ষষ্ঠঅধ্যায়
উপসংহার
যা না বললেই নয়
বইয়ের শেষপ্রান্তে এসে আমি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করতে চাই ইসলামী আন্দোলনকে ভবিষ্যত প্রশ্নে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে। যে দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আন্দোলন বৈধ উপায়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে জন্যে সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। এরূপ পরিকল্পনা আধুনিক ধ্যান ধারণা, নির্দিষ্ট পর্যায়ক্রমে বিভক্তি এবং তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রণয়ন করতে হবে। এ পরিকল্পনা নমনীয়, সহজে সম্পাদন ও বাস্তবায়নযোগ্য হতে হবে। এর সকল দায়িত্বভার উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিতে হবে এবং কোনো ব্যক্তি নির্ভর হওয়া উচিত নয়। কেননা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ব্যক্তি বা কতিপয় ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল হলে তারা যতক্ষণ সক্রিয় থাকবে, পরিকল্পনাও ততোক্ষণ।
প্রামাণিক তথ্য,প্রকৃত পরিসংখ্যান, বিস্তৃত পর্যালোচনা, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রাপ্ত ও সম্ভাব্য সকল বৈষয়িক ও মানবিক সম্পদ, ভেতর ও বাইরের সকল মনস্তাত্ত্বিক এবং বস্তুগত বাধাসমূহের অবমূল্যায়ন ও অতিরঞ্জন ব্যতিরেকেই ব্যাপক গবেষণা ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। [আলোচ্য পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে হলে পড়ুন আমার বই ‘দি ইসলামিক সলিউশনঃ এ ফারিদা এন্ড এ নেসেসিটি’। তাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে এই আলোচনা করা হয়েছে।]
জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের যোগ্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত টীমকে দিয়েই এরূপ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। প্রত্যেক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি তার দক্ষতা ও মেধা ও টীমে নিয়োজিত করবেন। এ টীম তাদের বিবেচনা মতো অন্য যে কোনো যোগ্য ব্যক্তির কাছ থেকেও মতামত অথবা তথ্যাদি সংগ্রহ করতে পারে।
পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে ও পরে দিকটি দিকের ওপর মনোযোগ দেয়া আবশ্যক- সার্বক্ষণিক কাজ, বিশেষজ্ঞদের যোগ্যতা এবং তথ্য ও গবেষণা। এ তিনটি দিক নিয়ে আমরা উপসংহার বিস্তারিত আলোচনা করব।
সার্বক্ষণিক কাজ
আন্দোলনের ভবিষ্যত পরিকল্পনায় সকল কৌশলগত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, তথ্য, গণমাধ্যম, রাজনীতি ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অবশ্যই বেশ কিছু যোগ্য ব্যক্তিকে সার্বক্ষণিক কাজে নিয়োগ করা উচিত।
আন্দোলনের কেবল খণ্ডকালীন স্বেচ্ছাসেবী লোকদের কাজের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। কারণ এসব লোককে তাদের ব্যক্তিগত কাজেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে হয় বলে যে সামান্য সময় তারা আন্দোলনকে দেয় তাতে বড় ধরণের কোনো দায়িত্ব সম্পাদনের আশা করা যায় না। অবশ্য যেসব স্বেচ্ছাসেবক আল্লাহর ওয়াস্তে সামান্য সময়ও ব্যয় করেন তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বরং তাদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপকভাবে ফলপ্রসূ হয়ে থাকে। কেননা স্বেচ্ছাসেবীরাই আন্দোলনের সম্প্রসারণশীল ভিত্তি রচনা করে। দাওয়াতি কার্যক্রমের স্বার্থে সার্বক্ষণিক কাজে নিয়োজিত কতিপয় ব্যক্তি ছাড়া আন্দোলনের সকল সদস্যই বিনা বেতনে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবী।
দাওয়াতী কাজ ও আন্দোলনের গতিপ্রবাহের চাপের মুখে ইমাম হাসান আল বান্না তার সম্পূর্ণ সময় ও প্রচেষ্টা আন্দোলনের কাজে লাগাতে বাধ্য হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আন্দোলনের মধ্যে থেকেও বেশ কয়েক বছর শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন।
একাধিক দেশে আন্দোলনের বহু সদস্য ও নেতৃবৃন্দ এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা অথবা স্বাধীন ব্যবসায়ী বা বণিক ছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে ভালো প্রচেষ্টা সেটিই হতে পারে যখন ব্যক্তি আন্দোলনের সেবায় এবং এর উদ্দেশ্য অর্জনে সার্বক্ষণিক কাজে নিয়োজিত হয়।
অবশ্য সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়োগের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরাই দায়িত্ব পায়। তারা একে অপরের পরিপূরক হবে। এভাবে কাজের সকল ক্ষেত্রই বিশেষজ্ঞের দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্র বাদ দিয়ে কেবল কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞায়নের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে সঠিক ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোথাও কোনো ব্যয় হবে না।
এক্ষেত্রে অর্থকড়ি কোনো সমস্যা হওয়া উচিত নয়। কারণ এ খাতে অর্থ ব্যয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি সর্বোত্তম উপায়। এজন্যে প্রয়োজনীয় তহবিল যাকাত, সাদকা, ওয়াকফ এবং অনুরূপ অন্যান্য সূত্র থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে।
স্থানীয় ও বিদেশী ব্যাংকে গচ্ছিত পুঁজি থেকে অর্জিত সুদও এ উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যায়। এ সুদ হারাম সূত্র থেকে অর্জিত হয় বলে এ অর্থ ব্যবহারে আমাদের কুণ্ঠিত হওয়া উচিত নয়। কারণ এটি হারাম কেবল পুঁজির আমানতকারীর ক্ষেত্রে। কিন্তু ইসলামের স্বার্থে এটি ব্যয় করা হালাল। আর সর্বাগ্রে ইসলামী আন্দোলনের সার্বক্ষণিক কর্মীদের জন্যে এ অর্থ ব্যয় করা যায়।
অন্যান্য স্থানে সমপর্যায়ের কাজের সমান পর্যাপ্ত বেতন নেয়ার ব্যাপারে নিষ্ঠাবান কর্মীদের অনাগ্রহী হওয়া উচিত নয় এজন্যে যে তারা যেন সন্তুষ্টি সহকারে আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যেতে পারে। আর কম বেতনের কারণে তাদের মধ্যে যেন অসন্তুষ্টি না থাকে। না খুব বেশি, না খুব কম পারিশ্রমিকই ন্যায্য বেতন বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।
তবে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব ছাড়া উপযুক্ত গুণ বৈশিষ্ট্য যাচাই করে সঠিক স্থানে সঠিক ব্যক্তিকে বসানো প্রয়োজন। যোগ্যতা ও সততা লোক বাছাইয়ের একমাত্র মানদণ্ড হওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ নিশ্চয়ই আপনার কর্মচারী হিসেবে সেই ব্যক্তি উত্তম যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত (সূরা কাসাসঃ ২৬)।