অধ্যায় এক
সমসাময়িক ইসলামী আসালা : এমমাত্র সমাধান
দিক নির্দেশিকা
মুসলিম জাতির মূল্যবোধ ও রীতিনীতি এবং এর মানবীয় ও বৈষয়িক সম্পদ সম্পর্কে ধারণা থাকা সত্ত্বেও যদি উম্মাহ স্পর্কে গভীর জ্ঞান না রাখেন, তাহলে তার পক্ষে উম্মাহর বর্তমান সাংস্কৃতিক অধোগতি, রাজনৈতিক বিচ্যুতি এবং উম্মাহর মূল সংকট। এটি অবশ্যম্ভাবী যে, এ ধরনের পশ্চাৎপদ এবং দিক নির্দেশনাহীন অবস্থা মুসলিম উমআহর চেতনার জগতে প্রধান বিষয় হিসেবে গণ্য ছিল, যা মুসলিম উম্মাহর অগ্রবর্তী ও চিন্তাশীল মনীষীগণ বরাবর চর্চা করে এসেছেন। সুতরাং এটিই স্বাভাবিক যে, উম্মাহকেই পরিবর্তন, সংস্কার ও পুনর্জাগরণ সম্ভব করতে হবে।
উম্মাহর কাঠমোগত সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানতে হলে এবং সীমাবদ্ধতাগুলো সফলতার সাথে দূর করার জন্য যে সব শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন হবে, আমাদেরকে সেযস মূল কারণ অবশ্যেই নির্ণয় করতে হবে। প্রকৃতপকেষ উম্মাহর বর্তমান দুর্বলতা ও পশ্চাৎপদতা এমন প্রকটভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে যে, উম্মাহর অস্তিত্ব, এর জীবন বিধান, চিন্তা. প্রতিষ্ঠানসমূহ পশ্চিমা সভ্যতাার দ্বারা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে উম্মাহর প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য একটি ব্যাপক এবং গভীর বিচার- বিশ্লেষণমূলক নিরীক্ষা ও অনুসন্ধিৎসা থাকা দরকার। এ ধরনের চুলচেরা বিশ্লেষণ আমাদেরকে এমন এক পথের সন্ধান দেবে, যে পথে অগ্রসর হলে উম্মাহর অধঃপতনেসর মৌলিক কারণগুলো আমরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হতে পারবো।
কয়ে শতাব্দী যাবত উম্মাহ অধঃপতিত অবস্থায় রয়েছে। প্রত্যন্ত কিছু অঞ্চল ছাড়া উম্মাহর সকল এলাকা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দখলে ছিল। সম্ভবত এর চেয়েও বেদনাদায়ক সত্য যে, এখন পর্যন্ত উম্মাহর উপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রভাব সতত ক্রিয়াশীল। গোটা বিশ্ব উম্মাহর কূটনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এলাকাসমূহ, বিদেশী শিল্পের জন্য উপযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বাজার, এর কাঁচামাল এবঙ সস্তা অদক্ষ শ্রমিক দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ঐ সব ঘটনা এমন সময় ঘটছ যখন উম্মাহ নিজের প্রয়োজনই মেটাতে পারছে না এবং শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত কাঠামোসহ অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তির উন্নততর প্রতিষ্ঠান এবং স্বাধীন সার্বভৌম ক্ষমতার উৎসসমূহের অভাবের তাড়নায় দারুণভাবে জর্জরিত।
উম্মাহর অধঃপতনের কারণ ইতিহাসের গভীর গ্রোথিত রয়েছে। যেমন, অনেক জাতির ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের অধঃপতনের শুরুতে তারা সম্পদ ভোগ করেছে এবং স্বচ্ছন্দে জীবন নির্বাহ করেছে, যা ছিল তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের উন্নতি ও প্রগতির ফসল। উম্মাহর ক্ষেত্রে উপর্যিুক্ত উদাহরণসমূহ, ব্যক্তির অঢেল ধনসম্পদ এবঙ সরকারি কর্মচাঞ্চল্যের কোনো কমতি ছিল না। তথাপি পতনের সুস্পষ্ট চিহ্নসমূহ সীমান্ত বৃদ্ধির তৎপরতা, দূর্নীতির সামাজিকীকরণ ও আক্রমণাত্মক মনোভঙ্গির বদলে আত্মরক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গির লালনেএবং জাগদাদ, জেরুজালেম, কর্ডোভাসহ বিভিন্ন স্থানের অপরিমেয় ক্ষতির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমরা আমাদের অধঃপতনের কারণসমূহ জানতে চাইলে আমাদের অসুস্থতার কারণ ও এর লক্ষণ এবং জটাজালের মধ্যৌ সুস্পষ্ট রেখা টেনে তার পরেই তুলণামূলক আলোচনায় প্রবেশ করতে হবে। প্রাচীন সম্প্রদায়সমূহের ঐতিহাসিক বিকাশ এবং বিভিন্ন ধরনের মতবাদ উম্মাহর ক্ষেত্রে নতুন কোনো বিষয় নয়। এসব দার্শনিক মহত হলো সাবাইয়া, ইসমাইলিয়া, নুসাইবিয়া, দ্রুজ ও অন্যান্য। অতীতের ধারাবাহিকতার সূত্রে বর্তমান টিকে আছে বাহাই, আহমাদিয়া, কাদিয়ানী এবং জাতীয়তাবাদ।
উপরিউক্ত আন্দোলনগুলো কোনো সমস্যার চিহ্ন বহন করে না, উম্মাহর প্রাথমিক বছরগুলোতেই এগুলো শিকড় গড়ার সুযোগ পেয়েছিল। রোমান ও পারসিয়ার রাজন্যবর্গ মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল, এই অস্ত্র ধারণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়নের কারণেই মরু আরবজাতির মধ্য সামাজিক ও সারিক শক্তি প্রসারের (যারা সে সময় ইসলাম গ্রহণ করেছিল।) লক্ষেযে কর্যক্রমক গৃহীত হয়েছিল তার ফলেই ঐ ধরনের বিভিন্নমুখী মতবাদের সৃষ্টি হয়। ইসলামী শিক্ষার পরও আরববাসীর উপজাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি কখনো পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়নি। তারা শীঘ্রিই বিদ্রোহ করে বসে এবং কালক্রমে নবীর প্রতিষ্ঠিত রাজধানী মদীনা আক্রমণ করে উসমান ইবনে আফ্ফান দধা দৃদীয় খলিফার সরকারের পতন ঘটায়। এই দুর্ঘটনা রাষ্ট্র সৃষ্টিতে উপজতীয় এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গির এমন পর্যায়। এই দুর্ঘটনা রাষ্ট্র সৃষ্টিতে উপজাতীয় এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদাযেল দৃষ্টিভঙ্গির এমন পর্যায় অতিক্রম করে যা ইসলামী এবং ইসলাম পূর্ব শিক্ষা ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে।
গভীর অভিনিবেশের সাথে উম্মাহর বিষয়গুলো মুল্যায়ন করলে আমরা উম্মাহর সংকট ও সমস্যাগুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি। এসব ক্ষতিকর ঘটনাগুলো স্পষ্ট এবং বাস্তব, মূলত উপর সকল যক্তিবাদী মানুষ একমত হতে পারে, তবুও এসব বিষয়য়ের সমাধানের ব্যাপারে কোনো ঐকমত্য নেই বা সিদ্ধান্তের জন্য সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট কোন দৃষ্টিভঙ্গিও নেই। সবচেয়ে বড় জটিলতা হলো জাতিকেন্দ্রীকতা ও জাতীয় নাস্তিকতা, বল প্রয়োগ এবং যৌন স্বাধীনতার এন্তার বিস্তার। নিজেদেরকে যারা সংস্কারক বলে দাবি করেন তারেদ মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা প্রকৃতপক্ষে উম্মাহর শত্রু, কেননা তারা এসব বিদেশী মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সকল পথ ও পন্থা ব্যবহার করেন। তাদের প্রকাশ্য দাবি হলো এসব মতবাদ সুস্থ সমাজরে লক্ষণ বা এগুলোর সংস্কার প্রগতির পথে যাত্রা শুরুরই ইঙ্গিত।
প্রথমত আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংকট সমাধানের শুরুটা আমরা কোথা থেকে শুরু করবো। আমাদের উচিত হবে উম্মাহর আওতাধীন যাত্রা শুরুর নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে নির্ণয়ের বিকল্পসমূহ স্থির করা। সে প্রেক্ষিতে এগুলোকে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ
১. বিদেশী সমাধানের অনুকরণ: এটিকে প্রায়শ বিদেশী সমাধন বলা হয়, যা মূলত ধার করা সমাধান এবং যার মূল ভিত্তি বা উৎ
স হলো সমসাময়িক পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা (ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্তুবাদ), এটি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, সমষ্টিবাদ বা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, নিরীশ্বরবাদ, পুঁজিবাদ অথবা মার্কসবাদ হিসেবে পরিচিত।
২. ঐতিহাসিক সমাধানের অনুকরণ : এই সমাধান ইসলামের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত সমাধানের উপর নির্ভর করে, যা কোনো স্থন-কাল-পাত্রের সংশ্লিষ্টতাকে গুরুত্ব দেয় না।
৩. ইসলামের মৌলিক সমাধান : এটি হচ্ছে ইসলারেম সূত্রগেো থেকে সাহায্য নিয়ে উম্মাহর বিভিন্ন সমস্যার প্রাসঙ্গিক সমাধানের জন্য প্রয়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি। মৌলিক প্রাণশক্তি পুনরুদ্ধানেরর জন্য উম্মাহর আকাঙ্ক্ষা চারটি পূর্বশর্ত রয়েছে।
ক. একটি সুষ্ঠু দৃষ্টিভঙ্গি নির্দিষ্টকরণ, খ. দৃষ্টিভঙ্গির উপর অবিচল আস্থা; গ. লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করার দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হওয়া এবং ঘ. এর সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তব উপকরণসমূহের ব্যবস্থা করা।
আমরা যে বিষয়গুলোকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে মনে করেছি তা যদি সরাসরি জনগণের কাছে নিয়ে গিয়ে এবং উম্মাহর লেখক, চিন্তাবিদ ও নেতৃবৃন্দের কাছে ব্যাখ্যা করে আমরা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে পারি এবং তা হলেই আমাদের মাঝেযে দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে তার সাথে তাদেরকে শরীক করা সম্ভব হবে।
সম্ভবত: সমাধান খুঁজে পাওয়ার সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হচ্ছে আমাদের ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতাগুলোও খোলাখুলি প্রকাশ করা। কেন এ দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক নয় তা ব্যাখ্যা করার পর সঠিক সমাধান উপস্থাপ৪ন করে কেন এ সমাধান গ্রহণ করা হলো তাও ব্যাখ্যা করতে হবে। এই পুস্তকে এই পদ্ধতেই অনুসরণ করা হয়েছে। উম্মাহ যেখানে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে আক্রান্ত এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসীরা উম্মাহকে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করতে চায়, সে সে ক্ষেত্রে উম্মাহকে অবশ্যই সে কারণগুলো উপলব্ধি করতে হবে যে, কেন অন্যদের প্রস্তাবিত সমাধান উম্মাহর কোনো কাজে আসছেনা। এভাবে উম্মাহ নিজের জন্য এর চেয়ে উপযোগী সমাধান নির্ণয় করতে আরো বেশী সক্ষম হবে এবং এই সমাধানকে বাস্তবে রূপদান করা যাবে।
অনুসরণযোগ্য ঐতিহাসিক সমাধান
ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিই ঐতিহ্যগতভাবে উম্মাহর পছন্দনীয়। এই দৃষ্টিতে স্ববাবতই পার্থিব এবং জাতিগত বিবেচনাকে দূরে সরিয়ে রাখে। সাম্প্রতিক সময়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি আধনিক জীবনধারা এবঙ উম্মাহর অস্তিত্ব ও চিন্তাধারার প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন শক্তিগুলোর চ্যালেঞ্চ মোকাবিলায় বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ঐতিহাসিক সমাধানগুলো কার্যকর থাকলে বর্তমানের কোনো সংকট দেখা দিত না। কোনো অধঃপতন আসত না এবং কোনো ভাবে দুর্যোগের ভয় থাকত না। অধিকন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব হ্রাসকারী কোনো উপাদান যদি থেকেই থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে, ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি সেগুলোকে বিবেচনায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। যাই হোক, এই দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যাটিকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে মোকাবিলা করতে পারেনি।
ইতিহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রধা ত্রুটি হচ্ছে, যেহেতু এটি তার নিজস্ব শুদ্ধতা সম্পর্কে পূর্ব শুভ ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করে সে কারণে এই দৃষ্টিভঙ্গি তার সাথে দ্বিমত পোষণকারী সংশ্লিষ্টমহল, দৃষ্টিভঙ্গি এবং পরিবেশকে কোনোভাবেই বরদাস্ত করতে পারে না। যে দৃষ্টিভঙ্গি বিরোধীদের সহযোগিতা কামনা করে তা সত্যিই অবাস্তব। বরং এটি উম্মাহর সমস্যারই কারণ। যে দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘকাল ধরে উম্মাহর চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে রেখেছে তা হচ্ছে ইসলামের স্বর্ণযুগের বাহ্যিক ঠাটবাট বজায় রাখার একগুঁয়েমি মনোভাব, এর চেয়ে বেশি বললেও অত্যুক্তি হবে না। ঐতিহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাস ও বস্তুগত উন্নতির বাস্তবতাকে উপক্ষো করে। সুতরাং ইসলামের উপর উম্মাহর ঈমান থাকলেও ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি পূর্বাপর ব্যর্থ হয়ে আসছে। ফকিহগণ আধুনিক জগতের ‘মোয়ামেলাত’ বা বৈষয়িক বিষয়াবলীর চর্চা থেকে নিজেদেরকে দূরে রেখে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও ব্যক্তিগত বিষয়াবলীর মধ্যেই কেন্দ্রীভূত করে রেখেছেন তাও ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ। ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি এখন যুক্তিহীন প্রান্তিক চরমপন্থার দিকে কীভাবে নিয়ে যেতে পারে তার প্রকৃত উদাহরণ এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কারকের একটি উক্তি। এই সংস্কারক খোলাফায়ে রাশেদীনেসর সময়কালের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পদ্ধতির মধ্যকার সম্পর্কের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ঐতিহ্যক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তিনি যে মতামত ব্যক্ত করেছিলেন তা ছিল তার ভাষায় একিটি ন্যায়পরায়ন একনায়কত্ব, যাদের মাধ্যমে উম্মাহর সংস্কার করা যেতে পারেব। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে কোনো ছাত্রই জানেন সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে এই ধরনের উক্তি স্ববিরোধিতার নামান্তর মাত্র। একনায়কত্ববাদ ও ইনসাফ যে সংঘর্ষশীল এবং কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়, তা আল্লাহর কিতাবে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে: মানুষ নিজেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ হিসেবে ধারণা করে সব ধরনের সীমারেখা লঙ্ঘন করে (৯ : ৬-৭)
…এবঙ তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করুন ( ৩:১৫৯)
…যারা নিজের কাজকর্ম পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে করে (৪২:৩৮)
ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে প্রথম খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়। উদাহরণ হিসেবে সে আমলে খলিফাদের সাথে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতি গ্রুপের মোকাবিলার বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব বি্দ্রোহই শেষ পর্যন্ত আল হুসাইন ইবনে আলী, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, মুহাম্মদ দুআল-নাফস আল জাকিয়া, যায়েদ ইবনে আলী এবং অন্যান্যদের মতো পুরানো নেতৃত্ব যারা মদীনর প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের অনুকরণে একটি ইসলামী প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রবক্ত ছিল, তাদের সাথে উদীয়মান রাজনৈতিক নেতৃত্ব যারা জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক অহমিকাবোধ এবং উপজাতীয় আনুগত্রেল ভিত্তিতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের সাথে চূড়ান্ত পর্যায়ে সংঘর্ষের রূপ লাভ করে। যখন প্রথম গ্রুপটি দ্বিতীয় গ্রুপের কাছে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হলো তখন প্রথম গ্রুপের লোকজন এবং তাদের সাথী মনীষীরা সমাজ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। যত সময় অতিক্রান্ত হতে লাগল ততই সমাজ থেকে মুসলিম বু্দ্ধিজীবীদের বিচ্ছিন্যতাবাদ প্রকট হতে লাগল। এর ফলে নতুন চিন্তাস্রোতের একটি দল সৃষ্টি হলো, যারা ছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সংরক্ষণবাদী (কারণ তাদের ভয় ছিল স্বেচ্ছাচারী শাসক ও তাদের তাবেদারদের হাতে শরিয়াহ বিকৃত হতে পারে) যারা এ ধরনের মতের অনুসারী ছিল, তারা তাদের লেখার পুরো অংশেই ইসলামের প্রাথমিক যুগের ঘটনাবলীর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইসলামী সমাজ ও সংস্কৃতির অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয় (মুহাম্মদ (সা)-এর জীবনকাল এবং তাঁর ওফারেত পর ত্রিশ বছর)। এবাবেই তারা সুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে অযোগ্যদের হাতে উম্মাহর রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব ছেড়ে দিল। এভাবে ময়দান ছেড়ে দেয়ার কারণে উম্মাহ সৈরতন্ত্র, দারিদ্র এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হলো। বাস্তবিকই মোঙ্গলীয় আগ্রসন এবং ক্রুসেডের সময় থেকে এটাই ছিল উম্মাহর ভাগ্যলিপি। অতিসাম্প্রতিককালে মুসলিম জাতি বিদেশী ঔপনিবেশিক শক্তির পদানত হয়েছে এবং তাদের অবস্থা হয়েছে এমন যে, স্বেচ্ছায় হোক বা চাপের মুখে হোক, তরা একটি বিদেশী সভ্যতার অন্ধ অনুকরণজনিত বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে এই অন্ধ অনুকরণের ফলে তারা বৃহত্তর এবং ব্যাপকভাবে নাজুক পরিস্থিতি ও পতনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। এভাবে উত্তর এ দক্ষিণের উন্নত শিল্পসমৃদ্ধ দেশ এবং তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশ যাদের অধিকাংশিই মুসলিম, এদের মধ্যে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবঙ প্রযুক্তিগত ব্যবধান বর্তমান রয়েছে। এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যায় যে, ঐতিহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি কোনো কাজে আসেনি এবং স্থান, কাল ও চিন্তার জগতে জীবসেনর নিরন্তর পদচারণা অন্তঃসারশূন্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে এই দৃষ্টিভঙ্গের সুস্পষ্ট পরিণতি হলো পশ্চাৎমুখীতা, দুর্বলতা ও পতন।
অনুসরণযোগ্য বিদেশী সমাধান
এই দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম বিশ্বে বিদ্যমান। দু’শ বছর আগে যখন উসমানিয়া সাম্রাজ্য ইউরোপের সামরিক শক্তির মুখোমুখি হলো তখনই প্রথম এ বিদেশী সমাধান গ্রহন করা হয়। খলিফা তৃতীয় সেলিমের আমলে উসমানীয় সাম্রাজ্য তাদের পতনমুখী শক্তি পুনরুদ্ধারের উপায় হিসেবে ইউরোপকে অনুকরণের নীতি গ্রহণ করে। যখন বিদেশী কারিগর, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আমদানীর চেষ্টা করা হলো তখনই অন্তঃসার শূন্যতার পরিক্রমা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অনুকরণই তাদের অভিষ্ট লক্ষ্য হিসেবে পরিণত হলো। প্রথম আধুনিক ইনিঞ্জনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তুরস্ক এই ব্যাপারে তার অভিযাত্রা শুরু করে। এরপর পাশ্চাত্য কায়দায় সেনা অফিসারদের প্রশিক্ষণেল জন্য একটি সামরিক একাডেমী স্থাপন করে। উসমানীয় খলিফারা তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করা এবং তাদের নিজস্ব পুরোনো সেনাবাহিনী জেনিসারিকে যখন আধনিকায়ন পরিকল্পনা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে, তখন তারা ব্যারাকে তাদের বাহিনীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সে যাহোক উসমানিয়া সাম্রাজ্যের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে পাশ্চাত্রের অনুকরণ, পাশ্চাত্যের পদ্ধতি অনুসরণ কোনোটাই সফল হতে পারেনি। বরং পশ্চিমা সামরিক শক্তির অগ্রাভিযানের দাপটে উসমানীয় সালতানাত অব্যাহতভাবে পিছু হটতে থাকে। ঘটনার অপ্রত্যাশিত মোড় পরিবর্তনের কারণে তারা ইউরোপে ঝাঁকে ঝাঁকে শিক্ষার্থী পাঠিয়ে পাশ্চাত্যের অনুকরণপ্রিয়তাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এই নীতির ফলে পাশ্চাত্যকরণ প্রক্রিয়া আরো বৃদ্ধি পায়। ফলে অনুসরণের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। রাজনৈতিক বা সামাজিক সংস্কার পাশ্চাত্যের ধাঁচে এগিয়ে নিতে হবে, এ সম্পর্কিত তুর্কিদের ধারণা ছিল এক ধরনের অনুকরণপ্রিয়তা। এই অনুকরণপ্রিয়তা এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তা না হলে তাদের সাম্রাজ্যের পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক সংস্কারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হতো না। এই ধারণা ও চিন্তাধারা অনেক উদার রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের জন্ম দেয়।
এসব সংস্কার পরবর্তী ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে মিধাত পাশার সংবিধানে সন্নিহিত হয়ে গৌরব দীপ্ত হয়। এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য যে, তাদের সংস্কারের এই প্রচেষ্টা পূর্ববর্তীদের তুলনায় তেমন সফল হয়নি। এভাবে তারা সুলতান আবদুল হামিদ দ্বিতীয়কে সরাসরি শাসন পরিচালনায় উৎসাহিত করে। কারণ এ টিই ছিল ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ঐতিহাসিক মডেল পুনরুদ্ধারের সর্বশেষ হতাশাব্যঞ্জক প্রচেষ্টা। এই সংস্কার আন্দোলন বিদেশী অনুকরণ নীতির উপর ভিত্তি করে অগ্রসর হয়। জাতিগঠনের উপাদান হিসেবে জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব সম্পর্কিত এক নতুন ও সুস্পষ্ট ইউরোপীয় ধ্যানধারণা এই সংস্কার আন্দোলনের এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তুর্কিদের মধ্যে বিদেশী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী সংস্কার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ জাতীয়তাবাদী ধারণাকে বলিষ্ঠভাবে উচ্চারিত করে। এটি অবশ্যম্ভাবীরূপে একটি প্যান-তুর্কি জাতীয়তাবাদ। পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার সকল তুর্কি ভাষাভাষী এর আওতাভুক্ত হয়। ঊনবিশং শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আধুনিকপন্থী সংস্কার আন্দোলনে তুরস্ক ক্ষমতাসীন হতে শুরু করে। এ সময় তারা ইউনিয়ন এবং প্রগ্রেস পার্টি নামে উসমানীয় সালতানাতকে চ্যালেঞ্জ করে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিয়ে নিজেরা ক্ষমতা দখল করে বসে। তুর্কিদের এই সংস্কার প্রচেষ্টা চূড়ান্ত যুদেগ্ধর পরাজয়ের মাধ্যমে ব্যর্থ হয়। এই বিপর্যয় ছিল উসমানীয় আমলের যে কোনো বিপর্যয়ের চেয়ে অধিক ভয়াবহ। চূড়ান্ত যুদ্ধে গ্রীকরা আনাতোলিয়ার প্রাণকেন্দ্র তুর্কিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। অথচ গ্রীকরা ছিল তুর্কিদের তুচ্ছ প্রজা।
