সুদ সমাজ অর্থনীতি
অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন
ইসলামীক ইকোনমিক্স রিসার্চ বুরো
প্রধম সংস্করণ
ভুমিকা
অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন রচিত “সুদ সমাজ অর্থনীতি” বইটির পাণ্ডুলিপি পড়লাম। আমার মতে, আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুদের ওপর এত বিস্তারিত আলোচনা বিশেষ করে বাংলা ভাষায় এটিই প্রথম। সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই বইটিতে সুদের বৈশিষ্ট্য থেকে শুরু করে এর নৈতিক ও সামজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ যুক্তিসহ চমৎকরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পুঁজি গঠন, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের গতিকে শ্লথ করে দিয়ে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের হাতিয়ার হয়ে এই সুদ সমাজের ভিতরে ও বাইরে কিভাবে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা আনয়ন করে তার একটি অনবদ্য চিত্র ফুটে উঠেছে এই বইতে।
আসলে এর বিপরীত কোন ফলাফল আশা করাটাই ছিল অবাস্তব। কেননা ১৪ শত বছর পূর্বেই আল-কুরআনে (রিবা) সম্পূর্ণভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। বইটির আলোচনা থেকে দুটো জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠেছেঃ (ক) উক্ত (নির্দেশ) শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্যই প্রযোজ্য এটা মনে করা সংকীর্ণ মনের পরিচায়ক হবে এবং (খ) সুদের কু-প্রভাব থেকে সমাজ তথা দেশকে মুক্ত করার জন্য কেবলমাত্র অর্থনীতিবিদরাই দায়িত্ব বহন করবেন তাও হবে অযৌক্তিক। রিবামুক্ত অর্থনীতি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের পূর্বশর্ত, এই সত্যটি আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যত তাড়াতাড়ি খোলা মন নিয়ে উপলব্ধি করতে পারব ততই মঙ্গল।
তবে, সুদের আর্থ-সামাজিক কুফলসমূহ সকল সচেতন মহলের সামনে তুলে ধরা উল্লেখিত লক্ষ্য অর্জনের প্রাথমিক ধাপ মাত্র। এগিয়ে যেতে হবে আরও অনেক দূর। সুদের কার্যকরী বিকল্প (লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে কারবার) পদ্ধতি দক্ষতা, নিষ্ঠা, দৃঢ়তা এবং সর্বোপরি আন্তরিকতার সাথে চালু করতে হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেখানে যেখানে এই পদ্ধতি কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে সেখানকার গবেষণালব্ধ ফলাফল সকল সচেতন ব্যক্তির সামনে উপস্থাপন করতে হবে এবং এর ভিত্তিতে প্রায়োগিক গবেষণা চালাতে হবে।
বইটির বহুল প্রচারের মাধ্যমে এরূপ একটি পরিবেশ সৃষ্টি হোক এই কামনা করছি।
প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
ভাইস চ্যান্সেলর
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
কুষ্টিয়া
কুষ্টিয়া
মাঘ ২৬,১৩৯৮
শাবান, ০৪, ১৪১২
ফেব্রুয়ারী ০৯, ১৯৯২
প্রকাশকের কথা
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ইসলামিক ইকোনমিকস রিসার্চ ব্যুরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইনের ‘সুদ সমাজ আর্থনীতি’ নামক বইটি আমাদের প্রকাশনা তালিকায় এক অনন্য সংযোজন। বইটি সুদের ওপর বাংলা ভাষায় রচিত ব্যাপক চিন্তা, গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণার ফসল। ঈমান-আকিদা ও আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুদের অভিশাপ যে কত ভয়াবহ তা অত্যন্ত নিখুঁত ভাষায় বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্ট করা হয়েছে বইটিতে। আমরা আশা করি সম্মানিত পাঠকগণ এ বই থেকে সুদ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে জানতে পারবেন। আমাদের এ প্রকাশনাটি ছাত্র, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের উপকারে আসবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
অধ্যাপক শরীফ হুসাইনের এ মূল্যবান পুস্তকটি প্রকাশের জন্য ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন অর্থ যোগান দেয়ায় এর প্রকাশনা সম্ভবপর হলো। আমরা ব্যুরোর পক্ষ থেকে তাই ব্যাংক ফাউন্ডেশনকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ এ বই পাঠে উপকৃত হলে আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে বলে ধরে নেব। আল্লাহ পাক সকলের অবদান কবুল করুন। আমীন।
মীর কাসেম আলী
চেয়ারম্যান
ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ বুরো
ঢাকা।
ঢাকা
মাঘ ২৬, ১৩৯৮
শাবান ০৪, ১৪১২
ফেব্রুয়ারী ০৯, ১৯৯২
লেখকের কথা
সর্বপ্রথম পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করছি যে, তিনি সুদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ফলাফল সম্পর্কে সামান্য কিছু জানা এবং তা প্রকাশ করার তৌফিক দিয়েছেন।
