অধ্যায় তিন
ইসলামী চিন্তাধারারয় পদ্ধতিবিজ্ঞানের নীতিমালা
নিজেদের প্রতি এবং ইসলামের ইতিহাসের প্রতি বিশ্ব মুসলিমের দায়িত্ব রয়েছে। তাদেরকে ইসলামের মহান আদর্শের আলোকে খেলাফতের কর্তব্য পালন ও সভ্যতার সংস্কার সাধেনের কাজ করতে হবে। বর্তমানবিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মানবজাতি ও মুসলিম উম্মাহর সামনে ইসলামের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র ইসলামের মাধ্যমেই আধুনিক সভ্যতার সংস্কার সাধন সম্ভব।
ইসলামের শিক্ষা উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই পদ্ধতিবিজ্ঞানের ব্যাপক কাঠামোর সংজ্ঞা দিতে হবে, কারণ এটি হচ্ছে কেন্দ্রবিন্দু যার চারপাশে ইসলামী চিন্তাধারা আবর্তিত হচ্ছে।
ইসলামী চিন্তাধারার পদ্ধতিগত কাঠামো
শুরুতে এ বিষয়টি উপলব্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলামী চিন্তাধারার কাঠামো জগৎ ও জীবনের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে। এটি উপলব্ধির পর ইসলামী চিন্তাধারা এবং তাকে নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন সম্পর্ক, মতবাদ, ধারণা এবং নীতিসমূহ বুঝার সূচনা বরা যায়। সুতরাং আমরা যদি ইসলামী চিন্তাধারা ও পদ্ধতি বিজ্ঞানের প্রকৃতি যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে ইচ্ছুক হই এবং ইসলাম যেসব লক্ষ্য অর্জন করতে চায় তা কখনো বুঝার আশা রাখি, তাহলে প্রথমে আমাদের ইসলামের দৃশ্য ও অদৃশ্য সম্পর্কিত ধারণা উপলব্ধি করা অত্যাবশ্যক। এসব ধারণা জীবনের উদ্দেশ্যকে সংজ্ঞায়িত করে এবং বস্তুজগতের বাইরের জগতের সাথে তাকে সম্পর্কিত করে। অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কে শুধু সম্পর্কে যতটুকু চান, তা প্রকাশ করেন। তারপর তিনি সেসব বান্দাদের রাসূল বা দূতরূপে মানবজাতির কছে হেদায়াতের জন্য এবং তাদের অস্তিত্বের তাৎপর্য সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য পাঠান। অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কিত ইসলামী ধারণা অনুসারে অদৃশ্য জগতের সাথে মানুষের উত্তম ও গঠনমূলক সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কের লক্ষ্য হচ্ছে পৃথিবীতে সত্য ও ইনসাফ সুপ্রতিষ্ঠা করা এবং তাকে দুর্নীতি মুক্ত রাখা।
তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমাদের মধ্যে কর্মে কে সর্বোত্তম তা পরীক্ষা আল্লাহ তোমাদের ইনসাফ (আদল) করার, সৎ কাজ (ইহসান) করার এবং আত্মীয় স্বজনের প্রতি উদার হতে নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন সব লজ্জাজনক, ঘৃণ্য ও বিদ্রোহাত্মক বা অন্যায় কাজে (১৬:৯০)।
আমরা অদৃশ্য বা গায়েবের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নীতিসমূহ এবং তা মানুষকে কী দিতে পারে তা সংক্ষেপে আলোচনা করতে পারি।
জীবনের একটি উদ্দেশ্য আছে, তা হচ্ছে নৈতিক কল্যাণ। এটি উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করা হয়নি। তুমি কি ধারণা কর যে, তোমাকে আমি বৃথা সৃষ্টি করেছি এবং তুমি কখনো আমাদের কাছে ফিরে আসবে না? (২৩:১১৫)
বিশ্বে সব কিছুর মধ্যে মৌলিক ও চিরন্তন সম্পর্ক রয়েছে। মানব মনের উপলব্ধি মানুষের ক্ষমতার বাইরে।
মানুষের জন্য অদৃশ্র জগতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হলো মহান আল্লাহর অস্তিত্ব, যিনি চিরন্তন স্রষ্টা, এক ও একক। তাঁর মতো আর কিছুই নেই এবং তিনি সব কিছু সম্পর্কে জানেন।
আখেরাতে পাপ-পূর্ণ বিচারের দিনে সকল রূহ পুনরুজ্জীবিত হবে। সেখানে মানুষকে ইহজাগতিক জীবনের কাজ অনুযায়ী পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া হবে।
এ পৃথিবী হচ্ছে ইতিবাচক কাজের জায়গা গড়ে তোলার স্থান এবং সব কিছুকে শৃঙ্খলার মধ্যে স্থিত করার স্থান। এ পৃথিবীতে মানুষকে খলিফা হিসাবে তার মিশনের জন্য সব কিছুকে তার ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। সে এখানে বসবাস করবে। সব কিছুকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনবে। পৃথিবীর সব কিছুকে তার অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল করে দেয়া হয়েছৈ, সব কিছুর রক্ষণাবেক্ষণ তাকেই করতে হবে, পৃথিবীকে ভালো কাজে ব্যবহার করতে হবে। এতে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা করে ক্ষমতার অপব্যবহার করবে না। সর্বশক্তিমান আল্লাহর সর্বজ্ঞতা থেকে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা উৎসারিত। এটি আল্লাহর সৃষ্টির অন্যতম আশ্চর্যচনক বিষয় এবং তাঁর মহত্ব ও ক্ষমতার একটি নিদর্শন। আল্লাহ তাঁর ইচ্ছায় অন্য সব কিছুর মতোই মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দান করে তাকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও সম্পর্কিত করেছেন।
আল্লাহ এ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে প্রাকৃতিক আইনের অধীন করেছেন। এসব আইন অনুসারে কাজ করে বিভিন্ন কর্ম সম্পাদন করা যায়, লক্ষ্য অর্জন করা যায় এবং মানবীয় ইচ্ছা, তার দৃঢ় সংকল্প ও নির্দেশনার প্রকাশ ঘটানে যায়। এসব আইন প্রয়োগ না করলে কোনো ইচ্ছা বা দৃঢ় সংকল্পের অস্তিত্ব থাকে না, কোনো লক্ষ্যে পৌছা যায় না এবং কিছুতেই প্রকাশ করা যায় না। মুমিন যখন প্রাকৃতিক আইনকে উপলব্ধির প্রচেষ্টা চালায় এবং সে অনুযায়ী কাজ করে তখন তাকে আল্লাহর উপর ভরসা (তায়াক্কুল) করতে হয়। কারণ তিনি অদৃশ্য জগতকে জানেন এবং গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আল্লাহ তাঁর বিশ্বাসী দাসের (মুমীন বান্দা) জন্য সব কিছুর বিধান দিয়েছেন। তার পর বান্দা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী তার সব দায়িত্ব পালন করে। এসবই বান্দা বা দাসের ইহকাল ও পরকালে কল্যাণের জন্যই। ওহী মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় অদৃশ্য জগতের জ্ঞান সরবরাহকারী খোদায়ী উৎসকেই বলা হয়।
অপরদিকে যুক্তি হচ্ছে দৃশ্যমান জগৎ, এ পৃথিবীতে মানুষের জ্ঞান আহরণ ও তা প্রয়োগের জন্য সহায়ক হাতিয়ার। মানুষের কাছে যুক্তির প্রয়োজন দেখা দেয় খেলাফতের দায়িত্ব পালন এং সত্য, ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হাসিলের জন্য। সুস্থ মানব প্রকৃতি (ফিতরাত), আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস এবং তাঁর ওহীর উপস্থিতিতে ওহী, যুক্তি ও প্রাকৃতিক বিশ্ব সম্পর্কিত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে বিরোধের কোনো অবকাশ নেই। ওহীর কাজ অদৃশ্যজগতকে নিয়ে। ওহী যে সত্যকে ধারণ করে তা গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে কাজ অদৃশ্যজগতকে নিয়ে। ওহী যে সত্যকে ধারণ করে তা গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আমরা সুষ্ঠু ও কলূষিত জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়য়ের উপাদান খুঁজে পাই। ফেরেশতার সঠিক দিকনির্দেশনা প্রাপ্ত জ্ঞান এবং ইবলিসের কলূষিত জ্ঞান ও যুক্তির মধ্যে পার্থক্য করার এটিই হচ্ছে মাপকাঠি। তারা বলল, জ্ঞান সম্পর্কে উদ্ধত স্বরে ঘোষণা করেছিল যে, সে উন্নতর উপাদানে সৃষ্ট। আপনি আমাকে আগুন থেকে এবং তাকে (আদমকে) মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন (৭:১২)। পরিপূর্ণ জ্ঞান ও শক্তির অধিকারী আল্লাহ বলেন, আমি যা জানি তা তোমরা জান না (২:৩০)।
চিন্তাধারার এ ব্যাপক ও সর্বাত্মক কাঠামোর মধ্যেই মুসলমানদের প্রথম প্রজন্ম তাদের সব প্রশ্নের জবাব, সব চাহিদার সমাধার খুঁজে পেয়েছিল। আল্লাহ কুরআনের সর্বত্র ঈমান বা বিশ্বাসকে সৎকর্মের সাথে গ্রথিত করে দিয়েছেন, এটি মুসলিমদের দৃষ্টি এড়ায়নি।
যারা বিশ্বাস আনে এবং সৎকাজ করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়। ১০৩: ৩)
সৎকাজ (সালেহ) বলতে বাস্তব উপলব্ধি, ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে বুঝায়। অন্যকথায় সদিচ্ছাই শুধু যথেষ্ট নয়।
মুসলিম মন-মানসকে তার শক্তি পুনরুদ্ধার করতে হলে তাকে প্রথমে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে পুনরায় আবিষ্কার করতে হবে। এর পরেই মানুষ ও তার চিন্তাধারাকে পরিচালনা করা যাবে, তার প্রচেষ্টা সাফল্যমন্ডিত হবে এবং শক্তি ও বিজয়ের জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে।
ইসলামী পদ্ধতিবজ্ঞানের উৎসসমূহ
প্রত্যাদেশ, যুক্তি ও মহাবিশ্ব
জ্ঞান ও পথ নির্দেশনার উৎস হিসেবে ওহী হচ্ছে মানব জীবনের জন্য সে সত্য যা আল্লাহ তাঁর রাসূলদের কাছে প্রত্যাদেশরূপে পাঠিয়েছেন, যাতে তারা মানুষের কাছে আল্লাহর আদেশ পৌঁছে দিতে পারে এবং মানব জীবনের অস্তিত্বের অর্থ, তাৎপর্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে মানুষকে পথ নির্দেশনা দিতে পারে, প্রশিক্ষণ দিতে পারে। ওহী মানুষের জন্য যে বাণী বয়ে এনেছে তার নির্যাস হচ্ছে আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের ব্যাখ্যা এবং এ পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্বের লক্ষ্য। মানুষ আল্লাহর সবচেয়ে সম্মানিত সৃষ্টি। কারণ মহান প্রভু তাদেরকে স্বাধীন ইচ্ছা দান করে ধন্য করেছেন। তারা স্বেচ্ছায় সত্যকে মেনে চলবে, তাদের হতে হবে সবার সেরা এবং তারা সৎ কাজ করবে। অপরদিকে খেয়াল-খুশির আবর্তে পড়ে সত্যকে অবজ্ঞা করলে তারা হবে অসৎ, দুর্নীতিপরায়ণ ও অত্যাচারী। শ্রেষ্ঠজীব মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক হচ্ছে নিজেকে সমর্পণের, শৃঙ্খলার এবং নিয়ন্ত্রণের, দাসত্বের। এ সম্পর্ক হচ্ছে খেলাফত ও সম্মানের, প্রশষংসা ও উজ্জীবনের। মানুষ যখন মহান আল্লাহর অনুজ্ঞাকে অনুসরণ করে তাঁরই দিকে মুখ ফেরায় এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা এড়িয়ে চলে তখন সে সম্পর্ক হয় সম্মন ও মর্যাদার। কারণ, এটি তাকে সত্যে পৌঁছায় এবং সত্যকে অর্জন করে, যা হচ্ছে কল্যাণ ও আসলে বাস্তবতা, সঠিক পথ, যে মহান লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সকল সৎ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ প্রচেষ্টা চালায়। মানুষ তার কর্মপ্রচেষ্টার বলেই উন্নত হয়, মহৎ হয় এবং ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে এ সম্পর্ককে উপলব্ধি করার জন্য কোনো অবমাননা, অবমূল্যায়ন, ঘৃণা বা শোষণেল ধারণা গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। এ সম্পর্কে মহানবী (সা) বলেছেন, রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের সুগন্ধ অপেক্ষ উত্তম (বোখারী ও মুসলিম)। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি মরুভূমিতে সফরে থাকো এবং নিজের বাহন উট হারিয়ে ফেলো যেটি একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ো এবং তারপর দেখতে পাও যে, তোমার উট ফিরে এসে তোমর পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তখন তোমার যে সন্তুষ্টি লাভ কর তার চাইতে আল্লাহ অনেক বেশি সন্তুষ্ট হন যখন তাঁর দাস তাঁর কাছে তাওবা করে (মুসলিম )।
আল্লাহ বলেন, আল্লাহর তরফ থেকে তোমারেদ কাছে এসেছে একটি আলো এবং একটি প্রাঞ্জল গ্রন্থ- এর সাহায্যে আল্লাহ, যারা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায় তাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথে পরিচালিত করেন। তিনি তাঁর ইচ্ছায় তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যান এবং তাদেরকে সরল সঠিক ও সোজাপথে পরিচালিত করেন (৫:১৫-১৬)।
যুক্তি
যুক্তি হচ্ছে মানুষের এমন একটি হাতিয়ার, যা কোনো কিছুর মর্ম উপলব্ধি করতে, নিরীক্ষণ করতে, দু’টি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে এবং তুলনা করতে সহায়ক হয়। দৃশ্যমান জগতে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য এটিই হচ্ছে অবলম্বন। কোনো কিছুর উপলব্ধি করার জন্য এটি মৌলিক উপায় হওয়া ছাড়াও যুক্তি এমন একটি বিষয়, যার সাহায্যে মানুষ জীবন, জগৎ ও অন্যান্য সৃষ্টির সাথে তার সম্পর্কের মর্ম বুঝতে পারে। এর ভিত্তিতে মানুষ তার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে পারে, যুক্তিকে বাদ দিয়ে কোনো মানুষ আর মানুষ থাকে না, কোনো উপলব্ধির ক্ষমতা থাকে না, তার কোনো গুণের সঠিক মূল্যায়ন থাকে না এবং কোনো দায়িত্বও থাকে না। সত্যিকার ওহী এবং বিভিন্ন বিভ্রান্তি কর মিথ্যাচার, বানোয়াট বিষয় এবং অবাস্তব কল্পনা ও পৌরণিক কাহিনীর মধ্যে যুক্তিই পার্থক্য সূচনা করতে পারে। অনুরূপভাবে যুক্তিই মানুষের মধ্যে যাচাই এবং পছন্দ ও অপছন্দের ক্ষমতা সৃষ্টি করে এবং তারা যা কিছু পছন্দ করে তার পরিণতি ভোগ করার জন্য তাকে সক্ষম করে তোলে।