এই সব দুর্বিপাক সত্তেও বিদেশী সংস্কার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। আধুনিক তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল মোস্তফা কামাল এবং তার সামরিক চক্রের হাতে উসমানীয় সালতানাতের পতন পর্যন্ত উপরিউক্ত সংস্কার আন্দোলন চলতে থাকে। এই মহল ইউরোপীয় ধাঁচের সাথে সংগতি রেখে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতির অবয়ব ধূলিসাৎ করে ইউরোপীয় ধর্মিনিরপেক্ষতাবাদী মতবাদ গ্রহণ করে এবং সুস্পষ্টভাবে ইসলামকে রাষ্ট্র ও সমাজের সকল ক্ষেত্র থেকে পৃথক করে ফেলে। উপরন্তু তারা ইসলামী আইন ও উসমানীয় রীতি পদ্ধতিকে রহিত করে তদস্থলে ইউরোপের সবচেয়ে অগ্রসর দেশ সুইজারল্যান্ডের আইনকানুন প্রতিষ্ঠা করে। ভবিষ্যত প্রজন্মের ধ্যানধারণায় ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাব চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে আরবি বর্ণমালা রহিত করে সেখানে লাতিন বর্ণমালা চালু করে। জনসাধারণকে ইউরোপীয় পোশাক পরিধান করতে, মহিলাদেরকে হিজাব পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এমনকি আজানের মতো একটি ইসলামী অনুষ্ঠানকে তুর্কি ভাষায় কার নির্দেশ দেয়া হয়।
আতাতুর্কের শাসন পরিসমাপ্তির আগে নব্য সরকার দেশের প্রধান অর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসন ও সেগুলোর নীতি নির্ধারণে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ সম্পর্কিত বিধি আরোপ করে। বিশেষ করে ব্যাং ও বীমা কোম্পানির মতো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্র গ্রহণ করে। যাহোক, একটি আধুনিক সেনাবাহিনীর সংগঠন, বেসামরিক প্রশাসনের আধুনিকায়ন, উদারনৈতিক মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রসার, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কারের আইন প্রণয়ন, জাতীয়তাবাদ, উপজাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ গ্রহণ, ইউরোপীয় আইন ও পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণসহ সব ধরনের বৈদেশিক অনুকরণ ও অনুসরণের সকল পর্যায় অতিক্রম করা সত্ত্বেও তুরষ্কের উপর পাশ্চাত্য শক্তির চাপের মুখে আতাতুর্কের উত্তরাধিকারী এবং দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সহচর জেনারেল ইসমত ইননু দেশে একদলীয় শাসন (রিপাবলিকান পার্টি) অবসান করে এক নতুন ধরনের উদার রাজনৈতিক সংস্কার মেনে নিতে বাধ্য হলেন। এর ফলে নতুন করে নির্বাচন হয় এবং আদনান মেন্দারেসের নেতৃত্বে বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতাসীন হয়।
এসকল পরিবর্ন যত গুরুত্বের সাথেই সম্পন্ন করা হোক না কেন, এর কোনটাই তুরস্ককে উদ্ধার করতে পারেনি অথবা তাকে খেলফতকালের গৌরবময় ক্ষমতা এবং মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পারেনি। বরং অথঃপতন এমন ষোলকলায় পূর্ণ হলো যে, ১৯৬০ সালের এক সামরিক অভ্যুত্থানের পর আদনান মেন্দারেসকে ফাঁসিত ঝুলানো হয়। পরপর কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে যার ফলে একনায়কত্ববাদ ও জুলুম জাতির উপর জেঁকে বসে। সুতরাং তুরষ্ক আগেরমতোই ‘সিকম্যান অব ইউরোপ’ই রয়ে যায়। সত্য বটে তুরস্কের অবস্থা ছিল সিকম্যানের চেয়েও নাজুক। তুরস্ক হচ্ছে পাশ্চাত্যের সবসময়ের অনুবর্তী। তার ভাগ্য উন্নয়নের কোনো আশাই আর অবশিষ্ট রইল না।
যদি আমরা মোহাম্মদ আলীর সময় ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে মিশর যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করি এবং আমরা যদি আরব, এশিয়া এবং আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমরা তুরস্কের অভিজ্ঞতার ও তার বেদনাদায়ক ফলাফলের বাইরে নতুন কিছুই সংযোজন করতে পারব না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম জাহান একটি দুর্বল ও ভঙ্গুর অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর াতে এ সভ্যতার যে ভিন্নতা রয়েছে তা ক্রমান্বয়ে বিস্তৃততর হয়েছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যর্থতার কারণগুলো সহজেই হৃদয়ঙ্গম করা যায়। জাতিকে জীবন্ত মানুসের সমষ্টি হিসেবে তার পরিগঠনে বাধাবিপত্তি কাটিয়ে উঠার ক্ষেত্রে যে পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হয় তা ব্যক্তির পরিগঠনের তুলনায় অবশ্যই অনেক জটিল। তারপর প্রতিটি জাতির নিজস্ব প্রেরণা, মনস্তত্ব ও ইতিহাস রয়েছে আরো রয়েছে মূল্যবোধ, বিশ্বস ও মতবাদের ক্ষেত্রে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। এসব সঠিকভাবে বুঝাতে না পারলে একটি জাতির অগ্রগতির জন্য তর সুপ্ত সম্ভাবনাগুলো উপলব্ধি করে তাকে অনুপ্রাণিত করা কঠিনতর হবে।
একজন মানুষকে যা অনুপ্রাণিত করতে পারে তা অন্যকে নাও করতে পারে। বিভিন্ন জাতি সম্পর্কেও এটা সত্য। কারণ, প্রতিটি জাতি সক্রিয় ও সজীব থাকে তার নিজস্ব প্রণোদনা ও অগ্রাধিকার নীতির মধ্যে। অন্য জাতির সাথে আলোচিত জাতির মৌলিক পার্থক্য না বুঝে কোনো জাতির প্রণোদনা ও অগ্রাধিকার নীতির উপেক্ষা করা এবং উৎপাদন ও সংস্কারের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে উপলব্ধি না করলে বিগত শতাব্দীর মতো উম্মাহর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর হবে না।
সাম্প্রতিক ইতিহাসের কিছু দৃষ্টান্ত
পূর্বে যা উল্লেখ করা হয়েছে তার সহজবোধ্য ও সরল উদাহারণ হলো, পাশ্চাত্যের অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যা মুসলমানদের উপর প্রভাব বিস্তার করে আছে। পশ্চিমা দেশগুলো এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু হয়। ব্যাংকিং-এর কাজ ছিল পাশ্চাত্য সমাজের আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনগুলো মেটানো। আমদানিকৃত এই প্রতিষ্ঠানটি মুসলিম উম্মাহর বুনিয়াদী বিশ্বাসের উপর সুস্পষ্টভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। উম্মাহর উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সহায়তাদানের পরিবর্তে এ ব্যংকিং ব্যবস্থা অধিকতর পাশ্চাত্য প্রভাবের পথকে সুগম করে। বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের পার্থক্যকেই এ নেতিবাচক ফলাফলের কারণ বলে ধরে নেয়া যায়। বাস্তবিকই পাশ্চত্যের ধাঁচের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রগতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করার পরিবর্তে বিভেদ সৃষ্টি, অধিকতর সাংঘর্ষিক পরিবেশ সৃষ্টি, উম্মাহর শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়ে, উম্মাহর প্রেরণাদায়ক শক্তিকে ক্ষয়িষ্ণ করা, প্রণোদনাকে নির্বাপিত করা এবং সম্পদের উপর বিদেশী আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে সহজতর করা মাধ্যমে সাফল্য লাভ করে।
পাশ্চাত্য ধাঁচের ব্যাংকিং ব্যবস্থা পাশ্চাত্যে সফল হয়েছে বলে ধরে নিলে মুসলিম সমাজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার কারণ এই যে, এই ব্যবস্থার মধ্যে এমন সব রীতি-পদ্ধতি সংযুক্ত করা হয়েছে যা মূল বিজাতীয় এবং ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধের বিরোধী। ব্যক্তি মুসলিম এবং মুসলিম উম্মাহকে এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা কঠিনতম পরীক্ষার সম্মুখীন করে। পরীক্ষার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো একজন ব্যক্তি বা মুসলিম জাতিকে সুদভিত্তিক লেনদেনের মাধ্যমে সম্পদ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করে পরকালীন জীবনে লাঞ্ছিত হওয়া অথবা ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধের অনুসরণ করে এ দাবি হচ্ছে সে এ দুনিয়াতে এমন একটি সুন্দর জীবনযাপর করবে যার ফলে েস আখেরাতের অনন্ত জীবনে আল্লাহর করুণা, প্রতিদান এবং চিরকালীন সুখ অর্জন করতে পারবে। এ দুনিয়াতে কোটি ভালো ও সঠিক এবং আখেরাতে কোনটি ভালো, মুসলিম বিবেকের মধ্যে এ নিয়ে দ্বৈত বোধ-বিশ্বাস অথবা স্ববিরোধিতার কোন সুযোগ নেই। মুসলিম বিশ্বে আজকের দিনের ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামী মাধঘান অথবা বিকল্প ব্যবস্থার একটি আংশিক উদ্যোগ মাত্র। যা সমসাময়িক কালের ইসরামী চাহিদা পূরণেল আশাবাদ ব্যক্ত করে এবং এটি মুসলমানদের এবঙ এটি মুসলমানদের ব্যক্তিত্ব, চিন্তাধারা ও হৃদয়াবেগের সাথে ঐক্য সৃষ্টি করবে।
উম্মাহ ও আমদানিকৃত সমাধান
আমদানিকৃত বিদেশী সমাধান- রূপক অর্থে বলতে গেলে একটি নাট্যমঞ্চীয় সমাধান বৈ কিছু নয়। এই নাটকে মুসলিম উম্মাহ একটি নিষ্ক্রিয় দর্শক মাত্র। এ নাটকটি অভিনয়ে ভরপুর, যা বাস্তবে ছায়া মাত্র। কর্শকরা নাটকের বিষয় যারা মঞ্চাভিনয়ের সময় বড়জোর খুশিতে হাততাডিল দিয়ে বাহবা জানাতে বা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে, মঞ্চে রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্বকারী অভিনেতাদের মাঝে উম্মাহ কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করতে পারে। মনে হয়া প্রতিবারই যখন এসব নাটকের কোনোটির যবনিকাপাত হয় অথবা তার কোনটির ভূমিকার সমাপ্তি ঘটে তখন যেন উম্মাহ সব কিচু ঝেড়ে মুছে ফেলে দিয়ে কিচু ঘটেনি এমন ভাব নিয়ে কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার ব্যাখ্যা আমরা এভাবেই করতে পার, খুব শিগগিরই তারা আরেকটি নাটকের দর্শক হবে, তাদের চিত্ত আবারো বিক্ষিপ্ত হবে, ফের নতুন কোনো নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে এবং তাদের সামনে আবরো আসবে অনুসরণযোগ্য ঐতিহাসিক ও বিদেশ বিভিন্ন সমাধান।
অগ্রসর জাতিগুলোর চিন্তাধারা, তাদের নেতৃত্ব এবং নিজ দেশে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পশ্চাৎপদ জাতিগুলোর চিন্তাধারা, তাদের নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পার্থক্য একেবারেই সুস্পষ্ট। উন্নত জাতিগুলোর জন্য এগুলো বাস্তব। কারণ এগুলো সেসব একেবারেই সুস্পষ্ট। উন্নত জাতিগুলোর জন্য এগুলো বাস্তব। কারণ এগুলো সেসব জাতির অস্তিত্ব, মূল্যবোধ, বিভিন্ন জনের চাহিদা থেকেই উৎসারিত হয়। জাতি তার নেতৃত্বের সাথে একাত্ম হয়ে একটি টিম হিসেবে দেশ বা জাতির অগ্রগতি, উন্নতি ও অভিষ্ট লক্ষ্যভিসারী উন্নয়নের জন্য কাজ করতে চাইলে এসবই তার চিন্তাধারা, নীতি ও আদর্শের উপাদান হিসেবে কাজ করে।
এ মৌলিক অন্তর্দৃষ্টি আমাদেরকে মুসলিম বিশ্বের এবং বৃহত্তর পরিমন্ডলে তৃতীয় বিশ্বে আমাদের ভাষার রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের কমেডির সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দিতে পারে। এরই সাহায্যে উন্নত বিশ্বের রাজনীতি, সরকার এবঙ প্রশাসনের প্রকৃতির মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান, তা ব্যাখ্যা করা যায়। বাস্তবাত থেকে উৎসারিত একটি সমাজ ও সামাজিক প্রক্রিয়া একটি আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বশীল পারস্পরিক ক্রিয়া-পতিক্রিয়া এবং এই তাৎপরতার মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তার সম্যক ব্যাখ্যা করা যায়।
আমাদের প্রয়োজন আমদানি করা বিজাতীয় সমাধানের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক মাত্রার সম্যক ধারণা অনুধাবন করা। আমরা উপলব্ধি করতে পারলে অনুসরণ ও নকল ববিশকতায় সময় নষ্ট হবে না। এ পদ্ধতিতে আমরা আমাদের নিজেদের ও উম্মাহর অবশিষ্ট লোকদের আরো দুঃখ এবং যাতনা থেকে উদ্ধার করতে পারব। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ব্যর্থ জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, মার্কসবাদী অথবা যে কোওেনা ধরনের রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের ধারায় উম্মাহ পরিচালিত করার জন্য কেনই বা উম্মাহকে সযোগ দেয়া হবে।
তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও পরিপক্ক মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও নেতাদেরকে সত্যিকারভাবে তাদের জন্য উন্মুক্ত একমাত্র পথে চলার জন্য অঙ্গীকাররাবদ্ধ হতে হবে, সে পথ যতই দুর্গম হোক। তাদেরকে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে, তারা যে নির্দিষ্ট সমাধন খজে বেড়াচ্ছেন তা তাদের ধর্ম, স্বদেশ ও ইতিহাস থেকে গ্রহণ করতে হবে এবং তারা এ সমাধানকে আঁকড়ে ধরে বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জকে দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করবে। এটি না করা হলে গত কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলিম বিশ্ব যে দুঃসহ ব্যর্থতার গ্লানি বহন করছে তার তুলনায় আগামীতে সকল নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হলে তা হবে আরো দুঃহ। অবশ্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী এবং গোটা মুসলিম উম্মাহ তাদের নিজ নিজ ঝোঁকপ্রবণতা ও পছন্দ থাকা সত্ত্বেও আগের মতোই যুক্তি, উন্নতি ও সম্মান অথবা ক্ষমতার স্বপ্ন দেখতে পারে। যদি তারা বর্তমান পথ ও পন্থা এবঙ চিন্তার পদ্ধতিতে পরিবর্তন না আনেন তাহলে পরিণামে তাদের ভাগ্য পূর্বের তুলনায় আরো বেশি খারাপ হবে। উম্মাহর বু্দ্ধিজীবী ও সমাজ নেতাদের অবশ্যই একটি প্রামাণ্য বিকল্প ইসলামী সমাধান বের করতে হবে এবং এব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। উম্মাহর চিন্তাবিদদের সংস্কৃতি, রীতিপদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের ভেতর থেকে সমাধানের উপাদানগুলো বের করে আনতে হবে।
উম্মাহ এবং ইতিহাস নির্ভর সমাধান
উম্মাহ অনুকরণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তবে এ সমাধান উম্মাহর কাঠামো এবং তার ঐতিহাসিক অভিযাত্রার সময় ও স্থানের উপাদানকে অবজ্ঞা করেছে। গত কয়েক শতাব্দীতে সমাময়িক জীবনযাপন এবং মুসলিম মনন ও চিন্তাধারার প্রতি বৈরী শক্তিগুলো যে চ্যালেঞ্জ করেছে, তার প্রেক্ষিতে উম্মাহর অবিরত পশ্চাদপসারণেই এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করছে। এটি স্পষ্ট যে, এ দৃষ্টিভঙ্গি উম্মাহকে কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ উম্মাহর অবস্থা দ্রুত অধোগতির দিকে ধাবিত হয়েছে। তার শত্রুরা এ সংকট থেকে বেশ ফায়দা লটছে এবং উম্মাহ অসংখ্য সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি সফল হলে কিছু অদৃশ্যি প্রতিবন্ধকতা কাঙ্ক্ষিত ফললাভকে প্রতিহত করছে বলে যে অজুহাত রয়েছে তা গ্রহণযোগ্য হতো না। ফলাফল দ্বারাই বোঝা যায় সমাধান হবে না। কারণ অপ্রত্যাশিত বিষয়গুলো সমস্যার অবিচ্ছিদ্য অংশ।
অনুকরণধর্মী ইতহাস নির্ভর সমাধান তার নিজস্ব নীতিমালার সুষ্ঠুকে প্রতিষ্ঠা এবং অন্যসব পদ্ধতির অপর্যাপ্ততা প্রমাণের প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে বিষয়সমূহকে অতি সরলীকরণ করে ফেলেছে। বাস্তবে সাফল্যের শর্ত হিসেবে এ সমাস্যার একটি অংরে প্রতিনিধিত্ব করে। এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
অনুকরণমূলক ইতিহাস নির্ভর সমাধান, দীর্ঘসময় ধরে যা অধিকাংশ মুসলমানের মন-মগজ দখল করে আছে, ইসলামের স্বর্ণ যুগে ফিরে যাওয়ার জন্য তা এক কঠিন জেদের চাইতে বেশি কিছু নয়। এ দৃষ্টিভঙ্গি কোনো পরিবর্তনকেই বিবেচনায় নেয় না, তা বস্তুগত বা বর্ণনা প্রাসঙ্গিক (Cobtextual) যাইহোক না কেন। উম্মাহকে তার দুঃখ-যাতনা থেকে মুক্তি দিতে হবে এ ‘ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি’ কেন বারবার ব্যর্থ হয়েছে, এর পেছনের কারণ এটিই। অথচ উম্মাহ তহার বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের দিক থেকে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী এবং ইতিহাসের সকল পর্যায়ে তাই রয়ে গেছে। ঐতিহ্যবাহী মাজহাব ভিত্তিক ফিকাহর শুধু আনুষ্ঠানিক ইবাদত ও ব্যক্তিজীবন সংক্রান্ত আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার পেছনে এটিই ছিল কারণ।
এ সমাধানের অন্তর্নিহিত ভ্রান্তির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছেন সৈয়দ জামাল উদ্দীন আফগানী। যদিও তিনি সাম্প্রতিককালে সকল মুসলিম সংস্কারকদের মধ্যে মহান বিচক্ষণ ছিলেন, তা সত্ত্বেও তিনি প্রাথমি যুগের খলিফাদের সময়কালে সামাজিক, রাজনৈতিক পদ্ধতির বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবঙ তিনি তার সেই অখ্যাত সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে উম্মাহর এখন শুধু প্রয়োজন একটি একনায়ক নেতৃত্ব। একনায়কত্ব এবং ইনসাফ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পর্যায়ে দু’বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। প্রাথমিক অবস্থায় অবতীর্ণ আয়াতগুলিতে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
….সত্যি সত্যি মানুষ সীমা লঙ্ঘন করে এ কারণে যে সে নিজেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ মনে করে। (৯৬:৬-৭)
অনুকরণমূলক ইতিহাস নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য উপলব্ধির প্রচেষ্টায় আমাদেরকে প্রথম অনুধাবন করতে হবে যে, এ দৃষ্টিভঙ্গি উম্মাহের ইতিহাসে কীভাবে আসলো। খোলাফায়ে রাশেদার শেষ দিনগুলোতে উম্মাহর মননশীল ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিভিক্তির মধ্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি শুরু হলো। এর বৈশিষ্ট্য ছিল রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব এবং নৃতাত্ত্বিক ও গোষ্ঠীবদ্ধ গোত্রীয় বেদুঈনদের মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজবংশীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মোকাবিলার একটি প্রকাশ্য রূপ পরিগ্রহ করলো। এ সময় মদীনর রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন হোসেন বিন আলী, আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের, মুহাম্মদ আল নাফসে জাকিয়া, যায়েদ বিন আলীর মথো নেতৃবৃন্দ। এ বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ধর্মীয় নেতৃত্বের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সংঘর্ষের অবসান ঘটে। এ পরাজয় তাদেরকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং তারা নতুন এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সে ভূমিকা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মীয় বিরোধিতা। শতাব্দীর পর শতাব্দী তাদের বিচ্ছিন্নতা বাড়তেই থোকে এবং ইসলামী চিন্তাধারার প্রকৃতি ও নেতৃবৃন্দের মনোযোগ আকর্ষণীয় বিষয়সমূহের ওপর অনপনেয় কালিমার ছায়া পড়ে। ইসলামী চিন্তাবিদারা যখন বিভিন্ন সমস্যাকে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার এবং ওহীর বিষয়বস্তুকে আভিধানিক অর্থে ব্যাখ্যা করার ফাঁদে পড়ে যয়, তখনই তকলিদের চিন্দাধারার উৎপত্তি ঘটে। অযোগ্য ও বিবেকহীনদের হাতে শরিয়তের বিকৃতি এবং শরিয়াহকে সংরক্ষণে ইসলামী চিন্তাবিদদে আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটায়। কালক্রমে ইসলামী চিন্তাধারা সুস্পষ্টভাবে অতীতমুখী হয়ে যায়। অতীতের দুর্বল স্মৃতিচারণ এবং পবিত্র স্থানগুলোর গুণকীর্তনে পর্যবরিসত হয়। এ ঘটনা প্রবাহের ফলে উম্মাহর সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি নিস্তেজ হয়ে যায়। যখন নেতৃত্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে সম্পূর্ণভাবে তাতে প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে তখন উম্মাহ অন্ধ অনুকরণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতায় নিজেদের সমর্পণ করে। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের বেরায় দেখা গেছে যে, তাদের বাস্তব আর কোন সামাজিক বা রাজনৈতিক ভূমিকা নেই। রাজনৈতিক ও সামাজিক তেত্ব বুদ্ধিবৃত্তিক বুনিযাদ হারিযে ফেলার কারণে জুলুম, নির্যাতন, স্বৈরাচার ও অধীনতা উম্মাহকে গ্রাস করে ফেলে। অথচ এ বুদ্ধিবৃত্তিক বুনিয়াদ থেকে উম্মাহর উন্নয়ন, তার বিকল্প পথ- ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সমাধান বের করার কতা ছিল।
একদিকে উম্মাহ অনুকরণমূলক ও স্থবির চিন্তাধারায় আবদ্ধ ছিল, অপরদিকে স্বেচ্ছাচার এবং রাজনৈতিক স্বৈরাচার দ্বারা ছিল আক্রান্ত। এটিই হচ্ছে উম্মাহর ইতিহাসের প্রায় নির্ভুল চিত্র। মোঙ্গল আগ্রাসন ও ক্রুসেডের পরে উম্মাহ যে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের শিকারে পরিণত হলো এবং আজ পর্যন্ত বিজতীয় অধীনতার পাশে আবদ্ধ রয়েছে এটিই তর কারণ। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উম্মাহর পতন, তার প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা এবঙ ইতিহাস নির্ভর অনুকরণের সীমার বাইরে চিন্তা করার অক্ষমতা আরো বড় ধরনের বিপদের মুখে পরিচালিত করেছে। সে বিপদ হলো, অনুকরণমূলক বিজাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্যমের মধ্যেই উম্মাহর সমস্যাগুলো সমাধান খুঁজে পাওয়অ যাবে এই উপলব্ধি। এই অনুকরণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্যমের ফলে উম্মাহর পতন তর্বরান্বিত হলো এবঙ উম্মাহ আগের চাইতেও দুর্বল হয়ে পড়লো। এই পথ অনুসরণ করে উম্মাহ অচিরেই পণ্ডিতদের ভাষায় সভ্যতার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের (অর্থনৈতিক ও প্রযুক্গিত) আবর্তে পড়ে গেল। এ ব্যবধান দেখা দিল উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে অথবা অগ্রসর ও শিল্পোন্নত দেশসমূহ ও অধিকাংশ মুসলিম অধ্যুষিত তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে। এ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যর্থতা থেকে আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা পাই তা হলো, অতীতের স্বপ্ন অস্বাভাবিক এবং জীবন, স্থান, কাল, চিন্তাধার ও ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণকারী গতি আইনের পরিপন্ধী। তাজাড়া সংস্কারের ক্ষেত্রে এ ধরনের পশ্চাৎমুখীতা পতন ও বিজাতীয় চিন্তাধারা সমৃদ্ধ আগ্রাসনের মুখে পরায়বরণ করে থাকে। উম্মাহকে অবশ্যই চলার জন্য একটি নতুন পথ খুঁজে নিতে হবে এবঙ বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সংস্কারের পথ ও পন্থা খুঁজে বের করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ নতুন পথটি কি? এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গিটি কি? এর অন্তর্নিহিত মর্মার্থ কি? এর বৈশিষ্ট্যগুলো কি? অন্যেরা যেখানে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে তার সফল হবে এবং এ দৃষ্টিভঙ্গি যে পূর্বের তুলনায় উত্তম হবে তা আমরা কি করে বুঝবো?
এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হলে প্রথমে আমারেদ বুঝতে হবে- এটি কীভাবে শুরু হয়? কখন, কী রূপে কেন এ পতনের সূচনা হয়? পরিস্থিতির অবনতি কীভাবে ঘটে? ব্যাধি কি আমরা যদি তা বুঝতে পারি, এর শুরু কখন হলো তা আমাদের জানা থাকে এবং তার লক্ষণ কি তা আমরা নির্ণয় করতে পারি এবং ইসলামের দেহ ও ইতিহাসে এ রোগের সংক্রমণ আমরা বুঝতে পারি তাহলে এটি তার রোগমুক্তির অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করবে। এ ধরনের উপলব্ধির ভিত্তিতে সংস্কারের জন্য যে ধরনের প্রচেষ্টা প্রয়োজন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে।
সমসাময়িক ইসলামী আসালা দৃষ্টিভঙ্গি
নাম থেকে বোঝা যায় যে, এটি ইসলামের লক্ষ্য, বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং চিন্তাধারার ভিত্তিকে গঠিক একটি দৃষ্টিভঙ্গি। উম্মারেহ যে উন্নতি, ইতিবাচক কর্মকান্ড এবং সংস্কার আমরা চাচ্ছি, সে উম্মাহর বিশ্বাস, মূল্যবোধ, মননশীলতা এবং মনস্তত্বিক প্রকৃতির দিক থেকে ইসলামী উম্মাহর মননশীলতা, লুক্কায়িত শক্তি এবঙ অভিসন্ধির মূল সত্যটাকে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করলে উম্মাহকে উদ্বুদ্ধ করার আর কোনো উপায় থাকে না।
স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমস্যা সমাধানের মূল সৌরভ দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করাটাই এখানে যথেষ্ট নয়। কারণ, ইসলাম অনুকরণীয় ইতিহাস নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমসাময়িক ইসলামী আসালা দৃষ্টিভঙ্গীরারই একটি অংশ। সুতরাং শেষোক্তটির বৈশিষ্ট্য সুনির্দিশষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা অত্যাবশ্যক। সমসাময়িক বিষয়সমূহ এবং প্রস্তাবিত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর ঐক্তানের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যগুলো তালাশ করা যেতে পারে। এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, উম্মাহর সমসাময়িক অবস্থা এবঙ তার বিষয়গুলো উপর প্রভাব বিস্তারকারী ইসলামী বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং ঝোঁক প্রবণতা থেকে সমাধন বের হয়ে আসবে। উপলব্ধি করতে হবে যে, পূর্বদিনের ইসলামী ঐতিহ্য ও তার প্রাথমিক যুগের অভিজ্ঞতার আলোকে স্থান ও কালের চাহিদা কি এবং অপরদিকে মানবজীবনে এর গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তনের তাৎপর্য কি? এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অনুকরণমূলক সমাধানের পার্থক্য রয়েছে, কারণ সমসাময়িক ইসলামী আসালা ভিত্তিক সমাধানটি উম্মাহর প্রয়োজন বা চাহিদার একটি ষোষণা। ইসলামের সামনে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে ইসলামী মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও লক্ষ্যেল ভিত্তিতে এটি তার জবাব। এ পথেই উম্মাহ ও তার সম্ভাবনাময় শক্তিগুলো নেতৃত্বের অবস্থানে থাকতে পারে এবঙ তার মূল্যবোধ ও লক্ষ্য – উদ্দেশ্যের মাধ্যমে মানবজাতির ভবিষ্যতকে সর্বোত্তমভাবে পরিচালনা করতে পারে।
সমসাময়িক আসালা সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি এবঙ উম্মাহর ইসলামী চরিত্রের গোড়া থেকে সমসাময়িক পরিস্থিতি অনুধাবনের অর্থ হচ্ছে এ ব্যাপকতা দিয়ে শুরুক করা। ভিন্নভাবে বলতে গেলে এটি হচ্ছে স্থান ও কালের মাত্রা ও পরিধিসহ ইসলামের প্রাথমিক যুগের বিভিন্ন তত্ত্ব ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে উপলব্ধি। এ জন্যে ইসলামের লক্ষ্য ও তার মাহন উদ্দেশ্য এবং এর মধ্যকার সঠিক সম্পর্ককেও পুরোপুরি বুঝতে হবে। অন্যান্য সভ্যতার মোকাবিলায় উম্মাহ যাতে একটি নেতৃত্বের অবস্থানে পৌঁছতে পারে সেই লক্ষ্যে এটি সমসাময়িক জীবন ও সমাজে উম্মাহর সকল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
সমসাময়িক আসালা বলতে যোগ্যতা, কারিগরী দক্ষতা এবং সুষ্ঠু প্রণালীকে বোঝায়। এটি প্রাকৃতির আইন ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিকে একটি প্রতিষ্ঠানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায়। এখানে যে অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে এ ইসলামী চিন্তাধারা, নীতিমালা, উদ্দেশ্য, মূল্যবোধ এবং শিক্ষার প্রেক্ষাপটে বাস্তব বিষয়াদি, সমস্যা এবং সম্ভাবনা থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করা হয়েছে তাই। প্রাতিষ্ঠানিক ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদেরকে পশুচারী (Pastoral), কৃষি এবং সাধারণ ব্যবসা নির্ভর সমাজ (Trading Society) থেকে আমাদেরকে কাঙ্ক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তিক ও সভ্যতাধর্মী উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হবে। কাঙ্ক্ষিত এ বিশ্বের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার সম্ভবানা, দক্ষতা, সম্পদ ও উৎপাদন এবং ব্যক্তি, গ্রুপ, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদ্ধতির চাহিদা এবং দায়িত্বের মধ্যে পরিবর্তন সাধন। এভাবে বিশ্ব যেসব চ্যালেঞ্জ, সংকট ও সংযোগ সুবিধা থেকে উপকৃত হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
সুতরাং ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গির চিন্তা অথবা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আন্দোলন ও সামজিক কর্মকান্ড অনুকরণের বিষয়কে এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। সর্বোপরি এর অর্থ হচ্ছে শরিয়ার উচ্চতর ও সাধারণ নীতি, মূল্যবোধ এবং মৌলিক শিক্ষা সম্পর্ক পূর্ণাঙ্গ বোধ বাউপলব্ধি। এগুলোই হবে সমসাময়িক ইসলামী সামাজিক চিন্তাধারা, বিভিন্ন প্রতষ্ঠান ও সংগঠনের ব্যবস্থাপনা এবং ইসলামী আন্দোলনের দিক-নির্দেশক বিধিবিধানের গোড়ার কথা। এসব লক্ষ্য অর্জিত হলে ইনসাফ, সংহতি, ভ্রাতৃত্ব এবং ইসলামের কাঙ্ক্ষিত সম মূল্যবোধই ইসলামী সমাজের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়াবে।
সমসাময়িক ইসলামী আসালার লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলামী বিষয়ে গবেষণার পদ্ধতিহকে অবশ্যই পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে ইসলাম এবং তার উচ্চতর লক্ষ্যসমূহ, মূল্যবোধ, সমাজ ও সভ্যতা বিষয়ক ধারণা বা মতবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বাস্তব অবস্থা থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। এর অন্য অপরিহার্য হলো সকল পর্যায়ে মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে ওঠার গুরুত্ব আরোপকারী ইসলামী শিক্ষা এবং বাস্তব ক্ষেত্রে গুরুত্ব দানকারী কারিগরি শিক্ষা, শিক্ষাব্যকবস্থার এ দুটি শাখার পুনঃমেরুকরণ। শিক্ষা সকল শাখার বিশেষ করে মানবিক ও সমাজ বিজ্ঞানে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনের উপর অবশ্যিই মনোযোগ দিতে হবে।
চূড়ান্ত বিশেষণে সমসাময়িক ইসলামী আসালার বিভিন্ন অগ্রাধিকারসমূহের পূনর্বিন্যাস এবং পদ্ধতি ও চিন্তাধারাকে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে সুষ্ঠু ইসলামী শিক্ষার পদ্ধতি খুঁজে পাওয়া যায়। অধিকন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, সমাজ ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পুনর্গঠিত করতে হবে যাতে পরিপূরক উদ্যোগ ও সুষ্ঠু অগ্রগতি সম্পন্ন সমাজকে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে বিনির্মাণের পথে পরিচালনা করা যায়। সমসাময়িক ইসলামী আসালার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সভ্যতার নেতৃত্বদানে এবং সংস্কারে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণকরতে চাইলে তাতে অবশ্যই দু’টি বিষয় থাকতে হবে। সভ্যতার পরিবর্তনের ইতিহাসনির্ভর এ দু’টি বিষয়ের একটি হচ্ছে ইতিবাচক ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রেরণা এবং অপরটি হচেছ ফলপ্রসূ চিন্তাধারার ঐতিহ্যমন্ডিত বৈশিষ্ট্যের অবস্থান।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে নিখাদ ইসলামী আকিদা এবং ইসলামী চিন্তাধারার শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমে এমনটি ঘটেছিল। এ দু’য়ের মিলনে মুসলমানদের প্রথম প্রজন্মের অনেক কিছু অর্জনের সৌভাগ্র হলো। পৌত্তলিক আরবদের বাণিজ্য পথ বন্ধা করে দেয়া, খন্দকের যুদ্ধে ও হোদায়বিয়ার সমারিক ও কূটনৈতিক প্রতিবার প্রমাণ, মক্কা বিজয়, ইয়ারমুকে বাইজেন্টািইনদের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধের আগে সিরীয় মরুভূমি পাড়ি দেয়ার অত্যাশ্চর্য ঘটনাপ, বিভিন্ন দিওয়ান রক্ষণাবেক্ষণে প্রদর্শিত প্রতিভা, প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন, বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা, স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্র হিসেবে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন, বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা, স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে মসজিদ নির্মাণ এবং জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক মতবাদের প্রচার ও প্রসার। এসব কিচুই উম্মাহর ইতিহাসের সেই প্রাথমিক যুগে তার সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যখন এ সভ্যতার দুর্নীতিগ্রস্ত, পতনোম্মুখ সভ্যতামূহ ও বর্বর বেদুইন জাতি দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। ইউরোপীয় রেনেসাঁর ক্ষেত্রেও এটিই সত্যি ছিল। কারণ এ রেনেসাঁর চালিকা শক্তি ছিল প্রচেষ্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলনের নতুন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি। এ দৃষ্টিভঙ্গির উদ্দেশ্য ছিল মধ্যযোগীয় কুসঙস্কার ও অজ্ঞতা নির্মূলের লক্ষ্যে একটি কার্যকর খ্রিষ্টিয় বিশ্ব দর্শনের উন্মেষ ঘটানো। এ দৃষ্টিভঙ্গর সঙ্গে ইউরোপীয় চিন্তাধারা সংস্কারের সম্মিলনে ইউরোপীয় রেনেসাঁ প্রচন্ড শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অথচ এর আগ পর্যন্ত ইউরোপীয় চিন্তাধারা বাইবেলীয় সূত্র থেকে গৃহীত বিভিন্ন কাল্পনিক উপমার আক্ষরিক ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ ছিল। ইসলামরে প্রাথমিক যুগে একটি গঠনমূলক ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কার্যকর ও উন্নত চিন্তাধারর সংমিশ্রণের ফলৈ যা ঘটেছিল ইউরোপেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং অনুরূপভাবে একটি নতুন সভ্যতা অর্থাৎ রেনেসাঁ যুক্ত ইউরোপের অভ্যুদয় ঘটে। সমসাময়িক আসালা দৃষ্টিভঙ্গিও এ দু’টি উপাদানে সমৃদ্ধ।
