অধ্যায় পাঁচ
সমাজ বিজ্ঞানের সূত্রসমূহ
জ্ঞান বিজ্ঞান সম্পর্কে ইসলামী প্রেক্ষিতের কোন সাধারণ পদ্ধতিবিজ্ঞান ও সূত্র থাকলে বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং বিষয়ের উপযোগী সুনির্দিষ্ট সূত্র ও পদ্ধতিবিজ্ঞান রয়েছে। সমসাময়িক যুগের মুসলিম পন্ডিতদের দায়িত্ব হচ্ছে এসব সূত্রগুলো আসলে কী তা নির্ধারণ করা, যাতে প্রয়োজনে কোন বিভ্রান্তি ছাড়া এগুলো ব্যবহার করা যায়।
আমি মনে করি এসব সূত্র নতুন ইসলামী সমাজ বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। ইসলামী সমাজবিজ্ঞানকে প্রতি সূত্র গুচ্ছের পিছনের কারণগুলোর ব্যাখ্যা ও সুস্পষ্ট করণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং সেগুলো সত্যিকার ইসলমী পরিপ্রেক্ষিতের কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করে, উম্মাহর প্রয়োজনের প্রতি কতটুকু সাড়া দেয় এবং বাস্তবে কি ফল হয় সে দিকেও ইসলামী সমাজ বিজ্ঞানকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
অধ্যয়নের কতগুলো ক্ষেত্র রয়েছে, যেগুলো আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। এসব গবেষণা ক্ষেত্রগুলো কাজে লাগনোর জন্য ইসলামী পরিপ্রেক্ষিতের সার্বিক কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করে উপায়ের ধরণ ও পদ্ধতিবিজ্ঞান নির্ধারণ করতে হবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ বিকৃত ওহীর মূল পাঠ এবং সে উপায়ে এগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেগুলোকে গবেষণার সাথে যুক্ত করা হয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে, মাকাসিদ অথবা শরিয়তের উচ্চতর লক্ষ্যসমূহ, মানব প্রকৃতি ও সমাজ সম্পর্কে উপলব্ধি, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, সামাজিক নীতিসমূহ, সমাজ প্রতিষ্ঠা ও এর উন্নয়ন এবং সমাজের কল্যাণের জন্য ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়ন।
এখানে যে সব ক্ষেত্রের কথা বলা হয়েছে তার প্রতিটিকে স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন বিষয় ও শিক্ষায় বিভক্ত করা যেতে পারে। বর্তমান জ্ঞানের ইসলামিকরণের প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের বিশ্লেষণ ও এর কার্যকরণ নীতি সম্পর্কিত বিজ্ঞান (Behavioural Science) যার মধ্যে মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও নৃবিদ্যা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে, এর গুরুত্ব নির্ধারণ করতে হবে। এসব বিজ্ঞানের ইসলামিকরণের পথে এগিয়ে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ আজকের যুগের পন্ডিত ও চিন্তাবিদদের আলোচ্যসূচিতে মানব প্রকৃতি, সমাজ প্রকৃতি, মানুষের অর্থ এবং মানুষের প্রকৃতি, গঠন ও চাহিদা, মৌলিক ধারণাসমূহ অধ্যয়নের জন্য বিজ্ঞানই হচ্ছে প্রকৃত ক্ষেত্র। অধিকন্তু, এসব বিজ্ঞানই তাদের সূত্র ও তত্ত্বের মাধ্যমে অন্যান্য মানবিক বিজ্ঞান, কলা, দর্শন, ইতিহাসের উপর প্রভাব বিস্তার করে।
এতে কোন সন্দেহ নেই শিক্ষা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রশাসন, যোগাযোগ এবং এসব বিজ্ঞানের প্রতিটির দর্শন মানুষের আচার-আচরণ সম্পর্কিত বিজ্ঞানের সূত্রাবলী, এর গবেষণার ফলাফল এবং মানব প্রকৃতি ও তার আচার ব্যবহারের ধরণ বা রীতিকে কেন্দ্র করে যেসব মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে তার ভিত্তিতে রচিত। এরপর এসব সূত্রের বিকল্প রূপে কোন ইসলামী সূত্র তৈরি করা না হলে বিভিন্ন বিজ্ঞান ও তার শাখা-প্রশাখার বাস্তব ইসলামিকরণ সম্ভব হবে না।
জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইসলামিকরণের সব প্রচেষ্টা একটি মাত্র পূর্বশর্তের ওপর নির্ভরশীল। তা হলো, মানবীয় সম্পর্কের ফিতরাত ও গতি বিজ্ঞান সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি। যেহেতু এধরণের উপলব্ধি একমাত্র আচার-আচরণ সংক্রান্ত বিজ্ঞান বা এর মাধ্যমেই পাওয়া যেতে পারে, সেহেতু আচার-আচরণ সম্পর্তি বিজ্ঞানের ইসলামিকরণ যুক্তিযুক্তভাবে সমাজ বিজ্ঞানের অপরাপর শাখার ইসলামিকরণের পথে প্রথম পদক্ষেপ হবে। অনুরূপভাবে শিক্ষা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির মত বিষয়ে ইসলামিকরণ অগ্রাধিকার ভিত্তিক কাজ বলে গণ্য হলে এর ইসলামিকরণ ওসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের পথে স্পষ্টভাবে একধাপ অগ্রগতি বলে ধরে নেয়া যাবে। এ উদ্যোগ যাতে সাফল্যমন্ডিত হয় সে উদ্দেশ্যে প্রথম গ্রাজুয়েট ও পোস্টগ্রাজুয়েট কর্মসূচি হাতে নিতে হবে, গবেষণা কেন্দ্র এবং এসব বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য বিভিন্ন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে পন্ডিতবর্গ ও চিন্তাবিদরা একসাথে এসব বিষয়ে সুষ্ঠু ইসলামী পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি করতে পারেনা।
ইসলামীকরণ ও শিক্ষাবিজ্ঞান
মুলিমরা নিজেদের সমস্যাবলী সমাধানে শ্রান্ত-ক্লান্ত হওয়ার পর নিজেদের দুর্বলতা ও পশ্চাত্পদতা দূরীকরণের কাজে নিজেদের নিয়োজিতকরনে ব্যর্থতার পর এবং প্রকৃতিবিজ্ঞান, সামাজিকবিজ্ঞান, আইনবিজ্ঞান এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রভাব বিস্তারের ফলে আশা হারানোর পর শিক্ষাবিজ্ঞান, প্রশাসনবিজ্ঞান ও অর্থনীতিবিজ্ঞানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে। সবশেষে তারা প্রচার মাধ্যম ও গনসংযোগ মাধ্যমের দিকেও ফিরে এসেছে।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিয়ে নিজেদের পশ্চিমাকরণ বা আধুনিকায়নে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার তিক্ততার মাঝে উম্মাহর অভ্যন্তরের জনগনের ইসলামের দিকে ফিরে আসার জন্য এর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের মনোযোগ নিবদ্ধ হয় ইসলামী আসালা মতবাদ (সনাতন ইসলামী নীতির নতুন রূপ প্রয়োগ) এবং উম্মাহর জীবন ও সমাজপদ্ধতিতে ইসলামী রীতিনীতি গ্রহণের প্রতি। আশা ছিল, এর ফলে তারা তাদের সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে এবং তারা তাদের গঠনমূলক জীবনীশক্তি ও সামর্থ পুনরুদ্ধার করতে পারবে। অর্থনীতি ও যোগাযোগের ন্যায় কয়েকটি প্রধান প্রাযোগিক সমাজবিজ্ঞানের বিষয় ইসলামিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাদান, বিভাগ ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ মনোভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়।
এ সব প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য নি:সন্দেহে সুযুক্তিপূর্ণ। এখানে এটা লক্ষ্য করা প্রয়োজন, এ দুটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র অর্থনীতি ও যোগাযোগ সামর্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং যদিও এ দুটি ক্ষেত্রে ইসলামিকরণ অত্যাবশ্যক ছিল কিন্তু বাস্তব ব্যাপার হলো যে, মুসলমানদের শিক্ষাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিসমূহ ইসলামী রঙে রঙিন না হলে এসব ক্ষেত্রে ইসলামীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ মুসলিম সমাজের জন্য কোন মুল্যবান বিষয় হবে না। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসহ মুসলিম সমাজকে সুশৃঙ্খল করা না গেলে িএ ধরণের পরিবর্তন খুব কমই কাজে লাগবে। এ কাজে মুসলিম পন্ডিতদের তাদের সংস্কারের শক্তিকে সর্বপ্রথম শিক্ষা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রতি নিয়োজিত করা প্রয়োজন। এ মনোযোগ দেয়ার বিষয়টি বড়জোর সেমিনার, সম্মেলন অনষ্ঠান, পাঠক্রম উন্নয়ন, অধ্যয়ন ও গবেষণা কেন্দ্র এবং একাডেমিক বিভাগ খোলা পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে।
