দ্বিতীয় অধ্যায়: সুদের অর্থনৈতিক কুফল
আজকের যুগে দুনিয়াব্যাপী প্রচলিত সুদ মাঝে মাঝেই বিভিন্ন স্থানে প্রচণ্ড আঘাত হেনে অর্থনীতকে বিকল ও লণ্ড-ভণ্ড করে দিচ্ছে। সঞ্চয় ও পুঁজি গঠন থেকে শুরু করে বিনিয়োগ, উৎপাদন, বাজার-বিনিময়-বরাদ্দ, বন্টন ও ভোগ তথা অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রেই সুদের কুফল অত্যন্ত ব্যাপক, ভয়াবহ ও মারাত্মক। নিচে উৎপাদন, বন্টন, ভোগ ও স্থিতিশীলতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হচ্ছে।
ক) উৎপাদন ক্ষেত্রে সুদের প্রভাব
উৎপাদন করতে হলে প্রয়োজন বিনিয়োগ, বিনিয়োগ করতে হলে দরকার মূলধন; আর মূলধন আসে সঞ্চয় থেকে। সুতরাং উৎপাদনের ওপর সুদের প্রভাব আলোচনা করতে হলে প্রথমে সঞ্চয় ও মূলধন গঠন এবং পরে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের ওপর সুদের প্রভাব আলোচনা করা দরকার।
১. সঞ্চয় ও মূলধন গঠনের ওপর
¡) সুদ সঞ্চয় ও মূলধন গঠনকে পিছিয়ে রাখে
ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ এড্যাম স্মিথ মনে করতেন, সুদের হার বেশি হলে সঞ্চয় ও পুঁজি গঠন বেশি হয়; অপরদিকে সুদের হার কমলে সঞ্চয় ও পুঁজি গঠন কম হয়। কিন্তু এ্যাডাম স্মিথের এ অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ “he has been proved a false prophet.”
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিগত দুই-আড়াই শতক ধরে সুদরে হার কমে যাওয়া সত্ত্বেও বিশ্বে সঞ্চয় বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে আমেরিকায় মাত্র ১% সুদের হারে সঞ্চয় এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, উচ্চতর সুদের হার থাকাকালে তা কখনও সম্ভব হয়নি।[ড. আনোয়ার ইকবাল কোরেশী, পূর্বোল্লেখিত, পৃ: ৩৭।]
অর্থনীতিবিদগণ দেখিয়েছেন যে, অনেক মানুষ সঞ্চয় করে, কিন্তু সেই সঞ্চিত অর্থ তারা সুদে খাটায় না। আবার সমাজে এমন লোক আছে যারা সুদে অর্থ খাটায় কিন্তু সে অর্থ তারা পূর্বপুরুষ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছে যার সাথে সুদের হারের সম্পর্ক নেই। এছাড়া, আধুনিক সমাজে পুঁজির এক বিরাট অংশ আসে ধনীদের সঞ্চয় থেকে, যা তাদের আর্থিক প্রাচুর্যের ফল; এর ওপর সুদের কোন প্রভাব নেই। তদুপরি করপোরেশন, ব্যাংক, বীমা কোম্পানী, সমবায় সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করে থাকে। কিন্তু এসব সঞ্চয়ের পরিমাণ সুদের হারের প্রভাবে নিরূপিত হয় না। সর্বোপরি মানুষ অধিক সুদ পাবার জন্য সঞ্চয় করে না; বরং তারা সঞ্চয় করে ভবিষ্যতের চিন্তায়, অজানা বিপদ-আপদ মুকাবিলার জন্য, সন্তান-সন্ততির শিক্ষাম বিয়ে-শাদী ইত্যাদি কারণে। সুদ না থাকলেও এসব কাণে মানুষ সঞ্চয় করবেই। অর্থনীতিবিদ প্যারেটো তাই বলেছেন, “সঞ্চয় সুদের হারের দ্বারা প্রভাবিত হয় না; বরং সুদের হারকে যদি শূন্যেও নামিয়ে আনা হয়, তাহলেও সঞ্চয়ের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।[গাইড এন্ড রিস্ট, এ হিস্টোরী অব ইকোনমিক ডকট্রিনস, পৃ: ৭৩২।]
নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ জে. এম. কীনস প্রমাণ পেয়েছেন সুদের হারের ওপর নয়, বরং সঞ্চয় নির্ভর করে আয়ের ওপর। আয় বাড়লে মানুষ সঞ্চয় বেশি করে; আর আয় কমলে সঞ্চয় কম করে। কীনস দেখিয়েছেন যে, কোন সমাজে কোন নির্দিষ্ট আয়ের প্রেক্ষিতে (আয় স্থির রেকে) সঞ্চয়কে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে যদি সুদের হার বাড়ানো হয়, তাহলে তা সঞ্চয়কে বাড়াতে তো দেয়ই না, বরং নানাভাবে সঞ্চয়কে আরও কমিয়ে দেয়।
প্রথমতঃ সুদের হার বেড়েছে, এজন্য বেশি সুদ পাওয়ার লোভে কেউ যদি পূর্বের চেয়ে বেশি সঞ্চয় করে, তাহলে তাকে ভোগের জন্য পূর্বের চেয়ে কম পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। ফলে পূর্বে বিক্রেতাগণ যে পরিমাণ পণ্য-সামগ্রী বিক্রয় করত এখন আর সে পরিমাণ বিক্রি হবে না; বরং উক্ত বর্ধিত সঞ্চয়ের মূল্যের সমপরিমাণ অবিক্রীত থেকে যাবে। সুতরাং বিক্রেতাদের আয় এবং সঞ্চয়ও সমপরিমাণে কমে যাবে। একজনে সঞ্চয় বৃদ্ধি করলে তা অন্য কারও আয় ও সঞ্চয় সমপরিমাণে কমিয়ে দেবে। সুতরাং মোট আয়ের পরমাণ স্থির থাকা অবস্থায় সুদের হার বাড়ালে কারও কারও ব্যক্তিগত সঞ্চয় বাড়লেও সমাজের মোট সঞ্চয় বাড়বে না।
তাছাড়া আয় স্থির থাকা অবস্থায় সুদের হার বৃদ্ধি করার দরুন দ্রব্য-সামগ্রীর মূল্য বেড়ে যাবে। ফলে আগের সমান পণ্য-সামগ্রী ক্রয় করতে হলে লোকদেরকে পূর্বের চেয়ে বেমি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। অথবা তাদেরকে পূর্বের তুলনায় কম পরিমাণ দ্রব্য-সামগ্রী ক্রয় করতে হবে। যেহেতু লোকদের আয় বাড়েনি সেহেতু ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হলে তা সঞ্চয় থেকে আনতে হবে এবং সঞ্চয় সমপরিমাণে কমে যাবে। আর যদি পণ্য-সামগ্রী ক্রয়ের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কোন কোন বিক্রেতার বিক্রয় পূর্বের চেয়ে কমে যাবে। সুতনাং আয় অপরিবর্তিত রেখে সুদের হার বাড়লে আসলে সঞ্চয় পূর্বের অবস্থাতেও থাকবে না, বরং তার চেয়ে কমে যাবে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝা সহজ হবে। ধরা যাক, কোন একটি সমাজে সকল মানুষের মোট আয় ১০০/- টাকা। আরও মনে করা যাক যে, এই সমাজের সকল ব্যক্তি মিলে ২০.০০ টাকা সঞ্চয় করে এবং ৮০.০০ টাকা ভোগের জন্য ব্যয় করে। আর এখানে প্রচলিত বাজার সুদের হার ৫%। এই অবস্থায় মনে করা যাক, আয় স্থির রেখে সুদের হার বৃদ্ধি পেয়ে ১০% হলো; এতে কতিপয় লোক প্রলুব্ধ হয়ে বর্ধিত হারে সুদ পাবার আশায় তাদের পূর্বেকার সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পরে। ধরা যাক বর্ধিত এই সঞ্চয় ৫.০০ টাকা। যেহেতু সমাজের মোট আয় বাড়েনি এবং যেহেতু সঞ্চয় ২০/- টাকা থেকে ২৫/- টাকারয় উন্নীত করা হয়েছে, সেহেতু সমাজে ভোগ্য ব্যয়ের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে ৭৫/- টাকায় দাঁড়াবে। সমাজে পণ্যসামগ্রী বিক্রেতাদের ৫/- টাকা কমে যাবে; ফলে তাদের সঞ্চয়ও সমপরিমাণে হ্রাস পাবে। এভাবে মোট সঞ্চয় আবার ২০/- টাকাতেই নেমে আসবে। কিন্তু ঘটনা এই পর্যন্তই সীমিত থাকবে তা নয়; বরং সঞ্চয় আসলে কমে যাবে।
কারণ, সুদের হার ৫% বাড়ার ফলে দ্রব্যমূল্য ৫% বৃদ্ধি পাবে, কারণ সুদ উৎপাদন খরচ হিসেবে দামের সাথে যুক্ত হয়। ফলে পূর্বে ৮০/- টাকায় যে পরিমাণ পণ্য-সামগ্র্রী কেনা যেত এখন সেই পরিমাণ পণ-সামগ্রী ক্রয় করতে ৫% টাকা বেশি অর্থাৎ মোট ৮৪/- টাকা লাগবে। ভোক্তারা যদি পূর্বের সমপরিমাণ ভোদ্য পণ্য ক্রয় করে, তাহলে সঞ্চয় ৪/- টাকা কমে ১৬ টাকায় দাঁড়াবে। আর ভোক্তাগণ যদি তাদের সঞ্চয় পূর্বের সমান স্থির রেখে চার টাকার ভোগ্য পন্য ক্রয় কমিয়ে দেয়, তাহলে পণ্য বিক্রেতাদের আয় চার টাকা হ্রাস পাবে, যা তাদের সঞ্চয় ৪/- কমিয়ে দেবে। অর্থাৎ মোট সঞ্চয় ১৬/- টাকায় নেমে আসবে।
বিনিয়োগের দিক থেকে দেখলেও একই ফলাফল লক্ষ্য করা যায়। নিবিয়োগকরীগণ কম সুদের হারে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করত সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই পরিমাণ বিনিয়োগ করবে না। কারণ পুজিঁর প্রান্তিক ক্ষতাকে বর্ধিত সুদের হারের সমান রাখতে হলে বিনিয়োগ না কমিয়ে উপায় নেই। (পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে।) দেখা যাচ্ছে, সুদের হার বৃদ্ধি করা হলে তা বিনিয়োগকে কমিয়ে দেয়; এতে উৎপাদনও আয় হ্রাস পায় এবং সঞ্চয়ও কমে যায়।
প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আয় স্থির রেখে সুদের হার বাড়ানো হলে তার প্রভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়; ফলে সঞ্চয়, বিনিয়োগ, উৎপাদন ও আয় পূর্বের চেয়ে কমে যায়। এ প্রসঙ্গে কীনস লিখেছেন, “প্রকৃত সঞ্চয়ের ওপর সুদের হারের প্রভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাধারণভাবে যা মনে করা হয় সুদের হার সঞ্চয়কে সেদিকে পরিচালিত করে না, বরং তার বিপরীত দিকেই সঞ্চয়কে নিয়ে যায়। উচ্চতর সুদের হার প্রকৃত সঞ্চয়কে অবশ্যই কমিয়ে দেয়। কারণ, মোট সঞ্চয় নিয়ন্ত্রিত হয় মোট বিনিয়োগের দ্বারা; সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ হ্রাস পায়; সুতরাং সুদ বৃদ্ধি পেলে তা অবশ্যই আয়কে কমিয়ে দেয়। এতে বিনিয়োগ যতটা কমে সঞ্চয় ততটাই হ্রাস পায়। যেহেতু আয় কমে যায় সেহেতু একথা অবশ্যই সত্য যে, সুদের হার বাড়লে ভোগের হারও কমে যায়। কিন্তু এর ফলে সঞ্চয়েরে জন্য বেশি অর্থ থেকে যায়, ব্যাপার আসলে তা নয়; বরং সঞ্চয় ও ভোগ্য ব্যয় উভয়টাই কমে যায়”।[জে, এম, কীনস, পূর্বে উল্লেখিত, পৃ: ১১০-১১১। “The influence of changes in the rate of interest on the amount actually saved is of paramount importance, but is in the opposite direction to that usually supposed. For even if the attraction of the larger future income to be earned from a higher rate of interest has the effect of diminishing the prosperity to consume, nevertheless we can be certain that a rise in the rate of interest will have the effect of reducing the amount actually saved. For aggregate saving is governed by aggregate investment; a rise in the rate of interest…. will diminish investment; hence a rise in the rate of interest must have the effect of reducing incomes to a level at which saving is decreased in the· same measure as investment. Since incomes will decrease, …. it is indeed true that, when the rate of interest rises, the rate of consumption will decrease. But this does not mean that there will be a wider margin for saving. On the contrary, saving and spending will both decrease.”]
জার্মান অর্থনীতিবিদ সিলভিও গ্যাসেলের সুদ তত্ত্বের এপর আলেকপাত করে কীনস লিখেছেন, “সুদের হার প্রকৃত মূলধন গঠনের ওপর সীমারেখা টেনে দেয়।[জে এম, কীনস, পূর্বোক্ত, পৃ: ৩৫৫: “that it is the rate of interest which sets a limit to the rate of growth of real capital.”] তিনি আবার বলেছেন, “আর্থিক সুদের হার প্রকৃত পুজিঁ গঠনে (Growth of real capital) বাধা সৃষ্টি করে”।[উপরোক্ত, পৃ: ৩৫৭: “that the growth of real capital is held back by the money-rate of interest, and that if this brake were removed the growth of real capital would be, in the modem world, so rapid that a zero money-rate of interest would probably be justified, not indeed forthwith, but within a comparatively short period of time. Thus the prime necessity is to reduce the money-rate of interest.”] কীনস দেখিয়েছেন যে, সঞ্চয় ও মূলধন গঠন সুদের হারের দ্বারা নির্ধারিত হয় না; বরং সঞ্চয় নির্ভর করে বিনিয়োগ হারের ওপর, আর বিনিয়োগ নির্ভর করে ভোগের ওপর (কার্যকর চাহিদার ওপর)। অপরদিকে ভোগ (কার্যকর চাহিদা) আবার নির্ভর করে আয়ের ওপর, যা আবা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। সহজ কথায়, বিনিয়োগ বাড়লে উৎপাদন বেশি হয়, মুনাফাও বেড়ে যায় এবং সঞ্চয় ও মূলধনও বৃদ্ধি পায় এবং সঞ্চয় ও মূলধন গঠন কম হয়। সুতরাং বিনিয়োগ যত বেশি হয় মূলধন তত বৃদ্ধি পায়। আর বিনিয়োগ পূর্ণ (full employment) হলে মূলধন গঠনও হয় সর্বাধিক।
কিন্তু বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখাতে হলে উৎপাদিত পণ্যের অব্যাহত কার্যকর চাহিদা (effective demand) থাকা অপরিহার্য। আর পণ্য-সামগ্রীর কার্যকর চাহিদা থাকতে হলে ক্রেতা তথা ভোক্তাদের হাতে যথেষ্ট অর্থ বা ক্রয়-ক্ষমতা থাকতে হবে।
এক্ষেত্রে দেশের কতিপয় লোকের হাতে বিপুল অর্থ-সম্পদ থাকলে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হবে না্ তাই সম্পদ দেশের সকল লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে; যত বেশি লোকের হাতে ক্রয়-ক্ষমতা থাকবে পণ্য-সামগ্রীর কার্যকর চাহিদাও তত বেশি হবে। এক কথায় অভাব সকল লোকেরই আছে, আর এ অভাব পূরল করার মত ক্রয়-ক্ষমতাও সকলেরই থাকা বাঞ্চনীয়। এজন্য দরকার সকল লোকের পরিমিত আয়ের ব্যবস্থা ও পূর্ণ কর্মসংস্থান।
পূর্ণ কর্মসংস্থান স্তরে সকল কর্মক্ষম লোক উপযুক্ত কাজ এবং আয় পায়; তাদের অভাব পূরণ করা সম্ভব হয়। অপরদিকে বিনিয়োগকারীদের উৎপাদিত সকল পণ্য-সামগ্রী বিক্রি হয়ে যায়। তারা উৎসাহিত হয় এবং আরও অধিক বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। এভাবে আবার বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, নতুন কর্মসংস্থান ও ক্রয়-ক্ষমতা সৃষ্টি হয়, চাহিদা সম্প্রসারিত হয় এবং বিক্রয় ও মুনাফা বৃদ্ধি পায় যা আবার বিনিয়োগ বৃদ্ করে। এভাবে ধাপে ধাপে মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়; সমাজ উন্নত থেকে উন্নততর অবস্থার দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু সুদ চালু থাকলে তা দ্রব্যমূল্যের সাথে যুক্ত হলে ভোক্তা জনগণের ক্রয়-ক্ষমতা শোষণ করে এনে পুজিঁপতিদের হাতে তুলে দেয়। ভোক্তাদের ক্রয়-ক্ষমতা ক্রমে হ্রাস পায় যা চাহিদাকে সংকুচিত করে দেয় এবং বিনিয়োগ হ্রাস করতে বাধ্য করে। যেহেতু বিনিয়োগ হ্রাস পায় সেহেতু জনগণের আয় ও সঞ্চয় কমে যায়।
কীনস লিখেছেন, “সুতরাং আসল কথা হলো মোট সঞ্চয় ও মোট ব্যয়ের হার সতর্কতা, দূরদৃষ্টি, হিসাব-নিকাশ, উন্নতি, স্বাধীনতা, উদ্যেগ, গৌরব বা লোভের ওপর নির্ভর করে না; এক্ষেত্রে পাপ-পুণ্যেরও কোন ভূমিকা নেই। বস্তুতঃ পুঁজির প্রান্তিক দক্ষতার বিচারে সুদ বিনয়োগরে জন্য কতটা অনুকূল তার ওপরই সবকিছু নির্ভর করে। সুদের হারকে যদি অব্যাহতভাবে পূর্ণ কর্মসংস্থান স্তরে রাকা সম্ভব হয়, তাহলে পূণ্য আবার এর কর্তৃত্ব বহাল করবে। মূলধন গঠনের হার ভোগ প্রবণতার দুর্বলতার ওপর নির্ভরশীল হবে”।[উপরোক্ত, পৃ: ১১১-১১২: “Thus, after all, the actual rates of aggregate saving and spending do not depend on Precaution, Foresight, Calculation, Improvement, Independence, Enterprise, Pride or Avarice. Virtue and Vice Play no part. It all depends on how far the rate of interest is favourable to investment, after taking account of the marginal efficiency of capital. No, this is an overstatement. If the rate of interest were so governed as to maintain continuous full employment, virtue would resume her sway: the rate of capital accumulation would depend on the weakness of the propensity to consume.”]
আমরা প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, কার্যকর সঞ্চয়েরে পরিমাণ অবশ্যই বিনিয়োগের আয়তন দ্বারা নিরূপিত হয়; আর বিনিয়োগের আয়তন সম্প্রসারিত হয় নিম্ন সুদের দ্বারা”। তাই কীনস সুদের হার কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, “সুতরাং এটাই আমাদের জন্য সর্বোত্তম সুযোগ। এ সুযোগে আমরা পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতার তালিকায় যেখানে পূর্ণ কর্মসংস্থানের স্তর অবস্থিত সুদের হার সে পর্যায়ে কমিয়ে আনতে পারি”। [উপরোক্ত, পৃ: ৩৭৫: “But we have shown that thw extent of effective saving is nevessarily by a low rate of interst… Thus it is to our best advantage to reduce the rate of interst to the point relatively to the schedule of the marignal efficiency if capital at wihich there is full employment.”]