বস্ত্ততঃ ইসলামের প্রভাবেই আরবের অসভ্য জাতি একদিন মানবতাকে অর্থনৈতিক মুক্তি ও উন্নয়নের পথ দেখিয়েছিল; গুরুর আসনে বসে তারা ইউরোপকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দানে সক্ষম হয়েছিল। ইসলাম-পরবর্তী আরবের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং স্পেন-করডোভার স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসই এর জ্বলন্ত সাক্ষী। কিন্তু শত শত বছরের রাজনৈতিক পরাধীনতা, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মুসলিম জাতিকে তার আদের্শ থেকে কেবল দূরে সরিয়েছে তাই নয়, বরং এই মহান আদর্শের সৌন্দর্যকেও বিস্মৃত করে দিয়েছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিকৃত ধারণা সৃষ্টি করতেও সক্ষম হয়েছে। পশ্চাত্যের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এর স্বার্থেই ইসলামী বিধি-বিধানের সত্যতা, কার্যকারিতা ও এর কল্যাণধর্মিতা সম্পর্কে নানা সংশয় ও প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে।
এমনি একটি বিষয় হচ্ছে সুদ। ইসলামী শরীয়তে হারাম ঘোষিত কাজের মধ্যে সুদ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা সবচেয়ে বেশী কঠোর। কিন্তু পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রভাবে সুদ আজ সারা দুনিয়ায় অর্থনীতিকে ছেয়ে ফেলেছে। পুঁজিবাদের প্রবক্তাগণ তাদেরেই স্বার্থে হারাম হওয়ার ব্যাপারে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে এবং এখনও করে চলেছে। এসব প্রশ্ন ও মন্তব্যের ধরন হচ্ছে নিম্নরূপঃ
-ইসলাম যে সুদ হারাম করেছে তা তৎকালে আরবে প্রচলিত সুদ; পরবর্তীকালের সুদ সেই নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্থ নয়;
-ইসলাম কেবল ভোগ্য ঋণের ওপর সুদের লেনদেনকে নিষিদ্ধ করেছে; উৎপাদনশীল ঋণের সুদকে ইসলাম হারাম করেনি;
-কুরআন মাজীদ শুধুমাত্র চক্রবৃদ্ধি হারের সুদকে হারাম করেছে, সরল সুদকে নয়;
-ইসলাম উচ্চ হারের (usury) সুদকে হারাম করেছে, নিম্ন হারের সুদকে (interst) হারাম করেনি;
-ইসলাম মহাজনী সুদকে হারাম করেছে, আধুনিককালের ব্যাংকে প্রচলিত সুদকে নিষিদ্ধ করেনি এবং
-আধুনিককালে সুদ ছাড়া অর্থনীতি চলতে পারে না ইত্যাদি।
আলহামদু লিল্লাহ, বিগত কয়েক দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিদেশী গোলামীর জিঞ্জির থেকে মুক্ত হবার পর মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী জাগরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মুসলিম গবেষকগণ ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যাপক গবেযণা পরিচালনা করেছেন। সুদ, যাকাত তথা ইসলামী অর্থনীতির ওপরও ব্যাপক গবেষণা চলছে। এসব মনীষীদের গবেষণায় দেখা যায়, ইসলাম কোন বিশেষে ধরনের সুদকে হারাম করেনি বরং সকল প্রকার সুদকেই নিষিদ্ধ করেছে; সুদের হার উচ্চ হোক না নিম্ন হোক, চক্রবৃদ্ধি সুদ হোক বা সরল সুদ হোক, ইসলামের সব সুদই হারাম। গবেষকগণ প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, তদানীন্তন আরবে কেবল ভোগ্য ঋণের সুদই চালু ছিল তা নয়, বরং বাণিজ্যিক ঋণ তথা উৎপাদনশীল ঋণের ওপরও সুদের প্রচলন ছিল। বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে নবী (সাঃ) সুদকে হারাম ঘোষণার সাথে সাথে তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের পাওনা যাবতীয় সুদ ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। আব্বাসের (রাঃ) নিকট থেকে বনু সাকিফ গোত্র যে ঋন নিয়েছিল তা ভোগের জন্য নয়, বরং ব্যবসার উদ্দেশ্যেই নিয়েছিল। রাসূল (সাঃ) সে সুদকেও নিষিদ্ধ করেছেন।
গবেষকগণ এটাও প্রমাণ করেছেন যে, মাহজনী সুদী কারবার আর আধুনিক ব্যাংকের সুদী কারবারের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে কোন পার্থক্য নেই; বরং বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন মহাজনী সুদের তুলনায় আধুনিক ব্যাংকের সংগঠিত সুদ অনেক বেশি ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক।
সুদমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থা ও অর্থনীতি চলার জন্য ইসলাম যে পথ দেখিয়েছে, গবেষকগণ তারও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন।
ইসলামী চিন্তাবিদ. উলামায়ে কিরাম, ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও গবেষকগণ সুদ হারাম হবার করণ সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা ও গভীর অধ্যয়ন করেছেন। এরা সুদকে মানবতার জন্য একটি জঘন্য অভিশাপরূপে চিহ্নিত করেছেন। সম্প্রতি পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদগণও সুদের মারাত্মক ধ্বংসকারী ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করে শিউরে উঠেছেন। এ সব অর্থনীতিবিদ গবেষকদের আলোচনায় সুদের যে মারাত্মক কুফলের উল্লেখ করা হয়েছে তারই একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা চেষ্টা করা হয়েছে এ ক্ষদ্র পুস্তকে। আলোচনার ভাষা যথাসম্ভব সহজ করার চেষ্টা করা হয়েছে যাতে সাধারণ পাঠকগণও এ থেকে উপকৃত হতে পারেন।