এ পর্যায়ে এটি লক্ষ্য করা প্রয়োজন যে, সাম্প্রতিক কালে ইসলামী ব্যক্তিত্বের যে দিকটি স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হয় তা হলো সে যা দাবি করে এবং বাস্তবে সে যা করে বা তার যা করার ক্ষমতা রয়েছে তার মধ্যে অসঙ্গতি। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের কালজয়ী বাণীর বাহব হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ, এটি বাস্তব সত্য হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম উম্মাহ ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করেনি এমনকি তার দৈনন্দিন জীবনে, তার প্রতিষ্ঠানগুলোতে অথবা তার বাস্তব জীবনাচারে ইসলাম প্রতিফলিত হয়নি। সম্ভবত কোনো পৌরাণিক কাহিনীর ন্যায় সঙ্গীতের উপজীব্য হয়ে থাকা ছাড়া উম্মাহর জীবনে ইসলামের উপস্থিতি নাই বললেই চলে। এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে যেখানে মুল্যবোধ, চরিত্র ও ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রকাশ ঘটানো যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে দেখা যায় ইসলামকে অসম্পূর্ণ ও অগোছালোভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ফলে অন্যরা ইসলামকে একটি কাঙ্ক্ষিত বিষয় হিসেবে অথবা নিজেদের জন্য জীবন ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনার যোগ্য আদর্শ হিসেবে যাতে দেখতে পারে সে উদ্দেশ্যে তাদের অনুপ্রাণিত করার শক্তি মুসলমানরা হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমান শতাব্দীতে ইসলামী শিক্ষা বিষয়ক চিন্তাধারা এবং এ সম্পর্কে ভাষা জ্ঞানের সঙ্গে যদি কেও পরিচিত থাকে তাহলে তিনি সহজেই বুঝতে পারবেন যে, বিষয়টির দিক থেকে একাডেমিক দিক থেকে গভীর অধ্যয়ন ছাড়া সমস্যাসমূহের কোন সমাধান করা যাবে না। এলোমেলোর পযবেক্ষণ যতই অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হোক না কেন, তার দ্বারা কখনো কোন কিছু অর্জন করা যাবে না। ইসলামী শিক্ষার মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইসলামী চিন্তবিদদের অসংখ্য মতামত ও মন্তব্য থাকা সত্ত্বেও আচার-আচরণ সম্পর্কিত বিজ্ঞানে একটি সমন্বিত একাডেমিক উদ্যোগের অনুপস্থিতি লক্ষ্যণীয় এবং পালাক্রমে মানবজাতি তার প্রকৃতি এবং যে উপায়ে সে গড়ে উঠেছে সে সস্পর্কে অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
যে পদ্ধতিতে ইসলামী মূল্যবোধ, নীতি ও ইসলামী আদর্শের মূলনীতিসমূহ ছাত্রদের মনে সঞ্চারিত করা হয় তা তাদের মানসিকতা ও মানসিক বিকাশের স্তর উপযোগী নয়। বাস্তব কথা এই যে, কুরআন ও নবী (সা) পৌত্তলিক আরব ও কুরাইশদের সম্বোধন করার জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করতেন তাই মুসলমানদের শিক্ষা পদ্ধতিকে ও মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবান্বিত করেছে। এভাবে আজকের দিনেও মুসলিম শিক্ষকরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করেন, অবশ্য তারা যাদের জন্যে এটি করেছেন তাদের অবস্থা সম্পর্কে তারা মোটেই চিন্তা করেন না। এ কারণে মুসলিমগণ কঠোরতম পদ্ধতি প্রয়োগ করে শিক্ষাদান ও সন্তানদের লালন পালন করে থাকেন। তাদের মনে করা হয় আরবগোত্রের পরিণত বয়সের লোকদের মতো, যাদের ঔদ্ধত্যের পরিণাম এবং সত্যকে অব্যাহতভাবে প্রত্যাখ্যানের ফলাফল সম্পর্কে শিক্ষিত কারতে রাসূল (সা) চেষ্টা করেছিলেন।
যখন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ঈমানের বিষয় গুলোরমত বিষয় শিখানো হয়, তখন যুক্তিগ্রাহ্যভাবেই তা তাদের সামনে পেশ করা হয়। কিন্তু শিশুদের সামনে বিষয়গুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা উচিত যা তাদের উত্সাহিত করে ও তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক হয়। এ শিক্ষা সারাজীবন তাদের সাথী হয়। এ কারণে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে জাহিলিয়ার যুগে যারা শ্রেষ্ঠ ছিলো ইসলামের যুগে তারা শ্রেষ্ঠ হবে যদ্দিন পযন্ত ইসলাম সম্পর্কে তোমরা তোমাদের জ্ঞান বাড়াতে থাকবে”। অন্য কথায় শৈশবে মজবুত ও সুন্দর চরিত্র গঠন করবে, বয়:প্রাপ্ত হলে তারা এ চরিত্র বজায় রাখতে পারবে। তারপর পূর্ণ বয়স্ক হবার পর তাদের জ্ঞান ও উপলব্ধি এবং ঈমান তাদের মহান ও সঠিক লক্ষ্য অর্জন তাদের শক্তি ও সামর্থ্যকে নিযোজিত করতে সাহায্য করবে। একটি শিশুর শিক্ষামূলক আলোচনা তার মৌলিক চরিত্র গঠনের জন্য একটি প্রক্রিয়া। বয়:প্রাপ্ত মানুষের জন্য এ ধরণের আলোচনাকে বড়জোর সাধারণ জ্ঞানের উপদেশ ও যুক্তিপূর্ণ পরামর্শ বলা যেতে পারে। সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের চিন্ত-ভাবনা করা উচিত তা হলো, শিশুদের আবেগ ও মানসিকতা বিকাশের সময়কালে বিভিন্ন স্তরে আমরা কিভাবে কোন পদ্ধতিতে আমাদের শিশুদের শিক্ষাদান করবো। তাদের শিক্ষাদানের পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন এবং আমাদের উপলব্ধি করা উচিত যে, পরিণত বয়সের লোকদের শিক্ষাদানের জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতির সঙ্গে শিশুদের শিক্ষাদানের পার্থক্য কোথায়।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ক্রমশ: বেড়ে ওঠা শিশুদের এমনভাবে শিক্ষাদান করা উচিত যা তাদের মধ্যে মজবুত চরিত্রের বীজ বপন করবে, তাদের স্বাধীনতা ও স্ব-নির্ভরতার চেতনা বৃদ্ধি করবে এবং গর্বের সাথে ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জীবনের লক্ষ্য অর্জন তাদের উত্সাহিত করবে। এ পথে তাদের চরিত্রে সে সবগুণ সৃষ্টি হবে যা মানবজাতির জন্য উম্মাহর মিশনকে সফল করে তুলতে সহায়ক হবে।
এটিও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে, তাদের কর্কশভাবে এবং শাসনের সুরে শিক্ষাদান করা উচিত নয়। এতে তাদের চরিত্র উপর্যুক্ত গুণাবলী সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে এবং আল্লাহর সঙ্গে তাদের সম্পর্কে ছিন্ন হবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্য কথায়, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষার মাধ্যমে যদি শিশুদের মনে ধর্মের জন্য ভালোবাসা বৃদ্ধি করতে হয়, ধর্ম নিয়ে যদি তাদের গর্ব করতে হয় এবং এ ক্ষেত্রে যদি কোন অবদান রাখার আকাঙ্ক্ষা হয় তাহলে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা দান করতে হবে। শৈশবে যে ব্যক্তি এ ধরণের ভালোবাসা ও গর্বের অধিকারী হয়, সে ধৈর্য, প্রেরণা এবং ত্যাগের শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে বড় হয়ে ওঠে। অপরদিকে যে ধর্মকে ভয় করে এবং তার শিক্ষা সম্পর্কে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বেড়ে ওঠে তার মধ্যে আবেগ ও মনস্তত্ত্বের দিক থেকে ধর্মীয় দিক শিক্ষককে প্রতিহত করার মনোভাব সৃষ্টি হয়। পূর্ণ পরিণত বয়সেও এটা তার মধ্যে থেকে যায়। এ ধরণের মানুষ ধর্মের বিধান পালন করার বাইরে আর কোন কর্তব্য পালন করতে শেখে না। এভাবে কুরেমি, ঢিলেমি আস্থা স্থাপনের অযোগ্যতা এবং অবসাদগ্রস্ত, দুর্বল দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকাংশ মুসলমানের মধ্যে ঠিক এ ধরনের চরিত্রই সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের ধর্ম যখন আমাদের বিবেচনায় আসে, তখন আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, আল্লাহর কাছে মুসলমানদের একটি বিশেষ স্থান আছে এবং আমরা এটাও জানি যে, যাই ঘটুক না কেন, মুসলমানরা পরিণামে জান্নাতের পুরস্কারে ভূষিত হবে। নবী (সা) বলেছেন, যে কেহ ঘোষণা করে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নাই, সে বেহেশতে প্রবেশ করবে, যদিও সে ব্যভিচার করে বা চুরি করে।