কীনসের পরে এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। কয়েক বছর পূর্বে আমেরিকায় অর্থ ও ঋণ বিষয়ে অধ্যায়ন করার জন্য একটি কমিশন নিয়োগ করা হয়েছিল। কমিশন এর রিপোর্টে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, ভোক্তার ব্যয় নির্ধারণে অন্যান্য কাণের তুলনায় সুদের ভূমিকা খুবই নগণ্য। [কমিশন অন মানি এন্ড ক্রেডিট (সি এম সি), ইম্প্যাকটস অব মনেটারী পলিসি, প্রেন্টিস হল, ১৯৬৪, পৃ: ৪১।]
বৃটেনে আর্থিক পদ্ধতি স্টাডি করার জন্য নিয়োজিত র্যাডক্লীফ কমিটি এর রিপোর্টে বলেন যে, অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ ও বিশষজ্ঞদের মতে সুদের হার বাড়লেও তা ব্যক্তিগত সঞ্চয় বৃদ্ধি করে না। [র্যাডক্লীফ কমিটি রিপোর্ট: হার মেজেস্ট্রিজ স্টেশনারী অফিস, লন্ডন, ১৯৫৯।]
এ কথা পূর্বেই উল্লেক করা হয়েছে যে, আধুনিক আরবাবে নিয়োজিত পুজিঁর এক বিরাট অংশ ব্যবসায়িগণ নিজেরাই যোগান দিয়ে থাকেন। করবা যে লাভ হয়, তার অধিকাংশই ব্যবসায় পুনঃবিনিয়োগ করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আমেরিকায় কারবারে অর্জিত মুনাফার ৭০% সঞ্চিত ও পুনঃবিনিয়োজিত হয়। অপরদিকে ব্যক্তিগত আয় থেকে সঞ্চয়ের হার হচ্ছে আয়ের মাত্র ৫%। অন্যান্য দেশের অবস্থাও প্রায় অনুরূপ। [এন, ক্যালডোর, ক্যাপিটাল এক্যুমুলেশন এন্ড ইকোনমিক গ্রোথ ইন দি থিওরী অব ক্যাপিটাল, এডিটেড বাই ডি, সি, হ্যাণ্ড, ম্যাকমিলান, লন্ডর, ১৯৫৫, পৃ: ১৯৭।]
এছাড়া কোম্পানীগুলো তাদের কল-কব্জার ক্ষয়-ক্ষতির জন্য অবচয় বাবদ যে অর্থ প্রতিবছর কেটে রাখে তাকেও পুজিঁ হিসেবে বিনিয়োগ করা হয়। আমেরিকায় আরবার প্রতিষ্ঠানসমূহের চার ভাগের তিন ভাগ পূজিঁ তাদরে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে আসে। [ সি এম সি, পূর্বোল্লেখিত পৃ: ৬৫৫।]
ইংল্যান্ডেও একই অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। র্যাডক্লীফ কমিটি তার রিপোর্টে আরও উল্লেখ করেছেন, শিল্প সম্প্রসারণের জন্য বিনিয়োজিত মূলধনের প্রধান এবং বৃহঃৱৎ উৎস হচ্ছে এ উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত মুনাফা এবং এর চেয়েও বৃহত্তম উৎস হচ্ছে কল-কব্জার ক্ষয়-ক্ষতি বাবদ সংরক্ষিত অবচয় তহবিল। [র্যাডক্লীফ কমিটি রিপোর্ট, পৃ: ৮০।] বস্তুতঃ পুজিঁ গঠনে কর্পোরেশনসমূহের সঞ্চয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকায় ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০-এই তিন বছরে অবন্টিত মুনাফা এবং অবচয় বাবদ সংরক্ষিতি তহবিলের পরিমাণ ছিল প্রদ্ত্ত ডিভিডেন্ড এর পাঁচ গুণ।[ফেডারেল রিজর্ভ বুলেটিন, জুন ১৯৮১, টেবল, ১.৪৯।] ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ-আর্থিক কারবার প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেশনসমূহের মোট মূলধন ব্যয় ছিল $২৯৯.১ বিলিয়ন ডলার। এই ব্যয়ের মধ্যে $২৫৯.৫ বিলিয়ন ডলার বা ৮৭% এসেছিল এসব কারবারের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে (অবন্টিত মুনাফা, অবচয় এবং অন্যান্য); $১১.৪ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা হয়েছিল নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে এবং বাকি মাত্র $২৮.২ বিলিয়ন ডলার ছিল ঋণ।[ফেডারেল রিজার্ভ, ফ্লো অব ফান্ডস IV-৮৯, ফেব্রুয়ারী ১৯৮১, পৃ: ৯।]
উল্লেখ্য যে, এসব কারবারের সঞ্চয়ী মূলধনের ওপর সুদের কোন প্রভাব নেই। [সিএমসি, পূর্বোল্লেখিত, পৃ: ৬৭৩-৬৭৪।] আর একথাও ধারণা করার কোন কারণ নেই যে, সুদ বিলোপ করা হলে এসব কারবার সঞ্চয় করা বন্ধ করে দেবে। ড. এম. উমর চাপরা তাই বলেছেন যে, সুদ বিলোপ করা হলে এসব কারবারে সঞ্চয় বন্ধ হয়ে যাবে-এরূপ ধারণা কেবল তখনই সমর্থন করা যায়, যখন কেউ সুস্পষ্টভাবে একথা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিতে পারবে যে, যাবতীয় অবিনিয়োজিত সঞ্চয় চুরি হয়ে গেছে এবং একক মালিকানাধীন, অংশীদারী এবং যৌথ মূলধনী কারবার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সাকুল্য বিনিয়োগেই লোকসান হয়েছে। এরূপ হওয়া কেবল সুদুর পরাহতই নয়, অসম্ভবও। [চাপরা, এম, উমর: টুওয়ার্ডস এ জাস্ট মনিটারী সিস্টেম, দি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৫, ইউ, কে, পৃ: ১১৪।]
ড. এম, উমর চাপরা দেখিয়েছেন যে, সুদ বিলোপ করা হলে পুজিঁ গঠন হ্রাস পাবে- একথা সত্য নয়; বরং উচ্চহারে হোক, আর নিম্নহারে হোক, সুদ বহাল থাকলেই পুজিঁ গঠন বাধাপ্রাপ্ত হবে। তিনিবলেছেন যে, সুদের হার পূর্বনির্ধারিত হলেও তা প্রায়ই ব্যাপকভাবে উঠা-নামা করে এবং মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিকে বিনষ্ট করার মাধ্যমে সম্পদ বন্টন ও বরাদ্দে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও অবিচার বয়ে আনে, যার সর্বশেষ পরিণতি স্বরূপ পুজিঁ গঠনের গতি মন্হর ও শ্লথ হয়ে আসে। তিনি দেখিয়েছেন, সুদ+লাভ= মোট আয়। সুতরাং সুদের হার বেশি হলে সুদ দেওয়ার পর উদ্যোক্তার লাভ কম থাকে বা তাকে লোকসান বহন করতে হয়। অন্যদিকে সুদের হার কম হলে, সঞ্চয়কারীদের অংশ কমে যায় এবং উদ্যোক্তারা বেশি লাভ পায়। এ উভয় অবস্থাই পুজিঁ গঠনের পক্ষে অনুপযোগী।[উপরোক্ত, পৃ: ১১৫।]
বস্তুতঃ পুজিঁবাদী ব্যবস্থায় উচ্চ সুদের হার মূলধন গঠনকে বাধাগ্রস্ত করে। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে পরিশোধিত সুদের পরিমাণ ছিল মূলধন থেকে প্রাপ্ত করপূর্ব আয়ের এক-তৃতীয়াংশ। ষাটের দশকের তুলনায় এই অংশ তিনগুণ এবং পঞ্চাশের দশকের তুলনায় ছয়গুণ। [হারম্যান আই, লাইবলিং; ইউ, এস, কোরপোরেট প্রফিটেবিলিটি এন্ড ক্যাপিটাল ফরমেশনঃ আর রেইটস অব রিটার্ন সাফিসিয়েন্ট? নিউইয়র্কঃ পারগামান পলিসি স্টাডিজ, ১৯৮০, পৃঃ ৭৮।] উচ্চ সুদ দেওয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেশনগুলোর লাভের অংক কমে যায় এবং তাদের সর্বমোট বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পায়। সুতরাং মোট অর্থ সরবরাহের ক্ষেত্রে ঝুকিঁ-বহনকারী মূলধনের (equity) অনুপাতও কমে আসে। যুক্তরাষ্টে অ-আর্থিক কর্পোরেশনগুলোর মোট অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল শেয়র মূলধন; কিন্তু ১৯৭৮ সালে তা কমে অর্ধেক হয়ে যায়। [ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট, ৫২তম বার্ষিক রিপোর্ট, এপ্রিল ১, ১৯৮১-, মার্চ ৩১, ১৯৮২, পৃ: ৩।] কেবল যুক্তরাষ্টের ক্ষেত্রেই এরূপ ঘটেছে তা নয়; বরং বিশ্বের সর্বত্রই প্রায় একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পশ্চিম জার্মানীতেও মোচ পুজিঁর ক্ষেত্রে শেয়ার মূলধনের অংশ ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছে। [লইবলিং, পূর্বোল্লেখিত, পৃঃ ৪-৫, টেবল ১৩, পৃঃ ১৩৫।] পুজিঁ গঠনের এই নিম্নগতির কারণ হচ্ছে উচ্চ হারের সুদ। [উপরোক্ত, পৃঃ ৮২।]
যুক্তরাষ্ট্রে মূলধন গঠনের এই নিম্নহার একটি দুষ্ট চক্রের সৃষ্টি করেছে। এর ফলে উৎপাদনশীনতা হ্রাস পেয়েছে, যা প্রকারান্তরে ঋণের ওপর ধার্যকৃত ক্রমবর্ধমান ব্যয় মিটাতে উদ্যোক্তাদের অক্ষম করে তুলেছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্বরূপ মুনাফা হ্রাস পেয়েছে এবং মূলধন গঠন আবারও কমে গিয়েছে। [উপরোক্ত, পৃঃ ৮২।]
ড. চাপরা বলেন, এ ব্যাপারে নিম্ন সুদের হারও কম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। উচ্চ সুদের হার যেমন উদ্যোক্তাদের দণ্ডিত করে, নিম্ন সুদের হার তেমনি বিভিন্ন প্রকার সুদী বিনিয়োগ পত্রে বিনিয়োগকারী সঞ্চয়ীদের ক্ষতি সাধন করে। বিপুল সংখ্যক বিনিয়োগকারীকে নাম মাত্র সুদ দিয়ে প্রকৃতপক্ষে এদের বঞ্চিত করা হয়। এর ফলে সমাজে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড় যায়। তাছাড়া নিম্ন সুদের হার সাধারণ মানুষ ও সরকারকে অনুৎপাদনশীল ভোগ্য ঋণ ফেরত দেওয়ার কালে সঞ্চয়ের অনুপাত করে যায় এবং মূলধন ঘাটতি সৃষ্টি হয়। তদুপরি, এটা অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেয় এবং পণ্য-সামগ্রী এ শেয়ার-বাজারে ফটকা প্রবণতার জন্ম দেয়। এরপরও নিম্ন সুদের হার প্রকট শ্রম বিমুখ (EXcessively labour saving) বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়ে বেকার সমস্যাকে প্রকট করে তোলে। সুতরাং পুজিঁর মূল্যের বিকৃতি সাধনের (distorting) মাধ্যমে নিম্ন সুদের হার ভোগকে বাড়িয়ে দেয়, সঞ্চয়ের হারকে নিম্নগামী করে, বিনিয়োগের মান হ্রাস করে এবং মূলধনের ঘাটতি সৃষ্টি করে। [চাপরা, এম, উমর: পূর্বোল্লেখিত, পৃঃ ১১৬।]
২. বিনিয়োগের ওপর
¡) সুদ বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়
অর্থনীতিবিদগণ সুদের হারের সাথে বিনিয়োগের বিপরীতধর্মী সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে লর্ড কীনসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি তাঁর “জেনারেল থিওরী অব এমপ্লয়মেন্ট , ইন্টারেস্ট এন্ড মানি” গ্রন্হে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ কমে যায় এবং সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। সুদের হার কম থাকলে মানুল বেশি ঋণ নেয় এবং বিনিয়োগ করে। কিন্তু সুদের হার বোড়ে গেলে মানুষ ঋণ নিয়ে বিনিয়োগা করাকে কম লাভজনক মনে করে এবং ঋণ কম নেয়। ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। নীচের রেখাচিত্রের সাহায্যে এ অবস্থা দেখানো হচ্ছেঃ
OY রেখায় সুদের হার এবং OX রেখায় বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে সুদের হার যখন সর্বোচ্চ, অর্থাৎ OB, তখন হয় মাত্র OA পরিমাণ। সুদের হার যখন কমে OB1 হয়, তখন বিনিয়োগ বেড়ে হয় OA1 পরিমাণ।সুদের হার যখন আরও কমে OB2 হয়, তখন বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় OA3 পরিমাণ। এভাবে সুদের হার আরও কমে যখন OB3 হয়, তখন বিনিয়োগ হয় OA3 পরিমাণ, সুদের হার যখন 0 (শূণ্য) হয়, তখন বিনিয়োগ হয় পূর্ণ।
লর্ড কীনস দেখিয়েছেন যে, সুদের হার শূন্য হলেই কেবল পূর্ণ বিনিয়োগ হয় এবং দেশের বস্তুগত ও মানবীয় সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হয়। অন্যথায় সুদের হার যত বাড়ে বিনিয়োগ তত কমে যায় এবং বস্তগত ও মানবীয় সম্পদও তত বেশি অব্যবহৃত থাকতে বাধ্য হয়। এজন্যই লর্ড কীনস শূন্য সুদের হারকে পূর্ণ বিনিয়োগ ও পূর্ণ কর্মসংস্থানের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুদের হার যাতে শূন্য হয় সেজন্য তিনি সরকারেকে তার আইনী ক্ষমতা (coercive power) প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। [জে, এম, কীনস: পূর্বোল্লেখিত, পৃ: ৩৫১।]
সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ হ্রাস পায় এবং সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বেশি হয়। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কীনস পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা যেখানে সুদের হারের সমান হয়, সেখানেই ভারসাম্য স্থাপিত হয় এবং বিনিয়োগকারীগণ ভারসাম্য বিন্দু পর্যন্তই বিনিয়োগ করে, তার অধিক বিনিয়োগ করে ন। [উপরোক্ত।]
সুদের হার ও পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা
সুদের হার | বিনিয়োগের একক (প্রতিটি ১০০/- টাকা) | পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা বা আয় (টাকায়) | সম্ভাব্য লাভ সুদ প্রদানের পর (টাকায়) | মোট লাভ |
২০% |
২০%
২০%
২০%
২০%
২০%
২০%১ম
২য়
৩য়
৪র্থ
৫ম
৬ষ্ঠ
৭ম
৪৫.০০
৩৮.০০
৩০.০০
২০.০০
৮.০০
.০০
(-)
৮.০০
২৫.০০
১৮.০০
১০.০০
০
(-)
১২.০০
(-)
২০.০০
(-)
২৮.০০২৫.০০
৪৩.০০
৫৩.০০
৫৩.০০
৪১.০০
২১.০০
-৭.০০
বাজারে সুদের হার ২০% ধরে নিয়ে ওপরের ছকটি দেখানো হয়েছে। ছকে দেখা যাচ্ছে যে, একজন উৎপাদনকারী ২০% সুদের হারে ব্যাংক থেকে ১০০.০০ টাকার এক একক পুজিঁ ধার নিয়ে বিনিয়োগ করে। সে এই একক থেকে ৪৫.০০ টাকার সমান প্রান্তিক দক্ষতা বা আয় পায়। এতে ব্যাংকের ২০.০০ টাকা সুদ পরিশাধ করার পর তার অতিরিক্ত আয় বা লাভ থাকে ২৫.০০ টাকা। আরও এক একক পুজিঁ বিনিয়োগ করলে আর আরও ২৫.০০ টাকা লাভ থাকবে আশা করে সে ১০০.০০ টাকার ২য় একক পুজিঁ ধার নিয়ে বিনিয়োগ করল। দেখা যাচ্ছে, ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি (Law of Diminishing Return) অনুসারে ২য় একক থেকে তার লাভ হলো ১৮.০০ টাকা। অনুরূপ লাভ পাবার আশায় সে ৩য় একক (আরও ১০০.০০ টাকা) ধার নিয়ে বিনিয়োগ করল। কিন্তু ৩য় এককের প্রান্তিক দক্ষতা কমে গেল এবং সেই একক থেকে সে পেল মাত্র ৩০.০০ টাকা। এতেও সুদ পরিশোধ করার পর তার লাভ থাকল ১০.০০ টাকা। সুতরাং আরও ১০.০০ টাকা পাবার আশায় সে ৪র্থ একক (আরও ১০০.০০) ধার নিয়ে বিনিয়োগ করল। দেখা গেল, এবার সে পেল ২০.০০ টাকা। এই এককের সুদ পরিশোধ করার পর তার লাভ কিছুই থাকল না। অতঃপর সে ৫ম একক বিনিয়োগ করে পায় মাত্র ৮.০০ টাকা। এতে এই এককের সুদ পরিশোধের জন্য তাকে পূর্বের লাভ থেকে ১২.০০ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়।ফলে তার মোট লাভ কমে যায়। সুতরাং ৫ম একক সে বিনিয়োগ করবে না। সে ৪র্থ একক অর্থাৎ যেখানে সুদের হার এবং পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা সমান সে পর্যন্তই বিনিয়োগ সীমিত রাখবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাজার-সুদের হার যদি ৮% বা তার চেয়ে কম হয়, তাহলে সে ৫ম একক বিনিয়োগ করবে। এমনকি, সুদের হার যদি শূন্য হয়, তাহলে সে পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা শূন্য হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগ করবে। কারণ এ ক্ষেত্রে তাকে সুদ দিতে হবে না এবং প্রান্তিক দক্ষতা শূন্য হলেও তাকে লোকসান দিতে হবে না বা তাতর মোট মুনাফা কমে যাবে না। অপরদিকে সুদের হার যদি ৩০% হয়, তাহলে উক্ত বিনিয়োগকারী ৩য় এককের পরে আর বিনিয়োগ করবে না। এভাবে সুদের হার আরও বেশি হলে সে বিনিয়োগ আরও কম করতে বাধ্য হবে।
উপরের উদাহরণ থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা যখন সুদের হারে সমান হয়, অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সে পর্যন্তই সীমিত থাকে। সুতরাং সুদ থাকলে সে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সুদহীন অর্থনীতির তুলনায় অবশ্যই কম থাকে; সুদের হার শূন্য হলেই কেবল বিনিয়োগ সর্বাধিক হতে পারে। অপরপক্ষে সুদের হার যত বেশি হবে, বিনিয়োগ তত কম হবে। বস্তুতঃ সুদী অর্থনীতিতে কখনও বিনিয়োগ সর্বাধিক হয় না।
ii) সুদ বিনিয়োগকে অনুৎপাদনশীল ফটকা খাতে ঠেলে দেয়
সুদী অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ কম হবার আর একটি বড় কারণ হচ্ছে, সুদ পুজিঁকে অনুৎপাদনশীল বিনিয়োগের দিকে ঠেলে দেয়। সুদী ব্যবস্থায় সঞ্চয়কারীগণ তাদের সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রাখে অতঃপর ব্যাংক এই অর্থ শিল্প, বাণিজ্য ও অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে বলে মনে করা হয়। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তা নয়। ব্যাংক নির্ধারিত, ঝুকিঁমুক্ত ও নিশ্চিত আয় পাবার আশায় জনগণের গচ্ছিত আমানতের এক বিরাট অংশ সরকারী সিকিউরিটি ক্রয়, বিনিময় বিল ভাঙ্গানো, ফটকামূলক কারবাল ইত্যাদি নানাবিধ অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে। ফলে উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় পুজিঁর অভাব দেখা দেয়। এতে পুজিঁর সুদের হার বেড়ে যায়; সঞ্চয়কারিগণ উৎসাহ বোধ এবং অধিকহারে সুদ পাবার লোভে তাদের সঞ্চয় ব্যাংকে জমা করে। ব্যাংকের আমানত বেড়ে যায়। ব্যাংক অনুৎপাদনশীল খাতে আরও অর্থ বিনিয়োগ করে। পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা আরও হ্রাস পায়। বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পরিমাণ আবার কমে যায়; বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়; দ্রব্যমূল্য আরও একদফা বেড়ে যায়।
সুদ না থাকলে নির্ধারিত, নিরাপদ ও নিশ্চিত আয় পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। সঞ্চয়কারিগণ নিজেরা প্রত্যক্ষভাবে অথবা ব্যাংক বা অন্য কোন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অংশীদারী ভিত্তিতে তাদের সঞ্চিত অর্থ শিল্প, বাণিজ্য এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হবে। এভাবে সুদী অর্থনীতিতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ অনুৎপাদনশীল খাতে প্রবাহতি হবে এবং উৎপাদনশী বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিবে। কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বেকার সমস্যা হ্রাস পাবে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য হ্রাস এবং জনগণের আয় ও ক্রয়-ক্ষমতা বেড়ে যাবে। পণ্যদ্রব্যের চাহিদা ও বিক্রি বেশি হবে। উৎপাদনকারীদের মুনাফার অংক বড় হবে। উৎপাদন কাজে নবতর উৎপাহ দেখা দেবে। বস্তুতঃ সুদ না থাকলে বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নতির গতি বেশি হতো এবং মানুল অধিকতর সমৃদ্ধিশালী ও সুখী বিশ্ব দেখতে পেত। [আফজালুল রহমান; পূর্বোল্লেখিত, পৃঃ ১০৬-১০৭।]