বইটি লেখার কাজ প্রথম হাতে নিই ১৯৮৮ সালের শেষ দিকে। বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক পৃথিবী’ ধারাবাহিক কটি সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশ করে। মাসিক পৃথিবীর অনেক পাঠক এবং সেন্টারের সম্মানিত ডাইরেক্টর অধ্যাপক এ. কে. এম. নাজির আহমদের পরামর্শে লেখাটি পুস্তকাকারে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ এর পরিচালকমণ্ডলীর সভাপতি এবং ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের সভাপতি কমডোর (অবঃ) আতাউর রহমান বইটির পণ্ডলিপি দেখেন এবং ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে অর্থ সাহায্য দিয়ে ইসলামিক ইকোনকিস রিসার্চ ব্যুরোকে বইটি প্রকাশের অনুরোধ করেন। ব্যুরো এ দায়িত্ব গ্রহণ করে। মাসিক পৃথিবীতে প্রকাশিত অংশে প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং আরও কিছু নতুন অংশ সংযোজন করে পুস্তকাকারে প্রকাশে বেশ বিলম্ব হয়ে গেল।
পুস্তকটি প্রণয়নকালে যাঁরা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে জনাব শাহ আব্দুল হান্নান, ড. সালাহউদ্দিন আহমদ, জনাব তাজুল ইসলাম ও জনাব এস, এম. আলী আক্কাসের নাম বিশেষভাবে উল্লখযোগ্য।
আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এম. এ. হামিদ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন এবং বইটির ভূমিকা লিখে এর মান বৃদ্ধি করেছেন।
জনাব হাসান রহমতী বইটির প্রুফ দেখার মত কঠিন কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। ব্যুরোর ডেপুটি ডাইরেক্টর জনাব ফেরদৌস কোরায়েশী বইটি ছাপার কাজে সহযোগিতা করেছেন এবং আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ এজন্য বেশ পরিশ্রম করেছেন।
মোটকথা, উল্লেখিত সকলের সহযোগিতা, পরামর্শ ও শ্রমের ফলেই পুস্তকটি সম্মানিত পাঠকবৃন্দের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হলে। এদের এ ঋণ শোধ করার সাধ্য আমার নেই। মেহেরবান আল্লাহ তাঁদের জাযা দান করুন এটাই কামনা করি।
বইটি প্রধানত অর্থনীতির অত্যন্ত জটিল বিষয় নিয়ে লেখা বিধায় এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া যথার্থ পরামর্শ ও সহযোগিতা বইটিকে আরও সুন্দর ও সুষমামণ্ডিত করতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ ব্যাপারে সুধী পাঠক, সম্মানিত উলামায়ে কিরাম, ইসলামী চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও গবেষকগণ তাদের মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে সাহয্য করলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলের এ শ্রমকে কবুল করুন এবং সুদের অভিশাপ থেকে মানবতাকে মুক্ত করুন-আমীন।
মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন
ঢাকা
তারিখ
বৈশাখ ১৫, ১৩৯৯
এপ্রিল ২৮, ১৯৯২
শাওয়াল ২৩, ১৪১২
দ্বিতীয় সংস্করণ
ভূমিকা
অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন তার প্রণীত ‘সুদ সমাজ অর্থনীতি’ পুস্তকে ক্রয়-বিক্রয় ও সুদ সম্পর্কে এ যাবত চলে আসা গতানুগতিক চিন্তাধারার ঊর্ধ্বে উঠে সুদের একক ও সমম্বিত সংজ্ঞা উদঘাটনের প্রয়াস পেয়েছেন। ক্রয়-বিক্রয় ও মুনাফা হালাল এবং সুদ হারাম হওয়ার কুরআন-সুন্নাহ সম্মত প্রকৃত কারণসহ ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রে কিভাবে সুদ উদ্ভূত হয় তার বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া সুদের আর্থ-সামাজিক ধ্বংসকর পরিণতির এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন। জনাব শরীফের চুলচেরা বিশ্লেষণ, অকাট্য যুক্তি এবং কুরআন-সুন্নাহ ও বাস্তবতার সাথে সংগতিশীল ব্যাখ্যা বইটিকে ক্রয়-বিক্রয় ও সুদ সংক্রান্ত বিপুল সাহিত্য ভাণ্ডারে এক চমৎকার সংযোজন করে তুলেছে সন্দেহ নেই; তাছাড়া ক্রয়-বিক্রয় ও সুদের ব্যাপারে বিভিন্ন ফিক্বহ, গবেষক ও চিন্তাবিদদের মধ্যে বিদ্যমান বহু মতপার্থক্য বিভ্রান্তির অবসানে বইটি বিশেষ সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
