৬. দ্বিতীয় মুরাদ
১. সুলতান পদে দ্বিতীয় মুরাদ
১৪২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম মুহাম্মাদের পুত্র দ্বিতীয় মুরাদ আড্রিয়ানোপলের মসনদে বসেন। তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ১৮ বছর।
২. দ্বিতীয় মুরাদ যেমন ছিলেন
দ্বিতীয় মুরাদ একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন। তিনি অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। তাঁর উদারতা, বিজ্ঞতা এবং পরমত সহিষ্ণুতা সর্বজন বিদিত ছিলো। তিনি দরিদ্র ও দুঃখী মানুষের বন্ধু ছিলেন। দ্বিতীয় মুরাদ একজন সুশাসক ছিলেন। তাঁর শাসনকালে রাষ্ট্রের সর্বত্র আইন-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত ছিলো। ইসলামী মূল্যবোধের উজ্জীবন ও সংরক্ষণের দিকে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিলো। রাষ্ট্রের সর্বত্র তিনি বহু সংখ্যক মাসজিদ এবং ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। জনগনের সুচিকিৎসার জন্য তিনি বহু হাসপাতাল ও স্থাপন করেছিলেন।
ইতিহাসবিদ গীবন বলেন, “ন্যায়নিষ্ঠা এবং সংযত আচরণ ছিলো দ্বিতীয় মুরাদের উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। খ্রিষ্টানগণ ও তা একবাক্যে স্বীকার করেছে। পূর্ব হতে বিশেষভাবে প্ররোচনা দ্বারা দ্বারা বাধ্য না হলে তিনি কখনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন না। আর সন্ধি চুক্তি প্রতিপালনে তাঁর কথাও ছিলো পবিত্র।”
তাঁর রাজ্যে খ্রিষ্টান প্রজাগণ সুখে বসবাস করতো। অন্য সম্প্রদায়ের খ্রিষ্টানদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে গ্রীক অর্থোডক্স চার্চের খ্রিষ্টানগণ তাঁর শাসিত অঞ্চলে এসে নিরাপদে বসবাস করতে থাকে।
৩. রণাংগনে দ্বিতীয় মুরাদ
সার্বিয়া উসমানী খিলাফাতের অধীনে একটি স্বায়ত্বশাসিত রাজ্য ছিলো। সার্বিয়ার নতুন রাজা জর্জ ব্রাংকোভিচ বোসনিয়া-হারজেগোভিনা, পোলান্ড, ওয়ালাচিয়া, আলবেনিয়া এবং হাংগেরীর রাজাদেরকে উসমানী খিলাফাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উসকানি দেন। হাংগেরীর বিখ্যাত সেনাপতি হুনিয়াডীর নেতৃত্বে বিশাল খ্রিষ্টান সেনাবাহিনী ১৪৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ভার্না প্রান্তরে দ্বিতীয় মুরাদের সৈন্য বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। হাংগেরীর রাজা ভ্যাডিসলাস এবং কার্ডিনাল জুলিয়ান এই যুদ্ধে নিহত হন। সেনাপতি হুনিয়াডী পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান।
উল্লেখ্য যে হুনিয়াডী সার্বিয়া এবং বোসনিয়া-হারজেগোভিনার খ্রিষ্টানদেরকে জোর পূর্বক রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী বানাতে চান। এতে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। তারা রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী হওয়ার চেয়ে নিজস্ব ধর্মমতে অটল থেকে উসমানী খিলাফাতের শাসনাধীনে থাকাকে শ্রেয় মনে করে। ওই সব দেশের রাজা এবং সেনাপতিগণ উসমানী খিলাফাতের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও জনগণ কিন্তু উসমানী খিলাফাতের নিকট আত্নসমপর্ন করাকেই সঠিক মনে করে।
৪. দ্বিতীয় মুরাদের ইন্তিকাল
১৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে ৬৮ বছর বয়সে দ্বিতীয় মুরাদ ইন্তিকাল করেন।
৭. দ্বিতীয় মুহাম্মাদ
১. সুলতান পদে দ্বিতীয় মুহাম্মাদ
১৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় মুহাম্মাদ আড্রিয়ানোপলের মসনদে বসেন। তখন তাঁর বয়স ছিলো ২১ বছর।
২. দ্বিতীয় মুহাম্মাদ যেমন ছিলেন
