ইসলামী অর্থনীতি
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (র)
শতাব্দী প্রকাশনী
সংকলন
প্রফেসর ড. খুরশিদ আহমদ
অনুবাদ
আব্বাস আলী খান
আবদুস শহীদ নাসিম
আবদুল মান্নান তালিব
সম্পাদনায়
অধ্যাপক শরীফ হুসাইন
শতাব্দী প্রকাশনী
আমাদের কথা
যেকয়টি প্রধান প্রধান উপাদান আধুনিক বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে তার অন্যতম হলো অর্থ। কারো কারো মতে তো অর্থই নিয়ন্ত্রক শক্তি। তাই অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা প্রচুর গবেষণা করেছেন এবং করছেন। গড়ে তুলেছেন বহু অর্থনৈতিক মতবাদ। একটার পর একটা মতবাদ চালু করা হচ্ছে মানব সমাজে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ব্যর্থতার ফলে কার্যকর করা হয় সমাতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা। এ ব্যবস্থাও তার অবাস্তব নীতির ফলে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়ে নিজ ঘরেই আত্মহত্যা করে। এখন পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির ছড়াছড়ি। আমাদের চোখের সামনে আছে ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক মতবাদ। এভাবে একটার পর একটা মতবাদ আসছে আর পরীক্ষা চলছে। কোনোটিই মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পারেনি, দিতে পারেনি মুক্তি।
আসলে মানব মস্তিষ্ক প্রসূত কোনো মতবাদই মানুষকে মুক্তি দিকে পারেনা। মানুষের সার্বিক মুক্তি, কল্যাণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে একমাত্র খোদায়ী বিধান, তথা আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা। আর এ জীবন ব্যবস্থার নাম হলো ইসলাম। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ মানব জীবনের সকল বিভাগকে পরিচালিত সঠিক নির্দেশনা দিয়েছেন ইসলাম। তাই ইসলামী অর্থনীতিই অর্থনৈতিক মুক্তিও উন্নয়নের একমাত্র চাবিচাঠি।
আধুনিক বিশ্বের সেরা ইসলামী চিন্তানায়ক সাইয়েদ আবুল আ’লা মুদূদী (র) মানব জীবনের প্রায় সকল বিভাগের ওপর ইসলামের নির্দেশনা উপস্থাপনা করেছেন। এ গ্রন্থটি ইসলামী অর্থনীতির ওপর তাঁর এক অনবদ্য গ্রন্থ। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডঃ খুরশীদ আহমদ গ্রন্থকারের ইসলামী বিষয়ক রচনাবল থেকে চয়ন করে সুনির্বাচিত লেখার এ সংকলনটি তৈরী করেছেন। এর প্রথম অংশে ইসলামী অর্থনীতির তাত্বিক ভিত্তি উপস্থাপন করা হয়েছে, আর দ্বিতীয় অংশে চিত্রিত হয়েছে ইসলামী অর্থব্যবস্তার রূপরেখা। গ্রন্থটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের দারুণ কাজে লাগবে এবং অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের পাথেয় হবে বলে আশা করি।
গ্রন্থটি ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোগিতায় প্রকাশিত হলো। এ সহযোগিতার জন্য ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন কর্তৃপকষকে মুবারকবাদ জানাই। মহান আল্লাহ এ গ্রন্থটি দ্বারা আমাদের জাতিকে উপকৃত করুন। আমীন।
আবদুস শহীদ নাসিম
পরিচালক
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রিসার্চ একাডেমী
ঢাকা ১. ৯. ১৯৯৪
কে কতটুকু অনুবাদন করেছেন
আবদুস শহীদ নাসিম
১৭….৯৪ পৃষ্ঠা
১২৫….১৭৩ পৃষ্ঠা
২২৯….২৫১ পৃষ্ঠা
২৭৫….২৮৪ পৃষ্ঠা
২৯৯….৩১৪ পৃষ্ঠা
আবদুল মান্নান তালিব
৯৫….১২৪ পৃষ্ঠা
১৭৪….২২৮ পৃষ্ঠা
২৫২….২৭৪ পৃষ্ঠা
৩১৫….৩২৮ পৃষ্ঠা
আব্বাস আলী খান
২৮৫….২৯৮ পৃষ্ঠা
গ্রন্থকারের কথা
এ গ্রন্থটি আমার সেসব রচনা, প্রবন্ধ ও নিবন্ধের সংকরণ যেগুলি আমি বিগত ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর কালে বিভিন্ন সুযোগ ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে ইসলামী অর্থনীতির মূলনীত ও বিধিমালার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং আধুনিক মানুষের জীবন সমস্যার ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ সম্পর্কে লিখে এসেছি। লেখাগুলো যথাসময়ে প্রকাশও হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে এ লেখাগুলোকে একত্রিত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আসছি। এ প্রয়োজন এজন্যে অনুভব করেছি যে, এর ফলে একদিকে সাধারণ পাঠকদের সামনে ইসলামী অর্থনীতির পূর্ণাংগ রূপরেখা এসে যাবে, অপরদিকে ইসলাম ও অর্থনীতি বিষয়ক ছাত্রদের জন্যেও এটি একটি পাঠ্য এবং সহায়ক গ্রন্থের কাজ দেবে। কিন্তু বহুমূখী ব্যস্ততার কারণে আজ পর্যন্ত এ কাজে হাত দেয়ার সযোগ পাইনি। আমি প্রফেসর খুরশী আহমদের কাছে কৃতজ্ঞ, তিনি কঠোর পরিশ্রম ও আন্তরিক মনোযোগের সাথে সেই লেখাগুলোর সমন্বয়ে এমন একটি চমৎকার গ্রন্থ সংকলন করেছেন যে, আমার মনে হয় আমি নিজেও এর চেয়ে সুন্দরভাবে গ্রন্থখানি সংকলন করতে পারতামনা।
সংকলনের পর গোটা গ্রন্থটির উপর আমি নজর বুলিয়ে দিয়েছি, প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সংযোজনও করেছি। আমি আশা করি, খুরশীদ সাহেব যে উদ্দেশ্য নিয়ে এ পরিশ্রম করেছেন, সে ক্ষেত্রে গ্রন্থটি অত্যন্ত উপকারী প্রমাণিত হবে।
আবুল আ’লা
লাহোর
১৪ যিলহজ্জ ১৩৮৮ হিঃ
৩ মার্চ ১৯৬৯ ইং
ভূমিকা
বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র বিরাজ করছে চরম অশান্তি ও অস্থিরতা। এই অস্থিরতার পেছনে যেসব শক্তির হাত রয়েছে এবং যেসব কারণে এ অশান্তির আগুন দিন দিন কেবল বেড়েই চলেছে, সেসবের মধ্যে অর্থনৈতিক কারণসমূহের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। অবশ্য অর্থনৈতিক উপাদানসমূহের এ ভূমিকার থাকার কারণ এ নয় যে, মানব জীবনে অর্থনৈতিক উপকরণসমূহের সিদ্ধান্তকর কোনে মর্যাদা রয়েছে; বরহ্চ তা এ কারণে যে, মানুষ অর্থনৈতিক কারণকে সেই মর্যাদা দিয়ে বসেছে, প্রকৃতিগতভাবে যে মর্যাদা তার নেই। তাই বিকৃতির কার্যকারণ অন্বেষণ এবং তার প্রতিকারের চেষ্টা সাধনা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ ও জটিল করে চলেছে। প্রথম দিকে মানুষের ধারণা ছিল, জীবিকার উপায় উপকরণের স্বল্পতাই মূল সমস্যা এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করলেই যাবতীয় বিকৃতি দূর হয়ে যাবে। কিন্তু উৎপাদন যখন শতগুণ বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাজারগুণ বৃদ্ধি পেলো, তখনো সমস্যা ও বিকৃতি একই রকম থেকে গেলো। এরপর মানুষ উৎপাদনের অর্থনীতি (Economics of Production) থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বন্টনের অর্থনীতি (Economics of distribution) এর দিকে মনোযোগ দিলো এবং নিজেদের যাবতীয় চেষ্টা সাধনা সেদিকেই নিবদ্ধ করলো। কিন্তু শত বছর যাবত সম্পদ বন্টন ও পুনর্বন্টনের (Redistribution of wealth ) এর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এখনো বিশ্ব ঠিক ঐ জায়গাতেই অবস্থান করছে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। সম্পদের দুষ্প্রাপ্যতা (Scarcity) ব্যষ্টিক অর্থনীতির (Micro Economics) জন্ম দেয়। কিন্তু সর্বনাশা ব্যবসাচক্র (Trade cycle) এবং মন্দা এই ব্যবস্থর বাস্তব কার্যকারিতার প্রক্রিয়াকে ধরাশায়ী করে দিয়েছে। এর ফলে সৃষ্টনতুন অবস্থা সামষ্টিক অর্থনীতির (Macro Economics) পথ সুগম করে দেয়। কিন্তু এ নতুন ব্যবস্থায় সম্পদের যে প্রাচুর্য (Affluence of wealth) দেখা দিয়েছে এবং তা নিজের সাথে যে সমস্যা বয়ে এনেছে, তার কারণে এ প্রাচুর্য স্বয়ং মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই অর্থনীতির ছাত্ররা পুনরায় একটি নতুন অর্থনীনৈতিক ব্যবস্থার সন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছে। এ হচ্ছে একটি দুষ্টচক্র (Vicious circle) যার মধ্যে মানুষ বৃথা ঘুরপাক খাচ্ছে এবং প্রতিটি আবর্তনে যার অবস্থা হলো এ প্রবাদ বাক্যর মতঃ
“রশির জট খুলে চলেছি দিবানিশি
আগা পাছার নেইকো খোঁজ!”
আজ আমরা মানব জাতিকে তাদের ধ্যান ধারণা ও মৌলিক দৃষ্টিভংগি পুনঃপরীক্ষা নিরীক্ষা ও পুনর্বিবেচনা কারা জন্যে আহবান জানাচ্ছি। চলার পথে উদ্ভূত জটিলতার কারণে আসল ক্ষতি ও অনিষ্ট সৃষ্টি হয়নি; বরঞ্চ অনিষ্ট ও ধ্বংসের মূল কারণ নিহিত রয়েছে সেই দৃষ্টিভংগি ও লক্ষ্যের মধ্যে যাকে সামনে রেখে যাত্রা শুরু করা হয়েছে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান ও কর্ম প্রক্রিয়ার সূচনাতেই রযেছে ভ্রান্তি। তাই সূচনাবিন্দুই পুনর্বিবেচনার দাবী রাখ। মানুষ নিজের সঠিক পরিচয় ও প্রকৃত মর্যাদাকে উপেক্ষা করে তার চিন্তা দর্শনের ইমারত নির্মাণ করতে যাওয়ার কারণেই এই চরম ব্যর্থতার গ্লানি বইয়ে চলেছে।
আমাদের হাতের এই গ্রন্থটি মূলত অর্থনীতি বিজ্ঞানের (Economic Science) গ্রন্থ নয়। বরঞ্চ, এতে অর্থনৈতিক দর্শনের (Eocnomics Philosophy) রাজপথ প্রদর্শিত হয়েছে। এতে সেই মৌলিক বিষয়সমূহের আলোচনা করা হয়েছে, অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা সাধারণত যেগুলো সম্পর্কে চিন্তা না করেই সামনে অগ্রসর হন। এসব মৌলিক বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা থাকার কারণে সামনে অগ্রসর হতে গিয়ে প্রতিটি কদমে হোঁচট খাচ্ছেন, ধাক্কা খাচ্ছেন। গবেষক ও পথ প্রদর্শকদের উচিত এ দিকনির্দেশনা অনুসরণ করা এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি ময়দানে এর বাস্তবায়ন করা। এতে লক্ষ্য অর্জন সহজতর হবে। অর্থনৈতিক চিন্তা দর্শনের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন, তার সূচনাবিন্দু হিসেবে এগুলোকে গ্রহণ করা উচিত। এ হিসেবে এ গ্রন্থটিকে আমরা অর্থনৈতিক দিকদর্শনে এ প্রশস্ত রাজপথ আখ্যা দিতে পারি।
মাওলানা সাইয়েদ আুল আ’লা মওদীদী একালের সর্বাধিক খ্যাতিমান ইসলামী চিন্তাবিদ। বিগত চল্লিশ বছরে তিনি ইসলামী সমাজ দর্শন ও সমাজ ব্যবস্থার প্রতিটি দিক ও বিভাগ সম্পর্কে কমবেশী কথা বলেছেন। তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে আধুনিক কালের সমস্যাবলী ও জটিলতারকে সামনে রেখে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় কোনো প্রকার কমবেশী না করে হুবহু তা তুলে ধরেছেন। আসল সিদ্ধান্ত তো ভবিষ্যতই করবে, তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় মাওলানার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, তিনি ইসলামকে একটি পূর্ণাংগ দার্শনিক ও বাস্তব জীবন ব্যবস্থা এবং দীন দুনিয়ার কল্যাণধর্মী এক বিশ্বজনীন সংস্কার আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। শুধু তাই নয়, বিগত চল্লিশ বছরের অবিরাম চেষ্টা সাধনার দ্বারা তিনি স্বীয় বিরোধীদের কাছ থেকে পর্যন্ত এ স্বীকৃতি আদায় করেছেন যে, জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের জন্যে ইসলাম তার নিজস্ব দৃষ্টিভংগির আলোকে মৌলিক পথ নির্দেশনা দন করেছেন। আর মুসলমান ব্যক্তি হিসেবে এবং জাতগতভাবে কেবল তখনই ইসলামের দাবী পূর্ণ করতে পারে, যখন সে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এসব পথনির্দেশের পূর্ণ অনুসরণ করবে।
