হাদীসের পরিচয়
জিলহজ্জ আলী
হাদীস
হাদীস আরবী শব্দ। আরবী অভিধান ও কোরআনের ব্যবহার অনুযায়ী ‘হাদীস’ শব্দের অর্থ- কথা,বাণী,বার্তা,সংবাদ,বিষয়,খবর ও ব্যাপার ইত্যাদি।
‘হাদীস’ শুধুমাত্র একটি আভিধানিক শব্দ নয়। মূলতঃ ‘হাদীস’ শব্দটি ইসলামের এক বিশেষ পরিভাষা। সে অনুযায়ী রাসূল(সাঃ)-এর কথা,কাজের বিবরণ কিংবা কথা,কাজের সমর্থন এবং অনুমোদন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত,ইসলামী পরিভাষায় তাই-ই ‘হাদীস’ নামে অভিহিত।
ব্যাপক অর্থে সাহাবীদের কথা,কাজ ও সমর্থন এবং তাবেয়ীদের কথা কাজ ও সমর্থনকেও হাদীস বলে।
কিন্তু,সাহাবা,তাবেয়ীগনের ন্যায় তাবে তাবেয়ীনের কথা,কাজ ও সমর্থনের বিবরণও যে কোরআন হাদীসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং বাস্তবে রূপায়নের দৃষ্টিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় জিনিস তাতে সন্দেহ নেই।
যেহেতু রাসূলে করীম (সাঃ),সাহাবায়ে কেরাম,তাবেয়ী এবং তাবে তাবেয়ীগণের কথা কাজ ও সমর্থন একই মূল বিষয়কে কেন্দ্র করেই প্রচলিত, সেই জন্য মোটামুটিভাবে সবগুলিকেই ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করা হয়।
কিন্তু তবুও শরীয়তী মর্যাদার দৃষ্টিতে এই সবের মধ্যে পার্থক্য থাকায় প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আলাদা পরিভাষা নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা- নবী করীম(সাঃ)-এর কথা কাজ ও অনুমোদনকে বলা হয় ‘হাদীস’।
সাহাবাদের কথা কাজ ও অনুমোদনকে বলা হয় ‘আছার’। তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীনদের কথা কাজ ও অনুমোদনকে বলা হয় ‘ফতোয়া’।
হাদীসের উৎসঃ হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) আল্লাহ মনোনীত সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল ছিলেন। সাথে সাথে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষও ছিলেন। এই জন্যে রাসূল(সাঃ)
এর জীবনের কার্যাবলীকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়-
ক. যা তিনি নবী ও রাসূল পদের দায়িত্ব পালন করার জন্য করেছেন।
খ. যা তিনি অন্য মানুষের মত মানুষ হিসেবে করেছেন। যেমন-খাওয়া-পরা,চলা-ফেরা- ইত্যাদি।প্রথম শ্রেণীর কাজ সমস্তই আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণাধীনে সম্পাদিত হয়েছে। অবশ্য দ্বিতীয় শ্রেণীর কাজ এ ধরনের নয়। হাদীস সম্মন্ধে বলতে গিয়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী(র.) বলেন, রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-এর হাদীস প্রদানত দুই প্রকারের-
প্রথম প্রকারঃ যাতে তার নবুওত ও রেসালাতের (নবী ও রাসূল পদের)দায়িত্ব সম্পর্কীয় বিষয়সমূহ রয়েছে। নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ এর অন্তর্গত-
১/ যাতে- পরকাল বা উর্ধ্ব জগতের কোন বিষয় রয়েছে। এর উৎস ওহী।
২/ যাতে- এবাদত ও বিভিন্ন স্তরের সমাজ ব্যবস্থার নিয়ম- শৃংখলাদি বিষয় রয়েছে। এর কোনটি উৎস ওহী আর কোনটির উৎস স্বয়ং রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-র ইজতেহাদ। কিন্তু রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-র ইজতেহাদও ওহীর সমপর্যায়ের।কেননা,আল্লাহ তা’আলা তাকে শরীয়ত সম্পর্কে কোন ভুল সিদ্ধান্তের ওপর অবস্থান করা হতে রক্ষা করেছেন।