বস্তুতঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইনসাফ ও আদলের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা পরিচালনা জন্য তার প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মাধ্যমে যথার্থ দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। বহু শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামী ও মুসলিম রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তা অনুসৃত হয়েছে। কিন্তু কাল পরিক্রমায় নিছক মুনাফভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রসার ও আগ্রাসী তৎপরতা অর্থনীতির ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়, ইনসাফ-আদলের অনুভূতি এবং বৈধ-অবৈধের পার্থক্যকে বিলীন করে দিয়েছে। ফলে যেন-তেন প্রকারে অর্থ উপার্জনের স্পৃহা সামষ্টিক স্বার্থকে উপেক্ষা করে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে এবং পুঁজিবাদী শোষণ বঞ্চনার কাছে অর্থনৈতিক সুবিচার পরাভূত হয়। এই প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদের বাইবেল হিসেবে পরিচিত হারবার্ট স্পেন্সারের Social Darwinisn এবং অ্যাডাম স্মিথের The Wealth of Nation পুস্তকদ্বয় অর্থশাস্ত্রে পারস্পরিক স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মানবিক মুল্যবোধকে ছৃঁড়ে ফেলে দিতে সহায়তা করে। পুঁজিবাদের আদলে অনুসৃত নিছক ব্যক্তিস্বার্থ ও মুনাফা কেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থা বিশ্ব-অর্থনীতিতে একাধিকবার সর্বগ্রাসী মন্দার সৃষ্টি করে প্রমাণ করেছে যে, এই ব্যবস্থাটি মানবতা-বান্ধব নয়। এই অবস্থায় ইসলামের ইনসাফভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন সময়ের দাবী। সুদ সমাজ অর্থনীতি পুস্তকটি এই দাবী পূরণে যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।
পুস্তকে শিল্প বাণিজ্য ও অর্থ খাতে পরিচালিত লেনদেনের ইসলামী পদ্ধতি, সুদের কারণ, সুদের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য এবং এর ধ্বংসকারিতা বিশদ ব্যাখ্যাসহ আলোচনা করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে ইসলামী অর্থনীতি চালু না থাকায় আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে যেমন এ সম্পর্কে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তেমনি বেশিরভাগ আলেম উলামার মধ্যেও এর যথার্থ চর্চা না থাকায় মুসলিম উম্মাহ কোথাও পুঁজিবাদ, আবার কোথাও সমাজবাদের গোলামী করতে বাধ্য হয়েছে। অধ্যাপক শরীফ হুসাইন তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে জ্ঞানের যে দ্বার উন্মোচন করেছেন তা নতুন চেতনার উন্মোষ ঘটাবে এবং এই গোলামী থেকে মুক্ত হতে আমাদের উজ্জীবিত করবে ইনশাআল্লাহ্। পুস্তকটি গবেষক, চিন্তাবিদ, আলেম-উলামা, ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, পরিকল্পনা বিশারদ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপকভাবে উপকৃত করবে বলে আমি মনে করি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। আমীন।
মানাজির আহসান
মহাপরিচালক
লেস্টার, ইউ.কে.
কার্তিক ১৭, ১৪১৯
নভেম্বর ০১, ২০১২
ইসলামিক ফাউন্ডেশন
জিলহজ্জ ১৫, ১৪৩৩
চেয়ারম্যানের কথা
‘সুদ সমাজ অর্থনীত’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে পেরে আমরা মহান আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করছি। ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরো ১৯৯২ সালে এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করে; পাঠক সমাজে বইটি বেশ সমাদৃত হয়। বিষয়ের গুরুত্ব ও চাহিদা বিবেচনা করে বেশ কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনীসহ দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হচ্ছে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন বইটিতে একদিকে কুরআন, সুন্নাহ ও সম্মানিত ফক্বীহদের মতামতের ভিত্তিতে সুদের প্রকৃত ও সমন্বিত সংজ্ঞা উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে সুদের ভয়াবহ অভিশাপ ও ধ্বংসকর পরিণতির চিত্র তুলে ধরেছেন্ বস্তুতঃ সুদের ওপর বাংলা ভাষায় রচিত এ পুস্তকটি গভীর চিন্তা, ব্যাপক অধ্যয়ন ও দীর্ঘ গবেষণার ফল।
লেখক, গবেঘক, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার এবং শিক্ষক-ছাত্রসহ পাঠকবৃন্দ বইটি দ্বারা সবিশেষ উপকৃত হবেন বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ প্রচেষ্টা কবুল করুন। আমীন।
শাহ্ আব্দুল হান্নান
চেয়ারম্যান
ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরো
ঢাকা: কার্তিক ১৭, ১২১৯
নভেম্বর ০১, ২০১২
জিলহজ্জ ১১, ১৪৩৩
প্রকাশকের কথা
একবিংশ শতাব্দীতে এসে সুদ সম্পর্কে মানুষকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। শুধু মুসলিম মনীষীগণই নন, অনেক অমুসলিম অর্থনীতিবিদও সুদের কুফল ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কেবল সচেতনিই নন, তাঁরা সুদ ভিত্তিক লেনদেন বাতিল করে এ বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন তাঁর লিখিত ‘সুদ সমাজ অর্থনীতি’ গ্রন্হে খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের গভীর অধ্যয়ন, ব্যাপক চিন্তা ও গবেষণার ফসল হিসেবে এ বিষয়ে এক অনবদ্য সমাধানের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
