ইসলামী সংগঠন
এ. কে. এম. নাজির আহমদ
বইটির অডিও শুনুন
ইসলামী সংগঠনের গুরুত্ব
সংগঠন শব্দের সাধারণ অর্থ সংঘবদ্ধকরণ। এর বিশেষ অর্থ দলবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ জীবন।
ইকামাতে দীনের কাজ আঞ্জাম দেয়। যেই সংগঠন তাকেই বলা হয় ইসলামী সংগঠন। ইসলামী সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ইকামাতে দীনের সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য ফরয।
না। সংগঠিত উদ্যোগ ছাড়া ইসলামের শ্ৰেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য বিকাশ সাধন সম্ভবপর নয় ।
সংগঠন সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ
واغتصموا بحبل الله جميعًا –
“তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জ্বকে (অর্থাৎ ইসলামকে) আঁকড়ে ধরা।” আলে। ইমরান: ১০৩
সংগঠন সম্পর্কে আল্লাহর রাসূলের (সা) বাণী
آنا أمركم بجْنس اللَّة أمرنى بهن الجماعة والسمع والطاعة
و الهجرة والجهاد فی سبیل اللّه فائه من خرج من الجماعة
قيد شبر, فقد خلع ربقة الاسلام من عنقه الأ أن يرجع ومن
دعا بدعوى جاهلية فهو من جنى جهنم – قالوا يا رسول اللّه
وان صنام وصلَّی ؟ قال وانصام وصلَّی وزعم آئلہ“مسنلۂ
“আমি তোমাদেরকে পাচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি। আল্লাহ আমাকে ঐগুলোর নির্দেশ দিয়েছেন। (বিষয়গুলো হচ্ছে)
১। সংগঠন,
২। নেতৃ নির্দেশ শ্রবণ,
৩। নেতৃ নির্দেশ পালন,
৪। আল্লাহর অপছন্দনীয় সবকিছু বর্জন এবং আল্লাহর পথে জিহাদ।
যেই ব্যক্তি ইসলামী সংগঠন ত্যাগ করে এক বিঘৎ পরিমাণ দূরে সরে গেছে সে নিজের গর্দন থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলেছে,
তবে সে যদি সংগঠনে প্রত্যাবর্তন করে তো স্বতন্ত্ৰ কথা। আর যেই ব্যক্তি জাহিলিয়াতের দিকে আহবান জানায় সে জাহান্নামী।
” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, ছালাত কায়েম এবং ছাওম পালন করা সত্ত্বেও?
” আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, “ছালাত কায়েম, ছাওম পালন এবং মুসলিম বলে দাবী করা সত্ত্বেও।”
– আহমদ ও হাকেম
لاً يحل لثلاثة يكونوا بفلاة من الأرض الأ أمروا عليهم أحدهم
“তিনজন লোক কোন নির্জন প্ৰান্তরে থাকলেও
একজনকে আমীর না বানিয়ে থাকা জায়েজ নয় ।”
اذا خرج ثلاثة فی سفر فليؤمروا عليهم أحدهم –
“তিনজন লোক সফরে বের হলে তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়।” – সুনানু আবী দাউদ
من سره أن يسكن بحبوحة الجثة فليلزم الجماعة –
“যেই ব্যক্তি জান্নাতের আনন্দ উপভোগ করতে চায় সে যেন সংগঠনকে আঁকড়ে ধরে।” – সহীহ মুসলিম
و من مات وهو مفارق للجماعة فائه يموت ميتة جاهلية –
“যেই ব্যক্তি জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু।”
-সহীহ মুসলিম
সংগঠন সর্ম্পকে হযরত উমারের (রা) উক্তি,
لاً اسلام الأ بجماعة ولاً جماعة الأ بامارة والأ امارة الأ بطاعة۔
“সংগঠন ছাড়া ইসলাম নেই। নেতৃত্ব ছাড়া সংগঠন নেই। আনুগত্য ছাড়া
এ সব আয়াত, হাদীস এবং উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে(১) মুমিনদেরকে সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করতে হবে। (২) এককভাবে জীবনযাপন করার অধিকার তাদের নেই। (৩) একক জীবন যাপনকারী শাইতানের শিকারে পরিণত হয়।
(৪) ইসলামী সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া জাহিলিয়াতে প্রত্যাবর্তনের শামিল ।
(৫) সংঘবদ্ধভাবে জীবন যাপন জান্নাত প্ৰাপ্তির অন্যতম পূর্বশত।
(৬) সংগঠন না থাকলে ইসলাম সগৌরবে টিকে থাকতে পারে না। ইসলামী সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া কোন সখের ব্যাপার নয়। ইসলামী সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নির্দেশের সুস্পষ্ট লংঘন। পক্ষান্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি ঈমানের অনিবাৰ্য দাবী হচ্ছে সংঘবদ্ধ জীবন যাপন ।
ইসলামী সংগঠনের উপাদান
নেতৃত্ব, কর্মী বাহিনী এবং সংগঠন পরিচালনা বিধি- এই তিনটি হচ্ছে সংগঠনের উপাদান।
যেই নেতৃত্ব ইসলামরে আলোকে আত্মগঠন করে শুধুমাত্র আল্লাহর দীনের প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মনিয়োগ ও কর্মী বাহিনী পরিচালনা করে সেই নেতৃত্বই ইসলামী নেতৃত্ব।
যেই কর্মী বাহিনী দুনিয়াবী কোন স্বার্থে তাড়িত না হয়ে কেবল আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী নেতৃত্বের অধীন সময়, শক্তি ও অর্থের কুরবানী দিতে থাকে তা-ই ইসলামী কর্মী বাহিনী।