দ্বিতীয় মুহাম্মাদ একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন। ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো খুবই বলিষ্ঠ। এই জন্য তাঁকে ‘নেক আমলের জনক’ বলা হতো। কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ে পর তিনি সেখানে ইয়েনি সারাই নামে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। এই শহরে তিনি অনেকগুলো মাসজিদ, ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল স্থাপন করেন।
যাকাত, মালে গানীমা এবং জিযইয়া ছিলো রাষ্ট্র তহবিলের আয়ের প্রধান উৎস। বিজিত অঞ্চলের রাজস্ব থেকে একটি অংশ ওয়াকফ সম্পত্তিরূপে আলাদা রাখা হতো এবং এর দ্বারা দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় ভার বহন করা হতো। মুসলিম নাগরিকদের কাছ থকে উশর (ফসলের যাকাত) আদায় করা হতো।
দ্বিতীয় মুহাম্মাদ বেসামরিক শাসনকার্য পরিচালনার জন্য একটি দিওয়ান বা পরিষদ গঠন করেন। উযীর, নিশানজী (সচিব), কাজী এবং খাজাঞ্চী – এই চারজনের ওপর দিওয়ান পরিচালনার দায়িত্ব ছিলো। দ্বীনী বিষয়ে তিনি প্রধান মুফতির ফতোয়ার উপর নির্ভর করতেন।
দ্বিতীয় মুহাম্মাদ সকল নাগরিককে সমান চোখে দেখতেন, সকলের প্রতি ন্যায় বিচার করতেন। তিনি বিচার ব্যাবস্থাকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য সজাগ দৃষ্টি রাখতেন।
শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি খিলাফাতকে কয়েকটি প্রদেশে এবং প্রতিটি প্রদেশকে কয়েকটি জিলায় বিভক্ত করেন। সরকারী কর্মচারীদের ট্রেনিং এর জন্য তিনি রাজধানীতে একটি ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করেন।
তিনি ছিলেন অসীম সাহসের অধিকারী। রণকৌশলে তাঁর পারদর্শিতা ছিলো অসাধারণ। তিনি একলক্ষ সদস্য বিশিষ্ট একটি সুদক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন।
৩. রণাংগনে দ্বিতীয় মুহাম্মাদ
৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন বসফরাস প্রণালীর উপকূলে প্রাচীন গ্রীক শহর বাইজেনটিয়ামে তাঁর সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী স্থাপন করে এর নাম রাখেন নোভারোমা বা নয়া রোম। কালক্রমে তাঁর নামানুসারে এই শহরের নাম রাখা হয় কনস্ট্যান্টিনোপল।
৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট থিউডোসিয়াস তাঁর দুই পুত্রের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে দেন। দুইটি সাম্রাজ্য পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য ও পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য নামে পরিচিত হয়। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের অপর নাম বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য। কনস্ট্যান্টিনোপল হয় বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী। তদুপরি এটি খৃষ্টানদের গ্রীক অর্থোডক্স চার্চের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।
দ্বিতীয় মুহাম্মাদের সময় গ্রীসের রাজা কনস্ট্যান্টাইন কনস্ট্যান্টিনোপলের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। দ্বিতীয় মুহাম্মাদ তাঁর পূর্বসূরীদের মতো কনস্ট্যান্টিনোপল দখলের উদ্যোগ নিচ্ছেন জেনে রাজা কনস্ট্যান্টাইন পশ্চিম ইউরোপের খৃষ্টান রাজাদের নিকট সাহায্যের আবেদন করেন। সমঝোতার খাতিরে তিনি তখন রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনেকগুলো দাবি-দাওয়া মেনে নেন। এতে গ্রীক অর্থোডক্স চার্চের নেতৃবৃন্দ ক্ষেপে যান। গ্রীন অর্থোডক্স চার্চের প্রধান গ্র্যান্ড ডিউক নোটারাস বলেন যে, রোমান সম্রাটের মুকুট অপেক্ষা তিনি উসমানী সুলতানের পাগড়ি দেখতে বেশি পছন্দ করেন। এই সব কারনে গ্রীসের রাজা বেশি সংখ্যাক যোদ্ধা যোগাড় করতে পারেননি।