গ্রন্হটি ২৮ এপ্রিল ১৯৯২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। দ্রুত এর সকল কটি নিঃশেষ হয়ে যায়। এটি আলেমে দ্বীন, ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি পুনঃপ্রকাশের দাবী আসতে থাকে। লেখক এ বিষয়ে কৈফিয়ত দিয়েছেন। বিলম্বে হলেও বর্ধিত কলেবরে তত্ত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ হয়ে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার এ গন্হটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের এ প্রকাশনাটি ছাত্র, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, উদ্যোক্তা ও গবেষকদের উপকারে আসবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। পরিবর্ধিত এ গ্রন্হ উপহার দেয়ার জন্য লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুকরিয়া জানাই।
গ্রন্হটি প্রকাশিত হওয়াতে পরম করুনাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। তিনি আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ দান করুন। আমীন॥
ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
প্রকাশনা সেক্রেটারী
জিলহজ্জ ১৫, ১৪৩৩
ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরো
ঢাকা: কার্তিক ১৭, ১৪১৯
নভেম্বর ০১, ২০১২
মুখবন্ধ
বর্তমান বিশ্বে সুদ লেনদেন অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। সকল দেশেই আইন করে সুদকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে এবং আইন-আদালতের মাধ্যমে সুদ আদায় করে নেওয়ার জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করে নেওয়া হয়েছে। অপরদিকে, সুদের ভয়াবহ ধ্বংসকর প্রতিক্রিয়া সর্বত্র অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত ও লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। “বস্তুতঃ আজকের দুনিয়ায় সুদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া যত ব্যাপক ও প্রকট হয়ে উঠেছে, অতীতে কখনও তা হয়নি। পূর্বকালে সুদী ভোগ্য ঋণ লেনদের হতো ব্যক্তি পর্যায়ে, আর এর কুফল সীমিত থাকতো ঋণগ্রহীতা পর্যন্ত। কিন্তু আধুনিককালের সুদী ঋণব্যবস্থা যেমন ব্যাপক, এর কুফল, জুলুম ও বেইনসাফীও তেমনি বিস্তৃত। এ ঋণের কুফল ছড়িয়ে পড়ে গোটা অর্থনীতিতে, বিপর্যস্ত করে দেয় সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে”। [উসমানী, মুহাম্মদ তকি: সুদ নিষিদ্ধঃ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়; বাংলা অনুবাদ, অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরো, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ,২০০৮, পৃঃ ৬৭-৬৮]
সুদের ধ্বংসকর পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মানব জাতিকে বহু পূর্বেই সতর্ক করে দিয়েছেন। বলা হয়েছে, “আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করেন, আর সাদাকাহকে ক্রমবৃদ্ধি দান করেন”। (২:২৭৬) আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামও তাঁর বাণীতে সুদের পরিণতির কথা বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সুদ সমৃদ্ধি আনে কিন্তু সুদের আসল পরিণতি হলো অভাব ও সংকোচন (scarcity and contraction) (মুসনাদে আহমদ হাদীস নং ৩৭৫৪)। অপর এক হাদীসে তিনি বলেছেনে, “যিনা ও সুদ যে কোন জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়”। (মুসনাদে আহমদ)
বস্ততঃ দুনিয়াজুড়ে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হওয়ার পর থেকে কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত সুদের এই ধ্বংসকর পরিণতি মানুষ বাস্তবে প্রত্যক্ষ করেছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিবিদগণও সুদের ধ্বংসকর পরিণতি মানুষ বাস্তবে প্রত্যক্ষ করেছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিবিদগণও সুদের এই ধ্বংসকর পরিণতি দেখে আঁতকে উঠেছেন; তাঁরা সমস্বরে চিৎকার করছেন সুদের এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য।