iii) সুদ পুঁজিকে অলস রাখতে প্রলুব্ধ করে
সুদী অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কম হওয়ার এটি আর একটি কারণ। সুদখোর পুঁজিপতি ও ঋণদাতাগণ মনে করে যে, কোন নির্দিষ্ট সুদের হারে ঋণ দেওয়া হলে মেয়াদ শেষ হবার পূর্বে ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে না এবং ইতোমধ্যে সুদের হার বেড়ে গেলে, সেই ঋণের ওপর অতিরিক্ত হারে সুদও পাওয়া যাবে না। ফলে এ সময়ে তাদের ঠকতে হবে। কারণ ঐ অর্থ হাতে থাকলে তারা তা বর্ধিত সুদের হারে ধার দিয়ে বেশি আয় করতে পারত। এ কারণে ভবিষ্যতে যে কোন সময়ে সুদের হার বেড়ে গেলে সে সুযোগে অধিক সুদ পাবার লোভে পূঁজিপতিগণ তাদের পুঁজির একটা বিরাট অংশ, কখনও কখনও বৃহত্তর অংশ, অলসভাবে ধরে রাখে। ফলে অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব আরও বেড়ে যায়; বিনিয়োগ আরও কম হয় এবং উৎপাদনও কমে যায়। শ্রমিক ও অন্যান্য উপকরণ বেকার থাকে আর জনগণের চাহিদা থাকে অপূর্ণ। কৃত্রিম অভাব দেখা দেয়। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক উন্নতির গাতি আরও শ্লথ হয়ে আসে।
সুদ না থাকলে পুজিঁপতিগণ মুনাফার জন্য বিনিয়োগ করতে বাধ্য হবে। আর যখন যেখানে মুনাফা থাকবে তাতেই বিনিয়োগ করবে এবং পুজিঁ অলস ধরে রাখলে মোট মুনাফার অংক কমে যাবার আশংকায় পূর্ণ বিনিয়োগ করবে। বিনিয়োগ ও উৎপাদন বেড়ে যাবে।
iv) সুদ ঝুঁকিবহুল বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়
প্রত্যেক অর্থনীতিতেই এমন কিছু কায়-কারবার থাকে যেগুলোতে বিপুল পরিমাণের পুজিঁ দরকার হয়। তাছাড়া, অন্যান্য কারবারের তুলনায় এগুলোতে ঝুকিঁও থাকে বেশি। অত্যাধিক ব্যয়সংকুল হওয়ার কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব শিল্প-কারখানা কায়েম করা সম্ভব নয়। তদুপরি সুদী ব্যবস্থায় এসব কারবারের ঝুকিঁ গ্রহণ করতে এগিয়ে আসাও অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। দেশের সরকারও সুদী ঋণের মাধ্যমে এ ধারনের কারবারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহবোধ করে না।
এসব বড় বড় শিল্প-কারখানায় যে বিপুল অর্থের দরকার হয় তা সুদের ভিত্তিতে ধার নেওয়া হলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ সুদের বোঝা বহন করতে হয়। তাছাড়া, শিল্প স্থাপনের কাজ শুরুর দিন হতে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা পর্যন্ত ‘গেসটেশন পিরিয়ড’ অর্থাৎ অবকাশ সময় লাগে প্রায় ২ থেকে ৫ বছর। এর মধ্যে সুদের বোঝা বেড়ে এমন আকার ধারণ করে যে, উৎপাদন লাভজনক হলেও সুদরে এ বোঝা বহন করা শিল্প প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব হয় না। তদুপরি এসব কারবারে ঝুকিঁ অপেক্ষাকৃত বেশি থাকায় যে কোন সময়ে বিপুল লোকসানের সম্মুখীন হওয়া অসম্ভব নয়। আর এরূপ লোকসান হলে সুদে-আসলে ঋণের যে অংক দাঁড়ায় তা আর কখনএ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এসব কারণে উদ্যোক্তাগণ ব্যক্তিগতভাবে যেমন এসব ঝুকিঁবহুল উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব হয় না। ফলে সুদী ব্যবস্থায় ঝুকিঁবহুল কায়-কারবার ও শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ হয় না বললেই চলে।
সুদ রহিত করা হলে, গোটা আর্থিক ব্যবস্থা লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে এবং ঝুকিঁবহুল কায়-কারবারে বিনিয়োগের পথে সুদরূপী বাধা আর থাকবে না। সুদমুক্ত অর্থনীতিতে সরকার প্রকল্পের লাভ-লোকসানে অংশীদারীর ভিত্তিতে অর্থ সংগ্রহ করে ঝুকিঁবহুল প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে। যদি লোকসান হয়, তাহলে উদ্যোক্তা বা সরকারকে একা তা বহন করতে হবে না; বরং পুজিঁদাতা প্রতষ্ঠানও এর আনুপাতিক অংশ বহন করবে। এভাবে বিনিয়োগকারী ও সরকারের জন্য এসব কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করা সহজতর হবে। অপরদিকে ঝূকিঁ কাটিয়ে যদি প্রকল্পে মুনাফা হয়, তাহলে তাও পুজিঁদাতা প্রতিষ্ঠান, উদ্যোক্তা, ও সমকার চুক্তির শর্ত অনুসারে ভাগ করে নেবে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেখানে ঝুকিঁ বেশি সেখানে লাভও বেশি। ফলে অধিক মুনাফা পেয়ে উদ্যোক্তা, সরকার ও পুজিঁদাতা সকলেই লাভবান হবে। মোট কথা, সুদী ব্যবস্থায় ঝুকিঁবহুল কারবারে বিনিয়োগ কম হয়; কিন্তু সুদমুক্ত ব্যবস্থায় পুজিঁপতিরাও ঝুকিঁ বহন করবে বিদায় উদ্যোক্তাগণ, বিশেষ করে, সরকার উৎসাহ লাভ করবে এবং এসব খাতে বিনিয়েগে এগেয়ে আসবে।
v) সুদ পুঁজির দক্ষতাপূর্ণ বরাদ্দে বাধা সৃষ্টি করে
ঋণদাতা এবং ঋণগ্রহীতা উভয় দিক থেকে এই বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ঋণদাতার দিক থেকে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, সুদী ব্যবস্থায় ঋণদাতাগণ কারবারের দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা ও লাভজনীনতা অপেক্ষা সুদসহ আসল ফেরত পাবার নিশ্চয়তার ওপরই অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে এবং প্রধানতঃ এর ভিত্তিতেই ঋণ বরাদ্দ করে থাকে। ঋণদাতা জানে যে, ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করে ঋণগ্রহীতা উচ্চহারে লাভ করলেও ঋণদাতা জানে যে, ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করে ঋণগ্রহীতা উচ্চহারে লাভ করে থাকে। ঋণদাতা জানে যে, ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করে ঋণগ্রহীতার লাভ যদি খুব কম হয়, অথবা যদি লোকসান হয়, তাহলেও ঋণদাতার নির্ধারিত সুদ কমে যাওয়ার কোন আশংকা নেই। ঋণের সুদ সর্বাবস্থাতেই নির্ধারিত। এমতাবস্থায় কারবারের লাভ-লোকসানের প্রতি ঋণদাতার আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঋণের সুদ ও আসল ফেরত পাবার নিশ্চয়তা থাকা ঋণদাতার জন্য অবশ্যই জরুরী। কারবারে লাভ-লোকসান যাই হোক, সকল অবস্থাতেই যাতে ঋণদাতা সুদ-আসল ফেরত পেতে পারে সেজন্য তারা সেইসব ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দেয় যাদের ঋণ ফেরত দেওয়ার মত যথেষ্ট সম্পদ আছে। একথা ঠিক যে, ঋণদাতাগণ প্রকৃত প্রকল্প বা কারবারের সুস্থতা এবং লাভজনীনতাও বিশ্লেষণ করে। তবে ঋণ বরাদ্দের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এর স্থান দ্বিতীয় পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে তারা ঋণগ্রহীতার ঋণবহনযোগ্যতা (Credit Worthiness) বিচার করে থাকে। এ কারণে প্রকল্প বা কারবারের সুস্থতা ও লাভজনীনতা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট সম্পদ ঋণগ্রহীতার নিকট না থাকার কারণে ঋণ মঞ্জুর করা হয় না। আবার ঋণগ্রহীতা যথেষ্ট বন্ধক ইত্যাদি দিতে পারলে ভবিষ্যত সন্দেহমুক্ত নয় এমন কারবারের জন্যও ঋণ মঞ্জজুর করতে ঋণদাতাগণ দ্বিধা করে না। অর্থনৈতিক বিচারে ঋণ বরাদ্দের ক্ষেত্রে কম দক্ষ এবং কম উৎপাদনশীল প্রকল্প অপেক্ষা অধিক দক্ষ ও বেশি উৎপাদনশীল প্রকল্প বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। কিন্তু সুদী ব্যবস্থায় উৎপাদনশীলতা নয়, ঋণবহনযোগ্যতাই ঋণ বরাদ্দের মানদণ্ড হয়ে উঠে। এর ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রে দু’ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়;
প্রথমত, ঋণ ফেরত দানের মত যথেষ্ট সম্পদ বা ঋণবহনযোগ্যতা থাকলে কম উৎপাদনশীল ও কম লাভজনক প্রকল্পও ঋণ পায়; অপরদিকে ঋণবহনযোগ্যতা কম হওয়ার কারণে বেশি লাভজনখ প্রকল্পের অধিকারী ঋণ পায় না। এতে সার্বিকভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; অর্থনীতি সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, ঋণবহনযোগ্যতা বা ঋণের মর্টগেজ ও সিকিউরিটি প্রদানর মত সম্পদ যাদের যত বেশি আছে, তারা তত বেশি ঋণ পায়। একে বলা যায়, ‘তেল মাথায় তেল দেওয়া’। কারবার যত বৃহৎ হয় , ঋণ তত বেশি নেওয়ার সুযোগ পায় এবং কারবার আরও বড় হতে হতে আয়তন মিতব্যয়িতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। অপরদিকে ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলো বড় প্রতিষ্ঠান অপেক্ষা অধিক দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার পরিচয় দিতে পারা সত্ত্বেও ঋণের অভাব শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় মৃত্যুবরণে বাধ্য হয়। এভাবেই সুদ ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে খতম করে দিয়ে বড়দের আরও বড় হবার সুযোগ করে দেয়।
ঋণের দক্ষতারপূর্ণ বরাদ্দ ও ব্যবহারের প্রশ্নটি ঋণগ্রহীতার দিক থেকে বিশ্লেষণ কের দেখা যেতে পারে। ঋণগ্রহীতার পক্ষে যতটা সম্ভব ঋণের অর্থ বেশি দক্ষতা ও অধিক লাভজনকভাবে ব্যবহার করতে প্রয়াস পাওয়ারই স্বাভাবিক। এজন্য অনেক সময় উদ্ভাবনশীলতা, নতুনত্ব ও উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার হয়। আর এতে ঝুকিঁ দেখা দেয়। পরীক্ষাকালে ব্যর্থতা আসতে পারে এবং উৎপাদন আশানুরূপ নাও হতে পারে। কিন্তু এসব পরীক্ষ-নিরীক্ষার ঝুকি নেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ পরীক্ষায় ব্যর্ত হয়ে পুজিঁর ক্ষতি হলে তা পূরণ করার মত কোন সংরক্ষিত তহবিল এদের থাকে না। এভাবে নির্ধারিত সুদের হারের ফলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, উদ্ভাবন ও নতুন নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের দ্বারা ভবিষ্যত সম্ভাবনাময় লাভ থেকে সমাজ বঞ্চিত থেকে যায়। অর্থাৎ সুদমূক্ত সমাজে উদ্ভাবনশীলতা ও নবতর প্রযুক্তির ব্যবহার সমাজকে যত দ্রুততার সাথে সামনে এগিয়ে নিতে পারে, সুদী সমাজে ততটা সম্ভব হয় না।
অর্থনীতিতে সুদ না থাকলে, ঋণদাতাগণ মুনাফার অংশের ভিত্তিতে পুজিঁ যোগান দিবে। ফলে ছোট, বড় ও মাঝারি সকল কারবার একই শর্তে ঋণ পাবে; তা হলো মুনাফার অংশ। অতঃপর যে কারবারে মুনাফার হর যত বেশি হবে, সে কারবারের পুজিঁ সংগ্রহের যোগ্যতা তত অধিক হবে। এতে একদিকে তুলনামূকভাবে অধিক উৎপাদনশীল প্রকল্পসমূহ পজিঁ পাওয়ার ফলে সমাজের সামগ্রিক উৎপাদন হবে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে যাদের সম্পদ আছে কেবল তারাই ঋণ পাবে, আর যাদের সম্পদ নেই তারা ঋণ থেকে চিরদিন বঞ্চিত থাকবে এমন অবস্থাও সৃষ্টি হবে না; বরং ছোট প্রকল্প যদি সত্যিই বেশি লাভজনক হয়, তবে এর ঋণ পাবার পথে আর কোন বাধা থাকবে না। অন্যদিকে বড় কারবার যদি কম লাভজনক হয়, তাহলে কেবল বড়ত্বের কারণেই তা অধিক ঋণ পেয়ে আরউ বড় হবার সুযোগ পাবে না। এভাবে প্রকল্পের লাভজনীনতা নিজেই সমাজের সর্বাচ্চ বিনিয়োগ ও উৎপাদন নিশ্চিত করবে এবং বৈষম্য হ্রাস করবে। তাছাড়া, পুজিঁপতিগণ কারবারের লাভ-ক্ষতিতে আগ্রহী হতে বাধ্য হবে এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনার সুফল পাবার আশায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঝুকিঁ হ্রাস পাবে এবং অর্থনীতি দ্রুততার সাথে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও নবতর প্রযুক্তি প্রয়োগে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
এভাবে পুজিঁর সর্বাধিক দক্ষতাপূর্ন বরাদ্দ, সর্বাধিক উৎপাদন ও নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হবে যদি সুদ না থাকে এবং মুনাফার ভিত্তিতে পুজিঁ বরাদ্দের ব্যবস্থা চালু হয়।
vi) সুদ কল্যাণকর খাতে বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়
বস্তুতঃ সুদের হার এমন এক বস্তু যা ব্যবসায়ীকে সর্বদাই সুদের হারের ঊর্ধে মুনাফা অর্জন করার জন্য সচেষ্ট থাকতে বাধ্য করে। সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করে বিনিয়োগ করতে হলে কারবারী বা উৎপাদনকারীকে প্রথমেমই বিবেচনা করে দেখতে হয়, তারও বিনিয়োগ থেকে অর্জিত মুনাফার হার কত হবে এবং অর্জিত মুনাফা থেকে সুদ পরিশোধ করার পর কোন মুনাফা তার থাকবে কি না; যদি থাকে তাহলে সেই মুনাফায় তার পোষাবে কিনা ইত্যাদি। আর একথা সকলেরই জানা আছে যে, সব ধরনের উৎপাদন কাজ এবং সকল প্রকার ব্যবসায়ে একই হারে মুনাফা অর্জন করা যায় না; বরং বাস্তবে দেখা যায়, কোন কোন দ্রব্য-সামগ্রীর উৎপাদন ও ব্যবসায় লাভের হার এত বেশি যে, উক্ত মুনাফা থেকে সুদ পরিশোধ করার পরও উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীগণ মোটা অংকের লাভ পেতে পারে। কিন্তু কোন কোন কারবারে লাভ এত কম হয় যে, এ থেকে সুদ পরিশোধ করাও সম্ভব হয় না। আবার কোন কোন কারবারে এই পরিমাণ লাভ পাওয়া যায় যা থেকে কোন রকমে সুদ পরিশোধ করা যায় বটে, কিন্তু তারপর বিনিয়োগকারী আর কিছুই পায় না। এই বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদগণ দেখিয়েছেন যে, সাধারণভাবে বিলাসসামগ্রী এবং সমাজের জন্য অকল্যাণকর পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবসায় মুনাফার হার বেশি হয়। অপরদিকে সমাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এবং কল্যাণকর দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার ক্ষেত্রে মুনাফার হার কম থাকে। [জে, এম, কীনস, পূর্বে উল্লেখিত, পৃঃ ১৭৭ : “There is no clear evidence from experience that the investment policy wich is sociallyy advantageous coincides with that which is mist prifitabke.”] তাছাড়া অর্থনীতিতে এমন কিছু কাজও আঞ্জাম দিতে হয় যাতে প্রভূত সামাজিক কল্যাণ সাধিত হয়; কিন্তু অর্থের সাহায্যে এর মুনাফা নিরূপণ্ করা সম্ভব নয় অথবা তা কাম্য নয়।
এমতাবস্থায় সমাজে সুদ চালু থাকলে বিনিয়োগকারীগণ স্বাভাবিকভাবে সেই সব খাতে পুজিঁ বিনিয়োগ করবে, যেখানে মুনাফার হার সুদের হারের চেয়ে বেশি। অপরদিকে যেসব খাতে মুনাফার হার সুদের হারের চেয়ে কম, সেসব খাতে কেউ পুজিঁ বিনিয়োগ করবে না। এমনকি, দেশের সরকারের পক্ষেও প্রচলিত সুদের হারকে উপেক্ষা করে, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও দরিদ্রদের জন্য গৃহ নির্মাণ ইত্যাদি সাধারণ জনকল্যাণমূলক খাতে অর্থ বিনিয়োগ করা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। ফলে সুদী সমাজে স্বাভাবিকভাবে জনকল্যাণমূলক এবং জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় খাতসমূহ উপেক্ষিত ও অবহেলিত হয়; অন্যদিকে সমাজের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিলাস সামগ্রী এবং নৈতিকতা পরিপন্হী খাতে পূজিঁ প্রবাহিত হয়। একদিকে, প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার অভাবে জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, অন্যদিকে বিলাসসামগ্রীসহ নৈতিকতা পরিপন্হী বতু পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন ও ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়ে সমাজবিরোধী কার্যকলাপের বিস্তার ঘটিয়ে থাকে।
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সুদী অর্থনীতিতে পুজি বিনিয়োগের প্রকৃত মানদণ্ড হচ্ছে পুজিপতি ও বিনিয়োগকারীর লাভ এবং স্বার্থ; সমাজের লাভ ও স্বার্থ সেখানে চরমভাবে উপেক্ষিত। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হতে পারে। মনে করা যাক, বাজারে প্রচলিত সুদের হার শতকরা ৬.০০ টাকা। এখন ধরা যাক, কোন পুজিঁপতির সমানে কয়েকটি আবাসিক গৃহ নির্মাণ এবং একটি জাকালো সিনেমা হল নির্মাণ, এ দুটি পৃথক প্রকল্প পেশ করা হলো। আরও ধরা যাক যে, প্রথম প্রকল্প হতে শকরা ৬ ভাগের কম মুনাফা পাওয়ার আশা আছে; আর দ্বিতীয় প্রকল্প থেকে শতকরা ৬ ভাগের অধিক মুনাফা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বিনিয়োগকারী কোন প্রকার দ্বিধা না করেই দ্বিতীয় প্রল্পটিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত করবে এবং প্রথম প্রকল্পের দিকে একবারও ফিরে তাকাবে না। ব্যাপার এখানেই শেষ হবে না; বরং উক্ত বিনিয়োগকারী সর্বদাই চেষ্টা করবে সুদের হার শতকরা ৬ ভাদ অপেক্ষা বেশি হারে মুনাফা অর্জন করতে এবং এজন্য সে নৈতিকতাবিরোধী পন্হা অবলম্বন করতে হলেও তাতে কুণ্ঠিত হবে না। নৈতিকতাসম্পন্ন এবং কল্যাণকর চিত্র প্রদর্শন করে যদি শতকরা ৬ ভাগের বেশি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব না হয়, তাহলে অবশ্যই সে নৈতিকতাবিরোধী ও অশ্লীল চিত্র প্রদর্শন করতে শুরু করবে এবং এজন্য এমনভাবে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাতে থাকবে যাতে হাজার হাজার মানুষ প্রেক্ষাগৃহের দিকে ছুটে আসবে। এই হচ্ছে সুদের কৃতিত্ব।
সুদ না থাকলে উক্ত দু’টি প্রকল্পের মধ্যে প্রথমটিতেও পুজিঁ প্রবাহিত হবার সম্ভাবনা থাকবে; এমনকি, নৈতিকতাসম্পন্ন বিনিয়োগকারীগণ কোন অবস্থাতেই দ্বিতীয়টিতে অর্থ বিনিয়োগে রাজি হবে না। তাছাড়া শতকরা ৬ ভাগের বেশি মুনাফা অর্জন করার জন্য অনৈতিক পন্হার আশ্রয়ও সে নেবে না। কেননা এক্ষেত্রে অর্জিত মুনাফা থেকে ৬% সুদ পরিশোধ করার প্রশ্ন থাকবে না এবং ৬% মুনাফাকে বিনিয়োগকারী তার জন্যে যথেষ্ট মনে করবে।