১৪৫৩ খৃষ্টাব্দে ২৫ শে মে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ রাজা কনস্ট্যান্টাইনের প্রতিরোধ ভেংগে ফেলে কনস্ট্যান্টিনোপলে প্রবেশ করেন। যুদ্ধে গ্রীসের রাজা নিহত হন। কনস্ট্যান্টিনোপলে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়। এই মহা বিজয়ের জন্যই দ্বিতীয় মুহাম্মাদ ফাতিহ মুহাম্মাদ বা বিজেতা মুহাম্মাদ নামে খ্যাত হন।
কনস্ট্যান্টিনোপল দখলের পর দ্বিতীয় মুহাম্মাদ গ্রীক অর্থোডক্স চার্চের কর্তৃপক্ষকে একটি সনদ প্রদান করেন। খৃষ্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি অবাধে প্রতিপালনের অধিকার স্বীকৃত হয়।
যুদ্ধকালে যেইসব খৃষ্টান শহর ছেড়ে পালিয়েছিলো দ্বিতীয় মুহাম্মাদ তাদেরকে স্বগৃহে ফিরে আসার আহবান জানান। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে বহু খৃষ্টান কনস্ট্যান্টিনোপলে ফিরে আসে।
দ্বিতীয় মুহাম্মাদ আড্রিয়ানোপল থেকে কনস্ট্যান্টিনোপলে উসমানী খিলাফাতের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
এই সময় বোসনিয়া-হারজেগোভিনার শাসক ছিলেন একজন উগ্র রোমান ক্যাথলিক খৃষ্টান। নাগরিকদের বেশীরভাগ ছিল বোগোমিল খৃষ্টান। এরা ঈসা (আঃ) এবং মারইয়ামের পূজা করতো না। তাদের উপাসনালয়ে কোন মূর্তি ছিলো না। এরা ক্রসকে ধর্মীয় প্রতীক গণ্য করতো না। তারা মানতো যে ঈসা (আঃ) শূলবিদ্ধ হয়েছেন। এরা মদ্যপান করতো না।
বোগোমিলদের ধর্মবিশ্বাস রোম থেকে প্রচারিত পোপের ধর্মবিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক ছিলো। তাই রোমান ক্যাথলিক চার্চ তাদের প্রতি খড়গহস্ত ছিলো। বোগোমিলদের উপর অত্যাচারের স্টীমরোলার চালানো হয়। বহু বোগোমিল নিহত হয়। অনেকে অন্যত্র পালিয়ে যায়।
অচিরেই বোসনিয়া-হারজেগোভিনার বোগোমিল খৃষ্টানগণ মুসলিমদের সদাচরণ ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে পরিচিত হয়। রোমান ক্যাথলিকদের যুলুম থেকে বাঁচার জন্য তারা মুসলিমদের সাহাযয় প্রার্থনা করেন।
১৪৬৩ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় মুহাম্মাদ একদল সৈন্য নিয়ে বোসনিয়া-হারজেগোভিনা পৌঁছে গণধিকৃত শাসককে যুদ্ধে পরাজিত করেন। ইসলামের সোউন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হাজার হাজার বোগোমিল খৃষ্টান মুসলিম হয়ে যায়। মাত্র একদিনেই ছত্রিশ হাজার খৃষ্টান মুসলিম হয়।
১৪৬৬ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় মুহাম্মাদ আলবেনিয়ার উদ্দেশ্যে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। আলবেনিয়া উসমানী খিলাফাতের অধীনে আসে। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সোউন্দর্যের সাথে পরিচিত হয়ে আলবেনিয়ার অগণিত খৃষ্টান ইসলাম গ্রহন করে আলবেনিয়াকে ইসলামের একটি মজবুত ঘাঁটিতে পরিণত করে।
১৪৬৭ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় মুহাম্মাদের অন্যতম দেনাপতি কুদুক আহমান ক্রিমিয়া জয় করেন।
১৪৭৭ খৃষ্টাব্দে সেনাপতি উমার পাশা যুদ্ধক্ষেত্রে ভেনিসের রাজাকে পরাজিত করেন।
১৪৮০ খৃষ্টাব্দে সেনাপতি কুদুক আহমাদ ইতালীর দ্বার অট্রেন্টো দখল করেন। এইভাবে ইতালীর একাংশ উসমানী খিলাফাতের অধীন হয়। দ্বিতীয় মুহাম্মাদ সমগ্র ইতালী জয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
৪. দ্বিতীয় মুহাম্মাদের ইন্তিকাল
১৪৮১ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় মুহাম্মাদ ইন্তিকাল করেন।