এটা স্বাভাবিক কথা, যে মহান ব্যক্তিত্ব এই বিরাচ কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন তিনি কেমন করে অর্থনৈতিক সমস্যার বিষয়ে নীরব থাকতে পারেন? তাইতো দেখি, মাওলানা তাঁরা তরজামানুল কুরআন পত্রিকা প্রকাশনার প্রথম বছরই [১৯৩৩ ইং] “সুদ” ও “জন্ম নিয়ন্ত্রণের” বিরুদ্ধে জিহাধ শুরু করেছেন। এযাবত অর্থনীতি বিষয়ে তার গবেষণা, লেখা ও কথা বলা অব্যাহত রয়েছে। অর্থনৈতিক বিষয়ে এ পর্যন্ত তাঁর চারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হলো, সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং, ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ, ভূমির মালিকানা বিধান এবং ইসলাম ও জন্মনিয়ন্ত্রণ। এ ছাড়াও এ বিষয়ে মাওলানার বহু প্রবন্ধ, পুস্তিকা এবং বক্তৃতা রয়েছে, যা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই চারটি গ্রন্থের স্বতন্ত্র গুরুত্বতো অবশ্যই আছে এবং এগুলো ইনশাল্লাহ নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে যাবে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংক্রান্ত মাওলানার সকল লেখা সামনে রেখে একটি পূর্ণাংগ গ্রন্থ সংকলনের প্রয়োজনীয়তা আমি দীর্ঘদিন থেকে অনুভব করে আসছিলাম। এমন একটি গ্রন্থ, যাতে সকল মৌলিক অর্থনৈতিক বিষয়ে একই সাথে মাওলানর দৃষ্টিভংগিও জানা যাবে এবং অর্থনীতির ছাত্ররা ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকও এক নজরে দেখতে পাবে। ফুল যতো সুন্দরই হোক নার তা বাগানময় যতো হাসিই ফুটাক, সেগুলো ফুলদানীতে সাজাবার মত একটি পুষ্পগুচ্ছে কেবল তখনই পরিণত হতে পারে, যখন মালি বাগান থেকে বেছে বেছে নির্বাচিত ফুলের সমন্বয়ে একটি গুচ্ছ তৈরী করবে।
এ কাজের প্রয়োজনীয়তা অনেকদিন থেকেই উপলব্ধি করছিলাম। একটি রূপরেখাও তৈরী করে রেখেছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এতোদিন এ কাজে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। ইতমধ্যে করাচী বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার্স ক্লাশের জন্যে ‘ইলামী অর্থনীতির’ একটি পত্র (Paper) সিলেবাসভুক্ত করেছে। তাছাড়া ‘দানশাগহে পাঞ্জাব’ও মাস্টার্ব-এ ইসলামী অর্থনীতি পড়ানো আরম্ভ করেছে। এ পদক্ষেপ নিতে দেরী হয়ে গেছে অনেক। কিন্তু এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা দেশ বিভাগের পরপরই যদি এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন, তবে হয়তো একটি শাস্ত্র হিসেবে ইসলামী অর্থনীতির উপর এতো দিনে অনেক মূল্যবান গ্রন্থাবলী রচিত হয়ে গেতো। যা হোক, এ পদক্ষেপকে আমরা আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। এ পদক্ষেপই আমাকে ত্বরিত এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করেছে। ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর শদ্ধেয় মাওলানার সকল গুরুত্বপূর্ণ রচনা একত্র সংকলন করে এ গ্রন্থ তৈরী করেছি, যাতে এক নজরে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পূর্ণাংগ রূপরেখা পাওয়া সম্ভব হয়।
গ্রন্থটিকে দুই অংশে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে স্থান পেয়েছে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসমূহের পর্যলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়ানা এতে অর্থনীতি বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভংগিও তুলে ধরা হয়েছে পূর্ণাংগরূপে। বিস্তারিত বিশ্লেষণের সাথে সাথে পেশ করা হয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কুরআন সুন্নাহ প্রদর্শিত অপরিহার্য নীতিমালা। এ খন্ডটি আমাদের ভবিষ্যত কর্মীদের জন্যে মাইল ফলকৈর কাজ করবে। এখন প্রয়োজন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন; এসব আদর্শ ও নীতিমালার আলোকে অর্থনীতির ভাষায় গবেষণা ও আলোচনা করা। এ রচনাগুলোর মর্যাদা আলোর মিনারের মতো। কিন্তু এ আলো স্বয়ং পথিক নয়; পথিকদের পথ-প্রদর্শক মাত্র। এ নির্দেশনার আলোকে অর্থনীতির ছাত্রদের সেই পথের সন্ধন করে নিতে হবে যার দিকে তা নির্দেশনা দান করছে। এটি একটি প্রদীপ। এ থেকে হাজারো নতুন প্রদীপ জ্বালাতে হবে। সুগম করতে হবে অন্যদের জন্যে চলার ও অনসরণ করার পথ। শ্রদ্ধেয় মাওলানা পথ চিহ্নিত করেছেন এখন মুসলিম অর্থনীতিবিদদের দায়িত্ব সম্মুখে অগ্রসর হওয়া এবং যুগোপযোগী পথ তৈরী করা।
গ্রন্থটির দ্বিতীয় খন্ডে স্থান পেয়েছে শ্রদ্ধেয় মাওলানার সেইসব রচনা, একদিকে যেগুলোর সম্পর্ক অর্থনৈতিক দর্শনের প্রয়োগের (Application) সাথে। এখানে এ প্রসংগে ইসলামী অর্থব্যবস্থার কেবল কয়েকটি দিক সম্পর্কেই আলোচনা করা হয়েছে। তবে এতে কয়েকটি আলোচনা এমনও আছে, যেগুলো আমাদের সামনে অর্থনীতির বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে চিন্তা ও গবেষণার পথ উন্মুক্ত করতে সহায়ক হবে। এ প্রবন্ধগুলো একদিকে কয়েকটি মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যার ক্ষেত্রে অত্যন্ত পরিষ্কার নির্দেশনা দান করছে; যেমন, ভূমির মালিকানা, সুদ, যাকাত এবং সামাজিক সুবিচার। অপরদিকে এ প্রবন্ধগুলো অর্থনীতির ছাত্রদের অংগুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইসলামের মৌলিক ধ্যান ধারণা এবং এর মৌলিক অ্থনৈতিক নীতিমালার আলোকে বিশেষ বিশেষ জিজ্ঞাসা ও সমস্যার অধ্যয়ন কিভাবে করতে হয়। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তথাকথিত প্রগতিশীল ভাঁড় ও অপরের অন্ধ অনুসারীদের মোকাবিলায় প্রকৃত সৃষ্টিধর্মী ও ইজতিহাদী রীতি কী? এটা চিন্তার স্বাধীনতার এক বিরাট কদাকার ধারণা যে, স্বাধীনতা ও ইজতিহাদ হলো স্বধর্মের শিক্ষাকে পরিবর্তন করা এবং পাশ্চাত্যের প্রতিটি ধ্যান ধারণার অন্ধ অনুকরণ করার নাম। এটা ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ নয়, ‘মানসিক দাসতব’। চিন্তার প্রকৃত স্বাধীনতা হলো, আমরা নিরপেক্ষ মন এবং সমালোচনার দৃষ্টি নিয়ে সকল আধুনিক মতবাদ অধ্যয়ন করবো এবং “যা সঠিক তা গ্রহণ কর, যা ভ্রান্ত তা পরিত্যাগ কর” –এই নীতির অনুসরণ করবো। আমরা আমাদের মন মানসিকতার দুয়ার এমনভাবে বন্ধ করে দেবোনা যে, কোনো কল্যাণকর জ্ঞান থেকে উপকৃত হবো না। আবার নিজেদের মন মানসিকতার উপর অন্যদের প্রভাবও এতোটা গ্রহণ করবো না যে, দেখার সময় তাদের চোখে দেখবো, চিন্তার সময় তাদের মন দিয়ে চিন্তা করবো এবং বলার সময় তাদের মুখ দিয়ে বলবো।
