হাদীসের কিতাবের বিভাগ
জামেঃ হাদীসকে বিষয় বস্তু অনুসারে সাজানো হয়েছে এবং সমস্ত প্রধান প্রধানগুলো সন্নিবেশিত যে হাদীস গ্রন্থ তাকে ‘জামে’ বলে।যেমন-‘জামে’ সহীহ বোখারী।
সুনানঃ যে হাদীস গ্রন্থে হাদীসকে বিষয়বস্তু অনুসারে সাজানো হয়েছে সেখানে কেবলমাত্র তাহারাত,নামায,রোযা,প্রভৃতি আহকামের হাদীসসমূহ সংগ্রহের দিকেই বেশী নজর দেয়া হয়েছে তাকে ‘সুনান’ বলে।যেমন-সুনানে আবু দাউদ।
মুসনাদঃ হাদীসসমূহকে সাহাবীদের নামানুসারে সাজানো হয়েছে এবং এক একজন সাহাবী বর্ণিত হাদীসসমূহকে একটি মাত্র হাদীস গ্রন্থে স্থান দেয়া হয়েছে-এমন হাদীসগ্রন্থকে ‘মুসনাদ’ বলে। যেমন-মুসনাদ ইবনে আহম্মদ।
মোয়াজামঃ মোয়াজাম বলে সেই হাদীস গ্রন্থকেই যাতে হাদীসসমূহ শায়খ ও উস্তাদদের নামানুসারে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। যেমন-মোয়াজাম ইবনে কানেয়।
রেসালাহঃ মাত্র একটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই যে হাদীসগ্রন্থ রচিত হয়েছে তাকে ‘রেসালাহ বলে’। যেমন-ইবনে খোজাইমা।এ হাদীস গ্রন্থে আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কিত হাদীস একত্রিত করা হয়েছে।
হাদীসের কিতাবের স্তর
হাদীসের কিতাবসমূহকে মোটামুটি পাঁচভাগে ভাগ করা হয়েছে। ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা’ তে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী(রঃ) হাদীসের কিতাবসমূহকে পাঁচভাগে ভাগ করেছেন।
দ্বিতীয় স্তরঃ ‘নাসায়ী শরীফ’,’আবু দাউদ শরীফ’,’তিরমিজী শরীফ’ এ স্তরের কিতাব। অবশ্য ‘মুসনাদে ইমাম আহমদ’ কে এ স্তরে শামিল করার পক্ষে মত দিয়েছেন- সুনানে দারেমী,সুনানে ইবনে মাজাহ এবং শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী(রঃ)। এ কিতাবগুলি প্রথম স্তরের কাছাকাছি। এতে সহীহ ও হাসান হাদীসই রয়েছে। জয়ীফ হাদীসের পরিমাণ খুবই নগণ্য। মূলত সকল মাজহাবের ফকীহগণ এ দুস্তরের হাদীসের ওপরই নির্ভরশীল।
তৃতীয় স্তরঃ মুসনাদে আবু ইয়ালা,মোসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, মোসান্নাফে আবু বকর ইবনে আবু শাইবাহ,মুসনাদে আবদ ইবনে হোমাইদ,মুসনাদে তায়ালাছী এবং বায়হাকী,তাহাবী ও তাবরানীর কিতাবসমূহ এ স্তরের অন্তর্ভূক্ত।
এ স্তরের কিতাবসমূহে সহীহ,হাসান,জয়ীফ,শাজ্জ,মোনকার ইত্যাদি সকল প্রকার হাদীস রয়েছে। এ জন্য পন্ডিতদের বাছাই ব্যতীত এ সকল কিতাবের হাদীস গ্রহণ করা যাবে না।
চতুর্থ স্তরঃ ইবনে হিব্বানের ‘কিতাবুল জুয়াফা”, ইবনে আসীরের কামেল, এবং আবু নোয়াইম,ইবনে আসাকির,জাওজাকানী,খাতাবী বাগদাদী, ইবনে নাজ্জার ও ফেরদৌস দায়লামীর কিতাবসমূহ এ স্তরের কিতাব। মুসনাদে খাওয়ারেজমীও এ স্তরের যোগ্য। এ স্তরের কিতাবস্মূহে সাধারণত জয়ীফ ও গ্রহণে অযোগ্য হাদীসই রয়েছে।