অতীত জাতিগুলোর কাছে প্রেরিত ওহীকে যখন বিকৃত করা হলো, তখন ওহীর বিশুদ্ধতার ও প্রামাণিকতা হারিয়ে গেল। অপরদিকে মুসলিম মন-মানস একটি পূর্ণাঙ্গ ও সত্যিকারের ওহী লাভ করে এবং দৃশ্যমান ও অদৃশ্য জগতকে পরিবেষ্টনকারী তার জ্ঞানের উৎসকে খুঁজে পেয়ে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হলো। এভাবে ওহী এবং যুক্তি বিশ্বজগতের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে একীভূত থেকে মানুষকে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য বুঝতে এবং খলিফার ভূমিকা পালন করতে সক্ষম করে তোলে। যুক্তির ভূমিকা হচ্ছে ওহীর প্রামাণিকতা ও বিশুদ্ধতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং তারপর দৃশ্যমান বিশ্বে মানস অস্তিত্ব সম্পর্কে তার উদ্দেশ্যকে উপলব্ধি করে দৃশ্যমান জগতকে বোঝা। মুসলিম মনের ভূমিকা হচ্ছে দৃশ্যমান জগতকে গঠন করা এবং আল্লাহর ইচ্ছার নির্দেশনা ও লক্ষ্য অনুযায়ী খলিফার কর্তব্য পালন করা। মুসলিম মন-মানস ওহীর উপলব্ধি থেকেই তারা শক্তি, স্থিতিশীলতা এবং ন্যায়পরায়ণতার অধিারী গয়ং। মুসলিম মন হচ্ছে একটি বিশ্বাসী, সঠিকরূপে পরিচালিত এবং পূর্ণ আস্থাশীল মন। একটি হঠকারী নয় এবং অনুমানের কারণে কোনো নিশ্চিত বিষয়কে অথবা অন্ধাকারের জন্য আলোকে বা ভ্রান্তির পথ নির্দেশকে ত্যাগ করে না। এ মনস একটি শক্তিশালী সক্ষম মন, এটি খলিফার ভূমিকা পালনেই পুরোপুরি নিমগ্ন। মুসলিম মন অনুমান নির্ভর বিষয়ে সময় বা শক্তি কোনোটাই ব্যয় করে না বা যেসব বিষয় সত্যিকার অর্থে কল্যাণকর বা প্রয়োজনীয় নয় তার পেছনে তার সময় ও শক্তিকে কাজে লাগায় না। এমনি দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মুসলিম মন অদৃশ্য জগতের বিষয়াবলীতে তর্ক জুড়ে দেবে না অথবা সে ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত কালামে ইলাহীর সুস্প্ট উচ্চারিত বাণী ও তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে উপলব্ধি ও ব্যাখ্যায় এবং সেগুলোকে বাস্তবায়নে যুক্তির ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে যাবে না। ইসলামের এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রকৃতি ও বিভিন্ন ঘটনাবলী অথবা বিভিন্ন পদ্ধতি বা ব্যবস্থা সৃষ্টিতে অথবা দায়িত্ব বহনে যুক্তির বূমিকাকে কোনোক্রমেই অবজ্ঞা করা যায় না।
এ দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে খেলাফতের দায়িত্ব পালনে, ধর্মের নামে মানুষের উপর যাজক ও পুরোহিতদের নিয়ন্ত্রণ প্রতেরোধ এবং যালিমদের অপতৎপরতা থামিয়ে দিতে সাহায্য করে। পরিণামে শরিয়তের প্রতিরোধ এবং যালিমদের অপতৎপরতা থামিয়ে দিতে সাহায্য করে। পরিণামে শরিয়তের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিপরীতে ধর্মীয় আবেগের অপব্যবহার বন্ধ করতে সাহায্য করবে। সত্যিকার ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্তি বা ধর্মের নামে বিচ্যুতি বা যুলুমের কোনো সুযোগ নেই। ইসলামী চিন্তার ইতিহাসে ওহী ও যুক্তির মধ্যে যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল একদিকে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও লক্ষ্যের বহিঃপ্রকাশ এবং অপরদিকে বিভিন্ন গোত্র ও জনগোষ্ঠির ইসলাম গ্রহণের ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যে থেকে পাওয়া প্রাক-ইসলামী যুগের সংস্কৃতির ফল। এর ফল মুসলিম চিন্তাধাাকে দু’বিপরীত দিকে টানাহেচড়া করা হলো। ঐতিহাসিক দিক থেকে বলতে গেলে মুসলমানরা অদৃশ্য বিষয়াবলী, আল্লাহর প্রকৃতি ও গুণাবলী সংক্রান্ত বিষয়সময়হ নিয়ে দার্শনিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে তাদের প্রচুর শক্তি নষ্ট করেছে।
তথাপি কিছু মায়া, মোহ এবং কুতর্ক এখনো বিরাজ করছে। উম্মাহর এখনো ধর্মতত্ত্ব নিয়ে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত আছে এবং এসব তর্ক-বিতর্ক অব্যাহতভাবে প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। সবচাইতে জঘন্য ব্যাপার হচ্ছে, কায়েমী স্বার্থবাদীরা এসব অস্তিত্ব বিনাশকাকরী বাজে বিষয়গুলো সমর্থন করছে। এতে উৎসাহ দিচ্ছে এবং এভাবে উম্মাহকে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা উচিত তা থেকে দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এ ধরনের পরিস্থিতি উম্মাহর দুশমনদের তাদের উদ্দেশ্য হাসিলে সাহায্য করবে। এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথা এ যে, ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞান নিয়ে অধ্যয়নকালে ইসলামী জ্ঞানের উৎস ওহীর যুক্তি এবং মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক আইনকে গবেষণা ও অধ্যয়নের মাধ্যমে সঙ্গে যেন আমরা তালগোল পাকিয়ে না ফেলি। প্রতিটি বৈজ্ঞানিক বিষয়ে তার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী উপায় বা মাধ্যম রয়েছে। এটি সুস্পষ্ট যে, ইসলামী শিক্ষা অবশ্যই ওহী, যুক্তি এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে যে মানদন্ড দিয়েছেন তার ভিত্তিত রচিত হবে। এভাবে তৈরি নতুন ইসলামী শিক্ষা ব্যাপক ও অনন্য হবে এবং মানবজাতির জন্য কল্যাণকর জ্ঞান সৃষ্টিতে সক্ষম হবে।
আধুনিক যুগে মুসলিম মন এখনো ইসলামী জ্ঞানের সুত্রসমূহের কোনো নিয়ামনুগ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। তথাপি এসব সূত্রের আলোকেই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির উপযোগী গড়ে তুলতে পারেনি। তথাপি এসব সূত্রের আলোকেই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির উপযোগী সমাজবিজ্ঞঅনের ভিত্তি স্থাপন করতে হবে। একমাত্র এ ধরনের সমাজ বিজ্ঞানের সাহায্যেই গবেষণা ও সমীক্ষার মাধ্যমে উম্মাহ তার যুব সমাজকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারবে। তবে মুসলিম মনকে তার নিজস্ব সমাজবিজ্ঞান সৃষ্টির আগে যেসব নীতি মতবাদের ভিত্তিতে ইসলামী চিন্তাধারা গড়ে উঠেছে তা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে।
ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞঅন ও চিন্তাধারার মূলনীতিসমূহ
ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞঅন ও চিন্তাধারা কিছু মৌলনীতি রয়েছে। এগুলোর সাহায্যে আমরা তাকে অন্যান্য পদ্ধতিবিজ্ঞান ও চিন্তাধরা থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করতে পারি। আমরা এসব নীতি বুঝতে না পারলে সেগুলো কাজে লাগাতে পারবো না বা ব্যবহার করতে পারবো না। এসব নীতি আসলে মৌলিক ও পূর্ব প্রতিষ্ঠিত স্বতঃসিদ্ধ ধারণারই প্রতিনিধিত্ব করে। এসব স্বতঃসিদ্ধ ধারণা জীবন ও জগতের উপলব্ধিতে একটি সৃজনশীল আন্দোলনে মানুষ মনকে দিকনির্দেশনা দেয়। একটি প্রগতিশীল উপায়ে কীভাবে জীবন ও জগতের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় নিজেকে সঁপে দিতে হয় তার শিক্ষাও মুসলিম মন এবং স্বতঃসিদ্ধ ধারণা থেকেই লাভ করা যায়।
এসব মূলনীতি হচ্ছে এতত্ববাদ, খেলাফত এবং দায়িত্ব। তিনটি নীতি মুসলিম মৌলিক কাঠামো গঠন করে তার গতিপথের সংজ্ঞা নিরূপণ করে এবং লক্ষ্যগুলোকে সুস্পষ্ট করে। এসব নীতির ভিত্তিতে না হলে কোনো কিছুই মুসলিম সচেতনতাকে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে না বা তাতে শক্তি যোগাতে পারবে না। অতীতে ইসলামী চিন্তাধারার ব্যর্থতার পেছনে এসব নীতির গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থতাই অনেকটা হবে। বর্তমান সময়ে মুসলিম মনের বিভ্রান্তি এবং তার অকার্যকারিতার ব্যাখ্যাও বহুলাংশে সেভাবেই করা যেতে পারে। পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে আমরা তিনটি নীতিকে পৃথক পৃথকভাবে পরীক্ষা করে দেখবো।
একত্বাবাদ: কালেমা শাহাদাতে আল্লাহর একত্ব স্পষ্টভাবে বর্ণিত এবং কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা অনুযায়ী এ নীতি ইসলামী চিন্তাধারা ও পদ্ধতিবিজ্ঞানকে এ সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত করে যে, পরম সত্যই হচ্ছে সমগ্র বিশ্বের ভিত্তি, উৎস, চূড়ান্ত নিয়তি। বিশ্বজগত একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়েই টিকে আছে এবং সমগ্র বিশ্বের চূড়ান্ত নিয়তি তুলনাহীন আল্লহর হাতেই রয়েছে। সমগ্র বিশ্ব একটি একক উৎস থেকেই জন্ম লাভ করেছে এবং… একটি একক বাস্তবতারই প্রতিনিধিত্ব করে; এবং মানুষ হচ্ছে অদ্বিতীয় ও অনুপম সৃষ্টি। আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং সত্য ও ইনসাফের ভিত্তিতে মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা ও খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করেছেন।
আপনার মহামহিমান্বিত প্রতিপালকের তাসবীহ পাঠ করুন, যিনি সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর সুঠাম করেছেন। আর যিনি তকদীর নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন অতঃপর পথ প্রদর্শন করেছেন আল্লাহ কোনো সন্তান জন্ম দেননি অথবা তাঁর সাথে আর কোনো সৃষ্টিকর্তাও শরিক নেই (যদি অনেকগুলো প্রভু হতো তাহলে প্রত্যেক প্রভু যে যা সৃষ্টি করেছে তা নিয়ে আলাদা হয়ে যেত এবং অতঃপর একজন অন্যজনের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতো)। আল্লাহ পবিত্র সেসব কথা থেকে যা এসব লোকেরা মনগড়া ভাবে বলে (২৩: ৯১)।
এরা কি কোনো সৃষ্টিকর্তা ছাড়া নিজেরাই অস্তিত্ব লাভ করেছে অথবা এরা নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টিকর্তা (৫২: ৩৫)?
তিনি বললেন, আমারেদ রব তিনি যিনি প্রত্যেকটি জিনিসের মূল সৃষ্টি কাঠামো দান করেন এবং তারপর তাকে পথ দেখিয়েছেন (২০ : ৫০)।
এমনই হবে আল্লাহর কুদরতের বিস্ময়কর কীর্তি, যিনি সব জিনিসকেই সুষ্ঠুভাবে মজবুত করে বানিয়েছেন। তোমরা কী করছ তা তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন (২৭: ৮৮)।
তিনি পৃথিবী ও আকাশমন্ডলকে সত্যিকার ভিত্তিতে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন, আর তোমদের আকার-আকৃতি বানিয়েছেন এবং অতীব উত্তম বানিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত তোমাদেরকে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে (৬৪: ৩)।
তোমাদের মহাদয়বানের সৃষ্টি কর্মে কোনোরূপ অসংগতি পারে না। দৃষ্টি আবার ফিরাও, কোথাও কোনো দোষ-ত্রুটি দৃষ্টিগোচর হয় কি (৬৭: ৩)?
যদি আসমানে ও জমিনে এক আল্লাহ ছাড়া আরো বহু খোদা থাকতো, তাহলে উভয়ের শৃঙ্খলা ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যেত। আরশের মালিক আল্লাহরই জন্য সমস্ত গৌরব ও পশংসা, তিনি সেসব কথা থেকে পবিত্র যা এসব লোকেরা বলে বেড়ায়ং। (২১: ২২)
বিশ্বলোকের কোনো জিনিসই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব কিছু শোনেন ও দেখেন (৪২:১১)
এবং যে কেউ আল্লাহতে ঈমান আনে, আল্লাহ তাকে হেদায়াত দান করেন। আর আল্লাহ সব কিছু জানেন (৬৪: ১১)।
এটি এ জন্য যে, আল্লাহই প্রকৃত সত্য, আর সেসব কিছুই বাতিল যাদেরকে তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে ডাকে। আল্লাহই প্রবল ও মহান (২২: ৬২)।
খেলাফত : পৃথিবীতে এবং মহাবিশ্বে মানুষের খেলাফরেত দায়িত্ব পালন করতে হলে তাকে এ পৃথিবী, বিশ্বজগত ও অন্যান্য সৃষ্টির সাথে লেনদেন ও সম্পর্ক-সম্বন্ধ বজায় রাখতে হবে এবং এজন্যে তাকে অভিভাবক ও আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে যেতে হবে। একজন মুসলিম তার ফিতরাত, আকিদা, চিন্তার পদ্ধিতি, স্বাধীণ ইচ্ছা এবং আল্লাহ তাকে শেখার যে ক্ষমতা দিয়ে সম্মানিত করেছেন তার অধিকারী হয়ে মহাবিশ্বে মানুষের অবস্থানকে একটি দায়িত্বশীল অভিভাবকের অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। মানুষ যদি অবিরাম কর্মে ব্যাপৃত না থাকে এবং প্রকৃতি জগতে তার পরিপার্শ্বকে কীভাবে পরিচালনা করতে হবে সে সম্পর্কে সিদ্ধঅন্ত না নেয় তাহলে সে তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না। জীবনে তার ভূমিকা পালন করতে পারবে না অথবা মানসিক শান্তি খুঁজে পাবে না। ইসলামী চিন্তাধারা অনুযায়ী খিলাফরেত নীতি মানুষের সহজাত কামনা-বাসনা সত্য, ইনসাফ ও সংস্কারে অভিমুখে পরিচালিত হয়।
তোমরা কী তাহলে চিন্তা করেছিলে যে, আমরা তোমাদেরকে অকারণে পয়দা করেছি আর তোমাদেরকে কখনো আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না (২৩ : ১১৫)?