সুতরাং একথা বলা যায় যে, সুদ না থাকলে পুজিঁপতি ও ব্যাংকারগণ লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হবে। বিনিয়োগকারীগণ যে মুনাফা অর্জন করবে, তারই অংশ পুজিঁপতিকে দেবে। ফলে উদ্যোক্তা সুদের হারের অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করতে বাধ্য হবে না এবং কেবল স্বাভাবিক মুনাফাটুকু পেলেই বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। ফলে সুদী ব্যবস্থায় যেসব খাত বঞ্চিত ও অবহেলিত থাকে, সেসব খাতে বিনিয়োগে তেমন কোন বাধা থাকবে না। অর্থনীতির উন্নয়ন ভারসাম্যপূর্ণ হবে। নৈতিকতা পরিপন্হী খাতে পুজিঁ প্রবাহিত হওয়ার আশংকাও তেমন থাকবে না।
vii) সুদ দীর্ঘ মেয়াদী উৎপাদনশীল বিনিয়োগ হ্রাস করে
সুদী অর্থনীতিতে ব্যাংকার ও পুজিঁপতিগণ ফটকাবাজারীর জন্য পুজিঁর একটা বিরাট অংশ নগদ ধরে রাখে। এছাড়া ভবিষ্যতে যে কোন সময়ে সুদের হার বেড়ে গেলে বেশি সুদে অধিক পুজিঁ খাটিয়ে যাতে উচ্চহারে সুদ অর্জন করতে পারে, সে উদ্দেশ্যেও তারা পুজিঁকে নগদ হাতে রেখে দেয় অথাব স্বল্প মেয়াদী ঋণে পুজিঁ খাটায়। ফলে সুদী অর্থনীতিতে স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘ মেয়াদী ঋণের জন্য পুজিঁর অভাব দেখা দেয়। দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ না পাওয়ার ফলে উৎপাদনকারী শিল্পপতিগণও স্বল্পোদ্যমের পরিচয় দিতে বাধ্য হয় এবং স্থায়ী কল্যাণ ও উন্নতির জন্য কিছু করার পরিবর্তে কেবল চালু কাজটি চালিয়ে যাওয়ার কৌশল গ্রহণ করে। স্বল্প মেয়াদী ঋণের দ্বারা অত্যাধুনিক মেশিন ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এজন্য তারা পুরোনো মেশিন ও যন্ত্রাদির সাহয্যে বেশি সময় ধরে কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যতক্ষণ তাদের পণ্যের বাজার থাকে ততক্ষণ তারা এভাবেই উৎপাদন চালিয়ে যায়। এইরূপে তারা ঋণ ও সুদ পরিশোধ এবং নিজেদের জন্য মুনাফা অর্জন করতে থাকে। অতঃপর বাজারে যখনই পণ্যের চাহিদা কমে যায়, তখনই তারা পণ্য উৎপাদনের গতি অব্যাহত রাখার সাহস হারিয়ে ফেলে এবং উৎপাদন হ্রাস করে দেয়। বাজারে পণ্যের দাম কমে গেলে দেউলিয়া হয়ে যাবে, এই ভয়েই তারা এরূপ ব্যবস্থা নেয়। এভাবে অর্থনীতিতে চরম সংকট দেখা দেয়।
অতঃপর সুদী অর্থনীতিতে বৃহৎ শিল্প-কারখানা ও কারবারের জন্য দীর্ঘ মেয়াদের বিত্তিতে যে স্বল্প পরিমাণ ঋণ পাওয়া যায়, নির্ধারিত সুদের কারণে তাও আবার বড় রকমের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ সাধারণতঃ দশ, বিশ বা ত্রিশ বছরের জন্য নেওয়া হয়। আর ঋণ প্রদান ও গ্রহণের সময়েই সমগ্র মেয়াদের জন্য বার্ষিক সুদের হার নির্ধারণ করা হয়। সুদের এ হার নির্ধারণকালে পরবর্তী দশ, বিশ বা ত্রিশ বছরে দ্রব্যমূল্যের উঠা-নামা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, ঋণগ্রহীতার মুনাফায় কি পরিমাণ কম-বেশি হবে অথবা আদৌ তার কোন মুনাফা হবে কিনা এসব বিষয়ে কারোই কোন জ্ঞান থাকে না। ফলে এসব দিকে দৃষ্টি রেখে সুদের হার নির্ধারণ করারও কোন প্রশ্ন উঠে না। অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতই এরূপ সুদী ঋণের চুক্তি সম্পাদনা করা হয়। অতঃপর ভাগ্য যদি ভাল হয় এবং যদি ঋণগ্রহীতার উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা ও দাম বহাল থাকে, তাহলে নিয়মিতভাবে আসল ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়। কিন্তু কোনরূপ ব্যতিক্রম ঘটলে ঋণগ্রহীতাকে দেউলিয়া হতে হয়, অথবা দেউলিয়াত্বের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে অবৈধ কাজ-কর্ম করতে বাধ্য হয়। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মনে করা যাক, কোন একজন উৎপাদনকারী ১৯৭০ সালে শতকরা বার্ষিক ৬ ভাদ সুদের হারে ২০ বছরের জন্য একটি বড় অংকের ঋণ গ্রহণ করল এবং এর দ্বারা বড় ধরনের কোন উৎপাদন কাজ শুরু করল। এখন ঋণগ্রহীতাকে প্রতিবছর নিয়মিতভাবে এই আসল অর্থের কিস্তিসহ সুদ পরিশোধ করে যেতে হবে। কিন্তু এই দীর্ঘ মেয়াদের মধ্যে যদি কোন কারণে দ্রব্যমূল্য কমে যায় অথবা উৎপাদন ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, তাহলে নিয়মিত কিস্তি ও সুদ পরিশোধ করা ঋণগ্রহীতার পক্ষে সম্ভব হবে না, অথবা তাকে দেউলিয়াত্ব বরণ করে নিতে হবে অথবা অন্য কোন অবৈধ কাজ-কারবারের মাধ্যমে তাকে টিকে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
যদি সুদের প্রচলন না থাকে, তাহলে প্রথমতঃ ফটকাবাজারীর উদ্দেশ্যে এবং ভবিষ্যতে বেশি হারে সুদ পাওয়ার আশায় ব্যাংকার ও ঋণদাতা কর্তৃক নগদ পুজিঁ ধরে রাখার আর কোন কারণ থাকবে না। সুদহীন অর্থনীতিতে ঋণ সাধারণতঃ লাভ-ক্ষতির অংশীদারীর ভিত্তিতে দেওয়া হবে এবং সে অবস্থায় বিনিয়োগ ও উৎপাদনকারীগণ বেশি হারে মুনাফা অর্জন করণে পুজিঁপতিগণও বেশি লাভ পাবে; আর উৎপাদনকারীদের লাভ কম হলে, পুজিঁপতিদের অংশেও কম লাভ আসবে। সুতরাং এক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণের জন্য ঋণযোগ্য তহবিলের অভাব সেরূপ হবে না, যেরূপ সুদী অর্থনীতিতে হয়ে থাকে।
দ্বিতীয়তঃ সুদমুক্ত অর্থনীতিতে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণগ্রহীতাকে সকল অবস্থাতেই নির্ধারিত হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে না; বরং কারবারে বেশি লাভ হলে সে ঋণদাতাকে বেশি মুনাফা দেবে, কম লাভ হলে কম দেবে এবং লাভ না হলে বা লোকসান হলে তারও আনুপাতিক অংশ ঋণদাতার ওপর চাপাতে পারবে। ফলে সুদী ব্যবস্থায় নির্ধারিত সুদের বোঝা বহন করতে গিয়ে এসব ঋণগ্রহীতার যেভাবে দেউলিয়াত্ব বরণ করতে হয়, সুদমুক্ত অর্থনীতিতে তার আশংকা একবারেই থাকবে না বলা যায়।
viii) সুদ সঞ্চয়কারীদের মধ্যে অলসাত সৃষ্টি করে
সুদী অর্থনীতিতে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে বিনা পরিশ্রমে ও বিনা ঝুকিতে নিশ্চত সুদ পাওয়া যায়। এই অবস্থা সঞ্চয়কারীদের অলস ও অকর্মণ্য বানিয়ে দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প তথা উৎপাদন কাজে যে চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং পরিশ্রম ও ঝুকিঁ গ্রহণের দরকার হয়, সঞ্চয়কাররিগণ তা কারতে রাজি হয় না; বরং তারা সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রেখে নির্ধারিত ও নিশ্চিত আয় পেয়ে সন্তুষ্ট থাকে এবং একেই নিরাপদ মনে করে। নির্ধারিত, নিশ্চিত ও নিরাপদ আয়ের পথ পরিহার করে ঝুকিঁপূর্ণ বিনিয়োগের দিকে যেতে চায় না। এ ব্যাপারে জন লক বলেছেন, “সুদ ব্যবসাকে ধ্বংস করে দেয়। মুনাফার চেয়ে সুদ বেমি সুবিধাজক। ব্যবসায়ীরা সুদপ্রাপ্তির নিশ্চয়তার লোভে ব্যবসা পরিহার করে সুদ অর্থ খাটায়”। [কীনস, পূর্বোল্লেখিত, পৃঃ ৩৪৪: “Locke quotes from A Letter to a Friend concerning Usuty; High interest decays Trade. The advantage from Lnterest is greater than the Profit from Trade, which makes the rich Merchants give over, and put out their Stock to Interest, and the lesser Merchants Break.”] বিষয়টি এভাবেব বললে বুঝতে সহজ হবে: মনে করা যাক, কোন একজন লোক কোনক্রমে এক কোটি টাকার মালিক হলো এবং এই এক কোটি টাকা ব্যাংকে জমা রাখল। ব্যাংক যদি এই আমানতের ওপর ১০% সুদ দেয়, তাহলে উক্ত জমাকারী বছরে মোট ১০,০০,০০০ টাকা সুদ পাবে। সুদের এই আয়ের দ্বারা তার সংসার চলে যাবে এবং সে আর কোন কাজ-কর্ম করবে না। বিনা পরিশ্রম ও ঝুকিঁমুক্ত এই নিশ্চিত আয়কে সে যথেষ্ট মনে করবে।
কিন্তু যে লোক কোটি টাকার মালিক হতে পারে তার নিজস্ব বুদ্ধি, মেধা ও দ্ক্ষতা কম হবার কথা নয়। এক কোটি টাকা রেকে নিশ্চত আয় পাওয়ার ফলে সে আর তার প্রতিভাকে কাজে লাগাল না। এই হচ্ছে সুদের অবদান! সুদের ফলে এভাবেই ব্যাপক সংখ্যক যোগ্য সঞ্চয়কারীর চিন্তা, মেদা, শ্রম ও ঝুকিঁ গ্রহণের সুফল থেকে অর্থনীতি বঞ্চিত হয়, বরং ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
সুদী পদ্ধতিতে নির্ধারিত, নিশ্চিত, নির্ঝঞ্ঝাট, ঝুকিঁমুক্ত ও নিরাপদ আয় পাবার লোভ সঞ্চয়কারী ও পুজিঁ মালিকদেরকে বিনিয়োগ বিমূখ করে তোলে। তারা বিনিয়োগের ঝামেলা, শ্রম ও ঝুকিঁ গ্রহণ অপেক্ষা নির্ধারিত সুদের ভিত্তিতে অর্থ খাটাতে আগ্রহেী হয়ে উঠে। এ প্রসঙ্গে জেমস রবার্টসন তাঁর অতি উন্নত মানের গবেষণা গ্রন্হ Transforming Economic Life: A Millennial Challenge- এ লিখেছেন, “অর্থ বাড়াতে হবে (money must grow) এই অনুজ্ঞা পরিবেশগত দিক থেকে (ecologically) ধ্বংসাত্মক। এর ফলে মানুষের কর্ম প্রচেষ্টা প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী ও সেবা উৎপাদনের কাজ থেকে বিমূখ হয়ে যায় এবং অর্থ থেকে অর্থ উপার্জনে মগ্ন হয়ে পড়ে”। [James Robertson: Transforming Economic Life: A Millennial Challenge, Green Book, Devon 1998; উদ্ধৃত, তকি উসমানী, পূর্বোক্ত, পৃ: ৮৮।]
সুদ না থাকলে সঞ্চয়কারীগণ নিজেরা অথবা অন্য কোন বিনিয়োগকারীর মাধ্যমে অংশীদারী ভিত্তিতে তাদের সঞ্চয় উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগ করবে এবং নিজেদের প্রতিভা ও দক্ষতা খাটিয়ে মুনাফা বৃদ্ধি করার প্রয়াস পাবে। অর্থনীতি এদের মেধা ও শ্রম থেকে উপকৃত হবে এবং তারা নিজেরাও অধিকতর লাভবান হবে। তাছাড়া, সুদবিহীন অর্থনীতিতে সঞ্চয়কারীগণ যখন তাদের সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রাখবে, তখনও তারা সে রকম অলসতা প্রদর্শন করবে না, যে রকম সুদী অর্থনিতিতে করে থাকে। সুদমুক্ত ব্যাংকে অর্থ জমাকারীগণ প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকের লাভ-ক্ষতিতে অংশীদার হবে। যদি ব্যাংকের বিনিয়োগ ও কারবার সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখা, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া, ইত্যাদি কাজ করতে বাধ্য হবে। ফলে অর্থনীতি এদের অবদান থেকে বঞ্চিত থাকবে না।
ix) সুদ পুঁজিপতিদের স্বেচ্ছাচারী আচরণে বাধ্য করে
সুদী অর্থনীতিতে পুজিঁপতি ও ব্যাংকারগণ সর্বদাই অধিক সুদ পাবার লক্ষ্য সামনে রেখে ঋণ দিয়ে থাকে। অর্থনীতির প্রায় গোটা মূলধন পুজিঁপতি ও ব্যাংকারদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে তারা যখন খুশী ঋণ সংকোচন এবং যখন খশী সম্প্রসারণ করতে পারে। তারা যখন মনে করে যে, ঋণের পরিমাণ বাড়ালে তারা বেশি ফায়দা পাবে, তখন তারা ঋণ বাড়িয়ে দেয়; আবার যখন ঋণ কমিয় দিলে বেশি লাভবান হবে বলে তাদের ধারণা হয়, তখন তারা ঋণ কমিয়ে দেয়। এভাবে যখন ঋণ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলেই তাদের স্বার্থ রক্ষা পাবে বলে মনে করে, তখন তারা ঋণ দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। তাদের এই স্বেচ্ছাচারী আচরণের ফলে অর্থনীতি ও সমাজের কি লাভ বা ক্ষতি হলো সেদিকে দৃষ্টি দেবার কোন প্রয়োজনই তারা বোধ করে না। অর্থনীতির স্বাভাবিক চাহিদা এবং যথার্থ প্রয়োজনের দিকটি তারা আদৌ বিবেচনা করে না। ফল এই দাঁড়ায় যে, অর্থনীতিতে যখন ঋণের প্রয়োজন কম থাকে, তখন পুজিঁপতিগণ সুদের হার কমিয়ে দেয় এবং বেশি বেশি দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। কিন্তু ঋণের চাহিদা যখন বেড়ে যায় এবং উৎপাদন ও উন্নয়নমুখী কাজের জন্য প্রচুর ঋণের প্রয়োজন হয়, তখন পুজিঁপতিগণ তাদরে ঋণের পরিমাণ কমিয়ে সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। এভাবে ঋণের চাহিদা যত বাড়তে থাকে সুদের হারও তত বেড়ে যায় এবং অবশেষে তা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌছেঁ যে, অতঃপর এত চড়া সুদের হারে ঋণ নিয়ে কারবারে খাটালে তাতে মুনাফা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না। এ পর্যায়ে এসে পুজিঁ বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়, অর্থনৈতিক উন্নতিতে সহসা ভাড়া পড়ে এবং সমগ্র অর্থনীতি মন্দাভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় পুজিঁপতি ও ব্যাংকারগণ তাদের পূর্বের ঋণ ফেরত পাবার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং ঋণগ্রহীতাদের ওপর চাপ দিয়ে তাড়াতাড়ি ঋণ ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করে, অথচ এ সময়ে ঋণগ্রহীতাদের অবস্থা থাকে সবচেয়ে সংকটময়। প্রকৃতপক্ষে ঋণদাতাদের এ আচরণকে “এমন এক ছাতার মালিকের সাথে তুলনা করা যায়, সে আবহাওয়া শুষ্ক থাকলে ছাতা ধার দেয়; কিন্তু বর্ষণ শুরু হওয়ার সাথে সাথে ছাতা ফেরত নিয়ে নেয়”। অথবা পুজিঁপতিদের এহেন আচরণকে এমন পানি সেচকারীর সাথে তুলনা করা যায়, যিনি কৃষিক্ষেতে পানির প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারে পানি দেওয়ার পরিবর্তে নিজের তৈরী নিয়ম অনুসারে ক্ষেতে পানি দিয়ে থাকেন। আর তার নিয়ম হচ্ছে যে, যখন ক্ষেতে পানির প্রয়োজন থাকে না, তখন সস্তা দামে পানি দিতে সে প্রস্তুত। কিন্তু যখন পানির দরকার হবে, তখন পারিন দাম বাড়িয়ে দেবে। এভাবে পানির প্রয়োজন যত বেশি হবে, দামও তত বাড়তে থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত পানির দাম এত বাড়িয়ে দেবে যে, দামে পানি সেচ করে ফসল ফলানো আদৌ লাভজনক হবে না। পানির এই মালিক কৃষি, তথা খাদ্য উৎপাদনে যে ক্ষতি করে, পুজিঁপতিগণও অতি মাত্রায় সুদের লোভে অর্থনীতির অনুরূপ ক্ষতি সাধন করে থাকে”। [মওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ’লা, পূর্বোল্লোখিত, পৃঃ ৬৩।
৩) উৎপাদনের ওপর
উপরের আলোচনায় দেখানো হয়েছে যে, সুদী অর্থনীতিতে পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা যেখানে সুদের হারের সমান হয় বিনিয়োগ সেখানেই থেমে যায় এবং সুদের হার শূন্য হলে পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা শূন্য হওয়া পর্যন্ত আরও যে পরিমাণ বিনিয়োগ হতে পারত, সেখানে তা বেকার থেকে যায়। এছাড়া, সুদী ব্যবস্থায় যথেষ্ট মূলধন গঠিত হয় না, আর যাও বা হয় তারও একটা বিরাট অংশ অনুৎপাদনশীল ও ফটকা খাতে বিনিয়োগ করা হয়, আর একটা আংশকে অলস রাখা হয়, সুদী সমাজে পুজিঁর বরাদ্দ দক্ষতাপূর্ণ হয় না, সঞ্চয়কারীদের মধ্যে আলস্য সৃষ্টি হয় এবং কল্যাণকর, ঝুকিঁবহুল ও দীর্ঘ মেয়াদী উৎপাদন কাজে বিনিয়োগ হয় খুব কম। এসব কারণে বিনিয়োগ যতটা হওয়ার কথা সুদী অর্থনীতিতে তার চেয়ে অনেক কম হয় এবং উৎপাদনও কম থাকে। এছাড়া উৎপাদন ক্ষেত্রে সুদ আরও কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। নিম্নে উৎপাদনের ওপর সুদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলোঃ
i) সুদ দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে বিনিয়োগ–উৎপাদন কমিয়ে দেয়
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সুদী ব্যবস্থায় সুদ দ্রব্যমূল্যের সাথে যুক্ত হয় এবং সমহারে দ্রব্যমূল্যকে বাড়িয়ে দেয়। নিম্নের উদাহরণের সাহাস্যে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা যেতে পারেঃ
সুদী অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যয়= মজুরী+খাজনা+সুদ+মুনাফা=দ্রব্যমূল্য।
সুদমুক্ত অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যয়= মজুরী+খাজনা+মুনাফা=দ্রব্যমূল্য।
মনে করা যাক, কোন একটি দ্রব্য উৎপাদন করতে সুদমুক্ত অর্থনীতিতে মজুরী বাবদ ১০/টাকা, খাজনা বাবদ ৫/টাকা এবং মুনাফা বাবদ ২/টাকা ব্যয় হয়। এক্ষেত্রে দ্রব্যটির মোট উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ১০+৫+২ =১৭.০০ টাকা মাত্র। দ্রব্যটি বাজার ১৭ টাকায় বিক্রি করা যায়। কিন্তু সুদী অর্থনীতিতে যদি একই অবস্থা বিরাজ করে, তাহলে উক্ত ব্যয়ের সাথে উদ্যেক্তা কর্তৃক ঋণদাতাকে প্রদত্ত সুদ যুক্ত হবে। মনে করা যাক, ২০% হারে ১৫ টাকার সুদ হয় ৩.০০ টাকা। এই সুদ যোগ করে দ্রব্যটির উৎপাদন ব্যয় দাঁড়াবে ২০.০০ টাকা। দ্রব্যুট ২০.০০ টাকার কমে বিক্রি করা হলে উদ্যেক্তার লাভ কমে যাবে অথবা তাকে লাকসান দিতে হবে। সুতরাং সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যে পণ্যের দাম হচ্ছে ১৭ টাকা, সুদী অর্থনীতিতে তারই দাম দাঁড়াচ্ছে ২০.০০ টাকা। ফলে সুদী অর্থনীতিতে পণ্য-সামগ্রীর চাহিদা কম থাকে এবং বিনিয়োগ উৎপাদন কম হয়।
সুদী অর্থনীতিতে দ্রব্যসামগ্রীর দাম বাড়ার আর একটি কারণ হচ্ছে উৎপাদন সর্বাধিক না হওয়া। ইতোপূর্বে দেখানো হয়েছে যে, সুদী অর্থনীতিতে উৎপাদন সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাতে পারে না। ফলে এককপ্রতি উৎপাদন ব্যয় এবং দাম বেশি হয়। তাছাড়া উৎপাদন কম হওয়ায় যোগান কম হয় এবং এককপ্রতি গড় দাম বেড়ে যায়। এভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় তা চাহিদা ও উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
সুদ না থাকলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছবে এবং দ্রব্যমূল্যের সাথে সুদ যোগ হবে না। এককপ্রতি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাবে এবং দামও কম হবে এবং পণ্যের চাহিদা ও বিক্রয় বেশি হবে। উৎপাদনকারীর মোট মুনাফা বৃদ্ধি পাবে। তারা উৎসাহিত হবে এবং আরও অধিক বিনিয়োগ উৎপাদনে এগিয়ে আসবে। দ্রব্যের যোগান বাড়বে এবং দাম আরও কমে আসবে।
ii) সুদ জনগণের ক্রয়–ক্ষমতা হ্রাস করে বিনিয়োগ–উৎপাদন কমিয়ে দেয়