পঞ্চম স্তরঃ উপরিউক্ত স্তরে যে সকল কিতাবের স্থান হয়নি সে সকল কিতাবই এ স্তরের কিতাব।
খবরঃ হাদীসকে আরবী ভাষায় খবরও বলা হয়। কিন্তু পার্থক্য এই যে খবর শব্দটি হাদীস অপেক্ষা ব্যাপক অর্থবোধক। যুগপৎভাবে হাদিস ও ইতিহাস উভয়কেই বুঝায়।
সুন্নাতঃ সফীউদ্দিন আল হাম্বলি লিখেছেন-সুন্নাত বলতে বুঝায় কোরআন ছাড়া রাসূলের সব কথা,কাজ ও সমর্থন।
তবুও আমরা হাদীস ও সুন্নাতের মধ্যে কিছু পার্থক্য দেখতে পাই- সূন্নাত শব্দটি সম্পূর্ণরুপে ও সর্বতোভাবে হাদীস শব্দের সমান নয়। কেননা ‘সূন্নাত’ হলো রাসূলের (সাঃ) বাস্তব কর্মনীতি, আর ‘হাদীস’ বলতে রাসূলের কাজ ছাড়াও কথা ও সমর্থন বুঝায়।
হাদীসের শ্রেণী বিভাগ
হাদীস শাস্ত্রের পন্ডিতগণ হাদীসকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন- ১। কাওলী ২। ফে’লী ৩। তাকরীরি।
কাওলীঃ আদেশ,নিষেধ অথবা অন্যান্য যত প্রকার মৌখিক বর্ণনা আছে তাকে ‘হাদীসে কাওলী’ বলে।
উদাহরণঃ হযরত আনাস(রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে,তিনি বলেছেন হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন-ফাসেক ব্যাক্তির প্রশংসা ও স্তুতি করা হলে আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট ও ক্রদ্ধ হন এবং এ কারনে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।(বায়হাকী)
এই হাদীসটি রাসূল (সাঃ)-র একটি বিশেষ কথার উল্লেখ থাকার কারণে এটা কাওলী হাদীস।
ফে’লীঃ কাজ-কর্ম,আচার-ব্যবহার,উঠা-বসা,লেন-দেন সম্পর্কীয় কথাগুলোকে ‘হাদীসে ফে’লী’ বলে।
উদাহরণঃ হযরত আবু মুসা(রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে,তিনি বলেছেন আমি রাসূলে করীম(সাঃ) কে মোরগের গোশর খেতে দেখেছি।(বোখারী ও মূসলিম)
এই হাদীসটিতে রাসূলের(সাঃ) র একটি কাজের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এই জন্য এটি ‘হাদীসে ফে’লী’।
তাকরীরিঃ অনুমোদন বা সমর্থন জ্ঞাপন সূচক হাদীস।দেখা গেছে অনেক সময় সাহাবীগণ অনেক কাজ করেছেন,যে কাজের ব্যাপারে রাসূল(সাঃ) সমর্থন দিয়েছেন অথবা মৌনতার মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছেন,এই ধরনের হাদীসকে ‘তাকরীরী হাদীস’ বলে।
হাদীসের দ্বিতীয় প্রকার শ্রেণী বিভাগ
বর্ণনাকারীদের (রাবী) সিলসিলা অনুযায়ী হাদীসকে তিনভাগে ভাগ করা যায়ঃ
ক। মারফু খ। মওকুফ গ। মাকতু
মারফুঃ যে হাদীসের সনদ বা সূত্র নবী করীম(সাঃ) পর্যন্ত পৌছেছে তাকে ‘মারফু হাদীস’ বলে। অর্থাৎ যে সূত্রের মাধ্যমে স্বয়ং রাসূলের কোন কথা,কোন কাজ করার বিবরণ কিংবা কোন বিষয়ের অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে,যে সনদের ধারাবাহিকতা রাসূল করীম(সাঃ) থেকে হাদীস গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত হয়েছে এবং মাঝখান থেকে একজন বর্ণনাকারীও বাদ পড়েনি তা ‘হাদীসে মারফু’ নামে পরিচিত।