তিনিই মৃত্যু ও জীবন উদ্ভাবন করেছেন, যেন তোমাদেরকে পরখ করে দেখতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে সেরা মানুষ কে (৬৭:২)।
তিনি জমিন ও আকাশমন্ডলের সব জিনিসকেই তোমাদের অধীন ও নিয়ন্ত্রিত করেছেন, সব কিছুই তাঁর নিজের নিকট থেকে এতে বড় নিদর্শন রয়েছে সেসব লোকদের জন্যে যারা চিন্তাভাবনা গবেষনা করতে অভ্যস্ত (৪৫: ১৩)।
সেই আল্লাহই তোমাদের জন্য ভূতলকে অধীন করে রেখেছেন, তোমরা চলাচল কর এর বক্ষের উপর এবং খাও আল্লাহর রিযক, তাঁরই নিকট তোমাদেরকে পুনর্জীবিত হয়ে যেতে হবে (৬৭: ১৫)
ইসলামী চিন্তাধারায় খেলাফতের বহুমাত্রিকতা থেকে আমরা বুঝতে পারি প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে, বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা)-এর অতুলনীয় কর্মশক্তিকে এবং তাঁর সঙ্গি-সাথিদের তেজ ও কর্মচাঞ্চল্যতে – যারা কখনো কর্মে ক্লান্তি অনুভব করেননি, ত্যাগ স্বীকার এবং অবিরাম জিহাদেও কোন ক্লান্তি যাদের স্পর্শ করেনি। এসবই আমাদেরকে খেলাফতের এ বহুমাত্রিক চিন্তা ও মানসে তার বিস্তারই উপলব্ধি পুরোটতেই সত্যের ও সংস্কারের এক আন্দোলন শুরু হলো, পৃথিবী নামক গ্রহের কোনো অঞ্চল তার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো না।
নৈতিক দায়িত্ব: তৃতীয় যে নীতির উপর ইসলামী চিন্তাধারা ও পদ্ধতিবিজ্ঞানের সত্যতা দৃঢ়ভাবে পতিষ্ঠিত তা হচ্ছে নৈতিক দায়িত্ব। মুসলিম চিন্তাধারার বহুমাত্রিকতা ও বিস্তরকে বিবেচনা ছাড়া আমরা মুসলিম চিন্তাধারাকে বুঝতে পারবো না। এমনকি পশ্চাৎপদতা ও অনগ্রসরতার ঘোর অন্ধকার যুগেও মুসলিমকে তার বিবেক, তার দায়িত্ব ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সতর্কতা তার সচেতনতাকে টিকিয়ে রেখেছে এবং তাকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচিয়েছে। এ কারণে মুসলিম মন বরাবরই অস্থির ছিল তা কখনো তার নিশ্চিত অবস্থা ও পশ্চাৎপদতাকে গ্রহণ করেনি। তার কারণ, মুসলিম মন মানস তার নৈতিক দায়িত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, এখন আর উদাসীন থাকা যায় না। এ কারণে পরবর্তী মুসলিম উম্মাহ যখন তার পথ হারিয়ে পিছনে পড়ে গল তখন তার ইতিহাস পরিণত হলো উৎকণ্ঠা ও দুঃখের ইতিহাসে। মুসলিম মন যা রেখে গেছে এবং যা কিছু সংরক্ষণ করেছে তা হলো খলিফা হিসাবে তার দায়িত্ববোধ। এভাবে মুসলিম মন-মানসের গঠনে দায়িত্ব নীতি খেলাফত নীতির অপরদিকে প্রতিফলন ঘটায়। খেলাফত-এর পেছনের উদ্দেশ্য এবং তার প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য (স্বাধীন ইচ্ছা, বিচার শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা এবং অধিক জ্ঞান অর্জনের সম্ভাবনা শক্তি)-এর সাথে থাকে তার ভূমিকা এবং তা পালনের জন্য যেসব সিদ্ধঅন্ত গ্রহণ করা হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় মানবিক দায়িত্ব।
একজন মুসলিম তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্য সার্থক করার জন্য ইচ্ছা ও সক্ষমাতাকে ব্যবহার করতে পারলে তার দায়িত্ব পালন করলো এবং পরকালে তার যাগ্যস্থান অধিকার করলো। উদাহরণ স্বরূপ, যে যদি তার ইচ্ছা ও সক্ষমতাকে এবং সঠিক উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে, যুলুম ও দুর্নীতির স্বার্থে ব্যবহার করে, তাহলে সে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলো। তার কর্তব্যের সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করলো এবং তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্যকে হারিয়ে ফেলল। তারপর পরকালে নিকৃষ্টতমদের মধ্যে হবে তার শেষ ঠিকানা।
বল, আমি তোমাদের মতোই এজন মানুষ। (তবে) আমার কাছে ওহী এসেছে যে তোমাদের খোদা শুধুমাত্র এক ও একক। অতএব, যে লোক নিজের প্রভুর সাথে সাক্ষাতের আশা করে সে যেন নেক আমল করে এবং বন্দেগী ও দাসত্বের ব্যাপারে নিজের খোদার সাথে অপর কাউকে শরিক বানিয়ে না নেয় (১৮ : ১১০)।
তিনি-ই মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যে, তোমাদের পরখ করে দেখতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে আমলে সর্বোত্তম কে। তিনি যেমন সর্বশক্তিমান, তেমনি ক্ষমাশীলও (৬৭:২)।
হে মানুষ জমিনে যেসব হালার ও পবিত্র দ্রব্যাদি রয়েছে তা খাও এবং শয়তানে পথে চলো না, কারণ যে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমান (২: ১৬৮)।
আল্লাহ তোমারেক যে ধনসম্পদ দিয়েছেন তা দিয়ে পরকালে ঘর তৈরির চিন্তা করো, অবশ্য দুনিয়া থেকেও নিজের অংশ নিতে ভুলো না। তুমি অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং জমিনে বিপর্যয় সৃষ্টির চেষ্টা করো না, আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না (২৮: ৭৭)।
সে দিনের লাঞ্ছনা ও বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করো, যেদিন তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে যাবে। সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার উপার্জিত পাপ বা পূণ্যে পুরোপুরি ফলদান করা হবে এবং কখনো কারো উপর জুলুম করা হবে না (২: ২৮১)।
আল্লাহ সুবিচার, ইনসাফ, অনুগ্রহ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং অন্যায় পাপ, নির্লজ্জতা ও জুলূম অত্যাচার করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে নসিহত করেছেন যেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারো (১৬ : ৯০)।
যে নেক আমল করবে সে নিজের জন্যই করবে, আর যে অন্যায় করবে সে নিজেই তার পরিণতি ভোগ করবে। শেষ পর্যন্ত সকলকে যেতে হবে নিজেদের রবের কাছে (৪৫: ১৫)।
উহা এ যে কোনো বহনকারী অন্য কোনো লোকের বোঝা বহন করবে না এবং এ যে মানুষের জন্যে কিচু নেই শুধু তাই যার জন্যে সে চেষ্টা করেছে, এ যে তার চেষ্টা প্রচেষ্টা শীঘ্রই দেখা যাবে এবং তার পূর্ণ ফল তাকে দেয়া হবে (৫৩: ৩৮-৮১)।
অতঃপর সকলেই স্বীয় প্রকৃত মাবুদের নিকট প্রত্যাবর্তিত হয়। সাবধান! ফয়সালা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমস্ত ইখতিয়ার কেবল তাঁরই রয়েছে। হিসাবে গ্রহণে তিনি পূর্ণ মাত্রায় ক্ষতাশালী (৬: ৬২)।
যে লোক বিন্দু পরিমাণও নেক আমল করে থাকবে সে তা দেখবে এবং যে লোক বিন্দু পরিসাণ বদ আমল করে থাকবে সেও তা দেখতে পারবে (৯৯: ৭-৮)।
মুসলিম মনে খেলাফতের নীতির সাথে দায়িত্ব নীতির একীকরণ থেকে আমরা প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের ভালোবাসা ও ত্যাগের শক্তিকে হয়তবা বুঝতে পারবো প্রাথমিক যুগের মুসলমানরা সব জাতি ও সমাজের জন্যে যে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। লোভ, ভন্ডামী ও ঔদ্ধত্যমুক্ত এবং সম্পদ আহরণ ও সঞ্চয় অনাগ্রহের জন্য খ্যাত প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের অসাধারণ দৃষ্টন্তের ব্যাখ্যা এভাবেই দেয়া যেতে পারে। পার্থিব অর্থ সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সম্পদ সংগ্রহ ও সঞ্চয়ে তারা ক্রমেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে থাকে। কুরআনে বর্ণিত লোকদের মধ্যে তারা অন্তর্ভুক্ত এবং আল্লাহর ভালোবাসায় তারা মিসকীন, এতিম ও কয়েদীদের খাবার খাওয়ান।
তারা বলে আমরা শুধু আল্লাহর জন্যেই খাবার দিচ্ছি, আমরা তোমাদের কাছে না কোনো প্রতিদান চাই, না কোনো কৃতজ্ঞতা (৭৬: ৮-৯)।
দায়িত্ব-নীতি, সঠিক ইসলামী চিন্তাধারা এবং সুষ্ঠু পদ্ধতিবিজ্ঞানের জন্য প্রয়োজন আরো একটি গ্যারান্টি। নিয়ত অনুযায়ী কাজ হয় এবং প্রত্যেক মানুষ তাই পাবে যে জন্যে সে নিয়ত করেছে (বোখারী ও মুসলিম)। একজন মুসলিম সত্য ইনসাফের পথ থেকে বিচ্যুত করা যায় না। কারণ সে নিশ্চিতভাবে জানে যে, তার মানসিক শান্তি এবং পরকালে তার পরিণতি নির্ভর করবে যে কর্মে ব্যস্ত থাকে, সংগ্রাম করে ত্যাগ স্বীকার করে এবং নেক কারজ করে যতটুকু দায়িত্ব পালন করেছে তার ওপর। তাওহীদ, খেলাফত এবং দায়িত্ব এ তিনটি নীতি মুসলমানদের কাছে সুস্পষ্ট হলে উম্মাহ তার পথ খুঁজে পেতে সক্ষম হবে, তার প্রাণশক্তির উৎসকে পুনরায় আবিষ্কার করবে এবং তার তরুণ প্রজন্মকে সুষ্ঠু ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞান অনুযায়ী গড়ে তুলতে পারবে। এর ফলে উম্মাহকে ইতিহাসের লগ্রণী ও সৃজনশীল শক্তি হিসাবে তার অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মুসলিম মন আবারে যোগ্যতা অর্জন করবে।
তাওহীদের সঠিক উপলব্ধি নিয়ে মুসলিম মন তার সত্যিকার দিক নির্দেশনা খুঁজে পাবে এবং সাফল্য অর্জন করবে। খলিফার ভূমিকা পালন করে মুসলিম মন এগিয়ে যাবে এবং সফল হবে। অখন্ড বিজ্ঞঅন নিয়ে মুসলিম মন হয় উঠবে প্রত্যয় এবং উৎপাদনমুখী।
ইসলামী চিন্তাধারা ও পদ্ধতিবিজ্ঞঅন কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য এ দু’টি নীতি যে নীতির উপর ভিত্তি করে পদ্ধতিবিজ্ঞঅন গড়ে উঠেছে তার রূপরেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়াই যথেষ্ট নয়। বরং উক্ত রূপরেখার বাস্তব দিকের প্রতিনিধিথ্বশীল ধারণাগুলোকে বোধশক্তির দিকে নির্ণয় করাও প্রয়োজনীয়। পদ্ধতিবিজ্ঞঅনের তাত্ত্বিক দিকগুলো জানা যথেষ্ট নয়। কারণ এর দ্বারা কীভাবে কাজ হয় তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সংস্কারমুখী বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাইলে আমাদের সেসব ধঅরণা সম্পর্কে জানতে হবে, যেসব ধঅরণা অনুসারে এবং যেসব চাহিদার ভিত্তিতে মুসলিম মন কাজ করে। বাস্তবে ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞান, জাহেলি সংস্কৃতি ও দর্শন দ্বারা বিকৃত হয়ে যায়। ইসলামে দীক্ষা গ্রহণকারী নও মুসলিমরা এ জাহেলিয়াতের সংস্কৃতি ও দর্শন সাথে নিয়ে এসেছিল। যেহেতু এ সংস্কৃতি ও দর্শন নও মুসলিমদের জ্ঞানে ও বাস্তব জীবনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল, এ কারণে উম্মাজর রাজনৈতিক নেতৃত্বের অঙ্গীকারহীনতা ও তাদের ন্যায়-অন্যায় বিচারশূন্য অপকর্মের ফলে এ পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞানে এ বিভ্রান্তি রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্যে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে। তারা এ হাতিয়ার ব্যবহারক করে যাতে উম্মাহর পরিস্থিতি পুরো অনুধাবন করতে না পারে। এ হাতিয়ার তারা কাজে লাগালো যুলুমবাজ নেতৃত্ব কায়েম করতে এবং উম্মাহর দৃষ্টিকে নেতৃত্বের নৈতিকতা বিরোধী অপকর্ম ও লক্ষ্য থেকে ভিন্ন দিকে ফিরিয়ে দিতে। পদ্ধতিবিজ্ঞান সম্পর্কিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা গুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
সৃষ্টির ও অস্তিত্বের উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রকৃতি
সত্যের বিষয়মখীতা এবং পরিস্থিতির আপেক্ষিকতা
সিদ্ধঅন্ত গ্রহণের স্বাধীনতা ও স্বাধীন ইচ্ছা
তাওয়াক্কুলের ব্যাপকতা বা সর্বাত্মক রূপ
বিভিন্ন কর্মের কার্যকারণ সম্বন্ধ
সৃষ্টি ও অস্তিত্বের উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রকৃতি
মুসলিম চিন্তাধারার বুনিয়াত হচ্ছে তাওহীদ এবং এককত্বের নীতি। এর থেকে উৎসারিত হয়েছে সৃষ্টির, জীবন, মানুষ্য এবং বাস্তবতার ঐক্য। এ এককত্ব ও ঐক্য, সৃষ্টি ও অস্তিত্বের পেছনের উদ্দেশ্যকে পরোক্ষভাবে প্রকাশ করে।
আকাশ ও পৃথিবীকে এবং উভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি (২১: ১৬)।
আমি জিন ও মানুষকে শুধু আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোনো রিজিক চাই না। অথবা আমি এটাও চাই না যে, তারা আমাকে খাওয়াবে (৫১: ৫৬-৫৭)।