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, পণ্য-মূল্যের আকারে ভোক্তা জনসাধারণের কাছ থেকে সুদ তুলে এনে গুটি কয়েক পুজিঁপতির হাতে পুঞ্জীভূত করা হয়। এ অবস্থা ক্রমাগত চলতে থাকে। প্রতিদিন, প্রতিটি পণ্য ক্রয়ে সুদ দিতে দিতে গরীব ও মধ্যবিত্ত ভোক্তা জনগণের ক্রয়-ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়। অবস্থা এমন হয় যে, শার্টের তীব্র প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় ক্রয়-ক্ষমতার অভাবে শার্ট ক্রয় করে পিঠ আবৃত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে পণ্য-সামগ্রীর চাহিদা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়, বিনিয়োগ কমে যায় এবং উৎপাদন স্থবির হয়ে পড়ে। বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কাজ হারায় ও বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। চাহিদা, বিনিয়োগ ও উৎপাদন আর এক দফা হ্রাস পায়। এভাবেই সুদী অর্থনীতিতে ধাপে ধাপে বিনিয়োগ-উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে।
সুদ না থাকলে দ্রব্যমূল্যকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়ার মত মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হবে না, অনুৎপদনশীল খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে এবং পুজিঁকে অলসভাবে ধরে রাখার প্রবণতা থাকবে না। ফলে সুদী অর্থনীতিতে যেভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ে, সুদহীন অর্থনীতিতে সেভাবে বাড়বে না, জনগণের ক্রয়-ক্ষমতাও কমে যাবে না। তারা তাদের আয় দ্বারা সুদী অর্থনীতির তুলনায় বেশি পণ্য-সামগ্রী ও সেবা ক্রয় করে অধিক পরিমাণ চাহিদা পূরণ করতে পারবে। বিনিয়োগ-উৎপাদন ক্রমশঃ বাড়তে থাকবে।
iii) উৎপাদিত সম্পদ ধ্বংস করতে বাধ্য করে
সুদী অর্থনীতিতে মন্দা এক অনিবার্য অবস্থা। তাছাড়া মন্দা একবার এসেই শেষ হয় না, বারবার ঘুরে ঘুরে আসে। আর মন্দার সময়ে ক্রেতার অভাবে একদিকে বিপুল পরিমাণ পণ্য-সামগ্রী অবিক্রীত অবস্থায় গুদামজাত হয়; অন্যদিকে ক্রয়-ক্ষমতার অভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী ক্রয় করতে পারে না। এই অবস্থাতেও উৎপাদনকারীগণ কেবল বাজার নষ্ট হওয়া এবং ভবিষ্যতের মুনাফার ক্ষতি হবার আশংকায় তাদের গুদামজাত পণ্য কম দামে বাজারে ছাড়তে রাজি হয় না। এক্ষেত্রে উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের আচরণ এতটা অমানবিক হয় যে, তাদের উৎপাদিত পণ্য গুদামে পচে নষ্ট হয় অথবা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়, কিংবা সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়, কিন্তু কিছুতেই তারা অভাবী ও প্রয়োজনশীল মানুলের কাছে সামান্য কম দামে তা বিক্রি করে না অথবা বিনামূল্যে দান করে না। বিশ্বে এ ধরনের ঘটনা একবার দু’বার নয়, বহুবার ঘটেছে। উদাহরণ স্বরূপ, কয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হলোঃ
প্রথম যে ঘটনাটির উল্লেখ করা হচ্ছে তা ঘটেছিল ১৯১৪ সালে ব্রাজিলে। গানথার তার Inside Latin America বইটিতে ঘটনাটি এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যা যুগপৎ হাসি ও বেদনার উদ্রেক করে। ১৯১৪ সালে ব্রাজিলে ব্যাপক পরিমাণ উৎপাদিত কফি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত করা হয়। প্রথমে ঠিক করা হয় এগুলো পুতেঁ ফেলা হবে। কিন্তু দেখা গেল যে, প্রতিবস্তার ওজন ১৩২ পাউন্ড করে মোট চার মিলিয়ন বস্তার জন্য যে পরিমাণ স্থান খুঁড়তে হয় তার আয়তন হয় সমগ্র রোড আইল্যান্ডের সমান। তাছাড়া কফির মধ্যে সার জাতীয় পদার্থ নেই বলে তা পচে মাটিকেই নষ্ট করে দেবে। বিশেষজ্ঞরা আতংকগ্রস্ত হয়ে মাথা ঘামালেন। অবশেষে স্থির হলো মাটিতে পুঁতার পরিবর্তে কফিগুলো পানিতে ফেলে দেয়া হবে। হাজার হাজার বস্তা ভর্তি করে সমুদ্রে ফেলা হলো। এতে মাইলের পর মাইল সমুদ্র তীর নষ্ট হলো, বিপুল পরিমাণ মৎস সম্পদও ধ্বংস হলো। ফলে মাটি বা পানি কোনটার দ্বারাই সমস্যার সমাধান হলো না। শেষ পর্যন্ত স্থির করা হলো কফি আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হবে। কিন্তু দেখা গেল যে, কফির মধ্যে জলীয় অংশ থাকার ফলে কৃত্রিম জ্বালানি মিশিয়ে না দিলে তা পুড়বে না। সুতরাং কেরোসীন আমদানী করা দরকার হলো। হিসাবে দেখা গেল এভাবে এক বস্তা পফি পোড়ানো জন্য আধা পাউন্ড অর্থ খরচ হয়। তার ওপর জাহাজ ভাড়া, গুদাম ভাড়া, শ্রমিক ব্যয় এবং বিনষ্টকৃত কফির মল্যতো আছেই। শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলকে এর চার মিলয়ন বস্তা অতিরিক্ত শস্য ধ্বংস করার জন্য প্রতিবছর খরচ করতে হয় ২০,০০,০০০ (বিশ লাখ) পাউন্ড। [ডব্লিউ, সি, মিচেল: হোয়াট ভেবলেন থট, পৃ-XIIV; উদ্ধৃত করেছেন, শেখ মাহমুদ আহমদ, ইসলামের অর্থনৈতিক বিধান; পৃঃ ১৩।]
দ্বিতীয় ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন শেখ মাহমুদ আহমদ। তিনি দেখিয়েছেন যে, আমেরিকার বেকার শ্রমিকরা ক্যালিফোর্নিয়ার ফলের বাগানে কাজ করতে যায়। শ্রমিকের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে মজুরীর পরিমাণ কমে গিয়ে জীবন ধাণ (Subsistence level) মান স্তরে নেমে আসে। এরপরও নতুন শ্রমিকদের বেশি কিছু সংখ্যক বেকার থেকে যায়। এসব লোক অভুক্ত-অর্ধভুক্ত থেকে মৃত্যুর শিকার হয়। তখনও বাগানে ফলের উৎপাদন ছিল প্রচুর। মালিকাদের হিসাব মতে উৎপাদিত ফলের একটা অংশ নষ্ট করে দেয়ার প্রয়োজন হলো। চেরী ও স্ট্রবেরী ফল গাছে গাছে পচতে লাগল। হাজার হাজার লোক সামান্য মজুরীর বিনিময়ে সেগুলোআহরণ করতে প্রস্তুত ছিল; কিন্তু মালিকরা তাতে রাজি হলো না। [শেখ মাহমুদ আহমদ: পূর্বোল্লেখিত, পৃঃ ১৪।]
এরপর এলো কমলা লেবুর পালা। কমলা আহরিত হবার পর মালিকরা হিসাব করে দেখল, এসব কমলা বাজারে ছাড়া হলে কমলার দাম পড়ে যাবে। সুতরাং উৎপাদিত কমলার এক বিরাট অংশ নষ্ট করে ফেলার সিদ্ধান্ত হলো। সুস্বাদু কমলাগুলো সোনার পাহাড়ের মত এক স্থানে জড়ো করা হলে এবং এর ওপর পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হলো। অথচ এ সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় অসংখ্য শিশু পুষ্টিহীনতায় ধুঁকছিল। কমলা পুড়িয়ে দেয়া হলো; কিন্তু এসব শিশুকে সস্তায় কমলা খাবার সুযোগ দেয়া হলো না। [উপরোক্ত, পৃঃ ১৪।]
বিগত মন্দার সময়েও ধাটি ধাটে উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী বিনষ্ট করা হয়েছে। ১৯৩৪ সালে এক মিলিয়ন কমলা লিভারপুল বন্দরের কাছে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল বাজারে কমলালেবুর সরবরাহ কমিয়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। অথচ এ সময়ে লিভারপুলের গরীব বাচ্চাদের জন্য কমলালেবু ছিল এক দুর্লভ বস্তু। [আর, পি, দত্ত: ফ্যাসিজম এন্ড সোশ্যাল রিভোলিউশন, পৃঃ ৪৫, উদ্ধৃত করেছেন , শেখ মাহমুদ আহমদ, উপরোক্ত, পৃঃ ১৫।]
বাজার পড়ে যাবার ভয়ে সম্পদের এই বিনাশ সাধনকে অর্থনীতির ভাষায় ডাম্পিং বা খালাস প্রথা বলা হয়েছে। এ কাজ যে নিতান্তই অমানবিক, তাতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়; কিন্তু যারা এ কাজ করে তারা চাহিদা ও যোগানের সমস্যার কারণেই করতে বাধ্য হয়। জনগণের ক্রয়-ক্ষমতা থাকে না বলে চাহিদা পড়ে যায়, আর কারবারী সমাজ চাহিদার স্বল্পতা দেখে উৎপাদন সংকুচিত করে বা উৎপাদিত সম্পদের ধ্বংস সাধন করে।
এ সমস্যার একমাত্র সঠিক সমাধান হচ্ছে পণ্য-সামগ্রীর উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং মূল্য হ্রাস করা। তাছাড়া জনগণের ক্রয়-ক্ষমতা বাড়িয়ে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করার মাধ্যমেও সমস্যার সমাধান হতে পারে। সুদের বিলোপ সাধন করা হলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমে আসবে এবং মূল্য হ্রাস পাবে। তাছাড়া সুদের যাঁতাকল থেকে মুক্ত হয়ে বিভিন্নমুখী উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং লক্ষ লক্ষ বেকার মানুষের কর্মসংস্থান করা সম্ভব হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেলে ক্রয়-ক্ষমতা বাড়বে; আর বর্ধিত ক্রয়-ক্ষমতা চাহিদা বাড়াবে। ফলে পণ্য-দ্রব্য পুড়ে ফেলা বা সমুোদ্র নিক্ষেপ করার পরিবর্তে কম দামে বাজারে বিক্রি করা লাভজনক হবে। অসংখ্য ভুখা-নাঙ্গা মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবে।
এ পর্যন্ত অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন ক্ষেত্রে সুদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এতে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, সুদী অর্থনীতিতে সর্বাধিক বিনিয়োগ ও সর্বাধিক উৎপাদন হয় না এবং মূলধন গঠন বাধাগ্রস্ত হয়। ব্যাংকে গচ্ছিত মূলধনের একটা বিরাট অংশ অনুৎপাদনশীল খাতে খাটানোহয় এবং আর একটা অংশ অলসভাবে নগদ ধরে রাখা হয়। মূলধনের বিনিয়োগ-বরাদ্দও যথার্ত দক্ষতাপূর্ণ হয় না এবং জনকল্যাণমূলক খাতগুলোর জন্য মূলধন যোগন দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। দীর্ঘ মেয়াদী পুজিঁর অভাব দেখা দেয় এবং নির্ধারিত সুদের শর্ত থাকার দরুন দীর্ঘ মেয়াদী ঋণগুলো প্রায়ই ঋণগ্রহীতাদের দেউলিয়াত্বের কারণ হয়। তাছাড়া নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত সুদের লোভ অর্থনীতিতে প্রতিভাবান লোকদের মেধা ও শ্রম থেকে উপকৃত হবার পথ রুদ্ধ করে দেয়। সর্বোপরি পুজিঁপতিদের স্বেচ্ছাচারমূলক আচরণ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং উৎপাদিত সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চরম সংকটে ঠেলে দেয়।
খ) বন্টন ক্ষেত্রে সুদের প্রভাব
সুদ সম্পদ ও আয়ের বন্টন ক্ষেত্রেও মারাত্মক জুলুম ও বৈষম্য সৃষ্টি করে। পরবর্তী পর্যায়ে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হচ্ছে।
১. সুদ নিদারুণ বে–ইনসাফীর জন্ম দেয়
সুদী ব্যবস্থায় ঋণগ্রহীতা, ঋণদাতা, ব্যাংকার ও ডিপোজিটর সকলেই ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে বে-ইনসাফী ও জুলুমের শিকার হয়। তবে সকল জুলুমের চূড়ান্ত দায়ভার আসলে সাধারণ জনগণকেই বহন করতে হয়।
সুদ ঋণগ্রহীতাদের ওপর জুলুম চাপিয়ে দেয়ঃ পুজিঁবাদের সুদী বন্টন ব্যবস্থায় ভূমি এর সেবার বিনিময় হিসেবে নির্ধারিত কারবারে খাটানোর জন্য সে ঋণ দেয় তার বিনিময়/কাউন্টাল ভ্যালু হিসেবে সে সমপরিমাণ অর্থ ফেরত নিয়ে নেয়। অতঃপর কাউন্টার ভ্যালুর ওপর নির্ধারিত সুদ নেয় কোন বিনিময় ছাড়া, মাগনা, শুধু চুক্তির বলে। আবার চুক্তিতে যদি চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ লেনদেনের শর্ত থাকে, তাহলে ঋণদাতা চক্রবৃদ্ধি হারেই সুদ নেয়। এই সুদ পরিশোধ করার পর উদ্বৃত্ত থাকলে উদ্যোক্তা লাভ পায়, উদ্বত্ত না থাকলে সে কিছুই পায় না; আর কারবারে লোকসান হলে সুদ প্রদন ও আসলের ঘাটতি পূরণের সাকুল্য বোঝা ঋণগ্রহীতাকেই বহন করতে হয়। এভাবে যে খাটে, ঝুকি নেয়, সময় ব্যয় করে তাকে সাকল্য লোকসানের বোঝাতো বহন করতেই হয়, তার ওপরে সুদের বোঝাও তাকেই টানতে হয়; অপরদিকে যে বিনিময় না দিয়ে মাগনা নেয় তার আয় হয় নির্ধারিত, নিশ্চিত ও নিরাপদ। ঋণগ্রহীতার ওপর এটি একটি অতি বড় জুলুম।
সুদ ঋণদাতা ও ব্যাংকারের ওপর বে-ইনসাফী করেঃ ঋণগ্রহীতার কারবারে যদি বিপুল পরিমাণ লাভ হয়, তাহলে ঋণদাতা কেবল নির্ধারিত হারে সুদই পায়, আর গোটা লাভ ঋণগ্রহীতা একাই নিয়ে যায়। এতে আবার ব্যাংকার ঋণদাতার ওপর জুলুম করা হয়।
সুদ ডিপোজিটরদের বঞ্চিত করেঃ সুদী ব্যবস্থায় ঋণগ্রহীতা বিনিয়োগকারীদের নিজস্ব পুজিঁ থাকে খকুবই কম, মোট পুজিঁর ১০%, ২০%, বা ৩০%; আর বাকি বেশির ভাগ পুজিঁ তারা নেয় ব্যাংক থেকে যার প্রকৃত মালিক হচ্ছে ডিপোজিটরগণ। অন্য কথায় বলা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারবারের ৭০% অর্তের মালিক আসলে ডিপোজিটরগণ। আর মাত্র ৩০% এর মালিক হচ্ছে উদ্যোক্তা। অথচ কারবারে অর্জিত বিপুল মুনাফার মাত্র ৫% থেকে ৭% দেওয়া হয় ডিপোজিটরদের অর্থাৎ ৭০% অর্থের মালিককে, আর মধ্যস্থতাকারী ব্যাংক পায় ৫%-৭%; অবশিষ্ট ৮৯-৮৫% নিয়ে যায় উদ্যোক্তাগণ, যারা মাত্র ৩০% অর্থের মালিক। তাছাড়া ডিপোজিটরগণ তাদের ডিপোজিটের ওপর যে হারে সুদ পায়, ভোক্তা হিসেবে দ্রব্য-সামগ্রীর দামের সাথে তার চেয়ে অধিক হারে সুদ তাদেরকে আবার দিতে হয়। ফলে তাদের নীট আয় দাঁড়ায় আসলে ঋণাত্মক। এব্যাপারে কথা শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়ালো যেস যাদের অর্থ, যারা সঞ্চয় করে ব্যাংকে জমা রাখে তারা পায় ঋণাত্মক আয়; আর যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তারা হয় ৮০-৯৫ বা ৯০% মুনাফার ভাগীদার।
সুদ এর চুড়ান্ত বোঝা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ঃ সর্বোপরি, সুদ এর চূড়ান্ত বোঝা ক্রেতাদের ওপর চাপিয়ে দেয়; চুড়ান্তভাবে বর্ধিত দ্রব্যমূল্য আকারে সুদের সাকুল্য বোঝা আসলে ক্রেতা সাধারণের ওপরই নিপতিত হয়।
২. সুদ বেকারত্ব বৃদ্ধি করে
সুদ কেবল বেকার সমস্যা সৃষ্টিই করে না, বেকারত্ব বৃদ্ধিও করে। বেকার সমস্যা সুদী অর্থনীতির একটা অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে, সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়, সুদী অর্থনীতিতে বিনিয়োগ তার চেয়ে কম হয়। সুদী অর্থনীতিতে পুজিঁর প্রান্তিক দক্ষতা যেখানে সুদের হারের সমান হয়, বিনিয়োগ সেখানেই থেমে যায়। অতঃপর পুজিঁর প্রাস্তিক দক্ষতা শুন্যে আসা পর্যন্ত যে পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করা যেত, সে পরিমাণ পুজিঁ অনিয়োজিত অথবা বেকার থেকে যায়। পুজিঁর এই বেকার অংশটুকু বিনিয়োগ করে যে পরিমাণ শ্রমিকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব এবং যে পরিমাণ অন্যান্য বস্তুগত সম্পদরে ব্যবহার করা যায়, সুদী অর্থনীতিতে তার সবটাই বেকার থাকতে বাধ্য হয়। সুতরাং সুদী অর্থনীতিতে মানবীয় সম্পদের ক্ষেত্রেই শুধু বেকারত্ব সৃষ্টি হয় তা নয়, বরং সেই সাথে অন্যান্য বস্তগত সম্পদের পূর্ণ ব্যবহারও সম্ভব হয় না। পূর্বে উল্লেখিত ছকে দেখানো হয়েছে যে, সুদের হার ২০% হলে উদ্যোক্তা ৪র্থ একক পর্যন্ত বিনিয়োগ করবে। আর সুদ না থাকলে সে ৬ষ্ঠ একক পর্যন্ত বিনিয়োগ করবে। সুতরাং সুদের হার ২০% হলে এই দুই একক পুজিঁ এবং তার সাথে নিয়োগযোগ্য শ্রমিক ও বস্তুগত সম্পদ বেকার ও অব্যবহৃত থাকতে বাধ্য হবে।
এছাড়া সুদী অর্থনীতিতে ফটকাবাজারীর উদ্দেশ্যে অলস ধরে রাখা ও অনুৎপাদনশীল খাতে ঠেলে দেয়ায় পুজিঁর একটা বিরাট অংশ উৎপাদনশীল খাতে প্রবাহিত হয় না বলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ও সম্পদ বেকার থাকতে বাধ্য হয়। সর্বোপরি পুজিঁপতিদের স্বেচ্ছাচারী আচরণ ও মন্দার ফলে ধাপে ধাপে বিনিয়োগ হ্রাস করে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে বেকার সমস্যাকে প্রকটতর করে তোলা হয়।
উপরের আলোচনায় প্রধানতঃ সংকটকালে সৃষ্ট বেকার সমস্যার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এজন্য যে, মন্দার সময় সুদী অর্থনীতির দোষ-ক্রটিগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং সমস্যা জটিলতর হয়। আসলে সুদী অর্থনীতিতে এসব দোষ সব সময়েই বর্তমান থাকে; এমনকি, চরম ব্যবসায়িক সাফল্যের সময়েও বেকারত্ব বর্তমান থাকে। উদাহরণস্বরূপ ১৯২৭ সালের কথা উল্লেখ করা যায়। এটি ছিল বাণিজ্যিক চরম সাফল্যের বছর। পুজিঁবাদী দেশগুলো ছিল সন্তুষ্ট। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সে সময়ে উৎপাদনক্ষম সম্পদ পুরোপুরি বিনিয়োগ করা যায়নি। এশিয়া ও আফ্রিকার লক্ষ লক্ষ অসহারয় মানুষের কথা বাদ দিলেও খোদ পুজিঁবাদী পশ্চিমা দেশসমূহে লাখ লাখ শ্রমিক এসময়ে বেকার ছিল। একটা অসম্পূর্ণ হিসাব থেকে জানা যায় যে, ১৯২৯ সালে ইটালিতে ৩,০৯,০০০, অষ্ট্রেলিয়ায় ২,২৫,০০০, পোল্যান্ডে ১,৭০,০০০, ইংল্যান্ডে ১২,০৪,০০০ এবং জার্মানীতে ২,৮৪,০০০ লোক বেকার ছিল। [শেখ মাহমুদ আহমদ, উপরোক্ত, পৃঃ ১২।] বর্তমানে বিশ্বের সর্বাধিক ধনশালী দেশ আমেরিকার দিকে তাকালেও দেখা যায় যে, সেখানে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ছয় ভাগের এক ভাগ লোক বেকার রয়েছে এবং দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে”। [আফজালুর রহমান, পূর্বোল্লোখিত, পৃঃ ১১৫।]
প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাপী একটা যুদ্বকালীন অবস্থা ব্যতীত অন্য সময় সুদী অর্থনীতি বেকার সমস্যা সমাধানে সম্পূর্ণ অসমর্থ; এমনকি উৎপাদনশীল সম্পদকেও পুরোপুরি কাজ লাগাতে পারে না। সবচেয়ে প্রাচুর্যের সময়েও প্রকৃত বেকার এবং কিছু মূলধন অব্যবহৃত অবস্থায় থেকেই যায়। এ ব্যাপারে কীনস তার জেনারেল থিওরীতে বলিষ্ঠভাবে লিখেছেন যে, সুদের হারের উপস্থিতিতে যুদ্ধকাল ছাড়া পূর্ণ কর্মসংস্থানের উপযোগী তেজীভাব আর কখনও দেখা দিয়েছে বলে আমার সন্দেহ হয়। [জে, এম, কীনস, পূর্বোল্লেখিত, পৃঃ ৩২২ : “Except during the war, I doubt if we have ang recent experience of a boom so strong that it led to full employment.”] কীনস বলেছেন, সুদের হার কমলে অর্থনীতির যেসব খাতে বিনিয়োগ সম্প্রসারিত হবে উচ্চ সুদের হার থাকাকালে সেখানে বিনিয়োগ লাভজনক হয় না। [ঐ, পৃঃ ১৯৩ : “A lower rate of interest stimulates an expansion of capita; investment in fields which at higher rates would be unprofitable.”]