গ্রন্থটির দ্বিতীয় অংশ মূলত এ ধরনের বিনির্মাণ ও সৃষ্টিধর্মী দৃষ্টিভংগির মুখপত্র। অর্থনীতির ছাত্ররা এ থেকে জানতে পারবে যে, বিশেষ বিশেষ ধরনের বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে কি পদ্ধতিতে চিন্তা-গবেষণা করতে হয়। এ খণ্ডটি মূলত একটি আদর্শ নমুনা। ভবিস্যতে যারা এ ময়দানে কাজ করবেন, তাঁদের অসংখ্য নতুন নতুন বিষয়ে কাজ করতে হবে। আমার বিশ্বাস তাঁদের চলার পথে এ সংকলনটি পথপ্রদর্শকের কাজ দেবে। শাস্ত্রীয় পরিভাষায় মাওলানা মওদূদী একজন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ [Economist] নন। কিন্তু তাঁর স্থান এর চেয়েও অনেক উর্ধ্বে। কোনো একটি নির্দিষ্ট শাস্ত্রের মানদন্ডে তিনি বিচার্য নন। তিনি এমন একজন চিন্তাবিদ যিনি ধর্মতত্ত্ব (Theology) থেকে শুরু করে প্রায় সকল সমাজ বিজ্ঞানের (Social Science) ময়দানে কেবল সিদ্ধান্তকর কথাই বলেননি, বরঞ্চ সেই সাথে ইসলামী দৃষ্টিভংগির আলোকে সেগুলোর কেন্দ্রীয় বিষয়বর্তুর (Central Core) নবনির্মাণ কাজের নীল নকশাও এঁকে দিয়েছেন। তাঁর অর্থনীতি বিষয়ক রচনাবলীর এ সংকলনটি অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই কাজই আঞ্জাম দিয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ের উপর কাজ করা সেইসব মনীষীদের দায়িত্ব যাঁরা ইসলামের প্রতি অটুট বিশ্বাস রাখেন, সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সঠিক দৃষ্টিভংগি পোষণ করেন এবং যারা অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রায়োগিত দক্ষতার (Technical Competence) অধিকারী। আমাদের মতে এ গ্রন্থটিতে সাধারণ পাঠদের জন্যেও অনেক মূল্যবান উপকরণ রয়েছে; আর অর্থনীতির ছাত্র এবং আগামী দিনের ইসলামী অর্থনীতিবিদদের জন্যে রয়েছে দিকনির্দেশনা। আমার বিশ্বাস, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে পঠন পাঠনের ক্ষেত্রে এ গ্রন্থটি বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
গ্রন্থটি সংকলন সংক্রান্ত একটি কথা এখানে বলে রাখা প্রয়োজন বোধ করছি। তা হোলো, এতে শ্রদ্ধেয় মাওলানার প্রবন্ধ এবং বক্তৃতা চাড়াও তাফহীমীল কুরআন থেকে সেই সব অংশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যেগুলোর বিষয়বর্তু অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত। একই ভাবে রাসায়েল মাসায়েল-এর সেইসব প্রশ্নের জবাবও এখানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, যেগুলোকে আমাদের আলোচনার পরম্পরার সাথে সম্বন্ধযুক্ত মনে করেছি। এছাড়া ‘ভূমির মালিকানা বিধা’ এবং ‘সুদ’ গ্রন্থ থেকে প্রাসংগিক আলোচনাসমূহ গ্রহণ করে তা সংক্ষিপ্ত আকারে সংযোজন করেছি। কিন্তু এ গ্রন্থে সেসব বিষয়ের সূচী বিন্যাস করেছি আমাদের প্রয়োজনে। মনে রাখতে হবে এ গ্রন্থে সংকলিত অংশগুলো মূল গ্রন্থসমূহের বিকল্প (Substitute) হতে পারেনা। অবশ্য এ গ্রন্থে সংকলিত হয়ে একটি সীমা পর্যন্ত সেগুলো আমাদের প্রয়োজন পূরণ করছে। বিস্তারিত জানার জন্য আমরা সম্মানিত পাঠকদের মূল গ্রন্থ পাঠ করার অনুরোধ করবো।
এ গ্রন্থের উপকরণসমূহ নেয়া হয়েছে বিভিন্ন স্থান থেকে। এগুলো লেখা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। লেখার সময় গ্রন্থকারের সামনে ছিলো বিভিন্ন ধরনের পাঠক। এই সবগুলো লেখাকে একত্রিত করা এবং সেগুলোকে প্রাসংগিকভাবে বিন্যস্ত করা বড় কঠিন কাজ। আমার সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছি যাতে বক্তব্যের প্রাসংগিকতা ছিন্ন না হয়। তা সত্ত্বেও সম্মানিক পাঠকদের নিকট আমার নিবেদন, তাঁরা যেন গ্রন্থটি পাঠের সময় সংকলকের সেইসব সীমাবদ্ধতাকে সামনে রাখেন, এ ধরনের কাজে অপরিহার্যভাবে যেগুলোর সম্মুখীন হতে হয়। এ ধরনের সংকলনের পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব নয়। তবে আমি আশা করি এ গ্রন্থে যেসব বিষয়ে পুনরাবৃত্তি এসেছে তা প্রয়োজনীয় এবং সেগুলো আলোচ্য বিষয় অনুধাবনে কাজে লাগবে। গ্রন্থের প্রথম অংশে এরূপ পুনরাবৃত্তি একটু বেশী। আর সেখানে এমনটি হওয়া জরুরীও ছিলো। ইনশাল্লাহ এ পুনরাবৃত্তি উপকারেই আসবে।
পরিশেষে একটি ব্যক্তিগত কৈফিয়ত পেশ করছি। এ গ্রন্থ সংকলনের বেশীরভাগ কাজ ১৯৬৮ ইসায়ী সালের আগস্ট মাসের মধ্যেই স্পন্ন করেছিলাম। কেবল কয়েক সপ্তাহের কাজই বাকী ছিলো। এরি মধ্যে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে আমাকে ইংল্যাণ্ডে যেতে হয়। আকাশ ভ্রমণের সমস্যাবলীর মধ্যে একটি সমস্যা হলো, মানুষ তার প্রয়োজনের সব জিনিস সাথে নিতে পারেনা। আমি আশা করছিলাম, আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবো এবং কাজটি সম্পন্ন করতে পারবো। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। পাণ্ডুলিপি হাতে পৌঁছে ডিসেম্বর মাসে। তাছাড়া এখানে আসার পর তিন চার মাস অন্য কাজের চাপে এতোটা ব্যস্ত ছিলাম যে, গ্রন্থটি সম্পন্ন করতি আরো বিলম্ব হলো।
