তৃতীয় অধ্যায়
সুদের রাজনৈতিক কুফল
ইতোপূর্বে সুদের নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। নিম্নে সুদের রাজনৈতিক কুফল সম্পর্কে আলোকপাত করা হচ্ছে।
১. সুদ রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে
অনেক সময় লাভজনক কাঝে লাগাবার জন্য সরকার নিজ দেশের জনগণ এবং ঋণদান প্রতিষ্ঠনের কাছ থেকে সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। মূলতঃ সরকারের এ ধরনের ঋণ এবং ব্যসায়ী ও কারবার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত বাণিজ্যিক ঋণের মধ্যে প্রকৃতিগত দিক থেকে কোন পার্থক্য নেই। নির্ধারিত সুদের হারের ফলে বেসরকারী বাণির্জিক ঋণের ক্ষেত্রে যেসব বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, সরকার কর্তৃক পৃঞীত ব্যসায়িক ঋণেও অনুরূপ কুফল দেখা দেয়। সাধারণ অভিজ্ঞাতায় দেখা গেছে, এসব ঋণের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমান সঠিক হয় না। বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ধার্যকৃত সুদের হারের চেয়ে বেশি হওয়া তো দূরের কথা, সুদের হারের সমাও হয় না। ফলে সরকারের পক্ষে ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়। সরকারকে নতুন ঋণ গ্রহণ করে তার দ্বারা পুরাতন ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ করতে হয়। নতুনভাবে বিভিন্ন লাভজনক কাজে অর্থ বিনিয়োগ করা সম্ভব হয় না। জাতির ঋণের বোঝা বছর বাড়তে থাকে এবং বিভিন্নমুখী বিনিয়োগের অভাবে জাতীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে অর্থনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি নান ধরনের রাজনৈতিক জটিলতা, অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জনগণের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি না হওয়ার ফলে জনমনে অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠে এবং সরকার ক্রমেই জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। বিভিন্ন পেশা ও শ্রমজীবী মানুষের পক্ষ থেকে নানাবিধ দাবী-দাওয়ার শ্লোগান উত্থিত হয়। ক্রমে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটি এবং অবশেষে একের পর এক রাজনৈতিক বিশৃংখলা ও পট পরিবর্তনের পালা চলতে থাকে। পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেক সময় দেশের বহু মানুষ ও বিপুল সম্পদ ধ্বংস হয়, কিন্তু সাধারণ মানুষের সমস্যার কোন সমাধান হয় না বরং কখনও কখনও সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয় মাত্র।
সুদ না থাকলে উক্ত রূপ অবস্থা হবার আশংকা তেম থকবে না। কারণ, সুদের অবর্তমানে অন্যান্য ব্যবসায়ীর ন্যায় সরকারও দেশের ধনশালী লোক এবং ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অংশীদারীর ভিত্তিতে পুজিঁ গ্রহণ করতে পারবে। আর এ ধরনের অংশীদারী পুজিঁ বিনিয়োগ করে লাভ কম হলে সরকার অংশীদারকে সেই কম মুনাফার অংশই প্রদান করবে, তার চেয়ে অতিরিক্ত কোন পূর্বনির্ধারিত অংক ঋণদাতাকে দিতে হবে না। যদি বিনিয়োগ লোকসান হয়, তাহলে সে লোকসানের ভাগও সরকার এবং ঋণদাতা উভয়ে মিলেই বহন করবে। সুদী ব্যবস্থায় ন্যায় পূর্বনির্ধারিত সুদ এবং সম্পূর্ণ আসল ফেরত দিতে গিয়ে নতুন ঋণে জড়িয়ে পড়তে সরকার বাধ্য হবে না। ফলে সুদী অর্থনীতিতে যেমন বছর বছর সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যায়, সুদমুক্ত অর্থনীতিতে তা কখনও হবে না। তাছাড়া পুরাতন ঋণের সুদ পরিশোধ করতে নতুন ঋণকেও নিঃশেষ করতে হবে না। এক কাজে ব্যর্থ হলে বা লোকসান দিলে নতুন ঋণ গ্রহল করে বিভিন্নমুখী বিনিয়োগে যাওয়ার পথে সুদরূপী বাধা থাকবে না। সরকারের পক্ষে নতুন নতুন বিনিয়োগে সহজতর হবে এবং অর্থনীতি স্বাচ্ছন্দ গতিতে সমানে চলতে সক্ষম হবে। রজনৈতিক অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলার আশংকা বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
