৪. সুদ শেয়ার–বাজারে ফটকাবাজির জন্ম দেয়
বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই সাধারণতঃ দালাল (Broker) এবং ঠিকাদারদের (Jobber) মাধ্যমে শেয়ার, স্টক, সিকিউরিটি ইত্যাদি বেচাকেনা করতে হয়। এই দালালরা সুকৌশলে শেয়ার-বাজারে ফটকা (Speculation) সৃষ্টি করে।
এম, এস, রিক্সা লিখেছেন যে, শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়কারীরা এমন একটি পণ্য বেচাকেনা করে যা তারা ভোগ করতে পারে না বা তাদের কারবারে খাটাতে পারে না। এ পণ্যের ওপর তারা কোন কাজ করে না এবং এর ওপর কোন মূল্য সংযোজনও তারা করে না। [এম, এস, রিক্সা: স্টক মার্কেট ইকোনোমিক্স, পৃ: ২০৪।] বস্তুতঃ ফটকা কারবারীরা অগ্রিম ভিত্তিতে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করে এবং ক্রয়-বিক্রয়কালে বিক্রেতা শেয়ারের সরবরাহ দেয় না এবং ক্রেতাও সরবরাহ নেয়ার প্রয়োজনবোধ করে না। এভাবে ক্রয়-বিক্রয়ে দামের পার্থক্যের মাধ্যমেই তারা বিরাট অংকের মুনাফা অর্জন করে নেয়।
শেয়ার কারবারীরা সাধারণতঃ ‘শর্ট বিক্রয়’ (Short Sale) অথবা ‘লং ক্রয়’ (Long Buy) করে থাকে। শর্ট বিক্রয়কারীকে সাধারণ ভাষায় বলা হয় বিয়ার (Bear)। বিয়ার যখন মনে করে যে, কোন শেয়ারের দাম খুব শীঘ্রই কমে যাবে, তখন তার কাছে থাকুক আর না থাকুক, সে সেই শেয়ারের বিরাট অংশ বর্তমান দামে বিক্রি করে দেয়। পরবর্তীতে সেই শেয়ারের দাম যখন সত্যি সত্যি কমে যায়, তখন সে কম দামে শেয়ার ক্রয় করে তার ঘাটতি বিক্রয় পূরণ করে। এভাবে পরবর্তী সময়ে কম দামে ক্রয় এবং পূর্বের বেশি দামে বিক্রয়ের মধ্যে দিয়ে সে তার মুনাফা করে নেয়।
লং ক্রেতাকে (Long Buyer) সাধারণতঃ বলা হয় বুল (Bull)। বুল যখন মনে করে যে, কোন শেয়ারের দাম বেড়ে যাবে, তখন সে বর্তমানের কম দামে সেই শেয়ারের বিরাট অংশ কিনে নেয় এবং পরে দাম বাড়লে উক্ত শেয়ার বর্ধিত দামে বিক্রয় করে লাভ করে।
শেয়ার-বাজারে এই ফটাকাবাজারীর জন্ম হয় সুদী ঋণ ব্যবস্থা এবং মার্জিনে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের (Purchase and Sale on Margin) সুযোগ থেকে। মার্জিনে ক্রয়ের বেলায় ক্রেতাকে তার ক্রীত শেয়ারের সাকুল্য দাম নগদ পরিশোধ করতে হয় না; বরং দালালের কোন লোকসান হলে, তা যাতে পূরণ করতে পারে সে জন্য শেয়ারের দামের একটা অংশ দালালের কাছে জমা রাখলেই চলে। এই জমা নগদ অর্থেও রাখা যায় অথবা গ্রহণযোগ্য কোন সিকিউরিটি হলেও চলে। ক্রীত শেয়ারের দামের বাকি অংশ দালালের পক্ষ থেকে ক্রোতাকে ধার দেওয়া হয়। দালাল সেই শেয়ারগুলো জামানত রেখে এর দামের সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে সুদের ভিত্তিতে ঋণ হিসেবে নিয়ে থাকে।
উক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, মার্জিনে ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থার দরুন ক্রতো অল্প অর্থ জমা দিয়ে বিপুল পরিমাণ শেয়ার ক্রয় করতে সক্ষম হয়। তেমনি সুদী ব্যবস্থা চালু থাকায় দালালের পক্ষে সুদী ঋণ নিয়ে বিপুল পরিমাণ শেয়ারে খাটানো সম্ভব হয়। সুতরাং একথা বিনা দ্বিধায় বলা যায় যে, মার্জিনে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণের শেয়ার লেনদেন হয়, অথচ এর ফলে মোট শেয়ারের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় না বা এতে অর্থনীতিতে মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটে না। এছাড়া প্রয়োজনীয় মার্জিনের হার অথবা সুদের হারে অথবা একই সাথে মার্জিন ও সুদের হারে যদি কোান পরিবর্তন হয়, তাহলে তা স্টক বাজারে নতুন