মুসলিম শিশুরা বয়:প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের কাজের জন্য দায়ী নয়। সুতরাং তাদের উন্নতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে কোন প্রচেষ্টা চালানোর প্রয়োজন নেই অথবা এমন কোন দায়িত্ব তাদের কাঁধে চাপানো উচিত নয় যা বহন করতে তারা সক্ষম নয়। এসব কিছুর মাঝে রাসূল (সা) এর দৃষ্টিন্ত আমাদের মনে রাখা দরকার। শিশুদের সাথে প্রিয়নবী (সা) এর ব্যবহার ছিল সবরকম ভালবাসায় পরিপূর্ণ এবং উত্সাহব্যঞ্জক। উদাহরণ স্বরূপ, চাচাত ভাই ইবনে আব্বাসের প্রতি তার মায়া মমতা ছিল সুবিদিত। হাদিস সাহিত্যে এমন সব ঘটনা রয়েছে যাতে দেখা যায় বিশ্বনবী (সা) তাঁর দৌহিত্রদের বাহুতে ধারণ করে জুমার খুতবা দিচ্ছেন অথবা মসজিদে ইমাম হিসেবে তিনি যখন সিজদায় যেতেন তখন তাঁর পিঠের ওপর উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা যেত, আনাস ইনবে মালিক (যিনি তখন ছোট ছিলেন) এর প্রতি তাঁর দয়া এবং সে বেদুইনের প্রতি তার বিরক্তির কথা, যখন নবী (সা) এর কাছে সে স্বীকার করলো যে, সে কখনো তার ছোট ছেলেমেয়েদের চুমো খায়নি, এসব কিছু আমরা হাদিস দেখতে পাই।
এটি নিশ্চিত যে, সঠিক সময়ে েএবং সঠিক পদ্ধতিতে একটি দাবি মুসলিম যুব সমাজের কাছে পৌছানো হলে তা তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আবু বকর, উমর, খলিফা ইবনে ওলিদ, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাছ, আবু ওবায়দা, আমির ইবন আল জাররাহ এবং তাদের মত আরো অনেক পূর্ণবয়স্ক সাহাবা ইসলাম গ্রহনের পর তাদের বেলায় এ রকমই ঘটেছিল। সুতরাং ইসলামী শিক্ষার সঠিক সূচনা হলো ভত্সনা বা ভীতিপ্রদর্শন নয় বরং যত্ন এবং ভালোবাসা। আল্লাহর ভালাবাসার শিক্ষা দিয়ে এ শিক্ষা শুরু হবে। এরপর শিক্ষার্থীকে আল্লাহর নবী (সা) এর সত্কর্ম, সত্য, ইনসাফ, খেলাফত, সংস্কার, ও জিহাদকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়া হবে এবং তার মনে চিরস্থায়ীভাবে আল্লাহর সাক্ষাৎ এবং তার দিদার লাভের আকাঙ্খা জাগ্রত করা হবে।
শিক্ষাক্ষেত্রে সম্ভবত অন্য যে কোন ক্ষেত্রের তুলনায় আমরা বেশি লক্ষ্য করি যে, সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে একাডেমিক গবেষণা এবং যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তাধারার ক্ষেত্রে যে সব প্রচেষ্টা চালানো হয় ওহীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তার পরিপূরক। এভাবেই ফিতরাত ও সম্পর্ক বিষয়ে একাডেমিক গবেষণা ইসলামের লক্ষ্য অর্জন এবং উচ্চতর আদর্শ হাসিলের একটি কার্যকর মাধ্যম। গত কয়েক শতাব্দীর ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয় যে, সৎ উদ্দেশ্য বা নেক নিয়তই যথেষ্ট নয়। বরং যে কল্যাণ আমরা আশা করি তা বাস্তব কীভাবে লাভ করা যায়, তা শিখে নেয়াই আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক। এ মুহূর্তে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ের পরেও শহুরে কোরাইশা পূর্বের মতোই তাদের ছোট ছেলেমেয়েদের বেদুইনের কাছে পাঠিয়ে দিত যাতে বেদুইনরা শিশুদের মরুভূমির আরবদের বৈশিষ্ট্যর আলোকে বড় করে তুলতে পারে। স্পষ্টত: শিশুদের এ লালন-পালন শুধু শারীরিক দিক থেকেই ছিল না, এটি মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও ছিল। মরুভূমির বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তরে শিশুরা বড় হয়ে ওঠে, তাদের মাথার উপর থেকে ভারমুক্ত বন্ধনহীন দিগন্ত। ব্যক্তি মানুষের ওপর সমাজের চাপিয়ে দেয়া সকল বিধি নিষেধ, রীতিনীতি থেকে মুক্ত থেকে তারা বেড়ে ওঠে। তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের এ প্রাথমিক পর্যায়ে আত্মনির্ভরশীলতা, স্বাধীনতা এবং বীরত্ব ও সাহসিকতার মত গুণাবলী স্বাভাবিকভাবেই শিশুর মৌলিক চরিত্র স্থান পাবে।
এভাবে ইসলামের শুরুতে কয়েক শতাব্দী ধরে রাজবংশীয় লোকজন এবং সমাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এ ধারা প্রচলিত ছিল। কারণ তারা জানতো যে, ভবিষ্যতে তাদের যে দায়িত্ব বহন করতে হবে তার জন্যে এটিই হচ্ছে সম্ভাব্য সর্বোত্তম প্রস্তুতি। মরুভূমিতে জীবন বিকাশের প্রাথমিক স্তর পার হয়ে শিশুরা শহর-বন্দরে ফিরে গিয়ে তাদের শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের কাছে আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু করে। এ পদ্ধতিতে তাদের শিক্ষা জীবন সমাপ্ত হতো।
ইসলামী শিক্ষার যে কোন প্রাথমিক পরিচয়মূলক বইতে শিশু ও যুবকদের সাথে আলাপ, আলোচনা ও কথোপকথনের যে পদ্ধতি আল্লাহর মহান নবী (সা) ব্যবহার করতেন তার অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে। তাদের সাথে আচরণে রাসূল (সা) এর স্নেহ-মমতা, ভালোবাসার অভিব্যক্তি দেখাতে হবে। তিনি তাদের যেভাবে যত্ন নিতেন এবং আলাপ-আলোচনা ও আচরণে যে ধৈর্যর পরিচয় দিতেন ইসলামী শিক্ষার যে কোন পুস্তকে অবশ্যই তা উল্লেখ থাকতে হবে। বস্তবিকই নবী (সা) কখনো কোনো শিশুকে আঘাত করেননি বা কোনো যুবকের সাথে আলাপ-আলোচনা বা কথা-বর্তায় কখনো কোনো অসম্মানসূচক, সৌজন্য বিরোধী আচরণ করেননি। ইতিহাসে এ ধরণের কোন তথ্য পাওয়া যায় না। আস্থা ও ভালোবাসার ধারণা শৃঙ্খলার ধারনার সঙ্গে কিছুটা অসামঞ্জস্যশীল-এ ধরনের ভুল বুঝাবুঝির কোনো কারণ নেই। বরং এটি সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত যে, শৃঙ্খলা এমন একটি গুণ যা শিশুরা অভ্যাস, অভ্যন্তকরণ এবং অপরের উদাহরণ থেকে নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করে। অধিকন্তু শৃঙ্খলা শিক্ষাকালে শিশুরা তাদের চরিত্রের ইতিবাচক দিকগুলো থেকে সহায়তা লাভ করে। তাদের চরিত্রের ইতিবাচক দিকগুলো তাদের সাফল্য অর্জনে এবং তাদের সম্মানিত ও প্রিয় ব্যক্তিদের মেনে নিতে শেখায়।
শিশুকে স্নেহ বা ভালোবাসা দেয়া মানে তাকে নষ্ট এমনটি মোটেও বুঝানো যাবে না। অনুরূপভাবে এটাও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, শিশুকে উপদেশ দেয়া বা মৃদু ভত্সনা করা আর শিশুকে শৃঙ্খলা শিক্ষা দেয়াকে মোটেই এক করে দেখা যাবে না। শিশুর লালন-পালনের জন্য স্নেহ-মমতা এবং শৃঙ্খলা দু‘টিরই প্রয়োজন। আমাদের স্নেহ-মমতা এবং শৃঙ্খলা দু‘টিরই প্রয়োজন আছে। আমরা সফল হলে আমাদের শিশুদের সফলভাবে গড়ে তুলতে পারবো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বর্তমান যুগে আমাদের নেতা, পন্ডিত, জ্ঞানী ও শিক্ষাবিদদের উপলব্ধি করতে হবে যে, তাদের সামনে শিক্ষা ও সংস্কারের যে কাজ রয়েছে তা বিভিন্নভাবে নবী (সা) ইসলামের প্রাথমিক যুগে যে কাজ করেছিলেন সেটা থেকে ভিন্ন। যেসব মানুষের কাছে তিনি তাঁর পয়গাম পৌছিয়ে ছিলেন তারা ছিল মজবুত ও দৃঢ়চেতা। তাবে সমস্যা ছিল যে, তারা ছিল অহঙ্করী, উদ্ধত এবং গোত্রীয় মনোভাবাপন্ন। অপরদিকে আজকের যুগে উম্মাহ এবং তার যুবশক্তিকে দুর্বলচিত্ত, অশ্লীল আমোদ-প্রমোদে মত্ত, উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন এবং আত্মবিশ্বসহীন আখ্যায়িত করা যেতে পারে।