২. সুদ সমাজকল্যাণধর্মী কাজে বাধা সৃষ্টি করে
প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই সমাজকল্যাণমূলক কিছু কাজ থাকে। এসব কাজ করা কেবল প্রয়োজনই নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে অপরিহার্যও। বিশেষ করে, আধুনিক সমাজে এসব সমাজকল্যাণমূলক কাজের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বাড়ছে। উদাহরণ স্বরূপ গ্রামীণ এলাকায় পথ-ঘাট নির্মাণ, আলো ও স্বাস্থ্যারক্ষার ব্যবস্থা করা, বিশুদ্ধ পানির জন্যে গ্রামে গ্রামে টিউবওয়েল বসানো, অনুর্বর জমিকে উর্বল করা, গরীব ও স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারীদের জন্য গৃহনির্মাণ, দরিদ্র সাধারণ মানুষের সন্তানসন্ততির সুশিক্ষার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
এসব কাজের সামাজিক গুরুত্বের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। কিন্তু আর্থিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে দেখতে গেলে এসব কাজ থেকে আর্থিক আয় পাওয়া সম্ভব নয়, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তা কাম্য হওয়াও উচিত নয়। কিন্তু সকল অবস্থাতেই এসব কাজ করতে হলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এত অধিক পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় যে, সরকারের নিজস্ব আয় থেকে এত অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব নয়, বিশেষ করে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশের সরকারের পক্ষে তো নয়ই।
কোন সরকার যদি একান্ত বাধ্য হয়ে সুদী ঋণের দ্বারা এরূপ অলাভজনক সমাজকল্যাণধর্মী কোন কাজে হাত দেয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এই দাঁড়ায় যে, সরকার এ পর্যায়ের যাবতীয় সুদের বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় বা চাপিয়ে দিতে বাধ্য হয়। আসল ঋণ ও তার সুদ পরিশোধ করার জন্য সরকার ট্যাক্স আরোপ করে প্রত্যেক ব্যক্তির পকেট থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঋণ ও সুদের টাকা বের করে নেয়। বছরের পর বছর ধরে সরকার এভাবে জনগণের পকেট থেকে টাকা নিয়ে পুজিঁপতিদের সুদ পরিশোধ করে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, সরকার ১৯৮৯ সালে সুদী ঋণের সাহায্যে পাঁচ কোটি টাকার একটি সেচ প্রকল্প কার্যকর করল। যদি সুদের হার বার্ষিক শতকরা ৬.০০ টাকাও হয়, তাহলে ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত সরকারকে প্রতিবছর ৩০ লাখ টাকা সুদ দিতে হবে, আর জনগণের কাছ থেকে কর হিসেবে এ বিপুল অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। যেসব চাষী এ সেচ প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করবে, সরকার তাদের ওপর সেচকর আরোপ করবে। এই কারের সাথে সুদের অংশও যোগ করা হবে। চাষীও এ পর্যায়ের কর এবং সুদের অংশ নিজের পকেট থেকে পরিশোধ করবে না, বরং সে তার উৎপাদিত ফসলের দামের সাথে সুদ যোগ করে ভোক্তাদের কাছ থেকে এ অর্থ উসূল করবে। এরূপে পরোক্ষভাবে যারা শস্য ব্যবহার করবে, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে এ সুদ আদায় করা হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক দারিদ্র-পীড়িত ও অনাহার-ক্লিষ্ট লোকের ভাতের থালা থেকে কমপক্ষে কয়েকটি করে ভাত কেড়ে নেয়া হবে এবং তা একত্রিত করে এই ঋণদাতা পুজিঁপতির বিরাট উদরে ঢেলে দেয়া হবে। এভাবে উক্ত ঋণ আদায় করতে যদি ৫০ বছরও লেগে যায়, তাহলেও সরকারকে এ দীর্ঘকাল ধরেই গরীবদের নিকট থেকে এক পয়সা-দু’পয়সা করে চাঁদা সংগ্রহ করে ধনী পুজিঁপতির পকেট ভারী করার দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। ঋণ ওপর সুদ দিতে হয় বলে এবং সমাজকল্যাণমূলক কাজে সুদ দেয়ার মত আর্থিক আয় পাওয়া যায় না বলে সরকার সুদী ঋণের সাহায্যে এসব কাজ করতে আগ্রহী হয় না; আর যদিও বা কখনও এ কাজে হাত দেয়, তাহলে জনগণের ওপর কর আরোপ করে সে সুদের অর্থ আদায় করতে সরকার বাধ্য হয়। আর এ কর দ্রব্যমূল্য বাড়ায় এবং জনগণের দুর্দশা বৃদ্ধির কারণ হয়।