৩/যাতে-এমন সকল জনকল্যাণকর ও নীতি কথাসমূহ রয়েছে,যে সকলের কোন সীমা বা সময় নির্ধারিত করা হয়নি। (অর্থাৎ,যা সার্বজনীন ও সার্বকালীন) যথা,আখলাক বা চরিত্র বিষয়ক কথা। এর উৎস সাধারণত তার ইজতেহাদ।
৪/যাতে- কোন আমল বা কার্য অথবা কার্যকারকের ফজীলত বা মহত্ত্বের কথা রয়েছে।এর কোনটির উৎস ওহী আর কোনটির উৎস তার ইজতেহাদ।
দ্বিতীয় প্রকারঃ –যাতে তার নবুওত ও রেসালাতের দায়িত্বের অন্তর্গত নয়,এরূপ বিষয়াবলী রয়েছে। নিম্নলিখিত বিষয়াবলী এর অন্তর্গত-
১/যাতে- চাষাবাদ জাতীয় কোন কথা রয়েছে।যথা-তাবীরে নখলের কথা।
২/যাতে- চিকিৎসা বিষয়ক কোন কথা রয়েছে।
৩/যাতে-কোন বস্তুর বা জন্তুর গূণাগুণের কথা রয়েছে।যথা, ‘ঘোড়া কিনতে গভীর কাল রং সাদা কপাল দেখে কিনবে।‘
৪/যাতে-সে সব কাজের কথা রয়েছে যে সব কাজ তিনি এবাদত রূপে নয় বরং অভ্যাস বশত অথবা সংকল্প ব্যতিরেকে ঘটনাক্রমে করেছেন।
৫/যাতে-আরবদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনীসমূহের মধ্যে তার কোন কাহিণী বর্ণনার কথা রয়েছে।যথা,উম্মেজারা ও খোরাফার কাহিনী।
৬/যাতে-সার্বজনীন,সার্বকালীন নয় বরং সমকালীণ কোন বিশেষ মোসলেহাতের কথা রয়েছে।যথা,সৈন্য পরিচালনা কৌশল।
৭/যাতে-তার কোন বিশেষ ফয়সালা বা বিচার সিদ্ধান্তের কথা রয়েছে।
এসবের মধ্যে কোনটির উৎস তার অভিজ্ঞতা,কোনটির উৎস ধারণা,কোনটির উৎস আদত-অভ্যাস,কোনটির উৎস দেশ-প্রথা আর কোনটির উৎস সাক্ষ্যপ্রমাণ(যথা,বিচার সিদ্ধান্ত)।(হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাস,পৃ-২)
প্রথম প্রকার হাদীসের অনুসরণ করতে আমরা বাধ্য এবং দ্বিতীয় প্রকার হাদীসও আমাদের অনুকরণীয়।
হাদীস শাস্ত্রের কতিপয় পরিভাষা
সাহাবীঃ যে ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় রাসূলে করীম(সাঃ) কে একটুক্ষণের জন্যে হলেও দেখেছেন,অন্তত একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি সাহাবী। কথাগুলো মেশকাত শরীফের ভাষায় বলা যায়।
যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে –
ক। রাসূলুল্লাহ(সাঃ)-এর সাহচর্য লাভ করেছেন বা খ। তাকে দেখেছেন এবং তার একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন অথবা গ। তাকে একবার দেখেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন তাকে ‘সাহাবী’ বলে।
তাবেয়ীঃ যিনি বা যারা ঈমানের সাথে কোন সাহাবীর সাহচর্য লাভ করেছেন,তার নিকট থেকে ইসলামী জ্ঞান আহরণ করেছেন এবং সাহাবীদের অনুকরণ অনুসরন করেছেন তাদেরকে ‘তাবেয়ী’ বলে। কোন কোন মুহাদ্দিসের মতে সাহাবী থেকে যিনি অন্তত একটি হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন।
তাবে তাবেয়ীঃ একই নিয়ম অনুযায়ী যিনি বা যারা তাবেয়ীদের সাহচর্য লাভ করেছেন বা একটু সময়ের জন্যেও দেখেছেন,তাদের অনুকরণ অনুসরণ করেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন তারাই ‘তাবে তাবেয়ী’।
রেওয়ায়েতঃ হাদীস বা আছার বর্ণনা করাকে ‘রেওয়ায়েত’ বলে।