করে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা বয়ে আনে। ব্যাক (Bach) বলেছেন, “If rising stock prices have been financed by borrowed money a downturn in the market may precipitate a major collapse in stock pdces, as lenders call for cash, and may place serious financial pressure on banks and other lenders. A high market based on credit is thus far more vulnerable than a cash market and is more likely to be a cyclically destabilising force.” [জি, এল, ব্যাক, ইকোনোমিক্সঃ এন ইনট্রোডাকশন টু এনালিসিস এন্ড পলিসি, ১৯৭৭, পৃঃ ১৮২।] “ঋণের অর্থ দ্বারা যদি চড়া বাজারে শেয়ার ক্রয় করা হয় তাহলে বাজারে একটু কমতে শুরু করলেই তা স্টক মূল্যে ব্যাপক ধসের কারণ হতে পারে। কেননা দাম কমার সময় ঋণদাতাগণ তাদের অর্থ ফেরত দাবী করে এবং ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণদাতাদের ওপর কঠিন চাপ সৃষ্টি করে। সুতরাং ঋণের ওপর ভিত্তিশীল চড়া বাজার নগদ ভিত্তিক বাজারের তুলনায় বেশি দুর্বল ও বিপদজনক এবং বাজারে চক্রাকারে অস্থিরতা সৃষ্টির কারণ”।
মার্জিনের হার এবং/অথবা সুদের হার হ্রাস পেলে শেয়ার-বাজার গরম হয়ে উঠে। ফটাক কাবারীরা অধিক পরিমাণে শেয়অর ক্রয় করতে শুরু করে। ব্যাংকাররাও ভবিষ্যতে সুদের হার বৃদ্ধি পাবে আশায়, স্বল্প মেয়াদী ফটকা শেয়ার কারবারীদের ঋণ দিতে এগিয়ে আসে; ফলে শেয়ার-বাজার আরও গরম হয়। এ সময়ে শেয়ার-বাজারে স্থিতিশীলতা বহাল করার লক্ষ্যে সরকার হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয় এবং সুদের হার ও মার্জিনের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলে শেয়ারের বাজার কমে যাওয়ার আশংকাঙ ফটাকা কারবারীরা দ্রুত তাদের শেয়ার বিক্রি করতে এগিয়ে আসে। বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বেড়ে যায় এবং আশংকা ছড়িয়ে যাওয়ার দরুন শেয়ার-বাজারে হঠাৎ করে বিপর্যয় দেখা দেয়। রাতারাতি শেয়ারের দাম পড়ে যায়, যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া গোটা অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিক করে।
শেয়ার-বাজারে এরূপ বিপর্যয়ের ফলে মুষ্টিমেয় কতিপয় বড় বড় ফটকা কারবারী রাতারাতি বিপুল মুনাফা করে নেয়। অপরদিকে অসংখ্য ছোট ছোট এবং নতুন কারবারী তাদের সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসতে বাধ্য হয়। যারা ভিতরের লোক (Insiders) বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পূর্বাহ্নে খবরাখবর (Ihsiders’ Knwledge) পাওয়ার সুযোগ যাদের আছে, সে কারবারীরা সকল সুবিধা লুটে নিতে পারে। কিন্তু যারা ছোট এবং যারা নতুন, পূর্বাভাস পাওয়ার সুবিধা যাদের নেই, যারা কবল গুজব এবং ঝোঁক-প্রবণতার দ্বারা তাড়িত হয়ে বেচাকেনা করে, তারাই মার খায়। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্টে পরিচালিত রকওয়েল স্টাডিতেও অনুরূপ মন্তব্য করে দেখানো হয়েছে যে, “বড় ফটকাবাজরা ক্রমাগতভাবেই জয়ী হয়; আর ছোট কারবারীদের ধ্বংসের বিনিময়েই বড়বা তাদের মুনাফা লাভ করে থাকে”। [আর, টি, টিওয়েলস, সি, ভি, হ্যারলো এন্ড এইচ, এল, স্টোন: দি কমোডিটি ফিউচার্স গেইম, ১৯৬৫, পৃঃ ২৯৯ ও ৩০২।] ‘ব্লেয়ার স্টাডিতেও অনুরূপ মন্তব্য করে দেখানো হয়েছে যে, শেয়ার-বাজারে শতকরা ৭৫ ভাগ ফটকাবাজই লোকসান দিতে হয়। [উপরোক্ত, পৃঃ ২৯৬।]