প্রকৃতপক্ষে সুদ বিলোপ করা হলে বিনিয়োগরে ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে। কোটি কোটি লোকের কর্মসংস্থান সম্ভবপর হবে। এই সব মানুষের হাতে ক্রয়-ক্ষমতা আসবে; উৎপাদিত পণ্যসমগ্রীর ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হবে। উৎপাদনকারীদের পণ্যের বিক্রয় বেড়ে যাবে, মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। সঞ্চয়, মূলধন গঠন ও বিনিয়োগ সম্প্রসারিত হবে। সুতরাং সুদের হার হ্রাস পাওয়া মানেই সমৃদ্ধির পথে এক ধাফ অগ্রগতি।
৩. সুদ মজুরী হ্রাস করে
সুদী অর্থনীতিতে শ্রমিকের মজুরী সর্বদাই পিছিয়ে থাকে। সুদের ফলে একদিকে বিপুল সংখ্যক জনশক্তি বেকার থাকে, অন্যদিকে যারা কাজ পায় তারাও তাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হয়। একেতো বিনিয়োগ কম হওয়ার দরুন শ্রমের চাহিদা কম থাকে, তার ওপর আবার বেকারত্বের ব্যাপ্তির কারণে শ্রমের সরবরাহ থাকে অনেক বেশি। চাহিদার তুলনায় যোগানের আধিক্যের দরুন শ্রমের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। তাছাড় সুদের বোঝা বহন করারপর উদ্যোক্তাদের পক্ষে আবার মজুরী বাড়ানো সম্ভব হয় না। সুদের কারণে দ্রব্যের উৎপাদন খরচ ও দাম বেড়ে যায়। এরপর আবার মজুরী বেশি দিতে হলে উৎপাদন আর লাভজনক থাকে নাবলেই উৎপাদনকারিগণ মজুরী বৃদ্ধি করতে পারে না। তদুপরি কম মজুরীতে যখন প্রচুর শ্রম পাওয়া যায়, তখন তারা বেশি মজুরী দেবেই বা কেন!
সুদী অর্থনীতিতে একদিকে দ্রব্যসামগ্রীর বর্ধিত মূল্যের চাপ, অন্যদিকে কম মজুরী শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তোলে। শ্রমিকগণ জীবন বাঁচানোর তাকিদেই বিভিন্ন দাবী-দা্ওয়া নিয়ে মালিক পক্ষের সাথে দর-কষাকষি করতে বাধ্য হয়, যা প্রায় সময়ই শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের অবনতি ঘটায় এবং উৎপাদন ব্যাহত করে। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কর্মবিরতি, ধর্মঘট, ইত্যাদি নানাবিধ চাপ সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অপরদিকে মালিক পক্ষ থেকেও বন্ধ ঘোষনা, লক আউট ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমিয়ে দেওয়া হয়। বস্ততঃ এসব পদক্ষেপ উৎপাদনের পরিবেশ নষ্ট করে এবং উৎপাদনকে দারুণভাবে ব্যাহত করে।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সুদমুক্ত অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বেশি তথা পূর্ণ বিনিয়োগ হবে। বেকার সমস্যার প্রকটতা থাকবে না। ফলে শ্রমের চাহিদা বাড়বে, আর এজন্য মজুরীও বেশি হবে। সুদ না থাকার উদ্যোক্তাগণ সুদ পরিশোধ করার পর মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করবে না; বরং প্রচলিত সুদের হারের সমান বা তার চেয়ে কম মুনাফা পেলেও তারা উৎপাদন কাজ চালিয়ে যাবে। এজন্য শ্রমিককে অধিক মজুরী প্রদান করার পরও কারবার লাভজনক থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া মজুরী বেশি দিলে তা বিপুল সংখ্যাক মানুষের হাতে ক্রয়-ক্ষমতা সৃষ্টি করবে যা পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করবে। এতে উদ্যোক্তাদের বিক্রি ও মুনাফা বাড়বে। ফলে মালিকগণ শ্রমিকাদের দাবী-দা্ওয়া পূরণে সুদী অর্থনীতির ন্যায় একগুয়েঁমি প্রদর্শন করার পরিবর্তে সহানুভূতি এ সহমর্মিতা নিয়ে এগিয়ে আসবে। শ্রমিকদের পক্ষেও কর্মবিরতি ও ধর্মঘটের ন্যায় উৎপাদন ব্যাহতকারী পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে কোন সংগত যুক্তি থাকবে না। শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং অনূকূল পরিবেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
৪. সুদ অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূল কাণ হচ্ছে সুদ। সুদ নানা দিক থেকে এই বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং ধনী-দরিদ্রদের মধ্যে সৃষ্ট ব্যবধানকে আকাশচুম্বী করে তোলে।
প্রথমত, সুদের পূর্বনির্ধারিত এবং নিশ্চত আয়ের ব্যবস্থা থাকার ফলে ব্যাংকারগণ আমানতের ওপর অতি অল্প হারে সুদ দিয়ে জনগণের বিপুল পরিমাণ অর্থকে নিজেদের কুক্ষিগত করে নেয় এবং এ অর্থকে কয়েকগুণ বর্ধিত করে ধার দিয়ে তার ওপর সুদ আদায় করে নিজেরা বিজুল সম্পদের মালিক হয়।
উদাহরণ হিসেবে ১৯৭৬ সালে আমেরিকার বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহে শেয়ার হোল্ডারদের সর্বমোট শেয়ারের পরিমাণ ছিল ৭৩.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ সে সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১,০৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ শেয়ার মূলধনের চৌদ্দ গুণেরও অধিক সম্পদের অধিকারী ছিল। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকের বড় বড় শেয়ারের মালিক, যারা ব্যাসার আসল নিয়ন্ত্রণকারী, তাদের মালিকানায় ছিল মাত্র ১৬.৪ বিলিয়ন ডলার, যা এই বিরাট সম্পদের অতি নগণ্য অংশ মাত্র। [চাপরা, এম, উমর: ইসলামী অর্থনীতিতে মুদ্রানীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থার রূপরেখা, মোঃ শরীফ হুসাইন অনূদিত, ইসলামিক ইকোনকমক্স রিসার্চ ব্যুরো, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃঃ, ১৫।] সুদী ব্যবস্থা এভাবেই পুজিঁপতিদেরকে জনগণের টাকা খাটিয়ে নিজেদের সম্পদ দ্রুত বাড়ানোর সুযোগ করে দেয় এবং কতিপয় পুজিঁপতির হাতে বিপল সম্পদ কুক্ষিগত করে থাকে।
সুদী ব্যবস্থায় ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আকাশ-পাতাল বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ার আর একটি কারণ হচ্ছে, যারা ধনী, বিত্তবৈভব যাদের বেশি, সিকিউরিটি মর্টগেজ দেওয়ার মত সম্পদ যাদের আছে, তারাই ব্যাংক ঋণের সুবিধা বেশি পায়। অন্যদিকে যাদের মর্টগেজ নেই, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এবং প্রকল্পের মান উন্নততর ও অধিকতর উৎপাদনশীল হলেও তারা ব্যাংক ঋণ পায় না। লেস্টার থুরোর মতে, “যারা যোগ্য বা দক্ষ (smart or meritocratic) তারা নয়, বরং কেবল ভাগ্যবানরাই ঋণ পায়”। [থুরো, লেস্টার, জিরো সাম সোসাইটি, নিউইয়র্ক, ব্যাসিক বুকস, ১৯৮০, পৃ: ১৭৫, উদ্ধৃত, উসমানী, মোহাম্মদ তকি: পূর্বোল্লেখিত, পৃ: ৭৯।] মর্গান গ্যারান্টি টাস্ট কোম্পানীও স্বীকার করেছে যে, ব্যাংকিং পদ্ধতি উন্নয়নশীল (maturing) ছোট ছো ট কোম্পানী অথাব ভেঞ্চার কলাপিটালিস্টদের অর্থায়নে আগ্রহী হয় না। কিন্তু বৃহৎ ও সর্বাধিখ নগদ অর্তের অধিকারী কোম্পানীকে অর্থ যোগান দেয় অপেক্ষাকৃত নিম্ন সুদের হারে। [মর্গান গ্যারান্টি ট্রাস্ট অব নিউইয়র্ক, ওয়াল্ড ফইন্যান্সিয়াল মার্কেটস, জানুয়ারী, ১৯৮৭, পৃ: ৭; উদ্ধৃত উসমানী, মোহাম্মদ তকি, পূর্বোক্ত, পৃ; ৭৯-৮০।] ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য থেকে ওপরে উল্লেখিত বক্তব্যের সত্যতা প্রতীয়মান হয়। স্টেট ব্যাংকের তথ্যে বলা হয়েছে যে, ১৯৯৮ সালে ২,১৮৪,৪২৭ জন জমাকারীর মধ্যে মাত্র ৯,২৬৭ জন জমাকারী (মোট জমাকারীর মাত্র .৪২৪৩%) সর্বমোট ৪৩৭.৬৭ বিলিয়ন রূপী ব্যবহার করেছে যা ব্যাংকসমূহ থেকে প্রদত্ত ঋণের ৬৪.৫ শতাংশ। [স্ট্যাটিস্টিক্যাল, বুলেটিন অবস্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান, সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯, পৃ: ৪৭, এনেক্সার-বি, উদ্ধৃত, উসমানী, মোহাম্মদ তকি, উপরোক্ত, পৃ: ৮০।] এজন্যই ড, চাপরা বলেছেন, “যদিও জনগণের বৃহত্তর অংশের বিভিন্ন শ্রেনী ও গোষ্ঠীর জমাকৃত অর্থ ব্যাংক আমানতের প্রধান উৎস, তবু এ অর্থের সুবিধা প্রধানত বিত্তশালীরাই ভোগ করে”। [চাপরা, এম. উমর,: পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টে দাখিলকৃত বক্তব্য, উদ্ধৃত, তকি উসামানী, উপরোক্ত, পৃ: ৮০।] সুদী অর্থনীতিতে আসলে তেলা মাথায় তেল দেওয়া হয়। এভাবে বৃহদায়তন কারবারগুলো কম সুদের বোঝা বহন করে আরও বৃহৎ হয়ে উঠে। অপরদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের কারবার প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ-বহনযোগ্যতা অপেক্ষাকৃত কম হবার কারণে উচ্চতর সুদের হারে কম পুজিঁ সংগ্রহ করতে পারে। ফলে এসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্টানগুলো প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে মৃত্যৃবরণে বাধ্য হয়। এভাবে সুদের স্বেচ্ছাচারী আচরণের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারবারের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যায়, বড় বড় প্রতিষ্ঠনগুলো আরও বড় হয়ে উঠে এবং ক্রমে এদের হাতেই সমস্ত সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়।
এছাড়া, পূর্বেই বলা হয়েছে যে, পণ্য-সামগ্রীর মূল্যের সাথে যুক্ত করে অসংখ্য ভোক্তার কাছ থেকে পণ্য-মূল্যের আকারে সুদ তুলে এনে গুটি করেক পুজিঁপতির হাতে পুঞ্জীভূত করা হয়। এ অবস্থা ক্রমাগত চলতে থাকে। প্রতিদিন, প্রতিটি পণ্য ক্রয়ে সুদ দিতে দিতে গরীত ও মধ্যবিত্ত ভোক্তা জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যায়। পণ্য-সামগ্রীর চাহিদা হ্রাস পায়, বাজার সংকুচিত হয়ে আসে, অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়; শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়; মিল-কারখানা একে একে বন্ধ হয়ে যায়। আয়হীন বেকার শ্রমিকরাও দরিদ্রের মিছিলে শামিল হতে বাধ্য হয়। এছাড়া অনেক উদ্যোক্তাও মন্দার ধকল কুলোতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গরীব-নিঃস্বদের সাথে যোগ দেয়। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি তকি উসমানী লিখেছেন, “এ ব্যাপারে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যে, সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে ছোট ছোট বহু ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসতে বাধ্য হয়েছে”। [উসমানী, মোহাম্মদ তকি: উপরোক্ত, পৃ: ৮১।]
বেকারত্বের অভিশাপের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয় এবং অর্থনীতি মানুষের দুর্দশার স্থবির সাগরে রূপ নেয়”। [মাইকেল রোবোথাম: The Grip of Death: A Study of Modern Money, John Carpentar, England 1989, p. 13, উদ্ধৃত, তকি উসমানী, উপরোক্ত, পৃ: ৮৭।] ফলে সুদ কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ায় না, বেকারত্ব বৃদ্ধি করে, দেউলিয়া বানায় এবং দারিদ্র্যের ব্যাপ্তি ও দরিদ্রের সংখ্যা সম্প্রসারিত করে।
সুদী ব্যবস্থায় ঋণদাতাগণ এমন কনেক ঋণ প্রদান করে যেগুলো থেকে কোন লাভজনক উৎপাদন পাওয়া যায় না, অথবা পাওয়া গেলেও সে লাভের পরিমাণ প্রদত্ত সুদেরে চেয়ে কম হয়, অথবা মেন কারবারেও ঋণ দেয়া হয়, দেখানে লাথ তো হয়ই না বরং লোকসান হয়ে মূলধনই খোয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে ভোগ্য ঋণ এবং সরকারী ঋণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ভোগ্য ঋণের ক্ষেত্রে অর্থ খেয়ে নিঃশেষ করা হয়, এর দ্বারা কিছুই উৎপাদন করা হয় না। অথচ ঋণগ্রহীতাকে তার নিজস্ব সম্পদ থেকে ঋণদাতাদের কাছে হস্তান্তরিত হয়ে ঋণ-গ্রহীতার সম্পদ কমিয়ে দেয় এবং ঋণদাতার সম্পদ বাড়িয়ে তোলে।
সরকারী ঋণের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। সরকার সাধারণতঃ তার গৃহীত ঋণ সমাজ কল্যাণ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে ব্য করে। এসব কাজের সামাজিক গুরুত্ব বেশি থাকা সত্ত্বেও ওগুলোতে আর্থিক লাভ খুবই কম হয় অথবা হয় না। তাচাড় অনেক সময় সরকার ঋণের অর্থ অনুৎপাদনশীল বিলাসিতামূলক খাতেও ব্যয় করে থাকে, যেখান থেকে কোন আয় পাওয়া যায় না। কিন্তু এসব সরকারী ঋণের ক্ষেত্রে সরকারকে সুদ অবশ্যই পরিশোধ করতে হয়। সরকার সাধারণতঃ জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করার মাধ্যমেই এ সুদ পরিশোধ করে। এভাবে করের মাধ্যমে জনগণের করের মাধ্যমে জনগণের সম্পদ হস্তান্তরিত হয়ে ব্যাংকার ও পুজিঁপতিদের হাতে কুক্ষিগত হয়। সাধারণ মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকে এবং পুজিঁপতিরা আরও ধনী হয়ে উঠে।
এছাড়া যেসব ঋণের ক্ষেত্রে কারবারের লোকসান হয় অথবা সুদের সমান লাভ হয় না, সেসব ঋণগ্রহীতা তাদের পূর্ব সম্পদ থেকে ঋণদাতাদের সুদ পরিশোধ করে। এতে এদের নিজস্ব সম্পদ কমে যায়; কিন্তু তা পুজিঁপতিদের কাছে হস্তান্তরিক হয়ে তাদের সম্পদ ফাঁপিয়ে তোলে।
সুদী ব্যবস্থা কিভাবে গরীবদের সর্বস্বান্ত করে ধনীদের আরও ধনশালী করে তোলে সে সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত অথচ পূর্ণাঙ্গ চিত তুলে ধরেছেন জেনস রবার্টসন যা পূর্বেই উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “সুদের মাধ্যমে এভাবে সম্দ হস্তান্তর অংশত একারণে হয় যে, ধার দেওয়ার মত অর্থ যাদের বেশি আছে তারা সে অর্থ দার দিয়ে…….অধিক সুদ অর্জন করে। আর এটা একারণেও হয় যে, যাদের সম্পদ কম তাদেরক প্রায়শই বেশি ধার করতে হয়। তাছাড়া সুদের মাধ্যমে সম্পদ হস্তান্তরের এটাও একটা প্রক্রিয়া যে, বর্তমানে দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা উৎপাদনে যে ব্যয় হয়, সুদজনিত ব্যয় হচ্ছে তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। আর বিত্তশালীদের অর্থায়নেই আবশ্যকীয় পণ্যসামগ্রী ও সেবার ব্যাপকত উৎপাদন হয়ে থাকে”। [James Robertson: Future Wealth: A New Economics for the 20th Century, Castle Publications, London, 1990, p. 130-131, উদ্ধৃত, তকি উসমানী, উপরোক্ত, পৃ: ৮২।] জেমস রবার্টসন অন্যত্র মন্তব্য করেছেন, “অর্থ ও অর্থায়ন ব্যবস্থায় মাধ্যমে গরীব লোকদের নিকট হতে ধনীদের কাছে, দরিদ্র এলাকা থেকে বিত্তশালী এলাকায় এবং দরিদ্র দে থেকে ধনশারী দেমে আয় হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি হচ্ছে নিয়মানুগ (systematic)। দরিদ্রদের থেকে ধনীদের দেশে আয় হস্তান্তরের একটি কারণ হচ্ছে অর্থনীতিতে সুদ প্রদান ও গ্রহণের প্রক্রিয়া”। [James Robertson: প্রাগুক্ত, পৃ: ৫১-৫৪; উদ্ধৃত, তকি উসমানী, উপরোক্ত, পৃ: ৮৩।]
উপরের আলোচনায় দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, সুদ নানা পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষের অর্থ গুটিকয়েক পুজিঁপতির হাতে কুক্ষিহত করে দেয় এবং তাদের সম্পদের পাহাড় তৈরী করে। অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষ ক্রমাগতভাবে দরিদ্র হতে হতে অবশেষে নিঃস্ব-সর্বহারাদের কাতারে শামিল হয়। সুদের অবসান ঘটালে এ বৈষম্য সৃষ্টির প্রধান হাতিয়ার অনুপস্থিত হয়ে পড়বে এবং বৈষম্য কমে গিয়ে স্বাভাবিক পর্যা নেমে আসবেব। এ ব্যাপারে প্রথম কথা সুদের অনুপস্থিতিতে ব্যাংকারদের আমানত গ্রহণ ও ঋণদান কার্যক্রম, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। সেক্ষেত্রে আমানতকারীগণ ব্যাংকের অংশীদরা হিসেবে মুনাফার অংশ পাবে এবং সে অংশ বর্তমান সুদের চেয়ে বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
মুনাফায় অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ঋণদান ব্যবস্থা চালূ হলে ঋণগ্রহীতাদের সম্পদের চেয়ে ঋণের মুনাফাজনীনতার ভিত্তিতে ঋণ বরাদ্দ ও মঞ্জুর করা হবে। এতে কেবল ধনীরা ঋণ পাবে এবং আরও ধনী হবার সুযোগ লাব করবে, অপরদিকে গরীবরা আদৌ ঋণ পাবে না-এমন অবস্থার অবসান ঘটবে। অতঃপর যে কারবার যত বেশি উৎপাদনশীল ও লাভজনক হবে, সে কারবার তত বেশি ঋণ পাবে।এ নীতিতে যোগ্য বিবেচিত হলে দরিদ্রদের কারবারও সমান গুরুত্ব লাভ করবে এবং ঋণ পাবে। এতে ধনীদের একচেটিয়া অধিাকার থাকবে না বরং ছোট ও মাঝারি কারবারও সমান অধিকার পেয়ে বড় হবার সুযোগ পাবে। [চাপনা, এম, উমর: পূর্বোক্ত, পৃ: ২৬।]
সুদমু্কত অর্থনীতিকে ব্যাংক থেকে ভোগ্য ঋণ দানের সুযোগ খুব কমই থাকবে; এজন্য পৃথক ব্যস্থা করতে হবে। ফলে সুদ আকারে ভোগ্য ঋণগ্রহীতাদের সম্পদ পুঁজিপতিদের কাছে চলে যাবে না। সরকারী ঋণের এমন ব্যবস্থা করা হবে যাতে জনগনের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে সরকার ঋণ গ্রহণ করতে পারে। এতে জনগণের সম্পদ কর আকারে পুজিঁরপতিদের হাতে চলে যাওয়ার পথ বন্ধ হবে।