এভাবে দেখা যায় সুষ্ঠু পদ্ধতি ছাড়া ধর্মীয় সংস্কারের উপর গুরুত্ব দেয়া হলে তাতে সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনের জন্যে কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এছাড়া পশ্চাত্যমুখী ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা সুষ্ঠু চিন্তাধারা ও তার চমৎকার সাফল্যের বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও তারাও সফল হবে না। বরং খিলাফতের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমন্ডল সৃষ্টি এবং একটি নতুন সভ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য এ দু’টি শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এ দু’টি শিবিরকে ঐক্যবদ্ধ করার অর্থ হচ্ছে, যুক্তি ও ওহীর মধ্যকার যোগসূত্র পুনরুদ্ধার অথবা ওহীর উপলব্ধি ও এর মর্মার্থ অনুধাবন এবং ওহীর লক্ষ্যাবলীর ব্যপাক ও বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার জীবন ও সভ্যতার মূল্যবোধ দিয়ে মনকে পরিজালনার যোগসূত্র পুনরুদ্ধার করা। এভাবে সংস্কারের অন্বেষায় এ দু’টি মহলকে এক সাথে করে দেয়া, পদ্ধতি ও রীতির বিবেনায় এটি একটি মননশীল প্রক্রিয়ায়। অন্যকথায় বর্তমান সময়ে উম্মাহর সামনে রয়েছে চিন্তাধারার সংকট। এটি স্বাভাবিক যে, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিরন দিকে আহ্বান, সে দৃষ্টিভঙ্গি কি এবং তাতে অগ্রাধিকার লাভের মতো বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা কি হওয়া উচিত এবং এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব উম্মাহর বুদ্ধিজীবী, লেখক এবং সংশ্লিষ্ট সামাজিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের। সংস্কারের চিত্রটি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা, উম্মাহকে সমস্যা সম্পর্কে অবহিত রাখা এবং সংসারের বীজ বপনের কাজ করার জন্য এদের অবশ্যই প্রচেষ্টা চালাতে হবে যাতে সংস্কারের চারাগুলো বেড়ে ওঠে এবং তাতে ফল ধরে। কখনো কখনো এ কাজটি বড়ই আঁকাবাঁকা ও সর্পিল মনে হতে পারে। মানুষ কখনো শুধু আয়াসের মধ্যেই পথ চলার পন্থা খুঁজে নেয়নি। অপর পক্ষে দেখা যায় মানুষ প্রথমে যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ঘর থেকে বেরিয়েছিল তা অর্জন করার উপযোগী পথই তাকে বেছে নিতে হয়েছে।
সংকটের ঐতিজাসিক উৎমূল
রাজনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তন :
বেদুঈন, অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ এবং খিলাফতের পতন:
উপরের বিশ্লেষণ থেকে এ কথা সুস্পষ্টপ যে, উম্মাহকে দুর্বলতা, দলাদলি পশ্চাৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সভ্যতাহীনতার সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে তাকে অবশ্যই ইসলামী সমাধান প্রয়োগ করতে হবে। নিজেদেরকে সংকট থেকে মুক্ত করা এবং নিজেদেরকে যখন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মুখোমুখি দেখতে পেল এবং তার হাতে পরাজয়ের তিক্ততার স্বাদ গ্রহণ করতে বাধ্য হলো তখন উম্মাহর প্রচেষ্টা শুরু হলো। এ সম্পর্কে বইয়ের প্রথমে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হয়ে্যেছ। প্রথমবারের মতো উম্মাহ চিহ্নিত ধ্বংসা্ত্মক শত্রুর সম্মুখীন হলো এবং পাশ্চাত্য প্রভাবে চ্যালেঞ্জ থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা কীবাবে বারবার ব্যর্থ হয়েছে, তার পর্যালোচনা করা হয়েছে।
আমারেদ আগের বিশ্লেষণ এবং এখন চারদিকে আমরা যা দেখছি তা থেকে আমরা সমসাময়িক ইসলামী আলোকে উম্মাহকে তার বর্তমান দুঃখ বেদনা থেকে নিষ্কৃতিদান এবং যে দুষ্টগ্রহের আবর্তে সে ঘুরপাক খাচ্ছে তা থেকে মুক্ত করতে হবে। সুতরাং সংকটের প্রকৃতি এবং এর উৎসকে বুঝার বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু এটি করতে পারলেই সংকটের মূল বিন্দুকে চিহ্নিত করা যাবে। এখন পর্যন্ত সংকটের মেজাজ সম্পর্কে আমাদের এ অজ্ঞতাই উম্মাহর সামগ্রিক কর্মান্ডকে সভ্যতা হিসেবে মূল্যায়নে বাধা দিয়েছে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ বাধা প্রগতির পথ ধরে আমাদের এহুতে দেয়নি। এ রকম পরিস্থিতিতে আমাদের এ গভীরতা অনুধাবন ও এ বাহুল্যকে বর্জন করতে হবে (আমারেদ সমৃদ্ধির পথে অন্তরায় থাকা সত্ত্বেও) এবং ঐ সকল জিনিস বর্জন করতে হবে যেগুলোকে আমরা বৈধতার আবরণে পবিত্র বলে গণ্য করে, যেগুলোতে আমাদের চিত্তচাঞ্চল্য আছে সেগুলোকে উপেক্ষা করার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এটি নিঃসন্দেহ যে, আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জনপ্রিয় রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি, যদিও এ সকল সংগ্রামের মূল প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট কোনো ধারণা লাভ করতে পারিনি। অধিকন্তু আমরা যেসব বিষয়কে পবিত্র জ্ঞান মনে করি, সেগুলো সম্পর্কে সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও আমরা সেসবের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারি না; এসব প্রভাব আমাদের হৃদয় ও আত্মাকে নিঃসাড় করে ফেলে এবং কোনো বিষয়ের গভীর গবেষণা থেকে বিরত রাখে এবং গভীরভাবে চিন্তা করা থেকে বিরত রাখে; সত্যিকার সাফল্য অর্জনে সহায়তা করতে পারে, এমন বুদ্ধি ও মনন দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা থেকেও বিরত রাখে।
সুতরাং বর্তমান অবস্থা এবং সুদীর্ঘ ইতিহসের প্রতিটি দিক বিবেচনা করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। মোটকথা পরিস্থিতিকে অবশ্যিই ভালভাবে অনুধাবন করতে হবে এবং সত্যিকার কোনটি পবিত্র এবং কোন্টি নয়, সেই পার্থক্যের সীমারেখা অপরের কাঁধে চাপানোর ব্যর্থ চেষ্টা এড়িয়ে চলতে হবে।
উম্মাহর বিদ্যমান সংকটের প্রথ চিহ্ন ছিল ইসলাম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধ আকারের চেতনা। এসব যুদ্ধে তৃতীয় খলিফা উসমান (রা) এবং তাঁর উত্তরিধাকারী আলী ইবনে আবু তালিব শহীদ হন। পরিণামে খেলাফতের অবসান ঘটে এবং উমাইয়া বংশের অসৎচারিত্রকতা, স্বেচ্ছাচার, গোত্রবাদ এ স্থান দখল করে।
যে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে খেলাফতের পতন ঘটে তা উম্মাহর ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবঙ আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত এ সম্বন্ধে সঠিকভাবে উপলব্ধি না করি, এর পেছনে কী কারণ ছিল, তা আবিষ্কার করতে না পারি এবং তা থেকে কি ফলাফল অর্জিত হলো তা হৃদয়ঙ্গ করতে না পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত এটিকে আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়। এ সম্পর্কিত তথ্য আমাদের প্রয়োজন, এ সময়কালের ঘটনাবলী এমনকি আজকের দিনেও আমাদের আচার-আচরণ ও মনোভঙ্গিকে প্রভাবিত করে চলেছে অব্যাহত গতিতে। এ অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল খিলাফত নেতৃত্ব। রাজনৈতিক ক্ষমতার সমনদে নীরবে, নিঃশব্দে এক অপরিহার্য পরিবর্তন ঘটে গেল। কারণ সাহাবায়েকেরাম (রা) ছিলেন রাসূল করিম (সা) প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ক্ষমতার মূল ভিত্তির জন্য উৎসর্গকৃত বাহিনী ও শাসকশ্রেণী। গুণগত মান, ঝুঁটিগ্রহণ, প্রশিক্ষণ, প্রজ্ঞা এবং নৈতিকতার ক্ষেত্রেও তারা খিলাতের জন্য একই কাজ করেছিলেন।
তদানিন্তন পারস্য এবং পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের চ্যালেঞ্জসহ সে সময় যেসব ঘটনা ঘটে সে সময় পর্য্ত গোত্র কেন্দ্রিকতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আরব বেদুঈন গোত্রগুলোর জন্য মুসলিম বাহিনীতে যোগদানের পথ খোলা ছিল। মুসলিম বাহিনীতে বেদুঈনদর সংখা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রবীণ সাহাবাদের সংখ্যা হ্রাস পেতে লাগল, কারণ এদের অনেকেই প্রথম দিকে বিজয় অভিযানকাল শাহাদাত বরণ করেছিলেন। এর ফলে বেদুঈনদের পক্ষে ইসলামের মৌল শিক্ষ ছাড়াও তাদের সব কুষংস্কার এবং মরুভূমির গোত্রগত আসক্তি ও ঝোঁকপ্রবণতা সংরক্ষণ, লালনপালন সম্ভবপর হয়েছিল। অথচ রাসূল (সা) তাঁর যত্ন ও সাধনার মধ্য দিয়ে বেদুঈনদের মন থেকে এসব কুসংস্কার, আসক্তি ও ঝোঁকপ্রবণতা দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এভাবে বেদুঈনদের উত্থানের ফলে খিলাফতের রাজনৈতিক বুনিয়াদগুলোতে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। নব্য বাহিনী অথবা নয়া রাজনীতির জন্য বিশ্বনবী (সা)-এর প্রচারিত ইসলামী মূ্ল্যবোধ, আদর্শ, লক্ষ্য ভালোমন্দ বিচারের মাপকাঠিকে এখন চালিকাশক্তির হিসেবে গণ্য করা হলো না। এর অনিবার্য ফল হলো অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গোত্রের শক্তি-নির্ভর গোত্রকেন্দ্রিক স্বৈরাচারী উমাইয়া রাজবংশ।
এটিও অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল যে, মক্কা ও মদীনায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এক শতাব্দীর বেশি স্থায়ী হতো না এবং বিপুল সংখ্যাগিরষ্ঠ বেদিঈনদের বিরুদ্ধে রক্তক্ত গৃহযুদ্ধে হোসেন বিন আলী, আবদুল্লাহ বিচন যুবাইর, মুহাম্মদ নফক জাকিয়অহ, যায়েদ বিন আলী প্রমুখের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেত। সময় অতিক্রান্ত হতে থাকল এবং বিপুল সংখ্যক পারসিক, বাইজান্টাইনীয়, ভারতীয়,তুর্কী, আফ্রিকান এবং অন্যান্য জাতি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করলো বটে, কিন্তু পুরোনো ধ্যানধারণা, কুসংস্কার এবং প্রকা-ইসলামিক মতবাদ বিসর্জন দেয়ার মতো ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত ছিল এবং হারিয়ে যাওয়া উপাদানটি শিগ্ডিগরই উম্মাহর অনেক সদস্যকে ইসলামী খাঁটি আচার অনুষ্ঠান, ধ্যানধারণা ও পদ্ধতি থেকে বিচ্যুটি করে ফেলল। সংক্ষেপে বলতৈ গেলে যখন বেদুঈন গোত্রীয় সংখ্যাগরিষ্ঠরা ক্ষমতা দখল করল। রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তিতে পরিবর্ন এলো এবং উম্মাহ এমন এক নেতৃত্বকে রাজনীতিতে বরণ করে নিতে বাধ্য হলো যা ছিল ইসলাম পূর্ব এবং ইসলামী পদ্ধতির রাজনৈতিক (Political power base) নেতৃত্বের একটা জগাখিচুড়ি সংস্করণ।
রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বে ভাঙ্গন
সেনাবাহিনীতে বেদুঈনদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফলে খেলাফরেত পতন এবং উমাইয়া রাজবংশের ক্ষমতা দখলকে পরিবর্তন ও বিচ্যুতির প্রথম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ প্রকাশ্য পালাবদলর ফলে যে সূক্ষ্ম মতবিরোধগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সেগুলো নিশ্চিতভাবে বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ। এ সময় সম্রাজের বিভিন্ন স্তরে রাজনৈতক এবং ধর্মীয় বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বের মধ্যে একটি ফাটল সৃষ্টি হয়। যে অবিশ্বাস্য ধরনর শক্তি ইসলামের জীবনী শক্তি থেকে ইসলাম সঞ্চায় করেছিল, সেই শক্তি ক্ষয়ে এ ভাঙ্গন অন্যতম ক্ষতিকারণ উপাদানে পরিণত হয়েছিল। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় উপজাতিগতহ ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর হেজাজে ধর্মীয় বুদ্ধিজীবী নেতৃবৃন্দ এ পরিবর্তেনের বাস্তবতা এবং কারণসমূহকে মেনে নিতে অস্বীকার করলো। বরং এর পরিবর্তে তারা গোঁড়া মতবাদ ও চিন্তাধারার ভিত্তিতে কোরাইশদের উমাইয়া শাখাসহ সকল উপজাতীয় শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললো।
শতাব্দীব্যাপী গৃহযুদ্ধ, সংকীরণ জাতিগত ও গোত্রগত চিন্তাধার, সংস্কৃতির ধারক-বাহক জনগণের সমর্থন লাভের ব্যর্থ ধর্মীয় বুদ্ধিজীবীদের শক্তি যকন নিঃশেষ করে দিল, তখন এদের অনুসারীরা পশ্চাদপসারণ করে কোনো উল্লেখযোগ্য বিরোধিতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা না চালিয়ে অনেক দূল থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে প্রার্থনা করে। নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোৗশল ছিল বেশি বেশি চাপ সৃষ্টি করে ধর্মীয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে ধারণ করা এবং তাদের অনুসারীদের নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করতে বাধ্য করা। এভাবেই উলামাদের ভাগ্যে, বিশেষ করে যারা বিভিন্ন মাযাহাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদের সামনে নেমে আসে নির্যাতন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। ইমাম আবু হানিফাকে (মৃত্যু ১৫০ হিঃ, ৭৬৭ খ্রি) ইসলামের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ নয় এমন একটি শাসনামলে বিচারকের পদ গ্রহণে অস্বীকার করার কারাগারে নিক্ষিপ্ত ও মৃতুবরণ করতে হয়। যখন ইমাম মালেক (মৃত্যু ১৭৫ হি. ৭৯৫ খ্রি) জোরজবদস্তিভাবে দেয়া তালাকের অবৈধতার পক্ষে তাঁর মতামত ব্যক্ত করলেন, তখন তাঁকে এমন নির্দয়ভাবে প্রহার করা হয় যে তার হস্ত মুবারক পঙ্গু হয়ে যায়। ইমাম আহমদ বিন হাম্বলকেও (মৃত্যু ২৪১ হিঃ, ৮৫৫ খ্রি) অনুরূপভাব ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের বিরোধীতা করার কারণে অনেক জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। ইমাম আল শাফেয়ীকে (মৃত্যু ২০৪ হিঃ, ৮২৭ খ্রি) শঙ্খলিত অবস্থায় ইয়েমেন থেকে বাগদাতে নিয়ে আসা হলে তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। অবশেষে তাকে রাজধানী থেকে বহুদূরে মিসরে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছিল। উম্মাহর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বের মধ্যে সৃষ্ট ভাঙন, মুসলিম শক্তির পতনের সূচনা, মুসলিম সমাজ দেহে ফাটল এবং ইসলামী চিন্তাধারা ও প্রতিষ্ঠানসমূহে সংকটো প্রতীক হয়ে দাড়ালো। এসব উপাদানই দুর্নীতি ও পতনের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করার সহায়ক হয়েয়ে। ক্রমে ক্রমে ইসলাম তার প্রাণ শক্তিকে আর ধরে রাখতে পারেনি। এরই ফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার আধ্যাত্মিক শিক্ষার কিছু ছিটেফোঁপাই শুধু অবশিষ্ট রইল। তার গৌরবোজ্জ্বল সভ্যতার অবশিষ্ট সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেল।