আল্লাহই সৃষ্টিকর্তা-এ বিশ্বাস থেকে এ অর্থ উপলব্ধি করা যায় যে, সৃষ্টির একটি মাত্রই উদ্দেশ্য রয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক সাধারণ জ্ঞান ও মুসলমানদের এককত্বে বিশ্বাস অনুযায়ী ঐক্য ও সৃষ্টির উদ্দেশ্য অথবা সৃষ্টির মূলে যে অখন্ডত্ব ও ঐকতান রয়েছে সে সম্পর্কে মুসলিম মন অনবহিত থাকবে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাওহীদে বিশ্বাসের প্রতি মুসলিম মনের স্বাভাবিক প্রবণতা তাকে অবশিষ্ট সৃষ্টির সাথে তার ভূমিকা পালনে পরিচালিত করে। মুসলিম মন এবং অবশিষ্ট সৃষ্টির সাথে তার সম্পর্কের এ ধারণার আলোকে বিশৃঙ্খল চিন্তা মোটেই মেনে নেয়া যায় না। তার মানব প্রকৃতি ও ইসলামী সচেতনতা তাকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছে। সে জন্যই মুসলিম একজন খলিফা, একজন সাক্ষী এবং সৃষ্টির অভিভাবক।
যে যাই হোক, কার্যকরণ সম্বন্ধ এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রকৃতি সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝির কারণে তাওয়অক্কুল ও তকদীন (কাজা ও কদর) সম্পর্ক ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মুসলিম মনকে এক হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি ও অবসন্নতা পেয়ে বসেছে। এ পরিস্থিতিতে সে হয়ে উঠেছে উদাসীন ও অদৃষ্টবাদী এবং সন্দেহাতীতভাবে ইসলাম বিরোধী কঠোর বৈরাগ্যবাদ নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। তারপর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সে বিশ্বে সংস্কার ও সভ্যতার শক্তি হিসাবে তার কর্মশক্তি ও ভূমিকা হারিয়ে ফেলেছে।
প্রকৃতির সব কিছু উদ্দেশ্যপূর্ণ-এ ধারণা সঠিকভাবে বুঝতে পারলে এটি উদাসীনতা ও অকর্মন্যতা প্রত্যাখ্যানের একটি সুদৃড় ভিত্তি হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে এটি মুসলমানদেরকে জ্ঞান অর্জনে এবং জীবন, জগৎ তার চারিদিকের ঘটনা প্রবাহের মধ্যকার সম্পর্ক ও সম্বন্ধ বুঝাতে উদ্বদ্ধ করে।
যার সাথে বাদশাহীতে কেউ শরিক নেই, যিনি সব জিনিসই পয়দা করেছেন এবং সেসবের তকদীর নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন (২৫: ২)।
এমনই হচ্ছে আল্লাহর কুদরতের বিস্ময়কর কীর্তি, যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে সুষ্ঠুভাবে মজবুত করে বানিয়েছেন। তোমরা কি করছ তা তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন (২৭: ৮৮)।
সত্যের বাস্তবতা এবং পরিবেশ-পরিস্থিতির আপেক্ষিকতাঃ
মুসলিম ফিতরাত সত্যের বাস্তবতার ধারণাকে এ অর্থে প্রকাশ করে যে, সে এ সসীম বিশ্বের একটি সসীম সৃষ্টি এবং ব্যাপক ও সঠিক আইনের অধীন। বিশ্বের আইন হচ্ছে একটি বাস্তবতা, মানুষকে এর সাথেই থাকতে হয়। মানুষ এসব আইনের অধীন এবং জীবনের প্রতিমুহূর্তে এগুলোর সাথে তার মোকাবিলা হয়। আরো বলতৈ গেলে, মানুষ হয়ত বা এ বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞাত থাকতে পারে এমনকি প্রাকৃতিক ব্যবস্থার কয়েকটি দিক এবং তার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণকারী বিধিবিধানগুলো বুঝতে পারে। সে নিজে পূর্ণ ব্যাপারটি বঝুত পারে না এমনকি তার গভীরতাও অনুধাবন করতে পারে না। মুসলিম মন যে অন্দর্দৃষ্টি লাভ করেছে এবং ওহীর মাধ্যমে যেসব নীতিমালা শিখেছে তার কারণে সে এসব আইনকে গ্রহণ করে এবং এসবের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করে। এভাবে মুসলিম মন জীবন ও মানব অস্তিত্বের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে।
ওহীর আলো এবং দিক নির্দেশনা থেকে মুসলিম মন ও তার সাধারণ জ্ঞান অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে। মুসলিম মনের কাছে বাস্তবতা হচ্ছে বৈষয়িক, যে এর অস্তিত্ব ও বহুমাত্রিকতাকে জানে এবং তার সাথে ও তার বিধিবিধানের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করতে চায়। মুসলিম মন পুরোপুরিভাবে বৈষয়িক। এটি খেয়ালের বশে চালিত হয় না এবং প্রত্যেককে সে অবজ্ঞা করে না। সাধুতা ও ন্যায়পরাণতাই তাকে উদ্বুদ্ধ করে এবং তার সমস্ত উদ্যম, সব প্রচেষ্টা বিশ্বের বিধিবিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সত্য অন্বেষার দিকে পরিচালিত হয়।
সাফল্যের ধারণা
মুসলিম মনের প্রবণতা অনুসারে অবাধ যৌনতা ও দুর্নীতির মধ্যে জীবনে সাফল্যের ধারণা নিহিত নয় বরং শৃঙ্খলা, সচেতনা এবং প্রকৃতির সাথে ঐকতানের মধ্যেই তা নিহিত রয়েছে। ব্যক্তি জীবনে বা সমষ্টি জীবনে যা সত্য এবং মানব অস্তিত্বের জন্য যা কিছু কল্যাণকর তা নিয়ে মুসলিম মনে কোনো বিরোধ নেই। অথবা মুসলিম মন-মানসে আধ্যাত্মিক জগৎ ও বস্তুজগতের মাঝে অথবা এ জীবনের জন্যে যা ভালো এবং পরকালের জন্যে যা ভালো তার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। এসবই অস্তিত্বের বাস্তবতার বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তারা এর সাথে একীভূত হয় এবং এর সাথে মিশে যায়।
একজন মুসলিম যে কাজই সে করুক না কেন এবং যে ভূমিকাই সে পালন করুক না কেন, সব কিছুতেই সে একজন অভিভাবক ও দায়িত্বশীলের অবস্থানে বর্তমান থাকে। সে তার চারিদিকে সব কিছুর সাথে ইনসাফ করার জন্য সচেষ্ট থাকে। সে পরামর্শ করে তার কাজকর্ম সম্পাদন করে এবং সত্য ও সুবিচার প্রার্থনা করে। সে যদি এ পন্থায় কাজ না করে সে তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে না।
তোমরা প্রত্যেকেই রাখাল এবং প্রত্যেকেই তার পালের জন্য দায়ী (বোখারী ও মুসলিম)।
বিশ্বাসীদের সকলের জীবনের মূল্য সমান। তারা শত্রুদের বিরুদ্ধে এক দেহ এক প্রাণ হয়ে লড়াই করে। তাদের মধ্যে সাধারণ মানুষটিও সমষ্টিগত বিষয়ের মতামত ব্যক্ত করতে পারে (আবু দাউদ, আল নাসায়ী)।
নবী করীম (সা) বলেছেন, “দ্বীন হচ্ছে আন্তরিকতা।” সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, “কার প্রতি বা কার জন্য এ আন্তরিকতা?” নবী (সা) জবাব দিলেন, “আল্লাহ, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল, মুসলমানদের নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মুসলমানদের জন্য” (মুসলিম)।
মুসলমানরা পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে তাদের বিষয়াদি পরিচালনা করে। তারা আছবিয়া (গোত্রকেন্দ্রিকতাবাদ), জাতীয়তাবাদ. দলবাদ অথবা সাম্প্রদায়িকতাবাদে বিশ্বাসী নয় এবং জুলুম, স্বৈরাচার অথবা দুর্নীতি তাদের কাছে কোনো তাৎপর্য বহন করে না।
বাস্তবতা মুসলমানদের মতে একটি বস্তুগত ব্যাপার হলেও এর দ্বারা সংকীর্ণতা বুঝায় না। এমনকি বাস্তবতা মৌলিক দিক থেকে এক এবং অপরিবর্তনশীল হলেও এতে মানুষের অবস্থান, ব্যক্তি বা সমাজের একটি অংশ হিসাবে খুবই ক্ষুদ্র এবং তা স্থান-কালের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয়। এর অর্থ এ দাঁড়ায় দৃষ্টিভঙ্গি, অবস্থান এবং প্রয়োগ এ সবই আপেক্ষিক। মানুষের বিভিন্ন চহিদা ও অবস্থঅন অনুযায়ী বাস্তবতার সঙ্গে মুসলিম মন-মানসের ব্যবহার পরিবর্তন ঘটে। শিশু বয়স্ক মানুষের মতো নয়, একনজ যোগ্য ব্যক্তি অযোগ্য ব্যক্তির মতো হয় না, জ্ঞানী মূর্খের মতো নয়, শিক্ষা ক্ষণস্থায়ী বিবেচনার মতো নয়, শান্তি যুদ্ধের মতো নয় এবং প্রাচুর্য দুর্ভিক্ষের মতো নয়। মুসলিম মন ঐক্যে, সর্বাত্মক বিশ্বাসে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হলেও এটি আবার বহুমুখী এবং স্থান ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে তার মূলভিত্তি বা দিকনির্দেশনা না হারিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজহনে বিভিন্ন সমাধান দিতেও সক্ষম।
স্বাধীনতার ধারণাকে বুঝার চেষ্টা করলে এটি অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলীকেও আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। স্বাধীনতা একটি অধিকার, এর দৃষ্টিভঙ্গি এবং যে কোনো দায়িত্বের মতো একটি দায়িত্ব। বিচ্ছিন্নতার মধ্যে অথবা বিশৃঙ্খলার মধ্যে স্বাধীনতার অনুশীলন করা যায় না। যে কোনো কিছুর তুলনায় এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কারণ মানুষের জীবন এবং তার অস্তিত্বের উপর এবং গভীর প্রভাব রয়েছে। ইচ্ছার স্বাধীনতা সাধারণভাবে এবং উপাসনার স্বাধীনতা বিশেষভাবে পরিণত ও সুস্থ বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির অধিকার, যে স্বাধীনতার অর্থ ও তার ফলাফল বুঝতে পারে, তার নিজ জীবনে স্বীয় কর্মের এবং তার চারিদিকের জীবনে বিভিন্ন কর্মের জন্য দায়িত্ব বহন করতে পারে।
শিশু ও কান্ডজ্ঞানহীনদের ক্ষেত্রে তাদের ত্রুটি বিচ্যুতির সুযোগ গ্রহণ করা অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক সাবালকত্ব অর্জন করে অথবা মানসিক ভারসাম্য ফিরে পেয়ে নিজেরা নিজেদের দায়িত্ব বহনে সক্ষম হওয়া পর্যন্ত তাদের সকল বিষয়ের জন্য দায়িত্বশীল অভিভাবকদর কর্তব্যকে অবমূল্যায়ন করা ভুল। মানুষের উপাসনার স্বাধীনতার অধিকার এবং সে স্বাধীনতার ব্যবহারে তার দায়িত্বের ভিত্তিতে আমরা দেখতে পাই প্রথম যুগের মুসলমানদের সেনাবাহিনী মান ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে যুলমবাজ শক্তিকে বাধা দিয়েছে, মানুষের উপাসনার স্বাধীনতার অধিকারকে রক্ষা করেছে, তাকে তার দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তুলেছে এবং অগ্রাসন প্রতিরোধ করেছে।
ইসলামী দর্শনানুযায়ী উপাসনার স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে মানুষের কোনো আদর্শকে বেছে নেয়া এবং তার অনুসরণ করার ব্যাপারে স্বাধীন, সেটা ইসলাম হোক বা ভিন্ন আদর্শ। এ সিদ্ধঅন্ত গ্রহণের অধিকার মানুষের একান্ত নিজস্ব এবং সে এ জন্যে দায়ী। ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ এ অধিকার রক্ষার, এ সিদ্ধান্তের প্রতিশ্রদ্ধা প্রদর্শনে এবং এ অধিকার প্রত্যেক দেশ সমুন্নত রাখতে এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানার বাইরেও তার নিশ্চয়তা দানের জন্য আইনগতভাবে বাধ্য।
মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা এবং এ ক্ষেত্রে ইসলামী আইন অনুশীলনকে উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকে এ বিষয়েংর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধারণা ও মতবাদের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখতে হবে। এসব ধারণা বা মতবাদকে সংক্ষেপে তিনটি বহুমাত্রিকতা এবং সামজিক আচরণের বহুমাত্রিকতা।
বিশ্বাসের স্বাধীনতা
ইসলাম সকল মানুষের বিশ্বাসের স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সুতরাং এই স্বাধীনতা ছিল সব ইমলামী সমাজ ব্যবস্থা এবং যুলুম বা শক্তির বিরুদ্ধে ইসলারেম বড় বড় লড়াইগুলোর ভিত্তি। এ ধারণার ভিত্তিতে ইসলাম রাষ্ট্র স্বয়ং তার অমুসলিম প্রজাদের উপাসনার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। এ ধারণা থেকে আমরা প্রিয়া নবী (সা) বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ ও শাসকদের কাছে যেসব চিঠিপত্র দিয়েছিলেন তার অর্থ বুঝতে পারে। তিনি এসব জানিয়েছিলেন যাতে প্রজারা উপাসনার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।
তিনি (মূসা) বললেন, সে সময় দূরে নয় যখন তোমাদের প্রভু তোমারেদ শত্রুদের ধ্বংস করবেন এবং তোমাদের পৃথিবীর উত্তরাধিকারী করবেন, যাতে তোমরা কি রকম কাজ করে তা তিনি দেখবেন (৭ : ১২৯)।
বলুন, হে মানুষ এখন তোমাদের প্রভুর কাছ থেকে তোমাদের কাছে প্রকৃত সত্য পৌঁছে গেছে। এখন যে লোক সত্য সোজা পথ অবলম্বন করবে তা তার নিজের কল্যাণের জন্যই অবলম্বন করবে এবং যে বিপথগামী হবে তার গোমরাহী তারই পক্ষে হবে ক্ষতিকর (১০ : ১০৮)।
(এমনই) হচ্ছে আল্লাহর কুদরতের বিস্ময়কর কীর্তি। যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকে সুষ্ঠুভাবে মজবুত করে বানিয়েছেন (২৭: ৮৮)।
সাবধান সৃষ্টি তাঁরেই এবং সার্বোভৌমত্বও তারই (৭ : ৫৪)।