শেয়ার-বাজারে ভবিষ্যতে দাম বাড়ার সম্ভাবনা থাকলে বিপুল পরিমাণ শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে শেয়ারের দামকে অধিকতর ফাপিয়েঁ তোলা হয়; অপরদিকে ভবিষ্যতে দাম কমে যাওয়ার আশংকা থাকলে বিপুল সংখ্যক শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে দামকে আরও নামিয়ে দিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়। আসলে ফটকা কারবারীর ফলেই এরূপ ঘটে। আন্দাজ-অনুমান এবং গুজন হচ্ছে ফটকা কারবারের প্রধান হাতিয়ার। কখনও কখনও ভিতরের লোক এবং স্বার্থন্বেষী মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজব ছড়িয়ে দেয়, যার ওপর ভিত্তি করে বাজারে এক একটি ঢেউ উঠে, আর সকলে ধাবিত হয় সে ঢেউয়ের পেছনে। তাছাড়া, ছল-চাতুরী এবং কারচুপিও শেয়ার-বাজারে বিরাট ভূমিকা পালন করে। এ ব্যাপারে আমেরিকার স্টক এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে মার্চন্ড সেজ-এর বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, “Intrigues, lethal competition, tense lunch-time deals, high stake gambles, the subterfuges, cover-ups, and huge payoffs that make Wall Street the greatest playground in the world. [মার্চেন্ড সেজ: স্ট্রীট ফাইটিং এট ওয়াল এন্ড ব্রডঃ এন ইনসাইডার্স টেইল অব স্টক মেনিপুলেশন, ১৯৮০।] “গোপন ষড়যন্ত্র গলা কাটা প্রতিযোগিতা, মধ্যাহ্ন ভোজকালে তীব্র উত্তেজনাকর লেনদেন, হার-জিতের মারত্মক ঝুকিঁ বহুল বাজি-জুয়া, এড়িয়ে যাবার কৌশল, ছল-চাতুরী, অতি মাত্রায় প্রতিশোধ স্পৃহা এবং বিপুল দেনা পরিশোধ এসব মিলে ওয়ালস্ট্রীটকে বিশ্বের বৃহত্তম লীলা মঞ্চে পরিণত করেছে”। এলান লেকনার ও সম্পর্কে লিখেছেন, “”There are, “Safeguards against such rigging but they don’t work”, because, ” Wall Street plays its games seriously, sometimes so well that neither you nor I-nor, seemingly, the Securities Exchange Commission-knows who is in there playing. [এলান লেকনার, স্ট্রীট গেইমসঃ ইনসাইড স্টোরিজ অব দি ওয়াল স্ট্রীট হাস্টল, পৃঃ ১০৪ ও ৮৪।] “এ কারচুপির বিরুদ্ধে প্রতিকার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু বাস্তবে সেগুলো সবই অচল। কারণ, ওয়ালস্ট্রীট তার খেলা গুরুতরাভাবেই খেলে, কখনও কখনও এত চাতুর্যের সাথে খেলে যে আমি, তুমি এবং আপাতদৃষ্টিতে যতদূর মানে হয়, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনও জানে না এই খেলা কে খেলছে”।
বর্তমান সুদী বিশ্বে ফটকাবাজারীর দরুন সৃষ্ট শেয়ার-বাজারের অস্থিরতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে রয়েছে। শেয়ার-বাজারে বিপর্যয় ঘটেছে বারবার। তবে এই বিপর্যয় সবচেয়ে বেশি মারাত্মক ও ব্যাপক রূপ নেয় একবার ১৯২৯ সালের ২৮ শে অক্টোবর এবং আর একবার ১৯৮৭ সালের অক্টোরব। ঘটনাক্রমে ২৮ অক্টোবর, ১৯২৯ সাল দিনটি ছিল সোমবার এবং ১৯ শে অক্টোবর, ৯৮৭ সালও ছিল সোমবার। মূলধন বাজারে এ দুটো দিনই ‘কালো সোমবার’ (Black Monday) হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
শেয়ার-বাজারে প্রথম ঐতিহাসিক ধস নামে ১৯২৯ সালের অক্টোবর। সেদিন নিউইয়র্কের বাজারে শেয়ারের মূল্য হ্রাস পায় শতকরা ১২ ভাগ। এ সময়ে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী মহামন্দা ও দুর্ভিক্ষের চিত্র আজও বিশ্ববারসীর কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে আছে। অতঃপর ১৯৮৭ সালের কালো সোমবারে নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রীটে শেয়ারের মূল্য এক লাফে নেমে যায় ২২.৬ শতাংশ। টোকিওর বাজারে শেয়ারের দাম হ্রাস পায় ২৫ শতাংশ। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী, অস্ট্রেলিয়া, সর্বত্রই সেদিন শেয়ার-বাজারে বিপর্যয় দেখা দেয় এবং বিশ্বব্যাপী মারাত্মক অর্থ সংকটে রূপ নেয়। ১৯ ও ২০ শে অক্টোবর, দুদিনে ওয়াল স্ট্রীটে সর্বকালীন রেকর্ড ভঙ্গ করে ২৩০ লাখ শেয়ার বিক্রয় করা হয়। এতে ওয়াল স্ট্রীটের শেয়ার কারবারীদের লোকসান হয় কোটি কোটি ডলার। কথিত আছে, একজন শেয়ার বিনিয়োগকারী তার বিপুল অংকের লোকসানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে প্রথমে তার দালালকে গুলী করে হত্যা করে এবং পরে নিজেও আত্মহত্যা করে। লন্ডনে এই দু’দিনে বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় আট হাজার কোটি ডলার। ফলে জনগণ কাগুজে টাকার ওপর আস্থা হারিয়ে সোনা আঁকড়ে ধরতে সচেষ্ট হয়।
বর্তমান বিশ্ব ছোট হয়ে এসেছে। আজকের দিনে নিউইয়র্ক বা লন্ডনের বাজারে কিছু ঘটলে অতি অল্প সময়েই তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াল স্ট্রীটের বাজারে ৮৭ তে যে ধস নামে, বিশ্বের প্রায় সকল দেশের অর্থনীতিতেই তার আঘাত লেগেছে। অনেক দেশ এখনও সেই মহামন্দার ধকল কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি।
১৯৮৭ সালের সেই কালো সোমবারের বিপর্যয়ের পর বিদেশের বাজারে মার্কিন পণ্যের দাম কমে যেতে থাকে। এর ফলে বিদেশের বাজার ঠিক রাখা এবং নতুন নতুন দেশে পণ্য বিক্রি করার জন্য মার্কিনী পণ্যের দাম কমিয়ে দিতে হয়। এ জন্য আবার উৎপাদন ব্যয় কমানোন প্রয়োজন হয়, যার ফলে শ্রমিক ছাঁটাই ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং ডিভিডেন্ডের হার কমানোর প্রয়োজন দেখা দেয়।
শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ায় বড় বকমের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় শিল্প কারখানায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনের ঝুকিঁর তুলনায় শেয়ার-বাজারে সস্তায় শেয়ার কেনা যায় বিধায় এসময়ে নতুন বিনিয়োগ কমে যায় এবয জাতীয় প্রবৃদ্ধির হারও কম হয়।
শেয়ার-বাজারে ধস নামার কারণ ব্যাখ্যা করে অর্থনীতিবিদগণ উচ্চ সুদের হারকে দায়ী করেছেন। ম্যাসাচুসেটন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজীর ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতির অধ্যাপক লেস্টার সি থারোর মতে, শেয়ার-বাজারে ধস নামার প্রধান কারণ চড়া সুদের হার। ১৯৮৭ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আমেরিকায় সুদের হার প্রায় ১০ ভাগ চড়ে যায়। ফলে ১০ ডলারের বন্ডে যেখানে আয় হয় এক ডলার, সেখানে ২০ ডলারের শেয়ারের লভ্যাংশ পাওয়া যায় এক ডলারের বেশি নয়। তাছাড়া শেয়ারে লভ্যাংশ পাওয়া যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, বরং লোকসানের ঝুকিঁ রয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীদের সুদ-প্রীতি মনোভাবেব দরুন শেয়ার-বাজারে ভূকম্পন শুরু হয়।
সুদ প্রথা বিলোপ করা হলে শেয়ার-বাজারে ফটকা অবশ্যই কমে আসবে এবং প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা পাবে। সুদের অনুপস্থিতিতে ব্যাংক এবং ঋণদান প্রতিষ্ঠানকে কারবারে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান যখন দেখবে যে, ফটকা কারবারে অর্থ খাটালে লাভ তো দূরের কথা আসলও খোয়া যেতে পারে, তখন এরা শেয়ার জামানত রেখে ঋণ দিতে অধিকতার সতর্কতা অবলম্বন করবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ফটকা কারবারে বিনিয়োগের জন্য ঋণের পরিমাণ কমে যাবে। ফলে মার্জিনের ভিত্তিতে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ও হ্রাস পাবে এবং ফটকা কারবার নিম্ন পর্যায়ে নেমে আসবে। এ ব্যাপারে লারগে মন্তব্য করেছেন, “The empirical results support the priori hypothesis that banning the use of credit for transactions in individual issues is associated with a cooling off of speculative activity in these stocks.” [চাপরা, এম, উমর: পূর্বোক্ত, পৃঃ ৯৮।] “গবেষণামূলক তথ্য একথাই (priori hypothesis) প্রমাণ করে যে স্টক ক্রয়-বিক্রয়ে ঋণের ব্যবহার বন্ধ করার সাথে স্টক বাজারে ফটকাবাজি স্তিমিত হয়ে আসা ধনাত্মক সম্পর্কে বাধা রয়েছে”।