মওকুফঃ যদি কোন সাহাবীর সনদ রাসূল(সাঃ) পর্যন্ত না পৌছে,সাহাবী পর্যন্ত গিয়েই স্থগিত হয়-অর্থাৎ যা স্বয়ং সাহাবীর হাদীস বলে সাব্যস্ত হয় তাকে ‘হাদীসে মওকুফ’ বলে।
ইমাম নববী এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন
‘যাতে কোন সাহাবীর কথা কাজ কিংবা অনুরূপ কিছু বর্ণিত হয়-তা পর পর মিলিত বর্ণনাকারীদের দ্বারা বর্ণিত হোক কিংবা মাঝখানে কোন বর্ণনা কারীর অনুপস্থিতি ঘটুক তা ‘মওকুফ হাদীস’।
মাকতুঃ যে হাদীসে রাবীদের ধারাবাহিকতা কোন তাবেয়ী পর্যন্ত পৌছেছে অর্থাৎ তাবেয়ীর হাদীস বলেই প্রমাণিত হয়েছে তাকে ‘হাদীসে মাকতু’ বলে।
হাদীসের তৃতীয় প্রকার শ্রেণিবিভাগ
রাবীদের বাদ পড়ার দিক থেকে হাদীস দু’প্রকার যথাঃ ১.মোত্তাছিল ২. গায়রে মোত্তাছিল।
মোত্তাসিলঃ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত হয়েছে,কোন রাবী বাদ বা উহ্য থাকেনি তাকে মোত্তাসিল বলে।
গায়রে মোত্তাসিলঃ সূত্র অসংলগ্ন অর্থাৎ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি,কোন না কোন স্থানের রাবী বাদ পড়েছে বা উহ্য রয়েছে এ ধরনের হাদীসকে ‘গায়রে মোত্তাসিল’ বলে।
হাদীসে গায়রে মোত্তাসিল আবার কয়েক প্রকারঃ
ক। মু’আল্লাক
খ। মুরসাল
গ। মুনতাকা
ঘ। মুদাল্লাস
ঙ। মো’দাল
মু’আল্লাকঃ হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে যদি প্রথম অংশেই রাবী বাদ পড়ে যায় তবে তাকে ‘মু’আল্লাক হাদীস’ বলে।
মুরসালঃ হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে যদি সনদের শেষাংসের রাবীর নাম বাদ পড়ে তবে তাকে ‘মুরসাল’ বলে।
মুনতাকাঃ অসংলগ্ন সূত্রের অর্থাৎ বর্ণনার সময় রাবী বাদ পড়েছে এমন যে কোন হাদীসকে ‘মুনতাকা’ বলা যায়। ইনতাকা শব্দের আভিধানিক অর্থ ছিন্ন হয়া। অতএব প্রত্যেক ছিন্ন সূত্রের হাদীসকে ‘মুনতাকা’ বলা যেতে পারে।
মো’দালঃ হাদীস বর্ণনার সময় যদি সনদ থেকে দুই বা ততোধিক রাবী বাদ পড়ে যায় তবে তাকে মো’দাল বলে।
মুদাল্লাসঃ যে হাদীসের রাবী নিজের প্রকৃত শায়খের নাম না করে তার ওপরস্থ শায়খের নামে এরূপভাবে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে মনে হয় তিনি নিজেই তা উপরিউক্ত শায়খের নিকট থেকে শুনেছেন অথচ তিনি নিজে তা তার নিকট থেকে শুনেননি (বরং তা তার প্রকৃত উস্তাদের নিকট শুনেছেন) সে হাদীসকে মুদাল্লাসা বলে এবং এইরূপ করাকে ‘তাদলীস’ বলে। আর যিনি এইরূপ করেছেন তাকে ‘মুদাল্লেস’ বলে। মুদাল্লেসের হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়- যে পর্যন্ত না তিনি একমাত্র ছেকাহ রাবী হতে তাদলীছ করেন বলে সাব্যস্ত হন অথবা তিনি তা আপন শায়খের নিকট শুনেছেন বলে পরিষ্কারভাবে বলে দেন।
বর্ণনার দুর্বলতার জন্য হাদীসের প্রকারভেদ