মিশরে ফেরআউনের আমলে ইসরাইলীরা দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ ছিল। বর্তমানে মিশরে দাসত্বের যুগের ইসরাইলী সন্তানদের সাথে অনেক দিক থেকে মুসলিম উম্মাহর সাদৃশ্য রয়েছে বলা যায়। সে সময়কালে মূসা (আ) চল্লিশ বছর ধরে ইসরাইলীদের নিয়ে সিনাইয়ের ঊষর ও জনমানবহীন প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন, সে সময়ের মধ্যে তিনি একটি নতুন সূযের চেয়ে দৃঢ়, স্বাধীন (stronger) ও বয়:প্রাপ্ত (came of age) হলেন। তখনই তারা মরুভূমি থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হলো, পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতে পারলো এবং সেখানে ইসলাম, তাওহীদ ও নবুয়তের সমাজ গঠনে সক্ষম হলো।
এখানে এ কাথা উপলব্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ যে, একটি জাতির মধ্যে সৃজণীলতা বৃদ্ধি বা প্রতিভার বিকাশের পরিবর্তে কৃত্রিমতা বা ভাসা ভাসা জ্ঞান তখনই স্থান করে নেয় যখন সে জাতির সামষ্টিক মন বা মনন বাস্তবানুগভাবে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির মোকাবেলা করার শক্তি হারিয়ে ফেলে, ফলে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের পাশাপাশি নিজেদের অস্তিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারে না। চ্যালেঞ্জ গ্রহণে ইতস্তত কর। ইসরাইলের সন্তান ও তাদের রাব্বি বা ওলামাদের বেলায় ঠিক এমনটি ঘটেছিল। তাদের মধ্যে কোনো গরীব মানুষ চুরি করলে তারা তাকে কঠোরতম শাস্তি দিত, কিন্তু কোনো ধনী একই অপরাধে অভিযুক্ত হলে তাকে ছেড়ে দেয়া হতো। এ করণে আল্লাহর নবী ঈসা (আ) এর শিক্ষা ও মিশনের কেন্দ্রী বিষয় ছিল, বনী ইসরাইলকে তাদের মৌল শিক্ষার দিকে ফিরিয়ে আনা, আপন জাতি বা গোত্রের মানুষদের ভালবাসার মাধ্যমে শিক্ষার দিকে তাদের আন্তরিকতা ও সেবার মনোভাব সৃষ্টির দিকে প্রত্যাবর্তন করানো।
এভাবে বলা যায়, উম্মাহের মধ্যে শিক্ষা ও লালনপালনের ক্ষত্রে সংস্কারের কাজটি যেভাবে করা যাবে, একটি পরিনত ও উন্নত জনগোষ্ঠিকে প্রশিক্ষণ পদ্ধতির অনুরূপ হবে না। অপর পক্ষে এ কাজ হবে একটি রুগ্ন ও দুর্বল জনগোষ্ঠিকে চিকিত্সা সুবিধা দেয়ার মতো যারা তাদের শক্তি, সংকল্প, উদ্ভাবনী দক্ষতা এবং ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলেছে।
মুসলিম শিক্ষাবিদদের তাদের মিশনকে ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে। তাদেরকে সুস্পষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং পদ্ধতি সম্বলিত একটি সুসংজ্ঞায়িত ইসলামী শিক্ষা তত্ত্ব সৃষ্টির জন্য একযোগে কাজ করতে হবে। বিশেষভাবে তাদেরকে শিক্ষার মনস্তাত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিকের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে উম্মাহর মনস্তাত্ত্বিক গঠন এবং যেসব দিকে তার সংস্কারের প্রয়োজন আছে তা বিবেচনা করতে হবে। এটিও গুরুত্বপূর্ণ যে, ওহী থেকে আমরা মানুষের বিচিত্র আধ্যাত্মিক, আবেগ সংক্রান্ত বস্তুগত বহুমাত্রিকতার পরিচয় পাই, তার আলোকে মুসলিম মনস্তাত্ত্ববিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মনস্তত্ত্ব ও অন্যান্য সমাজ বিজ্ঞানের ইসলামিকরণের জন্য নতুন করে প্রচেষ্টা চালাতে হবে যাতে মুসলিম শিক্ষকদের মানুষের ফিতরাত সম্পর্কে জ্ঞান ও সচেতনতা দান করা যায়, তাদের বোঝানো যায় কীভাবে মানবীয় ফিতরাতের বিকাম ঘটে এবং সর্বোত্তম কোনো উপায়ে একে কাজে লাগনো যায়।
ইসলামিকরণ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান
উম্মাহর রাজনীতি, এর অগ্রাধিকারসমূহ, নীতি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাছাই করার পদ্ধতি, উম্মাহর সাধারণ রাজনৈতিক আলোচ্য সূচি সুস্পষ্টকরণ, উম্মাহর রাজনৈতিক পদ্ধতি বিধিবদ্ধ আইন উপবিধি, ব্যবস্থা বা পদ্ধতি চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন, ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রশাসন, তার শক্তি ও সম্ভাবনার পরিচালনা সম্পর্কিত গবেষণাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান কাজ করে। আদর্শিক এবং সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বিষয় বর্তমান যুগে উম্মাহর জন্য অত্যন্ত জরুরি বিষয়।
রাজনীতির অধ্যয়ন ও অনুশীলন এসব উপাদানের সঠিক উপলব্ধির ওপর নির্ভর। এসব উপাদান যেভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত হয় তা সঠিকভাবে বোঝা প্রয়োজন। রাজনীতির আরো দাবি- সমাধান উপস্থাপন করার যোগ্যতা, পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার সামর্থ ও সক্ষমতা এবং এসব কিছু এমনভাবে হতে হবে যাতে উম্মাহর কল্যান, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়। এভাবে উম্মাহর যেসব ঐতিহাসিক মডেল উপস্থাপিত হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে অধ্যয়ন, যদিও নিশ্চিতভাবেই তা করা হয় না, কারণ উম্মাহ কখনো এগিয়ে গেরে তার যে ধরণের অধ্যায়ন প্রয়োজন সেসব মডেল তার গুরুত্বপূর্ণ উত্স হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। এ অধ্যায়নকালে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকার প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত। এ ধরণের অধ্যয়ন এসব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যে পদ্ধতি গড়ে উঠেছিলো তার পেছনের কারণসমূহের উপর আলোকপাত করতে পারবে এবং সংগঠনের নবায়ন বা নতুন করে সৃষ্টির কাজে সহায়তা দিতে পারবে। বাস্তবিকই উম্মাহ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের জন্য তার বিশেষ অবস্থা, পরিস্থিতি ও মূল্যবোধ অনুগত রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারবে, সে কখনো উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না। আমাদের যা উপলব্ধি করা প্রয়োজন তা হচ্ছে, উম্মাহর রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে উম্মাহর সত্যিকার মেজাজ এবং চিন্তাধারার প্রতিফলন থাকতে হবে। অন্যথায় কোনো নেতৃত্ব, সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের আকর্ষণ উন্নত হবে অথবা টিকে থাকবে এমন আশা কখনো করা যাবে না।
উম্মাহর রাজনীতিকে আমরা সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চাইলে আমাদের অবশ্যই এ কথা উপলব্ধি করতে হবে যে, এসব কিছুর জন্য অত্যাবশ্যক বিষয় হলো আমাদের যুব সমাজকে আমরা কি ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত করি এবং কীভাবে তাদের লালনপালন করি।
এটি নিশ্চিত যে, উম্মাহর পদ্ধতি এবং নেতৃত্ব উভয়ই তার ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারার প্রতিফলন। অধিকন্তু কোনো পদ্ধতি কখনো বদলানো যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার মনস্তাত্ত্বিক ও আদর্শিক ভিত পরিবর্তন করা না যায়। কাজেই আমরা উম্মাহর বিভিন্ন পদ্ধতি, নেতৃত্ব, প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিবর্তন কারতে চাইলে উম্মাহর চিন্তাধারা ও অনুভুতিকে সামনে রেখে আমাদেরকে অবশ্যই ভিত্তিমূল পর্যায়ে কাজ শুরু করতে হবে। সঠিক ইসলামী রাজনীতি হবে সুষ্ঠু ও সঠিক ভাবধারা সৃষ্টিতে সক্ষম একটি উম্মাহর অবদান। এমন একটি উম্মাহর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই তাদের উপর ন্যস্ত প্রশাসনে তাদের সদস্যদের অংশগ্রহণ এবং উম্মাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে দেয়া সুচিন্তিত পরামর্শের ভিত্তিতে চলতে হবে।