৫. সুদ পণ্য বাজারে ফটকা কারাবারকে প্ররোচিত করে
সুদের হারের অস্থিরতা শেয়ার-বাজারে যে ফটকা কারাবরের সৃষ্টি করে, তার প্রতিক্রিয়া পণ্য-বাজারকেও প্রভাবিত করে। সুদের হার কমলে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ দীর্ঘ মেয়াদী উৎপাদনশীল বিনিয়োগের জন্য ঋণ দেওয়ার পরিবর্তে স্বল্প মেয়াদী ফটকা কারবারের জন্য ঋণ দেয়। আর ফটকাবাজারীরা কম সুদরে হারে ঋণ নিয়ে একদিকে বেশি করে শেয়ার ক্রয় করে, অন্যদিকে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে মওজুদ করে রাখে। বাজারে দ্রব্য-পণ্যের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি হয় এবং পণ্যের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়। সেই সাথে আর্থিক কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের ফলে সুদের হার আবার বাড়ানো হয়। এতে দ্রব্যমূল্য আরও এক ধাপ চড়ে যায়। ফটকা কারবারীরা এই সুযোগের অপেক্ষায়ই থাকে এবং সুযোগ আসার সাথে সাথে তাদের মওজুদকৃত পণ্য উচ্চতর মূল্যে বিক্রয় করে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়।
সুদ না থাকলে শেয়ার-বাজারে ফটকা কারবার নিম্নতম স্তরে নেমে আসবে এবং পণ্য-বাজারেও তার সুফল দেখা দেবে। তাছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে বিধায় বিনিয়োগ ক্ষেত্রে সুদী অর্থনীতির ন্যায় অনিশ্চয়াতা থাকবে না। উৎপাদনশীল বিনিয়োগের গতি সর্বদাই অব্যাহত থাকবে, পণ্যের উৎপাদন বাড়তে থাকবে এবং দ্রব্যমূল্য মোটামুটি স্থিতিশীল থাকবে।
৬. সুদের হার মুদ্রানীতিকে বিকল করে দেয়
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা আর্থিক কর্তৃপক্ষ দেশে প্রয়োজনীয় পরিমাণ মুদ্রা সরবরাহের মাধ্যমে অর্থের মূল্য স্থিতিশীল রাখা, দ্রব্যমূল্যকে জনগণের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে আনা এবং বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ বহাল করার লক্ষ্যে মুদ্রানীতি চালু করে থাকে। কিন্তু সুদ এই মুদ্রানীতির কার্যকারিতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুতঃ সুদের হারের বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন মুদ্রার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করার প্রয়াস পায় এবং ব্যাংক হার (Bank Rate) বা বিধিবদ্ধ জমার হার(Statutory Reserve Ratio) বাড়িয়ে দেয়, তখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের সুদের হার বৃদ্ধি করে। ফলে দেশে বিনিয়োগ হ্রাস পায় এবং দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে সুদের হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সুদের হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে যায়, তাহলে ফটকামূলক কারবারে ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি পেয় মুদ্রাস্ফীতিকে ফাপিয়েঁ তোলে; দ্রব্যসামগ্রীর দাম না হওয়ায় দ্রব্যমূল্য আরও বৃদ্ধি পায়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাক সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে মুদ্রার পরিামণের ওপর এর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ড. উমর চাপরা তাই যথার্থই লিখেছেন, “The central bank can either control the rates of interest or the stock of money….. Experience has indicated that it is impossible to regulate both in such a balanced manner that inflation is checked without hurting investment”. [চাপরা, এম, উমর; পূর্বোক্ত, পৃঃ ১২০।] “কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেবল সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে অথবা কেবল মুদ্রার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে……। অভিজ্ঞতা বলে যে, একই সাথে সুদের হার ও মুদ্রার পরিমাণ এমন ভারসাম্যপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব যাতে বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ছাড়াই মুদ্রাস্ফীতি সংযত থাকবে”। তাছাড়া সুদের হার হ্রাস-বৃদ্ধি করে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের এ পদ্ধতির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও রয়েছে যা অর্থনীতিকে বাণিজ্য চক্রের উত্থাল-পাথালের মধ্যে খাবি খাওয়াতে থাকে। এ প্রসঙ্গে মাইকেল রোবোথাম বলেছেন, বস্তুতঃ এই পদ্ধতি হচ্ছে আর্থিক ব্যবস্থাপনার একটি কৌশল, একটি সিদ্ধান্তের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু এই পদ্ধতিতে নতুন ঋণ ঠেকানোর লক্ষ্যে সুদের হার বাড়ানো হলে পূর্বের ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি ও কারবারের ওপর আকস্মিক আঘাত এসে পড়ে, তাদের পূর্বের ঋণের ওপর অধিক হারে সুদ প্রদানে বাধ্য হতে হয়। এটি একটি বড় অবিচার ও জুলুম; কিন্তু সে অনুভূতি আজ হারিয়ে গেছে; ধর্মীয় প্রত্যয়ের মত এই আদর্শের চার পাশে পরিব্যাপ্ত কট্টর বিশ্বাসের মধ্যে তা বিলীন হয়ে গছে।……….
ব্যাংক, মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের এ পদ্ধতি নিশ্চয়ই কাজ করে। তবে তা সেইভাবে কাজ করে যে ভাবে মুরগীর রোস্ট কাটার ক্ষেত্রে একটা স্লেজ হাতুড়ি (Sledge Hammer) কাজ করে।….. নির্বিচারে গোটা অর্থনীতিকে ফাদেঁ বন্দী করা, অতঃপর একে মুগুর পেটা করা ব্যতীত আধুনিক অর্থনীতি আর কিছুই করতে পারে না”। [মাইকেল রেবোথাম: প্রাগুক্ত, পৃ: ২৭-২৮; উদ্ধৃত, তকি উসমানী, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৮৯।]
৭. সুদ বিনিশময় হারকে অস্থির করে তোলে
সুদের হারে ঘনঘন উঠা-নামা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের সকল প্রচষ্টাকে নিষ্ফল করে দেয়। যদি ফিক্সড প্যারিটি পদ্ধতিতে বিনিময় হার নিধারণ করা হয়, তাহলে সুদের হার বড়লে বর্ধিত সুদ পাবার আশায় বিদেশ থেকে গরম অর্থ (Hot Money) দেশে প্রবেশ করে। অপরদিকে সুদের হার কমলে দেশের অর্থ বাইরে চলে যায়। এমতাবস্থায় নির্ধারিত বিনিময় হার ঠিক রাখতে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য লোকসান দিতে হয়। ফলে নির্ধারিত বিনিমেয় হার বহাল রাখা সম্ভব হয় না। [চাপরা, এম, উমর: প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২০।]
অপরদিকে বিনিময় হার যদি পরিবর্তনশীল (floating rate) হয়, তাহলে মুদ্রার চাহিদা ও যোগানের সমতার ভিত্তিতে বাজারে বিনিময় হার নির্ধারিত হয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদের হারের উঠা-নামা এবং ফটকা কারবারের প্রভাবে উক্ত হার প্রতিনিয়তই উঠা-নামা করতে থাকে। দেশের অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থার সাথে এ হারের সংগতি থাকে না।
