-ইসলামিক ইনস্টিটউটে বিতর্ক ও আন্তঃমাজহাব সংলাপে অংশগ্রহণ করে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
বস্তুত তরুণ হাসান আল বান্নার অনুবাদের প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। তিনি ইংরেজী ভাষাভাষী পাঠকের কাছে ড. কারযাভীকে উপস্থাপন করেছে।
পাশ্চাত্যে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এ বিরাট অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আল্লাহ প্রফেসর ড. ইউসুফ আল কারযাভীকে এবং ইংরেজীতে ভাষান্তরের জন্য এস এম হাসান আল বান্নাকে পুরস্কৃত করুন। আমিন।
শায়খ রাশিদ ঘানুসী
সভাপতি
আন নাহদা পার্টি তউনিসিয়া
এপ্রিল ২০০০
ইংরেজী সংস্করণের সম্পাদকের কথা
দুর্ভাগ্য, বিংশ শতাব্দী ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেখতে পায়নি। তা সত্ত্বেও এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইসলামী পুনর্জাগরণ ও পুনরুত্থান ঘটার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের বিশেষত শিক্ষিত ও যুবকদের মধ্যে এ জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে যে ইসলাম একটি ব্যাপক জীবন ব্যবস্থা যা মানুষকে ইহজীবন ও পারলৌকিক জীবনে সত্যিকার অর্থে সুখের পথ প্রদর্শন করবে।
মুসলিম উম্মাহর বর্তমান পরিস্থিতি এমনি যে তাকে ভেতর ও বাইরের অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। আজ ইসলামী সভ্যতা এবং এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অন্যান্য বিষয় ক্ষয়িষ্ণুতার সম্মুখীন। যার ফলে বহু ব্যাধি ও সমস্যা দেখা দিয়েছে।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা- এটি উপলব্ধির ক্ষেত্রে ব্যর্থতা আজ মুসলিম মননের একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরণের লোক মনে করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সঙ্গে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে খাপ খেয়ে চলতে পারে। অপরদিকে রয়েছে তারা যারা ইসলামী দাওয়াতের কাজের ব্যাপারে একান্তই আন্তরিক, কিন্তু ইসলামকে বোঝার ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা চরমপন্থী- না হয় উন্নাসিক। ব্যাপক সমস্যার জন্য ব্যাপক সমাধান প্রয়োজন- অনেকে এটিও বুঝতে পারেন না। অন্যদের অবস্থা এ রকম যে তাদের রয়েছে উচ্চ আশা ও অত্যুচ্চ উদ্দেশ্য। কিন্তু যারা এ আশা ও স্বপ্ন উপলব্ধি করতে পারেন সে রকম মেধা তাদের নেই।
এছাড়াও অনেক ইসলামী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে বর্তমান অবস্থার দোষ-ত্রুটি সংশোধন করে এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সেই কাঙ্ক্ষিত সমাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে যেখানে সামগ্রিকভাবে আল্লাহই একমাত্র উপাস্য হতে পারেন। দেখা যায় এ ধরণের আন্দোলন প্রাথমিকভাবে বিকশিত হয় এবং জনগণের ব্যাপক আস্থা লাভ করে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তা স্থবির অবস্থায় পতিত হয়। সে সময়ই এখন আমরা অতিক্রম করছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মুসলিম উম্মাহ যে সকল ত্রুটি ও সমস্যা দ্বারা জর্জরিত- ইসলামী আন্দোলনও সেই সকল ত্রুটি ও সমস্যা দ্বারা সংক্রমিত।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা কোথা থেকে শুরু করব? আমাদের ঘাটতি কিসে? আমাদের কি করা উচিত? কিভাবে করা উচিত? আমরা কি সুস্পষ্টভাবে দাওয়াত, আন্দোলন (হারাকাহ) ও সংস্কারের (ইসলাহ) প্রকৃতি বুঝতে পেরেছি? কোন পদ্ধতি আমাদের প্রয়োগ করা উচিত? সমাজের বিভিন্ন অংশের সাথে আমরা কিভাবে আচরণ করব? ইসলামী আন্দোলনের অগ্রাধিকারসমূহ কি কি? এসব প্রশ্ন সামনে রেখে প্রফেসর ড. ইউসুফ আল কারযাভী এ বইটি লিখেছিলেন।
ফিকাহ শাস্ত্রে যে কয়েক জন বিজ্ঞ পণ্ডিত জীবিত আছেন আল্লাহর রহমতে তাদের মধ্যে ড. কারযাভী একজন।। তিনি নতুন যারা আধুনিকতার প্রতিনিধিত্বকারী ও পুরাতন যারা ঐতিহ্যবাদীর প্রতিনিধিত্বকারী এর উভয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ আধুনিক সিদ্ধান্ত এবং অভিমত পেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও সমৃদ্ধ জ্ঞান উম্মাহর কল্যাণ বয়ে এনেছে।