ধর্মীয় বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ ফাটলই ছিল উম্মাহর দেহে সকল রোগব্যাধির মূল কারণ। দেখা গেল পরবর্তীকালে এসব রোগব্যাধিই চারিদিক থেকে মুসলিম জাতিহকে আক্রমণ করে বসলো। এই তিক্ত ভাঙ্গনই বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বকে উম্মাহর সকল বাস্তব ও সামজিক দায়িত্ব থেকে অপসারণ করলো। অপরদিকে মুসলিম মনের অসাড়তা বা তার বোধশক্তিহীনতার পেছনে এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আক্ষরিক অর্থেই মুসলিমগণ মসজিদের চারদেয়ালের মাঝে আবদ্ধ হয়ে পড়ল। চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ থেকে তাদের জন্য একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ালো প্রাথমিকভাব তাত্ত্বিক মতবাদের কিছু মোটা বই পুস্তক অধ্যয়ন, যেগুলো ছিল কুরআনের আয়াত, রাসূল (সা)-এর সুন্নাহর বর্ণনামূলক ও শব্দার্থ ভিত্তিক ব্যাখ্যায় ভরপুর। বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বের আরো এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাদের সঙ্গে নিজেদের কর্মকান্ডের যৌক্তিকতা প্রমাণের উদ্দেশ্য কুরআন ও সুন্নাহর মূল বক্তব্য যাতে বিকৃত করতে না পারে এবং তার অপব্যাখ্য দিতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেথে তাদের প্রতিহত করা। এর ফল দাঁড়িয়েছে বস্তুগত বা মননের দিক থেকে উম্মাহ অন্যান্য সভ্যতার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। বাস্তবে তার অস্তিত্বই এখন সমসাময়িক পাশ্চাত্য সভ্যতা হুমকির সম্মুখীন।
এ দুঃখজনক পরিস্থিতি মুসলিম জাতিকে এমন এক পথে নিয় গেল যার ফলে ইজতিহাদের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কথাটির বহুবার বলা হলেও বাস্তবে ইজতিহাদের এমন কোনো দরজা ছিল না যা বন্ধ করার প্রয়োজন ঝিল। বরং দরজা বন্ধ করার কথাটি চিন্তার ক্ষেত্রে যে বন্ধাত্ব দেখা দিয়েছিল রাজনৈতিক কারণেই তা হয়েছিল। কারণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমাতাকে চিরস্থায় করার জন্য এবং সবকিছুই তার ও সাঙ্গোপঙ্গদের স্বার্থে নিয়োজিত করার বিষয়টিকে ইসলামের প্রতি প্রদত্ত অঙ্গীকারের উপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। চারিদিকে নিরন্তর যেসব পরিবর্ন হচ্ছিল এসব কিছু্ই তা থেকে আলেম সমাজকে দূরে সরিয়ে নিয়ে মসজিদের আরো নিভৃত কোণে ঠেলে দিলো। দ্বিতীয়ত, এই ভাঙ্গনের ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি উপযোগী বুদ্ধিবৃত্তিক বুনিয়াদ থেকে বঞ্চিত হলো। এ ধরনের বুনিয়াদ তাদেরকে পরিবর্তীতে পরিস্থিতিতে চিন্তাধারা, নীতিনির্ধারণী নির্দেশনা এবং কর্ম উপযোগী বিকল্প তাদের সমানে উপস্থিত করতে পারতো। কাজেই এটি আমাদের জন্য কোনো বিস্ময়কর ব্যাপার নয় যে, সাধারণভাবে বলতে গেল ইসলামী বিশ্বে স্বৈরাচারী ও একনায়কত্ববাদী নেতৃত্ব চলে আসছে। মুসলিম বিশ্বে শূরার সুযোগ খুব কমই ছিল। এ শুরা হচ্ছে কুযরআনের ভাষায় উম্মাহর পরিচালনায় জনগণের অংশীদারিত্ব। অবস্থা এ হয়ে থাকলে বিশ্বসভ্যতার দৃশ্যপট থেকে তার অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চিন্তাধারা এবং প্রতিষ্ঠানসহ উম্মাহ যেভাবে নিষ্প্রভ এবং বিলিন হয়ে গিয়েছে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। খেলাফরেত পতনের পর উম্মাহর রাজনৈতিক কাঠামোতে যে উপদলীয় কোন্দল ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয় তা অনুধাবন করতে নিশ্চয়ই পাঠকের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে সভ্যতা উদ্ভুত প্রাণশক্তির যে বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে তার সাথে পরবর্তীতে সে প্রাণশক্তির ব্যবধান অবশ্যিই পাঠকের বুঝতে হবে। এ সম্পদ ও সাম্রাজ্যর আবশ্যম্ভাবী পতনের ফলে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে ক্ষয় শুরু হয়েছিল তা সত্ত্বেও প্রাণশক্তির এ বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল। কারণ ইতোপূর্বে প্রাণশক্তি হারানোর যে কথা আমরা উল্লেখ করেছি তা ছিল একটি আপেক্ষিক ক্ষতি। বাস্তবে উম্মাহর মধ্যে তখনও বিরাট প্রাণশক্তি ছিল। সুতরাং এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, উম্মাহর শক্তি যে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল তা বাহ্যিক অবস্থা থেকে আঁচ করা না গেলেও পাঠকদের এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।
সমস্যার সূল এবং উম্মাহর ভবিষ্যৎ
চিন্তার সংকট, বিশ্বাসের নয়
উম্মাহর বিভিন্ন সমস্যার বিজাতীয় ও ঐতিহ্যানুগ সমাধানের জন্য বারবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মুসলিম জাতির মধ্যে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির উপলব্ধি সুস্পষ্ট হয়নি। এটি সম্ভবত বিশ্বাস ও চিন্তাধারা সম্পর্কে সাধারণ ভুল ধারণা পোষণ করার কারণেই হয়নি। অর্থাৎ বিশ্বাস ও চিন্তাধারাকে এক এবং একই বিষয় রূপে, নিরঙ্কুশ ও চিরকাল পবিত্র বলে মনে করা হয়েছে। এটি একটি ভুল ধারিণা। বাস্তবে এ ভুল ধারণা আমাদের দুশমনেরা সংস্কৃতি, শিক্ষা ও প্রচারমাধ্যম নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে প্রাচ্যবাদীদের অধ্যয়ন নামাদের বিভ্রান্তির ক্ষেত্রকে আরো স্ফীত করেছে। সমসাময়িক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে সুস্পষ্টতার অভাবের পেছনের কারণ ছিল মনস্তাত্ত্বিক বাধাসমূহ। এর ফলে মুসলিম মন এখন গৃহপালিত পোষা প্রাণীর মতো নিস্তেজ ও নির্বীর্য। অন্যকথায় তার বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকার অথবা তার জ্ঞান যাকে আমরা পবিত্র বলে থাকিজ বিশ্লেষণ করার মতো যথেষ্ট সাহস তার নেই। এর ফলে সত্যিকার অর্থে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সে উপলব্ধি করতে পারেছ না। মৌলিক ও নিরঙ্কুশের সঙ্গে সাময়িক ও সীমিত বিষয়গুলোর পার্থক্য করতে পারছে না। এমনকি কোন্টি অত্যাবশ্যক এবং কোনটি অভিনব রুচির সাথে সম্পর্কি তাও আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা আমাদের ভেতরে যে ভয়, যে আত্মবিশ্বাসের অভাব অনুভব করছি সেস ঘটনাপ্রবাহ ও তার আনুষঙ্গিক উপাদন আমাদের অতীতের বিচ্যুতির দিকে তাকাতে চিচ্ছে না।
সুতরাং মুসলিম মন যেসব ধ্যানধারণা ও মৌলিক দুষ্টিভঙ্গির অচলায়তনে বন্দী হয়ে রয়েছে এবং যা তাকে অতীতের ভুলভ্রান্তি ও অবাস্তব বিষয়েরে মধ্যে নিমগ্ন রেখেছে, যার কারণে সমস্যার অভ্যন্তরে প্রবেশ, ভালোমন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় এবং নিজের পথ ও পন্থাকে সংশোধন করতে পারছে না। অথবা তার সামনে বিরাজিত সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। যে জন্য মুসলিম জাতি সাহসের বিরাজিত সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে দিচ্ছ না। যে জন্য মুসলিম জাতি সাহসের সাথে নিজের জন্য কোন পথ তৈরী করতে পারছে না। কারণ সে দূল অতীতের ধূসর কোণায় হাত-পা বাঁধা ও চোখ বন্ধ অবস্থায় বসে আছে। চিন্তাধারার পদ্ধতি পরিবর্তন এবং দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধন না করা হলে মুসলিম মন যে কোনো বিষয়ে সমালোচনামূলক অথবা অন্তর্ভেদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারবে না। এর বদলে সে সবসময় এক ব্যর্থ সমাধান থেকে আরেকটি ব্যর্থ সমাধানের প্রতি আকৃষ্টি হবে। এ পথ পরিক্রমা চলতে থাকলে তা শুধু আরো খন্ড খনই বিভক্তি এবং পতনের দিকে পরিচালিত করবে নিঃসন্দেহে। এ দুর্ভাগ্য পীড়িত মুসলিম মানসে বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো উম্মাহর বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চেপে বসলো। তারা ইচ্ছা করেই হোক বা অনিচ্ছায় হোক, নেতৃত্বের উপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারি চিরকালের জন্য হতাশ হয় পড়ল। এরপর প্রত্যেক গ্রুপ চাইলো উম্মাহর উপর নিজস্ব কায়দায় সন্ত্রাস চাপিয়ে দিতে। উদ্দেশ্য যাই থাকুক রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ ধরনের একটি বস্তুবাদী সন্ত্রাস (material terror) এবং অপরদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব এ দু’ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সন্ত্রাস () নিয়ে মেতে উঠেছিল। এ দু’টি গ্রুপের এ ধরনের কর্মকান্ডে মেতে উঠার কারণ ছিল মুসলমানদেরকে যেন তাদের নেতৃত্বের সামনে সবসময় নিশ্চুপ, দুর্বল ও অধীন করে রাখা যায় তা নিশ্চিত করা। এটা অত্যন্ত হাস্যকর হলেও দুঃখজনক যে, এ সন্ত্রাসবাদ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যেখানে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী নেতৃত্ব নিজেরাও শোচনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চূড়ান্ত ফলাফল হলো বিজাতীয় ঔপনিবেশিক শক্তির হামলার মুখে নিজেরপ্রতিরক্ষায় সে অক্ষম হয়ে পড়ল।
মুসলিম দৃষ্টিশক্তির এ কুয়াশাচ্ছন্নতার কারণে আমরা মুসলিম জাতিকে দেখি হয়তবা সে তার অতীতকে বরণ করছে; তার সব বিচ্যুটি, চিন্তাধারা, সমাজ ও সংগঠনের বিশেষত্বসহ অথবা তাকে সব সহজাত মূল্যবোধসহ পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী উম্মাহর ব্যক্তিত্বে একটির পর একটি যে প্রাণঘাতী রোগ দেকা দিয়েছে তার ফলে তার দৃষ্টিশক্তি আরো বেশী ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। এ অসুস্থ মন ও দৃষ্টি দিয়ে সে সত্য ও অন্ধ বিশ্বাস, লক্ষ্য ও লক্ষ্যে পৌঁছার উপায়, ধর্ম ও লোককাহিনী, মূল্যবোধ ও গতানুগতিক ঘটনা এবং ধারণা ও অনুকরনৈর মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধির যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।
মৌলিকভাবে মুসলিম মন ও মানস দু’টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এ দু’টি শিবির চেয়েছে ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা ও অলীক কাহিনী অথবা উদ্দেশ্য ও পন্থার কোনো বাছবিচার না করেই বা কোনোই পার্থক্য না করেই সব কিছু গ্রহণ বা বর্জন করতে। উম্মাহর অভ্যন ্তরে কয়েকটি গ্রুপ এমনও দাবি করলো যে, যেসব জাতি বা সমাজের বস্তুগত সম্পদহানি হয়েছে তার পেছনে রয়েছে অশরীরী বা বিমূর্ত সংকটের কারণ।
চিন্তাধারা ও উপায় সংক্রান্ত প্রশ্ন বনাম মূল্যবোধ ও উদ্দেশ্য সংক্রান্ত প্রশ্ন