নেতা ছাড়া সংগঠন হয়না। তেমনি কর্মী ছাড়া নেতার উপস্থিতিতেই সংগঠন হয় না। নেতা ও কর্মী বাহিনী মিলিত হলে সম্ভাবনার দিক যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি এর সমস্যার দিকও আছে। সেই কারণেই নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী যাতে নিজেদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারেরসীমা রেখা সঠিকভাবে জেনে নিতে পারে তার জন্য সংগঠনের কিছু পরিচালনা বিধি থাকে। আধুনিক পরিভাষায় এসব বিধি- বিধানের নাম সংবিধান।
ইসলামী সংগঠনের মূল বিধি-বিধান আল কুরাআন ও সুন্নাহ। অবশ্য আল কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষার ভিত্তিতে রচিত সংবিধানও ইসলামী সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই সংবিধান যেহেতু আল কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষার ভিত্তিতে রচিত হয়ে এবং ইসলামী সংগঠনের পরিচালনা ও সংরক্ষণে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেহেতু একে পবিত্র দলিল গণ্য করা হয় এবং এর কোন ধারা লংঘন করাকে শৃঙ্খলা বিরোধী তৎপরতা রূপ চিহ্নিত করা হয়।
মূলত নেতৃত্ব, কর্মী বাহীনি এবং পরিচালনা বিধি নিয়েই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। চলার পথে আরও অনেক কিছু উপাদান যুক্ত হয়ে একে সমৃদ্ধ করে তোলে।
ইসলামী সংগঠন ও ইকামতে দীন
সমাজের চাকা গতিশীল। পরিবর্তনের ধারা এখানে লেগে আছে। আকাংখিত অনাকাংখিত ধারায় প্রবাহিত হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে সমাজ জীবনে ইসলামের অনুপস্থিতি। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত না থাকার কারণেই সমাজে অশান্তি ও অস্বস্তি বিরাজ করে। আর এই অশান্তি ও অস্বস্তি থেকে বাঁচবার তাগিদে মানব প্রকৃতি বিক্ষোব্ধ হয়ে ওঠে। মানুষের মনের ক্ষোভ অসন্তোষে এবং অসন্তোষ বিদ্রোহে পরিণত হয়। এভাবেই মানব সমাজে পরিবর্তনের পালা চলতে থাকে।
যখন একটা পরিবর্তন ঘটে তখন মানুষ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তারা বোঝতে পারে যে তারা যা দেখেছে তা মরিচিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। নতুন বোতলে পুরোনো মদই তাদের ভাগ্যে জুটেছে। অশান্তি ও অস্বস্তি জগদ্দল পাথরের মতোই তাদের ওপর চেপে আছে। এথেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, এভাবে প্রকৃত শান্তি ও স্বস্তির প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়।
সমাজ পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় নিজস্ব ভূমিকা পালনের জন্যই ইসলামের আবির্ভাব। ইসলাম মানব সমাজকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে নতুন ধাঁচে গড়ে তুলে মানব গোষ্ঠীর শান্তি ও স্বস্তির নিশ্চয়তা বিধান করতে চায়।
এই শান্তি ও স্বস্তির নিশ্চয়তা বিধানের প্রয়োজনে ইসলাম মানুষের ব্যক্তি জীবনের ক্ষুদ্র গন্ডী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনের বৃহৎ গন্ডী পর্যন্ত সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হতে চায়।
তবে ইসলাম নিজে নিজেই সমাজে কায়েম হয়ে যায় না। কোন ব্যক্তির একক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ও ইসলাম কায়েম হতে পারেনা। এর জন্য প্রয়োজন একদল মানুষের সংগঠিত উদ্যোগ। সর্বাত্মক প্রচেষ্টা।
ইসলামকে সমাজ জীবনে কায়েম করার পন্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে মত পার্থক্য হওয়াই স্বাভাবিক ছিলো। মত পার্থক্যের চক্করে পড়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বিঘিতœ হোক, এটা আল্লাহ চাননি। তাই তিনি জীবন বিধান পাঠানোর সাথে সাথে রসূলও পাঠিয়েছেন জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম পদ্ধতি শিক্ষা দেবার জন্য। আমাদের জন্য শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা) এর কর্মপন্থাই একমাত্র অনুসরণীয় কর্মপন্থা।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম পরিচালনার জন্য যেই সংগঠন গড়ে ওঠে তা মানুষকে আল্লাহর পথে আসার জন্য আহবান জানাতে থাকে। যারা আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে সংগঠন তাদেরকে সংঘবদ্ধ করে সুসংগঠিত শক্তিতে পরিণত করে এবং তদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এই সংগঠিত এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ব্যক্তিরাই হয় ঘুণে ধরা সমাজকে আঘাত হেনে ভেঙ্গে ফেলার এবং ইসলামী মূল্যমানের ওপর নতুন সমাজ বিনির্মাণের প্রধান উপাদান। ইসলামী সংগঠনের লোকদের দ্বারা যখন সরকার গঠিত হয় তখন সমাজের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সকল স্তরে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় জীবনের সবদিক ও বিভাগে। সমাজ থেকে রাজনৈতিক জুলুম অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক ভেদাভেদ এবং অশ্লীলতা দূর হয়। সমাজের সর্বত্র কল্যাণের প্লাবন সৃষ্টি হয় অশান্তি আর অস্বস্তির অভিশাপ থেকে মানুষ মুক্তি লাভ করে।