৮. দ্বিতীয় বায়েজিদ
১. সুলতান পদে দ্বিতীয় বায়েজিদ
১৪৮১ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় মুহাম্মাদের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিতীয় বায়েজিদ কনস্ট্যান্টিনোপলের মসনদে বসেন। তখন তাঁর বয়স ছিলো পয়ঁত্রিশ বছর।
২. দ্বিতীয় বায়েজিদ যেমন ছিলেন
তিনি একত্রিশ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। শাসনকালে প্রথম ভাগে তাঁকে ভাইদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে দেখা যায়।
শাসক হিসেবে তিনি তেমন কোন যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি।
৩. রণাংগনে দ্বিতীয় বায়েজিদ
মিসরের মামলুক শাসকদের সাথে উসমানী খিলাফাতের সংঘর্ষে একটি দুঃখজনক ঘটনা। ১৪৮৪ খৃষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৪৯১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত দ্বিতীয় বায়েজিদকে ছয়বার মিসরের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। ১৪৯১ খৃষ্টাব্দে একটি সন্ধির মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ হয়।
১৪৯১ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় বায়েজিদ ভেনিস বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ১৫০৩ খৃষ্টাব্দে ভেনিস তাঁর সাথে শান্তি যুক্তি স্বাক্ষর করে।
দ্বিতীয় বায়েজিদ ইরানের শাহ ইসমাঈলের সাথেও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। শাহ ইসমাঈল শিয়া ছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় এশিয়া মাইনরে শিয়াগণ উসমানী খিলাফাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্নক তৎপরতা শুরু করে।
১৫১১ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় বায়েজিদ উযীরে আযম আলী পাশার নেতৃত্বে শীয়াদের বিরুদ্ধে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। সেভার্স এর সন্নিকটে সংঘটিত যুদ্ধে শিয়াগণ পরাজিত হয়। তবে এই যুদ্ধে একদিকে উযীরে আযম আলী পাশা, অপরিদকে শীয়া নেতা শাহ কুলী নিহত হন।
৪. দ্বিতীয় বায়েজিদের ক্ষমতা ত্যাগ
১৫১২ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় বায়েজিদ জাননিসার এবং অন্যান্য সৈন্যদের চাপের মুখে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র প্রথম সলিমের পক্ষে ক্ষমতা ত্যাগ করেন।
৯. প্রথম সলিম
১. সুলতান পদে প্রথম সলিম
১৫১২ খৃষ্টাব্দে প্রথম সলিম কনস্ট্যান্টিনোপলের মসনদে বসেন। গৃহবিবাদ দমন করে তাঁকে ক্ষমতা পাকাপোখত করতে হয়।
২. প্রথম সলিম যেমন ছিলেন
প্রথম সলিম অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি দ্বীনি আলোচনায় অংশ নিতে আনন্দ পেতেন। অন্যান্য ধর্মানুসারীদের প্রতিও তিনি উদার ছিলেন। তাঁর শাসনকালে খৃষ্টান এবং ইয়াহুদীগণ পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করতো। তিনি খুবই বিদ্যানুরাগী ছিলেন। গভীর রাত পর্যন্ত তিনি পড়াশুনা করতেন। তা৬র প্রশাসনে বহু জ্ঞানীগুণি ব্যাক্তির সমাবেশ ঘটেছিলো। সাধারনত তিনি দয়ালু ব্যাক্তি ছিলেন। তবে অসাধু ব্যাক্তিদের প্রতি তিনি খুবই কঠোর ছিলেন। ক্ষেত্রবিশেষে তিনি নিষ্ঠুরতার আশ্রয় ও নিয়েছেন। জনগনের সখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধির ব্যাপারে তিনি খুবই সজাগ ছিলেন। সেনাবাহিনীর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দিকেও তাঁর নজর ছিলো।
৩. রণাংগনে প্রথম সলিম