এসব কারণে উম্মাহর রাজনৈতিক চিন্তাধারা পুনর্গঠিত করা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষা সম্পর্কেও এটি সমভাবে প্রযোজ্য। এটি করা হলেই কেবল উম্মাহর রাজনৈতিক ও শিক্ষা ব্যবস্থায় তার বিশেষ কর্ম ও মনস্তাত্ত্বিক সংবিধানের প্রতিফলন দেখা যাবে বা তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুধাবন করা যাবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একাডেমিক অধ্যয়ন উম্মাহর তার সমগ্রতা এবং সামাজিক সংবেদনশীলতা ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে, সমাজ পর্যায়ে কাজ করার ক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাণশক্তির নাবায়নে এবং তার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী অঙ্গীকারের দিকে পরিচালনা বিষয়ে অবশ্যই সহায়ক হতে হবে। এমনটি ঘটলে উম্মাহর রাজনৈতিক নেতৃত্ব অবশেষে উম্মাহর আস্থা ও সমর্থন লাভ করবে। এটি অত্যাবশ্যক যে, ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তাধার ও প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্যই উম্মাহকে ব্যর্থতা ও অপমান থেকে মুক্তি দেবে। কারণ এ ব্যর্থতা ও অপমান উম্মাহকে সুস্পষ্ট ও লক্ষণীয়ভাবে দাস মানসিকতায় নিক্ষেপ করেছে। এ দাস মানসিকতা তাদেরকে স্বাধীন ইচ্ছা ও স্বাধীন কর্মতত্পরতা থেকে বঞ্চিত করেছে।
উম্মাহর বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবশ্যই মনস্তাত্ত্বিক ও একাডেমিক সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে যা সত্যবাদিতা, বস্তুনিষ্ঠ চিন্তাধারা এবং নিজের অস্তিত্বের গর্ববোধেকে দাসত্বের নিগড়ে, অমুসলিমদের প্রতি অসহিঞ্চুতায়, অদৃষ্টবাদ, তাকলিদ এবং সবশেষে দুর্দশা ও অধ:পতনে নিক্ষেপ করেছে। বরং আমাদের অবশ্যই এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, মানুষ যাতে ইসলামী চিন্তধারাকে সম্মান ও শালীনতার রক্ষক হিসেবে উপলব্ধি করে এবং তাকে সত্য, সুন্দর, ত্যাগ, খিলাফত ও সংস্কারের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করে।
উম্মাহর বর্তমান অধপতিত অবস্থা, তার দুর্বলতা, তার পতন, তার দুশমন, আতঙ্ক, শত্রুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ষড়যন্ত্রের কাছে তার নতি স্বীকার, তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব- এসব কিছুই হচ্ছে উম্মাহর দাস মানসিকতার প্রতিফলন। দুর্বল চিন্তাধারা এবং বিকৃতি মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা লালনের ফলে এ দাস মনোবৃত্তির সৃষ্টি হয়।
অধিকন্তু, ইসলামী রাজনৈতিক বিষয় অধ্যয়নে ওহীর শব্দাবলী, একাডেমিক অধ্যয়নের ব্যাখ্যা এবং আইন প্রণেতা ও রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্তের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য কারতে হবে। চিন্তাবিদ ও পন্ডিতগণের একাডেমিক অধ্যয়ন ওহীর কালাম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সামাজিক আইন প্রণয়ন ও রাজনৈতিক সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে উদ্ভুত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও একাডেমিক অধ্যয়ন এক নয়। বরং এগুলো উম্মাহর জন্য চিন্তাধারার সমৃদ্ধ উত্সর প্রতিনিধিত্ব করে এবং এগুলো এমন মাধ্যম যাতে তার দৃষ্টি, কল্পনাশক্তি স্বচ্ছ হতে পারে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক আইন প্রণয়নে পন্ডিতগণের ভিন্ন ভিন্ন মত এসব বিষয়ে যে কোনো পক্ষের সমর্থকের মতকে খর্ব করে না। কাজেই কোনো একটি মতকে উম্মাহর সামনে যে সমস্যা আছে তা উপলব্ধির জন্য এক ধরণের সাহায্যের চেয়ে বড় কিছু হিসাবে নেয়া উচিত নয়। সুতরাং উম্মাহর গুণী লোকজন যত বেশি মত বা চিন্তাধারা সৃষ্টি করবে, তখন উম্মাহর পক্ষে সামাজিক ও রাজনৈতিক আইন প্রণয়নকে বস্তুনিষ্ঠ ও পরিপক্ক উপায়ে এবং তার প্রত্যয় ও দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে বিবেচনা করার সম্ভবনা ততোধিক বেড়ে যাবে। এভাবেই সামাজিক ও রাজনৈতিক আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত সদ্ধান্তসমূহে জনগন ও উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থের প্রতিফলন দেখা যাবে, যদিও এসব সিদ্ধান্ত সবসময় কিছু নির্দিষ্ট কাজে হচ্ছে উম্মাহর মানসিক গঠন ও চিন্তাধারার অপরিবর্তনীয় বিষয়গুলোকে সংজ্ঞায়িত করা। পন্ডিতদের আরো ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হবে আইন ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সর্বোত্তম কোন উপায়ে এ অপরিবর্তনীয় বিষয়গুলো ব্যবহার করা যাবে এবং উম্মাহর সমগ্র নির্বাহী ও সাংবিধানিক কাঠামো পাল্টিয়ে না দিয়ে সর্বোত্তম কোন উপায়ে চ্যালেঞ্জসমূহের মোকাবিলা করা যাবে। এটি এখন স্পষ্ট যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠানসমূহ মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটাবে না। ইসলামী উম্মাহ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিপরীতে, সত্য ও ইনসাফের সেবাকে তার পবিত্র কর্তব্য জ্ঞান করে। একইভাবে সে ওহী, ফিতরাত এবং যুক্তির মাঝে যে সত্য খুজে বেড়ায় তা বৈষয়িক ও বাস্তব। যখন সত্যের নির্দেশনা অনুসরণকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ইসলামী কল্যাণ অর্জন করার সর্বোত্তম উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখন সত্যে পৌছার জন্য পারস্পরিক পরামর্শকে উম্মাহ একটি মৌলিক পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করে। এখানে আমরা দেখতে পাই যে, পশ্চিমা দলীয় পদ্ধতি বাস্তব বা বন্তুনিষ্ঠ সত্যে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী নয় অথবা পাশ্চাত্যে দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে ইসলামী শূরার গতিশীলতা আনয়নের জন্য কোনো পন্থা উদ্ভাবন করা হয়নি। অপরদিকে প্রাচ্যের মাকর্সবাদী দেশগুলোতে যে অকনায়কত্ববাদ (Totalitarianism) পরিদৃষ্ট হয় তা কাঙ্ক্ষিত ইসলামী ধারণা থেকে বহুদূরে। বস্তুবাদ ও যুক্তিবাদ সমসাময়িক পশ্চিমা সভ্যতার ভিত্তি। পাশ্চাত্য সভ্যতার কোনো ধর্মীয় দিক যদিও বা পাওয়া যায় তা হচ্ছে তাদের উত্তরাধিকারের (Heritage) অবশিষ্ট ছিটেফোঁটা, যা বিলুপ্ত হবার নয় এবং প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বহুলভাবে ইসলামী সভ্যতা থেকে তা তারা ধার করেছে।