খুরশীদ আহমদ
লিস্টার, ইংল্যাণ্ড
২ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ ঈসায়ী
১৪ যুলকা’দা ১৩৮৮ হিজরী
সবকথার গোড়ার কথা
[১৯৪৮ সালের ২ মার্চ রেডিও পাকিস্তান [লাহোর] ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিষয়ে গ্রন্থকারের যে কথিকা প্রচার করেছিল, বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্যের কারণে এখানে সেটিকে ‘সব কথার গোড়ার কথা’ শিরোনামে সংকলন করা হলো।– সংকলক।]
মানুষের অর্থনৈতিক জীবন সুবিচার ও সততার উপর প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে ইসলাম কতিপয় মূলনীতি ও সীমা চৌহদ্দি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সম্পদের উৎপাদন, ব্যবহার ও বিনিয়োগের গোটা ব্যবস্থা এই সীমারেখার মধ্যে আবর্তিত হতে হবে। অবশ্য উৎপাদন ও বিনিয়োগ বিপণনের পন্থা পদ্ধতি কিরূপ হবে সে ব্যাপারে ইসলামের কোনো বক্তব্য নেই। কারণ সময় ও সভ্যতার উত্থান পতনের সাথে সাথে এসব পন্থা পদ্ধতি নির্ণিত ও পরিবর্তি হয়ে থাকে। বস্তুত, মানুষের অবসথা ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে এগুলো নির্ধারিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ইসলামের দাবী শুধু এতটুকু যে, সকল যুগ ও পরিবেশে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলী ও রূপই ধারণ করুক না কেন তাতে ইসলামের নির্দিষ্ট নীতিমালা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং নির্ধারিত সীমারেখা অবশ্যি অনুবর্তন করতে হবে।
ইসলামের বিঘোষিত দৃষ্টিভংগি হলো, এ বিশ্বজগৎ এবং এর যাবতীয় সম্পদ মহান আল্লাহ গোটা মানব জাতির কল্যাণের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। তাই পৃথিবীর বুক থেকে স্বীয় জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা করার অধিকার প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যেতে পারেনা। এক্ষেত্রে একজন অন্যজনের উপর অগ্রিধিকারও পেতে পারেনা। কোনো ব্যক্তি, বংশ, জাতি বা শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের উপর এমন কোনো বিধিনিষেধও আরোপ করা যেতে পারেনা যার ফলে তারা জীবিকার উপকরণের মধ্য থেকে কোনো কোনো উপকরণ ব্যবহারে অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে অথবা কোনো বিশেষ পেশা গ্রহণের দরজা তাদের জন্যে বন্ধ থাকবে। একই ভাবে আইনত এমন কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করাও বৈধ হতে পারেনা যার করণে জীবিকার উপকরণসূহ বিশেষ কোনো শ্রেণী, বংশ, জাতি বা পরিবারের একচেটিয়া ইজারায় পরিণত হয়ে যাবে। আল্লাহর সৃষ্ট এই বিশ্বে তাঁরই দেয়া জীবিকার উপকরণসমূহের মধ্য থেকে নিজের অংশ লাভের চেষ্টা করার প্রতিটি মানুষের অধিকার সমান। এ অধিকার লাভের সুযোগ সবার জন্যে সমভাবে উন্মুক্ত থাকতে হবে।
আল্লাহর দেয়া যেসব সম্পদ উৎপাদন করা কিংবা কার্যোপযোগী বানানোর ক্ষেত্রে কারো শ্রম বা যোগ্যতার বিনিয়োগ করতে হয়না তা সকল মানুষের জন্যে সাধারণবাবে বৈধ। নিজের প্রয়োজন অনুপাতে তা থেকে উকৃত হবার অধিকার প্রতিটি মানুষের রয়েছে। নদী নালা ও সমুদ্রের পানি, বনের কাঠ, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় উদগত ও লালিত গাছের ফল ফসল, স্বজাত ঘাস ও চারা, বায়ু, পানি, বিজন নের পশু, যমীনের উপর ভেসে উঠা খনিজ পদার্থ ইত্যাদি ধরনের সম্পদের উপর কারো একচেটিয়া মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। এগুলোর উপর এমন কোনো বিধিনিষেধও আরোপ করা যেতে পারেনা যার ফলে আল্লাহর বান্দারা কিছু ব্যয় করা ছাড়াই তা থেকে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে বাধাগ্রস্ত হবে। তবে হ্যাঁ, যারা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এসব সম্পদের ব্যাপক ব্যবহার করতে চাই, েতাদের উপর করারোপ করা যেতে পারে।
আল্লাহ তা’আল্ মানুষের কল্যাণের জন্যে যেসব জিনিস সৃষ্টি করেছেন, সেগুলো অনুৎপাদনশীল ও পতিত ফেলে রাখা উচিত নয়। ‘হয় নিজে সেগুলো দ্বারা লাভবান হও, অথবা অন্যরা যাতে উপকৃত হতে পারে সেজন্যে ছেড়ে দাও।’ এই মূলনীতির ভিত্তিতে ইসলামী শরীয়ত ফয়সালা দিয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি সরকার প্রদত্ত জমি তিন বছরের বেশী পতিত ফেলে লাকতে পারবেনা। যদি সে নিজে সে জমিতে খামার বা নির্মাণ কাজ না করে, কিংবা অন্য কোনো কাজে তা ব্যবহার না করে, তবে তিন বছর অতিক্রান্ত হবার পর তা পরিত্যক্ত ভূমি বলে গণ্য হবে এবং অপর কেউ তা কাজে লাগালে তাকে সেখান থেকে উৎখাত করা যাবে না। জমি তিন বছর পতিত ফেলে রাখলে সে জমি ফেরত নিয়ে নেবার অধিকার লাভ করবে এবং অপর কাউকে তা ব্যবহার করার জন্যে প্রদান করতে পারবে।