এটি সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত যে, যেসব মূল্যবোধ, নীতি ও বিশ্বাস ইসলামের মূল বুনিয়াদ, তা নিয়ে সম্ভবত কেউ আপত্তি তুলবে না। তারপরও ইসলামের শত্রুরা এসব বিষয়ে কথা বলে না। তাদের মতে, যখন কেউ ইসলামরে কথা বলে, তখন সে অন্ধ অদৃষ্টবাদ, জুলুম, রাজনৈতিক নিরঙ্কুষ সার্বভৌমত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক মনস্তাত্ত্বিক ত্রুটি-বিচ্যুটি. দাস ব্যবসা, অনাচার এবং নারী জাতির মর্যাদাহানির কথা বলে। এসব লোকরা আরো সোচ্চার কণ্ঠে বলে ইসলামী আকীদা, বিশ্বাস মুসলমানদের কিছু পৌরণিক কাহিনী এবং ভুলভ্রান্তির ইতিহাসেরই নামন্তর মাত্র এবং তাদের রীতিনীতি, প্রথা এবং ঐতিহ্যই হচ্ছে তাদের ঈমান এবং একই সাথে এগুলোই হচ্ছে তাদের অজ্ঞতা, অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের প্রতীক। যাহোক, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাদের পতনকালে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এ কারণে পরবর্তী কালে যা কিচু তাদের অর্জন, তা ছিল ইসলাম, তার নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মানজনক অবস্থানের ফসল। অপরদিকে ইসরাম ও ইসলামী মূল্যবোধের অস্তিত্ব সত্ত্বেও তাদের বিপদে পদচারণা ছিল তারেদ অতীত সভ্যতার অনুশীলনের ফল। ইসলাম, এর মূল্যবোধ ও শিক্ষার সভ্যতাগর্বী প্রভাব না থাকলে নিঃসন্দেহে মুসলমানরা আরো বেশি অবিচার, দুর্নীতি ও অজ্ঞতার পঙ্কিলে নিমজ্জিত হতো।
এ সংকট ও সন্ধিক্ষণে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অনুধাবন করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে মুসলমানদের ত্রুটি-বিচ্যুতি গুলো কোনোক্রমেই ইসলামের মূল্যবোধ, উদ্দেশ্য লক্ষ্যের কারণে ঘটেনি। বরং মুসলিম যে উপায়ে ও যেভাবে চিন্তা করছে, অনুভব করছে, যুক্তির অবতারণা করছে তারই ফল। কাজেই আমরা যখন সংস্কারের কথা বলি তখন আমরা বাস্তবিকই চিন্তা এবং মুসলিম মন-মানসে কথা বলি। যেদিকে বাস্তবিকিই মনোযোগ নিবদ্ধ করা প্রয়োজন, তা হলো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এবং বিভিন্ন আবহ ও পরিমন্ডলে মুসলিম মন কীভাবে সমাজে ও সংগঠনে ইসলারেম মূল্যবাধ ও শিক্ষাকে প্রয়োজ করছে।
সর্বোপরি পারস্পরিক ঐক্যমত, সংহতি এবং এসব নীতি বাস্তবায়নের জন্যে যে ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয় (অথবা বাস্তবে যেসব নীতির অবসান ঘটাতে অথবা যেগুলোতে ধ্বংস নামাতে প্রশ্রয় বা অনুমোদন দেয়া হয়) তার মধ্য পার্থক্য আছে। শরিয়াহ বা শরিয়তের উচ্চতর লক্ষ্য এবং সেগুলো সুনিশ্চিত করার জন্য তৈরি নীতিমালার মধ্যে এবং শরিয়াহর নীতি ও মূল্যবোধ এবং তা বাস্তবায়নের কার্যপ্রণালী ও ব্যবস্থাপনর মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। মূল্যবোধ, নীতি এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যেল মতো বিষয়গুলো বিশ্বজনীন অস্তিত্বের বিধিবিধানের অন্তর্ভুক্ত, যা স্থান-কালের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি সুসমন্বিত মানবীয় চরিত্রের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। অপরদিকে কার্যবিধি, নীত, দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাস্তব ব্যবস্থা স্থান ও কালের জনুরি অবস্থার সাথে ওপপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। এ সবের অর্থ এ যে, একদিকে ঈমান বা বিশ্বাস, নীতি ও মূল্যবোধের মধ্যে পার্থক্য এবং চিন্তাধারা, হৃদয়ঙ্গম করা এবং প্রয়োগ (অথবা প্রয়োগহীনতা বা অসম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ)- এর মধ্যে পার্থক্য একটি একান্তই মৌলিক বিষয়। আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাকে সঠিক দেখতে এবং যে কোনো অর্থপূর্ণ সংস্কার আনতে চাইলে আমাদেরকে বিষয়ে অবশ্যই সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তা সত্যই প্রতিভাত হয় যে, উম্মাহর সংকট মূলত বিশ্বাস নিয়ে নয় বরং চিন্তার ক্ষেত্রে, অর্থ উদ্ভূত নয় বরং পদ্ধতির এবং এতে যে সমস্যা সম্পৃক্ত তা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে নয় বরং উপায় বা কৌশল নিয়ে। তাহলে এটিই হচ্ছে সে সঠিক স্থান, যেখান থেকে আমরা গভীরবাবে অধ্যয়ন শুরু করতে পারি এবং তা করতে গিয়ে আমরা প্রতারণাপূর্ণ দাবি এবং কালজীর্ণ ঐতিহ্য সম্পর্কে অপ্রয়োজনীয় বিভ্রান্তির অবসান ঘটাতে পারি।
বুদ্ধিবৃত্তিক বিচ্ছিন্নতা
তকলিদ’র কারণ ও অনগ্রসরতা
সময়ের সাথে মুসলিম মন ও মানসের সংকটকে এড়িয়ে যাওয়া আরো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। কারণ তত্ত্ব ও বাস্তবতার মধ্যে পর্থক্য এখানে অনেক বেশি করা হয়। মুসলমানদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অলীক আশা ও উদ্ভট আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় এবং ইতিহাস ও অতীত দিনের স্মৃতির চেয়ে মুসলিম জাতির সাংস্কৃতিক গুণাবলী একটু বেশি অর্জিত হয়। যখন উম্মাহর নিয়ন্ত্রণ শত্রুর হাতে গিয়ে পড়ে মুসলিম সমাজ ও তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের দেউলিয়াপনা স্বতঃই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুসিলম বুদ্ধিজীবীদের ভাগ্যে এিই দশা জোটে এবং দুর্ভোগও তাদের সমান হয়, কারণ তারা এমন এক সময় পদার্পণ করে, যখন বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের হুমকি বা চ্যালেঞ্জের সামনাসামনি দাঁড়ানোর যোগ্যতা ও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। উম্মাহ অতীতে সভ্যতার যে উচ্চমার্গে আরোহন করেছিল, তা ছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগের ব্যক্তি মানুষের অদম্য প্রেরণার ফল। তথাপি সে স্ফুলিঙ্গকেও পরিণামে নিষ্প্রভ হতে হয় এবং একটি সময়ে আন্দোলনকেও স্থবির হয়ে যেতে হয়। সময় ও পরিস্থিতি বদলে যায়। কিন্তু উম্মাহর রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুদ্ধিজীবী নেতৃত্ব থেকে পৃথক হওয়ারর করণ মুসলমানরা সত্যিকারভাবে পথ হরিয়ে ফেলে এবং নিজেদেরকে নতুন করে গড়ে তোলার যোগ্যতা আর তাদের মাঝে থাকে না। নেতৃত্বের এ বিভক্তি তাদের মাঝে আক্ষরিক অর্থে, তাকলিদ অসংযম ও কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেয় ফলে অতি দ্রুত এগুলোই তাদের রীতিতে পরিণত হয়। এগুলোই হলো তারেদ সমসাময়িক হালচাল। নতুন চিন্তাধারা সৃষ্টি, নিজেদের প্রতিষ্ঠানগুলোর মনোন্নয়ন এবং সভ্যতার ক্ষেত্রে আরো এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, কর্মসূচি এবং নীতি প্রণয়নের যোগ্যতা উম্মাহ হারিয়ে বসে।
নেতৃত্ব পৃথক হবার পর থেকে, উম্মাহ ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের হাতে গড়া উদার সামাজিক বুনিয়াদের ধ্বংসাবশেষের উপর জীবন কাটিয়েছিল। তথাপি এ একই সময়ে মুসলিম জাতি ও তার নেতৃত্বের মধ্যে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষয়িষ্ণুতার উপাদানগুলো ছড়িয়ে পড়ে এবং চিন্তাধারা ও ঝোঁকপ্রবণতা ইতিহাসখ্যাত ইসলামী সমাজ কাঠামোকে বাস্তবে ধ্বংস করে দেয়।
বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বি বিচ্ছিন্নতার কারণে (প্রায়শ রাজনৈতিক কৃর্তৃত্ব এ বিচ্ছিন্নতাকে তাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে। সামজিক দায়িত্ব পালন করেছেন এমন উপলক্ষ ও ঘটনা খুব বিরল। এর পরিবর্তে তারা নিজেদেরকে মনে প্রাণে নিয়োজিত করলেন ধর্মীয় মৌলিক গ্রন্থ অধ্যয়নে, ধর্মশাস্ত্র চর্চার একটি মরুদ্যান রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং ধর্মীয় সকল মৌলিক গ্রন্থ ও বিজ্ঞানের মাধ্যমে হিসেবে প্রাচীন যুগের আরবি ভাষার জটিলতা ধরে রাখলেন। তাদের এসব কর্মকান্ডের ফলেই প্রতিষ্ঠা পেল কুরআন, সুন্নাহ এবং আরবি ভাষার পাঠ সংক্রান্ত বিজ্ঞান শাস্ত্র ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক ইবাদতের নিয়মবিধি ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ চিল। এ কারণে ফিকাহ শাস্ত্র প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের আবহ ও পরিমন্ডল পেরিয়ে কখনো এগুতে পারেনি। একইভাবে ফিকাহর ব্যবহারিক বিজ্ঞান কখনো বিশ্বাস সম্পর্কীয় বিজ্ঞান অর্থাৎ আকাঈদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়নি। এ কারণে সাধারণভাবে বলতে গেলে এসবই হয়ে দাঁড়ালো তাত্ত্বিক ও অনুমনাভিত্তিক। এভাবেই দেখা যায় বিশ্বাস সম্পর্কিত বিজ্ঞান (আকাঈদ) মুসলিম উম্মাহর দিক নির্দেশনায় কখনো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিতা পালন করতে পারেনি।
এমনকি ইসলামের প্রথমিক যুগের মুসলমানদের মন-মানস ও চিন্তাধারা যেসব ইসলামী নীতিমালা ও শিক্ষা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে তাতে সুস্পষ্টভাবে বিভাজন সৃষ্টি হয় দু’ভাগে। প্রথমভাগে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণভাবে এলো সেসব ইসলামী শিক্ষা নীতিমালা ও শিক্ষার কথা যেগুলোকে তাৎপর্যহীণ করে রাখা হয় এবং উপেক্ষা করা হয়। অথচ সেগুলো ছিল সামাজিক অবস্থা ও বিভিন্ন পরিস্থিতি ও সমাজ জীবনের পরিবর্তনশীলতা বিশ্লেষণের জন্য অপরিহার্য বিধিবিধান ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পর্কিত।
এ বিভাজনের ফলে ইসলামী মৌলিক গ্রন্থসমূহের সাথে সম্পর্কিত নীতিমালাসমূহ অত্যন্ত জটিল বিজ্ঞানে রূপান্তরিত হয়, অপরদিকে দ্বিতীয় পর্যায়ের শিক্ষা ও নীতিমালা এবং সেসবের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোকে অবশ্যম্ভাবীরূপে উপেক্ষা করা হয়। উপরিউক্ত কারণে ইসলামী শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সঠিক অর্থে কোনো সমাজ বিজ্ঞান সৃষ্টি হয়নি। ইসলামী অর্থনৈতিক, শিক্ষামূলক, রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক বিজ্ঞান জন্ম না নেয়ার পেছনে এটিই ছিল কারণ। এর পরিবর্তে প্রাচীনকালের সেরা মুসলিম পণ্ডিতগণ হয়তবা কখনো কখনো আলোচনা প্রসঙ্গে অথবা আকস্মিকভাবে স্বগতোক্তি বা মন্তব্য হিসেবে এসবের উল্লেখ করেছেন। দেখা গেল এভাবেই মুসলিম সমাজরে অভ্যন্তরে ক্যাডার সৃষ্টি, তাকের সুসংগঠিত করা এবং এর উন্নয়নের উপযোগী নীতিমালা প্রণয়নের মতো বিষয়সমূহ পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে ছিল অত্যনস্ত অস্থায়ী বা সাময়িক এবং পুরোপুরি খামখেয়ালীপূর্ণ। বিভিন্ন বিজ্ঞানকে এ কাজে লাগনোর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে আনুষ্ঠানিক যার গবেষয়নার কাঠামোগত, এ শুরু বাস্তবতা থেকে এবং প্রকৃতির উপলব্ধি থেকে, তারপর এটি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত থাকে লক্ষ্য, নীতিমালা ও মূল্যবোধের দিকে। সমাজ বিজ্ঞান প্রকৃত ফলাফল দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে এবং প্রায়শই যা দেখা যায়, আকর্ষণীয় বাক্য বিন্যাস ও অন্তঃসার শূন্য বাক্যাংশের পেছনে এর গা ঢাকা দেয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
মুসলিম মানসে সংকট হচ্ছে ইসলামের উচ্চতর লক্ষ্য অর্জন এবং এটি ইসলামী মূল্যবোধের মূর্ত প্রকাশের সাথে জড়িত। সুতরাং মূল এবং দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এটি হচ্ছে চিন্তাধারারই সংকট। সমাজ বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র হচ্ছে পদ্ধতিহীন থাকার সংকট। মুসলিম চিন্তার সংকট হচ্ছে সমাজ বিজ্ঞানের ঐ সকল শাখা প্রতিষ্ঠা করা যেগুলো উম্মাহকে তার চিন্তাধারা সংগঠন, প্রতষ্ঠান এবং নীতির ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। যখন আমরা সমাজ বিজ্ঞানের কথা বলি, তখন আমরা পদ্ধতিগত অধ্যায়ের ক্ষেত্রগুলো বিবেচনা করি এবং এ পদ্ধতিগত অধ্যয়ন বলতে আমরা ক্ষেত্রগুলো বিবেচনা করে। এ পদ্ধতিগত অধ্যয়ন বলতে আমরা কোনো বিশেষ মতবাদ বা চিন্তাধারা (পাশ্চাত্য, বামপন্থী প্রাচীন অথবা অন্য কোনো ) বিবেচনায় আনি না। এ কথা বলা যায় যে, যেহেতু মুসলিম মনের জ্ঞানের উৎস পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাত্মক এ কারণে বিজ্ঞান বিষয়ে এগুলো মূল্যবান অবদান রাখতে পারবে।
ইসলামী সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনার সময় এখনো আসেনি এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।