এই অবস্থায় ভবিষ্যত বিনিময় হার সম্পর্কে ধারণা করা দুরূহ হয়ে উঠে এবং দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ ও উৎপাদন পরিকল্পনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনীতির যে সব খাতে প্রতিযোগিতা খুব তীব্র এবং মুনাফার হার কম, সেসব খঅতে এর প্রতিক্রিয়া হয় অধিকতর বিরূপ। এছাড়া মন্দায় (Depression) নিপতিত দেশের জন্য অবস্থা আরও মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। মন্দা কাটিয়ে উঠা এবং অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য যদি সুদের হার কমানো হয়, তাহলে দেশের অর্থ অধিক সুদ পাবার লোভে বাইরে চলে যায়, দেশীঁ মুদ্রার মান হ্রাস পায় এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। পরিস্থিতি এতই নাজুক হয়ে পড়ে যে, সুদের হার না বাড়ালে অর্থের বহির্গমন ঠেকানো ও মুদ্রার মান বহাল রাখা যায় না; অন্যদিকে সুদের হার না কমালে বিনিয়োগ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গতি ফিরে আসে না, মন্দা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয় না। এই দুই বিপরীতধর্মী সমস্যার মুকারবিলায় সরকারকে প্রথমে মুদ্রার মান বহাল রাখার দিকেই নজন দিতে হয় এবং সুদের হার উর্ধে রাখতে হয়। এই পদক্ষেপ মন্দা থেকে উত্তরণের গতিকে মন্হর করে দেয় এবং মন্দাকে দীর্ঘায়িত করে। জনগণ সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। বস্তুতঃ সুদের হারের উঠা-নামা বিনিময় হারে অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিবেশকে অধিকতর অনিশ্চিত করে তোলে; বিনিয়োগ, উৎপাদন ও পুজিঁ গঠকে নিরুৎসাহিত করে এবং সম্পদের বরাদ্দ ও বন্টনকে অন্যায় ও বৈষম্যমূলক পথে পরিচালিত করে। [উপরোক্ত, পৃঃ ১২১।]
৮. সুদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে
সুদী অর্থনীতিতে উদ্যোক্তাকে, কারবারে লাভ বা লোকসান যাই হোক, প্রথমে সুদ পরিশোধ করতেই হয়। এরপর আবার যদি সুদের হার পরিবর্তনশীল হয়, তাহলে সুদের হার বেড়ে গেলে তাকে আরও অধিখ সুদ দিতে হয়। সুতরাং সুদের হার পরিবর্তনশীল হলে উদ্যোক্তাকে দুধরনের ঝুকিঁ সামনে রেখে সিদ্ধান্ত করতে হয়। প্রথমত, সে যে পণ্য উৎপাদন করবে সে পণ্যের বাঞ্ছিত দাম বাজারে থাকবে কিনা। দ্বিতীয়ত, সুদের হার বেড়ে গিয়ে তার মুনাফা কমিয়ে দেবে কিনা। বস্তুতঃ সুদের হার বৃদ্ধি হলেই উদ্যোক্তার প্রাপ্য মুনাফা হ্রাস পায়: অভ্যন্তরীণ নগদ অর্থের প্রবাহ (Internal cash flow) কমে যায় এবং তারল্য ঘাটতি দেখা দেয়। উদ্যোক্তাকে অধিক সুদের হারে ঋণ গ্রহণে বাধ্য হতে হয়। অধিক হারে সুদ প্রদান মুনাফাকে আরও সংকুচিত ও নিঃশেষ করে দেয় এবং ক্রমে কারবার দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এই অবস্থা দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগের পরিবেশেকে দূষিত করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিকে রুদ্ধ করে দেয়।
সুদের হার কমে গেলেও অবস্থা উন্নতির দিকে যায় না, বরং তা ভিন্নতর পদ্ধতিতে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সুদের হার কমলে সঞ্চঢকারীগণ বঞ্চিত হয়, ভোগ্য ব্যয় উৎসাহিত হয়, ফটকাবাজারী বৃদ্ধি পায় এবং অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগ বেড়ে যায়। স্বল্প সুদের হার অকল্যাণকর খাতে ঋণ সম্প্রসারণ ঘটিয়ে মুদ্রাস্ফীতিকে ফাপিয়েঁ তোলে এবং দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে।