সুদ না থাকল পুজিঁপতিদের সম্পদ রাতারাতি ফেঁপে উঠার পথ রুদ্ধ হবে। দ্রব্যমূল্য কমবে, করের বোঝা হ্রাস পাবে এবং উৎপানদশীল ও লাভজনক কাজে ঋণের সঠিক ব্যবহার হবে; ফলে অর্থনৈতক বৈষম্য সৃষ্টির কোন অবকাশ থাকবে না; বিশেষ করে, এভাবে সুদহীন অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পাবে।
৫. সুদ জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেয়
আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রধানতঃ তিনটি কারণে সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়ঃ (১) কোন কাজে অর্থ বিনিয়োগ করার পর সেখান থেকে আয় আসতে কিছু সময় লাগে; কিন্তু ইতোমধ্যে বিভিন্ন সরকারী কাজের জন্য অর্তের প্রয়োজন হলে সরকারকে স্বল্প মেয়াদী ট্রেজারী বিল বিক্রয় করে অর্থ ধার করতে হয়; (২) সরকারী খাতে অবস্থিত শিল্প-কারখানা এবং জনকল্যাণমূলক কাজে অর্থ যোগান দেওয়ার জান্যও সরকারকে ঋণের আশ্রয় নিতে হয় এবং (৩) দুর্যোগ মুকাবিলা বা যুদ্ধের ব্যয় বহন করার জন্যও সরকারকে বিপুল ঋণ গ্রহণ করতে হতে পারে।
প্রথম ক্ষেত্রে যেহেতু সরকারের বিভিন্ন ব্যয় নির্বাহের জন্য ঋণ করা হয়, সেহেতু এরূপ ব্যয় থেকে সরকার কোন আর্থিক মুনাফা পায় না। কিন্তু ট্রেজারী বিলগুলো নির্ধারিত সময় পরে পরিপক্ব হওয়ার সাথে সাথে এগুোলার ওপর নির্ধারিত সুদসহ আসল টাকা ফেরত দিতে হয়। এক্ষেত্রে সুদ বাবদ যে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়, তা কর রূপে জনসাধারণের নিকট থেকে আদায় করতে হয়। এতে এই সুদের বোঝা কর আকারে জনসাধারণের ওপর গিয়ে পড়ে। যদি প্রত্যক্কষ করের মাধ্যমে এ অর্থ আদায় করা হয়, তাহলে এর বোঝা সেই সব বিত্তশালী লোকের ওপর গিয়ে পড়ে, যারা ট্রেজারী বিল ক্রয় করে সরকারকে ঋণ দিয়েছিল। এর সরকারকে ঋণ দিয়ে সুদ অর্জন করে; আবার কর আকারে এ সুদ তাদের পকেট থেকেই দিতে হয়; বরং কর ব্যবস্থাপনার জন্য যে ব্যয় হয়, তার বোঝাও এই শ্রেণীর ওপরই বর্তায়। সুতরাং এই ব্যয়টুকু সামাজিক অপচয় এবং অতিরিক্ত বোঝা ছাড়া আর কিছু নয়। আর যদি পরোক্ষ করের মাধ্যমে সুদ বাবদ প্রদত্ত অর্থ আদায় করা হয়, তাহলে সে করের ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও সুদের বোঝা সবটাই সাধারণ মানুষের ওপর গিয়ে পড়ে এবং তাদের ওপর তা দুঃসহ বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
সরকারী ঋণের দ্বিতীয় প্রয়োজন হচ্ছে সরকারী খাতের শিল্প-কারখানা জনকল্যাণমূলক কাজে অর্থ যোগান দেওয়া। এক্ষেত্রে শিল্প-কারখানায় মুনাফা হতেও পারে বা নাও হতে পারে; কিংবা মুনাফা হলেও তা সুদের হারের সমান নাও হতে পারে। মুনাফা যদি সুদের হারের সমান বা বেশি হয়, তাহলে সেই মুনাফা থেকেই সুদ পরিশোধ করা সম্ভব। কিন্তু যদি মুনাফা না হয় অথবা মুনাফা যদি সুদের হার অপেক্ষা কম হয়, তাহলে সুদ পরিশোধ করার জন্য সরকারকে অবশ্যই করের আশ্রয় নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে এর অর্থ হচ্ছে সরকারী শিল্প-কারখানার লোকসানের বোঝা গোটা সমাজের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ঋণদাতার নির্দিষ্ট আয়ের নিশ্চয়াতা বিধান করা।
সর্বশেষে, যুদ্ধ বা প্রকৃতিক দুর্যোগ মুকাবিলার জন্য সরকার যেঋণ গ্রহণ করে তা প্রায়ই স্থায়ী হয়ে যায় এবং বংশানুক্রমে এর বোঝা বহন করতে হয়। পুরাতন বন্ডগুলো পরিপক্ব হবার পর এর পরিবর্তে নতুন বন্ড দেওয়া হয় এবং এভাবে বছরের পর বছর-এ ঋণ চলতে থাকে’ সরকার কেবল নির্দিষ্ট মেয়াদ পরপর জনসাধারণর নিকট থেকে কর আদায় করে এ ঋণের সুদ পরিশোধ করে যায়। এভাবে সুদের সমান এবং এর সাথে কর ব্যবস্থাপনার জন্য কৃত ব্যয়ের সমপরিমাণ বোঝা কর আকাররে জনগণের ওপর বর্তায়। জাতি প্রতি বছর সুদ পরিশোধ করতে থাকে; কিন্তু আসল ঋণ ঋণই থেকে যায়। অবশেষে অতিরিক্ত মুদ্রা সৃষ্টি করা ছাড়া এ ঋণ পরিশোধ করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। আর অতিরিক্ত মুদ্রা সৃষ্টি মানেই মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যা জনগণের দুর্দশাকে অধিকতর দুঃসহ করে তোলে।
আন্তর্জাতিক ঋণের ক্ষেত্রেও সরকারকে একই পদ্ধতি অবলম্বন করে সুদ ও ঋণ পরিশোধ করতে হয়। প্রকারান্তরে দেশের জনগণ করের বোঝায় নুইয়ে পড়ে। আমাদের দেশে ১৯৮৯-৯০ অর্থ বছরের বাজেটের দিকে তাকালে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। উক্ত বাজেটে অভ্যাক্তরীণ সুদ পরিশোধ বাবদ ২৫৮.৭৭ কোটি এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোদ বাবদ ৫০৮.০০ কোটি, মোট ৭৬৬.৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এ বছর জনসাধারণের নিকট থেকে নতুন কর ধার্য করে ৭০৩.৩৩ কোটি টাকা আদায় করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। [জাতীয় বাজেট, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, ১৯৮৯-৯০, সংক্ষিপ্ত বিবরণী, পৃঃ ৪।] সুতরাং এ কথা বিনা দ্বিধায় বলা যায় যে, উক্ত সুদ প্রদান করতে না হলে এ বছর দেশের বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিপীড়িত মানুষের ওপর এ নতুন করের বোঝা চাপানোর প্রয়োজন হতো না। সুদ এমন এক বোঝা যে, জাতীয় জীবনের চরম দুর্যোহ মুহূর্তেও এ বোঝা বহন না করে কোন উপায় থাকে না।
গ) স্থিতিশীলতার ওপর সুদের বিরূপ প্রভাব
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাজারের স্থিতিশীলতা হচ্ছে উন্নয়নের পূর্বশর্ত। কিন্তু সুদ এক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনীতিকে অস্থিত করে তোলে, উৎপাদনের পরিবেশ ব্যাহত করে এবং অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দেয়। স্থিতিশীলতার ওপর সুদরে কুফলগুলো নীচে আলোচনা করা হলো:
১. সুদ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে
বিশ্বে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদগণ প্রধানত সুদক্ দিায়ী করেছেন। সুদের কারণেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ‘নাই’ থেকে বহুগুণ অর্থ সৃষ্টি করে;
আর অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ দেয় যা মুদ্রাস্ফীতিকে ভয়ংকর পর্যায়ে পৌছেঁ দেয়। এছাড়া সরকারের ঋণ-চাহিদা পূরণের জন্য সৃষ্ট অর্থও মুদ্রাস্ফীতিকে ফাপিয়েঁ তোলে।
সুদ পূর্বনির্ধারিত ও নিশ্চিত। সুদী ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলো আসল ও সুদ ফেরত পাবার নিশ্চয়াত হিসেবে বলিষ্ঠ সহকারী জামানত গ্রহণকেই যথেষ্ট মনে করে; অতঃপর ঋণের অর্থ কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সে ব্যাপারে মাথা ঘামানোর তেমন প্রয়োজন বোধ করে না। এই ব্যবস্থা মানুষকে তাদের আয় অপেক্ষা অধিক ব্যায় করতে প্ররোচিত করে। মানুষ বাহুল্য ব্যয় ও আড়ম্বরপূণ্য ভোগের জন্য ঋণ গ্রহণ করে থাকে। আজকের যুগে ক্রেডিট কার্ড পদ্ধতি ঋণ প্রাপ্তিকে আরও সহজ করেছে এবং ঋণকে প্রত্যেক ভোক্তার হাতের মুঠোয় পৌছেঁ দিয়েছে। এছাড়া ব্যাংক এমন ঋণও বরাদ্দ করে যা সরবরাহ বাড়ায় যার সাথে পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধির কোন মিল থাকে না।
অনুরূপভাবে সরকারও বাজেট ঘাটতি পূরণ, উচ্চভিলাষী প্রতিরক্ষা সম্ভার গড়ে তোলা, দুর্যোগ মুকাবিলা এবং রাজনৈতিক ও অন্যান্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুৎপাদনশীল ব্যয়ের জন্য প্র্রতিবছর বিপল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে থাকে। এমনকি, অনেক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাড়তি নোট ছাপিয়ে এসব ঋণ সরবরাহ করা হয়। এ অবস্থা বাজারে অর্থের পরিমাণ এবং উৎপাদিত পণ্য-সামগ্রী ও সেবার পরিমাণের মধ্যে গুরুতর অসংগতি সৃষ্টি করে যা মুদ্রাস্ফীতি ঘটায় এবং অধিকতর ফাপিয়েঁ তোলে।
সর্বোপরি প্রাচীন গোল্ডস্মিথদের ন্যায় এ যুগের ব্যাংকগুলোরও একটি জাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে যাকে বলা হয় বহুগুণ ঋণ সৃষ্টির (Multiple credit creation) ক্ষমতা। আংশিক রিজার্ভ (Fractional reserve) পদ্ধতির অধীনে ব্যাংকগুঅেকেক এই ক্ষমতা প্রয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছৈ। এই ক্ষমতা বলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো জনগণের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে গৃহীত ডিপোজিটের দশগুণ বেশি অর্থ ঋণ দিচ্ছে। এভাবে তারা ‘নাই’ থেকে অর্থ সৃষ্টি করছে। ফলে ঋণের ওপর ঋণ সৃষ্টি হচ্ছে এবং সরকার কর্তৃক প্রকৃত মৃদ্রার তুলনায় এই কৃত্রিম অর্থের পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নের ছকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৭ সালে বৃটেনে মোট অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৫ বিলিয়ন পাউন্ড; এর মধ্যে সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রকৃত ঋণমুক্ত অর্থ ছিল ৮.১ বি. পা. যার মধ্যে মাত্র ২৫ বি. পা. হচ্ছে প্রকৃত মুদ্রা যা মোট মুদ্রার মাত্র ৩.৬% অর্থাৎ অবশিষ্ট ৯৬.৪% হচ্ছে কৃত্রিম অর্থ।
সাল | সরকারি ভাবে ইসুকৃত মোট মুদ্রা ও মোট (এম,ও) স্টারলিংপাউন্ড (বিলিয়নে) | মোট অর্থের পরিমাণ (এম,ও) বিলিয়নে | মোট অর্থ সরবারাহের মধ্যে প্রকৃত ঋণ-মুক্ত অর্থের শতকরা হার |
১৯৭৭ | ৮.১ | ৬৫ | ১২% |
১৯৭৯ | ১০.৫ | ৮৭ | ১২% |
১৯৮১ | ১২.১ | ১১৬ | ১০.৫% |
১৯৮৩ | ১২.৮ | ১৬১ | ৭.৯% |
১৯৮৫ | ১৪.১ | ২০৫ | ৬.৮% |
১৯৮৭ | ১৫.৫ | ২৬৯ | ৫.৮% |
১৯৮৯ | ১৭.২ | ৩৭২ | ৪.৬% |
১৯৯১ | ১৮.৬ | ৪৮৫ | ৩.৮% |
১৯৯৩ | ২০.০ | ৫২৫ | ৩.৮% |
১৯৯৫ | ২২.৪ | ৫৮৫ | ৩.৮% |
১৯৯৭ | ২৫.০ | ৬৮০ | ৩.৬% |
সূত্র: Bank of England, Releases 1995, 1997, quoted by মাইকেল রোবাথাম; উদ্ধৃত, তকি উসামনী, উপরোক্ত, পৃ:: ৮৫।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় একই অবস্থা বিরাজ করছে। প্যাট্রিক জে. এস. কারম্যাক ও বিল স্টিল বলেছেন, আমনা এমন একটি ঋণনির্ভির অর্থ ব্যস্থায় (debt money system) কাজ করছি যেখানে আমাদের সমগ্র অর্থই সমপরিমাণ ঋণের সাথে সমান্তরালভাবে সৃষ্টি করা হয়। বেসরকারী ব্যাংকগুঅে নিজেদের স্বার্থে এর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।তারা অর্থ সৃষ্টি করে তা সুদে ধার দেয় আর আমনা পাই ঋণ…….। এমনিভাবে আংশি রিজার্ভ ভিত্তিক ঋণের মাধ্যমে ব্যাংকগুঅে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি অর্থ সৃষ্টি করে। সুতরাং শতকরা ৯০ ভাগ মুদ্রাস্ফীতি তারাই ঘটিয়ে থাকে। [প্যাট্রিক, এস, এজ, কারম্যাক এন্ড বিল স্টিল: The Money Masters: How International Bankers Gained Control of America, রয়ালটি প্রডাকশন কোম্পানী, ১৯৯৮, পৃ: ৭৮, ৭৯, উদ্ধৃত, তকি উসমানী, পূর্বোক্ত, পৃ: ৮৬।]
তদুপরি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সৃষ্ট এই ভিত্তিহীন অর্থ আজ ‘ফিউচারস’ এবং ‘অপশনস’ রূপে উদ্ভূত অর্থের (derivatives) মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে ফটকা কারবারের বড় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, প্রারম্ভিককালে অর্থের ওপর দাবীকে (claims over money) অর্থই মনে করা হতো। কিন্তু এখন দাবী হচ্ছে দাবীর ওপর দাবী (claim over claim)। আর একে সে অর্থেই বিবেচনা করা হয়। এক গণনায় বলা হয়েছে যে, বিশ্বে সর্বমোট ১৫০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক পরিমাণ উদ্ভূত অর্থ (derivatives) প্রচলিত আচে। অথচ বিশ্বের ১৮৮ টি দেশের মধ্যে সবগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ মোট উৎপাদনের (GDP) যোগফল হচ্ছে মাত্র ৩০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের মত। এই কারবারের ৮০ ভাগেরই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে মাত্র দুই ডজন বৃহৎ ব্যাংক ও হেজ তহবিলের (hedge fund) হাতে। [আধ্যাপক খুরশীদ আহমদ: ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং: দি চ্যালেঞ্চ অব দি ২১ শতাব্দী, লেখক কর্তৃক আদালতে দাখিলকৃত লিখিত বক্তব্য: উদ্ধৃত, তকি উসমানী, পূর্বোক্ত, পৃ: ৮৮।]
ফলে বিশ্বের গোটা অর্থনীতির অবস্থা হচ্ছে একটিা বিরাট বেলুনের মত। প্রতিদিন নতুন ও নবতর আর্থিক লেনদেনের দ্বারা এই বেলূন ফাপিয়েঁ তোলা হচ্ছে; অথচ প্রকৃত অর্থনীতির সাথে এর কোন সৃংগতি নেই। এই ‘বেলুন’ বেলুনের মতই দুর্বল; বাজারের আঘাতে (market shocks) যে কোন মুহূর্তে ফেটে যেতে পারে এ বেলুন। বস্তুত নিকট অতীতে এরকম ফেটে যাওয়ার ঘটনা কয়েকবারই ঘটেছে, যার ফলে এশিয়ার ব্যাংকগুলো ধ্বংসের একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌছেঁ গিয়েছিল। এখানে আমরা আবারও জেমস রবার্টসনের ্র একটি উক্তি উদ্ধৃত করছি। তিনি তাঁর রছিত অতি উৎকৃষ্ট মানের সৃষ্টি ‘ট্রান্সফরমিং’ ইকোনমিক লাইফ: এ মিলেনিয়াল চ্যালেঞ্জ’ গ্রন্হে এই বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে নিম্নরূপ মন্তব্য করেছেনঃ
“বিশ্বে প্রতিদিন বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কন ডলার হস্তান্তর হয়; এই লেনদেনের কমপক্ষে ৯৫ ভাগই হচ্ছে নিছক আর্থিন লেনদেন; এর সাথে প্রকৃত অর্থনীতিতে সংঘটিত লেনদেনের কোন সংযোগ নেই। মানুষ ক্রমবর্ধমান হারে উপলব্ধি করছে যে, অর্থ, ব্যাংক ও আর্থিক পদ্ধতির কার্যক্রম হচ্ছে অবাস্তব (unreal), অবোধ্য (incomprehensible), বে-হিসেবী (unacccountable), দায়িত্বহীন (irresponsible), শোষণমূলক (exploitative) এবং নিয়ন্ত্রণহীন (out of control)। কেন পৃথিবীর কোন এক দূর প্রান্তে গৃহীত একটি মাত্র আর্থিক সিদ্ধান্তরে ফলে মানুষ বাস্তহারা হতে বাধ্য হচ্ছে, তাদেরকে চাকরি খুইয়ে পথে বসতে হচ্ছে? কেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থ ও আর্থিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়মিতভাবে গরীবদের সম্পদ ধনীদের হাতে চলে যাচ্ছে, গরীব দেশের সম্পদ বিত্তশালী দেশে গিয়ে পুঞ্জীভূত হচ্ছে? কিভাবে এক ব্যক্তি সিঙ্গাপুরে বসে টোকিওর স্টক এক্সচেঞ্চে জুয়া খেলতে সক্ষম হয় এবং কি করে সে লন্ডনের একটি ব্যাংকের পতন ঘটাতে পারে?……… লন্ডন নগরীতে কারবাররত উদ্ভূত অর্থের ব্যবসায়ী যুবকগণ কেন বছরে এত পরিমাণ বোনাস পায় যা সমগ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটের চেয়েও অনেক বেশি? আমনা কি এমন একটি অর্থ আর্থিক ব্যবস্থা চেয়েছিলাম, যা এভাবে কাজ করে? অর্থায়নকারী জর্জ সোরোস পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, “লেইসেজ-ফয়ার পজিঁবাদের অপ্রতিরোধ্য ব্যাপ্তি এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাজার-মূল্যবোধের সম্প্রসারণ আমাদের মুক্ত (open) ও গণতান্ত্রিক সমাজকে বিপদসঙ্কুল করে তুলেছে। আমি বিশ্বস করি সাম্যবাদী নয় বরং পুজিঁবাদী হুমকিই মুক্ত সমাজের প্রধান দুশমন”। [James Robertson: Transforming Economic Life: A Millenial Challenge; Green Book, Devon, 1998: উদ্ধৃত, তকি উসমানী, পূর্বোক্ত, পৃ: ৮৮-৮৯।] (ক্যাপিট্যাল ক্রাইমস, আটলান্টিক মানথলি, জানুয়ারি, ১৯৯৭।)
সমগ্র বিশ্ব আজ ওপরে উল্লেখিত যেসব ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হয়েচে তা অর্থনীতির ওপর প্রভুত্ব করার জন্য সুদী আর্থিক ব্যবস্থাকে প্রদত্ত লাগামহীন ক্ষমতার যৌক্তিক পরিণতি। এরপরও কি কেউ দাবী করতে পারে যে, সুদের লেনদেনে কোন দোষ নেই! বস্তুত পূর্ববর্তীকালে ব্যক্তি পর্যায়ে প্রচলিত সুদী ঋণ সংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্যক্তিকে প্রভাবিত করত’ কিন্তু আজকের বাণিজ্যিক সুদ বিশ্বব্যাপী যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি ব্যাপক ও মারাত্মক।
মুদ্রাস্ফীতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ড. উমর চাপরা লিখেছেন, “মুদ্রাস্ফীতি মানেই হচ্ছে, হিসাব-নিকাশের সুবিচারপূর্ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ একক হিসেবে কাজ করতে মুদ্রার ব্যর্থতা। মুদ্রাস্ফীতি মুদ্রাকে বকেয়া পরিশোধের একটি অসম মানদণ্ড এবং সঞ্চয়ের অনির্ভরযোগ্য বাহনে পরিণত করে। মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে আর্থিক সম্পদের ক্রয়-ক্ষমতার ক্ষয় সাধন করে এবং কিছু লোককে অন্যদের ওপর জুলুম করার সুযোগ করে দেয়। মুদ্রাস্ফীতি মুদ্রা-ব্যবস্থায় দক্ষতা ব্যাহত করতে যতটা সক্ষম হয়, সামাজিক কলাণ ঠিক ততটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।উৎপাদনশীল কর্ম প্রচেষ্টার পরিবর্তে ফটকা কারবারকে পুরস্কৃত করা এবং আয় বৈষম্যকে তীব্রতর করার মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নৈতিক মূল্যবোধকেও বিকৃত করে দেয়”। [চাপরা, এম, ওমর, পূর্বোল্লেখিত, পৃ: ৫।]