এ যুক্তিবাদী বস্তুবাদের আলোকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সৃষ্টিগুলোর এ পদ্ধতি অনুযায়ী ব্যক্তি ও সমাজের জন্য যা সর্বোত্তম তা অর্জনের জন্য সংসদীয় (অথবা দলীয়) সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম ব্যবস্থারূপে বিবেচনা করে। এভাবে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তসমূহ হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধন্ত। এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রাজনৈতিক দলের স্বার্থে। অপরদিকে মার্কসবাদের সৃষ্টি হয় একটি সংস্কারমূলক আন্দোলনরূপে। মার্কসবাদ মানব মনে দেবত্ব আরোপ করে তাকে সংগঠিত ধর্মগুলোকে প্রকাশ্যে নিন্দা কারতে শেখায় এবং জনসমক্ষে নিজস্ব নাস্তিক্যবাদের প্রচার করে। এভাবে মার্বসবাদ অর্থনীতি ও বৈষয়িক সমৃদ্ধিকে সব মানবিক অগ্রগতি বা উন্নতির তুলনায় ব্যক্তি জীবন অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন। মার্কসবাদের আদর্শিক ভিত্তিমূল ও উপলব্ধি নিয়ে যখন দেখা যায় ইউরোপে সমূহবাদ ও একনায়কত্ববাদ দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আছে তখন আমরা আর বিস্মিত হই না।
এখানে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ওহীকে প্রত্যাখ্যান করে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক পথ নির্দেশনা থেকে পাশ্চাত্য বঞ্চিত হয়েছে এবং এ কারণেই সে বস্তুবাদের ফাঁদ আটকা পড়েছে। মূলত: মানবীয় যুক্তি ও উপলব্ধি সীতিত প্রকৃতিই পাশ্চাত্যের সামনে উপস্থাপিত সামাজিক, নৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার আসল কারণ। আরেকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, মানবজাতির প্রতি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গীর ক্ষেত্রে ইসলামী চিন্তাধারার সাথে পশ্চিমা চিন্তাধারার পার্থক্য রয়েছে। ইসলাম জীবনের বিভিন্ন দিককে স্বীকৃতি দেয় এবং ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় এবং সত্য-মিথ্যার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগকে এ জীবনে তার উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এ দৃষ্টিভঙ্গী বা দর্শন ব্যক্তির অস্তিত্ব ও তার ইচ্ছার বাইরে সত্যকে বাস্তব করে তুলেছে। এ কারণে ব্যক্তির জন্য এটি এমন এক বিষয় পরিণত হয় যার জন্যে তাকে প্রচেষ্টা চালাতে হয়। এ কারণে ইসলামে শাসন বা আল হুকুম- এর ধারণা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের গণতান্ত্রিক ধারণা এ দুটি বিষয় এক নয়। বরং ইসলামী শাসন বা আল-হুকুমের ধারণা হচ্ছে উম্মাহর সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পারস্পারিক পরামর্শ বা শূরা এবং সত্যের অনুসন্ধান ও সমস্যা সমাধেনে স্বাধীনভাবে মত বিনিময়ের ধারণা। এ প্রক্রিয়ায় শুধু ওহীর শিক্ষা, প্রাকৃতিক আইন এবং উম্মাহর প্রয়োজন ও চাহিদাকে বিবেচনায় নিতে হবে।
সুতরাং শূরার দৃষ্টিভঙ্গী এবং উদ্দেশ্য গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ও উদ্দেশ্য থেকে ভিন্ন যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন, সত্য বা হক সম্পর্কে অস্পষ্টতা থাকলে অথবা যে ক্ষেত্রে কোন সুস্পষ্ট ঐক্যমত বা ইজমা নেই সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতই হচ্ছে সঠিক। শূরার প্রতিষ্ঠান এবং তার পদ্ধতিতে ওহীর মূল পাঠের মধ্যে সত্যের অনসন্ধানে ফিতরাহর প্রেরণায় এবং বিশ্ব প্রকৃতির বিধানে শূরার ধারণা প্রতিফলিত হতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং এর প্রক্রিয়াসমূহ ক্ষমতাসীন দল বা কোয়ালিশনভুক্ত ব্যক্তিবর্গের স্বার্থ ও মতামতের ভিত্তিতে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রচষ্টা চালায়। এর সঙ্গে শূরার অবশ্যই পার্থক্য থাকবে।
দৃষ্টিভঙ্গী ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক হলে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানসমূহে অবশ্যই এ ভিন্নতার প্রতিফলন থাকতে হবে। সুতরাং এটা অত্যাবশ্যক যে, ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে বাছাইয়ের স্বাধীনতা এবং তার আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো যেমন বিশ্বাস, চিন্তাধারা এবং সংগঠিত সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহনের স্বাধীনতা থাকতে হবে। একই সাথে এটিও অত্যাবশ্যক যে, এ ব্যবস্থায় উম্মাহর দৃঢ় প্রত্যয় এবং তার আদর্শের প্রতিফলন থাকতে হবে। সে যা হোক, সত্যিকার অর্থে প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব ছাড়া এর সমর্থনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের উপদেশ ও পরামর্শ থেকে কল্যাণ লাভের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও গুণাবলীর অধিকারী। এসব ব্যবস্থা বা পদ্ধতিকে বোঝা এবং সেগুলোকে অন্যান্য ব্যবস্থা বা পদ্ধতির সাথে তুলনা করার প্রচেষ্টায় সর্বাত্মক দৃষ্টিভঙ্গীর গুরুত্বের পেছনে যে সব যুক্তি রয়েছে তা আগের আলোচনার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। আমাদেরকে একটি মৌলিক ইসলামী পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো তৈরি করার ব্যাপারেও সাহায্য করা উচিত। মৌলিক ইসলামী ব্যবস্থা বা পদ্ধতি অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে উত্কৃষ্ট হবে, তাদেরকে শুধু নকল করার চেষ্টা মনে করা হবে না। কারণ, তাদের কাছে তখন এটি পরিস্কার হয়ে যায় যে, অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য উম্মাহর দৃষ্টিভঙ্গি এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে অনেকটা ভিন্ন।
সুতরাং কোন ব্যবস্থা বা পদ্ধতিতে রাজনীতি ক্ষেত্রে ইসলামী চেতনার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটে। কীভাবেই বা এ পদ্ধতি সৃষ্টি করা যাবে? নি:সন্দেহে ইসলামী পদ্ধতি আদর্শিক এবং সাংবিধানিক শর্তাবলী ও গুণাবলীর দ্বারা পৃথকভাবে চিহ্নিত হবে, এ জন্যে কিছু গ্যারান্টি দিতে হবে। একইভাবে শিক্ষা পদ্ধতিতে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে এবং ইসলামী রাজনৈতিক পদ্ধতি এবং সহায়ক রাজনৈতিক ও আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে কাজ করতে হলে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হবে। যোগ্যতা ও উদারতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দালগুলোর সংগঠন করতে হবে যাতে এটি নিশ্চিত করা যায় যে, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী সঠিক পরামর্শ ও অভিজ্ঞতার প্রতিনিধিত্ব করে। এর মাধ্যমে বুঝতে হবে যে, এ ব্যবস্থা বা পদ্ধতিতে অভ্যন্তরে বাস্তব চাহিদা এবং জরুরি পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃত্বের কয়েকটি পর্যায়, পরামর্শ পরিষদ ও আইন প্রণয়নকারী সংস্থা রয়েছে। উম্মাহর নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ যাতে গঠনমূলকভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে পারে সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক মত প্রকাশের মাধ্যমেও সংগঠনকে যথেষ্ট নমনীয় হতে হবে। এভাবে ইসলামী পদ্ধতির রাজনৈতিক দলগুলোকে সংসদীয় গ্রুপিং-এর মতো মনে হবে। সংসদীয় গ্রুপিংগুলো কোনো নিয়ন্ত্রন মানে না বা পূর্বে নির্ধারিত কোনো দলীয় অবস্থানের কাছে আত্মসমর্পণ করে না। বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের প্রেক্ষিতে গ্রুপ যে কর্মপন্থা গ্রহণ করে তা তাদের বস্তুনিষ্ঠ প্রত্যয়, ধারণা ও উপলব্ধি এবং শূরার মাধ্যমে প্রাপ্ত পরামর্শের ভিত্তিতে হয়।