মানু্যেষর স্বাধীন ইচ্ছার প্রকৃতি হচ্ছে এমন বিষয় যা তার সহজাত সাধারণ জ্ঞান সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। কুরআনে এরশাদ করা হয়েছে, মানব প্রকৃতির এবং সেই সত্তার শপথ যিনি তাকে সুবিন্যস্ত করেছেন, পরে ওর পাপ এবং ওর পরহেজগারী তার প্রতি ইলহাম করেছেন। নিঃসন্দেহে কল্যাণ লাভ করলো যে, যে নিজের নফসের প্রবিত্রতা সাধন করলো এবং ব্যর্থ হলো সে যে তাকে দমন করলো (৯১ : ৭-৮)।
আকাশ ও পৃথিবীর পত্যেকটি জিনিসের মালিক কেবল আল্লাহ যেন আল্লাহ অন্যায়কারীদেরকে শুভ প্রতিফল দিয়ে ধন্য করেন (৫৩ : ৩১)।
আকাশ ও পৃথিবীর প্রত্যেকটি জিনিসের মালিক কেবল আল্লাহ যেন আল্লাহ অন্যায়কারীদেরকে তাদের আমলের প্রতিফলন দেন এবং নেক ও ভালো আচরণকারীদেরকে শুভ প্রতিফল দিয়ে ধন্য করেন (৫৩ : ৩১)।
আল্লাহ তো আকাশমন্ডল ও জমিন যথাযথ সৃষ্টি করেছেন এ জন্য যে, প্রত্যেকটি প্রাণীকে যেন তার উপার্জনের প্রতিফল দেয়া যায় এবং লোকদের উপর কোনোরূপ যুলুম করা না হয় (৪৫: ২২)।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা, স্বাধীন ইচ্ছা ও দায়িত্ব
মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং এর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত দায়িত্বের ধারণা হচ্ছে তৃতীয় মৌলনীতি যার ভিত্তিতে ইসলামী চিন্তাধারা ও পদ্ধতিবিজ্ঞান গঠিত হয়েছে। আমরা স্বাধীন ইচ্ছার ধারণা এবং এর সঙ্গে আঙ্গাআঙ্গিভাবে জড়িত ব্যক্তিগত দায়িত্ব বুঝতে না পারলে জীবনের জন্য ইসলামের বাণীর অর্থ অথবা রাসূল (সা)-এর জীবনী ও জিহাদের অর্থ, অথবা পারসিক ও রোমানদের সঙ্গে প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের সংঘর্ষকে বুঝতে পারবো না। বিভিন্ন কর্ম ইচ্ছার বৈশিষ্ট্যমূলক গুণের ব্যাখ্যা দেয়। এটি কি ভালো বা মন্দ, এটি কি সত্য, ধার্মিকতা ও ইনসাফকে অনুসরণ করে নাকি ইচ্ছা তার নিজের আকাঙ্ক্ষার দ্বারা কলুষিত হয়। সর্বশেষ খলিফা হিসাবে ব্যক্তির ভূমিকার আলোকে কর্মের বিচার করা হবে এবং এ জীবনে ব্যক্তির ইচ্ছা ও কর্মের গুণের প্রতিফলন ও প্রতিনিধিত্ব হবে পরকাল।
মানব প্রকুতির এবং সেই সত্তার শপথ যিনি তাতে সুবিন্যস্ত করেছেন। পরে ওর পাপ ও ওর পরহেজগারী তার প্রতি ইলহাম করেছেন।
নিঃসন্দেহে কল্যাণ পেল সে, যে তার নিজের নফসের পবিত্রতা বিধান করলো এবং ব্যর্থ হলো সে তাকে দমন করলো (৯১ : ৭-১০)।
এ কুরআনকে আমরা সত্যতা সহকারে নাযিল করেছি এবং সত্যের সাথেই এটি নাজিল হয়েছে। (আর হে মুহাম্মদ) তোমাকে আমরা কেবল এ কাজ ছাড়া অন্য কিছুর জন্য পাঠাইনি যে, (যে মেনে নেবে তাকে) সুসংবাদ আর (যে মানবে না) তাকে সাবধান ও হুশিয়ার করে দেবে (১৭: ১০৫)।
আমরা তাদের কাঝে েএমন একখানা কিতাব এনে দিয়েছি যাকে আমরা জ্ঞান ও তথ্যে সুবিস্তৃত করেছি এবং যারা ঈমান রাখে এমন সব লোকদের জন্য যা হেদায়াত ও রহমত স্বরূপ (৭: ৫২)।
এ কুরআনকে আমরাই নাযিল করেছি এবং আমরা নিজেরা এর হেফাযতকারী (১৫: ৯)।
যুলুম, অবিচার ও জোরজবরদস্তির দৃষ্টিভঙ্গি ইসলাম সমর্থন করে না অথবা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিকে উপলব্ধির পথ সহজতর করে না। বরং এর পরিবর্তে এ ধরনের মনোভঙ্গি বা দৃষ্টিভঙ্গি বাণীর বিশুদ্ধতা, বাস্তবতা এবং ইসলামের লক্ষ্যসমূহের বিপরীতে আগ্রাসনের প্রতিনিধিত্ব করে। দীনের ব্যাপারে কোনো জোরজবরদস্তি নেই। প্রকৃত শুদ্ধ ও নির্ভুলতাকে ভুল চিন্তাধারা থেকে ছাঁটাই করে পৃথক করে রাখা হয়েছে (২: ২৫৬)।
এখন যার ইচ্ছা সে মেনে নেবে আর যার ইচ্ছা অমান্য বা অস্বীকার করবে (১৮: ২৯)।
তোমার প্রভু যদি ইচ্ছা করতেন সমগ্র মানবসমাজকে একই সমাজভুক্ত করে দিতে পারতেন (১১: ১১৮)।
তবে তুমি কি লোকদের মুমিন হবার জন্যে জোরবজবরদস্তি করবে (১০: ৯৯)।
যে কেহ নেক আমল করবে সে নিজের জন্যেই করবে আর যে অন্যায় করবে সে নিজেই তার পরিণতি ভোগ করবে। শেষ পর্যন্ত সবাইকে যেতে হবে তোমাদের রবের কাছে (৪৫: ১৫)।
খোদায়ী ওহীর জ্ঞানের ভিত্তিতে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অতীতে এবং এখনো তার শক্তিমত্তা এবং বিজয়ী হওয়ার সক্ষশতা নিশ্চিত। রাষ্ট্র যে শক্তি প্রয়োগের ক্ষশতা রাখে তার উপর নির্ভর করে নয় বরং এ জন্য যে ইসলাম বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে। সেটিই তা আসল শক্তি যতদিন ইসলামী দৃষ্টকোণ সঠিক পদ্ধতিবিজ্ঞঅন ও কাঠামোর অনুসরণ অব্যাহত রাখবে ততদিন তাকে কোনো সংঘর্ষ ও বৈপরিত্যকে ভয় করতে হবে না কারণ ইসলামী ফিতরাতের শক্তি সব সময়ই উম্মাহকে পরিচালনা করবে।
ইসলামের সুরক্ষার একটি মাত্র পথই আছে, তা হচ্ছে তাকে জানা, বুঝা এবং উত্তম রূপে ব্যাখ্যা করা এবং ইসলামী পদ্ধতির কাঠামো যে নির্ভরযোগ্য তা নিশ্চিত করা। আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা সমৃদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্রকে অথবা ইসলামী নীতিমালা, লক্ষ্য ও পদ্ধতিকে ভয় করার কোনো কারণ নেই। বাস্তবিকই, ইসলামের আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতাকে ইসলামের দর্শন ও ইসলামী ব্যবস্থার ভয় করার কিছু নেই।
ইসলামী সমাজে চিন্তার স্বাধীনতা হচ্ছে গন্তব্য অভিমুখে প্রবাহমান একটি গভীর নদীর মতো। এটি বিস্তার লাভ করে সত্যের অবস্থানের আপেক্ষিকতার ভিত্তিতে। মুসলিম চিন্তাধারায় সহিষ্ণুতা স্থান পেয়েছে, যা চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং বিরোধী বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিক অবস্থানের সংখ্যাধিক্যের দায়িত্কব গ্রহণ করে। উম্মাহর অভ্যন্তরে বিরোধী মতামতসমূহ তার ভিত্তিগুলোকে ধ্বংস করে দেবে এমন কোনো আশঙ্কা নেই। বরং ইসলাম ভারসাম্যের জন্য স্থান করে দেয় এবং স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি উপহার দেয়। কারণ ইসলামী চিন্তাধারা দিকনির্দেশনা, মূল্যবোধ, ধারণা, মতবাদ এবং ওহীর নীতিমালার ভিত্তিতে গঠিত অন্তরদৃষ্টির (Vision) কারণে মজবুত থাকবে। যে উম্মাহ তার মূলনীতির ব্যাপরে একমত তার কাছ থেকে ক্রমোন্নতি ও সৃজনশীলতা অবশ্যই বেরিয়ে আসবে।
জনগণকে তাদের স্বাধীনতার অধিকার বিশেষ করে বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে ভোগ করার ও অনুশীলনে সক্ষম করে তুলতে হলে সাংসঋতিক পরিপক্কতা একটি প্রয়োজনীয় শর্ত। কারণ আদিম সাংস্কৃতিক পরিবেশ অথবা কোনো এক ধরনের বেদুইনবাদের সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা, বর্বরতা অথবা মানসিক দিক থেকে যে অপরিপক্ক যে দায়িত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম। অবশ্যই এ অবস্থা তাকে স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে অযোগ্য করে তুলবে। এর দ্বারা এ বুঝায় যে, পরিপক্ক না হওয়া পর্যন্ত তাকে লালন করতে হবে অথবা সে সময় পর্যন্ত তাকে স্বাধীনতার অধিকার দেয়া উচিত নয় অথবা তাকে এর দায়িত্বভার গ্রহণ করতে দেয়া উচিত নয়। শুরুতে মরুভূমির আদিম ও পৌত্তলিক গোত্রগুলোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইসলাম এটিই করতে চেয়েছে। প্রত্যেকটি সম্ভাব্য উপায়ে ইসলাম তাদেরকে আদিম আচার অনুষ্ঠান ও ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে মুক্তিলাভের জন্য সাহায্য-সহায়তা দিয়েছে, তখন পর্যন্ত তারা যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতায় নিমজ্জিত তা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছে এবং মুসলমান জাতি ও তাদের মিত্রদের প্রকি পৌক্কলিব আরবদের বৈরিতা অবসান করতে চেয়েছে। মানুষের প্রতি মুসলিমদের দায়িত্বানুভূতি তাদের বাধ্য করেছিল এসব বর্বর গোত্রগুলোকে ইসলামী সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ছায়াতলে আশ্রয় দিয়ে তাদের বর্বর সামাকিজ আচরণবিধি ও পৌত্তলিক কল্পকাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করতে। সুতরাং ইসলাম এসব গোত্র সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করলো যে, তাদের বিষয়টি মানুষের ইচ্ছার এবং উপাসনার স্বাধীনতার বিষয় নয় বরং তা হচ্ছে তাদেরকে ইসলামী ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে এসে তখনো পর্যন্ত যে বর্বরতার মধ্যে তারা অবস্থান করছিল তা থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়ার বিষয়।
তারেদ মধ্যে সেই লোকেরা যাদের সাথে তুমি সন্ধি চুক্তি করেছ পরে তারা প্রত্যেকটি সুযোগেই সেটি ভঙ্গ করে এবং আল্লাহকে একবিন্দু ভয় করে না (৮ : ৫৬)।
কোনো ঈমানদার ব্যক্তির ব্যাপারে িএরা নিকট আত্মীয়তার কোনো খেয়াল করে আর না কোনো চুক্তির দায়িত্ব পালন করে। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি সব সময় তাদের পক্ষ থেকেই হয়েছে (৯: ১০)।
হে ঈমানদার ব্যক্তিগণ, মুশরিক লোকেরা নাপাক। অতএব, এ বছরের পরে তারা যেন মসজিদে হারামের কাছেও না আসতে পারে (৯: ২৮)।
আর মশরিকদের বিরুদ্ধে তোমরা সকলে মিলে লড়াই করো যেমন করে তারা সকলে মিলে তোমাদের সাথে লড়াই করেছে, আর জেনে রাখো আল্লাহ মুত্তাকী লোকদের সঙ্গেই আছেন (৯: ৩৬)।
হে ঈমানদার লোকেরা এ কাফেরদের সাথে লড়াই করো, যেন শেষ পর্যন্ত ফেতনা খতম হয়ে যায় এবং দীন পুরোপুরিভাবে আল্লাহরইা জন্য হয়ে যায়। পরে যদি তারা ফেতনা থেকে বিরত থাকে তবে তাদের আমল আল্লাহ দেখছেন (৮: ১৪)।
এ মরুচারী লোকেরা বলে আমরা ঈমান এনেছি। তাদের বলো তোমরা ঈমানা আনোনি বরং বলো যে আমরা অনুগত হয়েছি। ঈমান এখনো তোমাদের দিলে প্রবেশ করেনি। তোমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ করো, তাহলে তিনি তোমাদের আমলসমূহের প্রতিফল দানে কোনোরূপ কমতি করবেন না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ বড়ই ক্ষমাদানকারী ও দয়াবান (৪৯: ১৪)।
আদিম পৌত্তলিক মরুচারী আরবদের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে কল্যাণ কামনা এবং ইচ্ছার স্বাধীনতার অধিকার অর্জনের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা। যোগ্য ব্যক্তিদের ইচ্ছার স্বাধীনতার সম্পর্কিত ইসলামের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পেছনে সরে আসার প্রশ্ন নয়। ইসলারেম দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সুস্পষ্ট। ইসলাম আহলে কিতাবদের (ইহুদী ও খৃস্টান) শত্রুতা ও আগ্রাসী চক্রান্ত সত্ত্বেও তাদের উপাসনার স্বাধীনতার অধিকার প্রদান করেছে এবং তা রক্ষা করেছে। ইসলাম ধর্মগ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত এ অধিকারটি যারা অন্যান্য সভ্যতার অনুসারী তাদেরকেও দিয়েছিল। এ অধিকার ভোগকারী ছিলেন পারসিক ও ম্যাজিয়ানরা (magians)। অথচ তারা ছিলেন পৌত্তলিক এবং অগ্নি উপাসক। সুতরাং এটি সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত যে, উপাসনার স্বাধীনতা একটি মৌলিক ইসলামী ধারণা। এ বিষয়টি সঠিকভাবে উপলব্ধি করা না গেলে ইসলাম সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা, পদ্ধতি প্রণয়ন ও প্রয়োগ কখনো সঠিক হবে না।
চিন্তার স্বাধীনতা
মানবীয় চিন্তাধারায় স্বাধীনতার বহুমাত্রিকতা উপাসনার স্বাধীনতা থেকেই উদ্ভুত হয় এবং তাকে পরিপূর্ণ করে। চিন্তাধারার স্বাধীনতা মানুষের নৈতিক স্বাধীনতার সাথে সম্বন্ধযুক্ত, তবে এটি আদর্শিক অঙ্গীকারের কাঠামোর অভ্যন্তর থেকেই বেরিয়ে আসে। একটি ইসলামী সমাজে প্রতিটি মানুষ সচেতন নৈতিক প্রত্যয় অনুযায়ী কাজ কারা আদর্শিক অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক বাছাই করার এবং এসব প্রত্যয় ও বাছাইয়ের ভিত্তিতে যদি কেউ দৃঢ় প্রত্যয়ী না হয় অথবা তার প্রকৃতির বিরুদ্ধে বলে যা সে স্বেচ্ছায় স্বাধীনভাবে গ্রহণ করেনি অথচ তাকে যদি সে কাজ করতে বাধ্য করা হয়, তাহলে তা হবে ইসলামের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য।সুতরাং ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞান ও চিন্তাধারা অনুযায়ী চূড়ান্ত ও শেস সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অদিকার ব্যক্তির এবং তাকে (পুরুষ বা স্ত্রীলোক) শুধু জিজ্ঞাসা করা হবে। এ পছন্দ বা বাছাইয়ের পরিণাম বা ফলাফলই তাকে এ পৃথিবীতে ও পরজগতে বহন করতে হবে। তোমার হৃদয়ের সাথে পরামর্শ করো…. এমনকি যদিও মানুষ বারবার তোমাকে তাদের আইন সম্মত মতামত জানিয়ে দিয়ে থাকে (আহমদ)।