এরূপ কর আরোপ করার ফলে সরকার অনেক সময়ই বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়, জনপ্রিয়তা হারায় অথবা কখনও কখনও গণ-অসন্তোষের মুখে ক্ষমতায় টিকে থাকতে ব্যর্থও হতে পারে। তাই প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এসব কাজের জন্য সরকারকে সাহায্য, অনুদান ও সুদমুক্ত ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়। কারও দয়া হলে সাহায্য, অনুদান ও সুদমুক্ত ঋণ পাওয়া যায় এবং এসব কাজ করা হয় অন্যথায় এসব কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হয় না। এভাবে সুদের হার অলাভজনক বা কম মুনাফাকর অথচ অত্যাধিক সামাজিক গুরুত্বসম্পন্ন কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু সমাজকে যদি সুদমুক্ত ছাচেঁ গড়ে তোলা হয়, তাহলে সরকার পূর্বনির্ধারিত সুদ হাতে মুক্ত এবং মুনাফার অংশীদারীর ভিত্তিতে পুজিঁ পাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে লাভজনক কাজে বিনিয়োগে অনাগ্রহী হবরা কেন কারণ থাকবে না। তবে অতি কম মুনাফা বা মুনাফাহীন প্রকল্পসমুহ বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় অর্থ সংস্থান করতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের তলবী আমানতের ওপর মুনাফা দিতে হয় না বিধায় এর একটা অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারকে প্রদান করা হলে সমস্যা অপসারিত হতে পারে।
৩. জাতীয় জরুরী প্রয়োজনে সুদমুক্ত ঋণ পাওয়া যায় না
অনেক সময় সরকারকে জাতীয় জরুরী প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হতে হয়।এসব কাজে আর্থিক মুনাফার প্রশ্ন তো থাকেই না, বরং অনেক সময় বিপুল পরিমাণ অর্থ কেবল অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু সুদী সমাজের এমনই ব্যবস্থা যে, যুদ্ধের ন্যায় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য, যেখানে কেবল অর্থ ব্যয়ই করতে হয়, পুজিঁপতিগণ সুদমুক্ত ঋণ দিতে রাজি হয় না। পুজিঁপতিদের এহেন আচরণের অর্থ এই দাড়ায় যে, সমাজ যে পুজিঁপতিরর জন্ম দিয়েছে, যাকে লালন-পালন করেছে, যাকে আর্থোপার্জনের যেগ্য বানিয়েছে, বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেছে, সর্বোপরি শান্তিতে বসবাস করা ও কাজ-কারবার চালাবার উপগোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে নিরন্তর যার সেবা করে যাচ্ছে, সেই সমাজের বিপদ মুহূর্তে সেই পুজিঁপতিই আর্থিক লাভ বিমুক্ত কাজে সুদহীন ঋণ দি রাজি হচ্ছে না। অথচ সমাজের এসব প্রয়োজন পূরণ হবার সাথে সেই পুজিঁপতিদের নিজেদের স্বার্থও জড়িত রয়েছে। পুজিঁপতি যেন তার প্রতিপালনকারী সমাজকে বলেছে, “তুমি ঐ অর্থের সাহায্যে মুনাফা কর বা না কর, তাতে আমার কিছু আস যায় না, আমি আমার দেওয়া অর্থের ওপর বিশেষ পরিমাণ সুদ অবশ্যই নিতে থাকব”। যুদ্ধের সময় জাতি যে অর্থ ব্যয় করে তা আসলে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। মুনাফা তো দূরের কথা, আসলও সেখানে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যুদ্ধে সফলকাম হলে, বিপুল সম্পদ ও প্রাণের বিনিময়ে জাতি রক্ষা পায়, তার সাথে জাতির পুজিঁপতিরাও বেচেঁ যায়। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হলে বিপুল যুদ্ধ ব্যয়ের সাথে সাথে গোটা জাতিই ধ্বংস হয় বা পরাধীন হয়ে পড়ে, যা থেকে পুঁজিপতিরাও বাদ যায় না। জাতির এহেন জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে জাতির অন্যান্য লোকেরা নিজেদের ধন-প্রাণ সময় ও শ্রম সব কিছু ঢেলে দিয়ে সহযোগিতা করতে এগয়ে আসে। তাদরে কেউ এ প্রশ্ন উঠায় না যে, তাদের এ ভূমিকা ও ত্যাগের জন্য তারা বার্ষিক কত হারে মুনাফা পাবে। কিন্তু পুজিঁপতিদের কথা আলাদা। জাতীয় এমন দুর্যোগ মুহূর্তে, যার সাথে তাদের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নও জড়িত, পুজিঁপতিরা তাদের সম্পদ দেবার পূর্বে এ শর্ত আরোপ করে যে, যত দিন জাতি তাদের এ ঋণ পরিশোধ করতে না পারবে, ততদিন প্রতিবছন একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ তাদের দিতে হবে। এতে যদি শত বছরও লেগে যায়, তাতেও তাদের দাবীর নড়চড় হবে না। বলা বাহুল্য যে, পুজিঁপতিদের থেকে গৃহীত ঋণের সাকল্য অর্থই যুদ্ধ ক্ষেত্রে পুড়িয়ে নিঃশেষ করার পরই জাতি কোন রকমে রক্ষা পেয়েছে। এ যুদ্ধে কত লোক তাদের হাত-পা খুইয়েছে, কত লোক তাদের বাপ, ভাই ও স্বামীকে হারিয়েছে, এদের কেউ আর তাদের হারানো ধন ফিরে পাবে না। কিন্তু পুজিঁপতিরা তাদের ভস্ম করে দেওয়া অর্থ তো ফেরত পাবেই, তার সাথে বছর বছর সুদও তাদের দিতে হবে। আর সরকারকে যুদ্ধে বিধ্বস্ত জনগণের কাছ থেকেই আসল ও সুদের অর্থ সংগ্রহ করে দিতে হবে। এমনকি, হাত-পা খোয়ানো এবং বাপ-ভাই ও স্বামীহারা লোকেরাও এ সুদ সংগ্রহের আওতা থেকে বাদ পড়বে না। আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রঃ) তাঁর সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং গ্রন্হে এতদসংক্রান্ত দুটি বাস্তব ঘটনা পেশ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ সে ঘটনা দুটো এখানে তুলে ধরা হলো:
“আজ থেকে সোয়াশ বছর আগে তৎকালীন ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। সে যুদ্ধে ইংরেজ পুজিঁপতিরা যে যুদ্ধ-ঋণ দিয়েছিল আজও ইংরেজরা তার সুদ পরিশোধ করে যাচ্ছে”।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো আমেরিকার। ১৮৬১-৬৫ সালে আমেরিকায় যে গৃহযুদ্ধ হয়েছিল তার ব্যয় বাবদ যে ঋণ করা হয়েছিল, এ যাবত আমেরিকার অধিবাসীগণ সুদ হিসেবে সে ঋণের চারগুণ অর্থ পরিশোধ করেছে। কিন্তু ঋণ এখনও রয়ে গেছে এবং এখনও তাদেরকে আরও একশ কোটি ডলার সুদ হিসেবে পরিশোধ করতে হবে। [সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৬।]
সুদমুক্ত অর্থনীতিতে অবস্থা অবশ্যই ভিন্নতর হবে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমানকালে সংঘটিত যুদ্ধের অধিকাংশই দেশী ও বিদেশী কায়েমী স্বার্থের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। যুদ্ধের ব্যয় বহন করার জন্য সুদের ভিত্তিতে সহজে ঋণ পাওয়ার কারণে কায়েমী স্বার্থ ভবিষ্যত চিন্তা না করেই এসব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু সুদ রহিত করা হলে এরূপ ঋণ পাওয়া যাবে না। যে কোন সরকারকে তখন যুদ্ধের ব্যয় বহন করার জন্য জনগণের ওপর কর আরোপের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। আর এভাবে সংগৃহীত অর্থে ব্যয় সংকুলান না হলে জনগণের বিত্তশালী অংশের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সুদমুক্ত ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যয় সংকুলানের ব্যবস্থা করতে হবে। অতঃপর যুদ্ধ শেষে কয়েক বছর পর্যন্ত অল্প অল্প করে কর আদায় করে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। দেশের পুজিঁপতি ও ধনী ব্যবসায়ীদের পক্ষে সরকারকে বিনা লাভে এ ধরনের বাধ্যতামূলক যুদ্ধ-ঋণ প্রদান করার পেছনে যুক্তি হচ্ছে, যুদ্ধের সময় অন্যান্য নাগরিকগণ অকাতরে তাদের আমারা-আয়েশ পরিহার করে জাতিকে রক্ষা করার কাজে লেগে যায়; অনেকে তাদের ধন-সম্পদ অকাতরে দান করে এবং অনেকে জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে কুন্ঠিত হয় না। এমতাবস্থায় ধনীগণ জাতি ও দেশের জন্য নিজেদের সম্পদের কল্পিত মুনাফাটুকু ছাড়তে না পারার কোন যুক্তি নেই। তাছাড়া যুদ্ধের সময়ে পণ্য-সামগ্রীর চাহিদা ও দাম বৃদ্ধির ফলে ধনিক শ্রেণী ব্যবসা-বাণিজ্যে যে অতিরিক্ত মুনাফা পায়, তার দ্বারা ঐ ত্যাগের বেশিকিছু ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। সর্বোপরি, ধনীরা সরকারকে ঋণ হিসেবে যে অর্থ দেয়, তার ওপর সরকার সাধরণতঃ আয়কর ধার্য করে না। এতেও সুদমুক্ত ঋণ দানের ত্যাগজনিত ক্ষতি পুষিয়ে যায়।