সুতরাং উদ্যোক্ত, পুজিঁপতি, সঞ্চয়কারী এবং ভোক্তা সকলের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা এবং প্রবৃদ্ধির গতিকে এগিয়ে নেওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে সুদ বিলোপ এবং লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্ব ব্যবস্থা চালু করা।[উপরোক্ত, পৃঃ ১২৪।]
সুদের অর্থনৈতিক কুফল আলোচনায় একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, সুদ পুজিঁবাদী,শোষন, বৈষম্য ও জুলুমের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। সুদ অর্থনৈতিক গতিকে শ্লথ করে দেয়, বন্টনে বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং ফটকা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। সুদের হার শূন্য না হওয়া পর্যন্ত এসব কুফল থেকে পরিত্রাণের আর কোন উপায় নেই।
ঘ) ভোগের ওপর সুদের প্রভাব
১. সুদ ভোক্তাদের অভাব অপূর্ণ রাখতে বাধ্য করে
পূর্বেই বলা হয়েছে, দ্রব্যমূল্যের আকারে সুদ আসলে ভোক্তা জনগণের নিকট থেকেই আদায় করা হয়। ফলে ভোক্তাদের ক্রয়-ক্ষমতা ক্রমে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যায়। ক্রয়-ক্ষমতার অভাবে জনগণ অতি প্রয়োজনীয় অভাবও অপূর্ণ রাখতে বাধ্য হয়। অর্থনীতিতে এ কথাটি এভাবে বলা হয়েছে যে, ‘শর্টের তীব্র প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় ক্রয়-ক্ষমতার অভাবে শার্ট ক্রয় করে পিঠ আবৃত করা সম্ভব হয় না।
২. সুদ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে জনজীবন দুর্বিষহ করে তোলে
পূর্বেই বলা হয়েছে, অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ সুদ। বস্তুতঃ বহুগুণ ঋণ সৃষ্টির ক্ষমতা বলে ৯০ ভাগ মুদ্রাস্ফীতি ব্যাংকগুলোই সৃষ্টি করছে। ফলে একদিকে ক্রয়-ক্ষমতার অভাব ও ব্যাপক বেকারত্ব অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী অবস্থান এসব মিলে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।
৩. সুদ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করার সুযোগ করে দেয়
সুদী ব্যবস্থায় সুদ প্রদানে রাজি হলেই ঋণ পাওয়া যায়। বর্তমান যুগে সুদী ঋণপ্রাপ্তিকে আরও সহজ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র, ক্রেডিট কার্ড, ই-কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদির মাধ্যমে ঋণকে প্রত্যেক ভোক্তার হাতের মুঠোয় পৌছেঁ দেওয়া হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ আয় বুঝে ব্যয় করার নীতি বাক্য ভূলে গেছে এবং প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঋণ নিয়ে আয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ব্যয় করার দিকে ঝুকেঁ পড়ছে।
৪. সুদ অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসিতামূলক ব্যয় বাড়িয়ে দেয়
একদিকে সহজলভ্য ঋণ অন্যদিকে নানারূপ আকর্ষণীয় ও উত্তেজনাকর বিজ্ঞাপন জনসাধারণকে কেবল বাহুল্য ব্যয় নয় বরং নৈতিকতা পরিপন্হী ব্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
৫. সুদ ভোক্তাদেরকে ঋণের জালে আবদ্ধ করে
উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে সাধারণ মানুষ ক্রমে সুদ ও ঋণের জালে আষ্টেপৃষ্ঠ আবদ্ধহয়ে পড়ছে। বস্তুতঃ সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণকারী ভোক্তা জনসাধারণ দুইভাবে সুদ প্রদানে বাধ্য হচ্ছে। একবার তাদেরকে গৃহীত ঋণের ওপর ধার্যকৃত সুদ পরিশোধ করতে হয়, আবার সেই ঋণের অর্থ দ্বারা ক্রীত পণ্য-সামগ্রীর দামের সাথে সুদ প্রদান করতে হয়। ফলে একদিকে ঋণের অর্থ পুরোপুরি ভোগ করা তাদের ভাগ্যে জুটছে না; অপরদিকে, ঋণের বোঝা ক্রমেই বড় হচ্ছে। এ ঋণের জাল থেকে বেরিয়ে আসা আর কখনই সম্ভব হয় না।