যে গোমরাহী হয় তার এ গোমরাহ খারাপ পরিণাম তারই উপর পড়বে। কোনো বোঝা বহনকারী অপরের বোঝা বহন করবে না (১৭ : ১৫)।
অস্তিত্বের উদ্দেশ্য উপলব্ধি এবং খলিফার দায়িত্ব পালন করার জন্য চিন্তার স্বাধীনতার এবং বুদ্ধিবৃত্তির প্রত্যয় হচ্ছে মৌলিক প্রয়োজন। ন্যায়নীতি বিরুদ্ধ এবং চিন্তা ও প্রত্যয়ের অপব্যবহার জীবনের অর্থ ও দায়িত্বকে অস্বীকার করে এবং এটি ইসলামী পদ্ধবিজ্ঞান মোটেই মেনে নেয় না। উপাসনা ও চিন্তাধারার স্বাধীনতার অধিকারের প্রতি অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই কেবল ইসলামী চিন্তাধারা নির্মণ করা যায়। ইসলামী সমাজের অভিধানে আমরা সে সমাজকে চিহ্নিত করতে পারে যেখানে সৃজনশীলতার জন্য স্বাধীনতা আছে। তবে উপসংহারে, সে সমাজের অগ্রগতি, নীতিসমূহ এবং সৃজনশীলতা শুধু অস্তিত্বের উদ্দেশ্যের সাথেই সম্পর্কিত থাকে, যে উদ্দেশ্য হচ্ছে সংস্কারের যা বিগড়ে দেয়ার নয়। অনুরূপভাবে সামাজিক আচার-আচরণ ও উপাসনা চিন্তার অধিকারের উপর ভিত্তিশীল। এটি কোনো তাত্ত্বিক বা বিমূর্ত বিষয় নয় বরং একটি বাস্তব বিষয়।
মানবীয় আচার-আচরণ ও কাজের একটি যৌথ বা সামষ্টিক প্রকৃতি রয়েছে অর্থাৎ সেগুলো এ শর্তে সম্মাদন করতে হবে যে, তারা সম্পদের উপর পরস্পর ক্রিয়াশীল হবে এবং সমাজের পরিপূরক হবে। সামাজিক আচরণের সামষ্টিক বহুমাত্রিকতা থেকে ব্যক্তির ইচ্ছা দাবিয়ে রাখা বুঝায় নায়। এর পরিবর্তে এ কথা বুঝতে হবে যে, সমাজে কাজের স্বাধীনতাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ব্যক্তির উপাসনা ও চিন্তার অধিকার সমাজের বিশ্বাস ও কর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। অনুরূপভাবে (ঈমান ও আমল) সমোজের বিধিবিধান, আইন ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য হবে সমাজ যেসব লক্ষ্যের ব্যাপারে একমত হয়েছে সেগুলো হাসিল করা। ব্যক্তিকে এসব সীমারেখার ভিতরে অবস্থান কর তার সক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে তৎপরতার বালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেয়া, তাকে নিজ কাজের মাধ্যমে তার ইচ্ছার অভিব্যক্তি, চিন্তা ও প্রত্যয়ের ধরন প্রকাশে সাহায্য করা। সংখ্যাগরিষ্ঠদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে সমাজের বিধিবিধান ও সামাজিক পদ্ধতি। এমনকি ব্যক্তির যদি এমন কোনো বিশ্বাস থাকে যা তার দৃঢ় পত্যয়ে থেকে উৎসারিত তার পরও সে জনগণের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে পারে না। কারণ সমাজের বিধিবিধানকে গ্রহ্য না করে চিন্তাধারা ও প্রত্যয়ের স্বাধীনতার ভিত্তিতে ব্যক্তির আচার-আচরণ সে স্বাধীনতাকে সমাজের সর্বত্র বিভ্রান্তি ছড়ানোর একটি উপায়ে পরিণত করবে। এ পরিস্থিতিতে সকল স্বাধীনতাই তাদের অধিকার হারাবে এবং মানব অস্তিত্বের সব অর্থই হারিয়ে যাবে। কোনো কাজ জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ঐক্যমতে নির্ধারিত লক্ষ্য ও বিধিবিধানের অনুগামী কি না তার উর সে কাজের বৈধতা নির্ভর করে। অপরদিকে সংখ্যগরিষ্ঠ জনগণের সিদ্ধান্তের বৈধতা হচ্ছে মানব অস্তিত্বের মৌলিক লক্ষ্য অর্জনের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তি ইসলামী মতবাদ অনুযায়ী পৃথিবীতে খলিফা হওয়অ। কারণ বিধিবিধানকে লঙ্ঘন করলে খিলাফতের দায়িত্ব বৈধতা হারিয়ে ফেলে। যা হোক বিধিবিধানগুলো ব্যক্তির বিশ্বাস ও চিন্তাধারার অধিকার সংরক্ষণের জন্য তৈরি না হয়ে থাকলে সেগুলো তাদের বৈধতা হারিয়ে ফেলবে। মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে মুসলমানদের আচার-আচরণ ও জনগণের জন্য আইন প্রণয়ন ব্যবস্থা ইসলাম এবং তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতিবোধের প্রতি অঙ্গীকারের কাছে বৈধতা লাভ করে। মুসলিম সমাজের আইন প্রণেতারা তাদের প্রস্তাবিত বিধিবিধানে ইসলামের লক্ষ্যসমূহ ও মূল্যবোধকে অবজ্ঞা করতে পারে না। কারণ সেসব আইনকানুন মানুষের মধ্যেকার অনন্ত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে চায় যাতে পৃথিবীতে খলিফা হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। একইভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরা ইসলামের প্রতি তাদের অঙ্গীকার ভিত্তিতে মুসলিম ব্যবস্থায় আইনের যে সংজ্ঞা দিয়েছে একজন মুসলিমের কার্যকলাপ ও আচরণ তা অবহেলা করতে পারে না।
ইসলামী ব্যবস্থার অন্যতম মৌলনীতির বাইরের জিনিসগুলোকে ওহীর সুস্পষ্ট কালামের দ্বারা বিশেষভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে অথবা যা সমাজের মূল স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে এমন বিষয় ক্ষমা ব্যতীত অবশিষ্ট সব কিছুই বৈধ (হালাল)।
এ নীতির আলোকে আমরা সৎকাজের আদেশ দান এবং অসৎ কাজে নিষেধ করা (আল আমর বিল মারুফ ওয়া আল নাহি আনিল মুনকার)- এ ইসলামী মতবাদটি বুঝতে পারি। চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা হিসাবে এ মতবাদকে উপদেশ, পরামর্শ, পথ-নির্দেশ ও নেতৃত্বের প্রতীকরূপে গণ্য করা যেতে পারে। এ মতবাদ সামাজিক আচরণরীতি হিসাবে জিহাদ, কর্মশক্তির প্রয়োগ, ত্যাগ এবং সমাজ ধ্বংস হয়ে যাওয়া এবং নতুন সমাজ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্য এবং সংস্কার সাধনের স্বপ্ন হারিয়ে ফেলার হাত থেকে রক্ষার প্রতীক।
তাওয়াক্কুল নীতি
তাওয়াক্কুল অর্থ জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর আস্থা এবং আল্লাহর দেয়া তকদীর (কাজা ও কদর) মেনে নেয়া। তাওয়াক্কুল বলতে বোঝায়, একজন বিশ্বাসীর অন্তরে আল্লাহর শক্তি, পজ্ঞা ও ইনসাফের উপর বিশ্বাস স্থাপন। সে বিশ্বাস করে যে, সকল বিষয়ের উপর আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
মুমিনের তাওয়াক্কুল এ বিশ্বাস থেকে উৎসারিত হয় যে, অদৃশ্য জগত এবং অদৃশ্য জগতের নির্ধারিত সত্য এসব কিছুই দুনিয়া ও বেহশতের মালিক আল্লাহ নিয়ন্ত্রণ করে, এ সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান শুধু তাঁরই আছে। মুসলমানের তাওয়াক্কুল সম্পর্কিত উপলব্ধি একটি স্বাভাবিক ও সূক্ষ্ম উপলব্ধি। এটি তার মনস্তাত্ত্বিক শক্তি ও সক্রিয়তার অন্যতম উৎস। এ উৎস থেকেই আসে ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতার, দৃঢ় সংকল্প, সন্তোষ ও সুখ।
(তাদের বলো) এ কাজের সব ইখতিয়ার আল্লাহর হাতে (৩: ১৫৪)।
সাবধান, সৃষ্টি তাঁরই এবং সার্বভৌমত্তও তাঁরই (৭: ৫৪)।
তোমরা সঠিক জ্ঞানের কম অংশই পেয়েছ (১৭: ৮৫)।
তাঁর জ্ঞাত বিষয়সমূহের মধ্য থেকে কোনো জিনিসই তাদের জ্ঞানসীমার আয়ত্ত্বাধীন হতে পারে না। অবশ্য কোনো বিষয়ের জ্ঞান তিনি নিজেই যদি কাউকে জানাতে চান, হে আমাদের রব তুমি তোমার রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সবকিছুই গ্রাস (২: ২৫৫) করে রেখেছো (৪০: ৭)।
আল্লাহর নির্ধারিত তকদীরে মুসলমানের বিশ্বাস এবং তার চিন্তাধারা পদ্ধতি হচ্ছে যে, পরিণামে সব কিছু কল্যাণের জন্যই হবে, কারণ একজন মুসলিম যখন সুখে থাকে তখন সে আল্লাহকে ধন্যবাদ দেয় এবং দুঃখ, কষ্ট ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সে হয় ধৈর্যশীল। একইভাবে এ জীবনে যদি তার সৌভাগ্য লাভ ঘটে, সে সন্তুষ্ট হবে এবং দুর্ভাগ্য তার উপর আপতিত হলে সে হবে ধৈর্যশীল ও আল্লাহর উপর আস্থাবান। আখেরাতের জীবনে সে তার পুরস্কার পাবে। খোদায়ী তকদীরে মুসলিমের বিশ্বাস হচ্ছে যে, একজন মুসলমানের প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হবে এ জীবনে বস্তুগতভাবে তার সব কর্মকান্ড যত সফল বা ব্যর্থ হোক না কেন। তাদের বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত সত্যই বিজয়ী হবে, সত্যের জন্যে উম্মাহর জিহাদ পরিণামে জয়যুক্ত হবে যখন সব মানুষই আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে তখন মিথ্যা ব্যর্থ হবে এবং তার অনুসারীরা সত্য ও অসত্যের সংগ্রামে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হবে।
আমরা তোমাদেরকে অবশ্যই পরীক্ষার সম্মুখীন করবো যেন আমরা তোমাদের অবস্থা যাচাই করতে পারি এবং তোমারেদ মধ্যে মুজাহিদ ও নিজস্থানে অবিচল কে তা জানতে পারি (৪৭: ৩১)।
আমরা ভালো ও মন্দ অবস্থায় ফেলে তোমাদের সবাইকে পরীক্ষা করছি। শেষ পর্যন্ত তোমাদের সবাইকে আমাদের কাছেই ফিরে আসতে হবে। (২১: ৩৫)।
আর যারা আমাদের পথে চেষ্টা-সাধনা করবে তাদের অবশ্যই আমরা আমাদের পথ দেখাব। (২৯: ৬৯)।
আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যেমন জিহাদ করা উচিত (আন্তরিকতার সাথে সুশৃঙ্খলভাবে)। (২২: ৭৮)
যে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা যদি আল্লাহর সাহায্য করো, তাহলে তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের ভিত্তি সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন। (৪৭: ৭)।
আমি তো সংশোধন করতে চাই, যতখানি আমার সাধ্যে কুলায়, আর যা কিছু আমি করতে চাই, তার সব কিছুই আল্লাহর তাওফিকের ওপর নির্ভরশীল। তাঁরই উপর আমার ভরসা এবং আমি সব ব্যাপারে তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করি। (১১: ৮৮)
আমলকারী লোকদের জন্য এটি কতই না উত্তম প্রতিদান সেসব লোকের জন্যে যারা সবর করে আর নিজেদের খোদার ওপর ভরসা করে। (২৯: ৫৮-৫৯)।
আর যা কিছু আল্লাহর নিকট আছে তা যেমন উত্তম, উৎকৃষ্ট, তেমন স্থায়ীও। আর তা সে লোকদের জন্য যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের খোদার উপর নির্ভরতা রাখে। (৪৩: ৩৬)
আর সব ব্যাপারেই তারই দিকে ফিরে যায়। অতএব, তুমি তাঁরই বন্দেগী কর এবং তাঁরই উপর ভরসা রাখো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। (১১: ১২৩)
এখানে পার্থক্য করা দরকার। তাওয়াক্কুল আর তাওয়াক্কুল (অদৃষ্টবাদী আত্মসমর্পণ) একই বিষয় নয়। খোদায়ী তকদির যা আল্লাহ ছাড়া কখনো কেউ জানতে পারে না, বুঝতে পারে না অথবা নিয়ন্ত্রণষ করতে পারে না তা বিশ্বাস করা ও মেনে নেয়া হচ্ছে একজন মুসলিমের জন্য তাওয়াক্কুল। অপরদিকে তাওয়াক্কুলের অর্থের মধ্যে রয়েছে জড়তা, অক্ষমতা এবং সাধারণ অযোগ্যতার উপাদান কেননা আল্লাহ মানবজাতির জন্য যে আইন বিধান ও আদর্শ দিয়েছেন সে অনুযায়ী চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতিই হচ্ছে তাওয়াক্কুল। তাওয়াক্কুল ধারণার মধ্যে অদৃষ্টবাদ দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছে। এটি একই সাথে আল্লাহর নির্দেশের প্রতি অবাধ্যতার এবং ফিতরাত বা মনের প্রকৃতির অবজ্ঞা করা বুঝায়। জানতে চেষ্টা করা, সঠিক উপায়টি ব্যবহার করা এবং প্রাকৃতিক আইন অনুসারণে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয় তা আল্লাহর উপর আস্থা অথবা তাওয়াক্কুল থেকে আসে না। বরং সঠিক উপায় খুঁজে বের করে ব্যবহার করাই হচ্ছে এ জীবনে মানুষের দায়িত্বের সারকথা। কিন্তু তাওয়াক্কুল এ ধরনের বিশ্বাসের বিচ্যুতি। এ কারণেই যখন একজন বেদুইন তাওয়াকুলকে তাওয়াক্কুলের সাথে গুলিয়ে ফেলে রাসূল (সা)-এর কাছে এ বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তখন প্রিয়নবী (সা) বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বললেন, “যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করো, তারপর আল্লাহর উপর তুমি নির্ভর করো।”