কেউ যদি সরাসরি প্রকৃতরি ভাণ্ডার থেকে কোনো জনিস সংগ্রহ বা আহরণ করে এবং নিজের শ্রম ও যোগ্যতা খাটিয়ে একে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে, তবে সে-ই হবে সে জিনিসের মালিক। যেমন, যে পতিত জমির উপর এখনো কারো মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কেউ যদি তা অধিগ্রহণ করে এবং কোনো লাভজনক কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে, তবে তাকে সে জমি থেকে বেদখল করা যেতে পারেনা। বস্তুত ইসলামের দৃষ্টিভংগি অনুযায়ী পৃথিবীতে স্বত্বাধিকারের সূচনা হয়েছে নিম্নরূপে: প্রথমে যখন পৃথিবীতে মানুষের বসবা আরম্ভ হয়, তখন সকল জিনিস সকল মানুষের জন্যে সমানভাবে বৈধ ছিলো। অতঃপর যে ব্যক্তি যে বৈধ জিনিস নিজের মালিকানায় গ্রহণ করে কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় তাকে ব্যবহার উপযোগী করে নিয়েছে, সে-ই হয়েছে সে সম্পদের মালক। অর্থাৎ সে জিনিসের ব্যবহার কেবল তার নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করা হযেছে এবং অপরকে ব্যবহার করতে দেয়ার ক্ষেত্রে সে বিনিময় গ্রহণ করবার অধিকার লাভ করেছে। এ হলো মানুষের গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বাভাকি ভিত্তি। এ ভিত্তি এর নিজ স্থানে প্রতিষ্ঠিত থাকা অপরিহর্য।
শরীয়তসম্মত বৈধ পন্থায় পৃথিবীতে সে স্বত্বাধিকার অর্জিত হয়, তা অবশ্যই সম্মানযোগ্য। এ ব্যাপারে মতভেদ থাকলে তা কেবল এতটুকু থাকতে পারে যে, মালিকানা অর্জন আইনগতভাবে বিশুদ্ধ হয়েছে কিনা! আইনগতভাবে যেসব মালিকানা অবৈধ, সেগুলো অবশ্যি খতম করতে হবে। কিন্তু শরীয়তসম্মত বৈধ মালিকানা হরণ করার অধিকার কোনো সরকার বা আইন পরিষদের নেই। এমনকি, কোনো মালিকের শরীয়তসম্মত অধিকারের কমবেশী করবার অধিকারও কাউকে দেয়া হয়নি। সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের নামে এমন কোনো ব্যবস্থা কায়েম করা যেতে পারেনা, যা জনগণের শরীয়ত প্রদত্থ অধিকারকে পদদলিত করে। সমষ্টির কল্যাণে ব্যক্তির মালিকানার উপর স্বয়ং শরিয়ত যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তাতে হ্রাস করা যতো বড় অন্যায় সংযোজন করার ঠিক ততো বড় যুলুম। ব্যক্তির শরীয়ত প্রদত্ত অধিকার সংরক্ষণ করা এবং তা থেকে শরীয়ত নির্ধারিত সমষ্টিক অধিকার আদায় করা ইসলামী সরকারের অন্যতম কর্তব্য।
আল্লাহ তা’আলা তার দান ও অনগ্রহসমূহ বন্টনের ক্ষেত্রে সাম্যনীতি গ্রহণ করেননি। বরঞচ নিজের মহাপ্রজ্ঞার ভিত্তিতে কিছু মানুষকে অপর কিছু মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সৌন্দর্য, সুন্দর কণ্ঠস্বর, সুস্থতা, দৈহিক শক্তি, মেধা, জন্মগত পরিবেশ এবং অরুরূপ অপরাপর জিনিস সব মানুষকে সমভাবে প্রদান করা হয়নি। অরূপভাবে জীবিকার ব্যাপারেও এই একই কথা প্রযোজ্য। মানুষের মধ্যে জীবিকার তারতম্য হওয়অ আল্লাহ্র সৃষ্ট প্রকৃতিরই দাবী। সুতরাং মানুষের মধ্যে কৃত্রিম অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যে যতো কর্মকৌশলই গ্রহণ করা হোকনা কেন, ইসলামের দৃষ্টিতে, লক্ষ্যে ও মূলনীতির দিক থেকে তা সবই ভ্রান্ত। ইলাম যে সাম্যের সমর্থক, তা জীবিকার ক্ষেত্রে নয় বরঞ্চ জীবিকা লাভের প্রচেষ্টা ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধার সাম্য। ইসলাম চায়, সমাজে এমন কোনো আইনগত ও প্রথাগত প্রতিবন্ধকতা অবশিষ্ট না থাকুক, যার কারণে কোনো ব্যক্তি নিজের শক্তিসামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ উপার্জনের চেষ্টা সাধনার পথে বাধার সম্মুখীন হবে। অপরদিকে কোনো শ্রেণী, বংশ বা পরিবারের জন্মগত সৌভাগ্যকে আইনের দ্বারা স্থায়ী করার মতো বৈষম্যমূলক নীতিও ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এ দুটি পন্থা মানুষে মানুষে স্বাভাবিক প্রকৃতিগত বৈষম্যের স্থলে মানব সমাজে একটি জবরদস্তিমূলক কৃত্রিম বৈষম্যের সৃষ্টি করে। তাই ইসলাম এসব প্রথা ও আইনকে নির্মূল করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এমন একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক অবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত করেছে যেখানে প্রতিটি মানুষের জন্যে জীবিকা উপার্জনের সুযোগ সুবিধার দ্বার উন্মুক্ত থাকবে। কিন্তু যারা জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রে চেষ্টা করার মাধ্যম এবং ফলাফল লাভের ব্যাপারে সব মানুষকে জবরদস্তিমূলক একই সমতলে নিয়ে আসতে চায়, ইসলাম তাদের সাথে একমাত্র নয়। কেননা তারা প্রাকৃতিক অসাম্যকে কৃত্রিম সাম্যে রূপান্তরিত করার অসাধ্য সাধন করতে চায়। বস্তুত প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল ব্যবস্থা তো কেবল সেটাই হতে পারে, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি অর্থ উপার্জনের প্রচেষ্টা ক্ষেত্রে, ঠিক সেই স্থঅন এবং পরিবেশ থেকে যাত্রা শুরু করবে, যেখানে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে সৃষ্টি করেছেন। যে মটরগাড়ী নিয়ে জন্ম নিয়েছে, সে মটরগাড়ী নিয়ে যাত্রা শুরু করবে, যে কেবল দুই পা নিয়ে এসেছে সে পদদলে চলতে আরম্ভ করবে, আর যে খোড়া হয়ে জন্ম নিয়েছে তাকে খোড়া অবসথায়ই যাত্রা শুরু করতে দিতে হবে। সমএজ এমন আইন প্রথা কোনো অবস্থাতেই চালু হওয়অ এবং চালু থাকা উচিত নয়, যপর ফলে মটরগাড়ী নিয়ে জন্ম নেয়া ব্যক্তি অযোগ্য হওয়অ সত্ত্বেও কেবল আইন ও প্রথার বলে চিরদিনই মটরগাড়ীর মালিক থাকবে এবং পংগু হয়ে জন্ম নেয়া লোকেরা আইন প্রথার বাধা ডিঙ্গিয়ে কোনোদিনই মটর গাড়ীর মালিক হতে পারবেনা। অপরপক্ষে সমাজে এমন ব্যবস্থা থাকাও কিছুতেই সমীচীন নয় যে, সকল মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে একই স্থান এবং পরিবেশ থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে এবং সমগ্র পথে সকলকে একই সাথে গ্রথিত থাকতে হবে। বরঞ্চ সমাজের আইন ও প্রথাগত ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত এবং সাধারণভাবে এই সম্ভাবনা উন্মুক্ত থাকা আবশ্যক যাতে, কোন ব্যক্তি পংগু অবস্থায় যাত্রা শুরু করা সত্ত্বেও যদি মটর গাড়ী লাভ করার মত শ্রম, যোগ্যতা প্রতিভা তার থাকে তাহলে অবশ্যই যেন সে মটরগাড়ীর মালিক হতে পারে। অপরদিকে কেউ মটরগাড়ী দিয়ে যাত্রা শুরু করেও যদি নিজের অযোগ্যতার কারণে মটরগাড়ী হারিয়ে ফেলে, তবে তার সে অযোগ্যতার ফলও তার পাওয়অ উচিত।