এখন দেখা যাক, সুদ না থাকলে মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা কেমন হবে। সুদের অবর্তমানে ব্যাংকার এবং ঋণদাতাগণ প্রকল্পের মুনাফায় অংশ নেওয়ার শর্তে পুজিঁ যোগান দেবে। ব্যাংকার এবং উদ্যোক্তা যখন কোন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকৃত সম্পদ বৃদ্ধির নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখতে পাবে, তখনই কেবল অর্থ মুঞ্জুর করা হবে। সুতরাং নতুন অর্থ সৃষ্টি করা হলে তা সাধারণত দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার পরিমাণও বৃদ্ধি করবে। ফলে দ্রব্যসামগ্রীর যোগান অপেক্ষা মুদ্রার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকা থাকবে না।
যদি কোন প্রকল্পে আশানুরূপ লাভ না হয়, অথবা যদি এতে লোকসান হয়, তা হলে ও উক্ত পুজিঁর দ্বারা মুদ্রাস্ফীতি ঘটার আশংকা থাকবে না। কারণ এক্ষেত্রে ব্যাংককে এর নির্ধারিত সুদসহ আসল ফেরত দেওয়ার প্রশ্ন থাকবে না; এতে যে লোকসান হবে তা ব্যাংক এবং উদ্যোক্তা তাদের নিজ নিজ পুজিঁর আনুপাতিক হারে বহন করবে।
ভোগ্য ঋণের ক্ষেত্রে সুদমুক্ত ও লাভ-লোকসান ভিত্তিক ব্যাংকের ভূমিকা থাকবে না বললেই চলে। কারণ, ভোগ্য ঋণের ক্ষেত্রে লাভ-লোকসান নির্ধারণের কোন প্রশ্নই উঠে না। এছাড়া ভোগ্য ঋণ সুদী হোক,আর সুদমুক্ত হোক, সকল অবস্থাতেই দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ায় কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধিতে এর কেন ভূমিকা থাকে না। সুতরাং ভোধ্য ঋণ সর্বদাই মুদ্রাস্ফীতিজনক এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকারক। তবে যদি করজাত রাজস্ব আয় (Tax Revenue), যাকাত এবং সরকারের কাছে আসা সঞ্চয় থেকে ভোগ্য ঋণের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে তা মুদ্রাস্ফীতি উদ্দীপক হয় না। সুতরাং সুদমুক্ত ব্যবস্থায় ব্যাংক থেকে ভোগ্য ঋণ দান করার পরিবর্তে উপরোক্ত বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে এ জাতীয় ঋণ প্রদান করা হলে মুদ্রাস্ফীতির অশুভ ফল থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
সুদমুক্ত ব্যাংক উৎপাদন খাতে সাধারণভাবে যে পুজিঁ যোগান দিবে এর দ্বারা এই খাতের যাবতীয় আর্থিক প্রয়োজন পূরণ নাও হতে পারে এবং এর পরেও ‘ব্রীজ ফাইন্যান্স’ এবং অন্যান্য স্বল্প মেয়াদী প্রয়োজন পূরণের জন্য অর্থের প্রয়োজন হতে পারে। প্রশ্ন থেকে যায় যে, স্বাভাবিক অর্থায়নের ওপর আবার এসব স্বল্প মেয়াদী পুজিঁ দেওয়া হলে তা কি অর্থ সরবরাহ বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি ঘটাবে না? বস্তত এসব অর্থায়নের দ্বারা মুদ্রাস্ফীতি ঘটার আশংকা নেই। কারণ প্রথমত, এ পুজিঁর যোগান এত স্বল্প সময়ের জন্য হবে যে, এতে মুনাফা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। ফলে সাধারণতঃ ব্যাংকগুলো এরূপ অর্থায়ন করতে আগ্রহী হবে না। বিশেষ ব্যবস্থায় আইন প্রয়োগ এবং উৎসাহদানের মাধ্যমে ব্যাংককে এরূপ অর্থায়নে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ব্যাংকের নিজস্ব উদ্যোগ ও আগ্রহ না থাকায় এরূপ অর্থায়নের পরিমাণ হবে খুবই কম। দ্বিতীয়ত, এসব পুজিঁ সরাসরি উৎপাদনে ব্যবহৃত না হলেও উৎপাদনের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সুসম্পন্ন করতে অবদান রাখবে। সুতরাং এ পুজিঁ মুদ্রাস্ফীতি উদ্দীপক হবে একথা বলা যায় না। তাছাড়া, এরূপ পুজিঁর পরিমাণ এত অধিক হবে না যে, আর্থিক কর্তৃপক্ষ তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হবে।
সুদমুক্ত অর্থনীতিতে সরাকারকে যে ঋণ দেওয়া হবে তা মুদ্রাস্ফীতি ঘটাবে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে সরকারী ঋণের উৎস ও ব্যবহারের ওপর। জনগণের সঞ্চয় থেকে যদি এ ঋণ নেওয়া হয়, তাহলে তা কিছুতেই মুদ্রাস্ফীতি ঘটাবে না; কিন্তু যদি ব্যাংক সৃষ্ট অর্থ এ ঋণের উৎস হয়, তাহলে তা মুদ্রাস্ফীতি ঘটাতে পারে। অপরদিকে জনগণের সঞ্চয় থেকে ঋণ নিয়ে তা যদি অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করা হয়, তাহলে অর্থ সরবরাহ বাড়বে, কিন্তু দ্রব্য-সামগ্রী বাড়বে না। আবার ব্যাংক ঋণও যদি উৎপাদন কাজে লাগানো হয়, তাহলে অর্থের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে তা পণ্যসামগ্রী বৃদ্ধি করবে। তবে, একদিকে ব্যাংকের ঋণ, অন্যদিকে এর অনুৎপাদনশীল ব্যবহার-এ অবস্থা অবশ্যই মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে এবং তা বর্জন না করে উপায় নেই। অপরদিকে জনগণের সঞ্চয় থেকে গৃহীত সরকারী ঋণ এবং এ ঋণের উৎপাদনশীল ব্যবহার সম্ভব হলে এতে মুদ্রাস্ফীতি ঘটার আশংকা আদৌ থাকবে না।
২. সুদ বাণিজ্য–চক্র ও মন্দা সৃষ্টি করে
সুদ অর্থনীতিতে বারবার তেজীভাব ও মন্দা (Boom and Depression) সৃষ্টিল মাধ্যমে এক মারাত্মক অস্থির ও অনিশ্চিত অবস্থার জন্ম দেয়। অর্থনীতিবিদগণ দেখিয়েছেন যে, ঋণ প্রদানযোগ্য অর্থের চাহিদা ও যোগানের দ্বারাই সুদের হার নিরূপিত হয়। কোন দেশে শিল্পোন্নয়নের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ঋণের চাহিদা কম থাকে। ফলে সুদের হারও কম থাকে। এ সময়ে উৎপাদনকারীগণ কম সুদের হারে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে এবং বেশ মুনাফা পায়। সুদের হার কম থাকার কারণে দ্রব্যমূল্য কম থাকে, দ্রব্যের চাহিদা বেশি থাকে এবং বিক্রয়ও বেশি হয়। উৎপাদনকারিগণ অধিক মুনাফা অর্জনে আশাবাদী হয়ে উছে এবং এ সুযোগ গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে বৃহদাকারের উৎপাদন কাজে হাত দেয়। তারা অধিক পরিমাণে ঋণ গ্রহণ করতে এগিয়ে আসে। ঋণের চাহিদা বেড়ে যায়। এ সুযোগে পুজিঁপতি ও ব্যাংক-মালিকগণ তাদের ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। এভাবে ঋণের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সুদের হার বাড়তে থাকে। ফলে দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন ব্যয় ও দাম বেড়ে যায়। ক্রমে পণ্যসামগ্রীর দাম এত বৃদ্ধি পায় যে, উক্ত পণ্য ক্রয় করার সাধ্য আর সাধারণ ক্রেতাদের থাকে না। ক্রেতার অভাবে পণ্যসামগ্রীর বিক্রয় ব্যাপকভাবে কমে যায়। উৎপাদনকারীদের সকল আশা-আকঙ্ক্ষা আকস্মাৎ ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ক্রেতার অভাবে লক্ষ লক্ষ টন পণ্যদ্রব্য অবিক্রীত অবস্থায় গুদামজাত হতে থাকে। এ সময়ে পুজিঁপতি ও ব্যাংকারগণ তাদের পূর্বে দেওয়া ঋণ ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। তারা সুদের হার আরও বাড়িয়ে দেয় এবং ঋণের ব্যাপারে নানাবিধ কড়াকড়ি আরোপ করতে থাকে। এ অবস্থা মূলধন-বাজারে আতঙ্কের সৃষ্টি করে এবং অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে।
এভাবে সুদের হার বাড়ার ফলে পুজির প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন ব্যয় আরও বেড়ে যায়। উৎপাদনে মুনাফার সম্ভাবনা লোপ পায়। বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে কমে যায়। উৎপাদন ব্যাপকভাবেব হ্রাস পায় এবং বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। অপরদিকে উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে এবং ক্রেতাদের ক্রয়-ক্ষমতা কমতে থাকে। বাজারে দ্রব্যসমাগ্রীর বিক্রয় বন্ধ হয়ে যায় এবং অবিক্রীত পণ্যের স্তূপ জমতে থাকে। সঞ্চয়ের ক্ষমতা থাকে না, সঞ্চয়ের ইচ্ছাও বিলুপ্ত হয়। ফলে পুজিঁ গঠন রুদ্ধ হয়ে পড়ে। এভাবে এক মারাত্মক মহামন্দায় অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
অর্থনীতির চরম সংকটকালে ব্যাংকার ও পুজিঁপতিদের কাছ থেকে ঋণ নেয়া প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংকার ও পুজিঁপতিগণ লোকসানের ভয়ে তাদের ঋণের সুদের হার কমিয়ে ঋণদানে এগিয়ে আসে। সুদের হার হ্রাস পাবার সাথে সাথে দ্রব্যমূল্য কমে আসে, পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে এবং বিনিয়োগ লাভজনক হয়। উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী ও ফটকা কারবারীরা আবার ঋণ গ্রহণ করে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদন বেড়ে যায়। অর্থনীতি মন্দা অবস্থা কাটিয়ে আবার তেজী হয়ে উঠে। কিন্তু এ অবস্থায় পুজিঁর চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে ব্যাংকার ও পুজিঁপতিগণ আবার সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। অর্থনীতি পুনরায় মন্দা অবস্থার সম্মুখীন হয়। এভাবে অর্থনীতি বারবার তেজী ও মন্দা অবস্থার মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে।
এ প্রসঙ্গে মাইকেল রোবোথাম বলেছেন, “অর্থ সরবরাহের জন্য ঋণের ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতি এমন এক আর্থিক পদ্ধতিতে বন্দী হয়ে পড়েছে যেখানে ঋণ ও অর্থ সরবরাহ উভয়ই দ্রুত সম্প্রসারিত হয়; আর যে ঋণ গ্রহণের জন্য অর্থনীতি বাধ্য হয়েছে সে ঋণের জন্যই অর্থনীতি শাস্তিপ্রাপ্ত তথা দুর্দশায় নিপতিত হয়। অসংখ্য অতীত ঋণগ্রহীতাকেক দেউলিয়া বানিয়ে পথে বসানো হয়, বেশুমার লোককে বাড়িঘর থেকে উৎখাত ও বেদখল করা হয়, কারবারগুলোকে ধ্বংস করা হয় এবং মিলিয়ন মিলিয়ন কর্মক্ষম মানুষকে বেকারত্বের অভিশাপের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় যতক্ষণ না মুদ্রাস্ফীতি ও অতি গরম অবস্থাকে বিপদজনক বিবেচনা করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত ঋণকে নিরুৎসাহিত করা হতে থাকে এবং অর্থনীতি মানুষের দুর্দশার স্থবির সাগরে রূপ নেয়। অবশ্য এ অবস্থায় পৌঁছার সাথে সাথে চাহিদা পড়ে যায়; সুতরাং আমাদেরকে সুদের হার হ্রাস করতে হয় এবং ভোক্তাদের আস্থা ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসার জন্য প্রতীক্ষা করতে হয়্ সমগ্র অর্থনীতিতে আবার বাণিজ্য চক্র শুরু হয়। এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কিছুই হতে পারে না যে, আর্থিক ব্যবস্থাকে বুঝা ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে আধুনিক অর্থনীতি চরম ও পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বিচারে গোটা অর্থনীতিকে ফাদেঁ বন্দী করা, অতঃপর একে মুগুর পেটা করা ব্যতীত আধুনিক অর্থনীতি আর কিছুই করতে পারে না। কিন্তু এটা এমন এক নীতি যা অন্যায়ের দ্বার খুলে দেয় এবং সেই সাথে নৈতিক বিচ্যুতিকে উদ্বদ্ধ করে। পরিবর্তনশীল সুদের হারের ভিত্তিতে ঋণের সুদের হার পুনঃনির্ধারণের যে অসীম ক্ষমতা অর্থায়নকারীকে দেওয়া হয়, সেই ক্ষমতাবলে অর্থায়নকারী অতি চতুরতার সাথে ঋণ-চু্ক্তিতে ইচ্ছামত একতরফাভাবে সুদের হার পুনঃনির্ধারণ করে দেয়”। [মাইকেল রোবোথাম: পূর্বোক্ত, পৃ: ২৭, ২৮; উদ্ধৃত, তকি উসমানী, পূর্বোক্ত, পৃ: ৮৭-৮৮।]
অর্তনীতি তেজী ও মন্দার আবর্তে ঘুরপাক খাবার অন্যতম কারণ সুদ। সুদ না থাকলে বা সুদের বিলোপ সাধন করা হলে পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন খরচ কমে যাবে এবং দ্রব্যমূল্য হ্রাস পাবে। কম মূল্যে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারার দরুন ক্রেতাদের ক্রয়-ক্ষমতা বাড়বে এবং পণ্যের চাহিদাও বেড়ে যাবে। তাছাড়া সুদ না থাকলে পুজির প্রান্তিক দক্ষতা শূণ্য হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগ বাড়বে। কর্মসংস্থান বেশি হবে এবং বেকার সমস্যা হ্রাস পাবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ার সাথে সাথে ক্রয়-ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং বর্ধিত ক্রয়-ক্ষমতা অধিকতর চাহিদা সৃষ্টি করবে। ফলে দ্রব্যসামগ্রী অবিক্রীত থাকার আশংকা তেমন থাকবে না।
৩. সুদ অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়
সুদের হার বাজারে স্থির থাকে না, বরং প্রতিনিয়তই উঠা-নামা করে। অর্থনীতি যখনই একটু চাঙ্গা হয়ে উঠে এবং পুজিঁর চাহিদা বৃদ্ধি পায়, তখনই সুদের হার বেড়ে যায়। অপরদিকে পুজির চাহিদা কমার সাথে সাথে সুদের হারও কমে যায়। সুদের হারের এই অস্থিরতা গোটা অর্থনীতি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অন্যতম প্রধান উপাদান। [চাপরা, এম, উমর, পূর্বোল্লেখিত, পৃঃ ১১৭।] আমেরিকার অর্থনীতিতে নজীরবিহীন অস্থিরতার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে মিলটন ফ্রীডম্যান সুদের হারের অনিশ্চিত উঠা-নামাকেই দায়ী করেছেন। [মিলচন ফ্রীডম্যান, দি ইয়ো-ইয়ো ইউ, এস, ইকোনোমি, নিউজ উইক, ১৫ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৮২ পৃঃ ৪।] বস্তুতঃ সুদের হারের অনিয়মিত চঞ্চলগতির ফলে সুদভিত্তিক বিনিয়োগ, শেয়ার ও পণ্যমূল্য এবং মুদ্রা বিনিময় হারে দারুণ অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। ফলে গোটা অর্থনীতিতে দেখা দেয় চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
বর্তমান বিশ্বের দু’ধরণের সুদের হার চালু রয়েছে: একটি হলো নির্ধারিত হার (Fixed Rate)। ঋণ গ্রহণ-প্রদানকালে এ হার নির্ধারণ করা হয় এবং ঋণের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত এ হার বলবৎ থাকে। ইতোমধ্যে বাজারে সুদের হার বাড়লে বা কমলে উক্ত ঋণের সুদের হারে কোন পরিবর্তন হয় না। সুদের হারের দ্বিতীয় পদ্ধতিকে বলা হয় পরিবর্তনশীল সুদের হার (Floating Interst Rate). এই ব্যবস্থায় বাজারে সুদের হার বাড়লে প্রদত্ত ঋণের ক্ষেত্রেও সুদের হার বাড়ানো হয়। বিনিয়োগ ক্ষেত্রে এই উভয় প্রকার সুদের হারই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে।
নির্ধারিত সুদের হার ব্যবস্থায় বিনিয়োগকারী সুদের হার কিছু কমলে ঋণ নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগে যাবে বলে অপেক্ষা করতে থাকে। অপরপক্ষে ঋণদাতাগণ সুদের হার বাড়লে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ দেবে বলে তাকিয়ে থাকে।অর্থাৎ বাজারে সুদের হার কমলে ঋণদাতাগণ দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগে ঋণ প্রদানে এগিয়ে আসে না। ফলে এই ব্যবস্থায় কেবল স্বল্প মেয়াদী ঋণের লেনদেন ও বিনিয়োগ চলে। দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ হয় না। অথচ উৎপাদনশীল সকল বিনিয়োগই দীর্ঘ মেয়াদ দাবী করে। এক্ষেত্রে অনুৎপাদনশীল স্বল্প মেয়াদী, তথা ফটকা কারবারে বিনিয়োগ বেশি হয়।
সুদের হার যদি পরিবর্তণশীল হয়, তাহলে অর্থনীতির ওপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় আরও মারাত্মক। বিনিয়োগকারিগণ সুদের হারের ঘনঘন উঠা-নামার কারণে দারুণ অনিশ্চিত অবস্থায় নিপতিত হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় যদি কেউ সাহস করে দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগে যায়, তাহলে সুদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে পূর্বের ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি ও কারবারের ওপর আকস্মিক আঘাত পড়ে, তাদের পূর্বের চেয়ে অধিক হারে সুদ দিতে হয়; এতে কারবার থেকে প্রাপ্ত মোট আয়ে (সুদ+মুনাফা) পুজিঁপতির সুদের অংশ বৃদ্ধি এবং উদ্যোক্তার মুনাফার অংশ হ্রাস পেতে থাকে। ক্রমে উদ্যোক্তাকে তার আসল থেকে পুজিঁপতির সুদ পরিশোধ করতে হয় এবং এক সময় কারবারে ব্যর্থ ও দেউলিয়া হয়ে পাততাড়ি গুটাতে হয়। বলা বাহুল্য যে, কারবারের এই ব্যর্থতার (Business Failure) মূল কারণ সুদ, উদ্যোক্তার অদক্ষতা বা গাফলতি এর জন্য দায়ী নয়। অথচ পুজিঁপতিরি সুদ ও আসল তাকেই পরিশোধ করতে হয়। কারবার ব্যর্থ হলে উদ্যোক্তার আর্থিক ক্ষতি হয়, ব্যাপার কেবল এতটুকুই নয়, বরং এর ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, উৎপাদন ও বিনিয়োগ হ্রাস পায় এবং উৎপাদন ক্ষমতাও (Productive Capacity) কমে যায়। এসবের ক্ষতিপূরণ করা সময় সাপেক্ষ এবং অত্যন্ত কষ্টসাধ্যও। বস্তুতঃ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং স্থিতিশীলতার ওপর এসবের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক, সুদুরপ্রসারী এবং মারাত্মক। [চাপরা, এম, উমর: পূর্বোল্লেখিত, পৃ: ১১৮।]