কয়েকটি মুসলিম দেশে সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলগুলো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ পদক্ষেপটি হলো শাসক গোষ্ঠীর নিজ দলের বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠনের অনমতি দান ছাড়াও ইসলামী আন্দোলনসমূহের নেতৃত্ব থেকে কয়েকজন ব্যক্তিত্বকে শাসক দলে শামিল করে নেয়া হয়েছে। এভাবে ধর্মনিষ্ঠ মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাদের প্রজ্ঞা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা উপলব্ধির কারণে জনগণের আস্থা ও সম্মান লাভে সক্ষম হয়েছে। সাধারণভাবে পরিচিত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সমসাময়িককালের রাজনৈতিক জীবনে যে সব ঘটনা আমরা দেখতে পাই তা থেকে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি উম্মাহ কীভাবে রাজনৈতিক জীবন নিয়ন্ত্রণে এবং তাকে দুর্নীতির হাত থেকে রক্ষায় তার ভূমিকা সম্প্রসারিত করতে পারে। আমরা আরো শিখতে পারি আমরা কীভাবে রাজনৈতিক ফোরাম গড়ে তুলতে পারি এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তার বিকাশ ঘটাতে পারি, যাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য বৃহত্তর পরিসরে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়। তাদের সিদ্ধান্ত আরও বস্তুনিষ্ঠ হয় এবং মুসলিম জনসাধারণের স্বার্থেরও উত্তম প্রতিনিধিত্ব করা যায়। এসব কিছু করতে গিয়ে মুসলিম পন্ডিত ও আইন প্রণেতাদেরকে উম্মাহর স্বার্থ, প্রয়োজন ও মেজাজ রক্ষার উপযোগী বিকল্প হিসেবে চিন্তা করতে উত্সাহিত করা উচিত। যখন এ কাজ সম্পন্ন হবে অনুকরণ ও ভিন্ন ব্যবস্থার অংশ বিশেষ আমদানির আর কোনো প্রয়োজন থাকবে না।
মুসলিম উম্মাহর ক্রমবর্ধমান আকার যেভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে বিভিন্ন দেশে, জনগোষ্ঠিতে, সংস্কৃতিতে এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতায় তার দিকে লক্ষ্য করলে আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করতে পারি যে, তাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী সরকার পদ্ধতি হবে এমন যা মুসলিম দেশগুলোকে একটি শিথিল ফেডারেশনে শামিল রাখবে। এ ধরণের ব্যবস্থা নেতৃত্বের জন্য বিভিন্ন বিষয়কে সহজ করে তুলবে এবং জনসাধারনকে সরকারি দায়িত্ব পালনে অংশগ্রহণের জন্য উত্তম সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ইসলামী সূত্রগুলো এমন হওয়া প্রয়োজন যা খেলাফত সম্পর্কে আমাদের বর্তমান উপলব্ধিকে ছাড়িয়ে যাবে। খেলাফত সম্পর্কে আমাদের বর্তমান উপলব্ধি হচ্ছে- এটি একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান, আমাদের জন্য প্রয়োজন এটির অনুসরণ করা এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমানরা যেভাবে খেলাফত চালিয়েছিল ঠিক সেভাবে খেলাফত ব্যবস্থা চালু করা। এর পরিবর্তে এখন থেকে খেলাফতকে একটি গতিশীল ব্যবস্থা হিসেবে আমাদের বুঝতে হবে, যার লক্ষ্য হবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে মূল্যবোধ ও নীতি প্রতিষ্ঠা করা এবং নাগরিকদের ধর্মীয় ও পার্থিব স্বার্থের প্রতি মনোনিবেশ করে উচ্চতর লক্ষ্য অর্জন করা। এর ভিত্তিতে বিভিন্ন পদ্ধতি এবং প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে অনুসন্ধান চালিয়ে সেগুলোকে উম্মাহর স্বার্থ হাসিলের জন্য নতুনভাবে ঢেলে সাজানোতে (re-designing) আপত্তির কিছু নেই।
যারা খেলাফত সম্পর্কে অধ্যয়ন করে একে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কেন্দ্রায়নের ভিত্তিতে একটি জটিল ব্যবস্থা হলে মনে করে তারা সত্যিকারভাবে এ রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝেনি। উম্মাহ তার আধ্যাত্মিক ও পার্থিব আকাংখা পূরণের জন্য যে কোনো পদ্ধতির সরকার নিজের জন্য বেছে নিতে পারে এবং এ ধরণের সরকারকে খেলাফত ব্যবস্থা হিসেবে বুঝতে হবে এবং এভাবেই সে ব্যবস্থা উম্মাহর সমর্থনযোগ্য হবে। ইতিহাসে যে সরকার পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে ছাত্রদের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করা উচিত নয়। কারণ মূল বা আসলকে ছেড়ে দিয়ে আকার আকৃতি আঁকড়ে থাকা হচ্ছে অনভিজ্ঞতার ফল।
ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞান সূত্রগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে উম্মহর জীবনে তার সংগঠনে, তার সম্ভাবনা শক্তিতে এবং তার স্বার্থ ও প্রেক্ষিতের পার্থক্য, ইসলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যে ভূমিকা পালন করে সে সম্পর্কিত জ্ঞান। অপরদিকে পশ্চিমা রাজনৈতিক কাঠামো হলো কল্পনা ও বাস্তবতা। এ বিষয়ে তারা মূল্যবোধ ও নীতিকে ঘৃণার চোখে দেখে, কারণ এগুলো বর্তমান পরিস্থিতির ও প্রয়োজনের কোনো প্রতিফলন নয়। সুতরাং পাশ্চান্যবাসীকে তার নৈরাশ্যবাদের জন্য ক্ষমা করা অযৌক্তিক (কারণ তার সংস্কৃতিতে ওহীর সূত্রগুলোর বিকৃতির কারণে এ নৈরাশ্যবাদ সৃষ্টি হয়েছে)। ইসলাম যে লক্ষ্য, নীতি ও নির্দেশনা নিয়ে এসেছে তা কোনো অনুমান বা কল্পনা নয় বরং এটি সৃষ্টি, ফিতরাত এবং যে সত্যের ওপর আকাশ ও পৃথিবী তৈরি হয়েছে তা থেকে এসেছে।
ইসলাম বিভিন্ন বৈপরিত্যকে (Opposites) চিহ্নিত করে যেমন, ভালো-মন্দ, সত্য ও মিথ্যা, হেদায়েত ও পথভ্রষ্টতা, সততা ও দুর্নীতি ইত্যাদি। তবে ইসলামী সমাজ পৌরাণিক কাহিনীকে বাস্তবতার বিপরীত বিষয় হিসেবে মনে করে। বরং ইসলামী সমাজে মিথ্যা, পথভ্রষ্ঠতা এবং দুর্নীতির বিপরীতে রয়েছে সুষ্ঠু নির্দেশনা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা। ব্যক্তি ও সমাজের উপর এসব পরস্পরবিরোধী পরিবর্তনশীল দোষগুণ কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারে তার উপর সমাজের অবস্থা নির্ভর করবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সমসাময়িক ইসলামী চিন্তাধারাকে সেসব বিতর্ক ও পরিবেশ থেকে মুক্ত করতে হবে যা উম্মাহকে তার ইতিহাসের শুরু থেকেই চারিদিক থেকে আক্রমণ করছে এবং যে বিতর্ক ও পরিবেশ পরিস্থিতি ওহীর উত্সগুলোর নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ ব্যাখ্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়ে ও সীমাবদ্ধ ব্যাখ্যা এমনভাবে করা হয় যাতে এক গ্রুপ বা অপর গ্রুপের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল হয়। বাস্তবিকই এভাবে অনেক আগে উম্মাহর বিভিন্ন বিষয় পরিচালনায় তাওহীদ ও শূরার উপাদানগুলোকে পৃথক করে ফেলা হয়। পরিবর্তে বিভিন্ন বিজ্ঞমন্ডলী তাদের পৃষ্ঠপোষকদের রাজনৈতিক দাবিকে সত্য প্রামাণিত করার জন্য বিভিন্ন বক্তব্য ও ঐতিহাসিক নজির খুঁজে বের করে। ফলে উম্মহ ইসলামী মিশনের দায়িত্ব বহনের এবং পৃথিবীতে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যোগ্যতা হরিয়ে ফেলে। রাজনৈতিক জীবনের ইসলামিকরণের বাস্তব অর্থ হলো চিন্তা (Idea) ও শিক্ষার ইসলামিকরণ, রাষ্ট্র ব্যবহৃত polity- র মৌল বিষয়সমূহ- এর নেতৃত্ব, এর সংগঠন এবং এর ইসলামীকরণ। এ Islamization এর অর্থ হচ্ছে বাস্তববাদী শূরার মাধ্যমে ইমলামের মৌলিক মূল্যবোধ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের আনুগত্য এবং উম্মহ ও তার রাজনৈতিক ভিতকে (polotical base of elite) সে অনুগত্যের মৌলিক বিষয় ও সরাসরি পথ (Forthright ways) সম্পর্কে শিক্ষিত করা।