ইসলাম কেবল এতটুকুই চায়না যে, সমাজ জীবনে কেবল অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত এবং অবাধ থাকবে; বরঞ্চ সেইসাথে এটাও চায় যে, এ ময়দানে প্রযোগীগণ পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠুর ও নির্দয় হবার পরিবর্তে সহমর্মী ও সগযোগী হবে। ইসলাম একদিকে নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে অক্ষম ও পিছে পড়ে থাকা মানুষের আশ্রয় প্রদানের মানসিকতা সৃষ্টি করতে চায়; অপরদিকে সমাজে এমন একটি শক্তিশালী সংস্থা গড়ে তুলতে চায় যে অক্ষম ও অসহায় লোকদের সাহায্যের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। যেসব লোকের জীবিকা উপার্জনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা থাকবে না, তারা এই সংস্থা থেকে নিজেদের অংশ পাবে; যারা দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়বে, এই সংস্থ তাদের উঠিয়ে এনে আবার চলার যোগ্য করে দেবে। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্যে যাদের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন হবে, এই সংস্থা থেকে তারা সাহায্য সহযোগিতা লাভ করবে। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম আইনগতভাবে দেশের গোটা সঞ্চিত সম্পদ থেকে বার্ষিক ২.৫% ভাগ এবং গোটা বাণিজ্যিক পুঁজি থেকে বার্ষিক ২.৫% ভাগ যাকাত সংগ্রহ করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে। সমস্ত উশরী জমির উৎপন্ন ফসল থেকে ১০% ভাগ কিংবা ৫% ভাগ উশর এবং কেনো কোনো খনিজ সম্পদের উৎপাদন ২০% ভাগ যাকাত উসুল করতে বলেছে। এছাড়া গৃহপালিত পশুর উপরও বার্ষিক যাকাত আদায় করবে বলেছে। এই গোটা সম্পদ সামগ্রী ইসলাম গরীব, এতীম, বৃদ্ধ, অক্ষম, উপার্জনহীন, রাগী এবং সব ধরনের অভাবী ও দরিদ্রের সাহায্যার্থে ব্যবহার করতে বলেছে। এটা এমন একটা সামাজিক বীমা, যার বর্তমানে ইসলামী সমাজে কোনো ব্যক্তি জীবন যাপনে অপরিহার্য সামগ্রী থেকে কখনো বঞ্চিত থাকতে পারেনা। কোনো শ্রমজীবী মানুষকে অভুক্ত থাকার ভয়ে কারখানা মালিক বা জমিদারের যেকোনো অন্যায় শর্ত মেনে নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হতে হবেনা। আর উপার্জনের প্রতিযোগিতায় নামার জন্যে ন্যূনতম যে শক্তি সামর্থ্য থাকা অপরিহার্য, কোনো ব্যক্তির অবস্থাই তার চেয়ে নীচে নেমে যাবেনা।
ইসলাম ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে এমন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যাতে ব্যক্রি ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে, আর সামাজিক স্বার্থের জন্যেও তার স্বাধীনতা কোন ক্ষতির কারণ না হয়; বরং অবশ্যি কল্যাণবহ হয়। ইসলাম এমন কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কাঠামো সমর্থন করেনা, যা ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা ও স্বাধীনতাকে বিলীন করে দিয়ে তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। কোনো দেশের সমুদয় উৎপাদনের উপকরণকে জাতীয়করণ করার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো, দেশের সবগুলো মানুষকে সামাজিক স্বার্থের কঠোর নিগড়ে আবদ্ধ করা। এমতাবস্থায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জন্যে যেমন রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা প্রয়োজন তেমনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বড় বেশী দরকার। আমরা যদি ব্যক্তিত্বের মূলোৎপাটন করতে না চাই, তাহলে আমাদের সামাজিক জীবনে প্রতিটি মানুষের জন্যে এ সযোগ অবশ্যি বর্তমান রাখতে হবে, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি স্বাধীনভাবে নিজের জীবিকা উপার্জন করে নিজের মন মানসিকতার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারে এবং নিজের মানসিক ও নৈতিক তথা সমুদয় যোগ্যতাকে নিজের ঝোঁঁকপ্রবণতা অনুযায়ী বিকশিত করতে পারে। পরে মুষ্টিবদ্ধে রেশনের খাদ্য যতো প্রচুরই হোকনা কেন, তা মানুষের জন্যে তৃপ্তিদায়ক হতে পারেনা। কেননা, তাতে মনের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশে যে ক্ষতি হয়, কেবল মেদবহুল দেহ তা পূরণ করতে পারে না।
ইসলাম এ ধরনের সমাজ ব্যবস্থাকে সমর্থন করেনা; অরুরূপভাবে এমন সমাজ ব্যবস্থাকেও ইসলাম সমর্থন করেনা, যা ব্যক্তিকে সামাজিক ও অর্থনৈাতিক ক্ষেত্রে লাগামহীন স্বাধীনতা প্রদান করে এবং নিজের অবাধ কামনা বাসনা ও স্বার্থের জন্যে সমাজকে যথেচ্ছ ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগ করে দেয়। এ দুটি প্রান্তিক ব্যবস্থার মাঝখানে ইসলাম যে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে তা হলো- প্রথমত, সমাজের স্বার্থে ব্যক্তির উপর কিছু দায় দায়িত্ব এবং সীমারেখা আরোপ করা হবে। অতঃপর তার নিজের কর্মক্ষেত্রে তাকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হবে। ইসলাম নির্দেশিত এ সীমারেখা এবং দায় দায়িত্বের বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই; এখানে কেবল একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র পেশ করা হচ্ছে।