সুদ রহিত করা হলে এবং উল্লেখিত ব্যবস্থার মাধ্যমে যুদ্ধের ব্যয় বহণের ব্যবস্থা চালু হলে, যুগের পর যুগ ধরে কেবল সুদের বোঝা বয়ে চলার গ্লানি থেকে জাতি মুক্তি লাভ করবে এবং মাত্র কয়েক বছর কিছুটা বাড়তি কর দিয়ে সাকুল্য ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হবে।
তাছাড়া এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বড় লাভ হবে, বিশ্বে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং সামরিক খাতে বাহুল্য ব্যয়ও অনেকাংশে কমে আসবে। ড. উমর চাপরা এ দিকটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, “Present-day wars are at times the product of external or internal vested interests and the discipline of not financing them through the easy resort to the interest based public debt method should help eliminate unnecessary wars. It would also minimise the wasteful· defence build-up which is made possible in both the industrial and developing countries by the easy availability of borrowed funds. The drying up of this source of finance should force nations to explore more seriously all the possible ways of peaceful co-existence.” [চাপরা, এম, উমর: পূর্বোক্ত, পৃ: ১৩৫।] “বর্তমানকালে যুদ্ধ হচ্ছে বাইরের অথবা ভেতরের কায়েমী স্বার্থের সৃষ্টি। সরকার কর্তৃক অতি সহজেই সুদ ভিত্তিক ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে যুদ্ধ ব্যয় সংকুলান করার ব্যবস্থা বন্ধ করা হলে তা বহু অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ প্রতিরোধে সহায়ক হবে। এছাড়া শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশসমূহে সহজ প্রাপ্য ঋণের অর্থ দ্বারা অপচয়মূলক প্রতিরক্ষা সম্ভার গড়ে তোলার বাহুল্য ব্যয় কমিয়ে দেবে। অর্থায়নের এই সহজ উৎস নিঃশেষ হয়ে গেলে তা রাষ্ট্রগুলোকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বাধ্য করবে এবং এজন্য সম্ভাব্য সকল পথ-পন্হা খুজেঁ বের করতে উদ্বদ্ধ করবে”।
৪. সুদ ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করে
ইতোপূর্বে দেখানো হয়েছে যে, সুদ সমাজে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে; কিছু সংখ্যক পুজিঁপতিকে বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক বানিয়ে দেয় এবং সাধারণ মানুষকে ক্রমান্বয় নিঃস্ব ও সর্বহারা শ্রেণীতে পরিণত করে। উপরে এটাও দেখানো হয়েছে যে, সুদ জনগণের ছোট ছোট সঞ্চয়গুলোকেও ব্যাংকের মাধ্যমে পুজিঁপতিদের হাতে তুলে দেয় এবং পুজিঁপতগিণ উক্ত অর্থ সুদের ভিত্তিতে খাটিয়ে বিপুল সুদ অর্জন করে। সুদী ব্যবস্থায় পুজিঁপতিগণ এভাবেই ব্যাংকের মাধ্যমে অন্য লোকদের মূলধন ব্যবহারের সুযোগ পায় এবং ব্যাংকগুলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বস্তুতঃ ব্যাংকের ওপর প্রভাবশালী কতিপয় সুবিধাভোগী লোক নানাবিধ কূটকৌশলের মাধ্যমে এমন সব ব্যক্তিগত সুবিধা ভোগ করে থাকে যা দমন বা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই দুরূহ। প্রভূত অর্থনৈতিক ক্ষমতার বলে এসব লোকেরা রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রভাব খাটায় এবং সমাজের অতিশয় ক্ষমতাবানদের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নেয়। [চাপরা, এম, উমর: ইসলামী অর্থনীতিতে মুদ্রানীতি ও ব্যাক ব্যবস্থার রূপরেখা, পৃ: ১৪।] এভাবেই সুদী ব্যবস্থা অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি সাথে সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা পুজিঁপতিদের হাতে তুলে দেয় এবং ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করে।