রাবীঃ হাদীস বা আছার বর্ণনাকারীকে ‘রাবী’ বলে।
রেওয়ায়েত বিল মা’নাঃ অর্থের গুরুত্ব সহকারে হাদীস বর্ণনা করাকে ‘রেওয়ায়েত বিল মা’না’ বলে।
রেওয়ায়েত বিল লবজিহিঃ হুবহু অর্থাৎ নবী করীম(সাঃ)-এর সাহাবী,তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীনদের মুখনিঃসৃত শব্দ গুলিসহ হাদীস বর্ণনা করাকে ‘রেওয়ায়েত বিল লবজিহি’ বলে। এ ধরনের হাদীসের গুরুত্ব সব চাইতে বেশী।
মুনকার ও রেওয়ায়েতঃ যে দুর্বল বর্ণনাকারী রেওয়ায়েত বা হাদীস তদপেক্ষা সর্ব বর্ণনাকারীর রেওয়াতের পরিপন্থী হয় তাকে ‘মুনকার রেওয়ায়েত’ বলে।
দেরায়াতঃ হাদীসের মতন বা মূল বিষয়ে অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যুক্তির কষ্টিপাথরে যে সমালোচনা করা হয় হাদীস বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকে দেরায়াত বলে।
“এটাকে হাদীস সমালোচনা যুক্তি-ভিত্তিক প্রক্রিয়াও বলা যেতে পারে।এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক রয়েছে।তবে এর সারকথা এই যে, এতে হাদীসের মর্মকথা টুকুতে কোন ভুল,অসত্য,অবাস্তবতা এবং কোরআন ও সহীহ হাদীসের পরিপন্থী কিছু থাকলে এই পন্থার যাচাই-পরীক্ষায় তা ধরা পড়তে পারে না।অতএব কেবল মাত্র এই পদ্ধতিতে যাচাই করে কোন হাদীস উত্তীর্ণ পেলেই তা গ্রহণ করা যেতে পারে না।এই কারণে মূল হাদীস(মতন)-হাদীসের মর্মবাণীটুকু তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিবেচনার মানদন্ডে যাচাই করার উদ্দেশ্যে এই ‘দেরায়াত’ প্রক্রিয়ার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। হাদীস যাচাই পরীক্ষার ব্যাপারে ‘দেরায়াত’ নীতির প্রয়োগ ‘রেওয়ায়েত’ নীতির মতই কোরআন ও হাদীস সম্মত। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই কেবলমাত্র ‘রেওয়ায়েতের উপর নির্ভরশীল কোণ কথা গ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্ত করিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বরং দেরায়াত নীতির প্রয়োগ করতে কোরআনের বিভিন্ন স্থানে উৎসাহিত করেছেন।“ [হাদীস সংকলনের ইতিহাস-৬৫০ পৃ.]
যেমন- মদিনার মুনাফিকগণ হযরত আয়েশা(রাঃ)-এর নামে কুৎসা রটাচ্ছিল তখন কিছু সংখ্যক মুসলমানও কোন রকম বিচার বিবেচনা বাদেই তা বিশ্বাস করেন। এদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহপাক কোরআনের এই আয়াত নাযিল করেন “তোমরা যখন সে কথা শুনতে পেয়েছিলে তখন তোমরা (শুনে) কেন বললে না যে, এ ধরনের কথা বলা আমাদের কিছুতেই উচিত নয়। তখন বলা উচিত ছিল যে,খোদা পবিত্র মহান,এ এক সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা ও বিরাট দোষারোপ ছাড়া আর কিছুই নয়,এ কথা সত্য হয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।’’ [সূরা নূর-৮১ আয়াত]
এখানে বলা হচ্ছে –যখন এ ধরনের অবিশ্বাস্য সংবাদ পৌঁছেছিল তখনই তা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া উচিৎ ছিলো এবং এর প্রচার-প্রসার বন্ধ করাও জরুরী ছিল।তাৎক্ষনিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার এই জ্ঞানই দেরায়াত নীতির প্রয়োগ।
দেরায়াত প্রক্রিয়ার মূল নীতিগুলো হল-