প্রথমত জীবিকা উপার্জনের বিষয়টিই আলোচনা করা যাক। এক্ষেত্রে ইসলাম যতোটা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বৈধ অবৈধের পার্থক্য করেছে, বিশ্বের অন্য কোনো ব্যবস্থা তা করেনি। ইসলাম বেছে বেছে উপার্জনের সেই সকল উপায় উপকরণ বা মাধ্যমকে অবৈধ ঘোষণা করেছে, যেগুলোর দ্বারা এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে বা সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজকে নৈতিক ও বস্তুগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে স্বীয় স্বার্থ হাসিল করার সুযোগ পায়। মদ এবং মাদকদ্রব্য তৈরী ও বিক্রয় করা, বেশ্যাবৃত্তি, গান বাজনা ও নৃত্যগীতের পেমা, জুয়া, প্রতিজ্ঞাপত্র [এক প্রকার জুয়া], লটারী, সুদ; অনমান, প্রতারণা এবং এমন ব্যবসা যাতে এক পক্ষের লাভ নিশ্চিত এবঙ অপর পক্ষের লাভ অনিশ্চিত; মূল্যবৃদ্ধির লক্ষ্যে মজুতদারী এবং অনুরূপ অন্যান্য কায়কারবার যা সমাজের জন্যে অনিষ্টকর, ইসলামী আইনে তা সবই দ্ব্যর্থহীনভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বস্তুত ইসলামের অর্থনৈতিক আইনকানুন পর্যালোচনা করলে উপার্জনের অবৈধ পন্থাপদ্ধতির এক বিরাট তালিকা পাওয়া যাবে। এ তালিকার মধ্যে এমন পন্থাপদ্ধতিও আছে যেগুলো প্রয়োগ করে বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষ কোটিপতি হচ্ছে; কিন্তু ইসলাম এসব পন্থাপদ্ধতিকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ইসলাম কেবল সেইসব পন্থায়ই মানুষকে উপার্জনের স্বাধীনতা প্রদান করেছে, যেগুলোর মাধ্যমে সে অন্য লোকরেদ প্রকৃত ও কল্যাণকর কোনো সেবা করে সুবিচারের সাথে পারিশ্রমিক লাভ করতে পারে।
ইসলামী বৈধ উপায়ে উপার্জিত সম্পদের উপর ব্যক্তির স্বত্তাধিকার স্বীকার করে। কিন্তু এ অধিকারও নিয়ন্ত্রণহীন নয়। এক্ষেত্রে ইসলাম ব্যক্তিকে তার বৈধ উপার্জন বৈধ উপায়ে ও বৈধ পথে ব্যয় করতে বাধ্য করে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে ইসলাম এমন কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, যার ফলে ব্যক্তি সদাসিধে ও পূত-পবিত্র জীবনযাপন আবশ্যি করতে পারবে কিন্তু বিলাসিতার জন্যে অর্থ উড়াবার সুযোগ তার থাকবে না । জাঁকজমক প্রদর্শন করে এতোটা সীমাতিক্রম করারও সুযোগ পাবেনা, যার ফলে অন্যদের উপর তার প্রভুত্বের চাকা জেঁকে বসতে পারে। অপব্যয়ের অনেকগুলো খাতকে তো ইসলামী আইন সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে। আর কোনো কোনো খাতকে যদিও সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেনি, কিন্তু বাজে ও অন্যায় ব্যয় থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্যে নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা ইসলামী রাষ্ট্রকে দেয়া হয়েছে।
বৈধ ও যুক্তিসংগত আয়-ব্যয়ের পর ব্যক্তির হাতে যে অর্থসম্পদ উদ্বৃত্ত থাকবে, তা সে সঞ্চয়ও করতে পারে এবং অধিক আয় উপার্জনের কাজে বিনিয়োগও করতে পারে। কিন্তু এ দুটি অধিকারের উপর কিছু বিধিনিশেষ আরোচ করা হয়েছে। সঞ্চয় করার ক্ষেত্রে তাকে নিসাবের অতিরিক্ত সম্পদের জন্যে বার্ষিক শতকরা আড়াই ভাগ হারে যাকাত প্রদান করতে হবে; আর বিনিয়োগ করতে চাইলে কেবল বৈধ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। বৈধ বিনিয়োগ সরাসরি নিজেও করতে পারে; আবার ইচ্ছা করলে অপরকে নিজের পুঁজি টাকা, জমি, যন্ত্রপাতি এবং সাজসরঞ্জাম ইত্যাদি আকারে প্রদান করে লাভ লোকসানের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসাও করতে পারে। এ উভয় পন্থায়ই বৈধ। এইসব সীমরারেখার মধ্যে অবস্থান করে কেউ যদি কোটিপতিও হয় তাতে ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তির কিছু নেই। বরঞ্চ এটা তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্র বলে বিবেচিত হবে। তবে সমাজের স্বার্থে ইসলাম এরূপ ক্ষেত্রে দুটি শর্ত আরোপ করেছে; একটি হলো, উক্ত কোটিপতিকে তার ব্যবসার যাবতীয় সম্পদের যাকাত এবং কৃষি উৎপাদনের উশর প্রদান করতে হবে। আর দ্বিতীয়টি হলো, সে তার ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প কারখানা এবং ক্ষেত খামারে যেসব লোকের সাথে অংশীদারিত্বের কিংবা পারিশ্রমিকের ভিত্তি কর্মসম্পাদন করবে, তাদের সকলের সাথে আবশ্যি সুবিচারমূলক আচরণ করতে হবে। সে স্বয়ং যদি এ সুবিচার না করে, তবে ইসলামী রাষ্ট্র তাকে সুবিচারের জন্যে বাধ্য করবে।
এসব বৈধ সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে ব্যক্তি যে সম্পদের মালিক হবে, ইসলাম তাও দীর্ঘদিন ধরে জমা করে রাখার অনুমতি দেয়নি; বরঞ্চ উত্তরাধিকার আইনের মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় তা বন্টন করে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। এক্ষেত্রে ইসলামী আইনের লক্ষ্য বিশ্বের অন্য সকল আইনের চেয়ে ভিন্নতর। অন্যান্য আইন চেষ্টা করে একবার যে সম্পদ অর্জিত হয়েছে, তা যেনো পুরুষানুক্রমে চিরদিন বহাল থাকে। পক্ষান্তরে ইসলামী আইন অনুযায়ী ব্যক্তি সারাজীবনে যে সম্পদ সঞ্চয় করেছে, তার মৃত্যুর সাথে সাথে তা তার নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বন্টন করে দিতে হয়। নিকটাত্মীয় না থাকলে অংশ অনুপাতে দূরের আত্মীয়রা তার উত্তরাধিকারী হবে। আর দূরের কোনো আত্মীয়ও যদি না থাকে তাহলে গোটা মুসলিম সমাজ তার উত্তরাধিকার লাভ করবে। এই আইন বিরাট বিরাট সঞ্চিত পুঁজি এবং জমিদারীকে বেশীদিন টিকে থাকতে দেয়না। উল্লিখিত সকল বিধিনিষেধ সত্ত্বেও কারো সম্পদের আধিক্যের কারণে যদি সমাজে কোনো বিকৃতি সৃষ্টি হয়ও, তবে এই শেষ আঘাতই তা নির্মূল করে দেবে।