একই নীতি অনুসরণ করে ওমর ইবনে আল-খাত্তাব (রা) তাদের পশ্নের জবাব দিয়েছিলেন যখন তারা একটি প্লেগ আক্রান্ত দেশে প্রবেশে ওমর (রা)-এর অস্বীকৃতি জানানোকে আল্লাহর তকদির থেকে পলায়ন বলে ধারণা করেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল যে, সঠিক উপায় অন্বেষণে অথবা আল্লাহ বিশ্বের উপর যে প্রাকৃতিক আইন চাপিয়ে দিয়েছেন সে অনুযায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হওয়াই হচ্ছে সত্যিকার তাওয়াক্কুল এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা। ওমর (রা) সুস্পষ্টভাবে জানালেন, “আমি আল্লাহর এক তকদির থেকে অপর এক তকদিরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছি।”
কেউ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়, সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তকদির এবং কেউ যডিদ সে সংক্রামক রোগ থেকে নিজেকে বাঁচাতেক চায় সেটিও হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি তবদির। সব কিছুই আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে এবং প্রাকৃতিক আইনের সাথে সংগতি রেখে যথোপযুক্ত উপায় ব্যবহারের প্রচেষ্টা চালানো ও আল্লাহর তকদির থেকে উদ্ভুত হয়। এটি তাকে মান্য করার একটি পথ। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এর দ্বারা কুফর বুঝায় না অথবা কোনো ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করছে না তাও বুঝায় না।
‘তাওয়াক্কুল’ ও ‘তাওয়াকুল’-এর অর্থের মধ্যে এ সুস্পষ্ট পার্থক্যের পর এবং মানুষের ফিতরাতের প্রেরণার আলোকে এবং মানুষের প্রতি পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফঅ হওয়ার, পথিবীকে পরিচালনা করার এবং তাকে পালন করার জন্য আল্লার নির্দেশশ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারে যে, ‘তাওয়াকুল একটি অস্বাভাবিক ধারণা। ইসলাম নিশ্চিতভাবেই তা শিখায় না। অপর দিকে তাওয়াক্কুলের অর্থের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অথবা প্রথম যুগের মুসলমানের ঈমানের সাথে এর কোনো মিল নেই। বাস্তবিকই এটি রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবীদের জীবনের প্রতিটি দিক, তাঁদের জিহাদ, প্রাকৃতিক আইনের সাথে সংগতি, তাঁদের কৃত কর্মকান্ড, তাঁদের পরিকল্পনা এবং তাঁদের চিন্তার পদ্ধতি এসবেরই বিরোধী।
মানব প্রকৃতির কার্যকারণ সম্বন্ধ
আমরা উপরিউক্ত বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারলে মুসলিম জীবনে ও চিন্তাধারার একটি মৌলিক ধারণাও বুঝতে সক্ষম হবো। ফিতরাত এবং আকিদা একথা বুঝিয়ে দেয় যে, আল্লাহ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, একে আইন বিধান ও মানদন্ডের অধীন করেছেন, তারপর এ বিশ্বকে মানুষের কাছে সোপর্দ করেছেন, একে লালন করা, এর উপর প্রভুত্ব করা এবং একে সভ্য করা ও সংস্কার করার জন্য। মানুষকে তার দায়িত্ব পালনে এবং প্রাকৃতিক আইনের সাথে মিল রেখে সঠিক মাধ্যম বা উপায় ব্যবহার করে তার ইচ্ছ ব্যক্ত করার সামর্থ্য দিয়েছেন। সুতরাং সঠিক উপায় অবলম্বন না করা এবং সেগুলোকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ না করা পর্যন্ত মুসলিম মন ও ফিতরাতের পক্ষে তাদের দায়িত্ব পালন এবং গোটা সৃষ্টিকে পরিচালনা করা এবং অধীনে নিয়ে আসার জন্যে আর কোনো উপায় বা পথ নেই।
যিনি জমিন ও আসমানসমূহের বাদশাহীর মালিক, যিনি কাকেও পুত্র বানিয়ে নেননি, যার সাথে বাদশাহীতে কেউ শরিক নেই, যিনি সব জিনিসই পয়দা করেছেন এবং পরে তার একটি নির্দিষ্ট তকদির নির্দিষ্ট করেছেন। (২৫: ২)।
(হে নবী) তোমার মহান শ্রেষ্ঠ খোদার নামের তসবিহ করো যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং ভারসাম্য স্থাপন করেছন, যিনি তকদির নির্দিষ্ট করেছেন, পরে পথ দেখিয়েছেন। (৮৭: ১৩)।
এমনই আল্লাহর কুদরতের বিস্ময়কর কীর্তি, যিনি প্রতিটি জিনিসকেই সুষ্ঠুভাবে মজবুত করে বানিয়েছেন। তোমরা কি করছ তা তিনি ভালোভাবেই জানেন। (২৭: ৮৮)
প্রতিষ্ঠিত আকাশমন্ডল ও জমিন যথাযথ সৃষ্টি করেছেন, এ জন্যে যে প্রতিটি প্রাণীকে যেন তার উপার্জনের প্রতিফল দেয়া যায়। তব এ কথা ঠিক যে, তাদের উপর কোনো যুলুম করা যাবে না। (৪৫: ২২)
তোমাদের আগেও বহুযুগ অতীত হয়েছে। পৃথিবীতে ঘুরে ফিরে দেখ আল্লাহর (আদেশ ও বিধান) অমান্যকারীদের পরিণত কি হয়েছে। (৩: ১৩৭)
আমরা তাকে জমিনে আধিপত্য দান করেছিলাম এবং তাকে সব রকমের উপায় উপাদানও দান করেছিলাম। (১৮: ৮৪)
তোমরা আল্লাহর নিয়মনীতিতে কোনো পরিবর্তন পাবে না। আর আল্লাহর বিধানকে তার জন্য নির্দিষ্ট পথ থেকে কোনো শক্তি ফিরাতে পারে না। (৩৫: ৪৩)
এ যে কোনা বোঝা বহনকারী অন্য কোনো লোকের বোঝা বহন করবে না এবং এ যে, মানুষের জন্যে কিছুই নেই, কিন্তু শুধুই তাই, যার জন্যে সে চেষ্টা করেছে এবং এ যে তার চেষ্টা-প্রচেষ্টা খুব শিগগিরই দেখা হবে এবং তার পূর্ণ প্রতিফল তাকে দেয়া হবে। (৫৩ : ৩৮-৪১)
তিনি জমিন ও আকাশমন্ডলের সক জিনিসকেই তোমাদের জন্য অধীন ও নিয়ন্ত্রিত করেছেন। সব কিছুই তাঁর নিজের নিকজ থেকে, এতে বড়ই নিদর্শন রয়েছে সব লোকের জন্য যারা চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করতে অভ্যস্ত। (৪৫: ১৩)
….. যারা সৎকর্ম করে তাদেরকে দেন উত্তম পুরস্কার। (৫৩: ৩১)
তিনিই মৃত্যু ও জীবন উদ্ভাবন করেছেন, যেন তোমাদের পরখ করে দেখতে পারেন যে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? (৬৭: ২)
জমিনে তোমাদেরকে খলিফা বানাবেন, তারপর তোমরা কি রকম কাজ কর তা তিনি দেখবেন। (৭ : ১২৯)
আমরা এ আসমান ও জমিন এবং এদের মধ্যে আর যা কিচু আছে খেলার ছলে সৃষ্টি করিনি। (২১: ১৬)
জীবনের অর্থের এ উপলব্ধি মানুষের সামনে এ কথা সুস্পষ্ট করে দেয় , আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টির জন্য যে প্রকৃতির আইন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তা মানুষ যেভাবে ব্যবহার করে তার উপর তাদের এ জীবনের দায়িত্ব নির্ভর করে। মানুষ কী উপায়ে এসব আইনকে ব্যবহার করে তাকে কেন্দ্র করেই মানুষের ভূমিকা আবর্তিত হয়। তারপ বাস্তব উদ্দেশ্যের জন্যে উদ্ভাবনী পন্থায় সৃষ্টিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ উন্নত হয় এবং সমৃদ্ধ হয়।
মানুষ কার্যকারণ সম্বন্ধ বা হেতুবাদের নীতিকে যথাযথভাবে উপলব্ধি না করা পর্যন্ত তাদের কাজের জন্য কীভাবে দায়ী তা কখনো বুঝতে পারবে না। যখন তাদের মন নতুন কিছু আর সৃষ্টি করতে পারে না তখন তাদের কর্মকান্ড হবে প্রায় মৃত এবং ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যকষ করা এবং উপলব্ধি করার ক্ষমতা হ্রাস পাবে। এ থেকে রাসূল (সা)-এর পদ্ধতিবিজ্ঞান, জিহাদ ইজতিহাদ, সংগঠন, চিন্তা এবং প্রাকৃতিক আইনের জন্যে শ্রদ্ধার সাফল্যের কারণ বুঝতে পারা যায়।
প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জর বিরুদ্ধে মুসলমানদের শক্তি, সামর্থ্য, সক্ষমতা এবং সৃজনশীলতার ভিত্তি আমরা খুঁজে পাই বিশ্বাসে এবং প্রাকৃতিক আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সঠিক উপায় ও পন্থা আবিষ্কার ও ব্যবহারের গভীর প্রত্যয়ে। যখন মুসলমানা শক্তি, সক্ষমতা ও সৃজনশীলতার রীতিনীতি প্রয়োগ করে একমাত্র তখনই তারা সত্যিকারের বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুত সাহায্য, দুর্দশায় ত্রাণ এবং সাফল্য লাভের উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
প্রাথমিক যুগের মুসলিম পজন্ম এসব উপলব্ধি করেছিল এবং এর ফলে তারা সফল হয়েছিল। আজকের যুগের মুসলমানদের যদি সাফল্য ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কোনো ধারণা থাকে, তারা তা করবে তখনই যদি তারা তাদের রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক, সামাজিক, প্রযক্তিগত লক্ষ্য বা অন্য কিছু হাসিলের জন্য সঠিক উপায় অন্বেষণ করে।
মুসলমানেরা তাদের ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে সন্তুষ্টিচিত্তে বসবাস করে যদি পরিতৃপ্ত থাকে তাহলে আল্লাহ তাদের জন্য যা কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা তিনি পূরণ করবেন তা বাস্তব সম্মতভাবে আশা করতে পারে না। তারা যদি শুধু ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার বাইরে ভিন্ন কিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা না করে তা অব্যাহতভাবে পশ্চাৎপদতায় নিমজ্জিত থাকবে। খাঁটি মুসলিমের জন্যে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের ফিতরাতের চাহিদাকে উপলব্ধি না করে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের আদর্শ থেকে পথ নির্দেশনা না দেয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তারা বিশ্বের সাথে দায়িত্বশীল আচরণ করার জন্যে আল্লাহর নির্ধারিত পদ্ধতি বিজ্ঞান গ্রহণ না করে, তারা ভিন্ন কোনো উপায়ে সত্যিকার অর্থে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং আল্লাহ অপেক্ষা সত্যবাদী আর কে হতে পারে। (৮: ১২২)
ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞান : উপায় ও প্রয়োগ
ইসলামী চিন্তাধারার পদ্ধতিবিজ্ঞান যেসব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় তা নিয়ে এখন আলোচনা করা যাক। অনগ্রসরতার প্রভাব, বুদ্ধিজীব নেতৃত্বের বিচ্ছিন্নতা, পশ্চাত্য অভিজ্ঞতার নিরিখে ধর্মীয় ধারণার উপলব্ধির কারণে যেসব ক্ষেত্রে ইসলামী চিন্তাধারা ও পদ্ধতিবিজ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করা যেত, সেসব ক্ষেত্র থেকে তাকে বিশ্বাসীদের ব্যক্তিগত ও আধ্যাত্মিক বিষয়সমূহে পুরোপুরি ঠেলে দিয়ে নির্বাসন দেয়া হয়েছে। সাদামাটাভাবে বলতে হয় এ অনন্য চিন্তাধারা ও পদ্ধতিবিজ্ঞানের পরিধি ও সুযোগ বৃহত্তর ও সম্ভাবনাশীল।
এটি সুস্টষ্ট যে, ইসলাম বিশ্বাসীদের সব প্রচেষ্টাকে খলিফা হিসাবে তাদের ভূকিা পালনের দিকে পরিচালনা করে। মুসলমানদের উপলব্ধি করতে হবে যে, দৃশ্যমান জগতের সব কিছু তাদের বৈধ কর্মক্ষেত্র। সেখানে তারা তাদের শক্তি ও সামর্থ্য, তারেদ যা প্রয়োজন তারা ব্যবহার করতে পারে এবং তারা অদৃশ্য জগত থেকে অবতীর্ণ ওহী ও আল্লাহর জ্ঞানের ব্যাখ্যা অনুযায়ী মানুষের অীস্তত্বের উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত পথ নির্দেশ, নীতিমালা, মূল্যবোধ এবং প্রাকৃতিক আইনের ভিত্তিতেই শক্তি ও সামর্থ্য কাজে লাগায়। সুতরাং এ বোধ থেকে আমরা বলতে পারে ইসলামী চিন্তার পদ্ধতিবিজ্ঞান একটি সর্বাত্মক পদ্ধতিবিজ্ঞান এবং তা সংস্কার ও উন্নয়নের সকল পর্যায়ে মুসলমানদের কর্মতৎপরতাকে পরিচালনা করে।