এ সম্পর্কে ডি, এম, কোজ বলেছেন যে, “পুজিঁবাদে দক্ষতা নয়, পুজিঁর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণই হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি। ডি, এম, কোজ দেখিয়েছেন যে, “যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন সংস্থাসমূহের শতকরা ৬০ ভাগই মাত্র দু’শ বৃহৎ সংস্থা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ফলে এই দু’শ বৃহৎ সংস্থাই দেশের রাষ্ট্রীয় এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে প্রভাব খাটিয়ে থাকে; আর এ সংস্থাসমূহের ঋণদাতা হচ্ছে ব্যাংক। ফলে সেখানে যাবতীয় ক্ষমতা আসলে ব্যাংকারদের হাতেই কন্দ্রেীভূত হয়ে আছে”। [ডি, এম, কোজ: ব্যাংক কন্ট্রোল অব লার্জ কর্পোরেশনস ইন ইউ, এস, ১৯৭২ পৃঃ ১৪৮।] ড. এম, উমর চাপরা তাঁর ইসলামী অর্থনীতিতে মুদ্রানীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থার রূপরেখা নামক নিবদ্ধে ‘প্যাটম্যান রিপোর্ট’ ও ‘দি সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন রিপোর্টের’ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, “এ দেশে (যুক্তরাষ্ট্র) বৃহৎ ব্যাংকগুলো অর্থনীতি ক্ষেত্রে একক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে”। রিপোর্টে এই মর্মে সতর্ক করা হয়েছে যে, ব্যাংকের এই ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার ফলে প্রতিযোগিতার পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে এবং মারাত্মক স্বার্থদ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। ‘দি সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের রিপোর্টের উপসংহারে মন্তব্য করা হয়েছে যে, আমেরিকার বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠন, বিশেষ করে ব্যাকংসমূহ প্রভূত অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। সেখানকার কোম্পানী, বিশেষ করে বৃহৎ কম্পানীগুলোর সিকিউরিটিই হচ্ছে ব্যাংকগুলোর প্রধান বিনিয়োগ এবং এজন্য ব্যাংকগুলো এসব কোম্পানীর ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব খাটিয়ে থাকে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দু’শ অ-আর্থি প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত জরিপের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, এই বৃহৎ অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠনগুলো অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্টক (শেয়ার) ক্রয় করে অথভা এদেরকে মূলধন যোগান দেয় এবং এদের ওপর নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে থাকে। ডি, এম,কোজ তাই মন্তব্য করেছেন যে, “ এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, সর্বাধিক ধনশালী এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান পুজিঁপতিরা ব্যাংকের মাধ্যমেই কাজ করে এবং ক্ষমতা খাটিয়ে থাকে। রকফেলার ও মেলোন’ রা তাই নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা সংস্থাসমূহের নিয়ন্ত্রণে অধিকতর দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে”। [চাপরা, এম, উমর: উপরোক্ত, পৃঃ ১৪।]
সুদী সমাজে সম্পদ ও ক্ষমতা কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে কুক্ষিগত হয়। সাধারণ মানুষ নিঃস্ব ও সর্বহারা হবার কারণে তাদের কোন ক্ষমতাই থাকে না। এ অবস্থায় সেখানে গণতন্ত্রও আর গণতন্ত্র থাকে না এবয সবকিছু পুজিঁপতিদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়। সুদী সমাজের অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের ন্যায় প্রেস, প্ল্যাটফরম, এমনকি, রাজনৈতিক দলগুলোও পুজিঁ ও ক্ষমতার হাতে বন্দী হয়ে পড়ে এবং তাদের ইচ্ছাতেই চলতে বাধ্য হয়। পুজিঁপতিরা যেভাবে চায় সে ধরনের সরকারই সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সরকারের যাবতীয় পলিসিও পুজিঁপতিদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।