১/হাদীস-কোরআনের সুস্পষ্ট দলীলের বিপরীত হবে না।
২/হাদীস-মুতাওয়াতের সূত্রে প্রমাণীত সুন্নাতের বিপরীত হবে না।
৩/হাদীস-সাহাবায়ে কিরামের সুস্পষ্ট ও অকাট্য ইজমার বিপরীত হবে না।
৪/হাদীস-সুস্পষ্ট বিবেক বুদ্ধির বিপরীত হবে না।
৫/হাদীস-শরীয়তের চির সমর্থিত ও সর্বসম্মত নীতির বিপরীত হবে না।
৬/কোন হাদীস বিশুদ্ধ ও নির্ভুল গৃহীত হাদীসের বিপরীত হবে না।
৭/হাদীসের ভাষা আরবী ভাষার রীতি নীতির বিপরীত হবে না।কেননা নবী করীম(সাঃ) কোন কথাই আরবী নীতির বিপরীত ভাষায় বলেন নি।
৮/হাদীস-এমন কোন অর্থ প্রকাশ করবে না,যা অত্যন্ত হাস্যকর,নবীর মর্যাদা বিনষ্টকারী।
মরবি আনহুঃ যার নিকট থেকে হাদীস বা আছার বর্ণনা করা হয় তাকে ‘মরবি আনহু/ বলে।
সনদঃ হাদীসের মূল কথাটুকু যে সূত্র ও যে বর্ণনা পরম্পরা ধারায় গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌছেছে তাকে ইলমে হাদীসের পরিভাষায় সনদ বলে।
ইসনাদঃ মুখে মুখে হাদীসের সনদ আবৃতি করাকে ‘ইসনাদ’ বলে।
মতনঃ সনদ বাদে মূল কথা ও তার শব্দসমূহ হচ্ছে ‘মতন’।
রেজালঃ হাদীসের রাবী সমষ্টিকে ‘রেজাল’ বলে।
আসমাউর রেজালঃ যে শাস্ত্রে রাবীদের জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়েছে তাকে ‘আসমাউর রেজাল’ বলে।
আসমাউর রেজাল সম্পর্কে ডঃ স্প্রেনগার তার “লাইফ অব মুহাম্মদ।“ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন—–
দুনিয়ায় এমন কোন জাতি দেখা যায়নি এবং আজও নেই যারা মুসলমানদের ন্যায় ‘আসমাউর রেজালের’ বিরাট তত্ত্ব ভান্ডার আবিষ্কার করেছে। আর এর বদৌলতে আজ পাঁচ লাখ লোকের বিবরণ জানা যেতে পারে।
আদালতঃ মানুষের ভিতরের যে আদিম শক্তি তাকে ‘তাকওয়া’ ও ‘মরুওত’ অবলম্বন করতে (এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত রাখতে) উদ্বুদ্ধ করে তাকে ‘আদালত’ বলে। ‘তাকওয়া’অর্থে এখানে শিরক,বেদাআত ফিছক ও প্রকৃতি কবীরা এবং বারবার করা সগীরা গুনাহ থেকে বেচে থাকাকে বুঝায়,’মরুওত’ সর্বপ্রকার বদ রসম রেওয়াজ থেকে দূরে থাকাকে বুঝায়’ যদিও তা মুবাহ হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়-হাটে বাজারে প্রকাশ্যে পানাহার করা বা রাস্তাঘাটে প্রস্রাব করা ইত্যাদি।
আ’দেলঃ যে যে ব্যক্তি ‘তাকওয়া’ ও ‘মরুওত’ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তাকে আ’দেল বলে অর্থাৎ যিনি
১/ হাদীস সম্পর্কে মিথ্যাবাদী বলে প্রতিপন্ন হননি,
২/সাধারণ কাজ কারবার মিথ্যাবাদী বলে কখনো সাব্যস্ত হননি,
৩/অজ্ঞাতনামা অপরিচিত অর্থাৎ দোষ গুণ বিচারের জন্য যার জীবনী জানা যায় নি এরূপ লোকও নন,
৪/বে-আমল ফাছেকও নন,অথবা
৫/বদ-এতেকাদ বেদাআতীয়ও নন তাকে আ’দেল বলে।
মুহাদ্দিসগণের মতে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবীগণ কোন প্রকার মিথ্যার আশ্রয় নেননি।তাই তাদের সর্ব স্বীকৃত মত হচ্ছে –‘সকল সাহাবীই আ’দেল অর্থাৎ সত্যবাদী।
জবতঃ জবত হলো সেই শক্তি যা মানুষের শ্রুত ও লিখিত জিনিসের বিন্যাস থেকে রক্ষা করে অর্থাৎ স্মৃতিপটে জাগরিত করে হুবহু যখন তখন অপরের নিকট পৌছাতে পারে।
জাবেতঃ যে ব্যক্তি জবত গুণসম্পন্ন তাকে ‘জাবেত’ বলে।