লক্ষণীয় যে, সুদের একক ও সমন্বিত সংজ্ঞা পাওয়া কঠিন। তাফসীরকার, ফিক্বাহবিদ ও মুফাসসিরদের আলোচনায় দেখা যায় তাদের সকলেই আল-কুরআনে বর্ণিত রিবা ও আল-হাদীসে উল্লেখিত রিবাকে পৃথক পৃথক ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাছাড়া হাদীসে বর্ণিত রিবার আলোচনায় এমন জিনিসকে রিবার আওতাভুক্ত করা হয়েছে যার অস্তিত্ব আসলে কুরআন-সুন্নাহয় নেই। অপরদিকে, বহুল প্রচলিত যেসব সংজ্ঞা রিবার সংজ্ঞা হিসেবে চালু হয়ে আছে তার প্রায় সবগুলোই কেবল বাকি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে উদ্ভূত রিবাযার একমাত্র কার সংক্রান্ত; নগদ ক্রয়-বিক্রয়ে উদ্ভূত রিবা এর আওতায় আসেনি। তাদুপরি বিনিময়হীনতাই যে রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার একমাত্র কারণ এ কথাটি যেন সর্বত্র অস্পষ্টই থেকে গেছে। অবশ্য একথা ঠিক যে, বিভিন্ন মাযহাবের বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত ফক্বীহ রিবার প্রকৃত ও সমন্বিত সংজ্ঞাও দিয়েছেন। কিন্তু যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের অভাবে সে সংজ্ঞাগুলো যথার্থ মূল্যায়ন পায়নি।
এমতাবস্থায় সুদের সঠিক ও সমন্বিত সংজ্ঞা কি তা উদঘাটন এবং এর যথার্থ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত ক্রয়-বিক্রয় ও সুদ সংক্রান্ত হাদীস সমূহে ব্যবহৃত ‘মিসলান বিমিসলিন’- এর ভাষাগত স্বভাবিক অর্থ মানগত সমতাকে উপেক্ষা করে এর অর্থ করা হয়েছে পরিমাণগত সমতা; আর ‘ইয়াদান বিইয়াদিন’-এর অর্থ করা হয়েছে নগদ বিনিময়। ফলে একদিকে সমজাত অথচ ভিন্ন ভিন্ন মানের বস্তু ক্রয়-বিক্রয়ে বেইনসাফীর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে; অন্যদিকে সম ও অসম জাতের বস্তুর বাকি ক্রয়-বিক্রয় বিতর্কিত হয়ে পড়েছে এবং রিবা সম্পর্কে সৃষ্টি হয়েছে নানা জটিলতা ও বিভ্রান্তি। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে ত্রয়োদশ শতকে বৃটিশের তৈরী সুদ সংক্রান্ত আইন এবং এ প্রেক্ষিতে অভিধানে উল্লেখিত ইন্টারেস্ট ও ইউসারীর পৃথক পৃথক অর্থের আলোকে ব্যাংকের সুদকে বৈধ বলার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। এক-দুই জন আলেমকেও এতে সায় দিতে দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া ক্রয়-বিক্রয়, সুদ, মুনাফাও ভাড়ার পার্থক্য সম্পর্কে বিভ্রান্তিতো আছেই। শুধু যে সাধারণ এ বিভ্রান্তির শিকার তা নয় বরং গবেষক ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যেএ এ ধারণাসমূহ জটিল তত্ত্বে আবদ্ধ হয়ে আছে। সুতরাং ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া, মুনাফা হালাল এবং সুদ হারাম হওয়ার কারণও সুস্পষ্ট হওয়া দরকার, তেমনি ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া, মুনাফা হালাল এবং সুদ হারাম হওয়ার কারণও সুস্পষ্ট হওয়া দরকার।
সর্বোপরি সুদ দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়া, সুদের নানাবিধ ধ্বংসকর পরিণতি প্রত্যক্ষ করা এবং সুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠার পরও সুদ ছাড়া অর্থনীতি চলবে না- এই ভুল ধারণা প্রভাবশালী হয়ে আছে। এ অবস্থায় সুদের বিরূপ প্রতিক্রয়া সংক্রান্ত গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলোর সম্যক উপলব্ধি জরুরী।
উপরোক্ত বাস্তবতা সামনে রেখে এ লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে :
১. আল-কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সুদের সমন্বিত সংজ্ঞা উদঘাটন এবং এর যথার্থ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা;
২. ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া, মুনাফা ও সুদের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যের আলোকে ক্রয়-বিক্রয় হালাল ও সুদ হারাম হওয়ার যথার্থ কারণ তুলে ধরা;
৩. বাস্তবতা ও যুক্তির আলোকে সুদের ধ্বংসকর পরিণতির ওপর আলোকপাত করা।
উপরোক্ত লক্ষের প্রেক্ষিতে পুস্তকটিকে প্রধান দু’টি খণ্ডে সুদ ও ক্রয়-বিক্রয় এবং দ্বিতীয় খণ্ডে সুদের কুফল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
অতঃপর প্রথম খণ্ডকে ছয়টি অধ্যায়ে আল-কুরআনের সুদ শিরোনামে আল-কুরআনের চারটি সূরার মোট পনেরটি আয়াত সম্পর্কে আলোচনা করে দেখানো হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা সুদকে মূলতঃ বিনিময় না দিয়ে পরের সম্পদ খাওয়া, ভক্ষণ, গ্রাস বা আত্মসাৎ করার একটি বড় হাতিয়ার ও জুলুম হিসেবে তুলে ধরেছেন এবং প্রধানত এ কারণেই সুদকে নিষিদ্ধ করেছন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে সুন্নাহর দৃষ্টিতে সুদ শিরোনামে প্রথমে ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান সম্পর্কিত হাদীস এবং পরে সুদ উদ্ভূত হওয়ার কারণ সম্বলিত হাদীসগুলো সাজিয়ে পেশ করা হয়েছে। অপরাপর ধর্ম ও দার্শনিকদের দৃষ্টিতে সুদ শিরোনামে তৃতীয় অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে যে, বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সকল ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ, বড় বড় সকল দার্শনিকই সুদের নিন্দা করেছেন। চতুর্থ অধ্যায়ে ক্রয়-বিক্রয় ও মুনাফার সংজ্ঞা; ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান এবং ক্রয়-বিক্রয় ও মুনাফার গুরুত্ব এবং তা হালাল হওয়ার কারণ তুলে ধরা হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে জাহিলী যুগে প্রচলিত রিবা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার সাথে সাথে রিবার অর্থ, রিবার সমন্বিত সংজ্ঞা, শ্রেণীবিন্যাস ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিভিন্ন প্রকার ক্রয়-বিক্রয়ে সুদ উদ্ভূত হয় তা দেখানো হয়েছে।পরিশেষে এক নজরে ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া, মুনাফা ও সুদের তুলনার দ্বারা গ্রন্হের প্রথম খণ্ড শেষ করা হয়েছে।