ড. কারযাভী ইসলামী আন্দোলনের সমস্যা, সম্ভাবনা ও অগ্রযাত্রা নিয়ে সব সময় চিন্তাভাবনা করেন। তিনি আন্দোলনের কোনো বিষয়ে উপদেশ বা নির্দেশ দিতে নিজেকে সক্ষম মনে করলে তা নির্দ্বিধায় দেন।
ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের ক্ষেত্রে তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা থেকেই এ গ্রন্থটির জন্ম। এ গ্রন্থ থেকে শুধুমাত্র পরামর্শই নয় নির্দেশনাও নেয়া উচিত। কেননা আমরা এমন এক সময়ের মধ্যে বসবাস করছি যেখানে প্রত্যেকেরই বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিন্তু স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তিই দিক নির্দেশনা দেয়ার যোগ্যতা রাখেন।
মূল বইটি আরবী ভাষায় লিখিত। এর দশটি সংস্করণও ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। বইটি প্রকাশের কয়েক মাস পরই এর একটি প্রাথমিক ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কিন্তু তা ছিল অপূর্ণাঙ্গ। ফলে এর একটি সংশোধিত ইংরেজি অনুবাদের প্রয়োজন অনুভূত হয়- যা মূল আরবী গ্রন্থের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুর কাছাকাছি।
এ নতুন ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকা লিখে দিতে সম্মত হওয়ার জন্য আমি জনাব শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শায়খ রাশিদ ঘানুসীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। ড. কামাল হিলবাবি মূল্যবান উপদেশ ও পরামর্শ দিয়েছেন- আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। ইউসরা ঘানুসী ভূমিকার অনুবাদসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। এ সহযোগিতার জন্য আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করুন। এছাড়াও ওয়ালী, উমর, নাদীম, বারা, সাহেরা ও অন্যান্য অনেকের সহযোগিতার ফলেই বইটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। আল্লাহ তাদের সকলকেই পুরস্কৃত করুন।
পরিশেষে আমার শ্রদ্ধেয় পিতা হাফিজ আবদুল কাদিরসহ অন্যান্য শিক্ষক যারা আমাকে কোরআনের ভাষা শিখিয়েছিলেন তাদেরকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। আমি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি যে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য আস্বাদন করা যায় কেবল আরবি ভাষার মাধ্যমেই।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূললের সা. নির্দেশিত পথে ও আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আল্লাহ আমাদের সকলকেই এ পৃথিবীতে অবিচল রাখুন।
এস এম হাসান আল বান্না
লন্ডন, যুক্তরাজ্য।
এপ্রিল ২০০০
লেখকের মুখবন্ধ
সকল প্রশংসা সর্বশক্তিমান আল্লাহর জন্যই, যাঁর করুণায় সকল সৎকর্ম ফলপ্রসূ হয় এবং তাঁর প্রেরিত নবী, তাঁর পরিবার ও অনুসারীদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
এটি আমার সৌভাগ্য যে বিগত ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শীতকালে উত্তর আমেরিকার আরব মুসলিম ইয়ুথ এসোসিয়েশনের বার্ষিক কংগ্রেসে যোগ দেয়ার সময় সেখানে লেখক মোহাম্মদ আল হাশেমী আল হামেদীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেখানেই তিনি ‘সেন্টার ফল স্টাডিজ অন ইসলামিক ফিউচার’-এর প্রসঙ্গ আমার কাছে উত্থাপন করেছিলেন। এটি একদল মুসলিম চিন্তাবিদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। সেন্টারটির প্রতি সহযোগিতা ও সমর্থন দেয়ার জন্য তিনি আমাকে অনুরোধ করেন।