এ ধরনের হাদীস আবার কয়েক প্রকার-
১. মুজতারাব ২. মুদরাজ ৩. মাকলুব ৪. শাহ’জ ৫. মুনকার ৬. মুআল্লাল।
মুজতারাবঃ যদি কোন রাবী হাদীস বর্ণনার সময় সনদ ওলট পালট করে ফেলেন—– যেমন আবু হুরায়রার স্থানে আবু যুবাইর বললেন বা এক স্থানের শব্দ অন্য স্থানে লাগালেন অথবা একজনের নিকট একটি হাদীস একরকম বর্ণনা করে অন্য লোকের নিকট ঐ হাদীসই আবার আরেক রকম বর্ণনা করলেন এই ধরনের হাদীসকে ‘মুজতারাব’ বলে। এটা গ্রহণযোগ্য হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না এর সঠিকতা প্রমাণিত হয়।
মুদরাজঃ যদি কোন রাবী হাদীস বর্ণনা করার সময় নিজের কথা অথবা অন্য কারো কথা শামিল করে দেয় তার সেই হাদীসকে ‘মুদরাজ’ বলে।আর এইরূপ করাকে ‘ইদরাজ’ বা শামিল করা বলে। যদি ঐ কথা হাদীসের কোন শব্দকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় তা’হলে তা জায়েজ,নতুবা হারাম।
মাকলুবঃ যদি কোন রাবী হাদীস বর্ণনার সময় এক মতনের সনদকে অন্য মতনে জুড়ে বর্ণনা করেন তবে তাকে ‘মাকলুব” বলে।এরূপ কোন ঘটনা ঘটলে ঐ রাবীর স্মরণ শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়।এ প্রকার রাবীর বর্ণনাকৃত হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। তবে যাচাই বাছাই করার পর গ্রহণ করা যেতে পারে।
মাহফুজ ও শা’জঃ কোন সেকাহ রাবীর হাদিস অপর কোন সেকাহ-রাবী বা রাবী গণের হাদীসের বিরোধী হলে,যে হাদীসের রাবীর ‘জবত’ গুণ অধিক বা অপর কোন সূত্র দ্বারা যার হাদীসের সমর্থন পাওয়া যায় অথবা যার হাদীসের শ্রেষ্ঠত্ব অপর কোন কারণে প্রতিপাদিত হয় তার হাদীসটিকে হাদীসে মাহফুজ এবং অপর রাবীর হাদীসটিকে হাদীসে শা’জ বলে এবং এরূপ হওয়াকে ‘শুজুজ’ বলে। ‘শুজুজ’ হাদীসের পক্ষে একটি মারাত্মক দোষ। শা’জ হাদীস সহীহ রূপে গণ্য নহে।
মুনকারঃ জবত গুণ সম্পন্ন নয় এরূপ কোন ব্যক্তি এমন কোন হাদীস বর্ণনা করলো যা অন্য কারো নিকট থেকে শোনা যায়নি এরূপ হাদীসকে ‘মুনকার’ হাদীস বলে।যে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হয়েছে অথবা কোন গুনাহের কাজে লিপ্ত রয়েছে এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীসকে ‘মাতরুক’ বা পরিত্যক্ত হাদীস বলে।
মু-আল্লালঃ যে হাদীসের ভেতর অত্যন্ত সূক্ষ্ম ত্রুটি থাকে যা হাদীসের সাধারণ পন্ডিতগণ ধরতে পারেনা,একমাত্র সুনিপুন শাস্ত্র বিশারদ ব্যতিরেকে। এই প্রকার হাদীসকে ‘মু-আল্লাল’ বলে। এ এরূপ ত্রুটিকে ‘ইল্লত’ বলে। ‘ইল্লত’ হাদীসের পক্ষে মারাত্মক দোষ, এমনকি ‘ইল্লত’ যুক্ত হাদীস সহী হতে পারে না।
রাবীদের যোগ্যতা অনুসারে হাদীসের শ্রেণীবিভাগ
রাবীদের যোগ্যতা অনুসারে হাদীস তিন প্রকার-
১. সহীহ ২. হাসান ৩.জয়ীফ