বইটির দ্বিতীয় খণ্ডকে পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে ভূমিকায় সুদী কারবারের স্বরূপ, প্রথম অধ্যায়ে সুদের নৈতিক ও সামাজিক সুফল, দ্বিতীয় অধ্যায়ে অর্থনৈতিক কুফল, তৃতীয় অধ্যায়ে রাজনৈতিক কুফল, চতুর্থ অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক কুফল তুলে ধরা হয়েছে; আর পঞ্চম অধ্যায় উপসংহারে সুদের ধ্বংসের কিছু চিত্র পেশ করে বইটির সমাপ্তি টানা হয়েছে। পরিশিষ্টে সুদের সৃষ্ট ব্যাংকিং সংকট এবং অর্থনৈতিক সংকট ও মন্দার দু’টি তালিকা সংযোজন করা হয়েছে।
গ্রন্হটি লেখার ক্ষেত্রে প্রধানত বিশ্লেষণ পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সূত্র থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।
১৯৯২ সালে বইটির প্রথম প্রকাশের পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই সবগুলো কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। পাঠক সমাজের পক্ষ থেকে উপর্যুপরি দাবী সত্ত্বেও বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশে অস্বাভাবিক বিলম্ব হলো। এ ব্যাপারে কৈফিয়ত দেওয়া জরুরী। অতঃপর সহৃদয় পাঠকসমাজ বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করি।
বস্তুতঃ দীর্ঘকাল ধরে ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরোর কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা, ইসলামী ব্যাংকিং-এর সাথে সংশ্লিষ্টতা, ইসলামী ব্যাংকের জন্য জেনারেল ব্যাংকিং ম্যানুয়াল ও বিভিন্ন ব্যাংকের ম্যানুয়াল তৈরীতে ভূমিকা পালন এবং বিশেষ করে সুধী সমাোবশ ও বিভিন্ন ব্যাংকের ট্রেনিং প্রোগ্রামে সুদ, বিনিয়োগ-মুনাফা বিষয়ে বক্তৃতা করতে গিয়ে এসব বিষয়ে বহু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রশ্ন হচ্ছে, রিবা আসলে কোন্ বৃদ্ধিকে বলা হয়; আল-কুরআনের রিবা আর হাদীসের রিবা কি সত্যিই ভিন্ন ভিন্ন, আল-রিবার দ্বারা সকল রিবাকে বুঝানো হয়েছে নাকি বিশেষ কোন রিবাকে বুঝানো জন্য তা ব্যবহৃত হয়েছে, বহুল প্রচলিত সংজ্ঞাগুলো সুদের যথার্থ ও পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা কিনা, সুদ নিষিদ্ধ করার হেকমত (দর্শন) ও ইল্লাত (তাৎক্ষণিক কারণ) আসলে কি, এক মাযহাবের মতে যা সুদ অন্য মাযহাবের মতে তা সুদ নয়- একটি সুস্পষ্ট হারামের ব্যাপারে এরূপ হলো কেন, মানগত তারতম্য সত্ত্বেও সমজাতীয় দু’টি পণ্যের কেবল পরিমাণ সমান সমান করে বিনিময় করা হলে যে বেইনসাফী হয় তা কি সত্যিই বিবেচনার অযোগ্য, মুদ্রা (সরফ) ও পণ্যের বাকি ক্রয়-বিক্রয় কি সত্যিই নিষিদ্ধ, বাকির মেয়াদ কি আসলেই রিবা নাসা’ হাদীসে বর্ণিত মিসলান বিমিসলিন, ইয়াদান বিইয়াদিন, হা’য়া ওয়া হা’য়া, দাইনান, নাসীয়াহ পরিভাষাগুলোর প্রকৃত তাৎপর্য কি, রিববী ম্যাটেরিয়াল বলে কোন পণ্য আসলে আছে কি? আল্লাহ তা’য়ালা কুরআন মাজীদে ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে রিবার তুলনা করেছেন আর আমরা ব্যবসা ও মুনাফার সাথে সুদের তুলনা করি, এটা সঠিক কিনা, রিবা অর্থ বৃদ্ধি, মুনাফাও বৃদ্ধি—তাহলে রিবা হারাম, মুনাফা হালাল কেন, সর্বোপরি ক্রয়-বিক্রয় থেকে সুদ কিভাবে উদ্ভূত হয় ইত্যাদি। কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এবং অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বইটি বিশেষ করে, এর সুদ ও ক্রয়-বিক্রয় খণ্ডটি সম্পুর্ণ নতুন করে লিখতে হলো। আর বিলম্বের প্রধান কারণ এখানেই।