১৫১৪ খৃষ্টাব্দে প্রথম সলিম কালদিরান প্রান্তরে ইরানের শিয়া শাসক শাহ ইসমাঈলকে পরাজিত করেন। আহত অবস্থায় ইরানের শাহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তাঁর স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যবৃন্দ বন্দী হন। প্রথম সলিম ইরানের রাজধানী তাব্রিজে প্রবেশ করেন। তিনি ইরানের দিয়ারবেকির এবং কুর্দিস্তান উসমানী খিলাফাএত্র অন্তর্ভুক্ত করে রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল ফিরে আসেন।
১৫১৬ খৃষ্টাব্দে প্রথম সলিম মিসরের মামলুক শাসক কানসোহ আলঘোরীর নিকট থেকে সিরিয়া, ফিলিস্তিন এবং আরবের বৃহত্তর অংশ দখল করেন।
১৫১৭ খৃষ্টাব্দে প্রথম সলিম মিসরের নতুন শাস্ক তুমান বে-কে কায়রোর নিকতবর্তী বিদানিয়া প্রান্তরে পরাজিত করে মিসর উসমানী খিলাফাতের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
৪. খালীফা পদবী গ্রহণ
বাগদাদ কেন্রিক বিশাল বানুল আব্বাস খিলাফাত তাতারদের আক্রমণে তছনছ হয়ে গিয়েছিলো। ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে বাগদাদের পতন ঘটে তাতার সমর নায়ক হালাকু খানের হাতে। বানুল আব্বাসের জীবিত সদস্যগণ পালিয়ে মিসরে গিয়ে পৌঁছে। মিসরে তখন মামলুকদের শাসন।
খালীফা পদবী তখন মুসলিম জাহানের আত্নিক ঐক্যের একটি প্রতীকী পদবী ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। প্রথম সলিম যখন মিসর জয় করেন তখন খালীফা পদবীধারী আহমাদ আল্মুতাওয়াক্কিল কায়রোতে অবস্থান করছিলেন। তিনি ছিলেন মামলুকদের হাতের পুতুল মাত্র। প্রথম সলিম তাঁকে বন্দী করে কন্সট্যান্টিনোপলে নিয়ে আসেন। আহমাদ আল্মুতাওয়াক্কিলকে খালীফা পদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দ্যা হয়। প্রথম সলিম খালীফা পদবী গ্রহণ করেন। তখন থেকে উসমানী শাসকগণ একই সময় ‘সুলতান’ ও ‘খালীফা’ পদে অধিষ্ঠিত হতে থাকেন।
৫. প্রথম সলিমের ইন্তিকাল
১৫২০ খৃষ্টাব্দে সুলতান ও খালীফা প্রথম সলিম ইন্তিকাল করেন।
১০. প্রথম সুলাইমান
১. সুলতান ও খালীফা পদে প্রথম সুলাইমান
১৫২০ খৃষ্টাব্দে প্রথম সলিমের একমাত্র পুত্র প্রথম সুলাইমান কনস্ট্যান্টিনোপলের মসনদে বসেন। তখন তাঁর বয়স ২৬ বছর।
২. প্রথম সুলাইমান যেমন ছিলেন
যুবরাজ থাকাকালেই প্রথম সুলাইমান অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তখনই তা৬র সততা ও যোগ্যতার কথা সর্বত্র আলোচিত হতো। তিনি খালীফা হওয়ার পর সারা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রথম সুলাইমান ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম। দৈনন্দিন জীবনে তিনি ইসলামের অনুশাসনগুলো নিষ্ঠার সাথে প্রতিপালন করতেন। সকল মুসলিম নাগরিক যাতে নিয়মিত ছালাত আদায় এবং ছাওম পালন করে সেই দিকে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিলো। ছালাত এবং ছাওম পালনে শৈথিল্যের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। প্রথম সুলাইমান আল কুরআনের আটটি খন্ড নিজের হাতে কপি করে সুলাইমানিয়া মাসজিদে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তিনি কা’বারও সংস্কার সাধন করেন।
তিনি অন্যান্য ধর্মানুসারীদের প্রতিও উদার মনোভাব পোষন করতেন। তাঁর শাসনকালে ধর্মীয় কোন্দলের কারনে বিপদাপন্ন হয়ে খৃষ্টান দেশগুলো থেকে বহু প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক খৃষ্টান তাঁর পরিচালিত রাষ্ট্রে এসে নিরাপদে বসবাস করতে থাকে। ইতিহাসবিদ লর্ড ক্রেজি বলেন, “খৃষ্টান জগতে রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে অত্যাচার-অবিচারের যুগে সমসাময়িক অন্যকোন নরপতি সুলাইমানের ন্যায় প্রশংসা অর্জন করতে পারেননি।”
সাহসিকতা, মহানুভবতা, ন্যায়পরায়নতা এবং বদান্যতা তাঁর চরিত্রের ভূষন ছিল। তিনি নাগরিকদের করভার লাঘব করেন।