ছেকাহঃ যে ব্যক্তির মধ্যে আ’দল গুণ পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যাবে তাকে ‘ছেকাহ’ বলে।
আসহাবে সুফফাঃ যে সমস্ত সাহাবী সব সময় রাসূল(সাঃ)-এর সাহচর্যে থাকতেন অর্থাৎ রাসূলের(সাঃ)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ছিলেন এবং তার আদেশ নিষেধ শুনতেন ও কন্ঠস্থ করতেন এই নির্দিষ্ট সংখ্যক সাহাবীকে ‘আসহাবে সুফফা’ বলে।
মুহাদ্দিসঃ যিনি হাদীস শাস্ত্রে পন্ডিত অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ বা বিশারদ। যিনি হাদীস চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যক হাদীসের সনদ মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাকেই মুহাদ্দিস বলে। মুহাদ্দিসগণ হাদীস শাস্ত্রের ওপর গবেষণায় নিয়োজিত থাকেন।
শায়খঃ যিনি হাদীস শিক্ষা দেন সেই রাবীকে তার শাগরিদের তুলনায় ‘শায়খ’ বলে।
হাফেজঃ যিনি সনদ ও মতনের সমস্ত বৃত্তান্ত সহ একলক্ষ হাদীস আয়ত্ত বা মুখস্ত করেছেন তাকে ‘হাফেজ’ বা ‘হাফেজে হাদীস’ বলে।
হুজ্জাতঃ যিনি সনদ ও মতনের সমস্ত বৃতান্ত সহ তিন লক্ষ হাদীস মুখস্ত করেছেন বা আয়ত্ত করেছেন তাকে ‘হুজ্জাত’ বা ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ বলে।
হাকেমঃ যিনি সনদ ও মতনের সমস্ত বৃত্তান্তসহ সমস্ত হাদীস আয়ত্ত করেছেন তাকে ‘হাকেম’ বলে।
ফকীহঃ যারা হাদীসের আইনগত দিক পর্যালোচনা করেছেন তাদেরকে ‘ফকীহ’ বলে।
মোতাকাল্লেমীনঃ যে সমস্ত ব্যক্তিগণ হাদীস সম্পর্কিত দার্শনিক তথ্য পেশ করেছেন তাদেরকে ‘মোতাকাল্লেমীন’ বলে।
শায়খাইনঃ ইমাম বোখারী ও মুসলিমকে একত্রে ‘শায়খাইন’ বলে।(এখানে একটি কথা জেনে রাখা ভাল যে,খোলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে শায়খাইন বলতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক(রাঃ) ও হযরত ওমর(রাঃ)কেই বুঝায়।এভাবে হানাফী ফেকায় শায়খাইন বলতে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আবু ইউসুফকেই বুঝায়)।
সেয়াহ সেত্তাঃ যে ছয়খানা হাদীস গ্রন্থ ইসলামের ইতিহাসে অধিকতর বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়েছে তাকে “সেয়াহ সেত্তাহ” বলে।এগুলি হচ্ছে—
১. বোখারী শরীফ ২. মুসলিম শরীফ ৩. আবু দাউদ শরিফ ৪. তিরমিজী শরিফ ৫. নাসায়ী শরীফ ৬. ইবনে মাজাহ শরীফ। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে ষষ্ঠ নম্বরের হাদীস গ্রন্থ কোন খানা হবে এ নিয়ে বেশ মতভেদ আছে। বিশিষ্ট আলেমগণের অনেকেই ইবনে মাজাহর স্থলে ‘মোআত্তা ইমাম মালেক’ কে আবার কেউ কেউ ‘সুনানে দারেমীকে’ ই সেয়াহ সেত্তার শামীল করেন।
সহীহাইনঃ হাদীস শাস্ত্রে বোখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফের স্থান সর্ব উচ্চে। তাই বোখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফকে একত্রে ‘সহীহাইন’ বলে।
সুনানে আরবা সেয়াহ সেত্তার অন্তর্গত অপর চারখানি হাদীস গ্রন্থ (আবু দাউদ,তিরমিজী,নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ)কে এক সঙ্গে ‘সুনানে আরবা’ বলে।
মোত্তাফাকুন আলাইহিঃ যদি কোন হাদীস একই সাহাবীর নিকট হতে ইমাম বোখারী ও মুসলিম উভয় গ্রহণ করে থাকেন তবে সেই হাদীসকে ‘মোত্তাফাকুন আলাইহি’ বলে।