বইটি রচনায় যাঁরা সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন তাদেঁর মধ্যে প্রথমেই যাঁর নাম উল্লেখ করতে হয় তিনি হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড.আইয়ুবুর রহমান ভুঞা। অধ্যাপনা ও গবেষণা ক্ষেত্রে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, সংশোধন করেছেন, ধাপে ধাপে কাজ এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করেছেন এবং উৎসাহ যুগিয়েছেন। আর দ্বিতীয় যার নাম আসে তিনি হচ্ছেন ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরো’র সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা, বর্তমানে ব্যুরোর গবেষণা সেক্রেটারী জনাব জুনায়েদ মাশরুর খান। তিনি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে না দিলে গতানুগতিক ধারার ব্যতিক্রম এই পুস্তক লেখা সম্ভব হতো না; আল্লাহ তাঁদের জাযা দান করুন। তাঁর এবং অধ্যাপক ভুঞার ঋণ পরিশোধের ভার আল্লাহর ওপর ন্যস্ত না করে উপায় নেই। ব্যুরোর ত্রৈমাসিক জার্নাল থটস অন ইকোনমিক্স-এর সম্পাদক জনাব মো.নূরুল আমিন পাণ্ডলিপিটি আদ্যোপান্ত পড়েছেন, সংশোধন করেছেন এবং বেশ কিছু অংশ জার্নালে প্রকাশ করে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ্ কাউন্সিল- এর সদস্য মওলানা আব্দুস শহীদ নাসিম হাদীসগুলোর অনুবাদ ও সংযোজিত মন্তব্য দেখে দিয়ে একে ত্রুটিমুক্ত করতে সাহায্য করেছেন। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ্ বোর্ডের সদস্য মাওলানা আব্দুল হাকিম মাদানী বইতে উল্লেখিত হাদীস সমূহের নম্বর সংগ্রহ করে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনী দিয়ে এর নির্ভরযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর শরীয়াহ্ কাউন্সিলের সাবেক সদস্য সচিব প্রিন্সিপাল মওলানা মুহাম্মদ ছেরাজুল ইসলা, বর্তমান সদসল অধ্যাপক মওলানা ড. হাসান মঈন উদ্দীন, একই ব্যাংকের সাবেক এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট জনাব আব্দুর রকিব, শরীয়াহ কাউন্সিলির মুরাকিব মাওলানা শাসমুল হুদা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ্ বোর্ডের সদস্য সচিব মাওলানা আ. ন. ম. রশিদ আহমদ লিখিত মন্তব্য ও পরামর্শ দিয়ে উৎসাহিত করেছেন। দেশের প্রথিতযশা আলেম মুফতী সাঈদ আহমদ. অধ্যক্ষ মাওলানা সাইয়েদ কামালউদ্দীন জাফরী, মাওলানা আ. ন. ম. রফিকুর রহমান আল মাদানী, ড. মো. মানজুরে ইলাহী এবং অর্থনীতিবিদ ড. এস. এম. আলী আক্কাস, অধ্যাপক মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম, অথ্যাপক ড. কবির হাসান, জনাব এম. শফিউল্লাহ, জনাব আব্দুল আউয়াল সরকার, প্রখ্যাত ইসলামী ব্যাংকার জনাব এম. আযীযুল হক, জনাব মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম, জনাব নুরুল ইসলাম খলিফা, জনাব এ. টি. এম. সালেহ, ড. মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম প্রমুখ মুল্যবান মন্তব্য, পরামর্শ ও সংশোধনী দিয়ে বইটির মান বৃদ্ধি করেছেন। তাঁদের সকলের প্রতি রইলো আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। বইট প্রকাশের জন্য অনুমোদন করার লক্ষ্যে ব্যুরো কর্তৃক গঠিত কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ড. এস. এম. আলী আক্কাস তাঁর সীমাহীন ব্যস্ততার মধ্যেও প্রচুর সময় দিয়ে বইটির পাণ্ডলিপি দেখেছেন এবং কমিটিতে আলোচনা করে ব্যুরো কর্তৃক বইটির প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন। কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দ ও চেয়ারম্যানকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। সর্বোপরি ব্যুরোর সম্মানিত চেয়ারম্যান জনাব শাহ্ আব্দুল হান্নান পূর্ণাঙ্গ বইটি পড়ে পরামর্শ দিয়েছেন এবং ব্যুরো পক্ষ থেকে বইটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর পুরস্কার মহান আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত থাকবে আশা করি।
গ্রন্হটি টাইপ করা এবং বহুবার সংশোধন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করতে ব্যুরোর কম্পিউটার অপারেটর জনাব মো. সালাউদ্দিনকে প্রচুর শ্রম ব্যয় ও কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। তার সাথে ব্যুরোর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা জনাব মো. জাকির হোসেন ও ম্যাসেঞ্জার জনাব মোহম্মদ হোসেন বাবুলকেও বেশ খাটতে হয়েছে। দৈনিক সংগ্রামের প্রুফ বিভাগের জনাব হাসান রহমতী বইটর প্রুফ দেখেছেন এবং মেসার্স আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস বইট ছাপার দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহ এদের সকলের শ্রম কবুল করুন। দি ইসলামিক ফউন্ডেশন, ইউ. কে.- এর মহাপরিচালক ড. মানাজির আহসান দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা লিখে দিয়ে বইটিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় উন্নীত করেছেন এ জন্য তাঁকে জানচ্ছি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
পরিশেষে যিনি এই গন্হটি রচনার তৌফিক দিয়েছেন সেই মহাশক্তিধর ও রহমানুর রাহীম আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঘাপন করছি। আল্লাহ তাঁর অপার মেহেরবানী দ্বারা আমাদের সকলের এ ক্ষুদ্র প্রয়াসকে কবুল করুন এবং পরকালে নাজাতের ওসীলা বানিয়ে দিন। আমীন॥
মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন
ঢাকা
তারিখ :
কার্তিক ১৭, ১৪১৯
নভেম্বর ০১, ২০১২
জিলহজ্জ ১৫, ১৪৩৩