আমাদের উপলব্ধির জন্য আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক। এ উপলব্ধিগুলো প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দ্বারা। আদর্শিকভাবে বলতে গেলে এ ধরণের সিদ্ধান্তগুলো ওহী ও ফিতরাত এবং বাস্তবতাসহ ইসলামের উচ্চতর ও আদর্শের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমন্বয়ের ফল। এ সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিয়ে কুরআনের আয়াত নাজিল হয়, “আল্লাহর আনুগত্য করো, নবীর আনুগত্য করো এবং যারা তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বের অধিকারী“(৪:৫৯)। যে ধরণের আনুগত্য ও অভিজ্ঞতার বিষয় এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তা শুধু কুরআনের আয়াত এবং বাস্তব অবস্থায় প্রতিনিধিত্বকারী উম্মাহর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত অঙ্গীকারবদ্ধ ইসলামী নেতৃত্বের মধ্যে বাস্তব যোগাযোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে পাওয়া যাবে। উল্লেখ্য, এ বাস্তবতার মধ্যে বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন থাকবে এবং এর বাস্তবতা এমন হবে যা তার প্রয়োজন তা করার জন্য এবং তার সামনে যে সব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবিলার জন্য হিকমতের সাহায্যে এগিয়ে আছে। অন্যথা কুরআন ও সুন্নাহ হয়ে যাবে ধ্বংসাত্মক বিভেদ সৃষ্টিকারী, বিপথে পরিচালনাকারী এবং অবাস্তব চিন্তাধারার অনুকূল কালামে ওহী (নাউজুবিল্লাহ)
উম্মাহর নিজের জন্য একটি অঙ্গীকারবদ্ধ ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সঙ্কল্প ছেড়ে দেয়া কখনোও উচিত হবে না। এ ধরণের নেতৃত্বের মাধ্যমেই উম্মাহ ওহীর শিক্ষা থেকে উপকৃত হতে পারে। চিন্তাধারার সংশোধনে সফল হলে আমরা যে সব মতবাদ, উপায় ও মাধ্যমের সাহায্যে ইসলামী সামাজিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আছে তার কাছে পৌছাতে পারবো। তারপর সে ভিত্তি থেকে যোগ্য ও অঙ্গীকারবদ্ধ ইসলামী নেতৃত্ব উঠে আসবে। ইসলামী চিন্তাধারা এমন এক ভবিষ্যত দেখিয়েছিল যে তখন আল মাওয়ার্দী, ইবনে তাইমিয়া, আল ফারাবী ও ইবনে খলদুনের মত প্রতিভার জন্ম সম্ভব হয়েছিল। নতুন প্রতিভার আবির্ভাব ঘটানো প্রয়োজন যাতে উম্মাহ সভ্যতার ক্ষেত্রে পদ্ধতিবিজ্ঞানের বিকাশ সাধন করতে পারে এবং তাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পারে।
ইসলামিকরণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
উম্মাহর জীবনের গোড়ার দিকে পশ্চিমের সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক চাপের ফলে শিক্ষিত মুসলমানরা দুটি বিষয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিল : প্রথমত, সত্যের বস্তুগত বৈশিষ্ট্য ও বিশ্বজনীন আইন। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি ও সমাজ এসব সত্য ও বিশ্বজনীন আইনকে ব্যবহার করে তাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে নেয়। এভাবে শিক্ষিত মুসলমানরা পাশ্চাত্য ও বিজ্ঞানের সব কিছুকে বস্তুগত ও নিরপেক্ষ ধারণা করে গ্রহণ করে। তাবে সত্য কথা এ যে, অন্যান্য জাতি ও সভ্যতার সত পাশ্চাত্য সভ্যতাও তার নিজের বিশ্বাস, মনস্তাত্ত্বিক উপাদান এবং ঐতিহাসিক উপাদান দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। পাশ্চাত্য যখন আবিষ্কার করল যে, তাদের আসমানি কিতাবের উত্সগুলো বিকৃত ও পরিবর্তিত হয়ে গেছে, তখন আসমানি কিতাবের উত্সগুলোর উপর আনাস্থার সৃষ্টি হলো এবং তা তাদের সভ্যতার উন্নয়ন ও বিকাশের ওপর প্রভাব বিস্তার করল। এভাবে মানবজাতির বস্তগত প্রয়োজন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল যে, ব্যক্তি ও তার প্রয়োজন এক ধরনের পবিত্রতা অর্জন করল। এ পথেই তার সব আধ্যাত্মিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। এ কারণে দেখা যায় একদিকে পাশ্চাত্য সমাজে জনগণের বৈষয়িক কল্যাণ ও আরাম আয়েশের প্রচুর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে, অন্যদিকে পাশ্চাত্য সমাজ মানস্তাত্ত্বিক সমস্যা ও সামাজিক বিবাদ বিসম্বাদে জর্জরিত হয়ে পড়েছে যা সর্বক্ষণ সমাজকে অস্থিতিশীল রাখছে এবং তাকে ধ্বংসের হুমকি দিচ্ছে। সুতরাং মুসলমানদেরে জন্য উপলব্ধি করা খুবই প্রয়োজন যে, পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব কিছুই বৈশিষ্ট্যর দিকে থেকে বস্তুগত নয়। সমাজ বিজ্ঞানের বিষয়গুলো কীভাবে উপলক্ষ্য সম্পর্কীয় তা উপলব্ধি করা কষ্টকর না হলে বিজ্ঞান বাস্তবিকই যে পৃথক ধরনের তা বুঝতে পারা কষ্টকর হওয়া উচিত নয়। কোন পার্থক্য থেকে থাকলে তা হবে শুধু মাত্রার। বাস্তবিক বিজ্ঞান গবষক গবেষণা বিশৃঙ্খলভাবে হয় না। অপরপক্ষে এগুলো মানবীয় লক্ষ্য ও আধ্যাত্মিক বিবেচনা প্রসূত। এগুলো পাশ্চাত্য ধাঁচের মনের সৃষ্টি ও নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে সঙ্কল্পবদ্ধ। বিদেশী সভ্যতার সব বিজ্ঞানের এ প্রেক্ষাপট থেকে দেখা প্রয়োজন।
বিজ্ঞানের বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে সত্যিকারভাবে বলতে গেলে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ ইসলামী চিন্তাধারা প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয়, প্রাকৃতিক আইন, প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্পর্কিত অধ্যয়নে শুধু সীমিত যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হয় না বরং এর সাথে ওহীর ব্যাপক ও বিশ্বনবীর জ্ঞানকে সমন্বিত করে অগ্রসর হয় যাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান সত্যিকার রূপ নিয়ে উপস্থাপিত হয় এবং মানবজাতির পার্থিব ও আধ্যাত্মিক প্রয়োজন উভয়টাই পূরণ হয়।
সাধারণভাবে জ্ঞানের এবং বিশেষভাবে বিজ্ঞানের ইসলামিকরণ বলতে এটি বুঝায় কোনো প্রয়োজন নেই যে, বিজ্ঞানের বস্তুগত ও পেশাদারী বিষয়গুলো পৃথক হবে। বরং এর তাত্পর্য হচ্ছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রচেষ্টায় দিকনির্দেশনা প্রদান করা, যাতে এগুলো সত্যিকার অর্থে মানবজাতির সর্বোত্তম স্বার্থে পরিচালিত হয়। এভাবে ইসলামিকরণের অর্থ হলো সঠিক নির্দেশনা, সঠিক লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং সঠিক দর্শন। এভাবেই ইসলামী জ্ঞান প্রকৃতিগতভাবে সংস্কারমূলক, গঠনমূলক, নৈতিক, সঠিকভাবে পরিচালিত এবং তাওহীদী।
ইসলামিকরণের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো যে, তাকে মানবজাতির কাছে এমন এক চিত্র তুলে ধরতে হবে যাতে পৃথিবীর সংস্কার ও গঠনমূলক হিফাজত বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পরিপূর্ণ করার জন্য বিজ্ঞানকে মানবজাতি ও খেলাফতের সেবায় নিয়োগ করা যায়। এটি বাস্তবিকই বিস্ময়কর যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার ছায়াতলে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ অথবা দ্রুত ক্ষেপণযোগ্য ও অধিকতর ক্ষমতাসম্পন্ন মারাত্মক মারণাস্ত্র উত্পাদ ছাড়া মানবজাতির জন্য মহত্তর বা বৃহত্তর কিছু নেই। (এ ধরণের ব্যবস্থাপনায় যাদের কাছে সর্বাধিক পরিমাণ মানণাস্ত্র, ক্ষমতা ও সম্পদ আছে সত্য সব সময় তাদের সাথেই থাকবে।) নিশ্চিতভাবেই বর্তমানে এমন এক সন্ধিক্ষণে পৌছেছে যেখানে তার ভবিষ্যতের জন্য খোদায়ী নির্দেশনা আগের তুলনায় আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ইসলামের সর্বাত্মক দর্শনের জরুরি প্রয়োজন দেখা দিয়েছে এবং যেখানে গঠনমূলক ও সংস্কারধর্মী সভ্যতার প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে যাহোক, এটি জীবন্ত এক উদাহরণ।