তিনি সেন্টারের উদ্যোগে এমন সব ইস্যু নিয়ে একটি সিম্পোজিয়াম আয়োজনের ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলেন যার সঙ্গে ইসলামের ভবিষ্যত কল্যাণ অকল্যাণ জড়িত এবং এর আলোচ্য বিষয় ও আলোচকদের নামও উল্লেখ করেন। এ ব্যাপারে আমার অভিমত জানতে চাইলে সেন্টার ও সিম্পোজিয়াম আয়োজনের উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানিয়ে আমার সাধ্যমত পরামর্শ দেই। তা সত্ত্বেও এ উদ্যোগে আমার সক্রিয় অংশগ্রহণের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার তিনি চাচ্ছিলেন। তার প্রস্তাবকে আমার কাছে আরো হৃদয়গ্রাহী করার জন্য তিনি বললেন, আমরা এমন একটি দেশে সিম্পোজিয়াম করব যে দেশটি আপনি পছন্দ করেন- আর সে দেশটি হচ্ছে আলজেরিয়া। তিনি আমাকে সিম্পোজিয়ামের জন্য আগামী তিন দশকে ইসলামী আন্দোলনের অগ্রাধিকার বিষয়ে একটি নিবন্ধ রচনায় মনোনিবেশ করার অনুরোধ জানান। ইসলামী আন্দোলনের অগ্রাধিকার নির্ণয়ে আমার চিন্তাভাবনার প্রতি আগ্রহ দেখে তিনি এ বিষয়টি নির্ধারণ করে দেন। আমি ফিকাহর এ শাখায় আমার ধ্যানধারণা কেন্দ্রীভূত করেছি। এ ব্যাপারে অনেক আলাপ আলোচনাও করেছি। ইসলামী আন্দোলকে সঠিক পথে পরিচালনা এবং ইসলামী পুনর্জাগরণের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে এটি আমার আগ্রহেরই বিষয়। এটি এমন তাৎপর্যপূর্ণ যে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে বিষয়টি যেন যথার্থভাবে তুলে ধরতে পারি সে জন্য আল্লহার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। পরিস্থিতি এমনই ছিল যে সিম্পোজিয়ামের আয়োজকদের দাওয়াত কবুল করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আলোচ্য বিষয়, আমন্ত্রণকারী ব্যক্তি, অংশগ্রহণকারীগণ এবং অনুষ্ঠানের স্থান-এসব উপাদান আমাকে কেবল অনুপ্রাণিতই করেনি বরং দাওয়াত কবুলে বাধ্য করেছে।
সে সময়ে আমাকে বারবার সফর করতে হয়। যার ফলে আমার চিন্তা ও গবেষণাকর্মে বিঘ্ন ঘটে। আমি আল্লাহর সাহায্য কামনা করে নিবন্ধটি রচনায় মনোনিবেশ করি।
সেই গবেষণাকর্মের ফসল আমার এই বই। আমি আশা করি এতে যে আলোকরশ্মি রয়েছে তা ক্ষীণ হতে পারে কিন্তু তাই আমাদেরকে সঠিক পথ দেখাবে। তবে এটি যথেষ্ট যে বিষয়টি আমরা গবেষণা ও আলোচনার পর্যায়ে তুলে আনতে পেরেছি। যদি তা নাও হয় অন্ততঃপক্ষে তা প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। আমি এখানে যা কিছু লিখেছি তা বিশেষভাবে ইসলামী আন্দোলন এবং সাধারণভাবে ইসলামী পুনর্জাগরণ সম্পর্কে আমার ইতিপূর্বের বই-পুস্তক, প্রবন্ধ-নিবন্ধসহ বিভিন্ন রচনারই সংযোজন ও ধারাবাহিকতা।
আন্দোলন ও পুনর্জাগরণের মধ্যে তফাত হচ্ছে, একটি আন্দোলন কোনো সংগঠিত গ্রুপ বা গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করে যাদের সুস্পষ্ট কর্মপন্থাসহ নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। আর পুনর্জাগরণ হচ্ছে ব্যক্তি ও সমষ্টি এবং সংগঠিত অথবা অসংগঠিত উভয়কে পরিবেষ্টন করে এক সর্বব্যাপী স্রোতধারা। পুনর্জাগরণ এমন এক জোয়ার যা আন্দোলনকে বলীয়ান ও শাণিত করে। অন্যদিকে আন্দোলন এমন এক পাথেয় যা পুনর্জাগরণকে সঠিক পথ পরিচালনার দিক নির্দেশনা দেয়। উভয়ের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমন যুক্তিবাদীরা বলে থাকেন যে নিরঙ্কুশ সার্বজনীনতা এবসলিউট জেনার্যালিটি এবং নিরঙ্কুশ বিশিষ্টতা এবসলিউট পার্টিকুলারিটি- এ দু’টির মধ্যে তা বিদ্যমান রয়েছে। সকল আন্দোলন হচ্ছে পুনর্জাগরণ। কিন্তু সকল পুনর্জাগরণই আন্দোলন নয়। সেহেতু আন্দোলনের চেয়ে পুনর্জাগরণ তার লক্ষ্যের ক্ষেত্রে অধিকতর ব্যাপক ও বিস্তৃত।
এ ক্ষেত্রে আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমি যখনই ইসলামী আন্দোলনের কথা বলি তখন তা সর্বাত্মক ইসলামী আন্দোলনকে বুঝিয়ে থাকি। কোনো বিশেষ ধরণের সংগঠন বা আন্দোলনকে নয়। অবশ্য উদাহরণ হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি ইখওয়ানুল মুসলিমিনের কথাই উল্লেখ করব। কারণ এ আন্দোলনের মধ্যেই আমি নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছি। এ আন্দোলনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমি অভিজ্ঞতা লাভ করেছি এবং প্রায় অর্ধশতাধিক কালের ঘটনা প্রবাহ প্রত্যক্ষ করেছি।
আমি এ বইয়ের জন ‘প্রাইওরিটিস অব দি ইসলামিক মুভমেন্ট ইন দি কামিং ফেস’ নামটি বেছে নিয়েছি। অনুরোধ মাফিক আলোচনার বিষয়বস্তু তিন দশকের মধ্যে সীমিত রাখিনি। এ দ্রুত পরিবর্তনশীল যুগে আমি এরূপ সীমিত মেয়াদভিত্তিক আলোচনার কোনো কারণ খুঁজে পাই না।
প্রফেসর ড. ইউসুফ আর কারযাভী
দোহা, কাতার।
এপ্রিয় ১৯৯০