সহীহঃ যে মুত্তাসিল সনদের রাবীগণ প্রত্যেকেই উত্তম শ্রেণীর আদিল ও জাবিতরূপে পরিচিত অর্থাৎ সেকাহ হওয়ার শর্তাবলী তাদের মধ্যে পূর্ণরূপে বিরাজমান,মূল হাদীসটি সুক্ষ্ম দোষ ত্রুটি অথবা শা’জ বা দল ছাড়া হতে মুক্ত এরূপ হাদীসকে ‘সহীহ হাদীস’ বলে। অন্যভাবে বলা যায় যে হাদীসের বর্ণনা সূত্র ধারাবাহিক রয়েছে,সনদের প্রত্যেক স্তরের বর্ণনাকারীর নাম সঠিকরূপে উল্লেখিত হয়েছে,বর্ণনাকারীগণ সর্বোতভাবে বিশ্বস্ত সেকাহ যাদের স্মরণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর এবং যাদের সংখ্যা কোন স্তরেই মাত্র একজন হয়নি, এরূপ হাদীসকে হাদীসে সহীহ বলে।
সহীহ হাদীসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ইমাম নববী বলেছেন- “যে হাদীসের সনদ নির্ভরযোগ্য ও সঠিক রূপে সংরক্ষণকারী বর্ণনা কারকদের সংযোজনে পরম্পরাপূর্ণ ও যাতে বিরল ও ত্রুটিযুক্ত বর্ণনাকারী একজনও নেই,তাই ‘হাদীসে সহীহ’।
হাসানঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারীর মধ্যে সকল গুণ বর্তমান থাকা সত্ত্বেও যদি স্মরণ শক্তির কিছুটা দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়, তবে সেই হাদীসকে ‘হাদীসে হাসান’ বলে।
জয়ীফঃ উপরিউক্ত হাদীসে সহীহ ও হাদীসে হাসান বর্ণিত গুণগুলি যদি সনদ বর্ণনাকারী রাবীদের মধ্যে কম পরিলক্ষিত হয় তবে তাকে ‘হাদীসে জয়ীফ’ বলে।
[এখানে ভুল বুঝার অবকাশ আছে,এ জন্য তা থেকে মুক্ত করার মানসে হাদীসের ব্যাখ্যা মেশকাত শরীফ থেকে দেয়া হলো-রাবীর ‘জোফ’ বা দুর্বলতার কারণেই হাদীসটিকে জয়ীফ বলা হয়,অন্যথায় (নাউজুবিল্লাহ) রাসূলের কোন কথা জয়ীফ নয়।জয়ীফ হাদীসের জো’ফ কম ও বেশি হতে পারে।খুব কম হলে তা হাসানে নিকটবর্তী থাকে।আর বেশী হলে তা একেবারে মাওজুতে পরিণত হতে পারে। প্রথম পর্যায়ের জইফ হাদীস আমলের ফজিলত বা আইনের উপকারিতায় ব্যবহার করা যেতে পারে,আইন প্রণয়নে নয়।]
বর্ণনাকারীদের সংখ্যার দিক দিয়ে হাদীসের বিভাগ
হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে সকল ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীদের সংখ্যা এক রকম হয়নি।কখনো কম কখনো বা বেশী হয়েছে।এ জন্য এর ভিত্তিতে শ্রেণী বিভাগ করা হয়েছে।
মুতাওয়াতিরঃ যে হাদীসের সনদের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা এত অধিক যে,তাদের সম্পর্কে মিথ্যা হাদীস রচনার অভিযোগ আনা অসম্ভব বলে মনে হয়। এই ধরনে হাদীসকে ‘হাদীসে মুতাওয়াতির’ বলে। মুসলিম শরীফে বলা হয়েছে-‘যে কোন সহীহ হাদীসকে যুগে যুগে এত অধিক পরিমাণ লোকেরা বর্ণনা করছেন যে,একটি মিথ্যা কথার পক্ষে এত সংখ্যক লোক দলবদ্ধ হওয়াকে মানব বুদ্ধি অসম্ভব মনে করে,আবার সকলে এক অঞ্চলের লোক নন,বিভিন্ন অঞ্চল ও বিভিন্ন গোত্রের লোক। পরস্পরের মধ্যে তেমন যোগাযোগের কোন ব্যবস্থাই কোন কালে হয়নি। আবার রাবীগণের সংখ্যা সকল যুগে একই প্রকার রয়ে গেছে,কোন যুগে কমে এমন দাড়ায়নি যে সংখ্যাগুলি একত্র হওয়াকে মানব বুদ্ধি অসম্ভব ও অস্বাভাবিক মনে করে না। আর তারা যে কথাটি সংবাদ স্বরূপ পৌছে,তা দৃষ্ট ও বাস্তব অনুভূতি পক্ষান্তরে তা কোন ধারণামূলক বস্তু ও সম্ভ াবনামূলক নয়।এমন হাদীসকে ‘খবরে মোতাওয়াতির’ বলে।