সুলাইমানিয়া মাসজিদ তাঁর অমর কীর্তি। রাষ্ট্রের সর্বত্র তিনি বহু মাসজিদ, ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গোসলখানা, সেতু ইত্যাদি তৈরী করেন।
তিনি দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদেরকে বরখাস্ত করে সৎ ও যোগ্য লোক নিয়োগ করেন। ন্যায় বিচারের স্বার্থে তিনি আপন জামাতাকেও গভর্ণরের পদ থেকে সরিয়ে দেন। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি সমগ্র খিলাফাতকে ২১ টি ওলায়াত (প্রদেশ) এবং ২৫০ টি সানজাকে (জিলা) বিভক্ত করেন। প্রত্যেকটি সানজাক আবার কয়েকটি কাদাসে বিভক্ত ছিল। প্রদেশের শাসনকর্তাকে ওয়ালী বলা হতো। সানজাকের শাসনকর্তা ছিলেন পাশা। প্রত্যেকটি কাদাসে ছিলেন একজন কাযী। তবে প্রথম সুলাইমানের আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন পছন্দ করতেন। তাঁর ওপর অন্যতমা স্ত্রী রোক্সেলানার বিশেষ প্রভাব ছিল।
তাঁর সমসাময়িক প্রখ্যাত শাসক ছিলেন জার্মেনীর পঞ্চম চার্লস, ফ্রান্সের প্রথম ফ্রান্সিস, ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ, রাশিয়ার জার আইভানোভিচ, পোল্যান্ডের সিজিসমান্ড, ইরানের শাহ ইসমাঈল এবং ভারতের মোগল সম্রাট আকবর।
৩. দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা
প্রথম দিকে উসমানী শাসকগণ নিজেদেরকে ইসলামী আইনকানুনের প্রতিভূ মনে করতেন। ধর্মীয় আইনবিদগণ কাযী ও মুফতী নামে দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে বিভাগ দুইটিকে প্রধান মুফতীর অধীনে আনা হয়। প্রধান মুফতী শাইখুল ইসলাম নামে পরিচিত হন। ১৬ শতকের মধ্যভাগ থেকে শাইখুল ইসলামের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁর পদমর্যাদা প্রায় উযীরে আযমের পদমর্যাদার সমকক্ষ ছিল। কোন আইন ধর্মীয় বিধান সম্মত কিনা সেই সম্বন্ধে অভিমত দেওয়াই ছিল শাইখুল ইসলামের প্রধান কাজ। সকল দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁর দফতরের অধীন ছিল।
৪. রণাংগনে প্রথম সুলাইমান
হাংগেরীর রাজা দ্বিতীয় লুই খালীফার দূতকে হত্যা করেন। ১৫২১ খৃষ্টাব্দে প্রথম সুলাইমান সৈন্য বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়ে হাংগেরীর তখনকার রাজধানী বেলগ্রেড দখল করেন।
১৫২২ খৃষ্টাব্দে প্রথম সুলাইমান রোডস দ্বীপ জয় করেন।
১৫২৬ খৃষ্টাব্দে হাংগেরীর রাজা দ্বিতীয় লুই শক্তি সঞ্চয় করে আবার মুসলিমদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। প্রথম সুলাইমান উযীরে আযম ইবরাহীম পাশার সেনাপতিত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। মোহাক্স্ প্রান্তরে উভয় বাহিনীর মুকাবিলা হয়। যুদ্ধে দ্বিতীয় লুই পরাজিত ও নিহত হন। হাংগেরীর রাজধানী বুদাপেষ্ট মুসলিমদের দখলে আসে।
১৫৫৩ খৃষ্টাব্দে প্রথম সুলাইমান ইরানের হাত থেকে ইরাক ছিনিয়ে নেন।
১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে তিনি বাসরা জয় করেন।
তিনি প্রধান নৌ সেনাপতি খাইরুদ্দীন বারবারোসা এবং দ্রাগুত পাশা, উলুজ আলী, পিরি পাশা এবং পিয়ালী পাশা নামক কয়েকজন নৌ সেনাপতির সাহায্যে একটি দক্ষ নৌ-বাহিনী গড়ে তোলেন। এই নৌ-বাহিনী ভূমধ্য সাগর, লোহিত সাগর এবং আরব সাগরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
৫. প্রথম সুলাইমানের ইন্তিকাল
১৫৬৬ খৃষ্টাব্দে হাংগেরীর রাজা দ্বিতীয় ম্যাক্সিমিলান বিদ্রোহী হয়ে ওঠলে প্রথম সুলাইমান অভিযানে বের হন। পথিমধ্যে তিনি ক্রোশিয়া দখল করেন। তার পর তিনি সিগেত দুর্গ জয় করেন। সিগেত দুর্গের পতনের পর সেই রাতেই প্রথম সুলাইমান আকস্মিকভাবে ইন্তিকাল করেন।