যেহেতু ইসলামী চিন্তাধারার পদ্ধতি প্রয়োগের পরিধি ব্যাপক এবং এটি তার বৈশিষ্ট্য, সে কারণ উপায়ের (means) ব্যাপকতাও আর অনন্য বৈশিষ্ট্য। জীবনের সকল দিক ও বিভাগই মুসলমানদের জন্য প্রয়োগ ক্ষেত্র। এতে তারা উপলব্ধি করতে, জ্ঞান অন্বেষণ করতে এবং তাদের লক্ষ্যের দিকে সব কিছু দিয়ে এবং সব উপায় দিয়ে জীবনের বিভিন্ন বিষয় পরিচালনা করতে বাধ্য হয়। জ্ঞান অর্জন ও উপলব্ধিবোধের কোনো সুষ্ঠু মাধ্যমকে মুসলমানরা অবহেলা করে না, সেগুলো বস্তুগত শব্দার্থ বিদ্যা, শিল্পজনোচিত, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষামূলক যুক্তি সংক্রান্ত, গুণীয় মাত্রিক, তাত্তিবক অথবা বিশ্লেষণাত্বক যাই হোক না কেন। কিন্তু যে উপায় বা মাধ্যম মানুষের জীবন, উদ্দেশ্য প্রকৃতি বিরোধী, যে উপায় বা মাধ্যম মানুষকে অর্থহীন অভতা অসৎ বৃত্তি বা পেশার দিকে পরিচালিত করে, তাকে বিপথগামী করে তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। মুসলিম মন মানসকে অবশ্যই নিজেকে ছোটখাট বিতর্কে জাড়িয়ে পড়া থেকে সরিয়ে নিতে হবে এবং লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সৃজনশীল উপায়ে বিভিন্ন উপায় বা পন্থা গ্রহণের জন্যে নিজেদের নিয়োজিত কতে হবে। ইসলামী চিন্তাধারার পদ্ধতিবিজ্ঞান প্রকৃতি ও পরিধির দিক থেকে ব্যাপক ও সর্বাত্মক, তা উপলব্ধির পর আমরা বুঝতে পারি যে, ইসলামী জ্ঞান, চিন্তা ও সংস্কৃতির কাঠামো অবশ্যই ব্যক্তি, সমাজ, উম্মাহর পর্যায়ে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার ভিত্তিতে এবং মানব সভ্যতার ভিত্তিতে গঠিত হতে হবে। সুতরাং যে জ্ঞান আমরা অন্বেষণ করবো বা কাজে লাগাবো তা হবে নীতি, লক্ষ্য ও কাঠামোর দিক থেকে সুষ্ঠু ও নিখুঁত। এসব বৈশিষ্ট্যহীন জ্ঞান ইসলামী শিক্ষা ও নীতির আলোকে বিচার করা হলে বাজে বলে পরিগণিত হবে। মুসলমানদের জ্ঞান, চিন্তাধারা অথবা বিজ্ঞান মুসলিম মন, মানসকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপলব্ধি ও তৎপরতার উপায় বা মাধ্যম উপহার দিতে না পারলে সেটা চিন্তা, জ্ঞান অথবা জীবনের জন্য খাঁটি ইসলামী কাঠামো বা পদ্ধিতিবিজ্ঞান নয়। পরিধি ও প্রয়োগের দিক থেকে একটি ব্যাপক পদ্ধতিবিজ্ঞান ছাড়া মুসলমানরা কখনো তাদের উপর অর্পিত আস্থা পূরণ করতে পারবে না, বাণী প্রচার করতে পারবে না অথবা আল্লাহর খলিফা হিসেবে নিজেদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করত পারবে না।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবতার কল্যাণেল জন্যে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে তোমরা মানুষকে ভালো কাজের নির্দেশ দেবে, খারাপ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস করবে (৩ : ১১০)।
প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলেও এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপনে তাদের অভিজ্ঞতা কম থাকলেও তারা ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞানের চর্চা করেছিল সফলভাবে। ইসলামী পদ্ধতিবিজ্ঞানের এ সাফল্যের আলোকে বিভিন্ন নীতি কীভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে তা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হলে সে পদধতি এবং নব প্রবর্তিত ইজতিহাদ অধ্যয়ন করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। প্রাথমিক যুগের মুসলমানরা এবং তাদের ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা তারা তাদের অনুপ্রেরণার উৎস যেখান থেকে পদ্ধতিবিজ্ঞনের নীতিগুলো পেয়েছিল সে ওহীর বাণীগুলোকে আমাদের জন্য সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এগুলো পালাক্রমে, ব্যাপক কেতাবী অনুসন্ধান ও অধ্যয়নের বিষয়বস্তুতে পরিণত হলো। যাই হোক, পণ্ডিত ও চিন্তাবিদগণের সঙ্গে উম্মাহর রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিকূল সম্পর্ক বিরাজমান থাকার কারণে জীবনের বাস্তবক্ষেত্রের প্রতি অনুরূপ গুরুত্ব সহাকারে মনোযোগ দেয়া হয়নি। এভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো এবং সাধারণভাবে সমাজের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জন্য ইজতিহাদ খুব কমই প্রয়োগ করা হয়। অবস্থাতর পরিপ্রেক্ষিতে এ শাস্ত্রগুলো প্রণয়ন করা হয়নি। অপর কথায় জীবন ও সমাজের বাস্তবতা উপলব্ধি করে সেগুলো সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কাঙ্ক্ষিত সমন্বিত পদ্ধতিবিজ্ঞান কখনো গড়ে তোলা হয়নি। বাস্তবে, প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের বিভিন্ন সূত্র ও কৌশল নিয়ন্ত্রণকারী পদ্ধতিবিজ্ঞানের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নীতিমালা তৈরি করা ছাড়া ইসলামী চিন্তাধারা খুব বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্ধতিবিজ্ঞানের দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎস যা আগে আলোচিত হয়েছে, দ্বিতীয় পর্যায়েল উৎসের মধ্যে ছিল মাসআলা, দাফ আল দারার উরফ, ইসতিহসান এবং ইসতিসাব। সুতরাং ইসলামী চিন্তাধারা ও পদ্ধতিবিজ্ঞানকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং তারপর উৎস, উপায় বা মাধ্যম এবং অধয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে।
শরিয়তের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নির্দেশনামা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করার জন্য ইসলামী চিন্তাধারাকে অবশ্যই একটি পদ্ধতিগত সমীক্ষা চালিয়ৈ যেতে হবে যাতে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনীতি, অর্থনীতি, মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞান, কলা ও প্রযুক্তি ইসলামী অধ্যয়নের জন্য ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। ইসলামী চিন্তাধারা সমাজ বিজ্ঞানে অবদান রাখার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। ইসলামী ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পঠন পাঠন ওহীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে না অথবা সামাজিক ও প্রযুক্তিগত অধ্যয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। এসব কিছুই মানব জীবন ও তার কর্মকান্ডের ভিন্ন ভিন্ন দিক বা ক্ষেত্র। এসব কিছুই এমন সব ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্ব করে যেখানে ইসলামকে কিছুটা প্রয়োগ করা যেতে পারে। সুতরাং মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে পদ্ধতিগত ও শিক্ষা ও সংক্রান্ত নীতিগুলোর বিকাশ সাধন করা যা অনুসরণ করে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের সুপ্রতিষ্ঠা করা হয়।
ইসলামের লক্ষ্য, মূল্যবোধ ও মতবাদের মৌলিক সূত্রগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হলে মুসলিম চিন্তাবিদদের সর্বপ্রথম মূল ওহী, কুরআন এবং সুন্নাহর শ্রেণী ভাগ করতে হবে। তারপর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ইতিহাসখ্যাত বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যেরও শ্রেণী বিভাগ করতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ের এ কাজে এসব সাহিত্যকে ছেঁকে ফেলতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে। এরপর স্থিরভাবে নির্ধারণ করতে হবে এর মধ্যে কোনটিতে একপেশে ভাব বা পক্ষপাতপূর্ণ আসক্তি রয়েছে। রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ অথবা কোনোটিতে মিথ (Myth), পৌরণিক কাহিনী এবং ইহুদীদের প্রভাব রয়েছে। উল্লেখ্য, উত্তরাধিকার সূত্রে সাহিত্যকর্মের পরবর্তী লেখাগুলোতে এসব পৌরণিক কাহিনী, রূপকথা ও ইহুদীদের কেচ্ছা কাহিনী চুপিসারে ঢুকে পড়েছিল। এ ধরনের শ্রেণী বিভাজন জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় করা যেতে পারে এটি করতে হবে একটি আধুনিক ইসলামী পরিপ্রেক্ষিতের নির্দেশ অনুসারে। এ শ্রেণী বিভাজন প্রয়োজনীয়, যাতে করে মুসলিম ছাত্র, গবেষক এবং বিশেষজ্ঞগণ কালামে ওহী এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকার সহজেই উপলব্ধি করতে পারে এবং সেগুলো থেকে লক্ষ্য, মূল্যবোধ ও নীতির ব্যাপক ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়। তারপর এসবের আলোকে মুসলিম বিজ্ঞজনেরা জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃজনশীলভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে।
আজকের মুসলিম বিশ্বের পরিস্থিতি যন্ত্রণা ও বিভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ, এটা সুস্টষ্ট। সমসাময়িক ইসলামী চিন্তাধারা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান তার চাহিদা ও চ্যালেঞ্জের কোনো জবাব দেয় না। অপর পক্ষে এগুলো সাধারণ মুসলমান জনগোষ্ঠীর শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায় বলে মনে হয়। এমনকি পরিস্থিতিতে জ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে অনুপম ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্যে প্রয়োজনীয় সূত্র রচনা কর বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান-বিজ্ঞাহনের সংস্কার কাজ শুরু করা ছাড়া ইসলামী চিন্তাধারার জন্যে আর কোনো বিকল্প নেই। সুন্নাহর মূল পাঠগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণীকে বিভক্ত করা প্রয়োজন। যেসব হাদিস ধরন ও সারমর্মের দিক থেকে নির্ভরযোগ্য সেগুলোর শ্রেণী ভাগ করতে হবে এবং এ কাজ এমনভাবে করতে হবে যাতে যবেষকরা বিষয় বা মূল শব্দ অনুসারে এ বিষয়ে সহজে কাজ কতে পারেন। তারপর তা হাদিসের মূল পাঠসমূহকে একটি পদ্ধতি-বিজ্ঞানের ভিত্তিতে শ্রেণীভাগ ও নিয়ন্ত্রণ করা এবং হাদিসের খবরগুলোকে সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা ছাড়াও রাসূল (সা) এবং প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের সময়কালের উপর ইতিহাসভিত্তিক সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। এ সমীক্ষা বা অধয়্যন এমনভাবে করতে হবে যা গবেষকদের সেসব হাদিস কোনো সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে নাযিল হয়েছিল তা এবং প্রাথমিক যুগের মুসলমানেরা পে পরিস্থিতিতে যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছিল তা আরো ভালো উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।
শেষ কথা
আজকের দিনে পাশ্চাত্যের পণ্ডিত সমাজ এবং তাদের অনুসারী ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিমরা ইসলামকে অন্যসব ধর্মের মতো একই পাল্লায় ওজন করে। তাদের চিন্তাধারা অনুযায়ী অন্যসব ধর্মের মতো ইসলামকেও আধুনিক সমাজ ও তাকে নিয়ন্ত্রণকারী নীতিমালার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখার অনুমতি দেয়া যায় না। তাদের বিবেচনায় ইসলাম এবং সাধালনবাবে ধর্ম অতীতকালের বিভিন্ন আদর্শ ও ধর্ম ধারণার চেয়ে বড়জোর একটু বেশি কিছু হবে অথবা এগুলো পৌরণিক কল্পকাহিনী, বর্তমান যুগে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের মতে এ ধরনের চিন্তাধারা জাগুঘরের বিষয় অথবা বেশির পক্ষে এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার জগতে আবদ্ধ থাকা উচিত। এসব কিছুর পরও এ ধরনের চিন্তাধারা ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মের ব্যাপারে যথার্থ হয় কারণ এসব ধর্মের মৌলিক শিক্ষা ও বিশ্বাসকে বিকৃত করা হয়েছে এবং প্রায়ই এসব ধর্মের শিক্ষা ও আদর্শের স্থরাভিষিক্ত হয়েছে কিছু অবিশ্বাস্য বিষয় বা বিষয়বস্তু। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে এটা মোটেই সত্য নয়। আমাদের জন্য এটা উপলব্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলামের অনুসারীরা আজকের দিনে যে পদ্ধতিতে ইসলামকে অন্যদের সামনে তুলে ধরে তা তার জন্য যথেষ্ট ও পর্যাপ্ত নয়। এ কাজ করা যেতে পারে একমাত্র উপযুক্ত গভীল পাণ্ডিত্যের মাধ্যমে। এটি এমন পাণ্ডিত্য যা চিন্তাধারাকে কাজে এবং জীবন্ত বাস্তবতায় রূপান্তরিত করে এবং যা সমসাময়িক সমাজের সব মহলের স্বীকৃতি এবং সম্মান দাবি করে।
হে ঈমানদার লোকেরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও যখন রাসূল তোমাদেরকে ডাকেন সেই জিনিসের দিকে যা তোমাদেরকে জীবন দান করবে (২: ২৪)।
আমরা তোমার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি যা প্রত্যেকটি বিষয়েই সুস্পষ্ট বর্ণনা দানকারী এবং হেদায়ত, রহমত ও সুসংবাদ সেসব লোকের জন্য যারা মস্তক অবনত করেছে (১৬: ৮৯)।
খানিকটা ভেবেই দেখ না, যে লোক উল্টা দিকে মখ করে চলছে যে অধিক সত্যপথ প্রাপ্ত না কি যে লোক মাথা উঁচু করে সোজাসুজি এক সমতল সড়কের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে (৬৭: ২২)?
তিনিই নিজের রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য দীন সহকারে পাঠিয়েছেন, যেন তাকে অন্য সব দীনের উপর কিজয়ী করে দেয় (৬১: ৯)।
আর সে ব্যক্তির কথার চেয়ে ভালো কথা আর কার হবে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, ভালো কাজ করলো এবং বললো ‘আমি মুসলমান’ (৪১ : ৩৩)।