খবরে মোতাওয়াতির আবার দু’প্রকার ১.লফজি ও ২.মানবি।
লফজিঃ মোতাওয়াতির লফজি ঐ হাদীসকে বলে যার শব্দগুলিও যুগে যুগে একই প্রকারের রাবীগণ কর্তৃক আবৃত্তি হয়ে আসছে। যেমন রাসূলুল্লাহ(সঃ) এর বাণীটি “সাতারাওনা রাব্বুকুম” অর্থাৎ নিশ্চয়ই তোমরা তোমদের প্রভূকে দেখবে।
মা’নবিঃ মোতাওয়াতির মা’নবি ঐ সমস্ত হাদীসকে বলে।যে হাদিসে কোন একটি ঘটনাকে বহুলোক বিভিন্ন প্রকারে বর্ণনা করেছেন,কিন্তু এ ধরনের বিভিন্নতা সত্ত্বেও সকলকে একটি জায়গায় একমত হতে দেখা যায়।যেমন- কেঁউ বলেছেন,হাতেম তায়ী একশত উট দান করেছেন,কেহ বলেন আশিটি উট দান করেছেন,কেঊ বলেন নব্বই,কেঁউ বলেন সত্তরটি।এই ভাবে বিভিন্ন লোক বিভিন্ন সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। অতএব সংখ্যার দিকে তাকালে এই হাদীসটি খবরে মোতাওয়াতির হতে পারে না কিন্তু একটি কথায় সবাইকে একমত দেখা যাচ্ছে,সেটা হচ্ছে হাতেম তায়ী দানশীল ছিলেন।তাই এ হাদীসকে ‘মোতাওয়াতির মা’নবি’ বলা হয়েছে।
খবরে আহাদ
এ ধরনের হাদিস আবার তিন প্রকার ১.গরীব ২ .আজিজ ৩.মশহুর।
গরীবঃ কোন সহীহ হাদীসের যদি বর্ণনাকারী একজন হন তবে তাকে ‘গরীব’ হাদিস বলে।
আজিজঃ কোন সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারী যদি দু’জন হন বা তার থেকে কম না হন তা’হলে ঐ প্রকার হাদীসকে ‘হাদীসে আজিজ’ বলে।
মশহুরঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারী মাত্র তিনজন হন বা তার থেকে কম না হন তা’হলে ঐ প্রকার হাদীসকে ‘হাদীসে মশহুর” বলে।
এছাড়াও আরো তিন প্রকার হাদীস আছে,যথা- ১.মাওজু ২ .মাতরুক ৩ .মোবহাম
মাওজুঃ যে হাদীসের রাবী জীবনের কোন সময় রাসূলুল্লাহর(সঃ) নামে ইচ্ছে করে কোন মিথ্যা কথা রচনা করেছেন বলে প্রমাণ আছে-তার হাদীসকে ‘হাদীসে মাওজু’ বলে। এধরনের কোন ব্যক্তির হাদীসই কখনো গ্রহণযোগ্য নয়-যদি সে অতঃপর খালেস তওবাও করে।
মাতরুকঃ যে হাদীসের রাবী হাদীসের ব্যাপারে নয় বরং সাধারণ কাজকারবারে মিথ্যা কথা বলে খ্যাত হয়েছেন-তার হাদীসকে হাদীসে মাতরুক বলে। এ ধরনের ব্যক্তির হাদীসও পরিতাজ্য।অবশ্য পরে যদি তিনি সত্যিকার অর্থে তওবা করেন এবং মিথ্যা পরিত্যাগ ও সত্য গ্রহণ করেন তা হলে তার পরবর্তী কালের হাদীস গ্রহণ করা যেতে পারে।
মো’বহামঃ অপরিচিত রাবী অর্থাৎ যার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়নি,যাতে তার দোষগুণ বিচার করা যেতে পারে। – তার হাদীসকে ‘হাদীসে মোবহাম’ বলে।
এধরনের ব্যক্তি সাহাবী না হলে তার হাদীস গ্রহণ করা যাবে না।